
আমাদের জীবনের সঙ্গে রয়েছে পাখির নিবিড় সম্পর্ক। ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল, কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল’ কিংবা ‘পাখিটার বুকে কেউ তীর মেরো না, ওকে গাইতে দাও’ এই সব স্মৃতিজাগানিয়া কবিতা আর গান আমাদের যাপিত জীবনে পাখির সকণ্ঠ উপস্থিতিকে জানান দিয়ে যায়। ‘তোমরা যখন শিখছো পড়া/ মানুষ হওয়ার জন্য,/ আমি না হয় পাখিই হবো,/ পাখির মতো বন্য।’ অথবা ‘এমন যদি হতো/আমি পাখির মত/উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ’। গান আর কবিতায় পাখি এসেছে তাই নানা অনুচ্ছেদে নানা মাত্রিকতা নিয়ে।
আমরা সৌভাগ্যবান যে, না চাইতেই আমাদের দেশে প্রতি বছর শীতকালে অসংখ্য পাখি এসে ভিড় করে। সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, হিমালয়ের পাদদেশ, চীন-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়ে এখানে আসে তীব্র শীত ও খাদ্যাভাব থেকে বাঁচার জন্য। নভেম্বর মাস থেকে শুরু করে প্রায় এপ্রিল মাস পর্যন্ত এরা আমাদের অতিথি হয়ে থাকে। এসব পাখির বেশির ভাগই জলচর ও হাঁস প্রজাতির। বৃক্ষচারী পাখিও আছে, তবে সংখ্যায় কম। আগন্তুক পাখিদের মধ্যে থাকে বালিহাঁস, চখাচখি, বাদিহাঁস, শামুকখোল ইত্যাদি। প্রকৃতির ক্ষতিকর পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, ইঁদুর খেয়ে ওরা ফসল ও জলজ প্রাণীর সুরক্ষা সাধন করে। শীতের প্রকোপ কমলে এরা আবার ফিরে যায় নিজেদের দেশে।
ওরা জানে যে কখন ওদের কোন দেশে আশ্রয় নিতে হবে। এজন্য আসার আগে ওরা পাখার নিচে বেশি চর্বি জমা করে রাখে। মাইলের পর মাইল ওরা উড়ে চলে সেই সঞ্চিত চর্বির শক্তিতে। ওদের পরিযায়ন স্বভাবটাও বেশ অদ্ভুত। সাধারণত ওরা দলবেঁধে চলে। যেখানে ওরা একবার আসে, সাধারণত সেসব জায়গাতেই পরের বছরগুলোতেও আসার চেষ্টা করে। সবসময় একই পাখি হয়তো আসে না। তবে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অবশ্যই পূর্ব অভিজ্ঞ পাখি থাকে যারা ওড়ার সময় ঝাঁকের সামনে থাকে ও পথের নির্দেশ দেয়। এদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে জায়গা পরিবর্তন করে ফেলে। একবার কোনো জায়গা ছেড়ে দিলে তারা আর সেখানে ফিরে যায় না! ওদের দেহে অসাধারণ এক সংবেদ ও সাড়া প্রদান কৌশল আছে যা দিয়ে ওরা শত শত এমনকি হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ঠিকই আগের জায়গায় ফিরে আসতে পারে। যাত্রাপথের আকাশ, নক্ষত্র, পাহাড়, নদনদী, জলভূমি, অরণ্য ইত্যাদি ওরা চিনে রাখে এবং এসবের সাহায্যে ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছে যায়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া পাখিগুলো একটু উষ্ণতা, খাদ্য আর আশ্রয়ের আশায় আমাদের দেশের বিভিন্ন বনজঙ্গল, হাওর, বাঁওড়, খাল, নদী, চর, বিল, জলাশয়ে এসে জড়ো হয়। পাখিপ্রেমীরা মেতে ওঠে পাখি দেখার আনন্দে।
এইসব অতিথি পাখিদের জীবন এখন সংকটে। পাখি গবেষকরা এর কারণও খুঁজে বের করেছেন। এখানে পরিযায়ী পাখিদের বাসস্থান ক্রমে সঙ্কুচিত হচ্ছে। নিচু জমিতে গড়ে ওঠা ঝিল, বিল, প্রাকৃতিক সরোবর ছাড়াও মানুষের তৈরি দিঘি, পুকুরেও এদের আস্তানা। এই জলাভূমিগুলো বর্তমানে ভূমিরাক্ষসদের হাতে দারুণভাবে আক্রান্ত। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। পরিযায়ী পাখিদের অস্তিত্ব সংকটের একটি অন্যতম কারণ হলো হত্যা করার প্রবণতা। যে সব পাখির মাংস সুস্বাদু তাদেরই মূলত শিকার করা হয়। গ্রামেগঞ্জে এদের ধরার জন্য ফাঁদ পাতা হয়। এদেশে পাখি নিধনের ব্যাপারে কড়া আইন থাকলেও মানুষের সচেতনতার অভাবে তা আর সম্পূর্ণরূপে ফলপ্রসূ হয় না।
অন্য দিকে, প্লাস্টিক দূষণ পাখিদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। শুধুমাত্র বিদেশ থেকে আসা পাখিরা নয়, দেশীয় পাখিদের জীবনও আজ হুমকির মুখে। বিশেষ করে হাঁস গোত্রীয়রা প্লাস্টিক দূষণের শিকার বেশি হচ্ছে। এর কারণে মা পাখিদের জীবন বিপন্ন তো বটেই, এদের সন্তানরাও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অকালে।
এ ছাড়া অনেক পাখি গভীর জলে ডুব দিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। এ সময় তারা প্লাস্টিক ব্যাগ ও পরিত্যক্ত জালে আটকা পড়ে জলের ওপরে উঠতে পারে না ও বেঘোরে প্রাণ হারায়। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ ৯৯ শতাংশ পাখির শরীরই কোনো না কোনোভাবে প্লাস্টিক দ্বারা আক্রান্ত হবে। স্থলচর অতিথিরা খাদ্যের ব্যাপারে চাষের জমির ওপর নির্ভর করে থাকে। আর সেখানেই নিঃশব্দে লুকিয়ে থাকে তাদের মরণফাঁদ। উন্নত ফলনের আশায় অতিমাত্রায় কৃত্রিম রাসায়নিক বা কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। পাখিরা এই সব দানাশস্য খাওয়ার ফলে ফসলের মধ্যে সঞ্চিত বিষ তাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
অনেকে আবার পাখির সংখ্যা হ্রাসের কারণ হিসেবে মোবাইল ফোনের টাওয়ারের সংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন। মাত্রাধিক তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ স্বল্প মেয়াদে তেমন কুপ্রভাব না ফেললেও দীর্ঘদিনের সংস্পর্শে কুপ্রভাব পড়তে বাধ্য। এর প্রভাবে যেসব পাখি প্রজননের জন্য এ দেশে আসে তাদের সে ক্ষমতাই হারিয়ে যাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ডিম। শহরের আশপাশে তাই এখন লাল মুনিয়া, নীল কটকটিয়া, পশ্চিমি হলুদ খঞ্জনাদের দেখা মেলা ভার।
ইদানীং আরও একটি ব্যাপার চোখে পড়ছে। কোনো ঝিল বা বিলের কাছে শান্ত পরিবেশে পরিযায়ী পাখিরা আশ্রয় নিলেই তাকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে পিকনিক স্পট। অকারণ হুল্লোড় ও আধুনিক ডিজে বক্সের ভয়ানক আওয়াজে পরিবেশ হয়ে উঠছে অশান্ত। তাছাড়া কিছু মানুষ ইট-পাটকেল ছুড়ে পাখিদের বিরক্ত করার মতো বর্বর আচরণও করে থাকেন। পরিযায়ী পাখিদের কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের বিকাশের সুযোগ থাকলেও বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারায় আমরা তা হারাচ্ছি।
আমাদের ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২’-এ পরিযায়ী পাখি রক্ষার কথা বলা হলেও অল্পসংখ্যক মানুষ এ সম্পর্কে অবগত। অগত্যা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে এই সীমিত সংখ্যককেই উদ্যোগী হতে হয়। বিভিন্ন জেলার যেসব জায়গায় পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা সেখানে বিশেষ কর্মশালার মাধ্যমে পাখি হত্যা থেকে বিরত করতে হবে। পরিযায়ী পাখিরা আমাদের আঞ্চলিক অর্থনীতির বিকাশে যে ভূমিকা নিতে পারে সে বিষয়ে অবগত করতে পারলে এদের সুরক্ষার দিকে সবার নজর পড়বে।
এই অতিথিদের আমরা সব রকম সুবিধা হয়তো দিতে পারব না, তবু নিজেদের সাধ্যের মধ্যে চেষ্টা অন্তত করতে পারি। যত্রতত্র প্লাস্টিক আবর্জনা না ফেলে, জোরালো শব্দ না করে, রাসায়নিক ব্যবহারের মাত্রা কমিয়ে তাদের নির্বিঘ্নে দিনযাপন করার পরিবেশ দিতে পারে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরাই। যে পাখিরা উপকূল রেখা, সূর্যের অবস্থান, নদী-পাহাড় শ্রেণি দেখে পথ খুঁজে খুঁজে এসে কয়েক মাস এখানে আশ্রয় নেয় আমাদের ভরসা করে, তাদের নিরাপদে স্বভূমিতে ফিরতে দেওয়া তো আমাদেরই মানবিক কর্তব্য।
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করছেন ড. আকসাদুল আলম। বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চার রাজনীতি, ধারা, গতি-প্রকৃতি এবং স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইতিহাস পঠন-পাঠনের সংকট ও করণীয় নিয়ে একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : দেশে ইতিহাস চর্চার সার্বিক চিত্রটি কীরকম? একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে এর সংকট ও করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?
ড. আকসাদুল আলম : বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চা একটা বিশেষ ধারায় চলছে। গত ৫০ বছর ধরে ইতিহাসের যে চর্চা সেটাকে মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে একটা ন্যারেটিভ বেইজড ধারা। এই মেইনস্ট্রিম ইতিহাস চর্চার ধারা ৫০ বছরের আগেই শুরু হয়েছিল এবং এই চর্চায় খুব একটা বড় পরিবর্তন আসেনি।
দেশ রূপান্তর : মানে সেটা কি পাকিস্তান পিরিয়ড নাকি তারও আগের?
ড. আকসাদুল আলম : সেটা যদি সময়ের বিবেচনায় বলি তাহলে ভালো হয়। মোটামুটিভাবে ধরা যেতে পারে বিগত ১০০ বছর। তো এই ১০০ বছরে ইতিহাসচর্চার ধারাটা প্রায় একই রকম। আমরা যদি বলি একটা কনভেনশনাল বা ট্র্যাডিশনাল ওয়ে অব স্ট্যাডিং হিস্ট্রি, সেটাই এখানে প্রধান হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। বলার মতো কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। ক্রিটিক্যাল এনালিসিস বা একটা ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের দিকে, মানে হিস্ট্রিকে ক্রিটিক্যালি দেখার অনুপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভূত হয় এখানে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। মোটামুটিভাবে যারা এখানে ইতিহাস গবেষণা করছেন তারা মূলত একটা গৎ বাঁধা ন্যারেটিভ বেইজড ইতিহাস চর্চাই করছেন। তাত্ত্বিক কিংবা কনসেপচুয়াল জায়গা অথবা একটা ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের জায়গাগুলো অথবা ইতিহাস তত্ত্বকে একটা বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার চেষ্টার অভাব এখানে রয়েছে।
দেশ রূপান্তর : রাষ্ট্রের তো একটা ন্যারেটিভ বেইজড ইতিহাস থাকে বলে জানি। কিন্তু আমাদের এখানে তো সেই ন্যারেটিভ নিয়েই বিতর্ক হয়। এখানে ক্ষমতার বদল হলে গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে ইতিহাস চর্চার চেয়ে ইতিহাস নিয়ে রাজনীতিটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এভাবে কি কোনো ন্যারেটিভ দাঁড়ায়, যেটা সর্বজনীন?
ড. আকসাদুল আলম : প্রশ্নটা ইন্টারেস্টিং। দেখেন সারা পৃথিবীতেই ইতিহাস হচ্ছে রাজনীতির একটি উপকরণ। ইতিহাসকে ব্যবহার করা হয় সব ধরনের জ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে, রাজনীতির খুঁটি হিসেবে। সুতরাং বাংলাদেশে যেটি হচ্ছে সেটি নতুন কিছু নয়। রাজনীতি তার নিজস্ব ধারায় অনেক কিছুকেই ব্যবহার করবে। এতে কেউ লাভবান হতে পারেন, কেউ বা ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু ইতিহাসের একটা শাস্ত্রীয় প্রথা আছে, পদ্ধতি আছে। ইতিহাসের সেই প্রথা অনুযায়ী চর্চা দরকার। সেই চর্চা বাংলাদেশে কতটা হচ্ছে তা একটা প্রশ্ন। মানে ইতিহাসকে নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে, এর স্থানিক এবং কালিক মানদন্ড নিশ্চিত করতে হবে। আপনি ভিন্ন ভিন্ন ভৌগলিক বাস্তবতায় কোন ইতিহাস কোন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে পড়াচ্ছেন সেই বাস্তবতাকে সামনে রেখে ইতিহাসের বয়ান তৈরি হতে হবে। বিশেষভাবে দেখা যায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা এখানকার ইতিহাসের বয়ানে, চর্চায় খুব তীব্রভাবে বিদ্যমান। এটাকে ভালো-খারাপ মূল্যায়ন করাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো সর্বসাধারণের জন্য মানুষের সামষ্টিক অভিজ্ঞতার একটা ইতিহাসের শাস্ত্রসম্মত বয়ান তৈরি করা। কিন্তু সেই দিকে যাওয়ার বদলে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস পঠন-পাঠনের ইতিহাসের মূলধারাটি এখনো রাজা-বাদশাহ, রাজনীতি এবং কতিপয় অভিজাতের উচ্চাভিলাষ, জয়-পরাজয়কে মোটা দাগে রিপ্রেজেন্ট করছে। এর বিপরীতে যে প্রবণতা বা প্রয়াস যে একেবারেই নেই, তা কিন্তু নয়। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতির ভিত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের জনগোষ্ঠীর ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার চিত্র বাস্তবতা তুলে আনার একটা প্রয়াস কোনো কোনো ইতিহাসবিদেও ব্যক্তিগত গবেষণাচর্চায় হয়তো আছে, তবে সেটা বর্তমান গতানুগতিক চর্চার ডামাডোলে এবং রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নানারকম বিরোধাত্মক তথ্য, ক্ষমতাসীন দলের সাপেক্ষে তথ্য সংযোজন-বিয়োজনের পরও আমরা মোটা দাগে একটা বয়ান জানি। এবং আমরা বুঝতে পারি কোন দল কেন কী তথ্য জানাচ্ছে বা বাদ দিচ্ছে। কিন্তু রাজনীতি মূলত যেটা নিয়ে হচ্ছে সেটা হলো প্রাচীন এবং মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে। বাংলার ইতিহাসের এই রহস্য ও ধোঁয়াশাময় অধ্যায় নিয়ে দেশে চর্চার ধরণটা কেমন? আপনার মূল্যায়ন কি?
ড. আকসাদুল আলম : এমন একটি বিষয় উল্লেখ করলেন যে, আমাকে হতাশাজনক কথাই বলতে হবে। আপনি যথার্থই বলেছেন যে, বাংলাদেশের প্রাচীন এবং মধ্যযুগের ইতিহাসের বয়ান নিয়েই মূলত রাজনীতিটা হয়।
দেশ রূপান্তর : এখানে ওই কালক্রম ধরেই তো কে স্থানীয়, কে বহিরাগত, আর্য-অনার্য, মুসলমান-হিন্দু বিভেদমূলক বয়ান তৈরি ও তর্ক হয়। কাউকে বীর, কাউকে দখলদার বলা হয়।
ড. আকসাদুল আলম : ঠিক বলেছেন। ইতিহাসে এই যে ‘গৌরব’ আর ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ আরোপ করা, সেই বয়ানই বাংলাদেশের মূলধারার ইতিহাস চর্চার মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তকগুলোতে। বাংলাদেশের ৫০/৬০ বছরের পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসে খুব একটা পরিবর্তন আনা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে সিলেবাসও মোটাদাগে বলা যেতে পারে যে এটা ৬০/৭০ বছর ধরে প্রায় একই ধরনের। সুতরাং এই সিলেবাসগুলোর দিকে আপনি গভীরভাবে খেয়াল করলে দীর্ঘকাল ধরে পরিবর্তন না করার পেছনের রাজনীতি এবং এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সহজেই টের পাবেন। যে উদ্দেশ্য, আপনি যেভাবে ব্যাখ্যা করলেন- সেখানে রাজা-বাদশাহকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া, কোনো ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-জাতিকে গৌরবান্বিত কিংবা খাটো করা, এই শ্রেষ্ঠত্ব, গৌরব, সেরার স্বীকৃতি তৈরির বয়ানই এখানে ইতিহাসচর্চার নামে চলে আসছে, যা দুঃখজনক। এবং এর গোটা প্রক্রিয়াতেই প্রাচীন এবং মধ্যযুগের ইতিহাসকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করা হয়। দুঃখজনক হচ্ছে বাংলাদেশে প্রাচীন এবং মধ্যযুগের ইতিহাসচর্চায় আমরা ভীষণরকম পিছিয়ে আছি। বাংলাদেশ ৫০ বছর অতিক্রম করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ বছর অতিক্রম করেছে। কিš‘ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগ স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরেও ২/১ জন প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস গবেষক তৈরি করতে পারেনি। অথচ ত্রিশ্ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসে দৃষ্টান্তমূলক গবেষণাকর্ম উপহার দিয়েছে। সেই ধারা বন্ধ হয়ে গেছে স্বাধীন বাংলাদেশে। কেনো এমন হলো তা খতিয়ে দেখা জরুরি।
দেশ রূপান্তর : ঢাবিতে কি প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস এখন আর পড়ানো হয় না?
ড. আকসাদুল আলম : পড়ানো হয়। তবে পরিস্থিতি খুবই নাজুক। এক সময় প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস পঠন-পাঠনের আলাদা আলাদা গ্রুপ ছিল। কিন্তু বিগত ৪০/৫০ বছর যাবত প্রাচীন ও মধ্যযুগের পৃথক দুটি গ্রুপ এক করে একটি গ্রুপ করা হয়েছে। প্রাচীন ইতিহাস গবেষণা, চর্চা ও পঠন-পাঠনের রয়েছে নিজস্ব প্রথা-পদ্ধতি। মধ্যযুগের প্রথা-পদ্ধতিও সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন গ্রুপ এক করে একটি গ্রুপ বানিয়ে পড়ানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদেরকে এই গ্রুপ পড়তে উৎসাহিতও করা হতো না। লিপিতত্ব, মুদ্রাতত্ব, ভাস্কর্যবিদ্যা, জাদুঘরবিদ্যাসহ প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসের অসাম্প্রদায়িক গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ইতিহাস বিভাগের সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে চালু করা হলো প্রাচীন বাংলার কিছু বিষয়াবলী এবং মধ্যযুগের বাংলার কিছু বিষয়াবলী। এর ফলে ঢাবিতে গত ৫০ বছরে প্রাচীন বা মধ্যযুগের ইতিহাসের কোনো সত্যিকারের গবেষক, যেমন প্রত্নতত্ত্ব, এপিগ্রাফি, আইকোনোগ্রাফি জানা কোনো গবেষক তৈরি হয়নি। আপনি সামান্য মনোযোগ দিলে এই পরিস্থিতির পেছনের উদ্দেশ্য ও রাজনীতি বুঝতে পারবেন। পাকিস্তান আমলের ভাবধারায় পরিচালিত ইতিহাস এভাবেই দীর্ঘকাল ধরে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। বর্তমানেও প্রাচীণ ও মধ্য পর্বের গবেষণা হচ্ছে না বললেই চলে। আর এই ব্যর্থতার কারণে যেটি হয়েছে তা হলো একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসের ভিত্তির জায়গা, শিকড়ের জায়গা নিয়ে ইচ্ছেমতো রাজনীতি করার এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী ইতিহাস লেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর খেসারত দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থী, সমাজ এবং দেশকে। প্রাচীন ও মধ্যযুগ নিয়ে এই ৫০ বছরে দুএকটি নোট বই ছাড়া তেমন কোনো কাজই হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসের উপর যে চার খন্ড গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে সেখানে বিষয়ের বৈচিত্র্য রয়েছে বটে কিন্তু ধর্মভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক, রাজবংশভিত্তিক ইতিহাস, সেই পাকিস্তান আমলের প্রচলিত ধর্মভিত্তিক সেই পুরনো বস্তাপঁচা ন্যারেটিভ প্রাধান্য পেয়েছে।
দেশ রূপান্তর : আপনি জানেন স্কুল পর্যায়ে নতুন কারিকুলাম ও পাঠ্যবই এসেছে। সেখানে একপাক্ষিক ইতিহাস নির্মাণের অভিযোগ করছেন কেউ কেউ। আপনি কী মনে করেন?
ড. আকসাদুল আলম : স্কুলের নতুন পাঠ্যবই আমি দেখেছি। পুরো বই প্রণয়নের সঙ্গে থাকতে না পারলেও আমি এর কিছু কিছু পর্যায়ে জড়িতও ছিলাম। আপনি যদি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ের অনুশীলনী খণ্ডে প্রকাশিত ইতিহাসের মাত্র দুটি চ্যাপ্টার একটু কষ্ট করে পড়েন তাহলে দেখতে পাবেন যে, অভিযোগগুলোর সত্যতা সেভাবে নেই। ছোটখাটো কিছু ভুলত্রুটি হয়তো পাওয়া যাবে। ইতিহাসের বয়ান, চিন্তা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে স্বাভাবিকভাবেই পার্থক্য হতে পারে। কিন্তু না পড়ে সম্পূর্ণ কন্টেক্সটাকে সামনে না নিয়ে একদম পছন্দ মতো দু-একটি লাইনকে সামনে এনে যেভাবে আলোচনা হচ্ছে- সেটা আমার কাছে ইতিহাসম্মত মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে রাজনীতি। একটা সামগ্রিক ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন হতেই পারে। সেই আলোচনা যারা করছেন, তথ্য-প্রমাণভিত্তিক ও যুক্তিপূর্ণ হলে সেটা গ্রহণযোগ্যও হতে পারে। নিশ্চয়ই এনসিটিবি সেরকম জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে যদি কোথাও তথ্যগত ভুল থাকে সেগুলো সংশোধন বা সংযোজন করবে।
দেশ রূপান্তর : আগের ইতিহাস বইয়ের সঙ্গে নতুন কারিকুলামের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বই দুটিতে কী ধরনের পার্থক্য রয়েছে?
ড. আকসাদুল আলম : দেখেন আমি এই পাঠ্যপুস্তক যতটুকু দেখার ও পড়ার সুযোগ পেয়েছি, সেখান থেকে পরিষ্কার করে বলতে পারি যে, এতদিন স্কুলের ইতিহাস পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের ইতিহাস সন-তারিখে ভারাক্রান্ত, নাম-যশ-খ্যাতি বিস্তারে ব্যতিব্যস্ত সুদূর ভূ-খণ্ড থেকে আগত ক্ষমতা ও অর্থলিপ্সু রাজা-বাদশাহদের কে কার বাবা, কে কার দাদা, কে কোথায় যুদ্ধ করলেন, কত সালে কোন যুদ্ধ হলো, সেনাপতির নাম, কোন বংশ কোথা থেকে এলো, কোথায় তারা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করলেন ইত্যাদি এমন সব তথ্য দিয়ে বইগুলো লেখা ছিল যে আমাদের শিশুদের কাছে ইতিহাসকে আতঙ্কের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এটা বিগত ৫০/৬০ বছর ধরে বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে চলেছে। এই প্রক্রিয়াটাকে এবারই সম্ভবত প্রথম যে একটু কিছুটা পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা এনসিটিবি করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। আমার ভূল হতে পারে। কিন্তু পাঠ্যক্রম এবার যেভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে সেই প্রক্রিয়াটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে নতুন ধরণের শিখন, পঠন-পাঠন, পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, যার একটা পরীক্ষামূলক সংস্করণ এখন চলছে বলে এনসিটিবি জানিয়েছে, তা নিয়ে অবশ্যই সামগ্রিক একটা আলোচনা হতে পারে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী সমস্যা আছে, স্কুলগুলো তৈরি কিনা, শিক্ষকরা তৈরি কিনা; সেই জায়গাটাতে কিন্তু আমাদের আলোচনাটা হচ্ছে না।আমাদের আলোচনা যেটা হচ্ছে, আমি বলছি না যে সেটার গুরুত্ব নেই, ইতিহাসের যে কোনো আলোচনাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইতিহাসের তথ্যগুলোর ব্যাখ্যা নানা ধরনের হতে পারে। পাশাপাশি, আমি মনে করি আমাদের গুরুত্ব দেওয়া দরকার নতুন পাঠ্যসূচি, নতুন পাঠ্যক্রম পদ্ধতিগুলো নিয়ে। ইতিহাস গবেষক এবং বিদ্যৎ সমাজের সকলেরই এটা নিয়ে কথা বললে ও পরামর্শ দিলে ভালো হয়। একইসঙ্গে পাঠবইয়ে আমাদের ইতিহাসের বয়ান এমন হওয়া প্রয়োজন যাতে করে শিক্ষার্থীরা বিশ^জনীন, উদার, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
দেশ রূপান্তর : এ ক্ষেত্রে নতুন বইয়ে কোন কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এবং কেন? বয়ানের পার্থক্যটা ঠিক কী রকম?
ড. আকসাদুল আলম : বাংলার ইতিহাস বলতে আমরা আসলে কার বিবরণকে বুঝব? আগ্রাসী শাসকদের রাজনীতি, ধর্ম ও ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নাকি স্থানীয় প্রাকৃতজনের জীবন-জীবিকা-নির্মাণ-ধ্বংস-দুঃখ-সুখ, একইসঙ্গে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকা এবং সমাজ-সংস্কৃতি (বি)নির্মাণের অভিজ্ঞতার বিবরণ? আবেগ, বর্ণ, ধর্ম ও জাতিগত পক্ষপাতের বাইরে এসে ভিন্ন ভিন্ন স্থানিক-ভৌগোলিক বাস্তবতায় প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিকূলতা জয় করে সাধারণ মানুষের টিকে থাকার সামষ্টিক ও সামগ্রিক অভিজ্ঞতার বয়াণ আমাদের ইতিহাস পঠন-পাঠনে এবং গ্রন্থে কবে স্থান পাবে? এবারের বইতে রাজা-বাদশা, উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনা নায়কদের বদলে সাধারণ মানুষকে ইতিহাসে সামনে আনা হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।
সাক্ষাৎকারের বাকি অংশ আগামীকাল প্রকাশিত হবে।
এক. বেকারত্বের মিছিলে নতুন সমস্যাতৈরি পোশাক শিল্পে নারীশ্রমিক নিয়োগ কমে যাওয়া। ‘ম্যাপড ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্প মোট ৩ হাজার ৫শটি রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনকারী কারখানার তথ্য সংগ্রহ করে দেখিয়েছে, নারীশ্রমিকদের হার ৫৮ শতাংশ ও পুরুষদের ৪২ শতাংশ। অথচ একটা সময় ছিল নারীশ্রমিক প্রায় ৮০ শতাংশ। করোনাকালে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, মূল্যস্ফীতিতে শহরে বসবাস কঠিন হয়ে পড়েছে, গরিব মানুষ শহর ছাড়ছে বলে পোশাক শিল্পের নারীশ্রমিক সরবরাহ কমছে। এছাড়া আছে কারিগরি সমস্যা। রোবট, কাটিং মেশিন, লেজার মেশিন, অটোমেটিক যন্ত্রপাতি পরিচালনায় নারীদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং দেওয়া হয় না বলে নারীর তুলনায় পুরুষশ্রমিক নিয়োগের হার বাড়ছে।
কমবয়সী নারীর প্রখর আলো, গরম, মাইক্রো ফাইবারের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দীর্ঘ সময়ের শ্রমঘন কাজে নারীর দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যক্ষতি বাড়ছে বলে নারীরা পোশাক শিল্পে আগ্রহ হারাচ্ছেন। প্রান্তিক অর্থনীতির বর্ধিত নারী বেকারত্ব দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে শোচনীয় করবে। এসব কাঠামোগত সমস্যার সমাধান জরুরি হয়ে পড়ছে।
বেসরকারি হিসাবে প্রায় ৬০ লাখ উচ্চ শিক্ষিত বেকার, সঙ্গে শুরু হয়েছে স্বল্প দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমবাজারের বেকারত্ব। একদিকে কর্ম তৈরির সরকারি কৌশল নেই, অন্যদিকে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও ডলার-সংকট, বেসরকারি ঋণ ও বিনিয়োগ খাতে পাচার এবং কেলেঙ্কারিজনিত মন্দার থাবা। দক্ষতা তৈরিতে শিল্পে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা নেই। দেশের বেকারত্বের কেন্দ্রীয় ডেটাবেইস ও চাকরি তৈরির মাসিক ড্যাশবোর্ডও নেই। ফলে সরকার ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বেকারত্ব পরিস্থিতি নিয়ে অন্ধকারে রয়েছে।
সরকার দাবি করেছে, দেশের অর্থনীতি পোক্ত। মানুষের আয় বাড়ছে এবং মাথা তুলছে কর্মসংস্থানের হার। কিন্তু সেই দাবিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে অতিসম্প্রতি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সংসদে জানিয়েছেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও অফিসে বেসামরিক জনবলের ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রয়েছে।
বেকারত্বের সরকারি সংখ্যা যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক সেই প্রশ্নে বাড়াব না। তবে এই দিয়ে ফলপ্রসূ কৌশল তৈরিও অসম্ভব। বেকারত্ব বা কাজের বাজারের পূর্ণাঙ্গ কোনো পরিসংখ্যান সরকারের তরফে প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য, বেকারত্বের হার এখন এই সময়ে বেশি। বেকারত্বের সরকারি সংখ্যাও রেকর্ড করেছে।
দুই. সম্প্রতি বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেখানে অর্থনীতিবিদ ও গণনীতি বিশ্লেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দেশের বেকার যুবকদের সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সর্বশেষ জনশুমারির তথ্যানুযায়ী দেশে এখন পাঁচ কোটি যুবক রয়েছে। এর মধ্যে গড়ে তিনজনের মধ্যে একজন বেকার। বাংলাদেশে কর্মের নিশ্চয়তা দিয়ে একটি আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি।
তার এ বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি সহমত জানাই। একই সঙ্গে মনে করি, কর্মসংস্থান কমিশন গঠনও এখন জরুরি। ওই কমিশন বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবে। তাছাড়া কমিশন স্বয়ংক্রিয় অনলাইন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কর্মপ্রত্যাশী যুবকদের নিবন্ধন নিশ্চিত করে তাদের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও চাহিদা অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থা নেবে।
দেশে যুবসমাজের ভেতরে নানা ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অনেকেই হতাশ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন। অনেকে আবার মাদকাসক্তসহ নানা ধরনের উগ্রবাদী চিন্তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এটি আমাদের জন্য বড় ধরনের অ্যালার্মিং বিষয়। এসব থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করতে হলে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। অনেক দেশে যুবক ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও সেটি সম্ভব।
তিন. বাংলাদেশের চাকরি বাজারে আগে থেকেই দক্ষ জনবলপ্রাপ্তির সমস্যা রয়েছে। বাজার চাহিদার সঙ্গে শিক্ষার কোর্স-কারিকুলামের সংযোগ স্থাপিত হয়নি বলে এক পদের বিপরীতে শত শত আবেদনকারী থাকেন, কিন্তু যোগ্য ও দক্ষ রিসোর্স পাওয়া যায় না। অন্যদিকে দেশের প্রায় ৮৫ থেকে ৮৯ শতাংশ শ্রমবাজার অপ্রাতিষ্ঠানিক। ফলে চাকরি বাড়াতে বেসরকারি খাতে সত্যিকার বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ দরকার, এমন স্বচ্ছ উদ্যোগ যেখানে বিনিয়োগের নামে ঋণ নিয়ে সেটা পাচার কিংবা ভোগে ব্যয় হবে না। সরকারকে ক্ষুদ্র, এসএমই ও বৃহৎ ব্যবসা ও শিল্পের ভালো ব্যবসায়ীর ডেটাবেইস তৈরি করতে হবে, যারা ঋণ নিয়ে কিস্তি ফেরত দেন ও ব্যবসা করেন। তথ্যশালার আলোকে ক্রেডিট রেটিং-ভিত্তিক আধুনিক ঋণদান ব্যবস্থা দরকার। ব্যাংক ঋণ দানের ডিজিটাল ফিনটেক সমাধান ও আর্থিক তথ্যনির্ভর নতুন ডিজিটাল কৌশল বের করাও জরুরি। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, ক্ষুদ্র বা ব্যাস্টিক অর্থনীতির চাকরি বাঁচানো মন্দাকবলিত অর্থনীতির বড় কাজ। প্রশাসনের দুর্নীতি ও সরকারের অপখরচের লাগাম টেনে ধরে সামাজিক নিরাপত্তা ও চাকরি বাড়ানোর উদ্যোগ চাই।
চার. চাকরির জন্য ভিড় বাড়ছে। কিন্তু চাকরি বাড়ছে না। যে অর্থনীতি আয়ের সুযোগ দিতে পারে না, তা কোন অর্থে স্বস্তিদায়ক? শিক্ষা শেষে কাজে যোগ দিতে না পারা মানে শিক্ষিত মানুষের কর্মক্ষমতার অপচয়। অবসরের গড়পড়তা বয়স ৬০ বছর। তাই চাকরি পেতে যত দেরি হবে, তত অপচয় হবে কর্মক্ষমতার। যা দেশের সব থেকে মূল্যবান সম্পদ। বেকারত্বের কারণে মানবসম্পদের অপচয় আখেরে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই জনবহুল দেশের যুবসমাজকে শুধু চাকরির ওপরে নির্ভর করে না থেকে স্বনির্ভর হওয়ার প্রয়োজন। শিক্ষাগত ডিগ্রি অর্জন নয়, হাতেকলমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো জরুরি।
লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন
রাজনীতিতে একসময় আইনজীবী ও রাজনীতিবিদদের প্রাধান্য ছিল। সময়ের পরিবর্তনে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের পদচারণা বেড়েছে। জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ার প্রবণতা এখন আর নতুন কিছু নয়। বামপন্থিদের সভা-সমাবেশে মাঝেমধ্যে আগে শোনা যেত, এখন সেটাও কমে এসেছে। বরং এখন রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য নিয়েই বিভিন্ন মহলে আলোচনা আছে। শনিবার দেশ রূপান্তরে ‘রাজনীতিতে ব্যবসায়ী রাজ’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘বড়, মধ্যম ও ছোট ব্যবসায়ীরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রায় সব রাজনৈতিক দলেই দলীয় পদ-পদবি পাওয়া শুরু করেছেন। এ তিনটি দলে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে ব্যবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে শুরু করেছেন।’ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের হলফনামায় উল্লিখিত পেশা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৬১ শতাংশ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী। বাংলাদেশের প্রথম সংসদে এ হার ছিল ১৮ শতাংশ। একাদশ সংসদে পেশায় রাজনীতি এমন সংসদ সদস্য আছেন মাত্র ৫ শতাংশ। দলভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ও শরিক দলের সদস্যদের ৫৯ শতাংশ ব্যবসায়ী। অন্যদিকে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ৫৬ শতাংশ সংসদ সদস্যই ব্যবসায়ী। অন্য সব পেশা মিলিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন ২১ শতাংশ। অন্য পেশা মানে শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা, গৃহিণী ও পরামর্শক। ৭৩-এর পরের জাতীয় নির্বাচনগুলোতে সমাজসেবী, কৃষিজীবী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও অন্যান্য পেশার প্রতিনিধিত্ব সংসদে কমেছে। একমাত্র ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে সংসদে।
পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজনীতি ও অন্যান্য পেশার সংসদে প্রতিনিধিত্ব কমতে থাকলেও ব্যবসায়ীদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বেড়েছে। পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের ১৭তম লোকসভায় সংসদ সদস্যদের মধ্যে রাজনীতিক ৩৯ শতাংশ আর ব্যবসায়ী ২৩ শতাংশ। অন্যান্য পেশার সংসদ সদস্য রয়েছেন ৩৮ শতাংশ। বিভিন্ন দল ও পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব এমন পর্যায়ে চলে গেছে, যা দেখে বলা যায় রাজনীতিকদের ভেতরে হতাশা জেঁকে বসেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, শুধু সংসদ সদস্যই নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে গঠিত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্বেও থাকছেন ব্যবসায়ীরা।
প্রবীণ রাজনীতিক পংকজ ভট্টাচার্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে সব পেশার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও প্রতিনিধিত্ব ছিল। পার্থক্য হলো এখন রাজনীতি ও সংসদে অন্য পেশার লোকের সুযোগ কমে যাচ্ছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন আইনজীবী অথবা পেশাদার রাজনীতিক। তবে ব্যবসায়ী, কৃষক, সেনা কর্মকর্তা, অধ্যাপক বা এমনকি অভিনয় পেশার লোকজনও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এত পেশার লোকজনের ভিড়ে কারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভালো করেছেন তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে জরিপ হয়েছে। এসব নানা জরিপ বিবেচনায় নিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর এক সাবেক কর্নেল উইলিয়াম জি ক্যাম্পবেল জানিয়েছেন, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ব্যবসায়ী পেশা থেকে যারা এসেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তারা খুব খারাপ করেছেন। থাইল্যান্ডের সফল ব্যবসায়ী থাকসিন সিনাওয়াত্রা দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে সফল হতে পারলেন না।
রাজনীতিতে কোনো পেশার লোকজনের দাপট বাড়ছে বা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে চলে যাচ্ছে সেটা অবশ্যই আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণার বিষয়। দেশের গণতন্ত্রের মান, অবস্থা ও এর ভবিষ্যতের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সম্প্রতি বলেছিলেন, ‘রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে। এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়।’ বিশ্বের সব দেশেই রাজনীতিবিদ ও দলগুলোর চাঁদা ও অনুদানের বড় অংশের জোগান দেয় ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজনীতি এভাবে ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যাওয়া দেশ, দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। নির্বাচনের খরচ দিনে দিনে যত বেড়েছে, নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে ব্যবসায়ীদের দামও তত বেড়েছে। দলগুলোতে মনোনয়ন-বাণিজ্যের সংস্কৃতিও শুরু হয়েছে এসব কারণেই। অন্যদিকে নির্বাচিত হওয়া মানেই ব্যাংক, বীমা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হওয়ার পথ খুলে যাওয়া। রাজনীতিই এখন বিনিয়োগের বড় ক্ষেত্র ও ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। শুধু ব্যবসায়ীরাই যে রাজনীতিতে আসছেন বা রাজনীতি দখল করে নিচ্ছেন তাই না, পেশাদার রাজনীতিকরাও রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসায় জড়াচ্ছেন। নির্বাচন করে জেতার পর ব্যবসা করাটা এখানে খুব সহজ হয়ে যায়। কোনো দেশে রাজনীতিই যদি একটা ব্যবসায় পরিণত হয়, তবে সে দেশের রাজনীতিকে ব্যবসায়ীদের পকেট থেকে বের করে আনা কি আদৌ সম্ভব!
১৫৯২ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি, লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন প্রখ্যাত মোগল সম্রাট শাহজাহান। শৈশবে সম্রাট জাহাঙ্গীরের এই পুত্রের ডাকনাম ছিল খুররম। সিংহাসনে আরোহণের পর তার নতুন নাম হয় ‘আবুল মুজাফফর শিহাবুদ্দিন মুহম্মদ শাহজাহান সাহিব কিরান-ই-সানী’। মোগল সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে তিনি ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছেন। তিনি ছিলেন বাবর, হুমায়ুন, আকবর এবং জাহাঙ্গীরের পরে পঞ্চম মোগল সম্রাট। শাহজাহান অনেক শোভামণ্ডিত স্থাপনা তৈরি করেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত আগ্রার তাজমহল যা তার স্ত্রী মমতাজ মহলের সমাধি হিসেবে পরিচিত। অন্যান্য স্থাপত্যকীর্তির মধ্যে রয়েছে দিল্লি জামে মসজিদ, সিন্ধুর শাহজাহান মসজিদ, লাহোরের মতি মসজিদ, লাহোরের শালিমার গার্ডেন ইত্যাদি। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যায় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষের পরপরই উড়িষ্যায় ব্যাপক মড়ক দেখা দেয়। এই সময়, শাহজাহান সাত লাখ টাকার রাজস্ব মওকুফ করে দেন এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় লঙ্গরখানা খোলা হয়। মোগল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের বদান্যতায় পর্তুগিজরা এখানে কুঠি সম্প্রসারিত করে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করতে থাকে। তাদের দমনে ভূমিকা রাখেন সম্রাট শাহজাহান। অন্যদিকে, শাহজাহান সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকে আসাম ও আরাকানে রাজ্য বিস্তারের নীতি অনুসরণ করেন। উত্তরাধিকারী নিয়ে অনেক নাটকীয়তা ও লড়াইয়ের পর পুত্র আওরঙ্গজেব সিংহাসনে আরোহণের ৮ বছর পর ১৬৬৬ সালের ২২ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন সম্রাট শাহজাহান।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনকে বলা হয় ‘লাশের সাক্ষ্য’। সেই প্রতিবেদনে প্রায়ই ভুল থাকছে। হত্যা হয়ে যাচ্ছে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা। দেশের মর্গগুলোর আধুনিকায়ন না হওয়া, চিকিৎসকদের অদক্ষতা এবং মর্গে আসার আগেই মরদেহের আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ভুলের অন্যতম কারণ। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য এরকমই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের বেশিরভাগ মর্গে মরদেহের ভিসেরা বা বিভিন্ন নমুনা সংরক্ষণের আধুনিক সুবিধাসংবলিত জায়গা নেই। এসব ধারণের জন্য কনটেইনার, প্রিজারভেটিভ বা রাসায়নিকের সরবরাহও প্রয়োজনের তুলনায় কম। অনেক সময় প্রিজারভেটিভ না থাকলে লবণ পানির সাহায্যে মর্গে লাশ সংরক্ষণ করা হয় এবং হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল ল্যাবে যেসব স্যাম্পল বা নমুনা পাঠানো হয়, সেসব ভালোমানের ফরমালিন দিয়ে সংরক্ষিত করে পাঠানো হয় না। ফলে আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও ভুলের আশঙ্কা বাড়ে। কখনো চিকিৎসক প্রভাবিত হয়েও ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেন।
ময়নাতদন্তসংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলেন, আমাদের দেশে আধুনিক মর্গ ব্যবস্থাপনা নেই। তাছাড়া লাশ মর্গে আসার আগেই অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে প্রথমে থানায় নেয়; তারপর থানা থেকে নেয় মেডিকেল কলেজে। এরপর অ্যাম্বুলেন্স, লেগুনা বা ট্রাকে বা ভ্যানে করে আনে মর্গে। এত আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। এসব কারণে ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসে।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ময়নাতদন্তের ভুল প্রতিবেদনের প্রধান কারণ আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আধুনিক মর্গের অভাব। দ্বিতীয় কারণ, লাশ যখন আমাদের কাছে আসে তখন আমরা সিন অব দ্য ক্রাইম (অপরাধের দৃশ্য) ভিজিট করি না। ফলে অনেক ইনফরমেশন ধরা পড়ে না। উন্নতবিশ্বে কোথাও অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে পুলিশ ওই স্থানকে হলুদ টেপ দিয়ে ঘিরে রাখে এবং সবার আগে ভিজিট করে একজন ফরেনসিক স্পেশালিস্ট। ওখান থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগৃহীত হয়ে মর্গে চলে আসে। মর্গে লাশ পাঠায় পুলিশ, পরে পোস্টমর্টেম করে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে মরদেহের ফাইন্ডিংস মিলিয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। সেটাই সঠিক ও নির্ভরযোগ্য হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমন হয় না।’
ময়নাতদন্ত কী : খুন বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর ভুক্তভোগীর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানার জন্য একজন ফরেনসিক চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ মরদেহের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অঙ্গ বা অঙ্গবিশেষের গভীর নিরীক্ষণ করেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে মন্তব্যসহ যে প্রতিবেদন দেওয়া হয় তাই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মনে করেন, ময়নাতদন্ত হওয়া জরুরি, তখন মৃতদেহ সিভিল সার্জন বা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়।
সম্প্রতি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা ও রেল দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কথা উল্লেখ থাকা ২২টি মামলা তদন্ত করে পিবিআই জানায়, এগুলো ছিল পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। ওই মামলাগুলোতে পুলিশের অন্যান্য সংস্থা তদন্ত করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল।
পিবিআইপ্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হত্যা বা অপমৃত্যুর মামলার তদন্তে ময়নাতদন্তের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভালো ময়নাতদন্ত মামলার রহস্য উদঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে ময়নাতদন্ত সঠিক না হলে তদন্ত ভিন্ন পথে মোড় নেয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করে, ঘটনার রহস্য উদঘাটনে দারুণভাবে সহায়তা করে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিটফোর্ড বা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে ২০২১ সালে ৭৪০টি, ২০২২ সালে ৬০০টি ও চলতি বছর ১৫ মে পর্যন্ত ১৪৫টি মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। গত ১৫ মে দুপুরে সেখানকার মর্গে গিয়ে দেখা গেছে জরাজীর্ণ দশা। দুটি মরদেহ পড়ে আছে পোস্টমর্টেমের অপেক্ষায়। মর্গ সহকারী নাম প্রকাশ না করে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মর্গের লাশ রাখার একমাত্র ফ্রিজটি তিন বছর ধরে নষ্ট। ময়নাতদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় মালামালের সংকট সবসময়ই থাকে। নেই আধুনিক কোনো সুবিধা। তিনজন মর্গ সহকারীই বছরের পর বছর চুক্তিভিত্তিতে কাজ করছেন।’
জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য মর্গের দশা একই।
ময়নাতদন্ত সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে পিবিআইয়ের এক প্রতিবেদনে দেশের মর্গসংশ্লিষ্টদের ফরেনসিক বিষয়ে আধুনিক ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণের অভাব, বিশেষজ্ঞ ফরেনসিক চিকিৎসকের তুলনায় লাশের সংখ্যা বেশি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও হিমাগারসহ মানসম্মত অবকাঠামো না থাকাকে ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ডোমের স্বল্পতা, জটিল ও চাঞ্চল্যকর মরদেহের ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত না করা, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা থাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ময়নাতদন্ত কাজে অংশ নিতে চান না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ময়নাতদন্ত বিষয়ে পিবিআইয়ের প্রতিবেদন ও দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মর্গগুলোতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ও আলোর ব্যবস্থাসহ আধুনিক অবকাঠামো ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। অনেক জেলায় মর্গে বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে জেনারেটর নেই। অনেক জেলায় মর্গে পর্যাপ্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নেই। বংশ পরম্পরায় মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ডোমরা ময়নাতদন্তের সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও তাদের কোনো মৌলিক প্রশিক্ষণ নেই। তাছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ ব্যস্ত মর্গগুলোতে মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্টদের স্বল্পতা প্রকট। অনেক জায়গায় দেখা গেছে, লাশ সংরক্ষণের সুরক্ষিত পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাব। বিদেশি নাগরিক ও বিশেষ ক্ষেত্রে মরদেহ প্রচলিত নিয়মে হিমঘরে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে। অল্পসংখ্যক মর্গে কুলিং বা ফ্রিজিং বা মর্চুয়ারি কুলার সিস্টেম থাকলেও অধিকাংশ সময় নষ্ট থাকে বলে গরমের সময় লাশে দ্রুত পচন ধরে।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর সম্ভাব্য সময়ের উল্লেখ থাকা জরুরি। মর্গে আধুনিক প্রযুক্তি না থাকায় অভিমত প্রদানে বিশেষজ্ঞদের সমস্যা হয়। পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ১ জুন রাজধানীর কলাবাগান থানা এলাকায় নিজ বাসা থেকে ডা. কাজী সাবিরা রহমান লিপির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি খুন হয়েছিলেন। মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে। খুনের ধরন মোটামুটি স্পষ্ট হলেও ঘটনার রহস্য উন্মোচনে খুনের ‘সম্ভাব্য সময়’ জানার জন্য পিবিআই ঢামেক ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকদের সুযোগ-সুবিধা কম হওয়ায় চিকিৎসা শিক্ষায় এ শাখাটি অবহেলিত এবং কম গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। ফলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ ফরেনসিক ডাক্তারের স্বল্পতা রয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে আরেকটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, সিএমএম আদালতের নির্দেশে ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগরের লালমোহন থানা এলাকা থেকে কামাল মাঝির (৪৫) ৩৮ মাসের পুরনো মরদেহ তুলে ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যায়। সেখানে কর্মরতদের কারও এ ধরনের মরদেহের ময়নাতদন্তের অভিজ্ঞতা না থাকায় মরদেহটি ভোলা থেকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে নেওয়া হয়। দায়িত্বরত প্রভাষক জানান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের পদে কেউ কর্মরত নেই। তিনি মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য অন্য কোনো মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে নেওয়ার অনুরোধ করেন। পিবিআই মরদেহটি বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সংশ্লিষ্ট বিভাগে নিয়ে যায়।
হত্যা কেন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা হিসেবে আসে জানতে চাইলে ফরেনসিক চিকিৎসকরা জানান, কাউকে হত্যা করে রেললাইনে ফেলে রাখলে তার ওপর দিয়ে ট্রেন গিয়ে একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে হাড়গোড় বেরিয়ে দলিত হয়ে যায়। একে চিকিৎসাশাস্ত্রে মিউটিলেডেট লাশ বলে। ওইসব লাশের আলামত বোঝা যায় না। আগের আলামত নষ্ট হয়ে নতুন আলামত তৈরি হয়। তখন রেল দুর্ঘটনাই মনে হয়। এতে অনেক সময় চিকিৎসকরা মিসগাইডেড হয়।
ফরেনসিক বিভাগে চিকিৎসকের সংকট বিষয়ে এক চিকিৎসক বলেন, ‘আমি ঢাকায়ে আছি, অথচ আমাকে কক্সবাজার বা পঞ্চগড় গিয়ে স্বাক্ষর দিতে হচ্ছে। বাইরে যাওয়ার, বিশেষ করে একা, বিপদ আছে অনেক, সংক্ষুব্ধ পক্ষ হামলা চালাতে পারে। এজন্য অনেক চিকিৎসক এ বিভাগে থাকতে চান না। এখানে সুবিধাও অনেক কম। মফস্বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসককে মিসগাইড করে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে রিপোর্ট লেখানো হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ফ্যাটি লিভার রোগটি এখন ঘরে ঘরে। প্রাথমিকভাবে এই রোগের লক্ষণ না বুঝতে পারলে, অনেক সমস্যাই দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকরা জানান, এই রোগ থেকে বাঁচতে জীবনধারায় বদল আনতে হবে।
কোন কোন উপসর্গ দেখলে সতর্ক হবেন? শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, হঠাৎ ভুঁড়ি বেড়ে যাওয়া, হলুদ রঙের দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব, ওজন অত্যন্ত বেড়ে যাওয়া, সারাক্ষণ ক্লান্তিভাব— এই উপসর্গগুলি ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ হতে পারে। অনেকের ধারণা, মদ্যপান করলেই এই রোগের ঝুঁকি বাড়ে। তবে কেবল মদ্যপান ছেড়ে দিলেই এই রোগের ঝুঁকি কমবে না। কম তেলমশলার খাবার খাওয়া, বাড়ির খাবারে অভ্যস্ত হওয়া, মদ ছেড়ে দেওয়া— এই অভ্যাসগুলিই লিভারকে ভাল রাখার অন্যতম উপায়। এই অসুখকে ঠেকিয়ে রাখতে ডায়েটের ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। তবে এগুলিই শেষ কথা নয়। লিভার ভাল রাখতে মেনে চলতে হয় আরও কিছু নিয়মকানুন। কিন্তু কী কী?
চিনির মাত্রা কমানো
সহজে রোগা হতে চেয়ে অনেকেই নিজের খুশি মতো ডায়েট প্ল্যান বানিয়ে নেন। চিনি বাদ দিয়ে দেদারে কৃত্রিম চিনির উপরেই ভরসা করেন। এতেই আসলে চরম ক্ষতি করছেন শরীরের। অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার অভ্যাস আমাদের লিভারের ব্যাপক ক্ষতি করে। ফ্রুকটোজ হোক কিংবা কৃত্রিম চিনি, লিভারের অসুখ ডেকে আনে।
ব্যথার ওষুধ কম খান
বেশকিছু বেদনানাশক ওষুধ লিভারের ক্ষতি করে। কিছু প্যারাসিটামল বা কোলেস্টেরলের ওষুধও লিভারের প্রভূত ক্ষতি করে। ঘুম না হলে অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ খেতে শুরু করেন। এই অভ্যাসের কারণে লিভারের জটিল রোগে ভুগতে হতে পারে।
পানি বেশি করে খান
শরীর থেকে যতটা দূষিত পদার্থ বার করে দিতে পারবেন, লিভার ততটাই সুস্থ থাকবে। তাই বেশি করে পানি খেতে হবে। তবেই প্রস্রাবের সঙ্গে শরীরের টক্সিন পদার্থগুলি বেরিয়ে যাবে। দিনে কয়েক বার গরম পানিতে পাতিলেবুর রস দিয়ে সেই পানি খান। ডায়েটে রাখুন টক দইয়ের মতো প্রোবায়োটিক।
পর্যাপ্ত ঘুম
সারাদিন কর্মব্যস্ততা আর রাত জেগে মোবাইলে চোখ রেখে সিনেমা দেখা— সব মিলিয়ে ঘুমের সঙ্গে আপস। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দীর্ঘদিন ঘুমের অভাব হলে তার প্রভাব পড়ে লিভারের উপরেও।
ওজন কমান
শুধু সুন্দর দেখানোর জন্যই নয়, লিভার সুরক্ষিত রাখতে চাইলেও কিন্তু ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আমাদের শরীরে কার্বহাইড্রেট-প্রোটিন-ফ্যাটের সঠিক ভারসাম্য থাকা ভীষণ জরুরি। তবে ইদানিং বাড়ির খাবার নয়, বরং রেস্তোরাঁর খাবার, রেড মিট, বাইরের ভাজাভুজি, প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খেয়ে অভ্যস্ত। আর এর জেরেই শরীরে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা বাড়ছে। লিভারের পক্ষে এই ফ্যাট মোটেই ভাল নয়।
দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী লিমিটেড ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের মধ্যকার ফেডারেশন কাপ ফুটবলের ফাইনাল দেখতে কুমিল্লায় উড়ে গেছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন।
কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে আজ বেলা ৩টা ১৫ মিনিটে শুরু হয়েছে ম্যাচটি। সালাউদ্দিন ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা খানেক আগে কুমিল্লায় পৌঁছান।
ঢাকা থেকে সড়ক পথে কুমিল্লায় পাড়ি দিতে মাত্র দুই ঘণ্টা সময় লাগে। তবে সালাউদ্দিন দূরত্বটা পাড়ি দিয়েছেন হেলিকপ্টারে করে। যা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
টাকার অভাবে কদিন আগে নারী ফুটবলারদের অলিম্পিক বাছাইয়ে পাঠায়নি বাফুফে। অথচ ঢাকা থেকে কুমিল্লায় যেতে বাফুফে সভাপতি বেছে নিলেন হেলিকপ্টার।
হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে কুমিল্লার এই যাত্রায় বাফুফে সভাপতির সঙ্গী হয়েছেন সংস্থার নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ।
প্রথম সেট ২৫ মিনিট, দ্বিতীয়টি ২৮ মিনিটে জিতলেন কার্লোস আলকারাজ। মনে হচ্ছিল কোয়ালিফায়ার ফ্যাভিও কোবোলিকে বুঝি উড়িয়েই দিচ্ছেন শীর্ষ বাছাই।
না, তৃতীয় সেটতে প্রতিরোধ গড়লেন ইতালিয়ান। সময় গড়ালো ঘন্টায়। শেষপর্যন্ত জয় এসেছে ৬৬ মিনিটে। ৬-০, ৬-২, ৭-৫ গেমে প্রথম রাউন্ডের ম্যাচ জিতে রাফায়েল নাদালের উত্তরসুরি ক্লে কোর্টের সর্বোচ্চ আসর শুরু করলেন।
নাদালের চোটজনিত অনুপস্থিতিতে শীর্ষবাছাই আলকারাজ। ২০২১ এ তৃতীয় রাউন্ড, গতবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন। এবার আরো এগোলে সেমিফাইনালে নোভাক জকোভিচের সংগে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা।
সে দেখা যাবে। আপাতত দ্বিতীয় রাউন্ডে আলকারাজকে টপকাতে হবে জাপানের টি. দানিয়লেকে।
আইপিএলের পঞ্চম শিরোপা জিততে চেন্নাই সুপার কিংসের চাই ১৫ ওভারে ১৭১ রান। আহমেদাবাদে রাত ১২.৪০ মিনিটে শুরু হবে খেলা। গুজরাট টাইট্যান্সের ২১৪ রানের জবাবে খেলতে নেমে ৩ বলে ৪ রান করার পর বৃ্স্টিতে বন্ধ হয় ফাইনাল। অর্থাৎ বাকি ১৪.৩ ওভারে আরো ১৬৭ রান চাই ধোনীর দলের।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নির্মিত হয়েছে বিশেষ কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘ও ভোরের পাখি’। ঈমাম হোসাইনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করেছেন তামান্ন তিথি। অনুষ্ঠানটিতে আবৃত্তি করেছেন আশরাফুল আলম, মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, পলি পারভিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, আসলাম শিশির, সংগীতা চৌধুরী, আহসান উল্লাহ তমাল। প্রচারিত হয় ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টায়।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমারে দেবো না ভুলিতে’। অনুষ্ঠানটিতে গান, কবিতা ও আলোচনার সমন্বয়ে কবিকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ইয়াসমিন মুসতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, শেলু বড়ুয়া, ছন্দা চক্রবর্ত্তী ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন প্রফেসর মুন্সী আবু সাইফ। মনিরুল হাসানের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে ২৫ মে দুপুর ১ টা ০৫ মিনিটে। আরও প্রচারিত হবে সংগীতানুষ্ঠান ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘সন্ধ্যামালতী’। রাত ৯টায় প্রচারিত হবে নাটক ‘বনের পাপিয়া’ (পুনপ্রচার)।