
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করছেন ড. আকসাদুল আলম। বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চার রাজনীতি, ধারা, গতি-প্রকৃতি এবং স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইতিহাস পঠন-পাঠনের সংকট ও করণীয় নিয়ে একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
(গতকাল রবিবার ‘মূলধারার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্ব আরোপের বয়ানই চলছে’ শিরোনামে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের পরের অংশ)
দেশ রূপান্তর: আমাদের এখানে বিভিন্ন শাসক, সেনাপতি এসেছেন, অভিযান চালিয়েছেন। আগের পাঠ্যবইয়ে কারও অনুপ্রবেশ বা আগমনকে ‘বাংলার জয়’ বলা হয়েছে, কারও আগমনকে ‘দখল’। তো নতুন বইতে এই জয় ও দখলকে কীভাবে ডিফাইন করা হয়েছে?
ড. আকসাদুল আলম: দেখুন, এই বিজয় এবং দখল দুটোই কিন্তু দুটো আলাদা পার্সপেক্টিভে সঠিক হতে পারে। প্রশ্নটা দাঁড়াচ্ছে, আপনি ইতিহাসের ন্যারেটিভটা কীভাবে চিন্তা করছেন, তার ওপর। ইতিহাসের কোন কোন তাত্ত্বিক কাঠামো ও চিন্তা কাঠামোতে আপনি কোন ভূখণ্ডের কোন মানুষের জন্য কখন এবং কীভাবে লিখছেন, তার ওপর। সুতরাং দেখুন, একজন ব্যক্তির কোনো কর্মকাণ্ড দখলও হতে পারে, আবার বিজয়ও হতে পারে। আমরা যদি বলি, বাংলা বা বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস, বাংলাদেশ, তার প্রাচীন ও মধ্যযুগ এই সময়গুলোর ইতিহাস স্থানিক এবং কালিক মানদণ্ডে আপনাকে বুঝতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আইনগত সীমানা মাথায় রেখে আপনি তো প্রাচীন ও মধ্যযুগের, এমনকি ১৯৪৭-পূর্ব সময়ের ইতিহাস বুঝতে পারবেন না। ১৯৪৭-পূর্ববর্তী সময়ের ইতিহাস আপনাকে একটা বড় আঞ্চলিক ভূখণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে হবে। যেখানে হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় বাংলা ভাষা এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যে নির্দিষ্ট ভূখন্ডের রয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট নয়, প্রকৃতি কর্র্তৃক নির্ধারিত সীমানা, সেইখানে আপনাকে যেতে হবে। তো আপনি যখন সেখানে গেলেন, সেইখানে কিছু মানুষ আছে, তারা জীবনধারণ করছে, তাদের খাদ্যাভ্যাস, তাদের অর্থনৈতিক জীবন, তাদের বেঁচে থাকা, তাদের ভাষা, যোগাযোগ এবং ভূপ্রাকৃতিক বিবেচনায় রয়েছে স্থানিক নানারকমের চ্যালেঞ্জ। বাংলা অঞ্চলে ইতিহাস ও সভ্যতা নির্মাণের আদিপর্বে চ্যালেঞ্জগুলো ছিল বহুবিচিত্র। ছিল জল-জঙ্গলের প্রতিকূলতা, নিয়মিত বন্যা ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, সাপ, বাঘের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ। প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা, ধর্ম বা কোনো প্রথা পদ্ধতির সঙ্গে এই মানুষের কোনো যোগাযোগই ছিল না। পাহাড়, নদী, জঙ্গল এই মানুষকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে বহুকাল। তো এই সাধারণ মানুষকে যদি আপনি বিচার-বিবেচনায় নেন, তাহলে এবার আপনাকে ধরতে হবে যে, বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অধীন মানে আমি বলতে চাচ্ছি স্ট্রাকচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ, স্ট্রাকচারাল রিলিজিয়ন, পলিটিকস নিয়ে তথাকথিত অভিজাত বা এলিট ক্লাস পিপলের যারা ঢুকছেন তারা বহুদূরের ভূখণ্ড হতে আগত, তারা বাংলার ভৌগোলিক সীমানার বাইরের কোনো ভূখন্ড থেকে তাদের রীতিনীতি, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে প্রবেশ করছেন, কিছুটা পড়ালেখা জানা, কেউ ব্যবসায়ী, কেউবা ভাগ্যান্বেষী, কেউ আবার অর্থ এবং ক্ষমতালিপ্সু। এখানে ঢুকে যদি এমন হয় যে, তারা এখানকার ক্ষমতা নিয়ে নিজেদের উচ্চাকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করছেন, তাহলে বাংলা ভূখ-ে বসবাসকারী মানুষের প্রেক্ষাপটে, মানদ-ে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আপনি যদি বলতে চান; তাহলে তো আপনাকে বলতে হবে যে, বহুদূরের ভূখণ্ড থেকে এসে তারা বাংলা ভূখণ্ডে আদি বসতি স্থাপনকারী মানুষ এবং তাদের ভূখণ্ডের ওপর দখলদারিত্ব করছে, আধিপত্য স্থাপন করছে। এই যে, যারা দখল করছেন তাদের উৎকীর্ণ করা লিপি, তাদের লেখা গ্রন্থ কিংবা অন্যান্য উৎসতে কিন্তু এসব ঘটনা বিজয় হিসেবে চিত্রিত হয়েছে।
বাংলা অঞ্চলে কিন্তু অপেক্ষাকৃত বহু পরে ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম-সংস্কৃতি ও রাজনীতি প্রবেশ করেছে। এটাকে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বলতে পারেন বিজয়। আর বাংলা অঞ্চলের বেদ ও ব্রাহ্মণ্য-পূর্বকালীন ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষেরা বলবেন আগ্রাসন, আধিপত্য বা দখল। সমুদ্রগুপ্ত, হর্ষবর্ধন, শশাঙ্ক, ধর্মপাল, বিজয় সেনকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা হিসেবে প্রমাণ করার বয়ান এখানে চলছে। পরবর্তীকালে একই ধারায় চলছে তুর্কি-আফগান, পারস্য, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান থেকে আগত মুসলিম শাসকদের নিয়ে একই ধারায় ইতিহাসের বয়ান। বাংলাদেশের ৫০ বছর ধরে বহুদূরের ভূখণ্ড থেকে আগত এসব ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম-সংস্কৃতি ও শাসক বংশ, বৌদ্ধ ধর্ম-সংস্কৃতি ও শাসক বংশ, পরবর্তীকালে মুসলিম শাসক বংশ এবং তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির গৌরব আর বিজয়ের বয়ান পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হচ্ছে। ধরুন, হর্ষবর্ধন। তার সভাকবি একটি বই লিখেছেনহর্ষচরিত। সেখানে বানভট্ট এবং হর্ষের লিপিতে লেখা হয়েছে, হর্ষবর্ধন গৌড়কে পৃথিবীশূন্য করে দেবেন। শশাঙ্কের দিক থেকে এটাকে দখলের চেষ্টাই বলা হয়ে থাকে। সুতরাং এই দখল এবং বিজয় কথাটা কিন্তু একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। স্থানিক এবং পার্সপেক্টিভগত দিক থেকে বদলে যেতে পারে। এটা ইতিহাসবিদ এবং যারা লিখছেন তাদের ওপর নির্ভর করে যে, তারা কীভাবে, কখন, কোন তাত্ত্বিক কাঠামো এবং উৎস ব্যবহার করে একটি ভূখন্ডের মানুষের ইতিহাস লিখছেন।
দেশ রূপান্তর: ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির ইতিহাসও কি তাই?
ড. আকসাদুল আলম: একদমই তাই। আপনি যদি ধরেন প্রাচীনকালের রাজা, মধ্যযুগের রাজা, যদি বলেন ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক, যদি বলেন বৌদ্ধ শাসক, ইসলাম ধর্মের অনুসারী শাসক যারা ছিলেন তারা... প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এই কথাগুলো প্রযোজ্য। এখন আপনি হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান এইভাবে রাজাদের পরিচয় দেবেন, নাকি আপনি এই রাজাদের অভিজাত সম্প্রদায়, নাম-যশ-খ্যাতি বিস্তারে ব্যতিব্যস্ত অর্থসম্পদলিপ্সু একধরনের ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বলে পরিচয় দেবেন এটা আপনার নিজস্ব রাজনীতি। আপনি কী নামে পরিচয় দেবেন, এটা আপনার ওপর নির্ভর করে। ইতিহাসবিদের গবেষণা, মেথড, চিন্তাধারা এবং তত্ত্ব-কাঠামোর ওপর নির্ভর করে। আপনি ধর্মকে আশ্রয় করে যখন পরিচয় দেবেন, তখন জিনিসটা কী হচ্ছে দেখেন। বাংলায় যেসব মুসলমান শাসক ছিলেন তাদের ওপর দিল্লির মুসলমান শাসকগণ তো নিয়মিত আক্রমণ চালিয়েছে, অত্যাচার করেছে, বারবার এসে এখানে যুদ্ধ করেছে, ধ্বংস করেছে এগুলোকে কী বলবেন? এখানে তো একজন মুসলমান শাসক আরেকজন মুসলমান শাসকের ওপর এসে আক্রমণ করেছে, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছে। সুতরাং আপনি তাদের কি মুসলমান, ইসলাম নাম দিয়ে পরিচয় দেবেন; নাকি আপনি তাদের বলবেন যে, তারা হলেন রাজা, সম্রাট, সুলতান, নবাব ইত্যাদি। তারা ক্ষমতালোভী, তারা অভিজাত... কী বলবেন আপনি? এখানেই হচ্ছে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিগত বিষয়।
দেশ রূপান্তর: আচ্ছা, স্কুলের পাঠ্যবইয়ের ভাষা নিয়ে একটা বিতর্ক যেমন আছে, তেমনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসের ধোঁয়াশাপূর্ণ বা বিতর্কিত, অমীমাংসিত অনেক বিষয় নাকি রয়েছে। যেগুলো নিয়ে উচ্চশিক্ষা বা গবেষণা পর্যায়ে আলোচনা চলতে পারে। তো এই বিষয়গুলোর কতখানি শিশুদের ইতিহাস পাঠ উপযোগী?
ড. আকসাদুল আলম: এত সময় সে ইতিহাসের আলোচনা করছিলাম আপনার সঙ্গে, ইতিহাসের সেই বয়ান কিন্তু গত ৫০-৬০ বছর ধরেই সামান্য কিছু পরিবর্তন করে চলছে। এর পেছনে রয়েছে গভীর এক রাজনীতি। পাকিস্তান আমলের ভাবধারায় রচিত প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসের ধোঁয়াশাপূর্ণ বা বিতর্কিত, অমীমাংসিত অনেক বিষয় ইতিহাসের পাঠ হিসেবে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের স্কুল পাঠ্যবইগুলোতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসের বাংলা/বাংলাদেশ অধ্যয়নের নামে চলেছে।
দেশ রূপান্তর: মানে ইতিহাসের যে বিষয়গুলো নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গবেষণা এখনো চলছে বা চলার সুযোগ আছে, সে ধরনের বিষয় কি স্কুলের পাঠ্যবইয়ে থাকার দরকার ছিল?
ড. আকসাদুল আলম: সেটাই বলছিলাম, এগুলো এখনো চলছে। আপনি যদি বিগত যেকোনো বছরের আগের পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যবইগুলোকে দেখেন সেখানকার ভাষা, বিষয়, বয়ান, কেবলই সন-তারিখ, রাজা-বাদশার নাম-ঠিকুজি এবং তাদের গৌরব বয়ান দিয়ে ঠাসা। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে ইতিহাস তাই এক মহা আতঙ্কের নাম। কখনো হিন্দু রাজা, কখনো বৌদ্ধ রাজা, কখনো মুসলমান রাজা, কখনো সেন বংশ, কখনো খিলজি, কখনো সুলতানি, কখনো মুঘল... এসবের ফিরিস্তি দিয়ে ইতিহাসের বই ভরা। আমার মনে হয়েছে এবারই প্রথম একটা চেষ্টা করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে মূল উপজীব্য করে, সমাজসংস্কৃতি এবং মানুষের ধর্মজীবন ও অনুভূতির জায়গাগুলোকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে নির্মোহ ইতিহাস সহজ ভাষায় শিক্ষার্থীর সামনে আনতে। যেখানে গল্প আকারে শিক্ষার্থীরা বাংলা অঞ্চল তথা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অতীতের সকল সামষ্টিক অভিজ্ঞতার কথা জানতে পারে।
দেশ রূপান্তর: আমরা স্কুলে যেভাবে পড়েছি কত সালে কোন রাজা এলেন, কত সালে কোন রাজার কোন ছেলে সিংহাসনে বসলেন বা কোন রাজপুত্র তার বাবা বা ভাইকে মেরে ক্ষমতা নিলেন, এমন। এখানে কে প্রাচীন এলাকাটিতে আক্রমণকারী, কে অনুপ্রবেশকারী এবং এসবের আড়ালে সাধারণ মানুষ এই আক্রমণ আর অনুপ্রবেশে কী উদ্ধারটা পেল তা বোঝা যেত না। সে ক্ষেত্রে আমার মতো সাধারণ মানুষ, যাদের ইরান-তুরান-আফগান বা দিল্লির লিগেসি নেই, যথেষ্ট বংশীয় অর্থে সৈয়দ না, বাংলার সাধারণ মানুষের জায়গা থেকে এবার কি তবে নিজেকে খুঁজে পাওয়াটা সহজ হবে নতুন পাঠ্যবইয়ে?
ড. আকসাদুল আলম: সেটা বলা খুব কঠিন আমার জন্য। আমি ইতিহাসের শিক্ষার্থী। ভবিষ্যৎ তো বলতে পারব না ভাই। তবে হ্যাঁ, এই ভূখন্ডে আমার পূর্ব-পুরুষরা সাপের সঙ্গে, বাঘের সঙ্গে, বন্যায় ডুবে, জলচ্ছ্বাসে ভেসে লড়াই করে বেঁচে ছিল। আমি প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে এখানে টিকে থাকি, এরই মধ্যে বহু দূরের ভূখণ্ড থেকে একজন এসে আমার ওপর ভাষা চাপিয়ে দেবে, একজন ধর্ম চাপিয়ে দেবে, আরেকজন তার রাজবংশীয় শাসন চাপিয়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে পরিচয়-রাজনীতি করবেন, সেটা তো আমার জানার অধিকার আছে। এই ন্যারেটিভটাকে এবার সম্ভবত সামনে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। বাচ্চারা যাতে করে তার ভূখন্ডের আলোকে, তার অস্তিত্বটাকে যেন ইতিহাসের মাধ্যমে রিলেট করতে পারে। সে যেন তিন-চার হাজার বছর ধরে এখানে তার বেড়ে ওঠার লড়াই এবং অভিজ্ঞতাকে অনুধাবন করতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার। দেখুন, ইতিহাসে আমার-তোমার কিংবা আমি-তুমি বা আমরা এবং তোমরা এগুলো শিশু শিক্ষার্থীর জন্য খুবই ভয়ংকর বলে মনে করি। এটা কিন্তু ইতিহাসের একটা বড় সংকটের জায়গা। আর্যভাষীরা এখানে এসেছে, তাদের কেউ এখানে মিশে গিয়েছে, অনেকে সম্পদ লুট করে চলে গিয়েছে। সুতরাং অনেকে মিশেছে, অনেকে মেশেনি। অনেক সাধারণ মানুষও ব্যবসা কিংবা ধর্ম প্রচারে এখানে এসেছে, এখানে এসে নিজেদের বসতি স্থাপন করেছে। ফলে তারাও এ ভূখন্ডের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে। সুতরাং যারা মিলেমিশে গিয়েছে তারা তো ধীরে ধীরে এখানকার মানুষের অংশে পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের বয়ানে আপনি ইনক্লুসিভ হবেন নাকি এক্সক্লুসিভ হবেন, আপনি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিচয়-রাজনীতি নিয়ে ইতিহাসের বয়ান তৈরি করবেন নাকি একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার সামষ্টিক অভিজ্ঞতার বয়ান লিখবেন তা আগে নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন।
আর কয়েক দিন পরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে! যুদ্ধে এই এক বছরে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, জনপদের পরপর জনপদ ধ্বংস হয়েছে এবং এই ধারা অব্যাহত আছে। এত কিছুর পরও সমস্ত আশঙ্কাকে সত্যি করে যুদ্ধ যে দীর্ঘ মেয়াদে অব্যাহত থাকছে বস্তুত তার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। যুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ হচ্ছে ইউক্রেন ও রাশিয়া। কিন্তু প্রকারান্তরে ছায়া যুদ্ধ হচ্ছে ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে এবং এখানে আছে বিশ্ব রাজনীতির নানা মেরুকরণ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও বিশ্ব শাসনের একক ক্ষমতার আকাক্সক্ষা। ফলে এ সময় বিবদমান পক্ষগুলোর কাউকেই দায়িত্বশীল আচরণ করতে দেখা যায়নি। অধিকন্তু যা হয়েছে তা হচ্ছে সংঘাতকে আরও দীর্ঘায়িত করার আয়োজন। আর এর মানে হচ্ছে আরও প্রাণহানি, আরও জনপদ ধ্বংস, আরও বেশি ভোগান্তি; বলাবাহুল্য, তা বিশ্বের সব মানুষেরই।
সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে পৃথিবী অনেক বেশি বিভক্ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলোর খামখেয়ালিপনা যেমন বিশ্বযুদ্ধ ডেকে এনেছিল, তার সমস্ত লক্ষণই এখন দেখা যাচ্ছে। ধনী দেশগুলো একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হতে চাচ্ছে, ফলে নিজেদের মধ্যে শুরু হয়েছে ক্ষমতার লড়াই। আসলে কাক্সিক্ষত পৃথিবী গঠনে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে চূড়ান্ত হিসেবে ধরে নিলে বিভক্তি দূর করা যাবে না। কারণ এ ব্যবস্থার মাধ্যমে একটির পর একটি সংঘাতকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিশ্বের অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশগুলোর ওপর, যেমনভাবে দেওয়া হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাহীন মানুষগুলোর ওপর। যেমনটা আমরা দেখি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতীয়তা, নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়, ভাষা ও ধর্মের পার্থক্যের ভিত্তিতে বঞ্চনা ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে কাঠামোগত রূপ দেওয়া হয়েছে। দেশে দেশে জেনোফোবিয়া তো মহামারীর রূপ নিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের কাঠামোগত নিষ্পেষণ যেন ধারাবাহিক রীতিতে পরিণত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে।
রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের চূড়ান্ত মতবিরোধ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের হাত ধরে, যা অব্যাহত ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক দিন উনিশশ নব্বইয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের আগ পর্যন্ত। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর রাশিয়া যখন নিজেদের পুঁজিবাদী বিশ্বের কাতারে শামিল করে তখন ধরে নেওয়া হচ্ছিল পৃথিবী থেকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও বিভাজন দূর হলো বলে। তবে সেটা যে অলীক কল্পনা তা বুঝতে খুব বেশি সময়ে লাগেনি। আদতে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পতন পৃথিবীকে প্রতিশ্রুত সমতাপূর্ণ সমান্তরাল পৃথিবীর পরিবর্তে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় বাধ্য করেছে। অন্যদিকে, রাশিয়ার অভিযোগ সোভিয়েতের পতনের পর রাশিয়াকে ধীরে ধীরে প্রান্তিক করা হয়েছে, বিভিন্ন দেশে রুশ ভাষাভাষীদের ওপর বঞ্চনা ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা আরোপ করা হয়েছে এবং ন্যাটোর মাধ্যমে রাশিয়াকে সামরিকভাবে ঘিরে ফেলা হয়েছে যেমনটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে দমন করা হয়েছে অন্য ভিন্নমতাবলম্বী রাষ্ট্রসমূহকে। দীর্ঘদিনের শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে আশির দশক থেকে চীন ধীরে ধীরে পশ্চিমা দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়। চীনের সস্তা শ্রমিক ও কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে পেরেছিল এবং একই সঙ্গে এই ভূমিকার ফলে চীনে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ধীরে ধীরে চীন প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের যখন পশ্চিমা বিশ্বের মূলত ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইল তখনই দ্বন্দ্বটা একটু একটু করে প্রকাশ পেতে শুরু করল। চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগগুলো বেশ ধারাবাহিক। কৃত্রিমভাবে মুদ্রার অবমূল্যায়ন, প্রযুক্তি নকল করা ও সর্বশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগ। ফলাফল ব্যবসায়িক সহযোগী থেকে চীন এখন প্রতিদ্বন্দ্বী এবং প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি।
এতসব বিশ্ব রাজনীতি ও বিভাজনের মধ্যে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার খড়্গ গরিব দেশগুলোর জন্য যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। ভিন্নমতাবলম্বী দেশগুলোর ওপর ধারাবাহিক নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ একদিকে যেমন সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে এবং একই সঙ্গে বর্তমান বিশ্বে সমস্যা সমাধানের বহুপক্ষীয় ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিচ্ছে। অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মৌলনীতিও বেশ নড়বড়ে, একেক দেশের ওপর প্রয়োগ এক এক ধরনের কৌশলগত সম্পর্কের ভিত্তিতে। তাই এ সময় কৌশলগত সক্ষমতা অর্জন করা ছাড়া দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে এই ক্ষমতা সম্পর্কে টিকে থাকা খুবই কঠিন। এখন পর্যন্ত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তিশালী দেশগুলোর সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো অটোমেটিক চয়েজ বা ফেবার নেই। সবটুকুই স্বার্থসংশ্লিষ্ট। ফলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে শক্তিধর দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নব্বইয়ের বহুপক্ষীয় উদ্যোগগুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছিল তা প্রথমত স্বার্থের সংঘাতে, দ্বিতীয়ত, আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে সেখান থেকে ধীরে ধীরে সরে আসে।
এই স্বার্থের গ্যাঁড়াকলে পরে ছোট দেশগুলোর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করা এখন প্রায় দুরূহ ব্যাপার। অধিকন্তু কখনো কখনো ছোট দেশগুলোকে বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলো সর্বাত্মক চাপে রাখার চেষ্টা করে বিভিন্ন ধরনের কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা প্রয়োগের মাধ্যমে। যে কারণে এ দেশগুলো কোনোভাবেই দরিদ্র অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে পারে না বরং নানামুখী চাপের কারণে এদের ভঙ্গুরতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। সেই প্রেক্ষিতেই ছোট দেশগুলোকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন শক্তিশালী বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক ব্লকে অন্তর্ভুক্ত হতে হচ্ছে কখনো কখনো নিজস্ব আকাক্সক্ষার বিসর্জন দিয়েইএটাই এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা। আবার যেখানে বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে, সেখানে নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে যেন সবকিছুই চলতে পারে, তবে অবশ্যই তা আড়ালে ও আবডালে। সাম্প্রতিক এক খবরে প্রকাশিত বিশ্বের ১৩টি দেশের ১৩টি কোম্পানি মিয়ানমারকে অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম দিচ্ছে, যার মধ্যে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশসমূহ। এটি একটি উদাহরণ মাত্র। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন এবং সে সময় তিনি বিশ্বে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে পাশে চান বলে উল্লেখ করেন।
কিন্তু পৃথিবীর বর্তমান ক্ষমতা কাঠামোতে কীভাবে ন্যায়বিচার অর্জন করা সম্ভব? যেখানে সারা পৃথিবীর সম্পদ অল্পকিছু দেশ ও মানুষের কাছে কুক্ষিগত, যেখানে দরিদ্র দেশগুলোকে সবকিছুর জন্য অল্পকিছু দেশের কাছে মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে, যেখানে ধনী দেশগুলোর কৌশলগত স্বার্থ সবার আগে বিবেচ্য, যেখানে বিশ্বের অভুক্ত জনগোষ্ঠীর কাছে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার থেকে যুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহ গুরুত্ব বেশি পায়, সেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অলীক কল্পনাই বটে।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
হংকং-এ উচ্চশিক্ষা নিতে আসার সুবাদে, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি তার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসের মধ্যে বা ক্যাম্পাস-সংলগ্ন রাস্তায় দেখা হয়। ইলেকট্রিক্যাল ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এই জগদ্বিখ্যাত পণ্ডিত, পৃথিবীসেরা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কর্তাব্যক্তি হয়েও চলাফেরা করেন একা, কোনো আমলাতান্ত্রিক বাড়াবাড়ি বা অহংবোধ তার মধ্যে নেই। আমি তার সঙ্গে সেলফি তুলেছি, এবং দেখা হলেই তিনি আমাকে বলেন, ‘তোমার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল!’ আমার সঙ্গে কথোপকথনে তিনি জানতে চান, ‘এখানে আমি কেমন বোধ করছি, কোনো অসুবিধা আছে কি না?’ বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক এবং প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের এমন আচরণে আমরা খুব একটা অভ্যস্ত নই। কারণ, আমাদের দেশের উপাচার্যরা তাদের চালচলনে অনেকটাই আলাদা। তারা সাধারণত চলেন দলে-বলে। একগাদা কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং কখনো কখনো ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারাও তাদের ছোট-বড় সফরের সঙ্গী হন। আমাদের ভিসিরা কেমন যেন একটা আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগেন। এই কমপ্লেক্সিটি তাদের মধ্যে কাজ করা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা জাঁদরেল প্রফেসরদের পাশ কাটিয়ে আমাদের উপাচার্যরা তাদের রাজনৈতিক নিয়োগ ম্যানেজ করে ফেলেন, তখন যে তারা এমন আত্মবিশ্বাসহীনতা বা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন, তা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে পড়ে। অন্যদিকে হংকং-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানদের খুঁজে বের করা হয় বিখ্যাত সব পণ্ডিত ও পেশাগতভাবে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে। তাই, নিয়োগ-পরবর্তীকালে তাদের অন্যতম দায়িত্ব থাকে তার প্রতিষ্ঠানকে আরও কতটা জগদ্বিখ্যাত করা যায়, কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নত করা যায়। এগুলোর বাইরে অন্য বিষয় নিয়ে তাদের খুব একটা ভাবতে হয় না। দল-বল তারা খুব একটা পছন্দ করেন বলে মনে হয় না। কারণ তাদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকে না।
২ হাজার ৭৫৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই হংকং দীপপুঞ্জের অর্ধেকের বেশির ভাগই পানি, স্থলভাগ মাত্র ১ হাজার ১১০ বর্গকিলোমিটার, যা আমাদের ঢাকা জেলার তিন ভাগের একভাগ মাত্র। অথচ এমন একটা ছোট্ট ভূখণ্ডে ২২টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ১৪টা বিশ্ববিদ্যালয় আর বাকিগুলো বিভিন্ন ইনস্টিটিউট আর কলেজ। এখানকার ইউজিসি ফান্ডেড আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পাঁচটিই (যেমন : ইউনিভার্সিটি অব হংকং, হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং, সিটি ইউনিভার্সিটি অব হংকং ও হংকং পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি) কিউএস এবং টাইমস র্যাংকিংয়ে প্রথম ১০০টির মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া বাকিগুলো প্রথম ১০০-এর মধ্যে না থাকলেও তাদের র্যাংকিংও উল্লেখযোগ্য। এতগুলো উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এত ছোট্ট একটা শহরে থাকার নজির পৃথিবীতে বিরল। তাই তো, এশিয়ার যেকোনো অঞ্চলের মধ্যে, হংকংয়ের লেখাপড়ার উচ্চমান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তারই ফলে, এখানে লোকাল ও ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রছাত্রী যথেষ্ট। ভালো স্কলারশিপের সুযোগ থাকার কারণে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যসবখান থেকেই ছাত্রছাত্রী এখানে পড়তে আসে। অন্যদিকে, সরকারি, বেসরকারি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিলে বাংলাদেশে ১৫০টির এর বেশি বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও সেগুলো মানের দিক দিয়ে সাংঘাতিক পিছিয়ে। আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে হাজারের ঘরে পৌঁছাতে, এদের ঘাম ছুটে যায়। অধিকাংশ বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। তবে, কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের নিজ কর্মদক্ষতায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জায়গা করে নিলেও, তাদের সংখ্যা নেহাতই কম।
হংকং-এর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন সাবজেক্টের (অ্যাকাডেমিক থিমভিত্তিক) ওপর জোর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সব সাবজেক্ট সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না বা প্রায়োরিটি দেওয়া হয় না। যেমন : মেডিকেল সায়েন্স খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয় ইউনিভার্সিটি অব হংকং ও চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং-এ। অন্যদিকে, আইন বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব হংকং, সিটি ইউনিভার্সিটি অব হংকং ও চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং এ মুহূর্তে বিশ্বের প্রথম ৫০টির মধ্যে আছে। বায়োমেডিকেল সায়েন্স ও ভেটেরিনারিতে নাম করা সিটি ইউনিভার্সিটি। এডুকেশন-সংশ্লিষ্ট সাবজেক্টে ও এশিয়ান কালচার ও পলিটিকসে ভালো করছে এডুকেশন ইউনিভার্সিটি অব হংকং। লিবারেল আর্টস ও সোশ্যাল সায়েন্সে জোর দেয় লিংগন্যান ইউনিভার্সিটি। আবার, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং আর সায়েন্টিফিক সাবজেক্টগুলোর জন্য নামকরা ইউনিভার্সিটি অব হংকং, সিটি ইউনিভার্সিটি অব হংকং, হংকং পলিটেক ইউনিভার্সিটি, চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং ও ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। অন্যদিকে, সোশ্যাল সায়েন্স, বিজনেস হিউম্যানিটিজ সাবজেক্টগুলোর জন্য গুরুত্ব বহন করে ব্যাপ্টিস্ট ইউনিভার্সিটি ও হংকং পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি। এভাবে, একটা সম্পূরক ও সুদূরপ্রসারী প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে এদের টোটাল শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশরা এদের শিক্ষা খাতকে একটা শক্ত ভিত্তি দিয়ে গেছে। বি-ঔপনিবেশিককালে পরবর্তী সরকারগুলো খুব শৃঙ্খলার সঙ্গে সুন্দরভাবে এটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং আরও উন্নত করছে।
অথচ বাংলাদেশে খুব একটা থিমভিত্তিক বা বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হলো না। কয়েকটি ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া, অন্যসব সাবজেক্টভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় খুব একটা দেখা যায় না। কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে যদিও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নাম দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হলেও, সেখানে বিভিন্ন বারোয়ারি সাবজেক্ট ঢুকিয়ে এক জগাখিচুড়ি পাকানো হয়েছে। এগুলোতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণার অবকাঠামো তৈরি না করে, দক্ষ শিক্ষক আর প্রশাসক নিয়োগ না দিয়ে, শুধু শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এখানে কোনো উদ্যোগ নেওয়া বা সেই ভিত্তিতে কাজ করা হয় না। মাস্টারপ্ল্যান শব্দটাই বাংলাদেশে কাগুজে মাত্র। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অনেক শিক্ষার্থী হংকং-এ আসেন অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল আর পিএইচডি করতে। এমনকি অনেকে আসেন পোস্টডক করতে। বর্তমানে প্রায় তিনশর কাছাকাছি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এখানে অধ্যয়নরত এবং গবেষণারত আছেন। প্রতি বছর বাড়ছে এখানে শিক্ষার্থীদের পড়তে আসার সংখ্যা। অন্যদিকে, বাংলাদেশের শিক্ষার মান যথেষ্ট উন্নত না হওয়ার কারণে, এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থী টানতে পারেনি। আগে যাও কিছু বিদেশি শিক্ষার্থী দেখা যেত, সেটাও এখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গেছে।
হংকং এশিয়ার মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বিশ্ববাণিজ্যের অনেকটাই এখান থেকে পরিচালিত হয়। কিন্তু অর্থ ও বাণিজ্যের পাশাপাশি এই ছোট্ট শহরটি আজ শিক্ষা ক্ষেত্রে পৃথিবীর পুরনো বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। শিক্ষায় সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ এখানে যথেষ্ট। করোনার মতো বিশ্বদুর্যোগকে মোকাবিলা করতে গিয়ে, এরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অযাচিতভাবে বন্ধ রেখে শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যাহত করেনি। উন্নতমানের কারিকুলাম, বিশ্বমানের গবেষণাগার, প্রসিদ্ধ সব প্রফেসরদের উচ্চবেতনে এখানে নিয়োগ, অনেক ধরনের স্কলারশিপের ব্যবস্থা করা, এবং শিক্ষা শেষে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুবিধা, হংকং-এর শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। হংকং থেকে অর্জিত ডিগ্রি বিশ্বমানের এবং আন্তর্জাতিক জব মার্কেটে সমাদৃত। অথচ, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের বিষয়টি মনোযোগ পায়নি, পায়নি এজন্য যথেষ্ট সরকারি বরাদ্দ বা বেসরকারি অনুদান, যা কিছু বরাদ্দ হয়, তাও কিছু দালানকোঠা বানানো আর অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত জনবলের বেতন-ভাতা দিতে দিতে নিঃশেষ হয়। এর পাশে আছে, সীমাহীন দুর্নীতি আর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।
হংকং-এ অযোগ্য লোককে রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি বানানো হয় না; শিক্ষক নিয়োগে দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচ্য নয়কারণ মেধা ও যোগ্যতাই এখানে যাবতীয় কিছুর মাপকাঠি; শিক্ষায় বরাদ্দ বলতে শুধু কয়েকটা বিল্ডিং বানানো বোঝায় না; দুর্নীতির এখানে নেই কোনো স্থান। সর্বোপরি, শিক্ষা ও গবেষণা হংকং-এর অন্যতম প্রায়োরিটি; যা এশিয়ার অনেক দেশেই দেখা যায় না। গত চল্লিশ বছরে হংকং-এর শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষামেধা, যোগ্যতা, নিষ্ঠা, গবেষণা, বিনিয়োগ ও আইনের সুশাসন হংকংকে এশিয়ার উচ্চশিক্ষার রোল মডেল করেছে। এই তুলনামূলক আলোচনা থেকেই প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষায় কেন পিছিয়ে।
লেখক শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
একসময় বিশ্ববিদ্যালয় মাত্রই ছিল আবাসিক। কিন্তু এখন সব বিশ্ববিদ্যালয়ই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়। কিন্তু একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, বিশ^বিদ্যালয়ে নিবিড় পাঠ ও গবেষণার পরিবেশের সঙ্গে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধরাণাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের দেশে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংখ্যাবৃদ্ধি এবং দেশের নানাপ্রান্তে সেগুলোর অবস্থানগত বিস্তারের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আবাসনের সুবিধা না পেলে শিক্ষার্থীদের পাঠ ও গবেষণায় তা যেমন বিরূপ প্রভাব ফেলে তেমনি শিক্ষকদের বেলাতেই এটা প্রবলভাবে সত্য। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটকে কেন্দ্র করে চলছে ছাত্ররাজনীতির নামে নির্মম দখলদারিত্ব আর ক্ষমতার সন্ত্রাস। প্রায় একই রকমভাবে শিক্ষক রাজনীতিরও একটি প্রাথমিক ধাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে হাউজ টিউটিরশিপ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো যেমন এ বিষয়ে পরিকল্পনাহীন তেমনি উচ্চশিক্ষার নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে নিশ্চুপ।
রবিবার দেশ রূপান্তরে ‘হল সুবিধায় মাত্র ৩৬ শতাংশ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে দেশের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোর আবাসন সংকটের সর্বশেষ চিত্র উঠে এসেছে। ২০২১ সালের তথ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আবাসিক হল না থাকায় ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই আবাসিক সুবিধা পান না। ইউজিসির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর ৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিলেন ২ লাখ ৮৯ হাজার ৬৪৫ জন। এরমধ্যে আবাসন সুবিধা পান ১ লাখ ৪ হাজার ৮৫২ জন। অর্থাৎ শতকরা ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। এরমধ্যে ৫৯ শতাংশ ছাত্র ও ৪১ শতাংশ ছাত্রী। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের সংখ্যা মোট ১৫ হাজার ২৩৬ জন। এরমধ্যে আবাসিক সুবিধা ভোগ করছেন ২১ শতাংশ শিক্ষক। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৮৩৩ জন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ আবাসিক সুবিধা ভোগ করছেন। এরমধ্যে ৩ দশমিক ২১ শতাংশ কর্মকর্তা এবং ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ কর্মচারী আবাসিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবারই আবাসন সংকট রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। শিক্ষাবিদ ও উচ্চশিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া আসন সংখ্যা বাড়ানোয় এই সংকট তৈরি হচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরিকল্পিত নীতিই দায়ী। অন্যদিকে এটাও খেয়াল করা জরুরি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকেই যে আবাসিক সুবিধা দিতে হবে, তা আইনে নেই। কিন্তু একজন শিক্ষার্থী যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন সে আশা করে যে আবাসিক সুবিধা পাওয়া যাবে। আবার এখন সারা দেশে জেলা পর্যায়ে এমন সব জায়গায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, তার আশপাশে থাকার জায়গাও তেমন নেই। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক সুবিধা থাকলে তার পড়ালেখার জন্য সুবিধা হয়।
খেয়াল করার মতো বিষয় হলো, ৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১১ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের আবাসিক সুবিধাই গড়ে ওঠেনি। প্রশ্ন হলো এই ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন নীতিমালা না থাকার পক্ষে কোনো যুক্তি রয়েছে কি? আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক সুবিধা রয়েছে সেগুলোতে মোট হল বা ডরমিটরির সংখ্যা ২৬০টি। এরমধ্যে ১৫৯টি হল ছাত্রদের জন্য, যেখানে থাকেন ৬১ হাজার ৭০১ জন। আর ১০১টি হল ছাত্রীদের জন্য, যেখানে থাকেন ৪৩ হাজার ১৫১ জন। অন্যদিকে, শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাসিক সুবিধা পান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৭ শতাংশ। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪১ শতাংশ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ শতাংশ শিক্ষক আবাসন সুবিধা পান। এটা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক হল না থাকায় প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই গণরুম বা রাজনৈতিক রুমের সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের ৮ জনের একটি রুমেই গাদাগাদি করে ৪০ জন পর্যন্ত থাকেন। আবার এই সুযোগে ছাত্রনেতারা শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিকভাবে রুমে তুলে মাসে বা বাৎসরিক টাকাও আদায় করে থাকেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলগুলোতে নানা ধরনের নৈরাজ্যের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত বেশি সংখ্যক সম্ভব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আবাসন সুবিধা সৃষ্টি করা এবং মানসম্মত পাঠ ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টি একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে, শিক্ষায় বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হওয়া উচিত গবেষণায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আবাসন সুবিধার মতো মৌলিক অবকাঠামো গড়ে তোলাতেই আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে, ধাপে ধাপে বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে আবাসন সংকট নিরসনের একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে সে লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া।
১৮৯৭ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। তিনি সিভিল সার্ভিস থেকে ইস্তফা দিয়ে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯২৯-এ সুভাষ ছিলেন বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনের সভাপতি। ১৯৩৮ সালে সুভাষ সর্বসম্মতিক্রমে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। দলীয় সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তার একরোখা অবস্থানের কারণে অচিরেই তাকে কংগ্রেসের মূল নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তার বিরুদ্ধে চলে যান। ১৯৩৯ সালে তিনি কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি ভিন্ন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠন করেন এবং পরে এটি একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৩ সালের ২৫ আগস্ট সুভাষ আজাদ হিন্দ ফৌজের (আইএনএ) সর্বাধিনায়ক হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময় সুভাষ জার্মানি-জাপান-ইতালি অক্ষশক্তির পক্ষাবলম্বন করে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা বেগবান করার লক্ষ্যে এগোতে থাকেন। বিশ্বযুদ্ধের শেষলগ্নে সুভাষের নিখোঁজ হওয়া বা মারা যাওয়ার ঘটনা রহস্যাবৃত।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।