
মুচলেকা, নাকে খত, নির্মূল, উৎখাত অথবা হনুমানের ভেংচি বা গাধার হাসি; মোটেই অভিধান বহির্ভূত শব্দ নয়। কাউকে চুবিয়ে-ডুবিয়ে মারা, মাজা ভেঙে দেওয়া, শাড়ি ধরে টেনে নামানো ধরনের শব্দ-বাক্যও আছে বাংলা অভিধানে। তাই বলে যা-তা ভাবে ব্যবহারের শব্দ নয় এগুলো। শুনতে বা লিখতেও কেমন লাগে? এগুলো সচরাচর ভাষার সৌন্দর্য-গাম্ভীর্যের জন্যও মানায় না। কিন্তু, আমরা ব্যবহারের নামে সমানে অপব্যবহার করছি। এমনকি এই ভাষার মাসে কোনো ছাড় দিচ্ছি না। প্রসঙ্গেরও ধার ধারছি না।
কখনো বাতকে বাত, কখনো শালীনতার তোয়াক্কা না করে বা ব্যাকরণের কঠিন বেড়াজালে, কখনো ব্যাকরণ ভেঙেচুরে স্বেচ্ছাচারিতায় প্রকারান্তরে প্রিয় ভাষাটির সর্বনাশ করে ছাড়ছি। বাংলা চর্চায় অতি রক্ষণশীলতা বা উদারতা দুটোই বিপজ্জনক। ক্ষেত্রভেদে হঠকারিতাও। প্রকারান্তরে এটি ভাষার সঙ্গে জবরদস্তি, নাশকতা। তা শব্দ, বানান, বাক্যসহ গোটা বাংলা ভাষাটিরই সাবলীলতা নষ্ট হচ্ছে। একসময় বানান ও বাক্যে ভুলের মহোৎসব দেখা যেত বাস-ট্রাকে। দোকানপাটের সাইনবোর্ডে। ‘ঐ দেকা জায় গুলিস্থান, ব্যভহারে বংসের পরিচয়, ১০০ বা ৫০০ টাকার বাংতি নাই, কিসু পেলে গেলেন কি’Ñ ধরনের বানান ও কথাবার্তা এখন ভরপুর ফেসবুকে। যার মনে যা চায় স্ট্যাটাস লিখছেন। কমেন্টসও আচ্ছা রকমের। দৈনন্দিন যাপিত জীবনেও ভাষার ক্ষেত্রে সবাই এখানে স্বাধীন, সার্বভৌম, মহাপরাক্রমশালী।
বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবিটি সুপরিণতির দিকে নিতে চাইলে দেশে বাংলার চর্চা কোন স্তরে, কোন পর্যায়ে তা ভাবা জরুরি। ভাষার সঠিক চর্চা নিশ্চিতে অভিধানের চেয়েও বেশি শক্তি গণমাধ্যমের। দেশের সব ঘরে অভিধান নেই।
থাকলেও সেটা পড়ে থাকছে শো-পিসের মতো। কিন্তু সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, ফেসবুকের মতো গণমাধ্যম রয়েছে ঘরে ঘরে। এসব গণমাধ্যমে ব্যবহৃত শব্দ, বানান, বাক্যের গতি, শক্তি অভিধানের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু, দুঃখজনকভাবে সেখানেও বিস্তর গোলমাল। অর্থগতভাবে পর্যন্ত ছারখার করে ফেলা হচ্ছে রক্তাার্জিত বাংলাকে। ভুল স্বীকার না হোক, অন্তত শুদ্ধটা জানানোর তাগিদও চোখে পড়ে না। বানানের সঙ্গে বাক্য গঠনেও অরাজকতা। ডায়রিয়ায় ১৭ জন নিহত, বন্যার পানিতে ১৫ জন নিহত, অপুষ্টির অভাবে শিশুর মৃত্যু, নিহত হয়ে চারজনের মৃত্যুবরণ, দ্রব্যমূল্যের দাম আরও বেড়েছে, সিদ্দিকের চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেছে, তাকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, বাস না পেয়ে পায়ে হাঁটতে হয়েছে পাঁচ মাইল, এইচএসসিতে শতকরা গড় পাসের হার ৬৮.৯১ শতাংশ, পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ধরে আনার চেষ্টা চলছেÑ ধরনের বাক্যের অর্থ অডিয়েন্স বুঝে নিচ্ছে সত্য। কিন্তু, বাক্যগুলোর অর্থ-প্রয়োগে বাংলার করুণ দশা স্পষ্ট। কী বলতে গিয়ে কী বলা হচ্ছে? তথ্যই বা কী দাঁড়াচ্ছে? কেউ তা রোখার চেষ্টা করলে যুক্তির তেজে চুপ মেরে যেতে হয়। অর্থ, স্বকীয়তা, বিশেষত্ব ও ভাষা-ব্যাকরণের শুদ্ধরূপের ক্ষতবিক্ষত অবস্থা হজম করা ছাড়া আর গতি থাকে না।
বিশুদ্ধতা ও জাতপাত খোয়ানোর পরও ইংরেজি ভাষা কেন গোটা বিশ্বে প্রতিপত্তি বিস্তার করে চলছেÑ এমন বাঁকা প্রশ্নও ছোড়া হয়? ইংরেজি জানা সারা দুনিয়াতেই স্মার্টনেসের ব্যাপার? বিশ্বের অনেকে বাণিজ্যিক কারণে চীনা ভাষাও শিখছেন। আগে কেবল পণ্ডিতরা শিখতেন, এখন শিখছেন অনেক সাধারণ মানুষও। জাপানিজ, কোরিয়ান ভাষা শেখার পেছনেও বাণিজ্যিক ও কর্মসংস্থান বিষয়ক ঘটনা রয়েছে। হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির আধিপত্যও এখানে প্রাসঙ্গিক। সেই তুলনায় বাংলার বাজার কেন জমছে না এ প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। ইতিহাসে ভাষাকে একঘরে হয়ে যাওয়ার বহু তথ্য রয়েছে। সময়-অসময়ে বিভিন্ন ভাষা নেতিয়ে পড়া বা হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস প্রায় একই। কারও কারও মানতে কষ্ট হয়, ভাষার সঙ্গে রুটি-রুজিসহ কর্মজগতের বিশাল সম্পর্কের কথা। মানুষ অজস্র ভাষা সৃষ্টি করতে পারে। আবার পারে অপব্যবহারে, খামখেয়ালিতে ভাষার সর্বনাশ করতেও। কোনো ভাষাকে শক্তিধর রাখতে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক পদক্ষেপ দরকার। বিকৃতি আর শক্তিহীনতার কারণে পৃথিবীর একসময়ের শক্তিধর ভাষাগুলোর কিছু দুর্বল হয়েছে। কিছু হারিয়েই গেছে। বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভাষায় মেসিডোনিয়ায় আজ কজনে কথা বলে? পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্মপ্রণেতার অন্যতম যিশুখ্রিস্টের ভাষাও প্রায় বিলুপ্ত। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, বিশ্ববিজয়ী চেঙ্গিস খানের ভাষা দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোনো ভাষাই শুধু আবেগ, চেতনা আর ভালোবাসার ওপর ভর করে টিকে থাকে না। বাংলা ভাষা মোটেই ধনেজনে দুর্বল নয়। যথেষ্ট সমৃদ্ধÑ সামর্থ্যবান। তার ওপর বাংলার প্রতি আমাদের আবেগ, ভালোবাসা অসীম। কিন্তু খামখেয়ালি, শুধু আবেগ, ভালোবাসা, চেতনায় ভাষা বা কোনো কিছুর শেষরক্ষা হয় না। কারও আদেশ-নির্দেশেও হয় না। বিশ্বব্যাপী ইংরেজির এত চাহিদা কারও হুকুমে হয়নি। এর ভোক্তা বা গ্রহীতা দেশে দেশে। প্রয়োজনেই কোনো কিছুর ব্যবহার বাড়ে। আর ব্যবহার না হলে প্রেম-ভালোবাসাও বাড়ে না। অর্থাৎ চাহিদাই মূল বিষয়। প্রয়োজন প্রশ্নে আমরা পড়ে গেছি ‘লাভ বাংলা, ইউজ ইংরেজি’ থিওরিতে। রিজিকের তাগিদে আমরা ইংরেজিকে ব্যবহার করি। আর ভালোবাসি বাংলাকে। ঘর-সংসারের জন্য উপযুক্ত একজন, ভালোবাসার জন্য আরেকজন।
ভাষা হিসেবে বাংলাকে জীবন-জীবিকার সঙ্গে জোরালোভাবে সম্পর্কিত করার আবশ্যকতা এ কারণেই। বাংলার মধ্যে হরদম ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে কিছুটা প্রয়োজনে। কিছুটা অবচেতনে-অজান্তে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়সহ দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাসের বাংলা বইগুলো এখনো মানে অনেক পিছিয়ে। পেরে উঠছে না ইংরেজি বইয়ের সঙ্গে। নিজ ভাষার সম্মান-ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে ইংরেজির শরণাপন্ন হতেই হচ্ছে। যার জেরে ‘আপ-ডাউন’ ছাড়া দেশে এখন উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমসহ প্রায় সবদিকের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকের ছড়াছড়ি। এদিক, সেদিক, অন্যদিক কোনো দিকই আর বাদ নেই। আবার রয়েছে দু’দিক মেলানো নামও। নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, সাউথ ইস্ট, নর্দার্ন, সাউদার্ন, ইস্টার্ন নাম ঠেকানো কঠিন। তাচ্ছিল্য করারও অবস্থা নেই। তাছাড়া, বাংলা প্রতিশব্দ সৃষ্টি করতে গিয়ে কখনো কখনো ভুল প্রতিশব্দ জন্ম নিচ্ছে। বাংলা ব্যবহারে ভুলের ছড়াছড়িতে ‘আমি বড় শৃঙ্খলায় পড়ে গেছি, আপনার রান্নাটা বড় জটিল হয়েছে, আপনার জামাটা বেশ অস্থির লাগছে’ ধরনের কথায় কী বোঝাতে কী বলে ফেলা হচ্ছে? বাংলার জন্য তা আতঙ্কের। বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোর কথাকে অন্যদৃষ্টিতে দেখেন কেউ কেউ। ভাষা হিসেবে বাংলা জীবন-জীবিকার সঙ্গে কতটা সম্পর্কিত? ইংরেজিকে পাস কাটানোর কারণে বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ভালো করে বোঝা সম্ভব নয়। উল্টাপাল্টা বোঝার ঘটনাও ঘটছে। বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার কারণে ইংরেজি শিক্ষা বন্ধের পথে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইংরেজি বই পড়তে অনেকের নাকানি-চুবানি ছুটছে। এমনটি মোটেই ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে কাম্য ছিল না। স্বাধীনতার নামে শব্দ-বাক্যের যাচ্ছেতাই প্রয়োগও নিশ্চয়ই আকাক্সিক্ষত ছিল না। যার ছায়া পড়ছে কবিতা, চিত্রনাট্য, গল্পসহ সৃষ্টিশীলতার মাঝে। ‘খাইয়া ফালামু, তোরে খাইছি, ন্যাংটা করে ক্ষমতা ছাড়া করুম’ ধরনের শব্দ-বাক্য ভাষার জন্য মোটেই মর্যাদার নয়। গল্প, কবিতা, নাটক, ছায়াছবির নামকরণ-সংলাপে এগুলো দেদার ব্যবহার হচ্ছে। বাজারও পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। যার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে ভাষাকে কদাকার করে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলার শব্দ ভা-ার এত দুর্বল নয় যে এগুলোর বিকল্প বা প্রতিশব্দ নেই। এ নোংরামি বছরের পর বছর ধরে চলছে আমাদের জায়গার নামকরণেও। মৌজা, সিএস, আরএস, কাগজে-কলমে, সাইনবোর্ডে বোদা বাংলাদেশের একটি প্রশাসনিক এলাকা। অথচ এ নাম বা শব্দটি কেবল অসুন্দর নয়, অশ্লীলও। কঠিন এ বাস্তবতায় জায়গাটির নাম পরিবর্তনের দাবি উঠেছে অনেকবার। কিন্তু, দাবি জোরালো হয়নি। তবে, ‘মানুষমারা’ জায়গাকে ‘মানুষগড়া’ করার দৃষ্টান্ত আছে। দশ কাজের এক কাজের মতো তা করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। নীলফামারী সদরের ‘মানুষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর নাম পাল্টে নতুন নামকরণ হয়েছে ‘মানুষগড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এ মর্মে প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে শুধু স্কুল নয়, পাল্টে গেল জায়গাটির নামও। এই নাম নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহলের আপত্তি অনেক দিনের। চিত্ত-পিত্ত দুটোই পুড়ছিল তাদের। অবশেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা আমলে নিয়ে বিশ্রি নামটি পাল্টে দিয়েছে। বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রাম এবং অসংখ্য জায়গার মধ্যে ‘মানুষমারা’র চেয়েও উচ্চারণ অযোগ্য বহু নাম রয়েছে। কোনো কোনোটি ভদ্র-শিক্ষিত কারও সামনে উচ্চারণ করা কষ্টকর-লজ্জাকর। রুচিতে বাধলেও নামগুলো দলিল-মৌজা, খতিয়ান এমনকি বইপত্রসহ মুদ্রণে অটুট থাকছে।
কুত্তামারা, সোনাডাংগা, ছাগীপাড়া স্পষ্ট উচ্চারণও বিব্রতকর। হাঁটুভাঙ্গা, ভেড়ামারা, ঘোড়ামারা, ঠেঙ্গামারা, ছাগীপাড়া, ছেঙ্গারচর, কাউয়ারচর, ফাজিলপুর, ভুয়াপুর, ভুরুঙ্গামারী, ধরি কিলা, বলদপুর ধরনের নাম হজম করতে হয় বাধ্য হয়ে। যতই বলা হোক, নামে কিছু যায় আসে না। আসলে নামে অনেক কিছুই যায় আসে। নামটি অবশ্যই একটি ভাষা। এ ভাষাটির মর্যাদা-সৌন্দর্য কি ভাবতে নেই?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ) এ এম এ কবীর প্রাদেশিক সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব এ কিউ আনসারিকে যে প্রতিবেদন (ইংরেজিতে লিখিত) প্রেরণ করেন, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলায় সংক্ষেপে ভাষান্তর করা হলো :
প্রতিবেদনের বিষয় : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ শহীদ দিবস উদযাপন
১. অন্যান্য বছরের মতো এবারও বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সম্মিলিতভাবে শহীদ দিবস পালন করছে। বৃহৎ কলেবরে যথারীতি ঢাকাতেই অনুষ্ঠানগুলো হয়েছে, বয়োজ্যেষ্ঠরা সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেছেন।
২. পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ১২ জানুয়ারি ১৯৬১ পার্টির কর্মীদের জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে, তাতে শহীদ দিবস উদযাপনের সময় নিম্নবর্ণিত দাবিনামা পেশ করার নির্দেশ দেওয়া হয় :
ক. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন
খ. সংসদীয় সরকার
গ. শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ভাষা
ঘ. ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন
ঙ. শহীদ মিনার নির্মাণ সমাপ্তকরণ
সরকারের বিরোধিতার পরও যদি জনগণকে সংঘবদ্ধ করে সম্মিলিতভাবে শহীদ দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া যায় তাহলে এটি সফল প্রতিরোধ দিবস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে প্রজ্ঞাপনে পরামর্শ দেওয়া হয়। পার্টির ঢাকা জেলা সাংগঠনিক কমিটিও একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ছাত্রদের মাধ্যমে সরকারের কাছে পেশ করার জন্য তিনটি দাবিনামার উল্লেখ করেছে :
ক. ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা
খ. শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা
গ. উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে সব দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা চালু করা।
৩. উল্লেখ করা যেতে পারে, ১ জানুয়ারি ১৯৬১ নারায়ণগঞ্জ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যথাবিহিত মর্যাদার সঙ্গে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ছাত্রদের কাঁধে না চাপিয়ে যুবক এবং জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
৪. ইস্ট পাকিস্তান ইয়ুথ লিগের কর্মীরা ২৭ জানুয়ারি ১৯৬১ শহীদ দিবস মর্যাদার সঙ্গে পালনের উদ্দেশ্যে একটি গোপন বৈঠক করেছেন। তারা শহীদ মিনার সাজানোর জন্য ছাত্রদের কাছে আবেদন জানান এবং বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশের দাবিও করেন।
৫. ক্রোড়পত্র প্রকাশের জন্য সংবাদপত্রের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তবে ‘ইত্তেফাক’ ও ‘সংবাদ’ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে সংবাদ অসমাপ্ত শহীদ মিনারের ছবিও মুদ্রণ করে। পাকিস্তান অবজার্ভার, ইত্তেফাক এবং সংবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস বন্ধ রাখলেও পরদিনের পত্রিকা ছাপার আয়োজন করে এবং যথারীতি পত্রিকা বেরোয়।
৬. ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ডাকসুতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মূলত প্রধান পদসমূহ দখল করে আছে। তারা এবং বিভিন্ন হলে তাদের সমর্থকরা শহীদ দিবস পালনে প্রস্তুতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
৭. ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্স ইউনিয়ন (এপসু) ১ ফেব্রুয়ারি এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে শহীদ দিবসের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করে। সব হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জেনারেল সেক্রেটারি এবং ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতাদের নিয়ে আরও একটি বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়; প্যামফ্লেট ও পোস্টার মুদ্রণ, প্রভাতফেরি বের করা ও শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। শহীদ মিনারের কাজ সম্পন্ন করার জন্য ভাইস চ্যান্সেলরকে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করার দাবি জানানো হবে এবং সন্ধ্যায় উদ্যোক্তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন।
৮. যথারীতি ছাত্র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ এপসুর নেত্রী জাহান আরা আকতারের (তিনি তখন ডাকসুর ভিপি) সভাপতিত্বে ডাকসু অফিসে বৈঠক হয়। যদি এপসুই সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা ডানপন্থি সংগঠন এনএসএফ, এসএফ এবং ইপিএসএল প্রতিনিধিদেরও আমন্ত্রণ জানান। যথাযথভাবে শহীদ দিবস পালনের জন্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ভিপি ও জিএস-এর স্বাক্ষরে বিবৃতি প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। তাতে ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা, শহীদ মিনার নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা ও প্রশাসনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার চালুর দাবি জানানো হবে। প্রভাতফেরি সংগঠিত করাসহ শহীদ দিবসের বিস্তারিত কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। পরদিন ৯.২.৬১ তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। মুদ্রিত লিফলেট ছড়িয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। জগন্নাথ কলেজ, কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গেট, ঢাকা হলের অডিটোরিয়ামে পোস্টার সেঁটে দেওয়া হয়। কিছু বে-নামা পোস্টারও দেখা যায়। রমনা এলাকায় ন্যাশনাল ব্যাংকের দেয়ালে সাঁটানো পোস্টার দেখা যায়।
৯. কর্মসূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা ভোরে স্ব-স্ব হলে জমায়েত হন, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের জন্য মোনাজাত করে যার যার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ইকবাল হল, আবদুর রহমান খান হল এবং জগন্নাথ কলেজ কম্পাউন্ডে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়।
তারপর তারা কালোব্যাজ ধারণ করে নগ্নপদে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আজিমপুর গোরস্তানে গমন করে। কালোব্যাজে এবং সাদা কাপড়ে লেখা ছিল ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’ এবং ‘একুশে ফেব্রুয়ারি জিন্দাবাদ’।
প্রভাফেরিতে আসার পথে শিক্ষার্থীরা সজোরে নিচের সেøাগানগুলো দেন :
১. ২১ ফেব্রুয়ারি জিন্দাবাদ
২. শহীদ স্মৃতি অমর হোক
৩. রোমান হরফে বাংলা লেখা চলবে না
৪. ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা করো
৫. শহীদ মনুমেন্ট তৈরি করো
৬. ছাত্র-জনতা এক হও ৭. ধোঁকাবাজি চলবে না
১০. আজিমপুর কবরস্থানে পৌঁছে তারা বরকত ও সালামের কবরে পুষ্পস্তবক ও পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণে তারা নিহত হন। বাঁশের খুঁটি গেড়ে লাল কাগজে তাতে টানানো পোস্টারে লেখা হয়েছে :
‘হে আমার দেশ, বন্যার মতো, প্রচন্ড অভিজ্ঞতার পলিমাটিকে সরিয়ে এনে একটি চেতনাকে উর্বর করেছি এখানে আমাদের মৃত্যু ও জীবনের সমাপ্তি।’
ছাত্রদের রেখে যাওয়া অন্য পোস্টারে লেখা হয়েছে :
‘আমার ভাষা বাংলা, আমি বাঙ্গালী, এই মহান বার্তা নিয়ে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল বঙ্গজননীর সেই শহীদ প্রিয় সন্তান।’
অন্য একটিতে লেখা হয়েছে :
‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করেছে ভাষা বাঁচাবার তরে, আজিকে স্মরিও তারে।’
১১. কবরস্থান থেকে ১০০ ছাত্রীসহ ৩০০ শিক্ষার্থীর দুটি সিঙ্গেল লাইন মিছিল ৭টা ৪৫ মিনিটে শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যায়, তারা কালো পতাকা বহন করেন এবং প্রচলিত কিছু সেøাগান দেন। একটি কালো ব্যানারে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস সরকারি ছুটি ঘোষণা, শহীদ মিনার নির্মাণ সমাপ্ত করা এবং সর্বস্তরে বাংলা চালুর দাবি মুদ্রিত ছিল। অন্যটিতে শহীদ স্মৃতি অমর হোক। প্রথমটি বহন করেছেন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা, দ্বিতীয়টি ঢাকা হলের ছাত্ররা।’
১২. মিছিল ধীরে ধীরে পিলখানা রোড, ফুলার রোড, নীলক্ষেত রোড, ময়মনসিংহ রোড, ওল্ড গভর্নমেন্ট হাউজ রোড, আবদুল গণি রোড, জিন্নাহ অ্যাভিনিউ, রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টার রোড, সেক্রেটারিয়েট রোড (ঢাকা মেডিকেল কলেজের আগে পর্যন্ত) প্রদক্ষিণ করে সকাল ১০টায় মেডিকেল কলেজ গেটের কাছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ হয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে মিছিলকারীরা পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন এবং সেখানে জড়ো হতে থাকেন।
সমাবেশের সামনে বক্তৃতা দেন ঢাকা হল ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তাহের উদ্দিন ঠাকুর (এপসু), তিনি ভবিষ্যতেও এই দিনটি উদযাপনের আহ্বান জানান। পুলিশের গুলিতে নিহত হন বরকত, তার বাবার প্রেরিত বার্তা পড়ে শোনান এ কে এম জিয় উদ্দিন (এপসু)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন (ডাকসু) সহসভাপতি জাহান আরা আকতার সিদ্ধান্তসমূহ (দাবিনামা) পাঠ করে শোনান।
ক. শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা
খ. ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা
গ. জাতীয় জীবন ও প্রশাসনের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন
ঘ. বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিতে বাংলা একাডেমির কার্যক্রম জোরদার করা।
সোয়া ১০টার পর থেকে মিছিলে লোক কমতে থাকে।
১৩. ফুল দিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সাজানো হয়। একটি বড় কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। মিনারের মেঝে কালো কাপড়ে ঢাকা থাকে। লাল কাগজের পোস্টারে দাবিনামা লেখা হয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে ভাষা দিবসের গুরুত্ব নিয়ে লেখা রচনা দেয়ালপত্র স্থাপন করা হয়। এগুলো হচ্ছে :
ক. চতুষ্কোণ : ঢাকা হল ইউনিয়ন
খ. শিখা : ফজলুল হক মুসলিম হল ইউনিয়ন
গ. পদক্ষেপ : ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইউনিয়ন
ঘ. রক্ত অক্ষর : সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়ন
১৪. শহীদ দিবস উদযাপনে যেসব ছাত্র নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা হচ্ছেন :
১. বদরুল হক (এপসু) ইকবাল হল
২. মওদুদ আহমদ (পিএসএফ) ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
৩. তাহের উদ্দিন ঠাকুর (এপসু) সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা হল ইউনিয়ন
৪. বীরেন্দ্রনাথ হালদার (এপসু সমর্থক) সহসভাপতি জগন্নাথ হল ইউনিয়ন
৫. এ কে এম জিয়া উদ্দিন (এপসু) ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়
৬. অমূল্য কুমার রায় (এপসু সমর্থক) সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু
৭. জাহান আরা আকতার (এপসু সমর্থক) সহসভাপতি, ডাকসু
৮. এ জেড এনায়েত উল্লাহ খান (এপসু)
৯. আবদুল লতিফ মল্লিক, মেডিকেল কলেজ
১০. জাহাঙ্গির খালিদ (এপসু সমর্থক) সহসভাপতি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
১১. আমিনুল ইসলাম (এপসু) সাবেক সহসভাপতি, ডাকসু
১২. আশরাফ উদ্দিন মঘবুল (এপসু) সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু
১৩. এ এন এম শহীদ ওরফে শহীদ সিং (এপসু) সহসভাপতি, ঢাকা হল।
এ আর ইউসুফ একটি মিছিলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসেন।
১৫. এ ছাড়া বাইরের যারা এসেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন : কাজী জহিরুল হক, আবদুর রহমান, মিজানুর রহমান, আবদুর রশীদ, শামছুল আরেফিন, শাহ আজিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ (অধ্যাপক জগন্নাথ কলেজ) এবং আনোয়ার জাহিদ।
১৬. বিকেলে বাংলা একাডেমি, কার্জন হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল, জগন্নাথ হল এবং আরও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়।
১৭. বাংলা একাডেমির আয়োজনে একাডেমি প্রাঙ্গণে বিকেল ৩:৩০ থেকে ৫টার মধ্যে অনুষ্ঠিত সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডক্টর সৈয়দ আলী আহসান, সাহিত্যমোদী প্রায় ৬০ জন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। বিশিষ্টজনদের মধ্যে বক্তৃতা করেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী, অধ্যাপক হাসান জামান, অধ্যাপক আবুল কাশেম ও রওশন আরা বেগম। সভাপতি বলেন, যে ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া হয়েছে, সে ভাষার সমৃদ্ধি ঘটাতে হবে।
১৮. কার্জন হলে বহুল উপস্থিতিতে ডাকসুর একটি সভায় সভাপতিত্ব করেন ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন। ভাইস চ্যান্সেলরও এতে উপস্থিত ছিলেন। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান (নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সদস্য), সাবেক মন্ত্রী মাহমুদ আলী (নিষিদ্ধ ন্যাপের সদস্য) এবং আরও কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা উপস্থিত ছিলেন।
জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিত গুহ, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামন, ডক্টর জি সি দেব, বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর নুরুল মোমেন বক্তব্য দেন। তাদের দাবিনামায় তিনটি অতিরিক্ত বিষয় যোগ হয় :
ক. বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য বাংলা একাডেমিকে সক্রিয় করা।
খ. রোমান হরফে বাংলা চালুর চেষ্টা কিংবা অন্য ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা সহ্য করা হবে না।
গ. পুলিশের গুলিতে নিহতদের কবর রাষ্ট্রীয় খরচে পাকা করা।
গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহে ব্যবহৃত ভাষা নিয়ে ডক্টর কাজী মোতাহের হোসেন আপত্তি জানালে হাত তুলে উপস্থিত অংশগ্রহণকারীরা সমর্থন জানান। বাংলা ভাষাও এই দিবসের প্রশংসা করে গীত সংগীত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।
১৯. সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন প্রভোস্ট ডক্টর এম হক এবং ফজলুল হক ও জগন্নাথ হলের সভায় সভাপতি ছিলেন সংশ্লিষ্ট হল ইউনিয়নের সহসভাপতি। জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের লেকচার গ্যালারির অনুষ্ঠানে কমিনিউস্ট পার্টির সদস্য এবং সাবেক নিরাপত্তা কারাবন্দি রনেশ দাশ গুপ্ত। তিনি সভায় সভাপতিত্ব করেন। তিনি ছিলেন দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক।
২০. কিছুসংখ্যক ছাত্র সন্ধ্যাবেলায় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বালিত করে সম্মান জানান।
২১. ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ যে কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়েছিল তাতে কালো পতাকা উত্তোলন, মিছিল, সেøাগান এবং শহীদ মিনারের সভা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। স্লোগানগুলো নতুন কিছু নয়। গত বছরও তারা একই স্লোগান দিয়েছেন। গত বছরও মিছিল হয়েছে কিন্তু তা শহীদ মিনার থেকে আজিমপুর কবরস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এবার অনেক বড় আকারে মিছিল হয়েছে এবং সচিবালয়ের সামনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা রাস্তায়ও মিছিল চলেছে।
২২. পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত সুপারিনটেনডেন্ট শহীদ মিনারে মিছিল ও মিটিং সামরিক আইনের বরখেলাপ কি না এ নিয়ে পাবলিক প্রসিকিউটরের মতামত গ্রহণ করেছেন। এ মতামত তেমন কোনো কাজে আসেনি।
২৩. ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ ‘দিবস’ পালন-সংক্রান্ত সরকারের নীতিমালা জারি হয়েছে। কোনো রাজনীতিবিদের সক্রিয় অনুপ্রেরণা বা নাশকতামূলক কাজে উৎসাহ প্রদানের প্রমাণ না পাওয়া গেলেও আমি মনে করি শহীদ মিনারের সভায় ও মিছিলে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের নামের তালিকা ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানো দরকার, যাতে তিনি তাদের কঠোরভাবে সতর্ক করেন।
যদিও বাইরের কাউকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সভায় বা মিছিলে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি, আমরা প্রাপ্ত প্রতিবেদনগুলো আরও পরীক্ষা করব। সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী কেউ শনাক্ত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ এম এ কবির
ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ
(ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ)
পূর্ব পাকিস্তান, ঢাকা
পাবলিক প্রসিকিউটরের অভিমত
প্রেরিত কাগজপত্র দেখেছি, গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তার সঙ্গে কথাও বলেছি।
২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসের অনুষ্ঠান রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা কিছুসংখ্যক ছাত্রের উদ্যোগে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আয়োজন করা হয়েছে। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ করেছে। তবে গতকাল (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১) ছাত্রটা যে মিছিল করেছে তার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কোনো সংস্রব ছিল না। যদি মিছিলে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে না থাকে এবং তা যদি নিহতদের প্রতি তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ হয়ে তাকে তাহলে এ মিছিলকে রাজনৈতিক প্রকৃতির বলা যাবে না। আর তা যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তা মার্শাল ল রেগুলেশন নম্বর ৫৫ এ-র আওতায় আসবে।
পুলিশ রিপোর্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে, শহীদ মিনারের পাদদেশে একটি সভা হয়েছে, তবে সভায় কেউ সভাপতিত্ব করেননি, কিন্তু জনব্যবহার্য স্থানে একটি সভা হয়েছে, যা বেআইনি এবং এমএলআর ৫৫ এ-র পরিপন্থী।
মুদ্রিত লিফলেট প্রসঙ্গে বলা যায়, এতে শহীদ দিবস উদযাপনের কর্মসূচি লিপিবদ্ধ ছিল। তাদের কিছু অভিযোগ প্রশমনের দাবিদাওয়া এতে ছিল।
মো. আবদুল আলীম
পাবলিক প্রসিকিউটর, ঢাকা
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১
পাদটীকা :
এ এম এ কবীর হচ্ছেন পরবর্তীকালের পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল। তার জন্ম ২৫ নভেম্বর ১৯১১, মৃত্যু ১০ জানুয়ারি ১৯৯৬। তিনি ১৯৩২ সালের ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের বেঙ্গল ক্যাডারে যোগ দেন। ঘাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৯১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তাদকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের মধ্যে মওদুদ আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর এবং এ জেড এনায়েতুল্লাহ খান পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
লেখক : সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট
আবদুল হাকিম জন্মেছিলেন ১৬২০ সালে। মারা যান ১৬৯০ সালে। লিখে যান ৮টি কাব্যগ্রন্থ। এর একটি ‘নূরনামা কাব্য’। সেখানে তিনি লিখেন, ‘যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ অন্যদিকে বাংলা পঞ্চকবির একজন অতুল প্রসাদ সেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৭১ সালে। মারা যান ১৯৩৪ সালে। এ সময়ের মধ্যে গীতিকার, গায়ক, কবি অতুল প্রসাদ লিখে যান অসংখ্য গান। বাংলা সংগীত জগতে, অন্যান্য গানের সঙ্গে আমরা পাই সেই দুর্লভ গানÑ ‘মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা’। এরপর আসে পাকিস্তান আমলের নির্মম অত্যাচারের ২৪ বছর।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ। ৯ দিনের সফরে পূর্ববঙ্গ আসেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে, যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ইংরেজিতে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং অন্য কোনো ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।’
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল ভারত-ভাগের আগেই। অবাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদ ও অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবীরা বলছিলেন উর্দু ভাষার কথা। অন্যদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও এনামুল হকের মতো বাঙালি বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনতা বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আকাক্সক্ষা অনেক আগেই সৃষ্টি হয়েছিল। এই ধারাবাহিকতারই একটা অংশ হচ্ছে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, বেলা ১১টা ৩০ মিনিট। ১৪৪ ধারা মানেননি ছাত্র-জনতা। ভাষার দাবিতে রাজপথে খণ্ড খণ্ড মিছিল। লাঠি চালায় পুলিশ। আরও বেগবান হয় আন্দোলন, যোগ দেন সাধারণ মানুষ। সবার মুখে একটিই দাবিÑ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সেই মিছিল ঠেকাতে চলল গুলি। রাজপথে লুটিয়ে পড়লেনÑ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই। ২২ ফেব্রুয়ারি হত্যার প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ মিছিল। দাবি ওঠে শহীদের স্মৃতি সংরক্ষণের। মাত্র এক দিনের প্রস্তুতিতে তৈরি করা হয় শহীদ মিনার। এতে সরকার ভীত হয়ে পড়ে। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ভেঙে ফেলে শহীদ মিনার।
বর্তমানে আমরা যে শহীদ মিনার দেখছি, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এই শহীদ মিনারের স্থপতি হামিদুর রহমান। অমর একুশের গান লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী/ আমি কি ভুলিতে পারি’Ñ এই অবিনশ^র গানের প্রথম সুরকার আবদুল লতিফ। পরে সুরারোপ করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ১৯৫৪ সাল থেকে, যা আজও চলছে।
মাতৃভাষার এই আন্দোলনেই বীজ বপন হয়েছিল স্বাধীনতার। পাকিস্তান ভেঙে জন্ম নিল পৃথিবীর বুকে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
পার হয়েছে সুদীর্ঘকাল। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩। এই ৫২ বছরে, অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। বিদেশে থাকার কারণে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, তার দুই কন্যা। তবু থেমে থাকেনি নরঘাতকের দল। এর পরও চলে হত্যাকা-। জাতীয় চার নেতাসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। দীর্ঘকাল সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হন বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ। একই সঙ্গে চলে দেশকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র।
আবার ফিরে আসে নবজাগরণের ইতিহাস। জেগে ওঠে সভ্যতা। দেশের হাল ধরেন স্বাধীনতার সেই মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। তিনিই আজ ১৪ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তবু কি দুখিনী বাংলার সাধারণ মানুষের ভাগ্যের বদল হয়েছে? কমেছে কি শাসন-শোষণের পাহাড়সম বৈষম্য?
আমাদের রক্তে নব উদ্যমে কথা বলুক, একুশের চেতনা। মানুষ যেন মানুষের জন্য হয়। বাঙালি চেতনায় জেগে উঠুক বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করা কালজয়ী গান ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’-এর স্রষ্টা কবি ও গীতিকার গোবিন্দ হালদার ১৯৩০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার রচিত প্রথম কবিতা ‘আর কতদিন’। তিনি প্রায় সাড়ে তিন হাজার কবিতা ও গান লিখেছেন। তার প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দূর দিগন্ত’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারে সম্প্রচারিত তার লেখা গানসমূহ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করত। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার রচিত উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘লেফট রাইট লেফট রাইট’, ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘চলো বীর সৈনিক’ ও ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার বাংলার মাটি’ অন্যতম। বন্ধু কামাল আহমেদের অনুপ্রেরণায় এবং উৎসাহে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর গান রচনা করেন। কামাল আহমেদ তাকে স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্ণধার কামাল লোহানীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তার হাতে ১৫টি গানের একটি খাতা দেন। এ গানগুলোর মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রথম প্রচারিত হয় সমর দাসের সুরারোপিত ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গানটি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই তার আরও কিছু গান স্বাধীন বাংলা বেতারে সম্প্রচারিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পাওয়ার পরপরই সন্ধ্যায় ১৬ ডিসেম্বর প্রচারিত হয়Ñ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না’ গানটি, যা সুর দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদ এবং মূল কণ্ঠ দিয়েছিলেন স্বপ্না রায়, আপেল মাহমুদ ও সহশিল্পীরা। গোবিন্দ হালদার ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশ নারী জাতীয় ফুটবল দলের রক্ষণভাগের অন্যতম সেরা আঁখি খাতুন। সেই ছোট থেকেই গড়ন, উচ্চতা ও লড়াকু ফুটবল দিয়ে আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন। মেয়েদের ফুটবলে বাংলাদেশের প্রায় সব সাফল্যেই ছিলেন অগ্রনায়ক হয়ে। সম্প্রতি তিনিও জাতীয় দলের ক্যাম্প ছেড়েছেন। তবে সতীর্থ সিরাত জাহান স্বপ্নার মতো অবসরের সিদ্ধান্ত নেননি। বরং নিজেকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাফুফের বন্দী জীবনকে বিদায় জানিয়েছেন।
সম্প্রতি চীনের বন্দরনগরী হাইকোউ শহরের একটি ফুটবল অ্যাকাডেমিতে খেলার পাশাপাশি পড়ালেখার প্রস্তাব পেয়েছেন আঁখি। এখন চলছে চীনের ভিসা নেওয়ার প্রক্রিয়া। সবকিছু ঠিক থাকলে আসছে ঈদের পর দেশ ছাড়বেন তিনি। বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন আঁখি।
তিনি যে আর দশজন ফুটবলারের মতো নন, তা আগেই বুঝিয়েছেন আঁখি। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়ের পর বিশ্ব ফুটবলের নজর কাড়েন দীর্ঘদেহী এই ডিফেন্ডার। তার নির্ভীক ফুটবল বড্ড মনে ধরে সুইডেনের শীর্ষ লিগের একটি ক্লাবের। সাফে বাংলাদেশ মাত্র একটি গোল হজম করেছিল।
এই কৃতিত্বের বড় দাবীদার সেন্টারব্যাক আঁখি। তাই সুইডিশ ক্লাবটি তাকে দলে নেওয়ার প্রস্তাবও দেয়। প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে ইউরোপের কোন দেশের শীর্ষ লিগে খেলার প্রস্তাবে আঁখি দেখতে শুরু করেছিলেন বড় মঞ্চে নিজেকে প্রমাণের স্বপ্ন। তবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের হঠকারি সিদ্ধান্তে সুইডেনে খেলতে যাওয়া হয়নি। জাতীয় দলের খেলা থাকবে বলে সুইডেনের দরজা বন্ধ করে দেয় বাফুফে। পরে অবশ্য অর্থ সঙ্কটসহ নানা অযুহাতে জাতীয় দলকে সিঙ্গাপুরে ফিফা ফ্রেন্ডলি ও মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাইপর্ব খেলতে পাঠানো হয়নি।
বিষয়টা ভীষণ কষ্ট দিয়েছিল সদ্য এইচএসসি পাস করা আঁখিকে। অভিমানে কিছুদিন ক্যাম্প ছেড়েও চলে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ক্যাম্পে যোগ দেন। তবে হতাশা একটুও কমেনি। দিনের পর দিন লক্ষ্যহীণ পথ চলতে কারই বা ভালো লাগে? দেশের ফুটবলের যে ভবিষ্যত নেই ঢের বুঝতে পেরেছিলেন। তাই চীনের প্রস্তাবটাকে লুফে নেন আঁখি।
দেশ রূপান্তরের কাছে ক্যাম্প ছাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, 'আমি ওখান থেকে চলে এসেছি ঠিক, তবে ফুটবলেই থাকবো। চীনে ভাল অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন ও লিগ খেলার সুযোগ পাচ্ছি। তাই ওইখানে যাবো। এখন ভিসা নিয়ে কাজ করছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।'
গত ফেব্রুয়ারিতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৪.৫০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন সিরাজগঞ্জের গর্ব আঁখি। দেশে সুযোগ ছিল বেসরকারী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। তবে তিনি যে স্বপ্ন বুনেছেন চীনে লেখাপড়া করার, ‘মূলত আমি ওখানে পড়াশোনা ও খেলা এক সঙ্গে করবো। এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। তবে ভর্তি হইনি।’
তার এই সিদ্ধান্ত বাফুফেকে জানিয়েই নেওয়া। তবে জাতীয় দলের প্রয়োজনে যেখানেই থাকেন না কেন, চলে আসবেন, 'আমি পল স্যারকে (বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলি) জানিয়েই ক্যাম্প ছেড়েছি। তাকে এটাও বলেছি আমি যেখানেই থাকি, জাতীয় দলের প্রয়োজন হলে চলে আসবো।'
সম্প্রতি মেয়েদের ক্যাম্পে লেগেছে দ্রোহের আগুন। তিনদিন আগে অভিমানে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের অন্যতম স্ট্রাইকার স্বপ্না। একই দিনে মেয়েদের ফুটবলের সকল সাফল্যের রূপকার অভিজ্ঞ কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। মূলত বাফুফের গঞ্জনার শিকার হয়েই ছোটনের এই সিদ্ধান্ত। তাতেই হুলস্থুল লেগে গেছে ফুটবল অঙ্গনে। সালাউদ্দিন-কিরণের হাতে বন্দী নারী ফুটবল নিয়ে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। প্রিয় কোচ ছোটনের জন্য ভীষণ মন খারাপ আঁখির, 'সত্যি খুব খারাপ লাগছে স্যারের সরে যাওয়ার কথা শুনে।'
তাকে সুইডেনে খেলতে যেতে দেওয়া হয়নি। স্বপ্নাকেও ভারতের লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। আঁখি অবশ্য এই অপ্রিয় বিষয়গুলো এড়িয়েই যেতে চাইলেন। শুধু বলেছেন, 'স্বপ্না আপুর ভারতে খেলার সুযোগ ছিল। তার সঙ্গে কী হয়েছে, সেটা সবার জানা। আমার সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছে।'
শেষটায় আঁখি যা বলেছেন, তা দিয়েই নারী ফুটবলের ভেতরের চিত্রটা ফুটে উঠেছে। তারা দেশকে অসংখ্য সাফল্য এনে দিয়েছেন। গোটা দেশের কাছে তারা একেকজন খেলার মাঠের বীর সেনানী। তবে তাতে তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বাফুফের চতুর্থ তলায় গাদাগাদি করে থাকতে হয়। মাস শেষে জুটে নামকোয়াস্তে পারিশ্রমিক। সেটা বাড়ানোর দাবী করলেই নাম কাটা যায় গুডবুক থেকে। আঁখির কথায়, 'ভাইয়া, আমরা তো মেয়ে। আর কত কষ্ট করবো যদি ঠিকভাবে পারিশ্রমিকই না পাই?'
দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দল হওয়ার পরও আঁখিদের আকাশ ঢেকে আছে নিকশ কালো অন্ধকারে। এর দায় কী এড়াতে পারবেন, বছরের পর বছর মসনদ আঁকড়ে রাখা ফুটবল কর্তারা?
হার দিয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শেষ করলো চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটি। অন্যদিকে ৫-০ গোলের দাপুটে জয়ে শেষ করেছে দ্বিতীয় স্থানের আর্সেনাল। জিতেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। আর ৪-৪ গোলে ড্র করেছে লিভারপুল। সাউদাম্পটনের অবনমন আগেই নিশ্চিত হয়েছিল। রবিবার তাদের সঙ্গে নেমে গেছে লিস্টার ও লিডস। লিডস ১-৪ গোলে হেরে গেছে টটেনহ্যাম হটস্পারের কাছে। আর ২-১ গোলে ওয়েস্টহ্যামকে হারিয়েও লাভ হয়নি লিস্টারের। বেন্টফোর্ডের মাঠে হালান্ড-গুনদোয়ানসহ প্রথমসারির কয়েকজনকে খেলানইনি পেপ গার্দিওলা। সামনে ছিলেন আলভারেজ, মাহরেজ, তাদের পেছেন ফোডেন। ৮৫ মিনিট পর্যন্ত অরক্ষিত রেখেছিল সিটি তাদের গোল। ঠিক ওই সময়ে ব্রেন্টফোর্ডের ইথান পিনোক। পঞ্চম হার দিয়ে লিগ শেষ করে সিটি।
নগর প্রতিদ্বন্দ্বি ম্যানইউ ঘরের মাঠে জেডন সানচো ও ব্রুনো ফার্নান্দেজের দ্বিতীয়ার্ধের দুগোলে ফুলহ্যামকে হারিয়ে তৃতীয় হয়েছে। চেলসির সঙ্গে নিউক্যাসলে ১-১ গোলে ড্র করায় চতুর্থ স্থান নিয়ে শেষ করলো সৌদি যুবরাজের মালিকানধীন নিউক্যাসল। সাউদাম্পটনের সঙ্গে ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েও একপর্যায়ে ৪-২ গোলে পিছিয়ে পড়ে হারের শঙ্কায় পড়েছিল লিভারপুল। ৭২ ও ৭৩ মিনিটে কোডি গাকপো ও ডিয়েগো জোতার গোল ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে ইয়ুর্গেন ক্লপের শিষ্যরা। ৬৭ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম হয়েছে লিভারপুল। ব্রাইটন হয়েছে ষষ্ঠ। ঘরে মাঠে জাকার দুই ও সাকার এক গোলে উলভসের বিপক্ষে প্রথমার্ধেই ৩-০তে এগিয়ে যায় গানার্সরা। দ্বিতীয়ার্ধে জেসুস ও কিইয়োর আরো দুই গোল করলে বড় জয়ের স্বস্তিতে মৌসুম শেষ করে একসময় শিরোপা লড়াইয়ে থাকা আর্সেনাল।
নতুন পে-স্কেল কিংবা মহার্ঘ ভাতা নয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট অনুযায়ী। তাদের বেতন প্রতি বছর যতটা বাড়ার কথা এবার তার চেয়ে বেশি বাড়বে। আর তা চলতি বছরের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ানো হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশের বাইরে বাড়ানো হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত প্রায় এক বছর ধরে দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বেশিরভাগের একমাত্র আয় বেতন-ভাতা। বৈশি^ক মন্দার কারণে সরকারও খানিকটা সংকটে আছে। এ পরিস্থিতিতে পে-স্কেল দেওয়ার মতো বড় ধরনের ব্যয় বাড়ানো সরকারের পক্ষে কঠিন হবে। ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলে সরকারের ওপর চাপ বেশি হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সরকারি কর্মরতদের খানিকটা স্বস্তি দিতে কোন খাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এমন প্রস্তাব চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বাজেটবিষয়ক বিভিন্ন বৈঠকে সরকারি নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে আলোচনা করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই করে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করে। চলতি মাসে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী ওই বৈঠকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে কত বাড়তি ব্যয় হবে তা হিসাব করে পরের বৈঠকে উপস্থাপন করতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বড় ধরনের ব্যয় না বাড়িয়ে একটা উপায় বের করতেও বলেন। শেষ পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে নিজেই জানিয়েছেন।
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ২০১৫ সালের বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ বেতন কমিশন প্রণীত হয়েছিল। এ কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, আর নতুন বেতন কমিশন গঠন করা হবে না। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট বা বেতন বাড়ানো হবে। এ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তা হয়ে আসছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাব অনুযায়ী, দেশে সরকারি কর্মচারী ১৪ লাখ। বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে হিসাব করলে প্রায় ২২ লাখ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নিয়মিত ইনক্রিমেন্টের বাইরে আরও কতটা বাড়ানো যায় তা হিসাব করে নির্ধারণ করা হবে। এ কাজ করতে বাজেট প্রস্তাব পেশ করার পর আলাদা কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে যাচাই-বাছাই শেষে ইনক্রিমেন্টের হার সুপারিশ করবে। এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে বিদ্যমান ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে প্রতি মাসে বেতন বাড়ানো হবে, নাকি গড় মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে ইনক্রিমেন্টের হার বাড়ানো হবে, তা খতিয়ে দেখা হবে। ২০তম গ্রেড থেকে প্রথম গ্রেড পর্যন্ত সবার জন্য একই হারে বেতন বাড়নো হবে কি না, তা আরও খতিয়ে দেখা হবে। চূড়ান্ত হিসাব অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে প্রকাশ করা হবে। যে তারিখেই প্রকাশ করা হোক না কেন, আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকরী ধরা হবে।
এখানে মহার্ঘ ভাতা ১০ শতাংশ দেওয়া হলে এ হিসাবে ৪ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে ৬ হাজার কোটি এবং ২০ শতাংশ দেওয়া হলে ৮ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। অর্থাৎ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যয় বাড়বে। আর এতে সরকার ব্যয় কমিয়েও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টিতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো পথে হেঁটেছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতা বাবদ রাখা হয়েছে ছিল ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। খরচ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা বাজেট হওয়ার কথা আছে। এ বাজেট সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ ৭৭ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক পদ এখনো খালি আছে। এতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো হলেও সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের চাপ বাড়বে না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নির্মিত হয়েছে বিশেষ কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘ও ভোরের পাখি’। ঈমাম হোসাইনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করেছেন তামান্ন তিথি। অনুষ্ঠানটিতে আবৃত্তি করেছেন আশরাফুল আলম, মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, পলি পারভিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, আসলাম শিশির, সংগীতা চৌধুরী, আহসান উল্লাহ তমাল। প্রচারিত হয় ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টায়।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমারে দেবো না ভুলিতে’। অনুষ্ঠানটিতে গান, কবিতা ও আলোচনার সমন্বয়ে কবিকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ইয়াসমিন মুসতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, শেলু বড়ুয়া, ছন্দা চক্রবর্ত্তী ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন প্রফেসর মুন্সী আবু সাইফ। মনিরুল হাসানের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে ২৫ মে দুপুর ১ টা ০৫ মিনিটে। আরও প্রচারিত হবে সংগীতানুষ্ঠান ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘সন্ধ্যামালতী’। রাত ৯টায় প্রচারিত হবে নাটক ‘বনের পাপিয়া’ (পুনপ্রচার)।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোট শেষ হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫০টি কেন্দ্রের প্রাথমিক ফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকে আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩৭৯ ভোট এবং টেবিলঘড়ি প্রতীকে জায়েদা খাতুন পেয়েছেন ২ লাখ ৫ হাজার ৪১৩ ভোট।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
গাজীপুর সিটিতে মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের মধ্যে। দুজনই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। অপরদিকে ভোটের পরিবেশ ভালো বলে জানান আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহনূর ইসলাম রনি।
কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার পরও বিসিএস পরীক্ষায় নারীদের চাকরি পাওয়ার হার প্রায় একই রয়েছে। ১০ শতাংশ কোটা থাকা অবস্থায় তারা যে পরিমাণ চাকরি পাচ্ছিলেন, কোটা তুলে দেওয়ার পরও প্রায় একই হারে চাকরি পাচ্ছেন। সাধারণ ক্যাডার বা কারিগরি ক্যাডারে পিছিয়ে পড়লেও শিক্ষার মতো পেশাগত ক্যাডারগুলোতে এগিয়ে গিয়ে বিসিএসে মোট চাকরি পাওয়ার হারে প্রায় একই অবস্থান ধরে রেখেছেন নারীরা।
অথচ কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় বলা হয়েছিল, কোটা তুলে দিলে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণের গ্রাফ নিম্নমুখী হবে। আসলে তা হয়নি। কোটা তুলে দেওয়ার পরও তারা প্রায় সমানতালে এগিয়ে চলছেন।
৪০তম বিসিএস দিয়ে চাকরিতে ঢুকে বর্তমানে ঢাকা বিভাগে কর্মরত একজন নারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে বয়সে ছেলেরা চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা করে সেই বয়সে অধিকাংশ নারীকেই বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করতে হয়। সংসার করে, সন্তান লালনপালন করে নারীরা ভালো প্রস্তুতি নিতে পারে না। ফলে অনেক মেধাবী নারী প্রতিযোগিতায় উতরে যেতে পারেন না। অনেক নারী পারিবারিক কারণে বিয়ের পর চাকরির আবেদনই করেন না। বিয়ের পর পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধা আসে। এসব কাটিয়ে উঠে চাকরিতে প্রবেশ করা কঠিন। আর বিসিএসের চাকরি মানেই বদলিযোগ্য। সংসার-সন্তান রেখে বদলিকৃত পদে যোগ দেওয়া কঠিন বিষয়। সবকিছু মিলিয়ে নারীদের জন্য এ চাকরি সহজ নয়। একজন পুরুষ বেকার নারী বিয়ে করে, কিন্তু একজন নারী বেকার পুরুষ বিয়ে করে না। এ বিষয়টাও ছেলেদের প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। এ বাস্তবতা থেকেও পুরুষ প্রতিযোগী বেশি হয়। অন্যদিকে যোগ্য হলেও অনেক নারী প্রতিযোগিতাই করে না।
একজন নারী ইউএনও বলেন, পরীক্ষার হলে বা মৌখিক পরীক্ষার সময় অনেক নারীকে দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে সঙ্গে আনতে হয়। এগুলোও অনেক সময় নারীকে চাকরির ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে। ঘরে ঘরে বাধা পায় নারীর অগ্রযাত্রার নানা চেষ্টা। নগর-জীবনে নারীর অস্তিত্ব অনেকটা স্বচ্ছন্দের। কিন্তু নগরসভ্যতার বাইরে বিশাল বিস্তৃত গ্রামীণ জনজীবনে পুরুষতন্ত্রের নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত বেষ্টনী এখনো নারীকে ধরাশায়ী করে রাখে। হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথ হাঁটছে নারী-পুরুষ। তবু তাদের মধ্যে ভারসাম্য নেই।
কোটা না থাকার পরও নারীরা তাদের অবস্থান কীভাবে ধরে রাখলেন জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নারী শিক্ষায় বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। প্রাথমিকের পর মাধ্যমিকেও মেয়েরা অনেক এগিয়েছে। উচ্চশিক্ষায়ও মেয়েদের অংশগ্রহণের হার বেড়েছে। সবকিছু মিলে বিসিএসে এর প্রতিফল ঘটেছে। যে পরিমাণ মেয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, সেই তুলনায় চাকরিতে প্রবেশের হার বেশি। উচ্চশিক্ষায় যায় হয়তো ৮০ ভাগ ছেলে। আর মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার হার ৩০ বা ৩৫ শতাংশ। তাদের মধ্যে ২৬ বা ২৭ শতাংশ মেয়ে বিসিএস দিয়ে চাকরি পাচ্ছে। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে মেয়েরা অনেক ভালো করছে।’
এক প্রশ্নের জবাব ড. ইমতিয়াজ বলেন, ‘মেয়েদের কাছে শিক্ষা এখনো অপরচুনিটি (সুযোগ) আর ছেলেদের কাছে অধিকার। মেয়েরা যখন এ সুযোগটা পায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কাজে লাগাতে চায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিবারের ছেলেসন্তানের জন্য যে বিনিয়োগ, মেয়েসন্তানের জন্য এখনো তার চেয়ে অনেক কম। এখনো মনে করা হয় মেয়ে তো অন্যের ঘরে চলে যাবে। অথচ মজার বিষয় হচ্ছে, পরিবারের দায়িত্ব উচ্চশিক্ষিত ছেলের তুলনায় উচ্চশিক্ষিত মেয়ে অনেক বেশি বহন করে। এসব প্রতিবন্ধকতা হাজার বছরে তৈরি হয়েছে। এগুলো দূর হতে আরও সময় লাগবে।’
অন্যান্য কোটার মতো প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা ছিল। নারীরা যোগ্যতা অনুযায়ী মেধা কোটায়ও নিয়োগ পেতেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে মেধাভিত্তিক জেলা কোটার পাশাপাশি ১৫ শতাংশ নারী কোটা রয়েছে এখনো। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক জেলা কোটার পাশাপাশি ৬০ শতাংশ নারী কোটা সংরক্ষিত রেখে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে নারীরা সরকারি চাকরিতে পুরুষ প্রার্থীর সঙ্গে মেধা কোটায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিয়োগ লাভের পাশাপাশি সংরক্ষিত কোটায়ও নিয়োগ লাভের সুবিধা পেয়ে থাকেন।
শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ছাত্রীর হার বাড়ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এক দশকের বেশি সময় ধরে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর হার বেশি। কলেজ পর্যায়ে ছাত্র ও ছাত্রীর হার প্রায় সমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর হার ৩৬ শতাংশের বেশি।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকার। ৪০তম সাধারণ বিসিএস হচ্ছে কোটামুক্ত প্রথম বিসিএস। ধাপে ধাপে বাছাই করে গত বছর ৩০ মার্চ এই বিসিএসের চূড়ান্ত সুপারিশ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। প্রায় ১৩ মাস পর গত মাসে সেই সুপারিশের বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে পিএসসি। সেখানে বলা হয়েছে, ৪০তম বিসিএসে মোট ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশ নারী চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পেয়েছেন। যা কোটাযুক্ত ৩৮তম বিসিএসে ২৬ দশমিক ৯১ ও ৩৭তমে ২৪ দশমিক ৬০ শতাংশ ছিল। গত ১ নভেম্বর এ বিসিএসের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।
পিএসসির একজন সাবেক চেয়ারম্যান বলেছেন, কোটামুক্ত একটি সাধারণ বিসিএসে ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশ নারী চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পেয়েছেন এটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নারীদের শক্ত সক্ষমতা প্রকাশ করে। কারণ এর আগে কোটাযুক্ত ৩৮তম বিসিএসের তুলনায় মাত্র দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। অর্থাৎ কোটা তুলে দেওয়ার পরও নারীরা ১ শতাংশও পিছিয়ে পড়েননি। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, প্রত্যেক বিসিএসে নারীদের আবেদনের হার অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের হার পুরুষের তুলনায় কম অর্থাৎ গড় হার কম। পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতেও নারী প্রার্থীদের পুরুষের তুলনায় অনেক কম চোখে পড়ে। এমনকি কোনো কোনো কক্ষে নারী প্রার্থী থাকেই না। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ধাপগুলো অতিক্রম করার ক্ষেত্রে নারীদের অনুত্তীর্ণ হওয়ার পরিমাণ বেশি থাকে। ৪০তম বিসিএসে যোগ্য আবেদনকারী নারী ছিলেন ৩৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তাদের মধ্যে ১৯ দশমিক ১৯ শতাংশ নারী প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন। অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র। যোগ্য আবেদনকারী পুরুষ ছিলেন ৬১ দশমিক ৬২ শতাংশ। প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ পুরুষের হার ৮০ দশমিক ৮১ শতাংশ।
৪০তম বিসিএসের সাধারণ ক্যাডারে ২১ দশমিক ০৮ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। এই হার ৩৮ ও ৩৭তম বিসিএসে ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ১৪ ও ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
৪০তম বিসিএসের কারিগরি ক্যাডারে ২৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। এই হার ৩৮ ও ৩৭তম বিসিএসে ছিল যথাক্রমে ২৯ দশমিক ৫৩ ও ২৫ দশমিক ২ শতাংশ।
সাধারণ এবং কারিগরি ক্যাডারে নারীরা পিছিয়ে পড়লেও শিক্ষার মতো পেশাগত ক্যাডারে এগিয়েছেন। ৪০তম বিসিএসে ২৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। যা ৩৮তমে ২৬ দশমিক ৩০ এবং ৩৭তমে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ ছিল।
পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে নেওয়া ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারেও নারীরা পিছিয়েছেন। জেলা কোটাও না থাকায় নাটোর, ভোলা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি থেকে প্রশাসন ক্যাডারে কেউ সুপারিশ পাননি।
গত বছর প্রকাশিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্যসংক্রান্ত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস’ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সিভিল প্রশাসনের ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে ২৬ শতাংশ নারী। সরকারি দপ্তরের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করেন সবচেয়ে কমসংখ্যক নারী। মন্ত্রণালয়ের মোট জনবলের ১৯, অধিদপ্তরের ৩১, বিভাগীয় কমিশনার ও ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ের ১২ এবং আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ১২ শতাংশ কর্মী নারী।