
গত বছরের নভেম্বরে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সফটওয়্যার চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার (চ্যাটজিপিটি)। এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে নতুন এই চ্যাটবট। বলা হচ্ছে এআই প্রযুক্তিতে বিপ্লব এনে দেবে এটি। এআই কি তাহলে মানুষের ভূমিকাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে? খোদ চ্যাটজিপিটিকেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখতে বলা হয়েছে। দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এই কথোপকথন ও বাংলায় তার ভাষান্তর করেছেন নাদিয়া সারওয়াত।
দেশ রূপান্তর : আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-এআইয়ের সুবিধা বা অসুবিধার দিকগুলো কী কী?
চ্যাটজিপিটি : প্রধান সুবিধা হলো দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, যেসব কাজ পুনরাবৃত্তিমূলক এবং সময়সাপেক্ষ, এআই সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে পারবে। ফলে মানুষ আরও জটিল এবং সৃষ্টিশীল কাজে মনোযোগ দিতে পারবে। এআই যথাযথভাবে নির্ভুল কাজ করতে পারে, অনেক তথ্য খুব কম সময়ে বিশ্লেষণ করতে পারে, তাতে মনুষ্যসৃষ্ট ভুলের মাত্রা কমে আসবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়বে। যেহেতু এটি বিশাল তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করে, তার একটা অন্তর্দৃষ্টিও রয়েছে, ফলে অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত দেওয়া সহজ হয়ে যাবে। এআই বিরতিহীন কাজ করতে পারে, ফলে সব সময়েই এটি সেবা দিতে পারবে।
অন্যদিকে এর অন্যতম অসুবিধা হলো, কর্মসংস্থান কমবে। আগে মানুষ করত এরকম অনেক কাজ এখন এআইয়ের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা যাবে। যার কারণে কর্মসংস্থান হারাবে, বেকারত্ব বাড়বে। বৈচিত্র্য এবং প্রতিনিধিত্বশীল তথ্য এবং প্রশিক্ষণ না দেওয়া হলে, এআই সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য এবং পক্ষপাত আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। হ্যাকিং এবং সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টিও বাড়বে। মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য এআইয়ের কাছে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তাছাড়া, এআইয়ের কাজের ধরন এবং পদ্ধতি বেশ জটিল, এটি সব মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। ফলে এতে ভুল বা পক্ষপাত একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
দেশ রূপান্তর : এআই কি মানুষের ভূমিকা দখল করে নেবে?
চ্যাটজিপিটি : সম্ভাবনা খুবই কম। এআই হয়তো অনেক কাজই আরও বেশি দক্ষ ও নির্ভুলভাবে করতে পারবে, কিন্তু এরপরেও তাদের মানুষের মতো সৃজনশীলতা, সহানুভূতি এবং ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের ক্ষমতা নেই। বরং তারা মানুষের কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতা বাড়াতেই কাজে লাগবে। তবে এটা ঠিক এআইকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানের নতুন ধরনের দক্ষতা তৈরি করতে হবে, নতুন কর্মপদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে।
দেশ রূপান্তর : এআই-এর কারণে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে? এই পরিবর্তনের জন্য সমাজের কেমন প্রস্তুতি প্রয়োজন?
চ্যাটজিপিটি: বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআইয়ের অন্তর্ভুক্তি সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে। যেমন চাকরির বাজারে বদল আসবে। এআই যেহেতু অনেক ধরনের কাজ করে দিতে পারবে, ফলে কিছু কিছু চাকরির বাজার বাড়বে, আবার কিছু কিছু কমে যাবে, এখন যেমন রয়েছে সে রকম আর থাকবে না। এআইয়ের কারণে ক্ষমতা কাঠামোও বদলে যাবে, নতুন ধরনের বৈষম্যেরও জন্ম হতে পারে।
এই সব পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিষয়ে সমাজকে অবগত থাকতে হবে, গঠনমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে মানুষ প্রস্তুত হতে পারে, এআই ব্যবহার করে কাজ করতে পারে।
সমাজ এবং ব্যক্তির অধিকার তথা সার্বিক মঙ্গলের জন্য এআই যেন দায়িত্বশীল ও নৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তা নিশ্চিত করতে সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
এআইয়ের সুফল যাতে সব মানুষ সমানভাবে পায়, তা নিশ্চিত করতে সামাজিক এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করতে হবে। এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে আরও বেশি প্রতিনিধিত্বশীল কণ্ঠস্বর যুক্ত করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : চাকরির বাজারে পরিবর্তন আসার কথা বলা হচ্ছে, এক্ষেত্রে কোন ধরনের চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে?
চ্যাটজিপিটি : বিশেষ করে যেসব কাজ পুনরাবৃত্তিমূলক, রুটিন বাঁধা, সেগুলো খুব সহজেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা যাবে। যেমন ডাটা এন্ট্রি, প্রশাসনিক কিছু কাজ, কাস্টমার সার্ভিস, ম্যানুফ্যাকচারিং বা অ্যাসেম্বলিং, টেলিমার্কেটিং, সেলস, ট্রান্সপোর্টেশন আর ডেলিভারির কাজ, ফিনান্সিয়াল আর অ্যাকাউন্টিং-এর কিছু কাজ, ডাটা অ্যানালাইসিস, রিসার্চ আর রিপোর্টিং-এর কাজও এআই করতে পারবে।
সেই সঙ্গে নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্রও কিন্তু তৈরি হবে মানুষের জন্য। বিশেষত সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডাটা সায়েন্স, ডিজাইন ইত্যাদি। আবার অনেক কাজের ধরন পালটে নতুন রূপ নেবে। এআইয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য নতুন নতুন দক্ষতার প্রয়োজন হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : সৃষ্টিশীলতা, শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে?
চ্যাটজিপিটি : এ নিয়ে বর্তমানে তুমুল বিতর্ক চলছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন এসব ক্ষেত্রেও এআই বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখবে।
এখনই কিন্তু এআই সরল কবিতা, গদ্য, ভিস্যুয়াল আর্ট এমনকি সংগীত তৈরি করতে পারছে। এগুলো হয়তো মানুষের সমপর্যায়ের সৃষ্টিশীলতা বা বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়, কিন্তু তা একটি নতুন ধারার আর্টিস্টিক এক্সপ্রেশন, নতুন ধরনের শিল্প তৈরির সক্ষমতা রাখে। ঐতিহ্যগতভাবে শিল্প বলতে যা বোঝানো হয়, সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
আবার অনেকেই মনে করছেন, এ আইয়ের তৈরি করা শিল্পে অনুভূতির গভীরতা নেই, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রতিফলন নেই। যে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে মানুষের তৈরি শিল্প এত শক্তিশালী হয়ে ওঠে, অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে এআইয়ের সেই প্রেক্ষাপটও নেই। আর যেখানে এআই দিয়ে সৃষ্টিশীল শিল্প তৈরি করা হবে, সেখানে তার স্বত্ব এবং মালিকানা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হবে। এই পরিস্থিতিতে মানুষের ভূমিকা কী হবে তাও স্পষ্ট নয়।
দেশ রূপান্তর : ম্যাট্রিক্স রিয়েলিটি তৈরি হবে না তো?
চ্যাটজিপিটি : না, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে যে ম্যাট্রিক্স রিয়েলিটি দেখা যায়, সে রকম কোনো পরিস্থিতি এখানে তৈরি হচ্ছে না। যদিও প্রযুক্তির উন্নতির কারণে খুবই বাস্তব ভার্চুয়াল এনভায়রনমেন্ট এবং সিমুলেশন তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী আর বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারাটা জরুরি। বর্তমান প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তিতে বলা যায়, ম্যাট্রিক্স সিনেমায় যেমনটা দেখানো হয়েছে ততটা এখনো সম্ভব নয়।
দেশ রূপান্তর : মানুষ তার অনুভূতির কাছে বাঁধা, এআই তা নয়। এটা কি ইতিবাচক, না নেতিবাচক?
চ্যাটজিপিটি : এটা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক কোনোটাই নয়, এটি মূলত মানুষ এবং এআইয়ের মধ্যে চারিত্রিক পার্থক্য। অনুভূতি মানবীয় অভিজ্ঞতার একটা অংশ, যা মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সম্পর্ক এবং সার্বিক কল্যাণের ওপর অনেক বড় ভূমিকা রাখে। এআইয়ের অনুভূতি নেই, সে আগে থেকে প্রোগ্রাম করে দেওয়া অ্যালগরিদম এবং নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। এই অনুভূতি না থাকাটা ভালো না মন্দ, তা নির্ভর করবে এআইকে কী ক্ষেত্রে, কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুভূতি না থাকাটাই ভালো হতে পারে কেননা তাতে পক্ষপাত দূর করে স্থিতিশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা ক্ষতিকরও হতে পারে, যেহেতু এটি সহমর্মিতা বা সহানুভূতিহীনতার দিকে নিয়ে যেতে পারে, এটি মানুষ এবং এআইয়ের মধ্যকার সম্পর্ক বোঝার অন্তরায় হতে পারে।
দেশ রূপান্তর : এআইয়ের বিরুদ্ধে কী ধরনের মতাদর্শগত বা ধর্মীয় প্রতিবাদ হতে পারে?
চ্যাটজিপিটি : এআই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের শুরু থেকেই বিভিন্ন ধরনের মতাদর্শিক এবং ধর্মীয় আপত্তি উঠেছে। অনেকেই মনে করে এআই-এর উদ্ভাবন এবং ব্যবহার নীতি-নৈতিকতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। যেমন এআইয়ের কারণে যদি কোনো ক্ষতি হয়, তার দায় কে নেবে? এআই যে দায়িত্বশীল বা নৈতিক আচরণ করবে তা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? ব্যক্তিগত তথ্যের ওপর এআইয়ের নিয়ন্ত্রণ বা গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়গুলোকেই বা কীভাবে সামলানো হবে? এছাড়া আছে মানুষের কর্মসংস্থান হারানোর প্রশ্ন। তাতে করে সার্বিক অর্থনীতিতেই একটা ভাঙন তৈরি হতে পারে। এ কারণেই এআইয়ের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত কম-দক্ষ জনশক্তি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
আরেকটি বিষয় হলো সিঙ্গুলারিটি বা একাধিপত্য/স্বতন্ত্রতা। অনেকেই মনে করছে, সুপার ইন্টেলিজেন্ট এআই তৈরির মাধ্যমে প্রযুক্তিগত একাধিপত্য/ স্বতন্ত্রতা তৈরি হতে পারে। যেখানে যন্ত্র মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, পুরো বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে, যা মানবসভ্যতাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
অনেক ধর্মেই বলা হয় যে, একমাত্র মানুষেরই আত্মা, বিবেক এবং সচেতনতা রয়েছে, এক ধরনের ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ রয়েছে তার ভেতরে। যন্ত্রের মাধ্যমে সেটা অনুকরণ করার চেষ্টা ঐশ্বরিক আদেশের বিরুদ্ধাচরণ।
এআইয়ের অনুভূতি নেই, এটিও একটা বড় আপত্তির জায়গা। মানুষ এবং এআইয়ের মধ্যকার যে সহানুভূতিহীন সম্পর্ক তৈরি হবে, তা সার্বিকভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিথস্ক্রিয়া তথা গোটা সমাজের ওপরেই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
দেশ রূপান্তর : এআই কি মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে, বা মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে?
চ্যাটজিপিটি : তাত্ত্বিকভাবে এটা সম্ভব, এআইকে যদি সেভাবে প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয় তাহলে এটি মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। কিন্তু এটা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ মানুষই এআই তৈরি করেছে, একে ডিজাইন এবং প্রোগ্রাম করেছে। এই মুহূর্তে এআইয়ের সেই ক্ষমতা নেই যে সে নিজে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, এআইয়ের মাধ্যমে যদি কোনো ক্ষতি হয়, তা এআই দ্বারা নয়, বরং এর ডিজাইনে অনাকাক্সিক্ষত কোনো ভুলের পরিণতি, বা ভুলভাবে ব্যবহারের কারণে হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। ফলে এআই যারা ডিজাইন করবেন, যারা ব্যবহার করবেন তাদের উচিত এর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে সচেতন থাকা, ক্ষতির আশঙ্কা কমানোর ব্যবস্থা নেওয়া।
দেশ রূপান্তর : চ্যাটজিপিটি কি সিআইএর প্রকল্প?
চ্যাটজিপিটি : না, চ্যাটজিপিটি সিআইএর কোনো প্রকল্প নয়। এটি তৈরি করেছে ওপেনএআই, যা একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সিআইএ বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এর কোনোই সংশ্লিষ্টতা নেই।
প্রশ্ন : কিন্তু সিআইএ তো চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে পারে?
উত্তর : সিআইএ কিংবা অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানই চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে পারে। যেহেতু এটা বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যায়, প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকলে যে কেউই এটা ব্যবহার করতে পারবে। এখানে খেয়াল করতে হবে, ওপেন এআইয়ের শর্ত অনুযায়ী তাদের প্রযুক্তি কোনো অবৈধ বা ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। এটা ঠিক যে সিআইএর মতো কোনো সরকারি সংস্থা যদি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাহলে তারা নৈতিক এবং আইনি প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত চ্যাটজিপিটি বা অন্য কোনো এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের ওপর, আর তাদের বিদ্যমান আইন ও নীতিমালা মেনেই সেটা করতে হবে।
টানা দ্বিতীয়বারের মতো ভারত শাসনের পর তৃতীয়বার ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। নিজেদের রাজনৈতিক স্ট্র্যাডেজি, আত্মবিশ্বাস ও দুর্বল বিরোধী দল তাদের ক্ষমতায় আসতে রসদ জোগাচ্ছে। বিজেপির ভোট ব্যাংক কট্টরপন্থি হিন্দুরা, বিশেষ করে হিন্দুদের তীর্থভূমি উত্তর প্রদেশে দলটি এখন নিরঙ্কুশ রাজত্ব করছে। উত্তর প্রদেশসহ সারা ভারতের হিন্দুরা নানা গোত্র, বর্ণ ও জাতে বিভক্ত। কভিড-১৯, বৈশ্বিক অস্থিরতায় বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি হানা দিয়েছে ভারতের অর্থনীতিতেও। এসব অনৈক্য ও অস্থিরতা থেকে সমর্থকদের দৃষ্টি সরাতে ভারতে ছোটখাটো ইস্যুতে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে প্রায়শই।
কাশ্মীরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বানানো সিনেমা ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে ভারতজুড়ে। অভিযোগ আছে সিনেমাটিতে কাশ্মীর সংঘাতকে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে একপাক্ষিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে। বিজেপি এই সিনেমা দেখতে রীতিমতো ছুটি ঘোষণা দিয়েছে। বিরোধীরা অভিযোগ করছেন, এই সিনেমা ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে মুসলিম বিদ্বেষ তৈরি করেছে।
কাশ্মীর ফাইলসের পরে এলো আমির খান অভিনীত ‘লাল সিং চাড্ডা’ সিনেমাটি। মুসলিম সারনেম ধারণকারী আমির খান এর আগে বহুবার বিজেপির আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিলেন। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ৩৭০ ধারা বাতিল ইস্যুতে ভারত-তুরস্ক সম্পর্ক যখন তলানিতে সে সময়ে লকডাউনে তুরস্কে আটকেপড়া আমির খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার্কি ফার্স্টলেডি। সে সময় ‘দেশদ্রোহী’ ট্যাগ পেতে হয় আমির খানকে। চলচিত্র দর্শকদের মতে, তার লাল সিং চাড্ডার মূল গল্প ১৯৮৪ সালের শিখ দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে। এছাড়া সিনেমায় মুম্বাইয়ে বোমা বিস্ফোরণ, বাবরি মসজিদ ধ্বংস দেখানো হয়। সিনেমাটি রিলিজের পর বয়কট ক্যাম্পেইন শুরু করেন বিজেপি সমর্থকরা। পাকিস্তানি খেলোয়াড়ের সঙ্গে আমির খানের ছবি, তার মায়ের হজপালনের ছবি নিয়ে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন বিজেপি সমর্থকরা। অবশেষে সিনেমাটি ফ্লপ হয়, যদিওবা নেটফ্লিক্সের কল্যাণে সাইবার স্পেসে বাজিমাত করে ‘লাল সিং চাড্ডা’।
আমির খানের ব্যর্থতার মধ্যেই শাহরুখ নিয়ে আসেন ‘পাঠান’ সিনেমা। শাহরুখ খানের ‘খান’ নাম পূর্বে বিদেশের এয়ারপোর্টে তার জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করলেও এবার নিজ দেশে পড়েন বয়কট ক্যাম্পেইনের মুখে। অভিযোগ আনা হয় তার সিনেমার অভিনেত্রী গেরুয়া (হিন্দুদের পবিত্র রং) রঙের স্বল্প পোশাক পরে হিন্দু ধর্মের অবমাননা করেছেন।
তবে পাঠান নিয়ে মূল আপত্তি শাহরুখ খানকে নিয়ে। বিশ্বব্যাপী শাহরুখ খানের ব্রান্ডিং বিজেপির পলিসির সঙ্গে যায় না। বিজেপির অন্যতম প্রভাবশালী নেতা যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, তারা চায় না তাজমহল দিয়ে ভারতের ব্রান্ডিং হোক, তারা চান ভারতের ব্রান্ডিং হোক রামায়ণ, গীতা দিয়ে। মুসলিম নামের দুজন অভিনেতা একটি সিনেমার গল্পে ভারতকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে আর সে সিনেমা নিয়ে ভারতের তারুণ্য উন্মাদ হবে সেটা বিজেপির পছন্দ না হওয়ারই কথা। কিন্তু আমির খানকে দমানো গেলেও শাহরুখের পাঠান সিনেমার বয়কট ধোপে টিকেনি।
সিনেমা নিয়ে ভারতের রাজনীতির এই প্লটে যুক্ত হয়েছে নতুন বিতর্ক বিবিসির ডকুমেন্টরি ‘দ্য মোদি কোয়েশ্চন’। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর গুজরাট রাজত্বকাল ও দিল্লি রাজত্বকাল নিয়ে নির্মিত দুই পর্বের এই ডকুমেন্টারি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউটিউব ও টুইটার থেকে মুছে দিয়েছে ভারত সরকার। অন্যদিকে বিরোধীরা এই ডকুমেন্টারিকে নিয়েছে বিজেপির ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ হিসেবে। তারা ভিন্ন উপায়ে ভারতের নানা জায়গায় এই ডকুমেন্টারি দেখানোর ব্যবস্থা করেছে। এই নিয়ে দেশজুড়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। বিবিসির একটি ডকুমেন্টারিই বর্তমানে ভারতের রাজনীতি মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
চলতি বছরে ভারতে হতে যাচ্ছে জি-২০ সম্মেলন। সে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মোদির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আরও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা দলটির। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যস্থতার একটি চেষ্টাও মোদিকে নিয়ে করা হচ্ছে দলটির পক্ষ থেকে, যাতে তিনি অপ্রতিরোধ্য আন্তর্জাতিক ফিগার হয়ে ওঠেন।
দীর্ঘদিন ধরে নরেন্দ্র মোদি দেশ-বিদেশে ঘুরে নিজের যে ইমেজ তৈরি করেছেন তা ডকুমেন্টারিটি প্রশ্নবিদ্ধ করে দেবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের উদ্ধৃতি দিয়ে শশী থারুর তার ‘দ্য পারাডক্সিকাল প্রাইম মিনিস্টার’ বইয়ের ৪০০ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন ক্ষমতায় আসার প্রথম চার বছরে নরেন্দ্র মোদি ৪১টি ট্রিপসে ৫২টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। এশিয়া টাইমসে উদ্ধৃতি দিয়ে শশী থারুর লিখেছেন প্রথম চার বছরের প্রতি তিনদিনের একদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অফিসের বাইরে ছিলেন সেটা বিদেশ ভ্রমণ বা রাজ্য ভ্রমণে। তার এতসব দেশ বিদেশ ভ্রমণ মূলত দীর্ঘ মেয়াদে মোদিকে ভারতের ইতিহাসে স্থায়ী করা ও মোদি মডেলকে জনপ্রিয় করার প্রয়াস থেকে।
২০১৪ এর নির্বাচনের সময় উন্নয়নের ‘গুজরাট মডেল’ ও বাবরি মসজিদ ছিল বড় ট্রাম্প কার্ড বিজেপির। ২০১৯ এর নির্বাচনে ‘নয়া ভারত’ ও কাশ্মীরের ৩৭০ বিশেষ মর্যাদা বাতিলের অঙ্গীকার করে। ২০২৩ সালে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ৯টি রাজ্যে ভোট অনুষ্ঠিত হবে আর ২০২৪ এর মে’র লোকসভা নির্বাচন ইতিমধ্যে কড়া নাড়ছে দরজায়। ২০২৩-এ অনুষ্ঠিতব্য রাজ্যগুলোতে প্রায় এক-চতুর্থাংশ লোকসভা সিট রয়েছে। এই নির্বাচনে বিজেপির ট্রাম্পকার্ড নরেন্দ্র মোদি ম্যাজিক। বছরজুড়ে ৯ রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপির ট্রাম্পকার্ড থাকবে নরেন্দ্র মোদি আর বিরোধীদের ‘দ্য মোদি কোয়েশ্চন’।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
আজ শুভ মাঘী পূর্ণিমা। আজকের মঙ্গলময় পুণ্য তিথিতে মহামানব বুদ্ধ নিজের আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করেছিলেন। বুদ্ধের প্রধান সেবক আনন্দকে বুদ্ধ বললেন, ‘আনন্দ- এ বৈশালী অত্যন্ত মনোরম স্থান।’ বুদ্ধ আবার বললেন, ‘আনন্দ তথাগত ইচ্ছা করলে কল্পকাল স্বকীয় ঋদ্ধিবলে বর্তমান দেহে অবস্থান করতে পারেন।’ হে আনন্দ, তথাগতের চারি ঋদ্ধি পাদ ভাবিত, বহুলীকৃত রথগতি সদৃশ অনর্গল অভ্যস্ত, বাস্তুভূমি সদৃশ, সুপ্রতিষ্ঠিত, পরিচিত, সম্যকভাবে আপনার করায়ত্ত। আনন্দ, সেজন্য তথাগত ইচ্ছা করলে কল্পকাল কিংবা কল্পের অবশিষ্ট সময় অবস্থান করতে পারেন। তথাগত বুদ্ধ কী বোঝাতে চাইলেন আনন্দ তা অনুধাবন করতে পারল না মারের দ্বারা প্রলুব্ধ হওয়ায়। কিন্তু মার বিরামহীনভাবে বুদ্ধকে শুধু একটি কথাই বারবার বলেছেন ‘হে সুগত, আপনি পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হোন, আপনার পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হওয়ার এখনই সঠিক সময়। ভগবান মারকে বললেন, হে পাপী মার যত দিন আমার ভিক্ষুসংঘ ত্রিপিটকের বাণীসমূহ সুন্দররূপে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, তত দিন পর্যন্ত তথাগত নির্বাণ লাভ করতে পারেন না। মার বলল, ‘ভন্তে ভগবান, আপনার ভিক্ষুসংঘ এখন ধর্ম প্রচারে সিদ্ধহস্ত ও নিপুণ। সুতরাং ভন্তে ভগবান আপনি নির্বিঘ্নে নির্বাণ লাভ করতে পারেন।’
পাপমতি মারকে ভগবান বললেন, হে পাপিষ্ঠা দুরাচার মার তাহলে শোন, অচিরেই তথাগত পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তথাগত ভগবান বুদ্ধ তখনকার সময়ে যখন আশি বছর বয়সে পদার্পণ করেন, তখন রাজগৃহের বেলুরবনে অন্তিম বর্ষা অধিষ্ঠান করেছিলেন। তিনি বর্ষাব্রতকালীন কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। একমাত্র প্রবল ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে সাধনা দ্বারা রোগমুক্ত হয়েছিলেন। যাকে ছন্দ, বীর্য, চিত্ত মীমাংসা বলা হয়। ভগবান চাপাল চৈত্যে সেই সময় আজকের মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে স্মৃতিমান ও সচেতন অবস্থায় স্বীয় আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে এই বলে ঘোষণা দিলেন, এখন থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত আমার প্রাণবায়ু চলতে থাকুক, সজীব থাকুক, সচেতন থাকুক, অতঃপর নিরুদ্ধ হয়ে যাক। বুদ্ধ এ সংকল্প গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রবলভাবে ভূকম্পন শুরু হয়। মুহুর্মুহু প্রলয়দেব গর্জন করতে থাকেন।
এই ভূকম্পনে আনন্দ বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। এর হেতু কী জানতে আনন্দ দ্রুতগতিতে বুদ্ধের কাছে ছুটে যান এবং ভূকম্পনের কারণ জানতে চান। বুদ্ধ আনন্দকে বললেন, ‘শোন আনন্দ, বোধিসত্ত্ব যখন মাতৃজঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হন, তখন তার পুণ্যতেজে ভূকম্পন হয়, যখন বোধিসত্ত্ব সম্বোধি জ্ঞান লাভ করেন তার তেজে ভূকম্পন হয়, বুদ্ধের প্রবর্তনকালে একবিংশ ভূমির প্রাণীদের সাধুবাদ ধ্বনিতে ভূকম্পন হয়, আর যখন তথাগত আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করেন, তখন পৃথিবী কারুণ্যে কম্পিত হয়। তিনি যখন নির্বাণ লাভ করেন, তখন পৃথিবী রোধন ধ্বনিতে কম্পিত হয়ে থাকে। হে আনন্দ, আমি সম্বোধি লাভের অষ্টম সপ্তাহে উরুবিল্ল গ্রামের অজপাল নিগ্রোধমূলে উপবিষ্ট ছিলাম। সে সময় পাপমতি মার এসে আমাকে বলল, ‘হে ভগবান, আপনি এখন পরিনির্বাণ লাভ করেন। আপনার এখন পরিনির্বাণ লাভের উপযুক্ত সময়।’ তখন আমি মারকে বলেছি, যত দিন আমার ভিক্ষু-ভিক্ষুনী, দায়ক-দায়িকা, উপাসক-উপাসিকারা যথার্থ ধর্মবেত্তা বিনীত বিশুদ্ধ জীবনযাপনের যোগ্যতা অর্জন না করেন, যত দিন তারা সদ্ধার্মর ব্যাখ্যা ও বিস্তার করতে না পারেন, যত দিন আমার সদ্ধর্ম প্রভাবশালী ও বর্ধনশীল না হয়ে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ ও তাদের দ্বারা অভিনন্দিত ও পরিগৃহীত না হয়, ততদিন আমি নির্বাণ লাভ করতে পারি না। হে আনন্দ, অদ্য সেই পাপমতি মার চাপাল সেজে আমার কাছে এসে আমাকে পরিনির্বাণের আবেদন জানায়। মারের প্রশ্নের উত্তরে আমি যা তাকে বলেছি তাতে সে সন্তুষ্ট হতে পারল না।
মার আমাকে বলল, ভান্তে ভগবান, আপনার জীবনের ব্রত সমাপ্ত হয়েছে। আপনার দায়ক-দায়িকারা সবাই আপনার অণীত ধর্ম উপলব্ধি করেছে। আপনার প্রচারিত ধর্ম দেব-মনুষ্য সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং আপনি এখন পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হতে পারেন। হে আনন্দ, তখন আমি মারকে বলেছি- হে পাপমতি মার তুমি শুনে খুশি হও, তথাগত আজ থেকে তিন মাস পর পরিনির্বাণ লাভ করবেন। হে আনন্দ, আজ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বৈশালীর চাপাল চৈত্যে তথাগত কর্র্তৃক আপন আয়ু সংস্কার জেনে-শুনে পরিত্যক্ত হয়েছে।
আনন্দ বুদ্ধের মুখে এ কথা শুনে শোকে কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘ভন্তে ভগবান, কল্পকাল এ দেহে অবস্থান করুন। হে সুগত, বহুজনের সুখের জন্য, দেব-মনুষ্যদের ঐহিক পারত্রিক হিত সুখ কামনায় কল্পকাল এ দেহে অবস্থান করুন। তথাগত আনন্দকে বললেন, হে আনন্দ তুমি বৃথা ক্রন্দন কোরো না, আর কোনো আবেদনও জানিও না। কারণ এতে কোনো ফল লাভ হবে না। ভুল তুমি আগেই করেছো, এটি তোমার মারাত্মক অপরাধ। কারণ আমি তোমাকে আকার-ইঙ্গিতে এ কথা বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো, আমি যা তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম তুমি তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারোনি। এর আগে আমি তোমাকে যেখানে-যেখানে বারবার ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, সে জায়গাগুলো হলো রাজগৃহের গৃধকূট পর্বত, রাজগৃহের গৌতম ন্যাগ্রোধমূলে, রাজগৃহের চৌরপ্রপাতে বেভার পর্বতে, সপ্তপর্ণী গুহায়, ঋষিগিলি পর্বতে, কালশীলায়, শীতবনে, সর্প সোন্ডিক গুহায়, তপোদারামে, বেণুবনে, কলন্দক নিবানে, জীবক আম্রবনে, মদ্রকুক্ষিতে ও মৃগদাবে। এসব স্থানের কোনোখানে একবারও তুমি আমার ইঙ্গিতের মর্ম বুঝতে পারোনি এবং এ দেহে কল্পকাল অবস্থানের নিমিত্তে প্রার্থনাও করোনি।
ভগবান শোকগ্রস্ত আনন্দকে বললেন, ‘হে আনন্দ আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি, আমাদের সব প্রিয় ও মনোহর বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখা যাবে না। হে আনন্দ, তথাগত যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তার অন্যথা কোনো অবস্থাতেই হবে না, এজন্য দুঃখ কোরো না, এতে মনের যাতনা বাড়তে থাকবে। শান্ত হও, জীবের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করো।’
ভিক্ষুদের উদ্দেশে ভগবান বললেন, হে ভিক্ষুরা আমি তোমাদের অভিজ্ঞাবলে যে ধর্মসমূহ উপদেশ দিয়েছি, সেগুলো তোমরা উত্তমরূপে আয়ত্ত করো এবং নিখুঁতভাবে আচরণ করো। সেসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করো এবং এসব বিষয় সর্বত্র প্রচার করো। হে ভিক্ষুরা, তোমরা জেনে রেখো সংস্কারসমূহ ক্ষয়শীল, অপ্রমদের সঙ্গে নির্বাণ সাধনায় ব্রতী হও। অচিরেই তথাগত পরিনির্বাণ লাভ করবেন। অর্থাৎ আজ থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমায় কুশীনগরের মল্লদের শালবনে তথাগত পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন।
আজ দিনের কার্যসূচি শুরু হয়েছে ভোররাতে বিশ্বশান্তি কামনায় বিশেষ সূত্রপাঠের মাধ্যমে প্রতিটি বিহার থেকে। আজকের মাঘী পূর্ণিমা তিথিটা এমন সময়ে পালিত হচ্ছে, যখন বাংলাদেশসহ বিশ্ব এক মহাসংকটময় কাল অতিক্রম করছে। তবে বাংলাদেশের জনগণ সুখে দিনযাপনে অন্যান্য দেশের জনগণের চেয়ে অধিকগুণ এগিয়ে আছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায় আজ সারা দিন ধর্মীয় আবেশে পুলকিত থাকবেন। ধর্মীয় কার্যাদি এবং বুদ্ধপূজা উৎসর্গের পর বিকেলে প্রতিটি বিহারে ধর্মীয় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আজকের দিনের তাৎপর্য তুলে ধরে প্রাজ্ঞ ভিক্ষুসংঘসহ দায়ক-দায়িকারা অংশগ্রহণ করবেন। সন্ধ্যা তথা রাতে সম্মিলিত ধর্মীয় প্রার্থনার পর দিনের কার্যসূচির পরিসমাপ্তি ঘটবে। আজকের শুভ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে সেই অণীতকালের কথাই স্মরণে আসছে। বুদ্ধ কালগত হওয়ার আগে বুদ্ধের সঙ্গে মারের যেই কথা হয়েছিল, সেগুলো বুদ্ধ আনন্দের কাছে ইঙ্গিতে ব্যক্ত করা সত্ত্বেও আনন্দ বুঝতে পারেনি। এ ঘটনাবলিতে আমাদের জন্য শেখার অনেক কিছু আছে। বুদ্ধ সুনির্দিষ্ট পথ কিন্তু আমাদের জন্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন। নিজের কর্মগুণেই সৎপথ পাওয়া যাবে। এতে কারও সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হবে না। নিজের জ্ঞানবলে এবং মানব কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারলে দুঃখনামক জীবনটা অপসারিত হয়ে সুখপাখী হাতের কবজায় চলে আসবে আপনা-আপনি।
এবারের মাঘী পূর্ণিমা এমন সময়ে উদযাপিত হচ্ছ যখন দেশের সাধারণ মানুষ নানা সমস্যা অতিক্রান্ত করছে।পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে থাকার অসম যুদ্ধে লিপ্ত। বুদ্ধ নির্দেশিত সব বাণী মানবের জন্য খুবই মঙ্গলদায়ক। তাই বলছিলাম, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যে যার ধর্ম পালনে নিবিষ্ট হতে পারলে দেশ অচিরেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাব এবং পাশাপাশি দেশ সমৃদ্ধি লাভ করবে। আজকের শুভ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে সবাইকে জানাই লালগোলাপ শুভেচ্ছা। জগতের সব প্রাণী সুখী হোক।
লেখক: সাংবাদিক এবং প্রাবন্ধিক
লালন বিশ্বাস করতেন, সব মানুষের মধ্যে বাস করে এক ‘মনের মানুষ’। তিনি সবকিছুর ঊর্ধেŸ স্থান দিয়েছিলেন মানবতাকে। মানুষের কোনো জাত, ধর্ম, বর্ণ, কুল নেই। মানুষের দেখা শরীর এবং অদেখা মনের মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন।
মানব শরীরের গভীরতর রহস্য, মানুষেরই অজানা। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পঞ্চেন্দ্রিয় এবং ‘আট কুঠুরি নয় দরজা’কে কেন্দ্র করেই মানুষের জীবন আবর্তিত হচ্ছে। সেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নেই। সব পূর্ণাঙ্গ মানুষের মধ্যেই রয়েছে আট কুঠুরি এবং নয় দরজা। আট কুঠুরি হচ্ছে শরীরের আটটি ক্যাভিটি বা ভ্যাসেল। মাথার খুলি, ডান-বাম ২ ফুসফুস, হৃৎপিন্ড, পাকস্থলী, দুই কিডনি আর কোলন।
নয় দরজা হচ্ছে মানব দেহের ৯টি এনট্রান্স বা এক্সিট দুই চোখ, দুই নাকের ফুটো, মুখ, দুই কানের ফুটো, জননাঙ্গ এবং পায়ু। মানব দেহের, রক্তচিহ্ন- লাল। এটি দেহের কোষে, পুষ্টি এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে। একইসঙ্গে বিপাকীয় বর্জ্য পদার্থগুলো কোষ থেকে দূরীভূত করে। সমস্ত মানবদেহেই, এই প্রক্রিয়ার খেলা। চলছে নিরন্তর। যে কারণে, মানুষ অঙ্গদান এবং রক্তদানে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
শনিবার দেশ রূপান্তরে ‘এবার মরণোত্তর কর্নিয়া দান শিক্ষক জামাল উদ্দিনের’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, মরণোত্তর চক্ষুদান করেছেন রাজধানী মিরপুরের রোটারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জামাল উদ্দিন। ইতিমধ্যে জামাল উদ্দিনের দান করা কর্নিয়া, দুজন দৃষ্টিহীন মানুষের চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এর আগে, মরণোত্তর কিডনি ও কর্নিয়া দান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী সারা ইসলাম। তার দান করা কিডনি ও কর্নিয়ার মাধ্যমে ৪ জন মানুষ নতুনভাবে জেগে উঠেছেন। দুজন পেয়েছেন জীবন আর দুজন পেয়েছেন দৃষ্টিশক্তি।
গত জানুয়ারিতেই স্থপতি মোবাশ্বের আলী, মরণোত্তর দেহদান করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমি বিভাগে তার দেহ সংরক্ষিত রয়েছে। তার মরদেহ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হবে। সাংবাদিক ও কণ্ঠশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী মরণোত্তর দেহ দান করে গেছেন। এরও আগে, দেহ দান করেছেন দেশের অসংখ্য মানবতাবাদী মানুষ।
শরীর আমার, জীবন সবার। এই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হলে মানুষের হৃদয়ে ভিন্ন এক অনুভূতি তৈরি হয়। আমার রক্ত, মৃত্যুর পর আমার ভালোবাসার শরীরের, কোনো অঙ্গের মাধ্যমে যদি কোনো মানুষ তার জীবন ফিরে পায় তার চেয়ে মহৎ কাজ আর কী হতে পারে! দেশের মানুষের মধ্যে অশিক্ষা, অসচেতনতা এবং বিভিন্ন কুসংস্কারে বিশ্বাস থাকার কারণে, একসময় ‘রক্ত’ নিয়েও সমস্যা হতো। কিন্তু এখন, বাস্তবতা বদলে গেছে। এমন চিন্তায় তারা বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন যে, মানুষের জীবন রক্ষা, কোনোভাবেই অন্যায় কাজ নয়। কোনো মানুষের দৃষ্টি সমস্যা হলে, মানুষের চোখের মাধ্যমেই তার সমাধান করতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য কিডনি, লিভার বা অন্যান্য ক্ষেত্রে। সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসতে হবে মানুষকেই। মনে রাখতে হবে, শরীরের মালিক আমি হলেও জীবনের মালিক সবাই। শরীরটা আমার। কিন্তু এই নিথর শরীরের কোনো অঙ্গের সহযোগিতায়, কোনো মানুষ যদি নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন তার এই চাওয়াকে সম্মান করা দরকার, এগিয়ে আসা দরকার, ভালোবাসা দরকার।
দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, কিডনির অভাবে। এই মৃত্যুসংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। যার মূল কারণ, কিডনির অপ্রতুলতা। এ বিষয়ে মানুষকে আরও সচেতন করা প্রয়োজন। কারণ, জীবনকে ভালোবাসার চেয়ে মহৎ কিছু নেই। এখানে কোনো ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, গোত্র নেই। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা এবং অপার ভালোবাসাই পারে, আরেকজনকে জড়িয়ে নিতে। কারণ, আমি তো আর আমার নই। মানুষের মধ্যে আমার অবস্থান, আমাকেই মহিমান্বিত করবে। মৃত্যুর পর আমার শরীরের কোনো অঙ্গ নিয়ে অচেনা, অজানা এক মানুষ ফিরে পাবে নতুন জীবন এর চেয়ে ভালোলাগার, আনন্দিত হওয়ার আর কিছু থাকতে পারে না।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কর্মী, স্বাধীনতাসংগ্রামী, কবি ও সমাজসেবক আশালতা সেন ১৮৯৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা বগলামোহন দাশগুপ্ত ছিলেন নোয়াখালী জজকোর্টের আইনজীবী। তার পৈতৃক নিবাস ছিল বিক্রমপুরের বিদগাঁও গ্রামে। মাতামহী নবশশী দেবীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আশালতা রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে স্বামী সত্যরঞ্জন সেনের অকাল মৃত্যুতে তিনি শিশুপুত্র নিয়ে অত্যন্ত বিপর্যস্ত সময় কাটান। সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হলে আবার তিনি রাজনৈতিক কর্মধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি শ্বশুরের সহায়তায় ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় নিজ বাসভবনে মহিলাদের প্রশিক্ষণের জন্য ‘শিল্পাশ্রম’ নামে একটি বয়নাগার স্থাপন করেন। ১৯২২ সালে ঢাকা জেলার মহিলা প্রতিনিধিরূপে গয়া কংগ্রেসে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ঘটে। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে আশালতা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ত্রাণ তৎপরতায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদ এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি দিল্লিতে ছেলে সমররঞ্জন সেনের কাছে চলে যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নানাভাবে সাহায্য করেন। তাঁর বাড়িটি বর্তমানে ‘গেণ্ডারিয়া মনিজা রহমান বালিকা বিদ্যালয়’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি দিল্লিতে ছেলের বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশের ৫৩তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস রবিবার।
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত গণহত্যা অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বেসামরিক লোকের ওপর গণহত্যা শুরু করে।
তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। ওই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তারের আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তা জনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধর পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি ভূখণ্ডের, যার নাম বাংলাদেশ।
দেশে ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি ইন্টারনেট সেবা চালু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। অন্য অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক একই সেবা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সব মোবাইল অপারেটরই দেশের বেশিরভাগ স্থানে ফোরজি সেবা চালু করেছে। আর সে হিসেবেই তারা ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু গ্রাহকরা ফোরজি ইন্টারনেট কিনলেও দেশের অনেক এলাকায় টুজি-থ্রিজি’র সেবা পাচ্ছেন। তারা অপারেটর কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ জানালেও এর সুরাহা হচ্ছে না।
জানা গেছে, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে মোটামুটিভাবে গ্রাহকরা ফোরজি সেবা পাচ্ছেন। তবে এসব এলাকায়ও অনেক সময় ফোরজি থাকে না, থ্রিজিতে নেমে আসে নেটওয়ার্ক। তবে জেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ সময়েই থাকে থ্রিজি। আর মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ সময় সেই থ্রিজিও থাকে না, তখন টুজি নেটওয়ার্কই ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইন্টারনেট প্যাকেজ যথাযথভাবে থাকার পর তা কাজ করে না, বাফারিং হয়। এতে গ্রাহকরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো সারা দেশের ব্যবসা একত্রে হিসাব না করে এলাকাভিত্তিক ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা দেখেন, কোন এলাকায় তাদের গ্রাহক সংখ্যা কত, সেখানে কত সিমে ইন্টারনেট চালু আছে। যদি দেখা যায়, তাদের হিসাব মতে তা সন্তোষজনক আছে তাহলে সেখানে ফোরজি সেবা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বহাল রাখে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টাওয়ার নির্মাণ করে। কিন্তু যদি দেখে সন্তোষজনক গ্রাহক নেই তাহলে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না, এতে সেই এলাকায় ফোরজি পাওয়া যায় না। অথচ শহর এলাকাগুলোতে তারা বেশি ব্যবসা করলেও সেটাকে হিসাবে ধরে না। কিন্তু মফস্বল এলাকা থেকে কল বাবদ প্রয়োজনের বেশি ব্যবসা হলেও তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সমন্বয় করে না।
মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর ফেসবুক পেইজে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অভিযোগ জানান গ্রাহকরা। অভিযোগ অনুযায়ী, অপারেটরদের মধ্যে টেলিটকের নেটওয়ার্কই বেশি দুর্বল। টেলিটকের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে মো. ফয়জুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই, নেটওয়ার্ক পাই না সকাল থেকে। মিরপুর-২ নম্বরে বাসা স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে। আর আমার গ্রামের কথা না হয় বাদ দিলাম।’ আরাফাত আলী লেখেন, ‘২জিবি নেট কিনলে দেড় জিবি নষ্ট হয়। মেয়াদ ১৫ দিন তাও ফুরাতে পারি না। তাহলে বুঝেন নেটওয়ার্ক কত ভালো।’ কার্জন চাকমা লেখেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় ফোরজি নিশ্চিত করুন। আমাদের পার্বত্য এলাকাগুলোতে টেলিটকের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি, কিন্তু শুধু থ্রিজি-টুজিতে সীমাবদ্ধ।’ রাসেল আহমেদ লেখেন, ‘গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাংগা গ্রামে থ্রিজি নেটওয়ার্ক তো নেই-ই। মাঝেমধ্যে টুজি’ও নেই। বুঝুন অবস্থাটা। আমাদের থ্রিজি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করুন।’
টেলিটকের মহাব্যবস্থাপক (সিস্টেম অপারেশন) নুরুল মাবুদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ফাইভজি রেডিনেস প্রজেক্ট শুরু করেছি। যা শেষ হতে এক বছর বা তার কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। এর ফলে আমাদের কাভারেজ এলাকাগুলোতে ফোরজি সেবা নিশ্চিত হবে। এছাড়া আমাদের কাভারেজ বাড়ানোরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে।’
বাংলালিংকের পেজের একটি পোস্টে মাহাদী হাসান তালহা লেখেন, ‘আমার এলাকায় আপনাদের সিম ব্যবহার করতে হলে ফোন গাছের ডালে বেঁধে লাউডস্পিকার দিয়ে কথা বলা লাগে। এত্তো ফাস্ট কেন আপনাদের নেটওয়ার্ক।’ আকরাম হোসাইন লেখেন, ‘ভাই আপনাদের সবই ঠিক, তবে নেটওয়ার্ক সেøা।’
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অফিসার তৈমুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফোরজি সেবার জন্য ২৩০০ মেগাহার্জের স্পেকটার্ম প্রয়োজন হয়। কিন্তু টুজিতে তা লাগে মাত্র ৯০০ মেগাহার্জ। আমরা ইতিমধ্যে ৯৫ শতাংশ কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা নিশ্চিত করেছি। তবে আমাদের আরও বেশি সাইট লাগবে। যদি সব অপারেটর মিলে আমরা টাওয়ার শেয়ার করতে পারি, তাহলে সব গ্রাহকের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে।’
রবির পেজে এক পোস্টে তানভীর আহমেদ লেখেন, ‘কলাপাড়া থানা শহরে যদি থ্রিজি নেটওয়ার্ক না পাওয়া যায়, এরচেয়ে দুঃখজনক কিছুই হতে পারে না।’ এইচএমএম ইসমাঈল লেখেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার চম্পকনগর ইউনিয়নে রবি সিমের থ্রিজি নেই। অথচ অনেক বছর আগে রবি টাওয়ার বসানো হয়েছে। আমরা রবি সিম দিয়ে ইন্টারনেট চালাতে অক্ষম।’
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলটরি অফিসার শাহেদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা রয়েছে। তবে দেখা যায়, অনেক ফোন ফোরজি সাপোর্ট করে না। আর কাভারেজ এলাকা থেকে যতদূরে যাওয়া যাবে, নেটওয়ার্ক তত কমতে থাকবে। এছাড়া আমাদের কিছু জায়গায় নেটওয়ার্কের কাজ চলছে। পাশাপাশি নতুন কিছু টাওয়ার তৈরির কাজও আমাদের চলছে।’
গ্রামীণের পেইজে একটি পোস্টে রহিদুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই আমি যখন গ্রামে যাই তখন নেটওয়ার্কের ঝামেলা হয়।’ সাইদুর রহমান লেখেন, ‘এমন সার্ভিস হলে চলবে? কলরেট, ইন্টারনেটের দাম তো ঠিকই বেশি আপনাদের, বাকি সব অপারেটরদের থেকে।’
গত বছরের ২৮ এপ্রিল টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত ‘আনলিমিটেড’ ও ‘মেয়াদবিহীন’ ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। কারণ এজন্য প্যাকেজের দাম বাড়িয়েছে অপারেটররা। আর মেয়াদহীন ইন্টারনেট পেতে প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একই প্যাকেজ চালু করতে হবে। কিন্তু গ্রাহকের সব সময় একই ধরনের ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে গ্রাহকের কেনা ইন্টারনেট। এছাড়া মেয়াদবিহীন হিসেবে মোবাইল অপারেটররা যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে গ্রাহকদের।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে সচল সিমের সংখ্যা ১৮ কোটি ২০ লাখ ৬১ হাজার। এরমধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার, রবির ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৪ হাজার, বাংলালিংকের ৪ কোটি ৮৫ হাজার এবং টেলিটকের ৬০ লাখ ৬৭ হাজার। আর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫০ লাখ। এরমধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি ও পিএসটিএন)-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ লাখ ৮৭ হাজার গ্রাহক।
রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির মধ্যেই তৈরি পোশাক খাতের আকাশে দেখা দিয়েছে শঙ্কার মেঘ। কয়েক মাস ধরেই খাতটির উদ্যোক্তারা রপ্তানি আয় কমে যাওয়া নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। তারা বলছেন, রপ্তানির প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় আগামীতে ওই সব অঞ্চলে রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। তাদের ভাষ্য, ইতিমধ্যে তার প্রভাবও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। অর্ডার কমে যাওয়ায় কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যও বলছে সে কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার হার নেমেছে প্রায় অর্ধেকে।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তবে এই খাতের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির পুরোটাই আমদানিনির্ভর; যা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাপক হারে কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) টেক্সটাইল ফেব্রিক্স আমদানির এলসি বা ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ৬২৬ কোটি ডলারের এলসি খোলেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৬৫ কোটি ডলার।
তবে প্রস্তুত কাপড়ের চেয়ে বেশি আমদানি কমেছে কাঁচামালের। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে কাঁচা তুলা বা কটন আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এ সময়ে কাঁচা তুলা আমদানিতে ১৫৩ কোটি ডলারের এলসি খোলেন ব্যবসায়ীরা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে তুলা আমদানিতে ২৭২ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। আবার তুলার চেয়ে সুতা আমদানি আরও কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সুতা আমদানিতে এলসি খোলা হয় ১০৭ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৪২ কোটি ডলার। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুতা আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৬ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের আট মাসে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৪ দশমিক ১১ শতাংশ। এই সময় টেক্সটাইল যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমেছে ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৬৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে। আর এটি কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা নতুন কলকারখানা স্থাপন অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। এতে দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে ‘ধস’ নামার একটা অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ও জাহাজভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক পতন, বিভিন্ন দেশে মন্দার শঙ্কাসহ নানা কারণে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে দেশে ডলার সংকট দেখা দিলে এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। এতে ডলারের ওপর চাপ কিছুটা কমানো গেলেও আমদানি জটিলতায় পড়েছে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাত।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ কিছুটা কমেছে। কিন্তু উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানি বাড়ায় রপ্তানি আয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রভাব পড়েনি। যেহেতু সাধারণ পোশাক রপ্তানি কমেছে সে কারণে কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিও কমেছে। পাশাপাশি ডলার সংকটও আমদানি কমে যাওয়াতে ভূমিকা রেখেছে। ফারুকের আশঙ্কা, উন্নত দেশগুলোতে ব্যাংকিং খাতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তার কারণেও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে এসব বিষয় মোকাবিলায় পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করার মতো অর্থের সংকট রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারছে না। পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার বড় অবমূল্যায়নের কারণে মালিকরা খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আনছেন না। অবশ্য আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমায় আমদানির পরিমাণে প্রভাব পড়েছে বলেও মনে করেন ফজলে শামীম এহসান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দার আশঙ্কায় কেউ নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। তবে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়াটাকে তারাও আসন্ন সংকট হিসেবে দেখছেন। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশে ডলারের সংকটের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল আমদানি করতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এটা খুব ভালো লক্ষণ নয়। তবে তিনি আশাও দেখছেন। তার ভাষ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমে যাওয়ায় মূলত আমদানি ব্যয় কম হয়েছে। আমদানির পরিমাণ খুব একটা কমেছে বলে মনে করেন না তিনি।
পুলিশ ভেরিফিকেশন না হওয়ায় চাকরি স্থায়ীকরণ হচ্ছিল না। কিন্তু তার দেরি সয়নি। নিজের তত্ত্বাবধানে থাকা সার্ভিস বইয়ের পাতায় কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে স্থায়ী করে নিলেন নিজের চাকরি। এই ব্যক্তি হলেন ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী মো. মনোয়ার হোছাইন। স্থানীয় সরকার বিভাগ তদন্তের পর থানায় মামলা হয়। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে তার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের চারটির প্রমাণ মিলে। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট আইনের দুটি ধারায় তার ১২ বছর সাজা ও অর্থদ- হয়েছে। পুলিশ মনোয়ারকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ১৯ মে ‘ক্রু’ বা মশককর্মী পদে যোগ দেন মনোয়ার হোছাইন। দপ্তরের চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, এলডিএ কাম টাইপিস্ট হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করে তিনি ওই পদও বাগিয়েছেন। ওই পদ থেকে উচ্চমান সহকারী (হেড ক্লার্ক) পদেও পদোন্নতি নিয়েছেন। এরপর দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে নেন। তথ্য গোপন করে পদোন্নতি নেওয়া এই কর্মকর্তার বাদ ছিল চাকরিতে স্থায়ী হওয়া। প্রথমবার কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি নেওয়ার পর তার উচ্চাকাক্সক্ষা বেড়ে যায়। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল স্বাক্ষর করে চাকরি স্থায়ী করেন। এর আগে দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা তালুকদারকে চাকরি স্থায়ী করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।
এ ঘটনার পর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্থানীয় সরকার বিভাগ ও দুদকের তদন্ত কমিটির কাছে লিখিতভাবে তার স্বাক্ষর জাল করার বিষয়ে অভিযোগ করেন। ২০১১ সালে মনোয়ারকে বরখাস্ত করা হয়।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা তালুকদার তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগের পক্ষে বিভিন্ন প্রমাণও জমা দেন। তিনি লিখিত বক্তব্যে জানান, অভিযুক্ত মনোয়ার হোছাইনের চাকরি স্থায়ীকরণ সংক্রান্ত চাকরি বইয়ের দ্বিতীয় খ-ের নবম পৃষ্ঠায় যে স্বাক্ষর রয়েছে তা তার নয়। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখের স্বাক্ষরটি মনোয়ারের সৃজনকৃত। চাকরিকালীন তার বিষয়ে কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন করানো হয়নি। এ জন্য তার চাকরিও স্থায়ী করা হয়নি। আর সার্ভিস বইয়ে যে সিল ব্যবহার করা হয়েছে তা তার সময়ে ব্যবহৃত সিল থেকে ভিন্ন। সিলের নিচে যে স্বাক্ষর রয়েছে তিনি বলতে পারবেন সেটা কীভাবে হলো। ইস্যু রেজিস্টার খাতায় ৪৬ নম্বর দিয়ে যে চিঠিটি তৈরি করা হয়েছে তার কোনো কপি কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। ৪৬ নম্বর ক্রমিকটি ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি লেখা রয়েছে। অন্যান্য কলাম খালি রয়েছে। পরের পাতায় ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি ২৬ নম্বর ক্রমিক দিয়ে একটি বদলির চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরও জানান, ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মনোয়ার হোছাইন। দপ্তরের বিধি-বিধান অনুযায়ী নথি, রেকর্ডপত্র, সার্ভিস বই তার কাছে রক্ষিত ছিল। এ কারণে জাল স্বাক্ষরের দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। দপ্তরে জমা দেওয়া তার এলএলবি পাসের সনদও সঠিক ছিল না। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে তার ওই সনদ সঠিক নয় বলে লিখিতভাবে দপ্তরকে জানানো হয়েছে।
মনোয়ারের বিরুদ্ধে অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ, নিয়োগ বাণিজ্য, স্বাক্ষর জাল, নিজেই নিজের চাকরি স্থায়ীকরণ এবং নথি, রেকর্ডপত্র, সার্ভিস বইয়ে ত্রুটি ঘটানোসহ পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে চারটি অভিযোগের প্রমাণ মেলে।
ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তর সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশে ২০১৩ সালের ১৮ জুন দপ্তরের পক্ষ থেকে চকবাজার থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা (নম্বর-৪) করা হয়। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানো হয়। দুদক তদন্ত করে মনোয়ারের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট আইনের একটি ধারায় তার পাঁচ বছরের কারাদ- হয়। পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের সশ্রম কারাদ- দেয় আদালত। আরেকটি ধারায় সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়ার পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের বরখাস্ত উচ্চমান সহকারী মনোয়ার হোছাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, একটি চক্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। তাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে তিনি কর্মস্থল থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল এবং আদালতের সাজার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা কত কিছু করছে। কোথায় আবার কী করেছে বুঝতে পারছি না। এ প্রসঙ্গটি বারবার উত্থাপন করলেও তিনি এড়িয়ে যান।
মানহানির মামলায় কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর লোকসভার সদস্য পদও হারিয়েছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তবে তাতে তিনি ভীত নন, বরং উৎফুল্ল। নিজের অবস্থান থেকেও পিছু হটবেন না বলে ঘোষণাও দিয়েছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যখন পার্লামেন্টে আমার পরবর্তী বক্তব্য নিয়ে ভীত, তখন আমাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হলো। আমি তার চোখে ভয় দেখেছি। এ জন্যই তারা আমাকে পার্লামেন্টে বলতে দিতে চায় না।
গতকাল শনিবার দুপুরে কংগ্রেস সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে রাহুল গৌতম আদানির সঙ্গে বিপেজির সম্পর্ক নিয়ে তার অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শুরু থেকে তিনি যে প্রশ্ন করে চলেছেন, এখনো সেটাই করবেন। শিল্পপতি গৌতম আদানির গোষ্ঠীতে যে ২০ হাজার কোটি রুপি লগ্নি হয়েছে, সেই টাকার উৎস কী? তার সঙ্গে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্কই-বা কী?
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে কর্নাটকে এক সমাবেশে রাহুল ‘সব চোরের পদবি মোদি হয় কী করে?’ মন্তব্য করেছিলেন। ওই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় গুজরাটের সাবেক মন্ত্রী পুরনেশ মোদির করা মানহানির মামলায় বৃহস্পতিবার তাকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেয় সুরাটের এক আদালত। সাজা দিলেও রাহুলকে জামিন দেন বিচারক, উচ্চ আদালতে আপিল করতে, তার সাজা ৩০ দিনের জন্য স্থগিতও রাখা হয়। ওই সাজার ওপর ভিত্তি করে পরদিনই লোকসভা সচিবালয় কেরালার ওয়েনাড আসন থেকে নির্বাচিত রাহুলকে পার্লামেন্টে অযোগ্য ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এসব নিয়ে দেশজুড়ে কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবাদ দেখাচ্ছে কংগ্রেস, তার মধ্যেই গতকাল সংবাদ সম্মেলনে আসেন বাহুল। তিনি বলেন, তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হোক, কিংবা জেলেই পাঠানো হোক, তিনি তার কাজ চালিয়ে যাবেন।
লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি ভারতে ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ চেয়েছেন, বিজেপির এমন অভিযোগও অস্বীকার করেছেন তিনি। ওই বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইবেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে রাহুল বলেন, আমার নাম সাভারকার নয়, আমি গান্ধী, ক্ষমা চাইব না।
লন্ডনে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে পার্লামেন্টে বলতে স্পিকারকে অনুরোধ করার কথাও জানান সাবেক এই কংগ্রেস সভাপতি।
বলেন, আমার পদক্ষেপ কেবল একটিই, তা হলো সত্যের জন্য লড়া এবং দেশের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে রক্ষা করা। আজীবনের জন্য আমাকে অযোগ্য ঘোষণা করুক, আজীবনের জন্য জেলে পাঠাক, আমি লড়ে যাব।
রাহুল বলেন, আমি ভারতের জনগণের গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বরের সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য এখানে এসেছি। এটাই করে যাব। আমি কারও ভয়ে ভীত নই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের অপরাধীরা আগে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করত। এরপর জানা গেল, সেখান থেকে দেশে অপরাধ ঘটায় তারা। কারও কারও নেপালে অবস্থানের কথাও জানা যায়। ভারতকে নিরাপদ মনে না করায় আরব আমিরাতের দুবাই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। সেখানে তারা আস্তানা গেড়েছে।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা অপরাধ করেই দুবাই চলে যাচ্ছে। সেখানে বসেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে। এখন বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাও দুবাইকে কেন্দ্র করে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। তাদের কেউ কেউ সোনার কারবারও করছেন। ওই দেশে ভারতের দুর্ধর্ষ অপরাধী দাউদ ইব্রাহিমের শিষ্যত্ব নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ওইসব অপরাধীর তথ্য জানার পরও তাদের ফেরত আনতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিসের’ দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ধরতে রেড নোটিস জারি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে পার পেয়ে গেছে। যদিও মামলাটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে নতুন করে আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্ত করার কথা ভাবছে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ সড়কে গুলি চালিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত হন এক কলেজছাত্রী। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মূল হোতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার রাতেই দেশ ছেড়ে চলে যায় দুবাইয়ে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে মুসা চলে যায় ওমানে। জিসান ও জয় এখনো দুবাইতেই বসবাস করছে। যদিও ওমান থেকে মুসাকে ওই বছরের ৯ জুন ইন্টারপোলের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের আলোচনায় আসে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও হিরো আলমের দুবাই সফরকে কেন্দ্র করে। তারা বনানীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের আসামি আরাভ খান নামধারী রবিউল ইসলামের সোনার দোকান উদ্বোধন করতে সেখানে যান। দুবাই যাওয়ার কারণে সাকিব ও হিরো আলমকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হতে পারে। এ ছাড়া ‘প্লেজার ট্যুরের’ জন্য এখন দেশের শিল্পপতিদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে দুবাই। কারণ ঢাকাকে তারা নিরাপদ মনে করছেন না। পাশাপাশি দেশে আটক সোনার চালানের ৮০ শতাংশ জব্দ হচ্ছে দুবাইফেরত বিভিন্ন এয়ারলাইনস থেকে। সব মিলিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দুবাই।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীরা যে দেশেই থাকুক না কেন, তাদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে আটক করার পর দুবাই থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে চেয়েছিল পুলিশ। সম্প্রতি আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভকে দুবাই থেকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ে সুখবর দেওয়া সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে জানান, সম্প্রতি আলোচনায় আসা আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ভারতের পাসপোর্টধারী। দেশে তার নামে ১২টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ওইসব পরোয়ানার কপি ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে পাঠানোর পর দ্রুতই তাকে ফেরানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এর আগে জিসান ও জয়কে দুবাই থেকে ফেরত আনার উদ্যেগ নিয়েও আনতে পারেনি। টের পেয়ে তারা দুবাই ছেড়ে কানাডায় চলে যায়। তারা আবার দুবাই এসেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এই দেশে অপরাধ করে দুবাই গিয়ে আস্তানা গাড়েন। ইতিমধ্যে পুলিশ একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকায় গুলশান ও বনানী এলাকার মডেলের সংখ্যা বেশি। বছরখানেক আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকেন। তাদের সঙ্গে অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সখ্য আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এমনকি বনানীতে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যাকান্ডে তাদেরও সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার পর পিয়াসা, রাজ ও আরাভকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় তদন্ত করা হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগীতশিল্পী, এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও কয়েকজন মডেল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। আবার কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তাড়া খেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছে কেউ কেউ। আত্মগোপনে থেকেই তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দুবাই রয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আলাদাভাবে বৈঠক হয়েছে। ওইসব বৈঠকে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাই চলে যায়। সেখান থেকেও ঢাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তার সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল, কামরুল হাসান হান্নান, ইব্রাহীম, রবিন ও শাহাদৎ হোসেন বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, শাহাদৎ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নুর হোসেনসহ অনেকেই কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নুর হোসেন ছাড়া অন্য সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। সুব্রত, মোল্লা মাসুদ ও শাহাদৎ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে মুম্বাই হয়ে দুবাই চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার অপরাধজগতের এক সন্ত্রাসী এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধীরা এখন আর ভারত যেতে চায় না। কারণ ওই দেশে শান্তিতে থাকা যায় না। ফলে সবাই এখন দুবাইমুখী হচ্ছে। দুবাইয়ে সবাই নিরাপদে থাকতে পারছে।