
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট-২০২২’ প্রকাশিত হয়েছে গত ৩ জানুয়ারি ২০২৩। ইউনেস্কো বলছে, করোনা মহামারীর পর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় শিক্ষার ব্যয় বেড়েছে, ফলে অনেক পরিবার সন্তানের শিক্ষার খরচ জোগাতে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। প্রাইভেট টিউশন, শিক্ষা উপকরণসহ শিক্ষা-সংক্রান্ত খরচগুলো সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একই। ফলে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিতে এটি অনেক পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে শিক্ষা খাতে বেসরকারি খাতের আধিপত্য বেশি থাকাকে পরিবারভিত্তিক শিক্ষাব্যয় বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে বেসরকারি খাতের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল বাংলাদেশ। মাউশির ডিজি অবশ্য বাংলাদেশে শিক্ষার বেসরকারি খাত কথাটি পুনঃসংজ্ঞায়নের কথা বলেছেন। তিনি বলতে চাচ্ছেন এমপিওর মাধ্যমে শিক্ষকদের পুরো বেতন দিচ্ছে সরকার, বিদ্যালয় ভবন তৈরি করে দিচ্ছে সরকার, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দিচ্ছে সরকার এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে টিউশন ফি নেওয়া হয় সেটিও শিক্ষকদের বাকি চাহিদা মেটাতে বিদ্যালয় রেখে দিচ্ছে। তাহলে এই বিদ্যালয়গুলোকে আমরা ‘বেসরকারি’ বলব কি নাপ্রশ্ন রেখেছেন মাউশির ডিজি।
অন্যদিকে, বক্তাদের কেউ কেউ বলেছেন প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে শিক্ষায় কমিউনিটির অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে এবং প্রাথমিক শিক্ষা এক মানহীন শিক্ষায় পরিণত হয়েছে, যার ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষায় রাষ্ট্র পরিচালিত বিদ্যালয়ের পরিবর্তে বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। জেম রিপোর্টেও এসেছে যে, বাংলাদেশের প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার একটা বড় অংশ এখনো কিন্ডারগার্টেন ও ইংরেজি মাধ্যম প্রতিষ্ঠানের দখলে। প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যাপক জাতীয়করণের পরও প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু পাঠদান নিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে। মাধ্যমিকপর্যায়ে ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই পড়ছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বিদ্যালয়ে। আর উচ্চশিক্ষায় এক-তৃতীয়াংশের বেশি ডিগ্রি দিচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সব মিলিয়ে দেশের শিক্ষা খাত এখনো অনেকাংশেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠাননির্ভর।
সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান সন্তোষজনক নয় বলায় শিক্ষামন্ত্রী একটি পরিসংখ্যান দিয়ে বলেছেন, এবার দেশের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের মাধ্যমিক একটি অংশের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে বেসরকারি পর্যায়ে আসনসংখ্যা ছিল ৯ লাখ ২৫ হাজার ৭৮০। ভর্তির আবেদন পড়েছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার। আর সরকারিতে আসনসংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৯০৭, সেখানে আবেদন পড়েছে ৫ লাখ ৩৪ হাজার। তার মানে বেশি শিক্ষার্থী এবং বেশি অভিভাবক সরকারি বিদ্যালয়ে তাদের বাচ্চাদের পড়াতে চাচ্ছেন। এটি অবশ্য মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, প্রাথমিকে নয়। ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বিষয়টির ওপর চমৎকার এক মন্তব্য করে বলেছেন, এটি দুটি মেসেজ বহন করে। এক, সরকারি বিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আগ্রহ বেশি, বিশ্বাস বেশি কারণ সরকারিতে শিক্ষার মান ভালো। তার মানে হচ্ছে দেশে সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচ গুণ বাড়াতে হবে, যেটি সরকার করছে না। অন্য আরেকটি মেসেজ বহন করে, সেটি হচ্ছে এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের দিকে শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকদের আগ্রহ কম। তাহলে রাষ্ট্র এখানে যে অর্থ ব্যয় করছে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। জেম রিপোর্টের মূল উপস্থাপক বাংলাদেশ অংশের মূল উপস্থাপক ড. মনজুর আহমদ বলেছেন, সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে যে শিক্ষা অর্থাৎ এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান বিষয়টিকে পূর্ণ অর্থবহ করতে হবে।
ড. মনজুর আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশের মতো এত বিশাল বহরের শিক্ষাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা প্রয়োজন জেলাপর্যায় থেকেই। সবকিছু কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে শিক্ষার অগ্রগতি ও মান ব্যাহত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিশে^র কোথাও শিক্ষার দুটি মন্ত্রণালয় নেই, শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, রিলে রেশের মতো, প্রাথমিক একটি পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা সমাপ্ত করে আর একটি স্তরের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, এটি একেবারে বিচ্ছিন্নভাবে ঘটছে না।
আলোচনায় উঠে আসে যে, সরকারি ও বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার অনন্য মডেল হচ্ছে এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়। সেটিকে আর মিনিংফুল কীভাবে করা যায়, আরও অর্থবহ ও কার্যকর করা যায় সেটি দেখতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও প্রাইভেট কোচিং আছে, তবে এ খাতে বাংলাদেশের অভিভাবকদের ব্যয় করতে হয় সবচেয়ে বেশি। এ হার এখানে ৬৭ শতাংশ। আর গ্রামীণ এলাকায় ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে হয়। শ্রীলঙ্কায় শহরে ৬৫ শতাংশ, গ্রামে ৬২ শতাংশ, পাকিস্তানে সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের ২৫ শতাংশ ও বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের ৪৫ শতাংশ এবং ভারতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়ে। পাকিস্তানে শিক্ষাব্যয়ের ৫৭ শতাংশ ব্যয় করে পরিবার, বাংলাদেশে এটি ৭১ শতাংশ।
আমাদের শিক্ষাকে বৈশি^ক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য এবং শিক্ষাকে আনন্দময় করার ও প্রাইভেট কোচিং বন্ধ করার জন্য নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে, যেখানে পরীক্ষার পরিবর্তে শিখন-কার্যক্রমকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ শিক্ষাক্রম অনুসারে শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা। তবে, এগুলো সবই আশার কথা। নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা কম থাকলেও প্রাইভেট কোচিং বন্ধ হবে কি না সেই বিষয়টি নিয়ে যৌক্তিক কারণেই অনেক অভিভাবক সন্দিহান। কারণ বিদ্যালয়ে ৮০ থেকে ৯০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক আর ক্লাসের সময়কাল ৪০-৪৫ মিনিট। ফলে ক্লাসরুমে পাঠদান কতটা শেষ করা যাবে সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। একজন শিক্ষক কতজন শিক্ষার্থীদের দিকে সরাসরি নজর দিতে পারবেন সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ যেভাবে হচ্ছে সেখানেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
প্রখ্যাত ইংরেজ রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডো ১৮১৭ সালে প্রকাশিত তার On the Principles of Political Economy and Taxation গ্রন্থে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভিত্তি ‘তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্ব’ উপস্থাপন করেন। এই তত্ত্বের মূল কথা হলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক, জনমিতিক, শিক্ষাগত, প্রযুক্তিগত, অবকাঠামোগত নানা তারতম্যের কারণে বিশেষ বিশেষ পণ্য উৎপাদনে বিশেষ পারঙ্গমতা অর্জন করে; অর্থাৎ একেক দেশ স্বল্প খরচে অন্যের তুলনায় সমমানের বা ভালো মানের পণ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। এখন যে দেশ যে পণ্য উৎপাদনে বেশি পারদর্শী, তারা যদি সেই পণ্য উৎপন্ন ও রপ্তানি করে এবং যেসব পণ্য উৎপাদনে অন্য দেশের তুলনায় তাদের খরচ বেশি হয়, সেগুলো উৎপাদনে পারদর্শী দেশগুলো থেকে আমদানি করে, তবে সবার জন্য জয়জয়কার অবস্থা (win-win situation) তৈরি হয়; মোটের ওপর গোটা বিশ্বের উৎপাদন বেড়ে যায়। মুক্তবাজারে আস্থাশীল অর্থনীতিবিদদের ধারণা এই যে, বাধাহীন বৈশ্বিক বাণিজ্যের মাধ্যমে এই ব্যবস্থার পরম বিকাশ ঘটানো সম্ভব, যার ফলে সবাই লাভবান হবেন।
বিশ্বব্যাপী অবাধ বাণিজ্য ত্বরান্বিত করার জন্য এখন গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization,WTO)। বিশ্ববাণিজ্য বাধাহীন করার প্রধান লক্ষ্য থাকলেও এ সংস্থা যত আইন-কানুন ও বিধিবিধান তৈরি করেছে, তাতে অবাধ বাণিজ্যই অনেক ক্ষেত্রে তার প্রধান শিকারে পরিণত হয়ে পড়েছে। এজন্য বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে শুধু মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনই যথেষ্ট নয়, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিপুল ও জটিল আইন-কানুন, বিধিবিধান ও চুক্তি সম্পর্কে ধারণা ও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন এই জ্ঞান দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত জনবল।
বাণিজ্যের বিশ্বায়ন নিয়ে নানা সমালোচনা থাকলেও এবং বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ এই ব্যবস্থা থেকে সম্প্রতি বেশ ভালো সুফল অর্জন করতে সমর্থ হয়। দেশের রপ্তানি ক্রমেই বাড়ছে; macrotrends-এর তথ্য অনুযায়ী ২০০০ ও ২০১০ সালে দেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬.৫৯ ও ১৮.৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরপর ২০২১-২২ সালে রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫২.০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (Dhaka Tribune, Dated 03, July, 2022)। ৫০ বিলিয়নের নিশানা অতিক্রম করলেও দেশের জিডিপির অনুপাতে এই রপ্তানি আয়ে আত্মতুষ্টির কোনো কারণ থাকতে পারে না; এখনো এটা জিডিপির ১০-১২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, এটাকে স্বল্প মেয়াদেই অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। এর জন্য রপ্তানি পণ্য যেমন বহুমুখীকরণ করতে হবে, তেমনি রপ্তানির গন্তব্যও করতে হবে বিচিত্র ও নির্বিঘœ। পরিবহন খরচ ও সময় কম লাগায় নিকট প্রতিবেশীদের মধ্যে বাণিজ্যের প্রসার ঘটলে অবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটে থাকে। আসিয়ান (ASEAN) ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (EU) বাণিজ্য এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশ প্রায় তিন দিক দিয়ে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত। ভারত যেমন বৃহৎ এক অর্থনীতি, তেমনি বিরাট এক বাজারও বটে। এর অর্থনীতিও ক্রমোন্নতিশীল। রাজনৈতিক পর্যায়ে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক যেকোনো বিচারে তুঙ্গে। কিন্তু বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এ সম্পর্কের প্রতিফলন দেখা যায় না। যেমন বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাঁচামাল ও মূলধনসামগ্রী আমদানি করতে হয়। কিন্তু এই আমদানির প্রধান অংশীদার দোরগোড়ার ভারত নয়; দূরবর্তী চীন। ২০২০-২১ সালে ভারত থেকে আমদানি হয় ৮.৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর চীন থেকে আমদানি হয় ১২.৯ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রী (Business Inspection, August 28, 2022)। তা ছাড়া, ভারতের সঙ্গে যে বাণিজ্য হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের বিপক্ষে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বিপুল; ২০২১-২২ সালে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ১৬ বিলিয়ন ডলার এবং সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার। দীর্ঘ মেয়াদে এই ভারসাম্যহীনতা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়, কিন্তু এটা কমিয়ে আনার জন্য তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। উল্টো ভারতীয় বাণিজ্য প্রশাসন এমন কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, যাতে এ দেশের রপ্তানির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
ভারত ২০১৭ সালে বাংলাদেশি পাটপণ্য, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ও ফিশিং নেটের ওপর ৫ বছরের জন্য প্রতি টনে ১৯ ডলার থেকে ৩৫১.৭২ ডলার অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি (এডিডি) আরোপ করে। এডিডি হলো এমন এক ধরনের শুল্ক, যা আমদানিকারক দেশ সেসব পণ্যের ওপর অতিরিক্ত হিসেবে আরোপ করে থাকে, যেগুলো রপ্তানিকারক দেশ রপ্তানি-গন্তব্যে বাজার দখলের লক্ষ্যে উৎপাদন খরচের চেয়ে কমমূল্যে অথবা নিজ দেশে ওই পণ্যের বিক্রয় মূল্যের চেয়ে উল্লেখযোগ্য কম দামে রপ্তানি করে। এই অভিযোগের মধ্যে কোনো সত্যতা না থাকায় বিভিন্ন সময় বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ের সভায় বাংলাদেশ এই এডিডি আরোপের প্রতিবাদ করে আসছে। কিন্তু ভারতীয় আমলাদের বিবেচনায় বিষয়টি আধাবিচারিক হওয়ায় এ ক্ষেত্রে তাদের কিছু করণীয় নেই। বিগত ডিসেম্বর ২০২২ নয়াদিল্লিতে মন্ত্রিপর্যায়ের যে সভা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তার প্রতিপক্ষকে বিশেষভাবে অনুরোধ করে আসেন, যাতে এই এডিডির মেয়াদ আর না বাড়ে। যে হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ধারণা করা হয়েছিল যে, এই শুল্কের মেয়াদ আর বাড়বে না। কিন্তু দেখা গেল যে, পরিস্থিতি যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে; আবারও ৫ বছরের জন্য এডিডি বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ভারতের এডিডি আরোপ নতুন কিছু নয়; এর আগে ২০০১ সালে বাংলাদেশের লিড অ্যাসিড ব্যাটারির ওপর তারা এডিডি আরোপ করে। এরপর করে ক্লিয়ার ফ্লট গ্লাসের ওপর। গ্লাসের বেলায় অবশ্য ভুক্তভোগী শুধু বাংলাদেশ ছিল না; ছিল আরও অনেক দেশ। এই জাতীয় শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশের বৈচিত্র্যহীন রপ্তানি ঝুড়ির কলেবর আরও ছোট হয়ে যায়। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে যায় এবং দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রও তার বিরূপ প্রভাব পড়ে।
ভারত একাধারে পরম বন্ধুরাষ্ট্র, আঞ্চলিক শক্তি এবং ক্রমবর্ধমান বৃহৎ অর্থনীতি। তাই ছোট অর্থনীতির দেশ হিসেবে তার কোনো সিদ্ধান্তের আক্রমণাত্মক বিরোধিতায় স্পর্শকাতরতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু স্বীয় স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ ভারতের মতো শক্তিশালী দেশের সঙ্গে একাধিকবার লড়াই করে জয়লাভ করেছে। লিড অ্যাসিড ব্যাটারির শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিবাদ নিষ্পত্তি প্রতিষ্ঠানে (Dispute Settlement Body, DSB) ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা করে। ভারতীয় পক্ষ তাদের অবস্থানের পক্ষে যৌক্তিকতার অপর্যাপ্ততা বিবেচনায় এই মামলা না চালিয়ে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির প্রস্তাব করে। আলোচনা অন্তে ২০০৫ সালে এই শুল্ক প্রত্যাহৃত হয়। একইভাবে বাংলাদেশের জল সীমান্তে বিবাদমান ২৫,৬০২ বর্গকিলোমিটার জায়গায় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দি হেগের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করে এবং ২০১৪ সালে তাতে জয়লাভ করে; বিবাদমান জায়গার মধ্যে বাংলাদেশ ১৯,৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায়। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে এসব মামলা-মোকদ্দমা রজ্জু করা সত্ত্বেও কিন্তু দুদেশের মধ্যে সুসম্পর্কের কোনো অবনতি ঘটেনি; বরং তা উত্তরোত্তর সুসংহত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে এটা নিশ্চিত যে, ভারত দ্বিতীয়বারের মতো পাটপণ্য, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ও ফিশিং নেটের ওপর আরও ৫ বছরের জন্য যে এডিডি আরোপ করেছে, তা প্রত্যাহারের জন্য বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ডিএসবিতে আপিল করা হলে আগের মতোই প্রতিকার পাওয়া যাবে। এজন্য এখনই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বাণিজ্যমন্ত্রী অবশ্য সে রকম কাজেরই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে এর জন্য প্রয়োজন বিবাদমান বিষয়ের গুণাগুণ বিচার-বিশ্লেষণ অন্তে তা সঠিকভাবে আদালতে উপস্থাপন করা। আর এখানেই প্রয়োজন দক্ষ ও কুশলী এক কর্মীবাহিনীর। বর্তমানে এটার অভাব অনুভূত হলে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
অনেকে মনে করেন, বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বিস্তীর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (CEPA) সম্পাদনের যে আলোচনা চলছে, সেটা কার্যকর হলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমে যাওয়ার ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে। ক্রমবর্ধমান চীনা বিনিয়োগের প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালে ভারত-সূচিত এই ধারণার কার্যকর বাস্তবায়নে সে সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে; ধারণা করা হচ্ছে যে, এ চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ২-৩ বছরের মধ্যে দুদেশের বাণিজ্য ৪০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে। কিন্তু দেশের রপ্তানি পণ্যের ঝুড়ি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও গন্তব্যে সেগুলোর অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত না করতে পারলে ঘাটতি আরও বেড়েও যেতে পারে। এজন্য নতুন নতুন মানসম্পন্ন পণ্য যেমন নিয়ে আসতে হবে, তেমনি যেসব পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক বাজার সেখানে রয়েছে, সেগুলোর শুল্ক ও অশুল্ক বাধা চিহ্নিত এবং দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু আলোচনার টেবিলে ভারতের মতো শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ আলোচকদের কাছে এ দেশীয় প্রতিপক্ষ কি সমকক্ষতা প্রদর্শন করতে পারবে?
সামনে বাণিজ্য-অংশীদারদের অনেকের সঙ্গেই বিবাদ নিষ্পত্তিতে আইনি ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের প্রয়োজন হবে। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশি তৈরি-পোশাকের ওপর ২০২১ সালে ইন্দোনেশিয়া কর্র্তৃক আরোপিত রক্ষাকবচ শুল্ক আরোপের আরেকটি ইঙ্গিত। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের ক্লাব থেকে যখন স্নাতক হয়ে বেরিয়ে আসবে, তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ও অগ্রাধিকারের পরিবর্তে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। এই পটভূমিতে অচিরেই অনেক দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব, মুক্ত ও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। এসব চুক্তিতে দেশের স্বার্থ যাতে সমুন্নত থাকে, তার জন্য প্রয়োজন ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি, বিশ্ববাণিজ্য, আইন ও চুক্তি প্রভৃতি শাস্ত্রে বিদগ্ধ ও ভূয়োদর্শী এক নিয়মিত কর্মীবাহিনী। ভূতপূর্ব পাকিস্তানে দক্ষ ও চৌকস লোকবল গড়ার লক্ষ্যে সিএসপি ও পিএফএস অফিসারদের অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ও ফ্লেচারস স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসির মতো স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে এ ধরনের বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত জনবলের স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। তবে কিছুটা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় এ কাজে এখনই মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তার আগে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অ্যাডহক ভিত্তিতে জরুরি কাজ চালিয়ে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আশা করি কর্র্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনায় নেবে।
লেখক: খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও কলামিস্ট
আমার দুটি শিশুসন্তান আছে। ওদের দুজনেরই আছে শ্বাসকষ্টের সমস্যা। শীত এলে ওদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। টনসিল ও এডিনয়েড গ্ল্যান্ড ফুলে যায়। চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন, ধুলাবালির দূষণ এড়িয়ে চলতে হবে। না হলে এ সমস্যা বেড়ে অ্যাজমা হয়ে যেতে পারে! কিন্তু আমি ভেবে পাই না, অপরিকল্পিত এই রাজধানী নগরীতে বসবাস করে ধুলাবালির দূষণমুক্ত একটি পরিবেশ কি আদৌ পাওয়া সম্ভব?
এরই মধ্যে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় আমার বড় সন্তানের অস্ত্রোপচার করে তার গলার এডিনয়েড গ্ল্যান্ড ফেলে দেওয়া হয়েছে। এখন সে মোটামুটি শ্বাসকষ্টের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত আছে। তবে ধুলাবালি থেকে বাঁচতে তাকে মাস্ক পরতে হয়। কিন্তু ছোট সন্তানের সমস্যা সমাধানে আর অস্ত্রোপচারের দিকে যাইনি। কারণ, অভিজ্ঞতায় দেখলাম, এটি কষ্টসাধ্য একটি অস্ত্রোপচার এবং একই সঙ্গে ব্যয়বহুলও। ফলে ছোট সন্তানের জন্য ওষুধই ভরসা করে চলেছি।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নগরী অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। এ কারণে এই শহরে বসবাস করে ধুলাবালিমুক্ত পরিবেশ কল্পনাও করা যাবে না। সংবাদমাধ্যমে কাজ করি বলে ঢাকার দূষণের কথা আমার জানা। তাই সচেতনতা হিসেবে নিজের শিশুসন্তানদের যতটা পারি ধুলাবালি থেকে সুরক্ষার চেষ্টা করি। একই সঙ্গে শীতকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শে বিশেষ কিছু ওষুধ আগে থেকেই সেবন করানো শুরু করি। কিন্তু ওষুধও এখন কাজ করতে চায় না। বারবার একই ওষুধ সেবনে এর কার্যকারিতা হয়তো কমে আসে। এবার শীতেও ওষুধ সেবন চলছিল ছোট সন্তানটির। এর পরও কাশি আর শ্বাসকষ্ট শুরু হলো ওর। চিকিৎসক বললেন, ওষুধের পাশাপাশি নেবুলাইজ করতে হবে। এতে কিছুটা কাজ করলেও শেষে অ্যান্টিবায়োটিকও ধরতে হলো! অথচ এ শীতেই ওরা যখন ১৫ দিন গ্রামের বাড়ি ছিল, এক দিনের জন্যও কাশি বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়নি। ওষুধ নিয়ে গিয়েও সেগুলো সেবন করাতে হয়নি! এর একটিই কারণ, গ্রামের বাতাস ঢাকার থেকে দূষণমুক্ত, অনেক নির্মল। যে কারণে ওদের ফুসফুস যথেষ্ট ভালো বাতাস আর অক্সিজেন পেয়েছে, যেটি এই ঢাকাতে নেই। ঢাকায় থিতু হওয়ার পর থেকে আমার নিজেরও এই শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়েছে। প্রায় সময় ওষুধ চলে। আমি জানি, কাশি আর শ্বাসকষ্টের কী কষ্ট। দম বেরিয়ে যেতে চায় কাশতে কাশতে। এই লেখাটি যখন লিখছি (১৪ জানুয়ারি), রাত তখন ৩টা বাজে। ওপাশের ঘরে ছোট সন্তানটি আমার অনবরত কেশে চলেছে। বাবা হিসেবে আমারও বুকটা ফেটে যাচ্ছে প্রাণপ্রিয় সন্তানের বুকফাটা কাশির সেই শব্দে। একপর্যায়ে কাশতে কাশতে সন্তানটি আমার একবার বমিও করে ফেলল!
এই যে গ্রামে গেলে আমার শিশুসন্তানদের এ সমস্যাটা থাকে না, এই ঢাকায় ফিরলেই সমস্যাটা যে বাড়ে, সারতে চায় না; এর কারণটা কী? এই কারণ বের করতে বড় কোনো গবেষণার দরকার হয় না। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ আর পানিদূষণসহ নানা দূষণের কারণে এই শহর আর বাসযোগ্য নেই। লোকে লোকারণ্য এই নগর। এ লেখায় আজ শুধু ফোকাস করতে চাই দূষণের দিকে। সাত-আট লাখ কোটি টাকার রেকর্ড বাজেট আসে ফি-বছর, তার পরও কেন এই নগরকে বাসযোগ্য করতে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ কেন নেওয়া হচ্ছে না?
মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল বলছে, শ্বাসকষ্ট আর ফুসফুসের নানা রোগী গত পাঁচ বছরের তুলনায় এখন তিন গুণ বেশি হাসপাতালে আসছে। শুষ্ক মৌসুমে রোগীর চাপ বাড়ে। এর একটি বড় কারণ ঢাকার বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণজনিত রোগে দেশে কতসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তার কোনো সরকারি পরিসংখ্যানও নেই। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, বায়ুদূষণজনিত রোগ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকির শিকার গর্ভবতী মা ও শিশুরা। অটিস্টিক শিশুর জন্ম হওয়ার একটি কারণ দূষিত বায়ু। বাচ্চাদের জন্মকালীন ওজন কম হওয়ার একটি কারণও বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের কারণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। হাঁচি-কাশি, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে হচ্ছে ফুসফুসের ক্যানসারও। এই ক্যানসারের বড় কারণ দূষিত বায়ু। এ ছাড়া কিডনি ও হৃদরোগের কারণও হতে পারে বায়ুদূষণ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বরাবরই ঢাকার বায়ুর মান পরীক্ষা করছে। তাদের তথ্যে দেখা যায়, কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে দূষণে শীর্ষে থাকছে ঢাকা। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার ১৪ জানুয়ারি তাদের ওয়েবসাইটে জানায়, এদিন বাতাসের মান অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ওইদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ছিল ২৪৭। এরপরই ছিল ভারতের দিল্লি (২০৪)।
বায়ুদূষণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর বায়ুদূষণে ৮০ হাজার মানুষ মারা যান। মানুষের গড় আয়ু তিন বছর কমছে। দূষণের কারণে বাড়ছে মানুষের বিষণœতাও। যার অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির চার ভাগেরও বেশি। ঢাকায় সারা দিনে একজন যে পরিমাণে দূষিত বায়ু গ্রহণ করেন, তা প্রায় দুটি সিগারেটের সমান ক্ষতি করে! প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়, বায়ুদূষণে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, কাশি, নিম্ন শ্বাসনালির সংক্রমণ এবং বিষণœতার ঝুঁকি। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, বয়স্ক এবং রোগে আক্রান্তরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা শ্বাসরোগে আক্রান্তরা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।
স্বাধীনতা লাভের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ঢাকার অবস্থা আজও শোচনীয়। অপরিষ্কার, বসবাসের অনুপযোগী, অপরিচ্ছন্ন, দূষিত ও অসুখী শহরের তালিকার শীর্ষ সারিতে আমাদের রাজধানী শহর। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসুবিধা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা, শিল্পায়ন, অবকাঠামোসহ ৩০টি মানদণ্ডের বিবেচনায়ও তলানিতে রয়েছে ঢাকা। হতাশার এক নগরীতে পরিণত হয়েছে এককালের তিলোত্তমা নগরী ঢাকা।
জনবসতি ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা। সরকারি হিসাবে ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪৬ হাজার মানুষ বসবাস করলেও আসল সংখ্যাটা আরও বড়। হাজারো মানুষ প্রতিদিন ঢাকায় আসছেন শিক্ষা ও জীবিকার সন্ধানে। সরকারি অফিস, আদালত, ব্যাংক, পোশাক কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ঢাকামুখী হওয়ায় আজকে এ অবস্থা। জাতিসংঘের হ্যাবিটেট প্রতিবেদনে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকার রাস্তাঘাট, যানজট, গ্যাস বা ওয়াসার পানির ব্যবস্থা কোনোটিই মেগাসিটির মতো নয়। এর ফলে বাড়ছে মাটিদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ ও বায়ুদূষণের হার। নগরে বায়ুদূষণের হার যেভাবে বাড়ছে, নগরবাসীর জীবনে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। ঢাকামুখী জনতার ঢলের কারণও আমরা জানি। সব সুযোগ-সুবিধা এই নগরীতে বেশি। তাহলে সুযোগগুলো বাইরের প্রতিটি বিভাগে ছড়িয়ে দিলেই তো হয়। এটা বুঝতে কি বড় গবেষক হতে হয়? কিন্তু তা না, এখানেই সবকিছু করতে হবে। আমি বলছি না যে ঢাকার বাইরে কিছু হচ্ছে না, কিন্তু ঢাকার মতো কি হচ্ছে? হচ্ছে না। যার কারণেই দেশের আঠারো কোটি মানুষ ঢাকায় আসতে চাচ্ছে। আসছে। আমরা জানি, কোনো শহর ধারণক্ষমতার বেশি হলে সেই শহরের সমস্যার সমাধান সহজ নয়। তার ওপর থাকে যদি সিটি কর্র্তৃপক্ষের করাপশন, তাহলে তো কথাই নেই।
কয়েক বছর আগে পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রিন পিস তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বায়ুদূষণজনিত রোগে প্রতি বছরই বহু মানুষের অকালমৃত্যুও হচ্ছে। এটি গেল শুধু বায়ুদূষণের কথা। পানিদূষণ, শব্দদূষণ এবং ভূমিদূষণের কথা বাদই দিলাম। এ রকম সমস্যা বিশ্বের অনেক দেশের রাজধানীতেই আছে। সমস্যা সমাধানে অনেক দেশ তাদের রাজধানী বদল করেছে। আমাদেরও ভাবতে হবে এ বিষয়ে। আমাদের গ্রাম আর শহরের ব্যবধান অনেকটা স্বর্গ-নরকের মতো! অথচ ইচ্ছে করলেই গ্রামের সৌন্দর্য কাজে লাগিয়ে ছয় ঋতুর বিন্যাসে ঢাকাসহ এ দেশের বিভাগীয় শহরগুলো তৈরি করা যেত। প্রাকৃতিকভাবেও আমাদের সেই সুযোগ রয়েছে। ঢাকার কথাই যদি ধরি, চারপাশে নদী আছে, আছে অনেকগুলো খাল বিল-জলাশয়। তবে এর অধিকাংশই এখন বেদখল হয়ে গেছে। সেখানে এখন চলছে দূষণের আয়োজন।
এই ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ এবং ভূমিদূষণ থেকে মুক্ত করতে হবে। এসব করার জন্য সবার আগে ঢাকার জনসংখ্যার চাপ কমাতে হবে। আবার এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঢাকামুখী জনস্রোতকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। আর এসব তখনই করা যাবে যখন ঢাকার তাবৎ সুযোগ-সুবিধা অন্য বিভাগীয় শহরেও ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। না হয় সমস্যা সমাধানের জন্য সারা বছর পরিকল্পনা হবে, বাজেটের লাখো কোটি টাকার শ্রাদ্ধ হবে; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। আর টেকসই উন্নয়ন? সে তো বহুদূরের কথা। একটি দেশের মস্তিষ্ক রাজধানীকে অসুস্থ রেখে আপনি উন্নয়ন কল্পনা করতে পারেন না।
লেখক সাংবাদিক
মহাকবি ও নাট্যকার এবং বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক শ্রী মধুসূদন দত্ত। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা রাজনারায়ণ দত্ত, মা জাহ্নবী দেবী। কলকাতার হিন্দু কলেজে পড়ার সময়ই তার কাব্য-প্রতিভার বিকাশ ঘটে। সেখানেই বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা শেখেন তিনি। বিশপস কলেজে পড়ার সময় তিনি ইংরেজি ছাড়াও গ্রিক, লাতিন ও সংস্কৃত ভাষা শেখেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে বাবা অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দিলে তিনি মাদ্রাজে গিয়ে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করেন। রপ্ত করেন হিব্রু, ফারসি, জার্মান, ইতালিয়ান, তামিল ও তেলেগু ভাষা। ১৮৫৮ সালে পাশ্চাত্য রীতিতে লেখেন প্রথম বাংলা মৌলিক নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। এ ছাড়া দুটি প্রহসন : ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। এ ছাড়া নাটক ‘পদ্মাবতী’ও ‘কৃষ্ণকুমারী’ এবং কাব্য ‘তিলোত্তমাসম্ভব’, ‘বীরাঙ্গনা’ ও ‘ব্রজাঙ্গনা’ রচনা করেন তিনি। ১৮৬২ সালে মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেতে যান। ১৮৬৩ সালে তিনি যান ফ্রান্সে। ফ্রান্সের ভার্সাই তার জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। তিনি সনেট রচনা এবং মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করেন। ভার্সাইয়ে বসে লেখেন অমর সনেট ‘বঙ্গভাষা’ ও ‘কপোতাক্ষ নদ’। সনেটগুলো ১৮৬৬ সালে ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়। মধুসূদন দত্ত ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন মৃত্যুবরণ করেন।
পৃথিবীর কোনো দেশেই প্রকৃত উন্নয়ন বোঝাতে কেবল মাথাপিছু আয় ও জিডিপির হিসাবকে সূচক হিসেবে ধরা হয় না। কারণ মাথাপিছু আয় ও জিডিপির হিসাব দিয়ে সাধারণ মানুষের সত্যিকার উন্নয়ন এবং তাদের জীবনধারণের প্রকৃত অবস্থা জানা যায় না। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক প্রবর্তিত মানবপুঁজি সূচক একটা সাম্প্রতিক মানদ- বটে। যদিও বিশ্বব্যাংকের আগে থেকেই অনেকে এই বিষয় নিয়ে কথা বলে আসছিলেন। খেয়াল করা জরুরি, মানবপুঁজির দুটি দিক রয়েছেএক. শিক্ষাপুঁজি এবং দুই. স্বাস্থ্যপুঁজি। মানুষের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি ও সমাজের জীবনমানের প্রকৃত উন্নয়নের প্রশ্নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুটিই সমানভাবে ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর যেসব দেশে উন্নয়ন হয়েছে দেখা গেছে তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুটি খাতেই অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই নিজেদের উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুই খাতেই বাংলাদেশের বিনিয়োগ আশানুরূপ তো নয়ই, বরং কাক্সিক্ষত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে।
এমন বাস্তবতার মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার সারা বিশ্বে পালিত হলো‘আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ২০২৩’। জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, ‘জনগণের জন্য বিনিয়োগে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিন’। তবে দিবসটি আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় না। বেসরকারি উদ্যোগে কিছু সভা-সেমিনারের মাধ্যমেই দিবসটির আয়োজন সীমাবদ্ধ থাকছে। এটাও হয়তো শিক্ষায় বিনিয়োগে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতারই দৃষ্টান্ত। খেয়াল করা দরকার, চলতি অর্থবছরে আমাদের দেশে শিক্ষায় বরাদ্দ মোট বাজেটের ১২ দশমিক ০১ শতাংশ। গত অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে ইউনেস্কো শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলে আসছে। তবে একবারে এই বরাদ্দ ২০ শতাংশ দেওয়া সম্ভব না হলে জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলেছিলেন শিক্ষাবিদরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এক্ষেত্রেও সমালোচনা রয়েছে যে, শিক্ষায় বাজেটের যে অংশটুকুই বরাদ্দ দেওয়া হোক না কেন তার পুরো অর্থ প্রকৃত অর্থে শিক্ষায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। নানা উপখাতের মাধ্যমে বিভিন্ন বরাদ্দের হিসাবও শিক্ষা খাতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অথচ প্রয়োজন ছিল শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা।
ইউনেস্কোর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২’-এ বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ বাংলাদেশে মাধ্যমিকের ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশে শিক্ষাব্যয়ের ৭১ শতাংশ পরিবার বহন করে। তবে এনজিও স্কুলে ফি সরকারির তুলনায় তিনগুণ ও বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের ফি সরকারির তুলনায় ৯ গুণ বেশি। বাংলাদেশে ৭০ শতাংশের বেশি রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাইভেট পাঠদান শিক্ষার্থীদের ভালো ফল পেতে সাহায্য করেছে। এদিকে, রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মনে করেন, শিক্ষায় বিনিয়োগ কমলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা বাড়ে। বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। শিক্ষা সব দেশের উন্নয়নের চাবি। ভোকেশনাল, প্রাইমারি, সেকেন্ডারি শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার মানোন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। এক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার চেয়ে শিক্ষকদের অবদানই মুখ্য। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ্য মেধাবীদের শিক্ষা খাতের সঙ্গে সংযুক্ত করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান এত নিম্নমানের যে, অন্য কোনো পেশায় যাওয়ার সুযোগ থাকলে কেউ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না। অথচ উন্নত দেশে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক তার বিপরীত। এমনকি প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কার প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের মান আমাদের দেশের থেকেও অনেক উন্নত। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে যে সরকারের বিশেষ মনোযোগ নেই সেটা বোঝা যায় জাতীয় শিক্ষানীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে গড়িমসি থেকেও। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি গত ১২ বছরেও। এমনকি সরকারের এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেই। অন্যদিকে, শিক্ষা খাতে ধনী-গরিব, গ্রাম-শহরসহ নানা ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। মুখে মুখে কারিগরি শিক্ষার কথা বলা হলেও সেখানে নেই বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ। আর এজন্যই শিক্ষায় বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লেই কেবল মানবপুঁজিতে উন্নত জাতি হওয়া সম্ভব।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জেরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ও পার্লামেন্টে আসন হারিয়েছেন নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী রবি লামিছানে। শুক্রবারের রায়ে আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকত্বও নেই তার।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বিমল পৌদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকত্ব বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে রবি লামিছানের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন থেকে আর পার্লামেন্টের সদস্য নন তিনি।’
নেপালের এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রবি লামিছানে দেশটির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর নেপালের পার্লামেন্ট প্রতিনিধিসভার নির্বাচনে তার দল ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর গত ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারে নিজের দলসহ যোগ দিয়ে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন লামিছান।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব ছিল লামিছানের; কিন্তু নেপালের সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নেপালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথা ছিল লামিছানের; কিন্তু তা করেননি তিনি। ফলে এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকও নন লামিছান। এদিকে, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর লামিছানের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা; কিন্তু লামিছানে তাদের বলেন, ‘যেহেতু এই মুহূর্তে আমি কোনো দেশেরই নাগরিক নই, তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে উচিত নয়, সম্ভবও নয়।’