
লালন বিশ্বাস করতেন, সব মানুষের মধ্যে বাস করে এক ‘মনের মানুষ’। তিনি সবকিছুর ঊর্ধেŸ স্থান দিয়েছিলেন মানবতাকে। মানুষের কোনো জাত, ধর্ম, বর্ণ, কুল নেই। মানুষের দেখা শরীর এবং অদেখা মনের মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন।
মানব শরীরের গভীরতর রহস্য, মানুষেরই অজানা। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পঞ্চেন্দ্রিয় এবং ‘আট কুঠুরি নয় দরজা’কে কেন্দ্র করেই মানুষের জীবন আবর্তিত হচ্ছে। সেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নেই। সব পূর্ণাঙ্গ মানুষের মধ্যেই রয়েছে আট কুঠুরি এবং নয় দরজা। আট কুঠুরি হচ্ছে শরীরের আটটি ক্যাভিটি বা ভ্যাসেল। মাথার খুলি, ডান-বাম ২ ফুসফুস, হৃৎপিন্ড, পাকস্থলী, দুই কিডনি আর কোলন।
নয় দরজা হচ্ছে মানব দেহের ৯টি এনট্রান্স বা এক্সিট দুই চোখ, দুই নাকের ফুটো, মুখ, দুই কানের ফুটো, জননাঙ্গ এবং পায়ু। মানব দেহের, রক্তচিহ্ন- লাল। এটি দেহের কোষে, পুষ্টি এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে। একইসঙ্গে বিপাকীয় বর্জ্য পদার্থগুলো কোষ থেকে দূরীভূত করে। সমস্ত মানবদেহেই, এই প্রক্রিয়ার খেলা। চলছে নিরন্তর। যে কারণে, মানুষ অঙ্গদান এবং রক্তদানে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
শনিবার দেশ রূপান্তরে ‘এবার মরণোত্তর কর্নিয়া দান শিক্ষক জামাল উদ্দিনের’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, মরণোত্তর চক্ষুদান করেছেন রাজধানী মিরপুরের রোটারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জামাল উদ্দিন। ইতিমধ্যে জামাল উদ্দিনের দান করা কর্নিয়া, দুজন দৃষ্টিহীন মানুষের চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এর আগে, মরণোত্তর কিডনি ও কর্নিয়া দান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী সারা ইসলাম। তার দান করা কিডনি ও কর্নিয়ার মাধ্যমে ৪ জন মানুষ নতুনভাবে জেগে উঠেছেন। দুজন পেয়েছেন জীবন আর দুজন পেয়েছেন দৃষ্টিশক্তি।
গত জানুয়ারিতেই স্থপতি মোবাশ্বের আলী, মরণোত্তর দেহদান করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমি বিভাগে তার দেহ সংরক্ষিত রয়েছে। তার মরদেহ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হবে। সাংবাদিক ও কণ্ঠশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী মরণোত্তর দেহ দান করে গেছেন। এরও আগে, দেহ দান করেছেন দেশের অসংখ্য মানবতাবাদী মানুষ।
শরীর আমার, জীবন সবার। এই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হলে মানুষের হৃদয়ে ভিন্ন এক অনুভূতি তৈরি হয়। আমার রক্ত, মৃত্যুর পর আমার ভালোবাসার শরীরের, কোনো অঙ্গের মাধ্যমে যদি কোনো মানুষ তার জীবন ফিরে পায় তার চেয়ে মহৎ কাজ আর কী হতে পারে! দেশের মানুষের মধ্যে অশিক্ষা, অসচেতনতা এবং বিভিন্ন কুসংস্কারে বিশ্বাস থাকার কারণে, একসময় ‘রক্ত’ নিয়েও সমস্যা হতো। কিন্তু এখন, বাস্তবতা বদলে গেছে। এমন চিন্তায় তারা বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন যে, মানুষের জীবন রক্ষা, কোনোভাবেই অন্যায় কাজ নয়। কোনো মানুষের দৃষ্টি সমস্যা হলে, মানুষের চোখের মাধ্যমেই তার সমাধান করতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য কিডনি, লিভার বা অন্যান্য ক্ষেত্রে। সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসতে হবে মানুষকেই। মনে রাখতে হবে, শরীরের মালিক আমি হলেও জীবনের মালিক সবাই। শরীরটা আমার। কিন্তু এই নিথর শরীরের কোনো অঙ্গের সহযোগিতায়, কোনো মানুষ যদি নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন তার এই চাওয়াকে সম্মান করা দরকার, এগিয়ে আসা দরকার, ভালোবাসা দরকার।
দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, কিডনির অভাবে। এই মৃত্যুসংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। যার মূল কারণ, কিডনির অপ্রতুলতা। এ বিষয়ে মানুষকে আরও সচেতন করা প্রয়োজন। কারণ, জীবনকে ভালোবাসার চেয়ে মহৎ কিছু নেই। এখানে কোনো ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, গোত্র নেই। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা এবং অপার ভালোবাসাই পারে, আরেকজনকে জড়িয়ে নিতে। কারণ, আমি তো আর আমার নই। মানুষের মধ্যে আমার অবস্থান, আমাকেই মহিমান্বিত করবে। মৃত্যুর পর আমার শরীরের কোনো অঙ্গ নিয়ে অচেনা, অজানা এক মানুষ ফিরে পাবে নতুন জীবন এর চেয়ে ভালোলাগার, আনন্দিত হওয়ার আর কিছু থাকতে পারে না।
গত বছরের নভেম্বরে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সফটওয়্যার চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার (চ্যাটজিপিটি)। এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে নতুন এই চ্যাটবট। বলা হচ্ছে এআই প্রযুক্তিতে বিপ্লব এনে দেবে এটি। এআই কি তাহলে মানুষের ভূমিকাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে? খোদ চ্যাটজিপিটিকেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখতে বলা হয়েছে। দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এই কথোপকথন ও বাংলায় তার ভাষান্তর করেছেন নাদিয়া সারওয়াত।
দেশ রূপান্তর : আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-এআইয়ের সুবিধা বা অসুবিধার দিকগুলো কী কী?
চ্যাটজিপিটি : প্রধান সুবিধা হলো দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, যেসব কাজ পুনরাবৃত্তিমূলক এবং সময়সাপেক্ষ, এআই সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে পারবে। ফলে মানুষ আরও জটিল এবং সৃষ্টিশীল কাজে মনোযোগ দিতে পারবে। এআই যথাযথভাবে নির্ভুল কাজ করতে পারে, অনেক তথ্য খুব কম সময়ে বিশ্লেষণ করতে পারে, তাতে মনুষ্যসৃষ্ট ভুলের মাত্রা কমে আসবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়বে। যেহেতু এটি বিশাল তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করে, তার একটা অন্তর্দৃষ্টিও রয়েছে, ফলে অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত দেওয়া সহজ হয়ে যাবে। এআই বিরতিহীন কাজ করতে পারে, ফলে সব সময়েই এটি সেবা দিতে পারবে।
অন্যদিকে এর অন্যতম অসুবিধা হলো, কর্মসংস্থান কমবে। আগে মানুষ করত এরকম অনেক কাজ এখন এআইয়ের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা যাবে। যার কারণে কর্মসংস্থান হারাবে, বেকারত্ব বাড়বে। বৈচিত্র্য এবং প্রতিনিধিত্বশীল তথ্য এবং প্রশিক্ষণ না দেওয়া হলে, এআই সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য এবং পক্ষপাত আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। হ্যাকিং এবং সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টিও বাড়বে। মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য এআইয়ের কাছে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তাছাড়া, এআইয়ের কাজের ধরন এবং পদ্ধতি বেশ জটিল, এটি সব মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। ফলে এতে ভুল বা পক্ষপাত একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
দেশ রূপান্তর : এআই কি মানুষের ভূমিকা দখল করে নেবে?
চ্যাটজিপিটি : সম্ভাবনা খুবই কম। এআই হয়তো অনেক কাজই আরও বেশি দক্ষ ও নির্ভুলভাবে করতে পারবে, কিন্তু এরপরেও তাদের মানুষের মতো সৃজনশীলতা, সহানুভূতি এবং ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের ক্ষমতা নেই। বরং তারা মানুষের কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতা বাড়াতেই কাজে লাগবে। তবে এটা ঠিক এআইকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানের নতুন ধরনের দক্ষতা তৈরি করতে হবে, নতুন কর্মপদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে।
দেশ রূপান্তর : এআই-এর কারণে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে? এই পরিবর্তনের জন্য সমাজের কেমন প্রস্তুতি প্রয়োজন?
চ্যাটজিপিটি: বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআইয়ের অন্তর্ভুক্তি সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে। যেমন চাকরির বাজারে বদল আসবে। এআই যেহেতু অনেক ধরনের কাজ করে দিতে পারবে, ফলে কিছু কিছু চাকরির বাজার বাড়বে, আবার কিছু কিছু কমে যাবে, এখন যেমন রয়েছে সে রকম আর থাকবে না। এআইয়ের কারণে ক্ষমতা কাঠামোও বদলে যাবে, নতুন ধরনের বৈষম্যেরও জন্ম হতে পারে।
এই সব পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিষয়ে সমাজকে অবগত থাকতে হবে, গঠনমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে মানুষ প্রস্তুত হতে পারে, এআই ব্যবহার করে কাজ করতে পারে।
সমাজ এবং ব্যক্তির অধিকার তথা সার্বিক মঙ্গলের জন্য এআই যেন দায়িত্বশীল ও নৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তা নিশ্চিত করতে সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
এআইয়ের সুফল যাতে সব মানুষ সমানভাবে পায়, তা নিশ্চিত করতে সামাজিক এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করতে হবে। এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে আরও বেশি প্রতিনিধিত্বশীল কণ্ঠস্বর যুক্ত করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : চাকরির বাজারে পরিবর্তন আসার কথা বলা হচ্ছে, এক্ষেত্রে কোন ধরনের চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে?
চ্যাটজিপিটি : বিশেষ করে যেসব কাজ পুনরাবৃত্তিমূলক, রুটিন বাঁধা, সেগুলো খুব সহজেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা যাবে। যেমন ডাটা এন্ট্রি, প্রশাসনিক কিছু কাজ, কাস্টমার সার্ভিস, ম্যানুফ্যাকচারিং বা অ্যাসেম্বলিং, টেলিমার্কেটিং, সেলস, ট্রান্সপোর্টেশন আর ডেলিভারির কাজ, ফিনান্সিয়াল আর অ্যাকাউন্টিং-এর কিছু কাজ, ডাটা অ্যানালাইসিস, রিসার্চ আর রিপোর্টিং-এর কাজও এআই করতে পারবে।
সেই সঙ্গে নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্রও কিন্তু তৈরি হবে মানুষের জন্য। বিশেষত সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডাটা সায়েন্স, ডিজাইন ইত্যাদি। আবার অনেক কাজের ধরন পালটে নতুন রূপ নেবে। এআইয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য নতুন নতুন দক্ষতার প্রয়োজন হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : সৃষ্টিশীলতা, শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে?
চ্যাটজিপিটি : এ নিয়ে বর্তমানে তুমুল বিতর্ক চলছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন এসব ক্ষেত্রেও এআই বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখবে।
এখনই কিন্তু এআই সরল কবিতা, গদ্য, ভিস্যুয়াল আর্ট এমনকি সংগীত তৈরি করতে পারছে। এগুলো হয়তো মানুষের সমপর্যায়ের সৃষ্টিশীলতা বা বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়, কিন্তু তা একটি নতুন ধারার আর্টিস্টিক এক্সপ্রেশন, নতুন ধরনের শিল্প তৈরির সক্ষমতা রাখে। ঐতিহ্যগতভাবে শিল্প বলতে যা বোঝানো হয়, সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
আবার অনেকেই মনে করছেন, এ আইয়ের তৈরি করা শিল্পে অনুভূতির গভীরতা নেই, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রতিফলন নেই। যে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে মানুষের তৈরি শিল্প এত শক্তিশালী হয়ে ওঠে, অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে এআইয়ের সেই প্রেক্ষাপটও নেই। আর যেখানে এআই দিয়ে সৃষ্টিশীল শিল্প তৈরি করা হবে, সেখানে তার স্বত্ব এবং মালিকানা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হবে। এই পরিস্থিতিতে মানুষের ভূমিকা কী হবে তাও স্পষ্ট নয়।
দেশ রূপান্তর : ম্যাট্রিক্স রিয়েলিটি তৈরি হবে না তো?
চ্যাটজিপিটি : না, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে যে ম্যাট্রিক্স রিয়েলিটি দেখা যায়, সে রকম কোনো পরিস্থিতি এখানে তৈরি হচ্ছে না। যদিও প্রযুক্তির উন্নতির কারণে খুবই বাস্তব ভার্চুয়াল এনভায়রনমেন্ট এবং সিমুলেশন তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী আর বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারাটা জরুরি। বর্তমান প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তিতে বলা যায়, ম্যাট্রিক্স সিনেমায় যেমনটা দেখানো হয়েছে ততটা এখনো সম্ভব নয়।
দেশ রূপান্তর : মানুষ তার অনুভূতির কাছে বাঁধা, এআই তা নয়। এটা কি ইতিবাচক, না নেতিবাচক?
চ্যাটজিপিটি : এটা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক কোনোটাই নয়, এটি মূলত মানুষ এবং এআইয়ের মধ্যে চারিত্রিক পার্থক্য। অনুভূতি মানবীয় অভিজ্ঞতার একটা অংশ, যা মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সম্পর্ক এবং সার্বিক কল্যাণের ওপর অনেক বড় ভূমিকা রাখে। এআইয়ের অনুভূতি নেই, সে আগে থেকে প্রোগ্রাম করে দেওয়া অ্যালগরিদম এবং নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। এই অনুভূতি না থাকাটা ভালো না মন্দ, তা নির্ভর করবে এআইকে কী ক্ষেত্রে, কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুভূতি না থাকাটাই ভালো হতে পারে কেননা তাতে পক্ষপাত দূর করে স্থিতিশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা ক্ষতিকরও হতে পারে, যেহেতু এটি সহমর্মিতা বা সহানুভূতিহীনতার দিকে নিয়ে যেতে পারে, এটি মানুষ এবং এআইয়ের মধ্যকার সম্পর্ক বোঝার অন্তরায় হতে পারে।
দেশ রূপান্তর : এআইয়ের বিরুদ্ধে কী ধরনের মতাদর্শগত বা ধর্মীয় প্রতিবাদ হতে পারে?
চ্যাটজিপিটি : এআই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের শুরু থেকেই বিভিন্ন ধরনের মতাদর্শিক এবং ধর্মীয় আপত্তি উঠেছে। অনেকেই মনে করে এআই-এর উদ্ভাবন এবং ব্যবহার নীতি-নৈতিকতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। যেমন এআইয়ের কারণে যদি কোনো ক্ষতি হয়, তার দায় কে নেবে? এআই যে দায়িত্বশীল বা নৈতিক আচরণ করবে তা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? ব্যক্তিগত তথ্যের ওপর এআইয়ের নিয়ন্ত্রণ বা গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়গুলোকেই বা কীভাবে সামলানো হবে? এছাড়া আছে মানুষের কর্মসংস্থান হারানোর প্রশ্ন। তাতে করে সার্বিক অর্থনীতিতেই একটা ভাঙন তৈরি হতে পারে। এ কারণেই এআইয়ের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত কম-দক্ষ জনশক্তি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
আরেকটি বিষয় হলো সিঙ্গুলারিটি বা একাধিপত্য/স্বতন্ত্রতা। অনেকেই মনে করছে, সুপার ইন্টেলিজেন্ট এআই তৈরির মাধ্যমে প্রযুক্তিগত একাধিপত্য/ স্বতন্ত্রতা তৈরি হতে পারে। যেখানে যন্ত্র মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, পুরো বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে, যা মানবসভ্যতাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
অনেক ধর্মেই বলা হয় যে, একমাত্র মানুষেরই আত্মা, বিবেক এবং সচেতনতা রয়েছে, এক ধরনের ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ রয়েছে তার ভেতরে। যন্ত্রের মাধ্যমে সেটা অনুকরণ করার চেষ্টা ঐশ্বরিক আদেশের বিরুদ্ধাচরণ।
এআইয়ের অনুভূতি নেই, এটিও একটা বড় আপত্তির জায়গা। মানুষ এবং এআইয়ের মধ্যকার যে সহানুভূতিহীন সম্পর্ক তৈরি হবে, তা সার্বিকভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিথস্ক্রিয়া তথা গোটা সমাজের ওপরেই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
দেশ রূপান্তর : এআই কি মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে, বা মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে?
চ্যাটজিপিটি : তাত্ত্বিকভাবে এটা সম্ভব, এআইকে যদি সেভাবে প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয় তাহলে এটি মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। কিন্তু এটা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ মানুষই এআই তৈরি করেছে, একে ডিজাইন এবং প্রোগ্রাম করেছে। এই মুহূর্তে এআইয়ের সেই ক্ষমতা নেই যে সে নিজে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, এআইয়ের মাধ্যমে যদি কোনো ক্ষতি হয়, তা এআই দ্বারা নয়, বরং এর ডিজাইনে অনাকাক্সিক্ষত কোনো ভুলের পরিণতি, বা ভুলভাবে ব্যবহারের কারণে হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। ফলে এআই যারা ডিজাইন করবেন, যারা ব্যবহার করবেন তাদের উচিত এর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে সচেতন থাকা, ক্ষতির আশঙ্কা কমানোর ব্যবস্থা নেওয়া।
দেশ রূপান্তর : চ্যাটজিপিটি কি সিআইএর প্রকল্প?
চ্যাটজিপিটি : না, চ্যাটজিপিটি সিআইএর কোনো প্রকল্প নয়। এটি তৈরি করেছে ওপেনএআই, যা একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সিআইএ বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এর কোনোই সংশ্লিষ্টতা নেই।
প্রশ্ন : কিন্তু সিআইএ তো চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে পারে?
উত্তর : সিআইএ কিংবা অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানই চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে পারে। যেহেতু এটা বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যায়, প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকলে যে কেউই এটা ব্যবহার করতে পারবে। এখানে খেয়াল করতে হবে, ওপেন এআইয়ের শর্ত অনুযায়ী তাদের প্রযুক্তি কোনো অবৈধ বা ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। এটা ঠিক যে সিআইএর মতো কোনো সরকারি সংস্থা যদি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাহলে তারা নৈতিক এবং আইনি প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত চ্যাটজিপিটি বা অন্য কোনো এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের ওপর, আর তাদের বিদ্যমান আইন ও নীতিমালা মেনেই সেটা করতে হবে।
টানা দ্বিতীয়বারের মতো ভারত শাসনের পর তৃতীয়বার ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। নিজেদের রাজনৈতিক স্ট্র্যাডেজি, আত্মবিশ্বাস ও দুর্বল বিরোধী দল তাদের ক্ষমতায় আসতে রসদ জোগাচ্ছে। বিজেপির ভোট ব্যাংক কট্টরপন্থি হিন্দুরা, বিশেষ করে হিন্দুদের তীর্থভূমি উত্তর প্রদেশে দলটি এখন নিরঙ্কুশ রাজত্ব করছে। উত্তর প্রদেশসহ সারা ভারতের হিন্দুরা নানা গোত্র, বর্ণ ও জাতে বিভক্ত। কভিড-১৯, বৈশ্বিক অস্থিরতায় বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি হানা দিয়েছে ভারতের অর্থনীতিতেও। এসব অনৈক্য ও অস্থিরতা থেকে সমর্থকদের দৃষ্টি সরাতে ভারতে ছোটখাটো ইস্যুতে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে প্রায়শই।
কাশ্মীরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বানানো সিনেমা ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে ভারতজুড়ে। অভিযোগ আছে সিনেমাটিতে কাশ্মীর সংঘাতকে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে একপাক্ষিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে। বিজেপি এই সিনেমা দেখতে রীতিমতো ছুটি ঘোষণা দিয়েছে। বিরোধীরা অভিযোগ করছেন, এই সিনেমা ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে মুসলিম বিদ্বেষ তৈরি করেছে।
কাশ্মীর ফাইলসের পরে এলো আমির খান অভিনীত ‘লাল সিং চাড্ডা’ সিনেমাটি। মুসলিম সারনেম ধারণকারী আমির খান এর আগে বহুবার বিজেপির আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিলেন। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ৩৭০ ধারা বাতিল ইস্যুতে ভারত-তুরস্ক সম্পর্ক যখন তলানিতে সে সময়ে লকডাউনে তুরস্কে আটকেপড়া আমির খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার্কি ফার্স্টলেডি। সে সময় ‘দেশদ্রোহী’ ট্যাগ পেতে হয় আমির খানকে। চলচিত্র দর্শকদের মতে, তার লাল সিং চাড্ডার মূল গল্প ১৯৮৪ সালের শিখ দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে। এছাড়া সিনেমায় মুম্বাইয়ে বোমা বিস্ফোরণ, বাবরি মসজিদ ধ্বংস দেখানো হয়। সিনেমাটি রিলিজের পর বয়কট ক্যাম্পেইন শুরু করেন বিজেপি সমর্থকরা। পাকিস্তানি খেলোয়াড়ের সঙ্গে আমির খানের ছবি, তার মায়ের হজপালনের ছবি নিয়ে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন বিজেপি সমর্থকরা। অবশেষে সিনেমাটি ফ্লপ হয়, যদিওবা নেটফ্লিক্সের কল্যাণে সাইবার স্পেসে বাজিমাত করে ‘লাল সিং চাড্ডা’।
আমির খানের ব্যর্থতার মধ্যেই শাহরুখ নিয়ে আসেন ‘পাঠান’ সিনেমা। শাহরুখ খানের ‘খান’ নাম পূর্বে বিদেশের এয়ারপোর্টে তার জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করলেও এবার নিজ দেশে পড়েন বয়কট ক্যাম্পেইনের মুখে। অভিযোগ আনা হয় তার সিনেমার অভিনেত্রী গেরুয়া (হিন্দুদের পবিত্র রং) রঙের স্বল্প পোশাক পরে হিন্দু ধর্মের অবমাননা করেছেন।
তবে পাঠান নিয়ে মূল আপত্তি শাহরুখ খানকে নিয়ে। বিশ্বব্যাপী শাহরুখ খানের ব্রান্ডিং বিজেপির পলিসির সঙ্গে যায় না। বিজেপির অন্যতম প্রভাবশালী নেতা যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, তারা চায় না তাজমহল দিয়ে ভারতের ব্রান্ডিং হোক, তারা চান ভারতের ব্রান্ডিং হোক রামায়ণ, গীতা দিয়ে। মুসলিম নামের দুজন অভিনেতা একটি সিনেমার গল্পে ভারতকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে আর সে সিনেমা নিয়ে ভারতের তারুণ্য উন্মাদ হবে সেটা বিজেপির পছন্দ না হওয়ারই কথা। কিন্তু আমির খানকে দমানো গেলেও শাহরুখের পাঠান সিনেমার বয়কট ধোপে টিকেনি।
সিনেমা নিয়ে ভারতের রাজনীতির এই প্লটে যুক্ত হয়েছে নতুন বিতর্ক বিবিসির ডকুমেন্টরি ‘দ্য মোদি কোয়েশ্চন’। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর গুজরাট রাজত্বকাল ও দিল্লি রাজত্বকাল নিয়ে নির্মিত দুই পর্বের এই ডকুমেন্টারি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউটিউব ও টুইটার থেকে মুছে দিয়েছে ভারত সরকার। অন্যদিকে বিরোধীরা এই ডকুমেন্টারিকে নিয়েছে বিজেপির ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ হিসেবে। তারা ভিন্ন উপায়ে ভারতের নানা জায়গায় এই ডকুমেন্টারি দেখানোর ব্যবস্থা করেছে। এই নিয়ে দেশজুড়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। বিবিসির একটি ডকুমেন্টারিই বর্তমানে ভারতের রাজনীতি মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
চলতি বছরে ভারতে হতে যাচ্ছে জি-২০ সম্মেলন। সে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মোদির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আরও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা দলটির। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যস্থতার একটি চেষ্টাও মোদিকে নিয়ে করা হচ্ছে দলটির পক্ষ থেকে, যাতে তিনি অপ্রতিরোধ্য আন্তর্জাতিক ফিগার হয়ে ওঠেন।
দীর্ঘদিন ধরে নরেন্দ্র মোদি দেশ-বিদেশে ঘুরে নিজের যে ইমেজ তৈরি করেছেন তা ডকুমেন্টারিটি প্রশ্নবিদ্ধ করে দেবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের উদ্ধৃতি দিয়ে শশী থারুর তার ‘দ্য পারাডক্সিকাল প্রাইম মিনিস্টার’ বইয়ের ৪০০ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন ক্ষমতায় আসার প্রথম চার বছরে নরেন্দ্র মোদি ৪১টি ট্রিপসে ৫২টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। এশিয়া টাইমসে উদ্ধৃতি দিয়ে শশী থারুর লিখেছেন প্রথম চার বছরের প্রতি তিনদিনের একদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অফিসের বাইরে ছিলেন সেটা বিদেশ ভ্রমণ বা রাজ্য ভ্রমণে। তার এতসব দেশ বিদেশ ভ্রমণ মূলত দীর্ঘ মেয়াদে মোদিকে ভারতের ইতিহাসে স্থায়ী করা ও মোদি মডেলকে জনপ্রিয় করার প্রয়াস থেকে।
২০১৪ এর নির্বাচনের সময় উন্নয়নের ‘গুজরাট মডেল’ ও বাবরি মসজিদ ছিল বড় ট্রাম্প কার্ড বিজেপির। ২০১৯ এর নির্বাচনে ‘নয়া ভারত’ ও কাশ্মীরের ৩৭০ বিশেষ মর্যাদা বাতিলের অঙ্গীকার করে। ২০২৩ সালে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ৯টি রাজ্যে ভোট অনুষ্ঠিত হবে আর ২০২৪ এর মে’র লোকসভা নির্বাচন ইতিমধ্যে কড়া নাড়ছে দরজায়। ২০২৩-এ অনুষ্ঠিতব্য রাজ্যগুলোতে প্রায় এক-চতুর্থাংশ লোকসভা সিট রয়েছে। এই নির্বাচনে বিজেপির ট্রাম্পকার্ড নরেন্দ্র মোদি ম্যাজিক। বছরজুড়ে ৯ রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপির ট্রাম্পকার্ড থাকবে নরেন্দ্র মোদি আর বিরোধীদের ‘দ্য মোদি কোয়েশ্চন’।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
আজ শুভ মাঘী পূর্ণিমা। আজকের মঙ্গলময় পুণ্য তিথিতে মহামানব বুদ্ধ নিজের আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করেছিলেন। বুদ্ধের প্রধান সেবক আনন্দকে বুদ্ধ বললেন, ‘আনন্দ- এ বৈশালী অত্যন্ত মনোরম স্থান।’ বুদ্ধ আবার বললেন, ‘আনন্দ তথাগত ইচ্ছা করলে কল্পকাল স্বকীয় ঋদ্ধিবলে বর্তমান দেহে অবস্থান করতে পারেন।’ হে আনন্দ, তথাগতের চারি ঋদ্ধি পাদ ভাবিত, বহুলীকৃত রথগতি সদৃশ অনর্গল অভ্যস্ত, বাস্তুভূমি সদৃশ, সুপ্রতিষ্ঠিত, পরিচিত, সম্যকভাবে আপনার করায়ত্ত। আনন্দ, সেজন্য তথাগত ইচ্ছা করলে কল্পকাল কিংবা কল্পের অবশিষ্ট সময় অবস্থান করতে পারেন। তথাগত বুদ্ধ কী বোঝাতে চাইলেন আনন্দ তা অনুধাবন করতে পারল না মারের দ্বারা প্রলুব্ধ হওয়ায়। কিন্তু মার বিরামহীনভাবে বুদ্ধকে শুধু একটি কথাই বারবার বলেছেন ‘হে সুগত, আপনি পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হোন, আপনার পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হওয়ার এখনই সঠিক সময়। ভগবান মারকে বললেন, হে পাপী মার যত দিন আমার ভিক্ষুসংঘ ত্রিপিটকের বাণীসমূহ সুন্দররূপে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, তত দিন পর্যন্ত তথাগত নির্বাণ লাভ করতে পারেন না। মার বলল, ‘ভন্তে ভগবান, আপনার ভিক্ষুসংঘ এখন ধর্ম প্রচারে সিদ্ধহস্ত ও নিপুণ। সুতরাং ভন্তে ভগবান আপনি নির্বিঘ্নে নির্বাণ লাভ করতে পারেন।’
পাপমতি মারকে ভগবান বললেন, হে পাপিষ্ঠা দুরাচার মার তাহলে শোন, অচিরেই তথাগত পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তথাগত ভগবান বুদ্ধ তখনকার সময়ে যখন আশি বছর বয়সে পদার্পণ করেন, তখন রাজগৃহের বেলুরবনে অন্তিম বর্ষা অধিষ্ঠান করেছিলেন। তিনি বর্ষাব্রতকালীন কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। একমাত্র প্রবল ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে সাধনা দ্বারা রোগমুক্ত হয়েছিলেন। যাকে ছন্দ, বীর্য, চিত্ত মীমাংসা বলা হয়। ভগবান চাপাল চৈত্যে সেই সময় আজকের মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে স্মৃতিমান ও সচেতন অবস্থায় স্বীয় আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে এই বলে ঘোষণা দিলেন, এখন থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত আমার প্রাণবায়ু চলতে থাকুক, সজীব থাকুক, সচেতন থাকুক, অতঃপর নিরুদ্ধ হয়ে যাক। বুদ্ধ এ সংকল্প গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রবলভাবে ভূকম্পন শুরু হয়। মুহুর্মুহু প্রলয়দেব গর্জন করতে থাকেন।
এই ভূকম্পনে আনন্দ বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। এর হেতু কী জানতে আনন্দ দ্রুতগতিতে বুদ্ধের কাছে ছুটে যান এবং ভূকম্পনের কারণ জানতে চান। বুদ্ধ আনন্দকে বললেন, ‘শোন আনন্দ, বোধিসত্ত্ব যখন মাতৃজঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হন, তখন তার পুণ্যতেজে ভূকম্পন হয়, যখন বোধিসত্ত্ব সম্বোধি জ্ঞান লাভ করেন তার তেজে ভূকম্পন হয়, বুদ্ধের প্রবর্তনকালে একবিংশ ভূমির প্রাণীদের সাধুবাদ ধ্বনিতে ভূকম্পন হয়, আর যখন তথাগত আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করেন, তখন পৃথিবী কারুণ্যে কম্পিত হয়। তিনি যখন নির্বাণ লাভ করেন, তখন পৃথিবী রোধন ধ্বনিতে কম্পিত হয়ে থাকে। হে আনন্দ, আমি সম্বোধি লাভের অষ্টম সপ্তাহে উরুবিল্ল গ্রামের অজপাল নিগ্রোধমূলে উপবিষ্ট ছিলাম। সে সময় পাপমতি মার এসে আমাকে বলল, ‘হে ভগবান, আপনি এখন পরিনির্বাণ লাভ করেন। আপনার এখন পরিনির্বাণ লাভের উপযুক্ত সময়।’ তখন আমি মারকে বলেছি, যত দিন আমার ভিক্ষু-ভিক্ষুনী, দায়ক-দায়িকা, উপাসক-উপাসিকারা যথার্থ ধর্মবেত্তা বিনীত বিশুদ্ধ জীবনযাপনের যোগ্যতা অর্জন না করেন, যত দিন তারা সদ্ধার্মর ব্যাখ্যা ও বিস্তার করতে না পারেন, যত দিন আমার সদ্ধর্ম প্রভাবশালী ও বর্ধনশীল না হয়ে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ ও তাদের দ্বারা অভিনন্দিত ও পরিগৃহীত না হয়, ততদিন আমি নির্বাণ লাভ করতে পারি না। হে আনন্দ, অদ্য সেই পাপমতি মার চাপাল সেজে আমার কাছে এসে আমাকে পরিনির্বাণের আবেদন জানায়। মারের প্রশ্নের উত্তরে আমি যা তাকে বলেছি তাতে সে সন্তুষ্ট হতে পারল না।
মার আমাকে বলল, ভান্তে ভগবান, আপনার জীবনের ব্রত সমাপ্ত হয়েছে। আপনার দায়ক-দায়িকারা সবাই আপনার অণীত ধর্ম উপলব্ধি করেছে। আপনার প্রচারিত ধর্ম দেব-মনুষ্য সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং আপনি এখন পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হতে পারেন। হে আনন্দ, তখন আমি মারকে বলেছি- হে পাপমতি মার তুমি শুনে খুশি হও, তথাগত আজ থেকে তিন মাস পর পরিনির্বাণ লাভ করবেন। হে আনন্দ, আজ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বৈশালীর চাপাল চৈত্যে তথাগত কর্র্তৃক আপন আয়ু সংস্কার জেনে-শুনে পরিত্যক্ত হয়েছে।
আনন্দ বুদ্ধের মুখে এ কথা শুনে শোকে কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘ভন্তে ভগবান, কল্পকাল এ দেহে অবস্থান করুন। হে সুগত, বহুজনের সুখের জন্য, দেব-মনুষ্যদের ঐহিক পারত্রিক হিত সুখ কামনায় কল্পকাল এ দেহে অবস্থান করুন। তথাগত আনন্দকে বললেন, হে আনন্দ তুমি বৃথা ক্রন্দন কোরো না, আর কোনো আবেদনও জানিও না। কারণ এতে কোনো ফল লাভ হবে না। ভুল তুমি আগেই করেছো, এটি তোমার মারাত্মক অপরাধ। কারণ আমি তোমাকে আকার-ইঙ্গিতে এ কথা বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো, আমি যা তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম তুমি তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারোনি। এর আগে আমি তোমাকে যেখানে-যেখানে বারবার ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, সে জায়গাগুলো হলো রাজগৃহের গৃধকূট পর্বত, রাজগৃহের গৌতম ন্যাগ্রোধমূলে, রাজগৃহের চৌরপ্রপাতে বেভার পর্বতে, সপ্তপর্ণী গুহায়, ঋষিগিলি পর্বতে, কালশীলায়, শীতবনে, সর্প সোন্ডিক গুহায়, তপোদারামে, বেণুবনে, কলন্দক নিবানে, জীবক আম্রবনে, মদ্রকুক্ষিতে ও মৃগদাবে। এসব স্থানের কোনোখানে একবারও তুমি আমার ইঙ্গিতের মর্ম বুঝতে পারোনি এবং এ দেহে কল্পকাল অবস্থানের নিমিত্তে প্রার্থনাও করোনি।
ভগবান শোকগ্রস্ত আনন্দকে বললেন, ‘হে আনন্দ আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি, আমাদের সব প্রিয় ও মনোহর বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখা যাবে না। হে আনন্দ, তথাগত যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তার অন্যথা কোনো অবস্থাতেই হবে না, এজন্য দুঃখ কোরো না, এতে মনের যাতনা বাড়তে থাকবে। শান্ত হও, জীবের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করো।’
ভিক্ষুদের উদ্দেশে ভগবান বললেন, হে ভিক্ষুরা আমি তোমাদের অভিজ্ঞাবলে যে ধর্মসমূহ উপদেশ দিয়েছি, সেগুলো তোমরা উত্তমরূপে আয়ত্ত করো এবং নিখুঁতভাবে আচরণ করো। সেসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করো এবং এসব বিষয় সর্বত্র প্রচার করো। হে ভিক্ষুরা, তোমরা জেনে রেখো সংস্কারসমূহ ক্ষয়শীল, অপ্রমদের সঙ্গে নির্বাণ সাধনায় ব্রতী হও। অচিরেই তথাগত পরিনির্বাণ লাভ করবেন। অর্থাৎ আজ থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমায় কুশীনগরের মল্লদের শালবনে তথাগত পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন।
আজ দিনের কার্যসূচি শুরু হয়েছে ভোররাতে বিশ্বশান্তি কামনায় বিশেষ সূত্রপাঠের মাধ্যমে প্রতিটি বিহার থেকে। আজকের মাঘী পূর্ণিমা তিথিটা এমন সময়ে পালিত হচ্ছে, যখন বাংলাদেশসহ বিশ্ব এক মহাসংকটময় কাল অতিক্রম করছে। তবে বাংলাদেশের জনগণ সুখে দিনযাপনে অন্যান্য দেশের জনগণের চেয়ে অধিকগুণ এগিয়ে আছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায় আজ সারা দিন ধর্মীয় আবেশে পুলকিত থাকবেন। ধর্মীয় কার্যাদি এবং বুদ্ধপূজা উৎসর্গের পর বিকেলে প্রতিটি বিহারে ধর্মীয় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আজকের দিনের তাৎপর্য তুলে ধরে প্রাজ্ঞ ভিক্ষুসংঘসহ দায়ক-দায়িকারা অংশগ্রহণ করবেন। সন্ধ্যা তথা রাতে সম্মিলিত ধর্মীয় প্রার্থনার পর দিনের কার্যসূচির পরিসমাপ্তি ঘটবে। আজকের শুভ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে সেই অণীতকালের কথাই স্মরণে আসছে। বুদ্ধ কালগত হওয়ার আগে বুদ্ধের সঙ্গে মারের যেই কথা হয়েছিল, সেগুলো বুদ্ধ আনন্দের কাছে ইঙ্গিতে ব্যক্ত করা সত্ত্বেও আনন্দ বুঝতে পারেনি। এ ঘটনাবলিতে আমাদের জন্য শেখার অনেক কিছু আছে। বুদ্ধ সুনির্দিষ্ট পথ কিন্তু আমাদের জন্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন। নিজের কর্মগুণেই সৎপথ পাওয়া যাবে। এতে কারও সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হবে না। নিজের জ্ঞানবলে এবং মানব কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারলে দুঃখনামক জীবনটা অপসারিত হয়ে সুখপাখী হাতের কবজায় চলে আসবে আপনা-আপনি।
এবারের মাঘী পূর্ণিমা এমন সময়ে উদযাপিত হচ্ছ যখন দেশের সাধারণ মানুষ নানা সমস্যা অতিক্রান্ত করছে।পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে থাকার অসম যুদ্ধে লিপ্ত। বুদ্ধ নির্দেশিত সব বাণী মানবের জন্য খুবই মঙ্গলদায়ক। তাই বলছিলাম, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যে যার ধর্ম পালনে নিবিষ্ট হতে পারলে দেশ অচিরেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাব এবং পাশাপাশি দেশ সমৃদ্ধি লাভ করবে। আজকের শুভ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে সবাইকে জানাই লালগোলাপ শুভেচ্ছা। জগতের সব প্রাণী সুখী হোক।
লেখক: সাংবাদিক এবং প্রাবন্ধিক
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কর্মী, স্বাধীনতাসংগ্রামী, কবি ও সমাজসেবক আশালতা সেন ১৮৯৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা বগলামোহন দাশগুপ্ত ছিলেন নোয়াখালী জজকোর্টের আইনজীবী। তার পৈতৃক নিবাস ছিল বিক্রমপুরের বিদগাঁও গ্রামে। মাতামহী নবশশী দেবীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আশালতা রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে স্বামী সত্যরঞ্জন সেনের অকাল মৃত্যুতে তিনি শিশুপুত্র নিয়ে অত্যন্ত বিপর্যস্ত সময় কাটান। সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হলে আবার তিনি রাজনৈতিক কর্মধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি শ্বশুরের সহায়তায় ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় নিজ বাসভবনে মহিলাদের প্রশিক্ষণের জন্য ‘শিল্পাশ্রম’ নামে একটি বয়নাগার স্থাপন করেন। ১৯২২ সালে ঢাকা জেলার মহিলা প্রতিনিধিরূপে গয়া কংগ্রেসে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ঘটে। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে আশালতা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ত্রাণ তৎপরতায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদ এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি দিল্লিতে ছেলে সমররঞ্জন সেনের কাছে চলে যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নানাভাবে সাহায্য করেন। তাঁর বাড়িটি বর্তমানে ‘গেণ্ডারিয়া মনিজা রহমান বালিকা বিদ্যালয়’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি দিল্লিতে ছেলের বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।