
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য কেবল শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পাঠ দেওয়া নয়; বরং জ্ঞানচর্চা করা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিবিড় আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে সেই জ্ঞানের চর্চা হবে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার মধ্য দিয়ে নতুন জ্ঞান বিকাশের পথ তৈরি হবে। এ জন্য শ্রেণিকক্ষের মতো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও মুক্ত পরিসর সমান জরুরি। এই মুক্ত পরিসর কেবল ভৌত অর্থে স্থান নয়; বরং সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক জ্ঞানতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিসর। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একদিকে গবেষণাহীনতার কারণে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারছে না আর অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন মুক্ত পরিসরও ক্রমাগতই সংকুচিত হচ্ছে। বলা ভালো সংকুচিত হতে হতে তা বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত মৌলিক ধারণাকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এসব কারণেই সম্ভবত সাম্প্রতিককালে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মুখেই এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল যে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?’ কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এই প্রশ্নের কারণে তাকে হেনস্তার শিকার হতে হলেও বিদ্বৎসমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক মহলে বিষয়টি নিয়ে কোনো গুরুতর আলোচনা আমরা দেখিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজসংক্রান্ত এই মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা না হলেও বাস্তবতা যে খুবই করুণ, তা দেশ রূপান্তরের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শুক্রবার ‘প্রায় পাঠশালা ৮২ বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের সরকারি-বেসরকারি ১৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৩টি গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় করেনি। আর ৪৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার নামে ১০ লাখ টাকার নিচে লোক দেখানো ব্যয় করেছে। এমনকি একটি শিক্ষাবর্ষে ৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রকাশনাও বের করতে পারেনি। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার এই চিত্র অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় না করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ৬টি সরকারি ও ২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আর ১০ লাখ টাকার নিচে ব্যয় করেছে ৭টি সরকারি ও ৪২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরে কোনো গবেষণা নিবন্ধ বের হয়নি। বেসরকারির ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৪২। তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই গবেষণার খাতায় নাম ওঠাতে লোকদেখানো ব্যয় করেছে। যাতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয় না, এ কথা কেউ বলতে না পারে। এ জন্য তারা ছলচাতুরী করে গবেষণা খাতে ৫০ হাজার, ১ লাখ, ২ লাখ টাকার মতো ব্যয় করে ইউজিসির তালিকায় নাম তুলেছে। এই বাস্তবতা সম্পর্কে শিক্ষাবিদরা যে মন্তব্য করেছেন তা যথার্থই বলতে হবে। তারা বলছেন যে গবেষণাহীন বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠশালা বলাই শ্রেয়। ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা না হওয়াটা দুঃখজনক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম-বেশি গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ হয়। বিজ্ঞান ও কৃষিতে আমাদের ভালো গবেষণা হয়। আর বেসরকারি ১৫ থেকে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো; অর্থাৎ বাকি ৭০ থেকে ৮০টি বিশ্ববিদ্যালয় হলো পাঠশালা। প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করলে আরও দেখা যাচ্ছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তবে টাকার অঙ্কে তা মাত্র ৮ কোটি। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২১ সালে ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় মোট ব্যয় ছিল ৭৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ফলে বাকি অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও গবেষণায় নামমাত্র ব্যয় করেই দায় সেরেছে। অন্যদিকে, গবেষণার দিক দিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ছাড়িয়ে অনেক দূরে গেছে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বোচ্চ ৫৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা গবেষণায় ব্যয় করে সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষে স্থান নিয়েছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া গবেষণায় উল্লেখযোগ্য ব্যয় করেছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি এবং আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
প্রশ্ন হলো, বিপুল ব্যয়ে একের পর এক এমন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত কাজ শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে না কেন? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যদি ইউজিসির গবেষণা বরাদ্দের গড় করা হয়, তাহলে প্রতিটি প্রকল্পের জন্য গড়ে বরাদ্দ মাত্র সাড়ে ১৭ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে গবেষণা হয় না। তাই শিক্ষকরা বরাদ্দ নিলেও বেশির ভাগই প্রকৃত অর্থে কোনো গবেষণা না করে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়ে দায় সারেন। দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দই সবচেয়ে কম। জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ মাত্র ২ শতাংশ। যদিও ইউনেসকোর পরামর্শ, দেশগুলো যেন শিক্ষা খাতে কমপক্ষে জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়। এর ওপর যদি অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয়েই শিক্ষা খাতের বরাদ্দের সিংহ ভাগ চলে যায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণা করবেন কীভাবে? আর গবেষণাহীন বিশ্ববিদ্যালয় দেশকে কী দেবে?
আবার বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। ২০২২ সালের জুনে বেড়েছে গ্যাসের দাম, আগস্টে বেড়েছিল জ্বালানি তেলের দাম, ২১ নভেম্বর বেড়েছিল পাইকারি বিদ্যুতের দাম আর ১২ জানুয়ারি ২০২৩ সালে নববর্ষের উপহার হিসেবে বাড়ল খুচরাপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। এর প্রভাব পড়বে জীবনযাপনের সব ক্ষেত্রে। খরচ বাড়বে উৎপাদনের এবং সাধারণভাবে বাড়বে সব জিনিসের দাম।
বাজারে ডিমের হালি ৫০ পয়সা, চাল ২ টাকা সের, ১টা ইলিশ মাছ ৭/৮ টাকা, গরুর মাংস সের ২০/২৫ টাকা, এ কথা বললে চোখ কপালে উঠবে না কি! অবাক হওয়ার মতো অবিশ্বাস্য দাম! বেশি দিন আগে নয়-ছয় দশক আগে এসব পণ্যের দাম এমনই ছিল, এখন এসব পণ্যের দাম কত? এখন ৪০ টাকায় এক হালি ডিম, ১ কেজি চাল ৫০ থেকে ৯০ টাকা, ১টা ইলিশ (মাঝারি) ১ হাজার টাকা আর ৬০০ টাকা কেজিতে কিনতে হয় গরুর মাংস। কিন্তু যে পরিমাণে পণ্যমূল্য বেড়েছে সে অনুপাতে কি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আয় বেড়েছে?
টাকা ক্রমাগত মূল্যহীন হচ্ছে পণ্যের কাছে। কোথায় গিয়ে ঠেকেছে টাকার মূল্যমান যে ঢাকায় রিকশার সর্বনিম্ন ভাড়াও এখন আর ২০ টাকা নিতে রাজি হয় না রিকশাওয়ালারা। ভিক্ষুককে ১/২ টাকা দেওয়া যায় না। আর অভ্যন্তরীণ মুদ্রাবাজারে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে পয়সা। ক্রমাগত জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে পয়সা হারিয়ে গেছে প্রায় মুদ্রাবাজার থেকে। অথচ স্বাধীনতার পরেও বহুদিন পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা ও পঞ্চাশ পয়সা ইত্যাদি বিভিন্ন মানের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। কিন্তু কালক্রমে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এগুলোর ব্যবহার ক্রমেই কমতে থাকে। মূলত নব্বই দশকের গোড়া থেকেই পয়সার ব্যবহার কমতে থাকে। আর তার পরিবর্তে এক টাকা সমমানের মুদ্রা বাজারে ছাড়া হয়। বর্তমানে এক টাকা, দুই টাকা ও পাঁচ টাকার সমমানের মুদ্রা বাজারে চালু রয়েছে।
টাকার দাম কমছেই না শুধু এশিয়াতে অনেকের চেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স বাংলাদেশের টাকার। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট ও ক্রেডিট ডেফিসিটের জন্যই টাকার দামের এই রেকর্ড পতন। টাকার মূল্য আসলে কী? একই সাইজের কাগজের টুকরার কোনো মূল্য নেই কিন্তু টাকার আছে। সেক্রেটারি অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেকোনো মূল্যমানের টাকায় স্বাক্ষর করে সত্যায়িত করলেই টাকার মূল্য হয়ে যায়। ফলে টাকা হলো এক প্রকার অঙ্গীকারনামা। গভর্নর সাহেব টাকার গায়ে যে অঙ্ক লিখে দেবেন এবং বাহককে দেওয়ার অঙ্গীকার করবেন সেটাই টাকার মূল্য হিসেবে বিবেচিত হবে। নইলে এক টুকরা কাগজের আর কিইবা মূল্য। টাকার এ মূল্য যে দিন দিন নিচে নামছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন দেশের মানুষ।
দ্রব্যমূল্য লাগামহীন এবং দুবছর ধরে বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণহীন। অজুহাত হিসেবে কভিড আর রাশিয়ার যুদ্ধের কথা বলা হয়, তবে এর ফলে যতটা বাড়ার কথা তার চেয়ে অনেক বাড়িয়েছে সিন্ডিকেট। মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়ার ফলে মধ্যবিত্তের যেমন নাভিশ্বাস উঠেছে, গরিব মানুষের কষ্ট বেড়েছে তার চেয়েও বেশি। কারণ, শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি গরিব মানুষ বাস করেন আর গরিব মানুষকে খাবারের পেছনে তাদের আয়ের বেশির ভাগই ব্যয় করতে হয়, ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে তাদেরই বেশি ক্ষতি এবং এতে তাদের কষ্ট অনেক বেড়ে যায়। টাকার দাম প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে আর বিপরীতে পণ্যের দাম বছর বছর বেড়েই চলেছে। কিছুদিন আগেও একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে গেলে যতটা চাল-ডাল-তেল-মসলা, ফলমূল, মাছ-মাংস কেনা যেত, এখন তার থেকে কম পরিমাণে কেনা যাচ্ছে। এক বছরের পণ্যের দামের সঙ্গে পরের বছরের দাম মিলছে না। বাড়ছে সীমাহীন গতিতে।
টাকার দাম পড়ে যাওয়ার আর একটা মানে হলো, টাকার তুলনায় আমেরিকান ডলারের দাম বাড়ছে। অর্থাৎ, প্রতিটি ডলার কিনতে বছর ঘুরলেই বেশি টাকা লাগছে। তাই আমদানিপণ্যের মূল্য বাড়ছে। এক বছরের চিত্রটা দেখলেই বোঝা যাবে বছর বছর কীভাবে দাম বাড়ছে। এপ্রিল মাসে দেশে খুচরো পণ্যের বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৭৯ শতাংশ। তার মানে, ২০২১ সালের এপ্রিলে খুচরো বাজারে জিনিসপত্রের দাম যা ছিল, তার তুলনায় ২০২২-এর এপ্রিলে জিনিসপত্রের দাম ৭.৭৯ শতাংশ বেড়েছে। তুলনার জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০২২-এর মার্চ মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৯৫ শতাংশ, আর ২০২১-এর এপ্রিল মাসে ৪.২৩ শতাংশ। জরিপে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে বেশি হারে। ২০২২-এর এপ্রিলে শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.০৯ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে ছিল ৮.৩৮ শতাংশ। অবাক ব্যাপার হলো, পাহাড়ি এলাকায় মূল্যবৃদ্ধির হার আরও বেশি।
আবার সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার অনেক বেশিগ্রামে ৮.৫ শতাংশ আর শহরে ৮.০৯ শতাংশ। অর্থাৎ, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিই মূলত খুচরো বাজারে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হারটাকে ঠেলে তুলে দিচ্ছে। বছর বছর পণ্যের দাম যেমন বাড়ছে, তেমনি একবার কোনো কিছুর দাম বাড়লে আর তা কমে না। চাল, ডাল, আটা, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যেরই দাম বেড়েই চলেছে আর টাকার মূল্য যাচ্ছে কমে।
আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে নিজেদের অযোগ্যতা, দায়িত্ব অবহেলা এবং দুর্নীতিকে আড়াল করার চেষ্টা করে থাকে ক্ষমতাসীনরা। বিশ্ববাজারের প্রভাবটি অমূলক নয়। তবে দায় স্বীকারের উদাহরণ দেওয়া হয় না। যেমন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্রিটেনে তিন মাসের মধ্যে তিনজন প্রধানমন্ত্রীর পেয়েছে তারা। প্রথমে বরিস জনসন পদত্যাগ করলেন; ৪৫ দিন ক্ষমতায় থাকার পর লিজ ট্রাস আত্মসম্মান রক্ষার্থে পদত্যাগ করলেন। এরপর এ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন ঋষি সুনাক। কিন্তু আমাদের দেশে দায়গ্রহণ ও পদত্যাগের এ রকম কোনো নজির নেই। মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনরা তাদের সাফল্যের বর্ণনা দেন, আর জনগণ অমøান বদনে শুনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।
তাই তো দীর্ঘ ৫০ বছরেও নানা সূচকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হলেও বণ্টনজনিত বৈষম্যের কারণে দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি ছাড়া জনগণ খুব বেশি কিছু পায়নি। উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করেছে এবং করছে একটি ক্ষুদ্র শ্রেণি। মাত্র দুজন কোটিপতি দিয়ে যাত্রা শুরু করা স্বাধীন বাংলাদেশে এখন কোটিপতির সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, বৃদ্ধি পেয়েছে পুঁজির কেন্দ্রিকতা আর আয়-বৈষম্য। এর ফলে ২০২২ সালেও মূল্যস্ফীতির প্রচণ্ড চাপের মধ্যে অতিবাহিত করেছে বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে অসহনীয়ভাবে। দুটি কারণে এমনটি হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাজার তদারকির ব্যর্থতা। ফলে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণহীনভাবে দাম বাড়িয়েছে। অন্য কারণটি হলো টাকার অবমূল্যায়ন। তাই বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি আক্রমণ করেছে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমতে শুরু করেছে, জ্বালানি তেলের দামও নিম্নমুখী। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক দিকটিও গেল বছরের মতো প্রতিফলিত হবে না। তবুও দাম কমবে বলে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু দেখা যাচ্ছে না।
কৃষির সাফল্য নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও কৃষির ভালো অবস্থা কিংবা ভালো ফলন মানেই কৃষি মজুরের ভালো অবস্থা নয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এবং ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইরি) যৌথ এক গবেষণা প্রতিবেদনে কৃষি মজুরদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে। তারা ক্রয়ক্ষমতা পরিমাপক হিসেবে চাল ক্রয়ের সক্ষমতাকে বিবেচনা করেছেন। তাদের ২০১৯ সালের পর থেকে গত চার বছরে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কৃষিশ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা ৩৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমে গেছে। ২০১৫ সাল থেকে কৃষি মজুরের ক্রয়ক্ষমতা বাড়তে থাকে এবং ২০১৯ সালে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর থেকে ক্রয়ক্ষমতা কমতে কমতে বর্তমানে ২০১৫ সালেরও নিচে নেমে গেছে। ২০১৫ সালে একজন শ্রমিক তার দৈনিক শ্রমলব্ধ মজুরি দিয়ে ১০ দশমিক ১ কেজি চাল কিনতে পারতেন। ২০১৬ সালে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং দৈনিক মজুরি দিয়ে তা ১০ দশমিক ৬ কেজিতে উন্নীত হয়। এভাবেই ২০১৯ সালে তা সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৪ কেজিতে দাঁড়ায়। এর পরের বছর থেকেই কমতে থাকে কৃষিশ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা। ২০২০ সালে একজন কৃষিশ্রমিক দৈনিক মজুরি দিয়ে চাল কিনতে পারতেন ৯ দশমিক ১ কেজি; ২০২১ সালে তা নেমে আসে ৮ দশমিক ৬ কেজিতে আর ২০২২ সালে তা ৮ দশমিক ৫ কেজিতে নেমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে খানাপ্রতি বার্ষিক ব্যয়ের প্রায় ৩৪ শতাংশ যায় খাদ্যের পেছনে। এ খাদ্যব্যয়ের ৪১ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় চাল কেনা বাবদ। গত তিন বছরে দেশে চালের দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ, যা গোটা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। তাই চালের মূল্যবৃদ্ধি নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে কমিয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ নিয়েই ২০২২ সাল শেষ হয়েছে। গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ১ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ কমে গেছে। গত এক দশকে এটাই ছিল অর্থনীতির ওপর সবচেয়ে বড় চাপ। সেই আশঙ্কা এখনো কাটাতে পারছি না আমরা। যদিও অর্থমন্ত্রী আশ্বস্ত করে বলেছেন, রিজার্ভ এখন ৩৪ বিলিয়ন ডলার। উন্নয়ন সহযোগীদের হিসাব মতে, কমপক্ষে তিন মাসের আমদানিব্যয় মেটানোর রিজার্ভ থাকতে হয়। এ কথায় আশ্বস্ত হতে পারলে ভালো লাগত, কিন্তু তা হওয়া কঠিন। রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব উল্লিখিত অঙ্কের চেয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কম হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। রিজার্ভের পরিমাণ তো এক বছর আগেও ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩ হাজার ২৫৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানি করা হয়েছে ২ হাজার ৭৪ কোটি ডলার। এর অর্থ হলো, ১ হাজার ১৭৯ কোটি বা ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে জনজীবনে প্রকটভাবে। এর সঙ্গে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলবে।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
‘সদা সত্য কথা বলবে’, ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’এমন কিছু ভালো ভালো কথা বাসার খাতায় লিখে আমাদের হাতের লেখা ঠিক করতে হতো সেই ছোটবেলায়। এর ফলে যেমন হাতের লেখা ভালো হয়েছে, তেমন আমাদের সতর্ক করা হয়েছে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। ভালো বন্ধু একজন ব্যক্তির জীবনে ভালো প্রভাব ফেলে। এই কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, সবকিছুই যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বাবা-মা সারা দিন তাদের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। সেজন্য সন্তানদের সময় দেওয়া তাদের পক্ষে অনেকটাই অসম্ভব। সমাজের নানান কারণে কিশোর-কিশোরীরা আজ হতাশায় নিমজ্জিত। ফলে সেই হতাশা থেকেই তারা নানান নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আজ একে অন্যের সঙ্গে খুব দ্রুত মিশে যেতে পারছে, দ্রুত আদান-প্রদান হচ্ছে তথ্য। ফলে নষ্ট হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। বাবা-মা চাইলেও তাদের পাহারা দিয়ে রাখতে পারছেন না। অনেক পরিবার চাইলেও সারাক্ষণ সন্তানের সঙ্গে লেগে থাকতেও পারছেন না। আবার লেগে থাকলেও দেখা যাচ্ছে যে সন্তানরা নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। একা একা তারা কোনো কাজ করতে পারে না বা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্বের মানুষ এখন কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে চিন্তিত।
কে কখন কবে কার সঙ্গে মিশে নষ্ট হবে সেই চিন্তা সব বাবা-মার। বাবা-মা ভাবেন কিশোর-কিশোরীদের যদি একটা ভিত্তির ওপরে দাঁড় করানো যায়, তাহলেই তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সুযোগ আসে এবং জীবন সঠিক পথে চলতে পারে। জীবনে চলার পথে কখনো কখনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর জন্য একটি উপদেশ বার্তা সমাজে প্রচলিত যে, ‘নিজেকে মূল্যায়ন করো, সুন্দর বাছাইগুলো সম্পন্ন করো।’ এসব পছন্দের মধ্যে জীবনের অনেক দিক অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত হবেজাগতিক, আধ্যাত্মিক, আবেগবিষয়ক, সামাজিক, সততাবিষয়ক ইত্যাদি। জীবনের কঠিন পরিস্থিতিগুলোর জন্য অনেক সময় শিশু-কিশোরদের দায়ী করা হয়। কিন্তু কেন তারা এ অবস্থায় পড়েছে, সেটি আমরা চিন্তাভাবনা করি না।
আমরা যারা নিজেদের সামাজিক অবস্থানকে অপব্যবহার করি এবং ভুল আচরণ করি, তারা শুধু শিশুদের চেতনাই নষ্ট করি না, বরং শিশু-কিশোর-তরুণদের সামনে মূল্যবোধের নেতিবাচক আদর্শ গঠন কখন করি নিজেরাই টের পাই না। এর ফলে তাদের গোটা জীবনটাই ভুল মূল্যবোধ ও নেতিবাচক পথে চালিত হওয়ার আশঙ্কা এবং সুযোগ তৈরি হয়। আমাদের আশপাশে এমন অনেক ছেলেমেয়েকে দেখি, যারা বেঁচে থাকার জন্য এবং জীবিকার জন্য বছরের পর বছর ধরে ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তা ও দেশের অন্যান্য স্থানে বাস করছে। তাদের ঘরে এবং বাইরে অর্থাৎ সামাজিকভাবে নানা রকম নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়। এরা রাস্তায় গিয়ে নেশাদ্রব্য কিনে মাদক সেবন শুরু করে এক ধরনের হতাশা থেকে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ শিশুদের জীবনের মৌলিক ভিত্তি গড়তে শুধু তাদের শিক্ষার বন্দোবস্ত করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন, কিন্তু তাদের সঠিক আচার-আচরণ ও অহিংস প্রতিক্রিয়া ও ক্রিয়া শেখাচ্ছেন না। এই শিশু-কিশোররা কখনো কখনো প্রান্তিক শিশু হয়ে রাস্তায় বসবাস করে বেঁচে থাকে। দেশে শিশু সুরক্ষা আইন রয়েছে, কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ আছে কি?
এ কথা ধ্রুব সত্য যে, ‘যেখানে যন্ত্রণা নেই, সেখানে অর্জনও নেই’। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে মাদক কখনো কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। মাদক সেবন করে সমস্যার সমাধান করতে গেলে সেই সমস্যা শুধু আরও জটিল, কঠিন ও বিধ্বংসী রূপ নেয়। কোনো সমস্যা মোকাবিলার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে মা-বাবা, কোনো শিক্ষক বা নির্ভরযোগ্য অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সেটি নিয়ে আলোচনা করা, যার সামর্থ্য রয়েছে সমস্যাটি সমাধানে প্রয়োজনীয় সাহায্য করার।
সুন্দর জীবনের পথে অত্যন্ত মূল্যবান সোপান হিসেবে আরেকটি সেøাগান রয়েছে : ‘অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ করো’। শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠার অংশ হিসেবে তাদের সঙ্গে সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবের যোগাযোগ ঘরে-বাইরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। পরিবারকে শিশু-কিশোরদের সতর্ক হতে সহায়তা করতে হবে, তা না হলে তারা কখনো কখনো এমন কারও দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, যাকে ভালো বন্ধু বলে মনে হলেও আসলে সে একটি ‘অসৎ সঙ্গ’। একজন সত্যিকারের বন্ধু অন্যকে সৎ সহায়তা ও ভাবনাবিনিময়ের মাধ্যমে বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আমাদের সজাগ থাকতে হবে নিজেদের আচার-আচরণ, ভাষা, প্রতিক্রিয়া ও বন্ধুদের সম্পর্কে। এ ছাড়া যেসব স্থানে আমরা যাতায়াত করি, তার ব্যাপারে সত্যিকারের ‘উপকারী বন্ধুর’ বক্তব্যও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আমার জীবনে মা-বাবা ছাড়া তিন-চারজন সত্যিকারের উপকারী বন্ধু ও শিক্ষক রয়েছেন, যাদের কাছ থেকে আমি শিখেছি অনেক মূল্যবোধ ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে। আমি এখনো তাদের স্মরণ করি এবং সবচেয়ে মূল্যবান ‘উপকারী বন্ধু’ বলে মনে করি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব বন্ধু বা উপদেশদাতার সংখ্যা অনেক কমেছে। তরুণ বয়সে অনেকেই খুব আদর্শবাদী এবং অপরের জন্যও কিছু করতে কঠোর মনোবল নিয়ে কাজ করতে চায়। কখনো কখনো তাদের কেউ বড় হয়। তখন তারা অন্যকে সহায়তার মতো তরুণ বয়সের বিভিন্ন আদর্শ ভুলে যেতে শুরু করে এবং স্বার্থকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে। তারা অভাবগ্রস্ত মানুষের সহায়তার পরিবর্তে খ্যাতি ও নামের মোহে আটকা পড়ে। আমি তরুণদের আদর্শবাদী লক্ষ্যে অবিচল থাকতে উৎসাহ জোগাতে চাই।
যেসব মূল্যবোধ ও নীতি কেউ তরুণ বয়সে গ্রহণ করতে পারে এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে চর্চা শুরু করে, সেগুলো তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি হয়ে যায় এবং সেই জীবনের সহযোগিতা নিয়ে তাদের পরিবার, সম্প্রদায়, দেশ এবং অন্যরা সমৃদ্ধ হয়। আমি শেষ করছি এ কথা দিয়ে : ‘যদি প্রথমেই সাফল্য না পাও, চেষ্টা করো, চেষ্টা করো এবং চেষ্টা করো বারবার এবং আগে হোক, পরে হোক, সফল তুমি হবেই।’
লেখক : ব্যাংকার ও গবেষক
যেকোনো জাতির গতিপ্রবাহের সব বাঁক নির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকরা। স্রোতোধারা তথা আমজনতা জানেই না সামনের বাঁকটির পর কী অপেক্ষা করছে। জীবন-নদীর মানচিত্র তৈরি হয় নীতিনির্ধারক দ্বারা। তাই সমাজের চরম অবক্ষয়ের দায় তাদের ওপরই বর্তায়। এই ক্রান্তিলগ্নে করোনার হিংস্র থাবা আর ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব মানচিত্র আজ রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত। বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতির চাকা থমকে আছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও বিশ্ব রাজনীতির খেলা থেমে নেই। চীনের উত্থানের কারণে সমগ্র এশিয়া মহাদেশে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বব্যাপী অনেক দেশের অর্থনৈতিক সফলতার মিথগুলোও উলঙ্গ হয়ে পড়ছিল। সে তালিকায় আছে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশও। নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এত দিন এসব দেশকে টাইগার হিসেবে দেখাচ্ছিল। অথচ এখন আইএমএফের কাছে তাদের হাঁটুমুড়ে প্রার্থনায় বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা ছাড়াও অন্তত আরও দুটি দেশ বিদেশি দেনার ফাঁদে আছে এ অঞ্চলে। এসব দেশের নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করে যাচ্ছেন ক্রমাগত।
কিন্তু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে এসব দেশের বাজার সিন্ডিকেটগুলো নতুন উদ্যমে সাধারণদের পকেট কেটে যাচ্ছে। ঠিক এ কারণেই আঙ্কটাডের হিসাবে এ বছর বিশ্ববাজার প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করলেও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির গতি বিপজ্জনকভাবে নিম্নমুখী। গত ১০ মাসে ইউক্রেন যুদ্ধে ৪২ হাজার ৩০০ মানুষ মারা গেছেন, নিখোঁজ আরও ১৫ হাজার। যুদ্ধই ছিল গত বছরের বড় খবর। ইউরোপবাসীকে নানা ধরনের জ্বালানি সংকটে নাস্তানাবুদ করেছে যুদ্ধ। ৭০ লাখ শরণার্থীও গ্রহণ করতে হয়েছে তাদের। বিশ্বের প্রতিটি রান্নাঘরকে এ যুদ্ধ বিপদে ফেলেছে। এ লড়াই বিশ্বের অন্যতম বড় সামরিক শক্তি রাশিয়াকে লজ্জায়ও ফেলেছে। ইউক্রেনের প্রচুর ক্ষতি করতে পারলেও দেশটিকে পদানত করতে সফল হয়নি তারা।
অন্যদিকে, এই দুর্যোগের ভেতর ইউরোপ-আমেরিকা-চীনের সামরিক শিল্পে দারুণ প্রবৃদ্ধিও ঘটে যায়। যুদ্ধাস্ত্রের বৈশ্বিক বাজারের আকার আগের বছরে ছিল ৪৭৫ বিলিয়ন। ২০২২-এ হলো ৫১৪ বিলিয়ন। বৃদ্ধি প্রায় ৮ ভাগ। সরবরাহ ব্যবস্থায় নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেই তাদের এই প্রবৃদ্ধি চলছে। অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের অগ্রযাত্রা থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাধা-নিষেধ কিছুটা কাজ করলেও পশ্চিমের অবরোধে রাশিয়া প্রত্যাশামতো বিপদে পড়েনি এ বছর। বরং ওয়াশিংটনের চাপ মস্কো-পেইচিংকে কাছাকাছি এনেছে। বহুকাল অর্থনৈতিক গোলকায়নের শোরগোল দেখেছে বিশ্ব। এখন শেষমেশ অর্থনৈতিক-জাতীয়তাবাদ মদদ পাচ্ছে বড় শক্তিদের কাছে। কিছু দেশ চেষ্টা করছে ডলারভিত্তিক লেনদেনের পরাধীন দুনিয়া থেকে মুক্ত হতে। কিন্তু প্রায় সব অর্থনীতিবিদের অনুমান, আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতি খারাপ হবে। একের পর এক অর্থনৈতিক দুঃসংবাদের পাশাপাশি অবিশ্বাস্য গতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ঠা-া যুদ্ধের রণধ্বনিও বাড়ছিল এ বছর। তাইওয়ানকে ঘিরে ওয়াশিংটন ও পেইচিং নিয়মিত বাগ্বিতণ্ডায় লিপ্ত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের শাসকরা অতীতের অস্পষ্টতা এড়িয়ে এ বছর খোলাখুলিভাবে তাইওয়ানের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। চীন তার উত্তর দিয়েছে নিয়মিত তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের জন্য যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে। তৃতীয় মেয়াদে দল ও সরকারপ্রধান হয়ে চীনের নেতা সি চিন পিংয়ের সামনে তাইওয়ানকে আয়ত্তে আনাই যেন প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। একই সময় যুক্তরাষ্ট্রের চীননীতিও আমূল বদলে গেছে। এ বছরে ভূরাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এটা। সেই সূত্রে আন্তর্জাতিক উত্তেজনার যাবতীয় উপাদান ক্রমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জড়ো হচ্ছে। তার আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের গায়েও। শক্তিধর দেশগুলোর ঢাকায় অবস্থিত দূতাবাসের প্রচার-প্রচারণাতেও ঠা-া যুদ্ধের উত্তপ্ত আলামত দেখা যাচ্ছিল বছর শেষে। ইউক্রেন ও ইরানের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার ঘটনাবলিও এ বছর বিশ্ব মনোযোগ পেয়েছে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে নিয়মিত।
যুদ্ধের পরিস্থিতি তো সর্বত্রই বিদ্যমান। বাণিজ্যযুদ্ধ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বেধেছে আমেরিকা ও তার মিত্রদেশগুলোর। ভুক্তভোগী হচ্ছে ইউক্রেনের মানুষ। শুধু ইউক্রেনের কেন, বিশ্বের সব মানুষই নিদারুণ কষ্টে পড়েছে। জ্বালানি সংকট, খাদ্য উৎপাদন হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি, মাদক, পর্নোগ্রাফিসবকিছু আঘাত করছে মানুষকে। লাভ হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আর অত্যাশ্চর্য সব রাজনৈতিক ঘটনা তো ঘটেই চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালিতে মুসোলিনিপন্থিরা আবার রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তগত করবেএটা এর আগে কি ভাবা গেছে? টালমাটাল ঘটনা ঘটেছে গ্রেট ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসেও। তিন মাসে সেখানে তিনজন প্রধানমন্ত্রী দৃশ্যমান হয়েছেন। বরিস জনসন বিদায় নেন নানা অভিযোগের বোঝা মাথায় নিয়ে। এলেন এক নারী; বয়স তার অল্পই, কিন্তু টিকলেন মাত্র ৪৫ দিন। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করার ব্যর্থতার মুখে বিদায় হলেন আত্মসম্মান রক্ষা করে। এবার তার চেয়েও কম বয়সের এমন একজন এসেছেন, জাতি দাম্ভিক ইংরেজদের রাষ্ট্রশাসনের ইতিহাসে যার প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা এত দিন পর্যন্ত ছিল একেবারেই অকল্পনীয়। কিন্তু তাই বলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, এমনটা কোনো ইংরেজ কবে ভেবেছিল? তবে এটাই তো বাস্তবতা, নইলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন কেন? আর তিনি যে অযোগ্য, তাও নিশ্চয়ই নয়। অযোগ্য হলে তাকে বেছে নেওয়া কেন? অবশ্যই যোগ্য। বয়স যার মাত্র ৪২। কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি। এদিকে ব্রিটিশ লেবার পার্টিতে বামপন্থি যারা ছিলেন, তারা এখন ঠেলাধাক্কার মধ্যে রয়েছেন। বছরের শেষ প্রান্তে ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সেই নেতানিয়াহু, যার বিরুদ্ধে দেশের আদালতে দুর্নীতির মামলা এখনো চলমান। নিজে তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণেই দক্ষিণপন্থি।
সুইডেন তো এতকাল তার উদারনীতির জন্যই বিশ্বখ্যাত ছিল। কিন্তু সেখানেও দক্ষিণপন্থিরা ক্ষমতায় বসে গেছে। ঘটনা একই। পুঁজির হাতে মেহনতিদের লাঞ্ছনা; মুনাফালিপ্সার কাছে মনুষ্যত্বের পরাজয়। সর্বত্র ওই একই ব্যাপার। বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের যে উন্নয়ন ঘটেছে, তাতে মেহনতিদের দশা তো হয়েছে তেলাপোকার মতোই।
বিশ্বে শীর্ষ ধনীদের একজন হচ্ছেন ইলন মাস্ক। তিনি টুইটার প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেন। নিয়েই ঠিক করেন প্রতিষ্ঠানের আরও উন্নতি ঘটাবেন। তার জন্য প্রথম চোটেই অর্ধেক কর্মচারীকে ছাঁটাইয়ের নোটিস দিয়ে দেন। অন্যদের বলেন, কর্মঘণ্টা বাড়াতে হবে। সবকিছুই অবশ্য উন্নয়নের স্বার্থে। আর উন্নয়নের অর্থ হচ্ছে মালিকের মুনাফার স্বার্থ নিশ্চিত করা। অর্থনৈতিক সংকটে সহিংসতা বাড়ছে।
বাংলাদেশেও মানুষের ওই একই দশা। মেহনতিরা শ্রম করে, সুবিধাভোগীরা শ্রমের ফসল হাতিয়ে নেয়, কিছুটা ভোগবিলাসে খরচ করে বাকিটা পাচার করে দেয়। আরব মূল্যবোধ সঙ্গে নিয়েই কাতার, আরব আমিরাত ও সৌদি আরব বিশ্ব পরিসরে বড় ভূমিকা নিতে চাইছে। সামাজিক এ রূপান্তরকে এগিয়ে নিতে কাতারকে ২২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হলো। বিশ্বকাপের পাশাপাশি বিগত বছরের বড় প্রাপ্তি ছিল মহামারীর হয়রানি থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত হওয়ার সুযোগ। যদিও কভিড-১৯ একেবারে বিলীন হয়নি, কিন্তু বিধিনিষেধ অনেকটাই এখন স্মৃতি। মৃত্যুর নিয়তি নয়, মানুষ আবার বিশ্বসংসারের লাগাম নিতে পারল। তবে এর মধ্যে শ্রেণিযুদ্ধটাও বহাল তবিয়তে আছে। ব্রাজিলে বামপন্থি লুলা দ্য সিলভার ফিরে আসা মোকাবিলা হলো একই অক্টোবরে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক কর্র্তৃক ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে টুইটার কিনে নিয়ে। মাঠের লড়াই বনাম বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের চলমান এসব সংঘাত বিশ্বজুড়ে আরও নানা চেহারায় হাজির ছিল ২০২২ সালে। রাশিয়ার লৌহমানব পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে আছেন। সমাজতান্ত্রিক চেহারার এ দেশে কার্যত অন্য দলের সক্রিয়তার খবর খুব একটা পাওয়া যায় না।
বিশ্বের সামগ্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের মূলে কাজ করছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। সম্প্রতি প্রকাশিত অক্সফামের রিপোর্টে দেখা গেছে বিশ্বের ৮২ ভাগ সম্পদের মালিক ধনিক শ্রেণিভুক্ত মাত্র একভাগ মানুষ। আর এই ধনকুবেরদের ঠিকুজি খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, বিশ্বের বেশিরভাগ সম্পদ গুটিকয়েক পরিবারের হাতে। পুঁজিবাদের অনিয়ন্ত্রিত ও বল্গাহীন বিকাশের কারণে একই প্রকার সামাজিক ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার আওতায় থেকেও মানুষে মানুষে ব্যাপক পার্থক্য এবং বঞ্চনাবোধের মনোজাগতিক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যে নতুন মানবিক সত্তার জন্ম হয়েছিল সে সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা না থাকলে অর্থনৈতিক সংকট ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ অসম্ভব হবে।
বিশ্বরাজনীতিতে আজ দেখা দিয়েছে এক নতুন মেরুকরণের। বিশ্বায়ন-অনুসৃত এ পরিবর্তন অবশ্য একমাত্র পরিবর্তন নয়, পাশাপাশি চোখে পড়ে তার আরও এক রূপ, সেটি হলো নিরাপত্তাহীনতা। আবেগকেন্দ্রিক বিশ্লেষণের রেওয়াজ যে একেবারে আকস্মিক, তা কিন্তু নয়। অতীতে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতির বিশ্লেষণে অনেকেই আবেগের প্রভাবে সম্মোহিত হয়েছেন। আবেগের তীব্র অনুভূতির সামাজিক ও শৈল্পিক মূল্য সম্পর্কে উল্লেখ আছে প্লেটো থেকে হবস ও কান্ট থেকে হেগেলের ভাববাদী দর্শনে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লব এবং প্রজ্ঞার বিজয় দিয়ে যে আধুনিক সমাজের জন্ম হয়, এর অতিমাত্রিকতায় ক্লান্ত হয়ে অনেক কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিক আবেগভিত্তিক নতুন আন্দোলন গড়ে তোলেন প্রজ্ঞার রাহু থেকে মুক্তির আশায়।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দীন। তিনি ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট সীমান্তবর্তী ফেনী জেলার অন্তর্গত সোনাগাজী উপজেলার সেনেরখিল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৬ সালে তিনি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে যোগদান এবং ওই বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের বিচিত্র শ্রমজীবী, পেশাজীবী, বাঙালি ও বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সমাজজীবন ও তাদের আবহমানকালের সংস্কৃতিকে তিনি তার নাটকে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিদান করেছেন। জীবদ্দশায় তিনি একজন নাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও সমকালীন বিশ্বের শিল্পধারায় নতুন নন-জেনরিক শিল্পধারার প্রবর্তনে সচেষ্ট ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গঠন করেন ঢাকা থিয়েটার ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। তার রচিত হরগজ নাটকটি সুইডিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল কর্র্তৃক হিন্দি ভাষায় মঞ্চস্থ হয়েছে। সেলিম আল দীনের নাটক ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। তার উল্লেখযোগ্য নাটক ও নাট্যগ্রন্থসর্পবিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, বাসন, তিনটি মঞ্চ নাটক : মুনতাসির, শকুন্তলা ও কিত্তনখোলা; কেরামতমঙ্গল, প্রাচ্য ইত্যাদি।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
কুড়িগ্রাম সদরের বেলগাছা ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে সিমিত চন্দ্র (১২) নামের এক স্কুলছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বুধবার (৭ জুন) ভোরে ওই ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বেলগাছা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত এক কিশোরকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া সিমিত চন্দ্র বেলগাছা গ্রামের মানিক চন্দ্র ড্রাইভারের ছেলে। অভিযুক্ত কিশোর (১৬) একই গ্রামের প্রদীপ চন্দ্রের (দর্জি) ছেলে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম আর সাঈদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের গীতা সংঘ অনুষ্ঠান দেখতে যায় সিমিত ও তার বড় ভাই। সিমিতকে অনুষ্ঠানস্থলে রেখে বাড়িতে ফেরে তার বড় ভাই। পরে অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে সিমিতের সঙ্গে অভিযুক্ত কিশোরের কথা কাটাকাটি হয়। এ ঘটনায় সিমিতকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ওই কিশোর। পরে তাদের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের গর্তে সিমিতের মরদেহ পুতে রাখে। অনুষ্ঠান শেষে সিমিত বাড়িতে না ফিরলে স্বজনরা তার খোঁজে বের হয়। অভিযুক্ত কিশোরকে সিমিতের বিষয়ে জিজ্ঞাস করলে সে অসংলগ্ন আচরণ করে। পরে তার বাবা প্রদীপ চন্দ্র তাদের পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের একটি গর্তে সিমিতের মরদেহ দেখিয়ে দেন। বুধবার ভোরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে।
আটক কিশোরের স্বীকারোক্তিতে সদর থানার ওসি এম আর সাঈদ বলেন, অভিযুক্ত কিশোরের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। এ নিয়ে সিমিতসহ অনেকেই ওই কিশোরকে খোঁচা দিত। গত রাতে সিমিত ওই কিশোরের সাথে এ নিয়ে আবারও খোঁচা দিলে সে সিমিতের গলা চেপে ধরে। এত শ্বাসরোধ হয়ে শিশুটি মারা যায়।
তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত কিশোর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনা স্বীকার করেছে। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।