
বহু পণ্যের গায়ে লেখা থাকে ‘এতে ক্ষতিকারক ডিডিটি নেই’। ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরা আশ্বস্ত হই। হয়তো আমাদের বহুজনের কাছেই ডিডিটির বিষয়টি স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে মশার স্প্রে, শুঁটকি মাছ বা কৃষিফসলে ডিডিটির ব্যবহারের কথা আমরা কমবেশি জানি। ‘ডাই ক্লোরো ডাই ফিনাইল ট্রাই ক্লোরো ইথেন’ বা ‘ডিডিটি’ হলো বিশ্বব্যাপী রাসায়নিক দূষণের জন্য দায়ী বিপজ্জনক রাসায়নিক।
কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার রাসায়নীকরণের বিরুদ্ধে একটা প্রবল জনভিত্তি বিস্তার লাভ করছে বিশ্বময়। দীর্ঘ করোনা মহামারী, যুদ্ধ ও বৈশ্বিক সংকট সবকিছু ছাপিয়ে রাসায়নিক কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ এক বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ চার দশক পর বাংলাদেশ ডিডিটিমুক্ত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের বৃহত্তম ডিডিটির মজুদটি ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। প্রায় চার দশক পর নিষিদ্ধ ঘোষিত এই মারাত্মক রাসায়নিক বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো। ২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর ডিডিটির শেষ চালানটি ধ্বংস করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে ফ্রান্সে যায়। ডিডিটি অপসারণের কাজটি কোনোভাবেই সহজ ছিল না। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত সতর্কতা, নীতিগত প্রশ্ন, অর্থায়ন এবং সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক অঙ্গীকারÑসবকিছু এক কাতারে আসতে প্রায় চারটি দশক লেগেছে। জীবন ও প্রতিবেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই ডিডিটি অপসারণ ব্যবস্থাপনার নেতৃত্ব দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির (জিইএফ) অর্থায়নে, বাংলাদেশ সরকার এবং এফএও এর সহ-অর্থায়নে ‘পেস্টিসাইড রিস্ক রিডাকশন ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় ডিডিটি অপসারণ ও নিষ্ক্রিয়করণের কাজটি সম্পন্ন হয়েছে।
গণমাধ্যম সূত্র জানায়, ডিডিটি পাউডার নিষ্ক্রিয়করণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫৫ কোটি টাকা। ৩৫৫ কোটি টাকার এই প্রকল্পে সরকারের নিজের খরচ ২১৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বাকি ৭০ কোটি ১০ লাখ গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটিজ এবং ৬৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ম্যালেরিয়া নির্মূলে ৫০০ টন ডিডিটি আমদানি করে এবং এর আগের আরও ৫০০ টনসহ এক হাজার টন ডিডিটি দীর্ঘ ৩৭ বছর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের গোডাউনে পড়েছিল। ডিডিটি অপসারণ প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয় গ্রিসের একটি প্রতিষ্ঠান। বিশেষ পোশাক ও সতর্কতা অবলম্বন করে এসব রাসায়নিক কনটেইনারে ভরা হয় এবং পরিবহন করা হয়। অপসারণের সময় সমগ্র এলাকাকে রেড জোন বা বিপজ্জনক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। অপসারণ প্রক্রিয়ার পরিচালক গণমাধ্যমকে জানান, বিশেষ জাহাজের মাধ্যমে এই রাসায়নিক সমুদ্রপথে ১২টি বন্দর হয়ে ফ্রান্সে যাবে এবং সেখানে আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি মেনে বিশেষ চুল্লিতে এসব নিষ্ক্রিয় করা হবে। বেশ কয়েক মাসের এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার সর্বত্র ঝুঁকি ও বিপদ রয়েছে। তারপরও বিশ্ব থেকে বিপজ্জনক ডিডিটির সবচেয়ে বড় মজুদটি অপসারণ করা গেছে।
বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের জন্য এটি একটি গুরুত্ববহ ঘটনা। অবিস্মরণীয় এই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজটির সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তবে ডিডিটি অপসারণের এই উদাহরণ বাংলাদেশকে আরও বেশি দায়িত্বশীল এবং দায়বদ্ধ করে তুলল। বিশেষত কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় রাসায়নিকের ব্যবহার এবং নিষিদ্ধকরণ বিষয়ে রাষ্ট্রকে এখন থেকেই আরও বেশি সতর্ক ও মনোযোগী হওয়ার বার্তা জানান দিল। ভাবলেই কেমন শিউরে ওঠে চারধার, দীর্ঘ ৩৭ বছর এক হাজার টন ডিডিটির সঙ্গে বসবাস করেছি আমরা। এমনকি এই মজুদ ছিল দেশের উপকূলের এক দুর্যোগপীড়িত ঘনবসতিপূর্ণ শিল্পাঞ্চল চট্টগ্রামে। ১৯৯১ সালের বন্যায় প্লাবিত হয় চট্টগ্রাম এবং বন্যার পানিতে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে ডিডিটি বিষ। এ ছাড়া কৃষিতে ব্যবহৃত ডিডিটির কারণে আমাদের বাস্তুতন্ত্র ও শরীরে মিশেছে এই ভয়াবহ বিষ। বাংলাদেশের মতো একটা ছোট্ট আয়তনের দেশে ৩৭ বছর ধরে এক হাজার টন ডিডিটি নিরাপদে মজুদ রাখা সবদিক থেকেই এক জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়।
ডিডিটি, অলড্রিন, ডাইএলড্রিন, ক্লোরডেন, এনড্রিন, হেপ্টাক্লোর, মিরেক্স, টক্সাফিন, পিসিবি, হেক্সাক্লোরোবেনজিন, ডাইঅক্সিন ও ফিউরান পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী এই ১২টি মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিককে একত্রে ‘ডার্টি ডজন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ডার্টি ডজন সরাসরি মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির জীবন ও জন্মপ্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব তৈরি করে, ক্যানসার, ত্রুটিপূর্ণ জন্ম থেকে শুরু করে নানান দুরারোগ্য মরণব্যাধি ও প্রতিবেশগত বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। মাছসহ জলজ প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাবের কারণে ১৯৬২ সালে এনড্রিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে ডিডিটি ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ২০০০ সালে জোহানেসবার্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১২২টি দেশ ডার্টি ডজনের ব্যবহার সীমিত করতে বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০১ সালে স্টকহোম সম্মেলনে ডিডিটিসহ ক্ষতিকারক জৈব দূষণকারী কীটনাশকের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি গৃহীত হয়। ১৭১টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও ২০০১ সালের ২৩ মে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং এটি কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ১২ মার্চ। চুক্তির ১৫ বছর পর বাংলাদেশ থেকে ডিডিটি অপসারণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৮৭৪ সালে ডিডিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তা ম্যালেরিয়া ও টাইফাস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়। ১৯৩৯ সাল থেকে কীটনাশক হিসেবে এর ব্যবহার শুরু হয়। আর তখন থেকে ডিডিটির বহুল উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত প্রতি বছর কৃষিক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০,০০০ টন ডিডিটি ব্যবহৃত হতো। কীটনাশক হিসেবে ডিডিটি আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৮ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান পল হারম্যান মুলার। মার্কিন মনস্যান্টো, সিবা, মনট্রোজ কেমিক্যাল কোম্পানি, পেন্নাওয়াল্ট, ভেলসিকল কোম্পানিগুলো মূলত বৃহৎ ডিডিটি উৎপাদনকারী কোম্পানি। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০৯ সালে ভারত ৩,৩১৪ টন ডিডিটি উৎপাদন করে এবং ২০০৭ সালে চীনে ডিডিটি উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা আনা হয়।
বাংলাদেশে ১৯৫৬ সাল থেকে কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়। তখন প্রতি বছর ৩ টন কীটনাশক এবং ৫০০ ¯েপ্র ব্যবহার করা হতো। প্রথমদিকে যখন কীটনাশকের ব্যবহার কৃষকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো তখন প্রথমত অধিকাংশ কৃষক বিশ্বাসই করতে পারল না উদ্ভিদের রোগবালাই দমনের জন্য বিষ ব্যবহার করা যায়। ক্রমান্বয়ে কৃষির ওপর চেপে বসা এই বিষ মানুষের প্রাণও সংহার করতে থাকল। কৃষিতে বিষের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু আত্মহত্যাই বাড়ল না, বরং এটি আরও নানা ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি তৈরি করে প্রতিনিয়ত মানুষকে আরও বেশি সংকটাপন্ন করে তুলতে লাগল। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে ৮৮২ টাকার কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে মাত্র ৯৮ টাকার কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত। বাংলাদেশের মাটিতে হিউমাসের সঙ্গে মিশে গেছে ১২.৫ শতাংশ ডিডিটি, যা ব্রিটেনের তুলনায় পাঁচ গুণ। এই সর্বনাশা বিষের ফলে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে জলাশয়সহ স্থানীয় অগণিত প্রাণবৈচিত্র্য আর মানুষের নানান রোগবালাই বাড়ছে। এই সর্বনাশা বিষের ব্যবহার ১ শতাংশ বাড়ার সঙ্গে কৃষকের চিকিৎসাব্যয় বেড়ে যাচ্ছে দশমিক ৭৪ শতাংশ। বাংলাদেশে বর্তমানে ৯২টি রাসায়নিক গ্রুপের প্রায় ৩৭৭টি বালাইনাশক বাজারজাতকরণের জন্য নিবন্ধনকৃত। প্রায় সব কীটনাশকের প্রয়োগের পর অপেক্ষাকাল তিন দিন থেকে ২১ দিন, কিন্তু বাস্তবতা হলো সকালে কীটনাশক স্প্রে করে বিকেলে বা বিকেলে স্প্রে করে পরদিন জমিন থেকে ফসল তুলে বাজারে বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে শসা, টমেটো, ক্ষীরা বা অন্যান্য ফল, যা আমরা সাধারণত কাঁচা খেয়ে থাকি সেসব গ্রহণের মাধ্যমে সেসব ফসলে ব্যবহৃত কীটনাশক সরাসরি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের প্রায় ২৫ ভাগ আশপাশের জলাশয়ের পানিতে মিশে যায়।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েই এক ডিডিটিমুক্ত বাংলাদেশে আমরা আজ নতুন প্রজন্মকে স্বাগত জানাতে পারছি। তবে ডিডিটি অপসারণের এই জটিল প্রক্রিয়া আমাদের আরও কী বার্তা দেয়? কেন বা কাদের কথায় আমরা এমন বিপজ্জনক রাসায়নিক আমদানি ও ব্যবহার করলাম? তথাকথিত সবুজবিপ্লব প্রকল্পের মাধ্যমে ডিডিটির মতো এমন বহু বিপদ আমাদের কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় শুধু মুনাফার জন্য তৈরি হয়েছে। কোম্পানিগুলো মুনাফার পাহাড় চাঙা করার পর যখন জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে এসব চাপিয়ে দেওয়া বাণিজ্য কারবারগুলো চরম ক্ষতি তৈরি করছে, তখন সেসব বন্ধ করতে আমাদের দীর্ঘ সময় লড়াই করতে হচ্ছে। শুধু ডিডিটি নয়, আমাদের কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা এখনো দখল করে আছে বহুজাতিক কোম্পানি ও এজেন্সির নানামুখী ব্যবস্থাপত্র। মাটি থেকে শুরু করে মায়ের দুধ সর্বত্র মিশে যাচ্ছে বিষ আর প্লাস্টিক কণা। এক ডিডিটি নিষিদ্ধ ও অপসারণে আমরা বহু বছর ও বিপুল বাজেট ব্যয় করেছি। জনগণের টাকায় বিষ কিনে সেই বিষে জনগণের সর্বনাশ করে আবার সেই বিষ তাড়াতে আবারও জনগণের টাকাই গেল। তাহলে আমরা কেন এমন বিষের ব্যবহার শুরু করলাম এই প্রশ্নটি তোলা জরুরি। বিশেষ করে নিরাপদ কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার প্রসঙ্গ যখন আমরা আলাপে তুলেছি বিশ্বময়।
এখনো সময় আছে শুধু ডিডিটি নয়; সব রাসায়নিকের বন্দিদশা থেকেই আমাদের উৎপাদনব্যবস্থাকে মুক্ত করা জরুরি। আর ডিডিটি অপসারণের মতো রাষ্ট্র যেভাবে নীতিগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার করেছে সে রকম সব বিপজ্জনক রাসায়নিক বিষের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সমমনোযোগী হতে হবে। আমরা আশা করব রাষ্ট্র বিপজ্জনক রাসায়নিকমুক্ত কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে তৎপর ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার জোরালো করবে। শুধু ডিডিটিমুক্ত নয়, ক্ষতিকর রাসায়নিকমুক্ত এক নিরাপদ কৃষিভুবনে আমরা সবাইকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষা করছি।
লেখক: লেখক ও গবেষক
করোনাকালীন দুর্যোগ অতিক্রম করে আবারও নির্ধারিত সময়ে শুরু হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। এবার মেলার মূল প্রতিপাদ্য ‘পড় বই গড় দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে বিশ্বমন্দার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। পাশাপাশি কাগজের অস্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধিতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে প্রকাশনা শিল্প। তবুও ফেব্রুয়ারির বইমেলাকে ঘিরে আশা দেখছেন লেখক ও প্রকাশকরা। নতুন বই প্রকাশ অপেক্ষাকৃত কম হলেও আগে প্রকাশিত মানসম্পন্ন ভালো বইও মেলায় খুঁজে নেবেন পাঠকরা এমনটাই তাদের প্রত্যাশা। ফলে এবারও মেলার মাঠে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের অন্যরকম সম্মিলন ঘটবে। বই নিয়ে চলবে নানা আলোচনা ও পর্যালোচনা। বই ঘিরেই বাঙালির এই সম্মিলন সত্যিকারভাবে আমাদের অহংকারের বিষয়ও।
কিন্তু শুরুর দিকে অমর একুশে বইমেলার আয়োজনটি কেমন ছিল? সে ইতিহাসটি জানতে একটু পেছনে তাকাতে হবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা’ নামটি। এদেশে প্রকাশনা শিল্পের পথিকৃৎ তিনি। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনিই প্রথম গ্রন্থমেলার সূচনা করেন। প্রথম মেলাটি হয়েছিল বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণের বটতলায়, এক টুকরো চটের ওপর। কলকাতা থেকে আনা মাত্র ৩২টি বই সাজিয়ে উনি বইমেলার গোড়াপত্তন করেছিলেন। সে বইগুলোই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান, যা ছিল চিত্তরঞ্জন সাহার ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ (বর্তমানে যা মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন সাহা একাই গ্রন্থমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী গ্রন্থমেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমিকে সম্পৃক্ত করেন। পরের বছরই যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতিও। ১৯৮৪ সালে এ মেলার নামকরণ হয়ে যায় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। এভাবে চিত্তরঞ্জন সাহার ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলাটিই এখন বাঙালির প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। গ্রন্থমেলার পরিবর্তে বর্তমানে এটিকে বলায় হয়Ñঅমর একুশে বইমেলা।
বইমেলা এলেই কথা ওঠে মানসম্পন্ন বই নিয়ে। যদিও মেলা শেষে বাংলা একাডেমি ঘোষণা দেয় নতুন প্রকাশিত মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা কতটি। কিন্তু মান নির্ধারণের পদ্ধতিটি কী সেটি আমরা জানতে পারি না। তবে এটি সত্যি, মেলায় প্রকাশিত মানসম্পন্ন বই খুব বেশি নয়। এর দায় আসলে কার লেখকের, নাকি প্রকাশকের? বিক্রির বিষয়টি মাথায় রেখে অধিকাংশ প্রকাশক এখনো বই প্রকাশ করেন মেলাকে ঘিরে। বছরের বাকি সময়টায় খুব কম বই প্রকাশ করেন তারা। ফলে নতুন বই প্রকাশের তোড়জোড়ে প্রুফ দেখা ও সম্পাদনার কাজটি একেবারেই হয় না। আবার অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থারই নিজস্ব সম্পাদনা দল নেই। এতে তাদের মাধ্যমে রঙচঙা প্রচ্ছদ মোড়ানো ভুলেভরা যে বইগুলো মেলায় আসে, প্রকৃতপক্ষে তা পাঠককে তেমন আন্দোলিত করে না। ফলে বই কিনে অনেক পাঠকই ঠকে গিয়েছেন বলে মনে করেন। এই দায়টি লেখকেরও। বইমেলায় বই বেরিয়েছে বা বেরোবে এমন নব্বই ভাগ লেখকই নিয়মিত পত্রিকায় বা অনলাইন পোর্টালগুলোতে লেখেন না। ফলে লেখালেখির অনেক ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও তারা লেখার মাধ্যমে পাঠক তৈরির চেষ্টা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকেন। প্রতি বছরের মতো এবারও বইমেলায় প্রকাশিত হবে শত শত বই। তার মধ্যে কতটি বই মানসম্পন্ন, তা একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বসহকারে তুলে ধরার কাজটি আমরা বাংলা একাডেমির কাছ থেকেই আশা করি। ভালো পা-ুলিপি ও ভালো সম্পাদনার মাধ্যমে মানসম্পন্ন বই প্রকাশ না করলে মেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাই শুধু বাড়বে, তা দিয়ে শিল্প-সাহিত্যের তেমন কোনো উন্নতি হবে না। আর এ দায় যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি প্রকাশকের এবং লেখকেরও।
বইয়ের পাঠক বেড়েছে, নাকি কমেছে? এ নিয়ে নানা মত ছিল ও আছে। পাঠক বৃদ্ধির বিষয়টিকে অনেক প্রকাশকই শুধু মেলায় বই বিক্রির মাপকাঠি হিসেবেই তুলে ধরেন। আবার অনেকেই ফেইসবুক ব্যবহারের ফলে বইয়ের পাঠকের সংখ্যা কমেছে বলে ঢালাওভাবে অভিযোগ তোলেন। অথচ আমরা দেখি কয়েক বছর আগে থেকেই ফেইসবুকেও গ্রুপ তৈরি করে সাহিত্যচর্চার রীতি চালু হয়েছে। শুদ্ধচর্চা, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ও নান্দনিক কিছু সৃষ্টির লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ফেইসবুক গ্রুপ। তারা বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের নতুন পাঠক তৈরিতেও ভূমিকা রাখছে।
আবার দেশে বই বিক্রির পরিমাণও বেড়েছে। কীভাবে? সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার বই কিনছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠক তৈরির কর্মসূচি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বই কেনার সংখ্যাও। প্রতি বছর শুধু অনলাইনেই বিক্রি হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার বই। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, পাবলিক লাইব্রেরি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, নানা এনজিও ও বেসরকারি সংস্থাও বই কেনে প্রতি বছরই। সরকারিভাবে প্রতি জেলায় এবং অনেক উপজেলাতেও বইমেলার আয়োজন হচ্ছে নিয়মিত। বেশ কিছু প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে সারা বছরই ‘কৈশোর তারুণ্যে বই’ ও ‘ক্লাসরুমের পাশে বই’ শিরোনামে বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বইমেলার আয়োজন করছে। শ্রাবণ প্রকাশনী গাড়িতে করে মুক্তিযুদ্ধের বই নিয়ে ঘুরছে সারা দেশে। এসব উদ্যোগ যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি বইয়ের নতুন পাঠক ও ক্রেতা তৈরিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তাই দেশে বইয়ের পাঠক ও বই বিক্রি কমছেÑএমন ধারণা অনেক যুক্তিতেই টিকে না। এখন দরকার ভালো মানের বই প্রকাশ এবং তা খুব সহজেই পাঠকের কাছে নিয়ে যাওয়া।
প্রায় প্রতি বছরই একটি বিষয় অজ্ঞাত কারণে বাংলা একাডেমির নজর এড়িয়ে যায়। ধর্মের প্রতি আঘাত হানা বই খোঁজার দিকে নজর দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের অসচেতনতায় অজান্তেই চলে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীর লেখা বই বিক্রি ও বিতরণের কাজ। কয়েক বছর আগ থেকেই বইমেলায় যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কাদের মোল্লা, গোলাম আযমসহ অন্য যুদ্ধাপরাধীদের লেখা বইগুলো বিক্রিসহ বইমেলায় প্রবেশ ও বের হওয়ার রাস্তায় বিতরণে কাজ করে একটি চক্র। তা ছাড়া মওদুদীবাদের বইয়েরও বিক্রি চলে এ সময়। স্বাধীনতাবিরোধী মতাদর্শের এই চক্রটি এবারও নানাভাবে সে চেষ্টাটি চালাবে। তাই বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের উচিত এই দিকটির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। কেননা ভাষা আন্দোলনের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে অমর একুশে বইমেলা। তাই মানসম্পন্ন বইয়ের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীর বইমুক্ত বইমেলাও চাই আমরা। কয়েক বছর ধরে বইমেলার পরিসর বাড়ছে। স্টল বিন্যাসেও এসেছে বৈচিত্র্য। বইমেলার ভেতরেই বিভিন্ন স্থানে প্রয়াত নামকরা বিশিষ্ট কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, শিল্পী ও গবেষকদের পরিচিতিমূলক ছবির বিন্যাস ঘটানো যেতে পারে। তা দেখে মেলায় আগত শিশুরা তাদের সম্পর্কে ধারণা পাবে, যা শিশুদের মনোজগৎকেও প্রভাবিত করবে। একুশে বইমেলা সফলতা ও পরিপূর্ণতা লাভ করবে সবার অংশগ্রহণে। এবারও পাঠক, প্রকাশক ও লেখকদের সম্মিলন ঘটবে সেখানে। পাঠকদের বই কেনার মাধ্যমে আলোর মুখ দেখবে প্রকাশনা শিল্পÑএমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : লেখক ও গবেষক
পৃথিবীর ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লবের সময়খণ্ডটিকে সহিংসতার দাইমা হিসেবে দেখেন বিশে^র রাজনীতির ইতিহাস লেখক কেউ কেউ। তারা দেখান ফরাসি বিপ্লব জগৎবাসীকে সন্ত্রাস এবং নাগরিক সেনাবাহিনী দিয়েছে। তারা দেখান নেপোলিয়নের যুদ্ধক্ষেত্রের দর্শনীয় সাফল্যের পেছনে আসল কারণ, তার সেনাবাহিনী ভাড়াটে ছিল না, দেশপ্রেমিকদের দ্বারা গঠিত ছিল। তারা জাতীয় স্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ড চালাতেন। ফলে মানুষের সামনে হাজির হলো জাতীয়তাবাদী চেতনার একপ্রকার নাগরিক ধর্মমত।
দার্শনিক হেগেল তার ভাবনা লিখেছিলেন ফরাসি বিপ্লব প্রসঙ্গে বিপ্লব সাধনের লড়াইকে মানুষ তাদের নিজের জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করেছিল। তাই তারা প্রাণ দিতে রাজি ছিল। মনে হয় হেগেল এভাবে বললে ভালো হতো যে মানুষ স্বেচ্ছায় এ রকম কারণে হত্যাও করতে চায়। হ্যাঁ, বিগত বিংশ শতকে মানুষ যেভাবে গণহত্যা করেছে নানা অজুহাতে, হয়তো বনের কোনো হিংস্র প্রাণীও এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়নি। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ঔপনিবেশিক যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, বিপ্লব এবং প্রতিবিপ্লব মোটা দাগে গোটা শতাব্দীজুড়ে ছিল।
বৈশ্বিক রাজনীতির পটভূমিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধির ব্যর্থতা দেখার আগে আমরা আধুনিক রাজনৈতিক সহিংসতার একটি অধ্যায় দেখে নিতে পারি, যেখানে ইউরোপে জাতিগত নির্মূলকরণের ইতিহাস বিধৃত। দেখে নিতে পারি কেন ‘একীভূত স্পেনীয় রাষ্ট্র তার ইহুদিদের কড়া শর্ত দিল খ্রিস্টান হও অথবা নির্বাসনে যাও’? সাফ কথা সেদেশে থাকতে হলে খ্রিস্টান হতে হবে, না হও যদি এ দেশ থেকে পালাও। ‘গুড মুসলিম ব্যাড মুসলিম’ বইটির লেখক মাহমুদ মামদানি বিশ্ববাসীকে জানালেন ‘১৪৯২ সাল। এ বছরে ইউরোপীয় রেনেসাঁর শুরু ও তাদের রাজনীতির আধুনিক রূপের জন্মের সময়খণ্ড সেটা। এ বছরেই ক্রিস্টোফার কলম্বাস নতুন দুনিয়া খুঁজতে পাল তুলেছিলেন। এ বছরেই রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলার সৈন্যরা রাজধানী গ্রানাডা জয় করেছিল, যে-গ্রানাডা ছিল পশ্চিমের খ্রিস্টান বলয়ে মুসলিমদের সুরক্ষিত আশ্রয়স্থল। ফলে ১৪৯২ হয়ে উঠল দুটি সম্পর্কযুক্ত প্রচেষ্টার প্রবেশদ্বার। একটি হলো, একটি জাতির ঐক্য, অন্যটি বিশ্বজয় বা সাম্রাজ্য বিস্তার।’
মামদানি আরও জানালেন ‘জাতি একীকরণের ফলে জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়ে গেল। এ যুগে, রাজনৈতিক আধুনিকতা গণতন্ত্রের সূচনার সঙ্গে সমান করে দেখা হয়। কিন্তু উনিশ শতকের রাজনৈতিক তাত্ত্বিকরা বিশেষত ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, রাজনৈতিক আধুনিকতা নিরূপিত হয়, রাষ্ট্রের সহিংসতা একক কর্র্তৃত্বের দ্বারা একচেটিয়া হয়ে গেলে। জাতিরাষ্ট্রে আগের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সহিংসতা একত্র করে, অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সব শত্রুকে এক দুর্দান্ত ধাক্কা দিতে সক্ষম। এটা ছিল তাদের একটি সুশীল সমাজ তৈরির রাজনৈতিক পূর্বশর্তও।’
‘সংস্কৃতি ও বর্ণের দিক দিয়ে জাতির রাজনৈতিক আধুনিকতার চিন্তার দুয়ারে তখন ইউরোপ। ফার্দিনান্দ এবং ইসাবেলার স্পেনে, যে-জাতির পরিচয় সর্বাগ্রে খ্রিস্টান। স্পেনের একীকরণ শুরু হয়েছিল জাতিগত নির্মূলকরণের মাধ্যমে। ১৪৯২ সালেই রাজা ফার্দিনান্দ এবং রানী ইসাবেলা স্পেন থেকে ইহুদিদের সরানোর আইনে (এডিক্ট অব অ্যাক্সপালশন) স্বাক্ষর করেছিলেন। একীভূত স্পেনীয় রাষ্ট্র তার ইহুদিদের কড়া শর্ত দিলে প্রায় ৭০ হাজার স্পেনীয় ইহুদি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে স্পেনে থেকে গিয়েছিল। তাদের এই থাকা নিরাপদ ছিল না। তদন্তের দ্বারা জর্জরিত হয়েছিল। অভিযোগ এনেছিল ওরা খ্রিস্টান জাতিরাষ্ট্রের প্রতি আন্তরিক না। আনুমানিক ৫০ হাজার উত্তর আফ্রিকা ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বলকান প্রদেশগুলোতে চলে গিয়েছিল। সেখানে তাদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো হয়েছিল। বাকি প্রায় ৮০ হাজার সীমান্ত পেরিয়ে পর্তুগালে প্রবেশ করেছিল। স্পেন থেকে এ তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে। তখন একের পর এক ইউরোপের একেক অংশ থেকে ইহুদিদের বের করে দেওয়া হয়েছিল। ১৪৯৯ সালে, মানে ইহুদি বের করার আদেশের সাত বছর পরে, স্পেন সেদেশের মুসলমানদের একই ধরনের শর্ত দিয়েছে: খ্রিস্টান হও অথবা চলে যাও। সুতরাং আধুনিক রাষ্ট্রের ইতিহাসও বর্ণের ইতিহাস হিসেবে পড়া যেতে পারে।’ কিন্তু পরে বহু কারণে কিংবা ‘ধাক্কা মারলে ধাক্কা খেতে হয়’ এমন বাস্তবতার কারণেই হয়তো-বা রাষ্ট্রীয়ভাবে তাড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা থেকে বের হতে হয় ইউরোপকে। যদিও বর্ণবিভেদ আমজনতার মধ্যে সেখানে শেষ হয়ে যায়নি।
এখন আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার জায়গাগুলো দেখি। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান তার সেই বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা ‘সং অব মাইসেলফ’ এর এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘ডু আই কন্ট্রাডিক্ট মাইসেলফ? ইয়েস আই ডু’ (আমার মধ্যে কি স্ববিরোধ আছে? হ্যাঁ আছে)। সহজ কথায় এর অর্থ আমার যা করা উচিত না, আমি তা করি। প্রশ্ন হলো কেন করি বা কেন মানুষ করে? আত্মরক্ষার্থে? তাই যদি হয়, আত্মরক্ষার্থে যা করা উচিত না, তা করলে শেষ রক্ষা হয় কি? এ প্রশ্ন থেকে যায়।
মাহমুদ মামদানি ১৯৭৫ সালে, তানজানিয়ার দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ প্রভাষক। বছরটি বেশ গুরুত্ববহ ঔপনিবেশিকতামোচনের কাল হিসেবে। এ বছর আমেরিকা ইন্দোচীনে পরাজিত হয়। এ বছরেই আফ্রিকা মহাদেশের মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, গিনি থেকে পর্তুগিজরা বিদায় হয়েছে। এই বছরেই ঠাণ্ডা লড়াইয়ের প্রধান কেন্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে স্থানান্তর হয়। তখন কৌশলগত প্রশ্নটি ছিল, পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের টুকরোগুলো কে নেবে সোভিয়েত না যুক্তরাষ্ট্র? প্রধান কেন্দ্র স্থানান্তর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল পরিবর্তন হয়। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস ইন্দোচীন যুদ্ধের শিক্ষা বিবেচনায় নিয়ে শীতল যুদ্ধ স্থানান্তর করতে বলে। সেই শিক্ষা নিক্সন মতবাদ হিসেবে আইনসভায় গৃহীত এবং তা ক্লার্ক সংশোধনী আকারে পাস হয়। নিক্সনের মতবাদে ছিল ‘এশিয়ার যুদ্ধ এশিয়ার ছেলেদের করা উচিত’। এ শিক্ষা আমেরিকা পেয়েছে ইন্দোচীনে এক যুগের বেশি জড়িয়ে থেকে কোনো লাভ না হওয়াতে। বিশেষত তুলনামূলক লাওসে প্রক্সি যুদ্ধ সফল হলেও ভিয়েতনামে ব্যর্থতার চাপে সেই সফলতাও ব্যর্থ হয়েছে। ভিয়েতনামে সরাসরি যুদ্ধে নামে আমেরিকা হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে ভিয়েতনামি কমিউনিস্ট গেরিলাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু লাওসে এসে আমেরিকা দেখে তার হাত বাঁধা ১৯৬২ সালের চুক্তি অনুযায়ী মস্কোর সঙ্গে। সেই চুক্তি মোতাবেক আমেরিকান সৈন্য লাওসে প্রবেশ করতে পারে না। উপায় নেই দেখে আমেরিকা তাৎক্ষণিকভাবে যা মাথায় আসে তা করে লাওস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
উল্লেখ্য, ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, যখন জনসন প্রশাসন দাবি করল দুই আমেরিকান ডেস্ট্রয়ার আঘাত করেছে উত্তর ভিয়েতনামিদের টর্পেডো টনকিন উপসাগরে। আমেরিকান সংবাদ মাধ্যমে একটি চিত্র প্রকাশ পেল, যেখানে দেখানো হয় যুক্তরাষ্ট্রকে অপমান করা হয়েছে। তাই এর একটা জবাব দেওয়া উচিত দাবি করা হয় প্রভাবশালী মিডিয়াতে। মাহমুদ মামদানি জানালেন, ‘প্রেসিডেন্ট জনসন উত্তর ভিয়েতনামিদের ওপর বোমা মারা শুরু করেন। জোরেশোরে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কংগ্রেসের দুই হাউজ থেকে সেনা পাঠানোর অনুমোদন দিতে বললেন। দ্রুতগতিতে কাজ হলো, প্রেসিডেন্ট দুই হাউজ (হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ ও সিনেট) থেকেই আক্রমণের অনুমোদন পেয়ে গেছেন। অতঃপর যে খবর পাওয়া গেল, যে ডেস্ট্রয়ারের নাবিকরা জানিয়েছিলেন তারা টর্পেডো দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, তারাই পরে জানালেন আক্রান্ত হওয়ার খবরটি বানোয়াট ছিল। কিন্তু আমেরিকা অন্য হিসাব মাথায় নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। কারণ আমেরিকার প্রধান প্রতিপক্ষ রাশিয়া। ডেস্ট্রয়ার আক্রান্তের খবর পেয়ে তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যেন পেয়ে গেলেন ব্ল্যাংক চেকÑ বিস্তর শক্তি প্রয়োগের সুযোগ। কিন্তু সফল হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। ‘অপারেশন রোলিং থান্ডার’ করল যুক্তরাষ্ট্র উত্তর ভিয়েতনামে। নিরবচ্ছিন্ন বোমা ফেলতে থাকল। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো, শিল্প কারখানাগুলো ধ্বংস করতে থাকল এ আশায় যে উত্তর ভিয়েতনামিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।
কিন্তু ব্যর্থ হলো আমেরিকা আশানুরূপ ফল এলো না। প্রেসিডেন্ট জনসন দক্ষিণ ভিয়েতনামে কমব্যাট সৈন্য নামালেন। নতুন নতুন অপারেশন করল। ‘সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়’, ‘বডি কাউন্ট’ ইত্যাদি। কিন্তু ব্যর্থ হলো আমেরিকা। ছোট ছোট ব্যর্থতাগুলো বিশাল ব্যর্থতায় উন্নীত হলো। সেখানে তাদের ‘আমেরিকানাইজেশন’ হয়ে গেল ঐতিহাসিক ‘ভিয়েতনামাইজেশন’। প্রসঙ্গত, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর পুত্রজায়াতে ওআইসি-র সম্মেলনে বলেছিলেন- Jews rule the world by proxy. They get others to fight and die for them. কথাটা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আসার পর পক্ষে-বিপক্ষে বেশ হইচই হয়েছিল। সিএনএন-র রিপোর্টে বলা হয়, আমেরিকা ও ইসরায়েল মাহাথিরের কথাকে ‘পোলারাইজিং রেটোরি’ বা ‘নতুন অর্থের চটকদার বুলি’ বিবেচনা করেছিল। মাহাথির ঠিক ধরতে পেরেছিলেন ইহুদি পরিচয়ের জায়নবাদীরা অপরের মাধ্যমে দুনিয়া শাসন করছে। আমেরিকার একজন বিখ্যাত ইহুদি সাংবাদিক, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি উদঘাটনের অন্যতম অনুসন্ধানী কার্ল বার্নস্টাইন ২০১৩ সালের ৪ মে এমএসএনবিসি টিভি’র ‘মর্নিং জো’ টক শো-তে সাফ বলেছিলেন, ইসরায়েলি নিও-কনজার্ভেটিভেরা আমেরিকাকে ইরাক যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছিল তাদের স্বার্থে। ইনি সেই বার্নস্টাইন, যিনি আর বব উডওয়ার্ড মিলে প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রশাসনের ‘ডার্টি ট্রিক্স’ বের করে দিয়েছিলেন, যা ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’ নামে খ্যাত। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এভাবে ভেতরে এবং বাইরে বিস্তর ব্যর্থতা আছে আমেরিকার।
লেখক: কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক
আজকের বাংলাদেশে নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হলেও সারা দেশের বিপুলসংখ্যক নারী এখনো সমাজজীবনের অন্ধকারে রয়ে গেছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাশাপাশি এখন উচ্চশিক্ষায় নারীর সাফল্যও খুবই আশাব্যঞ্জক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফুটবল ও ক্রিকেটের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আসরগুলোতে বাংলাদেশের মেয়েদের শিরোপা জয় যেন সামাজিক পরিসরে নারীর আগুয়ান হওয়ার পদধ্বনি। রাজনীতির মাঠেও নারীর নেতৃত্ব ও সরব পদচারণা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের সঙ্গে উগ্র ধর্মীয় চিন্তাচেতনা মিলে নারীর এই অগ্রযাত্রাকে যেন পেছন থেকে টেনে ধরা হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতি এবং শাসনব্যবস্থার শিথিলতা যে অনেকাংশ দায়ী, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এসব কারণেই দেশে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর মুক্তি ও ক্ষমতায়ন এখনো সুদূরপরাহত। তবে সাম্প্রতিক কালে আইনি কাঠামোর সংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় কর্মপদ্ধতিতে নানা সংস্কারের মধ্য দিয়ে এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে এবং নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হচ্ছে।
আমাদের সমাজে প্রথাগতভাবেই অভিভাবকত্বের প্রশ্নে মায়ের চেয়ে বাবার ভূমিকাই মুখ্য। কিন্তু অভিভাবকত্বের প্রশ্নে মা ও বাবা দুজনের সমান ভূমিকা থাকা যে জরুরি সেটা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন আইনজীবী-মানবাধিকারকর্মী-নারী আন্দোলনকর্মীরা। জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রেও একমাত্র পিতৃপরিচয়ের প্রথাগত ধারণা ও চর্চার কারণে নানা ধরনের বাস্তবিক সংকট মোকাবিলা করতে হয় বহু ব্যক্তিকে। বহু আলোচনা-সমালোচনা ও সামাজিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জন্মনিবন্ধন, নাগরিকত্বের সনদ, পাসপোর্ট এবং বিয়ে-তালাক নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বাবার পাশাপাশি মাকে যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করার মধ্য দিয়ে এক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে সত্যি। কিন্তু এতে সংকট শেষ হয়ে যায়নি। যে কারণে জন্মনিবন্ধন ও শিক্ষাক্ষেত্রের মতো মৌলিক নথিপত্র পূরণে সমস্যায় পড়ছিল দেশের শিশুরা, বিশেষত পিতৃপরিচয় জানা নেই কিংবা জানানোর ক্ষেত্রে সংকট রয়েছে এমন শিশুরা। আশাব্যঞ্জক খবর হলো হাইকোর্টের এক রায়ের মধ্য দিয়ে এখন থেকে কেবল মায়ের নাম লিখেও শিক্ষাক্ষেত্রের সব ধরনের ফরম পূরণ করতে পারবে শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের দ্বৈত বেঞ্চের এক রায়ে এমন নির্দেশনা আসে। এতে শিক্ষার্থীদের সব ধরনের এসআইএফ (স্টুডেন্ট ইনফরমেশন ফরম) পূরণে বাবার নাম লেখার বাধ্যবাধকতাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে হাইকোর্ট বলেছে, ফরম পূরণের ক্ষেত্রে অভিভাবক কলামে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের যেকোনো একজনের নাম লেখা যাবে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষা বোর্ডকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
নারী অধিকারকর্মী ও সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা এ রায়কে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী উল্লেখ করে বলছেন, সংগত নানা কারণেই অনেক শিক্ষার্থীর পিতৃপরিচয় থাকে না। আবার সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে পিতার অভিভাবকত্ব প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার্থীদের ফরমে বাবার নাম লেখার বাধ্যবাধকতা থাকা প্রতিবন্ধকতা। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের বিপাকে পড়তে হয়। হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে শিক্ষার্থীর ফরমে মায়ের অভিভাবকত্ব যেমন প্রতিষ্ঠিত হলো তেমনি বাবা-মা কেউ না থাকলেও শিক্ষার্থীর আইনগত অভিভাবকের নামও লিখতে পারবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গত বছরের জুলাই মাসে হাইকোর্ট আরেক রায়ে পিতা-মাতার জন্মনিবন্ধন নেই এমন শিশুদেরও জন্মনিবন্ধনের সুযোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এই রায় বাস্তবায়নও এক যুগান্তকারী ঘটনা। একইভাবে, কিছুকাল আগে মুসলিম বিয়ে নিবন্ধন ফরম বা নিকাহনামায় নারী ও পুরুষের অধিকার ও মর্যাদায় যেসব বৈষম্য ছিল তার একটি দূর করা হয়েছে উচ্চআদালতের নির্দেশে। নিকাহনামায় কনের ক্ষেত্রে ‘কুমারী’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘অবিবাহিতা’ যুক্ত করতে এবং বরের ক্ষেত্রেও ‘বিবাহিত/বিপত্নিক/তালাকপ্রাপ্ত’ কি না তা সংযোজন করার নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত। নারী-পুরুষ বৈষম্য বিলোপে এমন পদক্ষেপগুলো সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু মনে রাখা দরকার দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন আইনে এখনো নারী-পুরুষের মধ্যে অনেক বৈষম্য রয়ে গেছে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ে নারী-পুরুষের মধ্যকার এই বৈষম্যের ধরনও ভিন্ন। এক্ষেত্রে মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য জাতি-সম্প্রদায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয়-পারিবারিক আইন অনুসরণ করা হয়ে থাকে। মানবাধিকারকর্মী এবং নারী আন্দোলন কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারাই সমাজে নারীর প্রতি নানাবিধ বৈষম্যের অন্যতম বড় কারণ। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীকে বঞ্চিত না করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন এবং বিষয়টি সুরাহার পথ খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা আশা করব এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুগম হবে।
সাধক, চিকিৎসক ও সৎসঙ্গ আশ্রমের প্রবর্তক অনুকূলচন্দ্র ঠাকুর। তিনি ১৮৮৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পাবনার হেমায়েতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শিবচন্দ্র চক্রবর্তী, মা মোহিনী দেবী। কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল থেকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের ডিগ্রি নেন। নিজ গ্রামে ফিরে চিকিৎসাসেবা শুরু করেন। তার বিশ্বাস ছিল, মানুষ শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকÑএই তিন ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তাই তিনি মানসিক ব্যাধির চিকিৎসার প্রতিই বেশি জোর দিতেন। মায়ের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে অনুকূলচন্দ্র মানুষের আত্মিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কীর্তন দল গঠন করেন। মানুষের আত্মিক উন্নতির লক্ষ্যে তিনি পাবনায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘সৎসঙ্গ আশ্রম’। অনুকূলচন্দ্র জনকল্যাণে তপোবন বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, পাবলিশিং হাউজ, ছাপাখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিহারের দেওঘরে যান এবং সৎসঙ্গের আদর্শে নতুন আশ্রম গড়ে তোলেন। ‘শাশ্বতী’ নামে আশ্রমের একটি মুখপত্র প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর তিনি আর ফিরে আসেননি। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় তিনি ৪৬টি বই লিখেছেন। এর মধ্যে ‘পুণ্যপুঁথি’, ‘অনুশ্রুতি’ (ছয় খণ্ড), ‘চলার সাথী’, ‘শাশ্বতী’ (তিন খণ্ড), ‘প্রীতিবিনায়ক’ (দুই খণ্ড) উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৯ সালের ২৬ জানুয়ারি বিহারে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ভারত ও বাংলাদেশ দুদেশেই তার ভক্তকুল ছড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশের ৫৩তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস রবিবার।
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত গণহত্যা অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বেসামরিক লোকের ওপর গণহত্যা শুরু করে।
তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। ওই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তারের আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তা জনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধর পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি ভূখণ্ডের, যার নাম বাংলাদেশ।
দেশে ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি ইন্টারনেট সেবা চালু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। অন্য অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক একই সেবা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সব মোবাইল অপারেটরই দেশের বেশিরভাগ স্থানে ফোরজি সেবা চালু করেছে। আর সে হিসেবেই তারা ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু গ্রাহকরা ফোরজি ইন্টারনেট কিনলেও দেশের অনেক এলাকায় টুজি-থ্রিজি’র সেবা পাচ্ছেন। তারা অপারেটর কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ জানালেও এর সুরাহা হচ্ছে না।
জানা গেছে, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে মোটামুটিভাবে গ্রাহকরা ফোরজি সেবা পাচ্ছেন। তবে এসব এলাকায়ও অনেক সময় ফোরজি থাকে না, থ্রিজিতে নেমে আসে নেটওয়ার্ক। তবে জেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ সময়েই থাকে থ্রিজি। আর মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ সময় সেই থ্রিজিও থাকে না, তখন টুজি নেটওয়ার্কই ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইন্টারনেট প্যাকেজ যথাযথভাবে থাকার পর তা কাজ করে না, বাফারিং হয়। এতে গ্রাহকরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো সারা দেশের ব্যবসা একত্রে হিসাব না করে এলাকাভিত্তিক ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা দেখেন, কোন এলাকায় তাদের গ্রাহক সংখ্যা কত, সেখানে কত সিমে ইন্টারনেট চালু আছে। যদি দেখা যায়, তাদের হিসাব মতে তা সন্তোষজনক আছে তাহলে সেখানে ফোরজি সেবা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বহাল রাখে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টাওয়ার নির্মাণ করে। কিন্তু যদি দেখে সন্তোষজনক গ্রাহক নেই তাহলে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না, এতে সেই এলাকায় ফোরজি পাওয়া যায় না। অথচ শহর এলাকাগুলোতে তারা বেশি ব্যবসা করলেও সেটাকে হিসাবে ধরে না। কিন্তু মফস্বল এলাকা থেকে কল বাবদ প্রয়োজনের বেশি ব্যবসা হলেও তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সমন্বয় করে না।
মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর ফেসবুক পেইজে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অভিযোগ জানান গ্রাহকরা। অভিযোগ অনুযায়ী, অপারেটরদের মধ্যে টেলিটকের নেটওয়ার্কই বেশি দুর্বল। টেলিটকের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে মো. ফয়জুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই, নেটওয়ার্ক পাই না সকাল থেকে। মিরপুর-২ নম্বরে বাসা স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে। আর আমার গ্রামের কথা না হয় বাদ দিলাম।’ আরাফাত আলী লেখেন, ‘২জিবি নেট কিনলে দেড় জিবি নষ্ট হয়। মেয়াদ ১৫ দিন তাও ফুরাতে পারি না। তাহলে বুঝেন নেটওয়ার্ক কত ভালো।’ কার্জন চাকমা লেখেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় ফোরজি নিশ্চিত করুন। আমাদের পার্বত্য এলাকাগুলোতে টেলিটকের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি, কিন্তু শুধু থ্রিজি-টুজিতে সীমাবদ্ধ।’ রাসেল আহমেদ লেখেন, ‘গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাংগা গ্রামে থ্রিজি নেটওয়ার্ক তো নেই-ই। মাঝেমধ্যে টুজি’ও নেই। বুঝুন অবস্থাটা। আমাদের থ্রিজি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করুন।’
টেলিটকের মহাব্যবস্থাপক (সিস্টেম অপারেশন) নুরুল মাবুদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ফাইভজি রেডিনেস প্রজেক্ট শুরু করেছি। যা শেষ হতে এক বছর বা তার কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। এর ফলে আমাদের কাভারেজ এলাকাগুলোতে ফোরজি সেবা নিশ্চিত হবে। এছাড়া আমাদের কাভারেজ বাড়ানোরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে।’
বাংলালিংকের পেজের একটি পোস্টে মাহাদী হাসান তালহা লেখেন, ‘আমার এলাকায় আপনাদের সিম ব্যবহার করতে হলে ফোন গাছের ডালে বেঁধে লাউডস্পিকার দিয়ে কথা বলা লাগে। এত্তো ফাস্ট কেন আপনাদের নেটওয়ার্ক।’ আকরাম হোসাইন লেখেন, ‘ভাই আপনাদের সবই ঠিক, তবে নেটওয়ার্ক সেøা।’
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অফিসার তৈমুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফোরজি সেবার জন্য ২৩০০ মেগাহার্জের স্পেকটার্ম প্রয়োজন হয়। কিন্তু টুজিতে তা লাগে মাত্র ৯০০ মেগাহার্জ। আমরা ইতিমধ্যে ৯৫ শতাংশ কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা নিশ্চিত করেছি। তবে আমাদের আরও বেশি সাইট লাগবে। যদি সব অপারেটর মিলে আমরা টাওয়ার শেয়ার করতে পারি, তাহলে সব গ্রাহকের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে।’
রবির পেজে এক পোস্টে তানভীর আহমেদ লেখেন, ‘কলাপাড়া থানা শহরে যদি থ্রিজি নেটওয়ার্ক না পাওয়া যায়, এরচেয়ে দুঃখজনক কিছুই হতে পারে না।’ এইচএমএম ইসমাঈল লেখেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার চম্পকনগর ইউনিয়নে রবি সিমের থ্রিজি নেই। অথচ অনেক বছর আগে রবি টাওয়ার বসানো হয়েছে। আমরা রবি সিম দিয়ে ইন্টারনেট চালাতে অক্ষম।’
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলটরি অফিসার শাহেদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা রয়েছে। তবে দেখা যায়, অনেক ফোন ফোরজি সাপোর্ট করে না। আর কাভারেজ এলাকা থেকে যতদূরে যাওয়া যাবে, নেটওয়ার্ক তত কমতে থাকবে। এছাড়া আমাদের কিছু জায়গায় নেটওয়ার্কের কাজ চলছে। পাশাপাশি নতুন কিছু টাওয়ার তৈরির কাজও আমাদের চলছে।’
গ্রামীণের পেইজে একটি পোস্টে রহিদুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই আমি যখন গ্রামে যাই তখন নেটওয়ার্কের ঝামেলা হয়।’ সাইদুর রহমান লেখেন, ‘এমন সার্ভিস হলে চলবে? কলরেট, ইন্টারনেটের দাম তো ঠিকই বেশি আপনাদের, বাকি সব অপারেটরদের থেকে।’
গত বছরের ২৮ এপ্রিল টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত ‘আনলিমিটেড’ ও ‘মেয়াদবিহীন’ ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। কারণ এজন্য প্যাকেজের দাম বাড়িয়েছে অপারেটররা। আর মেয়াদহীন ইন্টারনেট পেতে প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একই প্যাকেজ চালু করতে হবে। কিন্তু গ্রাহকের সব সময় একই ধরনের ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে গ্রাহকের কেনা ইন্টারনেট। এছাড়া মেয়াদবিহীন হিসেবে মোবাইল অপারেটররা যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে গ্রাহকদের।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে সচল সিমের সংখ্যা ১৮ কোটি ২০ লাখ ৬১ হাজার। এরমধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার, রবির ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৪ হাজার, বাংলালিংকের ৪ কোটি ৮৫ হাজার এবং টেলিটকের ৬০ লাখ ৬৭ হাজার। আর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫০ লাখ। এরমধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি ও পিএসটিএন)-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ লাখ ৮৭ হাজার গ্রাহক।
রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির মধ্যেই তৈরি পোশাক খাতের আকাশে দেখা দিয়েছে শঙ্কার মেঘ। কয়েক মাস ধরেই খাতটির উদ্যোক্তারা রপ্তানি আয় কমে যাওয়া নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। তারা বলছেন, রপ্তানির প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় আগামীতে ওই সব অঞ্চলে রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। তাদের ভাষ্য, ইতিমধ্যে তার প্রভাবও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। অর্ডার কমে যাওয়ায় কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যও বলছে সে কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার হার নেমেছে প্রায় অর্ধেকে।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তবে এই খাতের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির পুরোটাই আমদানিনির্ভর; যা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাপক হারে কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) টেক্সটাইল ফেব্রিক্স আমদানির এলসি বা ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ৬২৬ কোটি ডলারের এলসি খোলেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৬৫ কোটি ডলার।
তবে প্রস্তুত কাপড়ের চেয়ে বেশি আমদানি কমেছে কাঁচামালের। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে কাঁচা তুলা বা কটন আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এ সময়ে কাঁচা তুলা আমদানিতে ১৫৩ কোটি ডলারের এলসি খোলেন ব্যবসায়ীরা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে তুলা আমদানিতে ২৭২ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। আবার তুলার চেয়ে সুতা আমদানি আরও কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সুতা আমদানিতে এলসি খোলা হয় ১০৭ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৪২ কোটি ডলার। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুতা আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৬ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের আট মাসে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৪ দশমিক ১১ শতাংশ। এই সময় টেক্সটাইল যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমেছে ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৬৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে। আর এটি কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা নতুন কলকারখানা স্থাপন অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। এতে দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে ‘ধস’ নামার একটা অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ও জাহাজভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক পতন, বিভিন্ন দেশে মন্দার শঙ্কাসহ নানা কারণে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে দেশে ডলার সংকট দেখা দিলে এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। এতে ডলারের ওপর চাপ কিছুটা কমানো গেলেও আমদানি জটিলতায় পড়েছে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাত।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ কিছুটা কমেছে। কিন্তু উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানি বাড়ায় রপ্তানি আয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রভাব পড়েনি। যেহেতু সাধারণ পোশাক রপ্তানি কমেছে সে কারণে কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিও কমেছে। পাশাপাশি ডলার সংকটও আমদানি কমে যাওয়াতে ভূমিকা রেখেছে। ফারুকের আশঙ্কা, উন্নত দেশগুলোতে ব্যাংকিং খাতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তার কারণেও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে এসব বিষয় মোকাবিলায় পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করার মতো অর্থের সংকট রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারছে না। পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার বড় অবমূল্যায়নের কারণে মালিকরা খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আনছেন না। অবশ্য আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমায় আমদানির পরিমাণে প্রভাব পড়েছে বলেও মনে করেন ফজলে শামীম এহসান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দার আশঙ্কায় কেউ নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। তবে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়াটাকে তারাও আসন্ন সংকট হিসেবে দেখছেন। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশে ডলারের সংকটের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল আমদানি করতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এটা খুব ভালো লক্ষণ নয়। তবে তিনি আশাও দেখছেন। তার ভাষ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমে যাওয়ায় মূলত আমদানি ব্যয় কম হয়েছে। আমদানির পরিমাণ খুব একটা কমেছে বলে মনে করেন না তিনি।
পুলিশ ভেরিফিকেশন না হওয়ায় চাকরি স্থায়ীকরণ হচ্ছিল না। কিন্তু তার দেরি সয়নি। নিজের তত্ত্বাবধানে থাকা সার্ভিস বইয়ের পাতায় কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে স্থায়ী করে নিলেন নিজের চাকরি। এই ব্যক্তি হলেন ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী মো. মনোয়ার হোছাইন। স্থানীয় সরকার বিভাগ তদন্তের পর থানায় মামলা হয়। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে তার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের চারটির প্রমাণ মিলে। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট আইনের দুটি ধারায় তার ১২ বছর সাজা ও অর্থদ- হয়েছে। পুলিশ মনোয়ারকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ১৯ মে ‘ক্রু’ বা মশককর্মী পদে যোগ দেন মনোয়ার হোছাইন। দপ্তরের চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, এলডিএ কাম টাইপিস্ট হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করে তিনি ওই পদও বাগিয়েছেন। ওই পদ থেকে উচ্চমান সহকারী (হেড ক্লার্ক) পদেও পদোন্নতি নিয়েছেন। এরপর দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে নেন। তথ্য গোপন করে পদোন্নতি নেওয়া এই কর্মকর্তার বাদ ছিল চাকরিতে স্থায়ী হওয়া। প্রথমবার কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি নেওয়ার পর তার উচ্চাকাক্সক্ষা বেড়ে যায়। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল স্বাক্ষর করে চাকরি স্থায়ী করেন। এর আগে দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা তালুকদারকে চাকরি স্থায়ী করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।
এ ঘটনার পর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্থানীয় সরকার বিভাগ ও দুদকের তদন্ত কমিটির কাছে লিখিতভাবে তার স্বাক্ষর জাল করার বিষয়ে অভিযোগ করেন। ২০১১ সালে মনোয়ারকে বরখাস্ত করা হয়।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা তালুকদার তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগের পক্ষে বিভিন্ন প্রমাণও জমা দেন। তিনি লিখিত বক্তব্যে জানান, অভিযুক্ত মনোয়ার হোছাইনের চাকরি স্থায়ীকরণ সংক্রান্ত চাকরি বইয়ের দ্বিতীয় খ-ের নবম পৃষ্ঠায় যে স্বাক্ষর রয়েছে তা তার নয়। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখের স্বাক্ষরটি মনোয়ারের সৃজনকৃত। চাকরিকালীন তার বিষয়ে কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন করানো হয়নি। এ জন্য তার চাকরিও স্থায়ী করা হয়নি। আর সার্ভিস বইয়ে যে সিল ব্যবহার করা হয়েছে তা তার সময়ে ব্যবহৃত সিল থেকে ভিন্ন। সিলের নিচে যে স্বাক্ষর রয়েছে তিনি বলতে পারবেন সেটা কীভাবে হলো। ইস্যু রেজিস্টার খাতায় ৪৬ নম্বর দিয়ে যে চিঠিটি তৈরি করা হয়েছে তার কোনো কপি কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। ৪৬ নম্বর ক্রমিকটি ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি লেখা রয়েছে। অন্যান্য কলাম খালি রয়েছে। পরের পাতায় ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি ২৬ নম্বর ক্রমিক দিয়ে একটি বদলির চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরও জানান, ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মনোয়ার হোছাইন। দপ্তরের বিধি-বিধান অনুযায়ী নথি, রেকর্ডপত্র, সার্ভিস বই তার কাছে রক্ষিত ছিল। এ কারণে জাল স্বাক্ষরের দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। দপ্তরে জমা দেওয়া তার এলএলবি পাসের সনদও সঠিক ছিল না। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে তার ওই সনদ সঠিক নয় বলে লিখিতভাবে দপ্তরকে জানানো হয়েছে।
মনোয়ারের বিরুদ্ধে অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ, নিয়োগ বাণিজ্য, স্বাক্ষর জাল, নিজেই নিজের চাকরি স্থায়ীকরণ এবং নথি, রেকর্ডপত্র, সার্ভিস বইয়ে ত্রুটি ঘটানোসহ পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে চারটি অভিযোগের প্রমাণ মেলে।
ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তর সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশে ২০১৩ সালের ১৮ জুন দপ্তরের পক্ষ থেকে চকবাজার থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা (নম্বর-৪) করা হয়। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানো হয়। দুদক তদন্ত করে মনোয়ারের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট আইনের একটি ধারায় তার পাঁচ বছরের কারাদ- হয়। পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের সশ্রম কারাদ- দেয় আদালত। আরেকটি ধারায় সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়ার পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের বরখাস্ত উচ্চমান সহকারী মনোয়ার হোছাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, একটি চক্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। তাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে তিনি কর্মস্থল থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল এবং আদালতের সাজার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা কত কিছু করছে। কোথায় আবার কী করেছে বুঝতে পারছি না। এ প্রসঙ্গটি বারবার উত্থাপন করলেও তিনি এড়িয়ে যান।
মানহানির মামলায় কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর লোকসভার সদস্য পদও হারিয়েছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তবে তাতে তিনি ভীত নন, বরং উৎফুল্ল। নিজের অবস্থান থেকেও পিছু হটবেন না বলে ঘোষণাও দিয়েছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যখন পার্লামেন্টে আমার পরবর্তী বক্তব্য নিয়ে ভীত, তখন আমাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হলো। আমি তার চোখে ভয় দেখেছি। এ জন্যই তারা আমাকে পার্লামেন্টে বলতে দিতে চায় না।
গতকাল শনিবার দুপুরে কংগ্রেস সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে রাহুল গৌতম আদানির সঙ্গে বিপেজির সম্পর্ক নিয়ে তার অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শুরু থেকে তিনি যে প্রশ্ন করে চলেছেন, এখনো সেটাই করবেন। শিল্পপতি গৌতম আদানির গোষ্ঠীতে যে ২০ হাজার কোটি রুপি লগ্নি হয়েছে, সেই টাকার উৎস কী? তার সঙ্গে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্কই-বা কী?
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে কর্নাটকে এক সমাবেশে রাহুল ‘সব চোরের পদবি মোদি হয় কী করে?’ মন্তব্য করেছিলেন। ওই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় গুজরাটের সাবেক মন্ত্রী পুরনেশ মোদির করা মানহানির মামলায় বৃহস্পতিবার তাকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেয় সুরাটের এক আদালত। সাজা দিলেও রাহুলকে জামিন দেন বিচারক, উচ্চ আদালতে আপিল করতে, তার সাজা ৩০ দিনের জন্য স্থগিতও রাখা হয়। ওই সাজার ওপর ভিত্তি করে পরদিনই লোকসভা সচিবালয় কেরালার ওয়েনাড আসন থেকে নির্বাচিত রাহুলকে পার্লামেন্টে অযোগ্য ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এসব নিয়ে দেশজুড়ে কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবাদ দেখাচ্ছে কংগ্রেস, তার মধ্যেই গতকাল সংবাদ সম্মেলনে আসেন বাহুল। তিনি বলেন, তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হোক, কিংবা জেলেই পাঠানো হোক, তিনি তার কাজ চালিয়ে যাবেন।
লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি ভারতে ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ চেয়েছেন, বিজেপির এমন অভিযোগও অস্বীকার করেছেন তিনি। ওই বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইবেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে রাহুল বলেন, আমার নাম সাভারকার নয়, আমি গান্ধী, ক্ষমা চাইব না।
লন্ডনে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে পার্লামেন্টে বলতে স্পিকারকে অনুরোধ করার কথাও জানান সাবেক এই কংগ্রেস সভাপতি।
বলেন, আমার পদক্ষেপ কেবল একটিই, তা হলো সত্যের জন্য লড়া এবং দেশের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে রক্ষা করা। আজীবনের জন্য আমাকে অযোগ্য ঘোষণা করুক, আজীবনের জন্য জেলে পাঠাক, আমি লড়ে যাব।
রাহুল বলেন, আমি ভারতের জনগণের গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বরের সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য এখানে এসেছি। এটাই করে যাব। আমি কারও ভয়ে ভীত নই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের অপরাধীরা আগে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করত। এরপর জানা গেল, সেখান থেকে দেশে অপরাধ ঘটায় তারা। কারও কারও নেপালে অবস্থানের কথাও জানা যায়। ভারতকে নিরাপদ মনে না করায় আরব আমিরাতের দুবাই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। সেখানে তারা আস্তানা গেড়েছে।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা অপরাধ করেই দুবাই চলে যাচ্ছে। সেখানে বসেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে। এখন বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাও দুবাইকে কেন্দ্র করে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। তাদের কেউ কেউ সোনার কারবারও করছেন। ওই দেশে ভারতের দুর্ধর্ষ অপরাধী দাউদ ইব্রাহিমের শিষ্যত্ব নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ওইসব অপরাধীর তথ্য জানার পরও তাদের ফেরত আনতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিসের’ দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ধরতে রেড নোটিস জারি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে পার পেয়ে গেছে। যদিও মামলাটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে নতুন করে আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্ত করার কথা ভাবছে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ সড়কে গুলি চালিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত হন এক কলেজছাত্রী। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মূল হোতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার রাতেই দেশ ছেড়ে চলে যায় দুবাইয়ে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে মুসা চলে যায় ওমানে। জিসান ও জয় এখনো দুবাইতেই বসবাস করছে। যদিও ওমান থেকে মুসাকে ওই বছরের ৯ জুন ইন্টারপোলের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের আলোচনায় আসে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও হিরো আলমের দুবাই সফরকে কেন্দ্র করে। তারা বনানীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের আসামি আরাভ খান নামধারী রবিউল ইসলামের সোনার দোকান উদ্বোধন করতে সেখানে যান। দুবাই যাওয়ার কারণে সাকিব ও হিরো আলমকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হতে পারে। এ ছাড়া ‘প্লেজার ট্যুরের’ জন্য এখন দেশের শিল্পপতিদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে দুবাই। কারণ ঢাকাকে তারা নিরাপদ মনে করছেন না। পাশাপাশি দেশে আটক সোনার চালানের ৮০ শতাংশ জব্দ হচ্ছে দুবাইফেরত বিভিন্ন এয়ারলাইনস থেকে। সব মিলিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দুবাই।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীরা যে দেশেই থাকুক না কেন, তাদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে আটক করার পর দুবাই থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে চেয়েছিল পুলিশ। সম্প্রতি আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভকে দুবাই থেকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ে সুখবর দেওয়া সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে জানান, সম্প্রতি আলোচনায় আসা আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ভারতের পাসপোর্টধারী। দেশে তার নামে ১২টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ওইসব পরোয়ানার কপি ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে পাঠানোর পর দ্রুতই তাকে ফেরানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এর আগে জিসান ও জয়কে দুবাই থেকে ফেরত আনার উদ্যেগ নিয়েও আনতে পারেনি। টের পেয়ে তারা দুবাই ছেড়ে কানাডায় চলে যায়। তারা আবার দুবাই এসেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এই দেশে অপরাধ করে দুবাই গিয়ে আস্তানা গাড়েন। ইতিমধ্যে পুলিশ একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকায় গুলশান ও বনানী এলাকার মডেলের সংখ্যা বেশি। বছরখানেক আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকেন। তাদের সঙ্গে অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সখ্য আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এমনকি বনানীতে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যাকান্ডে তাদেরও সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার পর পিয়াসা, রাজ ও আরাভকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় তদন্ত করা হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগীতশিল্পী, এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও কয়েকজন মডেল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। আবার কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তাড়া খেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছে কেউ কেউ। আত্মগোপনে থেকেই তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দুবাই রয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আলাদাভাবে বৈঠক হয়েছে। ওইসব বৈঠকে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাই চলে যায়। সেখান থেকেও ঢাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তার সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল, কামরুল হাসান হান্নান, ইব্রাহীম, রবিন ও শাহাদৎ হোসেন বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, শাহাদৎ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নুর হোসেনসহ অনেকেই কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নুর হোসেন ছাড়া অন্য সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। সুব্রত, মোল্লা মাসুদ ও শাহাদৎ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে মুম্বাই হয়ে দুবাই চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার অপরাধজগতের এক সন্ত্রাসী এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধীরা এখন আর ভারত যেতে চায় না। কারণ ওই দেশে শান্তিতে থাকা যায় না। ফলে সবাই এখন দুবাইমুখী হচ্ছে। দুবাইয়ে সবাই নিরাপদে থাকতে পারছে।