
মিসর, চীন, বেবিলন, পারস্য, মেসোপটেমিয়া, মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সভ্যতা পৃথিবীতে গড়ে উঠলেও শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষের দিক দিয়ে গ্রিকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। মানব সভ্যতার উন্নতি ও শিক্ষা পাশাপাশি চললেও প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্র স্পার্টা বা এথেন্সে সর্বপ্রথম ‘শিক্ষার মৌলিক নীতি’ পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং শিক্ষার ঐতিহ্য নির্ণয় করার ভিত্তি হিসেবে গ্রিক সভ্যতাকে গণ্য করা শ্রেয়।
আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হয়েছে গ্রিসে। এ জন্য গ্রিসকে বলা হয় আধুনিক শিক্ষার জন্মভূমি। শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানেি গ্রিকরা ছিল সবার আদর্শ। গ্রিকদের এসব উন্নতির পশ্চাতে রয়েছে, উন্নত মানের শিক্ষাব্যবস্থা। দেখা যাচ্ছে, যে দেশে শিক্ষার যত প্রসার ঘটেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারাই উন্নত। সেই সভ্যতার হাজার বছর পার হয়েছে। আমরা আছি, ২০২৩ সালে। এখনো, এই মুহূর্তে একটি সঠিক পাঠ্যক্রম তৈরি করতে পারছি না। বছর শুরুতেই বিষয়-বৈচিত্র্য নিয়ে ঝকমকা বই, শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছি। সেখানেও, কিম্ভূতকিমাকার চিন্তাহীন সামঞ্জস্যহীন তথ্য। দুটি বই প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হাজার মানুষের সমালোচনা এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপকেই সঠিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন! কিন্তু, এই দায় মূলত কোন কোন জ্ঞানীজনের?
গতকাল দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘কাঁচা হাতে বড় কাজ’ শিরোনামের সংবাদে, বিষয়টি বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে তাড়াহুড়ো করে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করতে গিয়ে বড় বিপদে পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে দুটি বই প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। আরও তিনটি বইয়ে, বড় ধরনের সংশোধন আসছে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে আরও জানা যায়, এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জান বলেছেন, যে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে, তা এ বছর আর দেওয়া হবে না। কারণ ঐ বই দুটির দুটি অংশ ছিল। এখন যে অংশটি রয়েছে, তা দিয়েই বিষয়টি কাভার হবে। শিক্ষার্থীদের শিখনে কোনো সমস্যা হবে না বলেই, বই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের অনুশীলন বইয়ে আমরা নানা বিশ্বের নানা সভ্যতার ইতিহাস তুলে ধরেছি। এসব ইতিহাসকে প্রদর্শন করতে গিয়ে ‘অনুসন্ধানী পাঠে’ মিসরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতাগুলো এসেছে, প্রাচীন দেব-দেবী নিয়ে কথা এসেছে, তাদের সংস্কৃতির নানা ছবি ব্যবহার হয়েছে। যদি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাচ্চাদের জন্য প্রাচীন সভ্যতার বিষয়টি কঠিন হয়ে যায়, তাহলে তা আমরা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে ওপরের শ্রেণিতে নিয়ে যাব।’
চমৎকার কথা বলেছেন। কিন্তু একটা খটকা থাকে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য কোন বিষয়টি বোধগম্য আর কোনটি নয় সেটা কি পাঠ্যপুস্তক তৈরিতে যুক্ত বিজ্ঞজন, জ্ঞাত নন! তারা জানেন না, কোন বিষয়টি কোন বয়সীদের জন্য? প্রকাশিত সংবাদে আরও জানা যায় ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত পাঠ্যপুস্তকের অসংগতি, ভুল বা ত্রুটি চিহ্নিত করে তা সংশোধনে প্রয়োজনীয় সুপারিশের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক আব্দুল হালিমকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির মতামতের আগেই দুটি বই প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। এছাড়া ভুল-ত্রুটির জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তারকে আহ্বায়ক করে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের ভুলের দায় স্বীকার করেছেন, ওই বইটির সম্পাদক অধ্যাপক মো. জাফর ইকবাল ও হাসিনা খান।
প্রশ্ন হচ্ছে তাই-ই যদি হবে, তাহলে এত জল ঘোলা করা কেন? আরও আগেই তা করা যেত। দায় স্বীকার করে, বিবৃতি দিলেই হতো সমস্যার সমাধান। এত হৈ-হল্লা, হতো না। তবে ভবিষ্যতে এমনটি যেন না হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সেদিকে কঠোর নজরদারি দরকার। মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থীর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আগামীর নতুন দিগন্ত, ওদেরই হাতে।
স্বীকার করতেই হবে একাত্তরের যুদ্ধে নেতৃত্ব ছিল পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের হাতে। তাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে যুক্ত হয়েছিল বুর্জোয়াদের ছোট একটি অংশ। বুর্জোয়াদের বড় একটি অংশের নীরব সমর্থনও ছিল। কিন্তু অন্যসব বড়মাত্রার আন্দোলনে যেমন, এটিতেও তেমনি নেতৃত্ব সংরক্ষিত ছিল পেটি বুর্জোয়াদের কাছেই। বুর্জোয়াদের সঙ্গে পেটি বুর্জোয়াদের পার্থক্য অবশ্যই ছিল, বুর্জোয়ারা ছিল অধিক বিত্ত ও ক্ষমতার অধিকারী, তাদের জানাশোনা ওঠাবসা রাষ্ট্রীয় উচ্চমহলের সঙ্গে, যোগাযোগ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। কিন্তু মিলের জায়গাটা এইখানে যে উভয় শ্রেণিই উন্নতির জন্য উন্মুখ। এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি। মুসলমান বুর্জোয়া এবং পেটি বুর্জোয়ারা উভয়ে ব্রিটিশ আমলে দেখতে পাচ্ছিল যে তাদের জন্য উন্নতির পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে অগ্রসর হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা। পথ মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানের দরকার ছিল। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর টের পাওয়া গেল যে উন্নতির পথটা যথেষ্ট প্রশস্ত হয়নি; হিন্দুরা চলে গেছে কিন্তু অবাঙালিরা এসে হাজির হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এই নবাগতদের হটাবার জন্যও প্রয়োজন হয়েছিল। আত্মমর্যাদার ওপর আঘাত তো ছিলই, উন্নতিতে বিঘ্ন সৃষ্টিও ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।
আন্দোলনের মূল শক্তি এসেছে জনগণের অংশগ্রহণ থেকেই; পাকিস্তান আন্দোলনে যেমন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও তেমনি। তবে জনগণের আকাক্সক্ষাটা ছিল ভিন্ন প্রকারের। সেটাকে স্বপ্নও বলা চলে। বাস্তবের সঙ্গে আকাক্সক্ষার মিশ্রণে উৎপাদিত স্বপ্ন। স্বপ্নটা ছিল এই আন্দোলন তাদের জন্য মুক্তি এনে দেবে। ব্রিটিশ যুগের পাকিস্তান বলতে তারা জমিদার ও মহাজনদের অর্থনৈতিক নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি বুঝেছে, পুলিশ ও আমলার অত্যাচার থেকে অব্যাহতির আশা করেছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক শোষণ থেকে মুক্তি দেবে বলে তারা ভরসা করেছে। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’, এমন আশঙ্কা মেহনতিদের তেমন একটা বিচলিত করেনি, কারণ মুখ থেকে কেউ ভাষা কেড়ে নিতে পারে এটা অবাস্তবই ছিল তাদের কাছে।
একাত্তরের যুদ্ধে পেটি বুর্জোয়া, বুর্জোয়া ও মেহনতি সব শ্রেণির মানুষেরই অংশগ্রহণ ছিল, যদিও তাদের স্বপ্ন ছিল ভিন্ন ভিন্ন। পেটি বুর্জোয়ার আকাক্সক্ষা বুর্জোয়া হবে, বুর্জোয়ার আকাঙ্ক্ষা আরও বড় মাপের বুর্জোয়া হয়ে উঠবে। অপর দিকে মেহনতিদের স্বপ্ন ছিল সার্বিক মুক্তির। সব শ্রেণির মানুষ এক কাতারে চলে আসতে পেরেছিল কারণ সাধারণ শত্রু ছিল পাঞ্জাবিদের নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র। সবাই একত্রে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়ছিল। তবে ওই পর্যন্তই। এর বাইরে আকাক্সক্ষা ও অংশগ্রহণে ঐক্য স্থাপিত হয়নি। দু’পক্ষই বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছে। তবে দুই বিপ্লবের চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধনীদের বিপ্লব শরৎচন্দ্রের সব্যসাচী যাকে বলেছে ভদ্রলোকের বিপ্লব, সেই বিপ্লব। অর্থাৎ অবাঙালিদের হাঁকিয়ে দিয়ে তাদের পরিত্যক্ত আসনগুলোতে নিজেরা বসে পড়া, এবং অবিঘ্নিত রূপে শাসন করা ও তরতর করে উন্নতি করতে থাকা। আর মেহনতিদের বিপ্লব ছিল সামাজিক বিপ্লব, সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভু-ভৃত্যের পুরনো সম্পর্ক ভেঙে ফেলে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা, এবং তারই প্রয়োজনে রাষ্ট্রের ভেতরকার কাঠামোটা বদলে দেওয়া। বলাবাহুল্য পরস্পরবিরোধী এই দুই স্বপ্নের একটি অপরটিকে সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দেয়।
একাত্তরে বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়ারা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, মেহনতিরা ছিল দেশের ভেতরে, তাদের পক্ষে দেশত্যাগ সহজ ছিল না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল অসম্ভব। তারাই প্রাণ দিয়েছে, তাদের মেয়েরাই নিপীড়িত হয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। লড়াইটা মূলত তারাই করেছে। ভারতে গিয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছে তাদের ভেতরকার পারস্পরিক বিরোধের ও বিচ্ছিন্নতার খবর আমরা অনেকের লেখার মধ্যে পাই। জানা যায় যে আগরতলায় ছোটখাটো আনন্দানুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল। একজন সুপরিচিত ন্যাপ নেত্রী তার বিবাহবার্ষিকীও পালন করবার সুযোগ পেয়েছেন। কলকাতায় যারা গেছেন তারাও কেউ কেউ বিয়ে-শাদি করেছেন, বিবাহবহির্ভূত প্রেম করা থেকেও বিরত থাকেননি। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলির ওপরে অনেকে লিখেছেন। সেসব বই মিলিয়ে পড়লে টের পাওয়া যায় ঘটনা কোনদিকে এগুচ্ছিল।
বিজ্ঞান-কর্মকর্তা ড. ফারুক আজীজ খান কলকাতায় গিয়েছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের বিপদ-আপদের মধ্য দিয়ে, প্রাণঘাতী ঝুঁকি মাথায় করে। পরিবার-পরিজন ছেড়ে একাকী আগরতলায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন, সেখান থেকে গেছেন কলকাতায়। কলকাতায় তিনি কাজ করেছেন প্রবাসী প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে। ঝঢ়ৎরহম ১৯৭১ নামে তিনি ইংরেজি একটি বই লিখেছেন, তার বহু রকমের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে। একটি অভিজ্ঞতার বিবরণ বাংলায় অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায় : “খ্যাতনামা ও সংগ্রামী এক ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, একটি বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করল। মেয়েটি তার পিতামাতার সঙ্গে কলকাতায় এসেছিল। ভিআইপিদের জন্য একটি সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। জিনিসটা অনেকের কাছেই বেখাপ্পা ঠেকেছে কারণ ছাত্ররা যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে এবং প্রাণ দিচ্ছে তখন দেখা গেল তাদেরই একজন ঠিক সেই সময়টিকেই মনে করল বিবাহের জন্য উৎকৃষ্ট সময়।’ এর সঙ্গে তিনি আরেকটি মন্তব্যও করেছেন : “আমাদের অনেকেই তখন গৃহহীন সমাজের মানুষদের মতো আচরণ করছিল, কখনো কখনো তারা ভুলেও গেছে অন্য বাঙালিদের প্রতি তাদের দায়িত্বটা, যেন তারা অপেক্ষা করছিল কবে ঘরে ফিরবে, আজই যদি না হয় তাহলে নিশ্চয়ই আগামীকাল।” (পৃ ২০৩) কলকাতায় বাংলাদেশ হাই কমিশনারের অফিস ছিল সার্কাস এভিনিউতে, বাংলাদেশ সরকারের দপ্তর থিয়েটার রোডে, পরিহাস করে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন কলকাতায় যোদ্ধাদের ঘোরাফেরা মোটামুটি সীমিত ছিল সার্কাস থেকে বের হয়ে থিয়েটারে এবং থিয়েটারের কাজ সেরে সার্কাসে যাওয়ার ভেতরেই। ফারুক আজীজ খান অবশ্যই তেমন কোনো মন্তব্য করেননি, তবে তাকেও প্রথমে সার্কাস এভিনিউতে এবং সেখান থেকে থিয়েটার রোডে যেতে হয়েছিল। সার্কাস এভিনিউতে অভিজ্ঞতাটি ছিল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। হাইকমিশন অফিসের ভিড় ঠেলে, নানা প্রতিবন্ধক এড়িয়ে কোনো মতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন পুরনো এক বন্ধুর সামনে। বন্ধুটি তখন বাংলাদেশ সরকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি। ফারুক আজীজের অভিজ্ঞতাটা দাঁড়িয়েছিল, “বন্ধুটি তদ্সত্ত্বেও আমার সঙ্গে অদ্ভুত ব্যবহার করলেন। প্রথমে তিনি এমন ভান করলেন যে আমাকে তিনি চেনেনই না, তাছাড়া যদি চেনেনও তাহলেও তার সঙ্গে আমার কোনো কারবারই থাকতে পারে না, কারণ তিনি তখন বিগ বস। বুঝলাম তার কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়ার আশা নেই, তদ্সত্ত্বেও আমি জানতে চাইলাম আমি কোনোভাবে কোনো সাহায্যে আসতে পারি কি না। তিনি বললেন, ‘শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য বুলেটপ্রতি দশ পয়সা দিতে রাজি আছি।’ ” (পৃ ১৬৭) ফারুক আজীজ লিখছেন, সবই বুঝলাম এবং যুদ্ধ বলতে যা চলছিল সেটির অভিজ্ঞতা তার চেয়ে আমারও কিছু কম ছিল না। কিন্তু এটা কখনোই মনে হয়নি যে বুলেটপ্রতি দশ পয়সা পাবে এই আশাতে কেউ যুদ্ধ করছিল। মাঠের যোদ্ধা আর কলকাতার বস এক ছিল না।
এক কাতারে সবাই এসেছিল, কিন্তু আবার আসেও-নি। আসার উপায়ও সহজ ছিল না। ফারুক আজীজ যখন প্রাণভয়ে কাপ্তাইয়ে তার কর্মস্থল থেকে বন-জঙ্গল-পাহাড় পেরিয়ে চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা থেকে ভারত সীমান্তের দিকে এগুচ্ছিলেন তখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে পড়ে নিজের বাঙালিত্ব প্রমাণের যে কঠিন পরীক্ষার তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন সেটি বাকি জীবনে ভুলতে পারেননি। তার ঠোঁটে গোঁফ ছিল, সেটি ছিল কিছুটা তামাটে রঙের, বুদ্ধি করে সেটি কামিয়ে ফেলেছিলেন, নইলে অবাঙালিত্বের ওই ইশারার কারণেই তাকে প্রাণ দিতে হতো। উচ্চশিক্ষার জন্য এবং চাকরিসূত্রে কানাডা ও আমেরিকায় বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছেন, তবুও বাংলা ভোলেননি, বরঞ্চ বাংলাভাষার চর্চা তিনি করতেন নানা উপায়ে। তার বাংলা ইপিআর সদস্যদের বাংলার চাইতে উন্নত মানেরই ছিল। ঘটনার বিশ বছর পরে লিখতে গিয়ে তিনি কী করে যে বাঙালিত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন সেটা ভাবলে গা কাঁপে বলে উল্লেখ করেছেন। তার মনে পড়েছে যে আওয়ামী লীগের প্রধান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যদি ১৯৭১ সালে জীবিত থাকতেন এবং বাঙালি যোদ্ধাদের হাতে পড়তেন তাহলে তার বিপদটা হতো আরও বড় রকমের, কারণ ফারুক আজীজের ভাষায়, “বাংলায় সোহরাওয়ার্দীর দক্ষতা উর্দুতে আমার দক্ষতার মতোই নিম্নমানের ছিল।”
ফারুক আজীজ লিখছেন, কলকাতায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবরা যে ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করেছেন ১৯৭১ সেটি মুসলমান বাঙালিদের মুসলমান পাঞ্জাবি খুনি ও ধর্ষকদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি; এবং কোরআন শরিফের সুরা ঘাতকদের ছুরি ও বন্দুকের সামনে মোটেই রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করেনি। এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান রাজুর কাছে তিনি শুনেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ভারতীয় সীমান্তের কাছে বিহারি বলে সন্দেহ করে বাঙালি যোদ্ধারা এক ব্যক্তিকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, স্থানীয় এমপি মমতাজ বেগম এসে না পড়লে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেই যেত। ব্যক্তিটি আর কেউ নন, কর্নেল এম এ জি ওসমানী, পরে যিনি মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হয়েছেন। ওসমানী তখনো তার নিজস্ব কাটাকাটা উচ্চারণে ইংরেজি ভাষায় বলছিলেন; Look Raju, what the fellwos were going to do to me..’ (পৃ. ১২৪) চেনাজানা ছিল না, দূরত্ব ছিল শ্রেণির। রণাঙ্গনে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সেনাপতির তাই প্রাণ হারাবার উপক্রম হয়েছিল বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতেই।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা নানা রঙে-ঢঙে দিনটিকে রাঙিয়ে তোলেন। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ভালোবাসা দিবসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ভালোবাসা মানুষকে উড়তে শেখায়, ভালোবাসা মানুষকে বাঁচতে শেখায়, ভালোবাসা মানুষকে অধিকারের কথা বলতে শেখায়, পড়তে শেখায়, জ্বলতে শেখায়, নিভতে শেখায়। পুঁজিবাদী বিশে^ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হলেও, বাংলাদেশে দিবসটির ইতিহাসের একটু ভিন্ন তাৎপর্য আছে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও তা পালনের আয়োজন-প্রচারের তোড়ে সেই রক্তঝরা দিনটির কথা সবাই ভুলতে বসেছে। এর দায় কার? ছাত্রসমাজের রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস রাষ্ট্র ও গণমাধ্যম থেকে কীভাবে মুছে গেল? আজকের দিনে সপ্তম শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীকেও যদি প্রশ্ন করা হয় যে ভালোবাসা দিবস কবে। সেই শিশুশিক্ষার্থী অকপটে তার সঠিক উত্তর বলে দিতে পারবে। কিন্তু যখন বলা হবে বলো তো স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস কবে? তখন সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। এমনকি কলেজপড়–য়া শিক্ষার্থীরাও বলতে পারেন না। ভালোবাসা দিবস পালনে সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে এই দিবস পালনের ডামাডোলের মধ্যে সংগ্রামের ইতিহাসকে চাপা দিয়ে রাখা। এই রাজনীতির পাশাপাশি পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর বাণিজ্যিক কৌশলের প্রধান হাতিয়ার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। তাই সচেতন হতে হবে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব শরীফ কমিশনের ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষার অধিকার আদায়ের জন্য ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পুলিশের গুলিতে জীবন উৎসর্গ করেছিল মোস্তফা ওয়াজিল্লাহ, বাবুল প্রমুখ ছাত্র নেতারা। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি অনুসরণ করে হাঁটতে চেয়েছে স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতি। প্রশ্ন আসে, যে পাকিস্তানের শিক্ষানীতি রক্ত দিয়ে বাতিল করছে ছাত্ররা, সেই শিক্ষানীতি কি বাংলাদেশে চালু করা উচিত? তৎকালীন সামরিক শাসকের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব করেন। সেখানে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হয় মেধা অথবা ৫০ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা। ফলে সেই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১৭ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো। তারপর শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন, কালক্রমে যেটি গণ-আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। ছাত্রসমাজের দাবি ছিল একটি অবৈতনিক বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি। কিন্তু ড. মজিদ খান যে নীতি ঘোষণা করেন, সেখানে বাণিজ্যিকীকরণ আর ধর্মীয় প্রতিফলন ঘটেছে বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। তাই শুরু থেকেই ওই নীতির বিরোধিতা করতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে স্মারকলিপি দিতে শিক্ষার্থীরা মিছিল করে সচিবালয়ের দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ টিয়ার গ্যাস, জলকামান, অবশেষে নির্বিচারে গুলি চালায়। ফলে লুটিয়ে পড়েন শহীদ দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ূব, কাঞ্চনসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে বাধ্য হয়েছিল বাতিল করতে কুখ্যাত মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতি। সে কারণেই ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বৈরাচার ছাত্র প্রতিরোধ দিবস শুধু বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাড়া কোনো ছাত্র সংগঠন বা রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দিবস পালন করা হয় না।
তাই ভালোবাসার ফুল যাদের চরণে দিই যারা শিক্ষার রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে রাজপথে জীবন দিল। ভালোবাসার প্রাণ ওই শহীদরা। সেই ভালোবাসার কল্যাণেই এই মাটির ইতিহাস কখনোই ভোলার নয়। স্বাধীন জাতি হিসেবে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন এবং মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একই ধারায় বিজ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতির লক্ষ্য কতটা অর্জিত হলো, শিক্ষাব্যবস্থায় কী দুর্বলতা ও অসংগতি রয়ে গেছে, তা রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণ করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তা না হলে শহীদের রক্তের ঋণ অশ্রদ্ধা করা হবে। ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে রাজপথে থাকত শিক্ষার্থীরা, যার উজ্জ্বল উদাহরণ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কিন্তু যখন যেই সরকার ক্ষমতায় আসে সেই দলের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা যখন হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে পড়েন, তখনই সবাই ছাত্ররাজনীতির নামে ভয় পায়। আর কেউ কেউ ছাত্ররাজনীতি বন্ধের শোরগোল তোলেন। কিন্তু যুবলীগ নেতারা যে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত, কেউ কি একবারও যুবরাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন? আবার ধরেন পুলিশ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের দুর্নীতির খবর পাই তখন কি কোনো পেশা বন্ধের দাবি উঠেছে? উত্তর হচ্ছে বন্ধের কোনো দাবি ওঠেনি। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হবে কেন? যাদের সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠন তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। ছাত্ররাজনীতিকে বলা হয় নেতৃত্ব তৈরির বাতিঘর। সেই বাতিঘর তৈরির কাজ রাষ্ট্রকেই করতে হবে। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আড়ালে যেন পড়ে না থাকে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র প্রতিরোধ দিবস।
লেখক : প্রাবন্ধিক
ঝলমলে বইমেলা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আচমকা মনে হলো, সামনের তরুণটিকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কখনো সুবিমল মিশ্র পড়েছো! কিংবা ওই যে ঝকঝকে মেয়েটি বয়ফ্রেন্ডের কাঁধে হাত দিয়ে চলেছে, তার কাছে জানতে চাইব, সুবিমল কেমন লাগে! অথবা একটা পলিটিক্যাল স্টলে বসে থাকা পৌঢ় ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়, সুবিমল মিশ্র আপনার পছন্দের লেখক কিনা!
কিন্তু অদ্ভুত এক ভয় পেয়ে বসেছে। যদি কেউ সুবিমল মিশ্র সম্পর্কে কিছুই না জানেন। সুবিমল তো তথাকথিত ভদ্দরলোকীয় বৃত্তে তেমন খাতিরের লেখক ছিলেন না। যে লেখকদের সামনে অটোগ্রাফ খাতা হাতে দুরন্ত সুন্দরীরা দাঁড়িয়ে থাকেন সুবিমল তো কখনোই তাদের দলের লোক নন।
সুবিমল মিশ্র নিজেকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক বলতেন না। বলতেন, লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। তিনি উপন্যাস, গল্প কিস্যু লেখেননি। যা লিখেছেন সব অ্যান্টি নভেল, অ্যান্টি স্টোরি। ওর সবচেয়ে পঠিত উপন্যাস ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’ প্রথম পড়তে গিয়ে চমকে গিয়েছিলাম। অত রগরগে উপন্যাস বাংলা ভাষায় আগে কখনো পড়িনি। আমরা যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির, তাদের কাছে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ওই ঢাউস উপন্যাসটি ছিল নিখাদ পর্নোগ্রাফি। এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করেছিলেন সুবিমল, যা শোনাও তখন ছিল ‘গর্হিত অপরাধ’। আমাদের অনেকের কাছেই ছিল শুধু অপরাধ নয়, অশ্লীল লেখা পড়া মানেই প্রতিক্রিয়াশীল কাজ।
এই আমরা, আমাদের বলতে তখনকার দিনের বামপন্থি পরিবারের লোকজন। এখন বুঝি, আমাদের মধ্যে বিপুল ট্যাবু ছিল, যা এখন মনে হয় একধরনের মৌলবাদ। সুবিমল দূরের কথা, তখন বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভোর বৃষ্টি’, সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’, ‘বিবর’ নিয়েও তখন তর্কবিতর্ক প্রবল। যখন স্তন, জঙ্ঘা, শীৎকার নিষিদ্ধ শব্দ, তখন সুবিমল খোলাখুলিভাবে লিখছেন মাসী বোনপোর শরীরী সম্পর্কের বিশদ বর্ণনা।
সুবিমলের অন্যান্য লেখাতেও উঠে এসেছে যৌন অনুষঙ্গ। আসলে সুবিমল মিশ্র সেক্স, ভায়োলেন্স ব্যবহার করতেন তথাকথিত ভদ্রলোকীয় মূল্যবোধকে ধাক্কা দিতে। আজকাল সাব অলটার্ন তত্ত্ব নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। সুবিমল মিশ্র এই কাজটি বহু বছর আগে করেছিলেন। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে।
সেক্সের নন্দনতত্ত্ব বা ধ্রুপদী দিক নিয়ে সুবিমল মিশ্রের সাহিত্য নিঃসন্দেহে গবেষণার বিষয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির চরম যুগে দাঁড়িয়ে, আধিপত্যবাদকে কোণঠাসা করতে কখনো কখনো সুবিমল মিশ্র ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে একই সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়। র্যাডিক্যালিজম অনেক সময় ভায়োলেন্স দাবি করে। আন্ডারগ্রাউন্ড লিটারেচারে আপাত অশ্লীল বহু শব্দ সময় সময় ডিনামাইটের মতো ফেটে পড়ে।
এখন মনে হয় সুবিমল নানা সময় যৌনতা, নিষিদ্ধ সম্পর্ক নিয়ে একধরনের ফ্যান্টাসি তৈরি করতেন। ফ্যান্টাসির মধ্য দিয়ে বলতে চাইতেন, কোনো কিছুই নিষিদ্ধ বা বে-আইনি নয়। সব সম্ভব। পুঁজিবাদ একই রকম ফ্যান্টাসি তৈরি করে। মৌলবাদ যেমন মানুষকে পারলৌকিক জগতের দিকে আকৃষ্ট করে কল্পিত এক জগতের স্বপ্ন দেখিয়ে। ওয়াজ মেহফিলে বা পুরোহিতের উচ্চারণে দুনিয়ার যাবতীয় সংকট থেকে মুখ ফিরিয়ে কল্পিত ভবিষ্যতের ছবি পাই, ঠিক তেমনই পুঁজি নির্মাণ করে রঙিন দুনিয়া। ঠা-া মতলব- অমুক পানীয়, তমুক ক্রিম কিনলে ফর্সা হওয়ার গ্যারান্টি...। মুশকিল হচ্ছে, একদল মেঠো কথার কারণে চিহ্নিত হন মৌলবাদী বলে। অপরপক্ষ চকচকে মোড়কে স্বপ্ন বেচেন, তাই তারা আধুনিক, প্রগতিশীল। এই নতুন সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী সাংস্কৃতিক হেজিমনিকে কাউন্টার করতে চেয়েছিলেন সুবিমল মিশ্র।
গত শতকের ষাট দশকে ঝোড়ো হাওয়ার গতিতে সুবিমলের আবির্ভাব, সময়কাল পৃথিবীর ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভারত উপমহাদেশে তো বটেই। সারা দুনিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বিভাজন ঘটে গেছে। লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে জন্ম নিচ্ছে নতুন শিল্প। ফ্রান্সের অভিজাত ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা পথে নেমেছেন বিপ্লবের পতাকা নিয়ে। জাঁ পল সার্ত্র, সিমন দ্যা বোভেয়ার মতো বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী রাস্তায় নেমেছেন নিষিদ্ধ ইশতাহার বিক্রি করতে। দেয়ালে দেয়ালে লেখা হচ্ছে তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম। চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে ডাক দিয়েছেন ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে তখন দাবানলের মতন আছড়ে পড়েছে নকশালবাড়ী। নতুন নতুন সিনেমা, নাটক, কবিতা, গল্প, উপন্যাস তখন জন্ম নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে।
তার মধ্যে সম্পূর্ণ অন্য ধারার লেখক হিসেবে আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হলেন সুবিমল মিশ্র।
১৯৬৭ সাল থেকে মোটামুটি নিয়মিত লিটল ম্যাগাজিনে আমরা সুবিমল মিশ্রকে পাচ্ছি। ১৯৬৯ সালে কবিপত্র পত্রিকায় লিখলেন দুর্দান্ত গল্প, ‘হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধী মূর্তি’। গল্পের স্পিরিট ছিল আগে মড়া সরাও, না হলে গান্ধী মূর্তির হদিস মিলবে না ।
সোজা কথায়, আগে দেশের মানুষের মুখে খাবার তুলে দিয়ে তারপর নেতারা এই করেঙ্গে, সেই করেঙ্গে, ভাষণ দিয়ো। যে সময়ে এ লেখা, তখন ধীরে ধীরে ভারত বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। নকশালবাড়ীর তাপে উত্তপ্ত হয়ে গেছে সারা দেশ। ভোজপুর, জেহানাবাদ, আরা, শ্রীকাকুলাম খবরের কাগজের শিরোনামে। বধ্যভূমিতে পরিণত হচ্ছে আমার দেশ। তখন সম্পূর্ণ অন্য ধারায় এদেশের গরিব, প্রান্তিক মানুষের কথা লিখছেন সুবিমল মিশ্র, সোজা-সাপটা ভাষায়। রাষ্ট্র, সমাজের অসাম্য, ভ-ামি নিয়ে কোনোরকম দ্বিচারিতা সহ্য করেননি সুবিমল। সাহিত্য ছিল তার প্রতিবাদ, হয়তো প্রতিরোধেরও অস্ত্র।
কত গল্প লিখেছেন সুবিমল। কোনটি ছেড়ে কোনটির কথা বলব! তার প্রায় সব লেখাতেই রাজনৈতিক, সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতি দ্বিধাহীন বিশ্লেষণ ও মধ্যবিত্ত সমাজের যৌনতা নিয়ে অচ্ছুৎপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ লক্ষ করা যায়।
রাষ্ট্রব্যবস্থা, তার শোষণ, সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রতি ব্যঙ্গ, অবক্ষয়, দ্বন্দ্ব, লেখার কোলাজ এবং বিশেষভাবে নৈরাজ্য ইত্যাদি সুবিমলের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তেজস্ক্রিয় আবর্জনা’, ‘আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো’, ‘হাড়মটমটি’, ‘ক্যালাকাটা ডেটলাইন’, ‘চেটে চুষে চিবিয়ে গিলে’ ইত্যাদি।
সময়ের অনেক আগে জন্মেছিলেন সুবিমল। লেখায় তিনি যে প্ল্যানড ভায়োলেন্স চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন তা অধিকাংশই আমরা বুঝতে পারিনি বা চাইনিও। প্রচলিত সমস্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ জারি করেছিলেন সুবিমল। চিরটাকাল স্থিতাবস্থা ও ক্ষমতা কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ করে গেছেন আমাদের বাংলা সাহিত্যের ‘কালাপাহাড়’ সুবিমল মিশ্র।
সাজানো গোছানো ভদ্দরলোকদের মধ্যেও যে কত আদিম হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, বিকৃত যৌনচিন্তা লুকিয়ে থাকে তা টেনেহিঁচড়ে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছিলেন সুবিমল। তার আগে এই কাজটি করেছিলেন জগদীশ গুপ্ত।
সুবিমল মনে করতেন পাঠকের পড়ার সনাতনী অভ্যেসকেও বদলে দিতে হবে। তাই তিনি কখনো পাঠককে নিশ্চিন্তে তার লেখা পড়তে দেননি। এক এক লেখায় সুবিমল যে বীভৎস পৃথিবীর ছবি এঁকেছেন তা আজ আরও অনেক বেশি সত্য, ভয়ংকর।
সারা জীবন স্রোতের বিপরীতে হাঁটা আজ কঠিনতম কাজ। সেই কাজটি করতে অসম্ভব বুকের পাটা লাগে। সুবিমল মিশ্রের সেটা ছিল। কত তথাকথিত বিপ্লবী বাঘকে কাগুজে হতে দেখলাম চোখের সামনে। সুবিমল মিশ্র ঘোষিত বিপ্লবী না হয়েও কখনো কোনোদিনই প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেননি। সুবিমল মিশ্র, অমিয়ভূষণ মজুমদার, কমলকুমার মজুমদার, ধারা আলাদা হলেও পপুলিস্ট লেখক কেউই নন। আজ চারপাশের বিক্রি হয়ে যাওয়া লেখকদের ভিড়ে, ভয় হয় বাংলা সাহিত্যে ওদের মনে রাখবে কীভাবে তা ভেবে।
বইমেলায় হাঁটছি। আগের দিন সুবিমল মিশ্র চলে গেছেন। আজ বৃহস্পতিবার। কোথাও কোনো চাঞ্চল্য নেই লেখকের মৃত্যুতে। বিপুল ভিড়। বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে এক বা কতিপয় তরুণ লেখককে ঘিরে তুমুল উন্মাদনা। একা যেতে যেতে মনে হলো, ভিড়ের মধ্যে একটা মাথা আচমকাই সব মাথা ছাড়িয়ে বিশাল হয়ে উঠছেন। মুখের দিকে না তাকিয়েও নিশ্চিন্তে বলে দিতে পারি, তিনি, তিনিই সুবিমল মিশ্র।
যিনি সারা জীবন মেরুদণ্ড সোজা রেখে পথ হেঁটেছেন। আমরা, বামপন্থি ঘরানার লোকজন কোনোকালেই তাকে গুরুত্ব দিইনি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাকে সহযোদ্ধা ভাবিনি। আজ অন্তত একবার যেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী সবাই, মৃত্যুর পরে হলেও সুবিমল মিশ্রকে কুর্নিশ জানাই। আমাদের সময়ের এই আপসহীন যোদ্ধার জন্য থাকুক লাল গোলাপ ও জনগণের গান স্যালুট।
লেখক: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক
ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবী গাজীউল হকের জন্ম নোয়াখালীতে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২৯ সালে। তার বাবার নাম সিরাজুল হক ও মা নূরজাহান বেগম। ১৯৪৬ সালে তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে আইএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস নিয়ে ১৯৫১ সালে বিএ অনার্স ও ১৯৫২ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। স্কুলজীবন থেকে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৪৪ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ’ বগুড়া জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং কুষ্টিয়ায় ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৩ ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকায় তিনি গ্রেপ্তার হন। তিনি ১৯৬২ সালের শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন, ১৯৬৪-এর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। তার রচিত ‘ভুলব না, ভুলব না, ভুলব না/এই একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি গেয়ে একসময় প্রভাতফেরি করা হতো। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জেলের কবিতা, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এগিয়ে চলো, উচ্চ আদালতে বাংলা প্রভৃতি। একুশে পদক, বঙ্গবন্ধু পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছেন। ২০০৯ সালের ১৭ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
শনিবার ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭১ সালের এ দিন শেষে এক বিভীষিকাময় ভয়াল রাত নেমে এসেছিল। এদিন মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন এবং সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনা সভা হবে। এ ছাড়াও সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনের মিনিপোলগুলোতে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বাদ জোহর দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই নাম অপারেশন সার্চলাইট।
এ অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। অনেক পরে, ২০১২ সালে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অ·ফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।
অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিচারণ করে রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউজে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত করি।’ পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট।
যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হলো আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভ‚মি।’
পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্তে¡ও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। এদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারযোগে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসেন।
ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজীর জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্বে থাকা সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থেও এ সংক্রান্ত একটি বিবরণ পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল নিয়াজীর পাশেই ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অনুগত পাকিস্তানি হিসেবে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার চক্রান্ত তিনি খুব কাছে থেকেই দেখেছেন। ২৫ মার্চ, অপারেশন সার্চলাইট শুরুর মুহ‚র্ত নিয়ে তিনি লিখেন ‘নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এমন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহ‚র্ত (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল।’
পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।