
‘পটীয়সী’ কথাটি ‘পটু’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গবাচক। ‘পটু’ মানে দক্ষ। যিনি পটু, তাকে বলা হয় পটীয়ান। এই পটীয়ানের স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে পটীয়সী। মানে হচ্ছে, যে নারী অঘটন ঘটাতে পটু বা ওস্তাদ। কিন্তু চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তার নেতৃত্বে সম্ভবত রয়েছেন পটীয়ানরা!
খবরে প্রকাশচিকিৎসক ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহের সার্বিক দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের ওপর হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। গত ২৪ জানুয়ারি, জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকির দায়িত্ব জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) ওপর দেওয়ার ঘোষণা দেন। এর প্রতিবাদে গত ১ ফেব্রুয়ারি, সম্মেলন করেন খুলনা জেলা শাখার বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) নেতারা। সম্মেলনে, মন্ত্রীর প্রস্তাব দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানান তারা। বক্তব্যে প্রয়োজনীয় জনবল, অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও ওষুধ সংকট নিরসনের দাবি জানানো হয়। বলেনচিকিৎসক ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহ তদারকির জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, জেলা সিভিল সার্জন, বিভাগীয় পর্যায়ে পরিচালক ও সবার ওপরে আছেন মহাপরিচালক এবং তার দপ্তরের পরিচালক। এ ধরনের উপযুক্ত ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও অপেশাদার, ঔপনিবেশিক ভাবধারার আমলার মাধ্যমে অতিরিক্ত তদারকি করা হলে স্বাস্থ্য খাতে নিঃসন্দেহে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। তারা বলেন, এটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আমলাতন্ত্রের পূর্বনির্ধারিত অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্রের অংশ। একই সঙ্গে এমন কথাও বক্তব্যে বলা হয়স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে একটি কুচক্রী মহল প্রশাসনিক ক্যাডার ও চিকিৎসকদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
তারা আরও বলেনচিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র হলে, চিকিৎসকরা তা মেনে নেবে না এবং যেকোনো মূল্যে তা প্রতিহত করা হবে। এর ফলে যে অমানবিক, নিষ্ঠুর এবং নির্মম পরিস্থিতির উদ্ভব হবেস্বাস্থ্যমন্ত্রী তা ভালোমতোই জানেন। বক্তারা অবিলম্বে এমন নির্দেশ প্রত্যাহারের দাবি জানান। তবে একটি কথা বাস্তব সত্য যে, এমনিতেই একটি জেলার হাজার সমস্যা নিয়ে জেলা প্রশাসকদের ব্যস্ত থাকতে হয়। আবার এর মধ্যে এমন গুরুদায়িত্ব ডিসিদের দেওয়া হলে চিকিৎসা খাতের বহুমুখী সমস্যা তাদের কাঁধে ন্যস্ত হবে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে ‘হযবরল’ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। একই সঙ্গে ভাবা দরকারচিকিৎসাসেবার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত যে চিকিৎসক, তাকে চাপে রেখে কিংবা আতঙ্কগ্রস্ত করে, কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যাবে না। যতটুকু পাওয়া যাবে তাকে ‘সেবা’ বলা ঠিক হবে না। হতে পারে তা দায়সারা গোছের কিছু। আবার চিকিৎসকদেরও ভাবতে হবে, বাধ্য না হলে এমন সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়ার কথা না। তাদের ব্যর্থতার দিকগুলোও সমাধানের জন্য তাদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছেজাতীয় রাজনীতির এমন উত্তেজনাকর মুহূর্তে হঠাৎ করেই চিকিৎসকদের সঙ্গে আমলাতন্ত্রের এমন বৈরিতা কেন সৃষ্টি করা হলো? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে কি তৃতীয় কোনো পক্ষ এর সঙ্গে জড়িত? যদিও সেই ষড়যন্ত্র গোষ্ঠীর লিঙ্গ নির্ধারণ এ মুহূর্তে পরিষ্কার না। তবে এ সমস্যা যে দ্রুত সমাধান হচ্ছে না, তা পরিষ্কার। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, বক্তব্যটি দেওয়ার আগে মন্ত্রী মহোদয়ের উচিত ছিল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা।
আমার মনে হয়, আমলারাই সরকারের সঙ্গে চিকিৎসকদের দূরত্ব তৈরির জন্য এমন সিদ্ধান্ত মন্ত্রীর মাথায় ঢুকিয়েছেন। তবে আমরা বিভিন্ন নেতাদের নিয়ে দ্রুত বসব। যারাই জড়িত থাকুক, বিষয়টি দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, বৈরিতাকে সময় দিতে নেই। কারণ, সময়ক্ষেপণ মানেই ষড়যন্ত্রের ভাইরাসকে বংশ বৃদ্ধির সুযোগ দেওয়া। এর ফলে, অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হবে সাধারণ মানুষ। যাদের সঙ্গে, বিবদমান কোনো পক্ষেরই সম্পর্ক নেই।
আবদুল আলীমের কণ্ঠে আবদুল লতিফের সুরের এই লোকগানটি শোনেননি এমন কেউ আমার প্রজন্মে অন্তত নেই। গানের অন্তর্নিহিত দর্শনটি বৈশ্বিক, এই স্বর ও সুর বহন করে আফ্রিকার তুরকানা ও মাসাই জনগোষ্ঠী।
পরের জায়গা পরের জমিন
ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।।
সেই ঘরখানা যার জমিদারি
আমি পাই না তাহার হুকুমদারি
আমি পাই না জমিদারের দেখা
মনের দুঃখ কারে কই।।
যে ভার গাধা বইতে পারে না
যে সম্পদের ভার কারও গাধা বইতে পারে না, সে সম্পদে তার বৈধ অধিকার নেই। এমনকি রাজার বেলায়ও একই নিয়ম। কোনো ব্যক্তি কিংবা তার গাধা যে পরিমাণ সম্পদের বোঝা বহন করে জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম পথে অবলীলায় এগিয়ে যেতে পারবে, সেটুকুই কেবল বৈধ অধিকার। এর বেশি যার দখলে সে-ই লোভী, সে ব্যক্তিই ঈশ্বরের অপছন্দের এবং মানুষের ঘৃণার। বলাই বাহুল্য, ব্যক্তি কিংবা গাধা বহন করে নিয়ে যেতে পারে কেবল সামান্য পরিমাণ অস্থায়ী সম্পদ। জমি বহন করতে পারে না। জমির নিরঙ্কুশ মালিকানা একান্তই ঈশ্বরের। এতে মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সম্পদের অধিকার কার এ প্রশ্নের এত সহজ-সরল এবং সর্বজনীন ব্যাখ্যা দ্বিতীয়টি মিলবে না। এর চেয়ে বেশি সম্পদ যখন ব্যক্তির দখলে চলে আসবে, তখনই সংকট দেখা দেবে, তখনই দ্বন্দ্ব তখনই যুদ্ধ। তুরকানাদের এই বিশ্বাস হাজার বছরের। কিন্তু নতুন প্রজন্ম হতবুদ্ধ। এ বিশ্বাস যে আর কাজে লাগছে না।
কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলে তুরকানা আদিবাসীদের বাস। তুরকানা লেক ঘিরে বসবাস করা এই জনগোষ্ঠী সম্ভবত সুদানের দক্ষিণাঞ্চল থেকে এখানে এসে জমায়েত হয়েছে। তারা মনে করে জমিতে স্থিতিশীল হওয়া কখনো ঈশ্বরের ইচ্ছে হতে পারে না। সুতরাং তারা যাযাবর। তাদের গোটা জীবনযাপনই প্রার্থনা এবং উপাসনা। কাজেই তাদের চাওয়া তাদের কাজে ঈশ্বরের ইচ্ছা প্রতিফলিত হোক। ঈশ্বর এবং আকাশ তাদের কাছে সমার্থক। আকাশের বিচিত্র রূপে, আলোতে-আঁধারে, কালিমায়-লালিমায়, গর্জনে-বিদ্যুতে, বর্ষণে-খরায় ঈশ্বররে ভাষাই কেবল মূর্ত। সে ভাষা তুরকানারা জানে। সে নির্দেশনা তারা মানে। আকাশই বলে দেয়- এখনই সময়, যাত্রা শুরু করো। তখনই স্বল্পকালীন স্থিতির জড়তা কাটিয়ে তারা চলতে শুরু করে নতুন নিবাসের সন্ধানে। তাদের প্রার্থনা, পরিশ্রম এবং উদ্যোগের ফসল বণ্টিত হয় সম্প্রদায়ের ভেতরে ও বাইরে, কিছু ফসল সঞ্চিত রাখা হয় অজ্ঞাত পথচারীর জন্য নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়ার জন্য। আকাশ, ঈশ্বর এবং অদৃশ্য অনেক ঐশী শক্তির যেন তারা কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেয়, বিরত থাকে অকল্যাণ সৃষ্টি থেকে। আধুনিক অর্থে তাদের কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসন নেই, ঐশী শাসনে তার চালিত।
তুরকানারা জানে সবচেয়ে বড় বন্ধন সম্পদের। এ শৃঙ্খলে বাঁধা পড়লে মুক্তি নেই, স্বাধীনতা নেই, তাতে ঈশ্বরের নৈকট্যও নেই। সম্পদের অধিকার ঐশ্বর্যের নয়, দীনতার নামান্তর। অধিকারের যন্ত্রণা ও দীনতা থেকে বেরিয়ে আসা তুরকানারা ঈশ্বরের প্রিয়। সেজন্য আকাশ, তুরকানা এবং ঈশ্বর সবার পরিচিতি এক ‘আকুজ’। তারা আকুজের কাছে প্রার্থনা করে। তারা পূর্বপুরুষের আত্মার কাছে প্রার্থনা জানায় যেন খরা থেকে তাদের রক্ষা করে। একাত্মতার ঐশ্বর্য স্থিতিশীল সম্পদলোভী মানুষের মধ্যে থাকে না।
আদমের সন্তান আবেল ঈশ্বরের প্রিয়জন। আবেল ছিল মেষপালক। অপর সন্তান কেইন ভূমির কর্ষক, সম্পদলোভী এবং অবিশ্বাসী। আবেল ও কেইনের বিরোধই যাযাবর এবং স্থায়ী বসতি স্থাপনকারী মানুষের বিরোধের পূর্ব রূপ। অবিশ্বাসীরাই পার্থিব যাত্রায় এগিয়ে। কেইনের হাতে খুন হয় আবেল। স্থিতিশীল ও কথিত সভ্য মানুষের হাতে খুন হচ্ছে যাযাবর ও পশুপালক সম্প্রদায়।
কেবল আফ্রিকাতেই নয়, ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় যুদ্ধে জিতেছে কেইন। আবেল আহত ক্ষতবিক্ষত এবং সবশেষে নিহত।
অধিকার প্রত্যাশী কেইনের উত্তরসূরিরা কেবল জমি ও সম্পদে সন্তুষ্ট নয়, নারীতেও চাই নিরঙ্কুশ অধিকার। তারা ভেঙে ফেলেছে মাতৃতান্ত্রিকতার মঙ্গল কাঠামো। নারীকেও পরিণত করেছে একান্তই নিজের অধিকারে রাখার মতো একটি সামগ্রীতে। মায়ের ঐশ্বর্য ভূলুণ্ঠিত। এর ফলাফল ভালো হয়নি। তারা কল্যাণ আনতে পারেনি, এনেছে ক্রন্দন, এনেছে গ্লানি।
যাযাবর তুরকানাদের গান আছে, কবিতা আছে, গল্প আছে, দর্শন আছে। উত্তরাধিকার হস্তান্তরের সঙ্গে সঙ্গে এসব গল্প ও গানের অধিকারও চলে আসে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। বিশ্বাস ও সংস্কৃতির মিলনে তাদের ধর্মাচার। একসময় এসে হাজির হয় খ্রিস্টান মিশনারিরা। ঈশ্বর বিশ্বাসে এরা এমনিতেই অর্ধেক পথ এগিয়ে, কাজেই দলে দলে যোগ দেয় খ্রিস্টধর্মে। একেশ্বরবাদী অন্য ধর্মের মিশনারি আগে হাজির হলে হয়তো সে ধর্মেই তারা দীক্ষিত হতো। একেশ্বরবাদ বেশি ঠাঁই পেয়েছে যাযাবর সম্প্রদায়ের মধ্যেই। কারণ বিশ্বাস নিয়েই তাদের যাত্রা। মিশনারিদের দেখানো পথে এসেছে ঔপনিবেশিক শাসন। তাদের হাতে বাইবেল তুলে দিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে সার্বভৌমত্ব।
কেইনের প্রজন্ম সৃষ্টি করেছে জমির মালিকানা, সৃষ্টি করেছে বিরোধ। জমির মালিকানা ঈশ্বরের। এ জমি বেচাকেনা করার কোনো সুযোগ নেই। স্রষ্টা বলছেন, এ জমি কেবল আমারই। তোমরা সামান্য পরিব্রাজক (লেভিক্টিকাস)। কিন্তু সভ্যতার মানে দাঁড়িয়েছে জমিনে মালিকানা সৃষ্টি এই মালিকানায় যারা যত বেশি মূল্য সংযোজন করতে পেরেছে তারা তত সভ্য।
এই যাযাবররা শিল্পবিপ্লবের বিকৃত নৈতিকতায় তেমন প্রভাবান্বিত নয়, কিন্তু স্থিতিশীল মানুষ আধুনিকতা ও উন্নয়নের দোহাই দিয়ে ক্যালরিভিত্তিক খাবারের হিসাব দেখিয়ে, মাথাপিছু আয়ের অঙ্ক কষে এবং এমনকি তাদের একান্ত নিজস্ব যৌনাচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদের বিব্রত করছে, দূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ভেঙে ফেলছে তাদের ঘর-সংসার, আমূল উপড়ে ফেলছে তাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি। তারপর এগিয়ে এসেছে শীর্ষঘাতক, তার নাম বিশ্বায়ন। কেনিয়ার মাসাইদের জোর করে সম্পৃক্ত করা হয়েছে এই ভুবনীকরণের সঙ্গে। ঔপনিবেশিক শাসকরা ‘অন্ধকার আফ্রিকার’ যাযাবরদের সংস্কৃতায়নের গুরুদায়িত্ব নিল। তাদের ঘাড়েই যেন কালো মানুষের বোঝা। কেনিয়ার প্রথম গভর্নর স্যার চার্লস এলিয়ট তত্ত্ব দাঁড় করালেন মাসাইদের সর্বনাশ করেছে তাদের সংস্কৃতি ও সমাজ কাঠামো। এই কাঠামো তাদের পশ্চাৎপদ করে রাখছে। কাজেই ভাঙো তাদের কাঠামো, বদলে দাও সংস্কৃতি। এ জন্য সবার আগে দরকার স্থিতি। ঈশ্বর আবেলকে ভালোবাসেন। কিন্তু ধনবাদী অর্থনীতির পথকে নিশ্চয়ই নয়। তাদের পথে আনতে হবে, কেইনের পথে। মিশনারিরা এলো ধর্ম নিয়ে, কথিত সংস্কারকরা এলো আধুনিক শিক্ষা নিয়ে এবং বেনিয়ারা বাজার অর্থনীতি নিয়ে। পরিবর্তন এসেছে। অশিক্ষা, কুসংস্কার এবং বিনিময়ের অর্থনীতি কমেছে, সেই সঙ্গে হাতছাড়া হয়েছে ঈশ্বরের মালিকানাধীন মাসাইদের দখলাধীন বিশাল ভূখণ্ড, বিশাল পৃথিবী। কিন্তু আমরা অশিক্ষা কাকে বলি? কুসংস্কার কাকে বলি? এই রায় দেওয়ার মানদ- কে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে?
তুরকানাদের মতো মাসাইদেরও বিশ্বাস জমির স্থায়ী মালিকানা হতে পারে না, জমির ভাগাভাগি হতে পারে না, কেনাবেচা চলতে পারে না। ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হলেও, দর্শনটি বিদায় নেয়নি। স্বশাসনের ভেতর বেশ পাকাপোক্ত আসন করে নিয়েছে একই দর্শন। জমি যাবে ব্যক্তি খাতে, সম্পদের হবে অর্থায়ন। ভোগের অর্থনীতিতে তাদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে।
মাসাইদের এই ক্রমপরিবর্তন অসন্তুষ্ট করে মাসাই ঈশ্বর ‘এনকাই’কে। তার প্রিয় তরুণ মাসাইরা পিতৃপুরুষের পেশা ছেড়ে সামান্য মজুরির সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেনিয়ার পথে-প্রান্তরে. স্থিত-মানুষের আচরণ অনুসরণ করছে। সাফারি স্যুট পরে ব্রিফকেস হাতে, চোখে সানগ্লাস, চকচকে চামড়ার জুতো পায়ে বহুজাতিক কোম্পানির সিগারেট ফুঁকতে থাকা মাসাই যুবকের চিত্র ঈশ্বর ‘এনকাই’ কল্পনা করেননি। সরকারের মন্ত্রী ও সাংসদ তাদের কমিশন দিয়ে লাঠিয়াল হিসেবে ভাড়া করছে, তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে।
এনগঙ্গ পাহাড়ের কাছে প্রায় হাজার হাজার মাসাইকে উচ্ছেদ করা হলো। মাত্র কয়েকজন বহিরাগত ৩০ হাজার একর মাসাই জমি দখল করে নিল। জমি উদ্ধারের মামলায় নামল মাসাইরা। ভূমিমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট আশ্বাস দিলেন, তাদের জমিন ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু দেখা গেল, দখলদারদের একজন প্রভাবশালী প্রতিনিধির মাধ্যমে ভূমিমন্ত্রীও দখল করেছে হাজার একর। মাসাইদের এখন আর মর্ত্যরে কোনো ত্রাণকর্তা নেই। অমর্ত্যরেও নেই। মাসাই মারার দুই নদীর মাঝখানে লাখ লাখ একর মাসাই জমি ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গেছে রাজনৈতিক নেতারা ও তাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে। সবচেয়ে মূল্যবান জমির দখলদার স্বয়ং দখলদার ভাইস প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল আরাপ মই (তিনিই পরে প্রেসিডেন্ট হলেন)। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৮ তিনি ছিলেন কেনিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট আর ১৯৭৮ থেকে ২০০২ সে দেশের প্রেসিডেন্ট। দ্বিতীয় বৃহৎ দখলদার ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ স্যাইতোতি। এমনকি সেখানকার ধর্মমন্ত্রীও বাদ যাননি। দখলদারের তালিকায় ক্ষমতাসীন প্রায় সবাই। মাসাইরা বিচার চাইবে কার কাছে?
এনগঙ্গ পাহাড়ের পাদদেশের জমির মামলায় প্রধান বিচারক দখলদারদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন ১.৮ মিলিয়ন শিলিং। প্রায় ৩০ হাজার পাউন্ড স্টার্লিং। প্রেসিডেন্ট দখলদার, বিচারক ঘুষখোর মাসাইদের জীবন বাঁচানোই বড় সমস্যা। উন্নয়নের নামে, ব্যক্তি খাতের সমৃদ্ধির নামে, প্রবৃদ্ধির নামে যাযাবর ও আদিবাসীদের সমূলে উচ্ছেদ চলছে এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকায়। এমনকি এস্কিমোদের বরফের দেশও দখল করে নিচ্ছে আধুনিক উন্নয়নের সংস্কৃতি।
সম্পদের পরিমাপ নেওয়ার মতো গাধাও নেই। প্রায় ক্রমবিলুপ্তির পথে এই নিরীহ প্রাণীটিও। কেনিয়ার তুরকানা এবং মাসাই সম্প্রদায়ও হারিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের জোয়ারে। কতটুকু সম্পদের অধিকার বৈধ সেই অঙ্কও ভুলে গেছে পৃথিবী। কৃষিকাজ, শিকার ও মাছ ধরতে জানা তুরকানারা বদলে যাচ্ছে দ্রুত। তাদের পল এরেঙ্গ ৮০০ মিটার দৌড়ে অলিম্পিক স্বর্ণপদক পেয়েছেন। তাদের মেয়ে আজুমা নেসেনিয়ানা আফ্রিকার সুপার মডেল। মাসাইরাও বসে নেই- জোসেফ এনকাইসেরি কেনিয়ার কেবিনেট সেক্রেটারি হয়েছেন, এডওয়ার্ড সোকিনি এবং এডওয়ার্ড লাওয়াসা হয়েছেন তাঞ্জানিয়ার প্রধানমন্ত্রী, ডেভিড রুডিসা দৌড়ে বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী।
আবদুল আলীমের গাওয়া গানটার বাকি অংশ:
জমিদারের ইচ্ছামতো দেই না জমি চাষ
তাইতো ফসল ফলে না রে
দুঃখ বারো মাস।।
আমি খাজনাপাতি সবই দিলাম
তবু জমিন আমার হয় যে নিলাম
আমি চলি যে তার মন জোগাইয়া
দাখিলায় মেলে না সই।
একালের তুরকানা ও মাসাইরাও ব্যক্তিমালিকানার জমির অধিকারী হচ্ছে, লোভ বাড়ছে, মূলধন কুক্ষিগত করছে, নিজেদের মানুষকেও ঠকাচ্ছে। কথিত সভ্যতা আসার আগে মানুষকে সহজে মানুষ হিসেবে চেনা যেত, এখন চিনতে কষ্ট হয়।
লেখক
কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
‘বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না।’ ‘আজ নগদ কাল বাকি।’ ‘নগদ বিক্রি পেটে ভাত, বাকি বিক্রি মাথায় হাত।’ এমন উক্তি শুধু আমি নই, মোটামুটি বানান করে বাংলা পড়তে জানেন এমন মানুষ পাড়া-মহল্লার দোকানে সেই ছোটবেলা থেকেই পড়ে আসছেন। উক্তিগুলোর সরল অর্থ, বাকি বিক্রি নয়; বাকি বিক্রি ভালো নয়। যদিও দোকানিদের এমন ‘বাণী কৌশল’ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজে লাগে না। বাকি বেচাকেনায় দোকানি লজ্জা পেলেও অনেক ক্রেতাই বাকিতে পণ্য কিনতে লজ্জা পায় না। ক্ষেত্রবিশেষ অনেকে বাকিতে কেনাটাকে ক্রেডিট মনে করে।
এ কারণেই আজও পড়া-মহল্লার ছোট দোকান থেকে শুরু করে ব্যবসায়-বাণিজ্যে বাকির প্রচলন রয়েছে। যদিও বাকির আধিক্যে অনেকেই বলেন, বাকিতে কেনাবেচার নিয়ম এবং পরে বাকি টাকা পরিশোধ না করার রীতি শুধু বাংলাদেশেই আছে। এই কথার পক্ষে কোনো জোরালো যুক্তি আমার কাছে নেই। তবে বাকিতে পণ্য বিক্রি করে বহু দোকানি নিঃস্ব হয়েছেন এমন খবর বিভিন্ন গণ্যমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হয়।
সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থিত হোটেলে অনেক শিক্ষার্থী বাকিতে খেয়ে টাকা না দেওয়ায় বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র হোটেল ব্যবসায়ী ভয়ানক বিপদে পড়েছেন। পুঁজি শেষ হয়ে যাওয়ায় নিরুপায় হয়ে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এ জাতীয় সংবাদ জাতীয় গণমাধ্যমে বেশ ফলাও করে প্রচারও হয়েছে। বাকিতে কেনাকাটা বা খাওয়া নতুন কোনো প্রবণতা নয়। তবে বিষয়টি কেন কোনো কোনো দোকান মালিকের অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে, এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও প্রশ্ন।
ধর্মীয়, সামাজিকতা ও মানবিকতা উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম মানুষের জীবন সহজ ও স্বাভাবিক করার জন্য বাকিতে লেনদেনের অনুমোদন দিয়েছে। জীবনে চলার পথে যেকোনো পদক্ষেপে একজন মানুষ যেমন ঋণ গ্রহণে বাধ্য হয়, তেমনি আকস্মিক সংকটের মুখে কিংবা অনন্যোপায় হয়ে বাকিতে কোনো কিছু কিনতেও পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে। বাকিতে বিক্রি তো একপ্রকার ঋণই। বিভিন্ন আয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। পবিত্র কোরআনে বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় এভাবে আলোচিত হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! যখন তোমরা নির্দিষ্ট মেয়াদে বাকিতে লেনদেন করবে, তখন তা লিখে রেখো।’ -সুরা আল বাকারা : ১৮২
বর্ণিত আয়াতে অবশ্য বাকিতে লেনদেনের জন্য একটি বিশেষ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের লেনদেন যেখানে হয়, সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সাধারণত কোনো ধরনের পূর্বপরিচিতি থাকে। সেই পরিচয়ের সূত্রেই একজন বিক্রেতা নগদ টাকা না পেয়েও ক্রেতার হাতে পণ্য তুলে দেয়। কথামতো মূল্য পরিশোধ করে দেওয়া তাই বিবেক ও মানবিকতার দাবি। কিন্তু মানবিকতার একটি দুর্বল দিক হলো কখনো ক্রেতা ভুলে যেতে পারে তার দেনার কথা, ভুলে যেতে পারে তার দেনার পরিমাণের কথা। এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে তখন আগের ঘনিষ্ঠতা ও পরিচিতি তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। মানবিক এ দুর্বলতা থেকে রেহাই পেতে তাই শুরুতেই তা লিখে রাখার বিকল্প নেই। কোরআন মাজিদ আমাদের সেদিকেই পথনির্দেশ করছে।
বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে বর্তমান সময়ে আমরা দুই ধরনের প্রান্তিকতা দেখতে পাই। ১. আধুনিক অনেক শপিংমল, যেখানে নগদ লেনদেনের বাইরে ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো সুযোগ নেই। ২. বিলাসবহুল কিছু পণ্যের বাকিতে ক্রয়-বিক্রয়, যেখানে নামে কিংবা বেনামে সুদের লেনদেন হচ্ছে। অথচ ইসলাম এ উভয় ধরনের প্রান্তিকতা থেকে সরে এসে আমাদের মধ্যমপন্থায় চলতে শেখায়।
বাকিতে কোনো কিছু কেনার প্রয়োজন হতে পারে যে কারও। প্রয়োজনগ্রস্ত সেসব ব্যক্তির জন্য সাময়িক বাকিতে কেনার সুযোগ রাখা যেমন মানবিকতার দাবি, তেমনি বাকিতে লেনদেনের চোরাই পথে এসে অভিশপ্ত সুদ যেন আমাদের ইমান-আমলকে ধ্বংস করে না দেয়, বাকি পরিশোধ না করে আজীবন দেনার দায়ে আটকে থাকার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়- সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখা মুমিন হিসেবে অপরিহার্য কর্তব্য।
বাকিতে লেনদেন করলে ইসলামের শিক্ষা হলো, তা লিখে রাখা। এটা মোস্তাহাব। ব্যাপকভাবে না হলেও বড় বড় লেনদেনের ক্ষেত্রে লিখে রাখার প্রচলন আমাদের মধ্যে এখনো আছে। চুক্তিপত্র লিখে রাখা মূলত ক্রেতার দায়িত্ব। ক্রেতা যদি নিজে লিখতে না পারে, তাহলে সে অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নেবে। চুক্তিপত্র যে লিখে দেবে তার জন্যও রয়েছে ইসলামের নির্দেশনা। সে যেন যথাযথভাবে লিখে দেয়, কারও পক্ষপাতিত্ব না করে এবং কেউ তাকে লিখে দেওয়ার কথা বললে সে যেন অস্বীকৃতি না জানায়।
বাকিতে লেনদেনের সময় ইসলামের আরেক শিক্ষা সাক্ষী রাখা। এটাও মোস্তাহাব। করতে পারলে ভালো। দুজন পুরুষ কিংবা একজন পুরুষ ও দুজন নারীকে সাক্ষী রাখা। পরবর্তী সময় যেন কোনো রকম ঝামেলায় জড়াতে না হয়, সে জন্য ইসলামের এ নির্দেশনা। বড় লেনদেনের ক্ষেত্রে সাক্ষী রাখার প্রচলন আমাদের সমাজেও রয়েছে। সাক্ষী রাখার নির্দেশনা তো ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য। আর যারা সাক্ষী, তাদের জন্য নির্দেশনা হলো, তাদের যখন সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকা হবে, তখন তারা যেন অস্বীকৃতি না জানায়। পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অনেক সময় অনেক ন্যায্য অধিকারীও তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাই সাক্ষী হিসেবে যখন কাউকে ডাকা হয়, তখন সে যেন সাক্ষ্য দেয়।
পারস্পরিক ঝগড়া মিটিয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এ এক সামাজিক পদক্ষেপ, সামাজিক সেবা। ব্যক্তিগত একটু কষ্ট সয়ে নিয়ে হলেও এ সেবা করা উচিত। কোরআন মাজিদের ভাষায়, ‘যে সাক্ষীদের তোমরা পছন্দ করো তাদের থেকে দুজন পুরুষকে সাক্ষী রেখো, যদি দুজন পুরুষ না হয় তাহলে এক পুরুষ ও দুই নারী...। আর সাক্ষীদের যখন ডাকা হয় তারা যেন অস্বীকৃতি না জানায়।’ -সুরা বাকারা : ১৮২
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নিয়ে মাঝেমধ্যেই কথা ওঠে। শোরগোল পড়ে। শোরগোলটা পড়াও দরকার। যেহেতু শিক্ষা একটি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মনীষীরা যাকে বলেন মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন কারও পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না, তেমনি একটি জাতিও শিক্ষা বা সুশিক্ষা ছাড়া মাথা উঁচু করে বিশ্বসমাজে দাঁড়াতে পারে না। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে সারা বছরই কথা বলা দরকার। জাতির মেরুদণ্ডের যত্ন দরকার। এবং জাতির এই অঙ্গের সমস্যার বিষয়ে বা এর পরিপুষ্টতার বিষয়ে মাঝেমধ্যেই আলোচনার দরকার। এই আলোচনা থেকেই ইতিবাচক ফল আসবে।
এ যুগে সবাই মানেন, শিক্ষিত জাতি একটি সমাজের সম্পদ। কিন্তু সেটা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তখন সে সমাজ কখনো একটি দেশকে এগিয়ে নিতে পারে না। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। এই শূন্যতাটা বুঝা যায় আমাদের সমাজের নানা স্তরে বুদ্ধিভিত্তিক ও সাংস্কৃতিকসহ নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার চিত্র দেখে। অথচ একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা গেলে অন্যসব সমস্যার সমাধান করা একেবারেই সহজ হয়ে যায়। কারণ, সুশিক্ষিত নাগরিক অপরাধ করে কম, বা করেই না। গত কয়েকদিন ধরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের সপ্তম শ্রেণির নতুন বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তকে বেশ কিছু অনুচ্ছেদের ‘কুম্ভিলকবৃত্তি’ নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটিকেও বড় কোনো ঘটনা হিসেবে মনে করছি না। এরচেয়েও বড় আলোচ্য বিষয় আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নিয়ে।
২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী জাতীয়ভাবে এখন এ দেশে সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ। ইউনিসেফের তথ্য বলছে, ১৯৭১ সালে আমরা যখন স্বাধীনতা লাভ করি, তখন দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ। সেই হিসাবে আমরা এখন শিক্ষায় বিরাট এক অগ্রগতি লাভ করেছি। এই যে শিক্ষার হারের উচ্চগতি, তারপরও সমাজের নানা স্তরে দেখা যায় নৈতিকতাবোধের বিপুল ঘাটতি। স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ১৬.৮ শতাংশ শিক্ষিত নাগরিকের একটি সমাজ সেই সময় এদেশ স্বাধীন করার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিতে কার্পণ্য করেনি। আর এখন ৭৪ শতাংশ শিক্ষিত মানুষের সমাজে এমন একটি সংগ্রাম দরকার পড়লে কতজনকে পাওয়া যাবে? সংগ্রামের কথা তো দূরে থাক, এখন ভালো কাজে রাজি হওয়ার লোকই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই যে দেশে শিক্ষার হার আমরা বাড়িয়ে তুলেছি, জিপিএ ৫, স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডির ছড়াছড়ি; কিন্তু সুশিক্ষিত মানুষ সেভাবে দেখতে পাচ্ছি না। বরং মানুষ এখন যত শিক্ষিত হচ্ছে, কীভাবে যেন ততই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠছে! মেধাবী নয়, তারা হয়ে উঠছে একেক জন চালাক-চতুর। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। গুণগত মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত হলে এ প্রজন্মের নাগরিকরা নৈতিকভাবে শক্তিশালী হতো। দেশে অন্যায়-অপরাধ কমত। কিন্তু সে-রকম দৃশ্য তো দেখা যাচ্ছে না। এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, নিশ্চয়ই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সংকট আছে, সমস্যা আছে। আর চারদিকে চোখ মেলে তাকালেই এই সংকটের তীব্রতা আমরা আঁচ করতে পারি।
মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জিনিসটাই এখন উঠে গেছে। পরস্পরকে ঠকানোর এক প্রতিযোগিতায় নেমেছে মানুষ। এদের বেশিরভাগই কাগজে-কলমে সনদধারী, শিক্ষিত। যারা যত বেশি শিক্ষিত হয়ে উঠছে, তারা যেন তত বেশি চালাক হয়ে উঠছে। প্রতারণার ষোলোকলা রপ্ত করাই যেন শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য হয়ে উঠছে। দুর্নীতি করার জন্য যে শক্তি বা যোগ্যতা দরকার, সেটিই যেন তারা অর্জন করতে শিক্ষা নামের অস্ত্রের দ্বারস্থ হচ্ছে। অথচ আগের কালের মানুষ পড়তে জানত না, লিখতে জানত না। তবু মানুষের মনে ছিল না প্রতারণার এত ফন্দিফিকির। তারা কথা দিলে সে কথা রাখতে জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতেন। তারা কঠোর নৈতিকতা মেনে চলতেন। তারা বলতেন, ওয়ার্ড ইজ ওয়ার্ড! জবান জবানই। আর এখনকার শিক্ষিত মানুষজন লিখিত দিয়েও সেটি অস্বীকার করে বসে!
এই যে নৈতিকতার অধঃপতন, এই যে আদর্শহীনতা, এখান থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে পারছে না বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং গবেষকরা বলছেন, আধুনিক ও প্রতিযোগিতামূলক এখনকার বিশ্বে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃত জ্ঞান সৃষ্টি ও টিকে থাকার কোনো উপায় খোঁজার সহায়ক নয়। শৈশব থেকেই অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে থাকায় একসময় পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই শিক্ষার যথোপযুক্ত পরিবেশও। এমন অবস্থার মধ্যেই নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। ওদিকে গ্র্যাজুয়েটদের তুলনায় কাজের সুযোগ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠছে একেকটি হতাশা সৃষ্টির কারখানা। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে কারিকুলাম প্রণয়ন করে কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় সংকট হলো ত্রুটিপূর্ণ সিলেবাস। পড়ার বিষয়বস্তু ঠিক না রেখেই পড়ানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। ফলে শিক্ষার্থীরা কী পড়ে, কেন পড়ে সেটাই বুঝে উঠতে পারে না তারা। শুধু পড়ার প্রয়োজন তা-ই পড়ছে তারা। এ দেশে শিক্ষা মানেই শুধু বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা, পাঠ্যবই মুখস্থ করা বা পরীক্ষার খাতায় জিপিএ ৫ অর্জন করা। অথচ শিক্ষা মানে হলো অর্জন আর প্রয়োগের বিষয়। যেটার ধারেকাছে নেই আমরা। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশের শিক্ষার মান একদম তলানিতে। মানসম্মত উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং উদ্ভাবন এ তিন দিক দিয়েই আমরা অনেক পিছিয়ে। বিশ্বের উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলো যেখানে বিভিন্ন গবেষণা এবং নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে ব্যস্ত, তখন আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত থাকতে হয় জীবন-জীবিকা নিয়ে। তারপরও শিক্ষা শেষে মেলে না কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা।
ভর্তির পরপরই প্রতিষ্ঠান কর্র্তৃক শিক্ষার্থীদের মনে শিক্ষার আগ্রহের বীজটুকু বপন করানো জরুরি। বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনায় নির্দিষ্ট বিষয়াবলির প্রয়োগ ঘটানো জরুরি। পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত নৈতিক, মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক এবং ক্যারিয়ারবিষয়ক সেশন নেওয়া উচিত। কিন্তু সেসবের বালাই নেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। আমাদের দেশে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবাদাতাদের আচরণ, ভদ্রতাবোধ, সততা, কাজের দক্ষতা ও আন্তরিকতার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব বিবেচনা করলে দেখা যায়; আমাদের এই কর্মীরা একেবারেই অপেশাদার। সেবাগ্রহীতারাও একই রকম পরিচয়ের স্বাক্ষর রাখেন। কারণ আমরা সবাই একই শিক্ষাব্যবস্থার ফসল। শুধু চাকরিজীবী নন, প্রায় সব পেশাজীবীর মধ্যেই এ ঘাটতি রয়েছে। নিউইয়র্কভিত্তিক সিইও-ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন ২০২০ সালে সেরা শিক্ষাপদ্ধতির দেশগুলোর একটা তালিকা তৈরি করেছিল। ওই তালিকার ৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই! অথচ ওই তালিকায় মিয়ানমার, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারত স্থান পেয়েছে। এতে বোঝা যায়, পর্যাপ্ত সুনাগরিক তৈরির উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি এ দেশে।
শিক্ষার্থীরাই জাতির ভবিষ্যৎ। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে কোনো কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি না করলে সেটি জাতির ভবিষ্যৎও তৈরি করবে না। অতিরিক্ত, অযৌক্তিক, অবাঞ্ছিত সিলেবাসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া জিপিএর লোভ থেকে বের হতে হবে। শিক্ষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। যেটি এ দেশে হারহামেশা ঘটছে। এখানে শিক্ষার্থীদের নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাধ্যগতভাবে গতানুগতিক ভালো ফলাফল এলেও এই শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন কিংবা রাষ্ট্রের কী কাজে লাগবে তা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই জানে না। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষায় তৈরি হয়েছে চাকরির বাজারের অনিশ্চয়তা। যার দরুণ ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষার্থীরা আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে।
চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যাচ্ছে, সারা দেশে ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অন্তত ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এই অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর দায় আমরা এড়াতে পারি না। এ দায় যারা শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদেরই। শুধু আত্মহনন নয়, গোটা জাতির পতন ঠেকাতে এখনই শিক্ষাসংকটের সমাধান করতে উদ্যোগী হতে হবে আমাদের। না হয় তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নানা সম্ভাবনা থাকার পরও ছিটকে পড়তে হবে আমাদের।
লেখক: সাংবাদিক
১৮৮২ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন আধুনিক ভারতীয় শিল্পের প্রবর্তক নন্দলাল বসু। তিনি ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিষ্য। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বামী বিবেকানন্দ ও সিস্টার নিবেদিতার আধ্যাত্মিকতা, প্রাচীন ভারতের শৈল্পিক ঐতিহ্য এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা নন্দলালকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তার প্রথম দিকের অনেক ধর্মীয় এবং পৌরাণিক শিল্পকর্ম অজন্তা এবং অন্যান্য ঐতিহ্যগত প্রাচীরচিত্রের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অঙ্কিত হয়েছে। ১৯১৪ সালে নন্দলাল শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসেন। ১৯২০ সাল থেকে শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করেন এবং ১৯২২ সালে কলাভবনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নন্দলাল আধুনিক ভারতের প্রাচীরচিত্র পুনরুজ্জীবনে নেতৃত্ব দেন এবং নিজেও কিছু স্থানে প্রাচীরচিত্র অঙ্কন করেন। নন্দলালের কোনো কোনো ছাত্র, যেমন, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রাম কিংকর বেইজ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত শিল্পী হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। ১৯৩০ সালে লবণ-আন্দোলনে গান্ধীর গ্রেপ্তারের ঘটনাকে স্মরণীয় করে তোলার জন্য তিনি লাঠি হাতে পদযাত্রারত গান্ধীর একটি বস্ত্রখোদিত নকশা অঙ্কন করেন। এটি অহিংস-আন্দোলনের একটি আদর্শ ছবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৫১ সালে তিনি কলাভবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং তাকে প্রফেসর ইমেরিটাস পদ প্রদান করে সম্মানিত করা হয়। ১৯৫২ সালে বিশ্বভারতী তাকে দেশীকোত্তম উপাধি এবং ১৯৫৪ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৬৬ সালের ১৬ এপ্রিল তার মৃত্যু হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু জনঘনত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এক-তৃতীয়াংশ নগর সুবিধায় ঢাকায় চার গুণের বেশি মানুষের বসবাস। অবকাঠামো বিবেচনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ বহন করছে দেশের রাজধানী শহর।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে। ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন।
দুই সিটিতে বিভক্ত ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহরে জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়।
রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।
ড্যাপে আরও বলা হয়েছে, ঢাকার লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বসবাস করে। জনঘনত্বের দিক থেকে যা বিশে^র সর্বোচ্চ। চকবাজারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বসবাস করে। যা বিশে^ তৃতীয়। কোতোয়ালিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৩ জন বসবাস করে। যা জনঘনত্বের দিক থেকে বিশে^ দশম।
রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে মূল ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেখান থেকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের জন্য অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মূল ঢাকার জনঘনত্ব কমবে। আর জনঘনত্ব কমলে মূল ঢাকা অনেকাংশ বসবাস উপযোগী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এ সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটি এলাকার প্রায় ৮২ ভাগ কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে।
পরিকল্পনাবিদদের এ সংগঠটি বলছে, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয় ১৫ শতাংশ, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ ভাগ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তবে কোনো শহরের ৪০ ভাগের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
নিরাপত্তার বিবেচনায়ও ঢাকা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে, সেটা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৮ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৫ শতাংশ। আর গত বছর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভবিলিটি ইনডেক্স অনুসারে ঢাকা বিশে^র সপ্তম কম বসবাসযোগ্য শহর।
চলতি মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সাড়ে আট ভাগ সবুজ রয়েছে। ঢাকার উন্মুক্ত স্থান ও জলাশয়কেন্দ্রিক সুবজ এলাকা ধরে এ গবেষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে চার গুণ অর্থাৎ, ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। ভালো হতো ১২ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা থাকলে।
তিনি বলেন, ঢাকার বাস্তবতা বিবেচনায় চাইলেই আদর্শ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে না। ইচ্ছা করলেই এখন সড়কের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে এখনো কিছু উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। সেটা হলো, বিদ্যমান সড়কগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
ড. আদিল বলেন, ‘ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানো তো দূরের কথা, যেগুলো আছে সেগুলোও টিকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। এ জন্য পলিসি পর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো ঢাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাজউকের ড্যাপের কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করে ঢাকার জনঘনত্ব কমানো এবং গণপরিসর বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকার জনঘনত্ব কমাতে ঢাকায় নতুন কোনো কর্মস্থান সৃষ্টি করা যাবে না। যেমন শিল্প, কলকারখানা এবং অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাহলে জনসংখ্যার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।’
পরিকল্পনা হয় বাস্তবায়ন হয় না : ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগরপরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করে ব্রিটিশরা। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ।
এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।
বাংলাদেশে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি ধরা হতো। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এ মাস্টারপ্ল্যানের নাম ড্যাপ। মাস্টারপ্ল্যানটি পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ ভাগ সঠিক ছিল। তবে ৩০ ভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
আজ বুধবার (২৯ মার্চ) ভোর ৫টায় দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমবাগান এলাকার নিজ বাসা থেকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-এর একটি দল।
স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলো পত্রিকার আলোচিত রিপোর্টটির কারণে তাকে আটক করা হয়েছে বলে সিআইডির দলটি উপস্থিত ব্যক্তিদের জানিয়েছেন।
এভাবে গভীর রাতে তল্লাশি চালিয়ে একজন সংবাদকর্মীকে আটক বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর চরম আঘাত বলে মনে করে গণতন্ত্র মঞ্চ। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দ।
কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বানানোর পর থেকেই বিরোধী মতের রাজনৈতিক কর্মীরা যেমন মতপ্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তেমনি গণমাধ্যম কর্মীরাও নির্যাতিত হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামসহ সারাদেশে বহু গণমাধ্যমকর্মীদের ওপরই সরকারি সংস্থা কিংবা দলের লোকের নির্যাতনের খবর এসেছে। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে শামসুজ্জামান শামসকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানাচ্ছে। সেই সাথে গণমাধ্যম কর্মীসহ মত প্রকাশের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে তাদের মামলা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবী জানান নেতৃবৃন্দ।
চারদিকে পাহাড় ও সবুজের অরণ্য। এই সবুজ বিনাশ করে সড়ক নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। পাহাড়ি এলাকায় সড়ক নির্মাণের প্রকৌশলগত জ্ঞানের অভাব কিংবা অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা, রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার অংশ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের আওতায় চলে যাওয়া বা রেল লাইনের ওপর ব্রিজ নির্মাণসহ নানা জটিলতায় একের পর এক আটকে যাওয়া প্রকল্পটি ইতিমধ্যে ২৭ বছর পার করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ও পরিমার্জনে শুরুর ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৩৫৩ কোটিতে পৌঁছেছে। তারপরও শেষের দেখা নেই ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ ডিটি-বায়েজীদ (বায়েজীদ লিংক রোড) সংযোগ সড়কের।
দীর্ঘদিন ধরে রেললাইনের ওপরে নির্মিত ব্রিজের কাজ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পর এখন চলছে। গত সপ্তাহে দেখা যায়, রেললাইনের ওপরের অংশে গার্ডার বসানোর কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। এতদিন রেললাইনের উভয় প্রান্তে গার্ডার বসলেও রেললাইনের ওপরের অংশে খালি রাখা হয়েছিল। রেললাইন বিড়ম্বনার পাশাপাশি রোডের গা ঘেঁষে রয়েছে সুউচ্চ পাহাড়। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে রাস্তার ওপর পড়তে পারে এবং এতে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। অর্ধকাটা এসব পাহাড় নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও রোড নির্মাণ বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মধ্যে বিরোধ চলছে। পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। অর্ধকাটা এসব পাহাড় কেটে ঝুঁকিমুক্ত করার বিষয়ে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখনো এর সুরাহা নেই। যথারীতি আরেকটি বর্ষা আসছে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে খাড়া পাহাড়। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে জানমালের ক্ষতি হতে পারে সেই শঙ্কায় গত বছর বর্ষায় এই রোডে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে। এবারও কি একই পথে হাঁটতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় রোড বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাহাড়ের বিষয়টি নিয়ে এই সপ্তাহে পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের মিটিং রয়েছে। আশা করছি বিষয়টি সুরাহা হবে।’
এদিকে পাহাড় নিয়ে সুরাহার পথ সুগম হলেও জনগণের যাতায়াতের ওপর টোল বসাচ্ছে সিডিএ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে নগরবাসীর চলাচলের কোনো পথে টোল নেই (কর্ণফুলী সেতু ও টোল রোড ছাড়া)। এরমধ্যে টোল রোডটি শুধুমাত্র পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্মিত। কিন্তু ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়কে টোল যুক্ত হতে যাচ্ছে। ৩২০ কোটি টাকার প্রকল্প সরকার ৩৫৩ কোটি টাকায় বর্ধিতকরণের অনুমোদনের সময় অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা টোল আদায়ের মাধ্যমে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘রোড মেইনটেনেন্স আমরা করব। একইসঙ্গে সড়কবাতি স্থাপন, রেললাইনের ওপরে ব্রিজ নির্মাণ, নালা সংস্কার কাজগুলো নতুন করে করা হবে।’ টোল প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘টোল প্লাজা বসবে ফৌজদারহাট অংশে। শহর প্রান্ত দিয়ে এসে টোল প্লাজা ক্রস করলেই শুধুমাত্র টোল দিতে হবে। রোডের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে গেলে টোল দিতে হবে না।’
কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, চলতি বছরের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করে দ্বিতীয় ব্রিজটি চালু করে আনুষ্ঠানিকভাবে তা ওপেন করে দিতে চাই। যদিও ইতিমধ্যে এই রোড দিয়ে অনেক যান চলাচল করছে। কিন্তু ওভারব্রিজটি চালু না করায় তা পূর্ণতা পায়নি।
টোল কবে থেকে যুক্ত হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আগামী বছর থেকে টোল যুক্ত হতে পারে।’
সড়কের ইতিবৃত্ত বায়েজীদ বোস্তামী রোডের সঙ্গে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডকে (ডিটি রোড) যুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রায় ছয় কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকার ওপর দিয়ে এই রোড নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ৪০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পের অধীনে ব্যাপক হারে পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করলেও বর্ষা এলেই পুরো রাস্তাসহ পাহাড়ি ঢলে চলে যেত। ফলে প্রকল্পটি বারবার হোঁচট খায়। এই প্রকল্পের মাঝখানের এক কিলোমিটার অংশ আবার এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন করার সময় তাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যায়। ফলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের বাইরে দিয়ে নতুন করে বাঁক নিয়ে সড়কের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। দুই লেনের সেই প্রকল্প প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এসে আবারও নকশায় পরিবর্তন। এবার দুই লেনের পরিবর্তে চার লেনে উন্নীত করা হয়। যথারীতি বাজেট ৩২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২১ সালে এসে তা ৩৫৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
প্রথমবারের মত মা হলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি।
মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) রাত ১১টা ২০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মাহির স্বামী রাকিব সরকার।
তিনি জানান, মা ও ছেলে দুজনেই সুস্থ আছেন। পুত্রের নাম এখনও ঠিক করা হয়নি বলে জানান তিনি।
২০১২ সালে ‘ভালোবাসার রঙ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক ঘটে রাজশাহীর মেয়ে মাহির। পরবর্তীতে ‘অগ্নি’ ‘কী দারুণ দেখতে, ‘দবির সাহেবের সংসার’, ‘অনেক সাধের ময়না’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
দুই বছর আগে গাজীপুরের ব্যবসায়ী রকিবকে বিয়ে করেন মাহি। তার কয়েক মাস আগে পারভেজ মাহমুদ অপুর সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মা হচ্ছেন বলে খবর দিয়েছিলেন এই চিত্রনায়িকা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’