
বেশ আগের একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন চিত্রের কথা মনে পড়ে, ‘পানি নিয়ে ভাবনা আর না আর না’। আমরা সবাই জানি পানিই জীবন এবং সেটা আক্ষরিক অর্থেই। কারণ পানি ছাড়া প্রাণের কল্পনা করা যায় না, এটা সম্ভবও না। সুপেয় পানি মানুষ ও মানব সভ্যতার জন্য যারপরনাই দরকারি, যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এর সংকট প্রকট। যেখানে সুপেয় পানি নেই সেখানে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি কল্পনা করা যায় না। সাধারণভাবে পানির উৎস বিবিধ যেমন সাগর, নদী, খাল, বিল ইত্যাদি। আবার ভূগর্ভে হাজার হাজার বছর ধরে সঞ্চিত পানি ব্যবহার করতে কুয়া ও টিউবওয়েল তৈরি করা হয়। আমাদের দেশে ব্যবহার উপযোগী পানির মূল উৎস নদী। প্রধানত হিমালয় অঞ্চল, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও বরাক অববাহিকা থেকে বাহিত পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। আমাদের এই ভূমির একটি বড় অংশ তৈরি নদীবাহিত পলি সঞ্চিত হয়ে। নদীর দ্বারাই সৃষ্টি পৃথিবীর বাংলা নামের এই বৃহত্তম এখনো সক্রিয় ব-দ্বীপ। বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে আটশোর মতো নদী ছিল যাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এবং এই নদীগুলো আমাদের দেশকে মমতায় আগলে রেখে ভূমিকে সজীব ও সবুজ করে রাখছে।
শুধু আমাদের দেশ না, পৃথিবীতে মানবসংস্কৃতির ইতিহাস নদীর তীর ও পানির অববাহিকা ধরে বিবর্তিত ও সমৃদ্ধ। নদী শুধু জলের ধারা বয়ে নিয়ে আসে না অজানা কাল থেকেই নদী যোগাযোগ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও পবিত্রতার ধারণার সঙ্গে যুক্ত। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন গ্রন্থসমূহে নদীকে প্রাণ ও আত্মা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নদী যেখানে পানির প্রবাহের ধারাকে বয়ে নিয়ে চলে এর পাশাপাশি অন্যান্য সুপেয় পানির অন্যান্য উৎস যেমন পুকুর, খাল, বিল, নালাকে সমৃদ্ধ করে পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির প্রাকৃতিক সঞ্চয়ন প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখে। অতিরিক্ত পানি উত্তোলন ও ধারাবাহিক সঞ্চয়ন ব্যাহত হলেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায় এবং মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। আমাদের দেশের পরিবেশের বিবেচনায় কোনো কোনো অঞ্চলে সেই প্রবণতা আমরা ইতিমিধ্যে দেখতে পাচ্ছি, বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পানির উৎস নিয়ে নানা ধরনের সংকট থাকলেও আমাদের দেশের প্রকৃতি যেন দুহাত ভরে দিয়েছে। যেটা এ দেশের মানুষকে যেমন নির্ভার করেছে এবং একইসঙ্গে আমাদের সংস্কৃতিকেও করেছে সমৃদ্ধ। পাশাপাশি আমাদের দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মিষ্টি পানির গুরুত্ব অপরিসীম। এর উৎস কমে গেলে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ে, খাদ্য উৎপাদন কমে যায়। অনেক সময় উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল হয়ে যায়। ইদানীং কোনো কোনো বছর এমনকি আমন ধান উৎপাদনের সময়ও সেচের পানির ব্যবস্থা করতে হয়। অন্যদিকে কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্যদ্রব্যের প্রাপ্তি কমে যায়। অন্যদিকে মৎস চাষ, খামার তৈরি সব কিছুই পানির সহজলভ্যতা ও প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে।
প্রাকৃতির দান যেকোনো বিবেচনায়ই সম্পদ, তবে তা নির্ভর করে এর যথাযথ ব্যবহারের ওপর। প্রাকৃতিক সম্পদের দায়িত্বশীল ও পরিমিত ব্যবহারের মাধ্যমেই টেকসই পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব। তা না হলে প্রকৃতিই ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসবে সময়ে-অসময়ে এবং কারণে-অকারণে। নদীর ক্ষেত্রেও তাই। নদী তখনই সম্পদ যখন এটাকে নদী হিসেবে থাকতে দেওয়া হয়। এর প্রবহমানতা অব্যাহত থাকে, এর পানি মানুষের ও প্রকৃতির জন্য ব্যবহারযোগ্য থাকে, এবং পলি বয়ে নিয়ে আসে নতুন ভূমি গঠনের জন্য। নদীর নিজস্ব যে সত্তা তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনগতভাবে বাংলাদেশে সব নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয় আদালতের রায় অনুযায়ী।
আর এখানেই আমাদের সংকট। নিজস্ব সত্তা হিসেবে নয় নদী, খাল, বিলকে আমরা ড্রেন ও ময়লা আবর্জনার ভাগাড় হিসেবে দেখতে ও ব্যবহার করতে শুরু করেছি। আবার দখলদারদের পাল্লায় পরে সুপেয় পানির উৎস যেমন নদী, খাল, বিল বেদখল হয়ে যায়। মানুষের বর্জ্য, প্লাস্টিক বর্জ্য ও শিল্পের রাসায়নিক নদীর পরিবেশ ও মূল্যবান পানি দূষিত করে দেয়, প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এমনভাবে দূষিত করে যাতে কোনো ধরনের জলজ প্রাণী ও অনুজীব বেঁচে থাকতে পারে না, নিরাপদ ফসল উৎপাদন করা যায় না। যে নদী নিরাপদ পানির আধার না, প্রাণের সঞ্চার করে না, সেই নদী আমাদের জন্য সম্পদ না বরঞ্চ বোঝা। নদী ও পানি যেমন মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই পানির প্রবাহ যখন বন্ধ হয়ে যায় বা দূষিত হয়ে যায় সেটা শুধু মানুষের জীবনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, ক্ষতিগ্রস্ত করে সংস্কৃতি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে। অন্যদিকে নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে দিলে তার প্রকাশ ঘটে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যেমন প্রলয়ঙ্করী বন্যা, খরা, নদীভাঙন ইত্যাদি।
নদীকে শুধু মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় হিসেবে ভাবলেই হবে না। মানুষ নদীর ব্যবহারকারী মাত্র। নদীকে দেখতে হবে প্রকৃতির একটি আবশ্যিক অনুষঙ্গ হিসেবে, যার বিনাশে প্রকৃতির ধ্বংস। আর নদী যখন মানুষের সংস্কৃতির অনুষঙ্গ, এর সঙ্গে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন ধারণ ও জীবিকা যুক্ত তাই নদীর নিরাপদ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার ইস্যুগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নদীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের মাধ্যমে যে অপার সম্ভাবনা তৈরির সুযোগ আছে অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেটাই এখন সুদূরপরাহত। অনেক সময় শুধু আমাদের অসচেনতা ও কিছু মানুষের লোভই এর জন্য দায়ী। পাশাপাশি রয়েছে নদী নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও হঠকারী পরিকল্পনা আর এসবের কারণেই আজ কয়েকটি আন্তঃদেশীয় নদীর প্রবাহ বন্ধ হওয়ার পথে, যেমনটা হয়েছে গঙ্গা ও তিস্তা নদীর ক্ষেত্রে।
নদীর অস্তিত্ব রক্ষায় এর নিজস্ব সত্তাকে স্বীকার করা, এ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা, রাষ্ট্রযন্ত্রকে সক্রিয় করা পাশাপাশি এই অঞ্চলের সমস্ত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে হবে। যাতে কোনোভাবে নদীর প্রবহমানতায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করা হয় এবং কোনোভাবে পানি দূষিত না হয়। আন্তঃদেশীয় নদীর প্রবহমানতা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের পার্শ¦বর্তী দেশগুলোর সঙ্গে দেনদরবার করতে হবে এবং এর সঙ্গে সচেতন মহলকে যুক্ত করতে হবে। কারণ নদীর বিনাশে ভুক্তভোগী নদীর সঙ্গে যুক্ত সব দেশের মানুষ। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই, এসব প্রতিবন্ধকতার কারণেই একের পর এক নদী মরে যাচ্ছে এবং একই সঙ্গে মরে যাচ্ছে এর সত্তা। সূত্রমতে গত অর্ধশত বছরে বাংলাদেশে প্রায় দেড়শতাধিক নদী মরে গেছে এবং নর্দমায় পরিণত হয়েছে অসংখ্য। আর এভাবে যদি একের পর এক নদী নর্দমায় পরিণত হতে থাকে ও মরতে থাকে তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কী হবে, সেই ভাবনা কে ভাববে?
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
ব্যবস্থাপনায় ড. তোফায়েল আহমেদ। স্থানীয় শাসন ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে কুমিল্লা ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আগে শিক্ষকতা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। নির্বাচন কমিশন, ইভিএম মেশিন এবং রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : নির্বাচন কমিশন প্রস্তাবিত দুই লাখ নতুন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনার প্রকল্প স্থগিত হওয়ার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ড. তোফায়েল আহমেদ : কেন স্থগিত হয়েছে, তার কারণটা দেখতে হবে। কারণটা আমাদের কাছে পরিষ্কার জানা নেই।
দেশ রূপান্তর : বলা হচ্ছে তো অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে বাড়তি খরচ কমাতে, কৃচ্ছ্র সাধনের কথা।
ড. তোফায়েল আহমেদ : সেটা ঠিক আছে। এটা ইমিডিয়েট রিজন। যেটা সবাই দেখছে যে, এই পরিস্থিতিতে বাড়তি টাকা জোগাড় করা সরকারের জন্য কঠিন। কিন্তু সরকার যখন ইভিএম কেনার কথা বলছিল, তখনো কিন্তু দেশে টাকার সংকট ছিল। কিন্তু তারা ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট হবে, মেশিন কেনা হবে এমন কথাই বলে আসছিল। প্রথম কথা হচ্ছে- এখন ইমিডিয়েট রিজন যেটা বলছে যে টাকার অভাব সেটা হতে পারে। তবে, আরেকটা হতে পারে যে সরকার হয়তো কৌশলগতভাবে পিছু হটেছে, যেহেতু সবাই এটা চাচ্ছে না। ইভিএমের বিষয়ে ঐকমত্য নেই। কারণ এটার জন্য আবার নির্বাচনে না যাওয়ার মতো রিজন দাঁড় করানো হতে পারে। সুতরাং এক্ষেত্রে সরকার হয়তো কৌশলগতভাবে পিছিয়েছে। আর তৃতীয়ত, ম্যানেজমেন্ট প্রবলেম। কারণ, শুধু টাকা দিলেই তো হবে না। এই যন্ত্রগুলো আনা, সেগুলো ঠিকঠাক করা এবং এম মধ্যে এসব নির্বাচনের জন্য রেডি করা...। এসবে তো অনেক ঝক্কি আছে। সেটা সরকার নিতে চাচ্ছে কি না বা নির্বাচন কমিশনও এটা নিয়ে কতটুকু এগ্রিড, কারণ, পুরো নির্বাচন কমিশনই যে এটাই চাচ্ছিল তা মনে হয়নি। বিশেষ করে সিইসির কথায় এমন মনে হচ্ছিল। সবকিছু মিলিয়ে সময় বলে দেবে এটা কৌশলগত কারণেও হতে পারে আবার ইমিডিয়েট রিজন অর্থের অভাবেও হতে পারে।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু আগামী সংসদ নির্বাচনে সবগুলো আসনেই ইভিএম মেশিন ব্যবহারে বিভিন্ন বিরোধিতা থাকার পরও একরকম একরোখা মনোভাব দেখানো হচ্ছিল। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. তোফায়েল আহমেদ : হ্যাঁ, তবে সিইসি তো সম্ভব হবে না এমন কথাও বলেছেন। কারণ হচ্ছে কি, সরকারের মনোভাবটাই সিইসির মনোভাব। সরকার যেহেতু শক্তভাবে বলেছিল ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট হবে, সেজন্যই ইসিও তখন অন্য কথা ভাবতে চায়নি বা গ্রহণ করতে চায়নি। এখন সরকার তাদের না জানিয়েই এটা স্থগিত করেছে। কারণ তারা তো প্রস্তাব দিয়েছিলই। সরকার ইভিএমের পক্ষে দেখেই তারাও দৃঢ় মত দেখিয়েছে এবং প্রস্তাবও দিয়েছে। সরকারের বাইরে নির্বাচন কমিশনের শক্ত কোনো মতামত আছে এটা মনে করার কোনোই কারণ নেই।
দেশ রূপান্তর : নতুন মেশিন কেনার প্রস্তাব স্থগিত ঘোষণার পর সিইসি বলছেন পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাপ্যতা সাপেক্ষে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট হবে। এতে কি কোন আসনে ইভিএমে আর কোন আসনে ব্যালটে ভোট হবে তা নিয়ে নতুন জটিলতা তৈরি হবে না?
ড. তোফায়েল আহমেদ : হ্যাঁ, এটা নিয়ে একটা নতুন বিতর্ক তৈরি হবে। কারণ বিরোধীদের অনেকেই চাইবে না যে তার আসনে ইভিএমে ভোট হোক। আবার সরকারি দলের কেউ চাইতে পারে যে হোক। বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি, জাতীয় পার্টি তারা তো ইভিএমকে না বলেই দিয়েছে। অন্যরাও একই কথা বলবে হয়তো। তবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে অন্যরকম মনে করি ইভিএমকে, মানে প্রযুক্তিকে টোটালি না করাটা একটা খারাপ বার্তা দেয়। কম্প্রোমাইজড ফর্মুলার যে প্রস্তাবটা আসছিল, তারা সে কাজটা করেনি। এখনে প্রযুক্তিকে ভিলেন বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানে, প্রযুক্তির যে ত্রুটিগুলো আছে, ধরেন, এই যে পেপার ট্রেইল নেই, তারপর আঙুলের ছাপ না মেলা, ভোটদানের মেশিনে দেরি হওয়া প্রভৃতি শুধরে নেওয়ার দরকার ছিল। সেগুলো তারা করেনি। বরং তারা আরও দুই লাখ ইভিএম কেনার প্রস্তাব দিয়ে দিয়েছিল। তো এসব খুব একটা ভালো দৃষ্টিভঙ্গি না আর কি।
দেশ রূপান্তর : হ্যাঁ, ইভিএমে ভোটারকে পেপার ট্রেইল দেওয়ার ব্যাপারটি তো নাগরিক সমাজেরও কেউ কেউ বলেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে ইসি কোনো কথাই বলেনি।
ড. তোফায়েল আহমেদ : এটা নিয়ে কোনো বক্তব্যই পাওয়া যায় না ইসির। কিন্তু মেশিন কেনায় তাদের অনেক আগ্রহ। কিন্তু এসব মেশিন গুদামে মেইনটেন্যান্স ছাড়া পড়ে থেকে নষ্ট হলে তার দায় কে নেবে? আগের কেনা অনেকগুলো মেশিন যে এখন কাজ করছে না, তার দায় তো কেউ নিল না। আবার নতুন মেশিন কেনা হলে সেগুলো যে ওয়ার্কেবল থাকবে তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই। তাছাড়া আবার ত্রুটিপূর্ণ মেশিন আমি কেন কিনব? তাছাড়া মেশিনের দামের প্রশ্নেও অনেকের দ্বিমত আছে। যে দামে এটা কিনছি, সেটাই এই মেশিনের আসল দাম কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফলে অনেকগুলো কন্ট্রাভার্সি রয়ে গিয়েছে। এটার ইভাল্যুয়েশনগুলো হয়নি। মানে আগে যে মেশিনগুলো কিনেছি এবং সেগুলোর যে কার্যক্ষমতা সেটার ইভাল্যুয়েশন করে তার ভিত্তিতে যে আমরা নতুন জায়গায় যাব সে পরিস্থিতি তো তৈরি করা হয়নি।
দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি ইভিএমে ভোটগ্রহণকালে কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরায় দেখা গেল যে ভোটবুথে আগে থেকে অবস্থান করা বহিরাগত ভোট দিয়ে দিচ্ছে। ঢাকা থেকে এ দৃশ্য দেখে ভোটও বাতিল করা হয়েছিল। তো ভোটকেন্দ্র কি সিসি ক্যামেরা রাখা উচিত?
ড. তোফায়েল আহমেদ : আপনার দেশে যেহেতু মানুষ এভাবে ভোট সেন্টারে অনুপ্রবেশ করে ভোট দিয়ে দিচ্ছে এমন ইতিহাস আছে, সেহেতু এসব শনাক্তের জন্য অবস্থা বিবেচনায় সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের দরকার আছে। এখানে অনেক ক্ষেত্রে ইভিএম মেশিন নিয়ে যে প্রশ্নগুলো উঠেছে তার বেশিরভাগ প্রশ্নই কিন্তু মেশিনের এফিশিয়েন্সি নিয়ে না। মেশিনের দক্ষতা নিয়ে না। এটা হচ্ছে ভোটকেন্দ্রের ম্যানেজমেন্টের সমস্যা। ভোটকেন্দ্রে মেশিনে ভোটার শনাক্ত হওয়ার পরে অবাঞ্ছিত মানুষ ঢুকে তারা বাটন টিপে দিচ্ছে অথবা ভোটারকে নির্দেশ দিচ্ছে যে এখানে ভোট দাও। এগুলো তো গুরুতর অপরাধ। এখানে মেশিনের প্রশ্নের চেয়ে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে, রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই প্রশ্ন কেন কাজ করছে না যে ভোটকেন্দ্রে তো অবাঞ্ছিত কেউ ঢুকতে পারবে না। এটাকে উৎসাহ না দেওয়া বা এটার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে কোনো ঐকমত্য দেখা যায় না। বিশেষ করে রুলিং পার্টির মধ্যে। অপজিশন এবং অন্যদের ভয়টা তো এখানে। প্রশাসন, পুলিশ এবং দলীয় কর্মীরা একসঙ্গে হয়ে যখন রিগিং করে তখন মেশিন কিংবা নো মেশিন কোনো কিছুই কাজে আসছে না। এগুলো সবই মিস ম্যানেজমেন্ট। অনিয়ম করেই করা হচ্ছে। এবং জানাশোনার মধ্যে, ইচ্ছেকৃতভাবেই এসব হচ্ছে। প্রবলেম তো ওখানে, মেশিনে তো এত প্রবলেম দেখি না। প্রথম সমস্যা হচ্ছে ভোটকেন্দ্র ব্যবস্থাপনায়, ম্যানেজমেন্টে।
দেশ রূপান্তর : এটা কি কেবল ইসির ওপর নির্ভর করে? রাজনৈতিক সদিচ্ছা বা সংস্কৃতির ভূমিকা কতটা?
ড. তোফায়েল আহমেদ : রাজনৈতিক সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে হবে না। প্রশাসন কেন এমন করবে, পুলিশ কেন এর সঙ্গে যুক্ত হবে? আর ইসি-ইবা কেন চোখ বন্ধ করে থাকবে? রাজনৈতিক দল এটা করতে চাইবে। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট যখন ঠিক থাকবে তখন তারা এটা করতে পারবে না। একটা ভোট বাতিল হয়ে গেল না? এই জাতীয় জিনিস, দৃষ্টান্তগুলো তাদের ইন্সট্যান্ট ক্রিয়েট করতে হবে তো। কিন্তু আপনি যদি বলেন, আমি দেখিনি, আমাকে কেউ অভিযোগ করেনি এটা তো কোনো কথা না। তার মানে আপনি সব জানেন এবং আপনি এটা অ্যালাউ করেছেন। সমস্যাটা এখানেই।
দেশ রূপান্তর : বলা হয়ে থাকে বা আইন অনুযায়ী তো নির্বাচনকালীন প্রশাসন ইসির হাতে...
ড. তোফায়েল আহমেদ : এগুলো তো সব কথার কথা হিসেবে বলা আছে। হাতে থাকলে তাদের কথা শোনে না কেন?
দেশ রূপান্তর : ইসির তো সেই দৃঢ়তা দেখাতে হবে।
ড. তোফায়েল আহমেদ : হ্যাঁ, কিন্তু তারা যখন ইসির কথা শুনল না তখন কমিশন কী করেছে? এই যে গাইবান্ধার ইলেকশনে ইসির যে ফাইন্ডিংস, তার সঙ্গে সরকারের মানে প্রশাসনের যে ফাইন্ডিংস, তার মধ্যে তো বিরাট পার্থক্য। এখানে কোনো অ্যাকশন হয়েছে? হয়নি তো। যদি অ্যাকশন হতো, তাহলে শুধু নির্বাচন বাতিল করে দিলেই তো সব হবে না। বাতিলের পর কী কারণে এটা বাতিল হলো, কারা রেসপন্সিবল সেটা ফিক্সড করতে হবে। দায়িত্ব কার ছিল আর কে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে সেটা বের করে উপযুক্ত শাস্তির বন্দোবস্ত করতে হবে তো। এটা হলে আর ওই ঘটনার রিপিট হবে না।
দেশ রূপান্তর : নির্বাচনী আইন, আচরণবিধি ভঙ্গে শাস্তির নজির তো মনে পড়ে না।
ড. তোফায়েল আহমেদ : আচরণবিধিটা ধরেন কেবল প্রার্থীর জন্য। কিন্তু নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে কেউ, সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যারা ছিল, ভোট কাস্টিংয়ের দায়িত্বে যারা ছিল, ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব যাদের ছিল তারা তাহলে ফেইল করেছে। তারা দায়িত্বে থাকলে ভোটকেন্দ্রে অবাঞ্ছিত লোক কীভাবে ঢোকে! সিসি ক্যামেরায় কীভাবে শনাক্ত হলো? সিসি ক্যামেরায় যারা শনাক্ত হলো, তাদের কি কেউ অ্যারেস্ট করেছে? শাস্তি দেওয়া হয়েছে? যাদের দায়িত্বে অবহেলায় অবাঞ্ছিত লোক ঢুকল, তাদের কোনো শাস্তি হয়েছে? এটার ফাইন্ডআউট করা হয়নি। এসব হচ্ছে, এ কারণেই হচ্ছে। এবং এটা জেনেবুঝেই করা হচ্ছে।
দেশ রূপান্তর : নতুন ইভিএম কেনা বাতিল, বিরোধীদের সভা-সমাবেশে অপেক্ষাকৃত নমনীয়তা দেখানোর মধ্য দিয়ে কি বিরোধীদের নির্বাচনে আসার আস্থা তৈরি করা হচ্ছে?
ড. তোফায়েল আহমেদ : আপনার প্রশ্নের সঙ্গে আমি একমত না। আপনি কে যে আপনি ছাড় দেবেন, নমনীয়তা দেখাবেন? ধরে রাখবেন, আবার ছাড়বেন, এগুলো কী? এগুলো কি জাতির সঙ্গে তামাশা? মিটিং, মিছিল করার রাইট আছে, করবে। আপনি ছাড় দেওয়ার বা না দেওয়ার কে? এসব বেশিদিন রাখা যায় না। আমি না মানলে আপনি কী করবেন, আমি মিছিল করব। হ্যাঁ, আপনি হয়তো অ্যারেস্ট করবেন। কিন্তু এসব দেশকে একটা সংঘাতের দিকে নিয়ে যায়। একটা দল যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা যখন কতগুলো দাবি করছে এটা র্যাশনালি নিতে হবে। তাদের সব দাবি মানতে হবে তা না। সব দাবি কোনো সময়ই মানা হয় না। কিন্তু একটা মাঝামাঝি অবস্থায় আসতে হবে। অন্যদিকে, তারাও কালকেই সরকারকে ফেলে দিতে হবে, পদত্যাগ করতে হবেএরকম বলছে, যা ঠিক না। আবার সরকার বলছে যে সংবিধানে যা আছে তাই-ই হবে, এই সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। সেটাও ঠিক না। দুই পক্ষকেই ছাড় দিয়ে একটা জায়গায় আসতে হবে। সমাজটাকে, গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য এক জায়গায় আসতে হবে। কোনো কম্প্রোমাইজ হবে না, এমন একরোখা মনোভাব, এটা একদমই ঠিক না, সম্ভব না।
শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় সব ফরম পূরণের ক্ষেত্রে অভিভাবকের জায়গায় বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবককে রাখার নির্দেশ দিয়ে এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। এতদিন অভিভাবকের ক্ষেত্রে শুধু বাবার নাম দেওয়ার সুযোগ ছিল। এ রায়ের ফলে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মাকেও স্বীকৃতি দিয়েছে হাইকোর্ট।
হাইকোর্ট রায়ে বলেছে, পিতৃপরিচয়হীন সন্তান, যৌনকর্মীদের সন্তান যাদের বাবার পরিচয় নেই তারা শুধু মায়ের নাম দিয়েই ফরম পূরণ করতে পারবেন। হাইকোর্ট রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, সংবিধান সবাইকে সমান অধিকার দিয়েছে। শুধু বাবার নাম না থাকলে একজন শিশু ফরম পূরণ করতে পারবে না, পাসপোর্ট পাবে না এটা ঠিক না। এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে সমতার কারণে বাবা অথবা মায়ের পরিচয় থাকলেই যেকোনো ফরম পূরণ বা রেজিস্ট্রেশন পূরণ করার অধিকার পাবে। এই রায়ের ফলে বাবা-মা উভয়ের নাম লেখার বাধ্যবাধকতা থাকল না। শুধু মায়ের নাম লিখেও ফরম পূরণ করা যাবে। পরীক্ষা ও পাসপোর্টসহ সব ফরম পূরণে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম লেখা যাবে।
এই রায়ের প্রেক্ষাপট বেশ পুরনো। ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগে শিক্ষার্থী তথ্য ফরমে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে বাবার নাম পূরণ করতে না পারার কারণে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঠাকুরগাঁওয়ের এক তরুণীকে প্রবেশপত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায়। মা ও সন্তানকে কোনোরূপ স্বীকৃতি না দিয়ে বাবা চলে যাওয়ার পর ওই তরুণী তার মায়ের একার আদর-স্নেহে বড় হয়েছেন। পরে এ ঘটনার যথাযথ অনুসন্ধানের ওপর প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এবং সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মায়ের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২০০৯ সালের ২ আগস্ট তিনটি মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনবাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও নারীপক্ষ যৌথভাবে জনস্বার্থে একটি রিট দায়ের করে। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৩ আগস্ট বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহম্মেদ এবং বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ মানবাধিকার, সমতার পরিপন্থী ও বিশেষভাবে শিক্ষার অধিকারে প্রবেশগম্যতার বাধাস্বরূপ বিদ্যমান বৈষম্যমূলক এ বিধানকে কেন আইনের পরিপন্থী এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না এ মর্মে রুল জারি করে।
এরপর প্রায় এক যুগ চলে গেছে। আইনি প্রক্রিয়ার নানা ধাপ পেরিয়ে অবশেষে পরীক্ষা ও পাসপোর্টসহ সব ফরম পূরণে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম লেখার স্বীকৃতি এলো। এই রায়টি নানা দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে বাবাই ছিলেন সর্বেসর্বা। প্রচলিত ধ্যান-ধারণা নারীকে অভিভাবক হিসেবে দেখতে বা মানতে নারাজ। তাইতো সব ধরনের নথিপত্রেও দীর্ঘদিন ধরে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে শুধু বাবার নাম লেখার রীতি ছিল। ১৯৯৮ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবসে কোনো ব্যক্তির পরিচিতির ক্ষেত্রে বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম উল্লেখ রাখতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মায়ের নাম লেখার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন এবং ২০০০ সালের ২৭ আগস্ট এই বিধান কার্যকর হয়।
কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, নানা পারিবারিক ও সামাজিক কারণে মানুষের ব্যক্তিগত সংকট বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা। এতে করে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে শিশুরা। এখনো আমাদের প্রচলিত আইনে মা শুধু সন্তানের জিম্মাদার, অভিভাবক নন! বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাকে সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্বের জন্য আইনি লড়াই করতে হয়। মায়ের একক অভিভাবকত্বের আইনি স্বীকৃতি বাংলাদেশে এখনো অধরাই রয়ে গেছে। অভিভাবক ও প্রতিপাদ্য আইন অনুসারে, ১৮ বছরের কম বয়সী সন্তানকে নাবালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে শিশুর হেফাজত ও অভিভাবকত্ব মুসলিম শরিয়া আইন, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এবং অভিভাবক এবং প্রতিপালন আইন, ১৮৯০ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এসব আইন ও বিধির কোনোটিতেই মাকে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। যে মা তার জীবনের সব শখ ও স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে লড়াই করতে থাকেন, তাকে বিবাহবিচ্ছেদের পর আদালত অভিভাবকত্ব দেয় না, দেয় জিম্মাদারি। বাংলাদেশ অভিভাবক এবং প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০-এর ১৭ [ক] ধারা অনুযায়ী নাবালক সন্তানের জিম্মাদার করা হয়েছে মাকে আর বাবাকে অভিভাবক। ছেলেসন্তান ৭ বছর পর্যন্ত আর মেয়েসন্তান বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকবে। এমনকি আমাদের দেশে এখনো যদি কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, তাহলে তাকে নির্যাতনকারী ব্যক্তির সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়, যাতে পরে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে কোনো একজন পুরুষের নাম লেখা যায়। এটা অত্যন্ত জঘন্য এক মানসিকতা। এমন মানসিকতার কারণে পুরুষের লাম্পট্যের সামাজিক স্বীকৃতি মিলে যাচ্ছে।
পৃথিবীর অনেক দেশে ও অনেক ধর্মে কোনো কারণে মা-বাবা আলাদা হয়ে গেলে দুজনকেই অভিভাবক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যেন একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যজন দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কেউ যদি স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ না করতে চান, সেটি তার বিষয়; আর দুজন একসঙ্গে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে তা পারিবারিক বা সামাজিকভাবে আলোচনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায়, যিনি সন্তানের কোনো দায়িত্ব নিলেন না, শুধু কাগজে-কলমে মা অথবা বাবা হয়ে থাকলেন, সে ক্ষেত্রে সন্তান মহাবিপদে পড়ে যায়, উন্নত চিকিৎসা বা শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যেতে চাইলে দুজনেরই সম্মতির প্রয়োজন হয়; আর যদি তাদের একজনকে না পাওয়া যায়, তাহলে দ্বারস্থ হতে হয় আদালতের।
আধুনিক যুগে নারীরা সব ক্ষেত্রে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। এমনকি বিভিন্ন ইসলামিক দেশ কিংবা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নারীরা ভূমিকা পালন করছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে, মহাকাশ মিশনে অংশগ্রহণ করছেন। কিন্তু আইন এখনো নারীদের সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ ও অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে সমানাধিকার দিচ্ছে না। বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানের যৌথ হেফাজত ও অভিভাবকত্বের বিষয়টির আইনগত স্বীকৃতি আছে কিছু দেশে। এই স্বীকৃতি প্রথম মেলে সুইডেনে ১৯৭৬ সালে। এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হচ্ছে, সন্তানের প্রতি বাবা-মা উভয়ের রয়েছে অধিকার। এটা তো অবশ্যই সত্য যে, সাধারণভাবে সন্তানের প্রতি মায়ের পাশাপাশি বাবার স্নেহ-ভালোবাসাও অসীম। পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় সন্তানের যৌথ হেফাজতের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বটে। কিন্তু যদি একক অভিভাবকত্বের প্রশ্ন চলেই আসে, তাহলে উন্নত বিশ্বে বাবার আগে মাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বাংলাদেশে যেমন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাকে সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্বের জন্য আইনি লড়াই করতে হয়, ঠিক উলটোভাবে পশ্চিমা দেশগুলোতে বাবাকে এমন অধিকারের দাবিতে আদালতে ঘুরতে হয়।
অভিভাবক হওয়ার অধিকার যদি মা-বাবার সমান থাকত, তাহলে কোনো একজন অভিভাবক মারা গেলে বা পালিয়ে গেলে অন্য একজন সহজে দায়িত্ব নিতে পারতেন। বাস্তবতা বিবেচনায় ও সময়ে দাবি অনুযায়ী অভিভাবকত্বের সেকেলে আইন বদলে ফেলার সময় এসেছে। মনে রাখা দরকার যে, মা শুধু জন্মদাত্রী নন, পালন-পোষণ, দায়িত্ব গ্রহণ, সব ব্যাপারে সন্তানের সঙ্গে তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকেন। তাই অভিভাবক হিসেবে তারই নাম প্রথমে থাকা উচিত। যতই আমরা, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’ বলি, অভিভাবক হিসেবে তাকে সামাজিক ও আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত চেষ্টা দেখা যায় না।
মহামান্য হাইকোর্ট সব পরিস্থিতিতে অভিভাবক হিসেবে মায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার রায় দিয়েছে। এখন দরকার সমাজ-মানস পরিবর্তন করা। আমাদের দেশে নারীর কর্র্তৃত্ব, নেতৃত্ব, অধিকার, অভিভাবকত্বকে সামাজিকভাবে মেনে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। সমাজে পুরুষতন্ত্রান্ত্রিক চিন্তাভাবনা এখনো ছড়ি ঘুরিয়ে চলছে। সমাজের সবখানে ‘অভিভাবকত্ব’ ও ‘পৌরুষ’ আজও একই হুঁকোর নল নিয়ে টানাটানি করছে। এই অবস্থার আশু পরিবর্তন দরকার। স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং শিক্ষা বা কর্মজীবনে যেখানেই দরকার, মায়ের নাম অভিভাবক হিসেবে প্রথমেই রাখতে হবে। ‘অভিভাবক’ কে? যিনি ব্যক্তি বা সম্পত্তির যতœ নিতে পারেন, নিরাপত্তা বিধান করতে পারেন। মা যদি সেই কাজে পারঙ্গম হন, তবুও তাকে কেন ‘অভিভাবক’ মানা হবে না?
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
আত্মহত্যা, আত্মহত্যার চেষ্টা, প্রবণতা বা চিন্তাভাবনা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। এটি সরাসরি কোনো মানসিক রোগ না হলেও বেশ কিছু মানসিক রোগের শক্তিশালী উপসর্গ। ফলে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যার আগে নিজের সম্পর্কে, অন্যের সম্পর্কে বা পৃথিবী সম্পর্কে যেভাবে চিন্তাভাবনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সেটি সবসময় যৌক্তিক বা পূর্ণাঙ্গ চিত্র নাও হতে পারে। কোনো একটি পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক, সেই পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এক বা একাধিক বিকল্প থাকে। কিন্তু মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত ও বিপর্যস্ত অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্কের আবেগীয় অঞ্চল যতটা উদ্দীপ্ত থাকে, যৌক্তিক অঞ্চল ততটাই নিষ্ক্রিয় থাকে। ফলে সেই মুহূর্তে মানুষ সমস্যা সমাধানের যৌক্তিক ও সহায়ক রাস্তাগুলো দেখার বা আবিষ্কার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে এবং মস্তিষ্কের আবেগীয় অঞ্চল দ্বারা তাড়িত হয়ে এলোমেলো কিংবা জীবন বিপন্নকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন আত্মহত্যা প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন বা তুচ্ছ করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। বিচ্ছিন্নতার এ শহরে লাভ নেই মৃত্যুর পর সামাজিক মাধ্যমে নানা মন্তব্য আর জ্ঞানগর্ভ কথা বলে। বরং আত্মহত্যার মতো ঘটনাগুলোর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করে ফলপ্রসূ সমাধান প্রয়োজন। কারণ প্রতিটি প্রাণই অমূল্য এবং দেশের সম্পদ এই বিবেচনা করে সেই প্রাণের রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
শনিবার দেশ রূপান্তরের ‘মাসে ৪৪ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা’ প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, পরিবারের সঙ্গে অভিমান, প্রেমের সম্পর্কে টানাপড়েন, পারিবারিক কলহ, ইভটিজিং ও যৌন হয়রানি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলছে। এ ছাড়া আপত্তিকর ছবি ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া, গেম খেলতে বাধা দেওয়া, পরীক্ষায় অকৃতকার্য, মোবাইল ফোন ও মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়াসহ পড়াশোনার চাপ অনুভব করায় কোনো কোনো শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। ২০২২ সালের সারা দেশে ৪৪৬ জন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। গড় হিসাবে যা দাঁড়ায় প্রতি মাসে প্রায় ৪৪.৩৩ জন। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তৈরি করা এক সমীক্ষার এমন তথ্য উঠে এসেছে। এই সমীক্ষামতে, মোট আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী ৬৩ দশমিক ৯০ শতাংশ। দেশের আটটি বিভাগে স্কুল ও কলেজপড়–য়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ঢাকা বিভাগে ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এরপর চট্টগ্রামে ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, রাজশাহীতে ১৬ দশমিক ৮১ শতাংশ, খুলনায় ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ, রংপুরে ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ, বরিশালে ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৬ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং সিলেটে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং জরিপের তথ্যানুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী সবচেয়ে বেশি ৪০৫ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। যা মোট আত্মহত্যাকারীর ৭৬ দশমিক ১২ শতাংশ। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয় বলেই এ বয়সে আত্মহত্যার হার বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এছাড়া পারিবারিক মান-অভিমান তাদের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে। ২৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ স্কুল ও কলেজশিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে অভিমান করে। এদের বড় অংশেরই অভিমান হয়েছে পরিবারের সঙ্গে। খেয়াল করা দরকার, শিশু-কিশোরদের মন সাধারণত ভঙ্গুর প্রকৃতির হয়। এ বয়সে ছোট ছোট বিষয় তাদের আন্দোলিত করে। বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক বিকাশের সঙ্গে অনেকেই খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে তাদের প্রত্যাশার ক্ষেত্রে ছোটখাটো ঘাটতিও তাদের আত্মহত্যার মতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা বলছেন, বয়ঃসন্ধিকালের সময়টি পার করা কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের যতœ এবং সচেতনতা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা মোকাবিলায় সংস্থাটি শিক্ষার্থীদের হতাশা, একাকিত্ব ও নেতিবাচক ভাবনা থেকে দূরে রাখতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি করা, মানসিক বিকাশ এবং তাদের সহানুভূতির সঙ্গে শুনতে ও বুঝতে অভিভাবকদের জন্য প্যারেন্টিং কার্যক্রম চালু করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের আচরণ ও পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কৌশলী ও সহানুভূতিশীল হতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবারের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে ও দায় বৃদ্ধিতে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতার অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
কবি, ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। পৈতৃক নিবাস মাদারীপুর। আইনজীবী বাবা রাজকুমার সেনগুপ্তের কর্মস্থল ছিল নোয়াখালীতে। অচিন্ত্যকুমার ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৬ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি কলকাতায় বড় ভাই জিতেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের কাছে চলে যান। আশুতোষ কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ বিএ পাসের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ও ল’ পাস করেন। অস্থায়ী মুন্সেফ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে সাবজজ, জেলা জজ ও ল’ কমিশনের স্পেশাল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পর কল্লোল যুগের যেসব লেখক সাহিত্য জগতে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেন, অচিন্ত্যকুমার তাদের অন্যতম। ১৯২১ সালে প্রবাসী পত্রিকায় ‘নীহারিকা দেবী’ ছদ্মনামে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। প্রথম উপন্যাস ‘বেদে’। তার গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৭০। ১৯২৫ সালে তিনি কল্লোল পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্ব নেন। তার স্মৃতিচারণামূলক রচনা ‘কল্লোল যুগ’ বেশ সাড়া জাগায়। সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ‘জগত্তারিণী পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার’ ও ‘শরৎচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ জানুয়ারি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত মৃত্যুবরণ করেন।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় ব্যবসায়ীদের। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেনাপোল, হিলি ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে গত সোমবার থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। ট্রান্সপোর্ট খরচ, ট্যাক্স পরিশোধ ও লেবার খরচসহ আমদানিকরদের হাতে ভারতীয় পেঁয়াজের মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৭ টাকা। যা ভারতের বাজারে ১৪-১৫ রুপি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে এখানেও মধ্যস্বত্বভোগীর কারসাজি রয়েছে। দেশি পেঁয়াজের মতো কয়েক হাত ঘুরে অস্বাভাবিক দামে ২৭ টাকার পেঁয়াজ পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৫৬-৬০ টাকায়। তবে আমদানি করা পেঁয়াজ এখনো খুচরা বাজারে পৌঁছায়নি।
গতকাল মঙ্গলবার কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সোমবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। প্রথম দিনে ২ লাখ ৮০ হাজার ৮০০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। গতকাল দ্বিতীয় দিন শেষে আইপি বা আমদানি অনুমোদনের পরিমাণ ৪ লাখ ৩৩ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে।
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন। চলতি বছর পেঁয়াজের নিট উৎপাদন ধরা হচ্ছে ২৪ লাখ ৫৩ হাজার টন। ফলে বাকি পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৬৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল। গতকাল কৃষি মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এদিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থলবন্দর হয়ে ১ হাজার ২৮৮ টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে।
চলতি বছর পেঁয়াজের দর রোজার ঈদের পর থেকেই বাড়তে শুরু করেছিল। এক মাসের ব্যবধানে তা ৩০ থেকে ৮০ টাকায় উঠে যায়। গত কয়েক দিন ধরে ১০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছিল।
কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে এতদিন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি কৃষি মন্ত্রণালয় না দিলেও পরিস্থিতি দেখে রবিবার সায় দেয়। পরদিনই পাইকারি বাজারে এর প্রভাব দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় পেঁয়াজ আসা শুরু হলে পাইকারিতে দাম কমে যায় এক ধাক্কায় ৩০ টাকা। প্রতি কেজি পেঁয়াজের খুচরা মূল্য এখন ৪৫ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় বলে সরকার মনে করে। আর প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে যে পেঁয়াজ দেশে এসেছে, সেগুলো কেনা প্রতি কেজি ২১ থেকে ২২ টাকার মধ্যে ছিল বলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সব খরচ মিলিয়ে বন্দর পর্যন্ত প্রতি কেজি পেঁয়াজের ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ২৭ টাকায়। আমদানিকারকরা কেজিপ্রতি ২ টাকা লাভে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ২৯ টাকায় বিক্রি করছেন। স্থানীয়রা আরও ৫ টাকা লাভে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ঢাকার পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন ৩৪ টাকায়। ঢাকার পাইকাররা শ্যামবাজারে সেই পেঁয়াজ বিক্রি করেন ৫০-৫৬ টাকায়। শ্যামবাজার ব্যবসায়ীর হাতবদল হয়ে কারওয়ান বাজার পাইকারি মার্কেটে এসে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা করে।
ভোমরা স্থলবন্দরের আমদানিকারক আমির হামজা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভারতীয় বাজার থেকে ১৪-১৫ রুপিতে কিনে সব খরচসহ বন্দর পর্যন্ত প্রতি কেজি পেঁয়াজের মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৭ টাকা। কেজিতে ২ টাকা লাভে ভোমরা স্থলবন্দরের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ২৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
হিলির বন্দর এলাকার আরেক ব্যবসায়ী আহমেদ আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মূলত আমদানিকারকদের থেকে আমরা পেঁয়াজ কিনে থাকি। আমাদের কাছ থেকে ঢাকার ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ সংগ্রহ করেন। কেজিপ্রতি ৩১-৩২ টাকা আমাদের কেনা পড়ে। ঘরভাড়া, লেবার খরচসহ প্রতি কেজি পেঁয়াজে সামান্য লাভ করে ৩৪-৩৫ টাকা বিক্রি করতে হয়। এর নিচে বিক্রি করলে আমাদের ৭০-৮০ পয়সার মতো লোকসান হয়।’
গতকাল রাজধানীর শ্যামবাজার ঘুরে দেখা যায়, ভারত থেকে আসা পেঁয়াজ বাছাই করে দুই ভাগে বিক্রি করছেন শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরা। আকারে কিছুটা ছোট পেঁয়াজের কেজি ৪০-৪৫ ও ভালো মানের পেঁঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৬ টাকায়।
শ্যামবাজারের মেসার্স নিউ সেবা এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার শেখর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আজই (গতকাল) আমদানি করা পেঁয়াজের চালান শ্যামবাজারে এসেছে। হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী ভারতীয় পেঁয়াজ পেলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ী আমদানি করা এসব পেঁয়াজ পাননি। বেশ কিছু পেঁয়াজ ট্রাকে পচে যাওয়ায় দুই ভাগে তা বিক্রি হয়েছে। তুলনামূলক ভালো প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪০-৪৫ ও ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৬ টাকা করে।’
জানতে চাইলে শ্যামবাজার পেঁয়াজ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মোহাম্মদ মাজেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে ভারতের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৩-১৫ রুপিতে। সেই হিসাবে সব খরচ মিলিয়ে আমাদের দেশের পাইকারি বাজারগুলোতে ৩৫-৩৬ টাকায় ভোক্তারা কিনতে পারবেন। তবে এ পেঁয়াজ কেন ৫০ টাকার ওপর বিক্রি হচ্ছে সে বিষয়ে আমার জানা নেই।’
এদিকে ভারত থেকে আসা প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬০ টাকা করে বিক্রি করতে দেখা গেছে কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের। পেঁয়াজ ব্যবসায়ী ময়না মিঞা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভারতীয় পেঁয়াজ দেশের বাজারে আসায় আমাদের অনেক লস হয়েছে। আগের কেনা দেশি পেঁয়াজের কেজিপ্রতি ২০-২৫ টাকা করে লস দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে আমদানি করা যেসব পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে, তা শ্যামবাজার থেকে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। মার্কেটে ক্রেতা না থাকায় সব খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজিতে ২ টাকা লাভ করতেও এখন কষ্ট হচ্ছে।’
এদিকে খুচরা বাজারগুলোতে খবর নিয়ে জানা যায়, এখনো ভারত থেকে আসা আমদানি করা পেঁয়াজ খুচরা বাজারে প্রবেশ করেনি। আমদানি করা পেঁয়াজ খুচরা বাজারে না এলেও দেশি পেঁয়াজের দামে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা দরে। যা গত তিন দিন আগেও বিক্রি হয়েছে ১০০-১০৫ টাকায়।
এদিকে ভারতীয় পেঁয়াজ আসায় স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম কমেছে বলে জানান দিনাজপুর ও সাতক্ষীরা প্রতিনিধি। তাদের তথ্যমতে, সোমবার বিকেলে ভোমরা বন্দর দিয়ে ২৮৭ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও ৫০ ট্রাক পেঁয়াজ দেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে।
অন্যদিকে হাকিমপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের হিলি বন্দর দিয়ে গত দুদিনে ১৬ ট্রাক পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা দরে। আর দেশি পেঁয়াজ ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।