
একবিংশ শতাব্দীতে চীনের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উত্থান ও ২০১৩ সালে কাজাখস্তানে প্রস্তাবিত ও ইন্দোনেশিয়া সফরে ব্যাখ্যা করা চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের বেল্ট রোড অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভ বা ‘বিআরআই’ প্রকল্প ভারত সাগর থেকে লোহিত সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ভূ-রাজনীতিতে এক অভিনব ভূমিকম্পন তৈরি করেছে। চীনের এই প্রকল্পের বিপরীতে বিশে^র প্রভাবশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ বা ‘আইপিএস’ এবং যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে একটি সামরিক জোট কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগ বা ‘কোয়াড’ গঠন করে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র কেউই দক্ষিণ এশিয়ার দেশ না হলেও দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এ দেশ দুটির বর্তমান প্রভাব অনস্বীকার্য। এশিয়ার দুই শীর্ষ অর্থনীতি চীন ও ভারত। সীমান্তে নানা ইস্যুতে বিরোধ সত্ত্বেও চীন-ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক ঈর্ষণীয়। দুই দেশ মার্কিন বলয়ের বিকল্প ‘ব্রিকস’-এর সদস্য। ব্রিকস বিশে^র ২৩ শতাংশ জিডিপি ও ৩২ শতাংশ জিডিপি-পিপিপি নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রিকসের নিউ ডেভেলেপমেন্ট ব্যাংকের পুঁজি ১০০ বিলিয়ন ডলার, বার্ষিক ঋণ প্রদান ৩৪ বিলিয়ন ডলার পার করছে। এ ছাড়া নিরাপত্তা সংস্থা সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা বা ‘এসসিও’র প্রভাবশালী সদস্য চীন ও ভারত। ব্রিকস ও সাংহাই করপোরেশনের কমন রাষ্ট্র হলেও চীনের প্রস্তাবিত ‘বিআরআই’ প্রকল্পে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ভারত। যদিওবা বর্তমানে দুদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক ১০০ বিলিয়ন ডলার পার হয়েছে। গত তিন-চার বছরে সীমান্তে বহুবার চীন-ভারত মুখোমুখি হয়ে গেলেও সীমান্তের সে উত্তেজনা দুদেশের বাণিজ্যে খুব একটা আঘাত করতে পারেনি। তবে বাণিজ্য সম্পর্কের বাইরে দুদেশের বাকযুদ্ধ রীতিমতো চলমান ছিল। তাইওয়ানের নতুন সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ভারতীয় প্রতিনিধি পাঠিয়ে নয়াদিল্লি মূলত চীনকে ছেড়ে কথা না বলারই বার্তা দিয়েছে। ‘বিআরআই’কে এড়িয়ে ভারত বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘আইপিএস’ এবং সামরিক জোট ‘কোয়াড’-এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। শুধু তাই নয় ভারত মহাসাগরে চীনকে ঠেকাতে পশ্চিমাদের নির্ভরযোগ্য খুঁটিও ভারত।
তবে এরই মধ্যে ‘বিআরআই’ প্রকল্প দিয়ে চীন দক্ষিণ এশিয়াসহ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজস্ব বলয় তৈরি করে ফেলছে। বিআরআই মূলত একটি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প যা রেল, সড়ক ও সাগর পথে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাকে সংযুক্ত করবে। এই প্রকল্পের অধীনে চীন আট হাজার কিলোমিটার সড়ক বা রেলপথ নির্মাণ করতে চায়, নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বিশ্বের ৪০ শতাংশ জিডিপি। এরই মধ্যে ভারত ও ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব কটি দেশের সঙ্গেই চীন বিআরআই নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এ ছাড়া বিআরআই প্রকল্পের ছয়টি করিডরের দুটি ‘চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর’ ও ‘চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার ওপর দিয়ে। চীন এই প্রকল্পের অধীনে হংকং, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও মালদ্বীপ হয়ে জিবুতি, সুদান পর্যন্ত সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে একটি সামুদ্রিক অর্থনৈতিক হাব তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। বিনিয়োগ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করছে। চীন শুধু ব্যবসা করছে না, করছে ভূ-রাজনীতিও। মালদ্বীপে ২০১১ সালের আগে চীনের দূতাবাস না থাকলেও এখন দুদেশের মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। মালদ্বীপে দ্বীপ কিনছেন চীনা বিনিয়োগকারীরা। রাজধানী মালের সঙ্গে বিমানবন্দর দ্বীপ হুলহুলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনকারী ব্রিজসহ বিআরআই প্রকল্পের অধীনে বহু প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ চলছে মালদ্বীপজুড়ে। একসময়কার ‘সিয়েনটো’ ‘সিয়েটো’-এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও মার্কিন মিত্র পাকিস্তান পিংপং কূটনীতির মাধ্যমে চীন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপনে মধ্যস্থতা করেছিল। সে পাকিস্তান এখন বহুলাংশে চীনের দিকে ঝুঁকে আছে। বিআরআই প্রকল্পের অধীনে চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের মাধ্যমে পাকিস্তানে চীন বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে ৬০-৯০ বিলিয়ন ডলার, যা পাকিস্তানের মোট জিডিপির ১৪-২০ শতাংশ।
বিআরআই প্রকল্পের অধীনে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর বিনিয়োগ ফাঁদে পড়ে চীনের হস্তগত হওয়ার বিষয়টি এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়েছে। যদিওবা এই দাবির বিপক্ষেও শক্তিশালী মত আছে। কিন্তু এত তুমুল তর্কবিতর্ক শ্রীলঙ্কায় চীনের বাণিজ্য বা বিনিয়োগকে টলাতে পারেনি। কলম্বো বিমানবন্দরের উন্নয়ন ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চীনা বিনিয়োগের কর্মযজ্ঞ চলছে শ্রীলঙ্কায়। শুধু বিনিয়োগ নয় রাজনৈতিক কূটনীতিতেও চীন শ্রীলঙ্কার ছাতা হচ্ছে। যেভাবে চীন বারবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যু, সামরিক সরকারের নানা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনা সব নিন্দা প্রস্তাবকে আটকে দিয়ে মিয়ানমারকে বৈশ্বিক কূটনীতিতে চীননির্ভর করে তুলেছে শ্রীলঙ্কায়ও চীন তাই করছে। চীন দক্ষিণ এশিয়ায় একাধিক নীতিতে কাজ করছে কখনো রাজনৈতিক কূটনীতি, কখনো অর্থনৈতিক কূটনীতি, কখনো বা সফট পাওয়ার কূটনীতি নিয়ে তার হেজেমনি প্রতিষ্ঠার কাজ করছে। চীন ও ভারতের মধ্যে ‘বাফার জোন’ হিসেবে কাজ করে ভূবেষ্টিত নেপাল। বর্তমানে নেপালে চীনের বিআরআই প্রকল্পের অধীনে ২৪টি প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে নেপালকে চীনা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে পেইচিং। নেপালের সীমান্ত শহর খাসা থেকে তিব্বতের লাসা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ, কাঠমুন্ডু-পোখরান-লুম্বিনি রেল প্রজেক্টের মাধ্যমে নেপালের অর্থনীতি ও যোগাযোগব্যবস্থা বদলের পরিকল্পনা নিয়েছে চীন। এসব প্রকল্প নিয়ে বিতর্কের ছোঁয়া ছিল নেপালের সর্বশেষ হয়ে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনেও। যেখানে নেপালি কংগ্রেস এই ম্যারাথন রেল প্রকল্পের বিপক্ষে কথা বলছে আর বামপন্থিরা এই প্রকল্পকে ‘নতুন নেপাল’ নির্মাণের মাইলফলক বলছে। ফলে কাঠমুন্ডুর রাজনীতিতে দিল্লির পাশাপাশি পেইচিংও এখন একটি চাবি। বাংলাদেশের বহুল কাক্সিক্ষত পদ্মা বহুমুখী সেতুতে বিশ্বব্যাংক বিনিয়োগ আটকে দিলে কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে পাশে দাঁড়ায় চীন। সেতুটির রেলসংযোগ চীনের ‘বিআরআই’ প্রকল্পের অংশ হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প পেয়েছে চীন, নির্মাণ করছে কর্ণফুলীতে দেশের প্রথম টানেল। চীনের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এভাবে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার শতাধিক দেশের হাজারখানেক প্রকল্পে এক ট্রিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ফেলেছে।
চীন বিআরআই প্রকল্পের অধীনে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চাইলেও কোয়াড রাষ্ট্রসমূহ চীনের রাজনৈতিক বিনিয়োগের আড়ালের ভূ-রাজনীতি মোকাবিলায় বদ্ধ পরিকর। কোয়াড ও পশ্চিমা দেশগুলো এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে, সেখানে বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে হাজির হচ্ছে। এর ফলে বিআরআই, আইপিএস ও কোয়াডের শক্তি প্রদর্শনের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগর সমুদ্র অঞ্চল। কেননা উভয় পক্ষ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে প্রভাব তৈরিতে মরিয়া।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
প্রাণী ইঁদুররা মাটিখেকো নয়, বসবাসের জন্য গর্ত করে। খরগোশ, শজারু, শেয়াল, বন্যকুকুর ইত্যাদি প্রাণীরাও তাই করে। জলাশয়ের মাছদের মধ্যে কোনো কোনো প্রজাতিও মাটি খুঁড়ে গর্তে বসবাস করে। অমেরুদন্ডী প্রাণী কেঁচো মাটি খনন করে বসবাস করে। ওরা মাটিখাদক, কিন্তু উর্বরা শক্তিদান করে মাটিকে। আধুনিক চাষের প্রধান যে উপকরণ জৈব সার, কেঁচো সার নামে যার পরিচয় তা কেঁচোরই দান। আমাদের পরিচিত মাছদের মধ্যে বেলে মাছের পোনা অতিক্ষুদ্র বালিকণা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এই মাছের নামকরণও বালি থেকেই এসেছে। তা ছাড়া পাখি বা প্রাণীদের কেউ কেউ খাদ্যের বিষক্রিয়া থেকে আত্মরক্ষার জন্য বিশেষ ধরনের খনিজ মাটি খেয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের একশ্রেণির অর্থলোভী মানুষই বোধকরি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মাটিখেকো প্রাণী। ওদেরই অন্য নাম নরইঁদুর।
মানবসভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মাটিকে খেয়ে ফেলা বা অত্যাচারের অভ্যাস খুব প্রাচীন। কৃষিসভ্যতার বিকাশের যুগে শুধু অরণ্য নয়, তৃণ নয়, প্রকৃতির দান হাজার হাজার পাহাড় ধ্বংস করেছে মানুষ। সমতল খামার ভূমি তৈরি করেছে। এতে ওই এলাকার প্রকৃতির চরিত্রই পাল্টে যায়। সর্বনাশের শুরু শিল্পবিপ্লবের আধুনিক যুগে। শিল্প-কারখানা তৈরি থেকে শ্রমিক কলোনি তৈরিতে পাহাড়কে হত্যা করা হয়। এর ফলে ইউরোপে কোনো এলাকায় ঠান্ডা এবং কোনো এলাকায় উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। আফ্রিকা থেকে দাস সংগ্রহ এবং উপনিবেশের প্রজাদের শাসক দেশে আগমনের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। প্রয়োজন পড়ে ভূমির। আবাসনের। নগরায়ণের। এর ফলে ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করে। দুগ্ধ উৎপাদনের নামে, মাখন বা চিজ তৈরির জন্য হল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া গোচারণভূমির জন্য পাহাড় ধ্বংস করেছে। পুঁজিবাদী মুনাফার লোভ প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করেছে।
আধুনিক এই যুগে মহাসমুদ্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র তাদের নগর রক্ষার্থে জনবসতিশূন্য ছোট দ্বীপগুলো থেকে মাটি-পাথর সংগ্রহ করতে গিয়ে সাগরবুকে বিলীন করে দিয়েছে অসংখ্য দ্বীপ। মালদ্বীপ তাদের অন্যতম। রাজধানী মালেকে সমুদ্রের ঢেউ থেকে রক্ষার জন্য অন্য রাষ্ট্রের দ্বীপের মাটিও কিনতে হয় তাকে। সমুদ্রবন্দর বা মার্কিন নৌঘাঁটি নির্মাণের নামে মার্কিন এবং চীনারা এভাবে কত যে দ্বীপ গিলে ফেলেছে তার হিসাব নেই। দুর্বল দ্বীপরাষ্ট্রগুলো সাম্রাজ্যবাদী আর আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের কাছে বাধ্য হয়েছে সামান্য অর্থের বিনিময়ে সার্বভৌম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ লিজ দেওয়ার নামে বিক্রি করে দিতে। একই বলে ভূমি সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদের এতই ক্ষুধা যে, সে মাটি, পাতাল থেকে মহাকাশের, মহাসমুদ্রের সবকিছু গিলে খায়।
সিঙ্গাপুরের মতো ক্ষুদ্র অথচ ধনী রাষ্ট্র কিংবা চীনাদের অধীন স্বায়ত্তশাসিত হংকংয়ে মাটি বলে কিছু দৃশ্যমান নয়। সবই পায়ের তলায় পিষে মেরেছে অতিকায় বাড়িঘর। বাংলাদেশ আয়তনে খুবই ছোট একটি দেশ। বাঙালি জাতির একমাত্র স্বাধীন দেশ। ধনে-মানে যতই সে বড় হচ্ছে অর্থাৎ পুঁজিবাদ শক্তিশালী হচ্ছে, ততই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। এমনিতে দেশটির মাটির চেয়ে মানুষ বেশি, তার ওপর দেশটি পুঁজি আর মুনাফার খুদে দানবে পরিণত হচ্ছে। বাঙালির বেশির ভাগ ওই পুঁজির আর মুনাফার শোষণটা ততটা বুঝতে পারে না, ভাবে ওরা দরিদ্র থেকে বিত্তবান হচ্ছে। ওই যে প্রবাদ আছে‘দাদায় কইছে... ভাই, আনন্দের আর সীমা নাই।’ ৯৫ জনকে ঠকিয়ে ৫ জন যে লুটে নিচ্ছে, বিষয়টা তাদের বুঝিয়ে দেওয়ার রাজনীতিটা দেশে খুবই দুর্বল।
দেশটার সমুদ্র আছে, প্রকৃত অর্থে দ্বীপ বলতে তেমন কিছু নেই। সবেধন নীলমণি যা-ও একটা আছে অতিক্ষুদ্র প্রবাল দ্বীপ, তাতে রাক্ষসের মতো হামলে পড়েছে ভূমি নরইঁদুররা। পর্যটনের নামে ধ্বংস করছে তাকে। মূল্যবান পাথর সংগ্রহের নামে দ্বীপটির ভিত্তিভূমি তলদেশ ইঁদুরের মতো ফোকলা করে দিচ্ছে। একটা ভূকম্পন কিংবা সুনামি আঘাত করলে কখন যে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে, তার ভাবনা ভাবার আবার লোকের অভাব। হায়রে সেন্টমার্টিনস!
তা ছাড়া উপকূল বা নদী মোহনায়, যা ভূমি আছে সবই অত্যন্ত দুর্বল পলিমাটিতে গড়া চরমাত্র। ঔপনিবেশিক যুগ শুরুর আগেই সন্দ্বীপ চরটিকে আবিষ্কার করেছিল পর্তুগীজরা। ওরা বুঝেছিল এর স্থায়িত্ব অনন্তকাল নয়। তাই ধর্মপ্রচারের জন্য একটি গির্জা আর নাবিক-জলদস্যুদের জন্য ক্ষণস্থায়ী আবাস গড়েছিল। তাও টিকল না দুটি কারণে। একটি হচ্ছে দ্রুত ভাঙন, সমুদ্র গ্রাসে দ্রুত ভূমি বিলীন হয়ে যাওয়া। অন্য কারণটি হচ্ছে দিল্লির মুঘল সম্রাটের আক্রমণ এবং ইংরেজ বণিকদের প্রবল চাপ। আজ সেই সন্দ্বীপ সমুদ্রের মহাগ্রাসে পতিত। মাটি কেন, এক দিন তার নামটিও হারিয়ে যাবে। বাঙালি ভূমিগ্রাসীরা এটা বুঝতে চায় না। সন্দ্বীপের বনাঞ্চল আর তৃণভূমি দখল করেছে ভূমিদস্যুরা। প্রাচীন বন কেটে, গভীর শেকড় প্রবাহী আদিম তৃণকে ধ্বংস করে দ্রুত ঘটাচ্ছে ভূমিক্ষয়। সর্বনাশ যে দ্রুত এগিয়ে আসছে তা বুঝতে চায় না ওরা। রুদ্র প্রকৃতি যে চরাঞ্চলকে গ্রাস করে ক্রমেই এগিয়ে আসছে মূল ভূখ-ের দিকে তা হয়তো টের পাচ্ছে নোয়াখালী-বরিশালের স্থানীয় দরিদ্র মানুষ। ওরা দুর্বল, কিছু করার নেই তাদের।
শুনতে যতই খারাপ লাগুক, স্বাধীনতার অনেক উদ্দেশ্যের ভেতর গোপন যে উদ্দেশ্যটি ছিল তা হচ্ছে বিত্তবান হওয়া আর ক্ষমতাবান হওয়া। অর্থ-বিত্তের সঙ্গে চুরি-চামারি, লুটপাট, দুর্নীতির গভীর সম্পর্ক। টাকা বানানোর জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিহীন হচ্ছে মাটি বা বালি লুণ্ঠন। বিষয়টি বাঙালি প্রথম জানল একাত্তরের পর। নগরায়ণ বা পরিকাঠামো উন্নয়নের জোয়ার আসে সরকারি ও বেসরকারি খাতে। দ্রুত উদ্ভব ঘটে ঠিকাদার নামক মানবপ্রজাতির। ওদের হাত ধরেই রাজধানী শহর ঢাকার সীমানা সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। নদী-নালা, বিলঝিল জাদুমন্ত্রের মতো হাওয়া। এমন একটি নদী নেই যার তলদেশের বালি থেকে দুই পাড়ের মাটি লুণ্ঠিত না হচ্ছে। নদীর স্তব্ধতা, নির্জনতা খানখান করে নদীগর্ভ থেকে তোলা হচ্ছে বালি, যন্ত্র বা ড্রেজারের মাধ্যমে। অপরিকল্পিতভাবে এই বালি উত্তোলনের ফলে বর্ষার শুরুতেই শুরু হয় নদীভাঙন। বিনেপয়সায় নদীগর্ভ আর চরের বালিখাদান দখল করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন এত সহজে আর কোথায় হচ্ছে? ওপরমহল আর পোষা মাস্তান বাহিনী, এই হচ্ছে পুঁজি।
রাতের নির্জনতাকে উচ্চনাদে কাঁপিয়ে শত শত ট্রাকবোঝাই বালি অন্ধকার বিদীর্ণ করে ছুটছে শহরে। এরাই আবার ফিরে আসছে শস্যভূমির মাটি দরিদ্র মানুষকে দুপয়সা দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে দখল করে তুলে নিয়ে যথাস্থানকে ভরাট করে বাড়িঘর বানানোর কাজে। শুধু কাঁচামাটি দিয়ে কাজ হয় না। দরকার শক্ত বা পোড়ামাটি অর্থাৎ ইট। ইট তো আর শূন্য আসমান থেকে নেমে আসে না। তৈরি করতে হয় ব্রিকফিল্ডে। মাইলের পর মাইল শস্যভূমির বুক খামচে মাটি তুলে আর নদীর পলিমাটি লুট করে ইট পোড়ানো হয়। ইটের বড় বড় ভাটা দেখলে দূর থেকে মনে হয় ধরিত্রীর বুকে জ¦লছে এক মহাশ্মশান। সভ্যতা পুড়ে রক্তবর্ণ অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। ইট তো নয়, পৃথিবীর জমাট রক্তে তৈরি রক্তশিলা।
বাংলাদেশের শস্যদায়িনী প্রকৃতির দান পলিমাটির অর্ধেক আজ লোহিতবর্ণ পাথর বা ইট হয়ে গেছে। মাতৃভূমির বুকের রক্তমাংস আগুনে পুড়ে বাঙালি আজ নগরবাসী উন্নত জাতিতে পরিণত হচ্ছে! শুধু কি তাই? তা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করছে বুক চেতিয়ে। নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া বা উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ডের মতো রাজ্যগুলোতে সেই ইট, যা বাংলাদেশের পলল মাটি দিয়ে তৈরি, তা রপ্তানি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদীগুলো তাদের জলপ্রবাহকে দেশান্তরে পাঠায়, সেই জল প্রাকৃতিক নিয়মে সমুদ্র, বৃষ্টি, মেঘ হয়ে বর্ষায় ফিরে আসে বারবার।
কিন্তু কয়লা, গ্যাসপোড়া মাটির ইট, তা সাধারণ হোক চাই কী উন্নত সিরামিক ইট হোক, রপ্তানি হলে সে আর কি তার ধরিত্রী মাতার বুকে ফিরে আসে? আসে না তো, তা হলে? মাতৃভূমির বুক পরিণত হয় যে পোড়ামাটির অনুর্বর খানাখন্দে, মৃত মাটির কঙ্কালে, সে কি আর কোনো দিন যৌবন ফিরে পায়? পায় না। একাত্তরের বাঙালি শহীদের রক্তে ভেজা উর্বর মাটি নিয়েও মুনাফার বাণিজ্য করতে এতটুকু দ্বিধা করে না। এ না হলে আর বাঙালি!
বুড়িগঙ্গা। ইতিহাসের সাক্ষী। বাংলার প্রথম শহীদ এবং শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা এই নদীর বুক বেয়েই মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকা নগরীতে এসেছিলেন। শেষবারের মতো খাসমহলে ফিরেও যান। শহীদ বাংলার নবাবের স্মৃতিময় বুড়িগঙ্গার বুকের জলতলের মাটি আজ অদৃশ্য, অস্পর্শ। হাজার হাজার টন প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যে নদীর তলদেশ ঢাকা পড়ে গেছে। নদীর দুই তীরের মাটি অদৃশ্য। দ্রুত সংকীর্ণ নালায় পরিণত হচ্ছে এককালের প্রমত্তা বুড়িগঙ্গা। শত কি দুইশত বছর পর এ নদী নগর বর্জ্যবাহী নালায় পরিণত হবে। মাটি রাক্ষসের উদরে চলে গেছে নদীপাড়ের মাটি। বড় বড় অট্টালিকার পদতলে পদভারে আর্তনাদ করছে বুড়িগঙ্গা। বাঙালির শুধু নগরসভ্যতার স্মৃতি নয় বুড়িগঙ্গা। বাঙালির প্রবহমান ইতিহাস, তার সংস্কৃতি, সাহিত্য, অর্থনীতি এবং রাজনীতির সাক্ষ্য বহন করে এ নদী। প্রাচীন বাংলার প্রথম মানচিত্র এঁকেছিলেন যে রেনেল সাহেব তার নদ-নদীর সঙ্গে বুড়িগঙ্গারও নাম ছিল। আক্ষেপ এই, বাঙালি তার জাতীয় ঐতিহ্যের এই নদীটিকে হত্যা করে তার রক্তমাংস গিলে-চিবিয়ে খেয়েছে। প্রাচীন গ্রিকদের ইতিহাসে, মুঘল-সুলতানি ইতিহাসে, গুপ্তযুগের ইতিহাসে এবং ইংরেজদের ইতিহাসে বুড়িগঙ্গা যৌবনবতী নদী ছিল। বার্ধক্য অর্থে নয়, বরং আদরের বালিকা অর্থে তার নাম হয় বুড়িগঙ্গা। ভূমিদস্যু বা মাটিগ্রাসীরা চির কৈশোরের এই নদীটাকে বাঁচতে দিল না। সে যেন ধর্ষিত বিধ্বস্ত করুণ বালিকা।
আমার জন্ম নদী শীতলক্ষ্যা। শীতলক্ষ্যা আমার অস্তিত্ববিশ্ব। আমার সাহিত্যের, চিন্তা-চেতনা-দর্শনের অসীম এক জগৎ সে। মাতৃগর্ভ থেকে তার প্রসবের স্থান বরমী-কাপাসিয়া। ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী কালিবানার নদী থেকে সে জাত। সেখানে গেলে দেখা যায় বালিদস্যুদের ড্রেজার কীভাবে খুঁড়ে খাচ্ছে তার অতল জলের বুক। নদীর কলজে-হৃৎপিন্ড-ফুসফুস চিবিয়ে খাচ্ছে বালিদস্যুরা। বর্ষায় পাড় ভাঙছে। অচেনা হয়ে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যার জন্মশয্যা। শীতলক্ষ্যার জন্ম তো বালি-মাফিয়াদের মুনাফার জন্য হয়নি? হয়নি ঢাকা শহরের অট্টালিকা নির্মাণের জন্য? কিন্তু পুঁজিবাদী মুনাফার শক্তি-রহস্য যে বড় জটিল, নির্মম-নিষ্ঠুর। মাটি বা বালির ক্ষুধা যে অন্যসব ক্ষুধার চেয়ে কোনো অংশেই দুর্বল নয়। বরং বলতে হয় ধনতন্ত্রের ভয়ংকর বিভীষণ-বিভীষিকাময় ক্ষুধা। মাটিখেকো নরইঁদুরদের তৈরি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সিস্টেমের ধ্বংস না হলে মাটির এই ধরিত্রী বাঁচবে না। বাঁচানো যাবে না। মহাসংকটে পড়বে বাঙালি। আজ যে উন্নয়নের ঢাকঢোল পিটিয়ে, নহবত বাজিয়ে নৃত্য করা হচ্ছে তার আড়ালে রয়েছে কী? সস্তাশ্রম আর ভূমি গ্রাস করে রপ্তানিমুখী শিল্প স্থাপনের নামে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির শোষণের ক্ষেত্র তৈরি নয় কি? তার জন্য কি একাত্তরে রক্ত দিয়েছিল মানুষ? এটা কি মিথ্যে যে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশটার মাটি গ্রাস করেছে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি?
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
কবে শবে বরাত-কদর? কোন তারিখে শুরু রোজা? এরপর ঈদ! রোজাদার মুসলিমরা এখনো নিশ্চিত নন। এদ্দুর শুনেছেন আগামী ২৩ বা ২৪ মার্চ থেকে রমজান মাস শুরু হতে পারে। এ বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিতে রাখা হয়েছে চাঁদ দেখা কমিটি। কিন্তু, বাজার সিন্ডিকেট সব দেখে ফেলেছে। ঈদ-চাঁদ তাদের মুখস্থ। মৌসুম দৃষ্টে তাদের চানরাত চলছে, যা শুরু হয়েছে ঢের আগেই। মৌসুমি বাণিজ্য হাতাতে করণীয়র যাবতীয় ছক আগেই করে শুরু করেছে বাস্তবায়ন। আদা-সাধা থেকে রসুন, বুট, ছোলা, ডাল, তেল, মসলাসহ রোজা-রমজানের জরুরি সব আইটেমের কারসাজি তাদের কব্জায়। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও ডলার সংকট তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। সব কিছুতে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ আর ডলার সংকটের অজুহাত তাদের। কিশোরগঞ্জের শুঁটকি, কুমিল্লার কচুরলতি বা নরসিংদীর লাউয়ের দরেও শোনানো হয় ডলার ক্রাইসিসের কথা। জ্বালানি তেল পরিস্থিতির জন্য রাশিয়া প্রাসঙ্গিক। চাল, আটা-ময়দার চড়া দামের জন্য ইউক্রেনের দুরবস্থা, আর আদা-রসুনে জানানো হয় চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক বিরোধের তথ্য। এসব তথ্য একদম অমূলক বা ভিত্তিহীন নয়। যোগসূত্র অবশ্যই বিদ্যমান। কিন্তু, দোহাই আর অজুহাতের নমুনা বড় নির্মম। এরা অচেনা নয়, কিন্তু অধরা। ক্ষেত্র বিশেষে যেন সরকারের চেয়েও শক্তিশালী। তার মানে সরকার এদের চেয়ে কমজোরি? নিষ্পত্তিহীন প্রশ্ন।
বিলাসিতা পরিহার করে সংযম চর্চা রমজানের মূল শিক্ষা হলেও বাস্তবে মাসটিতে দেশের সিংহভাগ মানুষের ভোগ-চাহিদা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। বিশেষ করে ভোজ্য তেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি, খেজুর, বেগুনের পাশাপাশি মাছ-মাংসের চাহিদা বাড়ে দ্বিগুণের বেশি। এর লাগাম টানার আহ্বান জানানো হলেও নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটাই অসাধ্য। ঝুঁকিপূর্ণও। নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা নয়, কম খরচের আহ্বান বেশি রাখলেও ভিন্ন অর্থ টেনে আনার ভয় কাজ করে। এর পুরো সুযোগটা নেয় বাজার সিন্ডিকেট। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে হাহাকার ছড়ানো, নিত্যপণ্যের বাজার চড়ানোর অবারিত সুযোগ আপনাআপনিই চলে যায় তাদের হাতে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের জন্য এটি কিছুটা বিষে আক্রান্ত হওয়া বা বিষ খেয়ে বিষ হজম করার মতো দশা। এবার নিত্যপণ্যের বাড়বাড়ন্ত অবস্থার মধ্যে রমজানকে টার্গেট করে সিন্ডিকেট বেশি তৎপর। গত ক’দিন ধরে প্রতিটা দিনই তাদের কাছে চানরাতের মতো। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও ডলার সংকটকে কাজে লাগিয়ে মুনাফাবাজির ষোলোকলা ভরছে তারা। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, পাম অয়েল, হলুদ, মরিচ, এলাচ ও দারুচিনিসহ প্রায় সবপণ্যেই থাবা বসিয়েছে। নতুন করে কেবল দাম বাড়ায়নি, সামনে মাল পাওয়া কঠিন হবে মর্মে আতঙ্ক তৈরিতেও কামিয়াব হয়ে গেছে।
এরইমধ্যে পরিস্থিতি বিবেচনায় চাহিদার অতিরিক্ত পণ্য না কেনার আহ্বান জানিয়ে ট্রল আইটেম করে ফেলা হয়েছে বাণিজ্যমন্ত্রীকে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা এসেছে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। এতে গা মাখা বা ভয় পাওয়া কবেই ভুলে গেছে কথিত সিন্ডিকেট। জটিলতার মধ্যেও এলসির বহু পণ্য বন্দরে এসেছে-আসছে। ডলার সংকটে চালান খালাসে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে তাও সত্য। এ সত্যকে ভিত্তি ধরে আমদানিকারকদের প্রতিদিন লাখ লাখ ডলার ক্ষতির কথা বেশি বেশি প্রচারের মধ্যে সামনের দিনগুলোতে পণ্যমূল্য আরও বৃদ্ধির বার্তা পাচ্ছে মানুষ। যে পর্যায় বা পেশার মানুষই হোক তারা প্রতিদিনই দ্রব্যমূল্যসহ নানা সংকটের উত্তাপ টের পাচ্ছেন। যেসব এলসি হয়ে গেছে, সেসব পণ্যের অর্থ সময়মতো খালাস করতে পারলে সংকট প্রকট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু, তা প্রকাশের ভাব-ভঙ্গিতে মতলব পরিষ্কার। রমজান উপলক্ষে নিত্যপণ্যের জোগান নিশ্চিত ও দাম সহনীয় রাখতে সরকারের উদ্যোগকে পারলে আড়ালই করে ফেলা হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ থেকে জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভোজ্য তেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানির সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। যা ডলার সংকটের এই সময়ে এলসির অনিশ্চয়তা কিছুটা কমেছে। কিন্তু, সুযোগের অপেক্ষমাণদের তৎপরতা কমেনি।
কথাচ্ছলে বলা হয়ে থাকে, মুক্তবাজারে সরকার হস্তক্ষেপ করে না বা করতে পারে না। বাজার অর্থনীতি নিয়ে এ ধরনের আরও কিছু কথামালা প্রচলিত আছে। এসব কথার মধ্যে এন্তার ফাঁকফোকর। আগে-পিছে প্রচুর পরিমাণে ‘যদি, কিন্তু, তবে’ লুকানো এসব কথার পিঠে কথার সঙ্গে কিছু প্রশ্নও রয়েছে। বাজারে হস্তক্ষেপের চেয়ে এখানে বাজার নষ্টের হোতাদের শায়েস্তা করা বেশি প্রাসঙ্গিক। সেইক্ষেত্রে কেবল হস্তক্ষেপ নয়, প্রয়োজনে পদক্ষেপও প্রত্যাশিত। এটি সরকারের বিশেষ দায়িত্বও। যে কারণে ধরপাকড়-জরিমানাসহ অভিযান চলে এদের বিরুদ্ধে। কিন্তু, সুফলটা কাক্সিক্ষত মাত্রায় আসে না। অভিযানকারীরা চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাজার দুর্বৃত্তরা বেঁকে বসে। পারলে আগের চেয়ে আরেকটু বেশি করে। কেবল চিনি-পেঁয়াজ, নুন-মরিচ নয়; কচুরলতি-শুঁটকির বাজারও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলে। জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম, মজুদ, সরবরাহের নিয়ন্ত্রকও তারা। এদের রুখতে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একগুচ্ছ জরুরি নির্দেশনা জারি করাই আছে। নির্দেশনাগুলো কম-বেশি পালন হলেও এদের দমানো যাচ্ছে না। এই ছিনিমিনি, চালবাজিসহ বাজার পরিস্থিতির হোতারা অজানা-অচেনা নয়।
বহুদিন ধরে ‘চক্র-গোষ্ঠী’ ধরনের নামে সম্বোধন করা হতো এদের। গত বছর কয়েক ধরে ডাকা হয় ‘সিন্ডিকেট’ নামে। এদের কারণে সিন্ডিকেট নামের সুন্দর শব্দটির অর্থ বদলে গেছে। সিন্ডিকেট শব্দটি ফরাসি ভাষা থেকে আগত। উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ সিন্ডিকাস থেকে। ব্যাখ্যায় সিন্ডিকেট হলো: ব্যক্তি, কোম্পানি, করপোরেশন বা সংস্থার একটি স্ব-সংগঠিত গোষ্ঠী যা কিছু নির্দিষ্ট ব্যবসায় লেনদেন করার জন্য অথবা একটি অংশীদারত্বমূলক স্বার্থ অনুসরণ বা প্রচারের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। অভিধানে সিন্ডিকেটের প্রথম সংজ্ঞা হচ্ছে, ব্যবসায়িক উদ্যোগ বা সংগঠিত সংস্থাগুলোর একটি যৌথ প্রকল্প যা যৌথ মূলধন প্রয়োজনের জন্য গঠিত। কিন্তু, বাস্তবে এখানে অর্থটা ভিন্ন। বলার অপেক্ষা থাকছে না, কিছু লোকের কাণ্ডকীর্তিতে ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটির ব্যবহার প্রায়ই অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত অর্থ হয়ে গেছে। অথচ এক সময় সিন্ডিকেট শব্দটি স্মার্ট ছিল। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে সিন্ডিকেট-অ্যাসোসিয়েটস ধরনের শব্দ ব্যবহারে জৌলুশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বার বলতে অন্যরকম গর্ব হতো। এখন ব্যবহার হয় ‘দুষ্টচক্র’ অর্থে। দেশে সিন্ডিকেট বলতে এখন বোঝায়, মধ্যস্বত্বভোগী। তারা এ সমাজেরই অংশ। আমাদের চারপাশে বা মধ্যেই তাদের বিচরণ। কিন্তু, নিজেকে বা নিজেদের ‘সিন্ডিকেট’ বলে পরিচয় দেয় না। আবার কেউ আঙুল তুলে তাদের সিন্ডিকেট নামে ডাকে না। কিন্তু, নাম-ঠিকানাসহ জানে, চেনে। সরকারের দিক থেকেও সিন্ডিকেট শব্দ ব্যবহার হয়। এই সিন্ডিকেট সাহেবদের কর্মপরিধি কেবল চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণসহ নিত্যপণ্য নিয়ে নয়। পরিবহন, ব্যাংক-বীমা, গ্যাস-বিদ্যুৎ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, ঠিকাদারি, সরকারি কেনাকাটাসহ প্রায় সব সেক্টরেই। এদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য-চিকিৎসাও। একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিলে উদ্দেশ্য হাসিল করে চলছে তারা। শুধু সাধারণ মানুষের জীবন নাজেহাল নয়, সরকারকেও অক্টোপাসের মতো গিলে ফেলার অবস্থা করে দিচ্ছে এ সিন্ডিকেট।
বিভিন্ন সেক্টরে ঘটনাচক্রে নানান সিন্ডিকেটের কথা আসে। সিন্ডিকেট নেই কেবল গরিব ভোক্তাদের। এরাই হচ্ছে টার্গেট গ্রুপ। তাদের উদ্দেশ্য করে সিন্ডিকেট বেশ ক্রিয়াশীল। নিজেদের স্বার্থে এরা যেকোনো সময় জনগণকে জিম্মি করে ভোগান্তিতে ফেলতে কার্পণ্য করে না। এরা এক সেক্টরেও থাকে না। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারেও এরাই। মানবপাচার, খুন, গুম, ধর্ষণ ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও চলে বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। মৌসুম দৃষ্টে সেক্টর বদলায় অদৃশ্য শক্তির মতো। বিভিন্ন সেক্টরে মামুরা আর খালুরার মতো তারা তারাই করে যাচ্ছে নানা অপকর্ম।
চুরির ওপর সিনাজুরিতে এরা কেবল ক্রেতাকুলকে নয়, গোটা দেশ এমনকি সরকারকেও কাহিল করে চলছে। কিন্তু, সরকার সিন্ডিকেটকে সেই অনুপাতে কাবু করতে পারে না। জনগণের সঙ্গে পরিচয় করিয়েও দেয় না। শনাক্ত করার পদক্ষেপও নেয় না। পরিণামে দমনের চেষ্টা করেও কুলাতে পারে না। অথচ সিন্ডিকেটের কাজের দায়-বদনামের সিংহভাগ গড়ায় সরকারের ওপর। অজুহাতে পাকা এই চক্র করোনা মৌসুমে দাবড়িয়েছে সব সেক্টর। এরপর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে আশীর্বাদ হিসেবে পাকাপোক্তভাবে ভর করেছে খাদ্য থেকে ওষুধ পর্যন্ত যাবতীয় নিত্যপণ্যে। যথারীতি গত ক’দিন ধরে তাদের যাবতীয় কর্মযজ্ঞ রমজানকে ঘিরে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
আমাদের সমাজে কি সহিষ্ণুতা কমে যাচ্ছে? এ শুধু রাজনৈতিক পরমতসহিষ্ণুতার প্রশ্ন নয়, সমাজের সব স্তরে সব খানেই যেন সহিষ্ণুতার বড় অভাব। আর তার বিপরীতে যেকোনো ঘটনা-দুর্ঘটনাতেই আমরা যেন দ্রুতই উত্তেজিত হয়ে পড়ছি, উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছি আর সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছি। এমন বাস্তবতার খোঁজ পাওয়া যাবে পথে-ঘাটে বাজারে-বিপণিতে হরহামেশাই। অবস্থা দেখে মনে হয় সবাই যেন আপ্তবাক্য হিসেবে সংঘাত উসকে দেওয়া সেই পুরনো গ্রামীণ বচনই মেনে নিয়েছে যে ‘হাত থাকতে মুখে কি!’ এমন সহিংস প্রবণতা যেন সংক্রামক হয়ে গেছে সারা দেশের নগর-বন্দর-জনপদে। এই প্রবণতার পরিণতি যে কত ভয়াবহ হতে পারে সেটা দেখা যায় কোনো সংঘাত যখন জনতার মধ্যে ছড়িয়ে যায় তখন। জনতা একবার উত্তেজিত হয়ে পড়লে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। প্রশ্ন জাগছে যে, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে রবিবার সড়ক দুর্ঘটনায় এক কারখানা শ্রমিকের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় ৩০০ গাড়ি ভাঙচুর এবং সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা কি এমন সহিংস প্রবণতারই ফল নাকি এর নেপথ্যে রয়ে গেছে আরও গূঢ় কোনো কারণ?
সোমবার দেশ রূপান্তরে ‘৩০০ গাড়ি ভাঙচুর ৪ ঘণ্টার যানজটে নাভিশ্বাস’ প্রতিবেদনে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ঘটনাপ্রবাহে যে ভয়াবহ সন্ত্রাসের চিত্র ফুটে উঠেছে সেটা মেনে নেওয়া সত্যিই কষ্টকর। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, কালিয়াকৈরে সড়ক দুর্ঘটনায় এক নিরাপত্তাকর্মী নিহতের ঘটনার পর তার প্রতিবাদে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে প্রায় তিন শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর চালিয়েছেন কারখানার বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। এতে প্রায় অর্ধশত পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রী আহত হয়েছেন। এ সময় মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপাশে প্রায় ১৫-১৬ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন ইজতেমাগামী মুসল্লিসহ পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীরা। রবিবার সকালে ওই মহাসড়কে ট্রাকচাপায় আজাদুল ইসলাম (৪৫) নিহত ও তিন শ্রমিক আহত হন। এর পর থেকে মহাসড়কে বিক্ষোভ করতে থাকেন শ্রমিকরা। ট্রাকটিতে আগুন দিয়ে গাড়ি ভাঙচুর শুরু করেন তারা। এরপর ওই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। খেয়াল করা দরকার, এই দুর্ঘটনা এবং পরবর্তী সহিংসতার সঙ্গে মহাসড়কের ওই অংশে ফুট ওভারব্রিজ না থাকার মতো একটা বিষয়। এলাকাবাসী, কারখানার শ্রমিক, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কালিয়াকৈর ওই এলাকায় কোনো ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় মাহমুদ জিন্স লিমিটেড, নুর গ্রুপের রাইয়ান নিট কম্পোজিট লিমিটেড, নাগ্ররাসহ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা ওই স্থানে প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়ক পার হন। ফলে প্রায়ই ওই স্থানে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন শ্রমিকসহ স্থানীয়রা। পোশাক কারখানার কর্র্তৃপক্ষ মহাসড়কের ওই স্থানের দুপাশে নিরাপত্তাকর্মী রেখেছেন। প্রতিদিনের মতো সকালে কারখানায় কাজে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন শ্রমিকরা। এ সময় নিরাপত্তাকর্মীরা লাল নিশান উড়িয়ে যানবাহন থামানোর চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে মাহমুদ জিন্স লিমিটেড কারখানার নিরাপত্তাকর্মী আজাদুল ইসলামও নিশান উড়িয়ে শ্রমিক পারাপার করছিলেন। এ সময় তাদের নিশান উপেক্ষা করে পাথরভর্তি দ্রুতগতির একটি ট্রাক তাকেসহ চারজন শ্রমিককে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই নিরাপত্তাকর্মী আজাদুল ইসলাম মারা যান।
কালিয়াকৈরে ট্রাকচাপায় আজাদুলের মৃত্যু এবং পরবর্তী অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতা থেকে এটা স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান যে, ‘লাল নিশান’ উড়িয়ে মহাসড়ক পারাপারের মতো একটি অগ্রহণযোগ্য ব্যবস্থাপনার কারণেই সেখানে ট্রাকচাপায় ওই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, একটি শ্রমঘন শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের মহাসড়ক পারাপারের নিয়মিত ব্যবস্থা হিসেবে এমন ‘লাল নিশান ব্যবস্থা’ কীভাবে বৈধতা পেল? সেখানকার কারখানা মালিকরা কেন স্থানীয় প্রশাসন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্রমিকদের মহাসড়ক পারাপারের জন্য স্থায়ী সমাধান হিসেবে সেখানে ফুটওভার ব্রিজ তৈরির পদক্ষেপ নিলেন না? নিজ নিজ কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে সেটাই করণীয় ছিল কারখানা মালিকদের। অন্যদিকে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একটি পাথরবোঝাই ভারী ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে এক নিরাপত্তারক্ষীর মৃত্যু সহকর্মীদের ক্ষোভের কারণ হবে। কিন্তু সেই ক্ষোভের কারণে বহু মানুষের মধ্যে সহিংসতা ও সংঘাতকে আরও ছড়িয়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। উত্তেজনা থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়ার এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর ফুটওভার ব্রিজের মতো একটা কাঠামোর সংকট কীভাবে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে তার শিক্ষা নেওয়ারও তাগিদ দিচ্ছে কালিয়াকৈরের ঘটনা। কালিয়াকৈরের এই লাল নিশান থেকে যদি শিক্ষা না নিই তবে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি সারা দেশেই চলতে থাকবে।
১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে শহীদ হন ‘শহীদ মতিউর’ নামে খ্যাত মতিউর রহমান মল্লিক। তার জন্ম ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি ঢাকায়। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি কারফিউ ভেঙে ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশ সেই মিছিলে গুলি চালায়। তখন শহীদ হন ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান। এরপর ২৪ জানুয়ারি ঢাকা আবার মিছিলে উত্তাল হয়ে উঠলে সেদিন পুলিশ গুলি চালায়। তখন পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঐতিহ্যবাহী স্কুল নবকুমার ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। কিশোর সৈনিক শহীদ মতিউরের রক্ত বৃথা যায়নি। তার রক্তের ধারা বেয়েই ঊনসত্তরের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান তুঙ্গস্পর্শী হয়, আর তারই পরিণতিতে স্বৈরাচারী আইয়ুবের ক্ষমতার অবসান ঘটে। এর পরেই আসে সত্তরের নির্বাচন, নির্বাচনে বাঙালির বিজয়, ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে পরবর্তী স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের নানা ছলচাতুরী, প্রতারণা এবং সবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম। কিশোর শহীদ মতিউর শুধু ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানেরই এক অদম্য প্রেরণাশক্তি নয়, বাঙালির মহান মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসেও তার আত্মদান চিরদিন অম্লান থাকবে।
রোমাঞ্চকর ফাইনালে মোহামেডানকে ১৪ বছর পর ফেডারেশন কাপ শিরোপা এনে দেওয়ার অন্যতম নায়ক আহসান আহমেদ বিপু। দীর্ঘদিন সাদা-কালোদের হয়ে খেলা এই গোলরক্ষক কাল দেশ রূপান্তরের শিহাব উদ্দিনকে জানালেন আবাহনীর বিপক্ষে উত্তেজনার ম্যাচে চাপ মাথায় নিয়ে নামা ও পেনাল্টি ভাগ্যে জয়ী হওয়ার পেছনের গল্প…
এত বড় ফাইনালে হঠাৎ করে বদলি হিসেবে নামলেন। এটা কি আপনার জন্য চাপ হয়েছিল?
বিপু : চাপ তো অবশ্যই। গোল আর গোল, ফাইনাল, প্রতিপক্ষ আবাহনী। মানসম্মানের ব্যাপার। এটা কিন্তু একটা ফাইনাল না শুধু, সম্মানেরও ব্যাপার। চাপ তো অবশ্যই ছিল।
তো এই চাপটা সামলালেন কীভাবে?
বিপু : সত্যি বলতে আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল যে আমরা কামব্যাক করতে পারব। শুধু আমি একা না পুরো দল, হাফটাইমে যখন ২ গোল হয়, আমরা ডাগআউটে একজনও হতাশার কথা বলিনি। আমরা চরম বিশ্বাসী ছিলাম যে এখান থেকে ম্যাচ ঘুরানো সম্ভব। আমাদের অধিনায়ক দিয়াবাতে আত্মবিশ্বাসী ছিল যে ম্যাচে ফেরা সম্ভব।
কিন্তু নামার পরপরই তো একটা গোল হজম করলেন। তাতে কি চাপ বাড়েনি?
বিপু : না বাড়েনি কারণ গতকাল যে ৮টা গোল হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে সেরা গোল ছিল ওটা। গোলটা সত্যি বলব আমি নিজের ভুলে হজম করেছি। হাতেও লেগেছিল কিন্তু আটকাতে পারিনি।
পরে তো পেনাল্টি মানে ভাগ্য পরীক্ষাতেও নামতে হলো? তার মানে আপনার ওপর সবার বিশ্বাস ছিল?
বিপু : ওটা জানি না, এটুক বলতে পারি আমাদের কোচিং স্টাফ আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছিল। যেহেতু ফাইনাল, পেনাল্টির একটা সম্ভাবনা তো থাকেই। তো আমাদের আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া ছিল, গোলরক্ষক কোচ কানন ভাই আমাদের নিয়ে পেনাল্টির আলাদা কাজ করেছিলেন। কিছু বিষয় যেমন শুট নেওয়ার আগ মুহূর্ত মানে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা। আর নিজেও একটু চিন্তাভাবনা রেখেছিলাম। তো প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। চাপ নেওয়ার ব্যাপারটা আসলে আমি স্বাভাবিক ছিলাম। বেশি কিছু চিন্তা করিনি। এমন সময়গুলোতে বেশি চিন্তা করলে উল্টো চাপে পড়ে যেতে হয়।
পেনাল্টি নিয়ে প্রস্তুতির কথা বলছিলেন। আগে থেকেই কি পেনাল্টির প্রস্তুতি ছিল?
বিপু : সে রকম না। কারণ ফাইনালে আগে থেকেই তো বলা যায় না যে পেনাল্টি হবেই। তবে আমাকে খেলার আগে থেকেই মানে ফাইনালের আগেই বলা হয়েছিল যে খেলা যদি ড্রয়ের দিকে যায় তাহলে নামতে হতে পারে। সেই প্রস্তুতি নেওয়া ছিল। তবে পেনাল্টির একটু আগে নামতে হয়েছিল আরকি।
পেনাল্টিতে দুটো সেভ করলেন। এটা কীভাবে সম্ভব হলো। কী ভাবছিলেন ডাইভ দেওয়ার আগে?
বিপু : সত্যি বলছি আমার কোনো চিন্তাই ছিল না। হয়ে গেছে। আল্লাহ মিলিয়ে দিয়েছেন, এখানে আমার কিছু নেই।
বিশ্বকাপ ফাইনালেও তো পেনাল্টি হয়েছিল। তা তো দেখেছেন। নিজের পেনাল্টি মুখোমুখি হওয়ার সময় ওই রকম কিছু মনে হচ্ছিল?
বিপু : না, ওরকম কিছু না। আমি আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখেছিলাম। আর মনে মনে ভাবছিলাম যে দলের জন্য কিছু করতেই হবে। আমি বলতে পারি এই দলটার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো খেলোয়াড় কিন্তু আমি। আমি দীর্ঘদিন মোহামেডানে খেলেছি। মোহামেডান থেকে সুপার কাপ জিতেছি, স্বাধীনতা কাপ জিতেছি। তো ক্লাবের জন্য কিছু করার তাগিদটা ছিল।
পেনাল্টিতে প্রথম সেভ করার পর আপনার সাহস কি বেড়ে গিয়েছিল?
বিপু : সাহস তো বেড়েছেই। প্রথম সেভটা যখন করি তখন আমার টিম মেটরাও মানসিকভাবে এগিয়ে গেছে। এরপর আমাদের অধিনায়ক গোল করল। প্রথম গোল করা মানে মানসিকভাবে এগিয়ে থাকা। রাফায়েল কিন্তু আবাহনীর অনেক বড় ব্র্যান্ড। হতে পারে কলিনদ্রেস নামের বিচারে ভারী কিন্তু রাফায়েল এগিয়ে।
প্রথমটা তো সেভ করলেন দ্বিতীয় পেনাল্টি সেভের আগে কী ভাবনা হচ্ছিল আপনার। দ্বিতীয়টা সহজ হয় না কঠিন?
বিপু : ওটা ফিফটি-ফিফটি ছিল। কলিনদ্রেস একটু অপেক্ষা করছিল মারার সময় তাই আমিও ওয়েট করলাম। আর সফল হই। কলিনদ্রেসের শটটা কিন্তু যথেষ্ট পাওয়ারফুল ছিল। আমি সঠিক দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আর রাফায়েল একটু স্লো শট নেয় সবসময়। আর সবসময় একটু জার্ক করে বাঁদিকে শট নেয়, কাল নিয়েছিল ডানদিকে। আমি অপেক্ষা করায় সঠিক দিকে ডাইভ দিতে পেরেছি।
আচ্ছা আপনার পছন্দের গোলকিপার কে?
বিপু : পিওতর চেক।
বিশেষ কোনো কারণ আছে ওকে পছন্দ করার?
বিপু : ঠিক কেন সেটা বলতে পারব না। তবে ওর সেভগুলো আমার ভালো লাগে। এখন অনেক গোলরক্ষক থাকতে পারে, চেক আমার কাছে এখনো সেরা। বিশেষ করে একটা সেভ দেখেছিলাম ও মাটিতে পড়ে গিয়েও কীভাবে যেন হাত দিয়ে বল ফিরিয়েছিল। চেলসিতে থাকা অবস্থায় সম্ভবত। এছাড়া শুধু একটা না আরও অনেক সেভ করেছে সে। আর একটা ব্যাপার হলো তার ইনজুরির পরও যেভাবে সে খেলা চালিয়ে গেছে এটা আমাকে উজ্জীবিত করে। আমিও ইনজুরির পর খেলছি, ২০১৮-১৯ এ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বসুন্ধরার সঙ্গে ফেডারেশন কাপের ম্যাচ খেলার সময় আমার হাত ভেঙেছিল। এখনো হাতে প্লেট লাগানো আছে।
নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
বিপু : আমার কোনো নিজস্ব লক্ষ্য নেই। আমি খেলে যেতে চাই। কোচরা জানেন আমাকে কোথায় খেলাবেন। জাতীয় দলে খেলার ইচ্ছা তো সবারই থাকে কিন্তু আমি সেই লক্ষ্য নিয়ে আগাতে চাই না। হলে এমনিতেই হবে।
অনেক বছর পর মোহামেডান শিরোপা জিতল। এই ধারা অব্যাহত রেখে সামনেরবার কী লক্ষ্য রাখছেন?
বিপু : গত বছর আমরা সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিলাম সেখানে রেফারিংয়ের কিছু ব্যাপার ছিল আপনারা সবাই দেখেছেন। ইনশাআল্লাহ এই ধারা অব্যাহত থাকবে। আমাদের ফল তো আগের থেকে ভালো হচ্ছে। এটা বড় আত্মবিশ্বাসের কারণ।
নির্ধারিত সময় পেরিয়েছে। ১০ জনের ব্রাজিল। তবুও এগিয়ে ২-০ গোলে। খেলা গড়ায় ইঞ্জুরি টাইমে। তখনই যেন বেড়ে যায় সেলেসাওদের গতি। মিনিট কয়েকের মুহূর্তে ব্যবধান দাঁড়ায় ৪-০ গোলে। তবে প্রতিপক্ষ তিউনিশিয়াও কম যায় না। হাল ছাড়েনি তারা। শেষ মুহূর্ত অবধি লড়ে গেছে। তাতে আদায় করেছে একটি গোল। যদিও সেই গোল তাদের নিয়ে যেতে পারেনি পরের ধাপে।
যুব বিশ্বকাপে আন্দ্রে সান্তোসের জোড়া গোলে ম্যারাডোনার মাঠে উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিশিয়ার বিপক্ষে ৪-০ গোলের জয় পেয়েছে ব্রাজিল। এতে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করেছে সেলেসাওরা।
ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা মাল্টি পারপাস স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত শেষ ষোলোর খেলার পুরোটা সময় বলের দখলটা বেশি ছিল তিউনিশিয়ার পায়েই। আক্রমণের ধারও ছিল ভালো। গোলের সুযোগও অনেকগুলো সৃষ্টি হয়েছিল। তবু ফিনিশারদের ছিল ব্যর্থতা। আর সেটা কাজে লাগিয়েছেন ব্রাজিলের যুবারা। শুরুটা অবশ্য তিউনিশিয়ার কল্যাণেই।
খেলার ১১ মিনিটে পেনালটি পেয়ে যায় ব্রাজিল যুবারা। সেখান থেকে গোল আদায় করে নেন মার্কোস লিওনার্দো। ৩১ মিনিটে এই লিওনার্দো ফের দলকে এগিয়ে দেন। তবে এবার আর তিনি গোল করেননি, তবে করিয়েছেন। তার পাস থেকে পায়ে বল নিয়ে তিউনিশিয়ার জালে জড়ান আন্দ্রে সান্তোস।
২-০ গোলের ব্যবধান পেয়ে হৈ হৈ করতে করতে বিরতিতে যেতে পারত ব্রাজিল। কিন্তু প্রথমার্ধের শেষ বাঁশিটা বাজার আগ মুহূর্তেই লাল কার্ড দেখেন রবার্ট রেনান। তার এমন কাণ্ডে ১০ জনের দলে পরিণত হয় ব্রাজিল।
তাতে অবশ্য পরের অর্ধের নির্ধারিত সময়ে কোনো ছাপ পড়তে দেখা যায়নি। ব্যবধানটা যে তখনও ২-০ তেই ছিল। তবে ৯১ মিনিটে ফের গোল আদায় করে ফেলে ব্রাজিল। এবার ম্যাথুস মার্টিনস। তার ৯ মিনিট পর আন্দ্রে সান্তোস নিজের দ্বিতীয় গোল আদায় করে নেন। চার গোলে এগিয়ে থেকে ব্রাজিল যখন জয়ের অপেক্ষা করছিল, ঠিক তখনই ১০৩ মিনিটের সময় প্রথম গোলটি হজম করে সেলেসাওরা।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে ফরমায়েশি বলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য দেশের আইন ও আদালত অবমাননার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির মামলায় এর আগে বিএনপির দুই নেতাকে নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজা বহাল রেখে দেশের উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে, সে সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিবের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দেশবাসীকে হতাশ করেছে।’
গতকাল বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদে জানিয়ে এ বিবৃতি দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মনে করেন, মার্কিন নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করার পর বিএনপি তাদের বিদেশি প্রভুদের কাছ থেকে করুণা প্রাপ্তির আশায় সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। উচ্চ আদালতের রায়কে ফরমায়েশি বলা তাদের সেই চলমান ষড়যন্ত্রেরই অংশ। বিএনপির এ দুই নেতার আজকের পরিণতি তাদের ধারাবাহিক অপরাজনীতিরই ফসল বলে মন্তব্য করেন সেতুমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট শাসন আমলে হাওয়া ভবন খুলে তারা দুর্নীতি ও লুটপাটের মহোৎসবে মেতে উঠেছিল, যার পরিণতিতে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সে সময় হাওয়া ভবনের কর্ণধার জিয়াপুত্র তারেক রহমানের দুর্নীতির খতিয়ান বিশ^ গণমাধ্যম ও বিশ^খ্যাত গোপন নথি প্রকাশকারী সংস্থা উইকিলিকসে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি দুই নেতার দুর্নীতির মামলার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কোনো যোগসূত্র নেই। ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং তাদের অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার পর নিম্ন আদালত সাজা দিয়ে রায় দেয়। প্রায় ১৬ বছর বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করে আদালত তাদের সাজা দিয়েছে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দেশের পবিত্র সংবিধান অনুযায়ী সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও আইন ও বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। এমনকি বিশ্বজিৎ হত্যাকা- এবং বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার হত্যা মামলায়ও ছাত্রলীগের নেতারা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ভোগ করছেন।’ তিনি বলেন, বিএনপি দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তাদের দলীয় গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করেছে এবং দলের চিহ্নিত শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দিয়েছে।
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠলেই আলোচনায় আসেন সাবেক সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরণ। নগরীর লোকেরা বলে, তার মতো নগর পিতা দরকার। এবার আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত নগরবাসীকে কথা দিয়েছেন, হিরণের মতো করে নগরী গড়বেন তিনি। শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুর এক দশক পেরিয়ে গেছে, তবু তিনি আলোচনায়; শুধু বরিশালে নয়, সারা দেশে।
সংশ্লিষ্ট লোকজন বলে, হিরণের কর্মফলই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। একসময় সব ক্ষেত্রে বরিশাল সিটির মানুষ অবহেলিত ছিল। সেসব অবহেলার কারণ ঘুচিয়ে এবং মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী নগরীকে আধুনিক করার অঙ্গীকার নিয়ে হাজির হন হিরণ। মেয়র নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছরের মধ্যে নগরীর রূপ পাল্টে দেন তিনি। বরিশালকে সাজান আধুনিক রূপে।
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য আবদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হিরণ ছিলেন আদর্শ নেতা। মানুষকে বোঝার চেষ্টা করতেন। দক্ষ ও বিচক্ষণ এবং সৃজনশীল মানুষ। তিনি নগরীর উন্নয়ন নিয়ে যেমন ভেবেছেন, ঠিক তেমনি মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। তাই মানুষ ভুলতে পারে না তাকে।’
বিসিক শিল্পনগরীসংলগ্ন চায়ের দোকানদার মো. হালিম বলেন, ‘হিরণ সবসময় মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করতেন। সাধারণ পোশাকে চলতেন। দলমত নির্বিশেষ সবাইকে ভালোবাসতেন।’
নগরীর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সমির বলেন, ‘মেয়র হিরণ আমাদের জন্য রাস্তাঘাট, সড়কে বাতির ব্যবস্থাসহ অনেক কিছু করেছেন। তার কাজগুলোই কোনোমতে অনুসরণ করেছে অন্যরা। যে কাজ করে তাকেই তো মনে রাখব আমরা, তাই হিরণকে মনে রেখেছি।’
রিকশাচালক মো. হারুন বলেন, ‘এ নগরীর রাস্তাঘাট চলাচলের অযোগ্য ছিল। রাতে অন্ধকারে ডুবে থাকত। চুরি-ডাকাতি নিত্যখবর ছিল। কিন্তু হিরণ মেয়র হওয়ার পর রাতারাতি নগরী বদলে গেল। অনেক মানুষকে সিটি করপোরেশনে চাকরি দিয়েছেন তিনি। নগরীর গরিব মানুষকে এক টাকা করে হলেও সাহায্য করেছেন। সবার মন জয় করেছেন। আজ তার মতো একজন মানুষ থাকলে আমরা শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারতাম।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যাকে হারিয়েছি তাকে তো আর ফিরে পাব না। কিন্তু তার কর্ম, মানুষের প্রতি তার সম্মান এবং ভালোবাসা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি বিদ্যালয়ে এলে কখনো রাজনৈতিক আলাপ করতেন না। সবসময় শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হওয়ার জন্য বলতেন, গল্প শোনাতেন।’
একজন ব্যবসায়ী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হিরণ সাহেব থাকাকালে ব্যবসা করতে গিয়ে কখনো হেনস্তার শিকার হইনি। তিনি নিজেও ব্যবসায়ী ছিলেন। আমাদের ব্যবসায়ীদের কষ্ট তিনি বুঝতেন। কিন্তু নগরীর একদল মানুষ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাকে নির্বাচনে হারিয়ে দিয়েছে। তারপর হিরণ সাহেব দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন।’
বিএম কলেজের সাবেক ভিপি ও শওকত হোসেন হিরণের ঘনিষ্ঠ মঈন তুষার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হিরণ সাহেব প্রত্যেক নেতাকর্মীর নাম জানতেন। তিনি যার সাঙ্গে কথা বলতেন, সেই মানুষটিকে ভুলতেন না। এজন্য মানুষ তার প্রতি এত দুর্বল এবং আকৃষ্ট। নগরীর জন্য তিনি মাস্টারপ্ল্যান করে কাজ করেছেন। তার সঙ্গে মানুষ সরাসরি কথা বলতে পারত এবং দেখা করত। এখনো মানুষ তাকে ভালোবাসে এবং মনে রেখেছে।’
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সোহেল রানা বলেন, ‘সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণ বরিশালকে আধুনিক নগরীতে রূপান্তরিত করে গেছেন। উন্নয়ন-আন্তরিকতা ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতার সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি একজন আইকনিক সিটি মেয়র ছিলেন। আন্তরিকতাই একজন প্রশাসকের মূল সূচক। তাই তিনি সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছেন।’
মেয়র হিরণ ব্যক্তিগত জীবনে কেমন ছিলেন এ প্রশ্নের উত্তরে তার সহধর্মিণী ও সাবেক সংসদ সদস্য জেবুন্নেসা আফরোজ হিরণ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২৬ বছর আমি তাকে দেখেছি। তিনি কারও ভাই ছিলেন, একজন স্বামী ছিলেন এবং সন্তানদের বাবা ছিলেন। পরিবারভক্ত একজন মানুষ। মানবিক গুণাবলি ছিল। তার মা-ভক্তির খুব নাম আছে বরিশাল শহরে। স্বজন-সন্তান ও পরিবারের প্রতি যতœ নেওয়ায় কোনো কমতি ছিল না। স্ত্রী হিসেবে তাকে অসাধারণ কর্তব্যপরায়ণ একজন মানুষ হিসেবে দেখেছি আমি।’
তিনি বলেন, ‘উনি রাজনৈতিক মহলে অত্যন্ত বিচক্ষণ একজন ব্যক্তি ছিলেন। কর্মী ও সহযোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসা ছিল; নেতাদের প্রতি সম্মানে কোনো ঘাটতি ছিল না তার। ২০০১ সালের জামায়াত-বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে, তখন কর্মীদের কীভাবে বুকে আগলে রাখতে হয় আমি তা পাশে থেকে দেখেছি। রাজনীতি এবং নগর উন্নয়নÑ দুই ক্ষেত্রেই তিনি সফল।’
প্রসঙ্গত, শওকত হোসেন হিরণ এলএলবি পাস করার পর জাসদ ছাত্রলীগে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৮৮ সালে ২২ বছর বয়সে বরিশাল সদর উপজেলা থেকে বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর আলোচনায় আসেন তিনি। ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। রাজনীতিতে আরেক দফা পরিবর্তন আসে ১৯৯৬ সালের পর। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ভালো সখ্য থাকায় আওয়ামী লীগে যোগ দেন হিরণ। তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও সাংগঠনিক দক্ষতা বিবেচনা করে ২০০৩ সালে কেন্দ্রীয় কমিটি তাকে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মনোনীত করে। ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন। বরিশাল মহানগরীকে আধুনিক সাজে সাজান। স্থানীয় মানুষ ও তার অনুসারীদের কাছে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ২০১২ সালে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে বিএনপি নেতা আহসান হাবিব কামালের কাছে পরাজিত হন। গুঞ্জন রয়েছে, তার দলীয় লোকেরাই তার পরাজয়ের কারণ। হিরণের মন ভাঙলেও তিনি থেমে যাননি। ২০১৪ সালে বরিশাল সদর আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একই বছর ৯ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের মুখে থাকা কুড়িগ্রামের চর ভগপতিপুর সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিকটি অবশেষে বিলীন হয়ে গেছে। ক্লিনিকটি সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চলের চর ভগপতিপুর এলাকায় ছিল।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে চর ভগপতিপুর সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিকটি ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে বিলীন হয়। এর আগে ওই এলাকার একটি স্কুলও ভাঙনের শিকার হয়। এ ছাড়াও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে একটি মসজিদ ও আবাসন প্রকল্পের বাসিন্দাদের। ভাঙন আতঙ্কে দিন পার করছে ব্রহ্মপুত্র নদসহ অন্যান্য নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আব্দুল গফুর বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতির কারণে ক্লিনিকটি নিলামে বিক্রি করা সম্ভব হয়নি।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, অনেক চেষ্টা করেও ক্লিনিকটি রক্ষা করা গেল না।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।