
স্বীকার করতেই হবে একাত্তরের যুদ্ধে নেতৃত্ব ছিল পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের হাতে। তাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে যুক্ত হয়েছিল বুর্জোয়াদের ছোট একটি অংশ। বুর্জোয়াদের বড় একটি অংশের নীরব সমর্থনও ছিল। কিন্তু অন্যসব বড়মাত্রার আন্দোলনে যেমন, এটিতেও তেমনি নেতৃত্ব সংরক্ষিত ছিল পেটি বুর্জোয়াদের কাছেই। বুর্জোয়াদের সঙ্গে পেটি বুর্জোয়াদের পার্থক্য অবশ্যই ছিল, বুর্জোয়ারা ছিল অধিক বিত্ত ও ক্ষমতার অধিকারী, তাদের জানাশোনা ওঠাবসা রাষ্ট্রীয় উচ্চমহলের সঙ্গে, যোগাযোগ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। কিন্তু মিলের জায়গাটা এইখানে যে উভয় শ্রেণিই উন্নতির জন্য উন্মুখ। এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি। মুসলমান বুর্জোয়া এবং পেটি বুর্জোয়ারা উভয়ে ব্রিটিশ আমলে দেখতে পাচ্ছিল যে তাদের জন্য উন্নতির পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে অগ্রসর হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা। পথ মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানের দরকার ছিল। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর টের পাওয়া গেল যে উন্নতির পথটা যথেষ্ট প্রশস্ত হয়নি; হিন্দুরা চলে গেছে কিন্তু অবাঙালিরা এসে হাজির হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এই নবাগতদের হটাবার জন্যও প্রয়োজন হয়েছিল। আত্মমর্যাদার ওপর আঘাত তো ছিলই, উন্নতিতে বিঘ্ন সৃষ্টিও ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।
আন্দোলনের মূল শক্তি এসেছে জনগণের অংশগ্রহণ থেকেই; পাকিস্তান আন্দোলনে যেমন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও তেমনি। তবে জনগণের আকাক্সক্ষাটা ছিল ভিন্ন প্রকারের। সেটাকে স্বপ্নও বলা চলে। বাস্তবের সঙ্গে আকাক্সক্ষার মিশ্রণে উৎপাদিত স্বপ্ন। স্বপ্নটা ছিল এই আন্দোলন তাদের জন্য মুক্তি এনে দেবে। ব্রিটিশ যুগের পাকিস্তান বলতে তারা জমিদার ও মহাজনদের অর্থনৈতিক নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি বুঝেছে, পুলিশ ও আমলার অত্যাচার থেকে অব্যাহতির আশা করেছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক শোষণ থেকে মুক্তি দেবে বলে তারা ভরসা করেছে। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’, এমন আশঙ্কা মেহনতিদের তেমন একটা বিচলিত করেনি, কারণ মুখ থেকে কেউ ভাষা কেড়ে নিতে পারে এটা অবাস্তবই ছিল তাদের কাছে।
একাত্তরের যুদ্ধে পেটি বুর্জোয়া, বুর্জোয়া ও মেহনতি সব শ্রেণির মানুষেরই অংশগ্রহণ ছিল, যদিও তাদের স্বপ্ন ছিল ভিন্ন ভিন্ন। পেটি বুর্জোয়ার আকাক্সক্ষা বুর্জোয়া হবে, বুর্জোয়ার আকাঙ্ক্ষা আরও বড় মাপের বুর্জোয়া হয়ে উঠবে। অপর দিকে মেহনতিদের স্বপ্ন ছিল সার্বিক মুক্তির। সব শ্রেণির মানুষ এক কাতারে চলে আসতে পেরেছিল কারণ সাধারণ শত্রু ছিল পাঞ্জাবিদের নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র। সবাই একত্রে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়ছিল। তবে ওই পর্যন্তই। এর বাইরে আকাক্সক্ষা ও অংশগ্রহণে ঐক্য স্থাপিত হয়নি। দু’পক্ষই বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছে। তবে দুই বিপ্লবের চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধনীদের বিপ্লব শরৎচন্দ্রের সব্যসাচী যাকে বলেছে ভদ্রলোকের বিপ্লব, সেই বিপ্লব। অর্থাৎ অবাঙালিদের হাঁকিয়ে দিয়ে তাদের পরিত্যক্ত আসনগুলোতে নিজেরা বসে পড়া, এবং অবিঘ্নিত রূপে শাসন করা ও তরতর করে উন্নতি করতে থাকা। আর মেহনতিদের বিপ্লব ছিল সামাজিক বিপ্লব, সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভু-ভৃত্যের পুরনো সম্পর্ক ভেঙে ফেলে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা, এবং তারই প্রয়োজনে রাষ্ট্রের ভেতরকার কাঠামোটা বদলে দেওয়া। বলাবাহুল্য পরস্পরবিরোধী এই দুই স্বপ্নের একটি অপরটিকে সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দেয়।
একাত্তরে বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়ারা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, মেহনতিরা ছিল দেশের ভেতরে, তাদের পক্ষে দেশত্যাগ সহজ ছিল না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল অসম্ভব। তারাই প্রাণ দিয়েছে, তাদের মেয়েরাই নিপীড়িত হয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। লড়াইটা মূলত তারাই করেছে। ভারতে গিয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছে তাদের ভেতরকার পারস্পরিক বিরোধের ও বিচ্ছিন্নতার খবর আমরা অনেকের লেখার মধ্যে পাই। জানা যায় যে আগরতলায় ছোটখাটো আনন্দানুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল। একজন সুপরিচিত ন্যাপ নেত্রী তার বিবাহবার্ষিকীও পালন করবার সুযোগ পেয়েছেন। কলকাতায় যারা গেছেন তারাও কেউ কেউ বিয়ে-শাদি করেছেন, বিবাহবহির্ভূত প্রেম করা থেকেও বিরত থাকেননি। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলির ওপরে অনেকে লিখেছেন। সেসব বই মিলিয়ে পড়লে টের পাওয়া যায় ঘটনা কোনদিকে এগুচ্ছিল।
বিজ্ঞান-কর্মকর্তা ড. ফারুক আজীজ খান কলকাতায় গিয়েছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের বিপদ-আপদের মধ্য দিয়ে, প্রাণঘাতী ঝুঁকি মাথায় করে। পরিবার-পরিজন ছেড়ে একাকী আগরতলায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন, সেখান থেকে গেছেন কলকাতায়। কলকাতায় তিনি কাজ করেছেন প্রবাসী প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে। ঝঢ়ৎরহম ১৯৭১ নামে তিনি ইংরেজি একটি বই লিখেছেন, তার বহু রকমের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে। একটি অভিজ্ঞতার বিবরণ বাংলায় অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায় : “খ্যাতনামা ও সংগ্রামী এক ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, একটি বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করল। মেয়েটি তার পিতামাতার সঙ্গে কলকাতায় এসেছিল। ভিআইপিদের জন্য একটি সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। জিনিসটা অনেকের কাছেই বেখাপ্পা ঠেকেছে কারণ ছাত্ররা যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে এবং প্রাণ দিচ্ছে তখন দেখা গেল তাদেরই একজন ঠিক সেই সময়টিকেই মনে করল বিবাহের জন্য উৎকৃষ্ট সময়।’ এর সঙ্গে তিনি আরেকটি মন্তব্যও করেছেন : “আমাদের অনেকেই তখন গৃহহীন সমাজের মানুষদের মতো আচরণ করছিল, কখনো কখনো তারা ভুলেও গেছে অন্য বাঙালিদের প্রতি তাদের দায়িত্বটা, যেন তারা অপেক্ষা করছিল কবে ঘরে ফিরবে, আজই যদি না হয় তাহলে নিশ্চয়ই আগামীকাল।” (পৃ ২০৩) কলকাতায় বাংলাদেশ হাই কমিশনারের অফিস ছিল সার্কাস এভিনিউতে, বাংলাদেশ সরকারের দপ্তর থিয়েটার রোডে, পরিহাস করে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন কলকাতায় যোদ্ধাদের ঘোরাফেরা মোটামুটি সীমিত ছিল সার্কাস থেকে বের হয়ে থিয়েটারে এবং থিয়েটারের কাজ সেরে সার্কাসে যাওয়ার ভেতরেই। ফারুক আজীজ খান অবশ্যই তেমন কোনো মন্তব্য করেননি, তবে তাকেও প্রথমে সার্কাস এভিনিউতে এবং সেখান থেকে থিয়েটার রোডে যেতে হয়েছিল। সার্কাস এভিনিউতে অভিজ্ঞতাটি ছিল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। হাইকমিশন অফিসের ভিড় ঠেলে, নানা প্রতিবন্ধক এড়িয়ে কোনো মতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন পুরনো এক বন্ধুর সামনে। বন্ধুটি তখন বাংলাদেশ সরকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি। ফারুক আজীজের অভিজ্ঞতাটা দাঁড়িয়েছিল, “বন্ধুটি তদ্সত্ত্বেও আমার সঙ্গে অদ্ভুত ব্যবহার করলেন। প্রথমে তিনি এমন ভান করলেন যে আমাকে তিনি চেনেনই না, তাছাড়া যদি চেনেনও তাহলেও তার সঙ্গে আমার কোনো কারবারই থাকতে পারে না, কারণ তিনি তখন বিগ বস। বুঝলাম তার কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়ার আশা নেই, তদ্সত্ত্বেও আমি জানতে চাইলাম আমি কোনোভাবে কোনো সাহায্যে আসতে পারি কি না। তিনি বললেন, ‘শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য বুলেটপ্রতি দশ পয়সা দিতে রাজি আছি।’ ” (পৃ ১৬৭) ফারুক আজীজ লিখছেন, সবই বুঝলাম এবং যুদ্ধ বলতে যা চলছিল সেটির অভিজ্ঞতা তার চেয়ে আমারও কিছু কম ছিল না। কিন্তু এটা কখনোই মনে হয়নি যে বুলেটপ্রতি দশ পয়সা পাবে এই আশাতে কেউ যুদ্ধ করছিল। মাঠের যোদ্ধা আর কলকাতার বস এক ছিল না।
এক কাতারে সবাই এসেছিল, কিন্তু আবার আসেও-নি। আসার উপায়ও সহজ ছিল না। ফারুক আজীজ যখন প্রাণভয়ে কাপ্তাইয়ে তার কর্মস্থল থেকে বন-জঙ্গল-পাহাড় পেরিয়ে চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা থেকে ভারত সীমান্তের দিকে এগুচ্ছিলেন তখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে পড়ে নিজের বাঙালিত্ব প্রমাণের যে কঠিন পরীক্ষার তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন সেটি বাকি জীবনে ভুলতে পারেননি। তার ঠোঁটে গোঁফ ছিল, সেটি ছিল কিছুটা তামাটে রঙের, বুদ্ধি করে সেটি কামিয়ে ফেলেছিলেন, নইলে অবাঙালিত্বের ওই ইশারার কারণেই তাকে প্রাণ দিতে হতো। উচ্চশিক্ষার জন্য এবং চাকরিসূত্রে কানাডা ও আমেরিকায় বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছেন, তবুও বাংলা ভোলেননি, বরঞ্চ বাংলাভাষার চর্চা তিনি করতেন নানা উপায়ে। তার বাংলা ইপিআর সদস্যদের বাংলার চাইতে উন্নত মানেরই ছিল। ঘটনার বিশ বছর পরে লিখতে গিয়ে তিনি কী করে যে বাঙালিত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন সেটা ভাবলে গা কাঁপে বলে উল্লেখ করেছেন। তার মনে পড়েছে যে আওয়ামী লীগের প্রধান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যদি ১৯৭১ সালে জীবিত থাকতেন এবং বাঙালি যোদ্ধাদের হাতে পড়তেন তাহলে তার বিপদটা হতো আরও বড় রকমের, কারণ ফারুক আজীজের ভাষায়, “বাংলায় সোহরাওয়ার্দীর দক্ষতা উর্দুতে আমার দক্ষতার মতোই নিম্নমানের ছিল।”
ফারুক আজীজ লিখছেন, কলকাতায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবরা যে ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করেছেন ১৯৭১ সেটি মুসলমান বাঙালিদের মুসলমান পাঞ্জাবি খুনি ও ধর্ষকদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি; এবং কোরআন শরিফের সুরা ঘাতকদের ছুরি ও বন্দুকের সামনে মোটেই রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করেনি। এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান রাজুর কাছে তিনি শুনেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ভারতীয় সীমান্তের কাছে বিহারি বলে সন্দেহ করে বাঙালি যোদ্ধারা এক ব্যক্তিকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, স্থানীয় এমপি মমতাজ বেগম এসে না পড়লে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেই যেত। ব্যক্তিটি আর কেউ নন, কর্নেল এম এ জি ওসমানী, পরে যিনি মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হয়েছেন। ওসমানী তখনো তার নিজস্ব কাটাকাটা উচ্চারণে ইংরেজি ভাষায় বলছিলেন; Look Raju, what the fellwos were going to do to me..’ (পৃ. ১২৪) চেনাজানা ছিল না, দূরত্ব ছিল শ্রেণির। রণাঙ্গনে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সেনাপতির তাই প্রাণ হারাবার উপক্রম হয়েছিল বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতেই।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা নানা রঙে-ঢঙে দিনটিকে রাঙিয়ে তোলেন। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ভালোবাসা দিবসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ভালোবাসা মানুষকে উড়তে শেখায়, ভালোবাসা মানুষকে বাঁচতে শেখায়, ভালোবাসা মানুষকে অধিকারের কথা বলতে শেখায়, পড়তে শেখায়, জ্বলতে শেখায়, নিভতে শেখায়। পুঁজিবাদী বিশে^ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হলেও, বাংলাদেশে দিবসটির ইতিহাসের একটু ভিন্ন তাৎপর্য আছে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও তা পালনের আয়োজন-প্রচারের তোড়ে সেই রক্তঝরা দিনটির কথা সবাই ভুলতে বসেছে। এর দায় কার? ছাত্রসমাজের রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস রাষ্ট্র ও গণমাধ্যম থেকে কীভাবে মুছে গেল? আজকের দিনে সপ্তম শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীকেও যদি প্রশ্ন করা হয় যে ভালোবাসা দিবস কবে। সেই শিশুশিক্ষার্থী অকপটে তার সঠিক উত্তর বলে দিতে পারবে। কিন্তু যখন বলা হবে বলো তো স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস কবে? তখন সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। এমনকি কলেজপড়–য়া শিক্ষার্থীরাও বলতে পারেন না। ভালোবাসা দিবস পালনে সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে এই দিবস পালনের ডামাডোলের মধ্যে সংগ্রামের ইতিহাসকে চাপা দিয়ে রাখা। এই রাজনীতির পাশাপাশি পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর বাণিজ্যিক কৌশলের প্রধান হাতিয়ার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। তাই সচেতন হতে হবে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব শরীফ কমিশনের ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষার অধিকার আদায়ের জন্য ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পুলিশের গুলিতে জীবন উৎসর্গ করেছিল মোস্তফা ওয়াজিল্লাহ, বাবুল প্রমুখ ছাত্র নেতারা। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি অনুসরণ করে হাঁটতে চেয়েছে স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতি। প্রশ্ন আসে, যে পাকিস্তানের শিক্ষানীতি রক্ত দিয়ে বাতিল করছে ছাত্ররা, সেই শিক্ষানীতি কি বাংলাদেশে চালু করা উচিত? তৎকালীন সামরিক শাসকের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব করেন। সেখানে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হয় মেধা অথবা ৫০ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা। ফলে সেই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১৭ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো। তারপর শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন, কালক্রমে যেটি গণ-আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। ছাত্রসমাজের দাবি ছিল একটি অবৈতনিক বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি। কিন্তু ড. মজিদ খান যে নীতি ঘোষণা করেন, সেখানে বাণিজ্যিকীকরণ আর ধর্মীয় প্রতিফলন ঘটেছে বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। তাই শুরু থেকেই ওই নীতির বিরোধিতা করতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে স্মারকলিপি দিতে শিক্ষার্থীরা মিছিল করে সচিবালয়ের দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ টিয়ার গ্যাস, জলকামান, অবশেষে নির্বিচারে গুলি চালায়। ফলে লুটিয়ে পড়েন শহীদ দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ূব, কাঞ্চনসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে বাধ্য হয়েছিল বাতিল করতে কুখ্যাত মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতি। সে কারণেই ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বৈরাচার ছাত্র প্রতিরোধ দিবস শুধু বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাড়া কোনো ছাত্র সংগঠন বা রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দিবস পালন করা হয় না।
তাই ভালোবাসার ফুল যাদের চরণে দিই যারা শিক্ষার রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে রাজপথে জীবন দিল। ভালোবাসার প্রাণ ওই শহীদরা। সেই ভালোবাসার কল্যাণেই এই মাটির ইতিহাস কখনোই ভোলার নয়। স্বাধীন জাতি হিসেবে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন এবং মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একই ধারায় বিজ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতির লক্ষ্য কতটা অর্জিত হলো, শিক্ষাব্যবস্থায় কী দুর্বলতা ও অসংগতি রয়ে গেছে, তা রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণ করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তা না হলে শহীদের রক্তের ঋণ অশ্রদ্ধা করা হবে। ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে রাজপথে থাকত শিক্ষার্থীরা, যার উজ্জ্বল উদাহরণ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কিন্তু যখন যেই সরকার ক্ষমতায় আসে সেই দলের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা যখন হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে পড়েন, তখনই সবাই ছাত্ররাজনীতির নামে ভয় পায়। আর কেউ কেউ ছাত্ররাজনীতি বন্ধের শোরগোল তোলেন। কিন্তু যুবলীগ নেতারা যে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত, কেউ কি একবারও যুবরাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন? আবার ধরেন পুলিশ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের দুর্নীতির খবর পাই তখন কি কোনো পেশা বন্ধের দাবি উঠেছে? উত্তর হচ্ছে বন্ধের কোনো দাবি ওঠেনি। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হবে কেন? যাদের সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠন তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। ছাত্ররাজনীতিকে বলা হয় নেতৃত্ব তৈরির বাতিঘর। সেই বাতিঘর তৈরির কাজ রাষ্ট্রকেই করতে হবে। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আড়ালে যেন পড়ে না থাকে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র প্রতিরোধ দিবস।
লেখক : প্রাবন্ধিক
ঝলমলে বইমেলা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আচমকা মনে হলো, সামনের তরুণটিকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কখনো সুবিমল মিশ্র পড়েছো! কিংবা ওই যে ঝকঝকে মেয়েটি বয়ফ্রেন্ডের কাঁধে হাত দিয়ে চলেছে, তার কাছে জানতে চাইব, সুবিমল কেমন লাগে! অথবা একটা পলিটিক্যাল স্টলে বসে থাকা পৌঢ় ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়, সুবিমল মিশ্র আপনার পছন্দের লেখক কিনা!
কিন্তু অদ্ভুত এক ভয় পেয়ে বসেছে। যদি কেউ সুবিমল মিশ্র সম্পর্কে কিছুই না জানেন। সুবিমল তো তথাকথিত ভদ্দরলোকীয় বৃত্তে তেমন খাতিরের লেখক ছিলেন না। যে লেখকদের সামনে অটোগ্রাফ খাতা হাতে দুরন্ত সুন্দরীরা দাঁড়িয়ে থাকেন সুবিমল তো কখনোই তাদের দলের লোক নন।
সুবিমল মিশ্র নিজেকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক বলতেন না। বলতেন, লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। তিনি উপন্যাস, গল্প কিস্যু লেখেননি। যা লিখেছেন সব অ্যান্টি নভেল, অ্যান্টি স্টোরি। ওর সবচেয়ে পঠিত উপন্যাস ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’ প্রথম পড়তে গিয়ে চমকে গিয়েছিলাম। অত রগরগে উপন্যাস বাংলা ভাষায় আগে কখনো পড়িনি। আমরা যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির, তাদের কাছে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ওই ঢাউস উপন্যাসটি ছিল নিখাদ পর্নোগ্রাফি। এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করেছিলেন সুবিমল, যা শোনাও তখন ছিল ‘গর্হিত অপরাধ’। আমাদের অনেকের কাছেই ছিল শুধু অপরাধ নয়, অশ্লীল লেখা পড়া মানেই প্রতিক্রিয়াশীল কাজ।
এই আমরা, আমাদের বলতে তখনকার দিনের বামপন্থি পরিবারের লোকজন। এখন বুঝি, আমাদের মধ্যে বিপুল ট্যাবু ছিল, যা এখন মনে হয় একধরনের মৌলবাদ। সুবিমল দূরের কথা, তখন বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভোর বৃষ্টি’, সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’, ‘বিবর’ নিয়েও তখন তর্কবিতর্ক প্রবল। যখন স্তন, জঙ্ঘা, শীৎকার নিষিদ্ধ শব্দ, তখন সুবিমল খোলাখুলিভাবে লিখছেন মাসী বোনপোর শরীরী সম্পর্কের বিশদ বর্ণনা।
সুবিমলের অন্যান্য লেখাতেও উঠে এসেছে যৌন অনুষঙ্গ। আসলে সুবিমল মিশ্র সেক্স, ভায়োলেন্স ব্যবহার করতেন তথাকথিত ভদ্রলোকীয় মূল্যবোধকে ধাক্কা দিতে। আজকাল সাব অলটার্ন তত্ত্ব নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। সুবিমল মিশ্র এই কাজটি বহু বছর আগে করেছিলেন। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে।
সেক্সের নন্দনতত্ত্ব বা ধ্রুপদী দিক নিয়ে সুবিমল মিশ্রের সাহিত্য নিঃসন্দেহে গবেষণার বিষয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির চরম যুগে দাঁড়িয়ে, আধিপত্যবাদকে কোণঠাসা করতে কখনো কখনো সুবিমল মিশ্র ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে একই সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়। র্যাডিক্যালিজম অনেক সময় ভায়োলেন্স দাবি করে। আন্ডারগ্রাউন্ড লিটারেচারে আপাত অশ্লীল বহু শব্দ সময় সময় ডিনামাইটের মতো ফেটে পড়ে।
এখন মনে হয় সুবিমল নানা সময় যৌনতা, নিষিদ্ধ সম্পর্ক নিয়ে একধরনের ফ্যান্টাসি তৈরি করতেন। ফ্যান্টাসির মধ্য দিয়ে বলতে চাইতেন, কোনো কিছুই নিষিদ্ধ বা বে-আইনি নয়। সব সম্ভব। পুঁজিবাদ একই রকম ফ্যান্টাসি তৈরি করে। মৌলবাদ যেমন মানুষকে পারলৌকিক জগতের দিকে আকৃষ্ট করে কল্পিত এক জগতের স্বপ্ন দেখিয়ে। ওয়াজ মেহফিলে বা পুরোহিতের উচ্চারণে দুনিয়ার যাবতীয় সংকট থেকে মুখ ফিরিয়ে কল্পিত ভবিষ্যতের ছবি পাই, ঠিক তেমনই পুঁজি নির্মাণ করে রঙিন দুনিয়া। ঠা-া মতলব- অমুক পানীয়, তমুক ক্রিম কিনলে ফর্সা হওয়ার গ্যারান্টি...। মুশকিল হচ্ছে, একদল মেঠো কথার কারণে চিহ্নিত হন মৌলবাদী বলে। অপরপক্ষ চকচকে মোড়কে স্বপ্ন বেচেন, তাই তারা আধুনিক, প্রগতিশীল। এই নতুন সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী সাংস্কৃতিক হেজিমনিকে কাউন্টার করতে চেয়েছিলেন সুবিমল মিশ্র।
গত শতকের ষাট দশকে ঝোড়ো হাওয়ার গতিতে সুবিমলের আবির্ভাব, সময়কাল পৃথিবীর ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভারত উপমহাদেশে তো বটেই। সারা দুনিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বিভাজন ঘটে গেছে। লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে জন্ম নিচ্ছে নতুন শিল্প। ফ্রান্সের অভিজাত ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা পথে নেমেছেন বিপ্লবের পতাকা নিয়ে। জাঁ পল সার্ত্র, সিমন দ্যা বোভেয়ার মতো বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী রাস্তায় নেমেছেন নিষিদ্ধ ইশতাহার বিক্রি করতে। দেয়ালে দেয়ালে লেখা হচ্ছে তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম। চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে ডাক দিয়েছেন ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে তখন দাবানলের মতন আছড়ে পড়েছে নকশালবাড়ী। নতুন নতুন সিনেমা, নাটক, কবিতা, গল্প, উপন্যাস তখন জন্ম নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে।
তার মধ্যে সম্পূর্ণ অন্য ধারার লেখক হিসেবে আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হলেন সুবিমল মিশ্র।
১৯৬৭ সাল থেকে মোটামুটি নিয়মিত লিটল ম্যাগাজিনে আমরা সুবিমল মিশ্রকে পাচ্ছি। ১৯৬৯ সালে কবিপত্র পত্রিকায় লিখলেন দুর্দান্ত গল্প, ‘হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধী মূর্তি’। গল্পের স্পিরিট ছিল আগে মড়া সরাও, না হলে গান্ধী মূর্তির হদিস মিলবে না ।
সোজা কথায়, আগে দেশের মানুষের মুখে খাবার তুলে দিয়ে তারপর নেতারা এই করেঙ্গে, সেই করেঙ্গে, ভাষণ দিয়ো। যে সময়ে এ লেখা, তখন ধীরে ধীরে ভারত বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। নকশালবাড়ীর তাপে উত্তপ্ত হয়ে গেছে সারা দেশ। ভোজপুর, জেহানাবাদ, আরা, শ্রীকাকুলাম খবরের কাগজের শিরোনামে। বধ্যভূমিতে পরিণত হচ্ছে আমার দেশ। তখন সম্পূর্ণ অন্য ধারায় এদেশের গরিব, প্রান্তিক মানুষের কথা লিখছেন সুবিমল মিশ্র, সোজা-সাপটা ভাষায়। রাষ্ট্র, সমাজের অসাম্য, ভ-ামি নিয়ে কোনোরকম দ্বিচারিতা সহ্য করেননি সুবিমল। সাহিত্য ছিল তার প্রতিবাদ, হয়তো প্রতিরোধেরও অস্ত্র।
কত গল্প লিখেছেন সুবিমল। কোনটি ছেড়ে কোনটির কথা বলব! তার প্রায় সব লেখাতেই রাজনৈতিক, সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতি দ্বিধাহীন বিশ্লেষণ ও মধ্যবিত্ত সমাজের যৌনতা নিয়ে অচ্ছুৎপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ লক্ষ করা যায়।
রাষ্ট্রব্যবস্থা, তার শোষণ, সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রতি ব্যঙ্গ, অবক্ষয়, দ্বন্দ্ব, লেখার কোলাজ এবং বিশেষভাবে নৈরাজ্য ইত্যাদি সুবিমলের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তেজস্ক্রিয় আবর্জনা’, ‘আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো’, ‘হাড়মটমটি’, ‘ক্যালাকাটা ডেটলাইন’, ‘চেটে চুষে চিবিয়ে গিলে’ ইত্যাদি।
সময়ের অনেক আগে জন্মেছিলেন সুবিমল। লেখায় তিনি যে প্ল্যানড ভায়োলেন্স চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন তা অধিকাংশই আমরা বুঝতে পারিনি বা চাইনিও। প্রচলিত সমস্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ জারি করেছিলেন সুবিমল। চিরটাকাল স্থিতাবস্থা ও ক্ষমতা কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ করে গেছেন আমাদের বাংলা সাহিত্যের ‘কালাপাহাড়’ সুবিমল মিশ্র।
সাজানো গোছানো ভদ্দরলোকদের মধ্যেও যে কত আদিম হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, বিকৃত যৌনচিন্তা লুকিয়ে থাকে তা টেনেহিঁচড়ে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছিলেন সুবিমল। তার আগে এই কাজটি করেছিলেন জগদীশ গুপ্ত।
সুবিমল মনে করতেন পাঠকের পড়ার সনাতনী অভ্যেসকেও বদলে দিতে হবে। তাই তিনি কখনো পাঠককে নিশ্চিন্তে তার লেখা পড়তে দেননি। এক এক লেখায় সুবিমল যে বীভৎস পৃথিবীর ছবি এঁকেছেন তা আজ আরও অনেক বেশি সত্য, ভয়ংকর।
সারা জীবন স্রোতের বিপরীতে হাঁটা আজ কঠিনতম কাজ। সেই কাজটি করতে অসম্ভব বুকের পাটা লাগে। সুবিমল মিশ্রের সেটা ছিল। কত তথাকথিত বিপ্লবী বাঘকে কাগুজে হতে দেখলাম চোখের সামনে। সুবিমল মিশ্র ঘোষিত বিপ্লবী না হয়েও কখনো কোনোদিনই প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেননি। সুবিমল মিশ্র, অমিয়ভূষণ মজুমদার, কমলকুমার মজুমদার, ধারা আলাদা হলেও পপুলিস্ট লেখক কেউই নন। আজ চারপাশের বিক্রি হয়ে যাওয়া লেখকদের ভিড়ে, ভয় হয় বাংলা সাহিত্যে ওদের মনে রাখবে কীভাবে তা ভেবে।
বইমেলায় হাঁটছি। আগের দিন সুবিমল মিশ্র চলে গেছেন। আজ বৃহস্পতিবার। কোথাও কোনো চাঞ্চল্য নেই লেখকের মৃত্যুতে। বিপুল ভিড়। বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে এক বা কতিপয় তরুণ লেখককে ঘিরে তুমুল উন্মাদনা। একা যেতে যেতে মনে হলো, ভিড়ের মধ্যে একটা মাথা আচমকাই সব মাথা ছাড়িয়ে বিশাল হয়ে উঠছেন। মুখের দিকে না তাকিয়েও নিশ্চিন্তে বলে দিতে পারি, তিনি, তিনিই সুবিমল মিশ্র।
যিনি সারা জীবন মেরুদণ্ড সোজা রেখে পথ হেঁটেছেন। আমরা, বামপন্থি ঘরানার লোকজন কোনোকালেই তাকে গুরুত্ব দিইনি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাকে সহযোদ্ধা ভাবিনি। আজ অন্তত একবার যেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী সবাই, মৃত্যুর পরে হলেও সুবিমল মিশ্রকে কুর্নিশ জানাই। আমাদের সময়ের এই আপসহীন যোদ্ধার জন্য থাকুক লাল গোলাপ ও জনগণের গান স্যালুট।
লেখক: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক
মিসর, চীন, বেবিলন, পারস্য, মেসোপটেমিয়া, মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সভ্যতা পৃথিবীতে গড়ে উঠলেও শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষের দিক দিয়ে গ্রিকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। মানব সভ্যতার উন্নতি ও শিক্ষা পাশাপাশি চললেও প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্র স্পার্টা বা এথেন্সে সর্বপ্রথম ‘শিক্ষার মৌলিক নীতি’ পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং শিক্ষার ঐতিহ্য নির্ণয় করার ভিত্তি হিসেবে গ্রিক সভ্যতাকে গণ্য করা শ্রেয়।
আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হয়েছে গ্রিসে। এ জন্য গ্রিসকে বলা হয় আধুনিক শিক্ষার জন্মভূমি। শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানেি গ্রিকরা ছিল সবার আদর্শ। গ্রিকদের এসব উন্নতির পশ্চাতে রয়েছে, উন্নত মানের শিক্ষাব্যবস্থা। দেখা যাচ্ছে, যে দেশে শিক্ষার যত প্রসার ঘটেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারাই উন্নত। সেই সভ্যতার হাজার বছর পার হয়েছে। আমরা আছি, ২০২৩ সালে। এখনো, এই মুহূর্তে একটি সঠিক পাঠ্যক্রম তৈরি করতে পারছি না। বছর শুরুতেই বিষয়-বৈচিত্র্য নিয়ে ঝকমকা বই, শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছি। সেখানেও, কিম্ভূতকিমাকার চিন্তাহীন সামঞ্জস্যহীন তথ্য। দুটি বই প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হাজার মানুষের সমালোচনা এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপকেই সঠিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন! কিন্তু, এই দায় মূলত কোন কোন জ্ঞানীজনের?
গতকাল দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘কাঁচা হাতে বড় কাজ’ শিরোনামের সংবাদে, বিষয়টি বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে তাড়াহুড়ো করে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করতে গিয়ে বড় বিপদে পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে দুটি বই প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। আরও তিনটি বইয়ে, বড় ধরনের সংশোধন আসছে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে আরও জানা যায়, এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জান বলেছেন, যে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে, তা এ বছর আর দেওয়া হবে না। কারণ ঐ বই দুটির দুটি অংশ ছিল। এখন যে অংশটি রয়েছে, তা দিয়েই বিষয়টি কাভার হবে। শিক্ষার্থীদের শিখনে কোনো সমস্যা হবে না বলেই, বই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের অনুশীলন বইয়ে আমরা নানা বিশ্বের নানা সভ্যতার ইতিহাস তুলে ধরেছি। এসব ইতিহাসকে প্রদর্শন করতে গিয়ে ‘অনুসন্ধানী পাঠে’ মিসরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতাগুলো এসেছে, প্রাচীন দেব-দেবী নিয়ে কথা এসেছে, তাদের সংস্কৃতির নানা ছবি ব্যবহার হয়েছে। যদি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাচ্চাদের জন্য প্রাচীন সভ্যতার বিষয়টি কঠিন হয়ে যায়, তাহলে তা আমরা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে ওপরের শ্রেণিতে নিয়ে যাব।’
চমৎকার কথা বলেছেন। কিন্তু একটা খটকা থাকে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য কোন বিষয়টি বোধগম্য আর কোনটি নয় সেটা কি পাঠ্যপুস্তক তৈরিতে যুক্ত বিজ্ঞজন, জ্ঞাত নন! তারা জানেন না, কোন বিষয়টি কোন বয়সীদের জন্য? প্রকাশিত সংবাদে আরও জানা যায় ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত পাঠ্যপুস্তকের অসংগতি, ভুল বা ত্রুটি চিহ্নিত করে তা সংশোধনে প্রয়োজনীয় সুপারিশের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক আব্দুল হালিমকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির মতামতের আগেই দুটি বই প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। এছাড়া ভুল-ত্রুটির জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তারকে আহ্বায়ক করে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের ভুলের দায় স্বীকার করেছেন, ওই বইটির সম্পাদক অধ্যাপক মো. জাফর ইকবাল ও হাসিনা খান।
প্রশ্ন হচ্ছে তাই-ই যদি হবে, তাহলে এত জল ঘোলা করা কেন? আরও আগেই তা করা যেত। দায় স্বীকার করে, বিবৃতি দিলেই হতো সমস্যার সমাধান। এত হৈ-হল্লা, হতো না। তবে ভবিষ্যতে এমনটি যেন না হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সেদিকে কঠোর নজরদারি দরকার। মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থীর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আগামীর নতুন দিগন্ত, ওদেরই হাতে।
ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবী গাজীউল হকের জন্ম নোয়াখালীতে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২৯ সালে। তার বাবার নাম সিরাজুল হক ও মা নূরজাহান বেগম। ১৯৪৬ সালে তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে আইএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস নিয়ে ১৯৫১ সালে বিএ অনার্স ও ১৯৫২ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। স্কুলজীবন থেকে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৪৪ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ’ বগুড়া জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং কুষ্টিয়ায় ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৩ ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকায় তিনি গ্রেপ্তার হন। তিনি ১৯৬২ সালের শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন, ১৯৬৪-এর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। তার রচিত ‘ভুলব না, ভুলব না, ভুলব না/এই একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি গেয়ে একসময় প্রভাতফেরি করা হতো। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জেলের কবিতা, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এগিয়ে চলো, উচ্চ আদালতে বাংলা প্রভৃতি। একুশে পদক, বঙ্গবন্ধু পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছেন। ২০০৯ সালের ১৭ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মসজিদ ও মাদ্রাসায় ইমামদের সচেতনতা বার্তা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
রাজধানীর মিরপুরে পিএসসি (পুলিশ স্টাফ কলেজ) কনভেনশন হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকার মসজিদের ইমামদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
মতবিনিময় সভায় ডিএনসিসি এলাকার এক হাজার ইমাম ও খতিব অংশগ্রহণ করেন।
উপস্থিত ইমামদের উদ্দেশে ডিএনসিসি মেয়র বলেন, ‘আমরা মসজিদে গিয়ে ওয়াক্ত নামাজের সময়, জুমার নামাজের সময় মনোযোগ দিয়ে আপনাদের বয়ান শুনি। আপনারাই পারেন মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে। আপনারাই পারেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। আপনারা মানুষকে জানাবেন বর্ষাকালে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে যায়। এডিস মশার কামড়ে জ্বর হয়, মৃত্যু হয়। জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার লার্ভা জন্মায়। অতএব কোনোভাবে যেন পানি জমে না থাকে’।
মেয়র আরো বলেন, ‘এডিস মশা যখম কামড় দেবে, মশা কিন্তু চিনবে না কে মেয়র, কে কাউন্সিলর, কে ইমাম আর কে খতিব। এডিস মশা সবার জন্যই হুমকি। অতএব এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। একমাত্র সচেতনতা পারে ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। যদিও সিটি করপোরেশন থেকে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। কার্যকরী লার্ভিসাইডিং করছি, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছি। কিন্তু সবার সচেতনতা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়’।
এ সময় ডিএনসিসি মেয়র গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা, মাটির পাত্র, খাবারের প্যাকেট, অব্যবহৃত কমোড এগুলো দেখিয়ে উপস্থিত ইমামদের সচেতন করেন।
মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে লাখো লাখো মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার খতিব রয়েছেন। ইমাম ও খতিবরা মসজিদে মুসুল্লিদের ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সচেতন করলে এই ভয়াবহ মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যেকোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির ও অন্যান্য সাধারণ মানুষের বক্তৃতা থেকে ইমামদের বক্তৃতা বেশি কার্যকর হবে। মসজিদে বিশেষ করে জুমার নামাজের সময় বয়ানে, খুতবায় মুসুল্লিরা ইমামগণের কথা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনেন। আপনাদের বার্তা মানুষের মনে গেথে থাকে।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমানের সঞ্চালনায় ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহ. আমিরুল ইসলাম, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এস এম শরিফ-উল ইসলাম, কাউন্সিলর, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও ডিএনসিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
পিছিয়ে পড়া রিয়াল মাদ্রিদকে বহুবার ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছেন করিম বেনজেমা। ক্লাবের হয়ে শেষ ম্যাচেও তাই করলেন। তার গোলে ড্র করে মৌসুম শেষ করেছে রিয়াল।
ঘরের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে রিয়াল নিজেদের শেষ ম্যাচ খেলতে নামে অ্যাথলেটিক ক্লাবের সঙ্গে। ম্যাচের প্রথমার্ধটা গোল শূন্য থেকে যায়। এই সমতা নিয়ে বিরতিতে যায় দুই দল।
তবে বিরতি থেকে ফিরে চার মিনিটের মাথায় গোল পেয়ে যায় অ্যাথলেটিক। ৪৯ মিনিটে একক প্রচেষ্টায় একাধিক খেলোয়াড়কে কাটিয়ে লক্ষ্য বরাবর শট নেন ওয়েন সানচেত। তবে তিবু কুর্তোয়া দারুণভাবে সেটা প্রতিহত করেন। কিন্তু তিনি উল্লাসটা খুব দ্রুত করে ফেলেন, বলের দিকে তার নজর ছিল না। আর সেই সুযোগটা নেন সানচেত। আদায় করে নেন গোল।
সেই গোল হজম করে হার দিয়ে মৌসুম শেষের শঙ্কায় পড়েছিল রিয়াল। তবে প্রতিবার যেমন শেষবেলায় ত্রাতা হতেন বেনজেমা, এবারও তাই হলেন। গোল শোধ করতে মরিয়া মাদ্রিদিয়ানরা সেটা আদায় করে ৭২ মিনিটে। তবে সেটা নিজেদের পায়ের জাদুর নৈপুণ্যে নয়। ডি বক্সের ভেতরে মিলিতাওকে ফাউল করেন জুরি বারচিকে। হলুদ কার্ডের সঙ্গে জরিমানা হিসেবে গুনেন পেনালটি। সেখান থেকে গোল আদায় করে নেন বেনজেমা।
গোলের পরে তাকে নিয়ে সতীর্থরা মেতে উঠেন উল্লাসে। কারণ এটাই যে ছিল তার শেষ ম্যাচ। বিদায়ী ম্যাচটা গোল করে রাঙালেন বেনজেমা।
রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে ১৪ বছরের সম্পর্কের ইতি টানছেন ২০২২'র ব্যালন ডি'অর জয়ী করিম বেনজেমা। ক্লাবের তরফ থেকে আজ এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, 'রিয়াল মাদ্রিদ এবং আমাদের অধিনায়ক করিম বেনজেমা এই ক্লাবের হয়ে তার অসাধারণ ও অবিস্মরণীয় ক্যারিয়ারের ইতি টানার জন্য রাজি হয়েছে।'
মেসি, সুয়ারেজ ও নেইমার একসঙ্গে তিন মৌসুম খেলেছেন বার্সেলোনায়। ২০১৪ সালে লিভারপুল থেকে সুয়ারেজ বার্সায় আসার পর এবং ২০১৭-তে নেইমার পিএসজিতে পাড়ি জমানো পর্যন্ত ‘এমএসএন’ এর রাজত্ব ছিল বার্সেলোনায়। সে সময়ে এই তিনজন মিলে ৩৬৪ গোল করার পাশাপাশি অ্যাসিস্ট করেছেন ১৭৩টি। এই ত্রয়ী বার্সাকে দুটি লা লিগা খেতাব, তিনটি কোপা দেল রে এবং একটি করে সুপারকোপা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, উয়েফা সুপার কাপ ও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন।
সুয়ারেজ-নেইমার বার্সা ছেড়ে চলে গেলে মাঠের জুটি ভাঙলেও বন্ধুত্ব অটুট এমএসএনের। সেদিন মেসিকে মাঠে দর্শকরা দুয়ো ধনি দলে তার প্রতিবাদ করেছেন সুয়ারেজ নেইমার। মেসির পিএসজি ছাড়ার পর নেইমার বন্ধুর প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন, সুয়ারেজও জানিয়েছেন সাধুবাদ।
নেইমার ইনস্টাগ্রামে একটি বিদায় নোট পোস্ট করেছেন মেসিকে উদ্দেশ্য করে, 'ভাই.. আমরা যেমন ভেবেছিলাম তেমনটা হয়নি কিন্তু আমরা আমাদের সেরাটা দিয়েছিলাম। তোমার সাথে আরও ২ বছর ভাগ করে নিতে পারাটা আনন্দের ছিল। তোমার পরবর্তী। তোমার নতুন অধ্যায়ের জন্য শুভকামনা এবং সুখী হও। তোমাকে ভালোবাসি।'
উত্তরে মেসি বলেছেন, 'ধন্যবাদ নে! সব কিছুর পরও আমরা একসাথে খেলা উপভোগ করেছি এবং প্রতিদিন ভাগ করে নিয়েছি। তোমার জন্য শুভ কামনা। তুমি কিছু পাগলাটে, কিন্তু মানুষ তুমি দারুন।আর এটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি নেইমার।'
আর এই বার্তা পড়ে সুয়ারেজ লিখেছেন,' কি সুন্দর বার্তা মেসি। নেইমারের সাথে আপনাকে আবার একসাথে দেখে খুব ভালো লাগলো। একে অপরের প্রতি এই ভালবাসা, সর্বদা সবকিছুতে একে অপরকে সমর্থন করা আরও সুন্দর! আমি তোমাদের ভালোবাসি বন্ধুরা।'
তিনজনের এই বার্তা পড়ে একটা কথাই বলতে হয়, বন্ধুত্বের জয় হোক।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।