
প্রতি বছরের মতো এবারও তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলন শেষ হলো। ২৪ জানুয়ারি শুরু হওয়া এ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ২৫টি নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি ডিসিদের স্মরণ করিয়ে দেন, জনগণকে কাক্সিক্ষত সেবা দেওয়া প্রতিটি সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয় অনুরোধ করব, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনগণ কী ধরনের সেবা পাচ্ছেন তার একটি সঠিক ও গোপন প্রতিবেদন যদি তিনি সংগ্রহ করতে পারেন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে জনগণের সেবাপ্রাপ্তির একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে পারেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে, তাহলে অনেক বেশি কাজ হবে। কারণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রকৃত অর্থে জনগণের সেবাপ্রাপ্তিতে হয়রানির পরিমাণ যে কত বেড়েছে তা সম্ভবত তাদের কানে পৌঁছায় না।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী দেশের পরিবেশ ও বনের সুরক্ষা ও উন্নয়নে জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা চেয়েছেন। যত্রতত্র অবৈধ ইটভাটা স্থাপন, জ্বালানি হিসেবে বনজ কাঠের অবৈধ ব্যবহার, অবৈধভাবে পাহাড়-টিলা কর্তনকারী, অবৈধ করাতকল, বনভূমি ও নদী-খাল-জলাশয় জবর দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকদের তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ, বনায়ন কার্যক্রম, ইউক্যালিপ্টাসসহ ক্ষতিকারক বৃক্ষরোপণ রোধ, বনভূমি বন্দোবস্ত না দেওয়া, অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী ও পরিযায়ী পাখির নিধন প্রতিরোধ, সংরক্ষিত বন ঘোষণার কার্যক্রমে জেলা প্রশাসকদের সহায়তা কামনা করেন। তিনি সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নিষেধাজ্ঞাকালে মৌয়াল ও জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিধিভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ বিষয়েও কথা বলেন। সেন্টমার্টিনে যাতে কোনো অবস্থাতেই নতুন স্থাপনা গড়ে না উঠে সেদিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করেছেন। তবে জেলার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মকর্তার কী কাজ তা আমরা শুনতে পেলাম না।
স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে জেলা প্রশাসকদের সহায়তা চেয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, এখন প্রয়োজন এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা। মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের জেলাপর্যায় পর্যন্ত মোটামুটি ঠিক আছে, কিন্তু উপজেলাপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার মান এখনো উন্নতপর্যায়ে পৌঁছায়নি। আমাদের প্রত্যেক উপজেলা সরকারি হাসপাতালে এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন আছে। কোথাও কোথাও টেকনিশিয়ান না থাকায় সেগুলোতে একটু সমস্যা হচ্ছে। আবার কোথাও মেশিনে কারিগরি ত্রুটি থাকতে পারে। তবে মেশিন নেই, এ কথা ঠিক না।’ তো এখানে ডিসি কী করবেন? জেলায় একজন সিভিল সার্জন আছেন, তার কাজ কী? শুধু বদলি করা। জনপ্রতিনিধির কাজ কী? সরকারি এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতেও চাই না কারণ হতাশা আরও বাড়ে। মন্ত্রী বলেছেন, জেলা পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা ঠিক আছে। মন্ত্রী সরকারের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেই পারেন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, দেশের সাধারণ মানুষের আসলে কি কোনো চিকিৎসা আছে? অসুস্থ হলে যাদের সংগতি আছে তারা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড আর ভারতে যান। বাকিরা দেশের উপজেলা থেকে শুরু করে রাজধানীর সব প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। যাদের কোনো ধরনের সামর্থ্য নেই তারা সরকারি হাসপাতালে যান চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সেখানে কি চিকিৎসা হয়, তাদের কত কী অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। সেখানে যারা চিকিৎসা করান না তারা জানবেন না। আমার মনে আছে, বাংলাদেশি এক প্রবাসী সরকারি হাসপাতাল দেখে এসে আমাকে বললেন, এ তো গরুর খোঁয়াড়ের চেয়েও খারাপ। ওখানে গেলে তো মানুষ আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।’ এটি কারুর একক দোষ নয় বা মন্ত্রীকেও বলছি না। এটি আমাদের কালচার। এই কালচার কবে পরিবর্তন হবে আমরা কেউ জানি না।
প্রতিটি জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা, খাদ্য কর্মকর্তা, বন কর্মকর্তা রয়েছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগেই প্রায় সমমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পালন করেন। তারপরও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে জেলা প্রশাসকদেরই রাষ্ট্রের কেন্দ্র থেকে সরাসরি বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়। এখানে আমরা কিছুটা হলেও ব্রিটিশ রাজ প্রবর্তিত সেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, যারা সাদা চামড়ার মানুষ পাক-ভারত উপমহাদেশকে কীভাবে শাসন করেছিল সেই প্রথাই যেন অনুসরণ করছি। আমাদের জনপ্রতিনিধিরা যদি সঠিক ও নিরপেক্ষ আচরণ প্রদর্শন করে সে অনুযায়ী কাজ করার উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারতেন, তাহলে সরকারি একজন কর্মকর্তার ওপর রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে এত নির্ভরশীল হতে হতো না। ব্রিটিশ যে কারণে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদটি বানিয়েছিল প্রায় আড়াইশ বছর পরও তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি যদিও আমরা দুবার স্বাধীন হয়েছি। আগের ডিসি সম্মেলনগুলোতে ডিসিরা বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষমতা চাইতেন। এবার নাকি তারা এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের রাজনীতি বন্ধ করার কথা বলেছেন। এভাবে ২৪৪টি প্রস্তাব তুলে ধরার কথা শোনা যাচ্ছে।
চমৎকার সেবা! জনগণ যত সাধারণ, রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের অত্যাচার তাদের ওপর তত বেশি। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো পথই নেই বরং এই ওজন যেন আরও দিন দিন বাড়ছে। আমরা যদি নির্দিষ্ট কিছু সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে পারি তাহলে হয়তো জনগণ আশা করতে পারে যে, তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কিছুটা হলেও উপকার পাবে। তা না হলে তাদের জিম্মি করে রেখে সব প্রতিষ্ঠানই সেবার পরিবর্তে হয়রানি উপহার দিয়ে যেতে থাকবে। জনগণের এসব দুর্দশা দেখার আসলে কেউ আছে কি?
লেখক : প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)
আনন্দের কথা, পরিতুষ্টি ও তৃপ্তির কথা আগামীকাল আমি যেন পুনর্জন্ম লাভ করতে যাচ্ছি। এই কসমোপলিটন অথচ বায়ুদূষণে সেরা শহরের ঘিঞ্জি অলিগলি থেকে উদার উন্মুক্ত পরিবেশে সুরম্য সুউচ্চ সুবিস্তৃত রাজস্ব ভবন হিসেবে আমার দ্বার উদঘাটন হবে রবিবার। আমাকে সবাই চিনে না। তবে সমাজের যাদের আয়-রোজগার ভালো, যারা ব্যবসাপাতি করে খায়, জাহাজের খবর যারা রাখে তাদের তো আমারে চেনার কথা। শুনেছি অনেকে আমাকে চেনে, অনেকে আমার নাম শুনেছে, জানে। কিন্তু আমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চায়, আমার সঙ্গে দেখা না হলে ভালো, এমন মনে করে কেউ কেউ। নিজের দেশে না খাটিয়ে, কাজ-কাম সৃষ্টি না করে চুরি-বাটপারির টাকা যারা হরহামেশা বিদেশে পাঠায় তারা তো আমাকে চিনেও চিনবে না, জেনেও জানবে না, তাদের কাছে আমার বার্তা পৌঁছাতে আমি নব বলে বলীয়ান হতে যাচ্ছি। দেশে যারা সুবোধ সুশীল সদাচারে সুশাসনে ন্যায্যতায় বিশ্বাসী তাদের আরও উন্নত সেবা দেওয়ার সক্ষমতা পাবএ প্রত্যাশা ও প্রতিজ্ঞায় সবাইকে নতুন রাজস্ব ভবনে স্বাগত জানাই।
মিডিয়ার বন্ধুদের প্রতি আমি সবিশেষ কৃতজ্ঞ। তারাই তো আমার কথা ও ছবি হরহামেশা প্রকাশ ও প্রচার করে। বিট আপা, বিট ভাইয়ারা আমার খোঁজ করেন, আমার এখানে যাতায়াত করেন। আমার কাজকর্মের তারিফ যতটা না করেন তার চেয়ে আমার ভেতরের অনেক বিষয়-আশয় নিয়ে খোঁচাখুঁচি করেন বেশি। এটাকে আমি স্বাগত জানাই, কারণ সবার সঙ্গে আমার জানাশোনা যত বাড়বে তত আমাদের সবার জন্য ভালো। আমার সঙ্গে যাদের আনন্দ(?) কিংবা বিরাগ-বিষাদের যোগাযোগ তাদের সহায়তা করতে সাহায্য করার বিষয়ে মিডিয়ার ভূমিকাকে আমি বড় মূল্যবান মনে করি। আমার কর্মকাণ্ডের পরিসংখ্যানের সুচতুর সমালোচনায় ঘরে-বাইরে ও সবার মধ্যে যে কাণ্ডজ্ঞান ও দায়িত্ববোধ বাড়ে, সেদিকে তারা নজর যেমনটি দিচ্ছেন, সেটি যেন আরও জোরদার, রাজস্ব আহরণের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। এটি সবাইকে বোঝাতে চাই এ দেশ অর্থনীতি, সমাজ একান্তভাবে আমাদের, এর আয়-উন্নতি আমাদের জন্য দরকার। দূরে কিংবা কাছের জনের পরামর্শ, খবরদারি, শর্ত মেনে আমাকে চলতে হবে কেন। আমাদের যার যা আছে তা দিয়েই তো আমরা আমাদের উন্নতি, উন্নয়ন করতে পারি। নতুন রাজস্ব ভবন থেকে একটি স্বাবলম্বী, স্বয়ম্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার আহ্বান আমরা জানাতেই পারি। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে বর্তমানে আমরা যে পর্যায়ে পৌঁছেছি, সে সাফল্যের মর্মমূলে, মিডিয়ার সৌজন্যে সাড়া জাগাতে পেরেছি এটা কম কীসে।
এই আমার নিজের আবাসস্থলের কথাই ধরুন। পুরনো প্যাঁচানো সরকারি ভবনে আমার বাল্যকাল, কৈশোরকাল পেরিয়ে সাত দশক পার করেছি। আমার ছানা-পোনারা অমুকের গলি, তমুকের আস্তানায় এখনো ভাড়া থাকে। হায়রে কপাল, ভাড়াটিয়া হয়ে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে মাসোহারা পাই কেমনে? লোকে সেই ভাড়াটিয়া বাড়িতে বছরে একবার-দুবার আসে, গন্ধে মুখ সিটকায়। অন্ধকার ঘরে আগের হিসাব-কিতাবের কাগজ ঠিকমতো রাখার পারি না। ঘনঘন বাসা পাল্টানোয় তারা আমার আস্তানা ঠিক মনে রাখতে পারে না। সবাই কর মেলায় যেতে চায়। কর মেলার পরিবেশ পেতে চায়। এখন অনলাইনে সব সারার জন্য সবাই উন্মুখ। অনলাইন সবাইরে দেওয়ার জন্য, দেখভাল করার জন্য, তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের জন্য যে যোগ্য মানুষ দরকার, পরিবেশ প্রয়োজন সে জন্য আমি এখনো চেয়েচিন্তে চলেছি। নতুন আবাসে সার্ভার সুস্থ-সক্রিয় ও সুরক্ষা পাবেএ আশায় বুক বেঁধে আছি। আমি ভেবে রেখেছি শুধু ভবন সুন্দর হলে চলবে না, আমার কাজের মান, সবার সঙ্গে আচার-আচরণ, ব্যবহারের মাত্রায়ও যেন পরিবর্তন আসে, আমাকে আরও দায়িত্ব-কর্তব্যসচেতন হতে হবে।
আগামীকাল আমি নতুন গৃহে খাসা একটি বাড়ি জম্পেশ আয়োজনে যেতে যাচ্ছি। রাজধানী শহরে এ রকম একটা বাড়ি পেতে কতটাকাল অপেক্ষা করেছি জানেন? মোটামুটি প্রায় দুই দশক। হায়রে কপাল, আমার আশপাশে, দূরে-অদূরে কত শত সুরম্য ভবন হলো যাদের নির্মাণের নামে আমারই আহরিত টাকা ব্যয়ের খেলা আমি শুধু দেখেই চলেছি, সেসব ভবন বানানেওয়ালারা সুরম্য ভবন নির্মাণের মধ্যে গুড়ের সন্ধান পেয়েছে বলেই সেগুলো সত্বর তৈরি হয়েছে। আমি যে টাকা জোগাড় করি সেই টাকা এদিক-ওদিক করে অনেকের দেশ বিদেশে ঘরবাড়ি বানানো বাড়ছে অথচ আমার ঘর বাঁধার টাকা ও লোক সময়মতো পাওয়া যায় না। আমাকে যারা পছন্দ করে না তারা তুষ্টির ঢেকুর তোলে আমাকে ভাড়াবাড়িতে রেখে। উপজেলাপর্যায়েও অনেকের নিজস্ব বাড়ি আছে। আমার বেলায় ন্যূনতম নতুন জেলা শহরেও নগেনের গলি খগেনের আস্তানায় থাকার ব্যবস্থা চলছে তো চলছেই। গবেষণা, কর্মপরিকল্পনা, সবাইকে এক শামিয়ানায় আনা? উপজেলায় পয়সাওয়ালাদের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। আর তাদের দোরগোড়ায় গিয়ে যে খোঁজখবর করব তা আমি পারি না। তাহলে এটা কারণ কি না সবাই হয়তো বুঝবার পারছেন আমার সক্ষমতা বাড়ুক এটা তারাই চান না যাদের কাছ থেকে আমি সবার জন্য রাজস্ব সংগ্রহ করি। হায়রে যাদের সঙ্গে আমার নিত্য-সাক্ষাৎ হওয়ার কথা আলাপ-আলোচনা দরকার তারাই আমার জনপ্রিয়তা বাড়–ক চায় না। স্বাধীনতার পর প্রথম দশক ছিল পুনর্বাসন পুনর্গঠন, সে সময় বিদেশের অনুদানে চলা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না, অর্থনীতির যে অবয়ব, সেখান থেকে রাজস্ব আহরণের অবকাশ তেমন মেলেনি। কিন্তু আশির দশকে? যখন বিদেশি দেনায় একশ ভাগের বেশি উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়িত চলেছে তখনো আমার কথা কেউ ভাবেননি। বিদেশেও মুখাপেক্ষী হতে গিয়ে আমাদের নিজস্ব আয়-উপার্জনে নজর দেওয়া হয়নি। আমার লোকবল ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্প্রসারণের দাবি বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে এসে টনক নড়তে শুরু করে, কিন্তু অর্থনীতি যেভাবে হঠাৎ করে বড় হয়েছে, সেই অর্থনীতি থেকে রাজস্ব আয়ে আমার সক্ষমতা বাড়ানো যায়নি, অর্থনীতির অগ্রযাত্রার সঙ্গে আমার পথচলায় সমীকরণ মেলেনি বলেই আমাকে আজ নানান কথা শুনতে হচ্ছে, আইন সংস্কারে বিলম্ব, মেশিন দিতে বিলম্ব, অনলাইনে যেতে বিড়ম্বনাসব এখন আমাকে মাথায় নিতে হচ্ছে। আমাকে এড়িয়ে চলাদের গতি ও শক্তি বাড়ছে জ্যামিতিক হারে আর আমি গাণিতিক হারে সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়েই চলেছি।
আসলে আমাকে তো আইনকানুন কষে ধরে-বেঁধে রাজস্ব নিতে হয়, এর জন্য যে মেধা, যে প্রজ্ঞা, যে পারদর্শিতা দরকার তা আমার না বাড়ুক এটা তো তারা প্রকারান্তরে চাইবেনই না, ভাবখানা এই যে, আমি যেন তাদের ফাঁকি-যুকির নিয়ন্ত্রণে সবলতায় সফলতায় বড় হই। সেই প্রমাণই পেলাম দুই দশক সময় নিয়ে বানানো আমার নয়া বাড়ি, নিজের বাড়ি ‘রাজস্ব ভবন’-এ গৃহ প্রবেশের সময়। আমার পুরনো বাড়ির কাছে একসময় একটি বড় পুকুর ছিল, হিসাব নিরীক্ষা বিভাগের জুনিয়র অফিসাররা আশির দশকের শুরুতে সেখানে অডিট বিভাগের দপ্তর হবে, নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হতে হতে ওই অফিসাররা রিটায়রমেন্টে চলে গিয়েছেন।
আমাকে লোকবল না দিয়ে, আমার সক্ষমতা না বাড়িয়ে, পারঙ্গম হতে সহায়তা না করে আমাকে খালি খালি রাজস্ব আহরণের মোটা তাজা লক্ষ্যমাত্রা ধরিয়ে দেওয়ায় যাদের আমি চিনি, জানি শুধু তাদের কাছ থেকে বারবার বেশি করে চাইতে থাকি। কীভাবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পথে হাঁটতে গিয়ে আমি যা-যা করি তাকে অনেকে অযথা হয়রানি বলে থাকেন। নিজে ফাঁকি দেওয়ার পথ খুঁজবেন, আমাকে পারঙ্গম না করে এড়িয়ে চলার পথ খুঁজবেন, তাদের কাছে ন্যায্য হিসাবমতো রাজস্ব চাইতে গেলে, পাইতে গেলে আমার ভূমিকাকে ভিন্নভাবে দেখানো হয়, যা সংগ্রহ করি তাও আবার খাজাঞ্চিখানায় ঠিকমতো যায় না, সবাই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন, চাই ফাঁকি দিতে, ফন্দি আঁটবেন আর তার সব দোষ-দায়-দায়িত্ব আমার ওপর চাপানো। অস্বীকার করি না, সুশাসন ও জবাবদিহির দুর্বলতায় রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রেও স্বভাবচরিত্রে কিছু বদ-অভ্যাস গেঁড়ে বসেছে। রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার পথে সহায়ক ভূমিকা পালনে প্রলুব্ধ করতে বা হতে এসব ঘটে। চারদিকে এ ধরনের খেলা যখন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়, তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে, আমাকে খাতায় আনতে গিয়ে, আমাকে জোত-জমিদার, পাইক-বরকন্দাজের মতো হতে হয়। এ বদ-খাসলত সবার মধ্যে এক দিনে গড়ে ওঠেনি। এর জন্য আমরা উভয়ই দায়ী। আর দায়ী আমার আহরিত টাকা নয়-ছয় (দেশের ব্যাংকের বিতর্কিত সুদের হার নয়) করে, নীতি-নৈতিকতার মাথা খেয়ে ‘আরও চাই’-এর স্বভাবের কৌশলের কারণে।
দোষারোপে লাভ নেই, জাতীয় রাজস্ব আয়-উন্নতির পথ পেতে হবে, সঠিক পথে উঠতে হবে। সবাই যেন যার যার দায়িত্ব (আমার বেলায় ন্যায়নীতি নিয়মকানুন, এসআরও অর্থবিধি আইন হার ধারা সঠিকভাবে প্রয়োগ করে, হিসাব কষে) আর কর্তব্য (রাষ্ট্রের ন্যায্য পাওনা পরিশোধে সবার) পালনে এগিয়ে আসতেই হবে, নইলে আমরা সবাই বড় ক্ষতির মধ্যে পড়ে যাব। নতুন রাজস্ব ভবন হয়েছে, সুরম্য সুউচ্চ প্রাসাদ হয়েছে কিন্তু সেখানে সবার মধ্যে এই ভবনের নীতি-আদর্শের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের উপলব্ধি উপলব্ধিতে পরিণত যদি না হয় তাহলে লাখ টাকায় ঝাড়বাতিটা নিশুতি রাতে কেঁদেই মরবে।
আমাকে ঘর দেওয়া হয়েছে ভালো বর চাই। সহজ আলাপে সংসার নির্মাণ চাই, স্বনির্ভর হতে চাই। সামনে দিন খারাপ। ঘরে-বাইরে সমস্যারা পান-তামাক খেয়ে কোমরের বাঁধন কষে এগিয়ে আসছে, ধেয়ে আসছে। সেখানে নিজের সম্পদ আহরণ করে যদি আমরা বলশালী না হয়ে তাদের মোকাবিলায় না নামি তাহলে তাদের সঙ্গে পারব কেমনে। বল ও কর্মক্ষমতা ধার-কর্জ করে বাড়ানো যায় না, লক্ষ্য অর্জন করা যায় না। অন্যের শর্ত-সাবুদ মেনে তাদের বানানো পোশাক পরে তাদের আইনের ভাষায় ও চোখে তাকালে আমার খাবার খাদ্য জোগাড় তো ভেজালমুক্ত হবে না। আমার নতুন বাড়িতে সবাইকে সাদর সম্ভাষণ। আশা করি এখানে সবাই ভালো ব্যবহার পাবেন এবং আপনারা সবাই নিজ গুণে, উপলব্ধিতে নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসবেন। এটা মনে রাখতে হবে, আমরা সবাই এক হাঁড়ির ভাত খাই। আমাদের আয়োজন আমাদেরই করতে হবে।
লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক
ভারতবর্ষের অজস্র জাতিসত্তার মানুষের মাতৃভাষা কয়েকশ। এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪১৫টি। এই ৪১৫টি ভাষার উপভাষার সংখ্যা ১৫৭৬টি (১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে)। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ২৯টি কথ্যভাষায় ১০ লাখ মানুষ কথা বলে। ১২২টি কথ্যভাষা ১০ হাজার মানুষের মুখের ভাষা। এ ছাড়া অজস্র উপভাষা রয়েছে, যেগুলোর লিপি নেই। সেসব ভাষার অস্তিত্ব টিকে আছে মানুষের মুখে মুখে। বর্তমান ভারতের রাজ্যগুলোর ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। একই রাজ্যের একাধিক ভাষা যেমন রয়েছে, তেমনি একই ভাষা অপরাপর রাজ্যেও প্রচলিত আছে। ভারতের প্রাদেশিক সরকারি স্বীকৃত ভাষা (অসমিয়া, বাংলা, বোড়ো, ডোগরি, গুজরাটি, হিন্দি, কন্নড়, কাশ্মীরি, কোঙ্কনী, মৈথিলী, মলয়ালম, মৈত্রৈ (মণিপুরি), মারাঠি, নেপালি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত, সাঁওতাল, তামিল, তেলেগু, উর্দু, মিজো ও কোকোবরক। ইংরেজি ভাষাও অনেক প্রদেশের সরকারি ভাষার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, যেমন অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ও চণ্ডীগড়। ভারতের প্রাদেশিক ভাষাসমূহের তালিকাই প্রমাণ করে অপরাপর প্রাদেশিক ভাষার মতো হিন্দিও প্রাদেশিক ভাষা। অনেক প্রদেশের সহকারী সরকারি ভাষা হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা, মারাঠি, পাঞ্জাবি, খাসি, গারো, ভুটিয়া, গুরং, লেপচা, লিম্বু, মাঙার, মুখিয়া, নেওরি, রাজ, শেরপা, তমাং ইত্যাদি সিকিম প্রদেশের সহকারী সরকারি ভাষা।
প্রশ্ন থাকে, বহু ভাষাভাষীর দেশ ভারতে প্রাদেশিক হিন্দি ভাষা কেন সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পেছনে ফিরে যেতে হবে। ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতীয় পুঁজিপতি-শ্রেণি এক রাষ্ট্রের সুবিধায় ভারতে বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তার-প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। ব্রিটিশদের মুৎসুদ্দি রূপে নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুযোগও হাতাতে পেরেছিল। তাদের মনস্কামনা পূরণে অন্তরায় ছিল ভাষার বিভক্তি। ব্রিটিশ ভারতেই ভারতীয় বুর্জোয়ারা স্বীয় স্বার্থে এককেন্দ্রিক শাসনের পাশাপাশি এক ভাষা ও এক জাতির আওয়াজ তুলেছিল। জাতি হিসেবে ভারতীয় এবং ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল তারা হিন্দি ভাষা-দেবনাগরী লিপি। নিজেদের কায়েমি স্বার্থে হিন্দি ভাষাকে ভারতের সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ফন্দি এঁটেছিল; অপরাপর ভাষা-সংস্কৃতি, স্বাজাত্যবোধকে বিলীন করে দেওয়ার মতলবে। ব্রিটিশ ভারতে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের সুবিধা ভোগ সম্ভব হলেও, তাদের পক্ষে হিন্দি ভাষাকে সর্বভারতীয় ভাষায় পরিণত করা সম্ভব হয়নি।
১৯১৫ সালে ভারতে ফিরে এসে গান্ধী ভারতজুড়ে ভ্রমণ করেন। তখনই তিনি দেখতে পান ভারতীয় মাড়োয়ারি পুঁজিপতিরা গো-রক্ষা এবং হিন্দি ভাষা প্রচলনে নানান পন্থায় মদদ জুগিয়ে যাচ্ছে। গান্ধী সহসাই পুঁজিপতিদের পক্ষে সেই প্রচারাভিযানে যুক্ত হয়ে যান। অর্থাৎ গো-রক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি হিন্দি ভাষাকে সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার বুর্জোয়া শ্রেণির আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এই তৎপরতার মধ্য দিয়েই ভারতে গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। ১৯১৬ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে ‘সর্বভারতীয় এক ভাষা ও একলিপি সম্মেলন’ গান্ধীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১৯ সালে হিন্দি ভাষা প্রচারে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের উপকমিটির সভাপতি হয়েছিলেন গান্ধী। ভারতীয় মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের অর্থের জোগানে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। সিন্ধু ন্যাশনাল কলেজে ১৯২০ সালের জুলাইয়ে গান্ধী বলেছিলেন, ‘হিন্দিই হবে সমগ্র ভারতের ভাষা এবং সেজন্য হিন্দি শেখা অন্যসব প্রদেশের কর্তব্য।’ গান্ধী প্রকাশ্যে বলে বেড়াতেন, ‘অহিন্দিভাষীদের হিন্দি শেখা হচ্ছে ধর্ম।’ ভারতীয়দের ধর্মীয় অনুভূতিতে হিন্দি ভাষা বিস্তারে ধর্মকে পর্যন্ত ব্যবহার করতে চেয়েছেন। হিন্দি ভাষাকে ধর্মীয় পর্যায়ভুক্ত করতেও দ্বিধা করেননি গান্ধী। গান্ধী লিখেছিলেন, ‘এলাহাবাদের হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোগে ১৮ মাসব্যাপী মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে হিন্দি ভাষার প্রচার খুব জোরালোভাবেই চলছে।’ হিন্দি ভাষাকে সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের অর্থানুকূল্যের বিষয়টিও স্বীকার করে গান্ধী বলেছিলেন, ‘হিন্দি প্রচারের কাজ ভারতের এই রাজতুল্য বণিকশ্রেণির বিশেষত্ব।’
১৯২১ সালে এক চিঠিতে গান্ধী মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘ভারতবর্ষে ফিরে আসার পর থেকেই আমি আপনাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছি। আমার কাজে আপনারা প্রশ্রয় দিয়েছেন, এবং আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন। হিন্দি প্রচারের আন্দোলনকে আপনারা কার্যকরভাবে সমর্থন দিয়েছেন।’ গান্ধীর হিন্দি ভাষা প্রচারাভিযানে মাড়োয়ারিদের পাশাপাশি গুজরাটি, পার্শি বণিকশ্রেণিও আর্থিক সহায়তা প্রদানে পিছিয়ে ছিল না। বাংলা ও আসাম প্রদেশে হিন্দি প্রচারাভিযানে ১৯২৮ সালে হিন্দুত্ববাদী বুর্জোয়া ধনশ্যামদাস বিড়লাকে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করে কলকাতায় হিন্দি প্রচারের এক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালে হিন্দি ভাষাকে জাতীয় ভাষায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজেন্দ্র প্রসাদকে সভাপতি করে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে ‘রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতি’ গঠিত হয়। পরে স্বয়ং রাজেন্দ্র প্রসাদ লিখেছিলেন, ‘এর নীতি স্বয়ং গান্ধীজি নির্ধারণ করেছিলেন এবং আমাদের শিল্পপতি বন্ধুরা অর্থের জোগান দিতেন।’
হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপি সমগ্র ভারতীয়র ওপর চাপানোর এই উদ্যোগে উত্তর প্রদেশের মুসলিম সম্প্রদায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। উর্দুভাষী মুসলমানদের মধ্যে এ নিয়ে আতঙ্ক ও ভীতির সঞ্চারে তারা উপলব্ধি করে হিন্দির দৌরাত্ম্যে তাদের উর্দু ভাষা-সংস্কৃতির বিলোপ ঘটবে। ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে লক্ষেèৗতে মুসলিম লীগ অধিবেশনে সব মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতের জাতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার তীব্র নিন্দা জানায়।
১৯২৭ সালের জুলাইয়ে গান্ধী লিখেছিলেন, ‘সব ভারতীয় ভাষার একটি লিপি হওয়া উচিত এবং শুধু দেবনাগরীই হতে পারে সেই লিপি।’ গান্ধী বলেছেন, ‘হিন্দু-মুসলিম উন্মত্ততার জন্য সম্পূর্ণ সংস্কারের পক্ষে বাধা আছে। তবে এর আগে হিন্দু ভারতকে বুঝতে হবে যে, যেসব ভাষা সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত এবং দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত তাদের লিপিগুলো, যেমন বাংলা, গুরুমুখী, সিন্ধি, ওড়িয়া, গুজরাটি, তেলেগু, তামিল, কন্নড়, মলয়ালম ইত্যাদি ভাষার লিপিকে বর্জন করে সে স্থলে থাকবে শুধুই দেবনাগরী লিপি। এর ফলে হিন্দু ভারত সংহত ও বলিষ্ঠ হবে।’ গান্ধী নিজেই স্বীকার করেছেন পাঞ্জাবে হিন্দু-মুসলমান এবং অন্য সবাই উর্দু জানে (উর্দু ভাষার লিপি ফার্সি)। ধর্মের ভিত্তিতে ভাষার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন গান্ধী। পাঞ্জাবি হিন্দুরা দেবনাগরী লিপি গ্রহণ করবে এবং মুসলিমরা ফার্সি লিপি। একইভাবে বাঙালি হিন্দুর লিপি হবে দেবনাগরী এবং বাঙালি মুসলমানের লিপি হবে বাংলা অথবা ফার্সি। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরোধকে ভাষা ও লিপির ভেতরে টেনে আনেন স্বয়ং গান্ধী। ব্রিটিশদের বিভক্তিকরণের চক্রান্তের নীতি অনুসরণ কি ভাষার প্রশ্নে গান্ধী করেননি? হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভক্তি ব্রিটিশরা করেছিল তাদের শোষণ প্রক্রিয়া এবং দখলদারিত্ব স্থায়ী করার লক্ষ্যে। গান্ধীও হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপির পক্ষে সম্প্রদায়গত বিভাজনের নীতি অনুসরণ করে সেই বিভাজনকেই সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক বিভাজন-বিভক্তি ব্রিটিশদের সৃষ্ট। সাম্প্রদায়িক বিভাজন নতুন মাত্রা পেয়েছিল গান্ধীর হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপির জাতীয় ভাষা ও লিপির আন্দোলন অভিযানে। এতে দ্রুতই মুসলিম সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মুসলমানদের বিরোধিতার মুখে গান্ধী-নেহরুরা মত পরিবর্তন করলেও; উর্দুভাষী মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দি-উর্দু ভাষা বিতর্কে সরব হয়ে ওঠে। এবং ভাষা নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিরোধেরও সূচনা ঘটে। ১৯৩৭ সালের জুলাইয়ে কংগ্রেস সভাপতি নেহরু বলেন, ‘অবশ্যই হিন্দি অথবা হিন্দুস্তানি হচ্ছে জাতীয় ভাষা এবং হওয়া উচিতও। লিপি সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা দরকার যে, হিন্দি ও উর্দু দুই লিপিই সহাবস্থান করা উচিত।... এই বিতর্ক বন্ধ করার জন্য ভালো হবে যদি আমরা কথ্যভাষাকে হিন্দুস্তানি এবং লিপিকে হিন্দি অথবা উর্দু আখ্যা দিই। ইউরোপের প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর হিন্দিতে অনুবাদ হওয়া একান্ত দরকার।’ নেহরুর বক্তব্যটির সারকথা হচ্ছে, লিখিত ভাষা হিন্দিই হবে ভারতের জাতীয় ভাষা। সেটা দেবনাগরী কিংবা উর্দু দুই লিপিতেই লিখিত হতে পারে। ‘ভাষাপ্রশ্ন’ গ্রন্থে নেহরু লিখেছিলেন, ‘একমাত্র হিন্দুস্তানিই সমগ্র ভারতের ভাষা হতে পারে।’ লিপির ক্ষেত্রে দেবনাগরী এবং উর্দু লিপির কথাও মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষোভ প্রশমনে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন।
গান্ধী মুসলমানদের বিরোধিতার মুখে হিন্দুস্তানির অনুরাগী হয়েÑসেই লক্ষ্যে ১৯৪২ সালে ‘হিন্দুস্তানি প্রচার সভা’ সংগঠন গড়ে তোলেন। উত্তর ভারতে কথ্যভাষা রূপে হিন্দুস্তানি ভাষা ছিল বটে। তবে সেটি হিন্দি ও উর্দুর সংমিশ্রণে। লিপি না থাকায় লিখিত ভাষারূপে হিন্দুস্তানি ভাষার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ১৯৪৬ সালে নির্বাচনের আগে ভারতের সংবিধান সভায় গান্ধী প্রস্তাব করেছিলেন, তারাই সংবিধান সভার সদস্য হতে পারবেন যারা হিন্দি ভাষার সঙ্গে পরিচিত। গান্ধী আরও দাবি করেন, ভারতের সংবিধান হিন্দুস্তানি ভাষায় লিখিত হতে হবে। মৃত্যুর আগে গান্ধী বলেছিলেন, ‘তার যদি ক্ষমতা থাকত তবে তিনি তাদেরই কংগ্রেসের সদস্য করতেন, যারা হিন্দুস্তানি ভাষা জানেন।’ ১৯৪৭ সালে গান্ধী হিন্দুস্তানি ভাষাকে সমগ্র এশিয়ার ভাষায় পরিণত করার দিবা-স্বপ্নও দেখেছিলেন। মুসলমানদের বিরোধিতায় গান্ধী-নেহরুরা ভারতের জাতীয় ভাষা হিন্দির পরিবর্তে হিন্দুস্তানি কথ্যভাষার প্রচারণা ছিল প্রতারণার কৌশল। উদ্দেশ্য ছিল দেবনাগরী লিপির বাতাবরণে হিন্দি ভাষাকেই বিভিন্ন জাতিসত্তার স্কন্ধে চাপানোর। বাস্তবতা হচ্ছে হিন্দুস্তানি ভাষা প্রকৃতই কথ্যভাষা। সে ভাষার ছিল না লিপি। ছিল না সাহিত্য। সেটি শুধুই আঞ্চলিক কথ্যভাষা মাত্র। হিন্দুস্তানি ভাষার দাবিটি ছিল হিন্দি ভাষা প্রতিষ্ঠায় কৌশলগত অভিপ্রায় মাত্র। ওই কৌশলতাই অনিবার্য করে তোলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশভাগ। লেখকঃ নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত [email protected]
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দেশ। সুষ্ঠু ও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে স্বাভাবিকভাবেই, নির্বাচন কমিশন নিজস্ব ‘ক্ষমতা’ নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে। সংবিধানে প্রদত্ত নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা যথেষ্ট নয়। এ কারণে, তারা ভাবছে নিরঙ্কুশ বিধির কথা।
সংবিধানের ১২৬ ধারার আলোকে একটি বিধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে কমিশন। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে, সংবিধানের ১২৬ ধারায় বলা হয়েছে ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ শুক্রবার দেশ রূপান্তরে ‘ক্ষমতা নিরঙ্কুশে বিধির পথে ইসি’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যায় এই ধারায় পুরোপুরি ক্ষমতা প্রয়োগে কিছুটা দুর্বলতা দেখছে নির্বাচন কমিশন।
কমিশনের বক্তব্য নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বদলি/পদায়ন তাৎক্ষণিকভাবে করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু নির্বাচন চলাকালে এ ধরনের আদেশ বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। এসব আদেশ তাৎক্ষণিক কার্যকর দরকার। সে কারণেই, একটি বিধির প্রয়োজন।
আওয়ামী লীগের হাই প্রোফাইলের বেশ কয়েক নেতা, নির্বাচন কমিশনের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন যদিও। তারা বলেন, ‘সংবিধানের ১২৬ ধারায় নির্বাহী সমস্ত ক্ষমতা ইসির হাতে দেওয়াই আছে। এর জন্য আবার আলাদা বিধিবিধানের কী দরকার?’ এই কথার সঙ্গে তারা যোগ করেন ‘কমিশন তাদের খসড়া প্রস্তাব তুলে ধরুক, তখন ভালো-মন্দ বুঝে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।’
কমিশনের এই নিরঙ্কুশ ‘বিধি’ তৈরির প্রয়োজনীয়তাই প্রমাণ করে, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচন সম্পন্ন করতে কমিশন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। যদিও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কমিশনের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। আবার কমিশন যে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তা তাদের বক্তব্যের মাধ্যমেই স্পষ্ট।
একটি বিষয় পরিষ্কার যে, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সরকারের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। এই দ্বন্দ্ব নিরসন করতে হলে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। দুই পক্ষকে শর্তহীনভাবে, একটি অবস্থানে পৌঁছাতে হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশের মানুষ চায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে চাইলে, দুই পক্ষকে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে প্রশ্নহীনভাবে যদি আমরা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই।
প্রসঙ্গত, বহু প্রতীক্ষিত নির্বাচন কমিশন আইন পাস এবং সে অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশন গঠনের পরও নানান পরিস্থিতিতে বিতর্ক এড়াতে পারছে না ইসি। নির্বাচনী আইন ও আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনায় কঠোরতা দেখানো ছাড়া উপায় নেই। এর সঙ্গে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রমুখী করার প্রশ্ন যেমন জড়িত, তেমনি নিরাপত্তার প্রসঙ্গও রয়েছে। ভোটকেন্দ্র ব্যবস্থাপনায় ইসির মনোযোগ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং সেটা দেখাতেও হবে।
ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেসেটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনী কেন্দ্রে কোনো ধরনের, অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির উদ্ভব যেন না হয় তা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। শুধু তাই নয়, ভোটার তালিকা, নির্বাচনী কেন্দ্র, ব্যালট পেপার, রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার, এজেন্ট এবং শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রেখে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটপ্রদান এবং নির্বাচনী ফল ঘোষণা পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। সেক্ষেত্রে বিশেষ কিছু বিষয়ে, তাদের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে কী না তার যৌক্তিকতা যাচাই করা উচিত। যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নিরঙ্কুশ বিধির প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই পথে হাঁটাই বাঞ্ছনীয়। নির্বাচন কমিশনের ওপর সকল রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জনই এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনাস্থা নিয়ে নির্বাচন করলে তা সাধারণ মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
বিশ্বখ্যাত বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী, কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিকসের উদ্ভাবক, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ, বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯৭৪ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম কলকাতায়, ১ জানুয়ারি ১৮৯৪। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১৩ সালে তিনি গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানসহ স্নাতক এবং ১৯১৫ সালে মিশ্র গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানসহ এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। নবপ্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯১৫ সাল থেকে বিশ্বখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহার সাহচর্যে মিশ্র গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন এবং পরে বিভাগীয় প্রধান হন। তিনি এখানে ২৪ বছর একনিষ্ঠভাবে গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেন। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফির ওপর গবেষণা তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথের এ বিষয়ক প্রবন্ধ জার্মান ভাষায় অনুবাদ ও ব্যাখ্যাসহ প্রকাশ করলে তা ‘বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব’ নামে সমাদৃত হয়। পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামানুসারে পরমাণুর এক ধরনের কণিকার নাম রাখা হয়েছে ‘বোসন কণা’। সম্প্রতি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে ‘ঈশ্বর কণা’ নামে বহুল আলোচিত কণিকাটির নামও রাখা হয়, ‘হিগস-বোসন’ কণা। বিজ্ঞানী বসুর অবদানের সঙ্গে সম্পর্কিত বলেই এই নামকরণ হয়।
উচ্চশিক্ষায় ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে দুই বছর আগে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা। এ বছর তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা গুচ্ছ ভর্তি। স্বাভাবিকভাবেই তিন বছরে অনেকটাই গুছিয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু তা তো হয়নি, বরং আরও অনেকটা অগোছালো হয়ে উঠেছে। এমনকি গুচ্ছে থাকা বড় দুই বিশ্ববিদ্যালয় এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আর অনেকটা জোর করেই তাদের গুচ্ছে রাখার চেষ্টা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ফলে গুচ্ছ ভর্তি নিয়েই টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জোর করে হয়তো এ বছর ওই দুই বিশ্ববিদ্যালয়কে গুচ্ছে রেখে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এর ফল ভালো হবে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে তাদের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই অনুযায়ীই এগুনো উচিত।
জানা যায়, গত বছরের এইচএসসির ফল প্রায় সাত মাস দেরিতে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ হয়। অথচ এর আগেই তাদের প্রথমবর্ষের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা শেষ করার তাগিদ দিয়েছিল ইউজিসি। ইতিমধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে। কিন্তু গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা দফায় দফায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সঙ্গে বৈঠক করেও সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। এতে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের সেশনজটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দুই-একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেসব কারণ দেখিয়ে গুচ্ছ থেকে সরে আসতে চাচ্ছে তা যুক্তিসংগত নয়। আমাদের প্রত্যাশা, তারা গুচ্ছে থাকবেন। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে রাষ্ট্রপতি নিজেই গুচ্ছ ভর্তি শুরু করার তাগিদ দিয়েছিলেন। যারা গুচ্ছে এসেছিলেন তাদের এখন দায়িত্ব হয়ে পড়েছে, এখানে থাকা। আর গুচ্ছে গত দুই বছর যেসব ত্রুটি ছিল, সেসব ইতিমধ্যেই সমাধান করা হয়েছে। ফলে এ বছর অনেকটাই ত্রুটিমুক্ত হবে গুচ্ছ ভর্তি।’
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। সেখানে আলোচনা হয়েছে, নতুন পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে, তাই বলে এখান থেকে পিছু হটার বা বের হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ বছরও গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ই গুচ্ছে থাকছে। তবে আগামী বছর থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইউনিক পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হবে বলে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সভায় গুচ্ছে থাকার আলোচনা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাস্তব চিত্র ভিন্ন। গুচ্ছে থাকা বড় দুই বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোনোভাবেই গুচ্ছে থাকতে চান না। প্রয়োজনে তারা বড় ধরনের আন্দোলনে যেতেও পিছপা হবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আর আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজছে।
সূত্র জানায়, এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন গ্রহণ শুরুর কথা ছিল। আর জুলাইয়ের শেষ নাগাদ যাতে ক্লাস শুরু করা যায় সে ব্যাপারে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ পর্যন্ত গুচ্ছে থাকবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দেওয়ায় এখনো ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু বা চূড়ান্ত পরিকল্পনা করতে পারছে না গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটি।
গত ১৫ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের বিশেষ সভায় নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সে হিসাবে আগামী ২ এপ্রিলের মধ্যে কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটি গঠন ও ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আল্টিমেটাম বেঁধে দিয়ে উপাচার্য বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে শিক্ষকরা আন্দোলন ও কর্মসূচির মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে দাবি আদায় করার ঘোষণা দিয়েছেন।
শিক্ষকরা বলছেন, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের পরও যদি গুচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থাকে তাহলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৫ সালের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। এই অবস্থায় গুচ্ছে থাকতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সংশোধন করতে হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সব বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে থাকবে সে কথা বলেই আমাদের গুচ্ছে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না আসায় আমরা আমাদের স্বকীয়তাই হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি। আর গুচ্ছে হাজারো ত্রুটি। এতে দীর্ঘসূত্রতা ও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির পাশাপাশি সারা বছর ধরে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। ফলে গুচ্ছে ভালো ছেলেমেয়েরা আসছে না। অনেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নিজস্ব প্রক্রিয়ায় ভর্তি কার্যক্রম শুরু করার জন্য আগামী ২ এপ্রিল পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিয়েছি। এরমধ্যে ফল না এলে আমাদের আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া পথ থাকবে না।’
২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা নিজস্ব পদ্ধতিতে নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শিক্ষক সমিতি। গত ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ১২৫তম অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভায় সর্বসম্মতভাবে গুচ্ছে না যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে সভায় কয়েকটি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, অনতিবিলম্বে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করা, ১ জুলাই নতুন বর্ষের ক্লাস শুরু করা, আবেদনের জন্য ন্যূনতম ফি নির্ধারণ এবং শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে ভর্তি পরীক্ষার পর শুধু ভর্তি হওয়ার জন্যই ক্যাম্পাসে আসবে এবং বাকি কার্যক্রম অনলাইনে সম্পন্ন করতে হবে।
গত ২৮ মার্চ শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভা থেকে আগামী ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটির সভা আহ্বানের জন্য উপাচার্যকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. তপন কুমার জোদ্দার বলেন, ‘অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত এখনো বহাল আছে। ইতিমধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বর্ষের ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সভা আহ্বান করে দ্রুত ভর্তি কার্যক্রম শুরু করার জন্য ভিসি (উপাচার্য) স্যারকে অনুরোধ জানিয়েছি। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের বাইরে আমরা যাব না।’
জানা যায়, সাধারণ ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছের নাম দেওয়া হয়েছে জিএসটি (জেনারেল, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি)। প্রকৌশল গুচ্ছে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি গুচ্ছের আটটি বিশ্ববিদ্যালয়েও আলাদা ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত চার বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর) গুচ্ছ ভর্তিতে আসেনি। এ তালিকায় আছে বিশেষায়িত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
এ ছাড়া বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স), বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটিও আলাদা পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করে থাকে। অ্যাফিলাইটিং বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আলাদাভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করে থাকে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে সাধারণত ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া জিপিএ’র ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।
গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হলেও পরে আলাদা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের নিজেদের মতো শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। এতে একই শিক্ষার্থীর নাম একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা তালিকায় আসছে। কিন্তু ওই শিক্ষার্থী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় অন্যদের ফের মেধা তালিকা প্রকাশ করতে হচ্ছে। এভাবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই পাঁচ-সাতবার মেধা তালিকা প্রকাশের পরও তাদের আসন শূন্য থাকছে। এমনকি গত বছর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ গুচ্ছভুক্ত একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আসন পূর্ণ করতে পারেনি।
বর্তমান চ্যাম্পিয়ন গুজরাট লায়ন্স ও চারবারের চ্যাম্পিয়ন চেন্নাই সুপার কিংসের ম্যাচ দিয়ে শুক্রবার মাঠে গড়াবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ষোড়শ আসর।
আহমেদাবাদে আইপিএলের উদ্বোধনী ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায়। দশ দলকে নিয়ে আট সপ্তাহে ১২টি ভেন্যুতে এবারের আসরের খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হবে। মোট ম্যাচের সংখ্যা ৭৪টি।
গেল বছর আইপিএলে নতুন দুটি দল যুক্ত হয়- গুজরাট ও লখনউ সুপার জায়ান্টস। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই দারুণ ক্রিকেট খেলে তারা। লিগ পর্ব শেষে টেবিলের শীর্ষে ছিল হার্ডিক পান্ডিয়ার নেতৃত্বাধীন গুজরাট। রাজস্থান রয়্যালসের সাথে পয়েন্ট সমান হলেও রান রেটে পিছিয়ে তৃতীয় হয় লখনউ।
কিন্তু টুর্নামেন্টের ফাইনালে ঠিকই জায়গা করে নেয় গুজরাট। ফাইনালে রাজস্থানকে হারিয়ে শিরোপা জিতে গুজরাট। এবারও শিরোপা ধরে রাখার মিশন গুজরাটের। যথারীতি দলকে নেতৃত্ব দিবেন পান্ডিয়া।
টুর্নামেন্ট ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চারবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাই। ধোনির নেতৃত্বেই রেকর্ড নয়বার ফাইনালে খেলেছে তারা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দুই বছর আগে অবসর নিলেও এখনও আইপিএল খেলছেন ৪১ বছর বয়সী ধোনি। চেন্নাই দলের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে ধোনির উপর। ধরনা করা হচ্ছে এবারের আইপিএল ধোনির ক্যারিয়ারের শেষ আইপিএল।
আইপিএলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পাঁচবার শিরোপা জয়ের রেকর্ডের মালিক মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। গেল বছর টেবিলের তলানিতে থেকে আসর শেষ করে রোহিত শর্মার দল। দ্বিতীয় সফল দল চেন্নাইও ভালো করতে পারেনি। দশ দলের মধ্যে নবম ছিল চেন্নাই। মুম্বাই শেষ করেছিল সবার শেষে থেকে। এবার এই দুই দলের ওপরই আলাদা নজর থাকবে সবার।
আগামী ২৮ মে ফাইনাল দিয়ে পর্দা নামবে আইপিএলের এবারের আসরের।
পবিত্র রমজান মাস যেহেতু প্রতি বছরই আসে, সেজন্য এটা অনেকের জন্য পরীক্ষার বিষয় হয়ে যায়। কারণ যে কাজ বারবার করা হয় তাতে গভীর মনোযোগ ও একনিষ্ঠতা ধরে রাখা এবং ওই কাজের মাধ্যমে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা এবং সওয়াবের প্রত্যাশা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে পড়ে। তখন অনেকেই এ জাতীয় কাজ করেন অভ্যাসবশত। ফলে ওই কাজের গুরুত্ব ও মর্যাদা আর বজায় থাকে না। তার বিনিময়ে আল্লাহতায়ালার যে ওয়াদা সেটা স্মরণ থাকে না। কিংবা সেই ওয়াদার ওপর বিশ্বাস যথাযথভাবে মনে থাকে না। কারণ কোনো কাজ অভ্যাসজাত হয়ে গেলে তা অনেকটা অভ্যাসের তাগিদেই করা হয়। তাতে অন্য কোনো বিষয় খেয়াল করা হয় না। অথচ স্পষ্টভাবে হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ইমান (বিশ্বাস) ও ইহতিসাব (একনিষ্ঠতা)-এর সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার অতীত গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ -সহিহ বোখারি : ৩৮
বর্ণিত হাদিসে ইমান তথা বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশা নিয়ে রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে। এখান থেকে খুব খেয়াল করে শিক্ষাগ্রহণ এবং পুরো রমজান মাস সেই শিক্ষা মনে রাখা।
একটু চিন্তা করা দরকার, মানুষ কেন রোজা রাখে? কেন সে পানাহার ত্যাগ করে? প্রচ- গরমেও সে পানি পান করে না! তীব্র ক্ষুধায়ও খাবার খায় না। অথচ সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। চাইলেই সে যে কোনো কিছু গ্রহণ করতে পারে। এমনিভাবে সে আরও অনেক ধরনের কষ্ট করে। অনেক কিছু সয়ে নেয়। এসব কেন করে?
উত্তর পরিষ্কার। আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে। তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। তার কাছ থেকে বিনিময় ও সওয়াবের আশায়।
যারা মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান এবং মানবীয় দুর্বলতার খবর রাখেন, তারা জানেন- যখন কোনো বিষয় ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয় এবং নির্ধারিত রুটিনের আওতাভুক্ত হয়, তখন সেটা অনেক সময়ই উদাসীনভাবে পালন করা হয় এবং অবচেতন মনে আদায় করা হয়। রোজা রাখতে হবে, তাই রাখা। রোজা না রাখলে মানুষ মন্দ ভাববে, ঘরের লোক খারাপ বলবে। মানুষের কাছে লজ্জা পেতে হবে, সমালোচনা শুনতে হবে। তাই সে রোজা পালন করে।
আবার অনেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তেই রোজা রাখে কিন্তু তাদের হৃদয় সবসময় জাগ্রত থাকে না। রোজার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাদের স্মরণ থাকে না। অথচ আমলের হিসাব নেওয়া, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি মনোযোগী হওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবুও মানুষ সেদিকে মনোযোগী হয় না। খেয়াল করে না- কেন সে রোজা রাখছে? কেন সে পানাহার ত্যাগ করছে? চাহিদা ও চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা থাকার পরও সে কেন তা থেকে বিরত থাকছে? রোজাপালনের ক্ষেত্রে এমন উদাসীনতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
রোজার যেসব ফজিলত এবং রোজার মাধ্যমে যেসব বিষয় অর্জনের কথা বলা হয়েছে, তার একটি হলো- তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি। সরাসরি কোরআন মাজিদে এই ফজিলতের কথা এসেছে। আর হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, রোজার অসিলায় কামাই-রোজগারে বরকত হয়। মানব হৃদয় আলোকিত হয়। গোনাহ থেকে বাঁচার শক্তি অর্জিত হয়। আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সহজ হয়ে যায়। সর্বোপরি তাতে আল্লাহর নির্দেশ পালন ও নবী কারিম (সা.)-এর অনুসরণ করা হয়।
আমরা পানাহারে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও যখন শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তা পরিত্যাগ করি, তখন প্রতিটি মুহূর্তে সওয়াব হতে থাকে, আমাদের মর্যাদা উঁচু হতে থাকে। কারণ এই ত্যাগ আল্লাহর কাছে খুবই দামি, তাতে আল্লাহ খুব খুশি হন। বান্দা যখন তার হুকুম পালনার্থে এবং তাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে ক্ষুৎপিপাসার কষ্ট সহ্য করছে- এর মর্যাদা তার কাছে অনেক বেশি।
কিন্তু আফসোসের কথা হলো- অধিকাংশ রোজাদারেরই এসব কথা মনে থাকে না। রোজাদারের মর্যাদা, তার জন্য আল্লাহ কী পুরস্কার নির্ধারণ করেছেন, আল্লাহ তাকে কত ভালোবাসেন ইত্যাদি বিষয়ের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ হয় না। অথচ সেটা খুবই জরুরি। আল্লাহর হুকুমের কথা মনে করা, তার সন্তুষ্টি লাভের নিয়ত স্মরণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন একটা অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে শুরু হয়, নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় এবং সবাই তাতে অংশগ্রহণ করে তখন কে কী নিয়তে অংশগ্রহণ করে সেটা স্পষ্ট থাকা জরুরি। প্রত্যেকের মূল্যায়ন হবে তার নিয়তের ভিত্তিতে।
রমজানের রোজার ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেন একধরনের বাতাস আসে এবং সেইসঙ্গে একটি মৌসুম আসে। তাতে চারপাশে নতুন আবহ ছড়িয়ে পড়ে। সবাই ওই আবহে প্রভাবিত হয় এবং সে অনুযায়ী আমল শুরু করে। অথচ আসল উদ্দেশ্য ও নিয়তের কথা সবার মনে থাকে না।
জীবনের সব কাজে এই ‘ইমান (বিশ্বাস) ও ইহতিসাব (একনিষ্ঠতা)’ যদি আমাদের অর্জন হয়ে যায়, তাহলে পুরো জীবন আল্লাহর রহমত ও করুণার বারিধারায় স্নাত হবে। এর প্রকৃত ফায়দা দেখা যাবে কেয়ামতের দিন। যখন সবাই আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে, তখন বুঝে আসবে ‘ইমান ও ইহতিসাব’-এর মূল্য। ছোট ছোট এই আমলগুলোও দেখা যাবে- কত বড় আকারে সামনে আসছে! কারও কোনো ছোট্ট একটি কাজ করে দিয়েছিলাম, কারও সঙ্গে একটু হেসে কথা বলেছিলাম, সেগুলোই দেখা যাবে অনেক সওয়াবের মাধ্যম হয়ে গেছে। এটাই রমজান মাসের প্রথম ও সবচেয়ে বড় হাদিয়া। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তের গুণ অর্জন। এটাই জীবনের জন্য বরকতময় এ মাসের বার্তা।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
বাবা কাহিনি
আমার বাবা ১৯৪৬ সালের ম্যাট্রিকুলেটদের একজন (আমার বাবা আমার হাইপ্রোফাইল বন্ধুদের বাবাদের মতো কোনোকালেও ফার্স্ট ক্লাস বা ফার্স্ট ডিভিশন পাননি)। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনাচক্রে তিনি ঢাকায় ছিলেন, থাকার কথা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের চাকলালায় তার বিমানবাহিনীর কর্মক্ষেত্রে। সন্ধ্যার দিকে তার খুব ইচ্ছা হলো উত্তপ্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভেতরটাতে কী হচ্ছে একটু দেখে আসবেন (আমার বাবা কসি¥নকালেও ভাষাসৈনিকদের একজন ছিলেন না এবং তাকে ঠেলেঠুলে ভাষাসৈনিক বানানোর কোনো গোপন বা প্রকাশ্য ইচ্ছাও আমার নেই)। চারদিকে তখন ঢিল খাওয়া এত ক্ষুব্ধ পুলিশ যে, ডাক্তারদেরও ভেতরে প্রবেশ করতে অসুবিধা হচ্ছিল।
সাইকেল আরোহী আমার বাবা তার সাইকেলসহ ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন এবং পুলিশের ধমক খেলেন। কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে দলছুট একজন কনস্টেবলকে সালাম দিয়ে বললেন, স্যার, আমার একটু হাসপাতলের ভেতরে যাওয়া দরকার যদি একটু সুযোগ করে দিতেন স্যার, কৃতজ্ঞ থাকতাম।
একই বাক্যে দুবার স্যার সম্মোধন শুনে কনস্টেবল যথেষ্ট দয়া পরবশ হয়ে তাকে বললেন, সাইকেল নিয়ে যাওয়া যাবে না।
পরক্ষণেই আমার বাবা বললেন, স্যার, আপনি যদি আমার সাইকেলটা একটু দেখে রাখতেন...।
তার স্যার বলার আন্তরিকতা কনস্টেবল সাহেবকে মুগ্ধ করে থাকতে পারে। তিনি একটি জায়গা দেখিয়ে বললেন, এখানে রাখো, পনেরো মিনিটের মধ্যে যা যা দেখার দেখে ফিরে আসবে।
জি স্যার, অবশ্যই, বলে আমার বাবা তারই সঙ্গে গেট পর্যন্ত আসেন এবং ভেতরেও ঢুকে যান। তার পরিচিত দু-একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, কিছু দেখার কৌতূহল নিবৃত্ত করে আধা ঘণ্টা পর বেরিয়ে এসে আবারও তাকে স্যার ডেকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাইকেল নিয়ে রাত্রিনিবাসে ফিরে এলেন।
আমি একাধিকবার তার কাছে এই এপিসোডটি শুনেছি এবং প্রতিবারই তিনি উপসংহারে বলেছেন : স্যার ডেকে পুলিশকে দিয়ে আমার সাইকেলটি আধা ঘণ্টা পাহারাও দেওয়াতে পেরেছি।
তিনি যে স্যার ডেকে ভেতরে যেতে পেরেছেন তার কাছে এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে নিজের সাইকেলের নিরাপত্তায় পুলিশ প্রহরা নিশ্চিত করতে পারা।
কারও পছন্দ হোক বা না হোক, উপনিবেশবাদ তাদের কাউকে খোঁচা দিক বা না দিক আমি ব্যক্তিজীবনে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বাবার এই শিক্ষাটাকে গ্রহণ করেছি। কৌশল কিংবা চাতুর্য হিসেবে নয়, অপ্রত্যাশিতভাবেই আমি অনেককে স্যার বলি, বন্ধুদের কাউকেও বলি এবং বলে কিছুটা সম্মান ফিরেও পাই বলে আমার বিশ্বাস।
নিজের কাহিনি
‘আমলাতন্ত্রের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘লাল ফিতের দৌরাত্ম্য বন্ধ কর বন্ধ কর’ এসব লিখতে লিখতে এ চাকরি সে চাকরি করতে করতে বাবাকেও সন্তুষ্ট রাখতে ১৯৮২ সালের নিয়মিত বিসিএস পরীক্ষায় বসলাম এবং শুরুতে বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার কারণে সম্ভবত গণিত ও ইংরেজির পুঁজির জোরে পাসও করে গেলাম। প্রথম পদায়ন বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। হায়ারার্কি বা পদসোপানের বিষয়টি একটু একটু করে টের পেতে শুরু করলাম। একেবারে প্রথম দিনই অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোমেনুল হককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা ভাই, এই অফিসে কাকে কাকে স্যার বলতে হবে?’
আমার সৌভাগ্য আমার চাকরি জীবনে প্রথম কথা বলা বস মোমেনুল হক (১৯৬৯-এর ইপিসিএস) তখনই এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমলাতন্ত্র নিয়ে কিছু রসিকতা করলেন, টেক্সট বইয়ের বাইরে কিছু জানি কিনা বোঝার চেষ্টা করলেন এবং বুঝলেন আমি টেক্সট বইয়ের তেমন কিছুই জানি না, সামান্য যা জানি সবই টেক্সট বইবহির্ভূত আমার আমলে সেগুলোকে বলা হতো আউট বই কিংবা কাজে বই।
তাকে আমার প্রশ্নের জবাবে ফিরিয়ে আনি। তিনি বললেন, ডিসি, এডিসি জেনারেল, এডিসি রেভিনিউ, এডিসি ভূমি হুকুমদখল এবং এডিএম (শামসুল হক)-কে স্যার বলবে।
আমি দেখলাম যার সঙ্গে কথা বলছি তিনিও এডিএম, তাকেই বা কেন বাদ দেব। বললামও, তাহলে ভাই আপনাকেও স্যার বলব।
তিনি বললেন, ইচ্ছা হলে বলো। ইচ্ছা না হলে থাক।
আরও বললেন, সিনিয়রদের মধ্যে যাদের তুমি একটু বেশি পছন্দ করবে তাদের স্যার কম বললেও চলবে, কিন্তু যারা কম পছন্দের হবেন তাদের একটু বেশি বেশি করে বলাই হবে উত্তম কাজ।
স্যার শুনে যেমন তৃপ্তি (!) বলেও তো তৃপ্তি আছে। আমার চাকরিজীবনের (কিংবা আমলাজীবনের) শুরুতে যাকে স্যার বলে তৃপ্তি পেয়েছি, তিনি মোমেনুল হক। একটি প্রতিষ্ঠানের বড়কর্তা থাকা অবস্থায় পদব্রজে রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে যা আছে সব খোয়াতে বাধ্য হন। ঘটানাটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। ছিনতাইকারীরা তার ১৪৫ টাকার সবটাই নিয়ে যায়।
১৯৮৮ সালের একেবারে শুরুতে ভূমি সচিব এম. মোকাম্মেল হক আমাকে মাঠ থেকে তুলে ভূমি মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসেন। এটাই আমার সচিবালয় চাকরির সূচনা, সহকারী সচিব হিসেবে। মেজাজে আবেগময় দোদুল্যমানতা ছিল এমন একজন বিদ্বান যুগ্ম সচিব ডক্টর কামাল সিদ্দিকীকে আমাদের জ্যেষ্ঠ একজন সহকর্মী আসহাবুর রহমান বলতেন, কামাল ভাই। আমি ততদিনে সিনিয়রদের স্যার বলতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। কিন্তু ডক্টর সিদ্দিকী হুকুম করলেন এখন থেকে তুমিও আমাকে ভাই বলবে, কামাল ভাই। এটা আমার আদেশ। এটা তোমার জন্য স্পেশাল অফার। কিন্তু আদেশটা পালনের উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছি।
আবার সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্যার ছিলেন বাংলাদেশে প্রথম মন্ত্রিসভায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ডক্টর মফিজ চৌধুরী, তিনি সবার স্যার, কিন্তু আমার হয়ে রইলেন ভাই। আদমসূত্র ছাড়া তার সঙ্গে আমার আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। তাকে মফিজ ভাই বলছি শুনে আমার বাবাও অবাক হলেন এবং আমার অপরাধটা যে অমার্জনীয় তা মনে করিয়ে দিলেন। আমি যখন ডক্টর মফিজ চৌধুরীকে স্যার বলতে চেষ্টা করলাম, তিনি বললেন, ফাজলামি শুরু করলে।
তার সঙ্গে আমার সম্পর্কসূত্র সাহিত্যের, হ্যামলেটের, রবীন্দ্রনাথের। সুতরাং তিনি আবার বাবার স্যার হলেও আমার ভাই, মফিজ ভাই।
সে আমলে নারীদের স্যার বলার রেওয়াজটা শুরুই হয়নি। বগুড়া কালেক্টরেটের দোতলায় আমি বসি। দুপুরের পর পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন ভদ্রমহিলা এলেন, তার কয়েকটা কাগজ এবং ছবি প্রত্যয়ন করে দিতে হবে।
ছবিটা উল্টে দেখি নাম লেখা রোমেনা আফাজ। আমি নাম দেখেই দাঁড়িয়ে যাই। আমি অনেকটা তোতলাতে তোতলাতে বলি, আমি একজন রোমেনা আফাজকে জানি, দস্যু বনহুরের লেখক। আপনি তাহলে আরেকজন।
তিনি বললেন, না, একজনই রোমেনা আফাজ, আমিই দস্যু বনহুর সিরিজ লিখেছি। আমার ক্লাস সেভেন জীবনে রোমেনা আফাজই ছিলেন আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লেখক, আমি কীভাবে তাকে সম্বোধন করব, কীভাবে সম্মান জানাব, অস্থির হয়ে উঠলাম। ‘স্যার’ ছাড়া আর সম্মানসূচক যত শব্দ আমার মনে আসে সবই তার জন্য নিবেদন করেছি। ‘স্যার’ বলিনি কারণ, সে সময় কোনো নারী স্যার শুনলে ভাবতেন ‘বিটলামি’ করছি। আমার উচ্ছ্বাস তাকে বিব্রত করে থাকতে পারে তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন এবং বললেন, এই কালেক্টরেটে কত এসেছি, কিন্তু এত সম্মান কখনো পাইনি।
আমার আরও আরও স্যার
১৯৮৯-এর অক্টোবরে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার ইউএনও পদে যোগ দিই। আমাকে সংবর্ধিত করতেই কিনা যোগ দেওয়ার সঙ্গে ছুটতে হলো ডাকাতের গুলিতে নিহত পাঁচজনকে দেখতে। মৃত্যুশয্যায় আরও কয়েকজন। খানিকটা দেহ গাছের ওপর, খানিকটা ঘরের চালে এমন একটি মরদেহও নামাতে হলো। তার অল্পদিন আগে কুমিল্লায় নিদারাবাদের ছয় খুনের ঘটনা বেশ আলোচিত হয়েছে। পরদিনই আহতদের একজনের মৃত্যু হলে ঢাকায় পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গফরগাঁও নিদারাবাদের সঙ্গে ড্র করেছে।
বিভিন্ন কারণে গফরগাঁও প্রশাসনে তখন অস্থিরতা চলছে ইউএনওবিরোধী হয়ে উঠেছেন উপজেলা হাসপাতালের সব ডাক্তার; প্রকৃচি (প্রকৌশলী কৃষিবিদ ও চিকিৎসা) সমাজের আন্দোলনও চলছে। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, সংসদ সদস্য উপজেলার কারও কারও মতে, উপজেলাটাকে গিলে খাচ্ছেন। এ রকম একটি অস্থির পরিবেশে একটি সভাতে আমি গফরগাঁও সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আমীর আলীকে সম্বোধন করলাম স্যার; খায়রুল্লাহ গার্লস স্কুলের হেডমিস্ট্রেস মার্জিয়া বেগমকে বললাম ম্যাডাম; গফরগাঁও কলেজের প্রিন্সিপাল মোকাররম হোসেন তো অবশ্যই স্যার আমার এক-দুজন সহকর্মীর মনে হলো আমি প্রশাসনের ডিসিপ্লিন ভেঙে ফেলছি। অভিযোগটা আরও গুরুতর হলো যখন আমি একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে বললাম, স্যার। প্রশাসন বোধ হয় তখন পুরোটাই ভেঙেই পড়ল! সেই ইউনিয়নের নাম রাওনা এবং চেয়ারম্যান হামিদুল্লাহ মাস্টার। আমার ‘বস’ ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক শফিউল আলম ফিসফিস করে বললেন, কী শুনলাম, তুমি নাকি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকেও স্যার বলতে শুরু করেছ।
একটু হালকা চালে বললাম, স্যার, গ্রাসরুটস লেভেল থেকেও এগোতে এগোতে মন্ত্রী হওয়ার নজির আছে। মন্ত্রীকে সবাই স্যার বলেন। কে কখন মন্ত্রী হয়ে যান বলা তো যায় না, আমি না হয় একটু আগে থেকেই স্যার বলা শুরু করলাম।
গফরগাঁও স্কুলটা সরকারি হাইস্কুল, আমি ঢাকার একটি সরকারি হাইস্কুলে পড়তাম গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল। সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের আন্তঃস্কুল বদলি হয়েই থাকে। আমি হয়তো আমীর আলীকে সরাসরি আমার শিক্ষক হিসেবেই ল্যাবরেটরি স্কুলে পেতে পারতাম। কাজেই তাকে তো আমার স্যার বলতেই হবে, না বলাটাই হবে ঔদ্ধত্ব। বদলিসূত্রে আমি যখন গফরগাঁও ছেড়ে আসি, আমীর আলী স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, শিক্ষকতা জীবনের শেষ পর্বে এসে সম্মানটা পেয়েছি। ১৯৯৯-এর এপ্রিলে তার-আমার শেষ দেখা।
মার্জিয়া বেগমের ‘সফিসটিকেশন’ চোখে পড়ার মতো। আদর্শ স্কুলশিক্ষক, আমি সম্বোধন করতাম ম্যাডাম। সন্তানদের বাধা উপেক্ষা করে হামিদুল্লাহ মাস্টার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। অন্তত তার বিরুদ্ধে চাল-গম তছরুপের কাহিনি আমি শুনিনি। মাস্টার হিসেবে, ভালো মানুষ হিসেবে, ভালো জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি অবশ্যই আমার স্যার।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ কবি হিসেবে বড়, আমলা হিসেবেও। চাকরিসূত্রে তিনি কেবল আমার নন, আমার বসদের যারা বস তাদেরও স্যার। ১৯৮২ সালে সন্ধানী প্রকাশনীর কর্ণধার গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ আরও কটি বইয়ের সঙ্গে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর বইও দিলেন, উদ্দেশ্য বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় রিভিও লেখানো। আমি তার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে তখনো পরিচিত হইনি। ১৯৯২ সালে তার একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা যখন তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমিও ফিসফিস করে বললাম, স্যার, আমি অবজারভারে আপনার বই নিয়ে লিখেছিলাম।
তিনি বললেন, আমি তো তোমাকেই খুঁজছি। বলেই আমার কাছে তার মুখ এনে আস্তে করে বললেন, তুমি আমাকে স্যার বলবে না, সেন্টু ভাই বলবে। তারপরও দেখা হয়েছে, আমি সেন্টু ভাই বলতে পারিনি, স্যারই বলেছি।
লেখক: সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট
সুপারস্টার শাকিব খানের জন্মদিন ছিল ২৮ মার্চ। বিশেষ দিনটিতে অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীরা শুভেচ্ছায় সিক্ত হন নায়ক। একই সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির সহকর্মীরাও শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান তাকে।
বিশেষ ওই দিনটি ঘরোয়া আয়োজনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উদযাপন করেন তিনি। পরিবারের সদস্য এবং দুই ছেলে আব্রাম খান জয় ও শেহজাদ খান বীরের সঙ্গে কেক কাটেন তিনি। সমাজমাধ্যম ছড়িয়ে আছে সেসব ছবি।
অভিনেতার জন্মদিনে ছেলে বীরকে নিয়ে শাকিবের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে উঠেছিলেন বুবলী। তারই একটি ভিডিও বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টায় ফেসবুক ভেরিফায়েড পেজে পোস্ট করেছেন বুবলী।
নায়িকা ৩৪ সেকেন্ডের ভিডিও প্রকাশ করে ক্যাপশনে লেখেন—'বাবার জন্মদিনে যখন বাবা ছেলের দুষ্ট-মিষ্টি খুনসুটি।' এর পরই জুড়ে দেন একটি রেড হার্ট ইমো।
বুবলীর পোস্ট করা নজরকাড়া ভিডিওটি ইতিমধ্যে প্রায় চার লাখবার দেখা হয়েছে। এ ছাড়া মন্তব্য পড়েছে প্রায় তিন হাজার।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সন্ধ্যার আকাশে রহস্যময় চাঁদ দেখে আটকে যায় চোখ। চাঁদের নিচে আলোকরেখার মতো ছোট এক বিন্দু। এ নিয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) সন্ধ্যা থেকেই সোশালে মাতামাতি। এ সংক্রান্ত ছবি সমানে শেয়ার করে চলেছে নেটিজেনরা। সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন নানা রকম মন্তব্য।
কেউ কেউ বলছেন, এটি দেখতে ঠিক আরবি হরফ ‘বা’-এর মতো। আবার কেউ কেউ বলছেন, দৃশ্যটির সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে কাজী নজরুল ইসলামের একটি গান মোর ‘প্রিয়া হবে এসো রানী’র। গানে প্রিয়তমার খোঁপায় ‘তারার ফুল’ দেওয়ার কথা বলেছিলেন বিদ্রোহী কবি।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিকসের বরাত দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, বসন্তের আকাশে ধরা পড়া রহস্যময় এই আলোকরেখা আসলে শুক্র গ্রহ। অবশ্য এই মহাজাগতিক দৃশ্য বিরল। সৌরমণ্ডলের উজ্জ্বলতম গ্রহটি শুক্রবার চলে আসে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের কাছাকাছি। নতুন অবস্থানের কারণেই মানুষের কাছে ভিন্নভাবে ধরা দেয় গ্রহটি। তবে সেটি আবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই হারিয়ে যায়।
এদিন সন্ধ্যার পর বাংলাদেশ-ভারতসহ কয়েকটি দেশে আকাশে চাঁদের নিচে আলোকবিন্দুটি দেখা যায়। এ সময় অনেকেই চাঁদ দেখতে ঘর থেকে বের হয়ে যান। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এই বিরল মহাজাগতিক মিলন দেখার উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিকস টেলিস্কোপ ও ক্যামেরা ব্যবহার করে এই মহাজাগতিক ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করে।
সোশালে সাইফুদ্দিন আহমেদ নামে একজন কলেজ শিক্ষক মন্তব্য করেন, ‘এটিই নজরুলের ‘তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল...। কবি তার একটি গানে লিখেছিলেন, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল / কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল ...।’ গতকাল ছিল চৈত্র মাস, চাঁদ আর শুক্রের সম্মিলিত এই মোহনীয় রূপও ছিল ঠিক তৃতীয়া তিথিতে।
তবে শুধু এই কলেজ শিক্ষকই নন, আরও অনেকে চাঁদ ও শুক্র গ্রহের বিরল এবং যৌথ রূপকে কানের দুলের মতো দেখতে বলে মন্তব্য করেছেন।
এর আগে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে চাঁদের সঙ্গে এক সারিতে দেখা গিয়েছিল শুক্র ও সৌরমণ্ডলের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতিকে। এবার চাঁদের নিচে দেখা মিলল শুক্র গ্রহের। চাঁদের নিচে অবস্থানের পাশাপাশি কিছুক্ষণের জন্য চাঁদের আড়ালেও চলে গিয়েছিল গ্রহটি।
মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বলছে, গত ১ মার্চ থেকেই খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে বৃহস্পতি ও শুক্র গ্রহ। বিভিন্ন দেশে রাতের আকাশেই দেখা মিলছে এ বিরল দৃশ্যের। সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশের দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে বৃহস্পতি ও শুক্র। আকাশে মেঘ না থাকলে কাছাকাছি আসার দৃশ্য খালি চোখেই দেখতে পারছেন যে কেউ।
বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট অ্যাকিউ ওয়েদার বলছে, পৃথিবীর দুই প্রতিবেশী গ্রহ শুক্র ও মঙ্গল একে অপরের সবচেয়ে নিকটে আসতে চলেছে। একই সঙ্গে এক সারিতে দেখা যাবে শুক্র-মঙ্গল ও চাঁদকে। এমন ঘটনাকে ‘প্ল্যানেটরি কনজাংশন’ বলে আখ্যা করেছেন বিজ্ঞানীরা।
আগামী ২৬ মার্চ, মঙ্গল ও শুক্র গ্রহ নিজেদের কক্ষপথ থেকে সবচেয়ে কম দূরত্বে ও একই সারিতে অবস্থান করবে। ওই দিন সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশে দুটি গ্রহ দৃশ্যমান হবে। এর আগে, ২৫ মার্চ রাতে চাঁদের কাছাকাছি আসবে এই দুই প্রতিবেশী গ্রহ, যা মহাকাশ বিজ্ঞানে বেশ বিরল ঘটনা।