
সাধক, চিকিৎসক ও সৎসঙ্গ আশ্রমের প্রবর্তক অনুকূলচন্দ্র ঠাকুর। তিনি ১৮৮৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পাবনার হেমায়েতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শিবচন্দ্র চক্রবর্তী, মা মোহিনী দেবী। কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল থেকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের ডিগ্রি নেন। নিজ গ্রামে ফিরে চিকিৎসাসেবা শুরু করেন। তার বিশ্বাস ছিল, মানুষ শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকÑএই তিন ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তাই তিনি মানসিক ব্যাধির চিকিৎসার প্রতিই বেশি জোর দিতেন। মায়ের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে অনুকূলচন্দ্র মানুষের আত্মিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কীর্তন দল গঠন করেন। মানুষের আত্মিক উন্নতির লক্ষ্যে তিনি পাবনায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘সৎসঙ্গ আশ্রম’। অনুকূলচন্দ্র জনকল্যাণে তপোবন বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, পাবলিশিং হাউজ, ছাপাখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিহারের দেওঘরে যান এবং সৎসঙ্গের আদর্শে নতুন আশ্রম গড়ে তোলেন। ‘শাশ্বতী’ নামে আশ্রমের একটি মুখপত্র প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর তিনি আর ফিরে আসেননি। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় তিনি ৪৬টি বই লিখেছেন। এর মধ্যে ‘পুণ্যপুঁথি’, ‘অনুশ্রুতি’ (ছয় খণ্ড), ‘চলার সাথী’, ‘শাশ্বতী’ (তিন খণ্ড), ‘প্রীতিবিনায়ক’ (দুই খণ্ড) উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৯ সালের ২৬ জানুয়ারি বিহারে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ভারত ও বাংলাদেশ দুদেশেই তার ভক্তকুল ছড়িয়ে আছে।
বহু পণ্যের গায়ে লেখা থাকে ‘এতে ক্ষতিকারক ডিডিটি নেই’। ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরা আশ্বস্ত হই। হয়তো আমাদের বহুজনের কাছেই ডিডিটির বিষয়টি স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে মশার স্প্রে, শুঁটকি মাছ বা কৃষিফসলে ডিডিটির ব্যবহারের কথা আমরা কমবেশি জানি। ‘ডাই ক্লোরো ডাই ফিনাইল ট্রাই ক্লোরো ইথেন’ বা ‘ডিডিটি’ হলো বিশ্বব্যাপী রাসায়নিক দূষণের জন্য দায়ী বিপজ্জনক রাসায়নিক।
কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার রাসায়নীকরণের বিরুদ্ধে একটা প্রবল জনভিত্তি বিস্তার লাভ করছে বিশ্বময়। দীর্ঘ করোনা মহামারী, যুদ্ধ ও বৈশ্বিক সংকট সবকিছু ছাপিয়ে রাসায়নিক কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ এক বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ চার দশক পর বাংলাদেশ ডিডিটিমুক্ত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের বৃহত্তম ডিডিটির মজুদটি ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। প্রায় চার দশক পর নিষিদ্ধ ঘোষিত এই মারাত্মক রাসায়নিক বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো। ২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর ডিডিটির শেষ চালানটি ধ্বংস করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে ফ্রান্সে যায়। ডিডিটি অপসারণের কাজটি কোনোভাবেই সহজ ছিল না। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত সতর্কতা, নীতিগত প্রশ্ন, অর্থায়ন এবং সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক অঙ্গীকারÑসবকিছু এক কাতারে আসতে প্রায় চারটি দশক লেগেছে। জীবন ও প্রতিবেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই ডিডিটি অপসারণ ব্যবস্থাপনার নেতৃত্ব দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির (জিইএফ) অর্থায়নে, বাংলাদেশ সরকার এবং এফএও এর সহ-অর্থায়নে ‘পেস্টিসাইড রিস্ক রিডাকশন ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় ডিডিটি অপসারণ ও নিষ্ক্রিয়করণের কাজটি সম্পন্ন হয়েছে।
গণমাধ্যম সূত্র জানায়, ডিডিটি পাউডার নিষ্ক্রিয়করণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫৫ কোটি টাকা। ৩৫৫ কোটি টাকার এই প্রকল্পে সরকারের নিজের খরচ ২১৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বাকি ৭০ কোটি ১০ লাখ গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটিজ এবং ৬৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ম্যালেরিয়া নির্মূলে ৫০০ টন ডিডিটি আমদানি করে এবং এর আগের আরও ৫০০ টনসহ এক হাজার টন ডিডিটি দীর্ঘ ৩৭ বছর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের গোডাউনে পড়েছিল। ডিডিটি অপসারণ প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয় গ্রিসের একটি প্রতিষ্ঠান। বিশেষ পোশাক ও সতর্কতা অবলম্বন করে এসব রাসায়নিক কনটেইনারে ভরা হয় এবং পরিবহন করা হয়। অপসারণের সময় সমগ্র এলাকাকে রেড জোন বা বিপজ্জনক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। অপসারণ প্রক্রিয়ার পরিচালক গণমাধ্যমকে জানান, বিশেষ জাহাজের মাধ্যমে এই রাসায়নিক সমুদ্রপথে ১২টি বন্দর হয়ে ফ্রান্সে যাবে এবং সেখানে আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি মেনে বিশেষ চুল্লিতে এসব নিষ্ক্রিয় করা হবে। বেশ কয়েক মাসের এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার সর্বত্র ঝুঁকি ও বিপদ রয়েছে। তারপরও বিশ্ব থেকে বিপজ্জনক ডিডিটির সবচেয়ে বড় মজুদটি অপসারণ করা গেছে।
বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের জন্য এটি একটি গুরুত্ববহ ঘটনা। অবিস্মরণীয় এই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজটির সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তবে ডিডিটি অপসারণের এই উদাহরণ বাংলাদেশকে আরও বেশি দায়িত্বশীল এবং দায়বদ্ধ করে তুলল। বিশেষত কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় রাসায়নিকের ব্যবহার এবং নিষিদ্ধকরণ বিষয়ে রাষ্ট্রকে এখন থেকেই আরও বেশি সতর্ক ও মনোযোগী হওয়ার বার্তা জানান দিল। ভাবলেই কেমন শিউরে ওঠে চারধার, দীর্ঘ ৩৭ বছর এক হাজার টন ডিডিটির সঙ্গে বসবাস করেছি আমরা। এমনকি এই মজুদ ছিল দেশের উপকূলের এক দুর্যোগপীড়িত ঘনবসতিপূর্ণ শিল্পাঞ্চল চট্টগ্রামে। ১৯৯১ সালের বন্যায় প্লাবিত হয় চট্টগ্রাম এবং বন্যার পানিতে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে ডিডিটি বিষ। এ ছাড়া কৃষিতে ব্যবহৃত ডিডিটির কারণে আমাদের বাস্তুতন্ত্র ও শরীরে মিশেছে এই ভয়াবহ বিষ। বাংলাদেশের মতো একটা ছোট্ট আয়তনের দেশে ৩৭ বছর ধরে এক হাজার টন ডিডিটি নিরাপদে মজুদ রাখা সবদিক থেকেই এক জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়।
ডিডিটি, অলড্রিন, ডাইএলড্রিন, ক্লোরডেন, এনড্রিন, হেপ্টাক্লোর, মিরেক্স, টক্সাফিন, পিসিবি, হেক্সাক্লোরোবেনজিন, ডাইঅক্সিন ও ফিউরান পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী এই ১২টি মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিককে একত্রে ‘ডার্টি ডজন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ডার্টি ডজন সরাসরি মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির জীবন ও জন্মপ্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব তৈরি করে, ক্যানসার, ত্রুটিপূর্ণ জন্ম থেকে শুরু করে নানান দুরারোগ্য মরণব্যাধি ও প্রতিবেশগত বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। মাছসহ জলজ প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাবের কারণে ১৯৬২ সালে এনড্রিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে ডিডিটি ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ২০০০ সালে জোহানেসবার্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১২২টি দেশ ডার্টি ডজনের ব্যবহার সীমিত করতে বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০১ সালে স্টকহোম সম্মেলনে ডিডিটিসহ ক্ষতিকারক জৈব দূষণকারী কীটনাশকের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি গৃহীত হয়। ১৭১টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও ২০০১ সালের ২৩ মে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং এটি কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ১২ মার্চ। চুক্তির ১৫ বছর পর বাংলাদেশ থেকে ডিডিটি অপসারণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৮৭৪ সালে ডিডিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তা ম্যালেরিয়া ও টাইফাস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়। ১৯৩৯ সাল থেকে কীটনাশক হিসেবে এর ব্যবহার শুরু হয়। আর তখন থেকে ডিডিটির বহুল উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত প্রতি বছর কৃষিক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০,০০০ টন ডিডিটি ব্যবহৃত হতো। কীটনাশক হিসেবে ডিডিটি আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৮ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান পল হারম্যান মুলার। মার্কিন মনস্যান্টো, সিবা, মনট্রোজ কেমিক্যাল কোম্পানি, পেন্নাওয়াল্ট, ভেলসিকল কোম্পানিগুলো মূলত বৃহৎ ডিডিটি উৎপাদনকারী কোম্পানি। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০৯ সালে ভারত ৩,৩১৪ টন ডিডিটি উৎপাদন করে এবং ২০০৭ সালে চীনে ডিডিটি উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা আনা হয়।
বাংলাদেশে ১৯৫৬ সাল থেকে কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়। তখন প্রতি বছর ৩ টন কীটনাশক এবং ৫০০ ¯েপ্র ব্যবহার করা হতো। প্রথমদিকে যখন কীটনাশকের ব্যবহার কৃষকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো তখন প্রথমত অধিকাংশ কৃষক বিশ্বাসই করতে পারল না উদ্ভিদের রোগবালাই দমনের জন্য বিষ ব্যবহার করা যায়। ক্রমান্বয়ে কৃষির ওপর চেপে বসা এই বিষ মানুষের প্রাণও সংহার করতে থাকল। কৃষিতে বিষের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু আত্মহত্যাই বাড়ল না, বরং এটি আরও নানা ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি তৈরি করে প্রতিনিয়ত মানুষকে আরও বেশি সংকটাপন্ন করে তুলতে লাগল। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে ৮৮২ টাকার কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে মাত্র ৯৮ টাকার কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত। বাংলাদেশের মাটিতে হিউমাসের সঙ্গে মিশে গেছে ১২.৫ শতাংশ ডিডিটি, যা ব্রিটেনের তুলনায় পাঁচ গুণ। এই সর্বনাশা বিষের ফলে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে জলাশয়সহ স্থানীয় অগণিত প্রাণবৈচিত্র্য আর মানুষের নানান রোগবালাই বাড়ছে। এই সর্বনাশা বিষের ব্যবহার ১ শতাংশ বাড়ার সঙ্গে কৃষকের চিকিৎসাব্যয় বেড়ে যাচ্ছে দশমিক ৭৪ শতাংশ। বাংলাদেশে বর্তমানে ৯২টি রাসায়নিক গ্রুপের প্রায় ৩৭৭টি বালাইনাশক বাজারজাতকরণের জন্য নিবন্ধনকৃত। প্রায় সব কীটনাশকের প্রয়োগের পর অপেক্ষাকাল তিন দিন থেকে ২১ দিন, কিন্তু বাস্তবতা হলো সকালে কীটনাশক স্প্রে করে বিকেলে বা বিকেলে স্প্রে করে পরদিন জমিন থেকে ফসল তুলে বাজারে বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে শসা, টমেটো, ক্ষীরা বা অন্যান্য ফল, যা আমরা সাধারণত কাঁচা খেয়ে থাকি সেসব গ্রহণের মাধ্যমে সেসব ফসলে ব্যবহৃত কীটনাশক সরাসরি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের প্রায় ২৫ ভাগ আশপাশের জলাশয়ের পানিতে মিশে যায়।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েই এক ডিডিটিমুক্ত বাংলাদেশে আমরা আজ নতুন প্রজন্মকে স্বাগত জানাতে পারছি। তবে ডিডিটি অপসারণের এই জটিল প্রক্রিয়া আমাদের আরও কী বার্তা দেয়? কেন বা কাদের কথায় আমরা এমন বিপজ্জনক রাসায়নিক আমদানি ও ব্যবহার করলাম? তথাকথিত সবুজবিপ্লব প্রকল্পের মাধ্যমে ডিডিটির মতো এমন বহু বিপদ আমাদের কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় শুধু মুনাফার জন্য তৈরি হয়েছে। কোম্পানিগুলো মুনাফার পাহাড় চাঙা করার পর যখন জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে এসব চাপিয়ে দেওয়া বাণিজ্য কারবারগুলো চরম ক্ষতি তৈরি করছে, তখন সেসব বন্ধ করতে আমাদের দীর্ঘ সময় লড়াই করতে হচ্ছে। শুধু ডিডিটি নয়, আমাদের কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা এখনো দখল করে আছে বহুজাতিক কোম্পানি ও এজেন্সির নানামুখী ব্যবস্থাপত্র। মাটি থেকে শুরু করে মায়ের দুধ সর্বত্র মিশে যাচ্ছে বিষ আর প্লাস্টিক কণা। এক ডিডিটি নিষিদ্ধ ও অপসারণে আমরা বহু বছর ও বিপুল বাজেট ব্যয় করেছি। জনগণের টাকায় বিষ কিনে সেই বিষে জনগণের সর্বনাশ করে আবার সেই বিষ তাড়াতে আবারও জনগণের টাকাই গেল। তাহলে আমরা কেন এমন বিষের ব্যবহার শুরু করলাম এই প্রশ্নটি তোলা জরুরি। বিশেষ করে নিরাপদ কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার প্রসঙ্গ যখন আমরা আলাপে তুলেছি বিশ্বময়।
এখনো সময় আছে শুধু ডিডিটি নয়; সব রাসায়নিকের বন্দিদশা থেকেই আমাদের উৎপাদনব্যবস্থাকে মুক্ত করা জরুরি। আর ডিডিটি অপসারণের মতো রাষ্ট্র যেভাবে নীতিগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার করেছে সে রকম সব বিপজ্জনক রাসায়নিক বিষের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সমমনোযোগী হতে হবে। আমরা আশা করব রাষ্ট্র বিপজ্জনক রাসায়নিকমুক্ত কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে তৎপর ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার জোরালো করবে। শুধু ডিডিটিমুক্ত নয়, ক্ষতিকর রাসায়নিকমুক্ত এক নিরাপদ কৃষিভুবনে আমরা সবাইকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষা করছি।
লেখক: লেখক ও গবেষক
করোনাকালীন দুর্যোগ অতিক্রম করে আবারও নির্ধারিত সময়ে শুরু হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। এবার মেলার মূল প্রতিপাদ্য ‘পড় বই গড় দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে বিশ্বমন্দার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। পাশাপাশি কাগজের অস্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধিতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে প্রকাশনা শিল্প। তবুও ফেব্রুয়ারির বইমেলাকে ঘিরে আশা দেখছেন লেখক ও প্রকাশকরা। নতুন বই প্রকাশ অপেক্ষাকৃত কম হলেও আগে প্রকাশিত মানসম্পন্ন ভালো বইও মেলায় খুঁজে নেবেন পাঠকরা এমনটাই তাদের প্রত্যাশা। ফলে এবারও মেলার মাঠে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের অন্যরকম সম্মিলন ঘটবে। বই নিয়ে চলবে নানা আলোচনা ও পর্যালোচনা। বই ঘিরেই বাঙালির এই সম্মিলন সত্যিকারভাবে আমাদের অহংকারের বিষয়ও।
কিন্তু শুরুর দিকে অমর একুশে বইমেলার আয়োজনটি কেমন ছিল? সে ইতিহাসটি জানতে একটু পেছনে তাকাতে হবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা’ নামটি। এদেশে প্রকাশনা শিল্পের পথিকৃৎ তিনি। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনিই প্রথম গ্রন্থমেলার সূচনা করেন। প্রথম মেলাটি হয়েছিল বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণের বটতলায়, এক টুকরো চটের ওপর। কলকাতা থেকে আনা মাত্র ৩২টি বই সাজিয়ে উনি বইমেলার গোড়াপত্তন করেছিলেন। সে বইগুলোই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান, যা ছিল চিত্তরঞ্জন সাহার ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ (বর্তমানে যা মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন সাহা একাই গ্রন্থমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী গ্রন্থমেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমিকে সম্পৃক্ত করেন। পরের বছরই যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতিও। ১৯৮৪ সালে এ মেলার নামকরণ হয়ে যায় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। এভাবে চিত্তরঞ্জন সাহার ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলাটিই এখন বাঙালির প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। গ্রন্থমেলার পরিবর্তে বর্তমানে এটিকে বলায় হয়Ñঅমর একুশে বইমেলা।
বইমেলা এলেই কথা ওঠে মানসম্পন্ন বই নিয়ে। যদিও মেলা শেষে বাংলা একাডেমি ঘোষণা দেয় নতুন প্রকাশিত মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা কতটি। কিন্তু মান নির্ধারণের পদ্ধতিটি কী সেটি আমরা জানতে পারি না। তবে এটি সত্যি, মেলায় প্রকাশিত মানসম্পন্ন বই খুব বেশি নয়। এর দায় আসলে কার লেখকের, নাকি প্রকাশকের? বিক্রির বিষয়টি মাথায় রেখে অধিকাংশ প্রকাশক এখনো বই প্রকাশ করেন মেলাকে ঘিরে। বছরের বাকি সময়টায় খুব কম বই প্রকাশ করেন তারা। ফলে নতুন বই প্রকাশের তোড়জোড়ে প্রুফ দেখা ও সম্পাদনার কাজটি একেবারেই হয় না। আবার অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থারই নিজস্ব সম্পাদনা দল নেই। এতে তাদের মাধ্যমে রঙচঙা প্রচ্ছদ মোড়ানো ভুলেভরা যে বইগুলো মেলায় আসে, প্রকৃতপক্ষে তা পাঠককে তেমন আন্দোলিত করে না। ফলে বই কিনে অনেক পাঠকই ঠকে গিয়েছেন বলে মনে করেন। এই দায়টি লেখকেরও। বইমেলায় বই বেরিয়েছে বা বেরোবে এমন নব্বই ভাগ লেখকই নিয়মিত পত্রিকায় বা অনলাইন পোর্টালগুলোতে লেখেন না। ফলে লেখালেখির অনেক ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও তারা লেখার মাধ্যমে পাঠক তৈরির চেষ্টা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকেন। প্রতি বছরের মতো এবারও বইমেলায় প্রকাশিত হবে শত শত বই। তার মধ্যে কতটি বই মানসম্পন্ন, তা একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বসহকারে তুলে ধরার কাজটি আমরা বাংলা একাডেমির কাছ থেকেই আশা করি। ভালো পা-ুলিপি ও ভালো সম্পাদনার মাধ্যমে মানসম্পন্ন বই প্রকাশ না করলে মেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাই শুধু বাড়বে, তা দিয়ে শিল্প-সাহিত্যের তেমন কোনো উন্নতি হবে না। আর এ দায় যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি প্রকাশকের এবং লেখকেরও।
বইয়ের পাঠক বেড়েছে, নাকি কমেছে? এ নিয়ে নানা মত ছিল ও আছে। পাঠক বৃদ্ধির বিষয়টিকে অনেক প্রকাশকই শুধু মেলায় বই বিক্রির মাপকাঠি হিসেবেই তুলে ধরেন। আবার অনেকেই ফেইসবুক ব্যবহারের ফলে বইয়ের পাঠকের সংখ্যা কমেছে বলে ঢালাওভাবে অভিযোগ তোলেন। অথচ আমরা দেখি কয়েক বছর আগে থেকেই ফেইসবুকেও গ্রুপ তৈরি করে সাহিত্যচর্চার রীতি চালু হয়েছে। শুদ্ধচর্চা, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ও নান্দনিক কিছু সৃষ্টির লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ফেইসবুক গ্রুপ। তারা বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের নতুন পাঠক তৈরিতেও ভূমিকা রাখছে।
আবার দেশে বই বিক্রির পরিমাণও বেড়েছে। কীভাবে? সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার বই কিনছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠক তৈরির কর্মসূচি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বই কেনার সংখ্যাও। প্রতি বছর শুধু অনলাইনেই বিক্রি হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার বই। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, পাবলিক লাইব্রেরি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, নানা এনজিও ও বেসরকারি সংস্থাও বই কেনে প্রতি বছরই। সরকারিভাবে প্রতি জেলায় এবং অনেক উপজেলাতেও বইমেলার আয়োজন হচ্ছে নিয়মিত। বেশ কিছু প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে সারা বছরই ‘কৈশোর তারুণ্যে বই’ ও ‘ক্লাসরুমের পাশে বই’ শিরোনামে বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বইমেলার আয়োজন করছে। শ্রাবণ প্রকাশনী গাড়িতে করে মুক্তিযুদ্ধের বই নিয়ে ঘুরছে সারা দেশে। এসব উদ্যোগ যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি বইয়ের নতুন পাঠক ও ক্রেতা তৈরিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তাই দেশে বইয়ের পাঠক ও বই বিক্রি কমছেÑএমন ধারণা অনেক যুক্তিতেই টিকে না। এখন দরকার ভালো মানের বই প্রকাশ এবং তা খুব সহজেই পাঠকের কাছে নিয়ে যাওয়া।
প্রায় প্রতি বছরই একটি বিষয় অজ্ঞাত কারণে বাংলা একাডেমির নজর এড়িয়ে যায়। ধর্মের প্রতি আঘাত হানা বই খোঁজার দিকে নজর দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের অসচেতনতায় অজান্তেই চলে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীর লেখা বই বিক্রি ও বিতরণের কাজ। কয়েক বছর আগ থেকেই বইমেলায় যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কাদের মোল্লা, গোলাম আযমসহ অন্য যুদ্ধাপরাধীদের লেখা বইগুলো বিক্রিসহ বইমেলায় প্রবেশ ও বের হওয়ার রাস্তায় বিতরণে কাজ করে একটি চক্র। তা ছাড়া মওদুদীবাদের বইয়েরও বিক্রি চলে এ সময়। স্বাধীনতাবিরোধী মতাদর্শের এই চক্রটি এবারও নানাভাবে সে চেষ্টাটি চালাবে। তাই বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের উচিত এই দিকটির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। কেননা ভাষা আন্দোলনের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে অমর একুশে বইমেলা। তাই মানসম্পন্ন বইয়ের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীর বইমুক্ত বইমেলাও চাই আমরা। কয়েক বছর ধরে বইমেলার পরিসর বাড়ছে। স্টল বিন্যাসেও এসেছে বৈচিত্র্য। বইমেলার ভেতরেই বিভিন্ন স্থানে প্রয়াত নামকরা বিশিষ্ট কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, শিল্পী ও গবেষকদের পরিচিতিমূলক ছবির বিন্যাস ঘটানো যেতে পারে। তা দেখে মেলায় আগত শিশুরা তাদের সম্পর্কে ধারণা পাবে, যা শিশুদের মনোজগৎকেও প্রভাবিত করবে। একুশে বইমেলা সফলতা ও পরিপূর্ণতা লাভ করবে সবার অংশগ্রহণে। এবারও পাঠক, প্রকাশক ও লেখকদের সম্মিলন ঘটবে সেখানে। পাঠকদের বই কেনার মাধ্যমে আলোর মুখ দেখবে প্রকাশনা শিল্পÑএমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : লেখক ও গবেষক
পৃথিবীর ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লবের সময়খণ্ডটিকে সহিংসতার দাইমা হিসেবে দেখেন বিশে^র রাজনীতির ইতিহাস লেখক কেউ কেউ। তারা দেখান ফরাসি বিপ্লব জগৎবাসীকে সন্ত্রাস এবং নাগরিক সেনাবাহিনী দিয়েছে। তারা দেখান নেপোলিয়নের যুদ্ধক্ষেত্রের দর্শনীয় সাফল্যের পেছনে আসল কারণ, তার সেনাবাহিনী ভাড়াটে ছিল না, দেশপ্রেমিকদের দ্বারা গঠিত ছিল। তারা জাতীয় স্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ড চালাতেন। ফলে মানুষের সামনে হাজির হলো জাতীয়তাবাদী চেতনার একপ্রকার নাগরিক ধর্মমত।
দার্শনিক হেগেল তার ভাবনা লিখেছিলেন ফরাসি বিপ্লব প্রসঙ্গে বিপ্লব সাধনের লড়াইকে মানুষ তাদের নিজের জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করেছিল। তাই তারা প্রাণ দিতে রাজি ছিল। মনে হয় হেগেল এভাবে বললে ভালো হতো যে মানুষ স্বেচ্ছায় এ রকম কারণে হত্যাও করতে চায়। হ্যাঁ, বিগত বিংশ শতকে মানুষ যেভাবে গণহত্যা করেছে নানা অজুহাতে, হয়তো বনের কোনো হিংস্র প্রাণীও এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়নি। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ঔপনিবেশিক যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, বিপ্লব এবং প্রতিবিপ্লব মোটা দাগে গোটা শতাব্দীজুড়ে ছিল।
বৈশ্বিক রাজনীতির পটভূমিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধির ব্যর্থতা দেখার আগে আমরা আধুনিক রাজনৈতিক সহিংসতার একটি অধ্যায় দেখে নিতে পারি, যেখানে ইউরোপে জাতিগত নির্মূলকরণের ইতিহাস বিধৃত। দেখে নিতে পারি কেন ‘একীভূত স্পেনীয় রাষ্ট্র তার ইহুদিদের কড়া শর্ত দিল খ্রিস্টান হও অথবা নির্বাসনে যাও’? সাফ কথা সেদেশে থাকতে হলে খ্রিস্টান হতে হবে, না হও যদি এ দেশ থেকে পালাও। ‘গুড মুসলিম ব্যাড মুসলিম’ বইটির লেখক মাহমুদ মামদানি বিশ্ববাসীকে জানালেন ‘১৪৯২ সাল। এ বছরে ইউরোপীয় রেনেসাঁর শুরু ও তাদের রাজনীতির আধুনিক রূপের জন্মের সময়খণ্ড সেটা। এ বছরেই ক্রিস্টোফার কলম্বাস নতুন দুনিয়া খুঁজতে পাল তুলেছিলেন। এ বছরেই রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলার সৈন্যরা রাজধানী গ্রানাডা জয় করেছিল, যে-গ্রানাডা ছিল পশ্চিমের খ্রিস্টান বলয়ে মুসলিমদের সুরক্ষিত আশ্রয়স্থল। ফলে ১৪৯২ হয়ে উঠল দুটি সম্পর্কযুক্ত প্রচেষ্টার প্রবেশদ্বার। একটি হলো, একটি জাতির ঐক্য, অন্যটি বিশ্বজয় বা সাম্রাজ্য বিস্তার।’
মামদানি আরও জানালেন ‘জাতি একীকরণের ফলে জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়ে গেল। এ যুগে, রাজনৈতিক আধুনিকতা গণতন্ত্রের সূচনার সঙ্গে সমান করে দেখা হয়। কিন্তু উনিশ শতকের রাজনৈতিক তাত্ত্বিকরা বিশেষত ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, রাজনৈতিক আধুনিকতা নিরূপিত হয়, রাষ্ট্রের সহিংসতা একক কর্র্তৃত্বের দ্বারা একচেটিয়া হয়ে গেলে। জাতিরাষ্ট্রে আগের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সহিংসতা একত্র করে, অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সব শত্রুকে এক দুর্দান্ত ধাক্কা দিতে সক্ষম। এটা ছিল তাদের একটি সুশীল সমাজ তৈরির রাজনৈতিক পূর্বশর্তও।’
‘সংস্কৃতি ও বর্ণের দিক দিয়ে জাতির রাজনৈতিক আধুনিকতার চিন্তার দুয়ারে তখন ইউরোপ। ফার্দিনান্দ এবং ইসাবেলার স্পেনে, যে-জাতির পরিচয় সর্বাগ্রে খ্রিস্টান। স্পেনের একীকরণ শুরু হয়েছিল জাতিগত নির্মূলকরণের মাধ্যমে। ১৪৯২ সালেই রাজা ফার্দিনান্দ এবং রানী ইসাবেলা স্পেন থেকে ইহুদিদের সরানোর আইনে (এডিক্ট অব অ্যাক্সপালশন) স্বাক্ষর করেছিলেন। একীভূত স্পেনীয় রাষ্ট্র তার ইহুদিদের কড়া শর্ত দিলে প্রায় ৭০ হাজার স্পেনীয় ইহুদি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে স্পেনে থেকে গিয়েছিল। তাদের এই থাকা নিরাপদ ছিল না। তদন্তের দ্বারা জর্জরিত হয়েছিল। অভিযোগ এনেছিল ওরা খ্রিস্টান জাতিরাষ্ট্রের প্রতি আন্তরিক না। আনুমানিক ৫০ হাজার উত্তর আফ্রিকা ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বলকান প্রদেশগুলোতে চলে গিয়েছিল। সেখানে তাদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো হয়েছিল। বাকি প্রায় ৮০ হাজার সীমান্ত পেরিয়ে পর্তুগালে প্রবেশ করেছিল। স্পেন থেকে এ তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে। তখন একের পর এক ইউরোপের একেক অংশ থেকে ইহুদিদের বের করে দেওয়া হয়েছিল। ১৪৯৯ সালে, মানে ইহুদি বের করার আদেশের সাত বছর পরে, স্পেন সেদেশের মুসলমানদের একই ধরনের শর্ত দিয়েছে: খ্রিস্টান হও অথবা চলে যাও। সুতরাং আধুনিক রাষ্ট্রের ইতিহাসও বর্ণের ইতিহাস হিসেবে পড়া যেতে পারে।’ কিন্তু পরে বহু কারণে কিংবা ‘ধাক্কা মারলে ধাক্কা খেতে হয়’ এমন বাস্তবতার কারণেই হয়তো-বা রাষ্ট্রীয়ভাবে তাড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা থেকে বের হতে হয় ইউরোপকে। যদিও বর্ণবিভেদ আমজনতার মধ্যে সেখানে শেষ হয়ে যায়নি।
এখন আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার জায়গাগুলো দেখি। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান তার সেই বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা ‘সং অব মাইসেলফ’ এর এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘ডু আই কন্ট্রাডিক্ট মাইসেলফ? ইয়েস আই ডু’ (আমার মধ্যে কি স্ববিরোধ আছে? হ্যাঁ আছে)। সহজ কথায় এর অর্থ আমার যা করা উচিত না, আমি তা করি। প্রশ্ন হলো কেন করি বা কেন মানুষ করে? আত্মরক্ষার্থে? তাই যদি হয়, আত্মরক্ষার্থে যা করা উচিত না, তা করলে শেষ রক্ষা হয় কি? এ প্রশ্ন থেকে যায়।
মাহমুদ মামদানি ১৯৭৫ সালে, তানজানিয়ার দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ প্রভাষক। বছরটি বেশ গুরুত্ববহ ঔপনিবেশিকতামোচনের কাল হিসেবে। এ বছর আমেরিকা ইন্দোচীনে পরাজিত হয়। এ বছরেই আফ্রিকা মহাদেশের মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, গিনি থেকে পর্তুগিজরা বিদায় হয়েছে। এই বছরেই ঠাণ্ডা লড়াইয়ের প্রধান কেন্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে স্থানান্তর হয়। তখন কৌশলগত প্রশ্নটি ছিল, পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের টুকরোগুলো কে নেবে সোভিয়েত না যুক্তরাষ্ট্র? প্রধান কেন্দ্র স্থানান্তর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল পরিবর্তন হয়। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস ইন্দোচীন যুদ্ধের শিক্ষা বিবেচনায় নিয়ে শীতল যুদ্ধ স্থানান্তর করতে বলে। সেই শিক্ষা নিক্সন মতবাদ হিসেবে আইনসভায় গৃহীত এবং তা ক্লার্ক সংশোধনী আকারে পাস হয়। নিক্সনের মতবাদে ছিল ‘এশিয়ার যুদ্ধ এশিয়ার ছেলেদের করা উচিত’। এ শিক্ষা আমেরিকা পেয়েছে ইন্দোচীনে এক যুগের বেশি জড়িয়ে থেকে কোনো লাভ না হওয়াতে। বিশেষত তুলনামূলক লাওসে প্রক্সি যুদ্ধ সফল হলেও ভিয়েতনামে ব্যর্থতার চাপে সেই সফলতাও ব্যর্থ হয়েছে। ভিয়েতনামে সরাসরি যুদ্ধে নামে আমেরিকা হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে ভিয়েতনামি কমিউনিস্ট গেরিলাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু লাওসে এসে আমেরিকা দেখে তার হাত বাঁধা ১৯৬২ সালের চুক্তি অনুযায়ী মস্কোর সঙ্গে। সেই চুক্তি মোতাবেক আমেরিকান সৈন্য লাওসে প্রবেশ করতে পারে না। উপায় নেই দেখে আমেরিকা তাৎক্ষণিকভাবে যা মাথায় আসে তা করে লাওস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
উল্লেখ্য, ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, যখন জনসন প্রশাসন দাবি করল দুই আমেরিকান ডেস্ট্রয়ার আঘাত করেছে উত্তর ভিয়েতনামিদের টর্পেডো টনকিন উপসাগরে। আমেরিকান সংবাদ মাধ্যমে একটি চিত্র প্রকাশ পেল, যেখানে দেখানো হয় যুক্তরাষ্ট্রকে অপমান করা হয়েছে। তাই এর একটা জবাব দেওয়া উচিত দাবি করা হয় প্রভাবশালী মিডিয়াতে। মাহমুদ মামদানি জানালেন, ‘প্রেসিডেন্ট জনসন উত্তর ভিয়েতনামিদের ওপর বোমা মারা শুরু করেন। জোরেশোরে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কংগ্রেসের দুই হাউজ থেকে সেনা পাঠানোর অনুমোদন দিতে বললেন। দ্রুতগতিতে কাজ হলো, প্রেসিডেন্ট দুই হাউজ (হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ ও সিনেট) থেকেই আক্রমণের অনুমোদন পেয়ে গেছেন। অতঃপর যে খবর পাওয়া গেল, যে ডেস্ট্রয়ারের নাবিকরা জানিয়েছিলেন তারা টর্পেডো দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, তারাই পরে জানালেন আক্রান্ত হওয়ার খবরটি বানোয়াট ছিল। কিন্তু আমেরিকা অন্য হিসাব মাথায় নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। কারণ আমেরিকার প্রধান প্রতিপক্ষ রাশিয়া। ডেস্ট্রয়ার আক্রান্তের খবর পেয়ে তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যেন পেয়ে গেলেন ব্ল্যাংক চেকÑ বিস্তর শক্তি প্রয়োগের সুযোগ। কিন্তু সফল হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। ‘অপারেশন রোলিং থান্ডার’ করল যুক্তরাষ্ট্র উত্তর ভিয়েতনামে। নিরবচ্ছিন্ন বোমা ফেলতে থাকল। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো, শিল্প কারখানাগুলো ধ্বংস করতে থাকল এ আশায় যে উত্তর ভিয়েতনামিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।
কিন্তু ব্যর্থ হলো আমেরিকা আশানুরূপ ফল এলো না। প্রেসিডেন্ট জনসন দক্ষিণ ভিয়েতনামে কমব্যাট সৈন্য নামালেন। নতুন নতুন অপারেশন করল। ‘সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়’, ‘বডি কাউন্ট’ ইত্যাদি। কিন্তু ব্যর্থ হলো আমেরিকা। ছোট ছোট ব্যর্থতাগুলো বিশাল ব্যর্থতায় উন্নীত হলো। সেখানে তাদের ‘আমেরিকানাইজেশন’ হয়ে গেল ঐতিহাসিক ‘ভিয়েতনামাইজেশন’। প্রসঙ্গত, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর পুত্রজায়াতে ওআইসি-র সম্মেলনে বলেছিলেন- Jews rule the world by proxy. They get others to fight and die for them. কথাটা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আসার পর পক্ষে-বিপক্ষে বেশ হইচই হয়েছিল। সিএনএন-র রিপোর্টে বলা হয়, আমেরিকা ও ইসরায়েল মাহাথিরের কথাকে ‘পোলারাইজিং রেটোরি’ বা ‘নতুন অর্থের চটকদার বুলি’ বিবেচনা করেছিল। মাহাথির ঠিক ধরতে পেরেছিলেন ইহুদি পরিচয়ের জায়নবাদীরা অপরের মাধ্যমে দুনিয়া শাসন করছে। আমেরিকার একজন বিখ্যাত ইহুদি সাংবাদিক, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি উদঘাটনের অন্যতম অনুসন্ধানী কার্ল বার্নস্টাইন ২০১৩ সালের ৪ মে এমএসএনবিসি টিভি’র ‘মর্নিং জো’ টক শো-তে সাফ বলেছিলেন, ইসরায়েলি নিও-কনজার্ভেটিভেরা আমেরিকাকে ইরাক যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছিল তাদের স্বার্থে। ইনি সেই বার্নস্টাইন, যিনি আর বব উডওয়ার্ড মিলে প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রশাসনের ‘ডার্টি ট্রিক্স’ বের করে দিয়েছিলেন, যা ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’ নামে খ্যাত। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এভাবে ভেতরে এবং বাইরে বিস্তর ব্যর্থতা আছে আমেরিকার।
লেখক: কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক
আজকের বাংলাদেশে নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হলেও সারা দেশের বিপুলসংখ্যক নারী এখনো সমাজজীবনের অন্ধকারে রয়ে গেছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাশাপাশি এখন উচ্চশিক্ষায় নারীর সাফল্যও খুবই আশাব্যঞ্জক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফুটবল ও ক্রিকেটের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আসরগুলোতে বাংলাদেশের মেয়েদের শিরোপা জয় যেন সামাজিক পরিসরে নারীর আগুয়ান হওয়ার পদধ্বনি। রাজনীতির মাঠেও নারীর নেতৃত্ব ও সরব পদচারণা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের সঙ্গে উগ্র ধর্মীয় চিন্তাচেতনা মিলে নারীর এই অগ্রযাত্রাকে যেন পেছন থেকে টেনে ধরা হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতি এবং শাসনব্যবস্থার শিথিলতা যে অনেকাংশ দায়ী, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এসব কারণেই দেশে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর মুক্তি ও ক্ষমতায়ন এখনো সুদূরপরাহত। তবে সাম্প্রতিক কালে আইনি কাঠামোর সংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় কর্মপদ্ধতিতে নানা সংস্কারের মধ্য দিয়ে এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে এবং নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হচ্ছে।
আমাদের সমাজে প্রথাগতভাবেই অভিভাবকত্বের প্রশ্নে মায়ের চেয়ে বাবার ভূমিকাই মুখ্য। কিন্তু অভিভাবকত্বের প্রশ্নে মা ও বাবা দুজনের সমান ভূমিকা থাকা যে জরুরি সেটা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন আইনজীবী-মানবাধিকারকর্মী-নারী আন্দোলনকর্মীরা। জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রেও একমাত্র পিতৃপরিচয়ের প্রথাগত ধারণা ও চর্চার কারণে নানা ধরনের বাস্তবিক সংকট মোকাবিলা করতে হয় বহু ব্যক্তিকে। বহু আলোচনা-সমালোচনা ও সামাজিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জন্মনিবন্ধন, নাগরিকত্বের সনদ, পাসপোর্ট এবং বিয়ে-তালাক নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বাবার পাশাপাশি মাকে যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করার মধ্য দিয়ে এক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে সত্যি। কিন্তু এতে সংকট শেষ হয়ে যায়নি। যে কারণে জন্মনিবন্ধন ও শিক্ষাক্ষেত্রের মতো মৌলিক নথিপত্র পূরণে সমস্যায় পড়ছিল দেশের শিশুরা, বিশেষত পিতৃপরিচয় জানা নেই কিংবা জানানোর ক্ষেত্রে সংকট রয়েছে এমন শিশুরা। আশাব্যঞ্জক খবর হলো হাইকোর্টের এক রায়ের মধ্য দিয়ে এখন থেকে কেবল মায়ের নাম লিখেও শিক্ষাক্ষেত্রের সব ধরনের ফরম পূরণ করতে পারবে শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের দ্বৈত বেঞ্চের এক রায়ে এমন নির্দেশনা আসে। এতে শিক্ষার্থীদের সব ধরনের এসআইএফ (স্টুডেন্ট ইনফরমেশন ফরম) পূরণে বাবার নাম লেখার বাধ্যবাধকতাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে হাইকোর্ট বলেছে, ফরম পূরণের ক্ষেত্রে অভিভাবক কলামে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের যেকোনো একজনের নাম লেখা যাবে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষা বোর্ডকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
নারী অধিকারকর্মী ও সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা এ রায়কে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী উল্লেখ করে বলছেন, সংগত নানা কারণেই অনেক শিক্ষার্থীর পিতৃপরিচয় থাকে না। আবার সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে পিতার অভিভাবকত্ব প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার্থীদের ফরমে বাবার নাম লেখার বাধ্যবাধকতা থাকা প্রতিবন্ধকতা। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের বিপাকে পড়তে হয়। হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে শিক্ষার্থীর ফরমে মায়ের অভিভাবকত্ব যেমন প্রতিষ্ঠিত হলো তেমনি বাবা-মা কেউ না থাকলেও শিক্ষার্থীর আইনগত অভিভাবকের নামও লিখতে পারবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গত বছরের জুলাই মাসে হাইকোর্ট আরেক রায়ে পিতা-মাতার জন্মনিবন্ধন নেই এমন শিশুদেরও জন্মনিবন্ধনের সুযোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এই রায় বাস্তবায়নও এক যুগান্তকারী ঘটনা। একইভাবে, কিছুকাল আগে মুসলিম বিয়ে নিবন্ধন ফরম বা নিকাহনামায় নারী ও পুরুষের অধিকার ও মর্যাদায় যেসব বৈষম্য ছিল তার একটি দূর করা হয়েছে উচ্চআদালতের নির্দেশে। নিকাহনামায় কনের ক্ষেত্রে ‘কুমারী’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘অবিবাহিতা’ যুক্ত করতে এবং বরের ক্ষেত্রেও ‘বিবাহিত/বিপত্নিক/তালাকপ্রাপ্ত’ কি না তা সংযোজন করার নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত। নারী-পুরুষ বৈষম্য বিলোপে এমন পদক্ষেপগুলো সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু মনে রাখা দরকার দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন আইনে এখনো নারী-পুরুষের মধ্যে অনেক বৈষম্য রয়ে গেছে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ে নারী-পুরুষের মধ্যকার এই বৈষম্যের ধরনও ভিন্ন। এক্ষেত্রে মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য জাতি-সম্প্রদায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয়-পারিবারিক আইন অনুসরণ করা হয়ে থাকে। মানবাধিকারকর্মী এবং নারী আন্দোলন কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারাই সমাজে নারীর প্রতি নানাবিধ বৈষম্যের অন্যতম বড় কারণ। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীকে বঞ্চিত না করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন এবং বিষয়টি সুরাহার পথ খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা আশা করব এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুগম হবে।
লিওনেল মেসি ঘোষণা দিলেন, ‘আমি ইন্টার মিয়ামিতে যাচ্ছি।’
রাতে স্প্যানিশ গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে এ ঘোষণা দিয়েছেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক।
ডারিও স্পোর্টকে তিনি জানান, ‘আমার ইউরোপের আরেক ক্লাব থেকে প্রস্তাব ছিল। কিন্তু ওই প্রস্তাব দেখিওনি, কারণ আমি ইউরোপে খেললে বার্সেলোনায় খেলতে চেয়েছে। বিশ্বকাপ জেতার এবং বার্সাতে না যেতে পারায়, এখন সময় যুক্তরাষ্ট্র লিগে খেলার এবং ভিন্নাভাবে ফুটবলকে উপভোগ করার। তবে দায়িত্ব থাকবে একই এবং আকাঙ্খা থাকবে জেতার এবং অবশ্যই ভালো করার। তবে আরো শান্তিপূর্ণভাবে।’
মেসি জানান, ‘বুসকেটস আর জর্ডি আলবার সাথে যোগাযোগ ছিল, কখনো তাদের সাথে একই জায়গায় যাওয়ার ব্যাপারে কথা হয়নি। আমি আমার সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছি।’
শৈশবের ক্লাব বার্সেলোনা থেকে মনের কষ্ট নিয়েই ২০২১ সালে স্পেন ছেড়ে ফ্রান্সের পিএসজিতে যোগ দিয়েছিলেন লিওনেল মেসি। দু'বছর পর আবার বার্সেলোনায় ফিরতে চেয়েছিলেন খুব করে। তার জন্য বাধা হয়ে দাড়ানো লা ফিনান্সিয়াল ফেয়ার প্লে'র অনুমোদনও দিয়েছিল লিগা কর্তৃপক্ষ। মেসি চাচ্ছিলেন আগের বার তাকে যেভাবে চলে যেতে হয়েছিল বার্সেলোনা ছেড়ে, সেটা যেন না হয় পরে।
দুদিন ধরে এ নিয়ে কথাবার্তা হলেও বার্সেলোনা সেই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। মেসির কাছে ছিল দুটি অপশন- সৌদি ক্লাব আল-হিলালের দুবছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব গ্রহণ করা নয়তো মেজর লিগ সকারের ক্লাব ইন্টার মিয়ামির প্রস্তাব গ্রহণ করা। আল হিলালকে এক বছরের জন্য অপেক্ষায় থাকবে বলেছিলেন মেসি দুদিন আগে। বাকি ইন্টার মিয়ার প্রস্তাব। সেটাই গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রে ক্লাব ফুটবল খেলতে যাচ্ছেন।
মেসির সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি হচ্ছে ইন্টার মায়ামির। প্রতিবছর শেষ মেসি ক্লাব ছেড়ে দিতে পারবেন, না দিলে সয়ংক্রিয় ভাবে তিনি পরের বছর খেলবেন। বছর প্রতি ৫৪ লাখ ডলার পারিশ্রমিক পাবেন তিনি।
এবার অন্তর্বর্তীকালীন লভ্যাংশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ।
বুধবার কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সভায় ২০২২-২৩ হিসাববছরের নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে লভ্যাংশের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কোম্পানির সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এর আগে ১ জুন কোম্পানিটি ২০২১-২২ হিসাববছরের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করে।
কোম্পানি সূত্র জানায়, চলতি ২০২২-২৩ হিসাববছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে পণ্য বিক্রি করে আয় হয়েছে ৭৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। উৎপাদন, পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় সমন্বয়ের পর কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা।
এতে করে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় বা (ইপিএস) দাঁড়ায় ৮৭ পয়সার কিছুটা বেশি।
তবে এফআরসির বিধান অনুযায়ী, শেয়ার মানি ডিপোজিটের বিপরীতে নতুন ইস্যু করা শেয়ার বিবেচনায় নয় মাসে ইপিএস দাঁড়িয়েছে ৫৮ পয়সা। এই আয় থেকেই শেয়ারহোল্ডারদের ৫ শতাংশ অন্তর্বর্তী নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রায় ছয় বছর বন্ধ থাকার পর জাপানি বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনায় ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। জাপানি প্রতিষ্ঠান মিনোরি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধানে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে উৎপাদনে ফেরে মৃতপ্রায় এমারেল্ড। উৎপাদিত রাইস ব্র্যান অয়েল বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৪৫ কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগ ও নতুন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এমারেল্ডে প্রাণ ফিরিয়ে আনে মিনোরি।
রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় কোম্পানিটির প্রধান উদ্যোক্তা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায় ২০১৬ সালে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এমারেল্ড অয়েলের। এ কারণে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে টানা পাঁচ বছর শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। মিনোরির তত্ত্বাবধানে এখন লভ্যাংশ দেওয়া শুরু করেছে কোম্পানিটি।
মিনোরির নতুন বিনিয়োগের বিপরীতে গত ১০ এপ্রিল এমারেল্ড অয়েলের আরও ৩ কোটি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার নতুন শেয়ার ইস্যুর অনুমোদন দিয়েছে এসইসি, যা মিনোরি বাংলাদেশের নামে ইস্যু করা হবে। এর আগে বাজার থেকে এমারেল্ড অয়েলের ৪৬ লাখ শেয়ার কেনে মিনোরি বাংলাদেশ। নতুন শেয়ার যুক্ত হলে এমারেল্ড অয়েলের পরিশোধিত মূলধন ৯১ কোটি ২৭ লাখ টাকায় উন্নীত হবে।
ফুটবল কিংবদন্তী পেলের গোটা জীবন কেটেছে ব্রাজিলের ক্লাব সান্তোসে। বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিলের জার্সি গায়ে যিনি আলো ছড়িয়েছেন, তিনি ক্যারিয়ারের সেরা সময় যাননি ইউরোপের কোনো ক্লাবে।
তবে ১৯৭৪ সালে ৩৪ বছর বয়সে সান্তোসের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানেন ফুটবল সম্রাট। পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।
১৯৭৫ সালে নিউ ইয়র্ক কসমসে যোগ দেন। সেই বছরের ১৫ জুন ক্লাবটিতে নাম লিখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসেন।
যে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষজন একটা সময় ফুটবল খেলাই দেখতে যেতেন না, পেলে যোগ দেওয়ার পর ৮০ হাজার ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামের সব টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। সেদিনই পেলে নিউইয়র্ক জয় করেছিলেন।
পেলে কসমসে যাওয়ার ১৫ বছর পর ফের বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে টুর্নামেন্টের অভিষেক আসরের তৃতীয় স্থান অর্জনকারী যুক্তরাষ্ট্র। সেই থেকে শুধুমাত্র ২০১৮ সাল ছাড়া প্রতিটি বিশ্বকাপেই খেলেছে তারা। ২০০২ সালে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন। কাতার বিশ্বকাপেও শেষ ষোলো থেকে বিদায় নিয়ে হয়েছে ১৪তম দল হয়ে।
বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডে দারুণ একটা মৌসুম কাটিয়েছেন জুড বেলিংহাম। অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে নজর কেড়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের। আর তাই তো নতুন মৌসুম শুরু করবেন এই ক্লাবের জার্সি গায়ে। ইংল্যান্ডের এই মিডফিল্ডারকে দলে নিতে ১০৩ মিলিয়ন ইউরো খরচ করতে রাজি হয়েছে ব্ল্যাঙ্কোরা।
এক বিবৃতিতে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে ডর্টমুন্ড। তারা জানিয়েছে, স্প্যানিশ দলটি ১০৩ মিলিয়ন ইউরো দিতে সম্মত হয়েছে। যেখানে আনুসাঙ্গিক আরও অনেক বিষয় জড়িয়ে। যদি সেটা অর্জন করা সম্ভব হয়, তবে চুক্তিটি ১৩৩.৯ মিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছতে পারে।
২০২০ সালের জুলাইয়ে বার্মিংহাম সিটি থেকে ডর্টমুন্ডে যোগ দেন ১৯ বছর বয়সী বেলিংহাম। কাতার বিশ্বকাপেও ইংলিশদের সেরা পারফরমার ছিলেন তিনি। ম্যানচেস্টার সিটি ও লিভারপুল উভয় ক্লাবই তাকে পাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত মাদ্রিদে পাড়ি দিচ্ছেন।
এই চুক্তির মাধ্যমে বেলিংহামে বিশ্বের তৃতীয় দামি তরুণ ফুটবলার হতে চলেছেন। ২০১৯ সালে ইডেন হ্যাজার্ড ১১৫ মিলিয়ন ইউরোতে চেলসি থেকে রিয়ালে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
বেলিংহাম এই মৌসুমে তার ক্লাবের হয়ে ৪২ ম্যাচ খেলে ১৪ গোল করেছেন। সাতটি গোল তিনি করিয়েছেন।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।