
ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবী গাজীউল হকের জন্ম নোয়াখালীতে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২৯ সালে। তার বাবার নাম সিরাজুল হক ও মা নূরজাহান বেগম। ১৯৪৬ সালে তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে আইএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস নিয়ে ১৯৫১ সালে বিএ অনার্স ও ১৯৫২ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। স্কুলজীবন থেকে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৪৪ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ’ বগুড়া জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং কুষ্টিয়ায় ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৩ ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকায় তিনি গ্রেপ্তার হন। তিনি ১৯৬২ সালের শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন, ১৯৬৪-এর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। তার রচিত ‘ভুলব না, ভুলব না, ভুলব না/এই একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি গেয়ে একসময় প্রভাতফেরি করা হতো। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জেলের কবিতা, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এগিয়ে চলো, উচ্চ আদালতে বাংলা প্রভৃতি। একুশে পদক, বঙ্গবন্ধু পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছেন। ২০০৯ সালের ১৭ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
স্বীকার করতেই হবে একাত্তরের যুদ্ধে নেতৃত্ব ছিল পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের হাতে। তাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে যুক্ত হয়েছিল বুর্জোয়াদের ছোট একটি অংশ। বুর্জোয়াদের বড় একটি অংশের নীরব সমর্থনও ছিল। কিন্তু অন্যসব বড়মাত্রার আন্দোলনে যেমন, এটিতেও তেমনি নেতৃত্ব সংরক্ষিত ছিল পেটি বুর্জোয়াদের কাছেই। বুর্জোয়াদের সঙ্গে পেটি বুর্জোয়াদের পার্থক্য অবশ্যই ছিল, বুর্জোয়ারা ছিল অধিক বিত্ত ও ক্ষমতার অধিকারী, তাদের জানাশোনা ওঠাবসা রাষ্ট্রীয় উচ্চমহলের সঙ্গে, যোগাযোগ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। কিন্তু মিলের জায়গাটা এইখানে যে উভয় শ্রেণিই উন্নতির জন্য উন্মুখ। এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি। মুসলমান বুর্জোয়া এবং পেটি বুর্জোয়ারা উভয়ে ব্রিটিশ আমলে দেখতে পাচ্ছিল যে তাদের জন্য উন্নতির পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে অগ্রসর হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা। পথ মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানের দরকার ছিল। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর টের পাওয়া গেল যে উন্নতির পথটা যথেষ্ট প্রশস্ত হয়নি; হিন্দুরা চলে গেছে কিন্তু অবাঙালিরা এসে হাজির হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এই নবাগতদের হটাবার জন্যও প্রয়োজন হয়েছিল। আত্মমর্যাদার ওপর আঘাত তো ছিলই, উন্নতিতে বিঘ্ন সৃষ্টিও ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।
আন্দোলনের মূল শক্তি এসেছে জনগণের অংশগ্রহণ থেকেই; পাকিস্তান আন্দোলনে যেমন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও তেমনি। তবে জনগণের আকাক্সক্ষাটা ছিল ভিন্ন প্রকারের। সেটাকে স্বপ্নও বলা চলে। বাস্তবের সঙ্গে আকাক্সক্ষার মিশ্রণে উৎপাদিত স্বপ্ন। স্বপ্নটা ছিল এই আন্দোলন তাদের জন্য মুক্তি এনে দেবে। ব্রিটিশ যুগের পাকিস্তান বলতে তারা জমিদার ও মহাজনদের অর্থনৈতিক নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি বুঝেছে, পুলিশ ও আমলার অত্যাচার থেকে অব্যাহতির আশা করেছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক শোষণ থেকে মুক্তি দেবে বলে তারা ভরসা করেছে। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’, এমন আশঙ্কা মেহনতিদের তেমন একটা বিচলিত করেনি, কারণ মুখ থেকে কেউ ভাষা কেড়ে নিতে পারে এটা অবাস্তবই ছিল তাদের কাছে।
একাত্তরের যুদ্ধে পেটি বুর্জোয়া, বুর্জোয়া ও মেহনতি সব শ্রেণির মানুষেরই অংশগ্রহণ ছিল, যদিও তাদের স্বপ্ন ছিল ভিন্ন ভিন্ন। পেটি বুর্জোয়ার আকাক্সক্ষা বুর্জোয়া হবে, বুর্জোয়ার আকাঙ্ক্ষা আরও বড় মাপের বুর্জোয়া হয়ে উঠবে। অপর দিকে মেহনতিদের স্বপ্ন ছিল সার্বিক মুক্তির। সব শ্রেণির মানুষ এক কাতারে চলে আসতে পেরেছিল কারণ সাধারণ শত্রু ছিল পাঞ্জাবিদের নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র। সবাই একত্রে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়ছিল। তবে ওই পর্যন্তই। এর বাইরে আকাক্সক্ষা ও অংশগ্রহণে ঐক্য স্থাপিত হয়নি। দু’পক্ষই বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছে। তবে দুই বিপ্লবের চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধনীদের বিপ্লব শরৎচন্দ্রের সব্যসাচী যাকে বলেছে ভদ্রলোকের বিপ্লব, সেই বিপ্লব। অর্থাৎ অবাঙালিদের হাঁকিয়ে দিয়ে তাদের পরিত্যক্ত আসনগুলোতে নিজেরা বসে পড়া, এবং অবিঘ্নিত রূপে শাসন করা ও তরতর করে উন্নতি করতে থাকা। আর মেহনতিদের বিপ্লব ছিল সামাজিক বিপ্লব, সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভু-ভৃত্যের পুরনো সম্পর্ক ভেঙে ফেলে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা, এবং তারই প্রয়োজনে রাষ্ট্রের ভেতরকার কাঠামোটা বদলে দেওয়া। বলাবাহুল্য পরস্পরবিরোধী এই দুই স্বপ্নের একটি অপরটিকে সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দেয়।
একাত্তরে বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়ারা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, মেহনতিরা ছিল দেশের ভেতরে, তাদের পক্ষে দেশত্যাগ সহজ ছিল না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল অসম্ভব। তারাই প্রাণ দিয়েছে, তাদের মেয়েরাই নিপীড়িত হয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। লড়াইটা মূলত তারাই করেছে। ভারতে গিয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছে তাদের ভেতরকার পারস্পরিক বিরোধের ও বিচ্ছিন্নতার খবর আমরা অনেকের লেখার মধ্যে পাই। জানা যায় যে আগরতলায় ছোটখাটো আনন্দানুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল। একজন সুপরিচিত ন্যাপ নেত্রী তার বিবাহবার্ষিকীও পালন করবার সুযোগ পেয়েছেন। কলকাতায় যারা গেছেন তারাও কেউ কেউ বিয়ে-শাদি করেছেন, বিবাহবহির্ভূত প্রেম করা থেকেও বিরত থাকেননি। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলির ওপরে অনেকে লিখেছেন। সেসব বই মিলিয়ে পড়লে টের পাওয়া যায় ঘটনা কোনদিকে এগুচ্ছিল।
বিজ্ঞান-কর্মকর্তা ড. ফারুক আজীজ খান কলকাতায় গিয়েছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের বিপদ-আপদের মধ্য দিয়ে, প্রাণঘাতী ঝুঁকি মাথায় করে। পরিবার-পরিজন ছেড়ে একাকী আগরতলায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন, সেখান থেকে গেছেন কলকাতায়। কলকাতায় তিনি কাজ করেছেন প্রবাসী প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে। ঝঢ়ৎরহম ১৯৭১ নামে তিনি ইংরেজি একটি বই লিখেছেন, তার বহু রকমের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে। একটি অভিজ্ঞতার বিবরণ বাংলায় অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায় : “খ্যাতনামা ও সংগ্রামী এক ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, একটি বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করল। মেয়েটি তার পিতামাতার সঙ্গে কলকাতায় এসেছিল। ভিআইপিদের জন্য একটি সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। জিনিসটা অনেকের কাছেই বেখাপ্পা ঠেকেছে কারণ ছাত্ররা যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে এবং প্রাণ দিচ্ছে তখন দেখা গেল তাদেরই একজন ঠিক সেই সময়টিকেই মনে করল বিবাহের জন্য উৎকৃষ্ট সময়।’ এর সঙ্গে তিনি আরেকটি মন্তব্যও করেছেন : “আমাদের অনেকেই তখন গৃহহীন সমাজের মানুষদের মতো আচরণ করছিল, কখনো কখনো তারা ভুলেও গেছে অন্য বাঙালিদের প্রতি তাদের দায়িত্বটা, যেন তারা অপেক্ষা করছিল কবে ঘরে ফিরবে, আজই যদি না হয় তাহলে নিশ্চয়ই আগামীকাল।” (পৃ ২০৩) কলকাতায় বাংলাদেশ হাই কমিশনারের অফিস ছিল সার্কাস এভিনিউতে, বাংলাদেশ সরকারের দপ্তর থিয়েটার রোডে, পরিহাস করে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন কলকাতায় যোদ্ধাদের ঘোরাফেরা মোটামুটি সীমিত ছিল সার্কাস থেকে বের হয়ে থিয়েটারে এবং থিয়েটারের কাজ সেরে সার্কাসে যাওয়ার ভেতরেই। ফারুক আজীজ খান অবশ্যই তেমন কোনো মন্তব্য করেননি, তবে তাকেও প্রথমে সার্কাস এভিনিউতে এবং সেখান থেকে থিয়েটার রোডে যেতে হয়েছিল। সার্কাস এভিনিউতে অভিজ্ঞতাটি ছিল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। হাইকমিশন অফিসের ভিড় ঠেলে, নানা প্রতিবন্ধক এড়িয়ে কোনো মতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন পুরনো এক বন্ধুর সামনে। বন্ধুটি তখন বাংলাদেশ সরকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি। ফারুক আজীজের অভিজ্ঞতাটা দাঁড়িয়েছিল, “বন্ধুটি তদ্সত্ত্বেও আমার সঙ্গে অদ্ভুত ব্যবহার করলেন। প্রথমে তিনি এমন ভান করলেন যে আমাকে তিনি চেনেনই না, তাছাড়া যদি চেনেনও তাহলেও তার সঙ্গে আমার কোনো কারবারই থাকতে পারে না, কারণ তিনি তখন বিগ বস। বুঝলাম তার কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়ার আশা নেই, তদ্সত্ত্বেও আমি জানতে চাইলাম আমি কোনোভাবে কোনো সাহায্যে আসতে পারি কি না। তিনি বললেন, ‘শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য বুলেটপ্রতি দশ পয়সা দিতে রাজি আছি।’ ” (পৃ ১৬৭) ফারুক আজীজ লিখছেন, সবই বুঝলাম এবং যুদ্ধ বলতে যা চলছিল সেটির অভিজ্ঞতা তার চেয়ে আমারও কিছু কম ছিল না। কিন্তু এটা কখনোই মনে হয়নি যে বুলেটপ্রতি দশ পয়সা পাবে এই আশাতে কেউ যুদ্ধ করছিল। মাঠের যোদ্ধা আর কলকাতার বস এক ছিল না।
এক কাতারে সবাই এসেছিল, কিন্তু আবার আসেও-নি। আসার উপায়ও সহজ ছিল না। ফারুক আজীজ যখন প্রাণভয়ে কাপ্তাইয়ে তার কর্মস্থল থেকে বন-জঙ্গল-পাহাড় পেরিয়ে চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা থেকে ভারত সীমান্তের দিকে এগুচ্ছিলেন তখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে পড়ে নিজের বাঙালিত্ব প্রমাণের যে কঠিন পরীক্ষার তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন সেটি বাকি জীবনে ভুলতে পারেননি। তার ঠোঁটে গোঁফ ছিল, সেটি ছিল কিছুটা তামাটে রঙের, বুদ্ধি করে সেটি কামিয়ে ফেলেছিলেন, নইলে অবাঙালিত্বের ওই ইশারার কারণেই তাকে প্রাণ দিতে হতো। উচ্চশিক্ষার জন্য এবং চাকরিসূত্রে কানাডা ও আমেরিকায় বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছেন, তবুও বাংলা ভোলেননি, বরঞ্চ বাংলাভাষার চর্চা তিনি করতেন নানা উপায়ে। তার বাংলা ইপিআর সদস্যদের বাংলার চাইতে উন্নত মানেরই ছিল। ঘটনার বিশ বছর পরে লিখতে গিয়ে তিনি কী করে যে বাঙালিত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন সেটা ভাবলে গা কাঁপে বলে উল্লেখ করেছেন। তার মনে পড়েছে যে আওয়ামী লীগের প্রধান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যদি ১৯৭১ সালে জীবিত থাকতেন এবং বাঙালি যোদ্ধাদের হাতে পড়তেন তাহলে তার বিপদটা হতো আরও বড় রকমের, কারণ ফারুক আজীজের ভাষায়, “বাংলায় সোহরাওয়ার্দীর দক্ষতা উর্দুতে আমার দক্ষতার মতোই নিম্নমানের ছিল।”
ফারুক আজীজ লিখছেন, কলকাতায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবরা যে ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করেছেন ১৯৭১ সেটি মুসলমান বাঙালিদের মুসলমান পাঞ্জাবি খুনি ও ধর্ষকদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি; এবং কোরআন শরিফের সুরা ঘাতকদের ছুরি ও বন্দুকের সামনে মোটেই রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করেনি। এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান রাজুর কাছে তিনি শুনেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ভারতীয় সীমান্তের কাছে বিহারি বলে সন্দেহ করে বাঙালি যোদ্ধারা এক ব্যক্তিকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, স্থানীয় এমপি মমতাজ বেগম এসে না পড়লে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেই যেত। ব্যক্তিটি আর কেউ নন, কর্নেল এম এ জি ওসমানী, পরে যিনি মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হয়েছেন। ওসমানী তখনো তার নিজস্ব কাটাকাটা উচ্চারণে ইংরেজি ভাষায় বলছিলেন; Look Raju, what the fellwos were going to do to me..’ (পৃ. ১২৪) চেনাজানা ছিল না, দূরত্ব ছিল শ্রেণির। রণাঙ্গনে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সেনাপতির তাই প্রাণ হারাবার উপক্রম হয়েছিল বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতেই।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা নানা রঙে-ঢঙে দিনটিকে রাঙিয়ে তোলেন। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ভালোবাসা দিবসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ভালোবাসা মানুষকে উড়তে শেখায়, ভালোবাসা মানুষকে বাঁচতে শেখায়, ভালোবাসা মানুষকে অধিকারের কথা বলতে শেখায়, পড়তে শেখায়, জ্বলতে শেখায়, নিভতে শেখায়। পুঁজিবাদী বিশে^ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হলেও, বাংলাদেশে দিবসটির ইতিহাসের একটু ভিন্ন তাৎপর্য আছে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও তা পালনের আয়োজন-প্রচারের তোড়ে সেই রক্তঝরা দিনটির কথা সবাই ভুলতে বসেছে। এর দায় কার? ছাত্রসমাজের রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস রাষ্ট্র ও গণমাধ্যম থেকে কীভাবে মুছে গেল? আজকের দিনে সপ্তম শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীকেও যদি প্রশ্ন করা হয় যে ভালোবাসা দিবস কবে। সেই শিশুশিক্ষার্থী অকপটে তার সঠিক উত্তর বলে দিতে পারবে। কিন্তু যখন বলা হবে বলো তো স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস কবে? তখন সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। এমনকি কলেজপড়–য়া শিক্ষার্থীরাও বলতে পারেন না। ভালোবাসা দিবস পালনে সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে এই দিবস পালনের ডামাডোলের মধ্যে সংগ্রামের ইতিহাসকে চাপা দিয়ে রাখা। এই রাজনীতির পাশাপাশি পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর বাণিজ্যিক কৌশলের প্রধান হাতিয়ার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। তাই সচেতন হতে হবে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব শরীফ কমিশনের ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষার অধিকার আদায়ের জন্য ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পুলিশের গুলিতে জীবন উৎসর্গ করেছিল মোস্তফা ওয়াজিল্লাহ, বাবুল প্রমুখ ছাত্র নেতারা। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি অনুসরণ করে হাঁটতে চেয়েছে স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতি। প্রশ্ন আসে, যে পাকিস্তানের শিক্ষানীতি রক্ত দিয়ে বাতিল করছে ছাত্ররা, সেই শিক্ষানীতি কি বাংলাদেশে চালু করা উচিত? তৎকালীন সামরিক শাসকের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব করেন। সেখানে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হয় মেধা অথবা ৫০ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা। ফলে সেই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১৭ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো। তারপর শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন, কালক্রমে যেটি গণ-আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। ছাত্রসমাজের দাবি ছিল একটি অবৈতনিক বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি। কিন্তু ড. মজিদ খান যে নীতি ঘোষণা করেন, সেখানে বাণিজ্যিকীকরণ আর ধর্মীয় প্রতিফলন ঘটেছে বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। তাই শুরু থেকেই ওই নীতির বিরোধিতা করতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে স্মারকলিপি দিতে শিক্ষার্থীরা মিছিল করে সচিবালয়ের দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ টিয়ার গ্যাস, জলকামান, অবশেষে নির্বিচারে গুলি চালায়। ফলে লুটিয়ে পড়েন শহীদ দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ূব, কাঞ্চনসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে বাধ্য হয়েছিল বাতিল করতে কুখ্যাত মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতি। সে কারণেই ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বৈরাচার ছাত্র প্রতিরোধ দিবস শুধু বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাড়া কোনো ছাত্র সংগঠন বা রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দিবস পালন করা হয় না।
তাই ভালোবাসার ফুল যাদের চরণে দিই যারা শিক্ষার রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে রাজপথে জীবন দিল। ভালোবাসার প্রাণ ওই শহীদরা। সেই ভালোবাসার কল্যাণেই এই মাটির ইতিহাস কখনোই ভোলার নয়। স্বাধীন জাতি হিসেবে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন এবং মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একই ধারায় বিজ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতির লক্ষ্য কতটা অর্জিত হলো, শিক্ষাব্যবস্থায় কী দুর্বলতা ও অসংগতি রয়ে গেছে, তা রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণ করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তা না হলে শহীদের রক্তের ঋণ অশ্রদ্ধা করা হবে। ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে রাজপথে থাকত শিক্ষার্থীরা, যার উজ্জ্বল উদাহরণ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কিন্তু যখন যেই সরকার ক্ষমতায় আসে সেই দলের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা যখন হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে পড়েন, তখনই সবাই ছাত্ররাজনীতির নামে ভয় পায়। আর কেউ কেউ ছাত্ররাজনীতি বন্ধের শোরগোল তোলেন। কিন্তু যুবলীগ নেতারা যে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত, কেউ কি একবারও যুবরাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন? আবার ধরেন পুলিশ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের দুর্নীতির খবর পাই তখন কি কোনো পেশা বন্ধের দাবি উঠেছে? উত্তর হচ্ছে বন্ধের কোনো দাবি ওঠেনি। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হবে কেন? যাদের সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠন তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। ছাত্ররাজনীতিকে বলা হয় নেতৃত্ব তৈরির বাতিঘর। সেই বাতিঘর তৈরির কাজ রাষ্ট্রকেই করতে হবে। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আড়ালে যেন পড়ে না থাকে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র প্রতিরোধ দিবস।
লেখক : প্রাবন্ধিক
ঝলমলে বইমেলা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আচমকা মনে হলো, সামনের তরুণটিকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কখনো সুবিমল মিশ্র পড়েছো! কিংবা ওই যে ঝকঝকে মেয়েটি বয়ফ্রেন্ডের কাঁধে হাত দিয়ে চলেছে, তার কাছে জানতে চাইব, সুবিমল কেমন লাগে! অথবা একটা পলিটিক্যাল স্টলে বসে থাকা পৌঢ় ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়, সুবিমল মিশ্র আপনার পছন্দের লেখক কিনা!
কিন্তু অদ্ভুত এক ভয় পেয়ে বসেছে। যদি কেউ সুবিমল মিশ্র সম্পর্কে কিছুই না জানেন। সুবিমল তো তথাকথিত ভদ্দরলোকীয় বৃত্তে তেমন খাতিরের লেখক ছিলেন না। যে লেখকদের সামনে অটোগ্রাফ খাতা হাতে দুরন্ত সুন্দরীরা দাঁড়িয়ে থাকেন সুবিমল তো কখনোই তাদের দলের লোক নন।
সুবিমল মিশ্র নিজেকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক বলতেন না। বলতেন, লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। তিনি উপন্যাস, গল্প কিস্যু লেখেননি। যা লিখেছেন সব অ্যান্টি নভেল, অ্যান্টি স্টোরি। ওর সবচেয়ে পঠিত উপন্যাস ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’ প্রথম পড়তে গিয়ে চমকে গিয়েছিলাম। অত রগরগে উপন্যাস বাংলা ভাষায় আগে কখনো পড়িনি। আমরা যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির, তাদের কাছে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ওই ঢাউস উপন্যাসটি ছিল নিখাদ পর্নোগ্রাফি। এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করেছিলেন সুবিমল, যা শোনাও তখন ছিল ‘গর্হিত অপরাধ’। আমাদের অনেকের কাছেই ছিল শুধু অপরাধ নয়, অশ্লীল লেখা পড়া মানেই প্রতিক্রিয়াশীল কাজ।
এই আমরা, আমাদের বলতে তখনকার দিনের বামপন্থি পরিবারের লোকজন। এখন বুঝি, আমাদের মধ্যে বিপুল ট্যাবু ছিল, যা এখন মনে হয় একধরনের মৌলবাদ। সুবিমল দূরের কথা, তখন বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভোর বৃষ্টি’, সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’, ‘বিবর’ নিয়েও তখন তর্কবিতর্ক প্রবল। যখন স্তন, জঙ্ঘা, শীৎকার নিষিদ্ধ শব্দ, তখন সুবিমল খোলাখুলিভাবে লিখছেন মাসী বোনপোর শরীরী সম্পর্কের বিশদ বর্ণনা।
সুবিমলের অন্যান্য লেখাতেও উঠে এসেছে যৌন অনুষঙ্গ। আসলে সুবিমল মিশ্র সেক্স, ভায়োলেন্স ব্যবহার করতেন তথাকথিত ভদ্রলোকীয় মূল্যবোধকে ধাক্কা দিতে। আজকাল সাব অলটার্ন তত্ত্ব নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। সুবিমল মিশ্র এই কাজটি বহু বছর আগে করেছিলেন। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে।
সেক্সের নন্দনতত্ত্ব বা ধ্রুপদী দিক নিয়ে সুবিমল মিশ্রের সাহিত্য নিঃসন্দেহে গবেষণার বিষয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির চরম যুগে দাঁড়িয়ে, আধিপত্যবাদকে কোণঠাসা করতে কখনো কখনো সুবিমল মিশ্র ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে একই সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়। র্যাডিক্যালিজম অনেক সময় ভায়োলেন্স দাবি করে। আন্ডারগ্রাউন্ড লিটারেচারে আপাত অশ্লীল বহু শব্দ সময় সময় ডিনামাইটের মতো ফেটে পড়ে।
এখন মনে হয় সুবিমল নানা সময় যৌনতা, নিষিদ্ধ সম্পর্ক নিয়ে একধরনের ফ্যান্টাসি তৈরি করতেন। ফ্যান্টাসির মধ্য দিয়ে বলতে চাইতেন, কোনো কিছুই নিষিদ্ধ বা বে-আইনি নয়। সব সম্ভব। পুঁজিবাদ একই রকম ফ্যান্টাসি তৈরি করে। মৌলবাদ যেমন মানুষকে পারলৌকিক জগতের দিকে আকৃষ্ট করে কল্পিত এক জগতের স্বপ্ন দেখিয়ে। ওয়াজ মেহফিলে বা পুরোহিতের উচ্চারণে দুনিয়ার যাবতীয় সংকট থেকে মুখ ফিরিয়ে কল্পিত ভবিষ্যতের ছবি পাই, ঠিক তেমনই পুঁজি নির্মাণ করে রঙিন দুনিয়া। ঠা-া মতলব- অমুক পানীয়, তমুক ক্রিম কিনলে ফর্সা হওয়ার গ্যারান্টি...। মুশকিল হচ্ছে, একদল মেঠো কথার কারণে চিহ্নিত হন মৌলবাদী বলে। অপরপক্ষ চকচকে মোড়কে স্বপ্ন বেচেন, তাই তারা আধুনিক, প্রগতিশীল। এই নতুন সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী সাংস্কৃতিক হেজিমনিকে কাউন্টার করতে চেয়েছিলেন সুবিমল মিশ্র।
গত শতকের ষাট দশকে ঝোড়ো হাওয়ার গতিতে সুবিমলের আবির্ভাব, সময়কাল পৃথিবীর ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভারত উপমহাদেশে তো বটেই। সারা দুনিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বিভাজন ঘটে গেছে। লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে জন্ম নিচ্ছে নতুন শিল্প। ফ্রান্সের অভিজাত ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা পথে নেমেছেন বিপ্লবের পতাকা নিয়ে। জাঁ পল সার্ত্র, সিমন দ্যা বোভেয়ার মতো বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী রাস্তায় নেমেছেন নিষিদ্ধ ইশতাহার বিক্রি করতে। দেয়ালে দেয়ালে লেখা হচ্ছে তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম। চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে ডাক দিয়েছেন ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে তখন দাবানলের মতন আছড়ে পড়েছে নকশালবাড়ী। নতুন নতুন সিনেমা, নাটক, কবিতা, গল্প, উপন্যাস তখন জন্ম নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে।
তার মধ্যে সম্পূর্ণ অন্য ধারার লেখক হিসেবে আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হলেন সুবিমল মিশ্র।
১৯৬৭ সাল থেকে মোটামুটি নিয়মিত লিটল ম্যাগাজিনে আমরা সুবিমল মিশ্রকে পাচ্ছি। ১৯৬৯ সালে কবিপত্র পত্রিকায় লিখলেন দুর্দান্ত গল্প, ‘হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধী মূর্তি’। গল্পের স্পিরিট ছিল আগে মড়া সরাও, না হলে গান্ধী মূর্তির হদিস মিলবে না ।
সোজা কথায়, আগে দেশের মানুষের মুখে খাবার তুলে দিয়ে তারপর নেতারা এই করেঙ্গে, সেই করেঙ্গে, ভাষণ দিয়ো। যে সময়ে এ লেখা, তখন ধীরে ধীরে ভারত বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। নকশালবাড়ীর তাপে উত্তপ্ত হয়ে গেছে সারা দেশ। ভোজপুর, জেহানাবাদ, আরা, শ্রীকাকুলাম খবরের কাগজের শিরোনামে। বধ্যভূমিতে পরিণত হচ্ছে আমার দেশ। তখন সম্পূর্ণ অন্য ধারায় এদেশের গরিব, প্রান্তিক মানুষের কথা লিখছেন সুবিমল মিশ্র, সোজা-সাপটা ভাষায়। রাষ্ট্র, সমাজের অসাম্য, ভ-ামি নিয়ে কোনোরকম দ্বিচারিতা সহ্য করেননি সুবিমল। সাহিত্য ছিল তার প্রতিবাদ, হয়তো প্রতিরোধেরও অস্ত্র।
কত গল্প লিখেছেন সুবিমল। কোনটি ছেড়ে কোনটির কথা বলব! তার প্রায় সব লেখাতেই রাজনৈতিক, সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতি দ্বিধাহীন বিশ্লেষণ ও মধ্যবিত্ত সমাজের যৌনতা নিয়ে অচ্ছুৎপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ লক্ষ করা যায়।
রাষ্ট্রব্যবস্থা, তার শোষণ, সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রতি ব্যঙ্গ, অবক্ষয়, দ্বন্দ্ব, লেখার কোলাজ এবং বিশেষভাবে নৈরাজ্য ইত্যাদি সুবিমলের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তেজস্ক্রিয় আবর্জনা’, ‘আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো’, ‘হাড়মটমটি’, ‘ক্যালাকাটা ডেটলাইন’, ‘চেটে চুষে চিবিয়ে গিলে’ ইত্যাদি।
সময়ের অনেক আগে জন্মেছিলেন সুবিমল। লেখায় তিনি যে প্ল্যানড ভায়োলেন্স চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন তা অধিকাংশই আমরা বুঝতে পারিনি বা চাইনিও। প্রচলিত সমস্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ জারি করেছিলেন সুবিমল। চিরটাকাল স্থিতাবস্থা ও ক্ষমতা কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ করে গেছেন আমাদের বাংলা সাহিত্যের ‘কালাপাহাড়’ সুবিমল মিশ্র।
সাজানো গোছানো ভদ্দরলোকদের মধ্যেও যে কত আদিম হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, বিকৃত যৌনচিন্তা লুকিয়ে থাকে তা টেনেহিঁচড়ে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছিলেন সুবিমল। তার আগে এই কাজটি করেছিলেন জগদীশ গুপ্ত।
সুবিমল মনে করতেন পাঠকের পড়ার সনাতনী অভ্যেসকেও বদলে দিতে হবে। তাই তিনি কখনো পাঠককে নিশ্চিন্তে তার লেখা পড়তে দেননি। এক এক লেখায় সুবিমল যে বীভৎস পৃথিবীর ছবি এঁকেছেন তা আজ আরও অনেক বেশি সত্য, ভয়ংকর।
সারা জীবন স্রোতের বিপরীতে হাঁটা আজ কঠিনতম কাজ। সেই কাজটি করতে অসম্ভব বুকের পাটা লাগে। সুবিমল মিশ্রের সেটা ছিল। কত তথাকথিত বিপ্লবী বাঘকে কাগুজে হতে দেখলাম চোখের সামনে। সুবিমল মিশ্র ঘোষিত বিপ্লবী না হয়েও কখনো কোনোদিনই প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেননি। সুবিমল মিশ্র, অমিয়ভূষণ মজুমদার, কমলকুমার মজুমদার, ধারা আলাদা হলেও পপুলিস্ট লেখক কেউই নন। আজ চারপাশের বিক্রি হয়ে যাওয়া লেখকদের ভিড়ে, ভয় হয় বাংলা সাহিত্যে ওদের মনে রাখবে কীভাবে তা ভেবে।
বইমেলায় হাঁটছি। আগের দিন সুবিমল মিশ্র চলে গেছেন। আজ বৃহস্পতিবার। কোথাও কোনো চাঞ্চল্য নেই লেখকের মৃত্যুতে। বিপুল ভিড়। বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে এক বা কতিপয় তরুণ লেখককে ঘিরে তুমুল উন্মাদনা। একা যেতে যেতে মনে হলো, ভিড়ের মধ্যে একটা মাথা আচমকাই সব মাথা ছাড়িয়ে বিশাল হয়ে উঠছেন। মুখের দিকে না তাকিয়েও নিশ্চিন্তে বলে দিতে পারি, তিনি, তিনিই সুবিমল মিশ্র।
যিনি সারা জীবন মেরুদণ্ড সোজা রেখে পথ হেঁটেছেন। আমরা, বামপন্থি ঘরানার লোকজন কোনোকালেই তাকে গুরুত্ব দিইনি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাকে সহযোদ্ধা ভাবিনি। আজ অন্তত একবার যেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী সবাই, মৃত্যুর পরে হলেও সুবিমল মিশ্রকে কুর্নিশ জানাই। আমাদের সময়ের এই আপসহীন যোদ্ধার জন্য থাকুক লাল গোলাপ ও জনগণের গান স্যালুট।
লেখক: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক
মিসর, চীন, বেবিলন, পারস্য, মেসোপটেমিয়া, মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সভ্যতা পৃথিবীতে গড়ে উঠলেও শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষের দিক দিয়ে গ্রিকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। মানব সভ্যতার উন্নতি ও শিক্ষা পাশাপাশি চললেও প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্র স্পার্টা বা এথেন্সে সর্বপ্রথম ‘শিক্ষার মৌলিক নীতি’ পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং শিক্ষার ঐতিহ্য নির্ণয় করার ভিত্তি হিসেবে গ্রিক সভ্যতাকে গণ্য করা শ্রেয়।
আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হয়েছে গ্রিসে। এ জন্য গ্রিসকে বলা হয় আধুনিক শিক্ষার জন্মভূমি। শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানেি গ্রিকরা ছিল সবার আদর্শ। গ্রিকদের এসব উন্নতির পশ্চাতে রয়েছে, উন্নত মানের শিক্ষাব্যবস্থা। দেখা যাচ্ছে, যে দেশে শিক্ষার যত প্রসার ঘটেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারাই উন্নত। সেই সভ্যতার হাজার বছর পার হয়েছে। আমরা আছি, ২০২৩ সালে। এখনো, এই মুহূর্তে একটি সঠিক পাঠ্যক্রম তৈরি করতে পারছি না। বছর শুরুতেই বিষয়-বৈচিত্র্য নিয়ে ঝকমকা বই, শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছি। সেখানেও, কিম্ভূতকিমাকার চিন্তাহীন সামঞ্জস্যহীন তথ্য। দুটি বই প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হাজার মানুষের সমালোচনা এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপকেই সঠিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন! কিন্তু, এই দায় মূলত কোন কোন জ্ঞানীজনের?
গতকাল দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘কাঁচা হাতে বড় কাজ’ শিরোনামের সংবাদে, বিষয়টি বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে তাড়াহুড়ো করে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করতে গিয়ে বড় বিপদে পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে দুটি বই প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। আরও তিনটি বইয়ে, বড় ধরনের সংশোধন আসছে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে আরও জানা যায়, এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জান বলেছেন, যে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে, তা এ বছর আর দেওয়া হবে না। কারণ ঐ বই দুটির দুটি অংশ ছিল। এখন যে অংশটি রয়েছে, তা দিয়েই বিষয়টি কাভার হবে। শিক্ষার্থীদের শিখনে কোনো সমস্যা হবে না বলেই, বই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের অনুশীলন বইয়ে আমরা নানা বিশ্বের নানা সভ্যতার ইতিহাস তুলে ধরেছি। এসব ইতিহাসকে প্রদর্শন করতে গিয়ে ‘অনুসন্ধানী পাঠে’ মিসরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতাগুলো এসেছে, প্রাচীন দেব-দেবী নিয়ে কথা এসেছে, তাদের সংস্কৃতির নানা ছবি ব্যবহার হয়েছে। যদি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাচ্চাদের জন্য প্রাচীন সভ্যতার বিষয়টি কঠিন হয়ে যায়, তাহলে তা আমরা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে ওপরের শ্রেণিতে নিয়ে যাব।’
চমৎকার কথা বলেছেন। কিন্তু একটা খটকা থাকে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য কোন বিষয়টি বোধগম্য আর কোনটি নয় সেটা কি পাঠ্যপুস্তক তৈরিতে যুক্ত বিজ্ঞজন, জ্ঞাত নন! তারা জানেন না, কোন বিষয়টি কোন বয়সীদের জন্য? প্রকাশিত সংবাদে আরও জানা যায় ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত পাঠ্যপুস্তকের অসংগতি, ভুল বা ত্রুটি চিহ্নিত করে তা সংশোধনে প্রয়োজনীয় সুপারিশের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক আব্দুল হালিমকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির মতামতের আগেই দুটি বই প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। এছাড়া ভুল-ত্রুটির জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তারকে আহ্বায়ক করে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের ভুলের দায় স্বীকার করেছেন, ওই বইটির সম্পাদক অধ্যাপক মো. জাফর ইকবাল ও হাসিনা খান।
প্রশ্ন হচ্ছে তাই-ই যদি হবে, তাহলে এত জল ঘোলা করা কেন? আরও আগেই তা করা যেত। দায় স্বীকার করে, বিবৃতি দিলেই হতো সমস্যার সমাধান। এত হৈ-হল্লা, হতো না। তবে ভবিষ্যতে এমনটি যেন না হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সেদিকে কঠোর নজরদারি দরকার। মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থীর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আগামীর নতুন দিগন্ত, ওদেরই হাতে।
বাংলাদেশ নারী জাতীয় ফুটবল দলের রক্ষণভাগের অন্যতম সেরা আঁখি খাতুন। সেই ছোট থেকেই গড়ন, উচ্চতা ও লড়াকু ফুটবল দিয়ে আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন। মেয়েদের ফুটবলে বাংলাদেশের প্রায় সব সাফল্যেই ছিলেন অগ্রনায়ক হয়ে। সম্প্রতি তিনিও জাতীয় দলের ক্যাম্প ছেড়েছেন। তবে সতীর্থ সিরাত জাহান স্বপ্নার মতো অবসরের সিদ্ধান্ত নেননি। বরং নিজেকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাফুফের বন্দী জীবনকে বিদায় জানিয়েছেন।
সম্প্রতি চীনের বন্দরনগরী হাইকোউ শহরের একটি ফুটবল অ্যাকাডেমিতে খেলার পাশাপাশি পড়ালেখার প্রস্তাব পেয়েছেন আঁখি। এখন চলছে চীনের ভিসা নেওয়ার প্রক্রিয়া। সবকিছু ঠিক থাকলে আসছে ঈদের পর দেশ ছাড়বেন তিনি। বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন আঁখি।
তিনি যে আর দশজন ফুটবলারের মতো নন, তা আগেই বুঝিয়েছেন আঁখি। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়ের পর বিশ্ব ফুটবলের নজর কাড়েন দীর্ঘদেহী এই ডিফেন্ডার। তার নির্ভীক ফুটবল বড্ড মনে ধরে সুইডেনের শীর্ষ লিগের একটি ক্লাবের। সাফে বাংলাদেশ মাত্র একটি গোল হজম করেছিল।
এই কৃতিত্বের বড় দাবীদার সেন্টারব্যাক আঁখি। তাই সুইডিশ ক্লাবটি তাকে দলে নেওয়ার প্রস্তাবও দেয়। প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে ইউরোপের কোন দেশের শীর্ষ লিগে খেলার প্রস্তাবে আঁখি দেখতে শুরু করেছিলেন বড় মঞ্চে নিজেকে প্রমাণের স্বপ্ন। তবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের হঠকারি সিদ্ধান্তে সুইডেনে খেলতে যাওয়া হয়নি। জাতীয় দলের খেলা থাকবে বলে সুইডেনের দরজা বন্ধ করে দেয় বাফুফে। পরে অবশ্য অর্থ সঙ্কটসহ নানা অযুহাতে জাতীয় দলকে সিঙ্গাপুরে ফিফা ফ্রেন্ডলি ও মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাইপর্ব খেলতে পাঠানো হয়নি।
বিষয়টা ভীষণ কষ্ট দিয়েছিল সদ্য এইচএসসি পাস করা আঁখিকে। অভিমানে কিছুদিন ক্যাম্প ছেড়েও চলে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ক্যাম্পে যোগ দেন। তবে হতাশা একটুও কমেনি। দিনের পর দিন লক্ষ্যহীণ পথ চলতে কারই বা ভালো লাগে? দেশের ফুটবলের যে ভবিষ্যত নেই ঢের বুঝতে পেরেছিলেন। তাই চীনের প্রস্তাবটাকে লুফে নেন আঁখি।
দেশ রূপান্তরের কাছে ক্যাম্প ছাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, 'আমি ওখান থেকে চলে এসেছি ঠিক, তবে ফুটবলেই থাকবো। চীনে ভাল অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন ও লিগ খেলার সুযোগ পাচ্ছি। তাই ওইখানে যাবো। এখন ভিসা নিয়ে কাজ করছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।'
গত ফেব্রুয়ারিতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৪.৫০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন সিরাজগঞ্জের গর্ব আঁখি। দেশে সুযোগ ছিল বেসরকারী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। তবে তিনি যে স্বপ্ন বুনেছেন চীনে লেখাপড়া করার, ‘মূলত আমি ওখানে পড়াশোনা ও খেলা এক সঙ্গে করবো। এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। তবে ভর্তি হইনি।’
তার এই সিদ্ধান্ত বাফুফেকে জানিয়েই নেওয়া। তবে জাতীয় দলের প্রয়োজনে যেখানেই থাকেন না কেন, চলে আসবেন, 'আমি পল স্যারকে (বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলি) জানিয়েই ক্যাম্প ছেড়েছি। তাকে এটাও বলেছি আমি যেখানেই থাকি, জাতীয় দলের প্রয়োজন হলে চলে আসবো।'
সম্প্রতি মেয়েদের ক্যাম্পে লেগেছে দ্রোহের আগুন। তিনদিন আগে অভিমানে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের অন্যতম স্ট্রাইকার স্বপ্না। একই দিনে মেয়েদের ফুটবলের সকল সাফল্যের রূপকার অভিজ্ঞ কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। মূলত বাফুফের গঞ্জনার শিকার হয়েই ছোটনের এই সিদ্ধান্ত। তাতেই হুলস্থুল লেগে গেছে ফুটবল অঙ্গনে। সালাউদ্দিন-কিরণের হাতে বন্দী নারী ফুটবল নিয়ে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। প্রিয় কোচ ছোটনের জন্য ভীষণ মন খারাপ আঁখির, 'সত্যি খুব খারাপ লাগছে স্যারের সরে যাওয়ার কথা শুনে।'
তাকে সুইডেনে খেলতে যেতে দেওয়া হয়নি। স্বপ্নাকেও ভারতের লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। আঁখি অবশ্য এই অপ্রিয় বিষয়গুলো এড়িয়েই যেতে চাইলেন। শুধু বলেছেন, 'স্বপ্না আপুর ভারতে খেলার সুযোগ ছিল। তার সঙ্গে কী হয়েছে, সেটা সবার জানা। আমার সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছে।'
শেষটায় আঁখি যা বলেছেন, তা দিয়েই নারী ফুটবলের ভেতরের চিত্রটা ফুটে উঠেছে। তারা দেশকে অসংখ্য সাফল্য এনে দিয়েছেন। গোটা দেশের কাছে তারা একেকজন খেলার মাঠের বীর সেনানী। তবে তাতে তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বাফুফের চতুর্থ তলায় গাদাগাদি করে থাকতে হয়। মাস শেষে জুটে নামকোয়াস্তে পারিশ্রমিক। সেটা বাড়ানোর দাবী করলেই নাম কাটা যায় গুডবুক থেকে। আঁখির কথায়, 'ভাইয়া, আমরা তো মেয়ে। আর কত কষ্ট করবো যদি ঠিকভাবে পারিশ্রমিকই না পাই?'
দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দল হওয়ার পরও আঁখিদের আকাশ ঢেকে আছে নিকশ কালো অন্ধকারে। এর দায় কী এড়াতে পারবেন, বছরের পর বছর মসনদ আঁকড়ে রাখা ফুটবল কর্তারা?
হার দিয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শেষ করলো চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটি। অন্যদিকে ৫-০ গোলের দাপুটে জয়ে শেষ করেছে দ্বিতীয় স্থানের আর্সেনাল। জিতেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। আর ৪-৪ গোলে ড্র করেছে লিভারপুল। সাউদাম্পটনের অবনমন আগেই নিশ্চিত হয়েছিল। রবিবার তাদের সঙ্গে নেমে গেছে লিস্টার ও লিডস। লিডস ১-৪ গোলে হেরে গেছে টটেনহ্যাম হটস্পারের কাছে। আর ২-১ গোলে ওয়েস্টহ্যামকে হারিয়েও লাভ হয়নি লিস্টারের। বেন্টফোর্ডের মাঠে হালান্ড-গুনদোয়ানসহ প্রথমসারির কয়েকজনকে খেলানইনি পেপ গার্দিওলা। সামনে ছিলেন আলভারেজ, মাহরেজ, তাদের পেছেন ফোডেন। ৮৫ মিনিট পর্যন্ত অরক্ষিত রেখেছিল সিটি তাদের গোল। ঠিক ওই সময়ে ব্রেন্টফোর্ডের ইথান পিনোক। পঞ্চম হার দিয়ে লিগ শেষ করে সিটি।
নগর প্রতিদ্বন্দ্বি ম্যানইউ ঘরের মাঠে জেডন সানচো ও ব্রুনো ফার্নান্দেজের দ্বিতীয়ার্ধের দুগোলে ফুলহ্যামকে হারিয়ে তৃতীয় হয়েছে। চেলসির সঙ্গে নিউক্যাসলে ১-১ গোলে ড্র করায় চতুর্থ স্থান নিয়ে শেষ করলো সৌদি যুবরাজের মালিকানধীন নিউক্যাসল। সাউদাম্পটনের সঙ্গে ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েও একপর্যায়ে ৪-২ গোলে পিছিয়ে পড়ে হারের শঙ্কায় পড়েছিল লিভারপুল। ৭২ ও ৭৩ মিনিটে কোডি গাকপো ও ডিয়েগো জোতার গোল ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে ইয়ুর্গেন ক্লপের শিষ্যরা। ৬৭ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম হয়েছে লিভারপুল। ব্রাইটন হয়েছে ষষ্ঠ। ঘরে মাঠে জাকার দুই ও সাকার এক গোলে উলভসের বিপক্ষে প্রথমার্ধেই ৩-০তে এগিয়ে যায় গানার্সরা। দ্বিতীয়ার্ধে জেসুস ও কিইয়োর আরো দুই গোল করলে বড় জয়ের স্বস্তিতে মৌসুম শেষ করে একসময় শিরোপা লড়াইয়ে থাকা আর্সেনাল।
ত্রাসবুর্গের মাঠে তাদের বিপক্ষে ড্র করে ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ানের শিরোপা নিশ্চিত করেছে পিএসজি। তাই সময়টা এখন তাদের উৎসবের। সময়টা উপভোগ করতে ঘোড়দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন পিএসজি গোলরক্ষক সার্জিও রিকো। কিন্তু সেখানে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারাত্মক আহত হয়েছেন তিনি।
বর্তমান রিকোকে ইনটেনসিভ কেয়ারে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। পিএসজির এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘রিকোর অবস্থা আশঙ্কাজনক।’ পরে ক্লাব থেকে জানানো হয়, তার প্রিয়জনদের সঙ্গে ক্রমাগত যোগাযোগ করা হচ্ছে।
লিগ ওয়ান শিরোপা নিষ্পত্তি হওয়ার পর প্যারিসে ছুটি না কাটিয়ে নিজ দেশ স্পেনের সেভিয়ায় ফিরে যান রিকো। সেখানেই দুর্ঘটনার শিকার হোন তিনি।
স্পেনের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, ২৯ বছর বয়সী রিকো স্পেনের হুয়েলভা অঞ্চলের এল রোসিওতে ঘোড়দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে দৌড়ে থাকা আরেকটি ঘোড়ার সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হোন তিনি। রিকোকে দুর্ঘটনাস্থল থেকে সেভিয়ার এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় হেলিকপ্টারে করে।
সেভিয়ার সাবেক এই গোলরক্ষক ২০২০ সালে পিএসজিতে যোগ দেন। তার আগে ২০১৮-১৯ মৌসুমে ধারে কাটান প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব ফুলহামে। পিএসজির হয়ে রিকো ২৯ ম্যাচ খেলেছেন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সেভিয়া থেকে চলে যান তিনি।
নতুন পে-স্কেল কিংবা মহার্ঘ ভাতা নয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট অনুযায়ী। তাদের বেতন প্রতি বছর যতটা বাড়ার কথা এবার তার চেয়ে বেশি বাড়বে। আর তা চলতি বছরের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ানো হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশের বাইরে বাড়ানো হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত প্রায় এক বছর ধরে দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বেশিরভাগের একমাত্র আয় বেতন-ভাতা। বৈশি^ক মন্দার কারণে সরকারও খানিকটা সংকটে আছে। এ পরিস্থিতিতে পে-স্কেল দেওয়ার মতো বড় ধরনের ব্যয় বাড়ানো সরকারের পক্ষে কঠিন হবে। ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলে সরকারের ওপর চাপ বেশি হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সরকারি কর্মরতদের খানিকটা স্বস্তি দিতে কোন খাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এমন প্রস্তাব চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বাজেটবিষয়ক বিভিন্ন বৈঠকে সরকারি নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে আলোচনা করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই করে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করে। চলতি মাসে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী ওই বৈঠকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে কত বাড়তি ব্যয় হবে তা হিসাব করে পরের বৈঠকে উপস্থাপন করতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বড় ধরনের ব্যয় না বাড়িয়ে একটা উপায় বের করতেও বলেন। শেষ পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে নিজেই জানিয়েছেন।
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ২০১৫ সালের বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ বেতন কমিশন প্রণীত হয়েছিল। এ কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, আর নতুন বেতন কমিশন গঠন করা হবে না। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট বা বেতন বাড়ানো হবে। এ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তা হয়ে আসছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাব অনুযায়ী, দেশে সরকারি কর্মচারী ১৪ লাখ। বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে হিসাব করলে প্রায় ২২ লাখ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নিয়মিত ইনক্রিমেন্টের বাইরে আরও কতটা বাড়ানো যায় তা হিসাব করে নির্ধারণ করা হবে। এ কাজ করতে বাজেট প্রস্তাব পেশ করার পর আলাদা কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে যাচাই-বাছাই শেষে ইনক্রিমেন্টের হার সুপারিশ করবে। এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে বিদ্যমান ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে প্রতি মাসে বেতন বাড়ানো হবে, নাকি গড় মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে ইনক্রিমেন্টের হার বাড়ানো হবে, তা খতিয়ে দেখা হবে। ২০তম গ্রেড থেকে প্রথম গ্রেড পর্যন্ত সবার জন্য একই হারে বেতন বাড়নো হবে কি না, তা আরও খতিয়ে দেখা হবে। চূড়ান্ত হিসাব অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে প্রকাশ করা হবে। যে তারিখেই প্রকাশ করা হোক না কেন, আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকরী ধরা হবে।
এখানে মহার্ঘ ভাতা ১০ শতাংশ দেওয়া হলে এ হিসাবে ৪ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে ৬ হাজার কোটি এবং ২০ শতাংশ দেওয়া হলে ৮ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। অর্থাৎ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যয় বাড়বে। আর এতে সরকার ব্যয় কমিয়েও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টিতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো পথে হেঁটেছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতা বাবদ রাখা হয়েছে ছিল ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। খরচ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা বাজেট হওয়ার কথা আছে। এ বাজেট সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ ৭৭ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক পদ এখনো খালি আছে। এতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো হলেও সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের চাপ বাড়বে না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নির্মিত হয়েছে বিশেষ কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘ও ভোরের পাখি’। ঈমাম হোসাইনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করেছেন তামান্ন তিথি। অনুষ্ঠানটিতে আবৃত্তি করেছেন আশরাফুল আলম, মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, পলি পারভিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, আসলাম শিশির, সংগীতা চৌধুরী, আহসান উল্লাহ তমাল। প্রচারিত হয় ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টায়।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমারে দেবো না ভুলিতে’। অনুষ্ঠানটিতে গান, কবিতা ও আলোচনার সমন্বয়ে কবিকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ইয়াসমিন মুসতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, শেলু বড়ুয়া, ছন্দা চক্রবর্ত্তী ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন প্রফেসর মুন্সী আবু সাইফ। মনিরুল হাসানের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে ২৫ মে দুপুর ১ টা ০৫ মিনিটে। আরও প্রচারিত হবে সংগীতানুষ্ঠান ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘সন্ধ্যামালতী’। রাত ৯টায় প্রচারিত হবে নাটক ‘বনের পাপিয়া’ (পুনপ্রচার)।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোট শেষ হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫০টি কেন্দ্রের প্রাথমিক ফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকে আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩৭৯ ভোট এবং টেবিলঘড়ি প্রতীকে জায়েদা খাতুন পেয়েছেন ২ লাখ ৫ হাজার ৪১৩ ভোট।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
গাজীপুর সিটিতে মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের মধ্যে। দুজনই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। অপরদিকে ভোটের পরিবেশ ভালো বলে জানান আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহনূর ইসলাম রনি।
কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার পরও বিসিএস পরীক্ষায় নারীদের চাকরি পাওয়ার হার প্রায় একই রয়েছে। ১০ শতাংশ কোটা থাকা অবস্থায় তারা যে পরিমাণ চাকরি পাচ্ছিলেন, কোটা তুলে দেওয়ার পরও প্রায় একই হারে চাকরি পাচ্ছেন। সাধারণ ক্যাডার বা কারিগরি ক্যাডারে পিছিয়ে পড়লেও শিক্ষার মতো পেশাগত ক্যাডারগুলোতে এগিয়ে গিয়ে বিসিএসে মোট চাকরি পাওয়ার হারে প্রায় একই অবস্থান ধরে রেখেছেন নারীরা।
অথচ কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় বলা হয়েছিল, কোটা তুলে দিলে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণের গ্রাফ নিম্নমুখী হবে। আসলে তা হয়নি। কোটা তুলে দেওয়ার পরও তারা প্রায় সমানতালে এগিয়ে চলছেন।
৪০তম বিসিএস দিয়ে চাকরিতে ঢুকে বর্তমানে ঢাকা বিভাগে কর্মরত একজন নারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে বয়সে ছেলেরা চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা করে সেই বয়সে অধিকাংশ নারীকেই বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করতে হয়। সংসার করে, সন্তান লালনপালন করে নারীরা ভালো প্রস্তুতি নিতে পারে না। ফলে অনেক মেধাবী নারী প্রতিযোগিতায় উতরে যেতে পারেন না। অনেক নারী পারিবারিক কারণে বিয়ের পর চাকরির আবেদনই করেন না। বিয়ের পর পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধা আসে। এসব কাটিয়ে উঠে চাকরিতে প্রবেশ করা কঠিন। আর বিসিএসের চাকরি মানেই বদলিযোগ্য। সংসার-সন্তান রেখে বদলিকৃত পদে যোগ দেওয়া কঠিন বিষয়। সবকিছু মিলিয়ে নারীদের জন্য এ চাকরি সহজ নয়। একজন পুরুষ বেকার নারী বিয়ে করে, কিন্তু একজন নারী বেকার পুরুষ বিয়ে করে না। এ বিষয়টাও ছেলেদের প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। এ বাস্তবতা থেকেও পুরুষ প্রতিযোগী বেশি হয়। অন্যদিকে যোগ্য হলেও অনেক নারী প্রতিযোগিতাই করে না।
একজন নারী ইউএনও বলেন, পরীক্ষার হলে বা মৌখিক পরীক্ষার সময় অনেক নারীকে দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে সঙ্গে আনতে হয়। এগুলোও অনেক সময় নারীকে চাকরির ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে। ঘরে ঘরে বাধা পায় নারীর অগ্রযাত্রার নানা চেষ্টা। নগর-জীবনে নারীর অস্তিত্ব অনেকটা স্বচ্ছন্দের। কিন্তু নগরসভ্যতার বাইরে বিশাল বিস্তৃত গ্রামীণ জনজীবনে পুরুষতন্ত্রের নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত বেষ্টনী এখনো নারীকে ধরাশায়ী করে রাখে। হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথ হাঁটছে নারী-পুরুষ। তবু তাদের মধ্যে ভারসাম্য নেই।
কোটা না থাকার পরও নারীরা তাদের অবস্থান কীভাবে ধরে রাখলেন জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নারী শিক্ষায় বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। প্রাথমিকের পর মাধ্যমিকেও মেয়েরা অনেক এগিয়েছে। উচ্চশিক্ষায়ও মেয়েদের অংশগ্রহণের হার বেড়েছে। সবকিছু মিলে বিসিএসে এর প্রতিফল ঘটেছে। যে পরিমাণ মেয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, সেই তুলনায় চাকরিতে প্রবেশের হার বেশি। উচ্চশিক্ষায় যায় হয়তো ৮০ ভাগ ছেলে। আর মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার হার ৩০ বা ৩৫ শতাংশ। তাদের মধ্যে ২৬ বা ২৭ শতাংশ মেয়ে বিসিএস দিয়ে চাকরি পাচ্ছে। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে মেয়েরা অনেক ভালো করছে।’
এক প্রশ্নের জবাব ড. ইমতিয়াজ বলেন, ‘মেয়েদের কাছে শিক্ষা এখনো অপরচুনিটি (সুযোগ) আর ছেলেদের কাছে অধিকার। মেয়েরা যখন এ সুযোগটা পায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কাজে লাগাতে চায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিবারের ছেলেসন্তানের জন্য যে বিনিয়োগ, মেয়েসন্তানের জন্য এখনো তার চেয়ে অনেক কম। এখনো মনে করা হয় মেয়ে তো অন্যের ঘরে চলে যাবে। অথচ মজার বিষয় হচ্ছে, পরিবারের দায়িত্ব উচ্চশিক্ষিত ছেলের তুলনায় উচ্চশিক্ষিত মেয়ে অনেক বেশি বহন করে। এসব প্রতিবন্ধকতা হাজার বছরে তৈরি হয়েছে। এগুলো দূর হতে আরও সময় লাগবে।’
অন্যান্য কোটার মতো প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা ছিল। নারীরা যোগ্যতা অনুযায়ী মেধা কোটায়ও নিয়োগ পেতেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে মেধাভিত্তিক জেলা কোটার পাশাপাশি ১৫ শতাংশ নারী কোটা রয়েছে এখনো। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক জেলা কোটার পাশাপাশি ৬০ শতাংশ নারী কোটা সংরক্ষিত রেখে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে নারীরা সরকারি চাকরিতে পুরুষ প্রার্থীর সঙ্গে মেধা কোটায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিয়োগ লাভের পাশাপাশি সংরক্ষিত কোটায়ও নিয়োগ লাভের সুবিধা পেয়ে থাকেন।
শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ছাত্রীর হার বাড়ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এক দশকের বেশি সময় ধরে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর হার বেশি। কলেজ পর্যায়ে ছাত্র ও ছাত্রীর হার প্রায় সমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর হার ৩৬ শতাংশের বেশি।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকার। ৪০তম সাধারণ বিসিএস হচ্ছে কোটামুক্ত প্রথম বিসিএস। ধাপে ধাপে বাছাই করে গত বছর ৩০ মার্চ এই বিসিএসের চূড়ান্ত সুপারিশ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। প্রায় ১৩ মাস পর গত মাসে সেই সুপারিশের বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে পিএসসি। সেখানে বলা হয়েছে, ৪০তম বিসিএসে মোট ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশ নারী চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পেয়েছেন। যা কোটাযুক্ত ৩৮তম বিসিএসে ২৬ দশমিক ৯১ ও ৩৭তমে ২৪ দশমিক ৬০ শতাংশ ছিল। গত ১ নভেম্বর এ বিসিএসের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।
পিএসসির একজন সাবেক চেয়ারম্যান বলেছেন, কোটামুক্ত একটি সাধারণ বিসিএসে ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশ নারী চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পেয়েছেন এটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নারীদের শক্ত সক্ষমতা প্রকাশ করে। কারণ এর আগে কোটাযুক্ত ৩৮তম বিসিএসের তুলনায় মাত্র দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। অর্থাৎ কোটা তুলে দেওয়ার পরও নারীরা ১ শতাংশও পিছিয়ে পড়েননি। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, প্রত্যেক বিসিএসে নারীদের আবেদনের হার অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের হার পুরুষের তুলনায় কম অর্থাৎ গড় হার কম। পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতেও নারী প্রার্থীদের পুরুষের তুলনায় অনেক কম চোখে পড়ে। এমনকি কোনো কোনো কক্ষে নারী প্রার্থী থাকেই না। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ধাপগুলো অতিক্রম করার ক্ষেত্রে নারীদের অনুত্তীর্ণ হওয়ার পরিমাণ বেশি থাকে। ৪০তম বিসিএসে যোগ্য আবেদনকারী নারী ছিলেন ৩৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তাদের মধ্যে ১৯ দশমিক ১৯ শতাংশ নারী প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন। অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র। যোগ্য আবেদনকারী পুরুষ ছিলেন ৬১ দশমিক ৬২ শতাংশ। প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ পুরুষের হার ৮০ দশমিক ৮১ শতাংশ।
৪০তম বিসিএসের সাধারণ ক্যাডারে ২১ দশমিক ০৮ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। এই হার ৩৮ ও ৩৭তম বিসিএসে ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ১৪ ও ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
৪০তম বিসিএসের কারিগরি ক্যাডারে ২৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। এই হার ৩৮ ও ৩৭তম বিসিএসে ছিল যথাক্রমে ২৯ দশমিক ৫৩ ও ২৫ দশমিক ২ শতাংশ।
সাধারণ এবং কারিগরি ক্যাডারে নারীরা পিছিয়ে পড়লেও শিক্ষার মতো পেশাগত ক্যাডারে এগিয়েছেন। ৪০তম বিসিএসে ২৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। যা ৩৮তমে ২৬ দশমিক ৩০ এবং ৩৭তমে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ ছিল।
পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে নেওয়া ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারেও নারীরা পিছিয়েছেন। জেলা কোটাও না থাকায় নাটোর, ভোলা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি থেকে প্রশাসন ক্যাডারে কেউ সুপারিশ পাননি।
গত বছর প্রকাশিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্যসংক্রান্ত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস’ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সিভিল প্রশাসনের ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে ২৬ শতাংশ নারী। সরকারি দপ্তরের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করেন সবচেয়ে কমসংখ্যক নারী। মন্ত্রণালয়ের মোট জনবলের ১৯, অধিদপ্তরের ৩১, বিভাগীয় কমিশনার ও ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ের ১২ এবং আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ১২ শতাংশ কর্মী নারী।