
কবি ও শিশুসাহিত্যিক সুনির্মল বসুর জন্ম ভারতের বিহার রাজ্যের গিরিডিতে ১৯০২ সালের ২০ জুলাই। তার পৈতৃক নিবাস ছিল তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের মালখানগরে। সাহিত্যিক ও সাংবাদিক গিরিশচন্দ্র বসু ছিলেন তার পিতামহ। ১৯২০ সালে তিনি বাবার কর্মস্থল পাটনার গিরিডি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতার সেন্ট পলস কলেজে ভর্তি হন; কিন্তু ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে কলেজ ত্যাগ করেন। কিশোর বয়স থেকে কবিতা লেখা ও ছবি আঁকার প্রতি তার ঝোঁক ছিল। তিনি কিছুদিন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে আর্ট কলেজে ছবি আঁকা শেখেন। প্রবাসী পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তিনি কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, রূপকথা, ভ্রমণকাহিনি, কৌতুক, নাটক ইত্যাদি মাধ্যমে শিশু-কিশোর উপযোগী সাহিত্য রচনা করেন। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘হাওয়ার দোলা’, ‘ছানাবড়া’, ‘বেড়ে মজা’, ‘হৈচৈ’, ‘হুলুস্থুল’, ‘কথাশেখা’, ‘পাততাড়ি’, ‘ছন্দের টুংটাং’, ‘আনন্দ নাড়–’, ‘শহুরে মামা’, ‘কিপটে ঠাকুরদা’, ‘টুনটুনির গান’, ‘গুজবের জন্ম’, ‘বীর শিকারী’, ‘লালন ফকিরের ভিটে, ‘পাতাবাহার’, ‘ইন্তিবিন্তির আসর’, ‘পাহাড়ে জঙ্গলে’ ইত্যাদি। ‘ছোটদের চয়নিকা’ ও ‘ছোটদের গল্প সঞ্চয়ন’ তার সম্পাদিত দুটি উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ। তার রচিত আত্মজীবনী ‘জীবনখাতার কয়েক পাতা’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। তিনি তার সমকালের একমাত্র শিশুতোষ পাক্ষিক পত্রিকা ‘কিশোর এশিয়া’র পরিচালক ছিলেন। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের শিশুসাহিত্য শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৫৬ সালে তিনি সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ভুবনেশ্বরী পদক লাভ করেন। ১৯৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
করোনা মহামারী ও চলমান ইউরোপীয় সমর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থায় কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে চলে আসছে। এর মধ্যে বড় চ্যালেঞ্জ, কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আহরণ না হওয়া। কভিডে অর্থনীতি অনেকটা স্থবির থাকায় স্বাভাবিকভাবে রাজস্ব আহরণ কমে আসছে, কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছানো যাচ্ছে না। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসছে যে, মন্দাবস্থায় নিয়মিত রাজস্ব আহরণ কঠিন হচ্ছে। সংগত কারণেই ইদানীং আহরণ হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। লক্ষ্যমাত্রা কম কিংবা বেশি করে ধরা হোক বাস্তবতা হচ্ছে রাজস্ব আহরণ গতিশীল হচ্ছে না। সুতরাং অর্থনীতিকে সচল করা বা হওয়ার ওপরই রাজস্ব আহরণের মাত্রা ঊর্ধ্বগামী হওয়াটা নির্ভরশীল। আইএমএফ তেমন শর্তই দিয়েছে।
রাজস্ব আহরণ বাড়াতে বাংলাদেশ যতগুলো মুখরোচক উদ্যোগ নিয়েছে- তার মধ্যে একটি হলো, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। বিগত তিন-চার চলতি বাজেটবর্ষে অপ্রদর্শিত অর্থ, বিদেশে পাচার করা অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, বিদেশে অর্জিত (?) আয়, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যেকোনো সিকিউরিটিজের ওপর অত্যন্ত সীমিত হারে কর প্রদান করে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্র্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্র্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।’ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার খুব একটা লক্ষ করা যায়নি। তথাপি ন্যায়নীতি ও কর ন্যায্যতার মাথা খেয়ে এটি অব্যাহত রয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, এ কারণে তা কতটা যুক্তিযুক্ত সেটি পর্যালোচনার অবকাশ অবশ্যই রয়েছে।
আমাদের সম্পদ কর ব্যবস্থাপনার মধ্যে গলদ আছে। যেমন, জমি বিক্রি হলো ৭০ লাখ টাকা, অথচ রেকর্ড হলো ৬০ লাখ টাকা। বাকি ১০ লাখ টাকার কর কীভাবে হবে। এ রকম কিছু বিষয়ে বিদ্যমান বিধিবিধানে সমস্যা আছে। সেজন্য কারও কারও কাছে অপ্রদর্শিত অর্থ বা প্রদর্শন করেননি এমন অর্থ থাকতে পারে। এটা হতেই পারে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে চলতি বাজেটে অপ্রদর্শিত টাকা প্রদর্শনের মোড়কে মূলত দুর্নীতিজাত অবৈধ আয়কে বৈধ বিবেচনার একটা বিশেষ ধরনের সুযোগ ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের জন্য করহার করা হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ, যা কোনো দিন করা হয়নি, কোনো দেশে করা হয় না। এ ক্ষেত্রে দুটো বিষয় ঘটছে। এক. রাষ্ট্রের কর রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। যাদের জন্য এবং যেভাবে এ ছাড় দেওয়া তা ট্যাক্স জাস্টিসের পরিপন্থী। দুই. এর মধ্য দিয়ে নিয়মিত কর দেওয়া সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, প্রকারান্তরে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং সবাইকে করের আওতায় আনার ক্ষেত্রে এটি একটি অনৈতিক পন্থা বা পরিবেশ, যা কাম্য নয়। সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না।’ এটা একটা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেখানে যদি দেখা যায় অবৈধ অর্থ উপার্জনে বাধা দেওয়া হচ্ছে না, বড় ধরনের কর ছাড় দিয়ে আরও বলা হচ্ছে কীভাবে অর্থ উপার্জন করেছে তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এটা সংবিধানপ্রদত্ত রাষ্ট্রের দায়িত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
অনৈতিক পন্থায় করহার হ্রাস বা ছাড় দেওয়ার সঙ্গে কর অবকাশ বা অব্যাহতি এবং কর রেয়াতের একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। কোনো একটা এলাকা বা শিল্প পিছিয়ে আছে সেটিকে এগিয়ে আনতে কর অবকাশ বা অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর একটা যুক্তি আছে। এতে একটা এলাকা বা উদীয়মান শিল্পের উন্নয়ন হবে। সে ক্ষেত্রে প্রথমে কর ধরলে তার উন্নতি ব্যাহত হতে পারে। সেজন্য সব দেশেই ট্যাক্স হলিডের বিধান আছে। আমাদের দেশে এটাও ছিল বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এখনো আছেও। আর কর রেয়াত বা প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে প্রথম কর আদায় করা হয়, পরে শিল্পের বা সেবার স্বার্থে ফেরত দেওয়া হয়। এটাকে কর প্রত্যর্পণ বলা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর ভর্তুকি দেওয়ার নজিরও আছে। রাষ্ট্র যদি মনে করে যে কোনো খাত ভালো কাজ করছে। যেমন কৃষি খাতে প্রণোদনা বা ভর্তুকি দেওয়া হয়। কেন ভর্তুকি দেওয়া হয়? তাদের সমর্থ করে তোলার জন্য। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, একজন লোকের প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ অপ্রদর্শিত অর্থ (অপ্রদর্শিত অর্থের আড়ালে দুর্নীতিজাত কালো টাকা) ঘোষিত সুযোগে মাত্র সীমিত শতাংশ হারে কর দিয়ে বৈধ করতে পারছে। অর্থাৎ অন্য ব্যক্তি বা কোম্পানি করদাতা যেখানে ২৫-৩০ শতাংশ কর দিচ্ছে, সেখানে কালো টাকার মালিকরা পাচ্ছেন বিশেষ ছাড়। এটি একটি বড় ধরনের কর প্রণোদনা। আবার বলা হচ্ছে, কালো টাকার উৎস নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না অর্থাৎ দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্র সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বরং ইমিউনিটি দিচ্ছে।
রাষ্ট্রকে কর দেওয়া নাগরিকের দায়িত্ব। যদি করই না দেওয়া হয়, দুর্বল রিপ্রেজেনটেশনে জবাবদিহি চাওয়ার অধিকার তার থাকে না। নিজে কর না দিয়ে সে রাষ্ট্রের কাছে সেবা চাইছে। কর দিলে বাজেট বরাদ্দ পাওয়া তার অধিকার, কর না দিয়ে সে সরকারের কাছে অনুনয়-বিনয় করে, সরকার তার এই দুর্বলতা জানে বলে দয়াদাক্ষিণ্য হিসেবে কিছু সেবা দেয়, তার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে এবং রাষ্ট্রের টাকা আত্মসাতের সুযোগ পায় বা প্রলুব্ধ হয়। সে কর দেয় না বা ফাঁকি দেয় বা দিতে চায় বলেই কর অফিসের লোকরা তাকে চেপে ধরে, ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে ব্যাপৃত হয়। ফাঁকিবাজ করদাতা তার সঙ্গে আঁতাত করে রাষ্ট্রের কর স্বার্থকে ফাঁকি তো দেয়ই এবং কর বিভাগের অন্যায় হয়রানি বা ভয় প্রদর্শনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না।
এখানে প্রশ্ন হলো কর ইনসাফ প্রতিষ্ঠা না করলে কর আহরণে উন্নতি আসবে না। কর-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ যে তলানিতে, তার কারণটাই হলো এভাবে এ সমাজে কর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। মানে কাউকে ট্যাক্স দিতে বাধ্য করা হচ্ছে না বলে, এমনটিই হচ্ছে। অপ্রদর্শিত অর্থ এবং দুর্নীতিজাত অর্থ অর্থনীতির মূলধারায় আনার উদ্যোগ ইতিবাচক। কিন্তু বিশেষ হ্রাসকৃত হারে কর দিয়ে এবং উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, যেটি গুরুতরভাবে প্রশ্নসাপেক্ষ। কীভাবে উপার্জিত হলো, কীভাবে এলো, তা নিয়ে প্রশ্ন করা না গেলে তো সম্পদ পুনর্বণ্টনের কাজটি করা কঠিন হবে। অর্থাৎ বৈষম্য উসকে দেওয়া হবে, যদি টাকা কীভাবে উপার্জিত হচ্ছে তা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা বা প্রশ্নের মাধ্যমে বাধা না দেওয়া হয়, যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালের পর থেকে সম্পদের একটা বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। হু-হু করে জিডিপির সংখ্যাভিত্তিক পরিমাণ বেড়েছে এবং সেভাবে পারক্যাপিটা জিডিপিও বেড়েছে বলে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতায় ‘গরুর হিসাব শুধু কাজীর খাতায়, গোয়ালে তেমন গরু নেই’ পরিস্থিতি। বহু রিপোর্ট অনুযায়ী, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে খুব দ্রুত ধনীর সংখ্যা বাড়ছে।
রাষ্ট্র যদি মনে করে, কালো টাকা অর্থনীতিতে উপকারে আসুক তাহলে এমন সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। হাওর বা উপকূলীয় বাঁধ বা বড় অবকাঠামো প্রকল্প অর্থের অভাবে মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে, করোনাকালে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ পড়েছে। হাসপাতালে শয্যা কম। বিদ্যমান বরাদ্দ ও সরকারি প্রক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে করা যাচ্ছে না, জনসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান কিংবা শ্রমঘন কুটিরশিল্প উদ্যোগ গ্রহণে প্রযোজ্য কর দিয়ে সাদা করা টাকা বিনিয়োগের আহ্বান জানানো যায়। এসব জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করলে সরকার একটা উৎসাহব্যঞ্জক প্রণোদনা বা কর প্রত্যর্পণ ঘোষণা করবে। এর ফলে উন্নয়নে ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণও বাড়বে, বিনিয়োগের একটা সুযোগও তৈরি হবে। বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় প্রকল্পে যে দুর্নীতি হয় তা যদি প্রণোদনা আকারে দিয়ে দেওয়া হয় তাতেও লাভ। সুতরাং এ ধরনের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা করে কালো টাকাকে অর্থনীতির ধারায় আনতে হবে।
১৯৯৭ সালে ভারত যখন ‘ভলান্টারি ডিসক্লোজার অব ইনকাম স্কিম’ (ভিডিআইএস) জারি করেছিল, তখন কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অব ইন্ডিয়া এর কড়া সমালোচনা করেছিলেন। সাংবিধানিক সংস্থাটি সে সময় বলেছিল, এ সুযোগ সামাজিক সভ্য-ভব্যতার অপব্যবহার। এর ফলে এর আড়ালে অনৈতিকতা, অর্থ লোপাট স্বীকৃতি পাচ্ছে। ২০১৫ সালে ভারত ‘আনডিসক্লোজড ফরেন ইনকাম অ্যান্ড অ্যাসেটস ইমপোজিশন অব ট্যাক্স অ্যাক্ট’ জারি করেছিল। সেই আলোকে বাংলাদেশে ফরেন অ্যাসেটস ডিজক্লোজারের স্কিম জারি করা বরং বেশি প্রয়োজন ছিল। ভারতে ১৯৯৭ সালে ৪ লাখ ৭৫ জন নিজেদের আয়-সম্পদ ঘোষণা করেছিল। আর ২০১৫ সালে করেছিল ৬৩৮ জন। ১৯৯৭ সালে মোট অর্থ ডিসক্লোজ হয়েছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার আর ২০১৫ সালে ডিসক্লোজ হয়েছিল ৪ বিলিয়নের মতো। ১৯৯৭ সালে ভারত সরকার রাজস্ব পেয়েছিল ৯.৮৪ মিলিয়ন ডলার, ২০১৫ সালে পেয়েছিল ২ মিলিয়ন। এখানে কমপ্লায়েন্স পিরিয়ড ছিল কিন্তু তিন মাসের। জাল টাকার বিস্তার বা অন্য কোনো দুষ্কর্ম যেন না ঘটে তার জন্য সময় দিতে হয় অল্প। দুই মাস বা তিন মাস। বছরব্যাপী বা অবারিত থাকে না। ১৯৯৭ সালে ভারতে ভিডিআই এসএ করহার ছিল ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ তখনকার করপোরেট করের চেয়েও বেশি এবং অন্যদের জন্য ৩০ শতাংশ। তার মানে বিদ্যমান করহারের চেয়ে বেশি দিতে হয়েছিল। এটিই হলো পেনাল্টি। এটিই হলো সিস্টেম। এদিকে ২০১৫ সালে ৩০ শতাংশ কর এবং ৩০ শতাংশ পেনাল্টি ধরে দেওয়া হয়েছিল। কারণ এটা না থাকলে সৎ করদাতার সঙ্গে যেমন সাংঘর্ষিক হয়ে যায়, তেমনি এই সুযোগ দেওয়ায় দুষ্কৃতরাও অপকর্মে প্রলুব্ধ হয়। কর আরোপ করা এবং কর মওকুফের এখতিয়ার সংসদের রয়েছে ঠিকই। কর আরোপের ক্ষেত্রে যেমন রাষ্ট্রের স্বার্থ দেখতে হবে, তেমনি কর মওকুফের ক্ষেত্রেও সবার আগে রাষ্ট্রের স্বার্থটা দেখা দরকার।
লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি বিশ্লেষক
দৈনিক দিনকালের প্রকাশনা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবলম্বনকে স্বাধীন মতপ্রকাশে বাংলাদেশের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেশ ও বিদেশে অপতৎপরতা চোখে পড়ার মতো। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, সংবাদমাধ্যম ও অধিকার সংস্থাগুলো কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই এ অপপ্রচারে সায় দিচ্ছে; যা সর্বত্র বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পত্রিকাটির প্রকাশক ও মুদ্রাকর দেশের প্রধান বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ায় বিষয়টিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সুযোগ-সন্ধানী মহলের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। খুব সহজেই তারা প্রকৃত সত্য আড়াল করে বাকস্বাধীনতার ধোয়া তুলে দেশ-বিদেশে সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে। প্রকৃত সত্য হলো, দৈনিক দিনকালের প্রকাশনা বাতিলের সঙ্গে স্বাধীন মতপ্রকাশের সংশ্লিষ্টতা নেই বরং বিষয়টি নিতান্তই পত্রিকার প্রকাশনা ও রেজিস্ট্রেশন-সংক্রান্ত আইনগত ও পদ্ধতিগত ব্যত্যয়ের ফল; যা সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণে সম্পন্ন হয়েছে।
দৈনিক দিনকাল ২০০২ সালে তারেক রহমান প্রকাশক ও মুদ্রাকর মর্মে নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয়। পরে তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থানরত থাকায় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর ছাপাখানা ও প্রকাশনা ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) আইন ১৯৭৩-এর ১০, ১১, ১৬, ২০(১) (খ) ধারার আলোকে প্রকাশক বিধি অনুযায়ী দায়িত্ব হস্তান্তর না করে দীর্ঘ সময় বিদেশে অবস্থান, প্রকাশক ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় এবং যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে অফিসের ঠিকানা ও ছাপাখানা পরিবর্তন করার তিনটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক, ঢাকাকে অনুরোধ করে (চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের স্মারক নম্বর : ৬৫৭০, তারিখ : ০১/১০/২০১৯)।
জেলা প্রশাসক ওই স্মারকের ভিত্তিতে দৈনিক দিনকালকে কারণ দর্শানোর নোটিস প্রদান করলে দৈনিক দিনকাল এর কোনো উত্তর দেয়নি। পরে জেলা প্রশাসক, ঢাকা গত ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখ ছাপাখানা ও প্রকাশনা ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ আইন ১৯৭৩-এর ১০, ১১, ১৬, ২০(১) (খ) ধারা লঙ্ঘন করায় গত ১৬/০৪/২০০২ তারিখে দৈনিক দিনকালের প্রকাশক ও মুদ্রাকর হিসেবে পত্রিকার ঘোষণাপত্র ও মুদ্রণের ঘোষণাপত্র বাতিল করে।
দৈনিক দিনকাল ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখ বিধি মোতাবেক প্রেস কাউন্সিলে আপিল করে; যা দীর্ঘ পর্যালোচনার পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে খারিজ করে দেয়। ফলে জেলা প্রশাসক কর্র্তৃক প্রদান করা বাতিল আদেশ বহাল থাকে।
উল্লেখ্য, ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩-এর ধারা ১১, ১৬ মোতাবেক প্রকাশকের অনুপস্থিতিতে ৬ মাসের অধিক হলেই বিধি অনুযায়ী দায়িত্ব হস্তান্তর এবং যিনি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তার দায়িত্ব গ্রহণের লিখিত বিবরণী দাখিলের বাধ্যবাধকতা আছে, তা দৈনিক দিনকাল অনুসরণ করেনি।
ধারা ২০(১) (খ) অনুযায়ী মুদ্রাকর বা প্রকাশক যদি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধে দণ্ডিত হন; তাহলে তার পক্ষে প্রমাণীকরণ ঘোষণা বাতিল হয়ে যায়। ধারা ৭ ও ১০ মোতাবেক যথাযথ অনুমতি ও পদ্ধতিগত নীতিমালা অনুসরণে ব্যর্থ হলেও পত্রিকার ঘোষণাপত্র বাতিল হয়ে যাবে।
উপরোল্লিখিত ধারা মোতাবেক প্রেস কাউন্সিল বোর্ড যথাযথভাবে আপিলটির নিষ্পত্তি করলেও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একটি আইনগত সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক রঙ চড়িয়ে দেশের ভাবমূর্তি কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়েছে। দেশের মুক্তচিন্তা যুক্ত প্রকাশনা, মুক্ত সাংবাদিকতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবার অধিকার। রাষ্ট্র এ অধিকার সমুন্নত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু সবাইকেই নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হয়। ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩ অনুসরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে আরও ১০টি পত্রিকার নিবন্ধন বাতিল করা হয়। পত্রিকার নিবন্ধন বাতিল হলে নিয়মানুযায়ী পুনরায় নতুন করে অনুমতির জন্য আবেদন করতে হয়; যা সবাইকেই অনুসরণ করতে হয়।
কিন্তু দৈনিক দিনকাল রাজনৈতিক পত্রিকা হওয়ার কারণে এবং পত্রিকাটির পেছনে দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল থাকায় তারা রাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন, মিথ্যা ও ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে বিদেশি পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপানো ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে দেশের সম্মান ভূলুণ্ঠিত করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত। বিষয়টি একান্তই রাজনৈতিক ও দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে সহানুভূতি অর্জনের প্রচেষ্টা হিসেবে পরিগণিত।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, ফ্রিল্যান্সার
ভারতের মানুষের মাতৃভাষা কয়েকশ। এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪১৫টি। এই ৪১৫টি ভাষার উপভাষার সংখ্যা ১৫৭৬টি (১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে)। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ২৯টি কথ্যভাষায় ১০ লাখ মানুষ কথা বলে। ১২২টি কথ্যভাষা ১০ হাজার মানুষের মুখের ভাষা। এ ছাড়া অজস্র উপভাষা রয়েছে, যেগুলোর লিপি নেই। সেসব ভাষার অস্তিত্ব টিকে আছে মানুষের মুখে মুখে। বর্তমান ভারতের রাজ্যগুলোর ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। একই রাজ্যের একাধিক ভাষা যেমন রয়েছে, তেমনি একই ভাষা অপরাপর রাজ্যেও প্রচলিত আছে। ভারতের প্রাদেশিক সরকারি স্বীকৃত ভাষা (অসমীয়া, বাংলা, বোড়ো, ডোগরি, গুজরাটি, হিন্দি, কন্নড়, কাশ্মীরি, কোঙ্কনী, মৈথলী, মলয়ালম, মৈত্রৈ (মণিপুরি), মারাঠি, নেপালি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত, সাঁওতাল, তামিল, তেলেগু, উর্দু, মিজো ও কোকোবরক। ইংরেজি ভাষাও অনেক প্রদেশের সরকারি ভাষার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, যেমন অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ও চণ্ডীগড়। ভারতের প্রাদেশিক ভাষাসমূহের তালিকাই প্রমাণ করে অপরাপর প্রাদেশিক ভাষার মতো হিন্দিও প্রাদেশিক ভাষা। অনেক প্রদেশের সহকারী সরকারি ভাষা হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা, মারাঠি, পাঞ্জাবি, [খাসি, গারো, ভুটিয়া, গুরং, লেপচা, লিম্বু, মাঙার, মুখিয়া, নেওরি, রাজ, শেরপা, তমাং ইত্যাদি সিকিম প্রদেশের সহকারী সরকারি ভাষা।
প্রশ্ন থাকে বহু ভাষাভাষীর দেশ ভারতে প্রাদেশিক হিন্দি ভাষা কেন সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পেছনে ফিরে যেতে হবে। ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি এক রাষ্ট্রের সুবিধায় ভারতে বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তার-প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। ব্রিটিশদের মুৎসুদ্দি রূপে নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুযোগও হাতাতে পেরেছিল। তাদের মনস্কামনা পূরণে অন্তরায় ছিল ভাষার বিভক্তি। ব্রিটিশ ভারতেই ভারতীয় বুর্জোয়ারা স্বীয় স্বার্থে এককেন্দ্রিক শাসনের পাশাপাশি এক ভাষা ও এক জাতির আওয়াজ তুলেছিল। জাতি হিসেবে ভারতীয় এবং ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল তারা হিন্দি ভাষা-দেবনাগরী লিপি। নিজেদের কায়েমি স্বার্থে হিন্দি ভাষাকে ভারতের সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ফন্দি এঁটেছিল; অপরাপর ভাষা-সংস্কৃতি, স্বাজাত্যবোধকে বিলীন করে দেওয়ার মতলবে। ব্রিটিশ ভারতে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের সুবিধা ভোগ সম্ভব হলেও, তাদের পক্ষে হিন্দি ভাষাকে সর্বভারতীয় ভাষায় পরিণত করা সম্ভব হয়নি।
১৯১৫ সালে ভারতে ফিরে এসে গান্ধী ভারতজুড়ে ভ্রমণ করেন। তখনই তিনি দেখতে পান ভারতীয় মাড়োয়ারি পুঁজিপতিরা গো-রক্ষা এবং হিন্দি ভাষা প্রচলনে নানান পন্থায় মদদ জুগিয়ে যাচ্ছে। গান্ধী সহসাই পুঁজিপতিদের পক্ষে সেই প্রচারাভিযানে যুক্ত হয়ে যান। অর্থাৎ গো-রক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি হিন্দি ভাষাকে সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার বুর্জোয়া শ্রেণির আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এই তৎপরতার মধ্য দিয়েই ভারতে গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। ১৯১৬ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে ‘সর্বভারতীয় এক ভাষা ও একলিপি সম্মেলন’ গান্ধীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১৯ সালে হিন্দি ভাষা প্রচারে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের উপকমিটির সভাপতি হয়েছিলেন গান্ধী। ভারতীয় মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের অর্থের জোগানে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। সিন্ধু ন্যাশনাল কলেজে ১৯২০ সালের জুলাইয়ে গান্ধী বলেছিলেন, ‘হিন্দিই হবে সমগ্র ভারতের ভাষা এবং সেজন্য হিন্দি শেখা অন্যসব প্রদেশের কর্তব্য।’ গান্ধী প্রকাশ্যে বলে বেড়াতেন, ‘অহিন্দিভাষীদের হিন্দি শেখা হচ্ছে ধর্ম।’ ভারতীয়দের ধর্মীয় অনুভূতিতে হিন্দি ভাষা বিস্তারে ধর্মকে পর্যন্ত ব্যবহার করতে চেয়েছেন। হিন্দি ভাষাকে ধর্মীয় পর্যায়ভুক্ত করতেও দ্বিধা করেননি গান্ধী। গান্ধী লিখেছিলেন, ‘এলাহাবাদের হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোগে ১৮ মাসব্যাপী মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে হিন্দি ভাষার প্রচার খুব জোরালোভাবেই চলছে।’ হিন্দি ভাষাকে সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের অর্থানুকূল্যের বিষয়টিও স্বীকার করে গান্ধী বলেছিলেন, ‘হিন্দি প্রচারের কাজ ভারতের এই রাজতুল্য বণিকশ্রেণির বিশেষত্ব।’
১৯২১ সালে এক চিঠিতে গান্ধী মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘ভারতবর্ষে ফিরে আসার পর থেকেই আমি আপনাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছি। আমার কাজে আপনারা প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন। হিন্দি প্রচারের আন্দোলনকে আপনারা কার্যকরভাবে সমর্থন দিয়েছেন।’ গান্ধীর হিন্দি ভাষা প্রচারাভিযানে মাড়োয়ারিদের পাশাপাশি গুজরাটি, পার্শি বণিকশ্রেণিও আর্থিক সহায়তা প্রদানে পিছিয়ে ছিল না। বাংলা ও আসাম প্রদেশে হিন্দি প্রচারাভিযানে ১৯২৮ সালে হিন্দুত্ববাদী বুর্জোয়া ধনশ্যামদাস বিড়লাকে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করে কলকাতায় হিন্দি প্রচারের এক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালে হিন্দি ভাষাকে জাতীয় ভাষায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজেন্দ্র প্রসাদকে সভাপতি করে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে ‘রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতি’ গঠিত হয়। পরে স্বয়ং রাজেন্দ্র প্রসাদ লিখেছিলেন, ‘এর নীতি স্বয়ং গান্ধীজি নির্ধারণ করেছিলেন এবং আমাদের শিল্পপতি বন্ধুরা অর্থের জোগান দিতেন।’
হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপি সমগ্র ভারতীয়দের ওপর চাপানোর এই উদ্যোগে উত্তর প্রদেশের মুসলিম সম্প্রদায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। উর্দুভাষী মুসলমানদের মধ্যে এ নিয়ে আতঙ্ক ও ভীতির সঞ্চারে তারা উপলব্ধি করে হিন্দির দৌরাত্ম্যে তাদের উর্দু ভাষা-সংস্কৃতির বিলোপ ঘটবে। ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে লক্ষেèৗতে মুসলিম লীগ অধিবেশনে সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতের জাতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার তীব্র নিন্দা জানায়।
১৯২৭ সালের জুলাইয়ে গান্ধী লিখেছিলেন, ‘সব ভারতীয় ভাষার একটি লিপি হওয়া উচিত এবং শুধু দেবনাগরীই হতে পারে সেই লিপি।’ গান্ধী বলেছেন, ‘হিন্দু-মুসলিম উন্মত্ততার জন্য সম্পূর্ণ সংস্কারের পক্ষে বাধা আছে। তবে এর আগে হিন্দু ভারতকে বুঝতে হবে যে, যেসব ভাষা সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত এবং দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত তাদের লিপিগুলো, যেমন বাংলা, গুরুমুখী, সিন্ধি, ওড়িয়া, গুজরাটি, তেলেগু, তামিল, কন্নড়, মলয়ালম ইত্যাদি ভাষার লিপিকে বর্জন করে সে স্থলে থাকবে শুধুই দেবনাগরী লিপি। এর ফলে হিন্দু ভারত সংহত ও বলিষ্ঠ হবে।’ গান্ধী নিজেই স্বীকার করেছেন পাঞ্জাবে হিন্দু-মুসলমান এবং অন্য সবাই উর্দু জানে (উর্দু ভাষার লিপি ফার্সি)। ধর্মের ভিত্তিতে ভাষার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন গান্ধী। পাঞ্জাবি হিন্দুরা দেবনাগরী লিপি গ্রহণ করবে এবং মুসলিমরা ফার্সি লিপি। একইভাবে বাঙালি হিন্দুর লিপি হবে দেবনাগরী এবং বাঙালি মুসলমানের লিপি হবে বাংলা অথবা ফার্সি। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরোধকে ভাষা ও লিপির ভেতরে টেনে আনেন স্বয়ং গান্ধী। ব্রিটিশদের বিভক্তীকরণের চক্রান্তের নীতি অনুসরণ কি ভাষার প্রশ্নে গান্ধী করেননি? হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভক্তি ব্রিটিশরা করেছিল তাদের শোষণ প্রক্রিয়া এবং দখলদারিত্ব স্থায়ী করার লক্ষ্যে। গান্ধীও হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপির পক্ষে সম্প্রদায়গত বিভাজনের নীতি অনুসরণ করে সেই বিভাজনকেই সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক বিভাজন-বিভক্তি ব্রিটিশদের সৃষ্ট। সাম্প্রদায়িক বিভাজন নতুন মাত্রা পেয়েছিল গান্ধীর হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপির জাতীয় ভাষা ও লিপির আন্দোলন অভিযানে। এতে দ্রুতই মুসলিম সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মুসলমানদের বিরোধিতার মুখে গান্ধী-নেহরুর মত পরিবর্তন করলেও; উর্দুভাষী মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দি-উর্দু ভাষা বিতর্কে সরব হয়ে ওঠে এবং ভাষা নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিরোধেরও সূচনা ঘটে। ১৯৩৭ সালের জুলাইয়ে কংগ্রেস সভাপতি নেহরু বলেন, ‘অবশ্যই হিন্দি অথবা হিন্দুস্তানি হচ্ছে জাতীয় ভাষা এবং হওয়া উচিতও। লিপি সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা দরকার যে, হিন্দি ও উর্দু দুই লিপিই সহাবস্থান করা উচিত।... এই বিতর্ক বন্ধ করার জন্য ভালো হবে যদি আমরা কথ্যভাষাকে হিন্দুস্তানি এবং লিপিকে হিন্দি অথবা উর্দু আখ্যা দিই। ইউরোপের প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর হিন্দিতে অনুবাদ হওয়া একান্ত দরকার।’ নেহরুর বক্তব্যটির সারকথা হচ্ছে, লিখিত ভাষা হিন্দিই হবে ভারতের জাতীয় ভাষা। সেটা দেবনাগরী কিংবা উর্দু দুই লিপিতেই লিখিত হতে পারে। ‘ভাষাপ্রশ্ন’ গ্রন্থে নেহরু লিখেছিলেন, ‘একমাত্র হিন্দুস্তানিই সমগ্র ভারতের ভাষা হতে পারে।’ লিপির ক্ষেত্রে দেবনাগরী এবং উর্দু লিপির কথাও মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষোভ প্রশমনে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন।
গান্ধী মুসলমানদের বিরোধিতার মুখে হিন্দুস্তানির অনুরাগী হয়ে সেই লক্ষ্যে ১৯৪২ সালে ‘হিন্দুস্তানি প্রচার সভা’ সংগঠন গড়ে তোলেন। উত্তর ভারতে কথ্যভাষা রূপে হিন্দুস্তানি ভাষা ছিল বটে। তবে সেটি হিন্দি ও উর্দুর সংমিশ্রণে। লিপি না থাকায় লিখিত ভাষারূপে হিন্দুস্তানি ভাষার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ১৯৪৬ সালে নির্বাচনের আগে ভারতের সংবিধান সভায় গান্ধী প্রস্তাব করেছিলেন, তারাই সংবিধান সভার সদস্য হতে পারবেন যারা হিন্দি ভাষার সঙ্গে পরিচিত। গান্ধী আরও দাবি করেন, ভারতের সংবিধান হিন্দুস্তানি ভাষায় লিখিত হতে হবে। মৃত্যুর আগে গান্ধী বলেছিলেন, ‘তার যদি ক্ষমতা থাকত তবে তিনি তাদেরই কংগ্রেসের সদস্য করতেন যারা হিন্দুস্তানি ভাষা জানেন।’ ১৯৪৭ সালে গান্ধী হিন্দুস্তানি ভাষাকে সমগ্র এশিয়ার ভাষায় পরিণত করার দিবা-স্বপ্নও দেখেছিলেন। মুসলিম বিরোধিতায় গান্ধী-নেহরুরা ভারতের জাতীয় ভাষা হিন্দির পরিবর্তে হিন্দুস্তানি কথ্য ভাষার প্রচারণা ছিল প্রতারণার কৌশল। উদ্দেশ্য ছিল দেবনাগরী লিপির বাতাবরণে হিন্দি ভাষাকেই সমগ্র জাতিসত্তার স্কন্ধে চাপানোর। বাস্তবতা হচ্ছে হিন্দুস্তানি ভাষা প্রকৃতই কথ্য ভাষা। সে ভাষার ছিল না লিপি। ছিল না সাহিত্য। সেটি শুধুই আঞ্চলিক কথ্যভাষা মাত্র। হিন্দুস্তানি ভাষার দাবিটি ছিল হিন্দি ভাষা প্রতিষ্ঠায় কৌশলগত অভিপ্রায় মাত্র। ওই কৌশলতাই অনিবার্য করে তোলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশভাগ।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক নতুন দিগন্ত
আত্মা আগে দেহ পরে/এক ঘরেতে বাস/ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে/মহা সর্বনাশ জীবনগ্রাসী এই সর্বনাশের থাবা থেকে মানুষের রক্ষা নেই। দেহ থেকে আত্মা একসময় মুক্ত হবেই। তখন মানুষ হয়ে যান ‘লাশ’! কোনো নামে আর চিহ্নিত হন না। তখন তিনি নিষ্প্রাণ-নিথর-শীতল-প্রাণহীন একজন। জীবকুলের এই জীবনচক্র, আপন গতিতে চলছে। সেখানে মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যে কারণে ‘মৃত্যু’ স্বাভাবিক।
কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যুকে মেনে নেওয়া কঠিন। তবু মেনে নিতে হয়। যার গর্ভে জন্ম নিয়ে এই আমি দেখছি পৃথিবীর আলো সেই ‘মা’র অকালমৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারে না। তবু মা চলে যান আমাকে জন্ম দিয়ে। নয়তো মা-আমার দুজনেরই মৃত্যু সেই জন্মকালেই। এই অকালমৃত্যুহার আমাদের দেশে দিন দিন কমছে। এর মানে হচ্ছে জ্ঞান, বিজ্ঞানে আমরা উন্নত হচ্ছি। সচেতনতা বাড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
গতকাল দেশ রূপান্তরের শেষ পাতায় প্রকাশিত ‘২০ বছরে মাতৃমৃত্যু কমেছে ৭২.৫%’ শিরোনামের সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশে ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গত ২০ বছরে মাতৃমৃত্যু হার ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। সর্বশেষ ২০২০ সালে গর্ভাবস্থা বা প্রসবজনিত জটিলতার কারণে প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে মারা গেছেন ১২৩ জন। অথচ ২০০০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৪১ জন। সে হিসাবে এই ২০ বছরে প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে মৃত্যু কমেছে ৩১৮ জন।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ প্রকাশিত ‘মাতৃমৃত্যু প্রবণতা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনের তথ্যবিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের মাতৃমৃত্যু পরিস্থিতির এ চিত্র পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বিশ্ব মাতৃমৃত্যুর সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর সার্বিক হার এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। তবে এ সময় গর্ভাবস্থা বা প্রসবজনিত জটিলতার কারণে প্রতি ২ মিনিটে ১ জন নারীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মাতৃমৃত্যু হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। কিন্তু ২০১৬ থেকে ২০ সাল পর্যন্ত এ হার স্থবির ছিল এবং কিছু অঞ্চলে বেড়েছে।
সংবাদে আরও বলা হয়েছে, ২০ বছরের মধ্যে সামগ্রিক মাতৃমৃত্যুর হার ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। ২০০০ সালে প্রতি ১ লাখ শিশু জন্মের সময় ৩৩৯ জন মাতৃমৃত্যু থেকে কমে ২০২০ সালে ২২৩ জন হয়েছে। সে হিসাবে ২০২০ সালে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ জন নারী মারা গেছেন বা প্রতি ২ মিনিটে প্রায় একজন মারা গেছেন।
এর আগে ২০০৫ সালে গর্ভাবস্থা বা প্রসবজনিত জটিলতার কারণে বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে মারা গেছেন ৩৭৬ জন, ২০১০ সালে তা কমে ৩০১ জনে দাঁড়ায় ও ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল আরও কম, ২১২ জন।
প্রতিবেদনে মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে গুরুতর রক্তপাত, সংক্রমণ, অনিরাপদ গর্ভপাত থেকে জটিলতা এবং এইচআইভি/এইডসের মতো জটিলতা অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এসব জটিলতার অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।
এ ব্যাপারে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের প্রধান নাতালিয়া কানেম বলেন, ‘আমরা পরিবার পরিকল্পনায় জরুরিভাবে বিনিয়োগ করে এবং ৯ লাখ ধাত্রীর বৈশ্বিক ঘাটতি পূরণ করার মাধ্যমে আরও ভালো কিছু করতে পারি এবং অবশ্যই করতে পারি।’
বিশ্বব্যাপী গর্ভাবস্থায়, মা বা সন্তানের মৃত্যু শুধু হ্রাস করতে পারে আমাদের সচেতনতা। এর কোনো বিকল্প নেই। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কোনো মা যেন মৃত্যুর কোলে ঢলে না পড়েন। এই মৃত্যুহার নামুক শূন্যের কোঠায়। জীবন জড়িয়ে থাক, জীবনকে।
ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে জেলেখা বেগম নামে এক বৃদ্ধাকে মৃত দেখিয়ে তার বয়স্ক ভাতার কার্ড বাতিল করা হয়েছে। বিগত ৫ মাস যাবৎ তিনি বয়স্ক ভাতা বঞ্চিত রয়েছেন বলে জানা গেছে। অপরদিকে তার নাম পরিবর্তন করে আমিনা নামে অন্যজনকে বয়স্ক ভাতার কার্ড বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় মেম্বার বাদশার বিরুদ্ধে।
রানীশংকৈল উপজেলার নন্দুয়ার ইউনিয়নের সাতঘরিয়া গ্রাম এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেলেখা বেগম নন্দুয়ার ইউনিয়নের সাতঘরিয়া গ্রামের আ. রহিমের স্ত্রী। পূর্বের চেয়ারম্যান ওই বৃদ্ধার নামে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেন।
ভুক্তভোগী বলেন, আমি ভাতার কার্ড পাওয়ার পর থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর ১৫০০ টাকা করে পেয়েছিলাম। কিন্তু গত তারিখে আমার টাকার কোনো মেসেজ না আসায় আমি উপজেলা সমাজসেবা অফিসে গিয়ে জানতে পারি আমাকে মৃত দেখিয়ে আমিনা নামে ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন মেম্বার বাদশাহ।
ইউনিয়ন পরিষদে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৃত্যুর নিবন্ধন বইয়ের ২০২১ সালের রেজিস্ট্রারে বৃদ্ধার মৃত্যু নিবন্ধিত নেই। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এমন একটি সনদ দেওয়ায় তার ভাতাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তিনি এ বিষয়ে আরও বলেন, আমি জীবিত থাকার পরও মেম্বার বাদশাহ আমাকে মৃত দেখিয়ে আরেকজনের নামে কিভাবে টাকা খেয়ে ভাতার টাকা পরিবর্তন করে দেয়! আমি জীবিত থাকার পরও মেম্বার আমাকে মৃত দেখাল। আমি গরিব মানুষ। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নাই। এই টাকা দিয়ে ওষুধ খেয়ে বেঁচে আছি। আমি এর বিচার চাই।
মেম্বার বাদশাহ বলেন, প্রথমবারের মতো এমন ভুল করেছি। সামনের দিকে সর্তকতার সাথে কাজ করব।
নন্দুয়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বারী বলেন, জীবিত মানুষ মৃত দেখিয়ে ভাতার কার্ড পরিবর্তনের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে মেম্বার যদি করে থাকেন তাহলে খুবই খারাপ করেছেন।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুর রহিম বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে জানতে পারি, জেলেখা বেগম ৭ ডিসেম্বর ২০২১ এ মৃত্যু বরণ করেন। তাই ভাতাটি বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ওয়েবসাইটে মৃত্যু সনদ যাচাই ছাড়া সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর কাউকে মৃত দেখাতে পারবে না- সাংবাদিকের এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের এভাবেই হয়। আমরা এভাবেই করে থাকি, প্রত্যায়নপত্র দেখে প্রতিস্থাপন করে থাকি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমাজসেবা অফিসে প্রেরিত প্রত্যায়নটির কোনো তথ্য ইউনিয়ন পরিষদের ফাইলে সংরক্ষণ করা হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল সুলতান জুলকার নাইন কবির বলেন, এটি সংশোধনের কার্যক্রম চলমান। তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, এটি একটি গুরুতর অভিযোগ। আমরা তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেব।
বিরতি কাটিয়ে আবারও আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফিরছে আর্জেন্টিনা। গত মার্চে ঘরের মাঠে সবশেষ আকাশী-নীলদের দেখা গিয়েছিল তিন মাস পর আগামী জুনে তারা আসছে এশিয়া সফরে। সফরকালে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচও খেলবেন লিওনেল মেসিরা।
আগামী ১৫ জুন বেইজিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামবে আর্জেন্টিনা। চারদিন পর ১৯ জুন জাকার্তায় ইন্দোনেশিয়ার মুখোমুখি হবেন তারা। সেই ম্যাচ দুটিকে সামনে রেখে আজ দল ঘোষণা করেছেন দেশটির কোচ লিওনেল স্কালোনি। লিওনেল মেসিকে অধিনায়ক করে ২৭ সদস্যের দল ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু নাম। এই দলে এই দলে চমক হিসেবে রয়েছে আলেজান্দ্রো গার্নাচো। যিনি বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার প্রথম প্রীতি ম্যাচের দলে ছিলেন। তবে চোটের কারণে অভিষেকের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে আলো ছড়িয়েছেন গার্নাচো। গত বছরের জুলাইয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মূল দলে জায়গা হয় তার। এখন পর্যন্ত ক্লাবটির হয়ে ৩৫ ম্যাচ খেলেছেন এই লেফট উইঙ্গার। এখন পর্যন্ত নিজে করেছেন ছয়টি গোল, করিয়েছেন আরও ছয়টি। এমন পারফরম্যান্স নজর এড়ায়নি স্কালোনির। তাই জাতীয় দলে জায়গা পেতে বেগ পেতে হয়নি।
দলের তৃতীয় গোলকিপার হিসেবে জায়গা পেয়েছেন ওয়াল্টার বেতিনেজ। এছাড়া বেশ কয়েক বছর পর দলে ফিরেছেন লিওনার্দো বলের্দি। ফরাসি ক্লাব মার্সেইয়ের হয়ে চলতি মৌসুমে তিনি দুর্দান্ত খেলছেন। তবে স্কোয়াডের মাঝ মাঠের ফুটবলারদের নিয়ে কোনো চমক নেই।
তবে এই স্কোয়াডে নেই লাউতারো মার্তিনেজের নাম। গোড়ালির চোটের কারণে এই দুই প্রীতি ম্যাচে তাকে পাচ্ছে না আর্জেন্টিনা। তবে তার জায়গায় মাঠ মাতাতে দেখা যাবে জিওভানি সিমিওনেকে।
আর্জেন্টিনার ২৭ সদস্যের দল
গোলরক্ষক:
এমিলিয়ানো মার্টিনেজ (অ্যাস্টন ভিলা), জেরনিমো রুলি (আয়াক্স), ওয়াল্টার বেনিটেজ (পিএসভি)।
ডিফেন্ডার:
নাহুয়েল মোলিনা (অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ), গঞ্জালো মন্তিয়েল (সেভিয়া), জার্মান পেজেল্লা (রিয়েল বেটিস), ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো (টটেনহ্যাম হটস্পার), লিওনার্দো বলের্দি (অলিম্পিক মার্সেই), নিকোলাস ওতামেন্ডি (বেনফিকা), ফ্যাকুন্ডো মদিনা (আরসি লেন্স), নিকোলাস তাগলিয়াফিকো (লিয়ন), মার্কোস অ্যাকুনা (সেভিলা)।
মিডফিল্ডার:
লিয়ান্দ্রো পেরেদেস (জুভেন্তাস), এনজো ফার্নান্দেজ (চেলসি), গুইডো রদ্রিগেজ (রিয়েল বেটিস), রদ্রিগো ডি পল (অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ), এজেকিয়েল পালাসিওস (বেয়ার লেভারকুসেন), অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার (ব্রাইটন), থিয়াগো আলমাদা (আটলান্টা ইউনাইটেড), জিওভানি লো সেলসো (ভিলারিয়াল)।
ফরোয়ার্ড:
লুকাস ওকাম্পোস (সেভিয়া), অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া (জুভেন্তাস), লিওনেল মেসি (পিএসজি), জুলিয়ান আলভারেজ (ম্যানচেস্টার সিটি), জিওভানি সিমিওনে (নাপোলি), আলেজান্দ্রো গার্নাচো (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), নিকোলাস গঞ্জালেজ (ফিওরেন্টিনা)।
ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার আজমপুর ইউনিয়নের মদনপুর গ্রামে স্ত্রীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় চাচাতো ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে পলাশ হোসেন (২৮) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন।
শনিবার রাত ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত পলাশ হোসেন ওই গ্রামের মৃত ফজলুর রহমানের ছেলে।
স্থানীয়রা জানায়, নিহত পলাশ হোসেনের চাচাতো ভাই সুমন প্রায়ই পলাশের স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করত। শনিবার সন্ধ্যায় আবারো উত্ত্যক্ত করে। পলাশ বাড়িতে এলে বিষয়টি তাকে জানায় তার স্ত্রী। এ ঘটনায় পলাশ তার চাচাতো ভাইয়ের কাছে বিষয়টির প্রতিবাদ করতে গেলে উভয়ের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে সুমন ছুরি দিয়ে পলাশকে আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই পলাশ মারা যায়।
মহেশপুর থানার ওসি খন্দকার শামীম উদ্দিন বলেন, নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সদর হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। নিহত পলাশ পেশায় ভ্যানচালক ছিলেন, সঙ্গে কৃষিকাজও করত।
মার্চে ঘরের মাঠে দুটি প্রীতি ম্যাচের পর আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেখা যায়নি আর্জেন্টিনাকে। তিন মাস পর আগামী মাসে তারা খেলবে আরও দুটি প্রীতি ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচের জন্য ২৭ সদস্যের দল ঘোষণা করেছেন লিওনেল স্কালোনি। তবে ঘোষিত সেই দলে নেই লাউতারো মার্তিনেজ।
আর্জেন্টিনার ক্রীড়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম টিওয়াইসি স্পোর্টস ও ওলে তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গোড়ালির চোটের কারণে মার্তিনেজ চিকিৎসাধীন আছেন। তাই তাকে জাতীয় দলের স্কোয়াডে রাখা হয়নি।
চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে ইন্টার মিলানের হয়ে গোল করেছিলেন। ফাইনালেও তাকে ইতালিয়ান ক্লাবটির হয়ে খেলতে দেখা যেতে পারে। তারপরই তিনি মাঠের বাইরে চলে যাবেন। ঐ সময়ে তিনি বিশ্রামে থাকবেন। আর তাই কোচ স্কালোনি তাকে দলে রাখবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার শিরোপা জয়ের অন্যতম সদস্য মার্তিনেজ। তবে পুরো টুর্নামেন্টে তিনি ব্যাথানাশক ঔষধ খেয়ে খেলছিলেন।
আগামী ১৫ জুন বেইজিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ও ১৯ জুন জাকার্তায় ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামবে আর্জেন্টিনা।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তার বাসায় বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। বৃহস্পতিবার রাত থেকে হাজার হাজার সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী আসছেন তার ছয়দানার বাসায়। শনিবারও সেখানে ফুল আর মিষ্টির ছড়াছড়ি। মানুষের ভালোবাসার জবাব দিচ্ছেন নবনির্বাচিত মেয়র জায়েদা খাতুন ও তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম।
তবে এত উচ্ছ্বাসের মধ্যেও আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ী বহিষ্কার হওয়া জাহাঙ্গীরের শিবিরে অস্বস্তি আছে। কারণ তার সহযোগীরা মূল আওয়ামী লীগের। দলের প্রার্থী হেরে যাওয়ার পর পদ-পদবি পাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
অপরদিকে পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বাস ভবনে বিরাজ করছে নীরবতা। নেতাকর্মীদের কোনো আনাগোনা নেই।
শনিবার দুপুরে জাহাঙ্গীর আলমের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে তার মায়ের নির্বাচনে কাজ করা কর্মী ও সমর্থকরা দল বেঁধে তার বাস ভবনে আসছেন। অনেকের হাতে ফুল ও মিষ্টি। তারা মেয়র জায়েদা খাতুনের বাস ভবনের নিচতলা, দোতলা, তিনতলা ও বাড়ির প্রাঙ্গণে ভিড় করে আছেন। কিছুক্ষণ পরপর জায়েদা খাতুন বের হয়ে এসে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের শুভেচ্ছার জবাব দিচ্ছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীর আলম নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। সবাইকে মিষ্টি মুখ করাচ্ছেন।
জাহাঙ্গীর আলম তার কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে। কারও সঙ্গে কোনো বিরোধ সৃষ্টি করা যাবে না। আমরা সবাই মিলেমিশে কাজ করব।
জাহাঙ্গীর আলমের সান্নিধ্যে থেকে এবং তার মায়ের নির্বাচন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে অনেক নেতাকর্মী বহিষ্কার হয়েছেন। কাউকে কাউকে শোকজ করা হয়েছে। তারা এখন কিছুটা উজ্জীবিত হলেও তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকটা শঙ্কার মধ্যে আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সালনা এলাকার এক আওয়ামী লীগ নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, জাহাঙ্গীর আলম যখন দলের মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তখন আমিসহ প্রায় সব নেতাকর্মীই তার সঙ্গে ছিলাম। তিনি দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর তার কাছ থেকে অনেকে চলে গেছে আবার অনেকে গোপনে বা প্রকাশ্যে সম্পর্ক রেখেছে। এখন মহানগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন বাকি আছে। এই কমিটিতে জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে সখ্য থাকার কারণে তারা কোনো পদ-পদবি পাবেন কি না, তা নিয়ে আমরা চিন্তিত। এছাড়া মেয়র পদে জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের নির্বাচন অনেকে প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছে। আবার বেশিরভাগ গোপনে তার পক্ষে কাজ করেছে। এসব বিষয় নিয়ে আমরা বেশ চিন্তায় আছি।
তিনি মনে করেন, জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামী লীগ ছেড়ে অন্য কোনো দলে যোগ দেবেন না। কারণ জাহাঙ্গীর ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। একই সঙ্গে ওই আওয়ামী লীগ নেতা আশা প্রকাশ করেন, যেহেতু জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন তার ছেলের জনপ্রিয়তার কারণেই মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, সেহেতু তার জনপ্রিয়তা দেখে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জাহাঙ্গীর আলমকে ফের দলে ফিরিয়ে নেবেন; যা দলের অনেক নেতাকর্মীই বিশ্বাস করেন।
অন্যদিকে টঙ্গীর আরিচপুর এলাকার বাসিন্দা সুজন মিয়া বলেন, আজমত উল্লা খান মেয়র মনোনয়ন পাওয়ার পর অনেকে ধরে নিয়েছিলেন বিজয় নিশ্চিত। নেতাকর্মীদের মাঝেও ছিল এমন আত্মবিশ্বাস। কিন্তু নির্বাচন শেষে ফলাফল দেখে সবাই হতবাক। তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তাদের এমন ফল বিপর্যয় হবে। তিনি জানান, দুপুরের দিকে গিয়ে তিনি জানতে পারেন আজমত উল্লা খান বাসায় নেই। কোনো নেতাকর্মীকেও দেখতে পাননি।
জয়দেবপুর এলাকার আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা নাম প্রকাশ না করে জানান, গাজীপুরের ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের একটিতেও কোনো কর্মীর বুকে টেবিল ঘড়ি প্রতীকের ব্যাজ ছিল না। কেন্দ্রগুলোতে কোনো এজেন্ট না থাকার পরও ব্যক্তি জাহাঙ্গীর আলমের জনপ্রিয়তায় অপরিচিত এক নারী আওয়ামী লীগের বাঘা প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন, যা আওয়ামী লীগকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের অপর এক নেতা বলেন, তারা সবকিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। প্রতিটি কেন্দ্রের কেন্দ্র কমিটি, ওয়ার্ড কমিটি, থানা কমিটিসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কাছ থেকে তাদের এলাকায় নৌকা প্রতীকের ফলাফল খারাপ হওয়ার কারণ জানতে চাইব। তার পর এ বিষয়ে কী করণীয় তা নিয়ে দলের মহানগর ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে এগিয়ে যাব। এখন সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনই দলের জন্য চ্যালেঞ্জ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আজমত উল্লা খানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের কী ভুলত্রুটি ছিল, নেতাকর্মীদের ভূমিকা কী ছিল, এসব বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। উপযুক্ত সময়ে আমরা সব বিষয়ে কথা বলব।
নতুন পে-স্কেল কিংবা মহার্ঘ ভাতা নয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট অনুযায়ী। তাদের বেতন প্রতি বছর যতটা বাড়ার কথা এবার তার চেয়ে বেশি বাড়বে। আর তা চলতি বছরের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ানো হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশের বাইরে বাড়ানো হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত প্রায় এক বছর ধরে দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বেশিরভাগের একমাত্র আয় বেতন-ভাতা। বৈশি^ক মন্দার কারণে সরকারও খানিকটা সংকটে আছে। এ পরিস্থিতিতে পে-স্কেল দেওয়ার মতো বড় ধরনের ব্যয় বাড়ানো সরকারের পক্ষে কঠিন হবে। ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলে সরকারের ওপর চাপ বেশি হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সরকারি কর্মরতদের খানিকটা স্বস্তি দিতে কোন খাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এমন প্রস্তাব চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বাজেটবিষয়ক বিভিন্ন বৈঠকে সরকারি নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে আলোচনা করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই করে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করে। চলতি মাসে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী ওই বৈঠকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে কত বাড়তি ব্যয় হবে তা হিসাব করে পরের বৈঠকে উপস্থাপন করতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বড় ধরনের ব্যয় না বাড়িয়ে একটা উপায় বের করতেও বলেন। শেষ পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে নিজেই জানিয়েছেন।
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ২০১৫ সালের বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ বেতন কমিশন প্রণীত হয়েছিল। এ কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, আর নতুন বেতন কমিশন গঠন করা হবে না। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট বা বেতন বাড়ানো হবে। এ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তা হয়ে আসছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাব অনুযায়ী, দেশে সরকারি কর্মচারী ১৪ লাখ। বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে হিসাব করলে প্রায় ২২ লাখ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নিয়মিত ইনক্রিমেন্টের বাইরে আরও কতটা বাড়ানো যায় তা হিসাব করে নির্ধারণ করা হবে। এ কাজ করতে বাজেট প্রস্তাব পেশ করার পর আলাদা কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে যাচাই-বাছাই শেষে ইনক্রিমেন্টের হার সুপারিশ করবে। এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে বিদ্যমান ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে প্রতি মাসে বেতন বাড়ানো হবে, নাকি গড় মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে ইনক্রিমেন্টের হার বাড়ানো হবে, তা খতিয়ে দেখা হবে। ২০তম গ্রেড থেকে প্রথম গ্রেড পর্যন্ত সবার জন্য একই হারে বেতন বাড়নো হবে কি না, তা আরও খতিয়ে দেখা হবে। চূড়ান্ত হিসাব অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে প্রকাশ করা হবে। যে তারিখেই প্রকাশ করা হোক না কেন, আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকরী ধরা হবে।
এখানে মহার্ঘ ভাতা ১০ শতাংশ দেওয়া হলে এ হিসাবে ৪ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে ৬ হাজার কোটি এবং ২০ শতাংশ দেওয়া হলে ৮ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। অর্থাৎ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যয় বাড়বে। আর এতে সরকার ব্যয় কমিয়েও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টিতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো পথে হেঁটেছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতা বাবদ রাখা হয়েছে ছিল ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। খরচ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা বাজেট হওয়ার কথা আছে। এ বাজেট সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ ৭৭ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক পদ এখনো খালি আছে। এতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো হলেও সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের চাপ বাড়বে না।
সংলাপে রাজনৈতিক সংকট দূর হওয়ার নজির তৈরি হয়নি এখনো। তবুও নানা সময়ে সংকট নিরসনে রাজনীতিতে সংলাপ করা নিয়ে আলোচনা হয়। সংলাপের আশ্রয় নিতেও দেখা গেছে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভিন্ন মেরুতে অবস্থান থাকায় আবারও রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় আলোচনায় এসেছে ‘সংলাপ’। যদিও প্রধান দুই দলের নেতারা সংলাপে অনীহা প্রকাশ করে আসছেন। আবার আড়ালে আলাপে দুই দলের আগ্রহও দেখা গেছে।
অন্তরালের সংলাপ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার আড়ালে আলাপের মূল কারণ হলো বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বড় একটি অংশ বয়স্ক হয়ে গেছেন। তাদের অনেকের এবারের পরে নির্বাচন করার সক্ষমতা আর থাকবে না। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে গিয়ে সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হয়েছে। এ সময় সংসদ সদস্য হয়ে মর্যাদা নিয়ে চলতে চান তারা। বিএনপির ওই অংশের সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতাও রয়েছেন যারা নির্বাচনে যেতে চান। ফলে নির্বাচনে যেতে আগ্রহী বিএনপির সেই সব নেতা আড়ালে আলাপে থাকতে রাজি আছেন। অন্যদিকে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখতে চাওয়া বিদেশি শক্তিগুলোর সরকারের ওপর চাপ থাকায় বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে চায় আওয়ামী লীগ। ফলে প্রকাশ্যে সংলাপের আগ্রহ না দেখিয়ে আড়ালের আলাপে আগ্রহী দলটির নেতারা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে এক চুলও নড়বে না। অন্যদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে কোনোভাবেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যাবে না। দুই দলই নিজেদের এমন অনড় অবস্থান দেখাচ্ছে। দুই দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থানে সৃষ্ট সংকট সমাধানে বিদেশি তৎপরতা বেশ আগে থেকেই শুরু হয়েছে। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসতে শুরু করেছে বিদেশি সেই তৎপরতায়ও গতি এসেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি কাউকেই কাছাকাছি অবস্থানে, অর্থাৎ এক মেরুতে আনতে পারেনি এখনো। তবে বিদেশি প্রভাবশালী দেশগুলোর প্রতিনিধিরা সংকট নিরসনে দুই দলকেই সংলাপে বসার জন্য বলছেন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা সংলাপের মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধানের রাস্তা ঠিক করতে দুই দলকেই তাগিদ দিয়েছেন। বিদেশিদের অবস্থান হলো আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চান তারা। সে জন্য রাস্তা তৈরি করতে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই সংলাপে অনীহা দেখিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যে অনীহার কথা জানিয়েছেন। বিএনপিও প্রায় প্রতিদিনই অনীহা প্রকাশ করে বক্তব্য রাখছে।
তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও সংলাপে সমাধান আসেনি। এবারও সংলাপে সমাধান আসার সম্ভাবনা কম। যদি সংলাপের আগেই এজেন্ডা নির্ধারণ করে সংলাপে বসে, সেই সংলাপ সফল হওয়ার পথ থাকে না।
দুই দলের একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, প্রকাশ্যে সংলাপ না করে এবার আড়ালে সংলাপ হতে পারে। অনেকটা হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এমন ঘটনা ঘটে যেতে পারে-বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন দিয়ে বসতে পারেন।’ তিনি বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। সেই প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
নির্বাচন সামনে রেখে দেশে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকেরা সংকট নিরসনে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। ওই সব বৈঠকে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দুই দলেরই অবস্থান জানতে চেয়েছেন তারা। একই সঙ্গে দুই দলকে তারা এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে ভিন্নমত থাকলেও স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের স্বার্থে আগামী সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়া জরুরি। এ কারণে নির্বাচনের আগে দুই প্রধান দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার আবশ্যকতা রয়েছে। এই সমঝোতার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, কিংবা উভয় পন্থায় দুই দলের মধ্যে ‘আলাপ’ হওয়া দরকার, তা সেটা সংলাপ বা আলোচনা যে নামেই করা হোক না কেন। এদিকে কূটনীতিকদের কাছে আওয়ামী লীগ অভিযোগ করেছে, বিএনপি কোনো ধরনের সংলাপে আগ্রহী নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপির আচরণ বিদেশিদের কাছে তুলে ধরে সংলাপে বিএনপির অনীহার কথা জানান।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দাবি করছেন, রাজনীতিতে কোনো কিছু আদায় করতে হলে আন্দোলনের মাধ্যমে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীনদের বাধ্য করতে হয়। কিন্তু সেটা বিএনপি পারছে না। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছিল। সেখানে জনগণকে সম্পৃক্ত করে বিএনপিকে পদত্যাগে বাধ্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিএনপি এখন সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে করছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মাঠে আওয়ামী লীগের অবস্থান আছে। জনগণ সরকারের সঙ্গে আছে। আর তাদের সঙ্গে জনগণই নেই। তাই তো খালেদা জিয়াকে এখনো মুক্ত করতে পারেনি।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘যেকোনো সমস্যার সমাধান সংলাপের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। সংলাপে বসলে হয়তো শতভাগ পাব না। তবে গিভ অ্যান্ড টেক তো কিছু হবেই। গণতন্ত্রে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই।’
তবে দলটির সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, ‘সংলাপ চলছে। মিডিয়ায়, টক শোতে, মাঠে মঞ্চে। এক দল আরেক দলকে উদ্দেশ্য করে যে বক্তব্য দিচ্ছে, তাও এক ধরনের সংলাপ। এসব অনেকেই সংলাপ বলে টের না পেলেও মূলত এটাও সংলাপ।’
আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, সংলাপের ব্যাপারে পশ্চিমা কূটনীতিকেরা তাদের তেমন কোনো পরামর্শ দেননি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘আমরা তাদের (কূটনীতিক) বলেছি সংলাপের উদ্যোগ আমরা নিয়ে কী করব? তাদের (বিএনপি) যদি কোনো দাবি থাকে তাহলে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলতে পারে। নির্বাচন কমিশন যদি সুপারিশ করে, সেটা অবশ্যই সরকারের কাছে আসবে। সরকার দেখবে তখন।’
সংলাপ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ভাবনা আমাদের নাই।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি। আর আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচনকালীন এই সরকারই থাকবে এবং তাদের অধীনে নির্বাচনে হবে। নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ অবস্থায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সংকট সমাধানে কূটনীতিকদের দূতিয়ালি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও ইতিবাচক বিএনপি। সাম্প্রতিক সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাতিসংঘসহ বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার দূতসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। ওই বৈঠকগুলোতে কেন এই সরকারের অধীনে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না তা ব্যাখ্যা করেছে দলটি। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে যাবে না, সেটিও স্পষ্ট করেছে। একই সঙ্গে কূটনীতিকদের বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে সে বিষয়ে সংলাপের আহ্বান আসলে তাতে সাড়া দেবে বিএনপি। আর এই সংকট মোকাবিলায় কূটনীতিকদের ‘রোল প্লে’ (ভূমিকা রাখা) করার সুযোগ আছে বলে মনে করেন দলটির নেতারা। তাদের মতে, প্রকাশ্যে না হলেও পর্র্দার অন্তরালে সংলাপ হতে পারে। কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনেও গুঞ্জন রয়েছে ভেতর-ভেতর সংলাপ হচ্ছে।
সর্বশেষ ১৮ মে গুলশানের আমেরিকান ক্লাবে মার্কিন দূতাবাসের পলিটিক্যাল চিফ ব্রান্ডন স্ক্যাট, পলিটিক্যাল অফিসার ম্যাথিউ বে, পলিটিক্যাল কনস্যুলার ডেনিয়েল শেরির সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ।
জানতে চাইলে শামা ওবায়েদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকগুলোতে তারা আমাদের অবস্থান জানতে চান। আমরাও আমাদের অবস্থান তুলে ধরি। সর্বশেষ তারা জানতে চেয়েছেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে আপনাদের অবস্থান কী। আমরা বলেছি, আন্দোলন চলছে, সেটা আমরা কন্টিনিউ (চালিয়ে যাব) করব। তারা অন্য পক্ষের (ক্ষমতাসীনদের) কথাও শুনছেন। এ অবস্থায় তারা কী করছে (দূতিয়ালি), নাকি অন্য কিছু হচ্ছে সেটা তাদের বিষয়। তবে আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আরেকটি গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসুক, মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত হোক, সে ব্যাপারে তাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকুক।’
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আনুষ্ঠানিক সংলাপের ব্যাপারে কূটনীতিকেরা কোনো বৈঠকেই আমাদের কিছু বলেনি।’
তবে বৈঠকগুলোতে থাকা দলের আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা একাধিকবার সরকারের সঙ্গে সংলাপ করেছি। ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনের সংলাপে পর চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের তিন মাস পর নতুন নির্বাচন দেওয়ার কথা বলে তারা প্রতারণা করেছে। তাই এজেন্ডা ছাড়া কোনো সংলাপে আমরা যাচ্ছি না। কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে আমরা বলেছি, আনুষ্ঠানিক সংলাপের বিষয়ে আমরা ইতিবাচক। কিন্তু সেটি হতে হবে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে তা নিয়ে।’
ওই নেতার আরও বলেন, ‘সরকার এখন বিভিন্ন চাপে আছে। আন্তর্জাতিক চাপ তো আগে থেকেই আছে। এখন নতুন করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ বেড়েছে। এসব চাপ সামাল দিতে তারা সংলাপের নামে নানা কথা বলবে। কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের মনোভাবে কিছু হলেও আঁচ করা যায়। হয়তো কয়েক দিন পর সরকার আনুষ্ঠানিক সংলাপের জন্য আমন্ত্রণও জানাতে পারে।’
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে বর্তমানে তার মাসিক বেতন প্রায় ৩৪ হাজার। বাবার আর্থিক অবস্থাও অসচ্চল। কিন্তু তার আছে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, দামি জমিসহ অন্যান্য সম্পত্তি। সবমিলে তিনি অন্তত ১০ কোটি টাকার মালিক। দেশের ভেতরে যাতায়াত করেন বিমানে। ইচ্ছে হলে বিদেশেও যান। মাত্র ২৬ বছরে এত স্বল্প বেতনে চাকরি করেও সম্পদের বিশাল পাহাড় গড়ে সবাইকে তাজ্জব লাগিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী মুহাম্মদ এয়াকুব। একই সঙ্গে তিনি সিবিএর সাধারণ সম্পাদক এবং গ্যাস অ্যান্ড অয়েলস ফেডারেশনের মহাসচিব। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়োগ-পদোন্নতি নিয়ে বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এয়াকুব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে বিভিন্ন সময়ে ভুয়া অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু তা প্রমাণ হয়নি। আমি নিয়মিত আয়কর দাখিল করি। কোথাও অসামঞ্জস্য থাকলে সেটা আরও আগে ধরা পড়ত। আমি দুর্নীতিবাজ না। তবে আবার সুফিও না। সিবিএর নেতা হয়ে মসজিদের ইমাম সাহেবও হওয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমি পাঁচবার প্রত্যক্ষ ভোটে এবং তিনবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। আমি খুব গরিব ঘরের সন্তান। কিন্তু বেতন-ভাতা ভালো। এর বাইরে প্রতি বছর ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা কোম্পানির লভ্যাংশ পাই। মাছ চাষের জন্য তিনটি পুকুর আছে। গরু পালন করি। দুই ভাই বিদেশে থাকে। এসব টাকা দিয়েই বাড়ি কিনেছি। যমুনা অয়েলের একজন ক্লিনারেরও তো বাড়ি আছে। আমি সিবিএর নেতা। আমার একটা বাড়ি থাকা কি অন্যায়?’
এয়াকুব বলেন, ‘আমি আমার বিরুদ্ধে লেখেন কোনো সমস্যা নেই। মানুষ আজ পড়লে কাল ভুলে যাবে। হয়তো কিছু সম্মানহানি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেও দেশ ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটে আজ আমি কেরানি। কমার্স কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেছি। চাইলে আজ থেকে ১০ বছর আগেই কর্মকর্তা হতে পারতাম। কিন্তু সিবিএর নেতা হওয়া একটা নেশা।’
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার বেঙ্গুরা গ্রামের এয়াকুব ১৯৯৪ সালে যমুনা অয়েল কোম্পানিতে অস্থায়ী পদে দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে চাকরি শুরু করেন। মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠানের টাইপিস্ট পদে তার চাকরি স্থায়ী হয়। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রভিডেন্টফান্ড ও অন্যান্য খাতে টাকা কর্তন শেষে মাস শেষে তিনি বেতন পান ৩৩ হাজার ৯০৩ টাকা।
জানা গেছে, এত দিন ৪২ হাজার টাকার ভাড়া বাড়িতে থাকতেন এয়াকুব। সম্প্রতি ভাড়া বাসা ছেড়ে চট্টগ্রাম নগরীর অভিজাত এলাকা লালখান বাজারে তিনটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, যার আয়তন প্রায় সাড়ে চার হাজার বর্গফুট। দুটো ইউনিটে তিনি নিজে থাকেন, অন্যটি ভাড়া দিয়েছেন।
স্থানীয়দের দাবি, তিনটি ফ্ল্যাটের আনুমানিক মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো হবে। অভিজাত ফ্ল্যাট দুটি দামি আসবাব দিয়ে সাজানো হয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিষয়টি জানতে চাইলে এয়াকুব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা ঋণ এবং নিজের জমানো টাকা দিয়ে চার হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছি।
আরও জানা গেছে, নিজস্ব ফ্ল্যাট ছাড়াও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এক্সেল রোডে এয়াকুবের ৪ কাঠা জমিতে টিনশেডের ঘর আছে। ১০টি পরিবারের কাছে ভাড়া দিয়েছেন তিনি। দুদকের অনুসন্ধানেও এর প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। এয়াকুবের জমি ও ঘরসহ বর্তমানে ওই সম্পত্তির বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা হতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে তিনি অস্বীকার করে বলেছেন, ওই সম্পত্তির মালিক তিনি নন। জমিটি প্রথমে বায়না করলেও পরে আর কেনেননি।
এর বাইরে পতেঙ্গা, বেঙ্গুরাসহ বিভিন্ন স্থানে এয়াকুবের নামে-বেনামে জমি ও অন্যান্য সম্পদ থাকার তথ্য এসেছে দেশ রূপান্তরের কাছে।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এয়াকুব একটি মাইক্রোবাস ব্যবহার করেন। তবে দেশ রূপান্তরের কাছে তার দাবি, এই গাড়ির মালিক তার পরিচিত। কিন্তু গাড়িটি তার নয়।
অভিযোগ উঠেছে, যমুনা অয়েল কোম্পানির ঠিকাদারের শ্রমিক মো. আবদুল নুর ও মো. হাসান ফয়সালের সহযোগিতায় সিবিএ নেতা এয়াকুব কোম্পানির ডিপোতে চাকরি দেওয়ার নামে ৮ জনের কাছ থেকে কুরিয়ার সার্ভিস ও বিকাশের মাধ্যমে ২০১৯ সালে কয়েক দফায় ২৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু তাদের কাউকে চাকরি দেওয়া হয়নি। ওই টাকাও ফেরত পাননি কেউই। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী ডিপোতে কর্মরত তৎকালীন কর্মচারী তোতা মিয়ার মাধ্যমে এয়াকুবকে ওই টাকা পাঠানো হয়। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর একাধিক রসিদ দেশ রূপান্তরের হাতে এসেছে।
চাকরি না হওয়ায় টাকা ফেরত চাইলে তোতা মিয়া ও চাকরি প্রার্থীদের নানা রকম ভয়ভীতিসহ প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে এয়াকুবসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানায় ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই সাধারণ ডায়েরি করেন মো. তোতা মিয়া।
এয়াকুব দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে মিথ্যে অভিযোগ করা হয়েছিল। তিনি কোনো ধরনের অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নন। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় অভিযোগকারী আমার কাছে এবং কোম্পানির দায়িত্বশীলদের কাছে ক্ষমা চেয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
তবে বিষয়টি নিয়ে যমুনা অয়েলের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। তাদের অভিযোগ, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিবিএ নেতা এয়াকুব তোতা মিয়াকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার নির্দেশ দেন। ওই সময় টাকা ফেরত দেওয়ার শর্তে একটা মীমাংসা করা হলেও পরে ওই টাকা ফেরত দেয়নি এয়াকুব। তবে এয়াকুবের দাবি, তিনি কাউকে চাপ প্রয়োগ করেননি। অভিযোগটি মিথ্যে প্রমাণিত হওয়ায় তোতা মিয়া তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যমুনা অয়েলের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ করেন, সিবিএর কিছু নেতা নানা রকম অনিয়ম-দুর্নীতি করলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেন না।
এ বিষয়ে জানতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দীন আনচারীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করে, খুদে বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। কোম্পানির ঢাকা কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি দুদকের এক প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যমুনা অয়েল কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, ক্যাজুয়াল ও কন্ট্রাক্টর ক্যাজুয়াল নিয়োগ, ফার্নেস অয়েল, বিটুমিনসহ বিভিন্ন খাতে এয়াকুব মাসোহারা নেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় প্রধান তেল স্থাপনা ও দেশের সব ডিপো থেকে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায়েরও মৌখিক অভিযোগ পেয়েছে দুদক। তার এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বদলিসহ নানা রকম শাস্তি দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ থাকার অভিযোগ করেছেন একাধিক কর্মচারী।
দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১-এর সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, বিভিন্ন রেকর্ডপত্র এবং সরেজমিন তথ্য পর্যালোচনা করে এয়াকুবের বিরুদ্ধে অভিযোগ সঠিক ও গ্রহণযোগ্য হওয়ায় তা প্রকাশ্যে অনুসন্ধান করা দরকার। তার ওই সুপারিশ আমলে নিয়ে কমিশন আজ রবিবার সকালে চট্টগ্রাম কার্যালয়ে শুনানিতে হাজির হতে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছেন।
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে বর্তমানে তার মাসিক বেতন প্রায় ৩৪ হাজার। বাবার আর্থিক অবস্থাও অসচ্চল। কিন্তু তার আছে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, দামি জমিসহ অন্যান্য সম্পত্তি। সবমিলে তিনি অন্তত ১০ কোটি টাকার মালিক। দেশের ভেতরে যাতায়াত করেন বিমানে। ইচ্ছে হলে বিদেশেও যান। মাত্র ২৬ বছরে এত স্বল্প বেতনে চাকরি করেও সম্পদের বিশাল পাহাড় গড়ে সবাইকে তাজ্জব লাগিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী মুহাম্মদ এয়াকুব। একই সঙ্গে তিনি সিবিএর সাধারণ সম্পাদক এবং গ্যাস অ্যান্ড অয়েলস ফেডারেশনের মহাসচিব। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়োগ-পদোন্নতি নিয়ে বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এয়াকুব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে বিভিন্ন সময়ে ভুয়া অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু তা প্রমাণ হয়নি। আমি নিয়মিত আয়কর দাখিল করি। কোথাও অসামঞ্জস্য থাকলে সেটা আরও আগে ধরা পড়ত। আমি দুর্নীতিবাজ না। তবে আবার সুফিও না। সিবিএর নেতা হয়ে মসজিদের ইমাম সাহেবও হওয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমি পাঁচবার প্রত্যক্ষ ভোটে এবং তিনবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। আমি খুব গরিব ঘরের সন্তান। কিন্তু বেতন-ভাতা ভালো। এর বাইরে প্রতি বছর ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা কোম্পানির লভ্যাংশ পাই। মাছ চাষের জন্য তিনটি পুকুর আছে। গরু পালন করি। দুই ভাই বিদেশে থাকে। এসব টাকা দিয়েই বাড়ি কিনেছি। যমুনা অয়েলের একজন ক্লিনারেরও তো বাড়ি আছে। আমি সিবিএর নেতা। আমার একটা বাড়ি থাকা কি অন্যায়?’
এয়াকুব বলেন, ‘আমি আমার বিরুদ্ধে লেখেন কোনো সমস্যা নেই। মানুষ আজ পড়লে কাল ভুলে যাবে। হয়তো কিছু সম্মানহানি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেও দেশ ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটে আজ আমি কেরানি। কমার্স কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেছি। চাইলে আজ থেকে ১০ বছর আগেই কর্মকর্তা হতে পারতাম। কিন্তু সিবিএর নেতা হওয়া একটা নেশা।’
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার বেঙ্গুরা গ্রামের এয়াকুব ১৯৯৪ সালে যমুনা অয়েল কোম্পানিতে অস্থায়ী পদে দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে চাকরি শুরু করেন। মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠানের টাইপিস্ট পদে তার চাকরি স্থায়ী হয়। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রভিডেন্টফান্ড ও অন্যান্য খাতে টাকা কর্তন শেষে মাস শেষে তিনি বেতন পান ৩৩ হাজার ৯০৩ টাকা।
জানা গেছে, এত দিন ৪২ হাজার টাকার ভাড়া বাড়িতে থাকতেন এয়াকুব। সম্প্রতি ভাড়া বাসা ছেড়ে চট্টগ্রাম নগরীর অভিজাত এলাকা লালখান বাজারে তিনটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, যার আয়তন প্রায় সাড়ে চার হাজার বর্গফুট। দুটো ইউনিটে তিনি নিজে থাকেন, অন্যটি ভাড়া দিয়েছেন।
স্থানীয়দের দাবি, তিনটি ফ্ল্যাটের আনুমানিক মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো হবে। অভিজাত ফ্ল্যাট দুটি দামি আসবাব দিয়ে সাজানো হয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিষয়টি জানতে চাইলে এয়াকুব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা ঋণ এবং নিজের জমানো টাকা দিয়ে চার হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছি।
আরও জানা গেছে, নিজস্ব ফ্ল্যাট ছাড়াও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এক্সেল রোডে এয়াকুবের ৪ কাঠা জমিতে টিনশেডের ঘর আছে। ১০টি পরিবারের কাছে ভাড়া দিয়েছেন তিনি। দুদকের অনুসন্ধানেও এর প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। এয়াকুবের জমি ও ঘরসহ বর্তমানে ওই সম্পত্তির বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা হতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে তিনি অস্বীকার করে বলেছেন, ওই সম্পত্তির মালিক তিনি নন। জমিটি প্রথমে বায়না করলেও পরে আর কেনেননি।
এর বাইরে পতেঙ্গা, বেঙ্গুরাসহ বিভিন্ন স্থানে এয়াকুবের নামে-বেনামে জমি ও অন্যান্য সম্পদ থাকার তথ্য এসেছে দেশ রূপান্তরের কাছে।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এয়াকুব একটি মাইক্রোবাস ব্যবহার করেন। তবে দেশ রূপান্তরের কাছে তার দাবি, এই গাড়ির মালিক তার পরিচিত। কিন্তু গাড়িটি তার নয়।
অভিযোগ উঠেছে, যমুনা অয়েল কোম্পানির ঠিকাদারের শ্রমিক মো. আবদুল নুর ও মো. হাসান ফয়সালের সহযোগিতায় সিবিএ নেতা এয়াকুব কোম্পানির ডিপোতে চাকরি দেওয়ার নামে ৮ জনের কাছ থেকে কুরিয়ার সার্ভিস ও বিকাশের মাধ্যমে ২০১৯ সালে কয়েক দফায় ২৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু তাদের কাউকে চাকরি দেওয়া হয়নি। ওই টাকাও ফেরত পাননি কেউই। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী ডিপোতে কর্মরত তৎকালীন কর্মচারী তোতা মিয়ার মাধ্যমে এয়াকুবকে ওই টাকা পাঠানো হয়। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর একাধিক রসিদ দেশ রূপান্তরের হাতে এসেছে।
চাকরি না হওয়ায় টাকা ফেরত চাইলে তোতা মিয়া ও চাকরি প্রার্থীদের নানা রকম ভয়ভীতিসহ প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে এয়াকুবসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানায় ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই সাধারণ ডায়েরি করেন মো. তোতা মিয়া।
এয়াকুব দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে মিথ্যে অভিযোগ করা হয়েছিল। তিনি কোনো ধরনের অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নন। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় অভিযোগকারী আমার কাছে এবং কোম্পানির দায়িত্বশীলদের কাছে ক্ষমা চেয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
তবে বিষয়টি নিয়ে যমুনা অয়েলের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। তাদের অভিযোগ, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিবিএ নেতা এয়াকুব তোতা মিয়াকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার নির্দেশ দেন। ওই সময় টাকা ফেরত দেওয়ার শর্তে একটা মীমাংসা করা হলেও পরে ওই টাকা ফেরত দেয়নি এয়াকুব। তবে এয়াকুবের দাবি, তিনি কাউকে চাপ প্রয়োগ করেননি। অভিযোগটি মিথ্যে প্রমাণিত হওয়ায় তোতা মিয়া তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যমুনা অয়েলের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ করেন, সিবিএর কিছু নেতা নানা রকম অনিয়ম-দুর্নীতি করলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেন না।
এ বিষয়ে জানতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দীন আনচারীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করে, খুদে বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। কোম্পানির ঢাকা কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি দুদকের এক প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যমুনা অয়েল কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, ক্যাজুয়াল ও কন্ট্রাক্টর ক্যাজুয়াল নিয়োগ, ফার্নেস অয়েল, বিটুমিনসহ বিভিন্ন খাতে এয়াকুব মাসোহারা নেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় প্রধান তেল স্থাপনা ও দেশের সব ডিপো থেকে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায়েরও মৌখিক অভিযোগ পেয়েছে দুদক। তার এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বদলিসহ নানা রকম শাস্তি দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ থাকার অভিযোগ করেছেন একাধিক কর্মচারী।
দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১-এর সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, বিভিন্ন রেকর্ডপত্র এবং সরেজমিন তথ্য পর্যালোচনা করে এয়াকুবের বিরুদ্ধে অভিযোগ সঠিক ও গ্রহণযোগ্য হওয়ায় তা প্রকাশ্যে অনুসন্ধান করা দরকার। তার ওই সুপারিশ আমলে নিয়ে কমিশন আজ রবিবার সকালে চট্টগ্রাম কার্যালয়ে শুনানিতে হাজির হতে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।