
দেশকে স্বাধীন করতে জীবন বাজি রেখে যারা যুদ্ধ করেছিলেন তাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান (মুক্তিযোদ্ধা) হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও সম্মানী না পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় প্রায়ই। তেমনই নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের চারজন মুক্তিযোদ্ধা। তারা কাগজ হাতে নিয়ে বিভিন্ন অফিস-আদালতে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে।
তাদের মধ্যে একজন মো. মহুবর রহমান। তিনি নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ২ নম্বর বালাপাড়া ইউনিয়নের ভাসানী পাড়া গ্রামের মৃত মফিজ উদ্দিন সরকারের ছেলে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুদ্ধে অংশ নিতে ৬ নম্বর সেক্টর কোম্পানির কমান্ডার আছির উদ্দিনের মাধ্যমে দেওয়ানগঞ্জ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণে যান। পরে আবদুল খালেকের মাধ্যমে ভারত ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে ফিরে এসে বুড়িমারী হেডকোয়ার্টার ধরলা নদীর বিশাল মাঠে সর্বশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে রাইফেল হাতে দেশকে হানাদারমুক্ত করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বুড়িমারীতে যুদ্ধকালীন মহুবর রহমানের তিনজন সহযোদ্ধা ছিলেন মো. আমিরুল ইসলাম, মো. আশরাফ আলী ও মো. হাফিজুর রহমান। তারা তিনজনেই এখন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা।
তবে সময় কারও অপেক্ষায় থাকে না। প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ বিজয় দিবস পালন করেন। আর বিজয় মানে উল্লাস, আনন্দের ঘনঘটা। বিজয় দিবসে হাতে ফুল নিয়ে বধ্যভূমির সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে পারছেন স্বীকৃতি না পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা মহুবর রহমান। খুব কষ্ট করে কাঁপতে কাঁপতে শহীদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানান। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদু আপনার একটা ছবি তুলতে পারি? তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন না, ছবি তুলতে হবে না। আমি থমকে গিয়ে খানিকক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলাম দাদু ছবি তুলতে নিষেধ করলেন কেন? তিনি বললেন, আজ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারাই বৈষম্যের শিকার কেন? কেন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে স্বীকৃতি পেতে অফিসে অফিসে ঘুরে বেড়াতে হবে?
স্বাধীনতার ও বিজয় দিবসের ৫১তম বছরে এসেও তিনি আক্ষেপ করে বললেন, এখনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন না। রাজনীতিটা অপরাজনীতি হয়েছে। সবকিছুই যেন আজ পণ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তীতেও তার কোনো সুরাহা হলো না। কেন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ দিতে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতে হবে? তার যে প্রমাণ রয়েছে, এতে তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এর কোনো সন্দেহ নেই।
বড় উদ্বিগ্নতার বিষয়, দীর্ঘদিন ধরে অনেক চেষ্টা-তদবির করেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তার নাম লিপিবদ্ধ হয়নি। তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় তিনি বঞ্চিত রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে পারছেন না তিনি। নিজ গ্রামের মানুষসহ উপজেলার অন্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা মহুবর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা বলে ডাকলেও কাগজে-কলমে তার স্বীকৃতি মেলেনি স্বাধীনতার ৫১ বছরেও। ৬৫ বছর বয়সী মহুবর রহমান অলস সময়ে ঝাপসা চোখে এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন করেন।
চারদিকে গোলাগুলি, মানুষ প্রাণে বাঁচার জন্য ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন ভারতে। কিন্তু দেশ থেকে পালিয়ে না গিয়ে দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তিনি হলেন মো. মজিবর রহমান। তিনি নীলফামারীর ডোমার উপজেলার বাঘডোগাড়া ইউনিয়নের মৃত সহিমুদ্দিনের ছেলে। বর্তমানে ডিমলা উপজেলার ২ নম্বর বালাপাড়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ছাতনাই বালাপড়া গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। পরিবারের সাত সন্তানসন্ততি নিয়ে অভাবে জীবনযাপন করছেন। তার সবুজ মুক্তিবার্তা নম্বর : ০৩১৫০২০১৬৬। তিনি ১৯৭১ সালে ৬ নভেম্বর ভারতের কুচবিহার জেলার হলদিবাড়ী থানার দেওয়ানগঞ্জের ইয়ুথ ক্যাম্প নামক জায়গায় প্রথম যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
সেখান থেকে ফিরে এসে বুড়িমারী হেডকোয়ার্টার ধরলা নদীর বিশাল মাঠে সর্বশেষ প্রশিক্ষণ ৬ নম্বর সেক্টর কোম্পানির কমান্ডার আছির উদ্দিনের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনিও বয়সের ভারে চোখে তেমন দেখতে পারেন না। এ বৃদ্ধ বয়সে এসেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। এখন সব যেন নিয়তির খেলা বলে হতাশ হয়ে সব আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
৬ নম্বর সেক্টর কোম্পানির কমান্ডার আছির উদ্দিনের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নেন। তার সবুজ মুক্তিবার্তা নম্বর : ০৩১৫০২০১০৯। তিনি গুলিবিদ্ধ পায়ের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে প্রতি বছর শহীদ মিনারে ফুল দিতে এসে শুধু চোখের জল ফেলে যান। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই সমাজে কি আমার কোনো মূল্য নেই! তার এই প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্র তখনই দিতে পারবে যখন রাষ্ট্র তাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেবে। দেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও এখনো মুক্তি ভাটিয়ার দেহে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট হয়ে আছে।
সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার সহযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও তিনি সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখনো স্বীকৃতি পাননি। তার সংসার জীবনের অর্থনৈতিক সংকট কাঁধে করে, গ্রামে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে তার পাঁচ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন অন্যের জমিতে দুটি কুঁড়েঘর তৈরি করে জীবনযাপন করছেন। বৃদ্ধ বয়সেও পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে মানুষের চুল কেটে যে টাকা পান তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে জীবন কাটাতে হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা যখন রাষ্ট্রের বৃদ্ধভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। তখন রাষ্ট্রের উচিত বিষয়গুলো গুরুত্বসহ আমলে নিয়ে এর সমাধানের প্রকৃত পথ খুঁজে বের করা। বালাপাড়ার প্রকৃত চার মুক্তিযোদ্ধার করুণ দুর্দশা কবে দূর হবে? এর জবাব কে দেবে?
স্বাধীনতার ৫১ বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি পাওয়া তাদের অধিকার। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে মহুবর রহমান, মজিবর রহমান, সুরুজামাল এবং মজিবর রহমানের (নাউয়া) মতো শত শত মুক্তিযোদ্ধা। তারা আজ টাকার অভাবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারছেন না তারা মুক্তিযোদ্ধা। রাজাকারদের পেশিশক্তি ও অর্থের দাপটের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারের নাম উচ্চারণ করতেও যেন তারা ভয় পান। বিভিন্ন সময় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা নানা কৌশলে, রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। কিন্তু অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হননি। অনেকে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিতে না পারা জাতির জন্য লজ্জাজনক বিষয়।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত হলেও তারা যেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পান। তাদের কান্না বাংলার মানুষ দেখতে চান না। বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তারা স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীকে বিতাড়িত করার মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিনিয়ে এনেছেন। ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা কখনো তাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেননি। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে এ দেশের স্বাধীনতা এনেছেন, পরবর্তী প্রজন্মকে স্বাধীনভাবে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছেন। সেই বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানরা আজকে অবহেলিত হবেন কেন? তাদের অনেক বয়স হয়েছে, যেকোনো দিন মারা যেতে পারেন। কিন্তু মরার আগেই অন্তত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তারা যেন নিজের নামটি দেখে যেতে পারেন। তাই নতুন বছরের প্রত্যাশা, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে আবার ৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি কার্যকর হয়েছে। জানুয়ারিতে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার কথা রাখতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালের প্রথম মাসের ১২ তারিখ অর্থাৎ ১২ জানুয়ারি সরকারের নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) জানিয়েছিল, এখন থেকে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করা হবে। ২০ দিনের মধ্যেই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে সেই কথার বাস্তবায়ন করা হলো। এখন আর কেউ বলতে পারবে না যে সরকার কথা দিয়ে কথা রাখে না। সরকার নিজে কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কিনে দুটো মিলে দামের গড় করে জনগণের কাছে বিক্রি করে। বেসরকারি বিদ্যুতের দাম অনেক বেশি কাজেই সমন্বয়ের নামে বাস্তবে নিয়মিত বিদ্যুতের দাম বাড়াতেই হবে। আর ব্যবসাবান্ধব সরকার হতে গেলে ব্যবসায়ীদের সুযোগ না দিলে তো চলে না।
এক মাসেই দুইবার বিদ্যুতের এবং একবার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত এমন একটি সময়ে নেওয়া হয়েছে, যখন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবন দুর্বিষহ। আর সমন্বয়ের কথা! নিশ্চয়ই মনে আছে গত বছরের আগস্টে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম এক লাফে লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছিল সরকার। বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়া আর ব্যাপক সমালোচনার মুখে লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়েছিল। তেলের দাম বাড়ানোর পর পর যেভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়েছিল দাম কমানোর পর দ্রব্যমূল্যের ওপর তেমন কোনো প্রভাব কি পড়েছিল? সহজ উত্তর, না পড়েনি। (ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা বাড়ানোর পর কমল ৫ টাকা, প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট ২০২২) কাজেই অতীত ইতিহাস বলে, বিদ্যুতের দাম যদি কোনো মাসে কমানোও হয়, সেটার কোনো প্রভাব দ্রব্যমূল্যের ওপর না পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের অর্থ হবে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম যে বেড়ে যাবে তা আর কমবে না।
কী এক ভয়াবহ অবস্থার সামনে পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। দেশের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতেই হবে আর ভুলনীতির কারণে বিদ্যুতের যত উৎপাদন বাড়বে ততই লোকসান বাড়বে। ২০১২-১৩ সালে যখন বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট, তখন পিডিবির লোকসান ছিল ৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এরপর ২০১৭-১৮ সালে উৎপাদনক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াল ১৫ হাজার ৪১০ মেগাওয়াট আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। এভাবেই চলতে থাকে। সর্বশেষ ২০২১-২২ সালে ২১ হাজার ৬৮০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার বিপরীতে লোকসান হয় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। (সক্ষমতার সঙ্গে লোকসানও বেড়েছে, প্রথম আলো, ২৯ জুলাই ২০২২)। লোকসানের কারণ দূর না করে ভর্তুকি বা ঋণের পরিমাণ হ্রাস করার জন্যই এভাবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণের পকেট থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। আগেও এটা হয়েছে, এখন আইএমএফের শর্ত মানার নামে আর পিডিবি তথা সরকারের লোকসানের বোঝা কমানোর জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। অনিয়মের কারণে লোকসান, লোকসানের কারণে ভর্তুকি আর ভর্তুকি কমাতে মূল্যবৃদ্ধি, কী দারুণ চক্রে পড়েছে জনগণ। ফলে জনগণের পকেট থেকে আগের চেয়ে আরও বেশি পরিমাণ অর্থ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে গিয়ে ঢুকবে। উৎপাদন মূল্য বেশি রেখে পিডিবি কর্র্তৃক বেসরকারি মালিকদের কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার প্রক্রিয়া মসৃণ রাখার জন্য এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের যে নামমাত্র গণশুনানি হতো সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হলো। জবাবদিহি করার কোনো দরকার নেই, নিয়মিত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করল সরকার।
বিদ্যুতের মতো অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ঘাটতি থাকলেই দাম বাড়ানো উচিত কি না, দাম বাড়িয়ে জনগণের কাছ থেকে যে পরিমাণ টাকা পাওয়া যাবে তাতে সমস্যার সমাধান হবে কি না, তা বিবেচনা করতে হলে কয়েকটা বিষয় সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার এবং সরকারের কাছ থেকে যথাযথ তথ্য পাওয়া দরকার।
প্রথমত, ঘাটতি যেন না হয় তার উদ্যোগ নিতে হবে। দেখতে হবে উৎপাদন মূল্য যেন না বাড়ে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের খরচ, জ্বালানির খরচ, নানা ধরনের প্রশাসনিক ব্যয় খুব সতর্কতার সঙ্গে নির্ধারণ করতে হবে, নজরদারি রাখতে হবে। উৎপাদন খরচ বাড়ানোর সব পথ খুলে রেখে দফায় দফায় বিক্রয়মূল্য বাড়ালে ঘাটতি কমে না। কারণ ঘাটতি বাড়লে যাদের লাভ হয় তারা নানা অজুহাতে দিনে দিনে ঘাটতি বাড়াতেই থাকবে। ফলে ঘাটতি ও দাম বাড়ানো চলতেই থাকবে। যা ১৪ বছর মেয়াদের এই সরকারের আমলে ১২ বার দাম বাড়ানোর পরও হাজার হাজার কোটি টাকা ঘাটতির হিসাব দেখানোর ঘটনা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়।
দ্বিতীয়ত, উৎপাদনের সমস্ত বিষয় সততা ও সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করার পরও যদি নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য কোনো কারণে ঘাটতি হয়ে যায়, তাহলে তো ভর্তুকি প্রদান করতেই হবে। কিন্তু বিবেচনা করতে হবে বিদ্যুৎ অন্য পণ্যের মতো নয়। বিদ্যুতের দাম বাড়লে গোটা অর্থনীতিতে এর বহুগুণ প্রভাব পড়ে। কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে উৎপাদিত সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়, জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে। ফলে গুরুত্বের বিবেচনায় জনগণের দেওয়া কর-ভ্যাটের অর্থের একটা অংশ জনগণের স্বার্থে বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হবে। এ-কথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মোড়লরাও স্বীকার করে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে।
যদি ভর্তুকি পাবলিক বা রাষ্ট্রীয় খাতে ব্যবহার করা হয় তাহলে জনগণের টাকা জনগণের কাজেই লাগে। কিন্তু যদি দুর্নীতির ইঁদুরে গোলার ধান খেয়ে ফেলে তাহলে ইঁদুর না মেরে গোলা ভর্তি করার অর্থ ইঁদুরকে পুষ্ট করা ও বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করা। একদিকে বিদ্যুৎ খাত বেসরকারীকরণ করা তারপর সেখান থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার সহজ মানে হলো জনগণের অর্থ বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের কাছে তুলে দেওয়া এবং তাদের নিরবচ্ছিন্ন মুনাফা নিশ্চিত করা। বাড়তি অর্থ ভর্তুকি থেকে কিংবা দাম বাড়িয়ে যেভাবেই সংগ্রহ করা হোক না কেন তা তো জনগণেরই অর্থ। কাজেই বিদ্যুৎ খাতে জনগণের অর্থ জনগণেরই কাজে লাগানোর প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো দুর্নীতি বন্ধ করে উৎপাদন খরচ কমানো। রাজনৈতিকভাবেও এই দাবি তুলতে হবে যে বিদ্যুতে বেসরকারি খাত নয়, দুর্নীতিমুক্ত এবং জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় খাত শক্তিশালী করতে হবে।
একটি চৌবাচ্চার এক নল দিয়ে পানি বেরিয়ে যাওয়া আর সেই চৌবাচ্চা পূর্ণ করার অঙ্ক নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। জনগণ যেন ছোটবেলার শিক্ষা ভুলে না যায় সে চেষ্টা করছে সরকার। সেই অঙ্কে বলা ছিল না যে চৌবাচ্চার নলটা কেন খোলা ছিল বা কে খুলে রেখেছিল। আর এই প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না, কেন পানি বেরিয়ে যাওয়াটা বন্ধ করা হচ্ছে না? ক্লান্তিহীনভাবে পানি ভরতেই থাক আর বিরামহীনভাবে পানি বেরিয়ে যেতেই থাকুক। দেশটার অবস্থা যেন তেমনই হয়েছে। দুর্নীতি, লুটপাট, অপচয়, ভুলনীতির কারণে লোকসান হতেই থাকবে, লোকসানের কারণে ভর্তুকি দিতে হবে এবং জনগণের টাকায় ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব নয় বলে জনদরদি সরকার জনগণের ওপর বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বোঝা বাড়াতেই থাকবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চৌবাচ্চার ফুটো হলো বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০২০-২১ সালে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ছিল ৬ টাকা ৬১ পয়সা, যা ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১-২২ সালে দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৮৪ পয়সা। এর মধ্যে পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন খরচ ৫ টাকা ২ পয়সা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন খরচ ৪ টাকা ৪৭ পয়সা হলেও বেসরকারি খাতের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় উৎপাদন খরচ ৯ টাকা ৮০ পয়সা ও আইপিপিগুলোর গড় উৎপাদন খরচ ১১ টাকা ৫৫ পয়সা। এক বছর আগে বেসরকারি খাতের রেন্টাল ও আইপিপি বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ছিল যথাক্রমে ৭ টাকা ৪৭ পয়সা ও ৮ টাকা শূন্য ২ পয়সা। (পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২১-২২, পৃষ্ঠা ৯৬) আর এখানেই শেষ নয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার কারণে বেসরকারি খাতের কোনো কোনো আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে ৫৫ টাকা এবং ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট ২৭ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে। (পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২১-২২, পৃষ্ঠা ১১৪-১১৭) ফলে এটা সাধারণ মানুষের কাছেও স্পষ্ট যে বেসরকারি খাতের আইপিপি ও রেন্টাল মডেলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে অস্বাভাবিক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়েই পিডিবির লোকসান ঘটছে এবং বাড়ছে। এর দায়িত্ব কি জনগণকেই নিতে হবে?
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের শুধু তথ্য জানার অধিকার থাকলে চলে না। তথ্য যাচাই করার, সত্যাসত্য নির্ধারণ করার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। সরকার জানিয়ে দিল, দাম বাড়ানো হবে (দুঃখিত, বলা হয়েছে সমন্বয় করা হবে)। এটা কি তথ্য জানা নয়? কিন্তু এটুকু জানাকেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বলে না। তাহলে স্বৈরশাসকরাও বলবে আমরাও তো জানিয়েছি আমাদের সব পরিকল্পনা আর স্বপ্নের কথা। সে কারণেই শুধু জানা নয়, যা জানলাম তা যাচাই করা, গ্রহণ বর্জন করার পরিবেশ না থাকলে তাকে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বলে না। ফলে দাম বাড়ানোর কারণ জানা শুধু নয়, কাদের দুর্নীতি, অবহেলা, অপচয়ের কারণে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ে তাদের জ্বালানি অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। তা না হলে চৌবাচ্চার ছিদ্র ক্রমাগত বড় হতেই থাকবে।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
rratan. [email protected] com
গবেষকরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা এখন বিষাক্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনের বায়ুর মান যাচাইকারী সংস্থার তথ্য বলছে, ঢাকা এ মুহূর্তে বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে একটি এবং প্রায়ই সবচেয়ে বেশি দূষিতপূর্ণ শহরের তকমা লেগে যায়। দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকার এই বিবর্ণ অবস্থা, অবস্থার উন্নতি তো নয়ই, এখানকার বাতাস কতটুকু দূষিত হতে পারে, তার নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। শুধু ঢাকাই নয় এর আশপাশের জেলাগুলোর অবস্থা আরও করুণ। কয়েক বছর ধরে শীতকালের এ সময়টায় এটাই যেন বাস্তব পরিস্থিতি। বায়ুদূষণের কারণে শহরের অনেক মানুষ এখন ফুসফুসের সমস্যাসহ নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভুগছেন। বিশেষ করে যাদের নানা প্রয়োজনে দিনের বেশির ভাগ সময় ঘরের বাইরে থাকতে হয় তাদের অবস্থা যে কতটা শোচনীয় তা সহজেই অনুমেয়। অন্যদিকে যারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন স্বাভাবিকভাবেই তারা কিছুটা হলেও এই দূষণ থেকে মুক্তি পেতে পারেন কিন্তু যারা শ্রমজীবী মানুষ, যাদের রিকশা, গণপরিবহন বা হেঁটে পথ চলতে হয় তাদের এ থেকে নিস্তার নেই। আর শিশুদের ভোগান্তি তো অবর্ণনীয়, ধুলা ও দূষিত বায়ুর রাজ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা। ইউনিসেফ বলছে, বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। অন্যদিকে বায়ুদূষণ শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর কর্মক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা দুটোকেই কমিয়ে দিচ্ছে। এখানেই শেষ না, বায়ুদূষণের ফলে আর্থসামাজিক ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কতটা তা নিয়ে এখন গবেষণার প্রয়োজন আছে, যাতে ক্ষয়ক্ষতি যথাযথভাবে অনুধাবন করা যায় এবং ইস্যুটির গুরুত্ব প্রয়োজনীয় মাত্রায় বোঝা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিসমূহ যদিও মারাত্মকভাবে ফুটে ওঠে কিন্তু আর্থসামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে স্থানিক অভিজ্ঞতাসমূহ বিবেচনা করা দরকার।
ওয়াটারকিপার্সের সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাস বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩১৭ দিনই দূষিত থাকে এবং বছরের এ সময়টায় তা প্রায়ই অস্বাস্থ্যকর থেকে বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে যায়। আবার দূষণের মাত্রা সব এলাকায় সমান না, কোনো কোনো এলাকার বাতাস অন্য এলাকা থেকে বেশি দূষিত।
বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? ইদানীং বাতাসে ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো কোনো রাস্তায় পানি ছিটানো হয়। এ ধরনের উদ্যোগ সাময়িক কিছুটা স্বস্তি দেয় কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আবার সাবেক হুকুম বহাল, আবার বাতাসে ধুলাবালির ছড়াছড়ি। এভাবে পানি ছিটানো যে কোনো সমাধান না তা এরই মধ্যে ধারাবাহিক দূষণে ঢাকার শীর্ষস্থান দখলের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। আসলে পরিবেশে ধুলাবালি ও দূষণের উপকরণ থাকলে তা বাতাসে যুক্ত হবে ও পরিবেশ দূষণের কারণ হবে সেটাই স্বাভাবিক, এই সহজ বিষয়টাই আমাদের বুঝতে হবে। এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, সরকারি ও বেসরকারি যেকোনো পর্যায়ে, শহরের পরিকাঠামো নির্মাণে পরিবেশে সুরক্ষায় ন্যূনতম মান বজায় রাখা হয় না। সেটা হোক বিভিন্ন সেবা সংস্থার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বা ভবন নির্মাণ সব ক্ষেত্রেই। রাস্তাঘাটে উন্মুক্ত অবস্থায় বালি ও মাটি দিনের পর দিন ফেলে রাখা আমাদের চোখে অপরাধ না। আবার ঢাকা শহরে প্রত্যেকটি এলাকাতেই পুরাতন ভবন ভাঙা হচ্ছে, আবার নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে পুরনো ভবন ভাঙার ধুলাবালি বাতাসে মিশে যাচ্ছে, আবার ভবন নির্মাণের সময় উন্মুক্ত অবস্থায় নির্মাণসামগ্রীর পরিবহন ও রাস্তাঘাটে নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ করে রাখার কারণে ধুলাবালি আশপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে আছে রাস্তাঘাটে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপের জন অভ্যাস, যেটাকে বদঅভ্যাসও বলা যায়। আর এর সঙ্গে যদি যোগ হয় যানবাহনের কালো ধোঁয়া, অনিয়ন্ত্রিত চলাচল, তাহলে দূষণের ষোলোকলা পূর্ণ। আর সে বিষয়গুলোই আমরা দেখতে পাচ্ছি আজকের ঢাকার এই মারাত্মক বায়ুদূষণ পরিস্থিতেতে।
আগেই বলা হয়েছে এই মারাত্মক বায়ুদূষণের ভুক্তভোগী করা। এর উল্টোপিছে সুফলভোগী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান যারা নির্মাণকাজের খরচ বাঁচাতে পরিবেশসম্মত গাইডলাইন অনুসরণ করছেন না, যে ভবনমালিক খরচ বাঁচাতে যাচ্ছেনÑতাই ধরনের নির্মাণযজ্ঞ পরিচালনা করছেন, ত্রুটিপূর্ণ গণপরিবহনের মালিক এবং যা এদের মাধ্যমে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, বায়ুদূষণ প্রতিরোধে এদের জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসা কতটুকু সম্ভব এবং সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের সেই সদিচ্ছা ও সক্ষমতা আছে কি না? আর ঢাকার সাধারণ জনগণ এসব ব্যাপারে কতটুকু সচেতন তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। যত দিন না পর্যন্ত সেই সচেতনতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি তৈরি করা যাবে, তত দিন পর্যন্ত এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আমাদের সংস্কৃতিতে পরিবেশের সুরক্ষা প্রায় সব ক্ষেত্রেই সব থেকে কম গুরুত্ব পায়। দূষণের বিনিময়ে আমরা শুধু আর্থিক লাভটাই বড় করে দেখি কিন্তু যেকোনো দূষণের যে সামষ্টিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্য আছে যেটা বিবেচনায় আসে না। আবার বেশির ভাগ সময় পরিবেশ ও প্রকৃতির ধ্বংসকে নানা ধরনের ঠুনকো অজুহাতে এড়িয়ে যাওয়া হয়। কারণ দূষণের মাধ্যমে যারা লাভবান হন তারা অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাবান এবং সেই ক্ষমতার আশ্রয় নিয়েই পরিবেশের মতো সামষ্টিক সম্পদকে তারা লুট করে থাকেন এবং নিজেদের লাভের অঙ্ক আরও বাড়াতে থাকেন। তাই সব দেখেও এড়িয়ে যাওয়া যেন পরিবেশ দূষণে কারও কোনো দায় নেই।
তবে পরিস্থিতির উন্নয়নে দূষণকারীদের দায়মুক্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখি সব নেতিবাচক ক্ষেত্রে আমরা চ্যাম্পিয়ন, হয় আগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি বা এখন চ্যাম্পিয়ন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সব নেতিবাচক ইন্ডিকেটরে আমাদের চ্যাম্পিয়ন হতে হবে কেন? কেনই বা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরই অবস্থা থেকে উন্নতি করার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হবে। তার পরও কী আমরা সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারছি, নাকি একের পর এক রেকর্ড ভেঙেই যাব। আর তা যদি না করতে চাই তাহলে কোন কর্র্তৃপক্ষ এই ইস্যুটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবে। দায়িত্ব কার; পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত নাকি অন্য কেউ? যারা এই জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং যতটুকু দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা কি জনগণকে পরিস্থিতি উন্নতির জন্য আশ্বস্ত করতে পারে। জনগণকে কি জানাতে পারে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তারা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। নাকি এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার কেউ নেই এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত পরিস্থিতি প্রাকৃতিক নিয়মে কিছুটা উন্নতি হয়। হঠাৎ দু-একজনকে জরিমানা ও রাস্তায় পানি ছিটিয়ে হয়তো সাময়িক স্বস্তি আনা যায়। দূষণ নিয়ে কর্র্তৃপক্ষ ভাবছে সে সম্পর্কে জনমনে ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করা যায়। কিন্তু সমস্যার মূল কারণগুলো বিবেচনায় না নিয়ে এ ধরনের লোক দেখানো উদ্যোগ কার্যকর না। দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকেই হয়তো বলবেন, প্রয়োজনীয় জনবলের ঘাটতি কিন্তু জবাবদিহি ও সদিচ্ছা থাকলে যে সব সীমাবদ্ধতা দূর করা যায় তার দৃষ্টান্ত বোধকরি আমাদের সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থায় কম নেই।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
শুধু ঢাকা শহর না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, জনবহুল শহর ঢেকে যাচ্ছে দূষণে। বিভিন্ন রকম দূষণের মধ্যে, ‘বায়ুদূষণ’ নিয়ে, পৃথিবীব্যাপী মানুষের উদ্বেগ বেড়েছে। যদিও অন্যান্য দূষণে, মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন নানান রোগে। সেই মানুষ জানতেও পারেন না, তার রোগের মূল কারণ কী?
দূষণের রকমফের আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না বিভিন্ন দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণই প্রত্যক্ষভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে। কিন্তু শব্দদূষণেও মানুষ বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর বাইরে রয়েছে তড়িৎ চুম্বকীয় দূষণ, আলোদূষণ, প্লাস্টিক দূষণ, মৃত্তিকা দূষণ, ভিজ্যুয়াল দূষণ এবং জলদূষণ। সব দূষণের সঙ্গে এক রকম যুদ্ধ করে, টিকে রয়েছেন মানুষ। যদিও বায়ুদূষণই এ মুহূর্তে মাথাব্যথার কারণ।
অস্বাস্থ্যকর বায়ুতে ঢাকা শহর ছেয়ে গেছে। স্থান পেয়েছে বিশ্বের ১ নম্বরে। ৬ ফেব্রুয়ারি, দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, সুইজারল্যান্ডের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষক সংস্থা একিউএয়ারের তথ্য বলছেÑজানুয়ারি মাসে এক দিনের জন্যও অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে নামেনি ঢাকার বায়ু। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিষাক্ত প্লাস্টিকের কণা। গতকাল (৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে, ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬৩। এর মানে হচ্ছে, ঢাকা শহরের বাতাসের মান খুবই অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রয়েছে। ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে একিউআই স্কোর খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়ে থাকে।
দেশ রূপান্তরের ভিন্ন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑবায়ুদূষণ রোধে চার বছর আগে হাইকোর্টের দেওয়া ৯ নির্দেশনা কতটুকু বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তা দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে দিতে বলেছে আদালত।
গত এক বছরে ঢাকায় গড়ে বায়ুদূষণ বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের রোগ। মানুষ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছেন।
মেগাসিটি ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে বায়ুদূষণে। শহরের বাতাসের গুণমান শীতকালে অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে চলে যায়, বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হচ্ছে ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া এবং নির্মাণ সাইটের ধুলা। এই তিনটির কোনোটিই সরকারি নিয়ম মেনে চলে না। এই যে আইন না মানা তাতে কোনো সমস্যাও নেই। সবকিছুই ম্যানেজ করা যায়! দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সব দেখে-শুনে চুপ থাকে। কারণ কী? সবাই জানেন। বিশ^খ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মৃত্যুর আগে বারবার এই দূষণ বিষয়ে সতর্ক করে গেছেন। বলেছেন, মানবতার সবচেয়ে বড় ধরনের হুমকি দূষণ। যদিও বিশ^ সেদিকে তেমন একটা নজর দেয়নি।
প্রকৃতভাবে, ‘দূষণ’ পরিবেশগত সমস্যা নয়। এটা আসলে মূলত মানসিক সমস্যা, যা শতভাগ নির্ভর করে শিক্ষার ওপর। যে কারণে দেখা যায়, তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত-সভ্য দুনিয়ায় দূষণের মাত্রা কম। তারা জানে কী করলে একজন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। সেই ধরনের কাজ থেকে তারা নিজেকে বিরত রাখেন।
মানুষ প্রথমে শিক্ষা নেন পরিবার থেকে। এরপর শিক্ষাঙ্গন থেকে। তারপর বেড়ে ওঠেন সামাজিক-রাজনৈতিক শিক্ষায়। এই চার ধরনের শিক্ষার সমন্বয়ে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গড়ে ওঠে অন্তর্গত শিক্ষা। এই অন্তর্গত শিক্ষাই একজন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। তখন মানুষ নিজেকে ইচ্ছেমতো পরিচালনা করতে পারেন। ভালো-মন্দ বুঝতে পারেন। এমনটি না হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্মোহভাবে আইনের প্রয়োগ ঘটালে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে বিভিন্নভাবে সচেতন করাও কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।
মানুষের ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো কাজ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে চাইলে প্রকৃত শিক্ষার বিকল্প নেই। এর জন্য দরকার নিজেকে আলোকিত করা, যে আলো একমাত্র দিতে পারে শিক্ষাই। ঢাকা শহরসহ বাংলাদেশকে বাঁচাতে চাইলে মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় উন্নত করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
অনিল মুখার্জি বাংলাদেশের প্রখ্যাত বামপন্থি রাজনীতিক ও লেখক। তিনি ১৯১২ সালের ১০ অক্টোবর বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৯ সালে মুন্সীগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ব্রিটিশ আইন অমান্য আন্দোলনের অভিযোগে ১৯৩০ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে রাখা হয়েছিল মেদিনীপুর হিজলী বন্দিশিবিরে। সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে ব্রিটিশ সরকার সেখান থেকে তাকে আন্দামান দ্বীপের কারাগারে পাঠায়। সেখানকার বন্দিদের সঙ্গে তিনিও মরণপণ আন্দোলন করেন। ১৯৩৮ সালে ছাড়া পেয়েই তিনি কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে সক্রিয় হন। ১৯৪৬ সালে নারায়ণগঞ্জের সুতাকল শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন অনিল মুখার্জি। ভারত ভাগের পর আবারও গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৫৫ সালে মুক্তি পান। তখন থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৫৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় সম্মেলনে (গোপনে অনুষ্ঠিত) কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে পার্টির প্রথম কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ ও ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি। তার রচিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সাম্যবাদের ভূমিকা’, ‘শ্রমিক আন্দোলনের হাতেখড়ি’, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রামের পটভূমি’ ও ছোটদের জন্য লেখা ‘হারানো খোকা’। ১৯৮২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বেলজিয়ামের নতুন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে সম্মানতি বোধ করছেন ম্যানচেস্টার সিটি তারকা কেভিন ডি ব্রুইনা।
গত বছর বিশ্বকাপের পর রিয়াল মাদ্রিদ তারকা এডেন হ্যাজার্ড জাতীয় দলকে বিদায় জানান। বেলজিয়াম কোচ ডোমেনিকো টেডেসকো প্লেমেকার ডি ব্রুইনাকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন। বিশ্বকাপের পর বেলজিয়ামের কোচের পদে রবার্তো মার্টিনেজের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন টেডেসকো।
গত জানুয়ারিতে ৩২ বছরে পা রেখেছেন ব্রুইনা। আরটিএল-টিভিআই টেলিভিশনে বেলজিয়ামের নেতৃত্ব পাওয়া নিয়ে ডি ব্রুইনা বলেছেন, ‘এভাবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা সত্যিই সম্মানের। আমার বয়স প্রায় ৩২ হয়ে গেছে। আমি কখনই আন্তর্জাতিক অবসরের চিন্তা করিনি। আমি বিশ্বাস করি এখনো দলকে কিছু দেবার সক্ষমতা আমার আছে। এই সুযোগে তরুণদেরও সহযোগিতা করতে চাই।’
সুইডেনের বিরুদ্ধে শুক্রবার ইউরো বাছাইপর্বে অধিনায়ক হিসেবে ডি ব্রুইনার অভিষেক হতে যাচ্ছে। মাদ্রিদ গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া ও চেলসি রোমেলু লুকাকু ডি ব্রুইনার সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করবেন।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
কোনো জেলায় কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন রয়েছে কি না তা জানতে তালিকা তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রত্যেক ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা আমার সরকারের লক্ষ্য হওয়ায় আমি প্রত্যেককে বাড়ি দেব। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই প্রতিটি মানুষ বাড়ি, আশ্রয় এবং জীবিকার সুযোগ পাবে। তারা আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে না। আমরা চাই প্রত্যেকে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এবং যথাযথ সম্মানের সঙ্গে বসবাস করবে।’
গতকাল প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের চতুর্থ ধাপে বাড়ি হস্তান্তরের সময় এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি সাতটি জেলা ও ১৫৯টি উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। জেলাগুলো হলো মাদারীপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, জয়পুরহাট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা।
এর আগে তিনি পঞ্চগড় ও মাগুরার সব উপজেলাসহ ৫২টি উপজেলাকে গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। তিনি গতকাল ৯টি জেলা এবং ২১১টি উপজেলা গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। খবর বাসসের।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভূমিহীনদের ঘর দেওয়ার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো দুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। জাতির পিতা দেশকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত করে বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে একটি উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন দিতে চেয়েছিলেন। যার জন্য তার সরকার অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না বলে তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে গৃহহীনদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করেন। বঙ্গবন্ধুর পদচিহ্ন অনুসরণ করে তিনি বলেন, তার সরকার ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের বাড়িঘর ও জমির মালিকানা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া। অনুষ্ঠানে বাড়িপ্রাপ্তদের পরিবর্তিত জীবনযাত্রার ওপর একটি ভিডিও-প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
সরকার প্রধান বলেন, ‘কেউ ঠিকানা ছাড়া থাকবে না। আমরা তাদের শুধু ঘরই দিইনি, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। তাদের জীবিকার জন্য ঋণও দিয়েছি। তারা এখন দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।’ তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা ঘোষণা করেছিলেন, একজন ব্যক্তি ১০০ বিঘা জমির অধিকারী হতে পারবে এবং এর অতিরিক্ত পরিমাণ জমি কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র গড়তে রোডম্যাপ জরুরি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভৌগোলিক-কৌশলগত সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। গতকাল ঢাকায় প্রথম অ্যাভিয়েশন সামিটের উদ্বোধন অধিবেশনে দেওয়া এক ভিডিও ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সহযোগিতায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশন সামিট-২০২৩’-এর আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী এই শীর্ষ সম্মেলনকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। কারণ, দেশটির এই অঞ্চলে একটি বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার আকাক্সক্ষা রয়েছে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে শেখ হাসিনা যাত্রী ও মালামাল উভয়ের জন্যই একটি উন্নত ও টেকসই বাজার সৃষ্টির পাশাপাশি সহায়ক পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারি সংস্থা, এয়ারলাইনস ও সংশ্লিষ্ট অন্য সব পক্ষকে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সরকার ই-ভিসা সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে ও পর্যটনে আসা যাত্রীদের সুবিধা দেবে ও ভিসা প্রক্রিয়া দ্রুত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের যুবকদের অবশ্যই পাইলট, বিমান প্রকৌশলী, মেকানিক, ক্রু ও আরও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, তার সরকারের প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি দেশের বিমানশিল্পে লোকবলের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই বিমানশিল্প এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে নেতৃত্ব দিতে হবে।
সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী ও ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী বক্তব্য দেন।
রাজধানীর মালিবাগ রেলগেটে ট্রেনের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষের ঘটনায় ২ ঘণ্টা পর চালু হয়েছে রেল যোগাযোগ।
ইঞ্জিন পরীক্ষার পর পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাত ১১টার দিকে ছেড়ে যায়। এতে সড়কের ২ পাশের যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে।
বুধবার রাত ৯টার পর মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি সোহাগ পরিবহনের একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এ ঘটনায় তিন জন আহত হন। দুর্ঘটনার সময় বাসটিতে কোনো যাত্রী ছিল না। ট্রেনের গতিও কম ছিল।
মাদারীপুরের শিবচরে সড়ক দুর্ঘটনার কামরুজ্জামান ফকির (৩৫) নামে এক পল্লি চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। এ সময় জাহিদ (২৮) নামে আরেকজন আহত হন। আজ বৃহস্পতিবার ভোর ৬টার দিকে উপজেলার শেখপুর বাজারসংলগ্ন মির্জারচর এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত কামরুজ্জামান মাদারীপুর সদর উপজেলার আদিত্যপুর গ্রামের আবদুর রব ফকিরের ছেলে।
হাসপাতালে, ফায়ার সার্ভিস ও নিহতের আত্মীয় সূত্রে জানা যায়, ভোরে কামরুজ্জামান তার আপন ভায়রা জাহিদকে নিয়ে তাবলিগ জামাতে অংশ নিতে গাজীপুরের টঙ্গী যাওয়ার উদ্দেশে শিবচরের পাঁচ্চর বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হন। পাঁচ্চর থেকে বাসযোগে টঙ্গী যাওয়ার কথা ছিল তার। এ সময় তার মোটরসাইকেলটি শিবচর-মাদারীপুর আঞ্চলিক সড়কে শিবচরের শেখপুর মির্জারচর নামক স্থানে আসলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মোটরসাইকেল থাকা দুজন গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয়রা কামরুজ্জামানকে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। আহত জাহিদকে উদ্ধার করে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়।
শিবচর ফায়ার সার্ভিসের লিডার তরুনুর রশিদ খান বলেন, ভোরে আমরা খবর পেয় ঘটনাস্থলে যাই। সেখান থেকে আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরে ডাক্তার তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন।
শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, সকালে রোগীকে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসে। পরে আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পাই হাসপাতালে আসার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।