
মুচলেকা, নাকে খত, নির্মূল, উৎখাত অথবা হনুমানের ভেংচি বা গাধার হাসি; মোটেই অভিধান বহির্ভূত শব্দ নয়। কাউকে চুবিয়ে-ডুবিয়ে মারা, মাজা ভেঙে দেওয়া, শাড়ি ধরে টেনে নামানো ধরনের শব্দ-বাক্যও আছে বাংলা অভিধানে। তাই বলে যা-তা ভাবে ব্যবহারের শব্দ নয় এগুলো। শুনতে বা লিখতেও কেমন লাগে? এগুলো সচরাচর ভাষার সৌন্দর্য-গাম্ভীর্যের জন্যও মানায় না। কিন্তু, আমরা ব্যবহারের নামে সমানে অপব্যবহার করছি। এমনকি এই ভাষার মাসে কোনো ছাড় দিচ্ছি না। প্রসঙ্গেরও ধার ধারছি না।
কখনো বাতকে বাত, কখনো শালীনতার তোয়াক্কা না করে বা ব্যাকরণের কঠিন বেড়াজালে, কখনো ব্যাকরণ ভেঙেচুরে স্বেচ্ছাচারিতায় প্রকারান্তরে প্রিয় ভাষাটির সর্বনাশ করে ছাড়ছি। বাংলা চর্চায় অতি রক্ষণশীলতা বা উদারতা দুটোই বিপজ্জনক। ক্ষেত্রভেদে হঠকারিতাও। প্রকারান্তরে এটি ভাষার সঙ্গে জবরদস্তি, নাশকতা। তা শব্দ, বানান, বাক্যসহ গোটা বাংলা ভাষাটিরই সাবলীলতা নষ্ট হচ্ছে। একসময় বানান ও বাক্যে ভুলের মহোৎসব দেখা যেত বাস-ট্রাকে। দোকানপাটের সাইনবোর্ডে। ‘ঐ দেকা জায় গুলিস্থান, ব্যভহারে বংসের পরিচয়, ১০০ বা ৫০০ টাকার বাংতি নাই, কিসু পেলে গেলেন কি’Ñ ধরনের বানান ও কথাবার্তা এখন ভরপুর ফেসবুকে। যার মনে যা চায় স্ট্যাটাস লিখছেন। কমেন্টসও আচ্ছা রকমের। দৈনন্দিন যাপিত জীবনেও ভাষার ক্ষেত্রে সবাই এখানে স্বাধীন, সার্বভৌম, মহাপরাক্রমশালী।
বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবিটি সুপরিণতির দিকে নিতে চাইলে দেশে বাংলার চর্চা কোন স্তরে, কোন পর্যায়ে তা ভাবা জরুরি। ভাষার সঠিক চর্চা নিশ্চিতে অভিধানের চেয়েও বেশি শক্তি গণমাধ্যমের। দেশের সব ঘরে অভিধান নেই।
থাকলেও সেটা পড়ে থাকছে শো-পিসের মতো। কিন্তু সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, ফেসবুকের মতো গণমাধ্যম রয়েছে ঘরে ঘরে। এসব গণমাধ্যমে ব্যবহৃত শব্দ, বানান, বাক্যের গতি, শক্তি অভিধানের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু, দুঃখজনকভাবে সেখানেও বিস্তর গোলমাল। অর্থগতভাবে পর্যন্ত ছারখার করে ফেলা হচ্ছে রক্তাার্জিত বাংলাকে। ভুল স্বীকার না হোক, অন্তত শুদ্ধটা জানানোর তাগিদও চোখে পড়ে না। বানানের সঙ্গে বাক্য গঠনেও অরাজকতা। ডায়রিয়ায় ১৭ জন নিহত, বন্যার পানিতে ১৫ জন নিহত, অপুষ্টির অভাবে শিশুর মৃত্যু, নিহত হয়ে চারজনের মৃত্যুবরণ, দ্রব্যমূল্যের দাম আরও বেড়েছে, সিদ্দিকের চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেছে, তাকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, বাস না পেয়ে পায়ে হাঁটতে হয়েছে পাঁচ মাইল, এইচএসসিতে শতকরা গড় পাসের হার ৬৮.৯১ শতাংশ, পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ধরে আনার চেষ্টা চলছেÑ ধরনের বাক্যের অর্থ অডিয়েন্স বুঝে নিচ্ছে সত্য। কিন্তু, বাক্যগুলোর অর্থ-প্রয়োগে বাংলার করুণ দশা স্পষ্ট। কী বলতে গিয়ে কী বলা হচ্ছে? তথ্যই বা কী দাঁড়াচ্ছে? কেউ তা রোখার চেষ্টা করলে যুক্তির তেজে চুপ মেরে যেতে হয়। অর্থ, স্বকীয়তা, বিশেষত্ব ও ভাষা-ব্যাকরণের শুদ্ধরূপের ক্ষতবিক্ষত অবস্থা হজম করা ছাড়া আর গতি থাকে না।
বিশুদ্ধতা ও জাতপাত খোয়ানোর পরও ইংরেজি ভাষা কেন গোটা বিশ্বে প্রতিপত্তি বিস্তার করে চলছেÑ এমন বাঁকা প্রশ্নও ছোড়া হয়? ইংরেজি জানা সারা দুনিয়াতেই স্মার্টনেসের ব্যাপার? বিশ্বের অনেকে বাণিজ্যিক কারণে চীনা ভাষাও শিখছেন। আগে কেবল পণ্ডিতরা শিখতেন, এখন শিখছেন অনেক সাধারণ মানুষও। জাপানিজ, কোরিয়ান ভাষা শেখার পেছনেও বাণিজ্যিক ও কর্মসংস্থান বিষয়ক ঘটনা রয়েছে। হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির আধিপত্যও এখানে প্রাসঙ্গিক। সেই তুলনায় বাংলার বাজার কেন জমছে না এ প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। ইতিহাসে ভাষাকে একঘরে হয়ে যাওয়ার বহু তথ্য রয়েছে। সময়-অসময়ে বিভিন্ন ভাষা নেতিয়ে পড়া বা হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস প্রায় একই। কারও কারও মানতে কষ্ট হয়, ভাষার সঙ্গে রুটি-রুজিসহ কর্মজগতের বিশাল সম্পর্কের কথা। মানুষ অজস্র ভাষা সৃষ্টি করতে পারে। আবার পারে অপব্যবহারে, খামখেয়ালিতে ভাষার সর্বনাশ করতেও। কোনো ভাষাকে শক্তিধর রাখতে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক পদক্ষেপ দরকার। বিকৃতি আর শক্তিহীনতার কারণে পৃথিবীর একসময়ের শক্তিধর ভাষাগুলোর কিছু দুর্বল হয়েছে। কিছু হারিয়েই গেছে। বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভাষায় মেসিডোনিয়ায় আজ কজনে কথা বলে? পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্মপ্রণেতার অন্যতম যিশুখ্রিস্টের ভাষাও প্রায় বিলুপ্ত। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, বিশ্ববিজয়ী চেঙ্গিস খানের ভাষা দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোনো ভাষাই শুধু আবেগ, চেতনা আর ভালোবাসার ওপর ভর করে টিকে থাকে না। বাংলা ভাষা মোটেই ধনেজনে দুর্বল নয়। যথেষ্ট সমৃদ্ধÑ সামর্থ্যবান। তার ওপর বাংলার প্রতি আমাদের আবেগ, ভালোবাসা অসীম। কিন্তু খামখেয়ালি, শুধু আবেগ, ভালোবাসা, চেতনায় ভাষা বা কোনো কিছুর শেষরক্ষা হয় না। কারও আদেশ-নির্দেশেও হয় না। বিশ্বব্যাপী ইংরেজির এত চাহিদা কারও হুকুমে হয়নি। এর ভোক্তা বা গ্রহীতা দেশে দেশে। প্রয়োজনেই কোনো কিছুর ব্যবহার বাড়ে। আর ব্যবহার না হলে প্রেম-ভালোবাসাও বাড়ে না। অর্থাৎ চাহিদাই মূল বিষয়। প্রয়োজন প্রশ্নে আমরা পড়ে গেছি ‘লাভ বাংলা, ইউজ ইংরেজি’ থিওরিতে। রিজিকের তাগিদে আমরা ইংরেজিকে ব্যবহার করি। আর ভালোবাসি বাংলাকে। ঘর-সংসারের জন্য উপযুক্ত একজন, ভালোবাসার জন্য আরেকজন।
ভাষা হিসেবে বাংলাকে জীবন-জীবিকার সঙ্গে জোরালোভাবে সম্পর্কিত করার আবশ্যকতা এ কারণেই। বাংলার মধ্যে হরদম ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে কিছুটা প্রয়োজনে। কিছুটা অবচেতনে-অজান্তে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়সহ দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাসের বাংলা বইগুলো এখনো মানে অনেক পিছিয়ে। পেরে উঠছে না ইংরেজি বইয়ের সঙ্গে। নিজ ভাষার সম্মান-ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে ইংরেজির শরণাপন্ন হতেই হচ্ছে। যার জেরে ‘আপ-ডাউন’ ছাড়া দেশে এখন উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমসহ প্রায় সবদিকের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকের ছড়াছড়ি। এদিক, সেদিক, অন্যদিক কোনো দিকই আর বাদ নেই। আবার রয়েছে দু’দিক মেলানো নামও। নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, সাউথ ইস্ট, নর্দার্ন, সাউদার্ন, ইস্টার্ন নাম ঠেকানো কঠিন। তাচ্ছিল্য করারও অবস্থা নেই। তাছাড়া, বাংলা প্রতিশব্দ সৃষ্টি করতে গিয়ে কখনো কখনো ভুল প্রতিশব্দ জন্ম নিচ্ছে। বাংলা ব্যবহারে ভুলের ছড়াছড়িতে ‘আমি বড় শৃঙ্খলায় পড়ে গেছি, আপনার রান্নাটা বড় জটিল হয়েছে, আপনার জামাটা বেশ অস্থির লাগছে’ ধরনের কথায় কী বোঝাতে কী বলে ফেলা হচ্ছে? বাংলার জন্য তা আতঙ্কের। বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোর কথাকে অন্যদৃষ্টিতে দেখেন কেউ কেউ। ভাষা হিসেবে বাংলা জীবন-জীবিকার সঙ্গে কতটা সম্পর্কিত? ইংরেজিকে পাস কাটানোর কারণে বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ভালো করে বোঝা সম্ভব নয়। উল্টাপাল্টা বোঝার ঘটনাও ঘটছে। বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার কারণে ইংরেজি শিক্ষা বন্ধের পথে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইংরেজি বই পড়তে অনেকের নাকানি-চুবানি ছুটছে। এমনটি মোটেই ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে কাম্য ছিল না। স্বাধীনতার নামে শব্দ-বাক্যের যাচ্ছেতাই প্রয়োগও নিশ্চয়ই আকাক্সিক্ষত ছিল না। যার ছায়া পড়ছে কবিতা, চিত্রনাট্য, গল্পসহ সৃষ্টিশীলতার মাঝে। ‘খাইয়া ফালামু, তোরে খাইছি, ন্যাংটা করে ক্ষমতা ছাড়া করুম’ ধরনের শব্দ-বাক্য ভাষার জন্য মোটেই মর্যাদার নয়। গল্প, কবিতা, নাটক, ছায়াছবির নামকরণ-সংলাপে এগুলো দেদার ব্যবহার হচ্ছে। বাজারও পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। যার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে ভাষাকে কদাকার করে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলার শব্দ ভা-ার এত দুর্বল নয় যে এগুলোর বিকল্প বা প্রতিশব্দ নেই। এ নোংরামি বছরের পর বছর ধরে চলছে আমাদের জায়গার নামকরণেও। মৌজা, সিএস, আরএস, কাগজে-কলমে, সাইনবোর্ডে বোদা বাংলাদেশের একটি প্রশাসনিক এলাকা। অথচ এ নাম বা শব্দটি কেবল অসুন্দর নয়, অশ্লীলও। কঠিন এ বাস্তবতায় জায়গাটির নাম পরিবর্তনের দাবি উঠেছে অনেকবার। কিন্তু, দাবি জোরালো হয়নি। তবে, ‘মানুষমারা’ জায়গাকে ‘মানুষগড়া’ করার দৃষ্টান্ত আছে। দশ কাজের এক কাজের মতো তা করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। নীলফামারী সদরের ‘মানুষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর নাম পাল্টে নতুন নামকরণ হয়েছে ‘মানুষগড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এ মর্মে প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে শুধু স্কুল নয়, পাল্টে গেল জায়গাটির নামও। এই নাম নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহলের আপত্তি অনেক দিনের। চিত্ত-পিত্ত দুটোই পুড়ছিল তাদের। অবশেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা আমলে নিয়ে বিশ্রি নামটি পাল্টে দিয়েছে। বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রাম এবং অসংখ্য জায়গার মধ্যে ‘মানুষমারা’র চেয়েও উচ্চারণ অযোগ্য বহু নাম রয়েছে। কোনো কোনোটি ভদ্র-শিক্ষিত কারও সামনে উচ্চারণ করা কষ্টকর-লজ্জাকর। রুচিতে বাধলেও নামগুলো দলিল-মৌজা, খতিয়ান এমনকি বইপত্রসহ মুদ্রণে অটুট থাকছে।
কুত্তামারা, সোনাডাংগা, ছাগীপাড়া স্পষ্ট উচ্চারণও বিব্রতকর। হাঁটুভাঙ্গা, ভেড়ামারা, ঘোড়ামারা, ঠেঙ্গামারা, ছাগীপাড়া, ছেঙ্গারচর, কাউয়ারচর, ফাজিলপুর, ভুয়াপুর, ভুরুঙ্গামারী, ধরি কিলা, বলদপুর ধরনের নাম হজম করতে হয় বাধ্য হয়ে। যতই বলা হোক, নামে কিছু যায় আসে না। আসলে নামে অনেক কিছুই যায় আসে। নামটি অবশ্যই একটি ভাষা। এ ভাষাটির মর্যাদা-সৌন্দর্য কি ভাবতে নেই?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ) এ এম এ কবীর প্রাদেশিক সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব এ কিউ আনসারিকে যে প্রতিবেদন (ইংরেজিতে লিখিত) প্রেরণ করেন, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলায় সংক্ষেপে ভাষান্তর করা হলো :
প্রতিবেদনের বিষয় : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ শহীদ দিবস উদযাপন
১. অন্যান্য বছরের মতো এবারও বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সম্মিলিতভাবে শহীদ দিবস পালন করছে। বৃহৎ কলেবরে যথারীতি ঢাকাতেই অনুষ্ঠানগুলো হয়েছে, বয়োজ্যেষ্ঠরা সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেছেন।
২. পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ১২ জানুয়ারি ১৯৬১ পার্টির কর্মীদের জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে, তাতে শহীদ দিবস উদযাপনের সময় নিম্নবর্ণিত দাবিনামা পেশ করার নির্দেশ দেওয়া হয় :
ক. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন
খ. সংসদীয় সরকার
গ. শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ভাষা
ঘ. ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন
ঙ. শহীদ মিনার নির্মাণ সমাপ্তকরণ
সরকারের বিরোধিতার পরও যদি জনগণকে সংঘবদ্ধ করে সম্মিলিতভাবে শহীদ দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া যায় তাহলে এটি সফল প্রতিরোধ দিবস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে প্রজ্ঞাপনে পরামর্শ দেওয়া হয়। পার্টির ঢাকা জেলা সাংগঠনিক কমিটিও একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ছাত্রদের মাধ্যমে সরকারের কাছে পেশ করার জন্য তিনটি দাবিনামার উল্লেখ করেছে :
ক. ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা
খ. শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা
গ. উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে সব দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা চালু করা।
৩. উল্লেখ করা যেতে পারে, ১ জানুয়ারি ১৯৬১ নারায়ণগঞ্জ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যথাবিহিত মর্যাদার সঙ্গে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ছাত্রদের কাঁধে না চাপিয়ে যুবক এবং জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
৪. ইস্ট পাকিস্তান ইয়ুথ লিগের কর্মীরা ২৭ জানুয়ারি ১৯৬১ শহীদ দিবস মর্যাদার সঙ্গে পালনের উদ্দেশ্যে একটি গোপন বৈঠক করেছেন। তারা শহীদ মিনার সাজানোর জন্য ছাত্রদের কাছে আবেদন জানান এবং বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশের দাবিও করেন।
৫. ক্রোড়পত্র প্রকাশের জন্য সংবাদপত্রের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তবে ‘ইত্তেফাক’ ও ‘সংবাদ’ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে সংবাদ অসমাপ্ত শহীদ মিনারের ছবিও মুদ্রণ করে। পাকিস্তান অবজার্ভার, ইত্তেফাক এবং সংবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস বন্ধ রাখলেও পরদিনের পত্রিকা ছাপার আয়োজন করে এবং যথারীতি পত্রিকা বেরোয়।
৬. ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ডাকসুতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মূলত প্রধান পদসমূহ দখল করে আছে। তারা এবং বিভিন্ন হলে তাদের সমর্থকরা শহীদ দিবস পালনে প্রস্তুতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
৭. ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্স ইউনিয়ন (এপসু) ১ ফেব্রুয়ারি এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে শহীদ দিবসের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করে। সব হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জেনারেল সেক্রেটারি এবং ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতাদের নিয়ে আরও একটি বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়; প্যামফ্লেট ও পোস্টার মুদ্রণ, প্রভাতফেরি বের করা ও শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। শহীদ মিনারের কাজ সম্পন্ন করার জন্য ভাইস চ্যান্সেলরকে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করার দাবি জানানো হবে এবং সন্ধ্যায় উদ্যোক্তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন।
৮. যথারীতি ছাত্র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ এপসুর নেত্রী জাহান আরা আকতারের (তিনি তখন ডাকসুর ভিপি) সভাপতিত্বে ডাকসু অফিসে বৈঠক হয়। যদি এপসুই সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা ডানপন্থি সংগঠন এনএসএফ, এসএফ এবং ইপিএসএল প্রতিনিধিদেরও আমন্ত্রণ জানান। যথাযথভাবে শহীদ দিবস পালনের জন্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ভিপি ও জিএস-এর স্বাক্ষরে বিবৃতি প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। তাতে ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা, শহীদ মিনার নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা ও প্রশাসনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার চালুর দাবি জানানো হবে। প্রভাতফেরি সংগঠিত করাসহ শহীদ দিবসের বিস্তারিত কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। পরদিন ৯.২.৬১ তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। মুদ্রিত লিফলেট ছড়িয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। জগন্নাথ কলেজ, কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গেট, ঢাকা হলের অডিটোরিয়ামে পোস্টার সেঁটে দেওয়া হয়। কিছু বে-নামা পোস্টারও দেখা যায়। রমনা এলাকায় ন্যাশনাল ব্যাংকের দেয়ালে সাঁটানো পোস্টার দেখা যায়।
৯. কর্মসূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা ভোরে স্ব-স্ব হলে জমায়েত হন, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের জন্য মোনাজাত করে যার যার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ইকবাল হল, আবদুর রহমান খান হল এবং জগন্নাথ কলেজ কম্পাউন্ডে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়।
তারপর তারা কালোব্যাজ ধারণ করে নগ্নপদে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আজিমপুর গোরস্তানে গমন করে। কালোব্যাজে এবং সাদা কাপড়ে লেখা ছিল ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’ এবং ‘একুশে ফেব্রুয়ারি জিন্দাবাদ’।
প্রভাফেরিতে আসার পথে শিক্ষার্থীরা সজোরে নিচের সেøাগানগুলো দেন :
১. ২১ ফেব্রুয়ারি জিন্দাবাদ
২. শহীদ স্মৃতি অমর হোক
৩. রোমান হরফে বাংলা লেখা চলবে না
৪. ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা করো
৫. শহীদ মনুমেন্ট তৈরি করো
৬. ছাত্র-জনতা এক হও ৭. ধোঁকাবাজি চলবে না
১০. আজিমপুর কবরস্থানে পৌঁছে তারা বরকত ও সালামের কবরে পুষ্পস্তবক ও পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণে তারা নিহত হন। বাঁশের খুঁটি গেড়ে লাল কাগজে তাতে টানানো পোস্টারে লেখা হয়েছে :
‘হে আমার দেশ, বন্যার মতো, প্রচন্ড অভিজ্ঞতার পলিমাটিকে সরিয়ে এনে একটি চেতনাকে উর্বর করেছি এখানে আমাদের মৃত্যু ও জীবনের সমাপ্তি।’
ছাত্রদের রেখে যাওয়া অন্য পোস্টারে লেখা হয়েছে :
‘আমার ভাষা বাংলা, আমি বাঙ্গালী, এই মহান বার্তা নিয়ে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল বঙ্গজননীর সেই শহীদ প্রিয় সন্তান।’
অন্য একটিতে লেখা হয়েছে :
‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করেছে ভাষা বাঁচাবার তরে, আজিকে স্মরিও তারে।’
১১. কবরস্থান থেকে ১০০ ছাত্রীসহ ৩০০ শিক্ষার্থীর দুটি সিঙ্গেল লাইন মিছিল ৭টা ৪৫ মিনিটে শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যায়, তারা কালো পতাকা বহন করেন এবং প্রচলিত কিছু সেøাগান দেন। একটি কালো ব্যানারে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস সরকারি ছুটি ঘোষণা, শহীদ মিনার নির্মাণ সমাপ্ত করা এবং সর্বস্তরে বাংলা চালুর দাবি মুদ্রিত ছিল। অন্যটিতে শহীদ স্মৃতি অমর হোক। প্রথমটি বহন করেছেন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা, দ্বিতীয়টি ঢাকা হলের ছাত্ররা।’
১২. মিছিল ধীরে ধীরে পিলখানা রোড, ফুলার রোড, নীলক্ষেত রোড, ময়মনসিংহ রোড, ওল্ড গভর্নমেন্ট হাউজ রোড, আবদুল গণি রোড, জিন্নাহ অ্যাভিনিউ, রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টার রোড, সেক্রেটারিয়েট রোড (ঢাকা মেডিকেল কলেজের আগে পর্যন্ত) প্রদক্ষিণ করে সকাল ১০টায় মেডিকেল কলেজ গেটের কাছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ হয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে মিছিলকারীরা পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন এবং সেখানে জড়ো হতে থাকেন।
সমাবেশের সামনে বক্তৃতা দেন ঢাকা হল ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তাহের উদ্দিন ঠাকুর (এপসু), তিনি ভবিষ্যতেও এই দিনটি উদযাপনের আহ্বান জানান। পুলিশের গুলিতে নিহত হন বরকত, তার বাবার প্রেরিত বার্তা পড়ে শোনান এ কে এম জিয় উদ্দিন (এপসু)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন (ডাকসু) সহসভাপতি জাহান আরা আকতার সিদ্ধান্তসমূহ (দাবিনামা) পাঠ করে শোনান।
ক. শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা
খ. ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা
গ. জাতীয় জীবন ও প্রশাসনের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন
ঘ. বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিতে বাংলা একাডেমির কার্যক্রম জোরদার করা।
সোয়া ১০টার পর থেকে মিছিলে লোক কমতে থাকে।
১৩. ফুল দিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সাজানো হয়। একটি বড় কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। মিনারের মেঝে কালো কাপড়ে ঢাকা থাকে। লাল কাগজের পোস্টারে দাবিনামা লেখা হয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে ভাষা দিবসের গুরুত্ব নিয়ে লেখা রচনা দেয়ালপত্র স্থাপন করা হয়। এগুলো হচ্ছে :
ক. চতুষ্কোণ : ঢাকা হল ইউনিয়ন
খ. শিখা : ফজলুল হক মুসলিম হল ইউনিয়ন
গ. পদক্ষেপ : ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইউনিয়ন
ঘ. রক্ত অক্ষর : সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়ন
১৪. শহীদ দিবস উদযাপনে যেসব ছাত্র নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা হচ্ছেন :
১. বদরুল হক (এপসু) ইকবাল হল
২. মওদুদ আহমদ (পিএসএফ) ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
৩. তাহের উদ্দিন ঠাকুর (এপসু) সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা হল ইউনিয়ন
৪. বীরেন্দ্রনাথ হালদার (এপসু সমর্থক) সহসভাপতি জগন্নাথ হল ইউনিয়ন
৫. এ কে এম জিয়া উদ্দিন (এপসু) ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়
৬. অমূল্য কুমার রায় (এপসু সমর্থক) সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু
৭. জাহান আরা আকতার (এপসু সমর্থক) সহসভাপতি, ডাকসু
৮. এ জেড এনায়েত উল্লাহ খান (এপসু)
৯. আবদুল লতিফ মল্লিক, মেডিকেল কলেজ
১০. জাহাঙ্গির খালিদ (এপসু সমর্থক) সহসভাপতি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
১১. আমিনুল ইসলাম (এপসু) সাবেক সহসভাপতি, ডাকসু
১২. আশরাফ উদ্দিন মঘবুল (এপসু) সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু
১৩. এ এন এম শহীদ ওরফে শহীদ সিং (এপসু) সহসভাপতি, ঢাকা হল।
এ আর ইউসুফ একটি মিছিলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসেন।
১৫. এ ছাড়া বাইরের যারা এসেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন : কাজী জহিরুল হক, আবদুর রহমান, মিজানুর রহমান, আবদুর রশীদ, শামছুল আরেফিন, শাহ আজিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ (অধ্যাপক জগন্নাথ কলেজ) এবং আনোয়ার জাহিদ।
১৬. বিকেলে বাংলা একাডেমি, কার্জন হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল, জগন্নাথ হল এবং আরও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়।
১৭. বাংলা একাডেমির আয়োজনে একাডেমি প্রাঙ্গণে বিকেল ৩:৩০ থেকে ৫টার মধ্যে অনুষ্ঠিত সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডক্টর সৈয়দ আলী আহসান, সাহিত্যমোদী প্রায় ৬০ জন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। বিশিষ্টজনদের মধ্যে বক্তৃতা করেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী, অধ্যাপক হাসান জামান, অধ্যাপক আবুল কাশেম ও রওশন আরা বেগম। সভাপতি বলেন, যে ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া হয়েছে, সে ভাষার সমৃদ্ধি ঘটাতে হবে।
১৮. কার্জন হলে বহুল উপস্থিতিতে ডাকসুর একটি সভায় সভাপতিত্ব করেন ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন। ভাইস চ্যান্সেলরও এতে উপস্থিত ছিলেন। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান (নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সদস্য), সাবেক মন্ত্রী মাহমুদ আলী (নিষিদ্ধ ন্যাপের সদস্য) এবং আরও কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা উপস্থিত ছিলেন।
জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিত গুহ, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামন, ডক্টর জি সি দেব, বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর নুরুল মোমেন বক্তব্য দেন। তাদের দাবিনামায় তিনটি অতিরিক্ত বিষয় যোগ হয় :
ক. বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য বাংলা একাডেমিকে সক্রিয় করা।
খ. রোমান হরফে বাংলা চালুর চেষ্টা কিংবা অন্য ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা সহ্য করা হবে না।
গ. পুলিশের গুলিতে নিহতদের কবর রাষ্ট্রীয় খরচে পাকা করা।
গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহে ব্যবহৃত ভাষা নিয়ে ডক্টর কাজী মোতাহের হোসেন আপত্তি জানালে হাত তুলে উপস্থিত অংশগ্রহণকারীরা সমর্থন জানান। বাংলা ভাষাও এই দিবসের প্রশংসা করে গীত সংগীত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।
১৯. সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন প্রভোস্ট ডক্টর এম হক এবং ফজলুল হক ও জগন্নাথ হলের সভায় সভাপতি ছিলেন সংশ্লিষ্ট হল ইউনিয়নের সহসভাপতি। জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের লেকচার গ্যালারির অনুষ্ঠানে কমিনিউস্ট পার্টির সদস্য এবং সাবেক নিরাপত্তা কারাবন্দি রনেশ দাশ গুপ্ত। তিনি সভায় সভাপতিত্ব করেন। তিনি ছিলেন দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক।
২০. কিছুসংখ্যক ছাত্র সন্ধ্যাবেলায় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বালিত করে সম্মান জানান।
২১. ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ যে কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়েছিল তাতে কালো পতাকা উত্তোলন, মিছিল, সেøাগান এবং শহীদ মিনারের সভা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। স্লোগানগুলো নতুন কিছু নয়। গত বছরও তারা একই স্লোগান দিয়েছেন। গত বছরও মিছিল হয়েছে কিন্তু তা শহীদ মিনার থেকে আজিমপুর কবরস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এবার অনেক বড় আকারে মিছিল হয়েছে এবং সচিবালয়ের সামনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা রাস্তায়ও মিছিল চলেছে।
২২. পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত সুপারিনটেনডেন্ট শহীদ মিনারে মিছিল ও মিটিং সামরিক আইনের বরখেলাপ কি না এ নিয়ে পাবলিক প্রসিকিউটরের মতামত গ্রহণ করেছেন। এ মতামত তেমন কোনো কাজে আসেনি।
২৩. ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ ‘দিবস’ পালন-সংক্রান্ত সরকারের নীতিমালা জারি হয়েছে। কোনো রাজনীতিবিদের সক্রিয় অনুপ্রেরণা বা নাশকতামূলক কাজে উৎসাহ প্রদানের প্রমাণ না পাওয়া গেলেও আমি মনে করি শহীদ মিনারের সভায় ও মিছিলে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের নামের তালিকা ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানো দরকার, যাতে তিনি তাদের কঠোরভাবে সতর্ক করেন।
যদিও বাইরের কাউকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সভায় বা মিছিলে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি, আমরা প্রাপ্ত প্রতিবেদনগুলো আরও পরীক্ষা করব। সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী কেউ শনাক্ত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ এম এ কবির
ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ
(ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ)
পূর্ব পাকিস্তান, ঢাকা
পাবলিক প্রসিকিউটরের অভিমত
প্রেরিত কাগজপত্র দেখেছি, গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তার সঙ্গে কথাও বলেছি।
২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসের অনুষ্ঠান রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা কিছুসংখ্যক ছাত্রের উদ্যোগে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আয়োজন করা হয়েছে। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ করেছে। তবে গতকাল (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১) ছাত্রটা যে মিছিল করেছে তার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কোনো সংস্রব ছিল না। যদি মিছিলে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে না থাকে এবং তা যদি নিহতদের প্রতি তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ হয়ে তাকে তাহলে এ মিছিলকে রাজনৈতিক প্রকৃতির বলা যাবে না। আর তা যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তা মার্শাল ল রেগুলেশন নম্বর ৫৫ এ-র আওতায় আসবে।
পুলিশ রিপোর্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে, শহীদ মিনারের পাদদেশে একটি সভা হয়েছে, তবে সভায় কেউ সভাপতিত্ব করেননি, কিন্তু জনব্যবহার্য স্থানে একটি সভা হয়েছে, যা বেআইনি এবং এমএলআর ৫৫ এ-র পরিপন্থী।
মুদ্রিত লিফলেট প্রসঙ্গে বলা যায়, এতে শহীদ দিবস উদযাপনের কর্মসূচি লিপিবদ্ধ ছিল। তাদের কিছু অভিযোগ প্রশমনের দাবিদাওয়া এতে ছিল।
মো. আবদুল আলীম
পাবলিক প্রসিকিউটর, ঢাকা
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১
পাদটীকা :
এ এম এ কবীর হচ্ছেন পরবর্তীকালের পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল। তার জন্ম ২৫ নভেম্বর ১৯১১, মৃত্যু ১০ জানুয়ারি ১৯৯৬। তিনি ১৯৩২ সালের ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের বেঙ্গল ক্যাডারে যোগ দেন। ঘাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৯১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তাদকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের মধ্যে মওদুদ আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর এবং এ জেড এনায়েতুল্লাহ খান পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
লেখক : সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট
আবদুল হাকিম জন্মেছিলেন ১৬২০ সালে। মারা যান ১৬৯০ সালে। লিখে যান ৮টি কাব্যগ্রন্থ। এর একটি ‘নূরনামা কাব্য’। সেখানে তিনি লিখেন, ‘যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ অন্যদিকে বাংলা পঞ্চকবির একজন অতুল প্রসাদ সেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৭১ সালে। মারা যান ১৯৩৪ সালে। এ সময়ের মধ্যে গীতিকার, গায়ক, কবি অতুল প্রসাদ লিখে যান অসংখ্য গান। বাংলা সংগীত জগতে, অন্যান্য গানের সঙ্গে আমরা পাই সেই দুর্লভ গানÑ ‘মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা’। এরপর আসে পাকিস্তান আমলের নির্মম অত্যাচারের ২৪ বছর।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ। ৯ দিনের সফরে পূর্ববঙ্গ আসেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে, যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ইংরেজিতে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং অন্য কোনো ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।’
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল ভারত-ভাগের আগেই। অবাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদ ও অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবীরা বলছিলেন উর্দু ভাষার কথা। অন্যদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও এনামুল হকের মতো বাঙালি বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনতা বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আকাক্সক্ষা অনেক আগেই সৃষ্টি হয়েছিল। এই ধারাবাহিকতারই একটা অংশ হচ্ছে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, বেলা ১১টা ৩০ মিনিট। ১৪৪ ধারা মানেননি ছাত্র-জনতা। ভাষার দাবিতে রাজপথে খণ্ড খণ্ড মিছিল। লাঠি চালায় পুলিশ। আরও বেগবান হয় আন্দোলন, যোগ দেন সাধারণ মানুষ। সবার মুখে একটিই দাবিÑ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সেই মিছিল ঠেকাতে চলল গুলি। রাজপথে লুটিয়ে পড়লেনÑ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই। ২২ ফেব্রুয়ারি হত্যার প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ মিছিল। দাবি ওঠে শহীদের স্মৃতি সংরক্ষণের। মাত্র এক দিনের প্রস্তুতিতে তৈরি করা হয় শহীদ মিনার। এতে সরকার ভীত হয়ে পড়ে। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ভেঙে ফেলে শহীদ মিনার।
বর্তমানে আমরা যে শহীদ মিনার দেখছি, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এই শহীদ মিনারের স্থপতি হামিদুর রহমান। অমর একুশের গান লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী/ আমি কি ভুলিতে পারি’Ñ এই অবিনশ^র গানের প্রথম সুরকার আবদুল লতিফ। পরে সুরারোপ করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ১৯৫৪ সাল থেকে, যা আজও চলছে।
মাতৃভাষার এই আন্দোলনেই বীজ বপন হয়েছিল স্বাধীনতার। পাকিস্তান ভেঙে জন্ম নিল পৃথিবীর বুকে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
পার হয়েছে সুদীর্ঘকাল। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩। এই ৫২ বছরে, অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। বিদেশে থাকার কারণে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, তার দুই কন্যা। তবু থেমে থাকেনি নরঘাতকের দল। এর পরও চলে হত্যাকা-। জাতীয় চার নেতাসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। দীর্ঘকাল সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হন বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ। একই সঙ্গে চলে দেশকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র।
আবার ফিরে আসে নবজাগরণের ইতিহাস। জেগে ওঠে সভ্যতা। দেশের হাল ধরেন স্বাধীনতার সেই মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। তিনিই আজ ১৪ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তবু কি দুখিনী বাংলার সাধারণ মানুষের ভাগ্যের বদল হয়েছে? কমেছে কি শাসন-শোষণের পাহাড়সম বৈষম্য?
আমাদের রক্তে নব উদ্যমে কথা বলুক, একুশের চেতনা। মানুষ যেন মানুষের জন্য হয়। বাঙালি চেতনায় জেগে উঠুক বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করা কালজয়ী গান ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’-এর স্রষ্টা কবি ও গীতিকার গোবিন্দ হালদার ১৯৩০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার রচিত প্রথম কবিতা ‘আর কতদিন’। তিনি প্রায় সাড়ে তিন হাজার কবিতা ও গান লিখেছেন। তার প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দূর দিগন্ত’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারে সম্প্রচারিত তার লেখা গানসমূহ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করত। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার রচিত উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘লেফট রাইট লেফট রাইট’, ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘চলো বীর সৈনিক’ ও ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার বাংলার মাটি’ অন্যতম। বন্ধু কামাল আহমেদের অনুপ্রেরণায় এবং উৎসাহে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর গান রচনা করেন। কামাল আহমেদ তাকে স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্ণধার কামাল লোহানীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তার হাতে ১৫টি গানের একটি খাতা দেন। এ গানগুলোর মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রথম প্রচারিত হয় সমর দাসের সুরারোপিত ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গানটি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই তার আরও কিছু গান স্বাধীন বাংলা বেতারে সম্প্রচারিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পাওয়ার পরপরই সন্ধ্যায় ১৬ ডিসেম্বর প্রচারিত হয়Ñ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না’ গানটি, যা সুর দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদ এবং মূল কণ্ঠ দিয়েছিলেন স্বপ্না রায়, আপেল মাহমুদ ও সহশিল্পীরা। গোবিন্দ হালদার ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষী জনগণের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার দিন। তাদের চক্ষুষ্মান হওয়ার দিন। বাঙালিরা প্রথমে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতির দাবিতে সোচ্চার হয় এ উপলব্ধিতে যে ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই নিজের ভাষা-সাহিত্য, সংস্কৃতি-কৃষ্টিও ঐতেহ্যের বাঞ্ছিত বিকাশ ছাড়া জাতীয় পরিচয় নির্মল ও নিরাপদ নয়। কোনো জাতিকে পরাভূত করার প্রকৃষ্ট কৌশল হলো তার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে দুর্বল করা বা তার আত্মমর্যাদাবোধকে খর্ব করা। এ ভারতবর্ষের রাষ্ট্রযন্ত্রে মোগল আমলে ফার্সি, ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি এবং তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আমলে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস শুরু হয়। আর সেই থেকে বাঙালি জাতির চিন্তা-চেতনায় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় চলে আসে। মহান ভাষা আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন ও এর কার্যক্রমের মূল সুর বা বাণী বা দাবিই ছিল বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। কেননা বাংলা ভাষার যথাযথ স্বীকৃতি ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের মৌল উদ্দেশ্যই হবে বাংলাভাষী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন। এটা বাঙালি জাতির জাত্যাভিমানের প্রতি প্রকাশ্য আঘাত। এটা মেনে নেওয়া মানে বাঙালির স্বাধিকার চেতনার মর্মমূলে কুঠারাঘাত এবং প্রকারান্তরে আবহমানকালের সেই পরাধীন পরিবেশে বসবাস। ভাষা আন্দোলনের সৈনিকরা সমগ্র দেশবাসীকে এ সত্যটি উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে সাতচল্লিশে ভারত বিভাগ ও ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভের পর পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে মাতৃভাষা, বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা সংগত কারণেই সোচ্চার হয়ে ওঠে। আটচল্লিশের মার্চে জিন্নাহর ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’- এ উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী বছরগুলোতে বাংলা ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং তাদের প্রচারণা প্রয়াসে পূর্ববঙ্গের সচেতন ছাত্র-শিক্ষক-জনতা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার প্রশ্নে আপসহীন মনোভাব গ্রহণ করে। তাদের দৃঢ়চিত্ত প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা বাহান্নর ফেব্রুয়ারি মাসের দিনগুলোতে বাংলা ভাষা সংগ্রাম উত্তাল আকার ধারণ করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বুলেটের আঘাতে বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে ভাষা শহীদরা সেই সংগ্রামী প্রত্যয় ও প্রেরণাকে বেগবান করেছিলেন।
কোনো কোনো বিশেষ ঘটনা, কোনো কোনো আত্মত্যাগ আদর্শগত কারণে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যবহ রূপ লাভ করতে পারে। সেই আত্মত্যাগ যদি হয়ে থাকে মহত্তম কোনো আদর্শের প্রশ্নে, সেই বিশেষ ঘটনায় যদি ঘটে অনির্বাণ আকাক্সক্ষার অয়োময় প্রত্যয়ের প্রতিফলন। স্থান-কাল-পাত্রের সীমানা পেরিয়ে সেই ঘটনা ভিন্নতর প্রেক্ষাপটেও নতুন নতুন চেতনার জন্মদাত্রী হিসেবে প্রতিভাত হয়ে থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জীবনে তেমনি এক অসীম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যা আমাদের সার্বিক জাগরণের উৎসমুখও। একুশের চেতনা বারংবার সংকটে দিক-নির্দেশক, বিভ্রান্তিতে মোহজাল ছিন্নকারী এবং আপাত বন্ধ্যত্বে সৃষ্টিমুখরতার দ্যোতক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
সাত দশক আগে ১৯৫২-র একুশ ফেব্রুয়ারিতে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের যে প্রেক্ষাপট নির্মিত হয় তার তাৎক্ষণিক তাৎপর্য মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সীমবদ্ধ ছিল। কিন্তু কালপরিক্রমায় এর তাৎপর্যের পরিধি বিস্তৃত হয়। ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানে এক নতুন প্রত্যয় ও প্রতীতি দান করে। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে একুশের চেতনাই ছিল প্রাণশক্তি।
একুশের চেতনা যে সাংস্কৃতিক চেতনার জন্ম দেয় তার মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশমুখী আন্দোলনের একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও ছিল। একুশের চেতনা এমনই প্রগতিশীল ছিল, এমনই প্রগাঢ় ছিল যে যার জন্য স্বাধিকার আদায়ের সংগাম তীব্রতর হয়েছিল। একুশের ভাবধারা প্রথম দিকে ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীকালে তাতে দেশের আপামর জনসাধারণও উদ্বুদ্ধ হয় সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। একুশের মূল্যবোধ যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, স্বৈরাচারের পতনকার্যে একতাবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করতে, নিপীড়িত জনগণের পাশে এসে দাঁড়াতে এবং সর্বোপরি মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে শিক্ষা দেয়। একুশের চেতনা দেশের সাহিত্যাঙ্গনেও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জাতীয়তাবোধের উচ্চারণে সমৃদ্ধ সাহিত্যের পাশাপাশি গণমুখী সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন দেশের কবি-সাহিত্যিকরা। সাহিত্যধারায় সূচিত হয় এক নবযুগ।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও তাই একুশের চেতনা গোটা জাতির দীর্ঘ পরাধীনতার অভিশাপপ্রসূত দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে আত্মসম্ভ্রমবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে গঠনমূলক প্রতীতির জন্ম দিয়েছিল। এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দেওয়ার মধ্যেই একুশের চেতনার সার্থক স্বীকৃতি। স্বাধীনতার স্পর্শে জাতীয় জীবনে নৈতিকতা, পরস্পর শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা, বলিষ্ঠ জাতীয় চরিত্র চেতনার বিকাশ এবং দারিদ্র্য মোচনের দ্বারা স্বনির্ভরশীলতা অর্জনের মধ্যেই একুশের প্রকৃত প্রত্যয় নিহিত।
বাহান্ন সালে ভাষা আন্দোলনের ব্যানারে চলেছিল মূলত বাঙালির আত্মরক্ষার সংগ্রাম আর স্বাধীনতার লাভের পর তা প্রতিভাত হয় আত্মবুদ্ধি ও চেতনা প্রসারের। আবেগের তীব্রতায় একুশের চেতনা স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে যেভাবে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত করেছিল সবাইকে সেখানে মৃত্যুও তুচ্ছ ছিল। স্বাধীনতা-উত্তরকালে আজ সেই চেতনা আমাদের তা সম্মানসহকারে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায় এবং যার জন্য এখন নিছক আবেগ নয়, সার্বিক উন্নয়ন অভীপ্সায় আজ সুষ্ঠু গাণিতিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। সমগ্র ও বিপুলভাবে বাঁচার প্রয়োজনে সমষ্টিগত পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ ও নিরুদ্ধ সাংস্কৃতিক প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ প্রয়োজন।
একুশের চেতনা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জ্ঞানের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি সম্মানবোধকে জাগিয়ে তুলেছিল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সেই মূল্যবোধের বলিষ্ঠ বিকাশ প্রত্যাশিত রয়ে গেছে আজও। তবে সেই মূল্যবোধের বাঞ্ছিত বিকাশের সুযোগ সুদূর পরাহত নয়। একুশের চেতনা কালপরিক্রমায় সেই মনোভঙ্গি ও দূরদৃষ্টিকে করে সবল ও স্বচ্ছ। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে বাঞ্ছিত লক্ষ্যে আজ এগিয়ে সবাই। এটি একুশের চেতনার অবিনশ্বর অভিযাত্রা।
দেশের বিপুল জনসমষ্টিকে মানবসম্পদে রূপান্তরের মধ্যেই সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তির উপায় নিহিত। স্বনির্ভর অর্থনীতি উৎসারিত আত্মমর্যাদাবোধ জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অন্যতম রক্ষাকবচ। সে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে মানব সম্পদের উন্নয়ন আবশ্যক। বলিষ্ঠ চরিত্র চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে এটি এক মুখ্য বিবেচ্য বিষয়। নৈতিকতা, দেশপ্রেম এবং আত্মমর্যাদাবোধের ভিত্তি রচনা করে যে সব চরিত্রচেতনা তার বলিষ্ঠ ও বাঞ্ছিত বিকাশ প্রয়োজন। একুশের চেতনা সেই আকাক্সক্ষাকে অর্থবহ রূপদান করতে পারে। ইতিহাসের বিচিত্র পরিক্রমণে কখনো মানুষের নেতৃত্বে যুগের পরিবর্তন ঘটে, কখনো বা ঘটনার নেতৃত্বাধীনে মানুষ পরিবর্তিত মূল্যবোধে সংস্কৃত হয়ে ওঠে। একুশের চেতনা এ মুহূর্তে দেশবাসীকে সেই প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে এবং জাগাতে পারে শক্তি ও সাহস।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতার মৃত্যুতে গভীর ক্ষোভে তার কালো আচকান কাঁচি দিয়ে কেটে তার পোশাকের সঙ্গে সেঁটে শোকের ও প্রতিবাদের ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন। আরও পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, সেই ১৯২৬ সাল থেকে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী হবে কিংবা পূর্ববাংলার জনগণের মুখের ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি প্রদান নিয়ে তার সমসাময়িক বিজ্ঞজনদের মতো ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহও চিন্তিত ছিলেন, যুক্তি ও সক্রিয় সজ্ঞানে সোচ্চার ছিলেন। বাহান্নর বাষা আন্দোলন কোনো একটি সাধারণ বা সাময়িক ঘটনা ছিল না; এর ছিল সুদীর্ঘ এক পটভূমি। তারও আগে আমরা দেখি ১৯১৮ সালে খানবাহাদুর আহছানউল্লাহ (১৮৭৩-১৯৬৫) বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলার যথার্থ স্বীকৃতি, বিশেষ করে সমকালীন কিছু বিদ্বজ্জনের উর্দুর প্রতি প্রকাশ্য ওকালতির বিরুদ্ধে তিনি আপনার অভিমতকে যুক্তি সহকারে উপস্থাপন করেছিলেন।
বাহান্ন পর্যন্ত একুশ ছিল আত্মত্যাগ-পর্বের প্রস্তুতিপর্ব; আর বাহান্নর পরের একুশগুলো ছিল স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্দীপ্ত হওয়ার পথে প্রেরণার উৎস। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পূরণ হলে একুশের আন্দোলন স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে নিবেদিত হয়। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনে, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও নবজাগরণের প্রতিটি মাইলফলকে ভাষা আন্দোলনের চেতনাই বারবার প্রেরণা, দুরন্ত সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে বাঙালি জাতিকে। এসব প্রয়াস-প্রচেষ্টার পথ ধরেই চূড়ান্তভাবে একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরে মহান বিজয় সূচিত হয়েছে। জন্ম নিয়েছে ভাষার নামে একটি দেশ, ‘বাংলাদেশ’। পৃথিবীতে এমনভাবে কোনো জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি একমাত্র ব্যতিক্রম। চীনা জাতির ইতিহাসে ৪ মে যেমন, একুশে ফেব্রুয়ারি তেমন বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার চিন্তচেতনা জাগ্রত হওয়ার দিন।
স্বাধীনতা লাভের পরও একুশ বিভিন্ন সংকট সন্ধিক্ষণে, আপাত বন্ধ্যত্বের কালে জাতিকে জাগ্রত করতে চেতনাদাত্রী হিসেবে কাজ করেছে। একুশের বইমেলা সে ধরনের একটি উপায়-উপলক্ষ যা বাঙালি জাতিকে এক অনবদ্য ঐক্যে সৃজনশীল সাংস্কৃতিক আবহে উদ্বুদ্ধ করে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন এখন আর কোনো একপক্ষীয় দাবি বা কর্মসূচি নয়, বাংলা ভাষা এবং এর সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধকরণ সবার সম্মিলিত প্রয়াস-প্রচেষ্টার প্রতিফলনও। একুশের বাণী জাতিকে স্বয়ম্ভর হতেও উদ্বুদ্ধ করে ‘একুশ মানে মাথা নত না করা।’
লেখক: সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান [email protected]
এই লেখার বিষয় বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্র অথচ এত ছোট পরিসরে আলোচনা দূরের কথা, উল্লেখযোগ্য প্রামাণ্যচিত্রের নামোল্লেখ করাই অসম্ভব কাজ। ফলে বর্তমান লেখায় গত অর্ধশতাব্দীকালে নির্মিত বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্রের উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ ও প্রবণতা সম্পর্কে মোটাদাগে কয়েকটি ঝটিতি মন্তব্য করে যাব।
বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্রের যাত্রা শুরু প্রবাসী সরকারের অর্থায়নে ও জহির রায়হান পরিচালিত স্টপ জেনোসাইড-এর বিপ্লবী আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে। প্রামাণ্যচিত্রটি ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্রের উল্লেখযোগ্য এবং বড় একটি অংশের কেন্দ্রীয় বিষয় মুক্তিযুদ্ধ।
স্মৃতি৭১, তাজউদ্দীন আহমদ : নিঃসঙ্গ সারথি (তানভীর মোকাম্মেল), মুক্তির গান, মুক্তির কথা (তারেক মাসুদ), নট এ পেনি নট এ গান (মকবুল চৌধুরী), স্বাধীনতা (ইয়াসমীন কবির) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য যেখানে নানা আঙ্গিক ও চরিত্রের চোখে গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরা হয়েছে। তবে ন্যারেটিভ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈচিত্র্য বেশি নয়।
সামান্য ব্যতিক্রম হিসেবে হয়তো তারেক মাসুদের মুক্তির গান-এর দ্বিতীয় পর্ব মুক্তির কথা প্রামাণ্যচিত্রটির উল্লেখ করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের যে প্রথাগত বয়ান তার বাইরে কিছুটা হলেও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করেন যেখানে-যেমন বয়স্ক নারীকে বলতে দেখা যায় যে, ‘মুক্তিযুদ্ধ কি শুধু উনারা করেছেন? আমরাও তো করেছি।’ উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের কথা।
অবশ্য মোটাদাগে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রচলিত ও প্রভুত্বকারী ন্যারেটিভের বাইরে বিকল্প বয়ান হাজির করা প্রামাণ্যচিত্র বাংলায় তেমন নেই।
একই কথা প্রযোজ্য প্রামাণ্যচিত্রের অন্যতম শক্তিশালী ধারা রাজনৈতিক প্রামাণ্যচিত্রের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রামাণ্যচিত্রের শূন্যতা দৃষ্টিকটু রকমের। রাজনৈতিক ধারার প্রামাণ্যচিত্র সংখ্যায় অল্প কেবল নয়, প্রথাগত ও মূলধারার ন্যারেটিভকে চ্যালেঞ্জ করে বা নতুন দৃষ্টিকোণ হাজির করে এমন প্রামাণ্যচিত্র হারিকেন নিয়েও খুঁজে পাওয়া কঠিন। না পাওয়ার কারণ অবশ্য কঠিন না। দেশে মিডিয়া সেন্সরশিপের যে অবস্থা তাতে রাজনৈতিক প্রামাণ্যচিত্রের এই দশা অস্বাভাবিক না। নির্মাতা মাইকেল মুর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কোনো দেশের ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম যত শক্তিশালী ও স্বাধীন, সে দেশের রাজনৈতিক প্রামাণ্যচিত্র তত বেশি শক্তিশালী।
মুক্তিযুদ্ধের বাইরে বিপন্ন প্রতিবেশ, লিঙ্গ বৈষম্য, শিশুশ্রম, জাতিগত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি নজর দেওয়া, জনপদ, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব, ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ে পক্ষাবলম্বনের, তৎপরতার, কখনো-বা ইন্টারভেনশনের কিছু প্রয়াস বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্রে পাওয়া যায়।
ফৌজিয়া খানের যে গল্পের শেষ নেই প্রামাণ্যচিত্রে নারীর চোখে নারী ও যৌনতার মতো বিষয় উঠে এসেছে কাব্যিক ভঙ্গিতে। শিশুশ্রমের অমানবিকতা উঠে এসেছে কালিঘর প্রামাণ্যচিত্রে। ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি সংবেদী দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে তানভীর মোকাম্মেলের স্বপ্নভূমি বা কর্ণফুলীর কান্নায়।
আবার কিছু প্রামাণ্যচিত্র তাদের আর্কাইভিং মূল্যের কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পাচার্য (আলমগীর কবির) প্রামাণ্যচিত্রে জয়নুল কিংবা আদমসুরত (তারেক মাসুদ)-এ চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে আমরা পাই তাদের জীবন ও সৃষ্টিকর্মসমেত। লেখকের সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে নির্মিত ইলিয়াসের খোয়ারি (শিবু কুমার শীল)-তে পাই কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে।
রিয়েলিটির ক্রিয়েটিভ ট্রিটমেন্ট বা সৃজনশীল প্রামাণ্যকরণের চমৎকার কিছু নজির বাংলা প্রামাণ্যচিত্রে হাজির থাকলেও সংখ্যাটা এত কম যে হাতে গোনা যায়। কয়েকটি উল্লেখ করছি।
মানজারে হাসীন মুরাদের আমাদের ছেলেরা প্রামাণ্যচিত্রটি নাগরিক আঙ্গিকে কিছু ছেলের জীবন-স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার নিরীক্ষাধর্মী চিত্রায়ণ করে যাতে তথ্য ও প্রমাণের নিগড় ছেড়েও হৃদয়স্পর্শী ‘চরিত্র’ হয়ে ওঠে। মুরাদের রোকেয়া প্রামাণ্যচিত্রটিও সমান্তরালে বয়ে চলা কয়েকটি ন্যারেটিভ সহযোগে, অখ- সত্যের বদলে, সত্যের বহুমাত্রিক সিনেম্যাটিক চিত্র তুলে ধরে উদ্ভাবনী বয়ানকুশলতায়। শিল্পশহর স্বপ্নলোক (শাহীন দিল রিয়াজ) এ ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণির বিভিন্ন মানুষের সৃজনশীল ও অভিনব চিত্রায়ণ ঘটেছে। প্রামাণ্যচিত্রটি যেন ফিকশনের দিগন্ত ছুঁয়ে দিতে চায়। আমাকে বলতে দাও (ফৌজিয়া খান) সদ্য কৈশোর পেরুনো মেয়েরা নারী হয়ে ওঠার কালে, শহরে ও গ্রামে যে সমাজের সম্মুখীন হয় তার নারী-দৃষ্টিকেন্দ্রিক নির্মাণ। নারীর প্রতি প্রতিকূল সমাজের বিরুদ্ধে এক ধরনের তৎপরতাও। এছাড়া রামপালের ঝলমলিয়ার সনাতন মেলাকে উপজীব্য করে নির্মিত ঝলমলিয়া (সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল) অভিনব স্বাদের সৃজনশীল এক প্রামাণ্যচিত্র।
অর্ধশতাব্দীকাল বিবেচনায় নিলে সময়টা নেহাত কম নয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এ দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্র অসাধারণ, কালজয়ী কাজ তেমন উপহার দিতে পারেনি। তাছাড়া বিষয়ে বৈচিত্র্যের পরিসর ছোট না হলেও, প্রামাণ্যচিত্রে স্টোরিটেলিং, উপস্থাপনা ও নিরীক্ষায় সৃজনশীল স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যতটা দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্রে তার উপস্থিতি এখনো বিরল।
অথচ বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্র কিন্তু ভিন্ন হতে পারত। এই উপমহাদেশে প্রথম প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের হীরালাল সেনের হাত ধরে। মানিকগঞ্জের বিবাহোৎসব এবং স্নানার্থীদের নিয়ে নির্মিত হয়েছিল প্রামাণ্যচিত্র। ৪৭-এর দেশভাগের পর এই অঞ্চলের প্রথম প্রামাণ্যচিত্র ‘ইন আওয়ার মিডস্ট’ নির্মাণ করেছিলেন নাজীর আহমেদ ১৯৪৮ সালে। এমনকি এ অঞ্চলের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র ‘সালামত’ নির্মিত হয় ১৯৫৪ সালে।
মূলধারার পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্রে প্রযোজক ও পরিবেশক পাওয়া গেলেও প্রামাণ্যচিত্রের জন্য অত্যন্ত কঠিন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে অর্থের জোগান এবং মূলত বিদেশি ফান্ড কিংবা টেলিভিশনের ওপর নির্ভর করতে হয় তাদের। এমনকি ছবি নির্মাণের পর প্রদর্শনী নিয়েও ভাবতে হয়। অর্থ জোগানের এই উৎস প্রকারান্তরে নির্মাতাদের উপস্থাপনা ও সৃজনশীল স্বাধীনতাকেও সীমিত করে ফেলে। ফলে প্রায়শ প্রামাণ্যচিত্রগুলো হয়ে ওঠে যেন নির্দিষ্ট দল, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের এজেন্ডা-তাড়িত প্রকল্প।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও কিছুদিন ধরে চলচ্চিত্র প্রযুক্তির বহুমাত্রিক উদযাপনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যোগাযোগ প্রযুক্তির পরিবর্তন ও সহজলভ্যতার কারণে বর্তমানে এমনকি মোবাইল ফোনেও হয়তো প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে ফেলার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া বিশ্বায়নের ফলে চলচ্চিত্রবিষয়ক নানা ধ্যান-ধারণাও ক্রমাগত নবায়িত হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে এসব নতুনতর ভাবনা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনা প্রামাণ্যচিত্রে নতুনতর সৃজনশীলতা আনবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা যাক।
লেখক : ফিকশন ও নন-ফিকশন লেখক, অনুবাদক
ঢাকাসহ সারা দেশে তীব্র দাবদাহ চলছে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ থাকছে না বাসা-বাড়ি, অফিস আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।
বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে একটি মহল পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টায় আছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য এসেছে। আর ওই তথ্য পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর নড়েচড়ে বসেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ শীর্ষ কর্তারা বৈঠক করেছেন। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সোমবার পুলিশের সব রেঞ্জ অফিস ও ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
বিশেষ বার্তা পেয়ে ইউনিট প্রধান, রেঞ্জ ডিআইজি ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপাররা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছে পুলিশ।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি। এরই মধ্যে যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলো নিরাপত্তার আওতায় আনা হচ্ছে। এই জন্য আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সোমবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সব ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে বিদ্যুৎ স্টেশনে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি নজরদারি বাড়াতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একটি মহল লোডশেডিংয়ের অজুহাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। যেসব এলাকায় বেশি বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তারও একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, পুলিশ সদর দপ্তরের চিঠি পাওয়ার পর আমরা বিশেষ বৈঠক করছি। এলাকায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তা সত্য। এ জন্য আমরা বেশ সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ অফিস ও স্টেশনগুলোর বিষয়ে থানার ওসিদের দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, লোডশেডিংয়ের অজুহাত তুলে বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে একটি বিশেষ মহল। প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে থানার ওসিদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন জেলার পুলিশ সুপাররা। এমনকি বাড়তি ফোর্সও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তা ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
বিদ্যুৎ অফিসের পাশাপাশি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তুলতে ৫০ থানার ওসিদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
খন্দকার গোলাম ফারুক দেশ রূপান্তরকে জানান, বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে যাতে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সে জন্য আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো বাড়তি নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে সবাইকে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎসহ যেকোনো সমস্যা নিয়ে কোন মহল যাতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে। আশা করি বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটবে না। তারপরও পুলিশ সতর্ক আছে।
সূত্র জানায়, লোডশেডিংকে পুঁজি করে কেউ যাতে অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখতে বলা হয়েছে। নির্দেশনার পর সারা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, বিদ্যুৎ অফিস, সাবস্টেশনসহ কেপিআই স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের চেয়ে বৃদ্ধি করা হয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম ও পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা সমিতি বা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকেও পুলিশকে চিঠি দিয়ে বাড়তি নিরাপত্তাও চাওয়া হয়েছে।
অবশেষে বন্ধ হয়ে গেল দেশের সর্ববৃহৎ পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। গতকাল সোমবার দুপুরে কেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কয়লা সংকটে গত ২৫ মে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট বন্ধ হয়। ২০২০ সালে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পর এবারই প্রথম কয়লা সংকটে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন বন্ধ হলো।
চীন ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগের এই বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানটিকে কয়লা ক্রয়ে ঋণ দিয়ে আসছে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি (সিএমসি)। এপ্রিল পর্যন্ত কয়লার ৩৯০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সিএমসি। পরে ১০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হলে কয়লা আমদানির এলসি খোলার শর্ত দেয় চীনা প্রতিষ্ঠান। গতকাল পর্যন্ত ৯৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এ মাসের শেষদিকে কয়লা দেশে আসার কথা রয়েছে।
কয়লার অভাবে দেশের সবচেয়ে বড় এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এক মাসে লোকসান হবে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের কারণে জনদুর্ভোগ ও কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে পুরো ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।
এদিকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের বাইরে শুধু কয়লাবাবদ পিডিবির কাছে কেন্দ্রটির বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে থাকা এ বকেয়ার টাকা পরিশোধের জন্য দফায় দফায় চিঠি দিয়েও তা পরিশোধ করা হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলার কারণেই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নিজেদের দায় অস্বীকার করে বলছে, বৈশি^ক মন্দার পরিস্থিতিতে ডলার সংকটের কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের পাশাপাশি কেন্দ্রভাড়া বাবদ প্রতি মাসে পিডিবিকে ২৪৭ কোটি টাকা দিতে হবে। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও নির্ধারিত কেন্দ্রভাড়া পরিশোধ করতে হবে পিডিবিকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্নভাবে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট করে প্রায় তিন কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছিল কেন্দ্রটি। প্রতি মাসে এর পরিমাণ ছিল ৯০ কোটি ইউনিট। গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য ছিল ৫ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৬ টাকার মতো।
প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফার প্রকৃত জানা না গেলেও নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানান, সব ধরনের ব্যয় বাদ দিয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে তাদের নিট মুনাফা হতো ৫ থেকে ৬ শতাংশ। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড়মূল্য সাড়ে ৫ টাকা এবং মুনাফা সাড়ে ৫ শতাংশ বিবেচনায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির এক মাসে মুনাফার পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। কেন্দ্রটি বন্ধ থাকায় এ মুনাফা থেকে বঞ্চিত হবে বিসিপিসিএল। এদিকে কয়লা কেনার জন্য সাড়ে ৬ শতাংশ সুদে ঋণ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। গত ছয় মাসের বেশি সময় কয়লার বিল বকেয়া থাকায় সুদের পরিমাণও বেড়ে যাবে। বাড়তি এ সুদের অর্থ বিসিপিসিএলকেই পরিশোধ করতে হবে।
বর্তমানে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ের প্রতি ইউনিটের গড়মূল্য প্রায় ১১ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও পিডিবি এ বিদ্যুৎ লোকসান দিয়ে বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করছে ৮ টাকা ১০ পয়সায়। পায়রা থেকে এক মাস বিদ্যুৎ কিনতে না পারলে পিডিবির লোকসান আরও বাড়বে।
সূত্রমতে, কয়লা দেশে পৌঁছানো এবং কেন্দ্র চালু করতে সব মিলে অন্তত এক মাসের মতো সময় লাগবে। কোনো কারণে যদি কয়লা আসতে আরও দেরি হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিশে^র সেরা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এক সুইচে চালু করার পর নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও বৈশি^ক কারণে ডলার সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। এটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। তবে এ সময়ে আমরা বসে না থেকে কেন্দ্রের মেইনটেনেন্সের কাজটি করে ফেলব, যাতে দীর্ঘদিন আর মেইনটেনেন্স করা না লাগে।’
কেন্দ্রটি বন্ধের ফলে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হবে তা জানতে চাইলে প্ল্যান্ট ম্যানেজার শাহ আবদুল মওলা দেশ রূপান্তরকে বলেন ‘আমরা এমনিতেই বকেয়া বিল পাচ্ছি না। এটাই বড় ক্ষতি। অন্যান্য ক্ষতির পাশাপাশি কেন্দ্রটি বন্ধের কারণে সাশ্রয়ী দামে দেশের মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এ কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ দিতে না পেরে কমফোর্ড ফিল করছি না।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কেন্দ্র ভাড়ার পাশাপাশি লোডশেডিংয়ে মানুষের ভোগান্তি এবং কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলেও এ ক্ষতির পরিমাণ অপূরণীয়। আর লোডশেডিং না দিয়ে সরকার যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়, তাহলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই এই মুহূর্তে। সে ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে ৪ টাকার ওপর লোকসান হবে।’ তিনি বলেন, ‘ডলার ছাড় ঠিকই হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার আগেই ডলার ছাড় করা উচিত ছিল। এতে বিরাট ক্ষতি হলো। এ ক্ষেত্রে দুটো বিষয় হতে পারে। একটি হলো যারা ডলার ছাড় করছেন তারা বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না অথবা দেশের পরিস্থিতি আসলেই ভয়াবহ। তবে দেশের উন্নয়নে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতকে অবশ্যই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জাকির হোসেন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডলার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের। আর বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়া হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে। এ ক্ষেত্রে খাতের গুরুত্ব বুঝে ডলার ছাড় করা হয়। তবে দেশের প্রয়োজনে ডলার ছাড় করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ধরনের গাফিলতি নেই।’
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার খুকনি ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগ্রাম থেকে আরকান্দি গ্রাম পর্যন্ত এক কিলোমিটার যমুনা নদীর ভাঙ্গণ এলাকার পাশ থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এ কারণে ভাঙ্গণ এলাকায় হাজার হাজার বালুর বস্তা ডাম্পিং করেও ভাঙ্গণরোধ করা যাচ্ছে না। ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকা এ বাবদ খরচ হলেও কোনো কাজেই আসছে না বালুর বস্তা ডাম্পিং করে।
অপরদিকে অব্যাহত ভাঙ্গণের তাণ্ডবে প্রতিদিনই নদীগর্ভে বাড়িঘর বিলিন হয়ে যাওয়ায় এ এলাকার মানুষ গৃহহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে বাস করছে ও মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণগ্রামের নাজমা খাতুন আব্দুল কাদের, ইয়াহিয়া, জহুরুল ইসলাম, এমদাদুল হক মিলন, আরকান্দি গ্রামের মেহেদী হাসান, হালিমা খাতুন ও রেমান সরকার বলেন, গত ২ সপ্তাহ ধরে এখানে ব্যাপক ভাঙ্গণ শুরু হয়েছে। এই ভাঙ্গণের তাণ্ডবে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক বাড়িঘর ও বহু গাছপালা নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। এ ভাঙ্গণের তাণ্ডবে গৃহহারা হয়ে শত শত মানুষ অন্যত্র চলে গেছে। অনেকে আবার খোলাস্থানে ছাপড়া তুলে বাস করছে ও মানবেতর জীবন যাপন করছে।
তারা আরও বলেন, গত কয়েকদিন ধরে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ভাঙ্গণ এলাকায় বালুর বস্তা ফেলার কাজ শুরু করেছে। কিন্তু ঠিকাদারের লোকজন ধীরগতিতে কাজ করায় তা কোনো কাজেই আসছে না। যেসব স্থানে বস্তা ফেলা হচ্ছে দুই দিন না যেতেই সেখানে আবার ভাঙ্গণ দেখা দিচ্ছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ ভাঙ্গণ এলাকার ৫০ থেকে ১০০ গজ দূরে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে বস্তা ফেলার কয়েকদিন না যেতেই ওই এলাকায় আবারও ভাঙ্গণ দেখা দিচ্ছে। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট হলেও ভাঙ্গণ রোধ হচ্ছে না।
তারা আরও বলেন, শুষ্ক মৌসুমে বস্তা ফেলার কাজ না করে পানি বৃদ্ধি শুরু হয়ে যখন ব্যাপক ভাঙ্গণ শুরু হয়েছে, তখন ঠিকাদারের লোকজন ধীরগতিতে ২/৪ নৌকা বস্তা ফেলে চলে যায়। ২-৩ দিন না যেতেই তা আবার ভেঙ্গে যমুনায় বিলিন হয়ে যায়। ফলে এ বস্তা ফেলা কোনো কাজেই আসছে না। অপরদিকে ঠিকাদারকে বালু সরবরাহের নামে এলাকার কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রতিদিন ১৫/২০ ট্রলারে করে বালু অন্যত্র বিক্রি করছে। ফলে এ ভাঙ্গণের তাণ্ডব আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
এ বিষয়ে বালু সরবরাহকারী খোরশেদ আলম, জয়নাল সরকার ও ফজলু ব্যাপারী এলাকাবাসীর এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে অন্যত্র বিক্রি করা হচ্ছে না। ঠিকাদারের লোকজন বালু উত্তোলন করে তা বস্তায় ভরে ভাঙ্গণ স্থানে ফেলছে। আমরা শুধু তাদের কাজে সহযোগিতা করছি। একটি কুচক্রিমহল ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে আমাদের নামে মিথ্যা অপপ্রচার করছে।
এ বিষয়ে জানতে ঠিকাদার আব্দুর রাজ্জাকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিয়া আফরিন বলেন, নদীভাঙ্গণ রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড বস্তা ফেলার কাজ শুরু করেছে। অচিরেই এ সমস্যা আর থাকবে না।
ভাঙ্গণ এলাকার অদূরে যমুনা নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে অন্যত্র বিক্রির বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) লিয়াকত সালমান বলেন, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে খুকনি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের নায়েবকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের মোবাইল ফোনে কল করা হলে ফোনটি বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল বিশ্বের প্রায় সব দেশই। অধিকাংশ দেশই তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। প্রতিবেশী ভারত ও শ্রীলঙ্কার নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির কথা প্রায় সবারই জানা, তারাও ইতিমধ্যে তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসেছে। তবে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। কোনোভাবেই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। ফলাফল ভোক্তা মূল্যসূচকে (সিপিআই) বা মূল্যস্ফীতিতে ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড। মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সিপিআই ইনডেক্সে এ হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে।
গত ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করে সরকার। এ বাজেটের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আগামী অর্থবছরে সরকার কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাজেট প্রস্তাবে কোনো পদক্ষেপ না থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি পরাবাস্তব বাজেট। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা আসলে সম্ভব নয়। গত ১১ মাসে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। সে হিসাবে মূল্যস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো, আগের বছরের মে মাসে যে পণ্য গড়ে ১০০ টাকা কিনতে হয়েছে, এ বছরের মে মাসে তা কিনতে হচ্ছে গড়ে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সায়। আরও পরিষ্কারভাবে বললে, ধরুন আগের বছরের একই সময়ে ৫০০ টাকার একটি নোটে কোনো ব্যক্তি পাঁচটি পণ্য কিনতে পেরেছিলেন। এ বছরের একই সময়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় এখন একই টাকায় তিনটি পণ্য কিনতে পারছেন। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।
খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১ বছরে বেড়েছে ১১.৩২ শতাংশ : ২০২২ সালের মে মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, অথচ এ বছরের মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। এ বছরের এপ্রিল মাসেও খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ০৪ শতাংশ।
খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে এক বছরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৬৪ শতাংশ : বিবিএসের তথ্য বলছে, সদ্য শেষ হওয়া মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ হয়েছে। ২০২২ সালের মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৬৩ দশমিক ৮২ শতাংশ বা ৬৪ শতাংশ।
গ্রামের চেয়ে শহরের মূল্যস্ফীতি বেশি : এক বছর আগেও শহরের মূল্যস্ফীতি গ্রামের চেয়ে কম ছিল। কারণ গ্রামের চেয়ে শহরে পণ্য মজুদের আধুনিক ব্যবস্থা আছে। তবে সরকারি উদ্যোগে শহরের মতো গ্রামেও কিছু স্থানে খাদ্যগুদামের ব্যবস্থা তৈরি হওয়ায় এখন শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি কমেছে। মে মাসে শহর এলাকায় গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ, একই সময়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
বিশ্বে কমেছে মূল্যস্ফীতি, বাংলাদেশে বাড়ছে : গত শনিবার মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের (এমসিসিআই) বাজেট-পরবর্তী আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ মূল্যস্ফীতি ইস্যুতে বলেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশ সফলভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। শুধু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, থাইল্যান্ডে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, গত এপ্রিলে তা নেমে এসেছে ২ দশমিক ৭ শতাংশে। অর্থাৎ আগের তুলনায় দেশটিতে মূল্যস্ফীতি কমেছে ৬৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। সেখান থেকে ৪৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে আনতে সক্ষম হয়েছে তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের গত অক্টোবর মাসের মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখান থেকে ৩৪ শতাংশ কমিয়ে ৭ শতাংশে আনতে সক্ষম হয়েছে ইইউ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার বাড়িয়ে দেয়। তবে বাংলাদেশ এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় শুরুর দিকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো গত বছর আগস্টে এক ঘোষণাতেই জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই মাসেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ দেরিতে হলেও নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। বর্তমানে এ সুদহার ৬ দশমিক ২ শতাংশ। তবে নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে আভাস দিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দাবি করেছে, বিশে^র দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির যে হার, তা সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য হুমকি। মূল্যস্ফীতির এই হার ১২ বছর বা এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনো মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপর ছিল। পরে অবশ্য তা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ঠিক এরকম এক সময়ে গত বছর ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। এর পরপরই বাড়ানো হয় সব ধরনের পরিবহন ভাড়া। এ দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম। ফলে পরের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে।
যদিও সেপ্টেম্বর থেকে তা কমতে থাকে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে আসে। জানুয়ারিতে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে আসে। তবে রোজাকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চ মাসে হয় ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছিল।
মজুরি সূচক বেড়েছে : বিবিএসের তথ্য বলছে, গত কয়েক মাস ধরেই মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। অক্টোবরে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। যা মে মাসে এসে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩২ শতাংশে।
দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে হাইড্রোলিক পাওয়ার স্টেশনে তীব্র পানির সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনাবৃষ্টি এবং তীব্র তাপদাহে কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এই সংকট দেখা দিয়েছে। ৫টি ইউনিটের মধ্যে কোনরকমে মাত্র ১টি ইউনিট সচল রেখে সর্বনিম্ন ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার (৬ জুন) সকালে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আবদুজ্জাহের জানান, হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি জানান, পানির অভাবে কেন্দ্রের সব ক’টি ইউনিট সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে ঠেকেছে। তিনি আরও জানান, কেন্দ্রের ৫টি ইউনিটের মধ্যে বর্তমানে ১ নম্বর ইউনিটটি চালু রাখা হয়েছে। এই ইউনিট হতে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। অথচ এই কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট সচল থাকলে প্রায় ২৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে পাঠানো হয়। সেখানে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট।
এটিএম আব্দুজ্জাহের বলেন, বছরের এই সময়ে কখনই পানি এতো নিচে থাকে না। এ বছর এখনো বৃষ্টিপাত শুরু না হওয়ায় খুবই বিপাকে পড়তে হয়েছে আমাদের। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মাত্র একটি ইউনিট চালু আছে। আমরাও বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছি।
কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বরত প্রকৌশলী জানান, গত মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদের পানির পরিমাণ ৭৩ দশমিক ৬২ ফুট (মিন সি লেভেল) ছিল। রুলকার্ভ অনুযায়ী এসময় হ্রদে পানি থাকার কথা ৭৮ দশমিক ২০ ফুট এমএসএল (মিন সি লেভেল)। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর বৃষ্টিপাত না হলে এই সংকট হতে উত্তরণ সম্ভব নয় বলে জানান প্রকৌশলীরা।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, অনাবৃষ্টি, বন উজার হওয়া, কাপ্তাই হ্রদে নাব্যতা সংকটের কারণে পানি তলানিতে চলে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে এমন বিপর্যয় ঘটেছে। সঙ্গতকারণে গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে পানি কমে যাওয়ার ফলে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে তা নয়, কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। হ্রদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি উপজেলার সাথে নৌপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষের দুর্ভোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কাপ্তাই হ্রদের পাশে বসবাসকারী নুরুল ইসলাম জানান, ভারী বৃষ্টিপাত না হলে হ্রদে পানি বাড়ার সম্ভাবনা নেই। তাই দ্রুত সময়ে কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং করা প্রয়োজন। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কাপ্তাই হ্রদের গভীরতা যেমন বাড়বে তেমনি এই সমস্যা থেকে কিছুটা সমাধান পাওয়া যাবে।
বিলাইছড়ি বাজারের ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন জানান, বিলাইছড়িতে নৌপথ বন্ধ মানেই জীবন ও জীবিকার দুর্বিষহ অবস্থা। আমরা বিলাইছড়িবাসীই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি হ্রদের পানি কমে যাওয়ায়। বৃষ্টি হতে যত দেরি হবে আমাদের কষ্ট তত বেশি দীর্ঘায়িত হবে।
তিনি বলেন, হ্রদের পানি অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় বাজারের পণ্য পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। বড় বোটতো আসতেই পারছে না, ছোট ছোট বোটে পণ্য পরিবহনে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে, পর্যাপ্ত পণ্যও আনা যাচ্ছে না। আবার অনেক দূর থেকে পণ্য বাজারে তুলতে শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি দিতে হচ্ছে। একই সঙ্গে সাপ্তাহিক বাজারও এখন ঠিকমতো জমছে না। কারণ দূর থেকে মানুষজন আসতে পারছে না। এখন বৃষ্টি হওয়া ছাড়া পানি বাড়ার তো আর কোনো সম্ভাবনা নেই।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।