
বাংলাদেশের বিগত ছেচল্লিশ বছরের ইতিহাস নিরবচ্ছিন্ন স্বৈরশাসনের ইতিহাস। এই স্বৈরশাসন কখনো ছিল নির্বাচিত, কখনো অনির্বাচিত; তফাৎ ওইটুকুই। রাষ্ট্র ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে, বিশেষ ক্ষমতা আইন এসেছে, এসেছে জননিরাপত্তা নামক নিপীড়নের হরেক আইন। ওই জননিরাপত্তা আইন রাষ্ট্রের চরিত্রটিকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে। এই আইন জনগণকে পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের হাতে তুলে দেবে; আর ক্ষমতা পেয়ে ওই দুই প্রতিষ্ঠান ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গ টাউটরা জনগণকে অর্থনৈতিকভাবে নিপীড়ন করবে, তোলা তুলবে। আগেও তুলত, কখনো থামায়নি, কিন্তু এখন তুলতে পারবে আরও সহজে, একবারে বৈধভাবে, ধরে এনে, কিংবা ধরে এনে জামিনের অযোগ্য করে কারাগারে মাসের পর মাস বন্দি করে রাখবার হুমকি দিয়ে। এই রাষ্ট্র বস্তিবাসীকে উৎখাত করে; বলে, সন্দেহ হচ্ছে তোমরা খাঁটি সন্ত্রাসী, কিন্তু শেয়ার বাজার, উন্নয়নের অর্থ আত্মসাৎকারী, ব্যাংক লুটকারী প্রকৃত ও খুনের মামলার আসামি যে সন্ত্রাসী তাকে সে পাহারা দেয়। এই রাষ্ট্র হুঙ্কারের, ধমকের ও হুকুমের; এর ভাষা জনগণের ভাষা, অর্থাৎ বাংলা ভাষা হবে, এ-সম্ভাবনা বহুভাবেই ক্ষীণ।
স্বাধীনতার পরে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা ইংরেজিবিরোধী ছিল না, বরং ইংরেজির দিকেই ঝুঁকে পড়েছিল। কেননা, ক্ষমতায় এসেছে মধ্যবিত্ত, যে-মধ্যবিত্ত পুঁজিবাদকেই আদর্শ মনে করে, এবং শ্রেণিগতভাবে যারা মোটেই উপনিবেশবাদের বিরোধী নয়। এরা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পছন্দ করে। কেননা, আমলাতন্ত্র এদের নিয়েই গঠিত। পুঁজিবাদে এদের সুবিধা, কারণ ওই পথেই ধনী হওয়ার সম্ভাবনা। পরের নেতৃত্ব আগের নেতৃত্বকে ছাড়িয়ে গেছে এক ব্যাপারে, সেটা হলো পুঁজিবাদের জন্য পথ প্রশস্তকরণ। আর ওই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভাষা তো বাংলা নয়, তার ভাষা হচ্ছে ইংরেজি।
অর্থনৈতিকভাবে আমাদের রাষ্ট্র মোটেই স্বাবলম্বী নয়, বরং তার পরনির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। ঋণ-সাহায্য এনজিও তৎপরতা, সবই রয়েছে পুরোদমে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারিত হয় ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফ-এর নির্দেশ অনুযায়ী, এদের ভাষা বাংলা নয়। বাঙালি এখন জীবিকান্বেষণে ও শিক্ষালাভের আশায় বিদেশে যেতে পারলে যত খুশি হয়, তত খুশি কম জিনিসেই হয়ে থাকে। এজন্য তাকে ইংরেজি শিখতে হয়।
দেশের ভেতরে ধনীগৃহের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমেই পড়াশোনা করে। ঢাকা শহর এখন ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার চেয়ে কম যায় না, ইংরেজি শিক্ষার উন্মাদনায়। বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে; এই সৌভাগ্য তার জন্য দুর্ভোগের কারণ হবে বলে আশঙ্কা, কেননা নতুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে, এই সম্পদ দখল করার অভিপ্রায়ে। একাত্তরে আমেরিকা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোরতর বিরোধী, স্বাধীনতার পরে সেই আমেরিকাই হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির প্রধান ভরসা।
আসল সত্য এই যে, বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি অন্য কিছু দেখে না, নিজেদের স্বার্থ ছাড়া। বাংলাদেশের বাজার তারা বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে, দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করছে এবং দেশে সম্পদ যা আছে তাও বিদেশিদের হাতে নির্বিচারে ও সোৎসাহে তুলে দিচ্ছে। শাসকশ্রেণির একাংশ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে, অন্য অংশ বলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে তাদের ধ্বনি একেবারেই অভিন্ন; সেক্ষেত্রে কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, আর কে নয়, তা নিরূপণ করা একেবারেই অসম্ভব। বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্র কথা বলছে তার নিজের ভাষায়, জনগণের স্বার্থের যে ভাষা, অর্থাৎ বাংলাভাষা, সে-ভাষায় নয়।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাভাষার অবস্থা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। দেশে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে। এ-শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই যে স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাবে তা নয়, অনেকেই দেশে থেকে যাবে এবং আগামী দিনে আমলাতন্ত্রের উচ্চতর স্তরে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, বিভিন্ন পেশায় এবং রাজনীতিতেও এরা নেতৃত্ব দেবে। ওই নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখনই ইংরেজি-মিশ্রিত বাংলায় কথা বলে, ভবিষ্যতে মিশ্রণটা থাকবে না, ইংরেজিতেই কথা বলতে পছন্দ করবে। এবং যারা পারবে না তারা নিজেদের হীনজ্ঞান করা শুরু করবে। বাংলা মাধ্যমে স্কুলগুলোই অবশ্য শিক্ষাক্ষেত্রে প্রধান ধারা। কিন্তু এই ধারা ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে। অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষাকে জোরদার করা হচ্ছে। এই ধারায় বাংলাভাষা চর্চা কম, এবং এখানে যারা শিক্ষিত হচ্ছে পরবর্তীকালে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, রাষ্ট্রকে আরও দক্ষিণ দিকে ঠেলে দিতে চাইবে, এমন আশঙ্কা মোটেই অমূলক নয়।
আসলে মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করা আর গরিব মানুষকে আরও গরিব করার চেষ্টা যে রাষ্ট্রীয় অভিপ্রায়, তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই বরং বলা যায় এরা একই সূত্রে গ্রথিত। গরিবের সন্তানই মাদ্রাসায় পড়ে, এবং পরবর্তী জীবনে জীবন-সংগ্রামে ব্যর্থ হয়ে এরা আরও গরিব হবে। কেননা, তাদের শিক্ষার কোনো অর্থনৈতিক মূল্য তারা দেখতে পাবে না, ধর্মীয় কাজে আর ক’জনের কর্মসংস্থান হবে? শিক্ষাক্ষেত্রে এই যে বৈষম্য একে অস্বাভাবিক বলবার কোনো উপায় নেই। বরং বলতে হবে যে এটাই স্বাভাবিক। কারণ সমাজে বৈষম্য রয়েছে। এবং রাষ্ট্র সেই বৈষম্যকে মহোৎসাহে বিকশিত করছে ও কায়মনোবাক্যে পাহারা দিচ্ছে, এবং সেই বৈষম্যই স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে এসেছে শিক্ষাব্যবস্থাতে।
উচ্চতর শিক্ষায় বাংলাভাষা চালু করা হবে বলে আশা করা হয়েছিল। সেই আশা এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর কারণও ওই একই। যে-রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা নয়, সেই রাষ্ট্র উচ্চশিক্ষায় বাংলা প্রচলনের জন্য চেষ্টা করবে কেন? নির্মম সত্য এই যে, উচ্চবিত্তদের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা ইংরেজিতেই লাভ করবে বলে আশা রাখে। কেউ কেউ বিদেশেই যাবে। ওই উদ্দেশ্যে যারা যাবে না তারাও ব্যক্তিমালিকানাধীন তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো বটে এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ইংরেজির মাধ্যমেই শিক্ষিত হবে। উচ্চবিত্তরাই সমাজের নেতা, তারাই আদর্শ, অন্যরাও তাদের পথেই চলতে চাইবে, চলতে ব্যর্থ হলে ব্যর্থতার দুঃখে কপাল ঠুকবে।
বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি লোকের বাস। সারা বিশ্বে বাংলাভাষীর সংখ্যা বিপুল, বাংলাভাষায় উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা কোনো অসম্ভব কাজ ছিল না। তার জন্য প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রীয় উদ্দীপনা ও বিনিয়োগের। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন বই লেখার, বাইরের বিশ্বে যা লেখা হচ্ছে সেগুলো অনুবাদ করার। কাজটা প্রকৃত অর্থে বলতে গেলে শুরুই হয়নি; যে জন্য এখন বাংলা ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে অর্থনীতি। মধ্যবিত্তের একাংশ নিম্নমধ্যবিত্তে পরিণত হয়েছে, নিম্নমধ্যবিত্ত আরও নিচে নেমেছে, প্রান্তিক কৃষক পরিণত হয়েছে ভূমিহীনে, ভূমিহীন হয়ে পড়েছে ভিটাহীন। সবকিছুই ঘটেছে উন্নতির অন্তরালে। বস্তুত উন্নতির প্রচণ্ড চাপের কারণেই। এই যে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ, এদের জীবনে কোনো ভাষা নেই, নীরব ক্রন্দন ও আর্তনাদ ছাড়া। রাষ্ট্রভাষা থেকে এরা অনেক দূরে, রাষ্ট্রের ভাষা থেকে তো অবশ্যই। রাষ্ট্রের ভাষা এদের সন্ত্রস্ত রাখে এবং রাষ্ট্রভাষার চর্চা যে করবে, তেমন সুযোগ এরা পায় না।
আমাদের দেশে সবচেয়ে শক্তিশালী গণমাধ্যম হচ্ছে টেলিভিশন; টেলিভিশন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে চলে, রাষ্ট্রের শাসন কর্তৃত্বে পরিবর্তন ঘটে, একদল যায় আরেক দল আসে, কিন্তু টেলিভিশনের ভাষা সেই একই থাকে, সেটি রাষ্ট্রের ভাষা, অর্থাৎ শাসকশ্রেণির ভাষা। শাসকশ্রেণি তাদের মাহাত্ম্যের কথা বলতে থাকে। একবার এ দল বলে আরেকবার বলে অন্য দল। সংবাদপত্রগুলোও শাসকশ্রেণির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বটে; হয় এ দলের নয় তো ও-দলের, যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তাদের কর্তৃত্ব বাড়ে, স্বভাবতই।
রাষ্ট্রের আদর্শ পুঁজিবাদী, কিন্তু এই রাষ্ট্রে আবার সামন্তবাদকেও উৎসাহিত করে, নিজের স্বার্থে। ধর্মকে নিয়ে আসে রাজনীতিতে। এর একটা কারণ, রাষ্ট্রের যারা শাসক তারা স্থূল অর্থে বস্তুতান্ত্রিক অবশ্যই, যা পায় তাই খায়, কিন্তু দার্শনিক অর্থে ইহজাগতিক নয়, পরকালের কথা ভাবে এবং ইহকালে যেসব সুখ-সুবিধা পাচ্ছে সেগুলো পরকালেও পাবে, পেতেই থাকবে, এই আশাতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অন্যদিকে জনগণকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য আবার ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান ও সান্ত¡না সরবরাহ করা হয়। আজকের বাংলাদেশে বড় দু’দলের কোনোটিই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করে না। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল, বিএনপি তাকে সরিয়ে দিয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, তারা যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনঃস্থাপিত করেনি বরং রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সংবিধানভুক্ত করেছে।
কী করতে হবে আমরা জানি। রাষ্ট্রকে জনগণের সম্পত্তি ও অবলম্বনে পরিণত করতে হবে, অর্থাৎ তাকে গণতান্ত্রিক করার দরকার হবে, প্রকৃত অর্থে। সেটা যখন সম্ভব হবে তখন রাষ্ট্রের ভাষা এবং রাষ্ট্রভাষার মধ্যকার ব্যবধান দূর হবে; বাংলা হবে রাষ্ট্রের ভাষা, সর্বস্তরে তা চালু থাকবে। এই ভাষায় সৃষ্টিশীল কাজ হবে। বিশ্বের মানুষ একে মর্যাদা দেবে। জনগণের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি আসবে। রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন আনার লক্ষ্যেই তো আমরা আন্দোলন করেছি উনিশ শ’ বায়ান্নতে এবং একাত্তরে। একই আন্দোলন। আজ যে দেশে এত হতাশা তার কারণ ওই আন্দোলন এখন নেই। অথচ তার খুবই প্রয়োজন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিদ্যমান রাজনীতির প্রধান দুটি ধারা, যারা আসলে একই ধারা, তারা এই আন্দোলন করবে না। নতুন রাজনৈতিক ধারা দরকার হবে, সেই ধারা গণতান্ত্রিক হবে, অর্থাৎ তাকে বাম দিকের হতে হবে, ডান দিকের না-হয়ে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এক।
বাস্তিল দিবসে ফরাসি জাতি শতবছরের গ্লানি মুছে লাভ করেছিল নবজন্ম একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি জাতি খুঁজে পেয়েছিল তার আত্মপরিচয়। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন প্রধানত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও পরিণতিতে তা জাতিসত্তার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা উৎস হিসেবে পালন করেছে ঐতিহাসিক ভূমিকা।
দুই।
সব অর্জনের বা গৌরবে এমন দীর্ঘস্থায়িত্ব থাকে না সব সময়। হয় সে অস্পষ্ট নয়তো ভঙ্গুর হয়ে যায়। অথবা প্রাসঙ্গিকতা তাকে ছেড়ে যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা দিবস কিন্তু থেকে গিয়েছে, এত বছর পরেও একই রকম প্রাসঙ্গিক। কেবল একটি ভাষার জন্য। তার সম্মানের জন্য জীবন দেওয়ার কথা ভোলেননি কেউ, ইতিহাসেও তা একক। তবে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব যুদ্ধের পরিবর্তন হয়েছে, এ কথাও অনস্বীকার্য। এ যুদ্ধের একটি পরত নিশ্চয়ই বহুমাত্রিক, বহু ভাষাভাষী-পরাক্রম। দুই বাংলা ও দেশের বাইরে বসবাসকারী মানুষ মিলিয়ে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ৩০ কোটি।
পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ভাষার তালিকায় বাংলা ভাষা পঞ্চম। এই গৌরবের ভাষায় আত্মমর্যাদায় বাংলাদেশ তার ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে সসম্মানে। কিন্তু আমরা সত্যি তার সম্মান রাখতে পেরেছি? বাংলা ভাষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চেষ্টা আমাদের কতটুকু? বহুলাংশে মাতৃভাষায় শিক্ষানীতির প্রচলনের উদ্যোগ আজও সফল হয়নি। মাতৃভাষায় শিক্ষার পক্ষে নোম চমস্কির মতো সুবিদিত। ভাষার মাধ্যমে বিষয়কে চেনা নয় একই সঙ্গে ভাষা ও ইতিহাসের সাংস্কৃতিক পরম্পরা এক এবং অভিন্ন। প্রায়শ আমরা সেটি ভুলে যাচ্ছি।
তিন।
১৯৫২ সালের ভাষার লড়াইটি বাঙালিকে চিনিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রটির ধারালো রূপ। সে কারণেই ভাষার লড়াইয়ের পথ ধরেই এগিয়েছে পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন। প্রতিটি পদক্ষেপেই রাজনীতির সঙ্গে প্রগাঢ়ভাবে মিশেছিল সংস্কৃতি। বাঙালির কাছে একুশে মানে নোয়ানো যায় না এমন মেরুদণ্ড ও সাহস। সেই সাহসে বায়ান্নকে স্পর্শ করে রচিত হয় একাত্তর। সেই সাহসে পাকিস্তান নামের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে চুরমার করে দেয় ৩০ লাখ বাঙালির রক্তের স্রোত।
একুশ বাঙালিকে শিখিয়েছে যে, যেকোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে। আমরা যখনই অন্ধকার শক্তির আক্রমণের শিকার হয়েছি, একুশে হয়ে উঠেছে তখন প্রতিরোধের সাহস। অবশ্য বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির শক্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ অন্ধকার শক্তি হারিয়ে যায়নি। সে কারণেই মাতৃভাষার হাত ধরে থাকা মুক্তচিন্তা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর হামলার ঘটনাগুলো ঘটেছে। কারণ অপশক্তিরা ভালো করেই জানে বাঙালির শেকড় তার ভাষার লড়াই, সেই লড়াইয়ের স্মৃতি থেকেই দৃঢ় হয়ে ওঠে এই বাঙালির সংস্কৃতির ঔদার্য। সে কারণেই আমরা দেখেছি, পাকিস্তানিরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে শহীদ মিনার। তবে এই মিনার আমাদের কাছে ইট-সিমেন্টের একটি অবয়বই নয়, আমাদের হৃদয়ে স্থাপিত এক বাতিঘর। সে কারণেই এই মিনার কখনো ভেঙে ফেলা সম্ভব না। এই চেতনার বিনাশ নেই আছে বিকাশ।
চার।
বিভিন্নভাবে একেকটি ভাষা অন্য একটি ভাষার ভেতর প্রবেশ করে থাকে। আধিপত্য, বাণিজ্য, যাযাবরবৃত্তির কারণে একেকটি ভাষা অন্য একটি ভাষার শব্দে নিজের স্থান করে নেয়। এতে গ্রাসকারী ভাষাটি সমৃদ্ধ হয় সন্দেহ নেই। বাংলা ভাষার ভেতর আরবি, উর্দু, ফারসি, ইংরেজি বহু ভাষার হানা আছে। বেশির ভাগ দস্যু যাযাবর লুটেরা বাংলায় সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টাকালে তাদের ধর্ম ও ভাষাকেও আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার বানিয়েছিল। পাকিস্তানিরা তাদের উর্দু ভাষাকে বাংলার ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল; যা টেনে এনেছে একাত্তর।
তবে আমাদের ওপর সর্বশেষ যে দুটো আগ্রাসী ভাষা আগ্রাসন চালাচ্ছে তা হলো ইংরেজি আর হিন্দি। এদের আক্রমণের উপায় ভিন্ন। এরা আমাদের কাছে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ডাকাতি করতে আসে।
পুঁজিবাদ শুধু পণ্যনির্ভর নয়, ভাষানির্ভরও। বড় পুঁজির যারা কারবার করে, তাদের ভাষাও যে আধিপত্য বিস্তার করবে এটা পুঁজিবাদের ধর্ম। পণ্যায়ন মানুষকে নীতি, ভাষা ও সংস্কৃতিহীন করে তোলে। ক্রমেই ভোক্তাকে সাংস্কৃতিক শেকড়হীন করে তোলার ভেতর বাণিজ্য বিস্তারের রাজনীতি আছে। ‘বিশ্বায়ন’ এই ব্যবস্থার প্রকল্প। অন্যান্য ব্যবসার মতোই তারা ভাষা ও শিক্ষা ব্যবসায় নিয়েছে লাভজনক পরিকল্পনা।
পাঁচ।
সারা পৃথিবীতে ইংরেজি এক ভয়াবহ দানবে পরিণত হয়েছে। এই বিশ্বায়নের যুগে মূল আধিপত্যই ভাষাভিত্তিক। একটা সময় ছিল লেখার সঙ্গে বা কথা বলার ফাঁকে একটু-আধটু ফরাসি বা হিস্পানি বলাটা আভিজাত্যের পর্যায়ে পড়ত। রাশিয়ার সাহিত্যিক তলস্তয় বা দস্তয়েভস্কি বা অন্যান্য লেখকের লেখাতেও প্রচুর ফরাসি উদ্ধৃতি চোখে পড়ে। বিশ্বব্যাপী সেই জায়গাটা শুধু ইংরেজি দখলই করেনি, পুরোপুরি ইংরেজিতে লিখতে পড়তে চিন্তা ও জীবনযাপন করতে প্রলুব্ধ করেছে, বিভিন্ন কায়দায় বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শিক্ষাকেও বাজারব্যবস্থার আওতায় আনার ফলে শিক্ষা এখন শিক্ষক-ছাত্রের ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য পণ্য উৎপাদনকারী করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাইভেট স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় বিনিয়োগের মাত্রা বাড়িয়েছে। বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থা এখন আন্তর্জাতিক করপোরেট বাণিজ্যের অন্যতম লাভজনক ব্যবসা।
একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে, আর মনে করায়, শুধু সেই অমর শহীদদের জন্যই নয়, ইতিহাসের জন্যও নয়, ভবিষ্যতের জন্যও বাঁচিয়ে রাখতে হবে বাংলা ভাষার এই অক্ষর, এই কথন, এই ভাষ্য। ভাষার পাহারাদার হয়ে শুধু নয়, ভাষার লড়াইকে কেন্দ্রে ধারণ করেই আমাদের পাড়ি দিতে হবে সব অন্ধকার, জিততে হবে সবগুলো লড়াইয়ে। আর সেই লড়াইয়ে একুশ আছে, থাকবে আমাদের শেকড় আর সাহস হয়েই।
লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটি
অন্তর্জালের দুনিয়ায় আমরা যে শব্দটি খুব শুনে থাকি তা হলো ‘ভাইরাল’। কোনো ছবি, শব্দ, ভিডিও ইত্যাদি যদি সোশ্যাল মিডিয়ার খুব অল্প সময়ের ভেতর দ্রুত ও বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তবে তার সামাজিক নাম ‘ভাইরাল’। ভাইরাস থেকেই ভাইরাল শব্দের উৎপত্তি। ভাইরাস ও ভাইরাল সর্বদা ক্ষতিকর নয়। সমাজের সবচেয়ে বড় সংস্কৃতি ভোক্তা মধ্যবিত্তশ্রেণি। আজ থেকে মাত্র দেড় বা দুই দশক আগেও সমাজে কী গৃহীত হবে, কী দেখানো যাবে আর কী সংস্কৃতি আর অপসংস্কৃতি তার সীমানা নির্ধারণ করত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। ফলে মিডিয়া যত শক্তিশালী হয়েছে সমগ্র দুনিয়ায় ততই বৈচিত্র্যহীন সংস্কৃতির ভূত মানুষের ওপর চেপে বসেছে। লক্ষ করলে দেখা যায়, দুনিয়ার বেশির ভাগ মেইন মিডিয়ার নিউজ, নাটক, সিনেমার গল্প, রিয়্যালিটি শো, নৈতিক অবস্থান, নান্দনিক দৃশ্যকল্প, স্টারদের গায়ের রঙ, পোশাক, আচরণ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ইত্যাদি মোটা দাগে একই রকম। কারণ সমগ্র দুনিয়া, ক্ষেত্রবিশেষে নির্দিষ্ট দেশ-কালের কালচারাল ইন্ডাস্ট্রির নিয়ন্ত্রণ অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান করে থাকে।
দুনিয়ায় কোনো সত্য মানুষ জানবেন তা স্বাধীন কোনো বিষয় না। আমেরিকা কর্র্তৃক ইরাক আক্রমণের আগে তাদের লুকানো অদৃশ্য অস্ত্র আমেরিকান মিডিয়া শুধু একা একা দেখেনি, সমগ্র দুনিয়ার মিডিয়াতেও তা দেখতে বাধ্য করেছে। তারা কি বন্দুক ঠেকিয়ে এটা করতে বাধিত করেছে? না। ফ্যাশন বলতে আমরা কী বুঝি তাও দু-তিনটা মিডিয়া ঠিক করে দেবে। পহেলা বৈশাখে আপনি কী করবেন তার পুরোটা দায়িত্ব এদের। যদি আপনি তা করতে না পারেন বা করতে না চান তবে আনকালচারড হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। শিল্প-সাহিত্যের সংজ্ঞাও মোটামুটি তৈরি করে দিয়েছে। ফলে, দুনিয়ায় সংস্কৃতি ক্ষুধার্ত মানুষের মনে আমাদের মিডিয়াগুলো যে খাবার তুলে ধরেছে তা মোটা দাগে একই রকম। লক্ষ করে থাকবেন, সারা দেশে সিনেমা হল বলে আর কিছু নেই। সিনেপ্লেক্স নামক একটা ব্যাপার গড়ে উঠেছে, যার একমাত্র ভোক্তা উচ্চমধ্যবিত্ত। দেশের গরিববান্ধব সিনেমা হলগুলো কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে বন্ধ করা হলো?
আপনাদের যদি স্মরণ থাকে তবে দেখবেন নব্বই ও প্রথম দশকের শুরুর দিকে দেশের প্রথম সারির মিডিয়াগুলো একসঙ্গে এসব গরিবের সিনেমাকে ‘ছিঃনেমা’ ট্যাগ দিয়ে বছরের পর বছর রম্যরচনা লিখতে লিখতে ইনভ্যালিড করে দিয়েছে। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সিনেমা হলে যেত তাদের লজ্জা দেওয়া হয়েছে, তাদের অপরাধবোধে ভুগতে বাধ্য করা হয়েছে কারণ, তাদের মানদ-ে মানহীন সংস্কৃতিকে ধারণ করার জন্য। লজ্জা ও অপরাধ না করেই মানুষের ভেতর অপরাধবোধ জাগ্রত করা বন্দুক দেখিয়ে ভয় দেখানো থেকে কোনো অংশে কম নয়। কালচারাল পুলিশিংয়ের পাশাপাশি অদৃশ্য আইন আদালতে এগুলো যারা ধারণ ও তৈরি করে তাদের জেল-জরিমানাও হয়েছে। পরিশুদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয় মানুষের স্বাধীনচিন্তা ও চর্চার বিপরীতে মানদ- তৈরির ফ্যাসিবাদ দিয়ে। এসব ঘটনার ফলাফল দুটো।
প্রথমত, হলগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ভ্যানওয়ালা, রিকশাওয়ালা, মুটে, মজুররা যেখানে অল্প খরচে বিনোদন ভোগ করতে পারত, সেখানে তাদের জন্য আর কিছু অবশিষ্ট থাকল না। পরিবর্তে গড়ে উঠেছে শহরের অভিজাত শপিং মলে খাবারের দোকানের পাশে সিনেপ্লেক্স, প্রযুক্তির কল্যাণে ওটিটি। আরও মজার বিষয় হলো, আপনারা আরও লক্ষ করে থাকবেন যে, এসব ওটিটি প্ল্যাটফরমের মালিক ঘুরে-ফিরে সেসব মিডিয়া যারা জনবান্ধব সিনেমাকে ‘ছিঃনেমা’ বলে ব্যঙ্গবিদ্রƒপ করে একে মোরালি নাই করে দিয়েছে। এরপর চলচ্চিত্রের যে মান নির্ধারণ করেছে তা অনুযায়ী এসব আর্টফিল্ম ডিরেক্টরই ওটিটি বা সিনেপ্লেক্সগুলোর জন্য কনটেন্ট তৈরি করছেন অতি অল্প বাজেটে পুঁজির প্রফিট নিশ্চিত করার জন্য। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। সংস্কৃতির আরও যা যা অনুষঙ্গ আছে শিল্প, সাহিত্য, মঞ্চ, গান সর্বস্তরে প্রায় একই ঘটনা ঘটে গিয়েছে।
করপোরেট মিডিয়া দেশের সব মানুষকে একই বই পড়াতে চায়, একই স্বাদের খাবার খাওয়াতে চায়, একই রকম গান শোনাতে চায়, সব নাটকের কলাকুশীলব ঘুরে-ফিরে একই, তাদের উপস্থাপিত নায়করা একই টাইপের গল্পে একই টাইপের ডায়ালগ দেন। ব্যয়বহুল ‘দামে বেশি মানে কম’ মিডিয়ার দুয়ারে দুয়ারে বছরের পর বছর ঘোরা ছাড়া একজন আর্টিস্টকে এরা স্থান দেবেন না। শিল্পী কাজটা করবেন কখন? মিডিয়ার ভেতর দিয়ে কিছু হয়ে ওঠা লটারি জেতার মতো বিষয় ছিল একসময়। ফলে যোগ্যতা থেকে যোগাযোগই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমন অগণতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থাই আবার গণতন্ত্র, মুক্তির কথা বলে!
‘কেননা, তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’
দ্বিতীয়ত, এই সংস্কৃতি থেকে ‘গরিবের নিম্নরুচি হটাও, দখল করো’ ঘটনার পর বাদ পড়া বিপুল জনগণের সাংস্কৃতিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য বিরাট এক শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এখানে বড় ধরনের একটা বিপ্লব সাধনের সুযোগ তৈরি করল। বরিশালের লঞ্চে উঠে যার হাতে ক্যামেরা আছে তিনিই সাংবাদিক। একটা মোবাইল ও ইন্টারনেট থাকলেই কোনো মেইন মিডিয়ার জন্য আর অপেক্ষা করার দরকার নেই। শুধু মোবাইল বা স্বল্পমূল্যের হ্যান্ডিক্যাম ও গ্রিনস্ক্রিন ব্যবহার করে মানুষ নিজেই নিজের স্টুডিও তৈরি করে লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে কয়েক সেকেন্ডে। নিজের তৈরি ওয়েবসাইটে মতামত তৈরি করতে পারে যেকোনো প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া থেকে বেশি। যে সংস্কৃতিকে ‘নিম্নরুচি’র বলে দূরে সরিয়ে দেওয়া হলো তার চাহিদা ও প্রাসঙ্গিকতা সমভাবেই সমাজে বর্তমান ছিল। এই শ্রেণির জন্য কোনো প্রোডাক্ট আমাদের কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি তৈরি না করলেও তা উৎপাদনের দায় বের করে দেওয়া জনগণ নিজেরাই বহন করেছেন।
দেশের প্রথম শ্রেণির পত্রিকা থেকে কারও কারও ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলের ভিউ কয়েকশ গুণ বেশি। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে উঠে আসা হিরো আলম দেশের করপোরেট মিডিয়ার সেবক নায়ক-নায়িকা থেকে বেশি জনপ্রিয়। এই কথা নিজের রুচি নিয়ে ব্যায়াসনেসের কারণে মানতে চাইবেন না, কিন্তু এটাই সত্য। জনগণের এই নতুন নায়করা শুধু জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে না সামাজিক কর্মকা-েও অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে। ফলে, একমুখী সংস্কৃতি তৈরি মাস্টারপ্ল্যানের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরম বড় ধরনের প্রতিরোধ বলা চলে। কেননা পরিসংখ্যান বলে, মানুষ প্রায় গড়ে আড়াই ঘণ্টা সক্রিয়ভাবে এখানে সময় কাটান। টিভি বা অন্য মিডিয়ায় মানুষ এখন আর এতটা সক্রিয় নন।
‘ভাইরাল’ সংস্কৃতিকে সন্দেহজনক ব্যাপার হিসেবে দেখানোর একটা চল আছে করপোরেট মিডিয়ার পক্ষ থেকে। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নিজের রুচির শ্রেষ্ঠত্বের বোধ নিয়ে জীবনযাপন করতে শেখানো হয়। সংস্কৃতির কোনো ভালো-মন্দ হয় না। ফলে, যে কাজ মিডিয়া রম্যরচনা দিয়ে করছে তারই এক্সটেনডেড রূপ হলো, ভাইরাল হয়ে সামনে উঠে আসা মানুষদের ছোট হিসেবে দেখানো। দুনিয়ায় সব সেনাবাহিনীর একটা কাল্পনিক শত্রু থাকা লাগে সক্ষমতার বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের জন্য। আমাদের মধ্যবিত্ত রুচির কাল্পনিক শত্রু হলো ভাইরাল থেকে আসা সাধারণ মানুষগুলো। সমাজের তলানির মানুষরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যেকোনো নায়ক থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পেরেছে আমাদের বাস্তবতায় ভাইরাল হয়ে ওঠার কারণে।
এর বিপরীত চিত্রও আছে। কিছু কিছু ভাইরাল ভাইরা ভাইরাস হয়ে বিভিন্ন কোম্পানির পণ্যের বিজ্ঞাপনে জানপ্রাণ দিয়ে দিয়েছেন। অল্টারনেটিভ মিডিয়ার সাহিত্যিক বা গায়ক মেইন মিডিয়ায় গিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য আর ধরে রাখতে পারেননি। কোক স্টুডিও বাংলা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের কাজ দ্বারা জনপ্রিয় বেশ কিছু শিল্পীকে পিক করেছিল। তাদের চ্যানেলে গিয়ে আগের গানগুলো শুনে আসুন। পার্থক্য দেখতে পাবেন। কোক স্টুডিওতে গান গাওয়ার আগে যে নিবেদন ও নিরলস সাধনার স্পর্শ পাওয়া যায়, পরে তা বেশ বিরল। তারা ফর্মেটেড একটা সুরের ভেতর হারিয়ে যাওয়া শিল্পী। কাকলী ফার্নিচারের অ্যাড দেশের যেকোনো প্রথম শ্রেণির অ্যাড এজেন্ট দিয়ে বানানো কমার্শিয়াল থেকে সফল। সফল এই অর্থে যে, অ্যাডের কাজ মানুষের কাছে পৌঁছানো, নন্দন তৈরি না। ভুবন বাদ্যকারের কাঁচা বাদাম গতানুগতিক আনন্দহীন সংগীতের প্রতি একপ্রকার বিদ্রোহ। এমন ঘটনা আরও আছে। ফলে, মেইন মিডিয়ার যে শক্তি ও দৌরাত্ম্য তা ভেঙে গিয়েছে। আজকের টিভি বা প্রিন্ট মিডিয়া থেকেও ব্যক্তি-মানুষের মিডিয়া শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। দেশের প্রথম শ্রেণির পত্রিকার সারা দিনের ভিউ থেকে অনেক রাজনৈতিক ইউটিউবার বক্তাদের গড় ভিউ বেশি।
ফলে, আমাদের মিডিয়ার জন্য জনসংস্কৃতি থেকে ওঠে আসা ভাইরাল চরিত্রগুলো বড় থ্রেট। এই অস্তিত্ব সংকটটা আমাদের মেইন স্ট্রিম মিডিয়া বুঝতে পারে। ধীরে ধীরে দুনিয়ায় মেইন স্ট্রিম মিডিয়া সেকেন্ডারি মিডিয়া হয়ে উঠছে। ফলে, মেইন মিডিয়ার সংস্কৃতি ও ভাইরাল সংস্কৃতির একটা দ্বন্দ্ব খুব প্রবলভাবে চলছে। সংস্কৃতির জয়-পরাজয় হয় না। এই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে মেইন ও ভাইরালের একটা হাইব্রিড সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। মানুষ যতটা নিজেকে প্রকাশের সুযোগ পাবে নানাভাবে, ততই তা দুনিয়ার জন্য মঙ্গলকর। আমাদের কাজ সচেতনভাবে এগুলো ধরতে ও বুঝতে পারা। শুধু বুঝতে পারলেই হবে না, কণ্ঠটা ছাড়তে হবে জোরে।
লেখক: কবি, লেখক, অনুবাদক
কিংবদন্তি বাঙালি জাদুশিল্পী পি সি সরকার ১৯১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার আশেকপুর গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম প্রতুলচন্দ্র সরকার। স্থানীয় শিবনাথ হাইস্কুলে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। গণপতি চক্রবর্তী ছিলেন তার জাদুবিদ্যার গুরু। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিনি জাদু দেখানো শুরু করেন এবং কলেজে অধ্যয়নকালে পুরোপুরি জাদুবিদ্যার চর্চা শুরু করেন। ১৯২৯ সালে প্রবেশিকা এবং ১৯৩৩ সালে গণিতশাস্ত্রে অনার্সসহ বিএ পাস করে তিনি জাদুকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। পি সি সরকার শুধু জাদুশিল্পীই ছিলেন না, তিনি একজন লেখকও ছিলেন। জাদুবিদ্যা বিষয়ে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ইংরেজি, বাংলা ও হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত তার গ্রন্থের সংখ্যা ২০টি। গ্রন্থগুলো জাদুবিদ্যার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। জাদুশিল্পে পি সি সরকারের কৃতিত্ব হলো তিনি বহু প্রাচীন জাদুখেলার মূল সূত্র আবিষ্কার করেন। ‘এক্স-রে আই’, ‘করাত দিয়ে মানুষ কাটা’, ‘ওয়াটার অব ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি তার জনপ্রিয় খেলা। ১৯৩৪ সালে তিনি বিদেশ গমন করেন এবং ৭০টির মতো দেশে জাদু প্রদর্শন করে ব্যাপক খ্যাতি ও পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করেন। অস্ট্রেলীয় টেলিভিশন, বিবিসি, শিকাগোর ডাব্লিউজিএনটিভি এবং নিউ ইয়র্কের এনবিসি ও সিবিএস টেলিভিশনে বহুবার তার জাদু প্রদর্শিত হয়েছে। ১৯৫৭ ও ১৯৬৭ সালে আমেরিকায় এবং ১৯৬২ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো ও লেনিনগ্রাদ শহরে জাদু প্রদর্শন করে তিনি বিপুল সুনাম অর্জন করেন। জাদু দেখিয়ে তিনি দুবার আমেরিকার জাদুবিদ্যার নোবেল প্রাইজ বলে খ্যাত ‘দি ফিনিক্স অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। তার পুত্র পি সি সরকার জুনিয়রও একজন বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী। ১৯৭১ সালের ৬ জানুয়ারি জাপান সফরকালে পি সি সরকার মৃত্যুবরণ করেন।
যানজটে রাজধানীবাসীর কাহিল অবস্থা। কোটি-ঊর্ধ্ব মানুষের, সড়কে চলাচল প্রায় অচল হয়ে পড়ছে। প্রাইভেট কার, পাবলিক বাস, ট্রাক, লরি, রিকশা, ভ্যান এবং দূরপাল্লার বাসের কারণে রাজধানীবাসীর ত্রাহি অবস্থা। এরমধ্যে আবার সাধারণ মানুষের পায়ে হাঁটা পথ দখল করে আছে হাজার হাজার হকার। এই ফুটপাত, এখন আর সাধারণ মানুষের না। রাজধানীর কয়েকটি অভিজাত এলাকা ছাড়া, সমস্ত এলাকার ফুটপাতেই হকারের দৌরাত্ম্য। তারা নিয়মিত চাঁদা দেন। কে নেয়, এই টাকা? সবাই জানে। কিন্তু কেউ বলে না। যে কারণে, সড়কপথের চিন্তা বাদ দিয়ে অল্পসময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ফ্লাইওভার। কিন্তু সেখানেও শুরু হয়েছে ভয়ংকর সব কর্মকান্ড।
অপরাধীরা বসে থাকে না। তারা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। এদিক থেকে, ফ্লাইওভার তাদের কাছে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। অপরাধ করে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সটকে পড়তে পারে। হচ্ছেও তাই।
গতকাল দেশ রূপান্তরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ‘ফ্লাইওভার ভয়ংকর’ শিরোনামের সংবাদে জানা যায়, গত দশ বছরে অন্তত ৪০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ফ্লাইওভার থেকে। ফ্লাইওভারে নজরদারির কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি ফ্লাইওভারে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা থাকার কথা থাকলেও নেই। এই নিয়ে মহানগর পুলিশ ও সিটি করপোরেশন চিঠি চালাচালি করছে। কিন্তু এখনো অবস্থার বদল হয়নি।
গত মাসেও পুলিশ সদর দপ্তর বলেছে, সবকটি ফ্লাইওভারে সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে। সড়কবাতি নিয়মিত জ্বালানো ও পুলিশ টহল বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, সন্ধ্যার পর থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত পুলিশের টহল থাকতে হবে। এই নির্দেশ না মানলে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে পুলিশের বার্তায়।
সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে রাত যত গভীর হয়, ফ্লাইওভারগুলো ততই নীরব হয়ে যায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা ফ্লাইওভারগুলোতে ছিনতাইসহ নানা অপর্কম করে। ছিনতাইকারীরা মানুষ খুন করতে দ্বিধা করছে না। নিরাপদ জোন মনে করে লাশ ফেলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। গত ১০ বছরে প্রায় ৪০টি লাশ ফেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত দুই বছরে ফ্লাইওভারে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে অন্তত বিশ জন মারা গেছে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে- সন্ধ্যার পর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনের সড়কে ও ফ্লাইওভারে ভুতুড়ে অন্ধকার থাকে। সড়কে ও ফ্লাইওভারে অধিকাংশ লাইটপোস্টে বাতি জ¦লে না। রেলক্রসিং পার হয়ে এফডিসির সামনে দিয়ে হাতিরঝিলের শুরু পর্যন্ত এই অবস্থা। মগবাজার, মহাখালী, মৌচাক, বাংলামোটর ফ্লাইওভারের অধিকাংশ ল্যাম্পপোস্টে বাতি না জ্বলায় ভুতুড়ে অবস্থা তৈরি হয়। ভ্রাম্যমাণ মাদকসেবী আর ভাসমান যৌনকর্মীরা তখন সক্রিয় থাকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ফ্লাইওভারে পুলিশের তৎপরতা কেন নেই? সিসি টিভিগুলো, কাদের স্বার্থে নষ্ট রাখা হচ্ছে? রাজধানীবাসী চলাচল করবে নির্বিঘেœ। আর ফ্লাইওভার হচ্ছে আরও নিশ্চিন্ত চলাচলের পথ। সেখানেও যদি এমন আতঙ্কজনক পরিবেশ বিরাজ করে, তাহলে সেই পরিবেশ থেকে নগরবাসীকে পরিত্রাণের পথ কে দেখাবে? পতিতাদের দৌরাত্ম্য, ছিনতাই, হত্যার নিরাপদ স্থান যদি হয় ফ্লাইওভার, তাহলে এই উড়ালপথ নগরবাসী এড়িয়ে চলতে বাধ্য হবে।
এসব অবৈধ কর্মকান্ড প্রতিরোধে, সরকারের নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছেন। কিন্তু তারা যে, শতভাগ ব্যর্থ হচ্ছেন নগরবাসীকে নিরাপত্তা দিতে সেটা স্বীকার করা বা না করার বিষয় নয়। বাস্তবতা যা বলবে, সেটাই সত্য। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে রাজধানীর ফ্লাইওভারগুলো সাধারণ মানুষের চলাচলের উপযোগী হবে। সিসিটিভি থাকবে, সক্রিয়। ছিনতাই বন্ধ হবে। কমবে পতিতাদের দৌরাত্ম্য। নিশ্চয়ই এটি বড় কোনো চাওয়া নয়! ফ্লাইওভার নিয়ে, রাজধানীবাসীর মনে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, দ্রুত তা সমাধান হওয়া দরকার। আতঙ্ক আর ভয় নিয়ে জীবনযাপন, সভ্য মানুষের জন্য না।
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
‘বস্তি এলাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। পানি সরবরাহ ও নর্দমা লাইন প্রায়ই এক হয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে দূষিত ও নোংরা পানি পান করছেন তারা।’ এভাবে বলছিলেন ঢাকার বস্তির জীবন মান নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের উন্নয়ন কর্মী বাছেরা আক্তার।
শুধু বস্তি এলাকা নয়, দেশের সব এলাকার সুপেয় পানি সরবরাহের চিত্র এমনই। রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করা পানিই না ফুটিয়ে পান করা যায় না। চট্টগ্রাম শহরের পানি লবণাক্ত। রাজশাহীর পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। খুলনায় সরবরাহ করা পানিও না ফুটিয়ে পান করা যায় না। রয়েছে লবণাক্ততাও। গভীর নলকূপের পানিও নিরাপদ নয়, আর্সেনিক ও লবণাক্ততার কারণে ব্যবহার করাও দুষ্কর। পাহাড়ে সুপেয় পানির উৎস সীমিত। পাহাড়ি ছড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে নদন্ডনদীর পানিও কমছে। সুপেয় পানি ও সেচের জন্য অত্যধিক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে দিন দিন।
এ পরিস্থিতিতে আজ ২২ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য : ‘আসুন নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করি।’
সরকারের পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় মিষ্টি পানিসমৃদ্ধ বাংলাদেশেও সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার মানুষ সুপেয় পানির বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও নিরাপদ পানি মিলছে না। এ ব্যর্থতা ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও হুমকিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. তানভীর আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানিকে সুপেয় পানি বলা যায়। তবে সেখানে কোনো ময়লা ঢুকে পড়লে সেই পানিকে আর সুপেয় থাকে না। সুপেয় পানি না ফুটিয়েই পান করা যাবে।’
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ওয়াসার পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাইরে ময়লা ঢুকে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এমন ঘটনা ঘটলে সেই পানিকে নিরাপদ বলা যাবে না। শুধু ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পানির মান ভালো হলে চলবে না, বাসা পর্যন্ত ভালো পানি পৌঁছে দিতে হবে। কেননা সরবরাহ লাইনের পানি নিরাপদ রাখাও সংস্থার দায়িত্ব।’
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এ জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। আশা করি সবাই মিলে কাজ করে পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করে আমরা নির্ধারণ সময়ে লক্ষ্যপূরণ করতে পারব।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার। এর মধ্যে ৫৯ ভাগ অর্থাৎ ৯ কোটি ৭৪ লাখ ৪৩ হাজার ২২০ জন মানুষ সুপেয় পানি সুবিধার আওতায় এসেছে। আর সুপেয় পানি সুবিধার বাইরে রয়েছে ৪১ ভাগ অর্থাৎ ৬ কোটি ৭৭ লাখ ১৪ হাজার ৭৮০ জন মানুষ। এখনো দেশের ১০ ভাগ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।
বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে বলা হয়েছে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুপেয় পানি প্রাপ্যতার বিবেচনায় ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চর এলাকা, বন্যাপ্রবণ এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওর এলাকা, বরেন্দ্র অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকা। দেশের এই ছয় শ্রেণির এলাকা বিস্তৃত রয়েছে ১০০টি উপজেলায়। দেশের ১৫৯ সিটি ও পৌরসভায় সরবরাহ করা পানির মানও একই। ওইসব এলাকায় ১৬৮টি পানি শোধনাগার, ১ হাজার ৫০০টি গভীর নলকূপে ১৫ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সরকার চালু রেখেছে। গ্রাম পর্যায়ের ২০ লাখ টিউবওয়েলের পানি নিরাপদ হওয়ার কথা ছিল। তবে আর্সেনিক ও মাত্রাতিরিক্ত আয়রন সে পানিও জনজীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
২০১৬ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বিশে^র সবচেয়ে বড় ‘গণবিষ’-এর উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের আর্সেনিক পরিস্থিতিকে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বছরে আর্সেনিকে ৪৩ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়। আর ২০০৩ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়। আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্তে ২০১২ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। তখন ৬৫ হাজার ৯১০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে ৪২টি জেলার হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তথ্য সংগ্রহ করে। ওই হিসাব অনুযায়ী, ওই বছর এসব হাসপাতালে ১৮ হাজার ৬৬২ আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী সেবা গ্রহণ করে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের সরকারিভাবে স্থাপিত গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। সেই হিসাবে জনসংখ্যার বিবেচনায় সরকার ৮৩ জনে একটি পানির উৎস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সমগ্র জনসংখ্যার বিবেচনায় বর্তমান পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে ১১ ভাগ। আর শহর এলাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় ৩৮ ভাগ।
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারকে সুপেয় পানি সরবরাহে শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে হবে। সেটা করতে হলে প্রতি বছর ছয় ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। বর্তমান অগ্রগতি প্রায় এক ভাগ। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে সামনের দিনগুলোতে পানি সরবরাহ খাতের অর্জন আরও কম হতে পারে। এ জন্য লক্ষ্য পূরণে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে চারগুণ তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, দেশে বেসরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় দেড় কোটি। আর সরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। এ দুটো ধরে হিসাব করতে দাঁড়ায় প্রতি ১০ জনে একটি পানির উৎস রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকায় পানযোগ্য পানি খুবই দুষ্পাপ্য। এসব এলাকার বেশিরভাগ উপজেলায় গভীর নলকূপ কার্যকর নয়। সরকার পানি সরবরাহ সেবার আওতায় আনতে পেরেছে ৯৮ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষকে। এখনো ১ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষ পানি সুবিধার আওতার বাইরে রয়েছে।
নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর : ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ায় স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। যে হারে পানির স্তর নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। স্বাভাবিক অবস্থা ৬ থেকে ৭ ফুট নিচেই ভূগর্ভস্থ উৎসে পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই। ঢাকায় পানি পেতে ২৫৫ থেকে ২৬০ মিটার নিচে নামতে হচ্ছে। খুলনায় ভূগর্ভস্থ পানি নেমে গেছে ২৫-৩০ ফুট। রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ১২০ থেকে ১৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। খরার মৌসুমে এ অবস্থা থাকে। বর্ষার মৌসুমে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়।
অন্যদিকে দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২-৩ মিটার নেমে যায়। আর ২৫ ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৫-১০ মিটার নেমে যায়। বর্ষার মৌসুমে এসব এলাকার বেশিরভাগ অংশে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। তবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না। দেশের গৃহস্থালি ও খাবার পানির ৯৪ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। গ্রাম এলাকায় এ উৎস থেকে ৯৯ শতাংশ ও শহর এলাকায় ৮০ শতাংশ পানি সরবরাহ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১৮ শতাংশ নলকূপের পানি উত্তোলনে সমস্যা হয়। এ ছাড়া ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, গড়াই নদীর পানি কমে যাওয়ায় এসব এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পুনঃভরণ হয় না।
ভূ-উপরিস্থ সুপেয় পানির উৎসের অভাবে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর অঞ্চলে সারা বছর সুপেয় পানির সংকট থাকে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যরকম সংকট। খরার মৌসুমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনার নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্ষার মৌসুমে দেশের অন্যান্য এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির শূন্য স্তরের ২৫ শতাংশ পূরণ হয়ে যায়। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয়। ওইসব এলাকায় ১৬০ ফুটের আগে পানির দেখা মিলছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানি বিভাগের পরিচালক এবং পানি বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ার জাহিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারকে বর্ষায় কৃত্রিমভাবে মাটির নিচে পানি প্রবেশ করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমন উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে দেশ বড় ধরনের পানি সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
উপকূলে লবণাক্ততা সমস্যা : ভূতত্ত্ববিদদের মতে, উপকূলীয় এলাকার পানিতে একবার লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে ওখানকার ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নদীতে পানি না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই অববাহিকা অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাবে। একই সঙ্গে সাগরের দিক থেকে লবণ পানি প্রবেশের হার বাড়বে।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরের উপকূলীয় এলকাগুলোতে আমরা গভীর নলকূপ বসাতে পারি না। এই এলাকায় নলকূপে লবণাক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে।’
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা কমাতে উজান থেকে পানির প্রবাহ বাড়ানোর কথা বলছে ভূতত্ত্ববিদরা। কিন্তু ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ৫৬টি যৌথ নদী থেকে ইতিমধ্যে পানি প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে এবং শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়েও যাচ্ছে। নদীগুলোর গভীরতা কমে গিয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সারা নওরিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই পানির স্তর নিচে। এখন এই হার আরও বেড়েছে।’
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
২০১০ সালে ভোলার চর কুকরিমুকরি বনের ১৫ হাজার গাছের প্রাণভিক্ষা চেয়ে লিখেছিলাম। ‘১৫ হাজার গাছের প্রাণভিক্ষা চাই’ শিরোনামে দৈনিকে প্রকাশিত লেখাটি নিয়ে আলাপ ওঠেছিল তখন। চর কুকরিমুকরি বনের উত্তরাংশ বাবুগঞ্জ থেকে পাতিলার বুড়াগৌরাঙ্গ নদ পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২০ ফুট প্রশস্ত পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য কুকরিমুকরি ইউনিয়ন পরিষদ বন বিভাগে আবেদন করে। ১৬ মে ২০১০ তারিখে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ন্যূনতম গাছ কাটার শর্তে সড়ক নির্মাণের অনুমতি দেয়। সড়কপথে দ্বীপচরে যাতায়াতের জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় বাঁচাতে প্রাণদন্ড দেয়া হয়েছিল ১৫ হাজার গাছের। কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, পশুরের মতো অবিস্মরণীয় সব ম্যানগ্রোভ বৃক্ষপ্রজাতি।
চর কুকরিমুকরির পর এবার ভোলার ঢালচরের উপকূল বন বিপদে পড়েছে। উপকূল বন নিশ্চিহ্ন করে ঘরবাড়ি, বাণিজ্যিক মাছের ঘের, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ ছাড়া বনের গাছ কেটে ইটভাটায় বিক্রি হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, ঢালচরের প্রায় একশ একর বনভূমি উজাড় হয়েছে এভাবেই। মূলত বসতি স্থাপন, বেদখল, মাছের ঘের ও মাছ-ঘাট, এবং ইটভাটার কারণে। ঢালচর ইউনিয়নের চর সত্যেন মৌজার মাঝের চরে প্রায় ৭১ একর অরণ্যভূমি উজাড় করা হয়েছে। পুরো অঞ্চলে নিথর হয়ে পড়ে আছে বহু নিহত গাছের গুঁড়ি। চারধারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই রক্তাক্ত লাশ খ-গুলোই জানান দিচ্ছে কী নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক উপকূল বন। গণমাধ্যম জানায়, দ্রুত গাছ কাটার জন্য এখানে ভেকু মেশিন (যন্ত্রচালিত এক্সকাভেটর) ব্যবহার করা হয়। বন নিধনে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ জড়িত থাকলেও গণমাধ্যমের কাছে এ অভিযোগ অস্বীকার করে।
বন কেটে দখল নিয়ে যারা বসত গড়েছেন তাদের সবার ভাষ্য হলো, নদীভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে এই বিরান হওয়া বনভূমিতে তারা আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রাকৃতিকভাবে তো এই বন বিরান হয়নি, নিষ্ঠুরভাবে একে বিরান করা হয়েছে। ঢালচরসহ ভোলা ও উপকূল অঞ্চলে মূলত প্রাকৃতিকভাবেই বিশেষ ম্যানগ্রোভ বন গড়ে ওঠে। ঢালচর সংরক্ষিত বনের আওতায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর এলাকা আছে। স্থানীয় বন বিভাগের ভাষ্য, ১৯৭৬ সালে ঢালচরের মাঝেরচরে বৃক্ষরোপণ করা হয় এবং নদীভাঙনকবলিত মানুষের আশ্রয়ের নামে ইতিমধ্যে ৭৬ একর বন উজাড় হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে বন উজাড়ের ঘটনায় বন বিভাগ ৩৫টি মামলা করেও বন বিনাশ রোধ করতে পারেনি। জোয়ার-ভাটা ও ভূমি ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে চরফ্যাশনের বাস্তুতন্ত্র প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছে।
ঢালচর, পূর্বেরচর, ভাসানচর, বয়ারচর, চর আলিম, আন্ডারচর, কলাগাছিয়াচর ও শিবচরের মতো ভূখ-গুলো প্রায় ৮ হাজার একর ভূমি নিয়ে নতুনভাবে জেগেছে। এসব ভূমিতেও জোয়ার-ভাটায় ভেসে আসা বীজ দিনে দিনে নতুন বন-প্রতিবেশ গড়ে তুলবে। ঢালচরসহ পুরো উপকূল অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ-প্রহরী এই উপকূল বনগুলো। নিয়ত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, তীব্র তাপপ্রবাহ সব আপদ নিজের জীবন দিয়ে সামলিয়ে উপকূলকে নিরাপদ রাখে বনের বৃক্ষকুল। আর উপকূল-প্রহরী এই গাছগুলোকে খুন করে আমরা উপকূলকে বারবার বিপদের দিকে ঠেলছি। বৃক্ষপ্রাচীর ও বন ছাড়া আপদন্ডবিপদ সামাল দেয়া সম্ভব নয়।
সত্তরের ঘূর্ণিঝড়, বিধ্বস্ত মনপুরা কিংবা সিডরের অভিজ্ঞতা কী বলে? সুন্দরবনসহ উপকূল বনভূমি ও বৃক্ষকুল প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি ও মাত্রা নিজের জীবন দিয়ে দুর্বল করেছে। উপকূলে বন না থাকলে সব আপদন্ডবিপদে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি অসহনীয় হয়ে উঠত। কিন্তু আমরা আমাদের উপকূলের বৃক্ষকুল ও বনের কাছে একবিন্দু কৃতজ্ঞতাও জারি রাখিনি। বরং প্রতিদিন উপকূল বনকে ল-ভ- রক্তাক্ত করছি। ঢালচরের উপকূল বন সামগ্রিকভাবে সুরক্ষা করতে হবে। বৃক্ষ ও বন নিধনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইন ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। ঢালচরসহ উপকূল বনের সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং করণীয় বিষয়ে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার ও তৎপরতা স্পষ্ট করতে হবে।
আয়তনে ছোট্ট হলেও প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে বাংলাদেশ অনন্য। সমতল, অববাহিকা, বরেন্দ্র, গড়, টিলা, পাহাড়, চর এলাকার পাশাপাশি দেশের নোয়াখালী, ভোলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সুন্দরবন অঞ্চলের উপকূল-চর ও দ্বীপগুলো দেশকে দিয়েছে বিশেষ আমেজ ও গতিময়তা। নোয়াখালীর নিঝুপ দ্বীপ, সুখচর, হাতিয়া, তমরুদ্দিন, নলচিরা, চান্দনন্দি, হারনি, চর কিং, বয়রারচর, চরপিয়া; ভোলার মনপুরা, চর মনিকা, চর সাকুচিয়া, চরনিজাম, ঢালচর, চর কুকরিমুকরি, গাজীপুর, ভেদরিয়া, সোনাচর, হাজিরহাট, চর নিউটন, চর পাতিলা, চর লক্ষ্মী, চর আইচা, নীলকমল, মদনপুর, মেদুয়া; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ; কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন বা নারিকেল জিঞ্জিরা, সোনাদিয়া, শাহপরীর দ্বীপ এবং সুন্দরবন অঞ্চলের আন্ডারচর, ডিমেরচর, দিয়ারচর, কালীরচর বা দুবলারচর দেশের গুরুত্বপূর্ণ উপকূল চর ও দ্বীপাঞ্চল। নদীপ্রবাহের বিস্তীর্ণ পলিমাটিতে গড়ে ওঠা এসব চর-দ্বীপ। মহেশখালী শৈল দ্বীপ আর সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপ। প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক নানা বিন্যাস গড়ে উঠেছে এসব অঞ্চলে। এসব দ্বীপে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে নয়া ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থান। মাছ, পাখি, সরীসৃপ, কাছিমসহ জলজ ও স্থলজ প্রাণবৈচিত্র্যের এক অবিস্মরণীয় আখ্যান তৈরি হয়েছে দেশের দ্বীপগুলোতে।
জলোচ্ছ্বাস ও ঝড় থেকে দেশের ভূগোল বুক আগলে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে এসব দ্বীপাঞ্চল। শত-সহস্র মাছের জোগান দিয়ে তরতাজা রাখছে রাষ্ট্রের অর্থনীতি। কিন্তু নিদারুণভাবে বাংলাদেশের উপকূল-চর ও দ্বীপগুলো এক ‘অচ্ছুত’ এবং বঞ্চিত ভূগোল। এখানকার প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ নিরাপত্তা কোনো বিবেচনায় রাখা হয় না। এসব উপকূল চর ও দ্বীপগুলোর পরিবেশবিনাশ কিংবা সামাজিক সংঘাতের খবর খুব একটা প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েও আসে না। দেখা গেছে, একেবারেই স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য ও বিনাশ করে। এমনকি বৃহৎ অবকাঠামো, খনন, বাণিজ্যিক পর্যটন, করপোরেট মনস্তত্ত্বও উপকূল বনের প্রাকৃতিক বিকাশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষ করে উপকূল চরের বন বাস্তুতন্ত্র এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত। বসতি স্থাপন কিংবা বাসস্থান সম্প্রসারণের নামে সবচেয়ে প্রথম কোপ পড়ে উপকূল বনে। এভাবেই আমরা হারিয়েছি চর কুকরিমুকরি কিংবা ঢালচরের বিশাল অংশ।
ঢেউয়ে ভেসে আসা কেউরগুলা, ছুনে গুলা, শিউলি গুলা, গাকগুলা, কেয়াড়াগুলা, সুগুলা, উন্দুরাগুলা, চরিকগুলা, গুরুপ ফলগুলো মাছের জালে উঠে বা হাতেও ধরা যায়। নানান জাতের ইলিশ, পাতা মাছ, ব্যাঙ মাছ, আটগোড়া মাছ উপকূল চর-দ্বীপের অনন্য প্রাণসত্তা। উপকূলীয় অনেক চর-দ্বীপে বিকশিত হওয়া ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থানে শেয়াল, কাঠবিড়ালি, গুইসাপের পাশাপাশি হরিণেরও বংশবিস্তার ঘটছে। বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিতে থাকা চামচঠুঁটো বাটান পাখির বিচরণস্থল ঢালচরসহ আশপাশের উপকূল চরভূমি। যদি ঢালচরের বন সুরক্ষিত না থাকে তবে বহু বন্যপ্রাণ অচিরেই তাদের বিচরণ অঞ্চল ও খাদ্য উৎস হারাবে। ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য হবে।
সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ নিরাপত্তা বিধান করবে। সংবিধানের অঙ্গীকার অনুযায়ী ঢালচরের বনভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নদীভাঙা মানুষের আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করা জরুরি, কিন্তু সেটি প্রাকৃতিক বন উজাড় করে নয়। ঢালচরের বন বিষয়ে রাষ্ট্রকে অঙ্গীকার করতে হবে। বন বিভাগ, স্থানীয় সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ঢালচরের বন সুরক্ষায় তৎপর হতে হবে। স্থানীয় মানুষদের ঢালচরের বন ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক কাজে যুক্ত করা যেতে পারে। কারণ এই বন সব আপদন্ডবিপদ থেকে চরবাসীকে সুরক্ষিত রাখছে। নির্দয়ভাবে বনের বিনাশ বন্ধ করে বনের প্রতি ঢালচরের প্রতিজন নাগরিককে সামাজিক ঢাল হিসেবে দাঁড়াতে হবে। ঢালচরের প্রাকৃতিক ঢাল উপকূল-বন আর বনের ঢাল ঢালচরের জনগণ। প্রাকৃতিক ও সামাজিক ঢালের এই সংহতি সক্রিয় হলেই বিকশিত হবে ঢালচরের বন বাস্তুতন্ত্র।
লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।