
দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফট চালুর সিদ্ধান্ত জারির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারির আগে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক ও ক্লাসরুমের সংখ্যা না বাড়িয়ে বাস্তবতা বর্জিত নির্দেশনার বিষয়টিকে অনেকেই ভালোভাবে মেনে নিতে পারছেন না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, পাশাপাশি অবস্থিত দুই বা ততোধিক স্কুল সমন্বয় করে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে, আর এতে অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় হওয়া কয়েক হাজার কোটি টাকা বেঁচে যাবে।
এক শিফট করার যৌক্তিকতা:
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্তসংখ্যক ব্যবহারযোগ্য শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক রয়েছেন, সেগুলোতে অবিলম্বে এক শিফট চালু করতে হবে। যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক বা শ্রেণিকক্ষ নেই বা উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি আছে সেসব বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত এমন দুটি বিদ্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে পাশাপাশি দুটি বিদ্যালয়ে দুই ভাগ করে একক শিফটে পাঠদান পরিচালনা করতে হবে। এই বিভাজনের ক্ষেত্রে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত একটি বিদ্যালয়ে এবং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অন্য বিদ্যালয়ে পাঠদান করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। দেখা যায় কোনো প্রতিষ্ঠানে তিনটি কক্ষ আছে। পাশের একটি বিদ্যালয়েও হয়তো তিনটি কক্ষ রয়েছে। এ ধরনের স্কুলগুলোর মধ্যে পাঠদান সমন্বয় করা হবে। এতে কোনো শিক্ষক বাদ যাবেন না, বা কোনো স্কুল বিলুপ্ত হবে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কোনো সমস্যা হবে না। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার মতে, অনেক স্কুলে বেশি শিক্ষার্থী থাকলেও সে স্কুলের অবকাঠামোগত সক্ষমতা নেই। আবার পাশের স্কুলেই শিক্ষার্থী কম। এ ধরনের দুটি বিদ্যালয় সমন্বয় হলে বেশি শিক্ষার্থী থাকা প্রতিষ্ঠানটির জন্য নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণ বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন হবে না। এক শিফট হলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। শিক্ষকরা শ্রেণি পাঠদানের সময় বেশি পাবেন। তাই শিখন-শেখানো কার্যক্রম অধিক ফলপ্রসূ হবে। শিক্ষার্থীরা বেশি করে কো-কারিকুলাম কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। দুই শিফটে সময়ের অভাবে সংগীত চর্চা, কবিতা আবৃত্তি, শ্রুতি লিখন ও দেয়াল পত্রিকা তৈরি সঠিকভাবে করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া এক শিফট মানে হচ্ছে সব শিক্ষার্থীর একই পরিমাণ সময়। ফলে শিশুরা খেলাধুলা করার সুযোগ পাবে। কিন্ডারগার্টেন ও হাইস্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সময়সূচিও একই করা উচিত বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।
যেসব সমস্যার কথা বলা হচ্ছে:
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস্তবে এ আদেশ প্রতিপালন করা কঠিন। সব বিদ্যালয়ে এক শিফট করতে গেলে আরও শিক্ষক প্রয়োজন। দরকার হবে বাড়তি ক্লাসরুমেরও। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোমলমতি শিশুরা পড়ে। রয়েছে প্রাক-প্রাথমিকের খুদেরাও। তাদের পক্ষে এক কিলোমিটার দূরবর্তী স্থানে গিয়ে প্রতিদিন ক্লাস করা বাস্তবসম্মত নয়। এ সিদ্ধান্তের কারণে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাবে। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে ছাত্রীদের পক্ষে দূরের স্কুলে গিয়ে পাঠগ্রহণ সব সময় সম্ভব হবে না। এতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যাও কমে যেতে পারে। নষ্ট হবে ছাত্র ও ছাত্রী সংখ্যার ভারসাম্য। উপরন্তু চর, হাওর-বাঁওড় ও পার্বত্য অঞ্চলের মতো দুর্গম এলকায় এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। দুই পৃথক বিদ্যালয় একীভূত করা হলে যে বিদ্যালয়ে ক্লাস হবে না, সেই বিদ্যালয়ের ভূমি, ভবন, পুকুরসহ অন্যান্য সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ কীভাবে হবে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলছে না।
বর্তমানে সারা দেশে ৬৫ হাজার ৫৫৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে এক কোটি ৪২ লাখ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। শিক্ষক রয়েছেন সাড়ে তিন লাখ। সাড়ে ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৯০ ভাগই ডাবল শিফটের স্কুল। এ সংখ্যা ৫৫ হাজারের বেশি। এক শিফটের স্কুলগুলোতে সকাল ৯টায় পাঠদান শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে তিনটায় শেষ হয়। আর দুই শিফটের বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম শিফট সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা, ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সমাবেশ ও পিটি এবং দ্বিতীয় শিফটে সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল সোয়া চারটা পর্যন্ত টানা পাঠদান চলে। ঢাকা মহানগরীরর ক্ষেত্রে (শীতকালীন) ডাবল শিফটের স্কুল সকাল সোয়া ৮টা থেকে সোয়া ১১টা, দ্বিতীয় শিফট সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত পাঠদান চলে।
গ্রামে পাশাপাশি অবস্থিত দুটি বিদ্যালয়ের দূরত্ব কোথাও এক, কোথাও দুই কিংবা তিন কিলোমিটার। এভাবে এক বিদ্যালয় থেকে আরেক বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতে শিক্ষার্থীদের কয়েক কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই কারণে বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের জন্য বিকল্প প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা ভাবছেন। তাছাড়া বাচ্চারা তো নতুন পরিবেশে, নতুন জায়গায় খাপ খাওয়াতে পারবে না। রাজধানীর এক প্রধান শিক্ষক বলেন, এক শিফটের ক্লাস চালু করতে হলে ন্যূনতম ছয়জন শিক্ষক প্রয়োজন। তবুও তাদের সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একটানা ক্লাস নিতে হবে। কোনো কারণে একজন শিক্ষক ছুটিতে থাকলে সেদিন সব বিষয়ের ক্লাস হবে না। এই অবস্থায় এক শিফট চালু করতে গিয়ে বিদ্যালয় ভাগাভাগি করলে বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটের মুখে পড়বে। এক শিফটের স্কুলের সময় দাঁড়ায় সাত ঘণ্টা যা প্রাথমিকের শিশুদের জন্য উপযোগী তো নয়ই বরং বিরক্তিকর। এক সময় বাচ্চাদের পুষ্টিমানের বিস্কুট দেওয়া হতো যা এখন আর নেই। তাহলে এতক্ষণ ছোট ছোট শিশুরা না খেয়ে কীভাবে বিদ্যালয়ে থাকবে সেটি একটি প্রশ্ন।
উপসংহার:
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দু’একটি বিষয় কিন্তু স্পষ্ট যে, প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা হয়েছে অথচ জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুযায়ী বিদ্যালয় স্থাপন, শিক্ষার্থী সংখ্যা ইত্যাদি কিছুই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। শুধু শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা হয়েছে। এত বছরে আবিষ্কৃত হলো যে, প্রচুর সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে যার ফলে মন্ত্রণালয় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। মন্ত্রণালয় ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। এখানে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট যে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত মূলত নেওয়ার কথা জনপ্রতিনিধিদের, সরকারি কর্মকর্তাদের নয়। এখানে সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই নিয়েছেন এবং তারা কিন্তু কেউই শিক্ষক নন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। শিক্ষক থেকে যদি এই ধরনের পদে কেউ আসেন তাদের ক’জনের পক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে সেটিও একটি প্রশ্ন। সবশেষ বর্তমান সচিব যেটি বলেছেন তা অত্যন্ত যৌক্তিক কথা। তিনি বলেছেন, ‘সব বিদ্যালয়ে এক শিফট একসঙ্গে হবে না, করাও যাবে না। প্রাথমিকভাবে ১২ হাজার বিদ্যালয় নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের গবেষণা আছে এবং এই বার হাজারে এক শিফট করতে সমস্যা নেই। পরের ধাপে আরও কিছু বিদ্যালয়ে এক শিফট চালু করা হবে। কাজটি হবে ধাপে ধাপে। এটি করার কারণ হচ্ছে দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে মন্ত্রণালয় চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে। সেখানে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে তারা এটি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোনো কোনো বিদ্যালয়ে মাত্র ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থী আছে। কোথাও আধা কিলোমিটারের মধ্যে দুটি স্কুল, কোথাও আবার ২০ গজ, ৫০ গজের মধ্যে দুটি স্কুল রয়েছে। সেখানে এত সংখ্যক শিক্ষক রাখা যৌক্তিক নয়। কোনো বিদ্যালয়ে নাকি ১৭ জন পর্যন্ত শিক্ষক আছেন। আবার কোথাও তিনজন। তাই এই উদ্যোগ।’
সচিব মহোদয় অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আমাদের সঠিক পরিকল্পনার ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। জাতীয়করণ করার সময় বিষয়গুলো সঠিকভাবে বিবেচনায় নিলে শিশুদের কষ্ট হতো না।
লেখকঃ শিক্ষক ও শিক্ষাবিষয়ক গবেষক
শেষ পর্যন্ত দেশের জন্য আইএমএফের ঋণপ্রাপ্তি ঘটেছে, প্রথম কিস্তির অর্থও চলে এসেছে। বাংলাদেশ চেয়েছিল ৪.৫ বিলিয়ন ডলার; কিন্তু ঋণ প্রদানকারী সংস্থার নির্বাহী বোর্ড অনুমোদন করেছে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার। এ যেন বন্দুকের জন্য দরখাস্ত করে কামান পাওয়ার মতো অবস্থা। এজন্য অর্থমন্ত্রী তার অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও আইএমএফের সংশ্লিষ্ট নির্বাহীদের অত্যন্ত পুলকিত বদনে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন। দেশ যে এখনো খাদে পড়ে যায়নি, দেশের ঋণমান যে এখনো দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটির এই ঋণ অনুমোদন তার এক উজ্জ্বল প্রতিভাস হিসেবে বিবেচনায় নিলে এই পুলক অনুভব অযৌক্তিক কিছু নয়।এতে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আরও অর্থ ধার করার ক্ষেত্র প্রসারিত হলো; সেসব ক্ষেত্রে অল্প আলোচনাতেই ঋণের প্রয়োজনীয়তা ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে উপসংহারে উপনীত হওয়া যাবে।
৪২ মাসে ছাড়যোগ্য ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের এই ঋণ তিনটি প্যাকেজে বিভক্ত : ক) Extended Credit Facility, EDF, খ) Extended Fund Facility, EFF এবং গ) Resilience and Sustainable Facility, RSF। ঋণের প্রথমোক্ত অংশটি সুদমুক্ত; সাড়ে ৫ বছর পারিতোষিক কালসহ পরবর্তী ১০ বছরে পরিশোধযোগ্য। দ্বিতীয়াংশে উল্লিখিত অংশটিও ১০ বছরে পরিশোধযোগ্য, তবে পারিতোষিক কাল সাড়ে ৩ বছর। আর শেষাংশে উল্লিখিত নতুন অংশটির পরিমাণ ১.৪ বিলিয়ন ডলার যা ২০ বছরে পরিশোধযোগ্য, আর পারিতোষিক কাল ১০ বছর। সুদযোগ্য ঋণাংশে সুদ মাত্র ২.২ শতাংশ। বৈশ্বিক অর্থনীতির এই কঠিন সময়ে এত স্বল্প সুদে এরকম দীর্ঘ সময়ের জন্য এই রকম ঋণ পাওয়াটা দেশের জন্য অবশ্যই একটা বড় অর্জন। তবে এই ঋণ দেশের ক্রমাবনতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার ও অস্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতিকে কতটা স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হয়, সেটা দেখার বিষয়। কারণ, দেশের চাহিদার তুলনায় এই ঋণের পরিমাণ তেমন কিছু নয়; দেশের প্রায় ২ মাসের রেমিট্যান্সের প্রায় সমপরিমাণ। তদুপরি এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নানা শর্ত, যেগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে।
ঋণ প্রদানের জন্য আইএমএফ নাকি অন্তত ৩০টিরও বেশি শর্ত আরোপ করেছে, কিন্তু সেগুলো কী কী, এখনো তা স্পষ্ট নয়। তবে গণমাধ্যমের লেখালেখি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভর্তুকি উল্লেখযোগ্য হারে কমানো, ব্যাংকের মন্দঋণ ১০ শতাংশে নামানো, রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে করনীতি ও কর প্রশাসনের আধুনিকীকরণ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাঠামোগত সংস্কার সাধন, আর্থিক খাতের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো শক্তিশালীকরণ, সামাজিক, উন্নয়ন ও জলবায়ু খাতে টেকসই বিনিয়োগ বৃদ্ধিকরণ, ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন, সুশাসন নিশ্চিতকরণ, মানবসম্পদ ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো, মুদ্রা বিনিময় ও সুদ হার মূল্য বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব পদ্ধতি সংশোধন করা, বৈদেশিক মুদ্রার নিট স্থিতি অন্যূন ২৪.৪ বিলিয়ন ডলারে বজায় রাখা, পুঁজিবাজারের বিকাশ ঘটানোর মাধ্যমে উন্নয়নে অর্থের টেকসই জোগান বৃদ্ধি করা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সরকারি অর্থ ব্যয় করা প্রভৃতি।
আইএমএফের শর্তের মধ্যে কোনো গোপনীয়তা আছে কি না, থাকলে তাতে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছু আছে কি না, তা আমরা এখনো জানি না। তবে যেসব শর্ত ও সংস্কারের কথা জনসমক্ষে এসেছে, সেগুলো দেশের অর্থনীতির জন্য সময়োপযোগী নয় এমন কথা বোধ করি কেউ বলবেন না। দেশীয় অর্থনীতিবিদরা এই জাতীয় সংস্কারের কথা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। কিন্তু তা করা হয়নি। কারণ, সংস্কার সময়সাপেক্ষ ও পীড়নদায়ী। এজন্য এর বিরুদ্ধে সমাজে ও অর্থনীতিতে নানা প্রতিরোধ ও প্রতিবন্ধকতা থাকে, থাকে অনেক অজনপ্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের ঝুঁকি। সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তী দিল্লির এক সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক কিছু বৈপ্লবিক সংস্কার কাজে হাত দেন। কিন্তু সভাসদের অসহযোগিতায় ব্যর্থ হয়ে এই অসাধারণ প্রতিভাধর মানুষটি জনসাধারণের কাছে পাগলরূপে প্রতিভাত হয়ে আছেন। রাজনৈতিক অঙ্গীকার, আমলাতন্ত্রের বিশ্বস্ততা ও দক্ষতার অভাব এবং দুর্নীতি এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ। তবে দূরদর্শী ও দৃঢ় রাজনৈতিক নেতৃত্বে দক্ষ ও বিশ্বস্ত কর্মীবাহিনী দিয়ে এই পর্বতসম প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা অসাধ্যও কিছু নয়।
ইতিমধ্যে পাহাড়সম ভর্তুকি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; দফায় দফায় সমন্বয় করা হচ্ছে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম। সারের মূল্যও বাড়ানো হয়েছে। ভর্তুকি আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছানোর পথে অন্যতম বাধা। তবে সব ভর্তুকিকে একতরফাভাবে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। ভর্তুকি কমানোর ক্ষেত্রে দেশে এখন পর্যন্ত অবশ্য উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিরোধ দেখা যায়নি। তবে এর প্রভাব পরিদৃষ্ট হচ্ছে পণ্য ও সেবার মূল্যে; নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির ছোবলে সীমিত আয়ের মানুষ নাকাল হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের সুরক্ষা দিতে প্রয়োজন আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ন। সেটা করা না গেলে সমস্যার স্থানান্তর ঘটবে মাত্র, সমাধান হবে না।
দ্রুত প্রবৃদ্ধির এই দেশ ধনিক শ্রেণির উত্থানে বিশ্বে অগ্রবর্তী হলেও রাজস্ব সংগ্রহে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন কেন, তা এক মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন বটে। এদেশে ধনিক শ্রেণি ও বড় বড় করপোরেট হাউজ তাদের প্রদেয় কর কমই দেয়; কর বেশি দেয় সাধারণ মানুষ, ধনীরা কর এড়াতে এবং করভার নিচের দিকে স্থানান্তরে সিদ্ধহস্ত। দেশে এত মাল্টিবিলিয়নিয়ার তৈরি হওয়া সত্ত্বেও এখনো অন্যতম সেরা করদাতা জর্দা বিক্রেতা কাউস মিয়া। পাকিস্তান আমল থেকে তার এই তকমা। এখন আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রাজস্ব বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রভাবশালী কর ফাঁকিবাজদের যদি বাগে আনতে পারে, সেটা হবে একটা কাজের কাজ। সেটা করতে সফল না হয়ে তারা যদি মরিয়া হয়ে রাজস্ব বাড়াতে বাঁধা গরুর মতো নিয়মিত কর প্রদানকারীদের ওপর চড়াও হন, তবে সেটা হবে এক মুরগি দুই বার জবাই করার সমান। তাতে সমাজে অসন্তোষ বাড়বে, কর আদায় কমবে, আর বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আইনের নিরাসক্ত প্রয়োগ। এর জন্য শুধু ঋণের টাকায় গড়া সম্পত্তি অধিগ্রহণ করলেই যথেষ্ট হবে না, দোষীকে জেলে পর্যন্ত ভরতে হবে। আইএমএফের কল্যাণে যদি সেটা সম্ভব হয়, তবে তা হবে স্মার্ট বাংলাদেশে সুশাসনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এখন দেশের ব্যাংকিং জগতের সংস্কৃতিতে কলমের খোঁচায় মন্দঋণের পরিমাণ ১০ শতাংশেরও নিচে কমিয়ে আনা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী সংসদে ২০ জন সর্বোচ্চ ঋণখেলাপির যে ফিরিস্তি প্রকাশ করেছেন, তার মধ্যে অনেক রাঘব-বোয়ালের টিকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উদার হস্তে বণ্টিত পুনঃতফসিলীকরণ সুবিধার বদৌলতে তারা গা ঢাকা দেওয়ার সুযোগ পাওয়ায় হয়তো এমনটি ঘটেছে। এই একই কায়দায় কলমের খোঁচায় শর্ত পালনের জন্য খেলাপি ঋণের হার যদি ১০ শতাংশের নিচে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাতে নিয়ম রক্ষা হয়তো হবে, কিন্তু অবস্থার কোনো ইতরবিশেষ হবে না।
একই ভাবে অন্যান্য শর্তে যাই থাকুক না কেন, সেগুলো মূলত বাজার অর্থনীতির চিরাচরিত সূত্র থেকে উৎসারিত। কিন্তু দেশে ব্যবসায়ীরা রাজনীতির মাঠ জবরদখল করে ফেলায় নীতিনির্ধারণে তার অশুভ প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে; স্বার্থের সংঘাত অহরহ দেখা দিচ্ছে। ফলে এই সব সূত্রের কার্যকারিতা ব্যাকফুটে চলে যাচ্ছে। তাছাড়া কার্যকারিতা নির্ভর করছে দৃঢ় অঙ্গীকার, বাস্তবায়ন সক্ষমতা এবং বাস্তবায়নকালে পীড়ন সহ্য করার ক্ষমতার ওপর। সব ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ আকাশচুম্বী। এসব অতিক্রম করেই কেবল সফলতা আনা সম্ভব।
তবে আইএমএফের শর্তগুলোর মধ্যে কিছু বিষয় না আসায় অবাক হয়েছি। ধারণা করা হয় যে, এদেশ থেকে প্রতি বছর গড়পড়তা ৬ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পাচার হয়ে যায়। পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য বাজেটে বিশেষ ব্যবস্থা রাখায় এর সত্যতা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু পাচার রোধ করার জন্য গৃহীত কার্যক্রম তেমন দৃশ্যমান নয়। মাত্র ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ধারে পাওয়ার জন্য এত সব অজনপ্রিয় সংস্কার কাজের বোঝা ঘাড়ে নিয়েও পুলক বোধ, অথচ এর চেয়ে শতগুণ বেশি অর্থ দেশে আটকে রাখার জন্য তেমন কোনো গরজ নেই কেন সেটাও এক দুর্বোধ্য প্রশ্ন।
দেশের এক কোটিরও বেশি অদক্ষ শ্রমিক প্রবাসে নিদারুণ কায়িক শ্রমের বিনিময়ে বছরে ২০-২২ বিলিয়ন ডলার দেশে প্রেরণ করেন। অথচ এদেশে নয় দশ লাখ বিদেশি কর্মী কাজ করে বছরে ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যান। উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার এই অপচয় পর্যায়ক্রমে রোধ করা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রেও তৎপড়তা লক্ষণীয় নয়।
আমদানিতে পর্যাপ্ত রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে দেশে প্রতি মাসে চলতি হিসাবে যেখানে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, সেখানে এই ঋণে ৬ মাস অন্তর অন্তর আইএমএফ থেকে ৬০ কোটির কিছু বেশি ডলারপ্রাপ্তি নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। তবে এ ঋণের তাৎপর্য শুধু এর পরিমাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা উন্নয়ন সহযোগীদের একটা ইতিবাচক বার্তা দেবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সাময়িক পীড়ন সত্ত্বেও এর শর্তগুলোর সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন সামষ্টিক অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা আনতে সহায়তা করতে পারে। যে সব প্রয়োজনীয় সংস্কার স্বউদ্যোগে গ্রহণ করা যাচ্ছে না, আইএমএফের চাপে সেগুলো হয়ে গেলে তাকে অন্তত মন্দের ভালো বলাই যায়। তখন নিজস্ব উদ্যোগে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে আত্মনির্ভরশীল ও উদ্বৃত্ত হওয়ার পথ সহজতর হবে। সেই সঙ্গে অর্থ পাচাররোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি ঘটতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রে টনিকের কাজ করবে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসনের নিশ্চয়তা। এবারও আমরা আশাবাদী হতে চাই।
লেখকঃ খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক
এক. আমার শৈশব-কৈশোরের পুরোটাই অতিবাহিত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে। নোয়াখালী জিলা স্কুলে পড়ার কথা মনে পড়ে, ক্লাস সেভেনে থাকতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে পোস্টার লাগাতে গিয়ে স্কুল কর্র্তৃপক্ষের রোষানলে পড়তে হয়েছে। ছাড়পত্র (টিসি) দেওয়ার বন্দোবস্তও ছিল সেই রোষানলে। মফস্বলের একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক ও লেখক হিসেবে দেখতে হয়েছে, প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধের মর্মমূলে কীভাবে আঘাত করে চলেছে একটি অপশক্তি।
দুই. ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এই রায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সেদিন বিকেলে কিছু অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট শাহবাগে জড়ো হয়। প্রথমে কয়েকজন ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট শাহবাগে জড়ো হন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ভিড় বাড়তে থাকে। অনলাইনে অব্যাহত প্রচারণায় ধীরে ধীরে মানুষের স্রোত জনসমুদ্রে রূপ পেতে থাকে।
তিন. বিকেলে পল্টনে একটা মিটিং ছিল। তখন আমি যুব ইউনিয়ন ঢাকা মহানগরের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। সেই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়আমরা শাহবাগের আন্দোলনে সংহতি জানাব। মিটিং সেরে বাসায় এলাম। এরই মধ্যে আমার ফুফাতো ভাই অধ্যাপক ডক্টর আবদুল জব্বার খান (বর্তমানে বুয়েটের উপ-উপাচার্য) জানালেন, শাহবাগে যাচ্ছেন তিনি। আমরা ঘরে থাকার কোনো চিন্তাই করলাম নাতিন ভাই শাহবাগে চলে গেলাম। সেøাগানে-সেøাগানে একাত্ম হয়েছি। ছোট ছোট মোমবাতি নিয়ে স্লোগানে গলা মেলালাম। পোস্টার লিখতে বসেছি।
সেদিন রাতের কথা, বিএসএমএমইউর সামনে রাস্তায় বসে এক বৃদ্ধ মহিলা। তার সামনে ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই’ লেখা একটি কাগজ। চোখ বন্ধ করে তিনি জপে যাচ্ছেন কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই..., কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই...। কেউ একজন তাকে ভিক্ষুক ভেবে তার দিকে কুড়ি টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এই নিন। তিনি চোখ খুলে তাকালেন। বললেন, এটা কী? ওই ভদ্রলোক বললেন, টাকা। বৃদ্ধা বললেন, আমি দুইশ টাকা ধার করে এখানে আসছি, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাইতে। জানি আপনার টাকা নেব কেন?
এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আমাদের উৎসাহিত করেছে।
চার. বুকের মধ্যে একটা আগুন ছিলবারুদ-জ্বলা আগুন। কেমন করে যেন সেদিন বারুদ জ্বলে উঠল, মুহূর্তে টেনে নিয়ে গেল মহান মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ দেখিনিওই সময় বেঁচে থাকলে নির্ঘাত যুদ্ধে যেতামআবেগটা সেই লেভেলের ছিল। মুক্তিযুদ্ধ দেখিনিকিন্তু আমাদের প্রেরণা ছিল মহান স্বাধীনতা-সংগ্রামের লাখো শহীদের রক্তস্নাত স্বপ্ন, বিশ্বাস আর আত্মত্যাগ।
শাহবাগের গণজাগরণ শুধু নিছক আন্দোলন ছিল না। নানা মাত্রিকতার মিথস্ক্রিয়া তৈরি করেছিল সেই আন্দোলন। একদিকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ছিল এ আন্দোলনে, অন্যদিকে ছাত্র-যুবদের শ্রেষ্ঠতম আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আর বৌদ্ধিক আন্দোলনেও ‘শাহবাগ’ নতুন মাত্রা তৈরি করে গেছে।
এ আন্দোলন নিয়ে আলোচনা আছে, সমালোচনাও আছে। কিন্তু এ আন্দোলনের প্রেক্ষিত সর্বজনীন। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ শব্দটি বেহাত হয়ে গিয়েছিল। জয় বাংলাকে শাহবাগের গণজাগরণের মাধ্যমে অনেকাংশে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সব শক্তিকে একত্র করার ক্ষেত্রে সফল প্রেক্ষাপট গণজাগরণ মঞ্চ। দীর্ঘ সময় ধরে একটি অহিংস আন্দোলন করতে পারা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগের প্রবল বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং তা সমাজের বৃহত্তর অংশকেও বেশ আলোড়িত করে। একপর্যায়ে শাহবাগ চত্বরে বিপুলসংখ্যক মানুষের সপরিবারে উপস্থিতি লক্ষ করা যায়; নারী ও শিশুদের উপস্থিতিও ছিল ব্যাপক। আন্দোলন ছিল গানে, কবিতায়, স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত।
এ ছোট্ট জীবনে এ আন্দোলন সব সময় স্মরণীয়। গর্বিত হইএ আন্দোলনে আমি একজন সাধারণ কর্মী ছিলাম। এক দিন হয়তো বড় করে ইতিহাস হবে ‘শাহবাগের গণজাগরণ’। সেদিন স্পন্দিত বুকে বলতে পারবআমিও গণজাগরণে অংশ নিয়েছিলাম, সেই জাগরণ আমাকেও জাগিয়ে দিয়েছিল।
পাঁচ. ওই সময়গুলোতে প্রচুর ঝড় গেছে আমাদের ওপর। প্রতিনিয়ত আমাদের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। আমাদের অনেক সহযোদ্ধা নিরাপত্তাহীনতায় ছিল। বিভিন্ন হুমকির শিকার হতে হয়েছে। তবুও দুর্বিনীত ছিল। ভেঙে পড়েনি। লড়ে গেছে শেষ পর্যন্ত। তাদের শ্রদ্ধা জানাই, সম্মান জানাই। মাঝে মাঝে আমাদের ঠিকানা বদল করতে হয়েছে। তবুও আমরা কাঁধে কাঁধ রেখে ছিলাম। পালিয়ে যাইনি।
ছয়. শাহবাগ চত্বরপুরান ঢাকা থেকে নতুন শহরের দিকে আসা অজস্র বাস, গাড়ি, রিকশা জমে থাকে। ভিড় একটু হালকা হলে চোখে পড়ে, রাস্তার প্রস্থজুড়ে সাদা রঙ দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখাগণজাগরণ মঞ্চ। রঙ ফিকে হয়ে গিয়েছে। এই সেই চত্বর, যেখানে ১০ বছর আগে লক্ষাধিক মানুষ বহু দিন কাটিয়েছেন। তাদের আন্দোলন পুরো পৃথিবীতে সাড়া ফেলেছে। আজ কোথায় সেই আন্দোলনের গতিপথ? তবে কি রাস্তাজোড়া বর্ণমালার সাদা রঙের মতোই আন্দোলনও ফিকে হয়ে গেল? নাকি, আপাতত আগামী বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে?
গ্রামের মানুষদের কাছে শাহবাগ আন্দোলন তেমন কোনো বড় বিষয় নয়। শহরের গরিব মানুষও যে এর সঙ্গে খুব বেশি একাত্ম হয়েছিলেন, এমন নয়। কিন্তু এটা যদি আন্দোলনের ব্যর্থতা হয়, তবে এক অর্থে এটাই তার সাফল্যের চাবিকাঠি। বস্তুত, মুক্তিযুদ্ধের পরে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এ ধরনের ঐক্য আর কখনো সামনে আসেনি।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি হাতেগোনা ‘১০ থেকে ২০ জন’ নিয়ে যে আন্দোলনের শুরু, কেমন করে কয়েক ঘণ্টায় হাজার, কয়েক দিনে হাজার পেরিয়ে লাখে পৌঁছাল, তা ইতিহাস। এবং তারা কারা? যারা বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম, ভবিষ্যতের কারিগর। শাহবাগ ব্যর্থ না সফল, তা সময়ই বলবে। কিন্তু বুঝতে পারি যে, আমাদের প্রত্যেকের মনে একটা করে শাহবাগ তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রয়োজন হলেই আবার সেই লুকোনো শাহবাগ বেরিয়ে আসবে।
আন্দোলনের গোড়ার দিকে প্রায় কুড়ি দিন ও রাত একটানা শাহবাগে জমায়েত করেছিলাম। সে একটা অদ্ভুত অবস্থা। হাজার হাজার স্কুল, কলেজের ছাত্রছাত্রী, সাধারণ মানুষ রাস্তায় বসে আছে। কী খাবে, কোথায় থাকবে, কোনো চিন্তা নেই। শুধু সুনির্দিষ্ট দাবি পূরণ চাই। কিন্তু এমন করে তো বেশি দিন চলতে পারে না। অনেকে বাইরে থেকে চাকরি ছেড়ে, দোকান ফেলে এসেছেন। জানেন না চাকরি রইল কি না, দোকান কী অবস্থায়। সাধারণ মানুষ তো এগিয়েছে। ভাবা যায়, শাহবাগের জমায়েতে যাবে শুনলে রিকশাচালকও সওয়ারির কাছ থেকে ভাড়া নিতে চাননি। বিনা পয়সায় গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন!
সাত. এটা মানতে হবে, একটা সময়ে গণজাগরণ মঞ্চে বিভেদ তৈরি হয়েছে। তার কারণও আছে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে বিভিন্ন ধরনের মানুষ এসেছেন। এখানে দায়বদ্ধতা মেটাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মানুষ এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনসবাই এসেছেন। যারা এসেছিলেন, তাদের একটাই ইস্যু ছিল, যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক জায়গা থেকে যারা এসেছিলেন, তাদের প্রত্যেকের দলীয় রাজনীতির একটা যুক্তি ছিল। তিনি যখন দেখছেন, তার চিন্তাধারার সঙ্গে শাহবাগ ক্ল্যাশ করছে, তখন তিনি সরে গেছেন। তবে শাহবাগ আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে সরকার নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ফলে গণজাগরণ মঞ্চের বিভেদগুলো স্পষ্ট হতে থাকে। তবে, যে চেতনাকে ধারণ করেছে শাহবাগ, সে চেতনা আজও প্রদীপ্ত কোটি বাঙালির হৃদয়ে। ১০ বছর আগের শাহবাগের গণজাগরণ সেই শক্তির ডাক দেয়।
লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় কমিটি
কবির হৃদি অলকানন্দায় ভেসে গেলে কিবা ডুবে মরলে কারও ক্ষতি না হলেও দূষণে নদীই ভেসে গেলে, প্রবাহ থেমে মরে গেলে তা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু পরিহাস এই যে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নদীবিধৌত এই দেশের স্রোতস্বিনী অনেক নদীই দখল-দূষণের শিকার হয়ে এখন মরণোন্মুখ গাঙে পরিণত হচ্ছে চোখের সামনে।
বুধবার দেশ রূপান্তরে ‘শীতলক্ষ্যা এখন ভাগাড়’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শিল্পকারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্য এবং সিটি করপোরেশনের অসংখ্য ড্রেনের পানি সরাসরি নদীতে পড়ায় নদীটির মরণদশা। তরল শিল্পবর্জ্য শোধনাগারের (ইটিপি) মাধ্যমে শোধিত হওয়ার কথা থাকলেও হচ্ছে না। ইটিপি আছে শুধু কাগজে-কলমে। সরকার প্রতিটি কারখানায় ইটিপি প্ল্যান্ট বসানোর জন্য বরাদ্দ দিয়েছে। টাকা খেয়ে ফেলেছে মালিকরা, ইটিপি প্ল্যান্ট বসানো হয়নি। ফলে খাল-নালা হয়ে রাসায়নিক বর্জ্যসহ পানি এসে পড়ে নদীতে। বিভিন্ন স্থানের ড্রেনের ময়লা পানিও পড়ছে। আবার নদীর দুই তীরে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়।
টলটলে পানির কারণে ব্রিটিশরা একসময়ের স্রোতস্বিনী শীতলক্ষ্যার পানির নাম দিয়েছিল ‘ডিস্টিল্ড ওয়াটার’। এ নদীকে ঘিরেই একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রসার ঘটেছিল নারায়ণগঞ্জে। নদীর পানি দিয়ে গোসল, রান্নাবান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ করত নদীতীরবর্তী মানুষ। সেসব এখন অতীতের কথকতা। দূষণে ও দখলে সংকীর্ণ হওয়া এবং আবর্জনায় ভরাট হতে হতে শীতলক্ষ্যা এখন নর্দমা। পানিতে উৎকট গন্ধ। কালচে পানি মানুষের চর্মরোগের অন্যতম কারণ।
সভা-সেমিনারে শীতলক্ষ্যা নিয়ে কথা হয় অনেক, ফল কিন্তু শূন্য। জনপ্রতিনিধি ও বিশিষ্টজনরা শীতলক্ষ্যা রক্ষায় কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি। ফলে দুর্ভোগের শিকার কয়েক লাখ মানুষ। নদীর জীববৈচিত্র্যও হুমকিতে পড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জে তরল বর্জ্য নির্গমন হয় এমন শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪৫০টি। ১২০টিতে ইটিপি বসানো হয়নি। বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও তারা পরিবেশ আইন মানছে না। জরিমানা এবং মামলা করা হলেও কোনো দ্বিধা নেই তাদের মধ্যে। ইটিপি যাদের আছে তাদেরও বেশিরভাগ তা ব্যবহার করে না। এসব প্রতিষ্ঠানকে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু নদীদূষণ বন্ধ হচ্ছে না। এদের বিরুদ্ধে ২১টি মামলাও হয়েছে। হাইকোর্টে রিট হয়েছে ২৩টি।
পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি অ্যাডভোকেট এবি সিদ্দিক বলেন, নদীরক্ষা আইন থাকলেও যথাযথ প্রয়োগের অভাবে শীতলক্ষ্যা তার যৌবন হারাচ্ছে। বুড়িগঙ্গার অবস্থা আরও করুণ। ইটিপিবিহীন ডাইং ও কারখানাগুলো নদীদূষণের মূল কারণ। নদী বাঁচাতে হলে দূষণের দায়ে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো এখন দুর্দশাগ্রস্ত। একদিকে প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে অতিরিক্ত পলি ভরাট, অন্যদিকে মানবসৃষ্ট দখল-দূষণে নদীগুলো ভারাক্রান্ত। এ পরিস্থিতিতে সারা দেশের অনেক ছোট নদীই মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে কিংবা যাচ্ছে। অবৈধ দখল এবং সীমাহীন দূষণ নদীগুলোর এই সংকটময় পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে শহর-বন্দরের পয়োবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য। বিষাক্ত সব রাসায়নিক এবং প্লাস্টিক ও পলিথিনের দূষণে নদীগুলো ভয়ংকর দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে।
দেশের নদীগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা না হলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের যে ক্ষতি হবে, তা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব হবে না। সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া নদীগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন। এ প্রেক্ষাপটে দেশের নদ-নদীগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আরও কার্যকর ও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই।
নদীরক্ষার সঙ্গে যে মন্ত্রণালয়গুলো জড়িত রয়েছে তাদের সদিচ্ছার অভাব আছে। নদী শুধু খনন করলেই চলবে না, নদীর দুই পাড়ও প্রসারিত করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে শীতলক্ষ্যাসহ সব নদ-নদী-জলাশয়কে অবৈধ দখলমুক্ত ও খনন করে প্রাকৃতিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার করা এবং জীববৈচিত্র্যসহ নদী সুরক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
১৯২৩ সালের এই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন বরেণ্য বাঙালি অধ্যাপক, লেখক, সংস্কৃতিকর্মী কবীর চৌধুরী। বাবা খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী এবং মা উম্মে কবীর আফিয়া চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ ও এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমেরিকান সাহিত্য এবং সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কবীর চৌধুরীর কর্মজীবন বিচিত্র। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, রাজশাহী সরকারি কলেজ ও ঢাকা কলেজে ইংরেজি পড়ানোর পর তিনি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ ও ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষ হন। এরপর সরকারের শিক্ষা বিভাগে কাজ শেষে বাংলা একাডেমির পরিচালক ও মহাপরিচালক হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ন্যাশনাল এডুকেশন কাউন্সিলের প্রথম সদস্যসচিব এবং পরে শিক্ষা ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব হন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক হন। ১৯৯৮ সালে জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদায় ভূষিত হন। রচিত, সম্পাদিত ও অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা দুইশতেরও বেশি। বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি। ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন কবীর চৌধুরী।
ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু জনঘনত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এক-তৃতীয়াংশ নগর সুবিধায় ঢাকায় চার গুণের বেশি মানুষের বসবাস। অবকাঠামো বিবেচনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ বহন করছে দেশের রাজধানী শহর।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে। ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন।
দুই সিটিতে বিভক্ত ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহরে জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়।
রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।
ড্যাপে আরও বলা হয়েছে, ঢাকার লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বসবাস করে। জনঘনত্বের দিক থেকে যা বিশে^র সর্বোচ্চ। চকবাজারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বসবাস করে। যা বিশে^ তৃতীয়। কোতোয়ালিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৩ জন বসবাস করে। যা জনঘনত্বের দিক থেকে বিশে^ দশম।
রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে মূল ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেখান থেকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের জন্য অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মূল ঢাকার জনঘনত্ব কমবে। আর জনঘনত্ব কমলে মূল ঢাকা অনেকাংশ বসবাস উপযোগী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এ সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটি এলাকার প্রায় ৮২ ভাগ কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে।
পরিকল্পনাবিদদের এ সংগঠটি বলছে, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয় ১৫ শতাংশ, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ ভাগ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তবে কোনো শহরের ৪০ ভাগের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
নিরাপত্তার বিবেচনায়ও ঢাকা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে, সেটা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৮ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৫ শতাংশ। আর গত বছর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভবিলিটি ইনডেক্স অনুসারে ঢাকা বিশে^র সপ্তম কম বসবাসযোগ্য শহর।
চলতি মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সাড়ে আট ভাগ সবুজ রয়েছে। ঢাকার উন্মুক্ত স্থান ও জলাশয়কেন্দ্রিক সুবজ এলাকা ধরে এ গবেষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে চার গুণ অর্থাৎ, ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। ভালো হতো ১২ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা থাকলে।
তিনি বলেন, ঢাকার বাস্তবতা বিবেচনায় চাইলেই আদর্শ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে না। ইচ্ছা করলেই এখন সড়কের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে এখনো কিছু উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। সেটা হলো, বিদ্যমান সড়কগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
ড. আদিল বলেন, ‘ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানো তো দূরের কথা, যেগুলো আছে সেগুলোও টিকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। এ জন্য পলিসি পর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো ঢাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাজউকের ড্যাপের কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করে ঢাকার জনঘনত্ব কমানো এবং গণপরিসর বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকার জনঘনত্ব কমাতে ঢাকায় নতুন কোনো কর্মস্থান সৃষ্টি করা যাবে না। যেমন শিল্প, কলকারখানা এবং অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাহলে জনসংখ্যার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।’
পরিকল্পনা হয় বাস্তবায়ন হয় না : ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগরপরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করে ব্রিটিশরা। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ।
এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।
বাংলাদেশে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি ধরা হতো। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এ মাস্টারপ্ল্যানের নাম ড্যাপ। মাস্টারপ্ল্যানটি পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ ভাগ সঠিক ছিল। তবে ৩০ ভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
আজ বুধবার (২৯ মার্চ) ভোর ৫টায় দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমবাগান এলাকার নিজ বাসা থেকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-এর একটি দল।
স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলো পত্রিকার আলোচিত রিপোর্টটির কারণে তাকে আটক করা হয়েছে বলে সিআইডির দলটি উপস্থিত ব্যক্তিদের জানিয়েছেন।
এভাবে গভীর রাতে তল্লাশি চালিয়ে একজন সংবাদকর্মীকে আটক বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর চরম আঘাত বলে মনে করে গণতন্ত্র মঞ্চ। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দ।
কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বানানোর পর থেকেই বিরোধী মতের রাজনৈতিক কর্মীরা যেমন মতপ্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তেমনি গণমাধ্যম কর্মীরাও নির্যাতিত হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামসহ সারাদেশে বহু গণমাধ্যমকর্মীদের ওপরই সরকারি সংস্থা কিংবা দলের লোকের নির্যাতনের খবর এসেছে। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে শামসুজ্জামান শামসকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানাচ্ছে। সেই সাথে গণমাধ্যম কর্মীসহ মত প্রকাশের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে তাদের মামলা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবী জানান নেতৃবৃন্দ।
চারদিকে পাহাড় ও সবুজের অরণ্য। এই সবুজ বিনাশ করে সড়ক নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। পাহাড়ি এলাকায় সড়ক নির্মাণের প্রকৌশলগত জ্ঞানের অভাব কিংবা অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা, রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার অংশ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের আওতায় চলে যাওয়া বা রেল লাইনের ওপর ব্রিজ নির্মাণসহ নানা জটিলতায় একের পর এক আটকে যাওয়া প্রকল্পটি ইতিমধ্যে ২৭ বছর পার করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ও পরিমার্জনে শুরুর ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৩৫৩ কোটিতে পৌঁছেছে। তারপরও শেষের দেখা নেই ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ ডিটি-বায়েজীদ (বায়েজীদ লিংক রোড) সংযোগ সড়কের।
দীর্ঘদিন ধরে রেললাইনের ওপরে নির্মিত ব্রিজের কাজ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পর এখন চলছে। গত সপ্তাহে দেখা যায়, রেললাইনের ওপরের অংশে গার্ডার বসানোর কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। এতদিন রেললাইনের উভয় প্রান্তে গার্ডার বসলেও রেললাইনের ওপরের অংশে খালি রাখা হয়েছিল। রেললাইন বিড়ম্বনার পাশাপাশি রোডের গা ঘেঁষে রয়েছে সুউচ্চ পাহাড়। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে রাস্তার ওপর পড়তে পারে এবং এতে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। অর্ধকাটা এসব পাহাড় নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও রোড নির্মাণ বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মধ্যে বিরোধ চলছে। পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। অর্ধকাটা এসব পাহাড় কেটে ঝুঁকিমুক্ত করার বিষয়ে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখনো এর সুরাহা নেই। যথারীতি আরেকটি বর্ষা আসছে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে খাড়া পাহাড়। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে জানমালের ক্ষতি হতে পারে সেই শঙ্কায় গত বছর বর্ষায় এই রোডে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে। এবারও কি একই পথে হাঁটতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় রোড বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাহাড়ের বিষয়টি নিয়ে এই সপ্তাহে পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের মিটিং রয়েছে। আশা করছি বিষয়টি সুরাহা হবে।’
এদিকে পাহাড় নিয়ে সুরাহার পথ সুগম হলেও জনগণের যাতায়াতের ওপর টোল বসাচ্ছে সিডিএ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে নগরবাসীর চলাচলের কোনো পথে টোল নেই (কর্ণফুলী সেতু ও টোল রোড ছাড়া)। এরমধ্যে টোল রোডটি শুধুমাত্র পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্মিত। কিন্তু ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়কে টোল যুক্ত হতে যাচ্ছে। ৩২০ কোটি টাকার প্রকল্প সরকার ৩৫৩ কোটি টাকায় বর্ধিতকরণের অনুমোদনের সময় অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা টোল আদায়ের মাধ্যমে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘রোড মেইনটেনেন্স আমরা করব। একইসঙ্গে সড়কবাতি স্থাপন, রেললাইনের ওপরে ব্রিজ নির্মাণ, নালা সংস্কার কাজগুলো নতুন করে করা হবে।’ টোল প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘টোল প্লাজা বসবে ফৌজদারহাট অংশে। শহর প্রান্ত দিয়ে এসে টোল প্লাজা ক্রস করলেই শুধুমাত্র টোল দিতে হবে। রোডের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে গেলে টোল দিতে হবে না।’
কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, চলতি বছরের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করে দ্বিতীয় ব্রিজটি চালু করে আনুষ্ঠানিকভাবে তা ওপেন করে দিতে চাই। যদিও ইতিমধ্যে এই রোড দিয়ে অনেক যান চলাচল করছে। কিন্তু ওভারব্রিজটি চালু না করায় তা পূর্ণতা পায়নি।
টোল কবে থেকে যুক্ত হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আগামী বছর থেকে টোল যুক্ত হতে পারে।’
সড়কের ইতিবৃত্ত বায়েজীদ বোস্তামী রোডের সঙ্গে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডকে (ডিটি রোড) যুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রায় ছয় কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকার ওপর দিয়ে এই রোড নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ৪০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পের অধীনে ব্যাপক হারে পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করলেও বর্ষা এলেই পুরো রাস্তাসহ পাহাড়ি ঢলে চলে যেত। ফলে প্রকল্পটি বারবার হোঁচট খায়। এই প্রকল্পের মাঝখানের এক কিলোমিটার অংশ আবার এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন করার সময় তাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যায়। ফলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের বাইরে দিয়ে নতুন করে বাঁক নিয়ে সড়কের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। দুই লেনের সেই প্রকল্প প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এসে আবারও নকশায় পরিবর্তন। এবার দুই লেনের পরিবর্তে চার লেনে উন্নীত করা হয়। যথারীতি বাজেট ৩২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২১ সালে এসে তা ৩৫৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
প্রথমবারের মত মা হলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি।
মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) রাত ১১টা ২০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মাহির স্বামী রাকিব সরকার।
তিনি জানান, মা ও ছেলে দুজনেই সুস্থ আছেন। পুত্রের নাম এখনও ঠিক করা হয়নি বলে জানান তিনি।
২০১২ সালে ‘ভালোবাসার রঙ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক ঘটে রাজশাহীর মেয়ে মাহির। পরবর্তীতে ‘অগ্নি’ ‘কী দারুণ দেখতে, ‘দবির সাহেবের সংসার’, ‘অনেক সাধের ময়না’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
দুই বছর আগে গাজীপুরের ব্যবসায়ী রকিবকে বিয়ে করেন মাহি। তার কয়েক মাস আগে পারভেজ মাহমুদ অপুর সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মা হচ্ছেন বলে খবর দিয়েছিলেন এই চিত্রনায়িকা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’