
শত শত বছর আগে আরবিভাষী মুসলিম ধর্মপ্রচারকরা ইন্দোনেশিয়ায় এসেছিলেন। সে কারণে আরবি ভাষার প্রভাব রয়েছে ইন্দোনেশিয়ানদের ধর্মীয় এবং সামাজিক আচারে। তবে মাতৃভাষা পরিত্যাগ না করার ফলে ধর্মীয় আরবি ভাষার তুলনায় মাতৃভাষা রয়েছে শক্ত অবস্থানে। মাতৃভাষা এবং আরবি ভাষার মিশ্রণে নামও রয়েছে তাদের, যেমন আল হাসাবি, শিহাব ইত্যাদি। অস্ট্রোনেশিয়ান, জ্যাভানিজ, সুন্দানিজ, বালিনিজ ভাষার পাশাপাশি আরবি, সংস্কৃত, চাইনিজ এবং পশ্চিমা বিভিন্ন ভাষাভিত্তিক নামও অনেকের রয়েছে। সাবেক স্বৈরশাসক সুহার্তোর শাসনামলে আইনি প্রক্রিয়ায় চাইনিজদের নিজ ভাষায় নামকরণ নিষিদ্ধ করে ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় ব্যক্তির নামকরণে বাধ্য করা হয়েছিল। সে কারণে চাইনিজরা নিজেদের মাতৃভাষার পরিবর্তে ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় তাদের নাম রাখতে বাধ্য হয়েছিল। যেমন চাইনিজ জনৈক ব্যবসায়ী তার নাম লিম সু লং পাল্টে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন সুদানো সেলিম। সুহার্তোর শাসন অবসানের পর ওই কালো আইনটি রদ করা হয়েছে। সে কারণে চাইনিজ ইন্দোনেশিয়ানরা নিজ ভাষায় নাম রাখার স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছেন।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ইন্দোনেশিয়ানরা পারিবারিক নামের ধারাবাহিকতায় নিজেদের নামকরণ করেন না। নগণ্য সংখ্যকের ক্ষেত্রেই পারিবারিক নামের পদবি দেখা যায়। পিতৃপরিচয়ের ভিত্তিতে অনেকের নাম রয়েছে, যেমন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সুকর্নর কন্যা সাবেক প্রেসিডেন্ট মেঘবতী সুকর্ণ পুত্রী, যার বঙ্গানুবাদ মেঘবতী সুকর্নর কন্যা। আবার এমনও দেখা যাবে যে, পিতার নাম আহমেদ সুধর্মা, পুত্রের নাম আলি পুত্রা সুধর্মা অর্থাৎ সুধর্মার ছেলে আলি। এটি আরবদের অনুসরণে নিশ্চয়। আরবরা বিন-বিনতে-এর পর পিতার নাম যুক্ত করে দেয় নামের শেষে। ইদানীং আমাদের দেশেও অমন অনুকরণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।
খ্রিস্টান অধ্যুষিত পূর্ব তিমুর দীর্ঘকাল ইন্দোনেশিয়ার অংশ ছিল। পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে পূর্ব তিমুরবাসীর রক্তক্ষয়ী সংঘাত ছিল নিয়মিত। অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপে পূর্ব তিমুরের দখলদারিত্ব ইন্দোনেশিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। পূর্ব তিমুর এখন স্বাধীন পৃথক রাষ্ট্র। পূর্ব তিমুরের ভাষা পর্তুগিজ এবং টিটাম। এই দুই ভাষার পাশাপাশি পূর্ব তিমুরবাসীদের ব্যক্তির নাম ল্যাটিন এবং আরবি ভাষায়ও রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ নাম বিশ্বে বিরল। বিশেষ করে দুই-তিন ভাষার শব্দের মিশ্রণে খুব কম দেশের মানুষের নামকরণ রয়েছে।
ধর্মীয় আনুগত্যের দায়বদ্ধতায় ব্যক্তির নামকরণের পাশাপাশি কিছুটা হলেও ভাষাভিত্তিক ব্যক্তির নামকরণের প্রবণতা দেখা দিয়েছিল আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের সময়কালে এবং স্বাধীনতার পরপর। তবে সে-প্রবণতা স্থায়ী হয়নি। সে-ধারাবাহিকতা অক্ষুণœও থাকেনি, যেমন থাকেনি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিচয় পর্যন্ত। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ বিধান পাল্টে ধর্মীয় মোড়ক এঁটে দেওয়া হয়েছে পরিকল্পিতভাবেই। ঘটনাটি সামরিক সরকারের আমলে ঘটেছিল বটে, তবে নির্বাচিত সরকার স্থায়ী করে দিয়েছে। আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক নামকরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যক্তির ভাষাভিত্তিক নামকরণের দৃষ্টান্ত ক্রমেই বিরল হয়ে পড়েছে।
আমাদের দেশে প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যক্তির নামের শেষে মিয়া ব্যবহৃত হয়। মিয়া শব্দের অভিধানিক অর্থ সম্ভ্রান্ত মুসলিম ভদ্রলোক। শব্দটির আরবি অর্থ একশত। মিয়া পদবি এক সময়ে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ছিল। কালের বিবর্তনে তা এখন সেকেলে এবং অত্যন্ত সাধারণ পদবিতে পরিণত হয়েছে। সাধারণের নামের শেষেই স্থান পেয়েছে। একে অপরকে সম্মানিতরূপে মিয়া সম্বোধন অতীতের রেওয়াজ ছিল, এখন করলে অপমান-আপত্তিজনক বলেই বিবেচিত হবে।
হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তির নামের পেছনে পদবি থাকে। হিন্দুদের ক্ষেত্রে জাত-বর্ণের ভিত্তিতে এবং খ্রিস্টান-মুসলিমদের ক্ষেত্রে বংশানুক্রমে। চৌধুরী, মজুমদার পদবি হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের নামের শেষে আমরা দেখি বটে, তবে পদবির অগ্রভাগের নাম দেখে সহজেই চিহ্নিত করা যায় ব্যক্তির সম্প্রদায়গত পরিচয়। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠদের নামের প্রথমাংশ মাতৃভাষায় অর্থাৎ বাংলায়। তবে নামের শেষাংশ অবশ্যম্ভাবীরূপে সম্প্রদায়গত এবং জাত-বর্ণ পরিচয়ে। সে কারণে তাদের নামকে শতভাগ মাতৃভাষাভিত্তিক এবং সম্প্রদায়-ঊর্ধ্বে বিবেচনা করা যায় না। হরিপদ, বিষ্ণুপদ, ইন্দ্রজিৎ, রামপ্রসাদ, ঈশ্বরচন্দ্র, কালীপ্রসন্ন, নারায়ণ, বিষ্ণু-প্রিয়া, দুর্গাদাস, লক্ষ্মীকান্ত, শিবশঙ্কর, মহাদেব, শিবানী, ইত্যাদি প্রচুর নাম সম্পূর্ণরূপে সম্প্রদায়গত। দেবতাদের নামানুসারে। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় ধর্মীয় বিবেচনাতেই ব্যক্তির নামকরণ করে থাকে। নাম দিয়ে সহজেই চেনা যায় কে হিন্দু, কে মুসলিম।
যিশুখ্রিস্টের শিষ্য সেন্ট টমাস জেরুজালেম থেকে মাদ্রাজে এসেছিলেন ৫২ খ্রিস্টাব্দে। বিশ বছর ধর্মপ্রচারের পর ৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ভারতের চেন্নাইর মাইলাপোরে তার সমাধি রয়েছে। সমাধিস্থলটি বিশাল ইনস্টিটিউটে পরিণত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ মানত করতে সেখানে যান। সেখানকার সার্বিক অবস্থার সঙ্গে আজমিরের খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির দরগাহর মিল রয়েছে। সেন্ট টমাসের আগমন, ধর্মপ্রচার এবং মৃত্যুসহ সব তথ্যাদি পুস্তকাকারে বিলি করা হয় এবং বিশাল একটি এপিটাফে সে সমস্ত তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে।
খ্রিস্টান সম্প্রদায়ে মোটাদাগে দুটি ভিন্ন মত-পথ স্পষ্ট। একটি ক্যাথলিক অপরটি প্রোটেস্ট্যান্ট। ধর্মান্তরিত ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা অতীত নাম-পদবি পাল্টে নতুন নাম-পদবি গ্রহণ করে থাকে। বাইবেল অনুসরণে এবং বিভিন্ন সাধু-সাধ্বী, যাজকের নামানুসারে নাম রেখে থাকে। অপর দিকে প্রোটেস্ট্যান্টরা ধর্মান্তরে নাম-পদবি পরিবর্তন না করে অতীত নাম ও পদবি ব্যবহার করে। ১৯৭১-এর মার্চ থেকে ৯ মাসব্যাপী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার সময়কালে খ্রিস্টান পরিচয়ে আত্মরক্ষার্থে প্রোটেস্ট্যান্টরা বাধ্য হয়ে নিজেদের নামের অগ্রভাগে বিভিন্ন খ্রিস্টধর্মের সাধু, সাধ্বী, যাজকদের নাম যুক্ত করেছিল। তবে তাদের অতীত পদবি তারা বংশানুক্রমে নিজেদের নামের শেষে যুক্ত রেখেছে। তাদের পদবিতে দাস, বিশ্বাস, চৌধুরী, গুপ্ত, সাহা, ব্যানার্জি এমনকি খান, খন্দকার, হোসেন পর্যন্ত রয়েছে।
ধর্মীয় উৎসব পার্বণের এবং জাতীয় দিবসের নামানুসারে ব্যক্তির নাম রাখার নানা নজির রয়েছে। ওই সমস্ত দিনে জন্ম নেওয়া অনেকের নাম পার্বণের নামানুসারে হয়েছে; এমনটাও আমরা দেখে থাকি। যেমন আশুরার দিনে আশুরা, শবেকদরের দিনে কদর বানু, শবেমেরাজের দিনে মেরাজ, রোজার মাসে রমজান, কোরবানির ঈদে কোরবান আলি। ১৪ আগস্টে জন্ম নেওয়া অনেকের নাম পাকিস্তান, আজাদ, পাকিস্তান আমলে দেখেছি।
অনেকের আবার নাম আছে, যেমন- ফজর আলি, যোহর আলি, আসর আলি, মাগরিব উদ্দিন। এশা নামটি হালে কন্যাসন্তানদের ক্ষেত্রে অধিকমাত্রায় দেখা যায়। সপ্তাহের সাত দিনের নামেও অনেকের নাম রাখা হয়; শুক্রবারে শুকুর মিয়া, রবিবারে রবি, সোমবারে সম্মন, মঙ্গলবারে মঙ্গল ইত্যাদি।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
সংসদে সংরক্ষিত মহিলা এমপি লুৎফুন নেছা বক্তব্য দিচ্ছিলেন। ২০১৭ সালে সংসদের এক অধিবেশনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করছিলেন। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলেন, সংসদের তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া। শিশুর মতো অশুদ্ধ উচ্চারণ ও আঞ্চলিক ভাষায় পটুয়াখালীতে তার এলাকার সমস্যা তুলে ধরছেন তিনি। সংসদ টিভিতে অধিবেশনটি লাইভ প্রচার হচ্ছিল। তার বক্তব্য শুনে, অনেক সংসদ সদস্য হাসছিলেন। তবু তিনি একজন সংসদ সদস্য।
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এর ১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সংক্রান্ত বিধিমালা রয়েছে। এই আইনে যেকোনো শিক্ষাজ্ঞানসম্পন্ন বাংলাদেশি নাগরিক সংসদ সদস্য হওয়ার অধিকার রাখেন। অর্থাৎ একজন সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীর নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। নিবন্ধিত মনোনয়ন পেলেই হয়, আর স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে পূর্বে অন্তত একটি সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হতে হয় বা ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন থাকতে হয়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগ্রাহী প্রার্থীকে একটি মনোনয়ন ফরম পূরণ করতে হয়। ফরমটি পূরণের আগে একটি চেকলিস্ট ফরম রয়েছে , যা থেকে একজন ব্যক্তি নিজেকে যাচাই করতে পারেন তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন কি না। ফরমটিতে ক, খ ও গ তিনটি ভাগ তৈরি করা। তবে ক ভাগের ৪টি প্রশ্নের কোনো একটির উত্তর ‘না’ হলে, তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। ফরমটির ক বিভাগে জানতে চাওয়া হয় প্রার্থী বাংলাদেশের নাগরিক কি না, বয়স ২৫ বছর পূর্ণ, ভোটার তালিকায় নাম এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন, আর স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে পূর্বে অন্তত একটি সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়া বা ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন আছে কি না? থাকলেই একজন ব্যক্তি নির্বাচনের জন্য আবেদনে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তবে ফরমের খ ও গ অংশে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে প্রার্থী নিজেকে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা যাচাই করে নিতে পারেন।
জাতীয় সংসদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইনসভা। এককক্ষ বিশিষ্ট এই আইনসভার সদস্য ৩৫০ জন। এর মধ্যে ৩০০ জন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। অবশিষ্ট ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরা নির্বাচিত সংসদ সদস্যের ভোটে নির্বাচিত হন। সংসদের মেয়াদকাল পাঁচ বছর। সর্বোচ্চ আইনসভা হলেও সাংসদদের শিক্ষাগত কোনো যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। ফলে কিছু ব্যক্তি আঞ্চলিক আধিপত্য বা পৈতৃক সূত্র বা আর্থিক বদান্যতায় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বা সংসদ সদস্য হয়ে যান, কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই। ফলে অনেকেই জানেন না, পয়েন্ট অব অর্ডার কী, প্রশ্নোত্তরপর্ব কী, তারকা চিহ্নিত প্রশ্ন কী? এমনকি রাষ্ট্রীয় জরুরি বিষয়ে বা আলোচনায় তারা অংশ নিতে পারেন না। এমন অনেক সংসদ সদস্য আছেন যিনি ৫ বছরের সংসদ চলাকালে একদিনও সংসদে দাঁড়িয়ে কিছু বলেননি।
২০১৩ সালের ৯ জুন জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরপর্বে হাবিবুর রহমান মোল্লা সংসদ সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তৎকালীন সংসদকার্যে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা নির্ধারিত আছে। নতুন করে সংসদ সদস্যদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার বিধান অন্তর্ভুক্ত করে আইন সংশোধনের কোনো পরিকল্পনা আপাতত সরকারের নেই।
বেসরকারি সংস্থা ‘সুজন’-এর তথ্য মতে, একাদশ জাতীয় সংসদের ২৯৯ জন সাংসদের ৮০ দশমিক ৯৩ শতাংশের বা ২৪২ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। মহাজোটের সাংসদদের মধ্যে এ হার ছিল ৮১ দশমিক ৯৪ শতাংশ বা ২৩৬ জন এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাংসদদের ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ বা পাঁচজনের। নতুন সাংসদদের মধ্যে স্বল্পশিক্ষিত এসএসসি ও তার চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীর হার ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ বা ২০ জন। মহাজোটের সাংসদদের মধ্যে এ হার ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ বা ১৭ জন এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বা একজন। সব প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর), তবে নতুন সাংসদদের ৮০ দশমিক ৯৩ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত। অপরদিকে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ২২ দশমিক ৮৫ শতাংশ স্বল্পশিক্ষিত বা এসএসসি ও তার চেয়ে কম হলেও নতুন সাংসদদের ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ স্বল্পশিক্ষিত।
দশম জাতীয় সংসদে উচ্চশিক্ষিতের (স্নাতক বা স্নাতকোত্তর) হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৩ শতাংশ, একাদশ জাতীয় সংসদে যা সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে (৮০ দশমিক ৯৩ শতাংশ)।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিতদের মধ্যে, অন্তত ৭ শতাংশ প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল এসএসসি ও তার কম। আবার কিছু সংসদ সদস্য মনোনয়নপত্রে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ওই সংসদ সদস্য ছিলেন ৮ জন এসএসসির চেয়ে কম, মাধ্যমিক পাস ছিলেন ১৫ জন, ডিপ্লোমা পাস করা ছিলেন আটজন। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক পাস ছিলেন ২৬ জন, বিএ বা স্নাতক ডিগ্রি ছিল ১১১ জনের। মেডিকেল ডিগ্রিধারী ১১ জন এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ছিলেন ১১৪ জন। এছাড়া মনোনয়নপত্রে পিএইচডি ডিগ্রির কথা উল্লেখ করেছিলেন ৭ জন।
নবম সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়াপারসন খালেদা জিয়া নিজেকে ‘স্বশিক্ষিত’ বলে উল্লেখ করেছেন। আর বিএনপির সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার শিক্ষাগত যোগ্যতার অংশে লেখেন ‘নাই’। হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটনও হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি উল্লেখ করেন। আবার সংসদের জীবনবৃত্তান্তের সংকলনে বলেন ‘বি.কম’ পাস। ঢাকা-১০ আসনের সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ নিজেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং রংপুর-১ আসনের হোসেন মকবুল শাহরিয়ার, পাবনা-৩ আসনের মকবুল হোসেন, মৌলভীবাজার-৩ আসনের সৈয়দ মহসিন আলী হলফনামায় বলেছিলেন তারা এসএসসি পাস। কুষ্টিয়ার সুলতানা তরুণ এবং নারায়ণগঞ্জের সারাহ বেগম কবরী হলফনামায় নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি বলে উল্লেখ করেছিলেন।
সংসদ সদস্য হওয়ার সঠিক শিক্ষা ক্যাটাগরি না থাকায় জনসমর্থন বা দলীয় সমর্থন নিয়ে অনেকেই হচ্ছেন আইন প্রণেতা।
গত ৪ সেপ্টেম্বর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বগুড়া-৭ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রেজাউল করিমকে ‘জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ বিল-২০২১’-এর সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর বক্তব্য উপস্থাপন করতে বললে সাংসদ অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য উপস্থাপন করতে থাকেন। এতে সংসদে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি এ প্রসঙ্গে বলেন, জাতীয় সংসদের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন সাংসদকে কথা বলার ক্ষেত্রে তার জন্য বরাদ্দকৃত সময়ের সুষ্ঠু ব্যবহার কীভাবে করতে হবে তা জানতে হবে। নির্ধারিত বিষয়ে ফ্লোর পেয়ে একজন সাংসদকে কথা বলার আগে সেই বিষয়ে পড়াশোনা, চিন্তাভাবনা আর হিসাব করতে হবে- মুখে যা এলো তা বলে সংসদে হাস্যরসের সৃষ্টি করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এক্ষেত্রে সংসদীয় রীতিনীতি, আদব-কায়দা শেখানোর ব্যাপারটিকেও গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
আলোচনায় হিরো আলম : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন আলোচিত-সমালোচিত হিরো আলম। তিনি ওবায়দুল কাদেরকে ভোটের মাঠে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘তিনি কথায় কথায় বলেন আসুন খেলা হবে। আমি ওবায়দুল স্যারকে জোর গলায় বলতে চাই, খেলা সবার সঙ্গে করতে হবে না। আমি হিরো আলমের সঙ্গে একটা নির্বাচনে আপনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ও আপনি দলীয়ভাবে দাঁড়ান। এরপর আপনি সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে দেখেন খেলা হয় কি না।’
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) উপনির্বাচনের ৪৫টি ভোটকেন্দ্রের ভোট পুনঃগণনার আবেদন জমা দিতে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম এসব কথা বলেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া-৪ এবং বগুড়া-৬ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন হিরো আলম। বগুড়া-৪ আসনে ১৪ দলীয় সমর্থিত ও জাসদ প্রার্থীর কাছে ৮৩৪ ভোটে হেরে যান তিনি। এর পরেই হিরো আলম অভিযোগ করেন এই আসনে ভোট সুষ্ঠু হলেও গণনার সময় ফলাফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে। ৪৫টি ভোটকেন্দ্রের ফলাফল পুনঃগণনার জন্য আবেদন করেছেন। হিরো আলম বলেন, হিরো কখনো জিরো হয় না। কিন্তু সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল স্যার বলেছেন, হিরো আলম জিরো হয়ে গিয়েছে। যারা হিরোকে জিরো বানাতে চায় তারাই জিরো হয়ে গিয়েছে। সেতুমন্ত্রী আমাকে তাচ্ছিল্য করে কথা বলেছেন। তবে একজন মন্ত্রী দেশের নাগরিককে তাচ্ছিল্য করে কথা বলতে পারেন না। খেলার জন্য নাকি উনি মাঠে প্লেয়ার খুঁজে পান না। আমার সঙ্গে একটু প্রতি কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে ভোটারদের ভয় না দেখিয়ে সুষ্ঠু ভোট দিয়ে দেখেন।
হিরো আলম যাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, তিনি একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিক। সম্প্রতি তিনি তৃতীয়বারের মতো দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদক হয়েছেন। তিনি নোয়াখালী-৫ আসন থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। গত দুই সরকারের মেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন।
এটা হিরো আলম করতে পেরেছেন এ কারণে যে, বাংলাদেশের আইনসভার সদস্য হওয়ার যোগ্যতায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন। সংসদ নিয়ে তার জ্ঞান থাকুক বা না থাকুক, তিনি মনোনয়ন পেয়েছেন। দেশের সংবিধান বা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আইন হিরো আলমকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
একজন স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস ব্যক্তিকে আমাদের চাকরির বাজারে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির পদে চাকরি পেতে স্নাতক পাস প্রার্থী খোঁজা হয়। আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ছোটখাটো পদে চাকরির ক্ষেত্রেও এমবিএ পাস লাগে। একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা যখন গুরুত্বপূর্ণ তখন দেশের আইন প্রণেতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আবশ্যিকভাবেই ‘ভালো’ হওয়া উচিত। তা না হলে দেশের জন্য তারা যে আইন করবেন তা যথাযথ হবে কী করে?
২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম কুমিল্লায় একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য পৃথিবীর কোথাও শিক্ষাগত যোগ্যতা মুখ্য নয়। উচ্চশিক্ষিত না হলেও জনবান্ধব ও মেধাবী অনেকেই ভালো করছেন। তবে শিক্ষিত হলে অবশ্যই ভালো হবে।
মন্ত্রীর কথায় যুক্তি আছে। যদিও জাতীয় সংসদে উচ্চ শিক্ষিতের হার বাড়ছে। তা সত্ত্বেও সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার বিধান থাকা প্রয়োজন। বিশ্বের কোনো দেশে এই বিধান না থাকলে আমরা যে করতে পারব না তা কিন্তু না। একটি দেশের আইনসভার সদস্যদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলে দেশ এগুবে কী করে?
লেখক: সাংবাদিক
স্ত্রীকে নিয়ে পবিত্র হজব্রত পালনের জন্য ২০২০ সালে আট লাখ টাকা জোগাড় করেছিলেন টঙ্গীর বাসিন্দা মো. কামরুল ইসলাম। সেবার বেসরকারিভাবে হজে যাওয়ার ‘সাধারণ’ প্যাকেজের মূল্য ছিল জনপ্রতি ৩ লাখ ৬১ হাজার ৮০০ টাকা। তবে করোনা মহামারীর কারণে সে বছর শেষ মুহূর্তে হজে যেতে পারেননি তারা।
চলতি বছর হজপালনের পরিকল্পনা করছেন মো. কামরুল ইসলাম। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, এ বছর বেসরকারিভাবে জনপ্রতি হজ প্যাকেজের মূল্য ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৭ টাকা। এটাই সর্বনিম্ন প্যাকেজ, তবে এটা তিন বছর আগের খরচের প্রায় দ্বিগুণ। সরকারি আয়োজনে প্যাকেজ মূল্য আরও ১০ হাজার টাকা বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে।
মো. কামরুল ইসলাম এখন ভাবছেন বাড়তি টাকা কীভাবে জোগাড় করা যায়। তার পরিকল্পনা বাড়ির সামনের দোকানের পজিশন বিক্রির। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। না হলে হজপালনের পরিকল্পনাই বাদ দিতে হবে। মো. কামরুল ইসলামের মতো অনেকে হজ প্যাকেজের মূল্যবৃদ্ধির ফলে হজযাত্রা নিয়ে দোলাচলে পড়েছেন। কামরুল ইসলামের যদিও বিকল্পভাবে টাকা জোগাড়ের ব্যবস্থা আছে, যাদের নেই তাদের কী হবে?
খবরে প্রকাশ, এ বছর উড়োজাহাজভাড়া, মক্কা-মদিনার বাড়িভাড়া ও অন্যান্য পরিষেবা খরচ বেড়েছে। এর সঙ্গে ডলার ও সৌদি মুদ্রা রিয়ালের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিকভাবে হজপালনের খরচ বেড়েছে। গত বছরের হজ প্যাকেজের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া ও আসার উড়োজাহাজভাড়া বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। গত বছর যাওয়া-আসার (রাউন্ড ট্রিপ) ভাড়া ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এবার তা ৫৭ হাজার ৭৯৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। সাধারণভাবে ঢাকা-জেদ্দা-ঢাকা পথে একটি রাউন্ড ট্রিপে উড়োজাহাজের টিকিটের মূল্য ধরা হয় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকার মতো। সেই তুলনায় হজ প্যাকেজের উড়োজাহাজভাড়া অনেক বেশি। উড়োজাহাজভাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে মক্কা ও মদিনায় হজযাত্রীদের বাড়িভাড়া। গত বছর হজ প্যাকেজে বাড়িভাড়া (ভ্যাটসহ) ছিল ৬ হাজার ৫০৪ রিয়াল বা ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ২০১ রিয়াল বা ২ লাখ ৪ হাজার ৪৪৫ টাকা। গত বছর বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি রিয়ালের দাম ২৪ দশমিক ৩ টাকা হিসাব করা হয়েছিল। চলতি বছর তা হিসাব করা হয়েছে ২৮ দশমিক ৩৯ টাকা।
হজের সময় পাঁচ দিন ধরে মিনা, আরাফাহ ও মুজদালিফায় হজযাত্রীদের বিভিন্ন পরিষেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে তাঁবুর ব্যবস্থা করা, তাঁবুতে ম্যাট্রেস, বিছানা, চাদর, বালিশ, কম্বল, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও প্রতিদিনের খাবার সরবরাহ ইত্যাদি। মোয়াল্লেম সেবা হিসেবে পরিচিত এসব পরিষেবার জন্য খরচ গত বছর প্রাথমিকভাবে ২ হাজার ৫২০ রিয়াল বা ৬১ হাজার ২৩৬ টাকা (প্রতি রিয়াল ২৪ দশমিক ৩ টাকা ধরে) নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে তা বেড়ে হয় ৫ হাজার ৬৫৬ রিয়াল বা ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এ বছর এই খাতের খরচ মাত্র ২ রিয়াল বেড়েছে। তবে মুদ্রার বিনিময় হার বাড়ায় (প্রতি রিয়াল ২৮ দশমিক ৩৯ টাকা ধরে) তা ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৩০ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছর হজযাত্রীদের খাবার খরচ, জমজমের পানি, ভিসা ফি ও হজ গাইড বাবদ ব্যয় বেড়েছে।
হজের খরচ বৃদ্ধির কারণ বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট, হজের ব্যয় বৃদ্ধিতে সৌদি আরব এবং বাংলাদেশ যার যার অবস্থানে লাভের জায়গায় কোনো ধরনের ছাড় দেয়নি। অর্থাৎ লোভের হাত থেকে ছাড় পায়নি পবিত্র হজ খাত। হজের মতো ফরজ ইবাদত ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে এমন মুনাফাবাজি সাধারণ মানুষ কখনোই আশা করেনি। হজ থেকে তো কোনো সরকারেরই মুনাফা করার কথা নয়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত। প্রায় সবার শেষ আশা থাকে, আল্লাহর মেহমান হয়ে জীবনে একবার হলেও পবিত্র কাবা ঘর জিয়ারত ও নবীজির রওজায় উপস্থিত হয়ে সালাম পেশ করার। কিন্তু হজের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অনেক হজযাত্রীই চোখের পানি ফেলে প্রাক-নিবন্ধন বাতিল করছেন।
২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে হজ প্যাকেজের মূল্য ছিল ৫ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। একই বছর ভারতের হজ প্যাকেজ ছিল বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫ লাখ ৭৬৩ টাকা আর পাকিস্তানের হজ প্যাকেজের মূল্য ছিল বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩ লাখ ৩১ হাজার ৭৫২ টাকা। চলতি বছর বাংলাদেশি টাকায় ভারতের হজ প্যাকেজ মূল্য হচ্ছে প্রায় ৫ লাখ ১৫ হাজার ৮৪৬ টাকা আর পাকিস্তানের হজ প্যাকেজ মূল্য হচ্ছে ৩ লাখ ৫০ হাজার ৯৭২ টাকা।
গত জানুয়ারি মাসেও ১৫ দিনের ওমরাহ প্যাকেজের খরচ ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা। এই টাকায় উড়োজাহাজভাড়া, মক্কা-মদিনায় আবাসন, মক্কা-মদিনা যাতায়াত ও খাবার যুক্ত ছিল। সেখানে হজের সময় এমন অস্বাভাবিক খরচ বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ থাকতে পারে না।
প্রশ্ন হলো, বর্তমান অবস্থায় হজের ব্যয়বৃদ্ধির প্রভাব সম্ভাব্য হজযাত্রীরা কীভাবে মোকাবিলা করবেন? উত্তর, এ বছর বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়ার জন্য যারা নিবন্ধন করেছেন, হজের প্যাকেজ মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদের বড় একটি অংশই শেষ পর্যন্ত আর হজে যাবেন না। বাস্তবে তেমনটি ঘটলে সম্ভবত এ বছরই হবে এ ধরনের প্রথম ঘটনা যে কোটা বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তা অপূর্ণ থেকে যাবে।
যদি বলা হয়, উড়োজাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়ার কারণে প্যাকেজব্যয় বাড়াতে হচ্ছে, তাহলে বলব, হজযাত্রী পরিবহনের একচেটিয়া কর্র্তৃত্ব শুধু বাংলাদেশ বিমান ও সৌদি এয়ারলাইনসের ওপর ছেড়ে না দিয়ে সব এয়ারলাইনসের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। এমনটি করা হলে তাতে উড়োজাহাজভাড়া কমতে বাধ্য।
অন্যদিকে সৌদি আরবে পবিত্র কাবা অবস্থিত হওয়ায় পুরো হজ ব্যবস্থাপনা সৌদি সরকার করে থাকে। সৌদির সঙ্গে জড়িত হজপালনে যেসব আনুষঙ্গিক খরচ বেড়েছে, তা আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি নাসেটাও কূটনৈতিক পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। সবদিক থেকে হজপালনে কিছুটা ব্যয় সাশ্রয় হলে স্বল্প আয়ের দেশের মানুষ হজপালনে আরও বেশি করে অংশ নিতে পারবেন। তাই সরকারকে দেশে এবং সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে সহনীয় মাত্রায় হজযাত্রার ব্যয় সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকার নিচে পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। আর ব্যয়সাশ্রয়ের লক্ষ্যে হাজিদের দেখাশোনার জন্য ন্যূনতম পর্যায়ের লোকবল যুক্ত রেখে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে হজপালনের সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়েও সরকারের সিদ্ধান্ত কামনা করছি।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
১৬৭৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন বিশ্বখ্যাত ফরাসি নাট্যকার মলিয়ের। পশ্চিমা সাহিত্যের সেরা হাস্যরসাত্মক রচনাকারদের একজন হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। তার রচনাগুলোর মধ্যে ল্য মিসান্থ্রপি, ল্য এক্ল দেস ফেমেস, টারটুফে অউ ল্য ইম্পোস্তার, ল্য আভ্রে, ল্য মালাদে ইমাজিনারে উল্লেখযোগ্য। মলিয়ের ১৬২২ সালের ১৫ জানুয়ারি ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। ‘দে ক্লেরমন্ট’-এর মতো নামকরা কলেজে পড়ানোর কারণে থিয়েটারে যোগ দেওয়া তার জন্য খুব সহজ ছিল। ভ্রাম্যমাণ অভিনেতা হিসেবে ১৩ বছরের জীবনাভিজ্ঞতা থেকেই তিনি প্রথম নাটক লেখেন। সেখানে তিনি ইতালীয় ঘরানার কমেডির সঙ্গে ফরাসি হাস্যরসের মিশ্রণ ঘটান। পরে ফরাসি রাজার চোখে পড়ায় তিনি ও তার দল রাজভাতা পায়। যদিও তিনি রাজা ও প্যারিসের অধিবাসীদের ভূয়সী প্রশংসা পান, কিন্তু তার বিদ্রুপাত্মক লেখা নীতিবাদী ও ক্যাথলিক চার্চ অনুসারীদের সমালোচনার মুখে পড়ে। ধর্মীয় ভণ্ডামিকে আক্রমণ করায় চার্চ তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নাটকের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে মলিয়েরের স্বাস্থ্য দুর্বল হতে শুরু করে, ফলে ১৬৬৭ সালে তিনি বাধ্য হন মঞ্চ থেকে সাময়িক অবসর নিতে। ১৬৭৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যক্ষ্মাক্রান্ত অবস্থাতেই তিনি জীবনের শেষ নাটক ‘ল্য মালাদে ইমাজিনার’-এ অভিনয় করেন। আর্গন নামক স্বাস্থ্য আতঙ্কিত রোগীর ভূমিকায় অভিনয়রত অবস্থাতেই উপর্যুপরি কাশি ও রক্তস্রাবের শিকার হন। নাটকটির অভিনয় শেষ করে তিনি মঞ্চেই ঢলে পড়েন এবং কয়েক ঘণ্টা পর মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার বয়স ৫১ বছর। মলিয়েরের হাসির নাটক আমাদের দেশের মঞ্চেও জনপ্রিয়। লোক নাট্যদল ‘কঞ্জুস’ ও সাত্ত্বিক নাট্যদল ‘পেজগী’ নামে তার দুটি নাটকের বাংলা অনুবাদ মঞ্চস্থ করে থাকে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে, বাংলাদেশের ‘পরিবেশ’ বৈচিত্র্য বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। এসব বন্যপ্রাণী, বিভিন্ন প্রতিবেশ ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারায় অধিকাংশ প্রাণীই বর্তমানে বিপন্ন। বাদ পড়ছে না সরীসৃপ প্রাণীও।
বাংলাদেশে পাওয়া যায়, এমন সরীসৃপ প্রাণীর মধ্যে ত্রিশটিরও বেশি প্রজাতি বর্তমানে মহাবিপন্ন। ৩০ কোটি বছর আগে সরীসৃপের উদ্ভব ঘটেছিল। এসব সরীসৃপ প্রজাতির মধ্যেই আছে ২ প্রজাতির কুমির।
গতকাল দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত, ‘ভালুকায় উন্মুক্ত হলো- কুমিরের খামার’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, দেশীয় পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে ময়মনসিংহের ভালুকায় উথুয়া ইউনিয়নের হাতিবেড় গ্রামে দেশের প্রথম ‘র্যাপটাইলস ফার্ম’ নামের বাণিজ্যিক কুমির খামার পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এতে এই এলাকায় পর্যটনের পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। গত মঙ্গলবার খামারটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে খামার কর্তৃপক্ষ।
সংবাদে আরও জানা যায়, বর্তমানে নতুন বাচ্চাসহ ২৫২৬টি কুমির রয়েছে খামারে। চেয়ারম্যান ড. নাঈম আহমেদ জানান, খামারের ব্যয় মেটাতেই আমরা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করেছি। সেখানে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য টিকিটের মূল্য ১৫০ টাকা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
বিশ্ববাজারে কুমিরের চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁতের বেশ কদর। পাশাপাশি এর দামও চড়া। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, ইতালি এবং এশিয়ার চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ায় এগুলোর ব্যাপক চাহিদা। দেশের প্রথম র্যাপটাইলস ফার্ম নামের বাণিজ্যিক কুমির খামার পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এতে এলাকায় পর্যটনের পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ইউরোপ ছাড়া পৃথিবীর সব মহাদেশেই প্রায় ১৭.৫ কোটি বছর আগে ডাইনোসরের সমকালীন কুমিরের উদ্ভব ঘটলেও ডাইনোসরের বিলুপ্তির পর অদ্যাবধি এরা পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে আসছে।
পরিবেশ ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে বাংলাদেশে কুমিরের প্রজনন ও চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে কুমিরের বাণিজ্যিক চাষ করা হয়। অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত দেশে, কুমির অপ্রচলিত খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঐসব দেশে, পর্যটন শিল্প হিসেবে কুমিরের খামার স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া কুমিরের চামড়া অনেক অভিজাত সামগ্রী তৈরিতে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। প্রাকৃতিক পরিবেশে কুমিরের প্রজাতিসমূহের বিলুপ্তি রোধকল্পে এর আবাসস্থলের উন্নয়ন ও প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। তাছাড়া কুমিরের কৃত্রিম প্রজনন-কৌশল ও চাষ-পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য দেশের বিভিন্ন পরিবেশগত অঞ্চলে, সরকারি উদ্যোগে আধুনিক সুবিধা সংবলিত কয়েকটি গবেষণাগার স্থাপন করা জরুরি। এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে কুমিরের উৎপদন বৃদ্ধিসহ এ থেকে প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, যে কোনো দেশে অর্থনীতির মূল শক্তি রপ্তানি। যে দেশ যত বেশি পরিমাণে পণ্য রপ্তানি করতে পারে, সেই দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত শক্তিশালী। এক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে কুমির চাষ। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের জন্য, খামারটি উন্মুক্ত করে দেওয়ায় মানুষও পাচ্ছেন নির্মল বিনোদন। দেশে এমন ‘ক্ষেত্র’ খুব একটা নেই যেখান থেকে আয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা এবং দেশের মানুষ পাবে নির্মল বিনোদন। মানুষের হৃদয়স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে, নির্মল বিনোদন ভীষণ প্রয়োজন। কুমির খামারটি অর্থনৈতিকভাবে কীভাবে আরও ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু পদক্ষেপ জরুরি।
সচেতনতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে, বিপন্ন সরীসৃপ প্রাণী রক্ষা করা প্রয়োজন। তবেই প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে, ভালো থাকবে সার্বিক পরিবেশ।
বাংলাদেশের ৫৩তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস রবিবার।
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত গণহত্যা অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বেসামরিক লোকের ওপর গণহত্যা শুরু করে।
তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। ওই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তারের আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তা জনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধর পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি ভূখণ্ডের, যার নাম বাংলাদেশ।
দেশে ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি ইন্টারনেট সেবা চালু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। অন্য অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক একই সেবা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সব মোবাইল অপারেটরই দেশের বেশিরভাগ স্থানে ফোরজি সেবা চালু করেছে। আর সে হিসেবেই তারা ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু গ্রাহকরা ফোরজি ইন্টারনেট কিনলেও দেশের অনেক এলাকায় টুজি-থ্রিজি’র সেবা পাচ্ছেন। তারা অপারেটর কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ জানালেও এর সুরাহা হচ্ছে না।
জানা গেছে, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে মোটামুটিভাবে গ্রাহকরা ফোরজি সেবা পাচ্ছেন। তবে এসব এলাকায়ও অনেক সময় ফোরজি থাকে না, থ্রিজিতে নেমে আসে নেটওয়ার্ক। তবে জেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ সময়েই থাকে থ্রিজি। আর মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ সময় সেই থ্রিজিও থাকে না, তখন টুজি নেটওয়ার্কই ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইন্টারনেট প্যাকেজ যথাযথভাবে থাকার পর তা কাজ করে না, বাফারিং হয়। এতে গ্রাহকরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো সারা দেশের ব্যবসা একত্রে হিসাব না করে এলাকাভিত্তিক ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা দেখেন, কোন এলাকায় তাদের গ্রাহক সংখ্যা কত, সেখানে কত সিমে ইন্টারনেট চালু আছে। যদি দেখা যায়, তাদের হিসাব মতে তা সন্তোষজনক আছে তাহলে সেখানে ফোরজি সেবা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বহাল রাখে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টাওয়ার নির্মাণ করে। কিন্তু যদি দেখে সন্তোষজনক গ্রাহক নেই তাহলে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না, এতে সেই এলাকায় ফোরজি পাওয়া যায় না। অথচ শহর এলাকাগুলোতে তারা বেশি ব্যবসা করলেও সেটাকে হিসাবে ধরে না। কিন্তু মফস্বল এলাকা থেকে কল বাবদ প্রয়োজনের বেশি ব্যবসা হলেও তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সমন্বয় করে না।
মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর ফেসবুক পেইজে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অভিযোগ জানান গ্রাহকরা। অভিযোগ অনুযায়ী, অপারেটরদের মধ্যে টেলিটকের নেটওয়ার্কই বেশি দুর্বল। টেলিটকের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে মো. ফয়জুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই, নেটওয়ার্ক পাই না সকাল থেকে। মিরপুর-২ নম্বরে বাসা স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে। আর আমার গ্রামের কথা না হয় বাদ দিলাম।’ আরাফাত আলী লেখেন, ‘২জিবি নেট কিনলে দেড় জিবি নষ্ট হয়। মেয়াদ ১৫ দিন তাও ফুরাতে পারি না। তাহলে বুঝেন নেটওয়ার্ক কত ভালো।’ কার্জন চাকমা লেখেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় ফোরজি নিশ্চিত করুন। আমাদের পার্বত্য এলাকাগুলোতে টেলিটকের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি, কিন্তু শুধু থ্রিজি-টুজিতে সীমাবদ্ধ।’ রাসেল আহমেদ লেখেন, ‘গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাংগা গ্রামে থ্রিজি নেটওয়ার্ক তো নেই-ই। মাঝেমধ্যে টুজি’ও নেই। বুঝুন অবস্থাটা। আমাদের থ্রিজি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করুন।’
টেলিটকের মহাব্যবস্থাপক (সিস্টেম অপারেশন) নুরুল মাবুদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ফাইভজি রেডিনেস প্রজেক্ট শুরু করেছি। যা শেষ হতে এক বছর বা তার কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। এর ফলে আমাদের কাভারেজ এলাকাগুলোতে ফোরজি সেবা নিশ্চিত হবে। এছাড়া আমাদের কাভারেজ বাড়ানোরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে।’
বাংলালিংকের পেজের একটি পোস্টে মাহাদী হাসান তালহা লেখেন, ‘আমার এলাকায় আপনাদের সিম ব্যবহার করতে হলে ফোন গাছের ডালে বেঁধে লাউডস্পিকার দিয়ে কথা বলা লাগে। এত্তো ফাস্ট কেন আপনাদের নেটওয়ার্ক।’ আকরাম হোসাইন লেখেন, ‘ভাই আপনাদের সবই ঠিক, তবে নেটওয়ার্ক সেøা।’
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অফিসার তৈমুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফোরজি সেবার জন্য ২৩০০ মেগাহার্জের স্পেকটার্ম প্রয়োজন হয়। কিন্তু টুজিতে তা লাগে মাত্র ৯০০ মেগাহার্জ। আমরা ইতিমধ্যে ৯৫ শতাংশ কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা নিশ্চিত করেছি। তবে আমাদের আরও বেশি সাইট লাগবে। যদি সব অপারেটর মিলে আমরা টাওয়ার শেয়ার করতে পারি, তাহলে সব গ্রাহকের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে।’
রবির পেজে এক পোস্টে তানভীর আহমেদ লেখেন, ‘কলাপাড়া থানা শহরে যদি থ্রিজি নেটওয়ার্ক না পাওয়া যায়, এরচেয়ে দুঃখজনক কিছুই হতে পারে না।’ এইচএমএম ইসমাঈল লেখেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার চম্পকনগর ইউনিয়নে রবি সিমের থ্রিজি নেই। অথচ অনেক বছর আগে রবি টাওয়ার বসানো হয়েছে। আমরা রবি সিম দিয়ে ইন্টারনেট চালাতে অক্ষম।’
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলটরি অফিসার শাহেদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা রয়েছে। তবে দেখা যায়, অনেক ফোন ফোরজি সাপোর্ট করে না। আর কাভারেজ এলাকা থেকে যতদূরে যাওয়া যাবে, নেটওয়ার্ক তত কমতে থাকবে। এছাড়া আমাদের কিছু জায়গায় নেটওয়ার্কের কাজ চলছে। পাশাপাশি নতুন কিছু টাওয়ার তৈরির কাজও আমাদের চলছে।’
গ্রামীণের পেইজে একটি পোস্টে রহিদুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই আমি যখন গ্রামে যাই তখন নেটওয়ার্কের ঝামেলা হয়।’ সাইদুর রহমান লেখেন, ‘এমন সার্ভিস হলে চলবে? কলরেট, ইন্টারনেটের দাম তো ঠিকই বেশি আপনাদের, বাকি সব অপারেটরদের থেকে।’
গত বছরের ২৮ এপ্রিল টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত ‘আনলিমিটেড’ ও ‘মেয়াদবিহীন’ ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। কারণ এজন্য প্যাকেজের দাম বাড়িয়েছে অপারেটররা। আর মেয়াদহীন ইন্টারনেট পেতে প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একই প্যাকেজ চালু করতে হবে। কিন্তু গ্রাহকের সব সময় একই ধরনের ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে গ্রাহকের কেনা ইন্টারনেট। এছাড়া মেয়াদবিহীন হিসেবে মোবাইল অপারেটররা যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে গ্রাহকদের।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে সচল সিমের সংখ্যা ১৮ কোটি ২০ লাখ ৬১ হাজার। এরমধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার, রবির ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৪ হাজার, বাংলালিংকের ৪ কোটি ৮৫ হাজার এবং টেলিটকের ৬০ লাখ ৬৭ হাজার। আর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫০ লাখ। এরমধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি ও পিএসটিএন)-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ লাখ ৮৭ হাজার গ্রাহক।
রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির মধ্যেই তৈরি পোশাক খাতের আকাশে দেখা দিয়েছে শঙ্কার মেঘ। কয়েক মাস ধরেই খাতটির উদ্যোক্তারা রপ্তানি আয় কমে যাওয়া নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। তারা বলছেন, রপ্তানির প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় আগামীতে ওই সব অঞ্চলে রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। তাদের ভাষ্য, ইতিমধ্যে তার প্রভাবও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। অর্ডার কমে যাওয়ায় কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যও বলছে সে কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার হার নেমেছে প্রায় অর্ধেকে।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তবে এই খাতের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির পুরোটাই আমদানিনির্ভর; যা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাপক হারে কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) টেক্সটাইল ফেব্রিক্স আমদানির এলসি বা ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ৬২৬ কোটি ডলারের এলসি খোলেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৬৫ কোটি ডলার।
তবে প্রস্তুত কাপড়ের চেয়ে বেশি আমদানি কমেছে কাঁচামালের। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে কাঁচা তুলা বা কটন আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এ সময়ে কাঁচা তুলা আমদানিতে ১৫৩ কোটি ডলারের এলসি খোলেন ব্যবসায়ীরা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে তুলা আমদানিতে ২৭২ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। আবার তুলার চেয়ে সুতা আমদানি আরও কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সুতা আমদানিতে এলসি খোলা হয় ১০৭ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৪২ কোটি ডলার। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুতা আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৬ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের আট মাসে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৪ দশমিক ১১ শতাংশ। এই সময় টেক্সটাইল যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমেছে ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৬৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে। আর এটি কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা নতুন কলকারখানা স্থাপন অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। এতে দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে ‘ধস’ নামার একটা অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ও জাহাজভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক পতন, বিভিন্ন দেশে মন্দার শঙ্কাসহ নানা কারণে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে দেশে ডলার সংকট দেখা দিলে এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। এতে ডলারের ওপর চাপ কিছুটা কমানো গেলেও আমদানি জটিলতায় পড়েছে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাত।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ কিছুটা কমেছে। কিন্তু উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানি বাড়ায় রপ্তানি আয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রভাব পড়েনি। যেহেতু সাধারণ পোশাক রপ্তানি কমেছে সে কারণে কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিও কমেছে। পাশাপাশি ডলার সংকটও আমদানি কমে যাওয়াতে ভূমিকা রেখেছে। ফারুকের আশঙ্কা, উন্নত দেশগুলোতে ব্যাংকিং খাতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তার কারণেও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে এসব বিষয় মোকাবিলায় পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করার মতো অর্থের সংকট রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারছে না। পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার বড় অবমূল্যায়নের কারণে মালিকরা খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আনছেন না। অবশ্য আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমায় আমদানির পরিমাণে প্রভাব পড়েছে বলেও মনে করেন ফজলে শামীম এহসান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দার আশঙ্কায় কেউ নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। তবে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়াটাকে তারাও আসন্ন সংকট হিসেবে দেখছেন। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশে ডলারের সংকটের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল আমদানি করতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এটা খুব ভালো লক্ষণ নয়। তবে তিনি আশাও দেখছেন। তার ভাষ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমে যাওয়ায় মূলত আমদানি ব্যয় কম হয়েছে। আমদানির পরিমাণ খুব একটা কমেছে বলে মনে করেন না তিনি।
পুলিশ ভেরিফিকেশন না হওয়ায় চাকরি স্থায়ীকরণ হচ্ছিল না। কিন্তু তার দেরি সয়নি। নিজের তত্ত্বাবধানে থাকা সার্ভিস বইয়ের পাতায় কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে স্থায়ী করে নিলেন নিজের চাকরি। এই ব্যক্তি হলেন ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী মো. মনোয়ার হোছাইন। স্থানীয় সরকার বিভাগ তদন্তের পর থানায় মামলা হয়। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে তার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের চারটির প্রমাণ মিলে। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট আইনের দুটি ধারায় তার ১২ বছর সাজা ও অর্থদ- হয়েছে। পুলিশ মনোয়ারকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ১৯ মে ‘ক্রু’ বা মশককর্মী পদে যোগ দেন মনোয়ার হোছাইন। দপ্তরের চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, এলডিএ কাম টাইপিস্ট হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করে তিনি ওই পদও বাগিয়েছেন। ওই পদ থেকে উচ্চমান সহকারী (হেড ক্লার্ক) পদেও পদোন্নতি নিয়েছেন। এরপর দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে নেন। তথ্য গোপন করে পদোন্নতি নেওয়া এই কর্মকর্তার বাদ ছিল চাকরিতে স্থায়ী হওয়া। প্রথমবার কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি নেওয়ার পর তার উচ্চাকাক্সক্ষা বেড়ে যায়। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল স্বাক্ষর করে চাকরি স্থায়ী করেন। এর আগে দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা তালুকদারকে চাকরি স্থায়ী করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।
এ ঘটনার পর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্থানীয় সরকার বিভাগ ও দুদকের তদন্ত কমিটির কাছে লিখিতভাবে তার স্বাক্ষর জাল করার বিষয়ে অভিযোগ করেন। ২০১১ সালে মনোয়ারকে বরখাস্ত করা হয়।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা তালুকদার তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগের পক্ষে বিভিন্ন প্রমাণও জমা দেন। তিনি লিখিত বক্তব্যে জানান, অভিযুক্ত মনোয়ার হোছাইনের চাকরি স্থায়ীকরণ সংক্রান্ত চাকরি বইয়ের দ্বিতীয় খ-ের নবম পৃষ্ঠায় যে স্বাক্ষর রয়েছে তা তার নয়। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখের স্বাক্ষরটি মনোয়ারের সৃজনকৃত। চাকরিকালীন তার বিষয়ে কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন করানো হয়নি। এ জন্য তার চাকরিও স্থায়ী করা হয়নি। আর সার্ভিস বইয়ে যে সিল ব্যবহার করা হয়েছে তা তার সময়ে ব্যবহৃত সিল থেকে ভিন্ন। সিলের নিচে যে স্বাক্ষর রয়েছে তিনি বলতে পারবেন সেটা কীভাবে হলো। ইস্যু রেজিস্টার খাতায় ৪৬ নম্বর দিয়ে যে চিঠিটি তৈরি করা হয়েছে তার কোনো কপি কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। ৪৬ নম্বর ক্রমিকটি ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি লেখা রয়েছে। অন্যান্য কলাম খালি রয়েছে। পরের পাতায় ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি ২৬ নম্বর ক্রমিক দিয়ে একটি বদলির চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরও জানান, ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মনোয়ার হোছাইন। দপ্তরের বিধি-বিধান অনুযায়ী নথি, রেকর্ডপত্র, সার্ভিস বই তার কাছে রক্ষিত ছিল। এ কারণে জাল স্বাক্ষরের দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। দপ্তরে জমা দেওয়া তার এলএলবি পাসের সনদও সঠিক ছিল না। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে তার ওই সনদ সঠিক নয় বলে লিখিতভাবে দপ্তরকে জানানো হয়েছে।
মনোয়ারের বিরুদ্ধে অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ, নিয়োগ বাণিজ্য, স্বাক্ষর জাল, নিজেই নিজের চাকরি স্থায়ীকরণ এবং নথি, রেকর্ডপত্র, সার্ভিস বইয়ে ত্রুটি ঘটানোসহ পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে চারটি অভিযোগের প্রমাণ মেলে।
ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তর সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশে ২০১৩ সালের ১৮ জুন দপ্তরের পক্ষ থেকে চকবাজার থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা (নম্বর-৪) করা হয়। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানো হয়। দুদক তদন্ত করে মনোয়ারের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট আইনের একটি ধারায় তার পাঁচ বছরের কারাদ- হয়। পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের সশ্রম কারাদ- দেয় আদালত। আরেকটি ধারায় সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়ার পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের বরখাস্ত উচ্চমান সহকারী মনোয়ার হোছাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, একটি চক্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। তাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে তিনি কর্মস্থল থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল এবং আদালতের সাজার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা কত কিছু করছে। কোথায় আবার কী করেছে বুঝতে পারছি না। এ প্রসঙ্গটি বারবার উত্থাপন করলেও তিনি এড়িয়ে যান।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তান যা বলে, তারাও (বিএনপি) তাই বলে। কারণ তারা পাকিস্তানি ভাবধারায় উজ্জীবিত, তাদের হৃদয়ে পাকিস্তানি চেতনা।
আজ রবিবার (২৬ মার্চ) ভোরে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের দাবি 'আওয়ামী লীগের ভুলের জন্য গণহত্যা হয়েছিল'- এমন প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, তাদের (বিএনপি) হৃদয়ে পাকিস্তানি চেতনা। তারা এমনটা বলবে, এটাই সমীচীন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার শত্রুরা সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ; এমন নানা পোশাকে স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করে। এই অপশক্তিকে পরাস্ত করতে হবে। কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সোনার বাংলা গড়ার পথে রয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া এখন অন্যতম অঙ্গীকার।
এর আগে, জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মাহবুলউল আলম হানিফ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের অপরাধীরা আগে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করত। এরপর জানা গেল, সেখান থেকে দেশে অপরাধ ঘটায় তারা। কারও কারও নেপালে অবস্থানের কথাও জানা যায়। ভারতকে নিরাপদ মনে না করায় আরব আমিরাতের দুবাই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। সেখানে তারা আস্তানা গেড়েছে।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা অপরাধ করেই দুবাই চলে যাচ্ছে। সেখানে বসেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে। এখন বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাও দুবাইকে কেন্দ্র করে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। তাদের কেউ কেউ সোনার কারবারও করছেন। ওই দেশে ভারতের দুর্ধর্ষ অপরাধী দাউদ ইব্রাহিমের শিষ্যত্ব নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ওইসব অপরাধীর তথ্য জানার পরও তাদের ফেরত আনতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিসের’ দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ধরতে রেড নোটিস জারি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে পার পেয়ে গেছে। যদিও মামলাটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে নতুন করে আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্ত করার কথা ভাবছে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ সড়কে গুলি চালিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত হন এক কলেজছাত্রী। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মূল হোতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার রাতেই দেশ ছেড়ে চলে যায় দুবাইয়ে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে মুসা চলে যায় ওমানে। জিসান ও জয় এখনো দুবাইতেই বসবাস করছে। যদিও ওমান থেকে মুসাকে ওই বছরের ৯ জুন ইন্টারপোলের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের আলোচনায় আসে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও হিরো আলমের দুবাই সফরকে কেন্দ্র করে। তারা বনানীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের আসামি আরাভ খান নামধারী রবিউল ইসলামের সোনার দোকান উদ্বোধন করতে সেখানে যান। দুবাই যাওয়ার কারণে সাকিব ও হিরো আলমকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হতে পারে। এ ছাড়া ‘প্লেজার ট্যুরের’ জন্য এখন দেশের শিল্পপতিদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে দুবাই। কারণ ঢাকাকে তারা নিরাপদ মনে করছেন না। পাশাপাশি দেশে আটক সোনার চালানের ৮০ শতাংশ জব্দ হচ্ছে দুবাইফেরত বিভিন্ন এয়ারলাইনস থেকে। সব মিলিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দুবাই।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীরা যে দেশেই থাকুক না কেন, তাদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে আটক করার পর দুবাই থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে চেয়েছিল পুলিশ। সম্প্রতি আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভকে দুবাই থেকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ে সুখবর দেওয়া সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে জানান, সম্প্রতি আলোচনায় আসা আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ভারতের পাসপোর্টধারী। দেশে তার নামে ১২টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ওইসব পরোয়ানার কপি ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে পাঠানোর পর দ্রুতই তাকে ফেরানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এর আগে জিসান ও জয়কে দুবাই থেকে ফেরত আনার উদ্যেগ নিয়েও আনতে পারেনি। টের পেয়ে তারা দুবাই ছেড়ে কানাডায় চলে যায়। তারা আবার দুবাই এসেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এই দেশে অপরাধ করে দুবাই গিয়ে আস্তানা গাড়েন। ইতিমধ্যে পুলিশ একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকায় গুলশান ও বনানী এলাকার মডেলের সংখ্যা বেশি। বছরখানেক আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকেন। তাদের সঙ্গে অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সখ্য আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এমনকি বনানীতে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যাকান্ডে তাদেরও সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার পর পিয়াসা, রাজ ও আরাভকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় তদন্ত করা হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগীতশিল্পী, এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও কয়েকজন মডেল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। আবার কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তাড়া খেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছে কেউ কেউ। আত্মগোপনে থেকেই তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দুবাই রয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আলাদাভাবে বৈঠক হয়েছে। ওইসব বৈঠকে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাই চলে যায়। সেখান থেকেও ঢাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তার সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল, কামরুল হাসান হান্নান, ইব্রাহীম, রবিন ও শাহাদৎ হোসেন বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, শাহাদৎ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নুর হোসেনসহ অনেকেই কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নুর হোসেন ছাড়া অন্য সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। সুব্রত, মোল্লা মাসুদ ও শাহাদৎ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে মুম্বাই হয়ে দুবাই চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার অপরাধজগতের এক সন্ত্রাসী এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধীরা এখন আর ভারত যেতে চায় না। কারণ ওই দেশে শান্তিতে থাকা যায় না। ফলে সবাই এখন দুবাইমুখী হচ্ছে। দুবাইয়ে সবাই নিরাপদে থাকতে পারছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)