
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার বিখ্যাত ফুরফুরা শরিফকে ভাবা হয় আজমির শরিফের পর ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী দরবার শরিফ। বাংলাদেশ ও ভারতে ফুরফুরা শরিফের প্রচুর হিন্দু-মুসলিম ভক্ত রয়েছে। ফুরফুরা শরিফ মূলত সামাজিক সেবামূলক কর্মকান্ডে নিয়োজিত থাকলেও দরবারের বর্তমান পীরজাদারা রাজনীতির মাঠে বেশ সক্রিয়।
দরবারের প্রয়াত ছোট হুজুরের নাতি আব্বাস সিদ্দিকী প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’ নামে রাজনৈতিক দল। দল গঠনের পর গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতার সঙ্গে আসন ভাগাভাগির চেষ্টা করেছিলেন আব্বাস সিদ্দিকী। যদিওবা শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের সঙ্গে সংযুক্ত মোর্চায় যায় দলটি। আব্বাস সিদ্দিকীর ভাই নওশাদ সিদ্দিকী সে জোটের হয়ে নির্বাচন করে রাজ্যের বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
বর্তমানে কলকাতার রাজনীতির মাঠ সরগরম নওশাদ সিদ্দিকীর গ্রেপ্তার নিয়ে। মূলত ভাঙড়েতে (নওশাদ সিদ্দিকীর আসন) দলীয় পতাকা লাগানোকে কেন্দ্র করে তৃণমূল ও সেক্যুলার ফ্রন্টের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। সে সংঘর্ষের জেরে কলকাতায় সমাবেশ হলে সেখান থেকে নওশাদ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তার করা হয়। নওশাদ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তারের পর পীরজাদারা সম্মিলিত প্রতিবাদের ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়া, এ ঘটনায় অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এর মধ্যে কৌতূহল জোগায় পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমি নওশাদ ভাইয়ের মুক্তি দাবি করছি’। ২০২১-এ আব্বাস সিদ্দিকীরা যখন রাজনীতিতে এসেছিলেন তখন দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, ‘আমার যদি নির্বাচনে লড়াই করার অধিকার থাকে, তবে আব্বাস সিদ্দিকীরও রয়েছে।’ বিজেপির মুসলমানদের রাজনৈতিক দল গঠনকে উৎসাহ এবং মুসলিম নেতাদের মুক্তির দাবি করার এই কৌশলের বিশেষ রাজনীতি রয়েছে।
ভারতের যে কটি প্রদেশের নির্বাচনে মুসলিম ভোট ফ্যাক্টর তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ একটি। পশ্চিমবঙ্গের প্রতি তিনটি ভোটের একটি ভোট মুসলিম ভোট। দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটি’র মতে, ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দু ভোটের ৫০ শতাংশ পেয়েছে বিজেপি। অন্যদিকে মুসলিম ভোটের ৭৫ শতাংশ পড়েছে তৃণমূলের বাক্সে। ফলে আর কিছুটা হিন্দু ভোট বাড়াতে পারলে এবং মুসলিম ভোট বিভক্ত করতে পারলে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ শাসন করার স্বপ্ন পূর্ণ হতে পারে। মুসলমান ভোট বিভক্ত করে বিজেপির জেতার এই কৌশল বেশ কটি রাজ্যে বেশ সফল হয়েছে।
আসামের মুসলমানদের রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ)। দলটি ২০১৬ সালের আসাম বিধানসভায় স্বতন্ত্র নির্বাচন করে। ফলে মুসলিম ভোট কংগ্রেস থেকে সরতে শুরু করে। মুসলিম ভোটের এই বিভক্তির ফলাফল যায় বিজেপির ঘরে। ২০১৬ সালের আসাম বিধানসভায় জয়লাভ করে আসামে সরকার গঠন করে বিজেপি, অথচ আসাম রাজ্যের মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ শতাংশ। আসামে মুসলিম ভোটের বিভক্তি বিজেপির জয়কে সহজ করে দেয়। আসামের সে ফর্মুলা পশ্চিমবঙ্গে বাস্তবায়ন করতে চায় বিজেপি।
নওশাদ সিদ্দিকীর দল ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’ যতই মমতার মুখোমুখি দাঁড়ায় ততই বিজেপির সুবিধা। কারণ একচেটিয়া (৭৫ শতাংশ) মুসলিম ভোটপ্রাপ্তি মমতাকে সর্বশেষ বিধানসভায় জয় এনে দিয়েছে। আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে ও ২০২৬-এর পরবর্তী বিধানসভাকে সামনে রেখে মমতার সঙ্গে মুসলিম কমিউনিটির দূরত্ব তৈরি করতে পারলে বিজেপির জেতার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে।
ভারতের ৫৩০ লোকসভা আসনের মধ্যে অন্তত ১০০ লোকসভা আসনে মুসলমান ভোট ম্যাটার করে। তাই শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা আসাম নয় সারা ভারতের যেসব জায়গা মুসলিম ভোট ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে, সেসব জায়গায় বিজেপি এই কৌশল নিয়েছে।
উত্তর প্রদেশের ২৪ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠী মুসলিম, অর্থাৎ সাড়ে চার কোটি মুসলমানের বাস উত্তর প্রদেশে। তুরস্কের পর সবচেয়ে বেশি মুসলিম বাস করে উত্তর প্রদেশে। অথচ বর্তমান সরকারে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য হলেও মুসলিম সম্প্রদায় থেকে কোনো বিধায়ক নেই। মুসলিম ভোট বিভক্তি করে মাত্র ২০১৭ সালে বিজেপি উত্তর প্রদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। সেবার ৪০৩টি বিধানসভা সিটের মধ্যে ৩২২টিতে জিতেছিল বিজেপি অথচ তাদের পপুলার ভোট ছিল ভোটের ৪০ শতাংশ। কীভাবে সাড়ে চার কোটি মুসলিম জনসংখ্যাকে পাশ কাটিয়ে বিজেপি নিরঙ্কুশ হিন্দু সরকার গঠন করছে উত্তর প্রদেশে! বিশ্লেষণ বলে দেয়, মুসলিম ভোট বিভক্তির কৌশলই বিজেপিকে নির্বাচন জিতিয়ে এনেছে।
বর্তমান উত্তর প্রদেশ সরকারের ৪০৩টি বিধানসভার সিটের মধ্যে বিজেপি জিতেছে ২৭৪টি, যা গতবারের চেয়ে ৪৮টি কম। আর বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টি জিতেছে ১২৪ আসন, যা গতবারের চেয়ে ৭২টি বেশি। ২৭৪টি আসনে জয় পাওয়া বিজেপির পপুলার ভোট ৪৫ শতাংশ আর ১২৪ আসন পাওয়া সমাজবাদী পার্টির পপুলার ভোট ৩৬ শতাংশ আবার মাত্র ১ আসন পাওয়া বহুজন সমাজবাদী পার্টির (বিএসপি) পপুলার ভোট ১৩ শতাংশ। কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে সমাজবাদী পার্টি ও বিএসপির মোট পপুলার ভোট হয় ৪৯ শতাংশ, যা বিজেপির চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি। অথচ তাদের আসনসংখ্যা হয় ১২৫টি, যা বিজেপির চেয়ে ১৪৯টি কম।
জওয়াহেরলাল নেহরুর জন্মভূমি উত্তর প্রদেশের বিধানসভায় কংগ্রেস কোনো সমীকরণে নেই। রাজ্যটি দীর্ঘদিন শাসন করেছে অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি ও মায়াবতির বহুজন সমাজ পার্টি। দু-দলই বিজেপির বিরোধিতা করলেও তাদের মধ্যে ন্যূনতম ঐক্য নেই। গত বিধানসভা নির্বাচনে মায়াবতির বহুজন সমাজবাদী পার্টি ৪০৩ জনের মধ্যে ১১৩ জন প্রার্থী দেয় মুসলিম কমিউনিটি থেকে। অখিলেশ যাদবের দল থেকে দাবি করা হয়, ‘বিজেপির বি টিম হয়ে কাজ করেছে বিএসপি, মূলত সমাজবাদী পার্টি থেকে মুসলিম ভোট সরিয়ে বিজেপিকে সুবিধা দিতে মায়াবতী এতজন মুসলিম প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন।’ বিজেপি থেকে মাত্র ৯ শতাংশ পপুলার ভোট কম পাওয়া অখিলেশ যাদবের এমন আক্ষেপ থাকতেই পারে।
তবে সে নির্বাচনে হায়দ্রাবাদের আসাদউদ্দীন ওয়াইসির দল অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম) গিয়েও হাজির হয়। তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র ও বিহারের বিধানসভায় আসন পাওয়ার পর দলটি উত্তর প্রদেশেও লড়াই করে। কোনো আসন জিততে না পারলেও বেশ কিছু মুসলিম ভোট বাক্সে পেয়েছিল, যা হয়তো পড়ত সমাজবাদী পার্টির বাক্সে। সমাজবাদীর এই আক্ষেপ আরও তীব্র হয় যখন দেখা যায় তাদের প্রার্থী অনেক আসনে হাজারেরও কম ভোটে বিজেপির প্রার্থীর কাছে হেরেছে। এভাবে এমআইএম, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেসে বিভক্ত হয়ে যায় ২০ শতাংশ মুসলিম ভোট। বিরোধীদের এমন বিভক্তি মূলত বিজেপিকে সহজ ও নিরঙ্কুশ জয় এনে দেয়।
মুসলিমদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে দিলীপ ঘোষদের আরও নানা ধরনের সমীকরণ রয়েছে। মুসলিমদের সেক্যুলার রাজনীতি থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের দিকে ঠেলে দিতে পারলে তাদের রাজনৈতিক সুবিধা হয়। এতে বিজেপি সমর্থকদের গরম বক্তব্য দিয়ে উজ্জীবিত রাখার সুযোগ পাওয়া যায়। মুসলিমদের বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত ও চিহ্নিত করা যাবে। অন্যদিকে কংগ্রেস ও বিজেপি বিরোধী দলগুলোর মুসলিম ভোটের কাঁধে সাঁকো পার করাও বন্ধ করা যাবে।
ভারতের রাজনীতিতে হিন্দুদের কট্টরতার উদাহরণ দিয়ে মুসলমান দলের জনপ্রিয়তা বাড়ানো এবং মুসলমানদের কট্টরতার উদাহরণ দিয়ে হিন্দু দলের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর এক ধরনের কৌশলও রয়েছে। হায়দ্রাবাদের মুসলিম রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম) দলটি বেশ পুরনো। কিন্তু ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বিজেপির মুসলমান বিরোধিতাকে কাউন্টার করে দলটি সারা ভারতের মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশ্লেষকরা বলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম না হলে বা পাকিস্তান ও ভারত জিন্নাহর ঘোষণা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার মতো বন্ধুবৎসল প্রতিবেশী হলে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় বসতে পারত না। (জিন্নাহর তথ্যসূত্র শশী থারুর, ২০১৮)। এখনো পাকিস্তানের জেনারেলের এক একটা হুমকি ভারতে হু হু করে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি করে।
ভারতে মুসলমানদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনও সেক্যুলার ভারতের জন্য সুখকর নয়। কারণ রাজনীতি ও ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। রাজনীতি বলে ক্ষমতার কথা, ধর্ম বলে বিশ্বাসের কথা। ক্ষমতার জাঁতাকলে প্রায়ই বিশ্বাস ধামাচাপা পড়ে যায়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে জনগণ ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করতে পারে না। ফলে ধর্মের আবেগে তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রায়শই যৌক্তিকভাবে নিতে পারে না। এই যুক্তি ও আবেগের মাঝখানে ভারতের মুসলিম ভোট ভাগ হয়ে যাচ্ছে কয়েক গ্রুপে। এই ভাগাভাগি মমতার তৃণমূল কংগ্রেস, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি বা রাহুল গান্ধীর জাতীয় কংগ্রেসের মুসলিম ভোটব্যাংকের নিরঙ্কুশতাকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দিচ্ছে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
বিশিষ্ট অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার, শব্দসৈনিক মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুভাষ দত্ত (৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০-১৬ নভেম্বর ২০১২) সর্বৈবভাবে ছিলেন একজন সৃজনশীল সত্তা, কুশলী কৃতবিদ, সৎ ও স্বচ্ছমনের অধিকারী। প্রায় এক যুগ আগে নিজের সহযাত্রী আত্মীয়ের সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার উপলব্ধির স্তরে এমন আলোড়ন সৃষ্টি হয় যে পরবর্তীকালে তিনি সর্ববাদী, সাত্ত্বিক সাধনায় নিবেদিত হন। তার ‘আলিঙ্গন’ ছবিতে এ ধরনের একটি চরিত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল আমাদের। তার মধ্যে আমরা এমন একটি চরিত্রের সন্ধান পাই যার কাছে সব ধর্ম ও মতের মধ্যে ঐকমত্যের মর্মবাণী অনুভূত হয়। রামকৃষ্ণ মিশনের অনুরক্ত অনুসারী, বেলুড়মঠের নরেন্দ্রপুরের আত্মিক সাধনার সাত্ত্বিক পুরুষ সুভাষ দত্ত‘মনরে চল নিজের নিকেতনে’ স্বামী বিবেকানন্দের এই ভূয়োদর্শনে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। সব ধরনের সংকীর্ণতা রহিত সুভাষ দত্ত সর্ববাদী মতাদর্শের ছিলেন। তিনি অকপটে লিখেছেন
‘আমি ধর্মান্ধ নই, আমার ভেতর কোনো সংকীর্ণতা নেই। আমি আজমির শরিফে গিয়েছি বেশ কয়েকবার। শাহজালাল, শাহপরান, শাহ মোস্তান, হাইকোর্টের মাজার, মিরপুরের মাজারএসব জায়গায় আমি গিয়েছি। টুপি পরে বা মাথায় পাগড়ি দিয়ে ধ্যান করেছি, মোনাজাত করেছি। আমি মিলাদ-মাহফিলে শরিক হয়েছি। চার্চে নতজানু হয়ে যিশুর সামনে প্রার্থনা করেছি, গিয়েছি বৌদ্ধ বিহারে।’
অনন্য সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী সুভাষ দত্তের শিল্পভাবনার শর্ত ও মূল্যবোধ ছিলজীবন-সংগ্রামে মুখর তুখোড় তৎপরতা শেষে শিকড়ের কাছে প্রত্যাবর্তন, নিজের উপলব্ধির কাছে ফিরে আসা। পৈতৃক নিবাস বগুড়ার সারিয়াকান্দি ধুনটের হাটশের গ্রামে আর লেখাপড়ার হাতেখড়ি দিনাজপুরে মাতুলালয়ে, বড় হয়েছেন সেখানে। নিজে পড়াশোনার পাঠ মাঝপথে চুকিয়ে ‘ফিল্মের টানে’ সুদূর বোম্বেতে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেখানে ‘অনেক কিছু’ করার পর দেশে, সেই দিনাজপুরেই ফিরেছিলেন। ‘জীবিকার শহর ঢাকায়’ তার পদার্পণ ১৯৫৩ সালের ২৩ নভেম্বর।
ঢাকায় সিনেমার প্রচারপত্র ও আর্ট ডিরেকশন এবং বাংলা-উর্দু ছবিতে কৌতুকপ্রদ চরিত্রে অভিনয় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন। অসম্ভব অনুসন্ধিৎসু এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী কঠোর পরিশ্রমী এই মানুষটির সব সময় আগ্রহ ছিল সৃজনশীল কিছু করার। জীবনকে যেমন দেখতেন তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তেমনি এর শিল্পিত রূপায়ণেও ভাবতেন বেশি। আর এর জন্য তার পড়াশোনা ও অধ্যবসায় শেষমেশ মেশে সেলুলয়েডের ফিতার ক্যানভাসে জীবনের নিত্যতাকে তুলে ধরার।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্প যখন পশ্চিম বাংলার সেরা সব বাংলা ছবি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ছবির প্রচন্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় নিরুদ্দেশ যাত্রী, এই ঢাকাতেও উর্দু ছবি নির্মাণের বন্যা বইতে শুরু করেছিল, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে রক্ত দিতে হচ্ছিল, স্বাধিকার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অয়োময় আকাক্সক্ষা যখন দানা বাধছিলসে সময় ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ ছবি নির্মাণ করে বাঙালির, বাংলা সংস্কৃতির, সৃজনশীলতার, মৌলিকত্বের মর্মমূলে যেন আত্মবিশ্বাসের বিজয় নিশান উড়িয়ে দিলেন। সুতরাং সবই নতুন-চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, সংগীত পরিচালক, গীতিকার, নায়িকা, নায়ক, প্রযোজক, এরা সবাই যেন এক কাতারে শামিল হলেননতুন পথের, প্রত্যয়দীপ্ত নবযাত্রার অভিষেক ঘটাতে।
সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প নেন ১৯৬২ সালের শেষের দিকে। পত্রিকায় সুতরাং বানানোর বিজ্ঞাপন দেখে বাংলাবাজারের মেসে বসবাসকারী জনৈক সত্যসাহা (১৯৩৪-৯৯) সত্যই সাহস করে এসে সুরকার হতে চাইলেন। সুভাষ দত্তের ভাষায়‘আমি সত্যসাহার দু-একটা পরীক্ষা নিলাম। কেমন সুর-টুর জানে। তারপর ছবির সিচুয়েশন নিয়ে বসলাম। বললাম এ ধরনের গান লাগবে আমার ছবিতে। সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। এটা হওয়ার পর আমি নায়িকা খুঁজব। যেহেতু আমি বেঁটে মানুষ। তাই ছোটখাটো একটা মেয়ে দরকার আমার বিপরীতে, নায়িকা হওয়ার জন্য।’
তার নায়িকা চট্টগ্রামের মিনা পাল। তার আবিষ্কারের কাহিনীটিও অভিনব।
‘আমি ছবির ষোলোটি দৃশ্যের স্কেচ এঁকে পাঠালাম। স্কেচ দেখে মীনার ছবি তুলে আনলেন সত্য সাহা। কয়েকটি ফটোগ্রাফ খুবই ভালো লাগল। বললাম, ঠিক আছে। ওকে আসতে বলো। তারপর মীনা তার বাপ এবং বোনদের নিয়ে ঢাকা এলো। এখন আমার দুই প্রোডিউসার ওকে দেখে হই চই করে উঠলেন। আরে, এ দেখছি খুবই ছোট মেয়ে। বাচ্চা মেয়ে। একে দিয়ে হবে নাকি। মীনা পাল ফ্রক পরা ছিল। আমি বললাম, ফ্রকটা ছেড়ে শাড়ি পরে এসো। ওরা নবাবপুরে, ঢাকা বোর্ডিংয়ে উঠেছিল। সে হোটেলে গিয়ে শাড়ি পরে এলো। দেখলাম ভালোই লাগছে। মুহূর্তে শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতির মতো মীনা পাল থেকে কবরী বেরিয়ে আসে। ওর চেহারার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ওর হাসি।’
তার সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মর্মবাণী হলো শিকড়ের কাছে ফিরে আসা। ‘সুতরাং’ ছবিতে তার নিজের অভিনীত চরিত্র সিপাহি জব্বার শহরে ব্যস্ত সমস্ত কর্মজীবন ছেড়ে ‘ওরে মন ছুটে চল মধুমতি গায়’, গাইতে গাইতে ফিরেছে গ্রামে। ‘কত ঘুরে এলাম কত দেখে এলাম অশান্ত মনে আমি ছুটে এলাম... আমার গায়ের মত কভু দেখিনি, সে যে আমার জন্মভূমি...’। ‘আলিঙ্গন’র সাধু বাবার মতো সুভাষ দত্ত তার শিল্পকর্মে, ‘বসুন্ধরা’য় সেই মাটির কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি প্রকাশ করেছেন। দেশিকোত্তম এই ব্যক্তিত্ব নিজের দেশ, মাটি ও মানুষকে সর্বোচ্চ মহিমায় দেখিয়েছেন। ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েও সেই অভিনয় সুনামের সুবাদে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের শ্রদ্ধা ও সমীহবোধের কারণে মুক্তি পেয়েছিলেন। নিজের সেই মুক্ত পাওয়ার স্মৃতিকে ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষীতে’ আনোয়ার হোসেনের অভিনয়ের মধ্যে তুলে ধরেছেন।
‘সুতরাং’ ছবিতে নিজের প্রেমিকা জরিনার মাতৃহারা সন্তানকে লালনপালনের দায়িত্ব নেওয়ার ঔদার্য যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি ১৯৭২ সালে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের সামাজিক পুনর্বাসনে রেখেছেন মানবীয় দর্শনের ব্যাখ্যা ও সমাধানের প্রেরণা। অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকীর ‘গলির ধারের ছেলেটি’র চলচ্চিত্রায়ণে (ডুমুরের ফুল) একই সঙ্গে শিশু মনস্তত্ত্বের ও মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গির এমন কাব্যিক শোকগাথা নির্মাণ করেন, যা একটি ধ্রুপদি শিল্পকর্মে উন্নীত হয়। ‘আবির্ভাব’ ও ‘ ‘বসুন্ধরা’ ছবিতে সন্তানময়ী মায়ের আবেগ ও আকিঞ্চন আকাক্সক্ষাকে শৈল্পিক তুলিতে বিমূর্ত করেছেন। তার তাবৎ চলচ্চিত্রেই মানবিক মূল্যবোধের, সমাজ দর্শনের, এবং নিবিষ্ট চিন্তা-চেতনার ভাষ্যে বাক্সময় হয়ে উঠেছে।
নারীশিক্ষার অগ্রদূত মহীয়সী মহিলা বেগম রোকেয়ার ওপর সরকারি অনুদানে তার নির্মীয়মাণ শেষ ছবি শেষ করার ব্যাপারে তিনি বিশেষ আগ্রহী ছিলেনএ ছবিতে তিনি বেগম রোকেয়ার সামাজিক ভূমিকাকে বিশেষ ব্যঞ্জনায় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকে ‘বেগম রোকেয়ার সামাজিক ভূমিকা’ শীর্ষক আমার একটি প্রবন্ধ পড়ে এ ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ বোধ করেছিলেন। সামাজিক গবেষণার প্রতি তার নিষ্ঠা ছিল, প্রচুর পড়াশোনা করতেন। দুর্ভাগ্য, অলঙ্ঘনীয় জটিলতার আবর্ত ও অবগুণ্ঠন থেকে বেগম রোকেয়ার ওপর ছবিটি নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা সুনিশ্চিত করা যায়নি। এ নিয়ে তিনি প্রায়ই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতেন। কালজয়ী এক সৃজনশীল কাজের অপ্রকাশের এই অব্যক্ত বেদনাবোধ নিয়েই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
সুভাষ দত্ত একজন মহৎপ্রাণ শিল্পী ছিলেন। চলচ্চিত্রকে শিল্প মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে তার প্রয়াসের যেমন অন্ত ছিল না, আবার তার হাতেই বাংলা চলচ্চিত্রে পুঁজি বিনিয়োগের সার্থকতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বলাবাহুল্য, তিনিই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে নাবালকত্ব থেকে সাবালকত্বে, উর্দু ছবির ভাববন্ধন থেকে বাংলা ছবিকে রক্তমাংসসহ সবল-সতেজ ও শিল্প বিনিয়োগ উপযোগী করে তোলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। পুরো ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি।
লেখক: সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্ত এলাকার কয়েকটি শহর ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ১৯ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তুরস্কের ভূমিকম্পের খবর গণমাধ্যমে এভাবে এসেছে, ‘ঘুমন্ত দুই দেশে মৃত্যুর সকাল। তখন ভোররাত। বাইরে ঝিরিঝিরি তুষার পড়ছে। তীব্র শীতে ঘরের উষ্ণতায় বেশির ভাগ মানুষই গভীর ঘুমে। কিন্তু সে ঘুম যে আর ভাঙবে না তা জানা ছিল না হাজারো মানুষের। সোমবার ভোর সোয়া ৪টার সময় তীব্র ভূমিকম্পের আঘাতে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে ঘরবাড়ি। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বহু শহরের বাসিন্দারা।’
মানুষের কর্মকুশলতা পরীক্ষার জন্য আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন ‘জীবন ও মৃত্যু’। সুরা মুলকের সূচনায় আছে, ‘আল্লাহ জীবনের আগেই মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন।’ আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন নানাভাবে। মানুষ অনিবার্য কিয়ামতের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা এক মহাপ্রলয়ংকরী ভূমিকম্প। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন প্রবল কম্পনে জমিন প্রকম্পিত করা হবে। আর জমিন তার ভার বের করে দেবে। আর মানুষ বলবে, এর কী হলো? সেদিন জমিন তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে।’সুরা জিলজাল : ১-৪
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত পাঠ করলেন এবং বললেন, ‘তোমরা জানো, পৃথিবীর বৃত্তান্ত কি? সাহাবিরা (রা.) বললেন, আল্লাহ এবং তার রাসুলই ভালো জানেন। নবী করিম (সা.) বললেন, তার বৃত্তান্ত এই যে, নর অথবা নারী এ মাটির ওপর যা কিছু করছে এই মাটি তার সাক্ষী দেবে। আর বলবে, অমুক অমুক ব্যক্তি অমুক অমুক দিনে অমুক অমুক কর্ম করেছে।’মুসনাদে আহমদ : ২/৩৭৪
বস্তুত ভূকম্পনের মাধ্যমে আল্লাহ তার বান্দাদের সতর্ক করেন, যাতে তারা অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর পথে ফিরে আসে। এই সঙ্গে আমাদের অবশ্যই চিন্তা করা উচিত, কেন এত ভূমিকম্প হচ্ছে? মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনগুলো পাঠাই।’সুরা বনি ইসরাইল : ৫৯
বাংলাদেশেও মাঝেমধ্যে ভূমিকম্প হয়। তখন দেখা যায়, ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে লোকজন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটাছুটি করছে। কেউ কেউ তো নিজেকে বাঁচাতে বহুতল ভবন থেকে লাফ দিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। সামান্য সময়ের ভূমিকম্প শুরু ও শেষ হওয়ার পর অল্প কিছু মানুষ ছাড়া অধিকাংশের কাজ ছিল ভূমিকম্পের সময় কার কী অবস্থা হয়েছিল এবং ভূমিকম্পের আশঙ্কা কোথায়কতটুকু আছে এসব নিয়ে আলোচনা। বড় একটি অংশকে দেখা গেছে, ভূমিকম্পের দশ-পনেরো মিনিট পর থেকেই ফুর্তি ও আনন্দের আমেজ নিয়ে উল্লাস করতে। যেন এটা তেমন কিছুই নয় এবং এতে সতর্ক হওয়ার কিছুই নেই। অল্প কিছু মানুষ এ সময় অন্যান্য সতর্কতার পাশাপাশি তওবা-ইস্তেগফার করেছেন। মনেপ্রাণে আল্লাহকে ডেকেছেন, আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছেন। ভূমির কম্পনের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে পাপ ত্যাগ করে ভালোর পথে প্রত্যাবর্তন ও অনুতাপের কম্পন অনুভব করেছেন।
ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয়কর একটি কুদরতি দুর্যোগ যখন চলে আসে, তখন কোনো মানুষেরই কিছুই করার থাকে না। বিজ্ঞানের এত উন্নতি সত্ত্বেও কোনো পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয় না। এটা অবশ্যই আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সতর্কীকরণ। তার পরও দেখা যায়, সমাজের একটি বড় অংশ এমন একটা গা-ছাড়া অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, এতে কোনোভাবেই সতর্ক ও অনুতপ্ত হওয়ার মতো কোনো বোধ জাগ্রত হতে চায় না। অথচ মুমিনের অবস্থা এমন হওয়ার কথা নয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায় এ বৈশিষ্ট্য কাফের ও মুনাফিকদের। সুরা তওবার ১২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা কি লক্ষ করে না, প্রতি বছর তারা দু-একবার বিপর্যস্ত হচ্ছে। অথচ তারা এর পরও তওবা করে না কিংবা উপদেশ গ্রহণ করে না।’
বান্দা তো সর্বাবস্থায় অসহায়। একটু সমস্যায় পড়লেই সেটা টের পাওয়া যায়। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিকম্পসহ নানা পর্যায়ের বিপদে সেটা অনুভব করা যায়। মুমিন বান্দার কাজ এমন অসহায় অবস্থায় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা এবং জীবনব্যাপী করতে শেখা।
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ছোট-ছোট বিপদাপদরূপে কিছু শাস্তি যখন আসে, তখন আল্লাহর কথা স্মরণ হওয়া, অন্তরে তার ভয় জাগ্রত হওয়া, তার দিকে ফিরে আসা কাম্য। তাহলে মৃত্যুর আগেই মানুষ তার রবের পরিচয় পেয়ে যায় এবং আখেরাতের শাস্তি থেকে নাজাত পেয়ে যায়। পক্ষান্তরে ছোট-ছোট বিপদে মানুষ যদি সাবধান না হয়, এমনকি অন্যের ওপর পতিত বড় বড় বিপদ কিংবা প্রাণঘাতী বিপদেরও নানা ‘ব্যাখ্যা’ দাঁড় করিয়ে দয়াময় আল্লাহকে ভুলে থাকার চেষ্টা করে, সেটাই ‘অন্তরের কাঠিন্য।’ যা মানুষের জন্য অতি বড় বিপদ এবং ভয়াবহ বিপদের পূর্বাভাস। এ অবস্থার আরেক নাম ‘আল্লাহর পাকড়াও সম্পর্কে নির্ভয় ও বেপরোয়া হওয়া।’ কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর পাকড়াও সম্পর্কে নির্ভয় তো হয় শুধু ক্ষতিগ্রস্ত লোকরা।’সুরা আরাফ : ৯৯
আল্লাহতায়ালার পাকড়াও সম্পর্কে নিশ্চিন্ত ও বেপরোয়া হওয়া কবিরা গোনাহসমূহের একটি। সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘সবচেয়ে বড় গোনাহ চারটি। আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, আল্লাহর পাকড়াও সম্পর্কে বেপরোয়া হওয়া, তার ক্ষমা ও করুণা সম্পর্কে নিরাশ হওয়া, তার দয়া ও দান সম্পর্কে আশাহীন হওয়া।আল মুসান্নাফ, আবদুর রাযযাক : ১৯৭০১
বর্তমানে পৃথিবীর নানা স্থানে বিধ্বংসী ভূমিকম্প, প্রলয়ংকরী বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত তুষারপাত, ধ্বংসাত্মক ভূমিধস ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। এগুলো মহান আল্লাহর প্রেরিত সতর্ককারী নিদর্শন বৈ অন্যকিছু নয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে বিপদ-আপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই। আর আল্লাহ তোমাদের অনেক (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন।’সুরা শুরা : ৩০
তাই যখন কোথাও ভূমিকম্প হয়, সূর্যগ্রহণ হয় কিংবা ঝড়ো বাতাস অথবা বন্যা হয়, তখন মানুষের উচিত আল্লাহতায়ালার কাছে অতি দ্রুত একনিষ্ঠভাবে তওবা করা। তার কাছে আত্মসমর্পণ করা, নিরাপত্তা চাওয়া, আশ্রয় লাভের জন্য দোয়া করা। দয়াময় আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। সমাজে প্রচলিত জিনা-ব্যভিচার, অন্যায়-অবিচার রোধ করা।
প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ মানুষের অপকর্ম। এগুলোর পথ ধরেই মানুষ কিয়ামতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সতর্ক করে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যখন জাতির নিকৃষ্ট ব্যক্তি তাদের নেতা হবে, ক্ষতির ভয়ে মানুষকে সম্মান করা হবে, সে সময় তোমরা অপেক্ষা করো রক্তিম বর্ণের ঝড়ের (অ্যাসিড বৃষ্টি), ভূকম্পনের, ভূমিধসের, রূপ বিকৃতির (লিঙ্গ পরিবর্তন) পাথর বৃষ্টির এবং সুতো ছেঁড়া (তাসবিহ) দানার মতো একটির পর একটি নিদর্শনগুলোর জন্য।’জামে তিরমিজি
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
আইনজীবী, সমাজকর্মী ও ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার নওয়াপাড়ায় ১৮৬১ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮৮০ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ এবং ১৮৮৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে তিনি বিএল পাস করে রাজশাহীতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। গবেষণা ও ইতিহাসচর্চায় তার প্রবল আগ্রহ ছিল। তিনি বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস, শিল্পকলা ও পটশিল্প সম্পর্কে গভীর ও প্রামাণিক জ্ঞান অর্জন করেন। ঐতিহাসিক চিত্র শিরোনামে সিরাজউদ্দৌলা, মীর কাসিম, রানী ভবানী, সীতারাম প্রমুখ ব্যক্তিকে নিয়ে ইতিহাসবিষয়ক প্রথম বাংলা সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করেন। বরেন্দ্রবাসীর গৌরবময় অতীত সম্পর্কে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করতে তিনি সম্মিলিতভাবে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন এবং বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন। রাজশাহী পৌরসভার কমিশনার থাকাকালে তিনি রাজশাহীর নাগরিক সুবিধা-সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করেন। ডায়মন্ড জুবিলি ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলের সূচনালগ্নে তিনি এ প্রতিষ্ঠানকে যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। এমনকি স্কুলের অবৈতনিক প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি ছাত্রছাত্রীদের রেশম চাষ পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। বেশ কিছুসংখ্যক সংস্কৃত নাটকের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড় ও চিত্রকর হিসেবেও তার পরিচিতি ছিল। ১৯৩০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
যদি কেউ প্রশ্ন করেনশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কী? এক কথায় বিষয়টি ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। তবেআমাদের দেশের বাস্তবতা, শিক্ষা সম্পর্কে আলাদা ব্যাখ্যা দেয়। এখানে পুথিগত বিদ্যালাভই শিক্ষা। এর মানে, সার্টিফিকেট!
মানবিকতা, ভব্যতা, পরমতসহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার এবং শ্রদ্ধাবোধের সমন্বয় হচ্ছে সভ্যতা। বিদ্যাগ্রহণের ফলে আপনাতেই হৃদয়ে জন্ম নেয় এসব বোধ। মানুষ আলোকিত হয়ে ওঠে। তখন স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষ বিনয়ী হয়ে ওঠেন। অপরকে ভালোবাসেন। জড়িয়ে নেন অপার আনন্দে। শিক্ষার আলোয় মানুষ জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে। পানি মেশানো দুধ খেতে দিলে একটি হাঁস যেমন শুধু দুধটুকু খেয়ে নেয়, থাকে শুধু পানি। শিক্ষা তাই-ই। গ্রহণ এবং বর্জনের আলোকিত চিন্তার ক্ষমতাই শিক্ষা। নইলে, কোনো অর্জন সম্ভব নাসমস্তই বিসর্জন।
এইচএসসির ফল প্রকাশিত হয়েছে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করা এসব ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। যাদের সামর্থ্য বেশি তারা উচ্চশিক্ষায় যাবেবিদেশ। কিন্তু ভালো রেজাল্ট করা ছেলেমেয়ের মধ্যে বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করার সামর্থ্য কত শতাংশ মানুষের আছে? দেশে যারা থাকছে তাদের মধ্য থেকেই বা কত শতাংশ সুযোগ পাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার? আবার এরপর রয়েছে চাকরি। সেই সোনার হরিণ ধরতে পারছে কতজন! গতকাল ৯ ফেব্রুয়ারি দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৮৭ জন। পাস করেছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৮৭ জন। পাসের হার ৮৫.৯৫ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। এটি মোট উত্তীর্ণের ১৭.৪২ শতাংশ। এই যে প্রতি বছর লাখ লাখ ছেলেমেয়ে কলেজ থেকে বের হচ্ছে, তারা যাচ্ছে কোথায়? কত শতাংশ ছেলেমেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে? আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে পড়ানোর সামর্থ্য কত শতাংশ পরিবারের আছে?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমিত আসনের বিপরীতে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে থাকছে ভর্তির অপেক্ষায়। তাদের মধ্যে সামর্থ্যবান পরিবারের ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর বাকি ছাত্রছাত্রী! কোনো গবেষণা হয়েছে? খোঁজ নিলে জানা যাবে এদের কারও বিয়ে হয়েছে। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে কেউ নাম লিখিয়েছে চাকরিতে।
৫০, ৬০, ৭০-এর দশক পর্যন্ত এই ভূখন্ডের রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্রদের হাতে। ফলে, বাঙালির প্রধান তিন অর্জনবায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, শুরু করেছে ছাত্ররাই। এমনকি ৯০-এর গণ-আন্দোলনেও ছাত্রদের মুখ্য ভূমিকা ছিল। এ এক দীর্ঘ করুণ অধ্যায়। ‘অশুভ-কাল’ ছায়া গ্রাস করেছে ছাত্রসমাজকে। সেই কাল-প্রেতাত্মা জানে ছাত্রশক্তিকে বিভ্রান্ত, আদর্শচ্যুত এবং অর্থলোভে আকৃষ্ট করতে পারলে এই জনগোষ্ঠী থেকে মঙ্গলকর, জনকল্যাণকর কোনো ইতিহাসের জন্ম নেবে না। অনেক হয়েছে, এবার স্থবির থাকুক বাংলাদেশের ইতিহাস! বাস্তবে অনেকটা তাই হচ্ছে। এখন ছাত্ররা কীসে মুগ্ধ হয়? কী, ভীষণ প্রয়োজন তার? গবেষণা করলে দেখা যাবেঅধিকাংশ ছাত্র এখন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবে। সেখানে অন্য কেউ নেই। সমাজ-সংস্কৃতি গোল্লায় যাক! তাতে আমার কী?
জাপানে অপরাধ০ ভাগ! এমন সমাজব্যবস্থার ভিত্তি কীভাবে হলো? মানে, সবার মানসিকতা এত উন্নত হলো কীভাবে! দেখা যাবে এই নৈতিকতার শিক্ষা সে পেয়েছে স্কুল জীবনেই। আশা জাগানিয়া হচ্ছে জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা, বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে। তবে বেসরকারিভাবে। ‘কুমন পদ্ধতি’র মাধ্যমে শিশুরা এমন কিছু শিখবে, যা জীবনের জন্য ভীষণ দরকার। ক্লাসে প্রথম হওয়া বা এ-প্লাস পাওয়া জরুরি নয়। প্রয়োজন বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং আত্মবিশ্বাস।
বিদ্যালাভে মানুষই উন্নত হয়। সেই-ই উন্নত যে নিজেকে উন্নত করার পাশাপাশি অন্যের কথাও ভাবে। ‘একা’ উন্নত হলে কোনো লাভ নেই। সমাজ উন্নত না হলে এই আমি বিচ্ছিন্ন হব সমাজ থেকেই। তখন বিদ্যা থেকে ‘বিনয়’ তিরোহিত হতে বাধ্য।
শনিবার ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭১ সালের এ দিন শেষে এক বিভীষিকাময় ভয়াল রাত নেমে এসেছিল। এদিন মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন এবং সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনা সভা হবে। এ ছাড়াও সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনের মিনিপোলগুলোতে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বাদ জোহর দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই নাম অপারেশন সার্চলাইট।
এ অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। অনেক পরে, ২০১২ সালে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অ·ফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।
অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিচারণ করে রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউজে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত করি।’ পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট।
যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হলো আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভ‚মি।’
পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্তে¡ও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। এদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারযোগে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসেন।
ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজীর জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্বে থাকা সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থেও এ সংক্রান্ত একটি বিবরণ পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল নিয়াজীর পাশেই ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অনুগত পাকিস্তানি হিসেবে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার চক্রান্ত তিনি খুব কাছে থেকেই দেখেছেন। ২৫ মার্চ, অপারেশন সার্চলাইট শুরুর মুহ‚র্ত নিয়ে তিনি লিখেন ‘নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এমন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহ‚র্ত (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল।’
পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
কাল ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা দিবস। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হতে পুরোপুরি প্রস্তুত সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। দিনটি উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দিনের প্রথম প্রহর থেকে মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ফুলে ফুলে ভরে উঠবে স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদি। দিনটি উপলক্ষে এর মধ্যে জাতীয় স্মৃতিসৌধকে ধুয়ে-মুছে, ফুল আর রং-তুলির আঁচড়ে প্রস্তুত করেছে গণপূর্ত বিভাগ।
গণপূর্ত বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, দিনটি উপলক্ষে স্মৃতিসৌধের মিনার থেকে শুরু করে পায়ে চলার পথ সবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। রং-তুলির আঁচড় পড়েছে ফুলের টপসহ না স্থাপনায়। এর মধ্যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ধুয়ে-মুছে প্রস্তুত রেখেছে গোটা সৌধ এলাকা।
স্বাধীনতা দিবসে সৌধ এলাকা ছাড়াও পুরো উপজেলায় সেজেছে নতুন সাজে। সড়ক-মহাসড়ক ছাড়াও ভবনগুলো সাজানো হয়েছে লাল-সবুজ বাতিতে।
সাভার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাজহারুল ইসলাম বলেন, দিবসটি পালন করতে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর উপজেলা চত্বরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেওয়া হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন আয়োজন করেছে নানা অনুষ্ঠান।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাদা পোশাকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করছেন। গোটা সৌধ এলাকায় বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। এ ছাড়াও সড়ক-মহাসড়কে বসানো হয়েছে নিরাপত্তাচৌকি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার নির্যাসে ভাববাদী গীতি ও চারণ কবিরা, সাধু সন্ন্যাসীরা যে বাণী ও বয়ান রেখে গিয়েছেন তা অনুভবের আয়নায় প্রতিফলনের সময় ফুরিয়ে যায় না। কেননা ‘দিন থাকতে দ্বীনের সাধনা’র কথা ভুলিয়ে দেওয়ার প্রথম প্রয়াস আদি মানব মানবীর জীবনে স্বর্গ থেকে বিদায়ের কারণ হিসেবেই এসেছিল, এখনো যা আছে অব্যাহত। শিক্ষা নেওয়ার জন্যই ইতিহাস অধ্যয়ন, সময়ের উত্থান পতনের পটভূমি বোঝাবার জন্য অতীত রোমন্থন, কিন্তু সেই ইতিহাস যদি প্রতিষ্ঠা ও নির্মাণের নামে চর্বিত চর্বনে বিকৃত বিকারগ্রস্ত করা হয় তাহলে অতীত অনুসরণের মৌল ভূমিকায় ঘটে বিপত্তি। যে অনুসরণ বারবার ভুলিয়ে দিয়ে যায় সময়ের প্রবহমানতাকে, অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে বর্তমানকে দায় দায়িত্বহীন করার প্রয়াস প্রচেষ্টায় ভবিষ্যতের জন্য শুধু অন্ধকার অপেক্ষা করে। মানব সভ্যতার উত্থান বিকাশ ও পতনের নাড়ি নক্ষত্র ঘাঁটলে এ সত্যটাই বেরিয়ে আসে যে, মানুষই সভ্যতা সমৃদ্ধির স্রষ্টা, আবার এই মানুষই তার ধ্বংসকারী। বলাবাহুল্য মানুষই মানুষের শত্রু, যে শত্রুতা আদি মানব-মানবীর প্রথম সন্তানেরা পোষণ করতে প্ররোচিত হয়েছিলেন অশুভ প্রবণতা প্রবৃত্তির দ্বারা। এ প্ররোচনা এখনো চলছে, চলছে বলেই স্বার্থান্ধ হয়ে অতীতের কাছে আশ্রয় মাঙতে গিয়ে বর্তমানকে উপেক্ষার উপলক্ষ মিলে যায় এবং ভবিষ্যৎ কেন কীভাবে অগ্রসরমান হবে সে বিবেচনার সুযোগ হয় হাতছাড়া। এ কথা মাথায় রাখতে হবে যে আজকের বর্তমানই একদিন অতীত হবে, বর্তমানকে সময়ের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং ভবিষ্যতে এখনকার কর্মসাফল্য দিয়ে তখনকার জাত কুল মান রক্ষা করা কঠিন হবে।
আত্মশুদ্ধি আর খোদার নৈকট্য অর্জনের অসীম রহমত ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান আমাদের মধ্যে সমুপস্থিত। আল কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মাহে রমজানে রোজা পালন বা সিয়াম সাধনাকে ‘পরহেজগারি অর্জনের জন্য’ ফরজ বা অবশ্য পালনীয় বলে বিধান দিয়েছেন। বলা হয়েছে ‘পূর্ববতী সম্প্রদায়ের জন্যও একই বিধান ছিল।’ অর্থাৎ রোজা পালন শুধু কোরআনের বিধান ঘোষিত হওয়ার পর থেকে প্রবর্তিত হয়নি। আত্মশুদ্ধি ও বিধাতার নৈকট্য লাভের জন্য কৃচ্ছ্র সাধনের এই এবাদত হিসেবে শুধু ইসলামেই নয়, স্থান কাল পাত্র ভেদে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মিক নির্বাণ লাভের এ সাধনা বিদ্যমান।
সিয়াম সাধনায় আত্মশুদ্ধির চেতনা জাগ্রত হয়। কর্মফলের দ্বারা আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতের স্থায়িত্বের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে, আল কোরআনের এ ঘোষণা উপলব্ধি থেকেই আত্ম তাগিদ অনুভূত হয়। ৮ সংখ্যক সুরা আনফাল-এর ৫৩ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে ‘যদি কোনো সম্প্রদায় নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করে তবে আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তাদের যে সম্পদ দান করেন তিনি তা পরিবর্তন করবেন’। ১৩ সংখ্যক সুরা আর রা’দ-এর ১১ আয়াতে আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘মানুষের জন্য তার সম্মুখে ও পশ্চাতে একের পর এক প্রহরী থাকে; তারা আল্লার আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে। এবং আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।’
আল্লাহ্র নিয়ামত স্থায়িত্বের যে নিয়ম বা মূল নীতি তা হলো কোনো ব্যক্তি বা জাতিকে যে নেয়ামত দান করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা ফিরিয়ে নেওয়া হয় না, যে পর্যন্ত না নিজের বা নিজেদের অবস্থা ও কার্যকলাপকে পরিবর্তিত করে আল্লার আজাবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সুতরাং নেয়ামত প্রাপ্তির পর তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা, সচেতন দায়িত্ব পালনের দ্বারা এর মর্যাদা রক্ষা করা এবং নিজেদের মধ্যে সংশোধনীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
কোনো কোনো সময় আল্লাহ্ তায়ালা তার নিয়ামত এমন কোনো কোনো লোক বা সম্প্রদায়কে দান করেন, যে তার নিজের বা নিজেদের আমল বা কর্মের দ্বারা তার যোগ্য নয়, কিন্তু প্রদত্ত হওয়ার পর যদি সে নিজের আমল বা কর্মধারা সংশোধন করে কল্যাণের দিকে ফেরানোর পরিবর্তে মন্দ কাজের দিকে আরও বেশি উৎসাহী হয়ে পড়ে, তখন প্রদত্ত নিয়ামত তার বা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
আল্লাহমানুষকে বিবেক বুদ্ধি ও ভালো মন্দ জ্ঞানসহ সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তার প্রিয় বান্দা বিপথগামী হয়ে তার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হোক এটা তিনি চান না, তা সত্ত্বেও কেউ সঠিক ও কল্যাণের পরিবর্তে মন্দ ও অভিশপ্ত পথ নির্বাচন এবং সেখানে অনড় অবস্থান করলে; আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তার আনুগত্য ত্যাগ করে কুকর্ম, কুচরিত্র ও অবাধ্যতার পথ বেছে নিলে তার পরিণতি হয় দুঃখজনক। যে গজব নেমে আসে তা থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় থাকে না। কোনো ব্যক্তি বা জাতির জীবনে কল্যাণকর পরিবর্তন ততক্ষণ পর্যন্ত সূচিত হয় না, যতক্ষণ এই কল্যাণকর পরিবর্তনের জন্য নিজেদের অবস্থা সংশোধন করে নিজেদের তার যোগ্য করে না তোলা হয়।
আল কোরআনের ২৫ সংখ্যক সুরা আল ফোরকানের ৬৩ থেকে ৭৭ নম্বর আয়াতসমূহে আত্মশুদ্ধি লাভের কয়েকটি গুণ ও দোষের লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে। প্রথম ৬টি গুণাবলির মধ্যে আনুগত্যের মূলনীতি এবং পরবর্তী গুণাবলিসমূহ গোনাহ ও অবাধ্যতা থেকে পরিত্রাণ প্রত্যাশার/প্রচেষ্টার নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে।
১) নিজের বিশ^াস, চিন্তাচেতনা, ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা, আচার-আচরণ ও স্থিরতাকে সৃষ্টিকর্তার আদেশ ও অভিপ্রায়ের অনুগামী রেখে তার আদেশ-নিষেধ পালনের জন্য সদা সচেষ্ট থাকা।
২) নম্রতা সহকারে চলাফেরা করা চলন-বলন আচার-আচরণে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। যে পালনকর্তার ভরসা করে না এবং সবসময় দুনিয়ার লাভ-লোকসানের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকে, সে সব সময় বিভ্রান্তিতে থাকে, দুঃখই ভোগ করে।
৩) কথাবার্তায় নিরাপত্তার সঙ্গে সব সময় সচেতন থাকা উচিত। সালামের জবাব দেওয়া, কারও মনে আঘাত লাগতে পারে, বিরূপ ভাব ও সংক্ষোভের উদ্রেক করতে পারে এমন সংলাপ পরিহার করা। সুবচন ও সুশীল আচরণ কখনই বিত-ার জন্ম দেয় না।
৪) ইবাদতে রাত্রি জাগরণ। যে সময় নিদ্রা ও বিশ্রামের সে সময়ে কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও নামাজে দাঁড়ানোর মতো উত্তম কিছুই নেই। এ ইবাদত লোক দেখানোর জন্য নয় এবং এখানে নাম-যশের আশঙ্কা নেই।
৫) দিবারাতে ইবাদতে মশগুল হয়েও নিশ্চিত হয়ে বসে না থাকা। আল্লাহকে ভয় করা, জীবিকা অন্বেষণ ও তার সাহায্য কামনা করা।
৬) ব্যয় করার সময় অপব্যয় না করা, আয়-ব্যয়ের মধ্যে সমতা বজায় রাখা। বৈধ ও অনুমোদিত কাজে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করাও অন্যায় এবং অপব্যয়। রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, ব্যয় করতে গিয়ে মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করা মানুষের বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। যে ব্যক্তি ব্যয়ের সময় মধ্যবর্তিতা ও সমতার ওপর কায়েম থাকে, সে কখনো ফকির ও অভাবগ্রস্ত হয় না।
৭) শিরক সর্ববৃহৎ গোনাহ। দুনিয়ার ভালোমন্দে কাউকে নিয়ন্ত্রক ভাবাও শিরক।
৮) কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা না করা এবং ব্যভিচারের নিকটবর্তী না হওয়া।
৯) তওবা করা। কঠোর অপরাধী যদি তওবা করে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে সৎকর্ম করতে থাকে, তবে আল্লাহ তার মন্দ কর্মসমূহকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন।
১০) মিথ্যা ও বাতিল মজলিশে যোগ না দেওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়া। যদি কেউ মিথ্যা ও বাতিল মজলিশের নিকটবর্তী হয়ে পড়ে তবে গাম্ভীর্য ও ভদ্রতা সহকারে তা এড়িয়ে বা পরিহার করে চলে যাওয়া উচিত।
১১) আল্লার আয়াত ও শরিয়তের বিধানাবলি শুধু পাঠ করা যথেষ্ট নয়, শ্রবণশক্তি ও অন্তদৃষ্টি-সম্পন্ন মানুষের উচিত এগুলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা।
১২) নিজ সন্তান-সন্ততি ও স্ত্রীর জন্য আল্লার কাছে দোয়া করা। তাদের আল্লাহর আনুগত্যে মশগুল দেখা।
কোনো কিছুর বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকা উচিত। মাত্রা অতিক্রম করলে অনেক ভালো জিনিস মন্দ রূপ বা আকার ধারণ করতে পারে। যেমন মাত্রা অতিক্রম করলেই সাহস হঠকারিতায়, আত্মউৎসর্গ আত্মহত্যায়, প্রতিযোগিতা হিংসায়, ধর্মভীরুতা ধর্মান্ধতার পরিণত হতে পারে। অবস্থা বিশেষে সমালোচনা পরচর্চায়, প্রশংসা চাটুবাদে, তেজ ক্রোধে, দেশপ্রেম দেশদ্রোহিতার স্তরে নেমে আসতে পারে। সব দেশ সমাজ সংসারে, রাজনীতি সমাজনীতি অর্থনীতির অবকাঠামোয় এটি প্রায়শই লক্ষ করা যায়।
নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রা যেমন সবার পছন্দ তেমনি সুরের মধ্যে পঞ্চম-স্বরই মিষ্ট এবং শ্রেষ্ঠ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বারবার বলেছেন তোমরা কোনো কিছুতেই সীমালঙ্ঘন কোরো না। আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না। লোকমান হাকিম তার ছেলেকে উপদেশের ছলে বলেছেন, ‘মাটিতে হাঁটবে মধ্যম মেজাজে আর তোমার স্বর হওয়া উচিত মোলায়েম, স্বরের মধ্যে গাধার স্বরই নিকৃষ্ট।’
করোনাকালে এ শিক্ষা সবাই পেয়েছে যে, স্বাস্থ্যবিধি মানা মানে খাওয়া-দাওয়া, চলাচলে, চাওয়া-পাওয়ায়, মেলামেশা, আগ্রহ-আকাক্সক্ষার ক্ষেত্রে একটা পরিমিত বোধ মেনে চলা। নিয়মনিষ্ঠা পালন ও সহনশীলতা প্রকাশ যে কোনো বিশৃঙ্খল পরিবেশে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারে। অধিক ভোজনেই অধিকাংশ রোগবালাইয়ের কারণ। মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। অধিক পরিশ্রমে মন ও শরীর ভেঙে পড়ে। অতি কথনে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। অতিরিক্ত সব কিছু খারাপ। অতিভক্তি চোরের লক্ষণ এর চেয়ে সত্যবাক্য আর নেই।
লেখক: সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান
মানহানির মামলায় দণ্ডিত কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধীকে লোকসভায় অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার লোকসভা সচিবালয় তাকে অযোগ্য ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। অযোগ্য ঘোষিত হওয়ায় তার পার্লামেন্টের সদস্যপদও খারিজ হয়ে গেল। কংগ্রেস নেতা রাহুল লোকসভায় কেরালার ওয়েনাড আসনের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন।
এনডিটিভি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, রায় ঘোষণার দিন থেকেই রাহুল আর পার্লামেন্টের সদস্য থাকার যোগ্য নন বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কর্ণাটকের কোলারে এক জনসভায় পলাতক ব্যবসায়ী নীরব মোদি ও ললিত মোদির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির নামের মিল থেকে প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেছিলেন রাহুল। ‘সব চোরের পদবি মোদি হয় কী করে’ রাহুলের এই মন্তব্যের জেরে বিজেপি বিধায়ক ও গুজরাটের সাবেক মন্ত্রী পুরনেশ মোদি মানহানির মামলাটি করেছিলেন। চার বছর আগে করা ওই মানহানির মামলায় গত বৃহস্পতিবার কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয় গুজরাটের সুরাটের একটি আদালত। সাজা হলেও রাহুল জামিনে রয়েছেন, তাকে আপিল করার সুযোগ দিতে রায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে।
গতকাল রায়ের পরদিন স্বল্প সময়ের জন্য লোকসভায় গিয়েছিলেন রাহুল। তিনি সেখানে দলীয় এমপিদের এক বৈঠকেও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে তার মা, কংগ্রেসের পার্লামেন্টারি দলের প্রধান সোনিয়া গান্ধীও ছিলেন। বেশ কিছু ইস্যুতে হট্টগোলের কারণে শুরুর কয়েক সেকেন্ড পরই লোকসভার অধিবেশন দুপুর ১২টা পর্যন্ত মুলতবি হয়ে যায়, রাহুলও এরপর পার্লামেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে যান।
রাহুল গান্ধীকে কারাদণ্ড দেওয়ার প্রতিবাদে এদিন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলোর সাংসদরা দিল্লির বিজয় চক থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন অভিমুখে মিছিল শুরু করলেও পুলিশ বাধায় তা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি।
শুক্রবার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতির মধ্যেই ‘গণতন্ত্র বিপদে’ লেখা ব্যানার নিয়ে তাদের মিছিল শুরু হয়েছিল। পুলিশ নেতাদের আটক করে বাসে কাছাকাছি একটি থানায় নিয়ে যাওয়ায় মিছিলটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।
পুলিশ বলছে, বিরোধী দলীয় এমপিদের মিছিলটির অনুমতি ছিল না। তা ছাড়া প্রেসিডেন্টও বৈঠকের জন্য এমপিদের কোনো সময় দেননি।
আদানি-হিনডেনবার্গ ইস্যু তদন্তে যৌথ পার্লামেন্টারি কমিটির দাবি জানানো এই বিরোধী দলগুলো প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদি মুর্মুর সাক্ষাৎ চেয়েছে। দলগুলো বলছে, ধনী শিল্পপতি গৌতম আদানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কথিত বন্ধুত্ব নিয়ে আলোচনা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতেই ২০১৯ সালে করা একটি মানহানির মামলায় রাহুল গান্ধীকে কারাদণ্ড দিয়ে যে শোরগোল তোলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশোধমূলক রাজনীতির কারণে রাহুলকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে অভিযোগ তুলে শুক্রবার একাধিক রাজ্যে কংগ্রেস বিক্ষোভও দেখিয়েছে বলে জানিয়েছে এনডিটিভি।
কংগ্রেসের ভাষ্য, রাহুলকে চুপ করিয়ে দিতেই এই দণ্ড দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের সরকার কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলোকে অপব্যবহার করে বিরোধীদের দমন করতে চাইছে।
তবে বিজেপি বলছে, ‘চোর’ মন্তব্যে পিছিয়ে পড়া ‘মোদি’ সম্প্রদায়কে অপমান করায় স্বাধীন বিচার বিভাগ রাহুলকে দণ্ড দিয়েছে, এখানে তাদের হাত নেই।
আজ ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭১ সালের এই দিন শেষে এক বিভীষিকাময় ভয়াল রাত নেমে এসেছিল। এদিন মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে আজ রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন এবং সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনা সভা হবে। এ ছাড়াও সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনের মিনিপোলগুলোতে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বাদ জোহর দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই নাম অপারেশন সার্চলাইট।
এ অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। অনেক পরে, ২০১২ সালে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।
অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিচারণ করে রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউজে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি।’ পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট।
যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হলো আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।’
পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। এদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারযোগে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসেন।
ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজীর জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্বে থাকা সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থেও এ সংক্রান্ত একটি বিবরণ পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল নিয়াজীর পাশেই ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অনুগত পাকিস্তানি হিসেবে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার চক্রান্ত তিনি খুব কাছে থেকেই দেখেছেন। ২৫ মার্চ, অপারেশন সার্চলাইট শুরুর মুহূর্ত নিয়ে তিনি লিখেন ‘নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এমন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহূর্ত (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল।’
পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। বাসস
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের অপরাধীরা আগে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করত। এরপর জানা গেল, সেখান থেকে দেশে অপরাধ ঘটায় তারা। কারও কারও নেপালে অবস্থানের কথাও জানা যায়। ভারতকে নিরাপদ মনে না করায় আরব আমিরাতের দুবাই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। সেখানে তারা আস্তানা গেড়েছে।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা অপরাধ করেই দুবাই চলে যাচ্ছে। সেখানে বসেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে। এখন বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাও দুবাইকে কেন্দ্র করে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। তাদের কেউ কেউ সোনার কারবারও করছেন। ওই দেশে ভারতের দুর্ধর্ষ অপরাধী দাউদ ইব্রাহিমের শিষ্যত্ব নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ওইসব অপরাধীর তথ্য জানার পরও তাদের ফেরত আনতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিসের’ দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ধরতে রেড নোটিস জারি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে পার পেয়ে গেছে। যদিও মামলাটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে নতুন করে আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্ত করার কথা ভাবছে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ সড়কে গুলি চালিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত হন এক কলেজছাত্রী। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মূল হোতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার রাতেই দেশ ছেড়ে চলে যায় দুবাইয়ে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে মুসা চলে যায় ওমানে। জিসান ও জয় এখনো দুবাইতেই বসবাস করছে। যদিও ওমান থেকে মুসাকে ওই বছরের ৯ জুন ইন্টারপোলের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের আলোচনায় আসে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও হিরো আলমের দুবাই সফরকে কেন্দ্র করে। তারা বনানীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের আসামি আরাভ খান নামধারী রবিউল ইসলামের সোনার দোকান উদ্বোধন করতে সেখানে যান। দুবাই যাওয়ার কারণে সাকিব ও হিরো আলমকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হতে পারে। এ ছাড়া ‘প্লেজার ট্যুরের’ জন্য এখন দেশের শিল্পপতিদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে দুবাই। কারণ ঢাকাকে তারা নিরাপদ মনে করছেন না। পাশাপাশি দেশে আটক সোনার চালানের ৮০ শতাংশ জব্দ হচ্ছে দুবাইফেরত বিভিন্ন এয়ারলাইনস থেকে। সব মিলিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দুবাই।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীরা যে দেশেই থাকুক না কেন, তাদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে আটক করার পর দুবাই থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে চেয়েছিল পুলিশ। সম্প্রতি আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভকে দুবাই থেকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ে সুখবর দেওয়া সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে জানান, সম্প্রতি আলোচনায় আসা আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ভারতের পাসপোর্টধারী। দেশে তার নামে ১২টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ওইসব পরোয়ানার কপি ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে পাঠানোর পর দ্রুতই তাকে ফেরানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এর আগে জিসান ও জয়কে দুবাই থেকে ফেরত আনার উদ্যেগ নিয়েও আনতে পারেনি। টের পেয়ে তারা দুবাই ছেড়ে কানাডায় চলে যায়। তারা আবার দুবাই এসেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এই দেশে অপরাধ করে দুবাই গিয়ে আস্তানা গাড়েন। ইতিমধ্যে পুলিশ একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকায় গুলশান ও বনানী এলাকার মডেলের সংখ্যা বেশি। বছরখানেক আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকেন। তাদের সঙ্গে অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সখ্য আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এমনকি বনানীতে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যাকান্ডে তাদেরও সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার পর পিয়াসা, রাজ ও আরাভকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় তদন্ত করা হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগীতশিল্পী, এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও কয়েকজন মডেল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। আবার কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তাড়া খেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছে কেউ কেউ। আত্মগোপনে থেকেই তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দুবাই রয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আলাদাভাবে বৈঠক হয়েছে। ওইসব বৈঠকে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাই চলে যায়। সেখান থেকেও ঢাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তার সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল, কামরুল হাসান হান্নান, ইব্রাহীম, রবিন ও শাহাদৎ হোসেন বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, শাহাদৎ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নুর হোসেনসহ অনেকেই কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নুর হোসেন ছাড়া অন্য সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। সুব্রত, মোল্লা মাসুদ ও শাহাদৎ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে মুম্বাই হয়ে দুবাই চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার অপরাধজগতের এক সন্ত্রাসী এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধীরা এখন আর ভারত যেতে চায় না। কারণ ওই দেশে শান্তিতে থাকা যায় না। ফলে সবাই এখন দুবাইমুখী হচ্ছে। দুবাইয়ে সবাই নিরাপদে থাকতে পারছে।