
অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম হলো চাহিদা আর জোগানের ভারসাম্য থেকেই বাজারে স্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের দেশের মুক্তবাজার অর্থনীতি এমনই মুক্ত যে, কেবল চাহিদা আর জোগানই নয়, এক অদৃশ্য হাত রয়েছে যা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। খুচরা ব্যবসায়ী, দোকানি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এই অদৃশ্য হাতকে সিন্ডিকেট হিসেবে চেনে। চাল, ডাল, চিনি কিংবা ভোজ্য তেলসহ সব নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণেরই নানা সিন্ডিকেট আছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করে দেশের চিনির বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। চিনির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে ব্যবসায়ীরা খোলা ও প্যাকেটজাত চিনির দাম বাড়িয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত পাঁচ মাসে সরকারি হিসেবে কেজিপ্রতি চিনির দাম বেড়েছে ২৯ টাকা।
শুক্রবার দেশ রূপান্তরে ‘মূল্যবৃদ্ধিতেও কাটেনি চিনির সংকট’ ও ‘রোজার আগে দাম বাড়ছে কেজিতে ৫ টাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদন দুটি থেকে জানা যায়, গত কয়েক মাস ধরে বাজারে চিনির চরম সংকট চলছে। এর মধ্যেই দুই দফায় কেজিপ্রতি ২৮ টাকা বাড়িয়েছে চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। রোজা শুরুর আগের মাস ফেব্রুয়ারি থেকে আরেক দফা দাম বাড়নোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসআরএ)। নতুন দামে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে ১০৭ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। চিনি সরবরাহ ও দামের বিষয়ে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ‘হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি চিনি প্রক্রিয়াজাতকরণ করে থাকে। তাদের কারণে বাজারে চিনির কৃত্রিম সংকট তৈরি হলে সরকারের উচিত হবে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া।’ রমজানের পণ্যগুলোর মধ্যে চাহিদার শীর্ষে থাকে চিনি। রোজাদারদের স্বস্তির জন্য চিনির বাজার স্বাভাবিক হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। আশা করব ভোক্তার কথা চিন্তা করে রমজানের আগেই যেন সরকার দ্রুত চিনির বাজার স্বাভাবিক করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়। বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সংস্থার নজরদারি বাড়ানো উচিত। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চিনি পরিশোধনকারী মিলগুলোতে অধিদপ্তরের নজর রয়েছে। তবে লোকবল সংকটের কারণে মিল থেকে বাজারে আসা পর্যন্ত কোনো চক্র চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কি না তা জানা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ এ জন্য সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপর হওয়া জরুরি, যাতে করে চিনি সংকটের পেছনে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা যায়।
বাণিজ্যমন্ত্রী চিনির মূল্যবৃদ্ধিকে সঠিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলেছেন, ‘হিসাব-নিকাশ করে চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে। এটা যদি সমন্বয় করা না হয় তাহলে ফল ভিন্ন হবে। বাজারে চিনি পাওয়াই যাবে না।’ রমজানের আগে চিনির দাম বৃদ্ধির খারাপ প্রভাব পড়বে বাজারে। মন্ত্রীর কথা সঠিক ধরে নিলেও শুল্ক কমিয়ে চিনির দাম নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। অন্যদিকে, অবিলম্বে সরকারি চিনিকলগুলোকে পূর্ণ উৎপাদনশীল করা এবং বন্ধ চিনিকলগুলোকে পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে। রোজা বা রমজান সংযমের মাস বলে পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশে রোজার মাসে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি দেখে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যাবে না যে ব্যবসায়ীরা মুনাফার ক্ষেত্রে সংযম করছেন বা সংযত আছেন। রোজার মাসে প্রধানত খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ে। প্রতি বছর ব্যবসায়ীদের ঘুরেফিরে একই যুক্তি- বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে, আমদানি খরচ বেড়েছে, পরিবহন খরচ বেড়েছে প্রভৃতি। সাধারণ মানুষ দুঃখ করে বলেন, বাজারে কোথায় সংযম? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কিংবা জাতীয় প্রতিযোগিতা কমিশন কারোরই যেন কিচ্ছু করার নেই! অথচ কোন প্রক্রিয়ায় আমদানিকারক-মজুদদার-পাইকারি বিক্রেতারা চিনির মতো নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি করে আর সেটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিংবা বিবিধ সরকারি দপ্তরের কারোরই অজানা থাকার কথা নয়। সরকারের সংস্থাগুলো (আইন, বিধি, নীতিমালা, নিয়ন্ত্রক-তদারক সংস্থা) সক্রিয় থাকলে এ পরিস্থিতি হয় না। বাজার তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ একদিনের কাজ না; আমরা চাই সরকার এ বিষয়ে ৩৬৫ দিনই সতর্ক-সোচ্চার থাকুক। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের অবশ্যই কঠোর হস্তক্ষেপ দরকার। ভাবা দরকার যে, বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো থেকে শুরু করে সরকারের সাম্প্রতিক কোনো সিদ্ধান্তই সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিচ্ছে না। সাধারণ মানুষের সুরক্ষার প্রশ্নে সরকারকে অবশ্যই বাজার নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে হবে।
শ্রমিকদের বিশেষত গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বিতর্ক আবার শুরু হয়েছে। শ্রমিকদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তার মজুরি। এই প্রশ্ন সব সময়ই উঠে থাকে, যুক্তিসংগত অথবা মানবিক মর্যাদা রক্ষা করার মতো মজুরি নির্ধারণ করা হবে কীভাবে? একটু ভেবে দেখা যাক! একটি শ্রমিক পরিবারে কী কী দরকার হয়? অন্তত তিনবেলা খাবার, পোশাক, মাথা গোঁজার ঠাঁই, অসুস্থ হলে চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা, বৃদ্ধ বয়সের জন্য সঞ্চয়, অতিথি আপ্যায়ন ও বিনোদন ছাড়া মানবিক জীবন কীভাবে হয়? তাই এসব বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা উচিত। পৃথিবীর অন্তত, ৯০টি দেশে ন্যূনতম মজুরি আইন করে নির্ধারণ করা হয়। ন্যূনতম মজুরি আইন প্রথম করা হয় নিউজিল্যান্ডে ১৮৯৬ সালে। এরপর অস্ট্রেলিয়ায় ১৮৯৯ সালে, ব্রিটেনে ১৯০৯ সালে, শ্রীলঙ্কায় ১৯২৭ সালে এবং ১৯৩৬ সালে ভারতে, ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে প্রবর্তন করা হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, স্পেন, মরিশাস, মেক্সিকো, কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা হয়। কানাডায় করা হয় প্রতি দুই বছর পরপর। বাংলাদেশে পাঁচ বছর পরপর মজুরি পুনর্নির্ধারণের আইন করা হয়েছে। কিন্তু পাঁচ বছর দ্রব্যমূল্য তো এক জায়গায় থাকে না, তাই শ্রমিক প্রতি বছর হারাতে থাকে তার প্রকৃত মজুরি। বাংলাদেশের শ্রম আইনে মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী বলা আছে? শ্রম আইনের ১৪১ ধারায় বলা আছেজীবনযাপন ব্যয়, জীবনযাপনের মান, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, কাজের ধরন, ঝুঁকি ও মান, ব্যবসায়িক সামর্থ্য, দেশের ও সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা এবং অন্য প্রাসঙ্গিক বিষয় বিবেচনা করতে হবে। শ্রম আইনে উল্লিখিত মানদন্ডসমূহ একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক সে হিসেবে মজুরি কত হতে পারে।
১. জীবনযাপন ব্যয় : শ্রমিকের প্রধান সম্পদ তার কর্মক্ষমতা। তার কর্মক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সে যা আয় করে তা দিয়ে তার সংসার চালাতে হয়। কর্মক্ষম মানুষ, শিশু, বৃদ্ধ, সন্তানসম্ভবা মাসবার কথা বিবেচনা করে প্রতিদিন একজন মানুষের গড়ে ২৮০০ থেকে ৩০০০ কিলো ক্যালরি তাপ উৎপাদনের উপযোগী খাবার খেতে হয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষকরা সাম্প্রতিক সময়ে বলেছেন, বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ঢাকায় বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের খাবার খরচের জন্য মাসিক ২২ হাজার ৪২১ টাকা প্রয়োজন হচ্ছে। আর কোনো মাছ-মাংস না খেলেও খাবার বাবদ খরচ হচ্ছে ৯ হাজার ৫৯ টাকা।
আর জাতিসংঘের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত মত, বাংলাদেশে একজন মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য দৈনিক প্রয়োজন ২৭৬ টাকা। অর্থাৎ ৪ সদস্যের পরিবারের খাবার খরচ বাবদ মাসে প্রয়োজন হবে ৩৩,১২০ টাকা। জ্বালানি তেলের সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির দুই মাস আগে নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য বিবেচনায় নিয়ে সিপিডি বলেছিল খাবারের সঙ্গে এক কক্ষের ঘরভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল, চিকিৎসাব্যয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার পণ্য ক্রয়, সন্তানের পড়ালেখার খরচ, যাতায়াত, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের বিল হিসাব করলে ঢাকার আশপাশের এলাকায় চার সদস্যের এক পরিবারের মাসিক খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৫৪৮ টাকা। বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বিবেচনায় নিলে এ খরচের পরিমাণ আরও বেশি হবে।
২. সরকারি হিসাবে মাথাপিছু আয় ২৮২৪ ডলার। তাদের ঘোষণা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু আয় ৩০০৭ ডলারের বেশি হবে। সে হিসেবে ৪ সদস্যের পরিবারের বার্ষিক আয় ১১ লাখ ৫২ হাজার টাকার বেশি। এই আয়কে মাসিক আয়ে পরিণত করলে তার পরিমাণ হবে ৯৯ হাজার টাকার বেশি (১ ডলার = ১০৬ টাকা হিসাবে)। পরিবারের দুজন সদস্য আয় করলেও একজন কর্মক্ষম মানুষের গড় মাসিক আয় ৪৯ হাজার টাকার বেশি হতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, মাথাপিছু আয় মানে কি সবার আয় সমান হবে নাকি? কিন্তু যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, যারা দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য উৎপাদন করে তারা কি অন্তত মাথাপিছু আয়ের সমান মজুরি পাওয়ার অধিকার রাখে না?
৩. শ্রমিক কাজ করতে আসে দারিদ্র্য দূর করার জন্য। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মতো দেশে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে প্রতিদিন প্রতিজনের কমপক্ষে দুই ডলার আয় করতে হয়। সে হিসেবে মাসে ২৫ হাজার টাকার কম আয় হলে ৪ সদস্যের একটি পরিবার দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে পারবে না। তাহলে একটি উন্নয়নশীল দেশে উৎপাদনের প্রধান চালিকাশক্তি শ্রমিকরা মজুরি পেয়ে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠবে না, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
৪. সরকার ঘোষিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী ২০১৫ সালে পে-স্কেলের সর্বনিম্ন ধাপে বেতন ৮২৫০ টাকা বেসিক ধরে ১৪ হাজার ৫০০ টাকার বেশি নির্ধারণ করা হয়েছিল। গত আট বছরের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির হার বিবেচনা করলে বর্তমানে তা ২৩ হাজার টাকার বেশি দাঁড়ায়। এ ছাড়া তারা নববর্ষ বোনাস, ভ্রমণ-ভাতা, অবসর প্রস্তুতিকালীন সবেতন ছুটি ইত্যাদিসহ নানা রকম সুবিধা পেয়ে থাকেন। পে-স্কেলের সর্বনিম্ন ধাপের কর্মচারী একজন পিয়ন তার ৫৯ বছর বয়সে চাকরি অবসানের পর আজীবন পেনশন পাবেন। কিন্তু বেসরকারি খাতের শ্রমিকরা পেনশনসহ এসব অধিকার পান না। তাই ন্যায্যতার প্রশ্নে তাদের মজুরি সরকারি খাতের চেয়ে বেশি না হলে তা কোনোভাবেই ন্যায়সংগত হবে না।
৫. ২ জুলাই ২০১৮ তারিখে মন্ত্রিসভার বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার শ্রমিকদের মজুরি অনুমোদিত হয়। সে অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে কার্যকর মজুরির মূল বেতন ৮৩০০ টাকা, যা প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করার নিয়ম কার্যকর আছে। এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মূল বেতনের সঙ্গে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা-ভাতা, টিফিন-ভাতা, যাতায়াত-ভাতা, ধোলাই-ভাতা, ঝুঁকি-ভাতা, শিক্ষা সহায়তা-ভাতা যুক্ত করলে বর্তমান মজুরি হয় প্রায় ২৪ হাজার টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন কাঠামোকে জাতীয় মানদণ্ড ধরা উচিত।
৬. বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রারম্ভিক বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিরাপত্তাকর্মী, বার্তাবাহক, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ কর্মচারীদের প্রারম্ভিক বেতন-ভাতা সর্বনিম্ন ২৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করে গত এপ্রিল ২০২২ থেকে বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনা প্রমাণ করে যে মাসে ২৪ হাজার টাকার কম মজুরিতে ন্যূনতম মানসম্পন্ন জীবনযাপনের সুযোগ নেই।
৭. গার্মেন্টস পণ্য যে দেশেই তৈরি হোক না কেন এর বাজার আন্তর্জাতিক। গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারক ৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ নিয়ে জরিপ চালিয়ে অক্সফাম এই তথ্য জানায়। ২১ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অক্সফামের গবেষণা জরিপ ‘রিওয়ার্ড ওয়ার্ক নট ওয়েলথ’ নামে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে শ্রমিকদের জন্য শোভন মজুরি হতে হলে তা মাসে ২৫২ ডলার বা ২৪ হাজার ৬৯৬ টাকা হতে হবে। এটা তো ৪ বছর আগের হিসাব। শোভন কাজ, পরিবেশ এবং এসডিজি নিয়ে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও অনেক আলোচনা এবং পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শোভন মজুরি ছাড়া শোভন কাজ এই কথার কোনো অর্থ কি আছে?
৮. মজুরি নির্ধারণে একটি প্রধান বিষয় শ্রমিকের শ্রমে উৎপাদিত পণ্যে মূল্য সংযোজন কত হয়? এবং কী দামে তা বিক্রি হয়? পৃথিবীর যেকোনো দেশেই তা উৎপাদিত হোক না কেন গার্মেন্টস পণ্যের টার্গেট প্রধানত ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, রাশিয়ার বাজার। গার্মেন্টসশিল্পে মূল্য সংযোজন কী পরিমাণ হচ্ছে, প্রধান গার্মেন্টস রপ্তানি দেশ যেমন চীন, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারতের শ্রমিকদের তুলনামূলক মজুরি কত এ বিষয়গুলোও বিবেচনা করা উচিত।
গার্মেন্টস বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস। বাংলাদেশের রপ্তানির ৮৩ শতাংশের বেশি আসে গার্মেন্টস খাত থেকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৩০.৬২ বিলিয়ন ডলার আর ইপিবির তথ্যবিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। এই বাড়তি উৎপাদনের জন্য নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ার পরিবর্তে কমেছে, অর্থাৎ শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। অথচ আমরা দেখছি সেই গার্মেন্টসের শ্রমিকদের মজুরি পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন। শ্রমিকের আয় না বাড়ায় তাদের জীবনমান বাড়ছে না। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত বাংলাদেশে শ্রমিকরা মানসম্পন্ন জীবনযাপন করার মতো মজুরি পাবেন না এটা হতে পারে না। আবার অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক গতিশীলতা বাড়ে। মানসম্পন্ন মজুরি যেমন শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করে, তেমনি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। বাংলাদেশকে যদি উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত করতে হয় তাহলে শ্রমজীবী মানুষের আয় বাড়াতেই হবে। ন্যায্য মজুরির নির্ধারণ তাই বাংলাদেশের শ্রমিক এবং অর্থনীতির বিকাশের জন্যই প্রয়োজন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের উৎপাদিত পণ্য আমেরিকা, ইউরোপের বাজারে বিক্রি হয়। ৫-১০ সেন্ট দাম বাড়লে সেখানকার ক্রেতারা টি-শার্ট কিনবে না এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসলে শ্রমিককে কম মজুরি দেওয়ার জন্য কাল্পনিক ভয় দেখানো অনুচিত। আর বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস চলে যাওয়া তো দূরের কথা উল্টো চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে কাজ আসছে, চীনের ব্যবসায়ীদের দল মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশে আসছে, তারা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকরাও ২০৩০ সালের মধ্যে গার্মেন্টস পণ্যের রপ্তানি বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন করার স্বপ্ন দেখছেন। এসব স্বপ্নের সঙ্গে শ্রমিকদের মানসম্পন্ন জীবনযাপনের উপযোগী মজুরির কথাটা যেন চাপা পড়ে না যায়। মজুরি বিতর্কের গ্রহণযোগ্য সমাধান তাই জরুরি।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
কুষ্ঠ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন রোগ। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষ রবিবার বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সে হিসাবে এ বছর জানুয়ারি মাসের ২৯ তারিখে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে দিবসটি পালিত হবে। কুষ্ঠরোগের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই দিবস পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় এখনই কাজ শুরু করি, কুষ্ঠরোগ নির্মূল করি। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব অ্যান্টি-লেপ্রসি অ্যাসোসিয়েশনস (আইলেপ)-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাউল ফোলেরো বিশ্বব্যাপী কুষ্ঠরোগ বিষয়ক ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে ও কুষ্ঠরোগের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ১৯৫৪ সালে দিবসটি উদযাপনে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক কুষ্ঠবিরোধী সংগঠনসমূহের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ‘আইলেপ’, যা ১৩টি আন্তর্জাতিক এনজিওর সমন্বয়ে গঠিত, এই দিবসটি পালনে উদ্যোগ নেয়। কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাজে পুনঃগ্রহণ, সর্বপ্রকার কুষ্ঠজনিত কুসংস্কার দূরীকরণ, এই সব লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে জনসাধারণ এবং কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঠিক তথ্য ও শিক্ষা প্রদান করাই হচ্ছে এই দিবসের লক্ষ্য। বাংলাদেশে এই বছর দিবসটি পালনের গুরুত্ব রয়েছে, কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজধানীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কুষ্ঠ সম্মেলনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে কুষ্ঠমুক্ত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
১৮৭৩ সালে নরওয়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. আরমার হ্যানসেন কুষ্ঠরোগের জীবাণু ‘মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি’ আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের ফলে প্রমাণিত হয় যে, কুষ্ঠ একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, জন্মগত, বংশগত বা অভিশাপের ফল নয়। হাজার হাজার বছর ধরে কুষ্ঠরোগ ও কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিগণকে অভিশপ্ত এবং অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হতো এবং অনেককেই দ্বীপান্তরিত, বনবাস, গৃহচ্যুত করা হতো। কুষ্ঠরোগাক্রান্ত মানুষ মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হতো। হাজার বছরের অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কার মানুষের মনে এমনভাবে গেঁথে আছে যে, অনেক রোগী সামাজিকতার ভয়ে যথাসময়ে চিকিৎসা নিতে দেরি করে এবং ভয়াবহতা ডেকে আনে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ব্রাজিল, ভারত, নেপাল, মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো এবং তানজানিয়ায় কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা শনাক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হলেও এবং নিয়মিত চিকিৎসায় সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য রোগ হওয়া সত্ত্বেও এখনো রোগটি জনস্বাস্থ্য সমস্যারূপে রয়ে গেছে।
মাল্টি ড্রাগ থেরাপি (এমডিটি) প্রবর্তনের পর থেকে বিশ্বে কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আশির দশকে যেখানে বিশ্বে কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা ছিল ৫২ লাখ, তা এখন দুই লাখে নেমে এসেছে। তবে যে বিষয়টি এখনো যথেষ্ট উদ্বেগের তা হলো, গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর দুই লাখের ওপর নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এর ৫৬ শতাংশই শনাক্ত হয়েছে ভারতে। এরপর একাধিক্রমে রয়েছে ব্রাজিল (১৩.৬%), ইন্দোনেশিয়া (৮.৫%), নেপাল (১.৯%) ও বাংলাদেশ (১.৮%)। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশে নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজারের মধ্যে ছিল। দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ (টিএলএমআই-বি) এর মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতি বছর প্রায় নতুন কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৮-১০% সময়মতো চিকিৎসার অভাবে পরবর্তী সময়ে পঙ্গু হয়ে যায়। জাতীয় কুষ্ঠরোগ নির্মূল কর্মসূচি দেশের ১২ জেলাকে কুষ্ঠরোগের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো রংপুর বিভাগের রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী ও গাইবান্ধা; রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট জেলা; খুলনা বিভাগের মেহেরপুর জেলা; সিলেটের মৌলভীবাজার এবং পার্বত্য তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। এসব জেলায় প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে পাঁচজন বা তার অধিক কুষ্ঠরোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতি লাখে পাঁচজন বা তার অধিক কুষ্ঠরোগী পাওয়া গেলে তাকে উচ্চ ঝুঁকি বলতে হবে।
কুষ্ঠ সাধারণত চিকিৎসাবিহীন রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায় এবং আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক স্নায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙুল বাঁকা হওয়া, মুখের প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘা ইত্যাদি বিকলাঙ্গতা দেখা দেয় এবং রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা ও বৈষম্য প্রকটরূপে দেখা দেয়। চামড়ার অবশ দাগ দিয়ে এই রোগ শুরু হয়, অনেক সময় দানা গুটিও দেখা দেয়। চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠরোগ একটি মৃদু সংক্রামক রোগ। দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। কুষ্ঠরোগ প্রাথমিক পর্যায়ে চিহ্নিত হলে ও চিকিৎসার আওতায় এলে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশে কুষ্ঠ নির্মূলের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। কম গুরুত্ব দেওয়ার কারণে এই খাতে বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, বাজেট স্বল্পতার কারণে কুষ্ঠবিরোধী কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগী খুঁজে বের করার জন্য প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাব, এই রোগকে ঘিরে কুসংস্কার দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অভাব আছে। চিকিৎসকদের কুষ্ঠ বিষয়ে ধারণা কম থাকায় রোগী চিহ্নিত করা ও চিকিৎসাকাজ ব্যাহত হয়, দেশের সর্বত্র চিকিৎসাসুবিধা সমানভাবে প্রাপ্তিসাধ্য নয় এবং দেশে কুষ্ঠের কারণে বিকলাঙ্গদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার অভাব। আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত সমাজে কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। এর ফলে তাদের রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, আরোগ্যলাভ এবং সামাজিক কার্যাবলি ব্যাহত হয়। আমাদের মেডিকেল কলেজগুলোতে কুষ্ঠরোগ বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে পাঠদান করা হয় না। বাজেট স্বল্পতার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো যাচ্ছে না। অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম চালানো দরকার, এতে ব্যাপক অর্থের প্রয়োজন। দেশে কুষ্ঠের বিশেষায়িত সেবা খুবই অপ্রতুল। কুষ্ঠরোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে তিনটি সরকারি কুষ্ঠ হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু এই হাসপাতালগুলোর পূর্ণাঙ্গ সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অন্ততপক্ষে দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কুষ্ঠ সেবা প্রদানের জন্য উপযোগী করা দরকার।
কুষ্ঠবিষয়ক প্রায় ৮০ ভাগ স্বাস্থ্যসেবা এনজিও কর্র্তৃক পরিচালিত হাসপাতালগুলো দিয়ে থাকে। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে তাদের এই সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার এগিয়ে না এলে সমস্যা বাড়বে, প্রতিবন্ধিতা আরও বেড়ে যাবে। দেশে কুষ্ঠজনিত সব প্রতিবন্ধী লোকজনের সঠিকভাবে সামাজিক পুনর্বাসনের প্রয়োজন যেন তারা সমাজে মর্যাদার সঙ্গে বাস করতে পারে। উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের প্রতিবন্ধিতা কমিয়ে কর্মক্ষম করে তোলা সম্ভব। সমস্ত ধরনের বৈষম্য ও কুসংস্কারের অবসান ঘটিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করা দরকার। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও ক্ষমতায়ন করা দরকার যাতে তারা সক্রিয়ভাবে কুষ্ঠ সেবার বিষয়ে অংশ নিতে পারে। আক্রান্তদের ও তাদের পরিবারের জন্য জীবিকা অর্জনে সাহায্য করা দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্র্তৃক প্রণীত ‘কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৬-২০২০’ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়া উচিত বলে অধিকারকর্মীরা মনে করেন। উক্ত পরিকল্পনাতে কুষ্ঠ ও এর জটিলতা দূর করা, বৈষম্য দূর করা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করা, সময়মতো রোগী শনাক্তকরণে গুরুত্ব এবং পর্যাপ্ত সম্পদের নিশ্চয়তা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
আমাদের একযোগে অসহায়, দরিদ্র, নিপীড়িত কুষ্ঠরোগাক্রান্ত মানুষগুলোর জন্য কাজ করতে হবে। কারণ এতগুলো মানুষকে বঞ্চিত রেখে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কুষ্ঠরোগাক্রান্ত প্রতিবন্ধী মানুষগুলোর পুনর্বাসন এবং সঠিক যত্নের জন্য তাদের পাশে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন। যেন আক্রান্ত ব্যক্তিরা পরিপূর্ণ মর্যাদা ও অধিকারের সঙ্গে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারেন। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীরা দেশের বোঝা নয়, তাদেরও রয়েছে সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার।
লেখক : মেডিকেল অফিসার, সিভিল সার্জন অফিস
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির দুনিয়ায় এক নীরব সংকট বিরাজমান। উন্নত দেশগুলোয়ও চলছে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্বসহ নানা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এর পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটি নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে বলে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। তবে অনেক অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এর মূল কারণ নয়; বরং অন্তর্নিহিত মূল কারণগুলো অন্য কিছু। সেগুলো হলো বিশ্বব্যাপী ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের চর্চা, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অদক্ষতা, সুদ ও ঋণভিত্তিক অর্থব্যবস্থা, দীর্ঘদিন সম্পদের অসম বণ্টনব্যবস্থা প্রভৃতি। তবে আমাদের মতো দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির পেছনের মূল কারণ আরও ভয়াবহ। এখানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নামমাত্র।
একজন ব্যক্তির যেমন চলার এবং প্রয়োজন নির্বাহের জন্য অর্থের প্রয়োজন, একটি কোম্পানির যেমন অর্থের প্রয়োজন হয়, একটি দেশেরও চলার জন্য, ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। সাধারণত একজন ব্যক্তি বা কোম্পানির অর্থ পকেট একটি থাকে, বিনিময় ক্ষেত্রও একটি থাকে। কিন্তু একটি দেশের জন্য অর্থ পকেট থাকে ভিন্ন ভিন্ন। প্রতিটি দেশেই রাজস্ব ব্যয় হয় দেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন পূরণে। এর মধ্যে আছে সামাজিক অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, সাধারণ সেবা খাত। এগুলোর মধ্যে সাধারণত ভৌত অবকাঠামো শীর্ষ ব্যয় খাত। ইদানীং অতিমাত্রায় ঘাটতি বাজেট, দুর্নীতি, টেক্স টু জিডিপি রেশিও কমে আসায় যুক্ত হয়েছে সরকারের সুদভিত্তিক ঋণ থেকে সুদ বাবদ ব্যয় ও ভর্তুকি। সম্প্রতি এ দুটিই এখন বাজেটের শীর্ষ ব্যয় খাত। বলার অপেক্ষা রাখে না, চলমান রাজস্ব নীতি ও ব্যয় খাত নানাভাবে অসংগতিপূণর্, এতে অর্থনীতির সুফল প্রত্যাশিত মাত্রায় গণমুখী হচ্ছে না।
কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখন সর্বজনস্বীকৃত। মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলেছে দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, দেশে শ্রমিক রয়েছে ৬ কোটি ৩৫ লাখ, যারা কাজ করেন বিভিন্ন খাতে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩২ লাখ নারী। ৮০ ভাগেরও বেশি রপ্তানি আয়ে রয়েছে যাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) ভূমিকা রাখছে ১৪ ভাগের বেশি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, বর্তমানে ঢাকা শহরে চার সদস্যের একটি পরিবারের মাছ, মাংসসহ স্বাভাবিক পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা মেটাতে মাসে ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা প্রয়োজন। তালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিলে এ প্রয়োজন দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৫৭ টাকায়। কিন্তু নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের যে আয় তা দিয়ে খাদ্যপণ্য কিনে টিকে থাকা কঠিন। আর বেশির ভাগ শিল্পের কর্মীদের পক্ষে কেবল বেতনের অর্থ দিয়ে পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব না। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে ২০টি শিল্পের কর্মকর্তা ও শ্রমিকের খাদ্যের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতার চিত্র তুলে ধরা হয়। তাতে দেখা যায়, সব শিল্পের কর্মীদেরই চার সদস্যের পরিবারের জন্য রেগুলার ডায়েট বা মাছ ও মাংসসহ খাবারের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা নেই। মাছ-মাংস বাদ দিয়ে চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা আছে কেবল আটটি শিল্পের কর্মকর্তাদের এবং ছয়টি শিল্পের শ্রমিকদের। অথচ প্রতি বছরই তাদের ৫ শতাংশ হারে বেতন বেড়েছে।
সিপিডি বলছে, বেশির ভাগ শিল্পের কর্মীদের পক্ষেই পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে পণ্যের দাম বাড়ছে, তার চেয়েও বেশি হারে বাড়ছে দেশের স্থানীয় বাজারে। বিশেষ করে চাল, আটা, চিনি, ভোজ্যতেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও স্থানীয় বাজারে সেই প্রভাব নেই। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের দামও কারণ ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী। লাগামহীন এ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ। এজন্য ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো উচিত। শ্রমিক নেতাদেরও দাবি, পোশাক শ্রমিকরা এখন যে মজুরি পায়, তা দিয়ে তারা এবং সন্তানেরা পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে না। তাই নারী শ্রমিকদের রক্তশূন্যতা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। শুধু এ সমস্যাই নয়, তারা আরও মারাত্মক সব রোগে ভোগেন কিডনি, শ্বাসকষ্ট, যক্ষ্মা ইত্যাদি। এমনকি অতিরিক্ত কাজের চাপে অনেক নারী সন্তানধারণের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। পাশাপাশি ৪০-৪৫ বছর বয়স্ক পোশাক শ্রমিকের পক্ষে আর কাজ করার শক্তি থাকে না। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। তাতে কিছুটা হলেও সমস্যাগুলো লাঘব হতো।
কারখানার মালিকরা অবশ্য বারবারই দোষ চাপান নারীশ্রমিকদের ওপর। তারা দাবি করেন, এসব নারী গ্রাম থেকে আসায় তাদের অভ্যাস পরিবর্তন করা যাচ্ছে না। একসময় পোশাককর্মীদের দুপুরের খাবার দেওয়া হতো কারখানায়। কিন্তু তারা খাবার না খেয়ে টাকা নিতে চান। অথচ সে টাকায় তারা কোনো খাবারই খান না। ফলে তাদের জীবনযাপনের পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসের কারণেই এসব স্বাস্থ্যগত সমস্যা। চিকিৎসকরা অবশ্য বলে থাকেন শুধু দামি খাবারই পুষ্টিকর, এমন ধারণা ভুল। বলা হচ্ছে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যের কথা। একজন শ্রমিক প্রতিদিন একই ধরনের খাবার না খেয়ে এতে পরিবর্তন আনতে পারেন। যেমন একদিন লালশাক খেলে আরেকদিন খাবেন পুঁইশাক। এতে খাবারে যেমন বৈচিত্র্য আসবে তেমনি দূর হবে পুষ্টির অভাবও। বাজারে বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ পাওয়া যায়। একেক দিন একেক রকম ছোট মাছেও শ্রমিকের পুষ্টির অভাব পূরণ হতে পারে। এদিকে মূল্যস্ফীতি যোগ করলে দেখা যায়, গত ২৫ বছরে কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে সব ধরনের পুষ্টিকর খাবারের দাম। ফলে এগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা বিপুল সংখ্যক মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। আর পরিবারের ব্যয় সংকোচনের ক্ষেত্রে সেই চিরচেনা ভূমিকাতে বরাবরই অবতীর্ণ হন নারী। নানা ব্যয়ভার মেটাতে তারা সমঝোতা করেন নিজের পুষ্টির চাহিদা কিংবা সাধ-আহ্লাদের সঙ্গে। নিজের ও পরিবারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এ দেশের বেশির ভাগ পোশাক শ্রমিকই দৈনিক ১২ ঘণ্টা শ্রম দেন।
এসব-সহ নানাবিধ কারণে শিল্পকারখানায় দিন দিনই কমে যাচ্ছে নারীশ্রমিকের সংখ্যা। আগে যেখানে ৮০ শতাংশই নারীকর্মী ছিল, এখন তা কমে হয়েছে ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। মূলত প্রযুক্তি ও দক্ষতায় ঘাটতি, পুরুষশ্রমিক বেড়ে যাওয়া, অপুষ্টি আর নানা ধরনের নির্যাতনের কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মজুরিবৈষম্য ছাড়াও তারা কারখানার ভেতরে ও বাইরে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। আবার অধিকাংশ নারীশ্রমিকই নিয়োগপত্র পান না, ফলে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। তবু বাংলাদেশের নারীশ্রমিকরা থেমে নেই। নিত্যদিনের পুষ্টিহীনতা,রক্তস্বল্পতাসহ শারীরিক নানা ধরনের রোগব্যাধি; সঙ্গে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক নির্যাতনকে মাড়িয়েই তারা শ্রম দিয়ে চলেছেন। নিজেরাই হয়তো জানেন না তাদের কাঁধেই সওয়ার হয়েছে দেশের অর্থনীতি।
তবে এদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে ভবিষ্যতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেই। বিশেষত রপ্তানিমুখী শিল্পে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা গেলে পরবর্তী সময়ে ঋণ পরিশোধের জন্য বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর আর চাপ পড়বে না। ২০০৮ সালর বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য বাড়ার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় টানাপড়েনে পড়েছিল। প্রায় দেড় দশক ধরে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরে অর্থনীতি এখন আবার একটা অস্থিরতার দিকে পড়তে যাচ্ছে। এটাও মূলত বিশ্ব অর্থনীতির কারণেই। তবে অর্থনীতিতে এ ধরনের ঝাঁকুনি খেলেই হয়তো টেকসই প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে কাঠামোগত মৌলিক প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে, সেদিকে নজর পড়ে।
যেমন আগামী দিনে আমাদের উন্নয়ন ব্যয়ে অনেক সাশ্রয়ী হতে হবে এবং রাজস্ব সংগ্রহ অবশ্যই জোরদার করতে হবে। কারণ, পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, জনস্বার্থ রক্ষা ও প্রযুক্তিগত উন্নতি এসবের জন্যই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের খরচ ক্রমেই বেড়ে যাবে। উন্নয়নশীল বিশ্বে মধ্যমেয়াদে, বিশেষ করে এক দশক সময়ের জন্য উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অনেক নজির আছে। কিন্তু কয়েক দশক ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া পেরেছিল তার উদাহরণ খুবই বিরল। সে কারণেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে সিঙ্গাপুর বা হংকংয়ের মতো কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র বা অঞ্চল বাদ দিলে দক্ষিণ কোরিয়াই শুধু নিম্ন আয়ের দেশ থেকে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হওয়ার এখন পর্যন্ত একমাত্র দৃষ্টান্ত। সুতরাং এসব বিষয় নিয়েও ভাবতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার শঙ্কা কাটছেই না। ডলার সংকটে এখনো আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক হয়নি। এর মধ্যে রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস অনেক গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রতিদিনই কমছে। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা অনুযায়ী, অর্থনীতি এখনো নাজুক অবস্থায় না গেলেও সহসাই চাঙ্গা হবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। যে সূচকগুলোর ঊর্ধ্বমুখীর কারণে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়, সেই সব সূচক এখনো স্থিতিশীল। ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কোনো অবস্থায়ও যাচ্ছে না।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামী লালা লাজপত রায়ের জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৮৬৫ সালে পাঞ্জাব প্রদেশে। তাকে ‘পাঞ্জাব কেশরি’ নামেও ডাকা হয়। তিনি পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক ও লক্ষ্মী বীমা কোম্পানি স্থাপন করেছিলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের লাল-বাল-পালের তিনি অন্যতম নেতা। তার বাবার নাম মুনশি রাধা কৃষ্ণণ আজাদ। তিনি কিছুকাল হরিয়ানার রোহতক এবং হিসার শহরে ওকালতি করেন। বাল গঙ্গাধর তিলক ও বিপিন চন্দ্র পালের সঙ্গে তিনি লাল-বাল-পাল নামেই বিখ্যাত ছিলেন। এই তিন নেতাই প্রথমদিকে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ভারতের স্বাধীনতার দাবি করেন। তিনি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর সঙ্গে আর্যসমাজকে পাঞ্জাবে জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি অনেক স্থানে দুর্ভিক্ষের সময় শিবির স্থাপন করে মানুষের সেবা করেছেন। ১৯২৮ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে তিনি পুলিশের লাঠিপেটায় গুরুতর আহত হন এবং ১৭ নভেম্বর মারা যান। তার মৃত্যুতে সমগ্র দেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগত সিং, রাজগুরু, সুখদেব ও অন্যান্য স্বাধীনতাসংগ্রামী তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা নেয় এবং ১৭ ডিসেম্বর ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তা সাংডর্সকে গুলি করে হত্যা করে। এতে ব্রিটিশ সরকারের কারাগার থেকে তাদের ফাঁসিতে ঝুলানোর আদেশ দেওয়া হয়। তিনি হিন্দি ভাষায় মধ্যযুগীয় ভারতের নেতা শিবাজী ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনী রচনা করেন।
গাজীপুরের টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীতে ৩৬০ টাকা বেতনে কর্মজীবন শুরু করা আসাদুর রহমান কিরণ এখন গাজীপুর মহানগরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর বিভিন্ন দল বদলে ক্ষমতার পাশাপাশি প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। বিভিন্ন সূত্র মতে, কিরণ এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। তার এত সম্পদের মালিক হওয়ার পেছনে রয়েছে দখলবাজি, জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর দুর্নীতি ও অনিয়ম।
কিরণের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ ৩১টি দপ্তরে যে অভিযোগ জমা পড়েছে, তাতে ডিগবাজি দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসা এই ভারপ্রাপ্ত মেয়রের ৬০০ কোটি টাকার দুর্নীতি-অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য হাইকোর্ট দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দিয়েছে।
২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর নির্বাচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। নগরীর ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণ তখন ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পান।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণকে একাধিকবার ফোন করা হয়েছে। মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।
৩১ দপ্তরে অভিযোগ : গত বছর ২০ জুলাই ৩১টি দপ্তরে সচেতন নাগরিক, বাংলাদেশের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন মো. নজরুল ইসলাম। লিখিত অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, দুদক, স্থানীয় সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে দেওয়া হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে গত বছর জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি পালন না করেও সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছেন কিরণ।
জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার অভিযোগপত্রে ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণের দুর্নীতি ও অনিয়ম চিত্র তুলে ধরেছি।’
কিরণের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র : ভারপ্রাপ্ত মেয়রের চেয়ারে বসে কিরণ দুর্নীতি-লুটপাট, কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তার নজর পড়ে পুবাইলের চিরুলিয়ায় অর্পিত সম্পত্তির ওপর। ২৩ বিঘা জমি নিজের কবজায় নেন কিরণ। এর জন্য ভুয়া জমির মালিক বানান একজনকে। এ জমি নিজের করায়ত্তে নিতে সিটি করপোরেশনের ১৮ লাখ টাকা কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। জানাজানি হয়ে গেলে কিছুদিন আগে কর পরিশোধ করেন। তবে অবৈধ প্রক্রিয়ায় জমির মালিক হওয়ায় ওই জমির খাজনা এখনো দিতে পারেননি কিরণ।
পোশাকশিল্প কারখানার সবচেয়ে বড় নগরী গাজীপুর। সিটি করপোরেশনের আয়ের সবচেয়ে বড় মাধ্যম শিল্প ও হোল্ডিং ট্যাক্স। আর সেখানেই অনিয়মের বড় ক্ষেত্র তৈরি করেছেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র। তিন/পাঁচ কোটি টাকার বকেয়া হোল্ডিং, শিল্প ট্যাক্স অর্ধেকে নামিয়ে এনে করপোরেশনের কোষাগারে মাত্র ৫০ লাখ টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রেহাই দিয়ে দেন করদাতাদের। কিরণের এই কৌশলে বেঁচে যান কর ফাঁকি দেওয়া শিল্প-মালিকরা। কিন্তু রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র। নগরের আটটি জোনে করের টাকা আত্মসাৎ করার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিরণ ২০১৬-১৭ সালে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় একটি টেন্ডার আহ্বান করেন। টেন্ডার নম্বর : জিসিসি/জেড। ওই টেন্ডারের কাজের অগ্রগতি না থাকায় জাহাঙ্গীর আলম মেয়র নির্বাচিত হলে ওই টেন্ডারের কোনো বিল পরিশোধ করতে পারেননি কিরণ। ২০২১ সালে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেন। ওই সময়ের বিভিন্ন ঠিকাদারকে ডেকে তাদের কাছ থেকে কাজের হিসাব করে তার কমিশন আদায় করেন কিরণ। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কিছু চিত্র সিটি করপোরেশনের চেক রেজিস্ট্রার বই ঘেঁটেও পাওয়া গেছে।
উত্তরায় ‘অস্থায়ী কার্যালয়’ : উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে ৭ নম্বর রোডে ১০ নম্বর বাড়ির ছয়তলায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একটি ‘কার্যালয়’ করেছেন কিরণ। উত্তরার এ কার্যালয়ে বসে ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। লেনদেন-দরবার সবই হয় এ বাড়িতে বসেই। পার্সেন্টেজ ছাড়া যেমন ঠিকাদারদের কাজের বিল পরিশোধ করা হয় না, তেমনি পার্সেন্টেজ ছাড়া ঠিকাদারি কাজও পান না কেউই। কোন কাজ কে পাবে, কে পাবে না, কে কত পার্সেন্ট কমিশন দেবে এসব হিসাব ও মধ্যরাতের প্রমোদ-ফুর্তির যে ব্যয় হয় সিটি করপোরেশনের এলআর ফান্ড থেকে নির্বাহ করা হয়। শিল্পাঞ্চল-সমৃদ্ধ গাজীপুর নগরীর অধিকাংশ ব্যবসায়ী-ঠিকাদার ‘১০ পার্সেন্ট’ হিসাবেও কিরণকে চিনে-জানে।
বর্তমানে গাজীপুর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা সারা জীবন রাজনীতি করেছি দলের জন্য। অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছি কিন্তু মূল্যায়ন পাইনি। একটি কাজের জন্য আমি ছয় মাস ঘুরছি। কিন্তু কিরণ আমাকে কাজ দিচ্ছেন না। কারণ আমার কাছ থেকে পার্সেন্টেজ নিতে পারবেন না।’
শুধু কী তা-ই, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজনের নামে গত বছর ১৭ মার্চ কোনো আয়োজন না করেই কিরণ সিটি করপোরেশনের খরচের তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগও আছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৭৬ জন কাউন্সিলর এবং কিছু কর্মকর্তার সিলেটে পিকনিক আয়োজন করার নামে করপোরেশনের তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ বাবদ দেখিয়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগও আছে।
কিরণের সম্পদ : টঙ্গীর পাগাড়, ঢাকার আশুলিয়া এবং গাজীপুরে নিজ নামে, স্ত্রী, শ্যালক ও শ্যালিকার নামে ১১২ বিঘা জমির মালিক কিরণ। টঙ্গীর পাগাড়ে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কিছু জমি রয়েছে, যা নয়ছয় ও ভয়ভীতি দেখিয়ে দলিল করে নিয়েছেন তিনি। নজরুল ইসলামের অভিযোগ অনুযায়ী, উত্তরায় ১১ নম্বর সেক্টরে ৭ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়িটি সাততলা। এটি নির্মাণ করতে কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। একই এলাকার ৭ নম্বর সেক্টরে ১৮ নম্বর রোডে ৯৫ নম্বর বাড়ি রয়েছে। বারোতলা নির্মাণাধীন ওই ভবনের আনুমানিক মূল্য ৩৫ কোটি টাকা। গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কে ফ্ল্যাটের তথ্যও পাওয়া গেছে। ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটের মূল্য কমপক্ষে সাত কোটি টাকা।
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় স্ত্রী ও নিজের নামে অন্তত ২০০ বিঘা জমির ওপর ভারপ্রাপ্ত মেয়রের কারখানা রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ৩০০ কোটি টাকা হতে পারে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অধীনে টঙ্গীতে তিনটি কারখানা আছে তার। এগুলোর আনুমানিক মূল্য ৩০০ কোটি কোটি টাকা।
কিরণের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত কয়েকশ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিজের ও স্ত্রীর নামে যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্ক শহরে বাড়ি করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। কিরণ দ্বৈত নাগরিক বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
হাইকোর্টের আদেশ : গত বছরের ২০ জুলাই দুদকে জমা পড়া অভিযোগ লাল ফিতায় আটকে গেলে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন হয়। গত বছর ২১ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করা হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালত কিরণের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। হাইকোর্ট চার মাসের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে সময় বেঁধে দেন। একই সঙ্গে গাজীপুরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে আদালত।
রাজনীতিতে উত্থান : প্রিন্টিং প্রেস কারখানায় বাইন্ডার-ম্যান হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন আসাদুর রহমান কিরণ। ১৯৮৪-৮৫ সালে এলিট প্রিন্টিং প্রেস নামে ওই কারখানায় চাকরি করা কিরণ ১৯৮৬ সালে রাজনীতিতে আসেন। ওই সময় তিনি জাতীয় পার্টির যুব সংগঠন যুব সংহতির টঙ্গীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওই সময় গাজীপুর নিয়ন্ত্রণ করতেন হাসান উদ্দিন সরকার। তিনি জাতীয় পার্টি ও পরে বিএনপির রাজনীতিতেও যুক্ত হন। ওই সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর হাসান উদ্দিন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ও তার ঘনিষ্ঠ পরিচিতি লাভ করে শুরু করেন জমি দখল। টঙ্গী, পাগাড় মৌজায় হিন্দু-খ্রিস্টানের মালিকানায় থাকা জমি দখল করে নেন তিনি। পরে প্লট বানিয়ে চড়া দামে বিক্রি করেন। তবে প্রিন্টিং প্রেসের শ্রমিক কিরণ ওই সময় টঙ্গীর বিসিক এলাকায় শ্রমিক নেতা হিসেবেও আধিপত্য বিস্তার করেন। হিন্দু-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কেউ জমি দিতে না চাইলে রাজনৈতিক চাপ ও সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করতেন। পাগাড় শিল্পাঞ্চল এলাকা হওয়ায় ওই এলাকায় টার্গেট করে জমি দখল করেন কিরণ। টঙ্গী পৌরসভা হিসেবে প্রথম ভোটে ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কমিশনারও নির্বাচিত হন। তত দিনে ক্ষমতা-সম্পদ ও অঢেল অর্থের মালিক হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর গুরু পাল্টে কিরণ হয়ে যান সাবেক পৌর মেয়র গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লার ‘মাইম্যান’। এই সুযোগে ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে কিরণের। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে আজমত উল্লা মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক আবদুল মান্নানের কাছে পরাজিত হন। কিরণ মূলত দুর্নীতি-অনিয়ম শেখেন তখন থেকেই। বিএনপি নেতা মান্নান মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হলে তিনি ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পান। গাজীপুরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচন কেন্দ্র করে আজমত উল্লার সঙ্গেও সুসম্পর্ক নেই কিরণের।
গাজীপুরের মাওনা এলাকার আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চেয়ার ছুঁয়েই কিরণ স্বেচ্ছাচারিতা, লুটপাট, ভূমিদখলসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তিনি করেননি। দলীয় লোককে সরিয়ে রেখেছেন, সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখেছেন। কারণ, কিরণ আওয়ামী লীগ নয়, মূলত সুবিধাবাদী।’
ভারপ্রাপ্ত মেয়রের বিষয়ে জানতে চাইলে আজমত উল্লা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কিরণ অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে এসেছেন সত্যি, তবে তিনি দলের জন্য কাজ করেছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের যে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে সেটা তো প্রমাণ হয়নি এখনো। প্রমাণ হলে তখন মন্তব্য করা যাবে।’
ভাড়া করা বিমানে উড়িয়ে নিয়েও মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রথম ম্যাচে একাদশে রাখল না দিল্লি ক্যাপিটালস। আসরে তাদের শুরুটাও ভালো হলো না। লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে বড় ব্যবধানে হারল মোস্তাফিজবিহীন দিল্লি।
ঘরের মাঠে ৫০ রানের জয়ে আসর শুরু করল লক্ষ্ণৌ। ১৯৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে দিল্লি থামে ৯ উইকেটে ১৪৩ রানে। ৪ ওভারে মাত্র ১৪ রান খরচায় ৫ উইকেট নিয়ে লক্ষ্ণৌয়ের জয়ের নায়ক মার্ক উড।
এদিন দিল্লির ব্যাটিং ছিল পুরো ফ্লপ। দলের অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার ৪৮ বলে ৫৬ রান করেছেন। পাশাপাশি রাইলি রোশো ২০ বলে ৩০ রানের ইনিংস খেলেন। কিন্তু বাকিরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ফলে যা হরার তাই হলো ম্যাচের ফল।
এর আগে স্বাগতিক দলের হয়ে ঝড় তোলেন কাইল মেয়ার্স। এই ক্যারিবীয়ান ৩৮ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলেন। ২টি চারের সঙ্গে হাঁকান ৭টি ছক্কা। এ ছাড়া নিকোলস পুরান ২১ বলে ৩৬ রানের ইনিংস খেলেন। সুবাদে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৬ উইকেটে ১৯৩ রানের পুঁজি গড়ে লক্ষ্ণৌ।
গত অক্টোবরের পর আর্সেনালের জার্সিতে প্রথম গোলের দেখা পেলেন গাব্রিয়েল জেসুস। তার আবার জোড়া গোল। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের জ্বলে ওঠার দিনে লিডস ইউনাইটেডকে উড়িয়ে ম্যানচেস্টার সিটির চেয়ে ফের আট পয়েন্টে এগিয়ে গেল আর্সেনাল।
ঘরের মাঠে শনিবার প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচটি ৪-১ গোলে জিতে আর্সেনাল। স্পট কিকে দলকে প্রথম এগিয়ে দেন জেসুস। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে বেন হোয়াইট ব্যবধান দ্বিগুণ করেন। এর খানিক পরই জোড়া গোল পূর্ণ করেন জেসুস।
এরপর লিডস একটি গোল শোধ করলেও গ্রানিত জাকার গোলে বড় জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে স্বাগতিকরা।
আন্তর্জাতিক বিরতি থেকে ফেরার পর এটিই প্রথম ম্যাচ ছিল আর্সেনালের। বিরতিতে যাওয়ার আগে নিজেদের মাঠে একই ব্যবধানে তারা হারিয়েছিল ক্রিস্টাল প্যালেসকে।
এই জয়ে ২৯ ম্যাচে ৭২ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষস্থান আরও মজবুত করল গানাররা। ২০০৩-০৪ মৌসুমের পর প্রথমবার প্রিমিয়ার লিগ জয়ের স্বপ্ন দেখছে আর্সেনাল। তাদের সঙ্গে গত লিগের চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটির পয়েন্ট ব্যবধান ৮।
গানারদের চেয়ে এক ম্যাচ কম খেলে ৬৪ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে সিটি। একই দিন তারাও নিজেদের মাঠে লিভারপুলকে উড়িয়ে দিয়েছে ৪-১ গোলে।
বরকতময় রমজান মাস পাওয়া প্রতিটি মুমিনের জন্য মহা সৌভাগ্যের বিষয়। কেননা এ মাসের মর্যাদা অনেক বেশি। যাতে বান্দার জন্য মহান মনিবের সন্তুষ্টি অর্জন করা অন্য সময়ের চেয়ে সহজতর। কোরআনে কারিমের ভাষায়, ‘তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ -সুরা বাকারা : ১৮৫
বর্ণিত আয়াতে ‘শাহিদা’ (উপস্থিত ও বর্তমান থাকা) শব্দ দিয়ে রোজা সম্পর্কিত বহু হুকুম-আহকাম ও মাসয়ালা-মাসায়েলের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর আয়াতের শেষাংশে বান্দাকে ‘কৃতজ্ঞ’ হতে বলা হয়েছে। কৃতজ্ঞতর সাধারণ অর্থ উপকারীর উপকার মনে রাখা ও স্বীকার করে। এর সঙ্গে প্রশংসা, মহিমা, মূল্য ও যোগ্যতার বিষয়গুলো জড়িত। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ইসলামের শিক্ষা হলো- সর্বাবস্থায় সবকিছুর জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো। কেননা তিনিই তো এর প্রাপ্য। চোখের প্রতি পলকে এবং হৃৎপিণ্ডের ওঠানামার সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে তার দেওয়া অসংখ্য নিয়ামতে ডুবিয়ে রেখেছেন। এই নিয়ামত এবং দান, যেগুলো প্রতি দিনে-রাতে নবায়ন হচ্ছে, সেগুলোর জন্য আমাদের উচিত আল্লাহকে ধন্যবাদ জানানো। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং যারা উপদেশ গ্রহণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ইচ্ছুক, তাদের জন্য রাত এবং দিনকে সৃষ্টি করেছেন পরস্পরের অনুগামীরূপে।’ -সুরা আল ফুরকান : ৬২
ইসলাম কৃতজ্ঞতাকে উচ্চাসন দিয়েছে। তাই তো উপকারী ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। এ কৃতজ্ঞতা যদি কেউ প্রকাশ না করে, তাহলে সে সমাজের চোখে তো নিন্দিত হয়ই, সে নিন্দিত হয় মহান রাব্বুল আলামিনের কাছেও। নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করে না, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ হয় না।’ -জামে তিরমিজি : ১৯৫৪
উল্লিখিত কোরআনের আয়াত ও হাদিস দ্বারা এটা স্পষ্ট যে মানুষের অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা আদায় করা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরই অংশ। ইসলাম বলে, কৃতজ্ঞতার মানসিকতা লালন করে যেতে হবে। এমন যেন না হয়, আমার বিপদে একজন পাশে দাঁড়াল, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল, কিন্তু আমি তা ভুলে গেলাম, তার প্রতিপক্ষ হয়ে গেলাম। এমন হলে পারস্পরিক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়।
অকৃতজ্ঞতা নীতিহীনতার পরিচয়। এর মাধ্যমে নিয়ামতের অপরিসীম ধারাকে দাতার সামনেই অসম্মান করা হয়। এ ধরনের আচরণের ফলে আরও বেশি কিছু চাওয়া কিংবা পাওয়ার অধিকার হ্রাস পায়। মানবজাতির প্রতি আদেশ হলো, তাদের প্রতিপালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে।
কৃতজ্ঞতা কোনো কঠিন দায়িত্ব নয়, যেখানে ধৈর্যের সঙ্গে পথ চলতে হয়; বরং এটি হলো পরিপূর্ণতার পথ, যেটি দৃঢ় সংকল্প এবং উদ্দেশ্য নিয়ে পাড়ি দিতে হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে পবিত্র বস্তু আহার করো এবং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো; যদি তোমরা শুধু তারই ইবাদত করে থাকো।’ -সুরা বাকারা : ১৭২
মধুর আবেগ এবং হৃদয়ের উপলব্ধি দিয়ে আল্লাহর নিয়ামতের শোকরিয়া আদায়, একজন ব্যক্তিকে আরও বেশি পাওয়ার যোগ্য করে তোলে। তার রহমতের বর্ষণ ঠিক সেই উর্বর জমিতে ঢালা পানির ন্যায়, যা জমিনকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করে তোলে। কৃতজ্ঞতা শুধু ঠোঁটে প্রকাশযোগ্য কোনো শব্দ নয়; বরং কৃতজ্ঞতা হলো হৃদয়ের এমন এক অনুভূতি যা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তার জীবনের প্রতিটি কাজ এবং আচরণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। অকৃতজ্ঞতার পরিণাম সম্পর্কে মানবজাতিকে ভয়ংকর পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আর অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ -সুরা বাকারা : ১৫২
রমজান মাসে অনেক পুণ্যের সমাহার ঘটে। পুণ্যময় এসব কাজের একটি হতে পারে আল্লাহকে স্মরণ ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। কারণ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারীকে অনুগ্রহ লাভের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।
লেখক : খতিব, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ
জীবনালেখ্য
কারি আবদুল খালিক। এক নামে তাকে ঢাকার আলেমরা চেনেন। হাজার হাজার আলেমের ওস্তাদ। কোরআন শিক্ষায় নিবেদিত শ্যামবর্ণের মানুষটির জীবন ত্যাগ ও সাধনার। দুনিয়াবিমুখ এই মনীষীর জীবনের পরতে পরতে মিশে আছে আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস। যে বিশ্বাসের দ্যুতি তার জীবনের কর্মশক্তি। লিখেছেন মুফতি এনায়েতুল্লাহ
ধর্মপ্রাণ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের সুনাম রয়েছে। বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে দ্বীন দরদি মানুষের অংশগ্রহণ ঈর্ষণীয়। সাধারণ সম্পদশালীরা তাদের সম্পত্তির কিছু অংশ মসজিদন্ডমাদ্রাসা, খানকা-ঈদগাহ ও গোরস্তানসহ বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজে দান করে থাকেন। এর ব্যতিক্রম দৃষ্টান্তও আছে। রয়েছে আল্লাহর ওপর ভরসা করে ঘর-বাড়িসহ ভিটেমাটি দান করার নজির। ইসলামের প্রচার-প্রসার আর কোরআন-হাদিস শিক্ষার জন্য এমন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ আছেন বলেই এখনো দুনিয়ার বুকে ইসলাম টিকে আছে। দুনিয়ার কোনো স্বার্থ নয়, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের নিমিত্তে এমন আত্মত্যাগের ঘটনা সমাজে বিরল। কখনো তা ইতিহাসে পাতায় লেখা হয়, আবার কখনো তা থাকে অনুচ্চারিত।
আজ এমনই এক মহৎপ্রাণ মানুষের কথা আলোচনা করব, যিনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত নিজের ভিটেমাটিসহ একমাত্র ঘরটি ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। আলোকিত এই মানুষের নাম হাফেজ কারি আবদুল খালিক আসআদী।
কারি আবদুল খালিকের জন্ম বর্তমান বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জে ১৮৩৮ সালে। পিতা মৌলভী আরশাদ আলী (রহ.)। ১২ বছর বয়সে তিনি মাকে হারান। মাতৃবিয়োগের শোক তাকে দ্বীনের পথে আসতে অনুপ্রেরণা দেয়। গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মোরেলগঞ্জ রাজৈর সিনিয়র মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়ালেখা করেন। পরে ভগ্নিপতি মরহুম মাওলানা ইউসুফের হাত ধরে আলিয়া মাদ্রাসা ছেড়ে দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন পড়াশোনা শেষে ঢাকার ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে হেফজ শেষ করেন। হেফজ শেষে হেদায়াতুন্নাহু কিতাব পড়ার পর তিন বছর (১৯৬২-৬৪) পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থিত তাজবিদুল কোরআন মাদ্রাসায় কারি ইহসান আহমদ থানভী (রহ.) ও কারি শাকের আহমদ (রহ.)-এর কাছে ইলমুল কেরাত পড়েন। পাকিস্তানে থাকা অবস্থায় তার আব্বার ইন্তেকাল হয়।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান থেকে ফিরে খুলনা শিরোমণি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ওই বছরই তিনি বাগেরহাট জেলার রামপাল নিবাসী মরহুম মাওলানা আতহারুল ইসলাম খানের বড় মেয়ে আমিনা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
এখন থেকে ৬১ বছর আগে বাগেরহাটের মতো একটি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ইলমে দ্বীন শিক্ষার জন্য ঢাকা-পাকিস্তান গমন সোজা কথা নয়। তখনকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার প্রতিকূলতা জয় করতে সক্ষম হন শুধু কোরআনের ভালোবাসায়। নানা কারণে শিক্ষা জীবনের আনুষ্ঠানিক সফল পরিসমাপ্তি তার হয়ে ওঠেনি। এই না পাওয়াকে তিনি অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষকতায় তার একনিষ্ঠতা, আন্তরিকতা তাকে সাফল্য এনে দেয়। তিনি পরিচিতি পেয়েছেন, কিন্তু থেমে যাননি, এই পরিচয়কে দুনিয়ার পদন্ডপদবি লাভ ও সহায়-সম্পত্তি উপার্জনের হাতিয়ার বানাননি। তার স্বপ্ন ও ধ্যান ছিল ইসলামকে বিজয়ীরূপে দেখা। সমাজের আনাচে-কানাচে কোরআনের শিক্ষা প্রসার ঘটানো।
ঢাকার বিভিন্ন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে ছিলেন। গেণ্ডারিয়া জামালুল কোরআন মাদ্রাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি, এর নামকরণও তার। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তার ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারিরা আরজাবাদ মাদ্রাসা জ্বালিয়ে দেয়। তখন তিনি সতীশ সরকার রোড, জোরপুল লেন মসজিদে নামাজ পড়াতেন। সেখানে একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সফলতার জন্য দোয়া করলে রাজাকাররা তাকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করে। পরে মসজিদের মোতোয়ালি রাতের আঁধারে তাকে নিরাপদে সরিয়ে দেন। ওই সময় তিনি কিছুদিন চট্টগ্রামের শোলকবহর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের এক-দেড় বছর পর পুনরায় আরজাবাদ মাদ্রাসায় যোগ দেন।
যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর সেখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে পুনরায় আরজাবাদ ফিরে আসেন। এখন পর্যন্ত তিনি আরজাবাদেই শিক্ষকতা করছেন। বার্ধক্যজনিত নানাবিধ অসুস্থতার দরুন তিনি বাসা থেকে খুব একটা বের হন না। তার পরও নিয়ম করে মাদ্রাসায় যাওয়ার চেষ্টা করেন।
সাদামাটা জীবনের অধিকারী কারি আবদুল খালিক কখনো সহায়-সম্পদের দিকে আগ্রহী হননি। হাজার হাজার ছাত্রই তার কাছে সাত রাজার ধন। আশির দশক পর্যন্ত তার নিজ গ্রামে কোনো কওমি মাদ্রাসা ছিল না। এমনকি এখনো ওই এলাকার মানুষ কওমি মাদ্রাসাকে ‘খারেজি’ মাদ্রাসা বলে ডাকে। এমন পরিবেশে তিনিই প্রথম মাদ্রাসা হোসাইনিয়া ইসলামিয়া মৌলভীরহাট ও সায়্যিদ আরশাদ মাদানি মাদ্রাসাতুল বানাত নামে দুটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদানি পরিবারের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কারণে সায়্যিদ আসআদ মাদানি (রহ.), সায়্যিদ আরশাদ মাদানি ও সায়্যিদ আসজাদ মাদানিও তাকে ভালোবেসে, দুর্গম এলাকায় অবস্থিত তার প্রতিষ্ঠানে একাধিকবার সফর করেছেন।
১৯৮০ সালে দক্ষিণ চিংড়াখালী গ্রামে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সময় তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত নিজের ভিটেমাটিসহ ঘরটি মাদ্রাসার জন্য ওয়াকফ করে দিয়ে স্ত্রী এবং ছোট ছোট ৬ সন্তানকে নিজের চাচার ঘরে রেখে ঘর খুলে মাদ্রাসার ঘর নির্মাণের জন্য নিয়ে যান। পরবর্তীতে তার শ্বশুর জায়গার দাম পরিশোধ করে নতুন করে ঘর তুলে দেন। সম্পদ বলতে তার এতটুকুই।
কারি আবদুল খালিকের নয় সন্তান। ছয় ছেলে, তিন মেয়ে। বড় ছেলে হাফেজে কোরআন। পরের চারজন মাওলানা। দুই মেয়ের একজন আলেম। দুই জামাতার একজন দারুল উলুম দেওবন্দ পড়–য়া আলেম, অন্যজন মুফতি। তৃতীয় মেয়ে হেফজ শেষ করার পর এবং এক ছেলে ১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করে জান্নাতের মেহমান হয়েছেন। এখন সাত সন্তান নিয়ে তার সংসার। কারি সাহেবের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের মাঝে হাফেজে কোরআন ১০ জন, মাওলানা ৯ জন, (দাওরা শেষ করে) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষা লাভকারী ২ জন। বর্তমানে কারি সাহেবের পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের ১৫ জন মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। কারি আবদুল খালিক শুধু শিক্ষকতাতেই মনোনিবেশ করেননি। সুলুক-তাসাউফের মেহনতও করেছেন। প্রথমে সায়্যিদ আসআদ মাদানি (রহ.) ও পরে সায়্যিদ আরশাদ মাদানির হাতে বায়াত হন। এদিকে আরজাবাদ মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস মুফতি তাজুল ইসলামও তাকে খেলাফত প্রদান করেছেন। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে তিনি বহু বুজুর্গের সান্নিধ্য পেয়েছেন।
ষাটের দশকে পড়াশোনার জন্য পাকিস্তান সফর করেছেন। এ ছাড়া একাধিকবার ভারত সফর করেছেন। পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশে তিনি সৌদি আরবও গমন করেছেন। আজীবন প্রতিবাদী চেতনার কারি আবদুল খালিক ওস্তাদ হিসেবে মোজাহেদে মিল্লাত আল্লামা শামসুদ্দীন কাসেমীর সান্নিধ্য পেয়েছেন। আল্লামা কাসেমীর নেতৃত্বে ইসলামবিরোধী নানাবিধ কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮৬ সালে গুলিস্তানে গোলাপ শাহ মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে তৌহিদি জনতার আন্দোলন চলাকালে তিনি মসজিদের স্থলে খুতবা পাঠের সময় পুলিশের বেয়নেট চার্জে রক্তাক্ত হন।
রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো শিক্ষাচুক্তি না থাকায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তির জন্য দেওবন্দ কর্র্তৃক মনোনীত নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে সত্যায়নপত্র নিতে হয়। বিগত ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সত্যায়নপত্র দাতাদের একজন কারি আবদুল খালিক আসআদী। এ ছাড়া গত চার দশক ধরে বাংলাদেশে সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর পরিবারের সদস্যদের দ্বীনি সফরের ব্যবস্থাপনায় জড়িত।
স্পষ্টবাদী ও আমানতদার হিসেবে যথেষ্ট সুনাম রয়েছে তার। পরিচিত যে কেউ তাকে একবাক্যে দ্বীনের একজন নিঃস্বার্থ খাদেম হিসেবে অভিহিত করেন। নিজের আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতদের অনেকেই তার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। তার মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য পেয়ে অসংখ্য পরিবার স্বাবলম্বী হলেও তিনি ছয় দশক ধরে ঢাকায় বাস করলেও এখনো ভাড়া বাসায় থাকেন। ঢাকায় তার কোনো সহায়-সম্পদ নেই এবং গ্রামেও কোনো ফসলি জমিজমা নেই। সারাজীবন মসজিদন্ডমাদ্রাসা, দ্বীনি সংগঠন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং খতমে নবুওয়ত আন্দোলনের পেছনে নিজের সময়, শ্রম ও মেধা ব্যয় করছেন।
কারি আবদুল খালিকের মতো নিঃস্বার্থ মানুষ এ সময়ে বিরল। ছাত্র অন্তঃপ্রাণ এই দরদি শিক্ষকের স্নেহ, মায়া-মমতা আর ভালোবাসার ফসল হিসেবে দেশের আনাচে-কানাছে ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার আলেম, হাফেজ ও কারি। আলোকিত এক সমাজের দিকপাল তিনি। দোয়া করি, আল্লাহতায়ালা তাকে সুস্থতার সঙ্গে দ্বীনি খেদমতে নিয়োজিত থাকার তওফিক দান করুন। তার স্বপ্নগুলো আলোর মুখ দেখুক।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সময়ের আলোচিত চিত্রনায়িকা নুসরাত ফারিয়া। একাধারে উপস্থাপিকা, নায়িকা এবং সংগীতশিল্পীও। সিনেমার বাইরে তিনটি গান প্রকাশ পেয়েছে তার। সে ধারাবাহিকতায় এবারের ঈদে নতুন গান নিয়ে আসছেন তিনি।
গানের শিরোনাম ‘বুঝি না তো তাই’। বাঁধনের লেখা এ গানটির সংগীতায়োজন করেছেন বলিউড র্যাপার মুমজি স্ট্রেঞ্জার। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ফারিয়া। বাবা যাদবের কোরিওগ্রাফিতে ভিডিওতে অংশ নিয়েছেন ফারিয়া ও মুমজি। আসছে ঈদে উন্মুক্ত হবে গানটি। গানটি প্রকাশ করবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ভেঙ্কটেশ ফিল্মস।
সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে গানটির টিজার, যা দর্শকমহলে প্রশংসা কুড়াচ্ছে। এরমধ্যে সোমবার বিকেলে নিজের ফেসবুকে গান ভিডিওর দৃশ্যের একটি ছবি পোস্ট করেন এ গায়িকা। সেখানে ক্যাপশনে লিখেন, মাই হাইট ইজ ৫' ৩'' বাট অ্যাটিচিউড ৬' ১''।
গানটি প্রসঙ্গে নুসরাত ফারিয়া জানিয়েছিলেন, ‘নতুন এ গানটি বেশ আনন্দের সঙ্গে করেছি। আমার আগের তিনটি গানের মতো এটিও বেশ মজার। আমার বিশ্বাস এটি সবার পছন্দ হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে ‘পটাকা’ গানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ঘরানার গানে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন নুসরাত ফারিয়া। এরপর ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রকাশ পায় ‘আমি চাই থাকতে’ ও ‘হাবিবি’। আসছে ঈদুল ফিতরে এ অভিনেত্রী গায়িকা হিসাবে চতুর্থবার হাজির হচ্ছেন দর্শক শ্রোতাদের সামনে।
দেশে ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি ইন্টারনেট সেবা চালু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। অন্য অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক একই সেবা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সব মোবাইল অপারেটরই দেশের বেশিরভাগ স্থানে ফোরজি সেবা চালু করেছে। আর সে হিসেবেই তারা ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু গ্রাহকরা ফোরজি ইন্টারনেট কিনলেও দেশের অনেক এলাকায় টুজি-থ্রিজি’র সেবা পাচ্ছেন। তারা অপারেটর কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ জানালেও এর সুরাহা হচ্ছে না।
জানা গেছে, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে মোটামুটিভাবে গ্রাহকরা ফোরজি সেবা পাচ্ছেন। তবে এসব এলাকায়ও অনেক সময় ফোরজি থাকে না, থ্রিজিতে নেমে আসে নেটওয়ার্ক। তবে জেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ সময়েই থাকে থ্রিজি। আর মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ সময় সেই থ্রিজিও থাকে না, তখন টুজি নেটওয়ার্কই ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইন্টারনেট প্যাকেজ যথাযথভাবে থাকার পর তা কাজ করে না, বাফারিং হয়। এতে গ্রাহকরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো সারা দেশের ব্যবসা একত্রে হিসাব না করে এলাকাভিত্তিক ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা দেখেন, কোন এলাকায় তাদের গ্রাহক সংখ্যা কত, সেখানে কত সিমে ইন্টারনেট চালু আছে। যদি দেখা যায়, তাদের হিসাব মতে তা সন্তোষজনক আছে তাহলে সেখানে ফোরজি সেবা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বহাল রাখে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টাওয়ার নির্মাণ করে। কিন্তু যদি দেখে সন্তোষজনক গ্রাহক নেই তাহলে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না, এতে সেই এলাকায় ফোরজি পাওয়া যায় না। অথচ শহর এলাকাগুলোতে তারা বেশি ব্যবসা করলেও সেটাকে হিসাবে ধরে না। কিন্তু মফস্বল এলাকা থেকে কল বাবদ প্রয়োজনের বেশি ব্যবসা হলেও তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সমন্বয় করে না।
মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর ফেসবুক পেইজে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অভিযোগ জানান গ্রাহকরা। অভিযোগ অনুযায়ী, অপারেটরদের মধ্যে টেলিটকের নেটওয়ার্কই বেশি দুর্বল। টেলিটকের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে মো. ফয়জুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই, নেটওয়ার্ক পাই না সকাল থেকে। মিরপুর-২ নম্বরে বাসা স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে। আর আমার গ্রামের কথা না হয় বাদ দিলাম।’ আরাফাত আলী লেখেন, ‘২জিবি নেট কিনলে দেড় জিবি নষ্ট হয়। মেয়াদ ১৫ দিন তাও ফুরাতে পারি না। তাহলে বুঝেন নেটওয়ার্ক কত ভালো।’ কার্জন চাকমা লেখেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় ফোরজি নিশ্চিত করুন। আমাদের পার্বত্য এলাকাগুলোতে টেলিটকের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি, কিন্তু শুধু থ্রিজি-টুজিতে সীমাবদ্ধ।’ রাসেল আহমেদ লেখেন, ‘গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাংগা গ্রামে থ্রিজি নেটওয়ার্ক তো নেই-ই। মাঝেমধ্যে টুজি’ও নেই। বুঝুন অবস্থাটা। আমাদের থ্রিজি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করুন।’
টেলিটকের মহাব্যবস্থাপক (সিস্টেম অপারেশন) নুরুল মাবুদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ফাইভজি রেডিনেস প্রজেক্ট শুরু করেছি। যা শেষ হতে এক বছর বা তার কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। এর ফলে আমাদের কাভারেজ এলাকাগুলোতে ফোরজি সেবা নিশ্চিত হবে। এছাড়া আমাদের কাভারেজ বাড়ানোরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে।’
বাংলালিংকের পেজের একটি পোস্টে মাহাদী হাসান তালহা লেখেন, ‘আমার এলাকায় আপনাদের সিম ব্যবহার করতে হলে ফোন গাছের ডালে বেঁধে লাউডস্পিকার দিয়ে কথা বলা লাগে। এত্তো ফাস্ট কেন আপনাদের নেটওয়ার্ক।’ আকরাম হোসাইন লেখেন, ‘ভাই আপনাদের সবই ঠিক, তবে নেটওয়ার্ক সেøা।’
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অফিসার তৈমুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফোরজি সেবার জন্য ২৩০০ মেগাহার্জের স্পেকটার্ম প্রয়োজন হয়। কিন্তু টুজিতে তা লাগে মাত্র ৯০০ মেগাহার্জ। আমরা ইতিমধ্যে ৯৫ শতাংশ কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা নিশ্চিত করেছি। তবে আমাদের আরও বেশি সাইট লাগবে। যদি সব অপারেটর মিলে আমরা টাওয়ার শেয়ার করতে পারি, তাহলে সব গ্রাহকের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে।’
রবির পেজে এক পোস্টে তানভীর আহমেদ লেখেন, ‘কলাপাড়া থানা শহরে যদি থ্রিজি নেটওয়ার্ক না পাওয়া যায়, এরচেয়ে দুঃখজনক কিছুই হতে পারে না।’ এইচএমএম ইসমাঈল লেখেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার চম্পকনগর ইউনিয়নে রবি সিমের থ্রিজি নেই। অথচ অনেক বছর আগে রবি টাওয়ার বসানো হয়েছে। আমরা রবি সিম দিয়ে ইন্টারনেট চালাতে অক্ষম।’
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলটরি অফিসার শাহেদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা রয়েছে। তবে দেখা যায়, অনেক ফোন ফোরজি সাপোর্ট করে না। আর কাভারেজ এলাকা থেকে যতদূরে যাওয়া যাবে, নেটওয়ার্ক তত কমতে থাকবে। এছাড়া আমাদের কিছু জায়গায় নেটওয়ার্কের কাজ চলছে। পাশাপাশি নতুন কিছু টাওয়ার তৈরির কাজও আমাদের চলছে।’
গ্রামীণের পেইজে একটি পোস্টে রহিদুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই আমি যখন গ্রামে যাই তখন নেটওয়ার্কের ঝামেলা হয়।’ সাইদুর রহমান লেখেন, ‘এমন সার্ভিস হলে চলবে? কলরেট, ইন্টারনেটের দাম তো ঠিকই বেশি আপনাদের, বাকি সব অপারেটরদের থেকে।’
গত বছরের ২৮ এপ্রিল টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত ‘আনলিমিটেড’ ও ‘মেয়াদবিহীন’ ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। কারণ এজন্য প্যাকেজের দাম বাড়িয়েছে অপারেটররা। আর মেয়াদহীন ইন্টারনেট পেতে প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একই প্যাকেজ চালু করতে হবে। কিন্তু গ্রাহকের সব সময় একই ধরনের ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে গ্রাহকের কেনা ইন্টারনেট। এছাড়া মেয়াদবিহীন হিসেবে মোবাইল অপারেটররা যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে গ্রাহকদের।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে সচল সিমের সংখ্যা ১৮ কোটি ২০ লাখ ৬১ হাজার। এরমধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার, রবির ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৪ হাজার, বাংলালিংকের ৪ কোটি ৮৫ হাজার এবং টেলিটকের ৬০ লাখ ৬৭ হাজার। আর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫০ লাখ। এরমধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি ও পিএসটিএন)-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ লাখ ৮৭ হাজার গ্রাহক।