
বিসিএস পরীক্ষার পদ্ধতিতে কোটা তুলে দিয়ে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিঃসন্দেহে বড় ধরনের সংস্কার। অন্যদিকে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পিএসসির প্রতি মেধাবীরা আস্থা হারিয়েছিলেন। গত কয়েক বছর ধরে সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে পিএসসি। বিসিএসের প্রশ্নপত্র দৃশ্যত ফাঁস হয় না, প্রশ্নপত্র নিয়েও কোনো বড় অভিযোগ নেই। কিন্তু জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক অদৃশ্য কোটার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এক ধরনের ‘পারসেপশান’ ও জেলার নাম একরকম ‘ইজম’ তৈরি করে, যা কোনো প্রার্থীকে বাড়তি সুবিধা দিতে সুযোগ তৈরি করে। অবশেষে সেটা বন্ধের পদক্ষেপ নিয়েছে পিএসসি। সোমবার দেশ রূপান্তরে ‘জানতে চাওয়া হবে না আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) মৌখিক পরীক্ষার পরীক্ষকরা (ভাইভা বোর্ড) চাকরিপ্রার্থীর কাছে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জানতে চাইতে পারবেন না। এমনকি জেলার নামও না। বোর্ডের সদস্যদের বিশ্ববিদ্যালয়প্রীতি বা জেলাপ্রীতি বন্ধ করার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসসি।
দেখা গেছে, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের বা জেলার প্রার্থী পেলে অনেক পরীক্ষক পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন; যা প্রার্থীর জন্য সুবিধাজনক ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। পিএসসির চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে জানান, ‘কমিশন পুরো পরীক্ষা পদ্ধতিতেই সংস্কার আনার কথা। লিখিত, মৌখিক বা প্রিলিমিনারিতেও সংস্কার আসছে। এ বিষয়ে এক সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। আরও কিছু বিষয়ের মতো মৌখিক পরীক্ষায় চাকরিপ্রার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, এমনকি জেলার নামও জানতে চাওয়া যাবে না। পরীক্ষকরা চাকরিপ্রার্থীর রোল নম্বর ছাড়া কিছুই জানতে চাইবেন না।’ অন্যদিকে, প্রার্থীকে ভালোভাবে যাচাই করার যুক্তি দিয়ে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ করায় অনিয়মের সুযোগ বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও পিএসসি মৌখিক পরীক্ষাকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। ১০০ নম্বরের যুগে পরীক্ষকদের সামনে প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার নম্বরও থাকত। এখন আর সেই সুযোগ নেই। তারপরও প্রিয়জনপ্রীতির নানা সুযোগ রয়ে গেছে।
বোর্ড সদস্যদের মনোনীত করা হয় পরীক্ষার দিন সকালেই। এ কারণে দৃশ্যত কোনো ধরনের অসমতার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি পিএসসির চেয়ারম্যানও জানেন না সদস্যদের কে কোন বোর্ডে পরীক্ষা নেবেন। বোর্ডের সামনে প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার নম্বর থাকে না। প্রার্থী বোর্ড থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চেয়ারম্যান সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে নম্বর চূড়ান্ত করেন। এটা করা হয় সদস্যদের প্রত্যেকের দেওয়া নম্বর গড় করে। বোর্ডে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষককে রাখা হয়, আবার দেখা গেছে অনেক বোর্ড সদস্য কোনো প্রশ্ন করেন না। সবাইকে সমানহারে প্রশ্ন করতে হবে। কতটা প্রশ্ন করবেন বা কত সময় একজন প্রশ্ন করবেন, তা নির্ধারিত থাকতে হবে। বর্তমান পদ্ধতিতে বোর্ডের চেয়ারম্যান জানতে পারেন প্রার্থীর বৃত্তান্ত। বোর্ডের কোনো সদস্যকেই প্রার্থীর বৃত্তান্ত জানতে দেওয়া যাবে না। পুরোপুরি কোডিং সিস্টেমে চলে যেতে হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চাকরিপ্রার্থী দেশ রূপান্তরকে বলেন, বোর্ডে ঢোকার পর প্রথম প্রশ্নই হচ্ছে, ‘টেল অ্যাবাউট ইউরসেলফ’। নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে প্রার্র্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আসবে, জেলার নামও আসবে। কাজেই এমন কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, যেখানে ব্যক্তিগত তথ্যের নামে জেলা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন বিষয়ে ছোটখাটো সংস্কার পিএসসি করেছে। কিন্তু এই সংস্কারই যথেষ্ট না। পিএসসির সব উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় মৌখিক পরীক্ষার নম্বরে। রহস্যজনক কারণে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ করা হয়েছে। এতে নানা অনিয়মের দুয়ার খুলছে। কাজেই মৌখিক পরীক্ষার নম্বর কমাতে হবে। বিষয়টি সরকারের ওপর নির্ভর করলেও এ বিষয়ে পিএসসিকে সদিচ্ছা দেখাতে হবে। পিএসসি বার্ষিক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে সুপারিশ করতে পারে।
পিএসসির সবচেয়ে বড় সমালোচনা হচ্ছে বছরে একটি বিসিএস আয়োজন করতে না পারা। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে শুরু করে নিয়োগের সুপারিশ পর্যন্ত সব কাজ এক বছরেই শেষ হবে। বিসিএস শেষ করতে সাংবিধানিক সংস্থাটি যে রোডম্যাপ করেছিল, তা হোঁচট খাচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের প্রাইমারি থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকসহ প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সিলেবাস, মূল্যায়নসহ পুরো পাঠদান ও পরীক্ষাপদ্ধতির আধুনিকায়ন ঘটেছে। সরকারে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে থাকেন বিসিএস ক্যাডার অফিসাররাই। ফলে সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা অনেকাংশেই এই ক্যাডার অফিসারদের ওপরই নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়টি মাথায় রেখেই সেকেলে পরীক্ষাপদ্ধতি থেকে বেরিয়ে পিএসসির উচিত বিসিএসের সিলেবাসের আধুনিকায়ন ও পরীক্ষাপদ্ধতির আমূল সংস্কার।
বিখ্যাত বাঙালি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের পাবনা সদরে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মগত নাম ছিল রমা দাশগুপ্ত। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত। ১৯৪৭ সালে কলকাতার বিশিষ্ট বাঙালি শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে দীবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। ১৯৫২ সালে তিনি চলচ্চিত্র জগতে প্রথম পা রাখেন। প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’, তবে ছবিটি আর মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে নায়িকার অভিনয় করে সাড়া ফেলে দেন চলচ্চিত্র অঙ্গনে। বাংলা চলচ্চিত্রে উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন জুটি সবিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সুচিত্রা সেন অভিনীত প্রথম হিন্দি ছবি দেবদাস (১৯৫৫)। ১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’ জয় করেন। সুচিত্রা সেন ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবি করার পর লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। সুচিত্রা সেন ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভক্ত। সুচিত্রা সেনের একমাত্র সন্তান মুনমুন সেন এবং তার দুই নাতনি রাইমা সেন ও রিয়া সেনও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সুনাম কুড়িয়েছেন। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে। ২০১২ সালে তাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মাননা বঙ্গবিভূষণ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন সুচিত্রা সেন।
একটা দেশের উন্নতি নির্ভর করে তার প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার ও জনসম্পদের প্রকৃতির ওপর। শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেই কোনো দেশকে উন্নত বলা যায় না; বড়জোর ধনী আখ্যায়িত করা যায়। কিন্তু জনসম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশের উন্নতি হয় টেকসই, বহুমুখী ও গতিশীল; প্রাকৃতিক সম্পদের লভ্যতা সেখানে তেমন বড় কোনো বিষয় হয়ে ওঠে না, বরং সেটার দুর্লভতাই দেশের নাগরিক ও নেতাদের উন্নয়ন-প্রচেষ্টায় ‘মন্ত্রের সাধন, কিংবা শরীর পতন’-এর দেবসুধা পানে মরিয়া হয়ে ওঠার প্রেরণা জোগায়। প্রাকৃতিক সম্পদ আপনা-আপনি দেশের নাগরিকদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটায় না; দক্ষ জনসম্পদের মাধ্যমে সেগুলো সদ্ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। সে কারণে আফ্রিকার অনেক দেশ মহামূল্যবান নানা খনিজের অধিকারী হয়েও আজ অনুন্নত বা বড়জোর উন্নয়নশীল তকমায় ভূষিত। আর ইসরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশ তেমন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও অতি উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। তাদের এই উল্লম্ফনের পেছনে অনুঘটকের কাজ করেছে মানবসম্পদের উন্নয়ন, যেটা আবার এসেছে উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ থেকে।
পাকিস্তানের এক বছর পর ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাধীনতা লাভ, এরপর ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নিমজ্জন, যুদ্ধ শেষে বিধ্বস্ত অবকাঠামো ও মহারুগ্ণ এক অর্থনীতির পৃষ্ঠদেশে আরোহণ এই ছিল উন্নয়ন-পূর্ব দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাস। কিন্তু তারা ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা নিয়ে দেশ গড়ার ব্রত শুরু করেন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে, যেখানে প্রাধান্য পায় স্টেম (Science, technology, engineering and mathematics) এডুকেশন এবং গবেষণা ও উদ্ভাবন। প্রথম দিকে সরকারকে বিদেশ থেকে প্রযুক্তি আমদানি করতে হতো বটে, তবে স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা প্রশিক্ষণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেগুলোর বিস্তার যেমন ঘটানো হতো, তেমনি সেগুলোতে নব নব স্থানীয় প্রযুক্তির উদ্ভাবন সূচিত হতো। এগুলোকে সুসমন্বিত করে জাতীয় ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তারা গঠন করেন এনআইএস (National Innovation System)। প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় nq KIST (Korea Institute of Science & Technology) এবং স্থানীয়ভাবে জটিল প্রযুক্তির উন্মেষ ঘটাতে ১৯৭১ সালে স্থাপন করা হয় KAIST (The Korean Advanced Institute of Science & Technology)। এ পর্যায়ে এনআইএসের প্রধান কাজ হয়ে যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণাকাজের সমন্বয় সাধন, বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণার সম্প্রসারণ, গবেষণার ফলাফলের বিস্তার সাধন এবং সব পর্যায়ে গবেষণা ও উন্নয়ন (Research & Development, R&D) কার্যক্রমকে টেকসইকরণ।
গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে সরকার এই খাতে সম্পদের ন্যূনতম বিনিয়োগ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়, বেসরকারি কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে উন্মুক্ত হস্তে কর রেয়াত ও প্রণোদনা প্রদান করে এবং এই খাতে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা সেরা স্নাতকরা নিয়োজিত হতে পারেন, তার ব্যবস্থা নেয়। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বেসরকারি সেক্টরে এই খাতে বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ১৯৮০ সালে এই খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ০.২৮ শতাংশ, পক্ষান্তরে ২০১০ সালে তা বেড়ে উন্নীত হয়ে যায় ২.৮০ শতাংশে। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী আরঅ্যান্ডডি খাতে দক্ষিণ কোরিয়ার বরাদ্দ বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ; জিডিপির ৪.৮ শতাংশ। ৫.৪ শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে ইসরায়েল এ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের অধিকারী।
বাংলাদেশে গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দের চিত্র বড়ই করুণ। এখানে গবেষণা ও উন্নয়ন (R & D) খাত নামে স্বতন্ত্র কোনো খাত নেই; অথচ বিশ্বে ১২৫ দেশে এটির আলাদা অস্তিত্ব জাজ্বল্যমান। এখানে এটা শিক্ষা খাতের একটা উপখাত মাত্র। আর শিক্ষা খাতেই বরাদ্দের হার জিডিপির ২ শতাংশের যৎসামান্য ওপরে; গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে মাত্র ০.৩ শতাংশ। The Business Standard-এর ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২-এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে এ খাতে ব্যয় করেছে মাত্র ১৩৭ কোটি টাকা; যার মধ্যে সরকারিগুলোতে ৩৬ কোটি এবং বেসরকারিগুলোতে ১০১ কোটি টাকা। ১৫০টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৫টি এ খাতে কোনো টাকাই খরচ করেনি, আর যেগুলো এক লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে, সেগুলোর সংখ্যা ৪৪টি। উল্লিখিত, ইংরেজি দৈনিকটির ১৪ জানুয়ারি ২০২১ তারিখের আরেক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ১৯৯৬-২০১৭ সালের মধ্যে দেশের বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের সংখ্যা ৩৮,৩৯৭, পক্ষান্তরে ওই সময়ে নাইজেরিয়ার সংখ্যা ছিল ৭১,০৪৬, ইন্দোনেশিয়ার ৭২,১৪৬ এবং পাকিস্তানের ১,২১,৮৩৬। এ তো গেল সংখ্যাতত্ত্বের হিসাব; মানের বিচারেও দেশের গবেষণার অবস্থা তথৈবচ।
রচনা চুরি করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদাবনতি, নিম্নমান ও চুরি করা অভিসন্দর্ভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকার বৃত্তি বাতিলÑএই জাতীয় সংবাদ এখন হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে। এসব সংবাদ দেশে গবেষণার মান সম্পর্কে একটা বার্তা দেয়। দেশে এ জাতীয় গবেষণা আগেও যে ছিল না তা নয়। আকবর আলি খানের ‘আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি’তে উল্লেখ রয়েছে, ‘সত্তরের দশকে বাংলাদেশে মাত্র তিনজন অধ্যাপক ছিলেন যারা প্রত্যেকে দুটি করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। এরা তিনজনই দুর্নীতির দায়ে জেল খাটেন। এরপর বাংলাদেশে ডাবল পিএইচডির আর খবর পাওয়া যায়নি।’ এই তিনজন অধ্যাপক রচনা চুরি করে জেলে গিয়েছিলেন, নাকি অন্য কোনো কারণে লাল দালানে পদার্পণ করেন, তা অবশ্য বইটাতে স্পষ্ট উল্লেখ নেই। তবে এ গবেষণার অধিকাংশই অ্যাকাডেমিক ধাঁচের; পদোন্নতি লাভ ও ব্যক্তিগত কিছু প্রাপ্তিযোগের মোহে পরিচালিত। যার প্রায়োগিক মূল্য উল্লেখ করার মতো নয়। দেশে গবেষণার প্রায়োগিক মূল্য কেমন, তার দু-একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি।
কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে, যাতে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৪২ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত ছিল। ওই বছর সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলে চাল আমদানিও হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টন। এটা যুক্ত করা হলে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২ লাখ টন, যেটা পরবর্তী বছর জের হিসেবে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা। অঙ্কের হিসাবে এই পরিমাণ বছরের উৎপাদনের ২৫ শতাংশেরও বেশি। এ ধরনের মোটাসোটা জের-পরবর্তী বছরে যুক্ত হলে সাধারণভাবে মজুদ নিয়ে শঙ্কার কোনো কারণ থাকে না; পরবর্তী বছর ১০ শতাংশ উৎপাদন ঘাটতি হলেও তা সামলে নেওয়া সহজেই সম্ভব। অথচ মজুদের এই স্বাস্থ্যকর অবস্থা সত্ত্বেও মহার্ঘ মূল্যে এই দুঃসময়ে চাল আমদানি চালিয়ে নিতে হচ্ছে; চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ লাখ টন আমদানি হয়ে গেছে, পাইপ লাইনে আরও আছে। তাহলে এই গবেষণার ফল আমরা কী কাজে প্রয়োগ করব?
খাদ্য অধিদপ্তরে চাকরির সময় কয়েকজন গবেষকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। একবার এক গবেষক মডেল প্রয়োগ করে ধান, চাল ও গম সংগ্রহের বছরব্যাপী এক নির্ঘণ্ট তৈরি করে আনেন। তাতে দেখলাম যে, জুলাই ও আগস্ট মাস পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে গম সংগ্রহের এন্তেজাম করা হয়েছে। মে মাসের পর অভ্যন্তরীণ বাজারে দেশি গমের যে টিকিটি পর্যন্ত দেখা যায় না, সেটা বলার পর গবেষকরা পড়ে যান মহামুশকিলে; একদিকে মডেলের নির্ভুলতা, অন্যদিকে রূঢ় বাস্তবতা। পরে তারা কেমন করে যেন ম্যানুয়ালি সে আপদ অপসারণ করতে সক্ষম হন। এ জাতীয় উপযোগিতাÑশূন্য বহু গবেষণাপত্র খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটে খোঁজাখুঁজি করলে এখনো পাওয়া যাবে।
তবে এই জাতীয় প্রায়োগিক মূল্যহীন গবেষণা যে শুধু এ দেশে দেখা যায়, তা না। উন্নত অনেক দেশেও এগুলোর উপস্থিতি এন্তার। নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু চিকিৎসা বিভাগে গবাদি পশুর মূত্রত্যাগের অভ্যাস সম্পর্কে একটি গবেষণা প্রকল্পে মার্কিন সরকার ৩ মিলিয়ন ডলার অনুদান প্রদান করে। এখানে গবেষকরা জানতে চান যে, নদী পার হওয়ার সময়, গরু নদীতে নামার আগে, না পার হওয়ার পর প্রস্রাব করে। পুরো অর্থব্যয়ের পর জানা গেল যে, প্রকল্পে নিযুক্ত অধিকাংশ পর্যবেক্ষক গরুগুলো কখন নীরবে মূত্রত্যাগ করেছে, তা ঠাহর করতে পারেননি। সুতরাং এ বিষয়ে কিছু জানতে আরও একটি প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রকল্পটি ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি অপচয়ের নিকৃষ্টতম উদাহরণ হিসেবে সিনেটর প্রক্সমায়ার স্মারক পুরস্কারে ভূষিত হয় (আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি, আকবর আলি খান, পৃষ্ঠা : ১৬৬)।
এখন আমাদের বেশি প্রয়োজন প্রায়োগিক মূল্যমানসম্পন্ন গবেষণা; চাহিদা ও সম্পদের জোগানের ভিত্তিতে পরিচালিত গবেষণা। বিষয় হবে স্বল্পব্যয়ে স্বল্প সময়ে অধিক মানসম্পন্ন ও ক্রেতাদের মনোহরণ করেÑএমন নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন ও সেগুলোর বিপণন এবং নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান; আমরা রপ্তানি বাড়াতে চাই, কিন্তু পর্যাপ্ত পণ্য ও গন্তব্য নেই। দক্ষতার চাহিদা ও তার পরিবর্তন-প্রবণতা নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে পাঠ্যক্রম প্রবর্তন ও সংশোধন; আধুনিক শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধ এবং চাহিদাবিহীন ডিগ্রি-সর্বস্ব শিক্ষার ব্যয় সংকোচ একটি জরুরি গবেষণার ক্ষেত্র। আমাদের রয়েছে অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রচুর উচ্চশিক্ষিত বেকার। অথচ তাদের বাদ দিয়ে বহু দেশি প্রতিষ্ঠানই বিদেশি লোকবল নিয়োগ দেয়, যার জন্য বছরে ৭-৮ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে চলে যায়। এর কারণ ও প্রতিকার বের করা দরকার। অবহেলিত ও স্বল্প-কর্ষিত ক্ষেত্রগুলোর সম্ভাবনা যাচাইকরণ আরেকটি ক্ষেত্র হতে পারে; আমরা সমুদ্রে বিপুল সম্পদের মালিকানা পেয়েছি, কিন্তু এখনো তা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এ রকম আরও অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেগুলোতে গবেষণা পরিচালনা দেশের জন্য নবদিগন্তের সূচনা করতে পারে। এজন্য শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণায়ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষা খাতে ক্ষেত্রে ইউনেসকোর সুপারিশ জিডিপির ৬ শতাংশ; আর আরঅ্যান্ডডি খাতে বোদ্ধাদের দাবি ১.৫ শতাংশ।
তবে এসব গবেষণার ফলাফল যাতে কাজে লাগে, গবাদি পশুর মূত্রত্যাগবিষয়ক গবেষণার মতো এর অর্থ যাতে জলে না যায়, তার জন্য উপযুক্ত দিকনির্দেশনা প্রণয়ন করতে হবে এবং তা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে আংকেল শ্যামের আদলে প্রতি বছর দশটি উৎকৃষ্ট ও দশটি নিকৃষ্ট গবেষণার তালিকা প্রণয়ন করে গবেষকদের পুরস্কৃত ও তিরস্কৃত করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আর গবেষণাকে সমৃদ্ধ ও টেকসই করতে বেসরকারি সেক্টরে তার সম্প্রসারণ ঘটাতে এবং পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে ব্যবস্থা নিতে হবে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের গণ্ডি থেকে বের হয়ে স্নাতক হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পটভূমিতে এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন পরিক্রমা এ ক্ষেত্রে আমাদের পাথেয় হিসেবে কাজ করতে পারে। এ কাজে কোরিয়ার মতো সরকারকেই বন্ধু, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও কলামিস্ট
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল রাশিয়া। বছর ঘুরে এলেও যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। বড় গাছের যেমন বড় ছায়া পড়ে, তেমনি বড় কোনো দেশ যুদ্ধে জড়ালে তার কালোছায়া পড়ে পুরো বিশ্বেই। ইউক্রেন যুদ্ধের কালো ছায়াও পড়েছে এখন বিশ্বে। এই এক বছরেই বিশ্ব রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছে। বিশ্বের নানা দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা টানাপড়েন শুরু হয়েছে। অনেক দেশ দেউলিয়া হওয়ার পথে। বিশ্বজুড়ে দেখা দিচ্ছে অর্থনৈতিক মহামন্দা। দেশে দেশে দেখা দিচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি, কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। প্রশ্ন উঠছে, এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে? কে থামাতে পারবে এই যুদ্ধ? সাদা চোখে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ চলছে বলে মনে করা হলেও, এটি যে রাশিয়া আর পশ্চিমা ন্যাটো জোটের মধ্যকার লড়াই, তা সবাই জেনে গেছে। মূলত ইউক্রেন হচ্ছে এখানে প্রক্সি। যুদ্ধ থামানোর ভূমিকায় থাকার কথা ছিল ইউরোপের, কিন্তু তারা আর সে অবস্থানে নেই। ইউরোপীয় ন্যাটো মিত্ররা চাচ্ছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকেই সরিয়ে দিতে। ফলে, ইউক্রেন চাইলেও সমঝোতা আলোচনা সম্ভব হচ্ছে না। শান্তি আলোচনার তাবৎ উদ্যোগ তাই থমকে গেছে।
এরই মধ্যে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের মতো দরিদ্র দেশে। নতুন আরেকটি বছরে চলে গেল যুদ্ধটি। বিশ্বের সব বড় দেশের নেতারা যুদ্ধ বন্ধে বাস্তবধর্মী কোনো ফর্মুলা বাতলে দিচ্ছেন না। জাতিসংঘ কী করছে তা-ও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। একচোখা এই সংস্থাটির এ যুগে থাকা দরকার আছে কি না, তা নিয়েও অনেকে আবার কথা শুরু করেছেন। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রুশ-মার্কিন পাল্টাপাল্টি সামনের দিনগুলোতে বিশ্ববাসীকে আরও খারাপ সময়ের ভেতর ফেলে দেবে। পৃথিবী এর মধ্যেই মন্দা অর্থনীতির মধ্যে প্রবেশ করেছে। এটা থেকে বের হওয়ার চাবিকাঠি শুধু আমেরিকার হাতেই। কারণ, ইউক্রেন কিংবা ন্যাটো দুপক্ষই আমেরিকার অধীন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমেরিকা চাইলে যুদ্ধ বন্ধ করা কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু আমেরিকা নানা কারণেই সেটি করবে না। এ কারণে এই যুদ্ধ দীর্ঘ একটা রূপ পেতে যাচ্ছে।
যুদ্ধের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক জেনারেল এবং সামরিক বিশেষজ্ঞ মিক রায়ান বলছেন, স্বল্প মেয়াদে কোনো একটি পক্ষের কৌশলগত বিজয় কিংবা প্রতিপক্ষকে পুরোপুরিভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা এখানে খুব কম। যুদ্ধরত কোনো পক্ষই এমন ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারেনি, যা প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি ধরাশায়ী করতে পারে। ফলে যুদ্ধ সহসাই থামবে না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনও বারবার বলে চলেছেন, তিনি পিছপা হবেন না। তিনি মনে করছেন কৌশলগত ধৈর্য ধারণ করার মাধ্যমে তিনি এ যুদ্ধে লাভবান হবেন। কারণ দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা দেশগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়বে এবং তারা তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেওয়ার পাশাপাশি চীনের হুমকির ব্যাপারে আরও বেশি মনোযোগী হবে। আত্মবিশ্বাসী রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেও কোনো ফল পায়নি পশ্চিমারা। ইউক্রেনের তরফেও সমঝোতার টেবিলে বসার মনোভাব নেই। ন্যাটো ও আমেরিকার প্রশ্রয়ে তারাও অনড় অবস্থানে।
এ অবস্থায় পুতিন ইউক্রেনে পরমাণু হামলা চালাবেন কি না সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে তিনি কিছু একটা যে করে ফেলবেন, তা নিশ্চিত। ইউক্রেনে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটুক আর নাই ঘটুক, এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনীতিতে তার চেয়েও বড় বোমা পড়ছে প্রতিনিয়ত। বৈশ্বিক খাদ্যশস্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর মানুষ এখন দিশেহারা। পরিস্থিতি সামলাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যয়সংকোচন নীতি নেওয়া হচ্ছে। আমদানি পণ্যেও আরোপ হয়েছে নানা বিধিনিষেধ। বাংলাদেশও ধুঁকছে খাদ্যপণ্য আমদানি নিয়ে। ফলে চলমান সংকট নিরসনে ‘কৃচ্ছ্রসাধন’ বা ‘ব্যয় সংকোচন’নীতিকেই বেছে নিতে হয়েছে সরকারকে। চলতি বছরটা বাংলাদেশের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠবে। দেশের মানুষ ক্যালরির জন্য ভাতের ওপর নির্ভরশীল। তবে আটা-ময়দার ওপরও ধীরে ধীরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আর এই আটা-ময়দা আসে গম থেকে যার বেশির ভাগই আমদানি করা হয় ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে। নানা গবেষণা থেকে দেখা যায়, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশে তার চাহিদার ৮০ শতাংশ গম আমদানি করে। এর অর্ধেক আসে ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে। কিন্তু যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় গমের দাম বেড়েছে অনেক। এতে বাংলাদেশে আটা-ময়দার দামও বেড়েছে। গত এক যুগে বিদ্যুৎ খাতে নানা পদক্ষেপের পর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হলেও বাধ্য হয়ে লোডশেডিংয়ের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। সরকারের এমন ‘অজনপ্রিয়’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনেও রয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাসসহ দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যের। সেই সঙ্গে পরিবহন ব্যবস্থায়ও সমস্যা তৈরি হয়েছে, ভেঙে পড়েছে সরবরাহ ব্যবস্থাও। অনেক উন্নত দেশেও দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে জানিয়ে দেশবাসীকে মিতব্যয়ী ও সঞ্চয়মুখী হওয়ার আহ্বানও রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী।
এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে এরই মধ্যে। বিদ্যুতের মূল্য বাড়ছে বারবার। এতে করে সামনে পণ্যমূল্য আরও বাড়বে। ভোটের বছর এটি। এটি ইস্যু হিসেবে হাজির হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে জনগণ উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে। রুশ-মার্কিন পাল্টাপাল্টি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সামনের দিনগুলোতে দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য এমন প্রতিকূল পরিণতি বয়ে আনবে, যা বিশ্বের ভূ-অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকে নতুন আকার দিতে পারে। বাংলাদেশকেও সেই প্রতিকূলতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
আদালতে বিচারকাজ সম্পন্ন হয় আইনজীবী ও বিচারকের সমন্বয়ে। এটা অনেকটা দুই চাকার সাইকেলের মতো। একটি অকার্যকর হলে অন্যটি চলতে পারে না। আইনের শাসন কায়েম করতে হলে এই দুটি অঙ্গেরই ভূমিকা আছে। পারস্পরিক সম্মান, বোঝাপড়া ও সহযোগিতার মধ্য দিয়েই যুগ যুগ ধরে বিচারালয়ের কাজ পরিচালিত হয়েছে। তবে ইদানীং বিচারালয়ও অবক্ষয়গ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আইনজীবীদের সঙ্গে বিচারকরা বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন। গত কয়েক মাসে এমন বেশ কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারদের সঙ্গে আইনজীবীদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এই বিরোধের জের ধরে আইনজীবী ও বিচারকরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। আইনজীবীদের পক্ষ থেকে আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করায় জেলার বিচারাঙ্গনে রীতিমতো অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন বিচারপ্রার্থীরা।
পতনের যে সত্যিই কোনো সীমা হয় না, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীরা তা আরও এক বার প্রমাণ করলেন। অশ্রাব্য ভাষায় বিচারককে গালাগাল করেই ক্ষান্ত হলেন না, তারা বিচারকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখালেন, আদালত বয়কট করলেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা ‘নজিরবিহীন’ আইন পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এতখানি নিচে এর আগে নামেনি।
এর পাল্টা হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুককে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল ও অশালীন আচরণ ও এজলাসে খারাপ ভাষা ব্যবহার করার অভিযোগে ওই বারের ২১ আইনজীবীকে তলব করেছে হাইকোর্ট। এর আগেও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ৩ আইনজীবীকে তলব করেছে হাইকোর্ট। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ জুলাই এক জামিন শুনানিতে পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিমের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও বিচারিক কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় হাইকোর্টে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পার পান পিরোজপুর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) খান মো. আলাউদ্দিন। এরপর গত সেপ্টেম্বরে খুলনা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের (বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা জজ) বিচারকের সঙ্গে অসদাচরণের ঘটনায় খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ তিন আইনজীবী হাইকোর্টের তলবে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আদালত অবমাননার দায় থেকে অব্যাহতি পান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যা ঘটেছে, তা শুধু অনাকাক্সিক্ষতই নয়, নিন্দনীয়ও বটে। আমাদের দেশে বিচারালয়ে এমন ঘটনা আগে ঘটত না। কিন্তু এখন প্রায়ই ঘটছে। কেন এমন হচ্ছে, তার কারণ খুঁজে বের করা দরকার। কেননা রোগ নির্ণয় করা গেলে ওষুধ প্রয়োগ সম্ভব হবে। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য কার্যত উভয় পক্ষকেই সংযমী ও উদ্যোগী হতে হবে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, অনেক জেলায় বিচারকের সঙ্গে আদালতে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়। সাধারণ আইনজীবীরা এ অসৌজন্যতা দেখান না। দেখান তথাকথিত ‘পাওয়ারফুল’ আইনজীবীরা, বিশেষ করে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে যাদের সংযোগ আছে। অন্যদিকে বিজ্ঞ বিচারকরাও পক্ষপাত প্রদর্শন করেন বলে অভিযোগ আছে। তারা সাধারণ আইনজীবীদের মূল্যায়ন করেন না। অন্যদিকে ‘পাওয়ারফুল’ আইনজীবীদের তারা সমঝে চলেন, বেশি গুরুত্ব দেন। ফলে আশকারা পেয়ে ‘ক্ষমতাবান’ আইনজীবীরাই বিচারকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন।
বিচারকের কোনো সিদ্ধান্ত বা রায় যে সবার পছন্দ হবে, এমন নয়। রায় মনঃপূত না হলে উচ্চতর আদালতে আপিল করার ব্যবস্থাটিও আমাদের বিচারব্যবস্থায় সুপরিচিত। কিন্তু, বিচারপতির বিরুদ্ধে কটূক্তি, তাকে হয়রান করার এই সংস্কৃতির পেছনে যে রাজনৈতিক ক্লেদ রয়েছে, তা স্তম্ভিত করার মতো। অভিযুক্ত আইনজীবীর ঠিকুজি খুঁজলে রাজনীতির রং বের করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। তবে পরিস্থিতি যাই হোক, বিচারকের সঙ্গে অশোভন আচরণ করা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। বারের নেতাদের এসব বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া উচিত। শুধু উদ্যোগী হওয়া নয়, কখনোই যেন বার এবং বেঞ্চের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি না হয়, নেতাদের সে বিষয়ে বিশেষ যতœবান হওয়া উচিত।
বিচারকদের প্রতি আইনজীবীদের এমন আচরণের পেছনে ঢালাও রাজনীতিকীকরণের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অবক্ষয়ও কম দায়ী নয়। সব পেশার মানুষেরই একটা মান বা স্ট্যান্ডার্ড আছে। অন্তত থাকা উচিত। কাগজে-কলমে কে কতটুকু শিক্ষিত সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু শিক্ষা রুচির পরিচয় দিতে হয় ব্যবহারে, কথায়, আচরণে। আমাদের দেশে সব পেশার মানুষের মধ্য থেকেই সুবচন নির্বাসনে গেছে। যে ঘর থেকে মানুষের শিক্ষা শুরু হয়, সেখানেই গলদ সৃষ্টি হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আমাদের প্রয়োজনীয় ভদ্র-নম্র হতে শেখায় না। ফলে সমাজে পারস্পরিক সম্মান করার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। একজনকে সম্মান দেখালে সেও সম্মান করবে এটা মনে রাখতে হবে। কিন্তু পারস্পরিক সম্মানের বোধটাই যেন আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। সবাই নিজেকে ও নিজ পেশাকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। আর নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করার ফল হলো অন্যকে ছোট বা হীন করে দেখা। ফলে সমাজে বিরোধ-বিদ্বেষ বাড়ছে। একজন আরেকজনকে নিজের ক্ষমতা ও দাপট দেখানোর চেষ্টা করছে। ফলে সব খানে বিরোধ ও ঝগড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। যে যার ভূমিকা সুষ্ঠুভাবে পালন করলে এমনটা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। আইনজীবী বিচারক মানেন না। বিচারক আইনজীবী মানেন না। ছোট আইনজীবী বড় আইনজীবীকে হিংসা করেন। বড় বিচারক ছোট বিচারককে অবজ্ঞা করেন। প্রশাসন ক্যাডারের কর্তাব্যক্তিরা অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চান্স পেলে বিপদে ফেলেন। সবাই সবার প্রতিদ্বন্দ্বী, সবাই সবার মুখোমুখি। এ এক আশ্চর্য সমাজ বানিয়েছি আমরা! যেখানে কেউ কাউকে সম্মান করেন না, শ্রদ্ধা করেন না, নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন না। কেবল নিজেকে বড় মনে করা, অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করা এভাবে আমরা স্বখাত সলিলে যেন ডুবতে বসেছি!
বিচারক ও আইনজীবী মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ানোটা সমাজের জন্য মোটেও শুভ নয়। পেশাগত সম্পর্ক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমে আসায় এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ না করায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দেশ ও জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে পারস্পরিক ভারসাম্য রেখে কাজ করতে হবে। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ পৃথকভাবে দায়িত্ব পালন করলেও তারা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কেউ কারও প্রতিপক্ষ নন বরং পরস্পর সম্পূরক। তাই সংশ্লিষ্ট সবাইকে পারস্পরিক ভারসাম্য বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের অন্যতম। গণতন্ত্রের বিকাশ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের দেশের বিচারকরা ধোয়া তুলসীপাতা নন। নানা অভিযোগে তারাও অভিযুক্ত। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যা ঘটেছে, তাতে আইনজীবীরা কিছুতেই দায় এড়াতে পারেন না। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের একটা গূঢ়তর উদ্দেশ্য আছে। তা হলো নিজের ক্ষমতা জাহির করা এবং বিচারকদের মনে এক ধরনের আতঙ্কের সঞ্চার করা। এমন আশঙ্কা অমূলক নয় যে, এরপর হয়তো বিচারকদের শারীরিকভাবে নিগ্রহের ঘটনাও ঘটতে পারে। তা সত্যিই ঘটবে কি না, সে জল্পনা অবান্তর এমন একটি আশঙ্কা যে তৈরি হতে পারে, সে কথাই গভীর লজ্জা এবং উদ্বেগের। বিচারকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে তার প্রভাব তাদের সিদ্ধান্তের ওপরেও পড়তে পারে।
ক্ষুদ্র রাজনীতির পালে হাওয়া দিতে যদি বিচারব্যবস্থা বিঘিœত হয়, সেই ক্ষতি অপূরণীয়। দেশের রাজনীতির পরিচালকরা আত্মসমীক্ষা করতে পারেন যে গণতন্ত্রের পরিসরে তারা রাজনীতি করেন, তার মূলে কুঠারাঘাত করা কী বিপুল অবিবেচনার কাজ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিচারপতির বিরুদ্ধে ‘বিক্ষোভ’-এর পেছনে সংগঠিত রাজনীতির কলকাঠি নেই, এমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন। যারা এই কাজটি করছেন বা করাচ্ছেন, তাদের পরিণামের কথা মাথায় রাখা উচিত। অন্যের জন্য কবর খুঁড়লে অনেক সময় সেই কবরে নিজেকেই সমাহিত হতে হয়!
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
বেলজিয়ামের নতুন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে সম্মানতি বোধ করছেন ম্যানচেস্টার সিটি তারকা কেভিন ডি ব্রুইনা।
গত বছর বিশ্বকাপের পর রিয়াল মাদ্রিদ তারকা এডেন হ্যাজার্ড জাতীয় দলকে বিদায় জানান। বেলজিয়াম কোচ ডোমেনিকো টেডেসকো প্লেমেকার ডি ব্রুইনাকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন। বিশ্বকাপের পর বেলজিয়ামের কোচের পদে রবার্তো মার্টিনেজের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন টেডেসকো।
গত জানুয়ারিতে ৩২ বছরে পা রেখেছেন ব্রুইনা। আরটিএল-টিভিআই টেলিভিশনে বেলজিয়ামের নেতৃত্ব পাওয়া নিয়ে ডি ব্রুইনা বলেছেন, ‘এভাবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা সত্যিই সম্মানের। আমার বয়স প্রায় ৩২ হয়ে গেছে। আমি কখনই আন্তর্জাতিক অবসরের চিন্তা করিনি। আমি বিশ্বাস করি এখনো দলকে কিছু দেবার সক্ষমতা আমার আছে। এই সুযোগে তরুণদেরও সহযোগিতা করতে চাই।’
সুইডেনের বিরুদ্ধে শুক্রবার ইউরো বাছাইপর্বে অধিনায়ক হিসেবে ডি ব্রুইনার অভিষেক হতে যাচ্ছে। মাদ্রিদ গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া ও চেলসি রোমেলু লুকাকু ডি ব্রুইনার সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করবেন।
রাজধানীর মালিবাগ রেলগেটে ট্রেনের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষের ঘটনায় ২ ঘণ্টা পর চালু হয়েছে রেল যোগাযোগ।
ইঞ্জিন পরীক্ষার পর পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাত ১১টার দিকে ছেড়ে যায়। এতে সড়কের ২ পাশের যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে।
বুধবার রাত ৯টার পর মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি সোহাগ পরিবহনের একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এ ঘটনায় তিন জন আহত হন। দুর্ঘটনার সময় বাসটিতে কোনো যাত্রী ছিল না। ট্রেনের গতিও কম ছিল।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।