
একটা সময় ছিল যখন স্মার্ট ফোন ছিল দুর্লভ একটি বিষয়। সেই সময় মানুষের আগ্রহ ছিল বই পড়ার প্রতি, গল্প করার প্রতি। অনেক সামর্থ্যবানের বাড়িতে থাকত নিজস্ব গ্রন্থাগার। এখন সেই সব গল্প শুধুই অতীত। এ যুগে ঘরে ঘরে পাঠাগার না পাওয়া গেলেও স্মার্ট ফোন ঠিকই পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষের শরীরের জন্য যেমন খাদ্যের দরকার, তেমনি মনের খাদ্যও তার প্রয়োজন।
জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত বুকার পুরস্কার বিজয়ী লেখক হাওয়ার্ড জ্যাকসনের উদ্ধৃতিতে জানা যায়, স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং প্রচুর পরিমাণে ফেইসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের কারণে নাটকীয়ভাবে তরুণ প্রজন্মের যোগাযোগের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে আর এসবে কারণে তারা হারাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাস। এক্ষেত্রে তিনি শুধু তরুণ প্রজন্মের কথাই বলেননি বরং সেই সঙ্গে নিজের অবস্থাও তুলে ধরেছেন। তিনি নিজেও বইয়ের প্রতি আর তেমন মনোযোগ দিতে পারেন না। তার মনোযোগের একটা অংশও চলে যায় মোবাইল, কম্পিউটারের স্ক্রিনের পেছনে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আমরা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এমন শিশুদের পাবÑ যারা পড়তে পারবে না। আমরা কি-বোর্ডের কল্যাণে হাতের লেখা ভুলতে বসেছি। উন্নত দেশের স্কুলে নাকি পরীক্ষা ল্যাপটপে নেওয়া হচ্ছে। কারণ তাদের হাতের লেখা যাচ্ছেতাই।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার মধ্য দিয়ে পৃথিবী এগিয়েছে। যত নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে ততই মানুষ মানুষ থেকে মুখ ফিরিয়ে যান্ত্রিকতায় মগ্ন হচ্ছে। আমরা আজ যন্ত্রের দখলে। চব্বিশ ঘণ্টার একটি বড় অংশই কাটছে যন্ত্রের সঙ্গে। এই যন্ত্র ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই তরুণ। আজকাল কিশোর-তরুণদের হাতে হাতে মোবাইল ট্যাব। চোখের মণি সর্বদাই সেসব ডিজিটাল প্রযুক্তির পর্দায় স্থির হয়ে আছে। বাস, ট্রেনে সব জায়গাই এক দৃশ্য। যে সময়টাতে তাদের বই নিয়ে পড়ালেখা করার কথা সে সময়টাতে তার ফেইসবুকে বা ম্যাসেঞ্জারে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত রয়েছে অথবা কোনো ছবি আপলোড করতে ব্যস্ত। অথচ ফেইসবুকের মাধ্যমেও কিন্তু লেখাপড়া করা বা পাঠ্যবইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ শেয়ার করে বন্ধুদের সঙ্গে পড়া কোনো কঠিন বিষয় নয়। তবে সেটা খুব কমই হচ্ছে।
বিভিন্ন গবেষণা ও পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষার মান অনেক নেমে গেছে। ১৯৮২ সালের পর গত বছরই প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাহিত্য পড়ার হার সবচেয়ে কম। গত বছর মাত্র ৪৩ শতাংশ মানুষ বছরে মাত্র একটি বই পাঠ করেছেন। প্রতিদিনই বাড়ছে তরুণদের অনলাইনে কাটানো সময়ের হার। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে কিশোর বয়সীদের মধ্যে একাকিত্বের মাত্রা সবচেয়ে বেশি এবং ২০০৭ সালে আইফোন বাজারে আসার পর থেকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে অবনতি ঘটেছে।
সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ থেকে দেওয়া তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৩৩ লাখ ফেইসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে। এই ব্যবহারকারীর ৯১ শতাংশই ফেইসবুক ব্যবহার করে। এর মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ পুরুষ এবং ৬৩ লাখ নারী ফেইসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে। এই জরিপের বাইরেও ফেইসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে। এমনকি মাধ্যমিক পর্যায় শুরু করা উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীরাও ফেইসবুকে সারা দিন মুখ গুঁজে থাকে। এর সংখ্যাও কম নয়। লাইব্রেরিতে গিয়ে ভালো বই খোঁজাখুঁজি করছে এমন তরুণদের সংখ্যা হাতেগোনা। মূলত আগ্রহটাই কমে যাচ্ছে। বই আমাদের বড় বন্ধু হলেও আজকাল মোবাইল আর ফেইসবুকই বড় বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়েছে! এটা খুব একটা শুভ সংকেত নয়।
অনেকে মনে করেন, বর্তমানে ভালো ভালো বই প্রকাশ হচ্ছে না। সে কারণে বই পাঠ প্রীতি কমছে। অনেকে দায়ী করছেন প্রকাশকের মানহীন বই প্রকাশকে। অন্যদিকে রয়েছে ভালো লেখার অভাব। কেউ কেউ মনে করেন বই বিমুখতার জন্য দায়ী ব্যস্ত জীবনব্যবস্থা। আজকের শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়তই কোচিং-স্কুল-প্রাইভেট-কোচিং চক্রে বন্দি। ফলে পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার অবসর মিলছে না তাদের। কেবল জিপিএ ৫ প্রাপ্তির জন্য পড়লেই হবে না, ভালো মানুষ হওয়ার জন্য, সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য পড়তে হবে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার, ভালো মানের গ্রন্থাগার ও বই পাঠের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে মানুষের মধ্যে বইপ্রীতি বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীদের বইমুখী করতে হলে বাবা-মা ও শিক্ষকদের ভূমিকা রাখতে হবে। মা-বাবা ও শিক্ষকরা বই পড়তে শিক্ষার্থীকে উৎসাহিত করবেন। সপ্তাহে একদিন ৩০ মিনিট বই পাঠের একটি ক্লাস থাকতে পারে। প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি এবং অপব্যবহারের প্রভাব জীবনের নানাক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর ফলে সাইবার অপরাধও বাড়ছে।
সমৃদ্ধিশালী জাতি গড়ে তুলতে হলে বই পাঠের বিকল্প নেই। মানুষের মনের উৎকর্ষতা লাভের জন্য বই পড়া বাড়াতে হবে। সেজন্য প্রযুক্তির অপব্যবহার দূর করতে হবে। আর মনের উৎকর্ষতা লাভ হলেই একজন মানুষ মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন প্রকৃত মানবে পরিণত হতে পারে। তাই এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে এবং বই পড়া আর পাঠাগার স্থাপনে আগ্রহ বাড়াতে হবে এবং ছোটদেরও উৎসাহিত করতে হবে বেশি বেশি বই পড়তে।
লেখক : শিক্ষক
আব্দুল বায়েস। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। অর্থশাস্ত্রে বিশাল পান্ডিত্য তার। ৪০ বছর ধরে জড়িত অধ্যাপনার সঙ্গে। ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য। বর্তমানে আছেন ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে। খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। আইএমএফের ঋণপ্রাপ্তি, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, আর্থিক খাতে এর প্রভাব এবং গণমানুষের জীবনমান নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বললেন দীর্ঘক্ষণ। হৃদ্যিক সেই আলাপচারিতা তুলে ধরা হলো পাঠকের উদ্দেশে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- সহকারী সম্পাদক তাপস রায়হান।
দেশ রূপান্তর : জাতীয় অর্থনীতির যে বাস্তবতায়, আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হলো তাতে কি সংকট কাটবে?
আব্দুল বায়েস : কাটবে তো বটেই। তবে সংকটের মাত্রা কতটুকু, আর আমি পেয়েছি কতটুকু- এই দুটোর হিসাব করতে হবে। বর্তমানে যে সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি এবং সামনে যে সংকট দেখা দেবে- তা উত্তরণে, এই ঋণ সমস্যার সমাধান আনবে।
দেশ রূপান্তর : পেয়েছি কতটুকু? এটা কোত্থেকে পাব? কে দেবে- সরকার?
আব্দুল বায়েস : না। এটা তো দেবে, আইএমএফ।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু এর ফলে সাধারণ জনগণের ওপর, বাড়তি একটা চাপ তৈরি হবে না?
আব্দুল বায়েস : বাড়তি চাপ অনেক আগেই আসা উচিত ছিল। তাহলে আজ আইএমএফের কাছে যাওয়ার দরকার ছিল না।
দেশ রূপান্তর : যেমন?
আব্দুল বায়েস : আগেই যদি ট্যাক্স রেট বাড়ানো হতো জিডিপির অনুপাতে, করপোরেট শাসন সংস্কার করে, অটোমেশন এনে, বর্তমান সমস্যার সমাধান করা যেত। এসব তো ১৫ বছর ধরে কথা হচ্ছে। এই যে বিভিন্ন সেক্টরে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে, এটা কেন? আমাকে আগে, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক থাকতে হবে।
দেশ রূপান্তর : এর মানে, আমাদের ব্যর্থতার কারণেই ঋণ নিতে হলো?
আব্দুল বায়েস : অবশ্যই। তবে এটা পুরোপুরি ‘ব্যর্থতা’ না বলে, পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা বলা ভালো। তবে এটাও ঠিক, পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় ব্যর্থ হয়েছে বলেই- প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের জন্ম হয়েছে। সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে বলেই, এই মার্কেট ইকোনমির উৎসব। একটা ব্যর্থতা, আরেকটার জন্ম দেয়।
প্রথম দিকে যখন আইএমএফের ঋণ নেওয়া হতো, তখন মিছিল-মিটিং-জ্বালাও পোড়াও হতো। এখন তো ‘টুঁ’ শব্দও কেউ করে না। কেন করে না? তারা বুঝতে পেরেছে, বাস্তবতা অনেক কঠিন। আমার মনে হয় ঋণ, ‘আপাত’ একটা স্বস্তি দেবে। কিছু দিনের জন্য। এই সময়ের মধ্যে যদি বিভিন্ন সংস্কার না করতে পারে, তাহলে সরকারকে পস্তাতে হবে। চড়া মূল্য দিতে হবে।
দেশ রূপান্তর : ব্যাংক ব্যবস্থাপনা সংস্কার, দুর্নীতি হ্রাস, অর্থ পাচার রোধ এবং খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সরকারের আগ্রহ কেমন?
আব্দুল বায়েস : এবারই প্রথম না। এর আগেও আইএমএফের ঋণ নেওয়া হয়েছে। তখনো এসব শর্ত ছিল। কিন্তু তাতে কী হয়েছে?
দেশ রূপান্তর : এসব বিষয়ে সরকারের আগ্রহ কম- এটাই আপনি বলতে চাইছেন?
আব্দুল বায়েস : নেই তো। একেবারেই নেই। সরকারের আগ্রহ হলো- ব্যাংক লুট হচ্ছে? ঠিক আছে। কিছু টাকা দিয়ে, এটিকে বাঁচিয়ে রাখো। দেখো- বেসিক ব্যাংক, ফার্মারস ব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। কেন? এদের পারফরমেন্স কী? সমাজে এদের অবদানই বা কী? কিচ্ছু না। আমি কেন বলছি না- এই দায় আমি নেব না? মিল-কলকারখানা সব কিছুই তো। হ্যাঁ, সংস্কার করা কঠিন। এটি অ্যান্টিবায়োটিকের মতো। বর্তমানে কষ্ট দেবে। তবে, ভবিষ্যতে ভালো ফল দেবে।
দেশ রূপান্তর : আরেকটু পরিষ্কার করলে ভালো হতো?
আব্দুল বায়েস : সরকারের সারপ্লাস বাড়বে। বাজেট ডেফিজিট কমবে। সরকার সেটিকে উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করতে পারবে। বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে ব্যয় করতে পারবে। আমাদের এখানে ট্যাক্স রেট অনেক কম। মাত্র ১০%। ২০-৩০% সব দেশে।
দেশ রূপান্তর : তাহলে কি আপনি কর বৃদ্ধির কথা বলছেন?
আব্দুল বায়েস : না, না। তা বলছি না। ব্যক্তির ওপর কর বৃদ্ধির কথা বলছি না। নেট কর বাড়ানোর কথা বলছি। দুটো উপায়ে, রাজস্ব বাড়ানো যায়। এর একটি হচ্ছে- নেট বাড়ানো। উপজেলা পর্যায়ে যে সমস্ত বাড়ি-গাড়ি, তারা কি সবাই ট্যাক্স দেয়? আর, ব্যাংক কারা তৈরি করে? খেলাপি কারা? সেখানে সুব্যবস্থা আনতে হবে।
দেশ রূপান্তর : বিদ্যুৎ, জ¦ালানি, সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকি তুলে দিলে সমাজে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে?
আব্দুল বায়েস : কৃষিতে কোনোভাবেই ভর্তুকি কমানো যাবে না। এটা প্রয়োজনীয়। যত শর্তই তারা দিক। এটা ঠিক হবে না।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু নিত্যপণ্যের মূল্য তো দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে না?
আব্দুল বায়েস : তা তো অবশ্যই। কিন্তু তা হচ্ছে, সরকারের অদক্ষতার জন্য। কারণ, চুরি-অপচয়-দুর্নীতি আমি থামাতে পারছি না। সেই দায় পড়ছে, সাধারণ মানুষের ওপর। একটা উদাহরণ দিই। এই যে, ব্যাংকে সুদের হার- এত বেশি কেন? এর কারণ হচ্ছে- হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যারা ডিফল্টার, ব্যাংকের সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া হয়- সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দায়ভার সব সাধারণ মানুষের। তাতে কোনো সংকট হবে না। আইএমএফ যত শর্তই দিক, লাভ নেই। মনে রাখতে হবে, এই সরকার
কৃষিবান্ধব। কৃষির ওপর কোনো হুমকি এলে, এটা মেনে নেওয়া হবে না। এই সরকার কৃষিক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়নি। দেবেও না। তবে কৃষিক্ষেত্রে কিছু দুর্নীতি আছে।
দেশ রূপান্তর : ম্যাক্রো অর্থনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে?
আব্দুল বায়েস : হ্যাঁ, পড়বে তো। তবে, ক্রাইসিসের সময় আমাকে নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। বাংলাদেশে একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে লাভ আছে? সব লস। শুধু বিপিসি, যেটা মনোপলি। সেটা প্রচুর লাভ করে। কিন্তু প্রতিযোগিতা করে লাভ করেছে, এমন একটা খাতও নেই। কিন্তু কোরিয়াতে আছে। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস লাভ করছে। সেখানে বাংলাদেশ বিমান লস করে, রেলওয়ে লস করে- তাকে বাঁচাতে হবে! তাদের ভর্তুকি দিতে হবে। কেন? আমি বুঝি না।
দেশ রূপান্তর : বিশ্বের অনেক দেশ, আইএমএফের ঋণ নিয়ে বিপদে পড়েছে। আমাদের কি তেমন কোনো সম্ভাবনা আছে?
আব্দুল বায়েস : বিপদে পড়েছে অনেক দেশ- পড়বেই তো? পৃৃথিবীর বহু দেশ আইএমএফের ঋণ নিয়ে সমস্যার সমাধান করেছে। আবার কেউ কেউ পানিতে পড়েছে। ঋণ নিয়ে, ঘি খেলে তো তাই হবে। টাকার সুষ্ঠু ব্যবহার হলে, তেমনটি হওয়ার কারণ নেই। এটা ক্ষুদ্রঋণের মতো। তবে বাংলাদেশ অনেক ভালো অবস্থায় আছে। একদম ‘বটমলেস বাস্কেট’ থেকে আজকের পর্যায়ে আসতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। পরের স্টেজ কিন্তু অনেক কঠিন।
দেশ রূপান্তর : কেমন?
আব্দুল বায়েস : এখন প্রবৃদ্ধির হার গড়ে, ৬%। নিতে চাই, ৮-৯%। আমরা অনেক ভালো অবস্থায় আছি। তবে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে হলে, অনেক পরিশ্রম করতে হবে। যদিও আমাদের মাথাপিছু আয়, প্রায় ২,৯০০ ডলার।
দেশ রূপান্তর : মাথাপিছু আয় বা পার ক্যাপিটা ইনকাম- বিষয়টা কি সমাজে, সঠিক চিত্র দেয়? কারণ, দেশের সবার আয় তো সমান না? এখন জনসংখ্যার হিসাবে তাকে ভাগ করলে কি তা, বাস্তবসম্মত হবে?
আব্দুল বায়েস : (মুচকি হেসে) তা ঠিক না। এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। সারা পৃথিবীতেই এটা চলছে। এই ইনডিকেটরটাই নিতে হবে। এই হিসাব ছাড়া আর কোনো হিসাব কেউ তো দিতে পারে না। সারা পৃথিবীতেই, তাই। আমাদের সময় গরিবরা তো স্যান্ডেল পরত না। এখন পরে। এখন সাধারণ মানুষের আয় বেড়েছে। এটা তো সত্যি।
তবে, সমাজে বৈষম্য বেড়েছে অনেক।
দেশ রূপান্তর : এই বৈষম্য কমিয়ে আনার কোনো পথ নেই?
আব্দুল বায়েস : কেন থাকবে না। অনেক পথ আছে। যাদের আয় বেড়েছে, তাদের কাছ থেকে ৫০% ট্যাক্স নিলেই হয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই, এভাবে নেওয়া হচ্ছে। নরওয়ে, সুইডেন, কানাডায় তো তাই হচ্ছে।
দেশ রূপান্তর : আইএমএফের বিভিন্ন শর্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পরিবেশ তৈরি, মানব দক্ষতা বৃদ্ধি, আর্থিক খাতে সুশাসন, এবং ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করা। এসব ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কেমন?
আব্দুল বায়েস : এগুলো জটিল কিছু না। দিতে হয়, তাই দিয়েছে। একটা আমলাতান্ত্রিক বিষয় আছে না? তবে কিছু বিষয় তো আন্তরিকতা থাকলে, উন্নত করাই যায়। যেমন ধরো, ঋণখেলাপির বিষয়। এটা তো কঠিন কিছু না। এসব হচ্ছে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়। এটা তো কোনো টেকনিক্যাল বিষয় না। বাংলাদেশ যত জায়গা থেকে টাকা এনেছে, এই শর্ত ছিলই।
তবে মোদ্দাকথা হচ্ছে, এই ঋণটাকে ‘গোল্ডেন অপরচুনিটি’ মনে করে- সংস্কারগুলো করে ফেলা। দেরি করা ঠিক হবে না। সংস্কারবিরোধী মনোভাব তো একটা আছেই। বাই নেচার, বাংলাদেশ সোশ্যালিস্ট ওরিয়েন্টেড সোসাইটি। জন্মের থেকেই, আমাদের মধ্যে বামপন্থি একটা চিন্তাভাবনা কাজ করে। প্রীতিলতা, কমরেড মণি সিংহ, কমরেড ফরহাদের বংশধর আমরা। একটা সোশ্যালিস্ট ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আমাদের জন্ম। যদিও আওয়ামী লীগ বুর্জোয়া অর্থনীতির দ্বারাই পরিচালিত।
দেশ রূপান্তর : পুঁজিবাজারের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক রয়েছে?
আব্দুল বায়েস : আমার মনে হয় না।
বিজ্ঞানীদের নিত্যনতুন আবিষ্কারে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে আমাদের জগৎ। প্রযুক্তির উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে দেশ, বদলে যাচ্ছে গতানুগতিকতা, পরিবর্তন ঘটছে মানুষের জীবনধারায়। মানুষের জীবন সহজ, আরামদায়ক ও নিরাপদ করতে প্রযুক্তি অবদান রাখছে বড় মাত্রায়। জীবনের মুখ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে প্রযুক্তি। বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত আধুনিক প্রযুক্তির খোঁজ করে চলেছেন। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী শুরু হয়ে গেছে প্রযুক্তির বিপ্লব। রোবট, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইনে কেনাকাটা, রাইড, সর্বাধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, ফিশিং প্রযুক্তি, চালকবিহীন গাড়ি, ড্রোন, এআই সংবাদ পাঠকসহ বিচিত্র সব উদ্ভাবন মানুষের বিস্ময়ের সীমাকেও যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
হাতে থাকা ছোট্ট একটি মোবাইল ফোন হয়ে উঠেছে মানুষের সবচেয়ে বেশি ভরসার জায়গা। রাজ্যের সব কাজই সে করে দিচ্ছে। একটি স্মার্ট ফোন থাকলে ঘড়ি, টর্চলাইট, ক্যামেরা, পোস্ট অফিস, ব্যাংক, এমনকি রেডিও-টিভিরও দরকার নেই, দশভুজার মতো বিচিত্র ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন। দিন দিন বাড়ছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তির জোয়ারে ভাসছে আজকের প্রজন্ম। অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে প্রযুক্তির সম্প্রসারণ হচ্ছে ব্যাপক হারে।
সম্প্রতি প্রযুক্তিজগতে আলোড়ন তুলেছে চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার বা চ্যাটজিপিটি নামে একটি চ্যাটবট (সার্চ টুল)। এটা চালু করেছে ওপেনএআই। আপাতত পাবলিক টেস্টিংয়ের জন্য এটির ব্যবহার উন্মুক্ত করা হয়েছে। ওপেনআই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি কোম্পানি, যার একজন প্রতিষ্ঠাতা হলেন ধনকুবের ইলন মাস্ক।
গুগল মেল তথা জিমেইলের নির্মাতা পল বুহে বলেছেন, “বড়জোর এক থেকে দুবছর। তার পরই গুগল পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যাবে। যে সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে তথ্য দিয়ে গুগল সবচেয়ে বেশি আয় করে, তাকে ধ্বংস করে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। গুগল নিজেও যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেয়, তা হলেও তাকে নিজের ব্যবসার সবচেয়ে লাভজনক অংশটাকে নষ্ট করতে হবে।”
গুগল-এ একেবারে গোড়ার দিকের কর্মী বুহে। স্বভাবতই তার মুখে গুগলের ধ্বংসের এমন আভাস শুনে বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়। যে প্রযুক্তির দাপট দেখে বুহে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সেই সংস্থা খুব অল্প দিনে আলোড়ন ফেলেছে ই-দুনিয়ায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বলে বলীয়ান সফটওয়্যার ‘চ্যাটজিপিটি’-র সাফল্য দেখেই তিনি এই মন্তব্য করেছেন। মাত্র তিন মাস আগে অর্থাৎ গেল বছরের নভেম্বরের শেষে প্রযুক্তি-সংস্থা ‘ওপেন এআই’ ওই সফটওয়্যারটি প্রকাশ করে। তারপর ঝড়ের বেগে তা জনপ্রিয় হয়েছে বিশ্বজুড়ে।
প্রকাশের পাঁচ দিনের মধ্যে ১০ লাখ মানুষ চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা শুরু করেন। ওই সংখ্যক ব্যবহারকারী পেতে ইন্সটাগ্রামের লেগেছিল আড়াই মাস, ফেইসবুকের দশ মাস। কীসের টানে চ্যাটজিপিটির জন্য ছুটছে ই-জনতা? কোন শক্তিতেই বা এই সদ্যোজাত প্রযুক্তি-পণ্য গুগলকেও মুছে ফেলার ইঙ্গিত দিচ্ছে? এর উত্তর হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সেই প্রযুক্তির জোরেই চ্যাটজিপিটি-র সঙ্গে একটা মূলগত ফারাক হচ্ছে গুগলের। গুগলে কোনো বিষয় সম্বন্ধে ‘সার্চ’ করলে সেই সম্পর্কিত একাধিক ওয়েবসাইটের ঠিকানা সে হাজির করে। কোন কোন সাইটের নাম গুগল দেখাবে, তা ঠিক হয় ওই সমস্ত সাইটের গুগলকে দেওয়া অর্থ থেকে। সেটাই গুগলের আয়ের প্রধান উৎস। যিনি সার্চ করছেন, তিনি গুগলের এক বা একাধিক ওয়েবপেজ বা পাতা উল্টেপাল্টে, সেই সব পাতায় থাকা একাধিক ওয়েব ঠিকানায় গিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিতে পারেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জোরে এই জায়গাতেই গুগল বা অন্য যে কোনো সার্চ ইঞ্জিনকে টেক্কা দিতে চাইছে চ্যাটজিপিটি। সেখানে কোনো প্রশ্ন করলে কোনো ওয়েবসাইটের ঠিকানা নয়, একেবারে হাতেগরম উত্তর নিয়ে হাজির হচ্ছে সে। আপাতদৃষ্টিতে চ্যাটজিপিটির দেওয়া সেই উত্তর এতটাই নিখুঁত যে, তা কোনো বিশেষজ্ঞের লেখা বলে বিশ্বাস হতে বাধ্য।
দৈনন্দিন আটপৌরে প্রশ্ন থেকে তত্ত্ব বা দর্শন, সমাজ-রাজনীতি থেকে কবিতাÑ সব কিছু নিয়েই প্রশ্নের বিশদে উত্তর দিচ্ছে এই ই-নবজাতক। সেই উত্তর এতটাই তথ্যসমৃদ্ধ যে, গুগল ঘেঁটে নানা ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিয়ে লিখলেও তা হওয়া কঠিন। যেমন, দিনে ভিটামিন ডি-র ডোজ সবচেয়ে বেশি কত হতে পারে, তা জিজ্ঞাসা করলে গুগল যেখানে একাধিক ওয়েবসাইটের ঠিকানা এনে হাজির করত, সেখানে চ্যাটজিপিটি তা নিয়ে পরিপাটি প্রবন্ধ লিখে দিচ্ছে। জাপানি কবিতা হাইকু লিখতে বললে তাও লিখে ফেলছে চ্যাটজিপিটি!
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমন নিখুঁত হয়ে ওঠাই গুগলের চিন্তার কারণ। গুগল এসে তার পূর্বসূরি ইয়েলো পেজেস-এর যা হাল করেছিল, সেই অবস্থাই গুগলের হবে বলে আঁচ করছেন তারা। মানুষ খোঁজার সময়টুকু না ব্যয় করে সাজানো গোছানো বিশদ তথ্য পেতে গুগল ভুলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিকেই ঝুঁকবেন বলে তাদের মত।
চ্যাটজিপিটির এই শক্তিতেই লুকিয়ে রয়েছে বিপদের বীজ। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই অ্যাপ ব্যবহার করলে শিশুদের যুক্তিশক্তি হ্রাস পাবে। সেই কারণে ভবিষ্যতে মানুষের সমস্যা সমাধানের দক্ষতাও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবে। তা ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে তথ্য বা জবাব এনে হাজির করছে, সেই বুদ্ধিমত্তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার পক্ষপাতের দোষ। যারা সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোপণ করেছেন যন্ত্রে, তাদের মনে থাকা পক্ষপাত, আসক্তি-অনাসক্তি সবই চলে যাচ্ছে যন্ত্রের মগজে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, চ্যাটজিপিটির উত্তরে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মনে থাকা শ্রেষ্ঠত্ব, আধিপত্যের মনোভাব স্পষ্ট। লিঙ্গ, জাতি, বর্ণ নিয়ে যন্ত্রের মগজে রয়েছে বিভাজনমূলক ধারণা। একটি প্রশ্নের উত্তরে সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্বার্থপরদের ‘পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা’র কথা বলেছে। তাই আইন, বিচার, নৈতিকতা এসব সম্বন্ধেও তার মনোভাব গা-জোয়ারি শোনাচ্ছে অনেক সময়েই।
দুনিয়া এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গ্রাসে চলে গেলে আরও একটি বিপদ সাইবার সুরক্ষার ক্ষেত্রে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জোরে সাইবার অপরাধীদের কাজকর্ম, যেমন নকল ই-মেইল লিখে টোপ দেওয়া এতটাই নিখুঁত হয়ে যেতে পারে, যা চেনা দুরূহ হয়ে পড়বে। গুগলের প্রধান সংস্থা অ্যালফাবেট-এর সিইও সুন্দর পিচাই ও জেফ ডিনও সম্প্রতি কর্মীদের নিয়ে একটি বৈঠকে চ্যাটজিপিটির এই সীমাবদ্ধতার কথা বলে গুগলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন। ওপেন এআই-এর সিইও স্যাম অল্টম্যান স্বয়ং গত ১১ ডিসেম্বর টুইট করেছেন, “এখনই চ্যাটজিপিটি-র ওপর যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্ভর করা মারাত্মক ভুল। এর সীমাবদ্ধতা না জেনে মহান ভাবাটা মারাত্মক ভুল হবে। নির্ভরযোগ্য ও সত্যনিষ্ঠ হয়ে উঠতে আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে।”
এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সরঞ্জামের আবির্ভাব হওয়ায় যে লাখ লাখ কর্মসংস্থানের ওপর সংকটের মেঘ নেমে আসতে পারে, তা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে শিক্ষাক্ষেত্র, কন্টেন্ট রাইটিং এবং সফটওয়্যারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যদি এই অ্যাপটি সমস্ত দেশে পুরোপুরি কার্যকর হয়, তাহলে এর কারণে বহু মানুষ কাজ হারাতে চলেছেন।
দ্য গার্ডিয়ান-এ কলাম লিখেছেন হেনরি উইলিয়ামস নামের এক কপিরাইটার। তিনি চ্যাটজিপিটি-র সঙ্গে একটি কথোপকথন তুলে ধরেছেন। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, ‘তুমি কি মানুষের চাকরি খেয়ে ফেলবে?’ জবাবে চ্যাটজিপিটি যা লিখেছে, তার সারসংক্ষেপ হলো, ‘আমি একধরনের ভাষা মডেল। আমার নিজের পক্ষে এ-জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা নেই বা এ বিষয়ে মত দেওয়ারও আমি কেউ নই। তবে ধারণা করা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের সঙ্গে এবং বিভিন্ন শিল্পে অটোমেশন হলে অনেক মানুষ চাকরি হারাবে। আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় অনেক নতুন চাকরির সৃষ্টি হবে। সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থানে এর প্রভাব সরলরৈখিক হবে না, বিষয়টি জটিল। বিষয়টি নির্ভর করবে সরকারের নীতি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ওপর।’
তবে চ্যাটজিপিটি নিয়ে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেবল গুগলে তথ্য খোঁজা নয়, নিজের যাপনেও এই অভ্যাসই আমাদের জীবনকে চিনতে, জানতে, বুঝতে শেখায়। তার বদলে কেবল একপাক্ষিক একটা সাজানো-গোছানো পথ পেলে, কেবল সেই পথেই অন্ধের মতো কি আমরা মানুষ হিসেবেই আরও গণ্ডিবদ্ধ, কূপমন্ডুক হয়ে পড়ব না? রবার্ট ফ্রস্টের ‘দ্য রোড নট টেকেন’ কবিতার সেই কম চলা পথে চলে, বেছে নেওয়ার আনন্দেই জীবনের পূর্ণতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপজ্জনক পারিপাট্যে নয় এটা আমাদের সবারই মনে রাখতে হবে।
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
সম্প্রতি স্মরণকালের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা ২৩ হাজার ছাড়িয়েছে। তুরস্কের ১০টি অঞ্চলে মারা গেছে ১৯ হাজার ৮৭৫ জন। আর সিরিয়ায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৩ হাজার ৩৭৭ জনের। এই ভূমিকম্পে নিহতদের প্রতি আমরা জানাই গভীর শোক এবং আহতদের প্রতি সহমর্মিতা। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ একদিকে যেমন বিপর্যয় ডেকে আনে, তেমনি তা সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মানবিক বার্তা প্রদানের সুযোগও এনে দেয়। তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পের পঞ্চম দিনেও উদ্ধারকাজের অনেক বাকি। এখনো ধসে পড়া অনেক ভবনে শুরু হয়নি উদ্ধার তৎপরতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, সময় যত যাবে, মৃত্যুর সংখ্যা ততই বাড়বে। শেষ অবধি এ সংখ্যা কোথায় থামবে তার কোনো ধারণাও তাদের নেই। এ মধ্যে তীব্র ঠান্ডা, বৃষ্টি, যোগাযোগে বিপর্যয়সহ নানা সমস্যায় উদ্ধার ব্যাহত হওয়ায় ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়াদের জীবিত উদ্ধারের আশা ফিকে হয়ে আসছে। আশ্রয়, খাবার, পানি, জ্বালানি ও বিদ্যুতের অভাবে উপদ্রুত এলাকাগুলোর বেঁচে থাকা মানুষেরা রয়েছে প্রাণ সংশয়ে। ফলে বিশ^বাসীর দায় এখন মানবিক সহায়তার হাত বাড়ানোর। ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপে অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজ শুরু করেছে বাংলাদেশের সম্মিলিত উদ্ধারকারী দল। এরই মধ্যে দেশটির আদিয়ামান শহরে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরীকে জীবিত এবং তিনজনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন দলটির সদস্যরা। শুক্রবার রাতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে পাঠানো বার্তায় এসব তথ্য জানানো হয়। দীর্ঘদিন ধরে দুর্যোগ, দুর্ঘটনার বিপর্যয়ে মোকাবিলা করে পরিস্থিতিতে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা চালাতে এক ধরনের সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এদিকে ভূমিকম্প-পরবর্তী সাহায্য হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ত্রাণ ও চিকিৎসাসামগ্রী সিরিয়ায় পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। বন্ধুরাষ্ট্রের বিপদে ত্বরিত সাড়া দেওয়ার পাশাপাশি সহায়তায় এগিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে শোকও পালন করছে।
তবে ভূমিকম্পের ১১০ ঘণ্টা পরও শুক্রবার দুই দেশেই কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো কোথাও কোথাও প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা। ঠান্ডায় জমে যাওয়া আবহাওয়ার মধ্যে খোলা আকাশের নিচে কিংবা গাড়ির ভেতরে তৃতীয় রাত পার করেছে তুরস্ক এবং সিরিয়ার বহু মানুষ। ভূমিকম্পে তাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে কিংবা হেলে পড়েছে। সেখানে আর ফিরে যাওয়ার সাহস নেই কারও। গৃহহীন হওয়া লাখো মানুষ সাহায্যের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত উদ্ধারের আশাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। পাঁচ দিন ধরে উদ্ধারকর্মীরা যেমন দুর্গতদের বাঁচানোর লড়াই করে যাচ্ছেন, তেমনি বেঁচে থাকার লড়াই করতে হচ্ছে বেঁচে যাওয়াদেরও। সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, তুরস্কে উৎফুল্ল হওয়ার মতো উদ্ধারের কিছু ঘটনা ঘটলেও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের পরিস্থিতি ক্রমেই আশাহীন হয়ে উঠছে। সিরিয়ায় বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধের কারণে আগে থেকেই অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছিল। এর মধ্যে ভয়াবহ এ ভূমিকম্পে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা তুরস্ক ও সিরিয়ায় ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা শুরু করলেও তা বিপর্যয়ের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে, অন্যান্য দেশ, জাতিসংঘ, রেডক্রসসহ সবাইকে আরও তৎপর হতে হবে। দুর্গত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য বিশ্বের সব দেশ, মানবিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই।
ভূমিকম্প মোকাবিলায় মানুষের কিছু করণীয় না থাকলেও ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণ করতে পারলে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েকটি প্লেট থাকার কারণে এসব এলাকা ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা শহরে অনেক বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে ইমারত নীতিমালা না মেনে। ফলে সামান্য ভূমিকম্প হলেও বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা আছে। বিবিসির সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়েছে তুরস্কে নীতিমালা না মেনে সুউচ্চ ভবন তৈরি করায় এবং ভবন তৈরির আইন না মেনে তৈরি বাড়ির অনুমতি প্রদানের ঘটনা সাম্প্রতিক এই ভূমিকম্পে এত বেশিসংখ্যক ভবন ধসের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকায় এর চেয়ে কম শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্প হলেও পরিস্থিতি কী হবে, অনুমান করা কঠিন নয়।
শিশুসাহিত্যিক ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী খগেন্দ্রনাথ মিত্রের জন্ম কলকাতায় ২ জানুয়ারি ১৮৯৬ সালে। তার বাবার নাম শৈলেন্দ্রনাথ মিত্র। ১৯২০ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। প্রথমে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করেছেন, পরে বামপন্থি রাজনীতিতে যুক্ত হন। রেলে চাকরি করতেন। একসময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে সর্বক্ষণের জন্য সাহিত্য সাধনায় ব্রতী হন। ভারতবর্ষ, প্রবাসী, মহিলা ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। আরএম ব্যালেন্টাইনের ‘গোরিলা হান্টার’ অবলম্বনে তিনি লেখেন ‘আফ্রিকার জঙ্গলে’, যা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। তার বিখ্যাত রচনা ‘ভোম্বল সর্দার’ ছাড়াও ‘ডাকাত অমনিবাস’, ‘পাতালপুরীর কাহিনী’, ‘অতীতের পৃথিবী’, ‘আবিষ্কারের কাহিনী’, ‘ঝিলে জঙ্গলে’, ‘বাংলার ডাকাত’ প্রভৃতি। ১৯৪৮ সালে দৈনিক পত্রিকা ‘কিশোর’ তার সম্পাদনায় বের হয়। এ ছাড়া তিনি সম্পাদনা করেন ‘নতুন মানুষ’, ‘ছোটদের মহল’, ‘সপ্তডিঙ্গা’, ‘বার্ষিক শিশুসাথী’, ‘মানিকমালা’ ইত্যাদি পত্রিকা। তার সম্পাদিত ‘শতাব্দীর শিশুসাহিত্য ১৮১৮-১৯৬০’ বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তিনি ভুবনেশ্বরী পদক, মৌচাক সাহিত্য পুরস্কার, গিরীশ রৌপ্যপদকসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৫ সালে ভারতের জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হন, কিন্তু শিশুসাহিত্যের জন্য পাঁচ হাজার থেকে কমিয়ে পুরস্কার মূল্য এক হাজার টাকা বরাদ্দ করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলের আলো ঝলমলে অডিটোরিয়ামে দেশি-বিদেশী মডেল ভাড়া করে এনে সাড়ম্বরে ঘোষণা করা হয়েছিল প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক নারী ফুটবল আসর ওমেন্স সুপার লিগের। সিনে জগতের তারকাদের সঙ্গে মঞ্চে র্যাম্প করতে করতে প্রত্যাশার ঘুড়িটা দূর আকাশে উড়িয়েছিলেন সাবিনা-সানজিদারা। দেশের ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপন এখন তারা। ফুটবলপ্রেমীদের তাদের নিয়ে অসীম আগ্রহকে পুঁজি করে কে-স্পোর্টস আর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন চেয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট করে ফায়দা লুটতে। তবে দিন যত গড়িয়েছে, মেয়েদের স্বপ্ন ধূসর হয়েছে। এখন তো তা মিলিয়ে গেছে বহুদূরে।
কে-স্পোর্টস-বাফুফের কর্তারা বুঝেছেন, তাদের লেখা চিত্রনাট্য আর বাস্তবতায় বড্ড ফাঁরাক। তাই তারা বারবার টুর্নামেন্ট শুরুর তারিখ দিয়েও আলোচিত টুর্নামেন্টকে মাঠে নিয়ে যেতে পারেননি। সর্বশেষ ১০ জুন আসর শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন খোদ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। সেটাও মিথ্যে হয়ে গেছে। তাই হতাশা ছাঁপিয়ে নারী ফুটবলারদের মনে ভর করেছে রাজ্যের ক্ষোভ।
কে-স্পোর্টস আর বাফুফের কর্তারা ভেবেছিলেন এমন একটা টুর্নামেন্টের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে হামলে পড়বে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বছর নেপালে সাফ শিরোপা জয়ের পর মেয়েদের নিয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই আসলে স্বপ্নবাজ করে তোলে সালাউদ্দিন-মাহফুজা আক্তার-ফাহাদ করিমদের। তবে হয়েছে উল্টো। সেটাই যে হওয়ার কথা! কে-স্পোর্টস কিংবা বাফুফে, দুটি প্রতিষ্ঠানই যে এখন ভীষণভাবে ইমেজ সঙ্কটে ভুগছে। এর মাঝে অগোচরে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে, যেটা কখনই প্রত্যাশিত ছিল না। কে-স্পোর্টস আর বাফুফের দেখানো স্বপ্নে বুদ হয়ে গিয়েছিলেন ফুটবলাররা। এমন একটা টুর্নামেন্টে খেলতে মুখিয়ে ছিলেন তারা। এমনিতে ঘরোয়া ফুটবল খেলে সেভাবে পারিশ্রমিক জুটে না। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে হলে একটা আকর্ষণীয় পারিশ্রমিকের হাতছানি ছিল। তারচেয়েও বেশি ছিল নানা দেশের নামী-দামী ফুটবলারদের সঙ্গে ড্রেসিং রুম শেয়ার করার সুবর্ণ সুযোগ। দারুণ একটা স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুখ বুজে মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন দিনের পর দিন। এর মাঝেই তারা দেখেছেন বাবার মতো কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের বিদায়। বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ন্যায্য দাবী পুরোপুরি পূরণ না হওয়ার পরও তারা বাফুফের কঠোর অনুশাসন মেনে দুঃসহ গরমে সকাল-বিকাল ঘাম ঝড়িয়েছেন। এরপর যখন দেখলেন এই স্বপ্ন বারবার হোচট খাচ্ছে কে-স্পোর্টসের ব্যর্থতা আর বাফুফের অদূরদর্শীতায়, তখন আর মুখ বুজে থাকতে পারলেন না। হতাশার কথা জানাতে গিয়ে অগোচরে তাদের কণ্ঠ থেকে বের হয়ে এসেছে ক্ষোভের আগুন।
অবস্থা বেগতিক দেখে তড়িঘড়ি বৃহস্পতিবার ক্যাম্প বন্ধ ঘোষণা করে বাফুফে। সিনিয়র খেলোয়াড়দের দেওয়া হয় পাঁচ দিনের ছুটি। বৃহস্পতিবার রাতে বাসে করে সাতক্ষীরাগামী সাফজয়ের অগ্রনায়ক সাবিনা খাতুন দেশ রূপান্তরকে মুঠোফোনে বলছিলেন, 'ওমেন্স সুপার লিগ স্রেফ আমাদের আবেগ নিয়ে খেললো।' একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, 'প্রথমত সাফের পর কোন খেলা নেই। তারপর এই লিগ মেয়েদের নিয়ে দুই দফা এত কিছু করলো, এত আশা দিলো, মেয়েরা খেলার জন্য মুখিয়ে ছিল। আর সব থেকে বড় ব্যাপার বিদেশী খেলোয়াড় যারা দক্ষিণ এশিয়ার, তাদের নিয়ে আমি নিজেও কাজ করছিলাম। তাদের কাছে এখন আমার সম্মান কই থাকলো! বারবার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। মেয়েরা অনেক আশায় ছিল। কিন্তু... । এটা নিয়ে অবশ্য মেয়েরা অনেক আগেই আশা ছেড়ে দিয়েছিল। এখন আমিও কোন আশা দেখছি না।'
সতীর্থদের সংগে ময়মনসিংহের কলসিন্দুরে বাড়ির যেতে যেতে জাতীয় দলের রাইট উইঙ্গার সানজিদা বলছিলেন, 'আসলে কিছু বলার ভাষাই হারায় ফেলেছি। একটা টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল। এর জন্য আমরা কঠোর অনুশীলণ করছিলাম। আশা ছিল খেলবো। এখন সেটা হচ্ছে না বলে খুব কষ্ট লাগছে। যখন শুনলাম লিগটা হবে না, তখন মনের অবস্থা কেমন হতে পারে, বুঝতেই পারছেন।'
সাফের পর কোন ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি সিনিয়র ফুটবলাররা। এ নিয়ে ভীষণ হতাশ সানজিদা বলেন, 'নয়টা মাস ধরে অপেক্ষায় আছি খেলার। প্রীতি ম্যাচ বলেন কিংবা কোন টুর্নামেন্ট, একটা ম্যাচও আমরা খেলতে পারিনি সাফের পর। অথচ আমাদের সঙ্গে যারা সাফে খেলেছে, তারা প্রায় সবাই পাঁচটা-ছয়টা করে প্রীতি ম্যাচ খেলে ফেলেছে এর মধ্যে।' মেয়েদের সিঙ্গাপুরে গিয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলার কথা ছিল, মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাই খেলার কথা ছিল। অথচ বাফুফে অর্থ সঙ্কটসহ নানা অযুহাতে তাদের খেলতে পাঠায়নি। সানজিদা বললেন, 'আমরা আসলে হতাশ হতেও ভুলে গেছি। বারবার টুর্নামেন্টে খেলার কথা বলা হয়, আবার সেটা বাতিল হয়। এরকমটা হতে হতে আসলে আমরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে গেছি।'
হতাশা, বঞ্চনায় বাফুফের চাকুরি থেকে পদত্যাগ করেছেন নারী দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। প্রিয় কোচের জন্য কষ্ট পান সানজিদা, 'ছোটন স্যারের হাত ধরেই আমার এখানে আসা। তার কাছেই আমার ফুটবলার হয়ে গড়ে ওঠা। তিনি চলে গেছেন। এতে খুব কষ্ট পাই। তিনি আমাদের অনেক আদর-যত্ন করতেন। বাবা-মেয়ের সম্পর্ক যেমন হয়, ঠিক তেমন সম্পর্ক ছিল।'
১৩ জুন সাবিনা-সানজিদাদের ক্যাম্পে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে বাফুফে। বিকল্প নেই বলে তারা হয়তো ফিরবেন। তবে ফেরার সময় তাদের চোখে থাকবে না বড় কোন স্বপ্ন। সেটা দেখাই বারণ। কে-স্পোর্টস আর বাফুফে মিলে যে মেয়েদের সব স্বপ্ন গলা টিপে মেরে ফেলেছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর মেয়ের জামাতাকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার, কাস্টমস ব্যাগেজ, ইমিগ্রেশনসহ অন্যান্য প্রটোকল দেওয়ার একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
অনেকেই চিঠিটি শেয়ার করে সমালোচনা করছেন। কেউ বলছেন, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই বলে কথা! কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই প্রটোকল কোন হিসেবে পান? আবার কেউবা বলছেন, একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে!
জানা যায়, গত ৬ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। পরে ৭ জুন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালককে চিঠিটি পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে চিঠিটির সত্যতাও পাওয়া যায়।
মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার উপসচিব ড. অমিতাভ চক্রবর্ত্তী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হকের মেয়ের জামাতা মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ৯ জুন শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর ইকে ৫৮৬ যোগে দুবাই থেকে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন। তাকে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের অনুমতিসহ মন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার মশিউর রহমানকে কাস্টমস ব্যাগেজ, ইমিগ্রেশন এবং বিমানবন্দরের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য বোর্ডিং ব্রিজ পাস দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিমানবন্দর পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্য পৃথক লাউঞ্জ রয়েছে। যেটাকে ভিআইপি লাউঞ্জ বলা হয়। ভিআইপি লাউঞ্জ কারা ব্যবহার করতে পারবেন এমন একটি স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের।
লাউঞ্জ রজনীগন্ধা, বকুল, দোলনচাঁপা ও চামেলি নামে বিমানবন্দরে ৪টি ভিআইপি লাউঞ্জ রয়েছে। রজনীগন্ধা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ভিআইপিরা ব্যবহার করেন। বকুল ব্যবহার করেন অতিরিক্ত সচিব বা তার পদমযার্দার ও সমমর্যাদার ব্যক্তিরা। দোলনচাঁপা ব্যবহার করেন সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আর চামেলি দিয়ে একুশে পদক পাওয়া ব্যক্তি, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রবেশ ও বের হতে পারেন।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।