
প্রতিদিন তপ্ত হচ্ছে ঢাকা। বিষাক্ত হচ্ছে বাতাস। চামড়া থেকে চাদর ধুলার আস্তর এমনভাবে পড়ছে যাকে আর ‘ধূলিমলিন কিংবা ‘ধূলি ধূসরিত’ বলা যাচ্ছে না। ধূলি-দূষণের এই যন্ত্রণাকে বোঝাতে কি নতুন কোনো শব্দ তৈরি হচ্ছে? ঢাকার হাজারীবাগ থেকে বালুরমাঠ ঘুরে এমন কিছু একটা আন্দাজ করা গেল। বস্তিবাসী নিম্ন আয়ের মানুষ ধূলি-দূষণের এই নাকাল অবস্থাকে বলছেন ‘ধুলায় সব ভইরা গেছে’। এই ‘ভরে যাওয়া’ বলতে তারা কিন্তু ‘প্রলেপ বা আস্তর কিংবা অনুজ্জ্বলতা’ বোঝেন না, বোঝান ধুলায় তলিয়ে যাওয়া বা ডুবে যাওয়া। এভাবে জলবায়ু, প্রকৃতি ও মানবসৃষ্ট সংকটগুলো বরাবরই আমাদের ভাষা ও ব্যাকরণ প্রভাবিত করে। আবহাওয়া বদলায়, ভাষা বদলায়। প্রাণ-প্রকৃতি চুরমার হয়, ভাষাও বদলে বদলে যায়। যাহোক, আলাপখানি ভাষা নিয়ে নয়, জলাভূমি নিয়ে। প্রমাণ হয়েছে তপ্ত, বায়ু ও ধূলি-দূষিত ঢাকার এই নাকাল অবস্থা দ্রুত ঘটছে জলাভূমি, সবুজ বলয় ও উন্মুক্ত প্রান্তরের অভাবে। যদি এই নগরে পর্যাপ্ত জলাভূমি থাকত তবে এই নগর প্রাণবন্ত থাকত। দূষণের এই তীব্র ধকল সইতে হতো না। নিদেনপক্ষে ঢাকার আশপাশের নদী ও খালগুলো আমাদের বাঁচানো জরুরি। দখল আর দূষণে মৃত, রুগ্ণ জলাভূমি অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধারের এখনই শেষ সময়। যত দেরি তত ভোগান্তি। আর দীর্ঘসূত্রতা সামগ্রিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলবে, চাইলেও আর জলাভূমিগুলো পুনরুদ্ধার হয়তো সম্ভব হবে না। শুধু ঢাকা নয়, দেশজুড়ে সব জলাভূমি পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষার তৎপরতা জোরদার করতে হবে। জলাভূমি সুরক্ষায় আমাদের সংবিধান ও আইনসমূহ অঙ্গীকারবদ্ধ। জলাভূমি পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষায় নাগরিক ঐক্য ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার সক্রিয় করা জরুরি।
শুধু ঢাকা বা বড় শহরগুলো নয়; দেশের সর্বত্র জলাভূমিগুলো আজ নিদারুণ মৃত্যুযন্ত্রণা পাড়ি দিচ্ছে। চলনবিলের পাড়ে নাটোরের জোয়াড়ি গ্রামে ১৯০১ সালে জন্মানো প্রমথনাথ বিশী। সাহিত্যিক, শিক্ষক ও রাজনীতিক। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত ‘চলনবিল’ বইতে প্রমথনাথ লিখেছেন, ‘...অনুমান করলে অন্যায় হবে না যে, চারশত বৎসর পূর্বে এ বিলটি রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ার অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিরাজ করতো। ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার সঙ্গমস্থলের পশ্চিমোত্তর অংশে চলনবিল বিরাজিত। অবস্থান, আকৃতি, প্রকৃতি দেখে চলনবিলকে উত্তর বাংলার নদ-নদী-স্নায়ুজালের নাভিকেন্দ্র বললে অত্যুক্তি হবে না।’ দেশের সবচেয়ে বড় বিল হিসেবে পরিচিত ‘চলনবিলকে’ নিদারুণভাবে এলোপাতাড়ি উন্নয়নের কোপে ফালি ফালি করা হয়েছে। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকেও বিলটির আয়তন ছিল প্রায় এক হাজার বর্গ কিমি। চলতি সময়ে তা মাত্র ৩৬৮ বর্গ কিমিতে দাঁড়িয়েছে। বর্ষায় জলের বিস্তার থাকলেও হেমন্তে এর আয়তন দাঁড়ায় মাত্র ২৫.৯ বর্গ কিমি। নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলা, পাবনার ভাঙ্গুরা ও চাটমোহর উপজেলা, নওগাঁর আত্রাই উপজেলা এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া উপজেলায় বিস্তৃত দেশের এই বৃহত্তম বিলের বুকের কলিজা থেঁতলে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সড়কপথ। শুধু চলনবিল নয়, দেশের সব বিল জলাভূমিই আজ অধিপতি উন্নয়নের বাহাদুরিতে রক্তাক্ত। খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলায় বিস্তৃত বিলডাকাতিয়া এমনি আরেক দুঃসহ উন্নয়নক্ষত। উপকূলীয় বাঁধ, বাণিজ্যিক চিংড়িঘের বিলডাকাতিয়াকে তীব্র লবণজলে বন্দি করে রেখেছিল দীর্ঘসময়। মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকা জেলার তিনটি উপজেলায় বিস্তৃত দেশের মধ্য-অঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ বিল আড়িয়ল। শতবছর আগে ইতিহাসকার যতীন্দ্রমোহন রায় এই বিলের প্রশস্তি টেনে লিখেছেন, ‘চলনবিল ও আইরল (আড়িয়ল) বিলেই অতি প্রাচীনকালে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গম ঘটেছিল।’ রাষ্ট্র আড়িয়ল-সভ্যতাকে অস্বীকার করে বিমানবন্দর করতে চেয়েছিল। প্রবল জনরোষের মুখে তা বাতিল হয়।
নদীমাতৃক বাংলাদেশ জলাভূমিময়। এ কারণেই হয়তো শ্রী হরিদাস পালিত ১৯৩২ সালে প্রকাশিত ‘কায়স্থ সমাজ’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, “এ দেশটা জলবহুল দেশ, জলাভূমি যথেষ্ট, ছেঁচে জলক্ষেত্রে দিতে হতো না। বাং মানে না, আর লো মানে পাত্র ডুবিয়ে জল তোলা। তা থেকে জল ছেঁচাও বোঝায়। যে দেশে ছেঁচে জল দিতে হয় না, জল ছেঁচার আবশ্যক হয় না, অর্থাৎ ধান্যক্ষেত্রে জলের অভাব হয় না সেই দেশই ‘বাংলোদিশম’।” নানা বাস্তুসংস্থানে, নানা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এসব জলাভূমি দেশের নানাস্থানে গড়ে তুলেছে বহুমাত্রিক জীবনসম্পর্ক। হাওর, বিল, বাঁওড়, খাল, নালা, খাঁড়ি, দিঘি, পুকুর, ঝিরি, হ্রদ, ঝরনা, গর্ত, খাদ, পাগাড়, বাইদএ রকম নানা নামে নানা বৈশিষ্ট্য নিয়েই বাংলাদেশের জলাভূমি আখ্যান। জলাভূমি অঞ্চল হয়েও আমরা তৈরি করতে পারিনি ‘জাতীয় জলাভূমি নিবন্ধনতালিকা ও নির্ঘণ্ট’। দেশের জলাভূমিসমূহের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য ও বিবরণ আমাদের নাগালে নেই। জলাভূমির ধরন ও বিস্তারে ভিন্নতাকে গায়েব করে ‘জলাভূমি’ প্রত্যয়টি মূলত ‘নিম্নাঞ্চল’-এর সমার্থক করে তোলা হয়েছে।
মৌলভীবাজারের বড়লেখার মাধবকুন্ড জলপ্রপাত স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র জলধারা। সিলেট অঞ্চলে টিলা-অরণ্যে এ রকম অসংখ্য ঝরনা ও ছড়া স্থানীয় বাস্তুসংস্থানের আদি জলের উৎস। মাধবকু- জলপ্রপাতকে বনবিভাগ ইজারা দিয়েছে। তার আগে ‘লাইফ’ নামের একটি কোম্পানিকে এই জলপ্রপাতের পানি বোতলে ভরে বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। একই জেলার কমলগঞ্জের হামহাম জলপ্রপাত আজ বাঁশ-বাণিজ্যের কারণে ক্ষতবিক্ষত। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঝিরি ও ঝরনাগুলোর দশাও করুণ। বান্দরবান জেলার আলীকদমের পোয়ামুহুরী, কুরুকপাতা, দোছড়ি এলাকায় হেমন্তকালটি নিদারুণ পানির কষ্টে পাড়ি দিতে হয় আদিবাসীদের। কারণ ঝরনা ও ঝিরিগুলো আজ নিশ্চিহ্ন হয়েছে। পাহাড়ে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান খুন করে বহুজাতিক কোম্পানির তামাক চাষ, বনবিভাগের বাণিজ্যিক সেগুন বাগান, নিরাপত্তার নামে বৃহৎ অবকাঠামো, বাণিজ্যিক পর্যটন, লাগাতার ভূমি দখল সব মিলিয়ে ঝিরিগুলো প্রতিদিন উধাও হচ্ছে পাহাড় থেকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি অঞ্চলের নামও ধারণ করে আছে ঝিরির স্মৃতি। খাগড়াছড়ি, মহালছড়ি, সিন্দুকছড়ি, বরুণাছড়ি, বড়ইছড়ি, কুতুবছড়ি, মানিকছড়ি ও বিলাইছড়ি। বান্দরবানের নাফাখুম ঝরনা, বগা হ্রদ, রাঙ্গামাটির শুভলং ঝরনা, খাগড়াছড়ির আলুটিলা ঝিরি আজ করপোরেট পর্যটনের চাপে হাঁপাচ্ছে।
দেখা যায়, জলাভূমি সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় নীতি ও নথিগুলো কী বলে। জাতীয় পানিনীতির (১৯৯৯) ৪.১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘...হাওর, বাঁওড় ও বিলজাতীয় জলাভূমিগুলো বাংলােেদশর আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে এগুলোর গুরুত্ব অসীম। হাওর এবং বাঁওড়গুলোতে শুষ্ক মৌসুমেও যথেষ্ট গভীরতায় পানি থাকে, তবে ছোট বিলগুলো সাধারণত চূড়ান্ত পর্যায়ে আর্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। এই বিলগুলো প্লাবনভূমির নিম্নতম অংশ। এই জলাশয়গুলো আমাদের প্রাকৃতিক মৎস্য-সম্পদের সিংহভাগের উৎস এবং নানা ধরনের জলজ সবজি ও পাখির আবাসস্থল। তা ছাড়াও শীত মৌসুমে উত্তর গোলার্ধ থেকে আগত অতিথি পাখিদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। হাওর এবং বিলগুলো খালের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। অতীতে প্রকৌশলগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অনেক বিলকে তাৎক্ষণিক ফসল লাভের জন্য নিষ্কাশিত আবাদি জমিতে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকট আকার ধারণ করে। প্রথমেই মাছ এবং গ্রামীণ জনগণের খাদ্যের উৎস কচু, শাপলা, কলমি-জাতীয় জলজ সবজির বিলুপ্তি ঘটে। বর্ষা মৌসুমে প্লাবনভূমির বর্জ্য প্রবহমান খালের মাধ্যমে বাহিত ও শোধিত হয়ে নিষ্কাশিত হতো। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সেই প্রাকৃতিক শোধনক্রিয়া ব্যাহত হয়ে পরিবেশের মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করেছে।’
১৯৯৭ সালের আগেও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও এ সাল থেকেই প্রথম প্রতি বছরের ২ ফেব্র“য়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হয়। প্রতি বছরই পৃথিবীর জলাভূমিসমূহের গুরুত্ব এবং এর সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক এবং উন্নয়নধারাকে বিবেচনা করে প্রতি বছরের জন্যই এক একটি প্রতিপাদ্য তৈরি করা হয়। ২০০৬ সালে জলাভূমি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘জলাভূমিসমূহ এবং পানিনির্ভর জীবন ও স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রা’, ২০০৭ সালের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আগামীর জন্য মাছ?’, ২০০৮ সালে ‘স্বাস্থ্যকর জলাভূমি, স্বাস্থ্যকর জনগণ’, ২০০৯ সালে ‘নদী ও নদীতীর ব্যবস্থাপনা’, ২০১০ সালে ‘প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তন’, ২০১১ সালে ‘জলাভূমি ও জঙ্গল’, ২০১২ সালে ‘জলাভূমি ও পর্যটন’, ২০১৩ সালে ‘জলাভূমি ও পানি ব্যবস্থাপনা’, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের প্রতিপাদ্য ‘জলাভূমিসমূহই আমাদের ভবিষ্যৎ’, ২০১৬ ‘জলাভূমি আমাদের ভবিষ্যৎ ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন’, ২০১৭ ‘জলাভূমি দুর্যোগ কমায় বা জলাভূমি দুর্যোগ-ঝুঁকি হ্রাস করে, ২০১৮’ স্থায়িত্বশীল ভবিষ্যৎ নগরের জন্য জলাভূমি’, ২০১৯ ‘জলাভূমি ও জলবায়ু পরিবর্তন’, ২০২০ ‘জলাভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য’, ২০২১ ‘জল ও জলাভূমি’, ২০২২ ‘মানুষ ও প্রকৃতির জন্য জলাভূমি কর্মসূচি’। চলতি ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘জলাভূমি পুনরুদ্ধারের এখনি সময়’। জলাভূমিসমূহ আমাদের এই বৃহৎ বদ্বীপের প্রাণবৈচিত্র্যের আঁতুড়ঘর। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ বলেছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনোভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।’ কিন্তু প্রশ্নহীন উন্নয়নের চাপে বারবার দেশের সব জলাভূমির শ্রেণিচরিত্র নিদারুণভাবে পরিবর্তন করা হচ্ছে। জলাভূমির সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমরা বহু দেরি করে ফেলেছি। আর নয়। জলাভূমি পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষা ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রীয় মনোযোগ ও তৎপরতা সক্রিয় করার এখনই শেষ সময়।
লেখক: গবেষক ও লেখক
সিফাত (ছদ্মনাম) অষ্টম শ্রেণির একজন ছাত্র। মাধ্যমিক স্তর না পেরোতেই একটি মোবাইল না দেওয়ায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অথচ এ বয়সে একটা সময় মোবাইল কল্পনাও করা যেত না। শখের বসে প্রয়োজন হলেও সিফাতের মোবাইল ফোনটি কি খুব প্রয়োজন ছিল? সিফাতকে কি পরে কোনো মোবাইল কিনে দিত না? সিফাত কি পরে আরও সমৃদ্ধ মোবাইল পেত না? আত্মহত্যা কি সিফাতকে মোবাইল কিনে দিয়েছে? সিফাতের আশা কি পূরণ হয়েছে? সিফাত কি বাবা-মায়ের জন্য কিছু করতে পেরেছে? সিফাত সমাজের জন্য কী করল? সিফাতকে সমাজের মানুষ মনে রাখবে?
এই উত্তরগুলো আমরা অনেকেই জানি। সিফাত তার নিজের জন্য যেমন কোনো কিছু করতে পারেনি, ঠিক তেমনি সমাজের জন্যও কিছু করেনি। সিফাতের আত্মহত্যাটি ছিল নিষ্ফল আবেদন। সিফাতকে ঘৃণা ছাড়া প্রশংসার চোখে কেউ দেখবে না। অথচ সিফাতের জীবনে অনেক কিছু করার সময় বা সুযোগ ছিল। সিফাতের জীবনে শুধু মোবাইল নয় অনেক কিছু পাওয়া সম্ভব ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে সিফাতের মতো অনেক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ঘটছে এমন দুর্ঘটনা। বিশেষ করে অল্পবয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। পরিণত বয়সের আগেই তাদের এই অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত শুধু পরিবারেই প্রভাব ফেলছে না, প্রভাব পড়ছে সমাজে। অথচ এটি কোনো সমস্যা সমাধানের পথ নয়। আত্মহত্যা জীবন বদলে দেওয়ার কোনো গল্প নয়। বরং একটি স্বপ্নময় জীবনের অকালমৃত্যু আত্মহত্যা।
বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিত্বপূর্ণ জীবনী থেকে জানা যায় সাফল্যের পেছনে হতাশার গল্প। গভীর হতাশায় নিমজ্জিত থেকেও তারা বিশ্বে আজ আলোকিত। তাদের আলোয় আলোকিত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। তাদের জীবনী থেকেই জানা যায়, শৈশবে না পাওয়ার আক্ষেপের কাহিনী। কিন্তু পরিপূর্ণ বয়সে তারা জয় করেছে না পাওয়ার গল্প। তাদের এই সফলতার মূলমন্ত্র আমার কাছে ধৈর্য। এই সফলতার রহস্য আত্মসচেতনতা। অথচ এই আত্মসচেতনতার অভাবে অকালেই থেমে যাচ্ছে সফলতার গল্প।
যে সময়টা নিজেকে তৈরি করার সময় সেই শিক্ষাজীবনে আত্মহত্যার প্রতিবেদন দেখে আমার মতো উদ্বিগ্ন সচেতন সমাজের অনেকেই। জীবনের অনেক অংশ বাকি। কী এমন ঘটনা ছিল যে কারণে এ বয়সে এই পরিণতি? প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে সারা দেশে স্কুল ও কলেজপর্যায়ের ৪৪৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে স্কুল ও সমমানপর্যায়ের ৩৪০ জন এবং কলেজপর্যায়ের শিক্ষার্থী ১০৬ জন। এ ছাড়া বছরজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘স্কুল ও কলেজশিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা; সমাধান কোনো পথে?’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়েছে।
জরিপে দেখা যায়, ২০২১ সালেই দেশে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যাদের মধ্যে ৬২ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ২৩ জন বেসরকারি, ১২ জন মেডিকেল কলেজ ও অনার্সপড়ুয়া ও ৪ জন ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
এতে জানানো হয়, স্কুল-কলেজপর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ছিল ঢাকা বিভাগে। আর আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ২৮৫ জন এবং ছাত্র ১৬১ জন। এরই মধ্যে ৫৪ জন মাদ্রাসাশিক্ষার্থী।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশের আট বিভাগে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ ঢাকা বিভাগে এবং সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।
আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, ২৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ অভিমান করে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এদের বড় অংশেরই অভিমান ছিল পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার অন্য কারণগুলোর মধ্যে প্রেমঘটিত কারণও অন্যতম। প্রেমঘটিত কারণে ২৩ দশমিক ৩২ শতাংশ, পারিবারিক কলহে ৩ দশমিক ১৪, হতাশাগ্রস্ত হয়ে ২ দশমিক ০১, মানসিক সমস্যায় ১ দশমিক ৭৯, আর্থিক সমস্যায় ১ দশমিক ৭৯ এবং উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথে ধাবিত হয়েছেন ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।
কেন দিন দিন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে আর কীভাবেই বা এ থেকে তরুণসমাজকে রক্ষা করা যায় সে প্রশ্ন সচেতন সমাজের। আত্মসচেতনতা এই প্রবণতা কমার বড় উপায় বলে আমার মনে হয়। আর এই আত্মসচেতনতা বাড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা সভা, প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। নানা কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলেও জীবন বিসর্জনের এ প্রক্রিয়াকে সমর্থন দিচ্ছে না কোনো ধর্ম। প্রায় সব ধর্মই আত্মহত্যাকে মহাপাপ ও ক্ষমার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছে। সুতরাং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এই পাপকাজ থেকে বিরত থাকাই উত্তম। আসুন আত্মসচেতন হই, সমৃদ্ধ জীবন গড়ি।
লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং আরও আটটি ইউরোপীয় দেশসহ ১২ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য একে অপরকে রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে উত্তর আটলান্টিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। এটি মূলত সামরিক সহযোগিতার জোট। পরে কয়েক দশক ধরে জোটটি বড় হতে থাকে। আজকে ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা ৩০। ন্যাটো হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক সংগঠন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের হাত থেকে পশ্চিম বার্লিন এবং ইউরোপের নিরাপত্তা বাস্তবায়ন করা। ন্যাটো একটি যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি, যে চুক্তির আওতায় জোটভুক্ত দেশগুলো পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার পর ন্যাটো তাদের রক্ষায় মাঠে নামে। এর প্রত্যেকটি সদস্যরাষ্ট্র তাদের সামরিক বাহিনীকে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখতে বদ্ধপরিকর। বর্তমানে ন্যাটোর সদস্য দেশের সংখ্যা ৩০। সেসব হচ্ছেআলবেনিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, কানাডা, ক্রোয়েশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড, ইতালি, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, লুক্সেমবার্গ, মন্টিনেগ্রো, নেদারল্যান্ডস, উত্তর মেসিডোনিয়া, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, স্পেন, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হয় ৪ এপ্রিল, ১৯৪৯ তারিখ। ন্যাটো প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের হাত থেকে পশ্চিম বার্লিন এবং ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ন্যাটো হলো এমন একটি যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি, যে চুক্তির আওতায় জোটভুক্ত দেশগুলো পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ।
যা হোক, মূল কথায় আসা যাক, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রাজনীতিকরা তাদের নানা মাত্রার বীরত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। কিন্তু ঢালই যদি ভঙ্গুর হয় কিংবা যে উপকরণ দিয়ে ঢাল তৈরি হয়েছে, তাতে যদি ত্রুটি থাকে, তখন কী হয়? পশ্চিমা দেশগুলো সেটা কি বুঝতে পারছে? এ মাসে মাদ্রিদে হতে যাওয়া ন্যাটো সম্মেলনটি শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনমুখী বলে প্রচার করা হচ্ছে। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ৩০ দেশের এ জোট ‘মুক্তবিশ্ব’ রক্ষায় কীভাবে একত্র হলো, তা নিয়ে সেখানে আত্ম-অভিনন্দনের বন্যাও বয়ে যেতে পারে। কিন্তু মূল প্রশ্নটাই এড়িয়ে যাওয়া হবে। গত মার্চ মাসে পোল্যান্ডে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ন্যাটোর কার্যত নেতা জো বাইডেন বক্তব্য দিতে গিয়ে জোটটির নেতারা কী ধরনের কথা বলবেন, আর কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন, তার একটা মান ঠিক করে দিয়েছেন। বাইডেন তেজদীপ্ত শপথের সুরে বলেন, ‘ন্যাটোর প্রতি ইঞ্চি মাটি আমাদের সম্মিলিত শক্তির সবটা দিয়ে’ যুদ্ধের বাইরে রাখব। ওই বক্তব্যের কয়েক মাস পার হয়ে গেলেও দীর্ঘমেয়াদি কোনো তৎপরতার ব্যাপারে উদাসীনতাই দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি আইসল্যান্ডে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেল ওয়ালেশকে বাইডেনের সুরে সুর মেলাতে দেখা গেল। ইউক্রেনের পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট লিথুনিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়ায় হামলা করতে পারেন বলে চাউর হয়েছে। ওয়ালেশ সতর্ক করে বলেন, পুতিন এই দেশ তিনটিকে ইউক্রেনের মতো ‘প্রকৃত’ দেশ বলে মনে করেন না। কিন্তু বাইডেনের মতো ওয়ালেশও ইউক্রেন যাতে স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে পারে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা হাজির করেননি। যখন অনেক মিত্র দেশ সামনে এগিয়ে আসছে,তখন ইউরোপে ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা শীত নিন্দায় চলে যাচ্ছেন। তারা ন্যাটো জোটকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করছেন। কিয়েভকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গেলে মস্কোকে ক্রুদ্ধ করা হবেএমন যুক্তিতে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৌশলগত সার্বভৌমত্বের দিবাস্বপ্ন দেখা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁও কথার চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের কাজগুলো দ্বিধাগ্রস্ততা ও ঢিলেমির ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত।
আর নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিকতর ওরবান যেন ক্রিজের অন্য প্রান্তে সপাটে ব্যাট চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার তুরস্কের সমস্যা সৃষ্টিকারী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নিজ উদ্যোগে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সদস্যপদের বিরুদ্ধে যেভাবে পেছন থেকে ছুরি মেরেছেন, সেটাও ন্যাটো জোটের অনৈক্যের বড় এক দৃষ্টান্ত। ন্যাটোর গোবেচারা মহাসচিব স্টলটেনবার্গ সদস্য দেশগুলোর নানামুখী চাপ সামলাতে আর অনৈক্যের এই ফাটল মেরামত করতে গিয়ে রীতিমতো গলদঘর্ম। এদিকে পোল্যান্ড ও অন্য সম্মুখ সারির দেশগুলো কঠোরতম পদক্ষেপ চায়। রাশিয়ার সীমান্তে অতিরিক্ত সেনার সঙ্গে স্থায়ীভাবে ভারী সমরাস্ত্র ও যুদ্ধবিমানের মোতায়েন চায় তারা। তাদের এ ধরনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটোর কর্মকর্তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বলিষ্ঠ ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বর্তমান বিশ্বে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে শোষণ-বঞ্চনার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে। কিন্তু তার সঙ্গে পশ্চিমা ডানপন্থি কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা-নেত্রীদের দৃশ্যত কোনো বিরোধ নেই। সুচিন্তিতভাবে বিরোধ তৈরি করা হচ্ছে মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ ও তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। এতে পশ্চিমা উগ্র ডান কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মনে করে তাদের জনপ্রিয়তা অর্জন সহজতর হবে। বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে পশ্চিমা জগতে, বর্তমান প্রথাগত রাজনীতিকরা যখন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন, তখন উগ্র ডানপন্থি কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কখনো ধর্মীয় বিষয়কে ইস্যু করে মাঠে নামছে বিভিন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে, আবার কখনো জাতিগোষ্ঠীগত বৈষম্যকে উসকে দেয় তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে। ইতালি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, সুইডেনসহ বিভিন্ন পশ্চিমা রাষ্ট্রে এ ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যেও যে এ ধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অবসান ঘটেছে, তাও নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রভাবাধীন রিপাবলিকান দলের এক বিশাল অংশের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ কিংবা যুক্তরাজ্যের উগ্র জাতীয়তাবাদী ন্যাশনাল ফ্রন্টের শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ গণতন্ত্র ও মানবতাবাদের নাকের ডগায় বৃদ্ধাঙ্গুলি ঠেকিয়ে প্রকাশ্যেই চরম সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোয় সাম্প্রদায়িকতা কিংবা ধর্মীয় বিরোধ সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ হলেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অজুহাতে তারা এমন সব ঘটনাকেও বরদাশত করে যাচ্ছে, যা অগণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকারের বরখেলাপ। কারণ সেসব দেশে গণতন্ত্রের নামে সাম্প্রদায়িকতা কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা প্রচার ও প্রসারের কোনো অবকাশ নেই। ধর্ম, বর্ণ ও জাতীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি-নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার রয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ইতালি, ফিনল্যান্ড, সুইডেনসহ পশ্চিমা জগতে সেগুলো খাতায় লিপিবদ্ধ থাকলেও বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাতে তারা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে। সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে নানা বৈষম্য, বিরোধ ও সংঘর্ষ। তা ছাড়া উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও প্রতিক্রিয়াশীল তৎপরতার কারণে ভেঙে পড়ছে সাধারণ মানুষের প্রচলিত কিংবা প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ। গণতন্ত্র, মানবাধিকার কিংবা ধর্মবিশ্বাস ও চর্চার ক্ষেত্রটি ক্রমে ক্রমে নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। এতে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চলতি বছর মে মাসে তুরস্কে জাতীয় সংসদ এবং প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন ঘোষণা করেছেন দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম সেই নির্বাচনকে এ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেছে। কারণ সেই নির্বাচন একদিকে যেমন প্রাজ্ঞ-প্রবীণ রাজনীতিক এরদোয়ানের ভাগ্য নির্ধারণ করবে, অন্যদিকে বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ এবং এমনকি ন্যাটোর ভবিষ্যৎ অবস্থান ও কার্যক্রমকেও প্রভাবিত করবে বলে বিশ্ব গণমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষকদের অভিমত।
অবস্থায় চলতি বছরের নভেম্বরে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জি২০ শীর্ষ সম্মেলন। তাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত সভায় যুদ্ধবিরোধী প্রস্তাব নেওয়ার মতো বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষের পরিণতি এরই মধ্যে উপলব্ধি করেছে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো। বিশ্ব এখন এক অর্থনৈতিক মন্দার ব্যাপক গ্রাসে নিক্ষিপ্ত হতে যাচ্ছে বলে তাদের আশঙ্কা।
এ অবস্থায় ইউক্রেনকে বিজয়ী করতে কিংবা রাশিয়াকে ভেঙে দেওয়ার জন্য দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে যেতে তারা প্রস্তুত নয়। এখন ইউক্রেন যুদ্ধ যদি প্রলম্বিত হয়, যদি রাশিয়া ও ইউক্রেন আরও মরিয়া হয়ে ওঠে, যদি কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলো কানাগলিতে ঢুকে পড়ে, তাহলে ন্যাটোর দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতা ও ভঙ্গুরতা আরও বেশি অনিবার্য হয়ে উঠবে। সোভিয়েত পরবর্তীকালে ন্যাটো জোটের যে ধাপ্পাবাজি, সেটি সবার কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাবে। এত বড় কোনো সংস্থায় সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতৈক্য থাকবে, সে ধরনের কিছু আশা করা বোকামি হবে। কিন্তু সামরিক সক্ষমতার প্রসঙ্গ যখন উঠছে, তখন সবগুলো সদস্য দেশের মধ্যে অদ্ভুত একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে কে কার পেছনে যাবে, সেই প্রতিযোগিতা যেন সবার মাঝে। রাশিয়ার দিক থেকে আসা পারমাণবিক ও রাসায়নিক যুদ্ধের প্রচ্ছন্ন হুমকিতেই ন্যাটোর দেশগুলোর কণ্ঠ যেন বিকল হয়ে গেছে। আবার ন্যাটোর জোটের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। সামরিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া কোনো কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সাংগঠনিক ও সামরিক, দুটি ক্ষেত্রেই ন্যাটোর কার্যক্রম সবখানেই রয়েছে। ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রএ তিন দেশে জোটটির যৌথ কমান্ডের সদর দপ্তর অবস্থিত। আবার এর শীর্ষ জেনারেল বেলজিয়ামে থাকেন। এ রকম বাস্তবতায় অস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণে যেমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে, ঠিক তেমনি গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানেও বাধা তৈরি হচ্ছে। আবার ইউরো-আটলান্টিকে রাশিয়াকে এবং ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনকে সামলাতে গিয়ে ন্যাটোকে অনেক বেশি চাপ নিতে হচ্ছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ন্যাটো বল ছেড়ে দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল শেষ বাঁশি বেজে গেছে। খেলা শেষ। কিন্তু খেলা শেষ হয়নি। এখন যেমন পুতিন তার হাতের ঢোল পিটিয়ে পশ্চিমকে পরীক্ষার মুখে ফেলছেন। এখন ন্যাটো যদি নিজেকে না শোধরাতে পারে, তাহলে লুকানোর জায়গা তারা আর খুঁজে পাবে না। ন্যাটো কি আবার ব্যর্থ হবে? এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক
‘অহিংসা’একটি বহুমাত্রিক ধারণা। এটি জৈন ধর্মের নৈতিক দর্শনে একটি অসাধারণ বিকাশে পূর্ণতা পেয়েছিল। জৈন ধর্মের তেইশতম তীর্থংকর প্রভু পরশনাথ, খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে অহিংসার ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। কিন্তু অপরাধীরা, অহিংসার শাসন দ্বারা সুরক্ষিত নয়।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাজনীতিতে, অহিংসার নীতি সফলভাবে প্রচার করেন মোহন চাঁদ করমচাঁদ গান্ধী। মহাত্মা গান্ধীর এই অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলনসত্যাগ্রহ একসময় ভারতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। পরে ‘অহিংস’-নীতি নিয়ে রাজনীতি করা, সরকার পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এমন সৃজনশীল শক্তিকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রোথিত করা সম্ভব হয়নি। ভয়ংকর লোভ এবং আত্মকেন্দ্রিকতা মানুষকে ক্রমেই হিংস্র করে তুলছে। ঠিক তখনই প্রয়োজন হয়ে ওঠে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলার। যে কারণে সরকারকে এগিয়ে আসতে হয় রাষ্ট্রে বসবাসরত জনগণের কল্যাণার্থে। তৈরি করতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ করে, জনগণের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের জন্য পুলিশ বাহিনীকে দিন-রাত জাগ্রত থাকতে হয়।
আজ শনিবার, ৪৮ বছরে পা দিচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। ১২টি থানা ও সাড়ে ছয় হাজার জনবল নিয়ে ১৯৭৬ সালে গঠিত হয়েছিল ডিএমপি। বর্তমানে এর বিস্তৃতি ঘটেছে। থানা হয়েছে ৫০টি। স্বাভাবিকভাবেই জনবল বাড়িয়ে হয়েছে ৩২ হাজারের মতো। বাড়ানো হয়েছে পুলিশের সুযোগ-সুবিধা।
গতকাল ১০ ফেব্রুয়ারি দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত এক সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, পুলিশ বাহিনীতে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। আরও পরিবর্তন হবে। কিন্তু সে হিসেবে সেবার মান বাড়ছে না। থানাগুলোতে কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না নগরবাসী। যে কারণে সেবার মান বাড়াতে ডিএমপিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ভালো কাজ করার জন্য পুলিশের প্রত্যেক সদস্যকে কঠোর বার্তা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশকে জনবান্ধব করা হচ্ছে। থানায় গিয়ে কোনো নগরবাসী হয়রানির শিকার হওয়ার প্রমাণ মিললে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে শাস্তিও দেওয়া হয়েছে।
প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে আরও জানা যায়, জিডির বিষয়ে অনেকের কাছ থেকে নেতিবাচক বক্তব্য পাওয়া গেছে। নগরবাসীর অভিযোগজনবল, আধুনিক সরঞ্জাম, তথ্যপ্রযুক্তিসহ সব জায়গায় ডিএমপির সক্ষমতা বাড়লেও নাগরিক প্রত্যাশা পূরণে রয়েছে ঘাটতি। থানা-পুলিশের বিরুদ্ধে প্রায়ই হয়রানি, দেরিতে সাড়া দেওয়া, মামলা না নেওয়া, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। তবে ডিএমপি মনে করছেএত বড় একটি শহরে অপরাধের মাত্রা হিসাব করলে তেমন কোনো অপরাধই হচ্ছে না। দু-একটি চুরি, ছিনতাই ঘটছে, তা অল্প সময়ের মধ্যেই আসামিদের পাকড়াও করা যাচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। অনলাইনে জিডি করতে গিয়ে, বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন নগরবাসী। আবার সরাসরি মামলা করতে গেলেও নগরবাসীকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে! এ তো গেল রাজধানী ঢাকার কথা। দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলার থানাগুলোর অবস্থা কেমন? সেখানে কি জনগণ পুলিশের দায়িত্ব-কর্তব্য-সেবায় সন্তুষ্ট? পুলিশ কি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে? না পারলে মূল সমস্যাটা কোথায়! পুলিশের কাছে সাধারণ মানুষের আন্তরিক প্রত্যাশা থাকে। যে কারণে, তাদের বন্ধু হতে হয়। যাতে একজন মানুষ নির্ভয়ে সমস্যার কথা বলতে পারে। সহযোগিতা চাইতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় পুলিশের সংখ্যা একেবারেই কম। তবু আইনশৃঙ্খলার যাতে অবনতি না হয় সেদিকে রাখতে হবে কঠোর নজরদারি। তাদেরই জনগণের কাছাকাছি থাকতে হবে।
তবে, গুটিকয়েক পুলিশ সদস্যের অসৎ কর্মকা-ও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখা দরকার। তাদের চাঁদাবাজি, চারিত্রিক স্খলন এবং অসহযোগিতা গোটা পুলিশ বাহিনীকে বিতর্কিত করে তোলে। সাধারণ মানুষ, পুলিশের কাছে চায় সেবা। নিশ্চিন্ত এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে একজন মানুষ যখন পুলিশের কাছে সেবা পাবেন, তখনই তার প্রতি আস্থা তৈরি হবে। এর আগে না। মানুষের ভালোবাসা পেতে হলে দ্ব্যর্থহীনভাবে মানুষকেই ভালোবাসতে হবে। দরকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
‘ছন্দের জাদুকর’ নামে খ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম কলকাতার নিকটবর্তী নিমতা গ্রামে ১৮৮২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। তার বাবা রজনীনাথ দত্ত। তার পিতামহ অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক। ১৮৯৯ সালে তিনি কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯০১ সালে এফএ পাস করেন; কিন্তু পরে বিএ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। তিনি প্রথমে বাবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দেন এবং পরে ব্যবসা ছেড়ে কাব্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ভারতী পত্রিকাগোষ্ঠীর তিনি অন্যতম কবি ছিলেন। প্রথম জীবনে মধুসূদন দত্ত, অক্ষয়কুমার বড়াল প্রমুখের দ্বারা প্রভাবিত এবং রবীন্দ্রানুসারী হলেও তিনি কবিস্বভাবে হয়ে ওঠেন স্বতন্ত্র। বাংলা ভাষার নিজস্ব বাগধারা ও ধ্বনি সহযোগে নতুন ছন্দ সৃষ্টি তার কবিপ্রতিভার মৌলিক কীর্তি। এজন্য তিনি ‘ছন্দের জাদুকর’ ও ‘ছন্দরাজ’ নামে সাধারণ্যে পরিচিত ছিলেন। তার অন্য কৃতিত্ব বিদেশি কবিতার সফল অনুবাদ। আরবি, ফারসি, চীনা, জাপানি, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার বহু কবিতা অনুবাদ করে তিনি বাংলা সাহিত্যের বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি সাধন করেন। নবকুমার, কবিরতœ, অশীতিপর শর্মা, ত্রিবিক্রম বর্মণ, কলমগীর ইত্যাদি ছদ্মনামে তিনি কাব্যচর্চা করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলি সবিতা, সন্ধিক্ষণ, বেণু ও বীণা, হোম শিখা, ফুলের ফসল, কুহু ও কেকা, তুলির লিখন, অভ্র-আবীর, হসন্তিকা, বেলাশেষের গান, বিদায়-আরতি, কাব্যসঞ্চয়ন, শিশু-কবিতা; গদ্যরচনাজন্মদুঃখী (উপন্যাস); প্রবন্ধচীনের ধূপ, ছন্দ-সরস্বতী প্রভৃতি। ১৯২২ সালের ২৫ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রেকর্ড গড়ে সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। যে ইনিংসটি চোখে লেগে আছে ওপেনার লিটন দাসের। মুশফিকের এদিনের মতো ইনিংস বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারে ব্যাটেই দেখেননি বলে মন্তব্যও করেছেন তিনি।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায় বাংলাদেশ ইনিংসের পরই। এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৩৪৯ রানের পুঁজি গড়ে বাংলাদেশ। যা নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
ছয় নম্বরে খেলতে নেমে মুশফিক ৬০ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন ১৪ চার ও ২ ছক্কায়। ম্যাচ শেষে দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন লিটন। এ সময় মুশফিকের ইনিংস নিয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি যতদিন খেলছি, বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ই এভাবে শেষের দিকে গিয়ে ১০০ করেনি।’
মুশফিকে মুদ্ধ লিটন বলে যান, ‘যখন দল থেকে কেউ এরকম একটা সেঞ্চুরি করে, দেখলে অনেক ভালো লাগে। সিনিয়ররা কেউ করলে তো আরও ভালো লাগে। মুশফিক ভাইয়ের শুধু আজকের ইনিংস না, শেষ ম্যাচের ইনিংসটা যদি দেখেন, আমার মনে হয় অসাধারণ ছিল।’
‘যদিও রান বেশি নয়, ৪০ বা এরকম ছিল (২৬ বলে ৪৪)। এটাই কিন্তু বড় ভূমিকা রাখে তিন শর বেশি রান করতে। আজকের ইনিংসটা তো ম্যাচের চিত্র বদলে দিয়েছে।’
সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৮ উইকেটে ৩৩৮ রান করেছিল টাইগাররা। এ ম্যাচের আগ পর্যন্ত সেটাই ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছিল রেকর্ড ১৮৩ রানের ব্যবধানে। রানের হিসেবে যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। সুবাদে ১-০ তে সিরিজে এগিয়ে তামিম ইকবালের দল।
একই ভেন্যুতে আগামী বৃহস্পতিবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।