
গবেষকরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা এখন বিষাক্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনের বায়ুর মান যাচাইকারী সংস্থার তথ্য বলছে, ঢাকা এ মুহূর্তে বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে একটি এবং প্রায়ই সবচেয়ে বেশি দূষিতপূর্ণ শহরের তকমা লেগে যায়। দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকার এই বিবর্ণ অবস্থা, অবস্থার উন্নতি তো নয়ই, এখানকার বাতাস কতটুকু দূষিত হতে পারে, তার নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। শুধু ঢাকাই নয় এর আশপাশের জেলাগুলোর অবস্থা আরও করুণ। কয়েক বছর ধরে শীতকালের এ সময়টায় এটাই যেন বাস্তব পরিস্থিতি। বায়ুদূষণের কারণে শহরের অনেক মানুষ এখন ফুসফুসের সমস্যাসহ নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভুগছেন। বিশেষ করে যাদের নানা প্রয়োজনে দিনের বেশির ভাগ সময় ঘরের বাইরে থাকতে হয় তাদের অবস্থা যে কতটা শোচনীয় তা সহজেই অনুমেয়। অন্যদিকে যারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন স্বাভাবিকভাবেই তারা কিছুটা হলেও এই দূষণ থেকে মুক্তি পেতে পারেন কিন্তু যারা শ্রমজীবী মানুষ, যাদের রিকশা, গণপরিবহন বা হেঁটে পথ চলতে হয় তাদের এ থেকে নিস্তার নেই। আর শিশুদের ভোগান্তি তো অবর্ণনীয়, ধুলা ও দূষিত বায়ুর রাজ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা। ইউনিসেফ বলছে, বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। অন্যদিকে বায়ুদূষণ শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর কর্মক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা দুটোকেই কমিয়ে দিচ্ছে। এখানেই শেষ না, বায়ুদূষণের ফলে আর্থসামাজিক ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কতটা তা নিয়ে এখন গবেষণার প্রয়োজন আছে, যাতে ক্ষয়ক্ষতি যথাযথভাবে অনুধাবন করা যায় এবং ইস্যুটির গুরুত্ব প্রয়োজনীয় মাত্রায় বোঝা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিসমূহ যদিও মারাত্মকভাবে ফুটে ওঠে কিন্তু আর্থসামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে স্থানিক অভিজ্ঞতাসমূহ বিবেচনা করা দরকার।
ওয়াটারকিপার্সের সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাস বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩১৭ দিনই দূষিত থাকে এবং বছরের এ সময়টায় তা প্রায়ই অস্বাস্থ্যকর থেকে বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে যায়। আবার দূষণের মাত্রা সব এলাকায় সমান না, কোনো কোনো এলাকার বাতাস অন্য এলাকা থেকে বেশি দূষিত।
বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? ইদানীং বাতাসে ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো কোনো রাস্তায় পানি ছিটানো হয়। এ ধরনের উদ্যোগ সাময়িক কিছুটা স্বস্তি দেয় কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আবার সাবেক হুকুম বহাল, আবার বাতাসে ধুলাবালির ছড়াছড়ি। এভাবে পানি ছিটানো যে কোনো সমাধান না তা এরই মধ্যে ধারাবাহিক দূষণে ঢাকার শীর্ষস্থান দখলের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। আসলে পরিবেশে ধুলাবালি ও দূষণের উপকরণ থাকলে তা বাতাসে যুক্ত হবে ও পরিবেশ দূষণের কারণ হবে সেটাই স্বাভাবিক, এই সহজ বিষয়টাই আমাদের বুঝতে হবে। এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, সরকারি ও বেসরকারি যেকোনো পর্যায়ে, শহরের পরিকাঠামো নির্মাণে পরিবেশে সুরক্ষায় ন্যূনতম মান বজায় রাখা হয় না। সেটা হোক বিভিন্ন সেবা সংস্থার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বা ভবন নির্মাণ সব ক্ষেত্রেই। রাস্তাঘাটে উন্মুক্ত অবস্থায় বালি ও মাটি দিনের পর দিন ফেলে রাখা আমাদের চোখে অপরাধ না। আবার ঢাকা শহরে প্রত্যেকটি এলাকাতেই পুরাতন ভবন ভাঙা হচ্ছে, আবার নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে পুরনো ভবন ভাঙার ধুলাবালি বাতাসে মিশে যাচ্ছে, আবার ভবন নির্মাণের সময় উন্মুক্ত অবস্থায় নির্মাণসামগ্রীর পরিবহন ও রাস্তাঘাটে নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ করে রাখার কারণে ধুলাবালি আশপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে আছে রাস্তাঘাটে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপের জন অভ্যাস, যেটাকে বদঅভ্যাসও বলা যায়। আর এর সঙ্গে যদি যোগ হয় যানবাহনের কালো ধোঁয়া, অনিয়ন্ত্রিত চলাচল, তাহলে দূষণের ষোলোকলা পূর্ণ। আর সে বিষয়গুলোই আমরা দেখতে পাচ্ছি আজকের ঢাকার এই মারাত্মক বায়ুদূষণ পরিস্থিতেতে।
আগেই বলা হয়েছে এই মারাত্মক বায়ুদূষণের ভুক্তভোগী করা। এর উল্টোপিছে সুফলভোগী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান যারা নির্মাণকাজের খরচ বাঁচাতে পরিবেশসম্মত গাইডলাইন অনুসরণ করছেন না, যে ভবনমালিক খরচ বাঁচাতে যাচ্ছেনÑতাই ধরনের নির্মাণযজ্ঞ পরিচালনা করছেন, ত্রুটিপূর্ণ গণপরিবহনের মালিক এবং যা এদের মাধ্যমে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, বায়ুদূষণ প্রতিরোধে এদের জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসা কতটুকু সম্ভব এবং সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের সেই সদিচ্ছা ও সক্ষমতা আছে কি না? আর ঢাকার সাধারণ জনগণ এসব ব্যাপারে কতটুকু সচেতন তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। যত দিন না পর্যন্ত সেই সচেতনতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি তৈরি করা যাবে, তত দিন পর্যন্ত এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আমাদের সংস্কৃতিতে পরিবেশের সুরক্ষা প্রায় সব ক্ষেত্রেই সব থেকে কম গুরুত্ব পায়। দূষণের বিনিময়ে আমরা শুধু আর্থিক লাভটাই বড় করে দেখি কিন্তু যেকোনো দূষণের যে সামষ্টিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্য আছে যেটা বিবেচনায় আসে না। আবার বেশির ভাগ সময় পরিবেশ ও প্রকৃতির ধ্বংসকে নানা ধরনের ঠুনকো অজুহাতে এড়িয়ে যাওয়া হয়। কারণ দূষণের মাধ্যমে যারা লাভবান হন তারা অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাবান এবং সেই ক্ষমতার আশ্রয় নিয়েই পরিবেশের মতো সামষ্টিক সম্পদকে তারা লুট করে থাকেন এবং নিজেদের লাভের অঙ্ক আরও বাড়াতে থাকেন। তাই সব দেখেও এড়িয়ে যাওয়া যেন পরিবেশ দূষণে কারও কোনো দায় নেই।
তবে পরিস্থিতির উন্নয়নে দূষণকারীদের দায়মুক্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখি সব নেতিবাচক ক্ষেত্রে আমরা চ্যাম্পিয়ন, হয় আগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি বা এখন চ্যাম্পিয়ন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সব নেতিবাচক ইন্ডিকেটরে আমাদের চ্যাম্পিয়ন হতে হবে কেন? কেনই বা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরই অবস্থা থেকে উন্নতি করার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হবে। তার পরও কী আমরা সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারছি, নাকি একের পর এক রেকর্ড ভেঙেই যাব। আর তা যদি না করতে চাই তাহলে কোন কর্র্তৃপক্ষ এই ইস্যুটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবে। দায়িত্ব কার; পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত নাকি অন্য কেউ? যারা এই জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং যতটুকু দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা কি জনগণকে পরিস্থিতি উন্নতির জন্য আশ্বস্ত করতে পারে। জনগণকে কি জানাতে পারে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তারা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। নাকি এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার কেউ নেই এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত পরিস্থিতি প্রাকৃতিক নিয়মে কিছুটা উন্নতি হয়। হঠাৎ দু-একজনকে জরিমানা ও রাস্তায় পানি ছিটিয়ে হয়তো সাময়িক স্বস্তি আনা যায়। দূষণ নিয়ে কর্র্তৃপক্ষ ভাবছে সে সম্পর্কে জনমনে ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করা যায়। কিন্তু সমস্যার মূল কারণগুলো বিবেচনায় না নিয়ে এ ধরনের লোক দেখানো উদ্যোগ কার্যকর না। দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকেই হয়তো বলবেন, প্রয়োজনীয় জনবলের ঘাটতি কিন্তু জবাবদিহি ও সদিচ্ছা থাকলে যে সব সীমাবদ্ধতা দূর করা যায় তার দৃষ্টান্ত বোধকরি আমাদের সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থায় কম নেই।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে আবার ৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি কার্যকর হয়েছে। জানুয়ারিতে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার কথা রাখতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালের প্রথম মাসের ১২ তারিখ অর্থাৎ ১২ জানুয়ারি সরকারের নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) জানিয়েছিল, এখন থেকে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করা হবে। ২০ দিনের মধ্যেই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে সেই কথার বাস্তবায়ন করা হলো। এখন আর কেউ বলতে পারবে না যে সরকার কথা দিয়ে কথা রাখে না। সরকার নিজে কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কিনে দুটো মিলে দামের গড় করে জনগণের কাছে বিক্রি করে। বেসরকারি বিদ্যুতের দাম অনেক বেশি কাজেই সমন্বয়ের নামে বাস্তবে নিয়মিত বিদ্যুতের দাম বাড়াতেই হবে। আর ব্যবসাবান্ধব সরকার হতে গেলে ব্যবসায়ীদের সুযোগ না দিলে তো চলে না।
এক মাসেই দুইবার বিদ্যুতের এবং একবার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত এমন একটি সময়ে নেওয়া হয়েছে, যখন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবন দুর্বিষহ। আর সমন্বয়ের কথা! নিশ্চয়ই মনে আছে গত বছরের আগস্টে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম এক লাফে লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছিল সরকার। বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়া আর ব্যাপক সমালোচনার মুখে লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়েছিল। তেলের দাম বাড়ানোর পর পর যেভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়েছিল দাম কমানোর পর দ্রব্যমূল্যের ওপর তেমন কোনো প্রভাব কি পড়েছিল? সহজ উত্তর, না পড়েনি। (ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা বাড়ানোর পর কমল ৫ টাকা, প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট ২০২২) কাজেই অতীত ইতিহাস বলে, বিদ্যুতের দাম যদি কোনো মাসে কমানোও হয়, সেটার কোনো প্রভাব দ্রব্যমূল্যের ওপর না পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের অর্থ হবে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম যে বেড়ে যাবে তা আর কমবে না।
কী এক ভয়াবহ অবস্থার সামনে পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। দেশের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতেই হবে আর ভুলনীতির কারণে বিদ্যুতের যত উৎপাদন বাড়বে ততই লোকসান বাড়বে। ২০১২-১৩ সালে যখন বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট, তখন পিডিবির লোকসান ছিল ৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এরপর ২০১৭-১৮ সালে উৎপাদনক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াল ১৫ হাজার ৪১০ মেগাওয়াট আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। এভাবেই চলতে থাকে। সর্বশেষ ২০২১-২২ সালে ২১ হাজার ৬৮০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার বিপরীতে লোকসান হয় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। (সক্ষমতার সঙ্গে লোকসানও বেড়েছে, প্রথম আলো, ২৯ জুলাই ২০২২)। লোকসানের কারণ দূর না করে ভর্তুকি বা ঋণের পরিমাণ হ্রাস করার জন্যই এভাবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণের পকেট থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। আগেও এটা হয়েছে, এখন আইএমএফের শর্ত মানার নামে আর পিডিবি তথা সরকারের লোকসানের বোঝা কমানোর জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। অনিয়মের কারণে লোকসান, লোকসানের কারণে ভর্তুকি আর ভর্তুকি কমাতে মূল্যবৃদ্ধি, কী দারুণ চক্রে পড়েছে জনগণ। ফলে জনগণের পকেট থেকে আগের চেয়ে আরও বেশি পরিমাণ অর্থ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে গিয়ে ঢুকবে। উৎপাদন মূল্য বেশি রেখে পিডিবি কর্র্তৃক বেসরকারি মালিকদের কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার প্রক্রিয়া মসৃণ রাখার জন্য এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের যে নামমাত্র গণশুনানি হতো সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হলো। জবাবদিহি করার কোনো দরকার নেই, নিয়মিত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করল সরকার।
বিদ্যুতের মতো অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ঘাটতি থাকলেই দাম বাড়ানো উচিত কি না, দাম বাড়িয়ে জনগণের কাছ থেকে যে পরিমাণ টাকা পাওয়া যাবে তাতে সমস্যার সমাধান হবে কি না, তা বিবেচনা করতে হলে কয়েকটা বিষয় সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার এবং সরকারের কাছ থেকে যথাযথ তথ্য পাওয়া দরকার।
প্রথমত, ঘাটতি যেন না হয় তার উদ্যোগ নিতে হবে। দেখতে হবে উৎপাদন মূল্য যেন না বাড়ে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের খরচ, জ্বালানির খরচ, নানা ধরনের প্রশাসনিক ব্যয় খুব সতর্কতার সঙ্গে নির্ধারণ করতে হবে, নজরদারি রাখতে হবে। উৎপাদন খরচ বাড়ানোর সব পথ খুলে রেখে দফায় দফায় বিক্রয়মূল্য বাড়ালে ঘাটতি কমে না। কারণ ঘাটতি বাড়লে যাদের লাভ হয় তারা নানা অজুহাতে দিনে দিনে ঘাটতি বাড়াতেই থাকবে। ফলে ঘাটতি ও দাম বাড়ানো চলতেই থাকবে। যা ১৪ বছর মেয়াদের এই সরকারের আমলে ১২ বার দাম বাড়ানোর পরও হাজার হাজার কোটি টাকা ঘাটতির হিসাব দেখানোর ঘটনা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়।
দ্বিতীয়ত, উৎপাদনের সমস্ত বিষয় সততা ও সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করার পরও যদি নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য কোনো কারণে ঘাটতি হয়ে যায়, তাহলে তো ভর্তুকি প্রদান করতেই হবে। কিন্তু বিবেচনা করতে হবে বিদ্যুৎ অন্য পণ্যের মতো নয়। বিদ্যুতের দাম বাড়লে গোটা অর্থনীতিতে এর বহুগুণ প্রভাব পড়ে। কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে উৎপাদিত সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়, জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে। ফলে গুরুত্বের বিবেচনায় জনগণের দেওয়া কর-ভ্যাটের অর্থের একটা অংশ জনগণের স্বার্থে বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হবে। এ-কথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মোড়লরাও স্বীকার করে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে।
যদি ভর্তুকি পাবলিক বা রাষ্ট্রীয় খাতে ব্যবহার করা হয় তাহলে জনগণের টাকা জনগণের কাজেই লাগে। কিন্তু যদি দুর্নীতির ইঁদুরে গোলার ধান খেয়ে ফেলে তাহলে ইঁদুর না মেরে গোলা ভর্তি করার অর্থ ইঁদুরকে পুষ্ট করা ও বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করা। একদিকে বিদ্যুৎ খাত বেসরকারীকরণ করা তারপর সেখান থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার সহজ মানে হলো জনগণের অর্থ বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের কাছে তুলে দেওয়া এবং তাদের নিরবচ্ছিন্ন মুনাফা নিশ্চিত করা। বাড়তি অর্থ ভর্তুকি থেকে কিংবা দাম বাড়িয়ে যেভাবেই সংগ্রহ করা হোক না কেন তা তো জনগণেরই অর্থ। কাজেই বিদ্যুৎ খাতে জনগণের অর্থ জনগণেরই কাজে লাগানোর প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো দুর্নীতি বন্ধ করে উৎপাদন খরচ কমানো। রাজনৈতিকভাবেও এই দাবি তুলতে হবে যে বিদ্যুতে বেসরকারি খাত নয়, দুর্নীতিমুক্ত এবং জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় খাত শক্তিশালী করতে হবে।
একটি চৌবাচ্চার এক নল দিয়ে পানি বেরিয়ে যাওয়া আর সেই চৌবাচ্চা পূর্ণ করার অঙ্ক নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। জনগণ যেন ছোটবেলার শিক্ষা ভুলে না যায় সে চেষ্টা করছে সরকার। সেই অঙ্কে বলা ছিল না যে চৌবাচ্চার নলটা কেন খোলা ছিল বা কে খুলে রেখেছিল। আর এই প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না, কেন পানি বেরিয়ে যাওয়াটা বন্ধ করা হচ্ছে না? ক্লান্তিহীনভাবে পানি ভরতেই থাক আর বিরামহীনভাবে পানি বেরিয়ে যেতেই থাকুক। দেশটার অবস্থা যেন তেমনই হয়েছে। দুর্নীতি, লুটপাট, অপচয়, ভুলনীতির কারণে লোকসান হতেই থাকবে, লোকসানের কারণে ভর্তুকি দিতে হবে এবং জনগণের টাকায় ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব নয় বলে জনদরদি সরকার জনগণের ওপর বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বোঝা বাড়াতেই থাকবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চৌবাচ্চার ফুটো হলো বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০২০-২১ সালে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ছিল ৬ টাকা ৬১ পয়সা, যা ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১-২২ সালে দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৮৪ পয়সা। এর মধ্যে পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন খরচ ৫ টাকা ২ পয়সা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন খরচ ৪ টাকা ৪৭ পয়সা হলেও বেসরকারি খাতের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় উৎপাদন খরচ ৯ টাকা ৮০ পয়সা ও আইপিপিগুলোর গড় উৎপাদন খরচ ১১ টাকা ৫৫ পয়সা। এক বছর আগে বেসরকারি খাতের রেন্টাল ও আইপিপি বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ছিল যথাক্রমে ৭ টাকা ৪৭ পয়সা ও ৮ টাকা শূন্য ২ পয়সা। (পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২১-২২, পৃষ্ঠা ৯৬) আর এখানেই শেষ নয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার কারণে বেসরকারি খাতের কোনো কোনো আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে ৫৫ টাকা এবং ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট ২৭ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে। (পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২১-২২, পৃষ্ঠা ১১৪-১১৭) ফলে এটা সাধারণ মানুষের কাছেও স্পষ্ট যে বেসরকারি খাতের আইপিপি ও রেন্টাল মডেলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে অস্বাভাবিক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়েই পিডিবির লোকসান ঘটছে এবং বাড়ছে। এর দায়িত্ব কি জনগণকেই নিতে হবে?
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের শুধু তথ্য জানার অধিকার থাকলে চলে না। তথ্য যাচাই করার, সত্যাসত্য নির্ধারণ করার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। সরকার জানিয়ে দিল, দাম বাড়ানো হবে (দুঃখিত, বলা হয়েছে সমন্বয় করা হবে)। এটা কি তথ্য জানা নয়? কিন্তু এটুকু জানাকেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বলে না। তাহলে স্বৈরশাসকরাও বলবে আমরাও তো জানিয়েছি আমাদের সব পরিকল্পনা আর স্বপ্নের কথা। সে কারণেই শুধু জানা নয়, যা জানলাম তা যাচাই করা, গ্রহণ বর্জন করার পরিবেশ না থাকলে তাকে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বলে না। ফলে দাম বাড়ানোর কারণ জানা শুধু নয়, কাদের দুর্নীতি, অবহেলা, অপচয়ের কারণে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ে তাদের জ্বালানি অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। তা না হলে চৌবাচ্চার ছিদ্র ক্রমাগত বড় হতেই থাকবে।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
rratan. [email protected] com
দেশকে স্বাধীন করতে জীবন বাজি রেখে যারা যুদ্ধ করেছিলেন তাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান (মুক্তিযোদ্ধা) হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও সম্মানী না পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় প্রায়ই। তেমনই নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের চারজন মুক্তিযোদ্ধা। তারা কাগজ হাতে নিয়ে বিভিন্ন অফিস-আদালতে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে।
তাদের মধ্যে একজন মো. মহুবর রহমান। তিনি নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ২ নম্বর বালাপাড়া ইউনিয়নের ভাসানী পাড়া গ্রামের মৃত মফিজ উদ্দিন সরকারের ছেলে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুদ্ধে অংশ নিতে ৬ নম্বর সেক্টর কোম্পানির কমান্ডার আছির উদ্দিনের মাধ্যমে দেওয়ানগঞ্জ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণে যান। পরে আবদুল খালেকের মাধ্যমে ভারত ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে ফিরে এসে বুড়িমারী হেডকোয়ার্টার ধরলা নদীর বিশাল মাঠে সর্বশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে রাইফেল হাতে দেশকে হানাদারমুক্ত করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বুড়িমারীতে যুদ্ধকালীন মহুবর রহমানের তিনজন সহযোদ্ধা ছিলেন মো. আমিরুল ইসলাম, মো. আশরাফ আলী ও মো. হাফিজুর রহমান। তারা তিনজনেই এখন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা।
তবে সময় কারও অপেক্ষায় থাকে না। প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ বিজয় দিবস পালন করেন। আর বিজয় মানে উল্লাস, আনন্দের ঘনঘটা। বিজয় দিবসে হাতে ফুল নিয়ে বধ্যভূমির সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে পারছেন স্বীকৃতি না পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা মহুবর রহমান। খুব কষ্ট করে কাঁপতে কাঁপতে শহীদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানান। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদু আপনার একটা ছবি তুলতে পারি? তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন না, ছবি তুলতে হবে না। আমি থমকে গিয়ে খানিকক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলাম দাদু ছবি তুলতে নিষেধ করলেন কেন? তিনি বললেন, আজ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারাই বৈষম্যের শিকার কেন? কেন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে স্বীকৃতি পেতে অফিসে অফিসে ঘুরে বেড়াতে হবে?
স্বাধীনতার ও বিজয় দিবসের ৫১তম বছরে এসেও তিনি আক্ষেপ করে বললেন, এখনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন না। রাজনীতিটা অপরাজনীতি হয়েছে। সবকিছুই যেন আজ পণ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তীতেও তার কোনো সুরাহা হলো না। কেন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ দিতে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতে হবে? তার যে প্রমাণ রয়েছে, এতে তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এর কোনো সন্দেহ নেই।
বড় উদ্বিগ্নতার বিষয়, দীর্ঘদিন ধরে অনেক চেষ্টা-তদবির করেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তার নাম লিপিবদ্ধ হয়নি। তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় তিনি বঞ্চিত রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে পারছেন না তিনি। নিজ গ্রামের মানুষসহ উপজেলার অন্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা মহুবর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা বলে ডাকলেও কাগজে-কলমে তার স্বীকৃতি মেলেনি স্বাধীনতার ৫১ বছরেও। ৬৫ বছর বয়সী মহুবর রহমান অলস সময়ে ঝাপসা চোখে এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন করেন।
চারদিকে গোলাগুলি, মানুষ প্রাণে বাঁচার জন্য ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন ভারতে। কিন্তু দেশ থেকে পালিয়ে না গিয়ে দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তিনি হলেন মো. মজিবর রহমান। তিনি নীলফামারীর ডোমার উপজেলার বাঘডোগাড়া ইউনিয়নের মৃত সহিমুদ্দিনের ছেলে। বর্তমানে ডিমলা উপজেলার ২ নম্বর বালাপাড়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ছাতনাই বালাপড়া গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। পরিবারের সাত সন্তানসন্ততি নিয়ে অভাবে জীবনযাপন করছেন। তার সবুজ মুক্তিবার্তা নম্বর : ০৩১৫০২০১৬৬। তিনি ১৯৭১ সালে ৬ নভেম্বর ভারতের কুচবিহার জেলার হলদিবাড়ী থানার দেওয়ানগঞ্জের ইয়ুথ ক্যাম্প নামক জায়গায় প্রথম যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
সেখান থেকে ফিরে এসে বুড়িমারী হেডকোয়ার্টার ধরলা নদীর বিশাল মাঠে সর্বশেষ প্রশিক্ষণ ৬ নম্বর সেক্টর কোম্পানির কমান্ডার আছির উদ্দিনের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনিও বয়সের ভারে চোখে তেমন দেখতে পারেন না। এ বৃদ্ধ বয়সে এসেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। এখন সব যেন নিয়তির খেলা বলে হতাশ হয়ে সব আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
৬ নম্বর সেক্টর কোম্পানির কমান্ডার আছির উদ্দিনের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নেন। তার সবুজ মুক্তিবার্তা নম্বর : ০৩১৫০২০১০৯। তিনি গুলিবিদ্ধ পায়ের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে প্রতি বছর শহীদ মিনারে ফুল দিতে এসে শুধু চোখের জল ফেলে যান। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই সমাজে কি আমার কোনো মূল্য নেই! তার এই প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্র তখনই দিতে পারবে যখন রাষ্ট্র তাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেবে। দেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও এখনো মুক্তি ভাটিয়ার দেহে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট হয়ে আছে।
সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার সহযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও তিনি সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখনো স্বীকৃতি পাননি। তার সংসার জীবনের অর্থনৈতিক সংকট কাঁধে করে, গ্রামে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে তার পাঁচ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন অন্যের জমিতে দুটি কুঁড়েঘর তৈরি করে জীবনযাপন করছেন। বৃদ্ধ বয়সেও পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে মানুষের চুল কেটে যে টাকা পান তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে জীবন কাটাতে হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা যখন রাষ্ট্রের বৃদ্ধভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। তখন রাষ্ট্রের উচিত বিষয়গুলো গুরুত্বসহ আমলে নিয়ে এর সমাধানের প্রকৃত পথ খুঁজে বের করা। বালাপাড়ার প্রকৃত চার মুক্তিযোদ্ধার করুণ দুর্দশা কবে দূর হবে? এর জবাব কে দেবে?
স্বাধীনতার ৫১ বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি পাওয়া তাদের অধিকার। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে মহুবর রহমান, মজিবর রহমান, সুরুজামাল এবং মজিবর রহমানের (নাউয়া) মতো শত শত মুক্তিযোদ্ধা। তারা আজ টাকার অভাবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারছেন না তারা মুক্তিযোদ্ধা। রাজাকারদের পেশিশক্তি ও অর্থের দাপটের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারের নাম উচ্চারণ করতেও যেন তারা ভয় পান। বিভিন্ন সময় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা নানা কৌশলে, রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। কিন্তু অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হননি। অনেকে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিতে না পারা জাতির জন্য লজ্জাজনক বিষয়।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত হলেও তারা যেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পান। তাদের কান্না বাংলার মানুষ দেখতে চান না। বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তারা স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীকে বিতাড়িত করার মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিনিয়ে এনেছেন। ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা কখনো তাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেননি। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে এ দেশের স্বাধীনতা এনেছেন, পরবর্তী প্রজন্মকে স্বাধীনভাবে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছেন। সেই বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানরা আজকে অবহেলিত হবেন কেন? তাদের অনেক বয়স হয়েছে, যেকোনো দিন মারা যেতে পারেন। কিন্তু মরার আগেই অন্তত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তারা যেন নিজের নামটি দেখে যেতে পারেন। তাই নতুন বছরের প্রত্যাশা, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক
শুধু ঢাকা শহর না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, জনবহুল শহর ঢেকে যাচ্ছে দূষণে। বিভিন্ন রকম দূষণের মধ্যে, ‘বায়ুদূষণ’ নিয়ে, পৃথিবীব্যাপী মানুষের উদ্বেগ বেড়েছে। যদিও অন্যান্য দূষণে, মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন নানান রোগে। সেই মানুষ জানতেও পারেন না, তার রোগের মূল কারণ কী?
দূষণের রকমফের আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না বিভিন্ন দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণই প্রত্যক্ষভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে। কিন্তু শব্দদূষণেও মানুষ বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর বাইরে রয়েছে তড়িৎ চুম্বকীয় দূষণ, আলোদূষণ, প্লাস্টিক দূষণ, মৃত্তিকা দূষণ, ভিজ্যুয়াল দূষণ এবং জলদূষণ। সব দূষণের সঙ্গে এক রকম যুদ্ধ করে, টিকে রয়েছেন মানুষ। যদিও বায়ুদূষণই এ মুহূর্তে মাথাব্যথার কারণ।
অস্বাস্থ্যকর বায়ুতে ঢাকা শহর ছেয়ে গেছে। স্থান পেয়েছে বিশ্বের ১ নম্বরে। ৬ ফেব্রুয়ারি, দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, সুইজারল্যান্ডের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষক সংস্থা একিউএয়ারের তথ্য বলছেÑজানুয়ারি মাসে এক দিনের জন্যও অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে নামেনি ঢাকার বায়ু। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিষাক্ত প্লাস্টিকের কণা। গতকাল (৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে, ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬৩। এর মানে হচ্ছে, ঢাকা শহরের বাতাসের মান খুবই অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রয়েছে। ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে একিউআই স্কোর খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়ে থাকে।
দেশ রূপান্তরের ভিন্ন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑবায়ুদূষণ রোধে চার বছর আগে হাইকোর্টের দেওয়া ৯ নির্দেশনা কতটুকু বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তা দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে দিতে বলেছে আদালত।
গত এক বছরে ঢাকায় গড়ে বায়ুদূষণ বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের রোগ। মানুষ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছেন।
মেগাসিটি ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে বায়ুদূষণে। শহরের বাতাসের গুণমান শীতকালে অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে চলে যায়, বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হচ্ছে ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া এবং নির্মাণ সাইটের ধুলা। এই তিনটির কোনোটিই সরকারি নিয়ম মেনে চলে না। এই যে আইন না মানা তাতে কোনো সমস্যাও নেই। সবকিছুই ম্যানেজ করা যায়! দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সব দেখে-শুনে চুপ থাকে। কারণ কী? সবাই জানেন। বিশ^খ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মৃত্যুর আগে বারবার এই দূষণ বিষয়ে সতর্ক করে গেছেন। বলেছেন, মানবতার সবচেয়ে বড় ধরনের হুমকি দূষণ। যদিও বিশ^ সেদিকে তেমন একটা নজর দেয়নি।
প্রকৃতভাবে, ‘দূষণ’ পরিবেশগত সমস্যা নয়। এটা আসলে মূলত মানসিক সমস্যা, যা শতভাগ নির্ভর করে শিক্ষার ওপর। যে কারণে দেখা যায়, তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত-সভ্য দুনিয়ায় দূষণের মাত্রা কম। তারা জানে কী করলে একজন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। সেই ধরনের কাজ থেকে তারা নিজেকে বিরত রাখেন।
মানুষ প্রথমে শিক্ষা নেন পরিবার থেকে। এরপর শিক্ষাঙ্গন থেকে। তারপর বেড়ে ওঠেন সামাজিক-রাজনৈতিক শিক্ষায়। এই চার ধরনের শিক্ষার সমন্বয়ে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গড়ে ওঠে অন্তর্গত শিক্ষা। এই অন্তর্গত শিক্ষাই একজন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। তখন মানুষ নিজেকে ইচ্ছেমতো পরিচালনা করতে পারেন। ভালো-মন্দ বুঝতে পারেন। এমনটি না হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্মোহভাবে আইনের প্রয়োগ ঘটালে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে বিভিন্নভাবে সচেতন করাও কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।
মানুষের ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো কাজ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে চাইলে প্রকৃত শিক্ষার বিকল্প নেই। এর জন্য দরকার নিজেকে আলোকিত করা, যে আলো একমাত্র দিতে পারে শিক্ষাই। ঢাকা শহরসহ বাংলাদেশকে বাঁচাতে চাইলে মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় উন্নত করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
অনিল মুখার্জি বাংলাদেশের প্রখ্যাত বামপন্থি রাজনীতিক ও লেখক। তিনি ১৯১২ সালের ১০ অক্টোবর বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৯ সালে মুন্সীগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ব্রিটিশ আইন অমান্য আন্দোলনের অভিযোগে ১৯৩০ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে রাখা হয়েছিল মেদিনীপুর হিজলী বন্দিশিবিরে। সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে ব্রিটিশ সরকার সেখান থেকে তাকে আন্দামান দ্বীপের কারাগারে পাঠায়। সেখানকার বন্দিদের সঙ্গে তিনিও মরণপণ আন্দোলন করেন। ১৯৩৮ সালে ছাড়া পেয়েই তিনি কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে সক্রিয় হন। ১৯৪৬ সালে নারায়ণগঞ্জের সুতাকল শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন অনিল মুখার্জি। ভারত ভাগের পর আবারও গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৫৫ সালে মুক্তি পান। তখন থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৫৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় সম্মেলনে (গোপনে অনুষ্ঠিত) কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে পার্টির প্রথম কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ ও ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি। তার রচিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সাম্যবাদের ভূমিকা’, ‘শ্রমিক আন্দোলনের হাতেখড়ি’, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রামের পটভূমি’ ও ছোটদের জন্য লেখা ‘হারানো খোকা’। ১৯৮২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।