
সিনেমাতে ও বাংলাদেশের এনআইডিতে মায়ের চেয়ে ছেলে বড় অবশ্যই সম্ভব।
১০৬টি অ্যাপিসোডে সমাপ্ত আমেরিকার এনবিসি টেলিভিশনের ফ্যামিলি ড্রামা ‘দিস ইজ আস’। পিয়ারসন পরিবারের বড় বড় তিনটি সন্তান কেভিন, কেইট এবং র্যান্ডেল; তাদের বাবা জ্যাক পিয়ারসন এবং মা রেবেকা পিয়ারসন। রেবেকা আসলে অভিনয় এবং সংগীতে খ্যাত ম্যান্ডি মুর। তার জন্ম ১০ এপ্রিল ১৯৮৪। তার ব্যক্তি জীবনে দুটি ছেলে। ছোটটির জন্ম হয়েছে ২১ অক্টোবর ২০২২। আর সিনেমার ছেলে কেভিন আসলে জাস্টিন হার্টলে, তার জন্ম ২৯ জানুয়ারি ১৯৭৭, মায়ের চেয়ে সাত বছরের বড়। কেইট একটু মোটাসোটা। বাস্তব জীবনে অভিনেত্রী ও গায়ক ক্রিস্টিন মিশেলের জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮০, ক্রিস্টিনও মায়ের চেয়ে ৪ বছরের বড়। আর র্যান্ডেলের প্রকৃত নাম র্যান্ডেল হিল, কালো আমেরিকান, জন্ম ৩০ আগস্ট ১৯৮০; পিয়ার্সন পরিবার তাকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করে। র্যান্ডেলও মায়ের চেয়ে ৪ বছরের বড়।
জন্ম-তারিখ ধরে হিসাব করে দেখুন সিনেমার কেভিন কেইট ও র্যান্ডেল, রেবেকার গর্ভজাত পুত্র, গর্ভজাত কন্যা এবং দত্তক গৃহীত পুত্র তিনজনই মায়ের চেয়ে বয়সে বড়। সোজা কথা সিনেমায়, নাটকে সন্তান মায়ের চেয়ে বেশি বয়স্ক হতেই পারে। সিনেমার মায়ের বা বাবার সঙ্গে সন্তানের বয়সের হাস্যকর ব্যবধান থাকতেই পারে। এজন্যই তো সিনেমা আর নাটক।
‘রাইডিং ইন কারস উইথ বয়স’ সিনেমার মা ড্রু ব্যারিমুরের বয়স ২৬ বছর আর ছেলে অ্যাডাম গার্সিয়ার ২৮। ‘ব্লো’ সিনেমায় অভিনয়ের সময় মা র্যাচেল গ্রিফিথ ৩২ বছর বয়সী ছিলেন আর তার ছেলে জনি ডেপ তখন ৩৭। যখন বিখ্যাত সিনেমা হ্যামলেট মুক্তি পায় তখন হ্যামলেটের ভূমিকায় অভিনয় করা লরেন্স অলিভিয়ার ছিলেন ৪১ আর তার মা ডেনমার্কের রানি এইলিন হার্লের বয়স তখন ৩০ বছর। মাকে ছেলের চেয়ে বড় হতেই হবে সিনেমাতে এই বাধ্যবাধকতা নেই। আর একটি উদাহরণ না দিলেই নয়। ডাক ফাটানো সিনেমা আলেকজান্ডারে মা অ্যাঞ্জেলিনা জোলির ২৯ বছর। এখানে জীববিজ্ঞানের আইন মেনে তার পুত্র কলিন ফ্যারেন মাকে ডিঙাতে চেষ্টা করেননি। তার বয়স ২৮ বছর। মা ও ছেলের বয়সের ব্যবধান ১ বছর। সিনেমায় যতটুকু খোঁজ করেছি তাতে ছেলে মায়ের চেয়ে সর্বোচ্চ ১১ বছরের বড়। গঞ্জিকা সেবন করেই মাকে ছেলের চেয়ে কতটা বড় করা সম্ভব?
শিঙাড়া-সমুচা-চা-চপ সূচকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় যেমন পৃথিবীকে হারিয়ে দিয়েছে, তেমনি হারিয়েছে বয়সের মহামারপ্যাঁচে। রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে তৈরি করা জাতীয় পরিচয়পত্র ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ডে (এনআইডি) ছেলে তার মায়ের চেয়ে ১৩ বছরের বড়। শৈশবে পাকামি করার কারণেই হোক কি অতি স্নেহপ্রবণ হয়ে হোক বাবা-মা ছেলের নাম রেখেছেন পাকু। প্রকৃত বয়স এবং বেশি আই কিউজনিত মানসিক বয়সের কিছু তারতম্য হয়েই থাকে। নিজের প্রকৃত বয়স ৫ বছর বুদ্ধিমত্তা তাকে ১০-এর সমকক্ষ করে দিতে পারে। কোনো বিশেষ গুণের কারণে পাকু নিজেকে ছাড়িয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ভাইবোনদের ছাড়িয়ে এমনকি গর্ভদাত্রী মাকেও ছাড়িয়ে তার চেয়ে ১৩ বছর ৪ মাস এগিয়ে গেলেনতার জবাব দিতে পারে শুধু এনআইডি কর্তৃপক্ষ।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, পাকু দাসের মা রাধারানী দাশের জন্ম ৩ আগস্ট ১৯৬৮। আর তার গর্ভজাত পুত্র পাকু দাশের জন্ম ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড অনুযায়ী ২০ এপ্রিল ১৯৫৫, মায়ের জন্মেরও ১৩ বছর ৩ মাস ১৪ দিন আগে। শুধু যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি বলে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বাংলাদেশের নাম ওঠার আর একটি সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। পাকু দাশ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ২০২২-এর ৩০ অক্টোবর আরও কিছুসংখ্যক কর্মচারীর সঙ্গে তিনি চাকরি হারান। তার চাকরি হারানোর কারণ সরকার বিরোধিতা বা ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়া নয়, এমনকি অবৈধ অনুপস্থিতি বা ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিংসের সুপারিশের কারণেও নয়। চাকরি হারানোর কারণটি অত্যন্ত ন্যায়সংগত সুপার অ্যানুয়েশন। সময়মতো তার এনআইডি চেক করা হলে আরও আগেই তাকে বিদায় হতে হতো। চাকরি করার বিধিবদ্ধ যে চূড়ান্ত বয়স অর্থাৎ ৫৯ তিনি তা পেরিয়ে গেছেন। সুতরাং আর কত! এবার বিদায় নিন। কিন্তু ৫৯ হলোই বা, বিদায় নিতে হবে কেন? বাংলাদেশে কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে চাকরিকাল তো ৬৭ বছর। পাকু দাশ যদি সে রকম পদে অধিষ্ঠিত থাকতেন তাহলেও তাকে আরও আগে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হতো। মায়ের আগে জন্ম নেওয়া পাকু দাশের বেলায় চাকরিচ্যুতি মানে শুধু বেতন হারানো নয়, চাকরির কারণে পাওয়া বাসাটিও হারানো। কিন্তু তাকে দেখলে কি ঊনষাট মানে ষাট ছুঁই ছুঁই মনে হয়। দেখে যা মনে হয় সেটা মেনে নিলেই ঝামেলা চুকে যেত। কিন্তু তা হওয়ার নয়।
এনআইডি পাওয়ার মতো মহাসম্মানজনক ঘটনা তখনো ভারতে ঘটেনি। ভারতে নিম্ন আদালতের একটি মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছায়। শ্যাম কিশোর ঘোষ ভারত কয়লা লিমিটেডের কর্মচারী। শ্যাম কিশোরের দাবি, তার সার্ভিস বইতে বয়স বেশি লেখা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট অনেক বিচার বিবেচনার পর রায় দিয়েছে বানান ভুল সংশোধন করার সুযোগ আছে, কিন্তু চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সার্ভিস রেকর্ডে লিখিত বয়স এমনকি যদি ভুলও হয়ে থাকে সংশোধনের আর সুযোগ নেই। আবেদনকারীকে যত তরুণই মনে হোক না কেন সার্ভিস রেকর্ডের বয়সই তার স্বীকৃত বয়স। বাংলাদেশে অবশ্য কোনো সচিবও নির্ধারিত মেয়াদের চেয়ে বছর দু-এক বেশি চাকরি করার সময় ধরা পড়ে যান। পাকু দাশ ভাগ্যবান, তার ওপর মিডিয়ার আলো পড়েছিল বলে এনআইডি কর্তৃপক্ষ তার বয়স কমিয়ে সংশোধিত এনআইডি ইস্যু করে দিয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও পাকু দাশকে পূর্ব পদে বহাল করেছে। কিন্তু কোন অবস্থায় তাকে মায়ের চেয়ে বড় বানানো হলো, আবার কেমন করে মায়ের চেয়ে ছোট হয়ে গেলেন এ নিয়ে কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি, পেলে ভালো হতো। পাকু দাশের কর্মজীবনে প্রত্যাবর্তনকে অবশ্যই স্বাগত। এ ধরনের পাকু দাশ কেইস আরও থাকার কথা। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও স্থানীয় সরকার সংস্থায় যারা চাকরি করছেন নিঃসন্দেহে সবাই এনআইডিধারী। এনআইডির ভুল সংশোধনেরও সুযোগ রয়েছে। যদি পাকু দাশের বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে তো ১৯৫৫ সালের জন্ম-তারিখ নিয়ে তার চাকরিই পাওয়ার কথা নয়। তিনি কবে চাকরিতে ঢুকেছেন? ২০০০ সালেই তো তার বয়স ৪৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার কথা। এনআইডি এসেছে আরও অনেক পরে সন্দেহ নেই। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রুলিং অনুসরণ করলে চাকরিজীবীর বেলায় আদালতের আদেশ ছাড়া বয়স বাড়ানো কিংবা কমানো কিংবা সংশোধনের সুযোগ নেই। জন্মের প্রকৃত তারিখ যাই হোক বয়সটাকে কমিয়ে রাখার প্রবণতাই বেশি। আমি বাড়িয়ে নেওয়ার বেশ কটা ঘটনার সঙ্গেও পরিচিত। যেসব প্রতিষ্ঠানে পৌষ্যের চাকরি পাওয়ার অগ্রাধিকার রয়েছে, সেখানে পড়াশোনায় অনাগ্রহী ১৬ বছরের ছেলে বা মেয়েকে ১৮ দেখিয়ে বাবার অফিসে ঢুকিয়ে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য স্কুল রেজিস্টারে বয়সটা বেশিই লেখা হয়। আবার দুবছর কম লেখা হলে সরকারি চাকরিতে দুবছর বেশি চাকরি করার সুযোগটাও নেওয়া যায়। দুটোরই কিছু লাভজনক দিক রয়েছে। ভারতে বয়স নিয়ে বেশ কটা মামলার সুনির্দিষ্ট রুলিং রয়েছে। একটি মামলা সুনীল কুমার বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া নামের বানান সংশোধন বিষয়ে, এতে সংশোধিত বানান গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বয়সের কারণে সুনির্দিষ্ট কোনো সুযোগ না পাওয়ার ক্ষোভ থেকে জন্ম নেয় বর্ণবাদের মতো বয়সবাদ (এজিজম)। ১৯৬৯ সালে রবাট নিল বাটলার বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি বৈষম্য বোঝাতে ‘এজিজম’ টার্মটি ব্যবহার করেন। বয়স্করা তরুণদের যে নিপীড়ন করে থাকে তাকেও এজিজম বলা হয়েছে। বয়সের কারণে পক্ষপাত বোঝাতে সর্বদাই যে তরুণ পছন্দনীয় তা নয়, বয়স্কের প্রাধিকার মেলে তবে তা তুলনামূলকভাবে কম। বয়স্করা এখন এমনকি ইউরোপ-আমেরিকাতেও ডিজিটাল এজিজমের শিকার। তরুণরা দক্ষতার সঙ্গে ডিজিটাল যুগে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে, বুড়োরা পারেনি। সুতরাং তারা মার খেয়ে যাচ্ছে। বয়স-বৈষম্যের কথা বেশি শোনা যায় হলিউডেসুন্দরী নায়িকা কিংবা স্মার্ট নায়কের বয়স বেড়ে গেছে, তাদের আর নায়িকা নায়ক ভূমিকায় রাখা যায় না। তিন ধরনের এজিজমের কথা বলা হয়; প্রাতিষ্ঠানিক বয়স-বৈষম্যবাদ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে রাখা; আন্তব্যক্তিক বয়স-বৈষম্যবাদ : সমাজ জীবনে বয়স্করা প্রায়ই বৈষম্যের শিকার হন; আত্মীকৃত বয়স-বৈষম্যবাদ : এতে ব্যক্তি নিজেই বয়স-বৈষম্যবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং নিজের ওপর তা প্রয়োগ করতে থাকেন।
একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনের জন্য বিতর্কিত হেনরি কিসিঞ্জার ২৭ মে ২০২৩ শতবর্ষ পূর্ণ করবেন। ৯৯ বছর বয়সে প্রকাশ করেছেন একটি বহুলালোচিত গ্রন্থ : লিডারশিপ : সিক্স স্টাডিজ ইন ওয়ার্ল্ড লিডারশিপ। বয়স-বৈষম্যবাদ তিনি অবলীলায় ডিঙিয়ে গেছেন। ৮৯ বছর বয়সে সোপোক্লেস রচনা করেছেন ইডিপাস অ্যাট কোলোনাস। ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুর দিনই ভোরে গ্যালিলিও নতুন বৈজ্ঞানিক প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। বেনিয়ামিন ফ্রাঙ্কলিন পাবলিক সার্ভিস থেকে অবসর নেন ৮২ বছর বয়সে। রোলান্ড রেগান ৭০ বছর বয়সে যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, পত্রিকা শিরোনাম করেছিল লাইফ বিগিনস অ্যাট সেভিন্টি। তিনি আরও ৮ বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি সবচেয়ে সফল প্রেসিডেন্টদের একজন। হেনরিক ইবসেন ৭১ বছর বয়সে নাটক লিখেছেন : যখন আমরা মৃতেরা জেগে উঠব; অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস ৯২ বছর বয়সে গ্রিক ভাষা শিখে প্লেটোর রচনাবলি পড়তে শুরু করেন। হোয়াট শি শুড নট জর্জ বার্নার্ড শ লিখেছেন ৯৪ বছর বয়সে। বয়স যখন প্রায় পঁচাশি আইজ্যাক নিউটন রয়াল মিন্টের ওয়ার্ডেনের দায়িত্ব পালন করছেন।
তাদের সবাই নিজ গুণে বয়স-বৈষম্যবাদকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পেরেছেন। ব্রাজিলের ওয়াল্টার অর্থমান একই কোম্পানিতে ৮৪ বছর ৯ দিন চাকরি করে বিশ^রেকর্ড করেছেন, গিনেসের রেকর্ড বইতে তার নাম উঠেছে। তিনি শতবর্ষী। ১৫ বছর বয়সে চাকরিতে ঢুকেছিলেন। বুড়ো বয়স নিয়ে অস্বস্তি বোধ করার কারণ নেই। সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ২০২৫-এ পৃথিবীর ১৮ ভাগ মানুষ সিনিয়র সিটিজেন (৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব)। ২০৩০ নাগাদ এই সংখ্যা ৯৭৪ মিলিয়নে পৌঁছাবে। ওল্ড বয়স এবং ওল্ড গার্লস ক্লাবই হয়ে উঠবে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাব।
গৌরবের ওল্ড বয়েস ক্লাব মায়ের চেয়ে বয়সে বড় একজন পাকু দাশকে ধরে রাখতে পারল না।
লেখক: সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট
প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে দ্রুত পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ আমাদের কর্মসংস্থান ও জীবনপ্রণালীতে ব্যাপক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আবার বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ বৃদ্ধি, অভিবাসন ও জাতিগত সংঘাতের মতো বিষয় পৃথিবীর সমস্যাকে আরও ত্বরানিত করছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনমিতিক সম্ভাবনাকে সম্পদে রূপান্তর করতে প্রয়োজন জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও ইতিবাচক দৃষ্টিসম্পন্ন দূরদর্শী, সংবেদনশীল, অভিযোজনে সক্ষম, মানবিক, বৈশ্বিক এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক।
ওপরের এসব ভাবনা বিবেচনায় নিয়েই বহুল প্রতীক্ষিত নতুন শিক্ষাক্রম এ বছর থেকে দেশব্যাপী পরীক্ষামূলক সংস্করণ বাস্তবায়ন (প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে) শুরু হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে আগামীতে সব শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয় সর্বশেষ ২০১২ সালে। ফলে যুগোপযোগী নতুন শিক্ষাক্রমের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল।
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রধানত তিনটি পরিবর্তন আনা হয়েছে। ১. পাঠ্যবই পরিবর্তন ২. শিখন-শেখানো কৌশল পরিবর্তন ৩. মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন। নতুন শিক্ষাক্রমের দার্শনিক ভিত্তি হলো ডেভিড কোব-এর অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন। মূলত শিক্ষার্থীরা চারটি ধাপের মাধ্যমে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখবে। ডেভিড কোব-Learning is the process whereby knowledge is created through the transformation of experience (1984). ডেভিড কোব-এর শিখন-শেখানো কৌশলের চারটি ধাপ হলো যথাক্রমে: ১. প্রেক্ষাপটনির্ভর অভিজ্ঞতা ২. প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ ৩. বিমূর্ত ধারণায়ন এবং ৪. সক্রিয় পরীক্ষণ। ডেভিড কোব-এর অভিজ্ঞতানির্ভর শিখন মূলত আরেক দার্শনিক পেঁয়াজের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যেখানে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে পারস্পরিক মিথস্ত্রিয়ার মাধ্যমে জ্ঞানলাভ করবে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ও বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এই নতুন শিক্ষাক্রম খুবই কার্যকর ও সময়োপযোগী। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে অভিনব পদ্ধতি সংযোজন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে তিনভাবে। যথা: ১. শিখনকালীন মূল্যায়ন (সারা বছর ধরে চলবে) ২. সামষ্টিক মূল্যায়ন (বছরে দুইবার) ৩. আচরণিক মূল্যায়ন। নতুন শিক্ষাক্রমের ১০টি বিষয়ের মধ্যে ৫টি বিষয়ের (বাংলা, গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান) মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন ও সামষ্টিকভাবে। বাকি ৫টি বিষয়ের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন (বিদ্যালয় পর্যায়ে)।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়ার কোনো দরকার নেই। অবশ্যই নতুন বই হাতে পেয়ে শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে বুঝে গেছে কোচিং বা প্রাইভেট পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। গাইড বই বা অন্য কোনো সহায়ক বইয়েরও দরকার নেই। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও নতুন শিক্ষাক্রমের উপজেলা পর্যায়ের মাস্টার ট্রেনার (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান) হিসেবে বলতে পারি, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির পাঠ চলাকালীন শিক্ষার্থীদের এত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও আনন্দঘন পরিবেশ আগে কখনো লক্ষ করা যায়নি।
নতুন শিক্ষাক্রমের পড়াশোনা পুরোপুরি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে বিভিন্ন শিখন কৌশল ও শিখন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যোগ্যতা অর্জন করবে। যোগ্যতাভিত্তিক এই শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই বিভিন্ন সেশন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সহায়িকা (ঞএ) রাখা হয়েছে। শিক্ষকমন্ডলী এই শিক্ষক সহায়িকা দেখে পড়াবেন। শিক্ষক সহায়িকার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আশা করা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এই নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে বিশ^নাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা বলছে যে, শিক্ষকদের গুরুত্ব প্রদানের বিষয়টি এখনো হয়তো সবার মনোযোগের কেন্দ্রে নেই। তাই হয়তো আমার এক সহকর্মী কৌতুক করে বলছিলেন ‘বুঝলাম, নতুন শিক্ষাক্রম বিশ^মানের। তবে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কোন মানের?’
সে যাই হোক, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু ভুলত্রুটি (বানান, তত্ত্ব ও লাইনের অসংগতি) চোখে পড়েছে। আমি ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির নতুন বইয়ে বেশ কিছু পৃষ্ঠায় বানান ভুল চোখে পড়েছে। যা গ্রহণযোগ্য ছিল না। কেননা মাধ্যমিক পর্যায়ের লাখ লাখ শিক্ষার্থী এই ভুল দেখছে ও পড়ছে (যদিও শিক্ষকরা নিজে থেকে ক্লাসে ভুল সংশোধন করে দিচ্ছেন)। এটা ঠিক, নতুন বই মূলত ‘পরীক্ষামূলক সংস্করণ’।
পাঠ্যবইয়ের ভুলত্রুটি অবশ্যই সংশোধনযোগ্য। নতুন পাঠ্যবইয়ের সামান্য ভুলত্রুটি বা অসংগতি নিয়ে যারা বা যেসব মহল তিলকে তাল করছে তারা সঠিক কাজ করছে না। গঠনমূলক সমালোচনা সব পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য। নতুন শিক্ষাক্রম মূলত পুরো জাতির জন্য। সামান্য ভুলত্রুটি থাকলে সেটা গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে অবশ্যই সংশোধনযোগ্য। কেননা শিক্ষাক্রমের নতুন প্রতিটি বইয়ের শুরুতে ‘প্রসঙ্গ কথা’য় লেখা রয়েছে পরীক্ষামূলক এই সংস্করণের কোনো ভুল বা অসংগতি কারও চোখে পড়লে এবং এর মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কোনো পরামর্শ থাকলে তা জানানোর জন্য সবার প্রতি বিনীত অনুরোধ রইল।
আশা করি, নতুন শিক্ষাক্রমের ভুলত্রুটি নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি কর্তৃপক্ষ থেকে সংশোধনী আসবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় জীবন-জীবিকার যেমন সংকট থাকবে না তেমনি অভিযোজনের মাধ্যমে টেকসই ও নিরাপদ পৃথিবী গড়া সম্ভব হবে।
লেখক : শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী
‘দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো কম্প্রোমাইজ করব না’অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে গত বছরের শুরুতে দায়িত্বে অভিষেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর। এক বছরের মাথায় এসে ঘোষণা : ‘দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকরা ক্যানসারের মতো, ক্যানসার আক্রান্ত অঙ্গ যেমন কেটে ফেলা হয়, তেমনি দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকদের ছেঁটে ফেলা হবে’।
অভিষেকের সময় প্রধান বিচারপতির করা আশাজাগানিয়া ওই অঙ্গীকারের কোনো খেলাপ এখনো হয়নি। অথবা চেষ্টায় কমতি ঘটেছে বা হাল ছেড়ে দিয়েছেন এমনও নয়। অবিরাম তার নানা নির্দেশনা-আহ্বানের কিছু কিছু গণমাধ্যমেও আসছে। কোনো অনুষ্ঠানে রাখা বক্তব্যের খবরগুলোই সচরাচর প্রকাশ পায়। এ ছাড়া ইনডোরেও সুষ্ঠু বিচারের তাগিদ দিচ্ছেন নিয়মিত। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় বলা কথাবার্তার মধ্যে স্বল্প খরচ ও সময়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, আইনজীবীদের সপ্তাহে অন্তত এক দিন বিনাপয়সায় মামলায় লড়ার আহ্বান মানুষকে আশাবাদী করেছে। বিবেকবানদের দৃষ্টি কেড়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির শত বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের কয়েকটি বক্তব্য আরও তাৎপর্যপূর্ণ।
দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিতের তাগিদ দিতে গিয়ে তিনি কিছু উষ্মার কথা বলেছেন। বছরের পর বছর মাসের পর মাস মানুষ আদালতে ঘুরতে থাকলে আদালতের প্রতি অনাস্থার জন্য দায়ী হবে কে? প্রশ্নটি ছুড়ে জবাবে বলেছেন, দায়ী হবে সিস্টেম, দায়ী হবেন আইনজীবী, দায়ী থাকবেন বিচারক। কিছুদিন আগেও এক বক্তৃতায় তার প্রশ্ন ছিলএকটি কেইস ৩০ বছর ধরে চললে মানুষের কেন আস্থা থাকবে? চাঁপাইনবাবগঞ্জের বক্তৃতায় কোনো বিচারকের প্রতি অভিযোগ থাকলে সরাসরি তার কাছে অভিযোগ জানাতে বলেছেন। একপর্যায়ে বলেছেন সবচেয়ে কঠিন কথাটি‘দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকরা ক্যানসারের মতো, ক্যানসার আক্রান্ত অঙ্গ যেমন কেটে ফেলা হয়, তেমনি দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকদের ছেঁটে ফেলা হবে।... যেকোনো দুর্নীতি ক্যানসারের মতো। যদি কোনো আঙুলে ক্যানসার হয় উচিত হবে চট করে সেই আঙুল কেটে ফেলা।’ একেবারে মেদহীন কথা। যদি-কিন্তু-তবের ফাঁক নেই। বিচার বিভাগকে মহান সংবিধানের ‘শেষ রক্ষাকবচ’ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘আইনজীবীরা সেই বিচার বিভাগেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। বার ও বেঞ্চ পরস্পরের পরিপূরক। একটি পাখির দুটি ডানা। পারস্পরিক শ্রদ্ধাহীনতা দুই পক্ষকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো বিচার বিভাগ।’
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর কথাগুলোকে বলার জন্য বলা বা কথার কথা মনে করার জো নেই। কথা আর অবশিষ্ট রাখেননি তিনি। দায় নয়, প্রকারান্তরে দায়িত্ব নিয়েছেন। শুরু থেকেই চলমান অর্থ পাচার, মানি লন্ডারিং, ঘুষসহ বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ-কষ্টের কথা জানিয়ে আসছিলেন তিনি। যেগুলোর দায় এবং দায়িত্ব সরকারি মহলের। কিন্তু, এবার নিজস্ব আঙিনার দুর্নীতির দিকে আঙুল তুলে প্রধান বিচারপতি অতিরিক্ত দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়েছেন। কোনো তথ্য বা অভিযোগ ছাড়া তিনি ‘দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারক ও ক্যানসার’ প্রসঙ্গটি আনেননি। এ ছাড়া এমন একসময় তিনি তীরটি ছুড়লেন যখন আমাদের সামনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিন্ড্রোম। তাও তার আদালতে বিচারাধীন। সচরাচর সাধারণ মানুষ বিচার, বিচারালয়, বিচারপতি নিয়ে কথা বলতে ভয়ে থাকে। বিষয়গুলো স্পর্শকাতর। আড়ালে-আবডালে কিছু বললেও এদিক-ওদিক তাকায়। কারও কাছে আইন-আদালত ভীষণ ভয়ের। কারও কাছে শ্রদ্ধার। আর লেখালেখির ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের মধ্যে কাজ করে সর্বোচ্চ সতর্কতা। একটু এদিক-সেদিক হয়ে গেলেই আদালত অবমাননার মতো মহাবিপদের শঙ্কা তাড়া করে। আবার তথ্যসহ প্রযুক্তিগত নানা কল্যাণে কেউ না বললেও সব কথাই বলা হয়ে যায়। জানাজানির বাকি থাকে না। সোশ্যাল মিডিয়া মাড়িয়ে মূলধারার গণমাধ্যমেও চলে আসে। তার ওপর আইন-বিচারাঙ্গনে কর্মরতদের কাণ্ডকীর্তির খবর হালে মাত্রাগতভাবে বেশি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতের ঘটনার ফুটেজ প্রথমে ঘুরছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। পরে মেইন স্ট্রিমের মিডিয়ায়। একপর্যায়ে উচ্চ আদালতের বিচার্য বিষয়ে। আইন-আদালত-বিচার নিয়ে সাধারণ মানুষ ভয়ে বা শ্রদ্ধায় সংযত থাকলেও সংশ্লিষ্টরা দেখিয়েছেন উল্টোটা। হাইকোর্টের বিচারপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালত কক্ষের ওই ভিডিও ফুটেজ দেখে বলেই বসেছেন, কমলাপুরের কুলিরাও এ ভাষায় কথা বলে?
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই বিচারকের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ ও আইনজীবীদের কর্মবিরতির কারণে আদালতপাড়ায় টানা কয়েক দিন যে অচলাবস্থা চলেছে একে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি বিচ্ছিন্ন বা আঞ্চলিক ঘটনা বলার অবস্থা নেই। সেখানকার জেলা জজসহ দুই বিচারকের অপসারণ ও নাজিরের শাস্তির দাবিতে আইনজীবীরা কর্মবিরতিসহ কি না করেছেন? কীসব ভাষা ও আচরণ না করেছেন? এজলাস চলাকালে বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে আইনজীবীদের আচরণ ও ভাষার কয়েক মিনিট সারা দেশের মানুষের দেখা হয়েছে।
এ রকম সময় প্রধান বিচারপতি ‘চাঁপাই’তে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় যে মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তা উপলব্ধির মূল দায়িত্ব আইনজীবী-বিচারপতি দুপক্ষেরই। তার ‘একটি পাখির দুটি ডানা’ মন্তব্যের মধ্যে রয়েছে মোটা দাগের একটি সতর্কবার্তা। অথচ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইনজীবী আর বিচারকসহ আইনাঙ্গন সংশ্লিষ্টদের কদাকার ঘটনাকে জাস্ট ভাই-বোনের বিরোধের মতো বিষয় বলে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আচানক কাণ্ডের পর উচ্চাদালতেও কম যাননি আইনজীবীরা। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সম্পাদকসহ তিন আইনজীবীকে আদালত অবমাননার রুল দেওয়ার পর ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজিরা ছিল তাদের। দিনটিতে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ও বাক্য বাংলাদেশের বিচারালয়ের ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে থাকবে। আদালত বলেছে, ওই বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীরা যে আচরণ করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকলে বিচার বিভাগ ও আইন-আদালত বলে কিছু থাকবে না। সবাই মিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আগুন না থামালে আমাদের সবাইকে জ্বলতে হবে।
বিচারপতির উপরোক্ত তিনটি বাক্যের মধ্যে লুকানো বেদনা ও শঙ্কার মধ্যে বিবেকমান যে কারও জন্য ভাবনার অনেক উপাদান। ঘটনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। সেখানকার এমপি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি আবার একজন আইনজীবীও। তার বাবা প্রয়াত অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকও ছিলেন বাংলাদেশের আইন ও বিচার অঙ্গনের তারকা ব্যক্তিত্ব। মহল্লার মেলদরবারের মতো দুই কথার বাড়িতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এজলাসে হট্টগোল, বিচারক ও আদালতের কর্মচারীদের ‘গালাগাল ও অশালীন আচরণকে ‘ভাইবোনের ঝগড়ার মতো’ বলে উল্লেখ করেছেন আইনমন্ত্রী। বিচারক-আইনজীবী-আদালত-বিচার তথা আইন ভাইবোনের কাইজ্জার বিষয় নয়? স্বামী-স্ত্রী বা ভাই-বোন মিলে দল চালানো যায়। জোট গঠন করা যায়। বড় বড় কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা যায়। দেশও চালানো যায়। তা আইন, বিচার বা বিচারালয়ে কি খাটে? সাফাই বা এ ধরনের আশকারা দেশের বিচারব্যবস্থাকে কোন তলানিতে নিয়ে যেতে পারেসেই শঙ্কার বার্তা রয়েছে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যেও। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ ফারুক আহমেদের সঙ্গে অশালীন আচরণের ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে অপসারণের নির্দেশও দিয়েছে হাইকোর্ট। যেই লাখো-কোটি মানুষ ওই ভিডিও ফুটেজ দেখেছেন, গালমন্দগুলো শুনেছেন তাদের মনের হার্ডডিস্কে কিন্তু গেঁথে আছে। শুনানিতে হাইকোর্ট কেন শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীদের তলব করল, বিচারকদের প্রতি কেন আদালত অবমাননার রুল জারি করল নাএ ক্ষোভ ছোড়া হয়েছে। বিচারকদের আচরণ ও ক্রিয়াকলাপ বলতেও ছাড়েননি আইনজীবীরা। এ সময় আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা উচ্চৈঃস্বরে ‘ঠিক-ঠিক’ বলে ওঠেন। এত ঠিকের মধ্যে আইন-বিচার ও আদালতের ভবিষ্যৎ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিচারক বিচার চেয়েছেন। আগে অসদাচরণের শিকার বিচারকরাও বিচার চেয়েছিলেন। আদালতে তলব করে দুর্বিনীত আইনজীবীকে সমঝে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আদালতে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়ে তারা হাসিমুখে বের হয়ে বেপরোয়া আচরণের স্বীকৃতি হিসেবে ‘বিখ্যাত’ হয়েছেন। ঝালকাঠি, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর বা খুলনার ঘটনা অনেকের মনে আছে, যা আইন পেশার মানের নিম্নগামিতার সঙ্গে আরও নানান কিছু নির্দেশ করে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল টিআইবি একবার তাদের খানা জরিপ প্রতিবেদন দিয়ে ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল। টিআইবির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিচার বিভাগ ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সার্ভিস সেক্টর’। সুপ্রিম কোর্ট ক্ষুব্ধ এতে হয়। বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব মিয়ার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি বলেছিল, এই জরিপ উপকারী নয়। টিআইবি বলেছিল, এটা দৃষ্টিভঙ্গিগত একটি বিষয়। তবে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের মনোভাব কী, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র বিচার বিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক সময় অল্পসংখ্যক বিচারকদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ বিভিন্ন সেক্টরে অল্পরাই বেশি ক্ষমতাধর। এরাই উদাহরণ। প্রধান বিচারপতিও নিশ্চয়ই অনেক সংখ্যকের কথা বলেননি। অন্তত টোকেন বা প্রতীকী হলেও অল্পেরও অল্প কিছু দৃষ্টান্ত রাখার দায়িত্ব এখন প্রধান বিচারপতির। ক্যানসার মেডিসিনে না সারলে সার্জিক্যালে যেতে হয়, ক্যানসার আক্রান্ত অঙ্গ কেটে ফেলার সেই আভাস তিনি দিয়েছেন প্রকাশ্যে অনুষ্ঠানে। কথা বলেছেন অ্যাকটিভ ভয়েসে। এর মধ্য দিয়ে সার্জনের থিয়েটারে তিনি নিজেই। শনিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে এটি গুরুত্ব পেয়েছে দিনের টপ নিউজ হিসেবে। আরেক টপ নিউজ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারকের সঙ্গে অশালীন আচরণের ঘটনায় আদালত অবমাননার ব্যাখ্যার পরবর্তী তারিখ সামনের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। ওইদিন তিন আইনজীবীর সশরীরে লিখিত ব্যাখ্যার তারিখ। এর আগে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যটি রুলিংয়ের চেয়ে কম নয়। যদি বিচারক, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টরা তা উপলব্ধি করেন। এটি অন্য কারও বুঝিয়ে-শুনিয়ে আরোপের বিষয় নয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিবিড় পাঠ ও গবেষণার পরিবেশের সঙ্গে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের দেশে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংখ্যাবৃদ্ধি এবং দেশের নানাপ্রান্তে সেগুলোর অবস্থানগত বিস্তারের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আবাসনের সুবিধা না পেলে শিক্ষার্থীদের পাঠ ও গবেষণায় তা বিরূপ প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটকে কেন্দ্র করে চলছে ছাত্ররাজনীতির নামে নির্মম দখলদারিত্ব আর ক্ষমতার সন্ত্রাস। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো যেমন এ বিষয়ে পরিকল্পনাহীন তেমনি উচ্চশিক্ষার নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয় নিশ্চুপ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট কতটা প্রবল তা জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে। এতে জানা গেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আবাসিক হল না থাকায় ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই আবাসিক সুবিধা পান না। প্রতিবেদনে উল্লিখিত বাস্তবতার এক নির্মম চিত্র দেখা যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
রবিবার দেশ রূপান্তরে ‘আন্দোলন করে হলে উঠে ছাত্রীরা পেল চৌকি’ শিরোনামের প্রতিবেদন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ‘চৌকি নিবাস’-এর তথ্য উঠে এসেছে। জানা গেছে, তারিখ দিয়েও দফায় দফায় পেছানোর পর অবশেষে আন্দোলনের মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ছাত্রীদের জন্য তৈরি হলে শিক্ষার্থী ওঠানো শুরু হয়েছে। আসন বরাদ্দসহ চার দফা দাবিতে গত শুক্রবার রাতভর বিক্ষোভ করার পর গতকাল শনিবার নতুন ওই আবাসিক হলটিতে আসন পেয়েছেন জরাজীর্ণ ফজিলাতুন্নেছা হলের ছাত্রীরা। এ ছাড়া কয়েকদিনের মধ্যেই ছাত্রদের আরেকটি হল চালু করা হবে বলে জানা গেছে। তবে এসব হলে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সব সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি। শুধুমাত্র মাথাপিছু একটি করে চৌকি এবং পানি ও বিদ্যুৎ সুবিধা দিয়ে শিক্ষার্থী ওঠানো হচ্ছে। অথচ ২০১৮ সালে এই হলগুলোর নির্মাণকাজ উদ্বোধনের সময় বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের ডিসেম্বরেই কাজ শেষ হবে। দীর্ঘ আশ্বাসের পরেও আবাসিক হল দুটিতে পূর্ণাঙ্গ সুযোগ-সুবিধা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। হলের মধ্যে খাবারের ব্যবস্থা নেই। প্রত্যেককে একটি চৌকি দেওয়া হয়েছে। পানি এবং বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। তবে নেই গ্যাস সংযোগ। প্রত্যেক তলায় গ্যাসের চুলা থাকার কথা থাকলেও নেই। এ ছাড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে উন্নতমানের চেয়ার, শেলফসহ টেবিল ও লকার থাকার কথা। পাশাপাশি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগও দেওয়া হয়নি। কমনরুম, ব্যায়ামাগার এবং গ্রন্থাগারও প্রস্তুত হয়নি। পুরোদমে চালু হয়নি লিফট। নবীন শিক্ষার্থীদের নবনির্মিত হলে আসন দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণরুম বিলুপ্ত হবে বলেও আশ্বাস এসেছিল। আর সেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গত বছরের ৯ মার্চ ৫০তম ব্যাচের ক্লাস অনলাইনে শুরু করা হয়েছিল। তবে হলের কাজ শেষ না হওয়ায় ওই বছরের ২৩ মে গণরুমে তুলেই তাদের সশরীরে ক্লাস শুরু করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন গেল বছরের জুনের মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ করার কথা বলেছিলেন। পরে জুন মাসে এসে সে বছরের অক্টোবরে ৬টি হল উদ্বোধন করা যাবে বলে সাংবাদিকদের তিনি জানান। তবে কাজ শেষ করতে না পারায় ছয়টির মধ্যে দুটি হল নভেম্বরের মধ্যে উদ্বোধন করতে পারবেন বলে জানিয়েছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম। কিন্তু হল উদ্বোধন করতে না পারায় ইতিমধ্যে কয়েক দফায় নতুন শিক্ষাবর্ষের (৫১তম ব্যাচ) ক্লাস শুরুর সময়সূচি পিছিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ৩১ জানুয়ারি শুরু হতে যাওয়া ৫১তম ব্যাচের ক্লাস শুরুর আগেই ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য একটি করে হল চালুর ঘোষণা বাস্তবায়ন করছে প্রশাসন। তারই অংশ হিসেবে ছাত্রীদের নতুন হলটিতে শিক্ষার্থী ওঠানো হয়েছে।
শিক্ষাবিদ ও উচ্চশিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া আসন সংখ্যা বাড়ানোয় এই সংকট তৈরি হচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরিকল্পিত নীতিই দায়ী। অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচ্য ঘটনায় প্রশাসনের অদক্ষতা এবং দায়িত্বহীনতার বিষয়টি স্পষ্ট। যে কারণে দফায় দফায় সময় বেঁধে দিয়েও শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলে তোলা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত বেশি সংখ্যক সম্ভব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আবাসন সুবিধা সৃষ্টি করা এবং মানসম্মত পাঠ ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টি একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে, শিক্ষায় বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হওয়া উচিত গবেষণায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আবাসন সুবিধার মতো মৌলিক অবকাঠামো গড়ে তোলাতেই আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে, ধাপে ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসন সংকট নিরসনের একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে সে লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া।
চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনীর অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। খাপছাড়া পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। পরে তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। ১৯৫৭ সালে তিনি চলচ্চিত্রে যুক্ত হন ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ সিনেমার সহকারী পরিচালক হিসেবে। ১৯৬৪ সালে তিনি নির্মাণ করেন উর্দুতে পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’। ‘বরফ গলা নদী’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘আর কত দিন’, ‘তৃষ্ণা, ‘হাজার বছর ধরে’ প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তার পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘স্টপ জেনোসাইড’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। জহির রায়হান ছিলেন যুগপৎ শিল্পী ও যোদ্ধা। একাত্তরের যুদ্ধকালে তার নির্মিত বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে। এরপর অনেক কাজের পরিকল্পনা থাকলেও করতে পারেননি। বড় ভাই সাহিত্যিক, সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগ মুহূর্তে আলবদর বাহিনী অপহরণ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান মিরপুরে বিহারি-রাজাকার অধ্যুষিত এলাকায় যাওয়ার পর আর তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় সেদিনই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
গাজীপুরের টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীতে ৩৬০ টাকা বেতনে কর্মজীবন শুরু করা আসাদুর রহমান কিরণ এখন গাজীপুর মহানগরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর বিভিন্ন দল বদলে ক্ষমতার পাশাপাশি প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। বিভিন্ন সূত্র মতে, কিরণ এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। তার এত সম্পদের মালিক হওয়ার পেছনে রয়েছে দখলবাজি, জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর দুর্নীতি ও অনিয়ম।
কিরণের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ ৩১টি দপ্তরে যে অভিযোগ জমা পড়েছে, তাতে ডিগবাজি দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসা এই ভারপ্রাপ্ত মেয়রের ৬০০ কোটি টাকার দুর্নীতি-অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য হাইকোর্ট দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দিয়েছে।
২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর নির্বাচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। নগরীর ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণ তখন ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পান।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণকে একাধিকবার ফোন করা হয়েছে। মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।
৩১ দপ্তরে অভিযোগ : গত বছর ২০ জুলাই ৩১টি দপ্তরে সচেতন নাগরিক, বাংলাদেশের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন মো. নজরুল ইসলাম। লিখিত অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, দুদক, স্থানীয় সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে দেওয়া হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে গত বছর জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি পালন না করেও সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছেন কিরণ।
জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার অভিযোগপত্রে ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণের দুর্নীতি ও অনিয়ম চিত্র তুলে ধরেছি।’
কিরণের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র : ভারপ্রাপ্ত মেয়রের চেয়ারে বসে কিরণ দুর্নীতি-লুটপাট, কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তার নজর পড়ে পুবাইলের চিরুলিয়ায় অর্পিত সম্পত্তির ওপর। ২৩ বিঘা জমি নিজের কবজায় নেন কিরণ। এর জন্য ভুয়া জমির মালিক বানান একজনকে। এ জমি নিজের করায়ত্তে নিতে সিটি করপোরেশনের ১৮ লাখ টাকা কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। জানাজানি হয়ে গেলে কিছুদিন আগে কর পরিশোধ করেন। তবে অবৈধ প্রক্রিয়ায় জমির মালিক হওয়ায় ওই জমির খাজনা এখনো দিতে পারেননি কিরণ।
পোশাকশিল্প কারখানার সবচেয়ে বড় নগরী গাজীপুর। সিটি করপোরেশনের আয়ের সবচেয়ে বড় মাধ্যম শিল্প ও হোল্ডিং ট্যাক্স। আর সেখানেই অনিয়মের বড় ক্ষেত্র তৈরি করেছেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র। তিন/পাঁচ কোটি টাকার বকেয়া হোল্ডিং, শিল্প ট্যাক্স অর্ধেকে নামিয়ে এনে করপোরেশনের কোষাগারে মাত্র ৫০ লাখ টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রেহাই দিয়ে দেন করদাতাদের। কিরণের এই কৌশলে বেঁচে যান কর ফাঁকি দেওয়া শিল্প-মালিকরা। কিন্তু রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র। নগরের আটটি জোনে করের টাকা আত্মসাৎ করার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিরণ ২০১৬-১৭ সালে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় একটি টেন্ডার আহ্বান করেন। টেন্ডার নম্বর : জিসিসি/জেড। ওই টেন্ডারের কাজের অগ্রগতি না থাকায় জাহাঙ্গীর আলম মেয়র নির্বাচিত হলে ওই টেন্ডারের কোনো বিল পরিশোধ করতে পারেননি কিরণ। ২০২১ সালে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেন। ওই সময়ের বিভিন্ন ঠিকাদারকে ডেকে তাদের কাছ থেকে কাজের হিসাব করে তার কমিশন আদায় করেন কিরণ। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কিছু চিত্র সিটি করপোরেশনের চেক রেজিস্ট্রার বই ঘেঁটেও পাওয়া গেছে।
উত্তরায় ‘অস্থায়ী কার্যালয়’ : উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে ৭ নম্বর রোডে ১০ নম্বর বাড়ির ছয়তলায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একটি ‘কার্যালয়’ করেছেন কিরণ। উত্তরার এ কার্যালয়ে বসে ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। লেনদেন-দরবার সবই হয় এ বাড়িতে বসেই। পার্সেন্টেজ ছাড়া যেমন ঠিকাদারদের কাজের বিল পরিশোধ করা হয় না, তেমনি পার্সেন্টেজ ছাড়া ঠিকাদারি কাজও পান না কেউই। কোন কাজ কে পাবে, কে পাবে না, কে কত পার্সেন্ট কমিশন দেবে এসব হিসাব ও মধ্যরাতের প্রমোদ-ফুর্তির যে ব্যয় হয় সিটি করপোরেশনের এলআর ফান্ড থেকে নির্বাহ করা হয়। শিল্পাঞ্চল-সমৃদ্ধ গাজীপুর নগরীর অধিকাংশ ব্যবসায়ী-ঠিকাদার ‘১০ পার্সেন্ট’ হিসাবেও কিরণকে চিনে-জানে।
বর্তমানে গাজীপুর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা সারা জীবন রাজনীতি করেছি দলের জন্য। অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছি কিন্তু মূল্যায়ন পাইনি। একটি কাজের জন্য আমি ছয় মাস ঘুরছি। কিন্তু কিরণ আমাকে কাজ দিচ্ছেন না। কারণ আমার কাছ থেকে পার্সেন্টেজ নিতে পারবেন না।’
শুধু কী তা-ই, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজনের নামে গত বছর ১৭ মার্চ কোনো আয়োজন না করেই কিরণ সিটি করপোরেশনের খরচের তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগও আছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৭৬ জন কাউন্সিলর এবং কিছু কর্মকর্তার সিলেটে পিকনিক আয়োজন করার নামে করপোরেশনের তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ বাবদ দেখিয়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগও আছে।
কিরণের সম্পদ : টঙ্গীর পাগাড়, ঢাকার আশুলিয়া এবং গাজীপুরে নিজ নামে, স্ত্রী, শ্যালক ও শ্যালিকার নামে ১১২ বিঘা জমির মালিক কিরণ। টঙ্গীর পাগাড়ে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কিছু জমি রয়েছে, যা নয়ছয় ও ভয়ভীতি দেখিয়ে দলিল করে নিয়েছেন তিনি। নজরুল ইসলামের অভিযোগ অনুযায়ী, উত্তরায় ১১ নম্বর সেক্টরে ৭ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়িটি সাততলা। এটি নির্মাণ করতে কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। একই এলাকার ৭ নম্বর সেক্টরে ১৮ নম্বর রোডে ৯৫ নম্বর বাড়ি রয়েছে। বারোতলা নির্মাণাধীন ওই ভবনের আনুমানিক মূল্য ৩৫ কোটি টাকা। গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কে ফ্ল্যাটের তথ্যও পাওয়া গেছে। ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটের মূল্য কমপক্ষে সাত কোটি টাকা।
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় স্ত্রী ও নিজের নামে অন্তত ২০০ বিঘা জমির ওপর ভারপ্রাপ্ত মেয়রের কারখানা রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ৩০০ কোটি টাকা হতে পারে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অধীনে টঙ্গীতে তিনটি কারখানা আছে তার। এগুলোর আনুমানিক মূল্য ৩০০ কোটি কোটি টাকা।
কিরণের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত কয়েকশ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিজের ও স্ত্রীর নামে যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্ক শহরে বাড়ি করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। কিরণ দ্বৈত নাগরিক বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
হাইকোর্টের আদেশ : গত বছরের ২০ জুলাই দুদকে জমা পড়া অভিযোগ লাল ফিতায় আটকে গেলে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন হয়। গত বছর ২১ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করা হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালত কিরণের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। হাইকোর্ট চার মাসের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে সময় বেঁধে দেন। একই সঙ্গে গাজীপুরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে আদালত।
রাজনীতিতে উত্থান : প্রিন্টিং প্রেস কারখানায় বাইন্ডার-ম্যান হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন আসাদুর রহমান কিরণ। ১৯৮৪-৮৫ সালে এলিট প্রিন্টিং প্রেস নামে ওই কারখানায় চাকরি করা কিরণ ১৯৮৬ সালে রাজনীতিতে আসেন। ওই সময় তিনি জাতীয় পার্টির যুব সংগঠন যুব সংহতির টঙ্গীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওই সময় গাজীপুর নিয়ন্ত্রণ করতেন হাসান উদ্দিন সরকার। তিনি জাতীয় পার্টি ও পরে বিএনপির রাজনীতিতেও যুক্ত হন। ওই সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর হাসান উদ্দিন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ও তার ঘনিষ্ঠ পরিচিতি লাভ করে শুরু করেন জমি দখল। টঙ্গী, পাগাড় মৌজায় হিন্দু-খ্রিস্টানের মালিকানায় থাকা জমি দখল করে নেন তিনি। পরে প্লট বানিয়ে চড়া দামে বিক্রি করেন। তবে প্রিন্টিং প্রেসের শ্রমিক কিরণ ওই সময় টঙ্গীর বিসিক এলাকায় শ্রমিক নেতা হিসেবেও আধিপত্য বিস্তার করেন। হিন্দু-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কেউ জমি দিতে না চাইলে রাজনৈতিক চাপ ও সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করতেন। পাগাড় শিল্পাঞ্চল এলাকা হওয়ায় ওই এলাকায় টার্গেট করে জমি দখল করেন কিরণ। টঙ্গী পৌরসভা হিসেবে প্রথম ভোটে ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কমিশনারও নির্বাচিত হন। তত দিনে ক্ষমতা-সম্পদ ও অঢেল অর্থের মালিক হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর গুরু পাল্টে কিরণ হয়ে যান সাবেক পৌর মেয়র গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লার ‘মাইম্যান’। এই সুযোগে ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে কিরণের। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে আজমত উল্লা মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক আবদুল মান্নানের কাছে পরাজিত হন। কিরণ মূলত দুর্নীতি-অনিয়ম শেখেন তখন থেকেই। বিএনপি নেতা মান্নান মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হলে তিনি ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পান। গাজীপুরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচন কেন্দ্র করে আজমত উল্লার সঙ্গেও সুসম্পর্ক নেই কিরণের।
গাজীপুরের মাওনা এলাকার আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চেয়ার ছুঁয়েই কিরণ স্বেচ্ছাচারিতা, লুটপাট, ভূমিদখলসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তিনি করেননি। দলীয় লোককে সরিয়ে রেখেছেন, সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখেছেন। কারণ, কিরণ আওয়ামী লীগ নয়, মূলত সুবিধাবাদী।’
ভারপ্রাপ্ত মেয়রের বিষয়ে জানতে চাইলে আজমত উল্লা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কিরণ অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে এসেছেন সত্যি, তবে তিনি দলের জন্য কাজ করেছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের যে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে সেটা তো প্রমাণ হয়নি এখনো। প্রমাণ হলে তখন মন্তব্য করা যাবে।’
বরকতময় রমজান মাস পাওয়া প্রতিটি মুমিনের জন্য মহা সৌভাগ্যের বিষয়। কেননা এ মাসের মর্যাদা অনেক বেশি। যাতে বান্দার জন্য মহান মনিবের সন্তুষ্টি অর্জন করা অন্য সময়ের চেয়ে সহজতর। কোরআনে কারিমের ভাষায়, ‘তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ -সুরা বাকারা : ১৮৫
বর্ণিত আয়াতে ‘শাহিদা’ (উপস্থিত ও বর্তমান থাকা) শব্দ দিয়ে রোজা সম্পর্কিত বহু হুকুম-আহকাম ও মাসয়ালা-মাসায়েলের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর আয়াতের শেষাংশে বান্দাকে ‘কৃতজ্ঞ’ হতে বলা হয়েছে। কৃতজ্ঞতর সাধারণ অর্থ উপকারীর উপকার মনে রাখা ও স্বীকার করে। এর সঙ্গে প্রশংসা, মহিমা, মূল্য ও যোগ্যতার বিষয়গুলো জড়িত। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ইসলামের শিক্ষা হলো- সর্বাবস্থায় সবকিছুর জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো। কেননা তিনিই তো এর প্রাপ্য। চোখের প্রতি পলকে এবং হৃৎপিণ্ডের ওঠানামার সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে তার দেওয়া অসংখ্য নিয়ামতে ডুবিয়ে রেখেছেন। এই নিয়ামত এবং দান, যেগুলো প্রতি দিনে-রাতে নবায়ন হচ্ছে, সেগুলোর জন্য আমাদের উচিত আল্লাহকে ধন্যবাদ জানানো। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং যারা উপদেশ গ্রহণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ইচ্ছুক, তাদের জন্য রাত এবং দিনকে সৃষ্টি করেছেন পরস্পরের অনুগামীরূপে।’ -সুরা আল ফুরকান : ৬২
ইসলাম কৃতজ্ঞতাকে উচ্চাসন দিয়েছে। তাই তো উপকারী ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। এ কৃতজ্ঞতা যদি কেউ প্রকাশ না করে, তাহলে সে সমাজের চোখে তো নিন্দিত হয়ই, সে নিন্দিত হয় মহান রাব্বুল আলামিনের কাছেও। নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করে না, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ হয় না।’ -জামে তিরমিজি : ১৯৫৪
উল্লিখিত কোরআনের আয়াত ও হাদিস দ্বারা এটা স্পষ্ট যে মানুষের অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা আদায় করা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরই অংশ। ইসলাম বলে, কৃতজ্ঞতার মানসিকতা লালন করে যেতে হবে। এমন যেন না হয়, আমার বিপদে একজন পাশে দাঁড়াল, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল, কিন্তু আমি তা ভুলে গেলাম, তার প্রতিপক্ষ হয়ে গেলাম। এমন হলে পারস্পরিক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়।
অকৃতজ্ঞতা নীতিহীনতার পরিচয়। এর মাধ্যমে নিয়ামতের অপরিসীম ধারাকে দাতার সামনেই অসম্মান করা হয়। এ ধরনের আচরণের ফলে আরও বেশি কিছু চাওয়া কিংবা পাওয়ার অধিকার হ্রাস পায়। মানবজাতির প্রতি আদেশ হলো, তাদের প্রতিপালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে।
কৃতজ্ঞতা কোনো কঠিন দায়িত্ব নয়, যেখানে ধৈর্যের সঙ্গে পথ চলতে হয়; বরং এটি হলো পরিপূর্ণতার পথ, যেটি দৃঢ় সংকল্প এবং উদ্দেশ্য নিয়ে পাড়ি দিতে হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে পবিত্র বস্তু আহার করো এবং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো; যদি তোমরা শুধু তারই ইবাদত করে থাকো।’ -সুরা বাকারা : ১৭২
মধুর আবেগ এবং হৃদয়ের উপলব্ধি দিয়ে আল্লাহর নিয়ামতের শোকরিয়া আদায়, একজন ব্যক্তিকে আরও বেশি পাওয়ার যোগ্য করে তোলে। তার রহমতের বর্ষণ ঠিক সেই উর্বর জমিতে ঢালা পানির ন্যায়, যা জমিনকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করে তোলে। কৃতজ্ঞতা শুধু ঠোঁটে প্রকাশযোগ্য কোনো শব্দ নয়; বরং কৃতজ্ঞতা হলো হৃদয়ের এমন এক অনুভূতি যা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তার জীবনের প্রতিটি কাজ এবং আচরণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। অকৃতজ্ঞতার পরিণাম সম্পর্কে মানবজাতিকে ভয়ংকর পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আর অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ -সুরা বাকারা : ১৫২
রমজান মাসে অনেক পুণ্যের সমাহার ঘটে। পুণ্যময় এসব কাজের একটি হতে পারে আল্লাহকে স্মরণ ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। কারণ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারীকে অনুগ্রহ লাভের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।
লেখক : খতিব, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ
আজ রবিবার (২ এপ্রিল) সকাল ৯টায় রাজধানী ঢাকার বায়ুর মানের স্কোর ছিল ১২৫। এই স্কোরের অর্থ- ঢাকার দূষণমাত্রা 'সংবেদনশীলদের জন্য অস্বাস্থ্যকর'। বাতাসের মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) সূচক থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
একই সময়ে বায়ুদূষণের শীর্ষে রয়েছে থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই। শহরটির দূষণের স্কোর ২৫৪ অর্থাৎ 'খুবই অস্বাস্থ্যকর'। দ্বিতীয় চীনের রাজধানী বেইজিং, স্কোর ১৬৬ অর্থাৎ 'অস্বাস্থ্যকর'। আর ১৬৪ স্কোর নিয়ে তৃতীয় ভারতের দিল্লি, এটিও 'অস্বাস্থ্যকর'।
উল্লেখ্য, স্কোর শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে বায়ুর মান ভালো বলে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে মাঝারি, সংবেদনশীলদের জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ খুবই অস্বাস্থ্যকর আর ৩০১-এর বেশি হলে বিপজ্জনক।
ভাড়া করা বিমানে উড়িয়ে নিয়েও মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রথম ম্যাচে একাদশে রাখল না দিল্লি ক্যাপিটালস। আসরে তাদের শুরুটাও ভালো হলো না। লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে বড় ব্যবধানে হারল মোস্তাফিজবিহীন দিল্লি।
ঘরের মাঠে ৫০ রানের জয়ে আসর শুরু করল লক্ষ্ণৌ। ১৯৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে দিল্লি থামে ৯ উইকেটে ১৪৩ রানে। ৪ ওভারে মাত্র ১৪ রান খরচায় ৫ উইকেট নিয়ে লক্ষ্ণৌয়ের জয়ের নায়ক মার্ক উড।
এদিন দিল্লির ব্যাটিং ছিল পুরো ফ্লপ। দলের অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার ৪৮ বলে ৫৬ রান করেছেন। পাশাপাশি রাইলি রোশো ২০ বলে ৩০ রানের ইনিংস খেলেন। কিন্তু বাকিরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ফলে যা হরার তাই হলো ম্যাচের ফল।
এর আগে স্বাগতিক দলের হয়ে ঝড় তোলেন কাইল মেয়ার্স। এই ক্যারিবীয়ান ৩৮ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলেন। ২টি চারের সঙ্গে হাঁকান ৭টি ছক্কা। এ ছাড়া নিকোলস পুরান ২১ বলে ৩৬ রানের ইনিংস খেলেন। সুবাদে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৬ উইকেটে ১৯৩ রানের পুঁজি গড়ে লক্ষ্ণৌ।
গত অক্টোবরের পর আর্সেনালের জার্সিতে প্রথম গোলের দেখা পেলেন গাব্রিয়েল জেসুস। তার আবার জোড়া গোল। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের জ্বলে ওঠার দিনে লিডস ইউনাইটেডকে উড়িয়ে ম্যানচেস্টার সিটির চেয়ে ফের আট পয়েন্টে এগিয়ে গেল আর্সেনাল।
ঘরের মাঠে শনিবার প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচটি ৪-১ গোলে জিতে আর্সেনাল। স্পট কিকে দলকে প্রথম এগিয়ে দেন জেসুস। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে বেন হোয়াইট ব্যবধান দ্বিগুণ করেন। এর খানিক পরই জোড়া গোল পূর্ণ করেন জেসুস।
এরপর লিডস একটি গোল শোধ করলেও গ্রানিত জাকার গোলে বড় জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে স্বাগতিকরা।
আন্তর্জাতিক বিরতি থেকে ফেরার পর এটিই প্রথম ম্যাচ ছিল আর্সেনালের। বিরতিতে যাওয়ার আগে নিজেদের মাঠে একই ব্যবধানে তারা হারিয়েছিল ক্রিস্টাল প্যালেসকে।
এই জয়ে ২৯ ম্যাচে ৭২ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষস্থান আরও মজবুত করল গানাররা। ২০০৩-০৪ মৌসুমের পর প্রথমবার প্রিমিয়ার লিগ জয়ের স্বপ্ন দেখছে আর্সেনাল। তাদের সঙ্গে গত লিগের চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটির পয়েন্ট ব্যবধান ৮।
গানারদের চেয়ে এক ম্যাচ কম খেলে ৬৪ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে সিটি। একই দিন তারাও নিজেদের মাঠে লিভারপুলকে উড়িয়ে দিয়েছে ৪-১ গোলে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সময়ের আলোচিত চিত্রনায়িকা নুসরাত ফারিয়া। একাধারে উপস্থাপিকা, নায়িকা এবং সংগীতশিল্পীও। সিনেমার বাইরে তিনটি গান প্রকাশ পেয়েছে তার। সে ধারাবাহিকতায় এবারের ঈদে নতুন গান নিয়ে আসছেন তিনি।
গানের শিরোনাম ‘বুঝি না তো তাই’। বাঁধনের লেখা এ গানটির সংগীতায়োজন করেছেন বলিউড র্যাপার মুমজি স্ট্রেঞ্জার। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ফারিয়া। বাবা যাদবের কোরিওগ্রাফিতে ভিডিওতে অংশ নিয়েছেন ফারিয়া ও মুমজি। আসছে ঈদে উন্মুক্ত হবে গানটি। গানটি প্রকাশ করবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ভেঙ্কটেশ ফিল্মস।
সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে গানটির টিজার, যা দর্শকমহলে প্রশংসা কুড়াচ্ছে। এরমধ্যে সোমবার বিকেলে নিজের ফেসবুকে গান ভিডিওর দৃশ্যের একটি ছবি পোস্ট করেন এ গায়িকা। সেখানে ক্যাপশনে লিখেন, মাই হাইট ইজ ৫' ৩'' বাট অ্যাটিচিউড ৬' ১''।
গানটি প্রসঙ্গে নুসরাত ফারিয়া জানিয়েছিলেন, ‘নতুন এ গানটি বেশ আনন্দের সঙ্গে করেছি। আমার আগের তিনটি গানের মতো এটিও বেশ মজার। আমার বিশ্বাস এটি সবার পছন্দ হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে ‘পটাকা’ গানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ঘরানার গানে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন নুসরাত ফারিয়া। এরপর ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রকাশ পায় ‘আমি চাই থাকতে’ ও ‘হাবিবি’। আসছে ঈদুল ফিতরে এ অভিনেত্রী গায়িকা হিসাবে চতুর্থবার হাজির হচ্ছেন দর্শক শ্রোতাদের সামনে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এক বছরেরও কম। সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে অথবা আগামী বছরের জানুয়ারিতে নির্বাচন হবে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করা দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো আন্দোলন করছে।
এ ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে এই চাপ ক্রমশ বাড়ছে। বিদেশিদের মধ্যে এবার যুক্তরাষ্ট্রের চাপ অনেক বেশি। এর আলামত দেখা যাচ্ছে কয়েক মাস ধরে। নির্বাচন ছাড়াও দেশটি মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীন প্রশ্নে অনেক সোচ্চার। ২০২১ সালের ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি।
সরকারের তরফ থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য তারা বিদেশিদের উদ্যোগ নিতে বলছে। একই সঙ্গে সরকার যেকোনো চাপে নতি স্বীকার করবে না, সেটাও বলেছে।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৯০ সালে দেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি আসার পর থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক আগ্রহ বাড়ছে। নির্বাচনের এক বছর আগে থেকেই প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নানা সবক দিতে থাকে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
তাদের মতে, বরং নির্বাচন ঘিরে পরাশক্তিগুলোর প্রভাব লক্ষণীয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই প্রতিবেশী দেশ এবং বড় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সরকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য দেখিয়ে আসছিল ভারত। ১৯৯০ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমাদের প্রভাব। আর তিন দশক ধরে বিভিন্ন কূটনৈতিক জোট, আঞ্চলিক জোট এবং সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আগ্রহ বেড়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রভাবশালী দেশগুলোর নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ যতই থাক না কেন, এর মূল কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা। তারা মনে করছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সমাধান যদি নিজেরা না করতে পারি, তাহলে বাইরের প্রভাব বাড়তে থাকবে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালী উর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশকে তাদের প্রভাব বলয়ে রাখতে চায়। তাদের নিজেদের দেশেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। বর্তমান সরকারও অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কাজ করছে। তাদের এই চাপ কাজে দেবে না।’ আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মহলের অভিমত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে এবং আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণও তাই। কূটনীতিকরা বলছেন, ভারত, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ থাকলেও এক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতা লক্ষণীয়। এ ক্ষেত্রে সরকারবিরোধী বিএনপির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বারবার নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি কিছুটা হলেও গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতি এবং নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি সোচ্চার হলেও তাদের কূটনীতি সরকারবিরোধী দলগুলোর পক্ষে যাবে এমন ধারণা করার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। এটা যেমন সত্য, তেমনি ইন্দো প্যাসিফিক এবং এ অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের বোঝাপড়াটা বেশি জরুরি। আর সে কারণেই বিএনপি যতই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলুক যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে না। তাদের বক্তব্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং নির্বাচনে বিরোধীপক্ষের জন্য সুষ্ঠু ও অবাধ পরিবেশ তৈরি করা।
কূটনীতিক সূত্রগুলো বলছে, আগের কয়েক দফা যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী থাকলেও ভারতের সঙ্গে একধরনের সমঝোতা করে বা আলোচনা করে তাদের মতামত দিয়েছে। কিন্তু ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। এবার যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি নির্বাচন নিয়ে পরামর্শ এবং তাদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়ে বেশি সোচ্চার।
বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক চর্চার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগের বিষয়টি প্রথম প্রকাশ পায় ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে। এরপর থেকেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা চলছে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংলাপও হয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল এবং প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর করেছেন। তাদের সফরে আগামী নির্বাচন, বিরোধীপক্ষের প্রতি সরকারের আচরণ, মানবাধিকার ও সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সরকার, আওয়ামী লীগ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
গত ২১ মার্চ নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের উদ্ধৃত করে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে, নির্বাচনে জাল ভোট দেওয়া হয়েছে এবং বিরোধীদলীয় পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোসহ গুরুতর অনিয়ম রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিত সম্মান ও অংশীদারিত্বের মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে মানবাধিকারের বিষয়গুলো উত্থাপন করে। এটা তারা চালিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমন আগ্রহের কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বলয় বাড়াতে চায় দেশটি। এরই মধ্যে দেশটি এশিয়ায় তাদের বন্ধু দেশগুলোকে নিয়ে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ (আইপিএস) পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এর আওতায় ইন্দো-প্যাসিফিক ফোরাম গঠন করা হয়েছে। একই কৌশলের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারত সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে কোয়াড গঠন করেছে। এগুলোর লক্ষ্য হলো চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে একটি শক্তিশালী বলয় গঠন করা। ভারতের পাশাপাশি এ বলয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকেও চায়। বাংলাদেশ যেন কোনোভাবেই চীনের বলয়ে না যেতে পারে, সেই কৌশলের অংশ হিসেবেও আগামী নির্বাচন ঘিরে চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছে দেশটি। যদিও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো জোটেই যায়নি। আবার ‘বার্মা অ্যাক্ট’ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাবে তারা বাংলাদেশকে পাশে চায়। এসব কারণে বাংলাদেশকে চাপে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ নানা ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুসহ ঢাকায় সফররত দেশটির কর্মকর্তারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের পাশাপাশি দুই দেশের সম্পর্ক নিয়েও ইতিবাচক কথা বলেন। এ ছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের বিভিন্ন বক্তব্যেও নির্বাচনের পরিবেশ ও স্বচ্ছতা নিয়ে আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে ঢাকা সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তারও বলেছিলেন, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে তারা সরকারকে এবং এই দেশকে সহযোগিতা করেব। তিনি সেই সময় দেশটির যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা দূতাবাস ও ইউএসএইডের বাংলাদেশ কার্যালয়ে আয়োজিত এক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব তুলে ধরেন।
গত বছরের অক্টোবরে ঢাকায় এসেই এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাংবাদিকদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন দেখতে চায়। এরপর থেকে তিনি নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায় অভিন্ন বক্তব্য দিয়ে আসছেন। পাশাপাশি তিনি এ-ও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো একটি দলকে সমর্থন করে না। তারা চান জনগণ তাদের পছন্দের সরকার নির্বাচন করবে।
এর আগে গত বছরের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসহ ১৪টি দেশের কূটনীতিকরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন নিয়ে তাদের মনোভাব তুলে ধরেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অভিনন্দন বার্তায়ও বাংলাদেশে সবার জন্য উন্মুক্ত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। দিবসটি উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শুভেচ্ছা বার্তায় অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। শেখ হাসিনাকে লেখা বাইডেনের এ বার্তায় বর্তমান সরকার ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসাও করা হয়েছে।
এর আগে ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলে তার ঢাকা সফরে বলেছিলেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, অর্থাৎ যারা পরাজিত হবেন, তারাও যেন মনে করেন নির্বাচনটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ হয়েছে এমনটাই তারা চান। তিনি বলেছিলেন, শক্তিশালী সুশীল সমাজ, মুক্ত গণমাধ্যম এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ চায় যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে নেতিবাচক প্রশ্ন উঠবে না। এই পরিবেশ তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলেও শোলে জানান।
ডেরেক শোলে চলে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, সরকারপক্ষ থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে বলা হয়েছে তারা অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। তারা সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত। তবে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও পূর্ববর্তী নির্বাচন নিয়ে তারা তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। যখনই প্রয়োজন হবে, তারা সেটা জানাবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশিদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ নেই। এই সুযোগটা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোই করে দিয়ে আসছে। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র একটি শক্তিশালী অবস্থান চায়। এ জন্যই তারা কথা বলছে।’