
করোনাকালীন দুর্যোগ অতিক্রম করে আবারও নির্ধারিত সময়ে শুরু হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। এবার মেলার মূল প্রতিপাদ্য ‘পড় বই গড় দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে বিশ্বমন্দার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। পাশাপাশি কাগজের অস্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধিতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে প্রকাশনা শিল্প। তবুও ফেব্রুয়ারির বইমেলাকে ঘিরে আশা দেখছেন লেখক ও প্রকাশকরা। নতুন বই প্রকাশ অপেক্ষাকৃত কম হলেও আগে প্রকাশিত মানসম্পন্ন ভালো বইও মেলায় খুঁজে নেবেন পাঠকরা এমনটাই তাদের প্রত্যাশা। ফলে এবারও মেলার মাঠে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের অন্যরকম সম্মিলন ঘটবে। বই নিয়ে চলবে নানা আলোচনা ও পর্যালোচনা। বই ঘিরেই বাঙালির এই সম্মিলন সত্যিকারভাবে আমাদের অহংকারের বিষয়ও।
কিন্তু শুরুর দিকে অমর একুশে বইমেলার আয়োজনটি কেমন ছিল? সে ইতিহাসটি জানতে একটু পেছনে তাকাতে হবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা’ নামটি। এদেশে প্রকাশনা শিল্পের পথিকৃৎ তিনি। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনিই প্রথম গ্রন্থমেলার সূচনা করেন। প্রথম মেলাটি হয়েছিল বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণের বটতলায়, এক টুকরো চটের ওপর। কলকাতা থেকে আনা মাত্র ৩২টি বই সাজিয়ে উনি বইমেলার গোড়াপত্তন করেছিলেন। সে বইগুলোই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান, যা ছিল চিত্তরঞ্জন সাহার ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ (বর্তমানে যা মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন সাহা একাই গ্রন্থমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী গ্রন্থমেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমিকে সম্পৃক্ত করেন। পরের বছরই যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতিও। ১৯৮৪ সালে এ মেলার নামকরণ হয়ে যায় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। এভাবে চিত্তরঞ্জন সাহার ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলাটিই এখন বাঙালির প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। গ্রন্থমেলার পরিবর্তে বর্তমানে এটিকে বলায় হয়Ñঅমর একুশে বইমেলা।
বইমেলা এলেই কথা ওঠে মানসম্পন্ন বই নিয়ে। যদিও মেলা শেষে বাংলা একাডেমি ঘোষণা দেয় নতুন প্রকাশিত মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা কতটি। কিন্তু মান নির্ধারণের পদ্ধতিটি কী সেটি আমরা জানতে পারি না। তবে এটি সত্যি, মেলায় প্রকাশিত মানসম্পন্ন বই খুব বেশি নয়। এর দায় আসলে কার লেখকের, নাকি প্রকাশকের? বিক্রির বিষয়টি মাথায় রেখে অধিকাংশ প্রকাশক এখনো বই প্রকাশ করেন মেলাকে ঘিরে। বছরের বাকি সময়টায় খুব কম বই প্রকাশ করেন তারা। ফলে নতুন বই প্রকাশের তোড়জোড়ে প্রুফ দেখা ও সম্পাদনার কাজটি একেবারেই হয় না। আবার অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থারই নিজস্ব সম্পাদনা দল নেই। এতে তাদের মাধ্যমে রঙচঙা প্রচ্ছদ মোড়ানো ভুলেভরা যে বইগুলো মেলায় আসে, প্রকৃতপক্ষে তা পাঠককে তেমন আন্দোলিত করে না। ফলে বই কিনে অনেক পাঠকই ঠকে গিয়েছেন বলে মনে করেন। এই দায়টি লেখকেরও। বইমেলায় বই বেরিয়েছে বা বেরোবে এমন নব্বই ভাগ লেখকই নিয়মিত পত্রিকায় বা অনলাইন পোর্টালগুলোতে লেখেন না। ফলে লেখালেখির অনেক ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও তারা লেখার মাধ্যমে পাঠক তৈরির চেষ্টা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকেন। প্রতি বছরের মতো এবারও বইমেলায় প্রকাশিত হবে শত শত বই। তার মধ্যে কতটি বই মানসম্পন্ন, তা একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বসহকারে তুলে ধরার কাজটি আমরা বাংলা একাডেমির কাছ থেকেই আশা করি। ভালো পা-ুলিপি ও ভালো সম্পাদনার মাধ্যমে মানসম্পন্ন বই প্রকাশ না করলে মেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাই শুধু বাড়বে, তা দিয়ে শিল্প-সাহিত্যের তেমন কোনো উন্নতি হবে না। আর এ দায় যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি প্রকাশকের এবং লেখকেরও।
বইয়ের পাঠক বেড়েছে, নাকি কমেছে? এ নিয়ে নানা মত ছিল ও আছে। পাঠক বৃদ্ধির বিষয়টিকে অনেক প্রকাশকই শুধু মেলায় বই বিক্রির মাপকাঠি হিসেবেই তুলে ধরেন। আবার অনেকেই ফেইসবুক ব্যবহারের ফলে বইয়ের পাঠকের সংখ্যা কমেছে বলে ঢালাওভাবে অভিযোগ তোলেন। অথচ আমরা দেখি কয়েক বছর আগে থেকেই ফেইসবুকেও গ্রুপ তৈরি করে সাহিত্যচর্চার রীতি চালু হয়েছে। শুদ্ধচর্চা, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ও নান্দনিক কিছু সৃষ্টির লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ফেইসবুক গ্রুপ। তারা বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের নতুন পাঠক তৈরিতেও ভূমিকা রাখছে।
আবার দেশে বই বিক্রির পরিমাণও বেড়েছে। কীভাবে? সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার বই কিনছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠক তৈরির কর্মসূচি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বই কেনার সংখ্যাও। প্রতি বছর শুধু অনলাইনেই বিক্রি হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার বই। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, পাবলিক লাইব্রেরি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, নানা এনজিও ও বেসরকারি সংস্থাও বই কেনে প্রতি বছরই। সরকারিভাবে প্রতি জেলায় এবং অনেক উপজেলাতেও বইমেলার আয়োজন হচ্ছে নিয়মিত। বেশ কিছু প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে সারা বছরই ‘কৈশোর তারুণ্যে বই’ ও ‘ক্লাসরুমের পাশে বই’ শিরোনামে বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বইমেলার আয়োজন করছে। শ্রাবণ প্রকাশনী গাড়িতে করে মুক্তিযুদ্ধের বই নিয়ে ঘুরছে সারা দেশে। এসব উদ্যোগ যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি বইয়ের নতুন পাঠক ও ক্রেতা তৈরিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তাই দেশে বইয়ের পাঠক ও বই বিক্রি কমছেÑএমন ধারণা অনেক যুক্তিতেই টিকে না। এখন দরকার ভালো মানের বই প্রকাশ এবং তা খুব সহজেই পাঠকের কাছে নিয়ে যাওয়া।
প্রায় প্রতি বছরই একটি বিষয় অজ্ঞাত কারণে বাংলা একাডেমির নজর এড়িয়ে যায়। ধর্মের প্রতি আঘাত হানা বই খোঁজার দিকে নজর দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের অসচেতনতায় অজান্তেই চলে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীর লেখা বই বিক্রি ও বিতরণের কাজ। কয়েক বছর আগ থেকেই বইমেলায় যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কাদের মোল্লা, গোলাম আযমসহ অন্য যুদ্ধাপরাধীদের লেখা বইগুলো বিক্রিসহ বইমেলায় প্রবেশ ও বের হওয়ার রাস্তায় বিতরণে কাজ করে একটি চক্র। তা ছাড়া মওদুদীবাদের বইয়েরও বিক্রি চলে এ সময়। স্বাধীনতাবিরোধী মতাদর্শের এই চক্রটি এবারও নানাভাবে সে চেষ্টাটি চালাবে। তাই বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের উচিত এই দিকটির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। কেননা ভাষা আন্দোলনের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে অমর একুশে বইমেলা। তাই মানসম্পন্ন বইয়ের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীর বইমুক্ত বইমেলাও চাই আমরা। কয়েক বছর ধরে বইমেলার পরিসর বাড়ছে। স্টল বিন্যাসেও এসেছে বৈচিত্র্য। বইমেলার ভেতরেই বিভিন্ন স্থানে প্রয়াত নামকরা বিশিষ্ট কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, শিল্পী ও গবেষকদের পরিচিতিমূলক ছবির বিন্যাস ঘটানো যেতে পারে। তা দেখে মেলায় আগত শিশুরা তাদের সম্পর্কে ধারণা পাবে, যা শিশুদের মনোজগৎকেও প্রভাবিত করবে। একুশে বইমেলা সফলতা ও পরিপূর্ণতা লাভ করবে সবার অংশগ্রহণে। এবারও পাঠক, প্রকাশক ও লেখকদের সম্মিলন ঘটবে সেখানে। পাঠকদের বই কেনার মাধ্যমে আলোর মুখ দেখবে প্রকাশনা শিল্পÑএমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : লেখক ও গবেষক
বহু পণ্যের গায়ে লেখা থাকে ‘এতে ক্ষতিকারক ডিডিটি নেই’। ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরা আশ্বস্ত হই। হয়তো আমাদের বহুজনের কাছেই ডিডিটির বিষয়টি স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে মশার স্প্রে, শুঁটকি মাছ বা কৃষিফসলে ডিডিটির ব্যবহারের কথা আমরা কমবেশি জানি। ‘ডাই ক্লোরো ডাই ফিনাইল ট্রাই ক্লোরো ইথেন’ বা ‘ডিডিটি’ হলো বিশ্বব্যাপী রাসায়নিক দূষণের জন্য দায়ী বিপজ্জনক রাসায়নিক।
কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার রাসায়নীকরণের বিরুদ্ধে একটা প্রবল জনভিত্তি বিস্তার লাভ করছে বিশ্বময়। দীর্ঘ করোনা মহামারী, যুদ্ধ ও বৈশ্বিক সংকট সবকিছু ছাপিয়ে রাসায়নিক কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ এক বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ চার দশক পর বাংলাদেশ ডিডিটিমুক্ত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের বৃহত্তম ডিডিটির মজুদটি ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। প্রায় চার দশক পর নিষিদ্ধ ঘোষিত এই মারাত্মক রাসায়নিক বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো। ২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর ডিডিটির শেষ চালানটি ধ্বংস করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে ফ্রান্সে যায়। ডিডিটি অপসারণের কাজটি কোনোভাবেই সহজ ছিল না। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত সতর্কতা, নীতিগত প্রশ্ন, অর্থায়ন এবং সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক অঙ্গীকারÑসবকিছু এক কাতারে আসতে প্রায় চারটি দশক লেগেছে। জীবন ও প্রতিবেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই ডিডিটি অপসারণ ব্যবস্থাপনার নেতৃত্ব দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির (জিইএফ) অর্থায়নে, বাংলাদেশ সরকার এবং এফএও এর সহ-অর্থায়নে ‘পেস্টিসাইড রিস্ক রিডাকশন ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় ডিডিটি অপসারণ ও নিষ্ক্রিয়করণের কাজটি সম্পন্ন হয়েছে।
গণমাধ্যম সূত্র জানায়, ডিডিটি পাউডার নিষ্ক্রিয়করণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫৫ কোটি টাকা। ৩৫৫ কোটি টাকার এই প্রকল্পে সরকারের নিজের খরচ ২১৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বাকি ৭০ কোটি ১০ লাখ গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটিজ এবং ৬৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ম্যালেরিয়া নির্মূলে ৫০০ টন ডিডিটি আমদানি করে এবং এর আগের আরও ৫০০ টনসহ এক হাজার টন ডিডিটি দীর্ঘ ৩৭ বছর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের গোডাউনে পড়েছিল। ডিডিটি অপসারণ প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয় গ্রিসের একটি প্রতিষ্ঠান। বিশেষ পোশাক ও সতর্কতা অবলম্বন করে এসব রাসায়নিক কনটেইনারে ভরা হয় এবং পরিবহন করা হয়। অপসারণের সময় সমগ্র এলাকাকে রেড জোন বা বিপজ্জনক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। অপসারণ প্রক্রিয়ার পরিচালক গণমাধ্যমকে জানান, বিশেষ জাহাজের মাধ্যমে এই রাসায়নিক সমুদ্রপথে ১২টি বন্দর হয়ে ফ্রান্সে যাবে এবং সেখানে আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি মেনে বিশেষ চুল্লিতে এসব নিষ্ক্রিয় করা হবে। বেশ কয়েক মাসের এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার সর্বত্র ঝুঁকি ও বিপদ রয়েছে। তারপরও বিশ্ব থেকে বিপজ্জনক ডিডিটির সবচেয়ে বড় মজুদটি অপসারণ করা গেছে।
বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের জন্য এটি একটি গুরুত্ববহ ঘটনা। অবিস্মরণীয় এই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজটির সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তবে ডিডিটি অপসারণের এই উদাহরণ বাংলাদেশকে আরও বেশি দায়িত্বশীল এবং দায়বদ্ধ করে তুলল। বিশেষত কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় রাসায়নিকের ব্যবহার এবং নিষিদ্ধকরণ বিষয়ে রাষ্ট্রকে এখন থেকেই আরও বেশি সতর্ক ও মনোযোগী হওয়ার বার্তা জানান দিল। ভাবলেই কেমন শিউরে ওঠে চারধার, দীর্ঘ ৩৭ বছর এক হাজার টন ডিডিটির সঙ্গে বসবাস করেছি আমরা। এমনকি এই মজুদ ছিল দেশের উপকূলের এক দুর্যোগপীড়িত ঘনবসতিপূর্ণ শিল্পাঞ্চল চট্টগ্রামে। ১৯৯১ সালের বন্যায় প্লাবিত হয় চট্টগ্রাম এবং বন্যার পানিতে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে ডিডিটি বিষ। এ ছাড়া কৃষিতে ব্যবহৃত ডিডিটির কারণে আমাদের বাস্তুতন্ত্র ও শরীরে মিশেছে এই ভয়াবহ বিষ। বাংলাদেশের মতো একটা ছোট্ট আয়তনের দেশে ৩৭ বছর ধরে এক হাজার টন ডিডিটি নিরাপদে মজুদ রাখা সবদিক থেকেই এক জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়।
ডিডিটি, অলড্রিন, ডাইএলড্রিন, ক্লোরডেন, এনড্রিন, হেপ্টাক্লোর, মিরেক্স, টক্সাফিন, পিসিবি, হেক্সাক্লোরোবেনজিন, ডাইঅক্সিন ও ফিউরান পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী এই ১২টি মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিককে একত্রে ‘ডার্টি ডজন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ডার্টি ডজন সরাসরি মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির জীবন ও জন্মপ্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব তৈরি করে, ক্যানসার, ত্রুটিপূর্ণ জন্ম থেকে শুরু করে নানান দুরারোগ্য মরণব্যাধি ও প্রতিবেশগত বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। মাছসহ জলজ প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাবের কারণে ১৯৬২ সালে এনড্রিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে ডিডিটি ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ২০০০ সালে জোহানেসবার্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১২২টি দেশ ডার্টি ডজনের ব্যবহার সীমিত করতে বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০১ সালে স্টকহোম সম্মেলনে ডিডিটিসহ ক্ষতিকারক জৈব দূষণকারী কীটনাশকের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি গৃহীত হয়। ১৭১টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও ২০০১ সালের ২৩ মে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং এটি কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ১২ মার্চ। চুক্তির ১৫ বছর পর বাংলাদেশ থেকে ডিডিটি অপসারণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৮৭৪ সালে ডিডিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তা ম্যালেরিয়া ও টাইফাস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়। ১৯৩৯ সাল থেকে কীটনাশক হিসেবে এর ব্যবহার শুরু হয়। আর তখন থেকে ডিডিটির বহুল উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত প্রতি বছর কৃষিক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০,০০০ টন ডিডিটি ব্যবহৃত হতো। কীটনাশক হিসেবে ডিডিটি আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৮ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান পল হারম্যান মুলার। মার্কিন মনস্যান্টো, সিবা, মনট্রোজ কেমিক্যাল কোম্পানি, পেন্নাওয়াল্ট, ভেলসিকল কোম্পানিগুলো মূলত বৃহৎ ডিডিটি উৎপাদনকারী কোম্পানি। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০৯ সালে ভারত ৩,৩১৪ টন ডিডিটি উৎপাদন করে এবং ২০০৭ সালে চীনে ডিডিটি উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা আনা হয়।
বাংলাদেশে ১৯৫৬ সাল থেকে কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়। তখন প্রতি বছর ৩ টন কীটনাশক এবং ৫০০ ¯েপ্র ব্যবহার করা হতো। প্রথমদিকে যখন কীটনাশকের ব্যবহার কৃষকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো তখন প্রথমত অধিকাংশ কৃষক বিশ্বাসই করতে পারল না উদ্ভিদের রোগবালাই দমনের জন্য বিষ ব্যবহার করা যায়। ক্রমান্বয়ে কৃষির ওপর চেপে বসা এই বিষ মানুষের প্রাণও সংহার করতে থাকল। কৃষিতে বিষের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু আত্মহত্যাই বাড়ল না, বরং এটি আরও নানা ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি তৈরি করে প্রতিনিয়ত মানুষকে আরও বেশি সংকটাপন্ন করে তুলতে লাগল। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে ৮৮২ টাকার কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে মাত্র ৯৮ টাকার কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত। বাংলাদেশের মাটিতে হিউমাসের সঙ্গে মিশে গেছে ১২.৫ শতাংশ ডিডিটি, যা ব্রিটেনের তুলনায় পাঁচ গুণ। এই সর্বনাশা বিষের ফলে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে জলাশয়সহ স্থানীয় অগণিত প্রাণবৈচিত্র্য আর মানুষের নানান রোগবালাই বাড়ছে। এই সর্বনাশা বিষের ব্যবহার ১ শতাংশ বাড়ার সঙ্গে কৃষকের চিকিৎসাব্যয় বেড়ে যাচ্ছে দশমিক ৭৪ শতাংশ। বাংলাদেশে বর্তমানে ৯২টি রাসায়নিক গ্রুপের প্রায় ৩৭৭টি বালাইনাশক বাজারজাতকরণের জন্য নিবন্ধনকৃত। প্রায় সব কীটনাশকের প্রয়োগের পর অপেক্ষাকাল তিন দিন থেকে ২১ দিন, কিন্তু বাস্তবতা হলো সকালে কীটনাশক স্প্রে করে বিকেলে বা বিকেলে স্প্রে করে পরদিন জমিন থেকে ফসল তুলে বাজারে বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে শসা, টমেটো, ক্ষীরা বা অন্যান্য ফল, যা আমরা সাধারণত কাঁচা খেয়ে থাকি সেসব গ্রহণের মাধ্যমে সেসব ফসলে ব্যবহৃত কীটনাশক সরাসরি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের প্রায় ২৫ ভাগ আশপাশের জলাশয়ের পানিতে মিশে যায়।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েই এক ডিডিটিমুক্ত বাংলাদেশে আমরা আজ নতুন প্রজন্মকে স্বাগত জানাতে পারছি। তবে ডিডিটি অপসারণের এই জটিল প্রক্রিয়া আমাদের আরও কী বার্তা দেয়? কেন বা কাদের কথায় আমরা এমন বিপজ্জনক রাসায়নিক আমদানি ও ব্যবহার করলাম? তথাকথিত সবুজবিপ্লব প্রকল্পের মাধ্যমে ডিডিটির মতো এমন বহু বিপদ আমাদের কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় শুধু মুনাফার জন্য তৈরি হয়েছে। কোম্পানিগুলো মুনাফার পাহাড় চাঙা করার পর যখন জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে এসব চাপিয়ে দেওয়া বাণিজ্য কারবারগুলো চরম ক্ষতি তৈরি করছে, তখন সেসব বন্ধ করতে আমাদের দীর্ঘ সময় লড়াই করতে হচ্ছে। শুধু ডিডিটি নয়, আমাদের কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা এখনো দখল করে আছে বহুজাতিক কোম্পানি ও এজেন্সির নানামুখী ব্যবস্থাপত্র। মাটি থেকে শুরু করে মায়ের দুধ সর্বত্র মিশে যাচ্ছে বিষ আর প্লাস্টিক কণা। এক ডিডিটি নিষিদ্ধ ও অপসারণে আমরা বহু বছর ও বিপুল বাজেট ব্যয় করেছি। জনগণের টাকায় বিষ কিনে সেই বিষে জনগণের সর্বনাশ করে আবার সেই বিষ তাড়াতে আবারও জনগণের টাকাই গেল। তাহলে আমরা কেন এমন বিষের ব্যবহার শুরু করলাম এই প্রশ্নটি তোলা জরুরি। বিশেষ করে নিরাপদ কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার প্রসঙ্গ যখন আমরা আলাপে তুলেছি বিশ্বময়।
এখনো সময় আছে শুধু ডিডিটি নয়; সব রাসায়নিকের বন্দিদশা থেকেই আমাদের উৎপাদনব্যবস্থাকে মুক্ত করা জরুরি। আর ডিডিটি অপসারণের মতো রাষ্ট্র যেভাবে নীতিগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার করেছে সে রকম সব বিপজ্জনক রাসায়নিক বিষের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সমমনোযোগী হতে হবে। আমরা আশা করব রাষ্ট্র বিপজ্জনক রাসায়নিকমুক্ত কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে তৎপর ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার জোরালো করবে। শুধু ডিডিটিমুক্ত নয়, ক্ষতিকর রাসায়নিকমুক্ত এক নিরাপদ কৃষিভুবনে আমরা সবাইকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষা করছি।
লেখক: লেখক ও গবেষক
পৃথিবীর ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লবের সময়খণ্ডটিকে সহিংসতার দাইমা হিসেবে দেখেন বিশে^র রাজনীতির ইতিহাস লেখক কেউ কেউ। তারা দেখান ফরাসি বিপ্লব জগৎবাসীকে সন্ত্রাস এবং নাগরিক সেনাবাহিনী দিয়েছে। তারা দেখান নেপোলিয়নের যুদ্ধক্ষেত্রের দর্শনীয় সাফল্যের পেছনে আসল কারণ, তার সেনাবাহিনী ভাড়াটে ছিল না, দেশপ্রেমিকদের দ্বারা গঠিত ছিল। তারা জাতীয় স্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ড চালাতেন। ফলে মানুষের সামনে হাজির হলো জাতীয়তাবাদী চেতনার একপ্রকার নাগরিক ধর্মমত।
দার্শনিক হেগেল তার ভাবনা লিখেছিলেন ফরাসি বিপ্লব প্রসঙ্গে বিপ্লব সাধনের লড়াইকে মানুষ তাদের নিজের জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করেছিল। তাই তারা প্রাণ দিতে রাজি ছিল। মনে হয় হেগেল এভাবে বললে ভালো হতো যে মানুষ স্বেচ্ছায় এ রকম কারণে হত্যাও করতে চায়। হ্যাঁ, বিগত বিংশ শতকে মানুষ যেভাবে গণহত্যা করেছে নানা অজুহাতে, হয়তো বনের কোনো হিংস্র প্রাণীও এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়নি। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ঔপনিবেশিক যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, বিপ্লব এবং প্রতিবিপ্লব মোটা দাগে গোটা শতাব্দীজুড়ে ছিল।
বৈশ্বিক রাজনীতির পটভূমিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধির ব্যর্থতা দেখার আগে আমরা আধুনিক রাজনৈতিক সহিংসতার একটি অধ্যায় দেখে নিতে পারি, যেখানে ইউরোপে জাতিগত নির্মূলকরণের ইতিহাস বিধৃত। দেখে নিতে পারি কেন ‘একীভূত স্পেনীয় রাষ্ট্র তার ইহুদিদের কড়া শর্ত দিল খ্রিস্টান হও অথবা নির্বাসনে যাও’? সাফ কথা সেদেশে থাকতে হলে খ্রিস্টান হতে হবে, না হও যদি এ দেশ থেকে পালাও। ‘গুড মুসলিম ব্যাড মুসলিম’ বইটির লেখক মাহমুদ মামদানি বিশ্ববাসীকে জানালেন ‘১৪৯২ সাল। এ বছরে ইউরোপীয় রেনেসাঁর শুরু ও তাদের রাজনীতির আধুনিক রূপের জন্মের সময়খণ্ড সেটা। এ বছরেই ক্রিস্টোফার কলম্বাস নতুন দুনিয়া খুঁজতে পাল তুলেছিলেন। এ বছরেই রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলার সৈন্যরা রাজধানী গ্রানাডা জয় করেছিল, যে-গ্রানাডা ছিল পশ্চিমের খ্রিস্টান বলয়ে মুসলিমদের সুরক্ষিত আশ্রয়স্থল। ফলে ১৪৯২ হয়ে উঠল দুটি সম্পর্কযুক্ত প্রচেষ্টার প্রবেশদ্বার। একটি হলো, একটি জাতির ঐক্য, অন্যটি বিশ্বজয় বা সাম্রাজ্য বিস্তার।’
মামদানি আরও জানালেন ‘জাতি একীকরণের ফলে জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়ে গেল। এ যুগে, রাজনৈতিক আধুনিকতা গণতন্ত্রের সূচনার সঙ্গে সমান করে দেখা হয়। কিন্তু উনিশ শতকের রাজনৈতিক তাত্ত্বিকরা বিশেষত ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, রাজনৈতিক আধুনিকতা নিরূপিত হয়, রাষ্ট্রের সহিংসতা একক কর্র্তৃত্বের দ্বারা একচেটিয়া হয়ে গেলে। জাতিরাষ্ট্রে আগের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সহিংসতা একত্র করে, অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সব শত্রুকে এক দুর্দান্ত ধাক্কা দিতে সক্ষম। এটা ছিল তাদের একটি সুশীল সমাজ তৈরির রাজনৈতিক পূর্বশর্তও।’
‘সংস্কৃতি ও বর্ণের দিক দিয়ে জাতির রাজনৈতিক আধুনিকতার চিন্তার দুয়ারে তখন ইউরোপ। ফার্দিনান্দ এবং ইসাবেলার স্পেনে, যে-জাতির পরিচয় সর্বাগ্রে খ্রিস্টান। স্পেনের একীকরণ শুরু হয়েছিল জাতিগত নির্মূলকরণের মাধ্যমে। ১৪৯২ সালেই রাজা ফার্দিনান্দ এবং রানী ইসাবেলা স্পেন থেকে ইহুদিদের সরানোর আইনে (এডিক্ট অব অ্যাক্সপালশন) স্বাক্ষর করেছিলেন। একীভূত স্পেনীয় রাষ্ট্র তার ইহুদিদের কড়া শর্ত দিলে প্রায় ৭০ হাজার স্পেনীয় ইহুদি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে স্পেনে থেকে গিয়েছিল। তাদের এই থাকা নিরাপদ ছিল না। তদন্তের দ্বারা জর্জরিত হয়েছিল। অভিযোগ এনেছিল ওরা খ্রিস্টান জাতিরাষ্ট্রের প্রতি আন্তরিক না। আনুমানিক ৫০ হাজার উত্তর আফ্রিকা ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বলকান প্রদেশগুলোতে চলে গিয়েছিল। সেখানে তাদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো হয়েছিল। বাকি প্রায় ৮০ হাজার সীমান্ত পেরিয়ে পর্তুগালে প্রবেশ করেছিল। স্পেন থেকে এ তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে। তখন একের পর এক ইউরোপের একেক অংশ থেকে ইহুদিদের বের করে দেওয়া হয়েছিল। ১৪৯৯ সালে, মানে ইহুদি বের করার আদেশের সাত বছর পরে, স্পেন সেদেশের মুসলমানদের একই ধরনের শর্ত দিয়েছে: খ্রিস্টান হও অথবা চলে যাও। সুতরাং আধুনিক রাষ্ট্রের ইতিহাসও বর্ণের ইতিহাস হিসেবে পড়া যেতে পারে।’ কিন্তু পরে বহু কারণে কিংবা ‘ধাক্কা মারলে ধাক্কা খেতে হয়’ এমন বাস্তবতার কারণেই হয়তো-বা রাষ্ট্রীয়ভাবে তাড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা থেকে বের হতে হয় ইউরোপকে। যদিও বর্ণবিভেদ আমজনতার মধ্যে সেখানে শেষ হয়ে যায়নি।
এখন আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার জায়গাগুলো দেখি। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান তার সেই বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা ‘সং অব মাইসেলফ’ এর এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘ডু আই কন্ট্রাডিক্ট মাইসেলফ? ইয়েস আই ডু’ (আমার মধ্যে কি স্ববিরোধ আছে? হ্যাঁ আছে)। সহজ কথায় এর অর্থ আমার যা করা উচিত না, আমি তা করি। প্রশ্ন হলো কেন করি বা কেন মানুষ করে? আত্মরক্ষার্থে? তাই যদি হয়, আত্মরক্ষার্থে যা করা উচিত না, তা করলে শেষ রক্ষা হয় কি? এ প্রশ্ন থেকে যায়।
মাহমুদ মামদানি ১৯৭৫ সালে, তানজানিয়ার দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ প্রভাষক। বছরটি বেশ গুরুত্ববহ ঔপনিবেশিকতামোচনের কাল হিসেবে। এ বছর আমেরিকা ইন্দোচীনে পরাজিত হয়। এ বছরেই আফ্রিকা মহাদেশের মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, গিনি থেকে পর্তুগিজরা বিদায় হয়েছে। এই বছরেই ঠাণ্ডা লড়াইয়ের প্রধান কেন্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে স্থানান্তর হয়। তখন কৌশলগত প্রশ্নটি ছিল, পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের টুকরোগুলো কে নেবে সোভিয়েত না যুক্তরাষ্ট্র? প্রধান কেন্দ্র স্থানান্তর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল পরিবর্তন হয়। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস ইন্দোচীন যুদ্ধের শিক্ষা বিবেচনায় নিয়ে শীতল যুদ্ধ স্থানান্তর করতে বলে। সেই শিক্ষা নিক্সন মতবাদ হিসেবে আইনসভায় গৃহীত এবং তা ক্লার্ক সংশোধনী আকারে পাস হয়। নিক্সনের মতবাদে ছিল ‘এশিয়ার যুদ্ধ এশিয়ার ছেলেদের করা উচিত’। এ শিক্ষা আমেরিকা পেয়েছে ইন্দোচীনে এক যুগের বেশি জড়িয়ে থেকে কোনো লাভ না হওয়াতে। বিশেষত তুলনামূলক লাওসে প্রক্সি যুদ্ধ সফল হলেও ভিয়েতনামে ব্যর্থতার চাপে সেই সফলতাও ব্যর্থ হয়েছে। ভিয়েতনামে সরাসরি যুদ্ধে নামে আমেরিকা হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে ভিয়েতনামি কমিউনিস্ট গেরিলাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু লাওসে এসে আমেরিকা দেখে তার হাত বাঁধা ১৯৬২ সালের চুক্তি অনুযায়ী মস্কোর সঙ্গে। সেই চুক্তি মোতাবেক আমেরিকান সৈন্য লাওসে প্রবেশ করতে পারে না। উপায় নেই দেখে আমেরিকা তাৎক্ষণিকভাবে যা মাথায় আসে তা করে লাওস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
উল্লেখ্য, ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, যখন জনসন প্রশাসন দাবি করল দুই আমেরিকান ডেস্ট্রয়ার আঘাত করেছে উত্তর ভিয়েতনামিদের টর্পেডো টনকিন উপসাগরে। আমেরিকান সংবাদ মাধ্যমে একটি চিত্র প্রকাশ পেল, যেখানে দেখানো হয় যুক্তরাষ্ট্রকে অপমান করা হয়েছে। তাই এর একটা জবাব দেওয়া উচিত দাবি করা হয় প্রভাবশালী মিডিয়াতে। মাহমুদ মামদানি জানালেন, ‘প্রেসিডেন্ট জনসন উত্তর ভিয়েতনামিদের ওপর বোমা মারা শুরু করেন। জোরেশোরে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কংগ্রেসের দুই হাউজ থেকে সেনা পাঠানোর অনুমোদন দিতে বললেন। দ্রুতগতিতে কাজ হলো, প্রেসিডেন্ট দুই হাউজ (হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ ও সিনেট) থেকেই আক্রমণের অনুমোদন পেয়ে গেছেন। অতঃপর যে খবর পাওয়া গেল, যে ডেস্ট্রয়ারের নাবিকরা জানিয়েছিলেন তারা টর্পেডো দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, তারাই পরে জানালেন আক্রান্ত হওয়ার খবরটি বানোয়াট ছিল। কিন্তু আমেরিকা অন্য হিসাব মাথায় নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। কারণ আমেরিকার প্রধান প্রতিপক্ষ রাশিয়া। ডেস্ট্রয়ার আক্রান্তের খবর পেয়ে তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যেন পেয়ে গেলেন ব্ল্যাংক চেকÑ বিস্তর শক্তি প্রয়োগের সুযোগ। কিন্তু সফল হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। ‘অপারেশন রোলিং থান্ডার’ করল যুক্তরাষ্ট্র উত্তর ভিয়েতনামে। নিরবচ্ছিন্ন বোমা ফেলতে থাকল। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো, শিল্প কারখানাগুলো ধ্বংস করতে থাকল এ আশায় যে উত্তর ভিয়েতনামিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।
কিন্তু ব্যর্থ হলো আমেরিকা আশানুরূপ ফল এলো না। প্রেসিডেন্ট জনসন দক্ষিণ ভিয়েতনামে কমব্যাট সৈন্য নামালেন। নতুন নতুন অপারেশন করল। ‘সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়’, ‘বডি কাউন্ট’ ইত্যাদি। কিন্তু ব্যর্থ হলো আমেরিকা। ছোট ছোট ব্যর্থতাগুলো বিশাল ব্যর্থতায় উন্নীত হলো। সেখানে তাদের ‘আমেরিকানাইজেশন’ হয়ে গেল ঐতিহাসিক ‘ভিয়েতনামাইজেশন’। প্রসঙ্গত, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর পুত্রজায়াতে ওআইসি-র সম্মেলনে বলেছিলেন- Jews rule the world by proxy. They get others to fight and die for them. কথাটা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আসার পর পক্ষে-বিপক্ষে বেশ হইচই হয়েছিল। সিএনএন-র রিপোর্টে বলা হয়, আমেরিকা ও ইসরায়েল মাহাথিরের কথাকে ‘পোলারাইজিং রেটোরি’ বা ‘নতুন অর্থের চটকদার বুলি’ বিবেচনা করেছিল। মাহাথির ঠিক ধরতে পেরেছিলেন ইহুদি পরিচয়ের জায়নবাদীরা অপরের মাধ্যমে দুনিয়া শাসন করছে। আমেরিকার একজন বিখ্যাত ইহুদি সাংবাদিক, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি উদঘাটনের অন্যতম অনুসন্ধানী কার্ল বার্নস্টাইন ২০১৩ সালের ৪ মে এমএসএনবিসি টিভি’র ‘মর্নিং জো’ টক শো-তে সাফ বলেছিলেন, ইসরায়েলি নিও-কনজার্ভেটিভেরা আমেরিকাকে ইরাক যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছিল তাদের স্বার্থে। ইনি সেই বার্নস্টাইন, যিনি আর বব উডওয়ার্ড মিলে প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রশাসনের ‘ডার্টি ট্রিক্স’ বের করে দিয়েছিলেন, যা ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’ নামে খ্যাত। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এভাবে ভেতরে এবং বাইরে বিস্তর ব্যর্থতা আছে আমেরিকার।
লেখক: কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক
আজকের বাংলাদেশে নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হলেও সারা দেশের বিপুলসংখ্যক নারী এখনো সমাজজীবনের অন্ধকারে রয়ে গেছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাশাপাশি এখন উচ্চশিক্ষায় নারীর সাফল্যও খুবই আশাব্যঞ্জক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফুটবল ও ক্রিকেটের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আসরগুলোতে বাংলাদেশের মেয়েদের শিরোপা জয় যেন সামাজিক পরিসরে নারীর আগুয়ান হওয়ার পদধ্বনি। রাজনীতির মাঠেও নারীর নেতৃত্ব ও সরব পদচারণা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের সঙ্গে উগ্র ধর্মীয় চিন্তাচেতনা মিলে নারীর এই অগ্রযাত্রাকে যেন পেছন থেকে টেনে ধরা হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতি এবং শাসনব্যবস্থার শিথিলতা যে অনেকাংশ দায়ী, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এসব কারণেই দেশে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর মুক্তি ও ক্ষমতায়ন এখনো সুদূরপরাহত। তবে সাম্প্রতিক কালে আইনি কাঠামোর সংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় কর্মপদ্ধতিতে নানা সংস্কারের মধ্য দিয়ে এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে এবং নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হচ্ছে।
আমাদের সমাজে প্রথাগতভাবেই অভিভাবকত্বের প্রশ্নে মায়ের চেয়ে বাবার ভূমিকাই মুখ্য। কিন্তু অভিভাবকত্বের প্রশ্নে মা ও বাবা দুজনের সমান ভূমিকা থাকা যে জরুরি সেটা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন আইনজীবী-মানবাধিকারকর্মী-নারী আন্দোলনকর্মীরা। জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রেও একমাত্র পিতৃপরিচয়ের প্রথাগত ধারণা ও চর্চার কারণে নানা ধরনের বাস্তবিক সংকট মোকাবিলা করতে হয় বহু ব্যক্তিকে। বহু আলোচনা-সমালোচনা ও সামাজিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জন্মনিবন্ধন, নাগরিকত্বের সনদ, পাসপোর্ট এবং বিয়ে-তালাক নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বাবার পাশাপাশি মাকে যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করার মধ্য দিয়ে এক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে সত্যি। কিন্তু এতে সংকট শেষ হয়ে যায়নি। যে কারণে জন্মনিবন্ধন ও শিক্ষাক্ষেত্রের মতো মৌলিক নথিপত্র পূরণে সমস্যায় পড়ছিল দেশের শিশুরা, বিশেষত পিতৃপরিচয় জানা নেই কিংবা জানানোর ক্ষেত্রে সংকট রয়েছে এমন শিশুরা। আশাব্যঞ্জক খবর হলো হাইকোর্টের এক রায়ের মধ্য দিয়ে এখন থেকে কেবল মায়ের নাম লিখেও শিক্ষাক্ষেত্রের সব ধরনের ফরম পূরণ করতে পারবে শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের দ্বৈত বেঞ্চের এক রায়ে এমন নির্দেশনা আসে। এতে শিক্ষার্থীদের সব ধরনের এসআইএফ (স্টুডেন্ট ইনফরমেশন ফরম) পূরণে বাবার নাম লেখার বাধ্যবাধকতাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে হাইকোর্ট বলেছে, ফরম পূরণের ক্ষেত্রে অভিভাবক কলামে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের যেকোনো একজনের নাম লেখা যাবে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষা বোর্ডকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
নারী অধিকারকর্মী ও সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা এ রায়কে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী উল্লেখ করে বলছেন, সংগত নানা কারণেই অনেক শিক্ষার্থীর পিতৃপরিচয় থাকে না। আবার সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে পিতার অভিভাবকত্ব প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার্থীদের ফরমে বাবার নাম লেখার বাধ্যবাধকতা থাকা প্রতিবন্ধকতা। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের বিপাকে পড়তে হয়। হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে শিক্ষার্থীর ফরমে মায়ের অভিভাবকত্ব যেমন প্রতিষ্ঠিত হলো তেমনি বাবা-মা কেউ না থাকলেও শিক্ষার্থীর আইনগত অভিভাবকের নামও লিখতে পারবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গত বছরের জুলাই মাসে হাইকোর্ট আরেক রায়ে পিতা-মাতার জন্মনিবন্ধন নেই এমন শিশুদেরও জন্মনিবন্ধনের সুযোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এই রায় বাস্তবায়নও এক যুগান্তকারী ঘটনা। একইভাবে, কিছুকাল আগে মুসলিম বিয়ে নিবন্ধন ফরম বা নিকাহনামায় নারী ও পুরুষের অধিকার ও মর্যাদায় যেসব বৈষম্য ছিল তার একটি দূর করা হয়েছে উচ্চআদালতের নির্দেশে। নিকাহনামায় কনের ক্ষেত্রে ‘কুমারী’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘অবিবাহিতা’ যুক্ত করতে এবং বরের ক্ষেত্রেও ‘বিবাহিত/বিপত্নিক/তালাকপ্রাপ্ত’ কি না তা সংযোজন করার নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত। নারী-পুরুষ বৈষম্য বিলোপে এমন পদক্ষেপগুলো সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু মনে রাখা দরকার দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন আইনে এখনো নারী-পুরুষের মধ্যে অনেক বৈষম্য রয়ে গেছে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ে নারী-পুরুষের মধ্যকার এই বৈষম্যের ধরনও ভিন্ন। এক্ষেত্রে মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য জাতি-সম্প্রদায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয়-পারিবারিক আইন অনুসরণ করা হয়ে থাকে। মানবাধিকারকর্মী এবং নারী আন্দোলন কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারাই সমাজে নারীর প্রতি নানাবিধ বৈষম্যের অন্যতম বড় কারণ। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীকে বঞ্চিত না করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন এবং বিষয়টি সুরাহার পথ খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা আশা করব এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুগম হবে।
সাধক, চিকিৎসক ও সৎসঙ্গ আশ্রমের প্রবর্তক অনুকূলচন্দ্র ঠাকুর। তিনি ১৮৮৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পাবনার হেমায়েতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শিবচন্দ্র চক্রবর্তী, মা মোহিনী দেবী। কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল থেকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের ডিগ্রি নেন। নিজ গ্রামে ফিরে চিকিৎসাসেবা শুরু করেন। তার বিশ্বাস ছিল, মানুষ শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকÑএই তিন ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তাই তিনি মানসিক ব্যাধির চিকিৎসার প্রতিই বেশি জোর দিতেন। মায়ের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে অনুকূলচন্দ্র মানুষের আত্মিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কীর্তন দল গঠন করেন। মানুষের আত্মিক উন্নতির লক্ষ্যে তিনি পাবনায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘সৎসঙ্গ আশ্রম’। অনুকূলচন্দ্র জনকল্যাণে তপোবন বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, পাবলিশিং হাউজ, ছাপাখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিহারের দেওঘরে যান এবং সৎসঙ্গের আদর্শে নতুন আশ্রম গড়ে তোলেন। ‘শাশ্বতী’ নামে আশ্রমের একটি মুখপত্র প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর তিনি আর ফিরে আসেননি। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় তিনি ৪৬টি বই লিখেছেন। এর মধ্যে ‘পুণ্যপুঁথি’, ‘অনুশ্রুতি’ (ছয় খণ্ড), ‘চলার সাথী’, ‘শাশ্বতী’ (তিন খণ্ড), ‘প্রীতিবিনায়ক’ (দুই খণ্ড) উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৯ সালের ২৬ জানুয়ারি বিহারে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ভারত ও বাংলাদেশ দুদেশেই তার ভক্তকুল ছড়িয়ে আছে।
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
‘বস্তি এলাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। পানি সরবরাহ ও নর্দমা লাইন প্রায়ই এক হয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে দূষিত ও নোংরা পানি পান করছেন তারা।’ এভাবে বলছিলেন ঢাকার বস্তির জীবন মান নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের উন্নয়ন কর্মী বাছেরা আক্তার।
শুধু বস্তি এলাকা নয়, দেশের সব এলাকার সুপেয় পানি সরবরাহের চিত্র এমনই। রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করা পানিই না ফুটিয়ে পান করা যায় না। চট্টগ্রাম শহরের পানি লবণাক্ত। রাজশাহীর পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। খুলনায় সরবরাহ করা পানিও না ফুটিয়ে পান করা যায় না। রয়েছে লবণাক্ততাও। গভীর নলকূপের পানিও নিরাপদ নয়, আর্সেনিক ও লবণাক্ততার কারণে ব্যবহার করাও দুষ্কর। পাহাড়ে সুপেয় পানির উৎস সীমিত। পাহাড়ি ছড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে নদন্ডনদীর পানিও কমছে। সুপেয় পানি ও সেচের জন্য অত্যধিক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে দিন দিন।
এ পরিস্থিতিতে আজ ২২ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য : ‘আসুন নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করি।’
সরকারের পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় মিষ্টি পানিসমৃদ্ধ বাংলাদেশেও সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার মানুষ সুপেয় পানির বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও নিরাপদ পানি মিলছে না। এ ব্যর্থতা ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও হুমকিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. তানভীর আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানিকে সুপেয় পানি বলা যায়। তবে সেখানে কোনো ময়লা ঢুকে পড়লে সেই পানিকে আর সুপেয় থাকে না। সুপেয় পানি না ফুটিয়েই পান করা যাবে।’
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ওয়াসার পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাইরে ময়লা ঢুকে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এমন ঘটনা ঘটলে সেই পানিকে নিরাপদ বলা যাবে না। শুধু ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পানির মান ভালো হলে চলবে না, বাসা পর্যন্ত ভালো পানি পৌঁছে দিতে হবে। কেননা সরবরাহ লাইনের পানি নিরাপদ রাখাও সংস্থার দায়িত্ব।’
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এ জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। আশা করি সবাই মিলে কাজ করে পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করে আমরা নির্ধারণ সময়ে লক্ষ্যপূরণ করতে পারব।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার। এর মধ্যে ৫৯ ভাগ অর্থাৎ ৯ কোটি ৭৪ লাখ ৪৩ হাজার ২২০ জন মানুষ সুপেয় পানি সুবিধার আওতায় এসেছে। আর সুপেয় পানি সুবিধার বাইরে রয়েছে ৪১ ভাগ অর্থাৎ ৬ কোটি ৭৭ লাখ ১৪ হাজার ৭৮০ জন মানুষ। এখনো দেশের ১০ ভাগ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।
বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে বলা হয়েছে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুপেয় পানি প্রাপ্যতার বিবেচনায় ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চর এলাকা, বন্যাপ্রবণ এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওর এলাকা, বরেন্দ্র অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকা। দেশের এই ছয় শ্রেণির এলাকা বিস্তৃত রয়েছে ১০০টি উপজেলায়। দেশের ১৫৯ সিটি ও পৌরসভায় সরবরাহ করা পানির মানও একই। ওইসব এলাকায় ১৬৮টি পানি শোধনাগার, ১ হাজার ৫০০টি গভীর নলকূপে ১৫ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সরকার চালু রেখেছে। গ্রাম পর্যায়ের ২০ লাখ টিউবওয়েলের পানি নিরাপদ হওয়ার কথা ছিল। তবে আর্সেনিক ও মাত্রাতিরিক্ত আয়রন সে পানিও জনজীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
২০১৬ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বিশে^র সবচেয়ে বড় ‘গণবিষ’-এর উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের আর্সেনিক পরিস্থিতিকে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বছরে আর্সেনিকে ৪৩ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়। আর ২০০৩ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়। আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্তে ২০১২ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। তখন ৬৫ হাজার ৯১০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে ৪২টি জেলার হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তথ্য সংগ্রহ করে। ওই হিসাব অনুযায়ী, ওই বছর এসব হাসপাতালে ১৮ হাজার ৬৬২ আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী সেবা গ্রহণ করে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের সরকারিভাবে স্থাপিত গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। সেই হিসাবে জনসংখ্যার বিবেচনায় সরকার ৮৩ জনে একটি পানির উৎস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সমগ্র জনসংখ্যার বিবেচনায় বর্তমান পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে ১১ ভাগ। আর শহর এলাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় ৩৮ ভাগ।
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারকে সুপেয় পানি সরবরাহে শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে হবে। সেটা করতে হলে প্রতি বছর ছয় ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। বর্তমান অগ্রগতি প্রায় এক ভাগ। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে সামনের দিনগুলোতে পানি সরবরাহ খাতের অর্জন আরও কম হতে পারে। এ জন্য লক্ষ্য পূরণে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে চারগুণ তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, দেশে বেসরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় দেড় কোটি। আর সরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। এ দুটো ধরে হিসাব করতে দাঁড়ায় প্রতি ১০ জনে একটি পানির উৎস রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকায় পানযোগ্য পানি খুবই দুষ্পাপ্য। এসব এলাকার বেশিরভাগ উপজেলায় গভীর নলকূপ কার্যকর নয়। সরকার পানি সরবরাহ সেবার আওতায় আনতে পেরেছে ৯৮ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষকে। এখনো ১ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষ পানি সুবিধার আওতার বাইরে রয়েছে।
নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর : ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ায় স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। যে হারে পানির স্তর নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। স্বাভাবিক অবস্থা ৬ থেকে ৭ ফুট নিচেই ভূগর্ভস্থ উৎসে পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই। ঢাকায় পানি পেতে ২৫৫ থেকে ২৬০ মিটার নিচে নামতে হচ্ছে। খুলনায় ভূগর্ভস্থ পানি নেমে গেছে ২৫-৩০ ফুট। রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ১২০ থেকে ১৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। খরার মৌসুমে এ অবস্থা থাকে। বর্ষার মৌসুমে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়।
অন্যদিকে দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২-৩ মিটার নেমে যায়। আর ২৫ ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৫-১০ মিটার নেমে যায়। বর্ষার মৌসুমে এসব এলাকার বেশিরভাগ অংশে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। তবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না। দেশের গৃহস্থালি ও খাবার পানির ৯৪ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। গ্রাম এলাকায় এ উৎস থেকে ৯৯ শতাংশ ও শহর এলাকায় ৮০ শতাংশ পানি সরবরাহ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১৮ শতাংশ নলকূপের পানি উত্তোলনে সমস্যা হয়। এ ছাড়া ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, গড়াই নদীর পানি কমে যাওয়ায় এসব এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পুনঃভরণ হয় না।
ভূ-উপরিস্থ সুপেয় পানির উৎসের অভাবে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর অঞ্চলে সারা বছর সুপেয় পানির সংকট থাকে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যরকম সংকট। খরার মৌসুমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনার নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্ষার মৌসুমে দেশের অন্যান্য এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির শূন্য স্তরের ২৫ শতাংশ পূরণ হয়ে যায়। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয়। ওইসব এলাকায় ১৬০ ফুটের আগে পানির দেখা মিলছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানি বিভাগের পরিচালক এবং পানি বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ার জাহিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারকে বর্ষায় কৃত্রিমভাবে মাটির নিচে পানি প্রবেশ করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমন উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে দেশ বড় ধরনের পানি সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
উপকূলে লবণাক্ততা সমস্যা : ভূতত্ত্ববিদদের মতে, উপকূলীয় এলাকার পানিতে একবার লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে ওখানকার ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নদীতে পানি না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই অববাহিকা অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাবে। একই সঙ্গে সাগরের দিক থেকে লবণ পানি প্রবেশের হার বাড়বে।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরের উপকূলীয় এলকাগুলোতে আমরা গভীর নলকূপ বসাতে পারি না। এই এলাকায় নলকূপে লবণাক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে।’
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা কমাতে উজান থেকে পানির প্রবাহ বাড়ানোর কথা বলছে ভূতত্ত্ববিদরা। কিন্তু ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ৫৬টি যৌথ নদী থেকে ইতিমধ্যে পানি প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে এবং শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়েও যাচ্ছে। নদীগুলোর গভীরতা কমে গিয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সারা নওরিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই পানির স্তর নিচে। এখন এই হার আরও বেড়েছে।’
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
২০১০ সালে ভোলার চর কুকরিমুকরি বনের ১৫ হাজার গাছের প্রাণভিক্ষা চেয়ে লিখেছিলাম। ‘১৫ হাজার গাছের প্রাণভিক্ষা চাই’ শিরোনামে দৈনিকে প্রকাশিত লেখাটি নিয়ে আলাপ ওঠেছিল তখন। চর কুকরিমুকরি বনের উত্তরাংশ বাবুগঞ্জ থেকে পাতিলার বুড়াগৌরাঙ্গ নদ পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২০ ফুট প্রশস্ত পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য কুকরিমুকরি ইউনিয়ন পরিষদ বন বিভাগে আবেদন করে। ১৬ মে ২০১০ তারিখে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ন্যূনতম গাছ কাটার শর্তে সড়ক নির্মাণের অনুমতি দেয়। সড়কপথে দ্বীপচরে যাতায়াতের জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় বাঁচাতে প্রাণদন্ড দেয়া হয়েছিল ১৫ হাজার গাছের। কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, পশুরের মতো অবিস্মরণীয় সব ম্যানগ্রোভ বৃক্ষপ্রজাতি।
চর কুকরিমুকরির পর এবার ভোলার ঢালচরের উপকূল বন বিপদে পড়েছে। উপকূল বন নিশ্চিহ্ন করে ঘরবাড়ি, বাণিজ্যিক মাছের ঘের, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ ছাড়া বনের গাছ কেটে ইটভাটায় বিক্রি হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, ঢালচরের প্রায় একশ একর বনভূমি উজাড় হয়েছে এভাবেই। মূলত বসতি স্থাপন, বেদখল, মাছের ঘের ও মাছ-ঘাট, এবং ইটভাটার কারণে। ঢালচর ইউনিয়নের চর সত্যেন মৌজার মাঝের চরে প্রায় ৭১ একর অরণ্যভূমি উজাড় করা হয়েছে। পুরো অঞ্চলে নিথর হয়ে পড়ে আছে বহু নিহত গাছের গুঁড়ি। চারধারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই রক্তাক্ত লাশ খ-গুলোই জানান দিচ্ছে কী নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক উপকূল বন। গণমাধ্যম জানায়, দ্রুত গাছ কাটার জন্য এখানে ভেকু মেশিন (যন্ত্রচালিত এক্সকাভেটর) ব্যবহার করা হয়। বন নিধনে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ জড়িত থাকলেও গণমাধ্যমের কাছে এ অভিযোগ অস্বীকার করে।
বন কেটে দখল নিয়ে যারা বসত গড়েছেন তাদের সবার ভাষ্য হলো, নদীভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে এই বিরান হওয়া বনভূমিতে তারা আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রাকৃতিকভাবে তো এই বন বিরান হয়নি, নিষ্ঠুরভাবে একে বিরান করা হয়েছে। ঢালচরসহ ভোলা ও উপকূল অঞ্চলে মূলত প্রাকৃতিকভাবেই বিশেষ ম্যানগ্রোভ বন গড়ে ওঠে। ঢালচর সংরক্ষিত বনের আওতায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর এলাকা আছে। স্থানীয় বন বিভাগের ভাষ্য, ১৯৭৬ সালে ঢালচরের মাঝেরচরে বৃক্ষরোপণ করা হয় এবং নদীভাঙনকবলিত মানুষের আশ্রয়ের নামে ইতিমধ্যে ৭৬ একর বন উজাড় হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে বন উজাড়ের ঘটনায় বন বিভাগ ৩৫টি মামলা করেও বন বিনাশ রোধ করতে পারেনি। জোয়ার-ভাটা ও ভূমি ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে চরফ্যাশনের বাস্তুতন্ত্র প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছে।
ঢালচর, পূর্বেরচর, ভাসানচর, বয়ারচর, চর আলিম, আন্ডারচর, কলাগাছিয়াচর ও শিবচরের মতো ভূখ-গুলো প্রায় ৮ হাজার একর ভূমি নিয়ে নতুনভাবে জেগেছে। এসব ভূমিতেও জোয়ার-ভাটায় ভেসে আসা বীজ দিনে দিনে নতুন বন-প্রতিবেশ গড়ে তুলবে। ঢালচরসহ পুরো উপকূল অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ-প্রহরী এই উপকূল বনগুলো। নিয়ত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, তীব্র তাপপ্রবাহ সব আপদ নিজের জীবন দিয়ে সামলিয়ে উপকূলকে নিরাপদ রাখে বনের বৃক্ষকুল। আর উপকূল-প্রহরী এই গাছগুলোকে খুন করে আমরা উপকূলকে বারবার বিপদের দিকে ঠেলছি। বৃক্ষপ্রাচীর ও বন ছাড়া আপদন্ডবিপদ সামাল দেয়া সম্ভব নয়।
সত্তরের ঘূর্ণিঝড়, বিধ্বস্ত মনপুরা কিংবা সিডরের অভিজ্ঞতা কী বলে? সুন্দরবনসহ উপকূল বনভূমি ও বৃক্ষকুল প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি ও মাত্রা নিজের জীবন দিয়ে দুর্বল করেছে। উপকূলে বন না থাকলে সব আপদন্ডবিপদে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি অসহনীয় হয়ে উঠত। কিন্তু আমরা আমাদের উপকূলের বৃক্ষকুল ও বনের কাছে একবিন্দু কৃতজ্ঞতাও জারি রাখিনি। বরং প্রতিদিন উপকূল বনকে ল-ভ- রক্তাক্ত করছি। ঢালচরের উপকূল বন সামগ্রিকভাবে সুরক্ষা করতে হবে। বৃক্ষ ও বন নিধনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইন ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। ঢালচরসহ উপকূল বনের সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং করণীয় বিষয়ে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার ও তৎপরতা স্পষ্ট করতে হবে।
আয়তনে ছোট্ট হলেও প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে বাংলাদেশ অনন্য। সমতল, অববাহিকা, বরেন্দ্র, গড়, টিলা, পাহাড়, চর এলাকার পাশাপাশি দেশের নোয়াখালী, ভোলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সুন্দরবন অঞ্চলের উপকূল-চর ও দ্বীপগুলো দেশকে দিয়েছে বিশেষ আমেজ ও গতিময়তা। নোয়াখালীর নিঝুপ দ্বীপ, সুখচর, হাতিয়া, তমরুদ্দিন, নলচিরা, চান্দনন্দি, হারনি, চর কিং, বয়রারচর, চরপিয়া; ভোলার মনপুরা, চর মনিকা, চর সাকুচিয়া, চরনিজাম, ঢালচর, চর কুকরিমুকরি, গাজীপুর, ভেদরিয়া, সোনাচর, হাজিরহাট, চর নিউটন, চর পাতিলা, চর লক্ষ্মী, চর আইচা, নীলকমল, মদনপুর, মেদুয়া; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ; কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন বা নারিকেল জিঞ্জিরা, সোনাদিয়া, শাহপরীর দ্বীপ এবং সুন্দরবন অঞ্চলের আন্ডারচর, ডিমেরচর, দিয়ারচর, কালীরচর বা দুবলারচর দেশের গুরুত্বপূর্ণ উপকূল চর ও দ্বীপাঞ্চল। নদীপ্রবাহের বিস্তীর্ণ পলিমাটিতে গড়ে ওঠা এসব চর-দ্বীপ। মহেশখালী শৈল দ্বীপ আর সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপ। প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক নানা বিন্যাস গড়ে উঠেছে এসব অঞ্চলে। এসব দ্বীপে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে নয়া ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থান। মাছ, পাখি, সরীসৃপ, কাছিমসহ জলজ ও স্থলজ প্রাণবৈচিত্র্যের এক অবিস্মরণীয় আখ্যান তৈরি হয়েছে দেশের দ্বীপগুলোতে।
জলোচ্ছ্বাস ও ঝড় থেকে দেশের ভূগোল বুক আগলে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে এসব দ্বীপাঞ্চল। শত-সহস্র মাছের জোগান দিয়ে তরতাজা রাখছে রাষ্ট্রের অর্থনীতি। কিন্তু নিদারুণভাবে বাংলাদেশের উপকূল-চর ও দ্বীপগুলো এক ‘অচ্ছুত’ এবং বঞ্চিত ভূগোল। এখানকার প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ নিরাপত্তা কোনো বিবেচনায় রাখা হয় না। এসব উপকূল চর ও দ্বীপগুলোর পরিবেশবিনাশ কিংবা সামাজিক সংঘাতের খবর খুব একটা প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েও আসে না। দেখা গেছে, একেবারেই স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য ও বিনাশ করে। এমনকি বৃহৎ অবকাঠামো, খনন, বাণিজ্যিক পর্যটন, করপোরেট মনস্তত্ত্বও উপকূল বনের প্রাকৃতিক বিকাশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষ করে উপকূল চরের বন বাস্তুতন্ত্র এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত। বসতি স্থাপন কিংবা বাসস্থান সম্প্রসারণের নামে সবচেয়ে প্রথম কোপ পড়ে উপকূল বনে। এভাবেই আমরা হারিয়েছি চর কুকরিমুকরি কিংবা ঢালচরের বিশাল অংশ।
ঢেউয়ে ভেসে আসা কেউরগুলা, ছুনে গুলা, শিউলি গুলা, গাকগুলা, কেয়াড়াগুলা, সুগুলা, উন্দুরাগুলা, চরিকগুলা, গুরুপ ফলগুলো মাছের জালে উঠে বা হাতেও ধরা যায়। নানান জাতের ইলিশ, পাতা মাছ, ব্যাঙ মাছ, আটগোড়া মাছ উপকূল চর-দ্বীপের অনন্য প্রাণসত্তা। উপকূলীয় অনেক চর-দ্বীপে বিকশিত হওয়া ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থানে শেয়াল, কাঠবিড়ালি, গুইসাপের পাশাপাশি হরিণেরও বংশবিস্তার ঘটছে। বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিতে থাকা চামচঠুঁটো বাটান পাখির বিচরণস্থল ঢালচরসহ আশপাশের উপকূল চরভূমি। যদি ঢালচরের বন সুরক্ষিত না থাকে তবে বহু বন্যপ্রাণ অচিরেই তাদের বিচরণ অঞ্চল ও খাদ্য উৎস হারাবে। ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য হবে।
সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ নিরাপত্তা বিধান করবে। সংবিধানের অঙ্গীকার অনুযায়ী ঢালচরের বনভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নদীভাঙা মানুষের আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করা জরুরি, কিন্তু সেটি প্রাকৃতিক বন উজাড় করে নয়। ঢালচরের বন বিষয়ে রাষ্ট্রকে অঙ্গীকার করতে হবে। বন বিভাগ, স্থানীয় সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ঢালচরের বন সুরক্ষায় তৎপর হতে হবে। স্থানীয় মানুষদের ঢালচরের বন ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক কাজে যুক্ত করা যেতে পারে। কারণ এই বন সব আপদন্ডবিপদ থেকে চরবাসীকে সুরক্ষিত রাখছে। নির্দয়ভাবে বনের বিনাশ বন্ধ করে বনের প্রতি ঢালচরের প্রতিজন নাগরিককে সামাজিক ঢাল হিসেবে দাঁড়াতে হবে। ঢালচরের প্রাকৃতিক ঢাল উপকূল-বন আর বনের ঢাল ঢালচরের জনগণ। প্রাকৃতিক ও সামাজিক ঢালের এই সংহতি সক্রিয় হলেই বিকশিত হবে ঢালচরের বন বাস্তুতন্ত্র।
লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রাজধানীর একটি নামি স্কুলে আগের বছরগুলোর মতো এবারও শিক্ষার্থীদের বর্ষপঞ্জি দেওয়া হয়। তাতে মার্চের মাঝামাঝি তাদের প্রথম শ্রেণি-অভীক্ষা শুরুর উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণ পেয়ে শিক্ষকরা জানান, এ বছর শ্রেণি-অভীক্ষা হবে না। ফলে শিথিল অবস্থায় ছিল শিক্ষার্থীরা। প্রথম অভীক্ষার জন্য দেওয়া সিলেবাসও শেষ হয়নি তাদের। এখন হঠাৎ করে প্রচলিত নিয়মে শ্রেণি-অভীক্ষা নেওয়া শুরু করেছে স্কুলটি। দশ বিষয়েরই। এতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
শুধু রাজধানীর একটি স্কুলই নয়, দেশের বেশির ভাগ স্কুলেই এ বছর একই অবস্থা। নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে সবাই তালগোলে পড়ে গেছে। এ বছর প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আগামী বছর প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণি এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে।
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে প্রচলিত কোনো পরীক্ষা বা মডেল টেস্ট নেওয়া যাবে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়াই সারা বছর শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়ন চলবে। বছর শেষে মাত্র একটি পরীক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু তা না মেনে অনেক স্কুল শ্রেণি-অভীক্ষা বা সিটি পরীক্ষার সূচি প্রকাশ করেছে। কোনো স্কুল পরীক্ষা নিতেও শুরু করেছে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ১০টি বিষয় রয়েছে। এসবের মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ৪০ শতাংশ। আর জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি এই পাঁচ বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে যে বিষয়গুলো আনার পরিকল্পনা ছিল তা সঠিকভাবে আনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু বইপত্র নিয়ে যা হয়েছে, মূল্যায়ন নিয়ে এর চেয়েও বেশি তালগোল অবস্থা তৈরি হবে। যে শিক্ষাক্রম হয়েছে, তা আমাদের শিক্ষকদের সক্ষমতার বাইরে। এই শিক্ষাক্রম অনুসরণ করার মতো শিক্ষক আমাদের নেই। বই যারা লিখেছেন তারাও নিরপেক্ষ থাকেননি।’ আগামী দিনের জন্য পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম আরও সময় নিয়ে ধাপে ধাপে করা উচিত ছিল। আগে যথাযথভাবে বইপত্র তৈরি করতে হবে, শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে; তারপর শিক্ষকদের তৈরি করতে হবে। চার-পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষক তৈরি করা সম্ভব নয়। আগামী বছরের জন্য এখন থেকেই এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’
জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রম চালু করে স্বস্তিতে নেই শিক্ষা প্রশাসন। গত মাসে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের অনুসন্ধানী পাঠ্যবই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী পাঠ ও ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান এই তিনটি বই সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখনো সংশোধনের কাজ শেষ হয়নি। তিন মাস হতে চলছে বই তিনটি ঠিকমতো পড়াতে পারছেন না শিক্ষকরা। নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যান্য বইতেও অসংখ্য ভুল আর অসংগতি ধরা পড়ছে। অথচ দুটি বই প্রত্যাহার করেই দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিনটি বইয়ের সংশোধন বিষয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। কাজ এখনো শেষ হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রুত তা করা যায়। যে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে ওই দুটির আরেকটি করে অংশ রয়েছে, যা পড়লে শিক্ষার্থীরা পুরো পাঠই পাবে। আগামী বছরের বইগুলোর ব্যাপারে আমরা আরও সচেতন থাকব। এ বছরের বইগুলোর যথাযথ পরিমার্জন করা হবে আগামী বছর।’
আগে পাঠ্যবইয়ের কোনো কিছু না বুঝলে সহায়ক বইয়ের সাহায্য নিতেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সহায়ক বই প্রকাশ করেনি। ফলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। তারা প্রতিদিন লাইব্রেরিতে সহায়ক বইয়ের জন্য ধরনা দিচ্ছেন।
এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ হয় প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার ফল। দুপুরে ফল প্রকাশ হলেও বিকেলেই তা স্থগিত করা হয়। পরদিন ১ মার্চ রাতে সংশোধিত ফল প্রকাশ করা হয়। দেখা যায়, প্রথমবার প্রকাশিত ফলে যারা বৃত্তি পেয়েছিল, সংশোধিত ফলে তাদের অনেকের নাম নেই। অথচ বৃত্তি পেয়ে আনন্দ-উল্লাস, মিষ্টি বিতরণ করে ফেলেছিল তারা। তাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা জেনে গিয়েছিল বৃত্তি পাওয়ার খবর। কিন্তু সংশোধিত ফলে যখন ওই শিক্ষার্থীর নাম এলো না তখন তাদের মন ভেঙে যায়।
১৪ বছর ধরে চালু থাকা সৃজনশীল পদ্ধতি শুরুতে বুঝতে হিমশিম খেয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এখন আবার নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ায় আবারও হিমশিম খাওয়ার দশায় পড়েছে তারা। অনেকেই তাল মেলাতে পারছে না। পরীক্ষা ও নম্বর বণ্টনের বিষয়টি তারা বুঝে উঠতে পারছে না। পরীক্ষার ওপর চাপ কমানোর ফলে স্কুলেও পড়ালেখার চাপ কমেছে। কোনো রকমে ক্লাস পার করেই দায় সারছেন অনেক শিক্ষক। আর অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমবিষয়ক মাত্র পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষকরা কতটা আত্মস্থ হতে পেরেছেন তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। বাস্তবভিত্তিক ও শিখনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত নিয়েও জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বোঝানো একজন শিক্ষকের পক্ষে কষ্টকর। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, বিজ্ঞানাগার ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ নেই বেশির ভাগ স্কুলে। এটা বড় সমস্যা। এই শিক্ষকরাই যেহেতু সরাসরি শিখনকালীন মূল্যায়ন করবেন, তারা কতটুকু নির্মোহভাবে তা করতে পারবেন সে ব্যাপারে অভিভাবকরা সন্দিহান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হবে। কারণ ধনী পরিবারের সন্তানরা এরই মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে প্রশিক্ষণ পাওয়া একাধিক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়া শুরু করেছেন। এগিয়ে যাচ্ছে তারা। আর প্রাইভেট পড়তে না পেরে পিছিয়ে পড়ছে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা। আবার শহরের স্কুলের চেয়ে গ্রামের স্কুলগুলো আগে থেকেই পিছিয়ে আছে। কারণ শহরের স্কুলগুলোতে বেশি বেতন ও প্রাইভেটে বেশি শিক্ষার্থী পাওয়ায় অপেক্ষাকৃত মেধাবীরা সেখানে শিক্ষকতা করেন। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য আরও বাড়বে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সব শিক্ষক সমান যোগ্যতাসম্পন্ন নন। ফলে তারা এখনো সেভাবে নতুন শিক্ষাক্রমে অভ্যস্ত হতে পারেননি। একদল শিক্ষার্থী মনে করছে, তাদের পরীক্ষা নেই। তারা রিলাক্স মুডে রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা-সহায়ক সামগ্রী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই। নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর এখনো প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি। তারা কীভাবে বিষয়টির তদারকি করবেন, সেটা বড় সমস্যা।’