
করোনা মহামারী ও চলমান ইউরোপীয় সমর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থায় কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে চলে আসছে। এর মধ্যে বড় চ্যালেঞ্জ, কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আহরণ না হওয়া। কভিডে অর্থনীতি অনেকটা স্থবির থাকায় স্বাভাবিকভাবে রাজস্ব আহরণ কমে আসছে, কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছানো যাচ্ছে না। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসছে যে, মন্দাবস্থায় নিয়মিত রাজস্ব আহরণ কঠিন হচ্ছে। সংগত কারণেই ইদানীং আহরণ হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। লক্ষ্যমাত্রা কম কিংবা বেশি করে ধরা হোক বাস্তবতা হচ্ছে রাজস্ব আহরণ গতিশীল হচ্ছে না। সুতরাং অর্থনীতিকে সচল করা বা হওয়ার ওপরই রাজস্ব আহরণের মাত্রা ঊর্ধ্বগামী হওয়াটা নির্ভরশীল। আইএমএফ তেমন শর্তই দিয়েছে।
রাজস্ব আহরণ বাড়াতে বাংলাদেশ যতগুলো মুখরোচক উদ্যোগ নিয়েছে- তার মধ্যে একটি হলো, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। বিগত তিন-চার চলতি বাজেটবর্ষে অপ্রদর্শিত অর্থ, বিদেশে পাচার করা অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, বিদেশে অর্জিত (?) আয়, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যেকোনো সিকিউরিটিজের ওপর অত্যন্ত সীমিত হারে কর প্রদান করে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্র্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্র্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।’ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার খুব একটা লক্ষ করা যায়নি। তথাপি ন্যায়নীতি ও কর ন্যায্যতার মাথা খেয়ে এটি অব্যাহত রয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, এ কারণে তা কতটা যুক্তিযুক্ত সেটি পর্যালোচনার অবকাশ অবশ্যই রয়েছে।
আমাদের সম্পদ কর ব্যবস্থাপনার মধ্যে গলদ আছে। যেমন, জমি বিক্রি হলো ৭০ লাখ টাকা, অথচ রেকর্ড হলো ৬০ লাখ টাকা। বাকি ১০ লাখ টাকার কর কীভাবে হবে। এ রকম কিছু বিষয়ে বিদ্যমান বিধিবিধানে সমস্যা আছে। সেজন্য কারও কারও কাছে অপ্রদর্শিত অর্থ বা প্রদর্শন করেননি এমন অর্থ থাকতে পারে। এটা হতেই পারে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে চলতি বাজেটে অপ্রদর্শিত টাকা প্রদর্শনের মোড়কে মূলত দুর্নীতিজাত অবৈধ আয়কে বৈধ বিবেচনার একটা বিশেষ ধরনের সুযোগ ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের জন্য করহার করা হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ, যা কোনো দিন করা হয়নি, কোনো দেশে করা হয় না। এ ক্ষেত্রে দুটো বিষয় ঘটছে। এক. রাষ্ট্রের কর রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। যাদের জন্য এবং যেভাবে এ ছাড় দেওয়া তা ট্যাক্স জাস্টিসের পরিপন্থী। দুই. এর মধ্য দিয়ে নিয়মিত কর দেওয়া সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, প্রকারান্তরে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং সবাইকে করের আওতায় আনার ক্ষেত্রে এটি একটি অনৈতিক পন্থা বা পরিবেশ, যা কাম্য নয়। সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না।’ এটা একটা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেখানে যদি দেখা যায় অবৈধ অর্থ উপার্জনে বাধা দেওয়া হচ্ছে না, বড় ধরনের কর ছাড় দিয়ে আরও বলা হচ্ছে কীভাবে অর্থ উপার্জন করেছে তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এটা সংবিধানপ্রদত্ত রাষ্ট্রের দায়িত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
অনৈতিক পন্থায় করহার হ্রাস বা ছাড় দেওয়ার সঙ্গে কর অবকাশ বা অব্যাহতি এবং কর রেয়াতের একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। কোনো একটা এলাকা বা শিল্প পিছিয়ে আছে সেটিকে এগিয়ে আনতে কর অবকাশ বা অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর একটা যুক্তি আছে। এতে একটা এলাকা বা উদীয়মান শিল্পের উন্নয়ন হবে। সে ক্ষেত্রে প্রথমে কর ধরলে তার উন্নতি ব্যাহত হতে পারে। সেজন্য সব দেশেই ট্যাক্স হলিডের বিধান আছে। আমাদের দেশে এটাও ছিল বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এখনো আছেও। আর কর রেয়াত বা প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে প্রথম কর আদায় করা হয়, পরে শিল্পের বা সেবার স্বার্থে ফেরত দেওয়া হয়। এটাকে কর প্রত্যর্পণ বলা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর ভর্তুকি দেওয়ার নজিরও আছে। রাষ্ট্র যদি মনে করে যে কোনো খাত ভালো কাজ করছে। যেমন কৃষি খাতে প্রণোদনা বা ভর্তুকি দেওয়া হয়। কেন ভর্তুকি দেওয়া হয়? তাদের সমর্থ করে তোলার জন্য। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, একজন লোকের প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ অপ্রদর্শিত অর্থ (অপ্রদর্শিত অর্থের আড়ালে দুর্নীতিজাত কালো টাকা) ঘোষিত সুযোগে মাত্র সীমিত শতাংশ হারে কর দিয়ে বৈধ করতে পারছে। অর্থাৎ অন্য ব্যক্তি বা কোম্পানি করদাতা যেখানে ২৫-৩০ শতাংশ কর দিচ্ছে, সেখানে কালো টাকার মালিকরা পাচ্ছেন বিশেষ ছাড়। এটি একটি বড় ধরনের কর প্রণোদনা। আবার বলা হচ্ছে, কালো টাকার উৎস নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না অর্থাৎ দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্র সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বরং ইমিউনিটি দিচ্ছে।
রাষ্ট্রকে কর দেওয়া নাগরিকের দায়িত্ব। যদি করই না দেওয়া হয়, দুর্বল রিপ্রেজেনটেশনে জবাবদিহি চাওয়ার অধিকার তার থাকে না। নিজে কর না দিয়ে সে রাষ্ট্রের কাছে সেবা চাইছে। কর দিলে বাজেট বরাদ্দ পাওয়া তার অধিকার, কর না দিয়ে সে সরকারের কাছে অনুনয়-বিনয় করে, সরকার তার এই দুর্বলতা জানে বলে দয়াদাক্ষিণ্য হিসেবে কিছু সেবা দেয়, তার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে এবং রাষ্ট্রের টাকা আত্মসাতের সুযোগ পায় বা প্রলুব্ধ হয়। সে কর দেয় না বা ফাঁকি দেয় বা দিতে চায় বলেই কর অফিসের লোকরা তাকে চেপে ধরে, ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে ব্যাপৃত হয়। ফাঁকিবাজ করদাতা তার সঙ্গে আঁতাত করে রাষ্ট্রের কর স্বার্থকে ফাঁকি তো দেয়ই এবং কর বিভাগের অন্যায় হয়রানি বা ভয় প্রদর্শনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না।
এখানে প্রশ্ন হলো কর ইনসাফ প্রতিষ্ঠা না করলে কর আহরণে উন্নতি আসবে না। কর-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ যে তলানিতে, তার কারণটাই হলো এভাবে এ সমাজে কর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। মানে কাউকে ট্যাক্স দিতে বাধ্য করা হচ্ছে না বলে, এমনটিই হচ্ছে। অপ্রদর্শিত অর্থ এবং দুর্নীতিজাত অর্থ অর্থনীতির মূলধারায় আনার উদ্যোগ ইতিবাচক। কিন্তু বিশেষ হ্রাসকৃত হারে কর দিয়ে এবং উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, যেটি গুরুতরভাবে প্রশ্নসাপেক্ষ। কীভাবে উপার্জিত হলো, কীভাবে এলো, তা নিয়ে প্রশ্ন করা না গেলে তো সম্পদ পুনর্বণ্টনের কাজটি করা কঠিন হবে। অর্থাৎ বৈষম্য উসকে দেওয়া হবে, যদি টাকা কীভাবে উপার্জিত হচ্ছে তা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা বা প্রশ্নের মাধ্যমে বাধা না দেওয়া হয়, যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালের পর থেকে সম্পদের একটা বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। হু-হু করে জিডিপির সংখ্যাভিত্তিক পরিমাণ বেড়েছে এবং সেভাবে পারক্যাপিটা জিডিপিও বেড়েছে বলে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতায় ‘গরুর হিসাব শুধু কাজীর খাতায়, গোয়ালে তেমন গরু নেই’ পরিস্থিতি। বহু রিপোর্ট অনুযায়ী, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে খুব দ্রুত ধনীর সংখ্যা বাড়ছে।
রাষ্ট্র যদি মনে করে, কালো টাকা অর্থনীতিতে উপকারে আসুক তাহলে এমন সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। হাওর বা উপকূলীয় বাঁধ বা বড় অবকাঠামো প্রকল্প অর্থের অভাবে মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে, করোনাকালে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ পড়েছে। হাসপাতালে শয্যা কম। বিদ্যমান বরাদ্দ ও সরকারি প্রক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে করা যাচ্ছে না, জনসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান কিংবা শ্রমঘন কুটিরশিল্প উদ্যোগ গ্রহণে প্রযোজ্য কর দিয়ে সাদা করা টাকা বিনিয়োগের আহ্বান জানানো যায়। এসব জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করলে সরকার একটা উৎসাহব্যঞ্জক প্রণোদনা বা কর প্রত্যর্পণ ঘোষণা করবে। এর ফলে উন্নয়নে ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণও বাড়বে, বিনিয়োগের একটা সুযোগও তৈরি হবে। বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় প্রকল্পে যে দুর্নীতি হয় তা যদি প্রণোদনা আকারে দিয়ে দেওয়া হয় তাতেও লাভ। সুতরাং এ ধরনের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা করে কালো টাকাকে অর্থনীতির ধারায় আনতে হবে।
১৯৯৭ সালে ভারত যখন ‘ভলান্টারি ডিসক্লোজার অব ইনকাম স্কিম’ (ভিডিআইএস) জারি করেছিল, তখন কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অব ইন্ডিয়া এর কড়া সমালোচনা করেছিলেন। সাংবিধানিক সংস্থাটি সে সময় বলেছিল, এ সুযোগ সামাজিক সভ্য-ভব্যতার অপব্যবহার। এর ফলে এর আড়ালে অনৈতিকতা, অর্থ লোপাট স্বীকৃতি পাচ্ছে। ২০১৫ সালে ভারত ‘আনডিসক্লোজড ফরেন ইনকাম অ্যান্ড অ্যাসেটস ইমপোজিশন অব ট্যাক্স অ্যাক্ট’ জারি করেছিল। সেই আলোকে বাংলাদেশে ফরেন অ্যাসেটস ডিজক্লোজারের স্কিম জারি করা বরং বেশি প্রয়োজন ছিল। ভারতে ১৯৯৭ সালে ৪ লাখ ৭৫ জন নিজেদের আয়-সম্পদ ঘোষণা করেছিল। আর ২০১৫ সালে করেছিল ৬৩৮ জন। ১৯৯৭ সালে মোট অর্থ ডিসক্লোজ হয়েছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার আর ২০১৫ সালে ডিসক্লোজ হয়েছিল ৪ বিলিয়নের মতো। ১৯৯৭ সালে ভারত সরকার রাজস্ব পেয়েছিল ৯.৮৪ মিলিয়ন ডলার, ২০১৫ সালে পেয়েছিল ২ মিলিয়ন। এখানে কমপ্লায়েন্স পিরিয়ড ছিল কিন্তু তিন মাসের। জাল টাকার বিস্তার বা অন্য কোনো দুষ্কর্ম যেন না ঘটে তার জন্য সময় দিতে হয় অল্প। দুই মাস বা তিন মাস। বছরব্যাপী বা অবারিত থাকে না। ১৯৯৭ সালে ভারতে ভিডিআই এসএ করহার ছিল ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ তখনকার করপোরেট করের চেয়েও বেশি এবং অন্যদের জন্য ৩০ শতাংশ। তার মানে বিদ্যমান করহারের চেয়ে বেশি দিতে হয়েছিল। এটিই হলো পেনাল্টি। এটিই হলো সিস্টেম। এদিকে ২০১৫ সালে ৩০ শতাংশ কর এবং ৩০ শতাংশ পেনাল্টি ধরে দেওয়া হয়েছিল। কারণ এটা না থাকলে সৎ করদাতার সঙ্গে যেমন সাংঘর্ষিক হয়ে যায়, তেমনি এই সুযোগ দেওয়ায় দুষ্কৃতরাও অপকর্মে প্রলুব্ধ হয়। কর আরোপ করা এবং কর মওকুফের এখতিয়ার সংসদের রয়েছে ঠিকই। কর আরোপের ক্ষেত্রে যেমন রাষ্ট্রের স্বার্থ দেখতে হবে, তেমনি কর মওকুফের ক্ষেত্রেও সবার আগে রাষ্ট্রের স্বার্থটা দেখা দরকার।
লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি বিশ্লেষক
দৈনিক দিনকালের প্রকাশনা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবলম্বনকে স্বাধীন মতপ্রকাশে বাংলাদেশের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেশ ও বিদেশে অপতৎপরতা চোখে পড়ার মতো। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, সংবাদমাধ্যম ও অধিকার সংস্থাগুলো কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই এ অপপ্রচারে সায় দিচ্ছে; যা সর্বত্র বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পত্রিকাটির প্রকাশক ও মুদ্রাকর দেশের প্রধান বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ায় বিষয়টিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সুযোগ-সন্ধানী মহলের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। খুব সহজেই তারা প্রকৃত সত্য আড়াল করে বাকস্বাধীনতার ধোয়া তুলে দেশ-বিদেশে সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে। প্রকৃত সত্য হলো, দৈনিক দিনকালের প্রকাশনা বাতিলের সঙ্গে স্বাধীন মতপ্রকাশের সংশ্লিষ্টতা নেই বরং বিষয়টি নিতান্তই পত্রিকার প্রকাশনা ও রেজিস্ট্রেশন-সংক্রান্ত আইনগত ও পদ্ধতিগত ব্যত্যয়ের ফল; যা সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণে সম্পন্ন হয়েছে।
দৈনিক দিনকাল ২০০২ সালে তারেক রহমান প্রকাশক ও মুদ্রাকর মর্মে নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয়। পরে তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থানরত থাকায় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর ছাপাখানা ও প্রকাশনা ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) আইন ১৯৭৩-এর ১০, ১১, ১৬, ২০(১) (খ) ধারার আলোকে প্রকাশক বিধি অনুযায়ী দায়িত্ব হস্তান্তর না করে দীর্ঘ সময় বিদেশে অবস্থান, প্রকাশক ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় এবং যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে অফিসের ঠিকানা ও ছাপাখানা পরিবর্তন করার তিনটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক, ঢাকাকে অনুরোধ করে (চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের স্মারক নম্বর : ৬৫৭০, তারিখ : ০১/১০/২০১৯)।
জেলা প্রশাসক ওই স্মারকের ভিত্তিতে দৈনিক দিনকালকে কারণ দর্শানোর নোটিস প্রদান করলে দৈনিক দিনকাল এর কোনো উত্তর দেয়নি। পরে জেলা প্রশাসক, ঢাকা গত ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখ ছাপাখানা ও প্রকাশনা ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ আইন ১৯৭৩-এর ১০, ১১, ১৬, ২০(১) (খ) ধারা লঙ্ঘন করায় গত ১৬/০৪/২০০২ তারিখে দৈনিক দিনকালের প্রকাশক ও মুদ্রাকর হিসেবে পত্রিকার ঘোষণাপত্র ও মুদ্রণের ঘোষণাপত্র বাতিল করে।
দৈনিক দিনকাল ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখ বিধি মোতাবেক প্রেস কাউন্সিলে আপিল করে; যা দীর্ঘ পর্যালোচনার পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে খারিজ করে দেয়। ফলে জেলা প্রশাসক কর্র্তৃক প্রদান করা বাতিল আদেশ বহাল থাকে।
উল্লেখ্য, ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩-এর ধারা ১১, ১৬ মোতাবেক প্রকাশকের অনুপস্থিতিতে ৬ মাসের অধিক হলেই বিধি অনুযায়ী দায়িত্ব হস্তান্তর এবং যিনি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তার দায়িত্ব গ্রহণের লিখিত বিবরণী দাখিলের বাধ্যবাধকতা আছে, তা দৈনিক দিনকাল অনুসরণ করেনি।
ধারা ২০(১) (খ) অনুযায়ী মুদ্রাকর বা প্রকাশক যদি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধে দণ্ডিত হন; তাহলে তার পক্ষে প্রমাণীকরণ ঘোষণা বাতিল হয়ে যায়। ধারা ৭ ও ১০ মোতাবেক যথাযথ অনুমতি ও পদ্ধতিগত নীতিমালা অনুসরণে ব্যর্থ হলেও পত্রিকার ঘোষণাপত্র বাতিল হয়ে যাবে।
উপরোল্লিখিত ধারা মোতাবেক প্রেস কাউন্সিল বোর্ড যথাযথভাবে আপিলটির নিষ্পত্তি করলেও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একটি আইনগত সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক রঙ চড়িয়ে দেশের ভাবমূর্তি কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়েছে। দেশের মুক্তচিন্তা যুক্ত প্রকাশনা, মুক্ত সাংবাদিকতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবার অধিকার। রাষ্ট্র এ অধিকার সমুন্নত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু সবাইকেই নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হয়। ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩ অনুসরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে আরও ১০টি পত্রিকার নিবন্ধন বাতিল করা হয়। পত্রিকার নিবন্ধন বাতিল হলে নিয়মানুযায়ী পুনরায় নতুন করে অনুমতির জন্য আবেদন করতে হয়; যা সবাইকেই অনুসরণ করতে হয়।
কিন্তু দৈনিক দিনকাল রাজনৈতিক পত্রিকা হওয়ার কারণে এবং পত্রিকাটির পেছনে দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল থাকায় তারা রাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন, মিথ্যা ও ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে বিদেশি পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপানো ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে দেশের সম্মান ভূলুণ্ঠিত করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত। বিষয়টি একান্তই রাজনৈতিক ও দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে সহানুভূতি অর্জনের প্রচেষ্টা হিসেবে পরিগণিত।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, ফ্রিল্যান্সার
ভারতের মানুষের মাতৃভাষা কয়েকশ। এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪১৫টি। এই ৪১৫টি ভাষার উপভাষার সংখ্যা ১৫৭৬টি (১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে)। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ২৯টি কথ্যভাষায় ১০ লাখ মানুষ কথা বলে। ১২২টি কথ্যভাষা ১০ হাজার মানুষের মুখের ভাষা। এ ছাড়া অজস্র উপভাষা রয়েছে, যেগুলোর লিপি নেই। সেসব ভাষার অস্তিত্ব টিকে আছে মানুষের মুখে মুখে। বর্তমান ভারতের রাজ্যগুলোর ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। একই রাজ্যের একাধিক ভাষা যেমন রয়েছে, তেমনি একই ভাষা অপরাপর রাজ্যেও প্রচলিত আছে। ভারতের প্রাদেশিক সরকারি স্বীকৃত ভাষা (অসমীয়া, বাংলা, বোড়ো, ডোগরি, গুজরাটি, হিন্দি, কন্নড়, কাশ্মীরি, কোঙ্কনী, মৈথলী, মলয়ালম, মৈত্রৈ (মণিপুরি), মারাঠি, নেপালি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত, সাঁওতাল, তামিল, তেলেগু, উর্দু, মিজো ও কোকোবরক। ইংরেজি ভাষাও অনেক প্রদেশের সরকারি ভাষার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, যেমন অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ও চণ্ডীগড়। ভারতের প্রাদেশিক ভাষাসমূহের তালিকাই প্রমাণ করে অপরাপর প্রাদেশিক ভাষার মতো হিন্দিও প্রাদেশিক ভাষা। অনেক প্রদেশের সহকারী সরকারি ভাষা হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা, মারাঠি, পাঞ্জাবি, [খাসি, গারো, ভুটিয়া, গুরং, লেপচা, লিম্বু, মাঙার, মুখিয়া, নেওরি, রাজ, শেরপা, তমাং ইত্যাদি সিকিম প্রদেশের সহকারী সরকারি ভাষা।
প্রশ্ন থাকে বহু ভাষাভাষীর দেশ ভারতে প্রাদেশিক হিন্দি ভাষা কেন সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পেছনে ফিরে যেতে হবে। ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি এক রাষ্ট্রের সুবিধায় ভারতে বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তার-প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। ব্রিটিশদের মুৎসুদ্দি রূপে নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুযোগও হাতাতে পেরেছিল। তাদের মনস্কামনা পূরণে অন্তরায় ছিল ভাষার বিভক্তি। ব্রিটিশ ভারতেই ভারতীয় বুর্জোয়ারা স্বীয় স্বার্থে এককেন্দ্রিক শাসনের পাশাপাশি এক ভাষা ও এক জাতির আওয়াজ তুলেছিল। জাতি হিসেবে ভারতীয় এবং ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল তারা হিন্দি ভাষা-দেবনাগরী লিপি। নিজেদের কায়েমি স্বার্থে হিন্দি ভাষাকে ভারতের সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ফন্দি এঁটেছিল; অপরাপর ভাষা-সংস্কৃতি, স্বাজাত্যবোধকে বিলীন করে দেওয়ার মতলবে। ব্রিটিশ ভারতে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের সুবিধা ভোগ সম্ভব হলেও, তাদের পক্ষে হিন্দি ভাষাকে সর্বভারতীয় ভাষায় পরিণত করা সম্ভব হয়নি।
১৯১৫ সালে ভারতে ফিরে এসে গান্ধী ভারতজুড়ে ভ্রমণ করেন। তখনই তিনি দেখতে পান ভারতীয় মাড়োয়ারি পুঁজিপতিরা গো-রক্ষা এবং হিন্দি ভাষা প্রচলনে নানান পন্থায় মদদ জুগিয়ে যাচ্ছে। গান্ধী সহসাই পুঁজিপতিদের পক্ষে সেই প্রচারাভিযানে যুক্ত হয়ে যান। অর্থাৎ গো-রক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি হিন্দি ভাষাকে সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার বুর্জোয়া শ্রেণির আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এই তৎপরতার মধ্য দিয়েই ভারতে গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। ১৯১৬ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে ‘সর্বভারতীয় এক ভাষা ও একলিপি সম্মেলন’ গান্ধীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১৯ সালে হিন্দি ভাষা প্রচারে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের উপকমিটির সভাপতি হয়েছিলেন গান্ধী। ভারতীয় মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের অর্থের জোগানে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। সিন্ধু ন্যাশনাল কলেজে ১৯২০ সালের জুলাইয়ে গান্ধী বলেছিলেন, ‘হিন্দিই হবে সমগ্র ভারতের ভাষা এবং সেজন্য হিন্দি শেখা অন্যসব প্রদেশের কর্তব্য।’ গান্ধী প্রকাশ্যে বলে বেড়াতেন, ‘অহিন্দিভাষীদের হিন্দি শেখা হচ্ছে ধর্ম।’ ভারতীয়দের ধর্মীয় অনুভূতিতে হিন্দি ভাষা বিস্তারে ধর্মকে পর্যন্ত ব্যবহার করতে চেয়েছেন। হিন্দি ভাষাকে ধর্মীয় পর্যায়ভুক্ত করতেও দ্বিধা করেননি গান্ধী। গান্ধী লিখেছিলেন, ‘এলাহাবাদের হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোগে ১৮ মাসব্যাপী মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে হিন্দি ভাষার প্রচার খুব জোরালোভাবেই চলছে।’ হিন্দি ভাষাকে সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের অর্থানুকূল্যের বিষয়টিও স্বীকার করে গান্ধী বলেছিলেন, ‘হিন্দি প্রচারের কাজ ভারতের এই রাজতুল্য বণিকশ্রেণির বিশেষত্ব।’
১৯২১ সালে এক চিঠিতে গান্ধী মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘ভারতবর্ষে ফিরে আসার পর থেকেই আমি আপনাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছি। আমার কাজে আপনারা প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন। হিন্দি প্রচারের আন্দোলনকে আপনারা কার্যকরভাবে সমর্থন দিয়েছেন।’ গান্ধীর হিন্দি ভাষা প্রচারাভিযানে মাড়োয়ারিদের পাশাপাশি গুজরাটি, পার্শি বণিকশ্রেণিও আর্থিক সহায়তা প্রদানে পিছিয়ে ছিল না। বাংলা ও আসাম প্রদেশে হিন্দি প্রচারাভিযানে ১৯২৮ সালে হিন্দুত্ববাদী বুর্জোয়া ধনশ্যামদাস বিড়লাকে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করে কলকাতায় হিন্দি প্রচারের এক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালে হিন্দি ভাষাকে জাতীয় ভাষায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজেন্দ্র প্রসাদকে সভাপতি করে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে ‘রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতি’ গঠিত হয়। পরে স্বয়ং রাজেন্দ্র প্রসাদ লিখেছিলেন, ‘এর নীতি স্বয়ং গান্ধীজি নির্ধারণ করেছিলেন এবং আমাদের শিল্পপতি বন্ধুরা অর্থের জোগান দিতেন।’
হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপি সমগ্র ভারতীয়দের ওপর চাপানোর এই উদ্যোগে উত্তর প্রদেশের মুসলিম সম্প্রদায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। উর্দুভাষী মুসলমানদের মধ্যে এ নিয়ে আতঙ্ক ও ভীতির সঞ্চারে তারা উপলব্ধি করে হিন্দির দৌরাত্ম্যে তাদের উর্দু ভাষা-সংস্কৃতির বিলোপ ঘটবে। ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে লক্ষেèৗতে মুসলিম লীগ অধিবেশনে সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতের জাতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার তীব্র নিন্দা জানায়।
১৯২৭ সালের জুলাইয়ে গান্ধী লিখেছিলেন, ‘সব ভারতীয় ভাষার একটি লিপি হওয়া উচিত এবং শুধু দেবনাগরীই হতে পারে সেই লিপি।’ গান্ধী বলেছেন, ‘হিন্দু-মুসলিম উন্মত্ততার জন্য সম্পূর্ণ সংস্কারের পক্ষে বাধা আছে। তবে এর আগে হিন্দু ভারতকে বুঝতে হবে যে, যেসব ভাষা সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত এবং দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত তাদের লিপিগুলো, যেমন বাংলা, গুরুমুখী, সিন্ধি, ওড়িয়া, গুজরাটি, তেলেগু, তামিল, কন্নড়, মলয়ালম ইত্যাদি ভাষার লিপিকে বর্জন করে সে স্থলে থাকবে শুধুই দেবনাগরী লিপি। এর ফলে হিন্দু ভারত সংহত ও বলিষ্ঠ হবে।’ গান্ধী নিজেই স্বীকার করেছেন পাঞ্জাবে হিন্দু-মুসলমান এবং অন্য সবাই উর্দু জানে (উর্দু ভাষার লিপি ফার্সি)। ধর্মের ভিত্তিতে ভাষার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন গান্ধী। পাঞ্জাবি হিন্দুরা দেবনাগরী লিপি গ্রহণ করবে এবং মুসলিমরা ফার্সি লিপি। একইভাবে বাঙালি হিন্দুর লিপি হবে দেবনাগরী এবং বাঙালি মুসলমানের লিপি হবে বাংলা অথবা ফার্সি। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরোধকে ভাষা ও লিপির ভেতরে টেনে আনেন স্বয়ং গান্ধী। ব্রিটিশদের বিভক্তীকরণের চক্রান্তের নীতি অনুসরণ কি ভাষার প্রশ্নে গান্ধী করেননি? হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভক্তি ব্রিটিশরা করেছিল তাদের শোষণ প্রক্রিয়া এবং দখলদারিত্ব স্থায়ী করার লক্ষ্যে। গান্ধীও হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপির পক্ষে সম্প্রদায়গত বিভাজনের নীতি অনুসরণ করে সেই বিভাজনকেই সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক বিভাজন-বিভক্তি ব্রিটিশদের সৃষ্ট। সাম্প্রদায়িক বিভাজন নতুন মাত্রা পেয়েছিল গান্ধীর হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপির জাতীয় ভাষা ও লিপির আন্দোলন অভিযানে। এতে দ্রুতই মুসলিম সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মুসলমানদের বিরোধিতার মুখে গান্ধী-নেহরুর মত পরিবর্তন করলেও; উর্দুভাষী মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দি-উর্দু ভাষা বিতর্কে সরব হয়ে ওঠে এবং ভাষা নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিরোধেরও সূচনা ঘটে। ১৯৩৭ সালের জুলাইয়ে কংগ্রেস সভাপতি নেহরু বলেন, ‘অবশ্যই হিন্দি অথবা হিন্দুস্তানি হচ্ছে জাতীয় ভাষা এবং হওয়া উচিতও। লিপি সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা দরকার যে, হিন্দি ও উর্দু দুই লিপিই সহাবস্থান করা উচিত।... এই বিতর্ক বন্ধ করার জন্য ভালো হবে যদি আমরা কথ্যভাষাকে হিন্দুস্তানি এবং লিপিকে হিন্দি অথবা উর্দু আখ্যা দিই। ইউরোপের প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর হিন্দিতে অনুবাদ হওয়া একান্ত দরকার।’ নেহরুর বক্তব্যটির সারকথা হচ্ছে, লিখিত ভাষা হিন্দিই হবে ভারতের জাতীয় ভাষা। সেটা দেবনাগরী কিংবা উর্দু দুই লিপিতেই লিখিত হতে পারে। ‘ভাষাপ্রশ্ন’ গ্রন্থে নেহরু লিখেছিলেন, ‘একমাত্র হিন্দুস্তানিই সমগ্র ভারতের ভাষা হতে পারে।’ লিপির ক্ষেত্রে দেবনাগরী এবং উর্দু লিপির কথাও মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষোভ প্রশমনে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন।
গান্ধী মুসলমানদের বিরোধিতার মুখে হিন্দুস্তানির অনুরাগী হয়ে সেই লক্ষ্যে ১৯৪২ সালে ‘হিন্দুস্তানি প্রচার সভা’ সংগঠন গড়ে তোলেন। উত্তর ভারতে কথ্যভাষা রূপে হিন্দুস্তানি ভাষা ছিল বটে। তবে সেটি হিন্দি ও উর্দুর সংমিশ্রণে। লিপি না থাকায় লিখিত ভাষারূপে হিন্দুস্তানি ভাষার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ১৯৪৬ সালে নির্বাচনের আগে ভারতের সংবিধান সভায় গান্ধী প্রস্তাব করেছিলেন, তারাই সংবিধান সভার সদস্য হতে পারবেন যারা হিন্দি ভাষার সঙ্গে পরিচিত। গান্ধী আরও দাবি করেন, ভারতের সংবিধান হিন্দুস্তানি ভাষায় লিখিত হতে হবে। মৃত্যুর আগে গান্ধী বলেছিলেন, ‘তার যদি ক্ষমতা থাকত তবে তিনি তাদেরই কংগ্রেসের সদস্য করতেন যারা হিন্দুস্তানি ভাষা জানেন।’ ১৯৪৭ সালে গান্ধী হিন্দুস্তানি ভাষাকে সমগ্র এশিয়ার ভাষায় পরিণত করার দিবা-স্বপ্নও দেখেছিলেন। মুসলিম বিরোধিতায় গান্ধী-নেহরুরা ভারতের জাতীয় ভাষা হিন্দির পরিবর্তে হিন্দুস্তানি কথ্য ভাষার প্রচারণা ছিল প্রতারণার কৌশল। উদ্দেশ্য ছিল দেবনাগরী লিপির বাতাবরণে হিন্দি ভাষাকেই সমগ্র জাতিসত্তার স্কন্ধে চাপানোর। বাস্তবতা হচ্ছে হিন্দুস্তানি ভাষা প্রকৃতই কথ্য ভাষা। সে ভাষার ছিল না লিপি। ছিল না সাহিত্য। সেটি শুধুই আঞ্চলিক কথ্যভাষা মাত্র। হিন্দুস্তানি ভাষার দাবিটি ছিল হিন্দি ভাষা প্রতিষ্ঠায় কৌশলগত অভিপ্রায় মাত্র। ওই কৌশলতাই অনিবার্য করে তোলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশভাগ।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক নতুন দিগন্ত
আত্মা আগে দেহ পরে/এক ঘরেতে বাস/ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে/মহা সর্বনাশ জীবনগ্রাসী এই সর্বনাশের থাবা থেকে মানুষের রক্ষা নেই। দেহ থেকে আত্মা একসময় মুক্ত হবেই। তখন মানুষ হয়ে যান ‘লাশ’! কোনো নামে আর চিহ্নিত হন না। তখন তিনি নিষ্প্রাণ-নিথর-শীতল-প্রাণহীন একজন। জীবকুলের এই জীবনচক্র, আপন গতিতে চলছে। সেখানে মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যে কারণে ‘মৃত্যু’ স্বাভাবিক।
কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যুকে মেনে নেওয়া কঠিন। তবু মেনে নিতে হয়। যার গর্ভে জন্ম নিয়ে এই আমি দেখছি পৃথিবীর আলো সেই ‘মা’র অকালমৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারে না। তবু মা চলে যান আমাকে জন্ম দিয়ে। নয়তো মা-আমার দুজনেরই মৃত্যু সেই জন্মকালেই। এই অকালমৃত্যুহার আমাদের দেশে দিন দিন কমছে। এর মানে হচ্ছে জ্ঞান, বিজ্ঞানে আমরা উন্নত হচ্ছি। সচেতনতা বাড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
গতকাল দেশ রূপান্তরের শেষ পাতায় প্রকাশিত ‘২০ বছরে মাতৃমৃত্যু কমেছে ৭২.৫%’ শিরোনামের সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশে ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গত ২০ বছরে মাতৃমৃত্যু হার ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। সর্বশেষ ২০২০ সালে গর্ভাবস্থা বা প্রসবজনিত জটিলতার কারণে প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে মারা গেছেন ১২৩ জন। অথচ ২০০০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৪১ জন। সে হিসাবে এই ২০ বছরে প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে মৃত্যু কমেছে ৩১৮ জন।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ প্রকাশিত ‘মাতৃমৃত্যু প্রবণতা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনের তথ্যবিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের মাতৃমৃত্যু পরিস্থিতির এ চিত্র পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বিশ্ব মাতৃমৃত্যুর সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর সার্বিক হার এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। তবে এ সময় গর্ভাবস্থা বা প্রসবজনিত জটিলতার কারণে প্রতি ২ মিনিটে ১ জন নারীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মাতৃমৃত্যু হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। কিন্তু ২০১৬ থেকে ২০ সাল পর্যন্ত এ হার স্থবির ছিল এবং কিছু অঞ্চলে বেড়েছে।
সংবাদে আরও বলা হয়েছে, ২০ বছরের মধ্যে সামগ্রিক মাতৃমৃত্যুর হার ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। ২০০০ সালে প্রতি ১ লাখ শিশু জন্মের সময় ৩৩৯ জন মাতৃমৃত্যু থেকে কমে ২০২০ সালে ২২৩ জন হয়েছে। সে হিসাবে ২০২০ সালে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ জন নারী মারা গেছেন বা প্রতি ২ মিনিটে প্রায় একজন মারা গেছেন।
এর আগে ২০০৫ সালে গর্ভাবস্থা বা প্রসবজনিত জটিলতার কারণে বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে মারা গেছেন ৩৭৬ জন, ২০১০ সালে তা কমে ৩০১ জনে দাঁড়ায় ও ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল আরও কম, ২১২ জন।
প্রতিবেদনে মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে গুরুতর রক্তপাত, সংক্রমণ, অনিরাপদ গর্ভপাত থেকে জটিলতা এবং এইচআইভি/এইডসের মতো জটিলতা অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এসব জটিলতার অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।
এ ব্যাপারে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের প্রধান নাতালিয়া কানেম বলেন, ‘আমরা পরিবার পরিকল্পনায় জরুরিভাবে বিনিয়োগ করে এবং ৯ লাখ ধাত্রীর বৈশ্বিক ঘাটতি পূরণ করার মাধ্যমে আরও ভালো কিছু করতে পারি এবং অবশ্যই করতে পারি।’
বিশ্বব্যাপী গর্ভাবস্থায়, মা বা সন্তানের মৃত্যু শুধু হ্রাস করতে পারে আমাদের সচেতনতা। এর কোনো বিকল্প নেই। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কোনো মা যেন মৃত্যুর কোলে ঢলে না পড়েন। এই মৃত্যুহার নামুক শূন্যের কোঠায়। জীবন জড়িয়ে থাক, জীবনকে।
কবি ও শিশুসাহিত্যিক সুনির্মল বসুর জন্ম ভারতের বিহার রাজ্যের গিরিডিতে ১৯০২ সালের ২০ জুলাই। তার পৈতৃক নিবাস ছিল তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের মালখানগরে। সাহিত্যিক ও সাংবাদিক গিরিশচন্দ্র বসু ছিলেন তার পিতামহ। ১৯২০ সালে তিনি বাবার কর্মস্থল পাটনার গিরিডি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতার সেন্ট পলস কলেজে ভর্তি হন; কিন্তু ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে কলেজ ত্যাগ করেন। কিশোর বয়স থেকে কবিতা লেখা ও ছবি আঁকার প্রতি তার ঝোঁক ছিল। তিনি কিছুদিন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে আর্ট কলেজে ছবি আঁকা শেখেন। প্রবাসী পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তিনি কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, রূপকথা, ভ্রমণকাহিনি, কৌতুক, নাটক ইত্যাদি মাধ্যমে শিশু-কিশোর উপযোগী সাহিত্য রচনা করেন। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘হাওয়ার দোলা’, ‘ছানাবড়া’, ‘বেড়ে মজা’, ‘হৈচৈ’, ‘হুলুস্থুল’, ‘কথাশেখা’, ‘পাততাড়ি’, ‘ছন্দের টুংটাং’, ‘আনন্দ নাড়–’, ‘শহুরে মামা’, ‘কিপটে ঠাকুরদা’, ‘টুনটুনির গান’, ‘গুজবের জন্ম’, ‘বীর শিকারী’, ‘লালন ফকিরের ভিটে, ‘পাতাবাহার’, ‘ইন্তিবিন্তির আসর’, ‘পাহাড়ে জঙ্গলে’ ইত্যাদি। ‘ছোটদের চয়নিকা’ ও ‘ছোটদের গল্প সঞ্চয়ন’ তার সম্পাদিত দুটি উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ। তার রচিত আত্মজীবনী ‘জীবনখাতার কয়েক পাতা’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। তিনি তার সমকালের একমাত্র শিশুতোষ পাক্ষিক পত্রিকা ‘কিশোর এশিয়া’র পরিচালক ছিলেন। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের শিশুসাহিত্য শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৫৬ সালে তিনি সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ভুবনেশ্বরী পদক লাভ করেন। ১৯৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলের আলো ঝলমলে অডিটোরিয়ামে দেশি-বিদেশী মডেল ভাড়া করে এনে সাড়ম্বরে ঘোষণা করা হয়েছিল প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক নারী ফুটবল আসর ওমেন্স সুপার লিগের। সিনে জগতের তারকাদের সঙ্গে মঞ্চে র্যাম্প করতে করতে প্রত্যাশার ঘুড়িটা দূর আকাশে উড়িয়েছিলেন সাবিনা-সানজিদারা। দেশের ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপন এখন তারা। ফুটবলপ্রেমীদের তাদের নিয়ে অসীম আগ্রহকে পুঁজি করে কে-স্পোর্টস আর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন চেয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট করে ফায়দা লুটতে। তবে দিন যত গড়িয়েছে, মেয়েদের স্বপ্ন ধূসর হয়েছে। এখন তো তা মিলিয়ে গেছে বহুদূরে।
কে-স্পোর্টস-বাফুফের কর্তারা বুঝেছেন, তাদের লেখা চিত্রনাট্য আর বাস্তবতায় বড্ড ফাঁরাক। তাই তারা বারবার টুর্নামেন্ট শুরুর তারিখ দিয়েও আলোচিত টুর্নামেন্টকে মাঠে নিয়ে যেতে পারেননি। সর্বশেষ ১০ জুন আসর শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন খোদ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। সেটাও মিথ্যে হয়ে গেছে। তাই হতাশা ছাঁপিয়ে নারী ফুটবলারদের মনে ভর করেছে রাজ্যের ক্ষোভ।
কে-স্পোর্টস আর বাফুফের কর্তারা ভেবেছিলেন এমন একটা টুর্নামেন্টের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে হামলে পড়বে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বছর নেপালে সাফ শিরোপা জয়ের পর মেয়েদের নিয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই আসলে স্বপ্নবাজ করে তোলে সালাউদ্দিন-মাহফুজা আক্তার-ফাহাদ করিমদের। তবে হয়েছে উল্টো। সেটাই যে হওয়ার কথা! কে-স্পোর্টস কিংবা বাফুফে, দুটি প্রতিষ্ঠানই যে এখন ভীষণভাবে ইমেজ সঙ্কটে ভুগছে। এর মাঝে অগোচরে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে, যেটা কখনই প্রত্যাশিত ছিল না। কে-স্পোর্টস আর বাফুফের দেখানো স্বপ্নে বুদ হয়ে গিয়েছিলেন ফুটবলাররা। এমন একটা টুর্নামেন্টে খেলতে মুখিয়ে ছিলেন তারা। এমনিতে ঘরোয়া ফুটবল খেলে সেভাবে পারিশ্রমিক জুটে না। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে হলে একটা আকর্ষণীয় পারিশ্রমিকের হাতছানি ছিল। তারচেয়েও বেশি ছিল নানা দেশের নামী-দামী ফুটবলারদের সঙ্গে ড্রেসিং রুম শেয়ার করার সুবর্ণ সুযোগ। দারুণ একটা স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুখ বুজে মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন দিনের পর দিন। এর মাঝেই তারা দেখেছেন বাবার মতো কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের বিদায়। বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ন্যায্য দাবী পুরোপুরি পূরণ না হওয়ার পরও তারা বাফুফের কঠোর অনুশাসন মেনে দুঃসহ গরমে সকাল-বিকাল ঘাম ঝড়িয়েছেন। এরপর যখন দেখলেন এই স্বপ্ন বারবার হোচট খাচ্ছে কে-স্পোর্টসের ব্যর্থতা আর বাফুফের অদূরদর্শীতায়, তখন আর মুখ বুজে থাকতে পারলেন না। হতাশার কথা জানাতে গিয়ে অগোচরে তাদের কণ্ঠ থেকে বের হয়ে এসেছে ক্ষোভের আগুন।
অবস্থা বেগতিক দেখে তড়িঘড়ি বৃহস্পতিবার ক্যাম্প বন্ধ ঘোষণা করে বাফুফে। সিনিয়র খেলোয়াড়দের দেওয়া হয় পাঁচ দিনের ছুটি। বৃহস্পতিবার রাতে বাসে করে সাতক্ষীরাগামী সাফজয়ের অগ্রনায়ক সাবিনা খাতুন দেশ রূপান্তরকে মুঠোফোনে বলছিলেন, 'ওমেন্স সুপার লিগ স্রেফ আমাদের আবেগ নিয়ে খেললো।' একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, 'প্রথমত সাফের পর কোন খেলা নেই। তারপর এই লিগ মেয়েদের নিয়ে দুই দফা এত কিছু করলো, এত আশা দিলো, মেয়েরা খেলার জন্য মুখিয়ে ছিল। আর সব থেকে বড় ব্যাপার বিদেশী খেলোয়াড় যারা দক্ষিণ এশিয়ার, তাদের নিয়ে আমি নিজেও কাজ করছিলাম। তাদের কাছে এখন আমার সম্মান কই থাকলো! বারবার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। মেয়েরা অনেক আশায় ছিল। কিন্তু... । এটা নিয়ে অবশ্য মেয়েরা অনেক আগেই আশা ছেড়ে দিয়েছিল। এখন আমিও কোন আশা দেখছি না।'
সতীর্থদের সংগে ময়মনসিংহের কলসিন্দুরে বাড়ির যেতে যেতে জাতীয় দলের রাইট উইঙ্গার সানজিদা বলছিলেন, 'আসলে কিছু বলার ভাষাই হারায় ফেলেছি। একটা টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল। এর জন্য আমরা কঠোর অনুশীলণ করছিলাম। আশা ছিল খেলবো। এখন সেটা হচ্ছে না বলে খুব কষ্ট লাগছে। যখন শুনলাম লিগটা হবে না, তখন মনের অবস্থা কেমন হতে পারে, বুঝতেই পারছেন।'
সাফের পর কোন ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি সিনিয়র ফুটবলাররা। এ নিয়ে ভীষণ হতাশ সানজিদা বলেন, 'নয়টা মাস ধরে অপেক্ষায় আছি খেলার। প্রীতি ম্যাচ বলেন কিংবা কোন টুর্নামেন্ট, একটা ম্যাচও আমরা খেলতে পারিনি সাফের পর। অথচ আমাদের সঙ্গে যারা সাফে খেলেছে, তারা প্রায় সবাই পাঁচটা-ছয়টা করে প্রীতি ম্যাচ খেলে ফেলেছে এর মধ্যে।' মেয়েদের সিঙ্গাপুরে গিয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলার কথা ছিল, মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাই খেলার কথা ছিল। অথচ বাফুফে অর্থ সঙ্কটসহ নানা অযুহাতে তাদের খেলতে পাঠায়নি। সানজিদা বললেন, 'আমরা আসলে হতাশ হতেও ভুলে গেছি। বারবার টুর্নামেন্টে খেলার কথা বলা হয়, আবার সেটা বাতিল হয়। এরকমটা হতে হতে আসলে আমরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে গেছি।'
হতাশা, বঞ্চনায় বাফুফের চাকুরি থেকে পদত্যাগ করেছেন নারী দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। প্রিয় কোচের জন্য কষ্ট পান সানজিদা, 'ছোটন স্যারের হাত ধরেই আমার এখানে আসা। তার কাছেই আমার ফুটবলার হয়ে গড়ে ওঠা। তিনি চলে গেছেন। এতে খুব কষ্ট পাই। তিনি আমাদের অনেক আদর-যত্ন করতেন। বাবা-মেয়ের সম্পর্ক যেমন হয়, ঠিক তেমন সম্পর্ক ছিল।'
১৩ জুন সাবিনা-সানজিদাদের ক্যাম্পে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে বাফুফে। বিকল্প নেই বলে তারা হয়তো ফিরবেন। তবে ফেরার সময় তাদের চোখে থাকবে না বড় কোন স্বপ্ন। সেটা দেখাই বারণ। কে-স্পোর্টস আর বাফুফে মিলে যে মেয়েদের সব স্বপ্ন গলা টিপে মেরে ফেলেছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর মেয়ের জামাতাকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার, কাস্টমস ব্যাগেজ, ইমিগ্রেশনসহ অন্যান্য প্রটোকল দেওয়ার একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
অনেকেই চিঠিটি শেয়ার করে সমালোচনা করছেন। কেউ বলছেন, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই বলে কথা! কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই প্রটোকল কোন হিসেবে পান? আবার কেউবা বলছেন, একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে!
জানা যায়, গত ৬ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। পরে ৭ জুন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালককে চিঠিটি পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে চিঠিটির সত্যতাও পাওয়া যায়।
মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার উপসচিব ড. অমিতাভ চক্রবর্ত্তী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হকের মেয়ের জামাতা মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ৯ জুন শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর ইকে ৫৮৬ যোগে দুবাই থেকে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন। তাকে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের অনুমতিসহ মন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার মশিউর রহমানকে কাস্টমস ব্যাগেজ, ইমিগ্রেশন এবং বিমানবন্দরের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য বোর্ডিং ব্রিজ পাস দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিমানবন্দর পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্য পৃথক লাউঞ্জ রয়েছে। যেটাকে ভিআইপি লাউঞ্জ বলা হয়। ভিআইপি লাউঞ্জ কারা ব্যবহার করতে পারবেন এমন একটি স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের।
লাউঞ্জ রজনীগন্ধা, বকুল, দোলনচাঁপা ও চামেলি নামে বিমানবন্দরে ৪টি ভিআইপি লাউঞ্জ রয়েছে। রজনীগন্ধা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ভিআইপিরা ব্যবহার করেন। বকুল ব্যবহার করেন অতিরিক্ত সচিব বা তার পদমযার্দার ও সমমর্যাদার ব্যক্তিরা। দোলনচাঁপা ব্যবহার করেন সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আর চামেলি দিয়ে একুশে পদক পাওয়া ব্যক্তি, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রবেশ ও বের হতে পারেন।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।