
এক বছর আগে, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের সিদ্ধান্ত সমগ্র বিশ্বকে হতচকিত ও আতঙ্কিত করে তুলেছিল। তখন কেউ ভাবেনি যে, এই যুদ্ধ এতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, এক বছর পরও এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা যাবে না। এক বছরে ইউক্রেন দেশটি বিধ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু আরও বড় কথা, ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে যে, আধুনিক ইতিহাসের একটি মাইলফলক হয়ে চলেছে এই যুদ্ধ। পুরো বিশ্বাসীকেই এই যুদ্ধের নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে তা হলো, পরমাণু যুদ্ধ কি আসন্ন? ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তির আগে, গত ২১ ফেব্রুয়ারি রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের হুমকিতে সেই জল্পনাই এখন চরমে। এতদিন মস্কোর তরফে এ ব্যাপারে পরোক্ষে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আচমকা কিয়েভ সফর এবং হুমকিতে এক লহমায় পাল্টে গিয়েছে গোটা পরিস্থিতি। এই পদক্ষেপের জবাবে এদিন আমেরিকার সঙ্গে স্বাক্ষরিত পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি ভাঙার কথা ঘোষণা করেন পুতিন। তার সাফ হুঁশিয়ারি, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, তাহলে আমরাও পিছিয়ে থাকব না। একসপ্তাহ আগে আমি যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন স্ট্র্যাটেজিক সিস্টেম মোতায়েনের ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেছি।’ যদিও সেটি কী, তা স্পষ্ট করা হয়নি। তবে একথার মাধ্যমে তিনি যে কার্যত পরমাণু যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা স্পষ্ট।
পুতিনের এই ঘোষণা পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনা উসকে দিয়েছে বলে মত সামরিক বিশেষজ্ঞদেরও। ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে গত ২০ ফেব্রুয়ারি আচমকা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ পরিদর্শনে যান জো বাইডেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে পাশে নিয়ে প্রচ্ছন্ন হুমকিও দেন মস্কোকে। সঙ্গে ছিল ইউক্রেনকে চার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র সাহায্য, প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র এবং আধুনিক সাঁজোয়া গাড়ি পাঠানোর আশ্বাস। বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি ক্রেমলিন। তাই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত শেষ চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’ বা ‘স্ট্র্যাটেজিক অফেন্সিভ আর্মস ট্রিটি’ থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে আসার কথা ঘোষণা করেছেন পুতিন।
২০১০ সালের ৮ এপ্রিল বারাক ওবামার আমলে তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের সঙ্গে এই কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষর করে ওয়াশিংটন। দু’দেশে পরমাণু অস্ত্র হ্রাসে এটির ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ২০২১ সালে সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন সেটি আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে দেয়। এদিন দেশবাসীর উদ্দেশে ‘স্টেট অব দ্য নেশন’ ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট তা খারিজ করে দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে আমেরিকাসহ পশ্চিমি দুনিয়াকে দায়ী করেছেন পুতিন। তিনি বলেছেন, ‘স্থানীয় সমস্যাগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে রূপ দিয়েছে পশ্চিমি দেশগুলো। দেশের স্বার্থে এই অভিসন্ধির বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছি। রাশিয়াকে সহজেই হারানো যাবে বলে মনে করেছিল পশ্চিমের দেশগুলো। সেই কারণে ইউক্রেনে সংঘাতের আগুন জ্বালানো হয়। কিন্তু আমাদের হারানো অসম্ভব। তাদের জন্যই আমরা আজ যুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছি।’ ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল (খেরাসন, জাপোরিঝিয়া, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক) রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত করার কথাও ঘোষণা করেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
এই মুহূর্তে ইউক্রেন যুদ্ধ দু’টি গতিপথের সামনে দাঁড়িয়ে। এক, ক্রমাগত ও নিরন্তর আক্রমণ প্রসারে তত বেশি না-হলেও ক্ষয়ক্ষতিপ্রবণ ঘটিয়েই যাবে রাশিয়া। বহু মানুষ মারা যাবেন, বহু নগর-লোকালয় বিনষ্ট হবে, রুশ ফেডারেশনের মধ্যেও দেখা দেবে অস্থিরতা। দুই, একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের অঞ্চলগণ্ডি পেরিয়ে এটি আরও বড় হয়ে উঠতে পারে, যে পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের পরমাণু-অস্ত্র নিয়ে জুয়াখেলার ইচ্ছেও চাগিয়ে উঠতে পারে।
ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে মোড় নিচ্ছে তাতে একটি ছবি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপীয় শক্তি, অর্থাৎ ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোকে অতঃপর একটি বৃহত্তর ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে পূর্ব ইউরোপীয় অঙ্গনে। যদি কখনো প্রেসিডেন্ট পুতিন যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করেন, তখনো। কেননা ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন কিংবা কাশ্মীরের মতোই, সম্ভবত ইউক্রেনেও কোনো যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। মূল রাশিয়ার সঙ্গে পূর্বতন সোভিয়েট বলয়ের সম্পর্ক এমনই বিস্ফোরক থেকে যাবে, বিশেষত ইউক্রেনে এর সহজ মীমাংসা কল্পনাতীত। সে ক্ষেত্রে আর একটি দ্বিতীয় ইসরায়েল পরিস্থিতির জন্ম হলো বলা যায়, যেখানে পশ্চিমি শিবির সব সময়ে দায় বোধ করবে একটি নির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক ভূমিকা পালনের, প্রয়োজনে সামরিক হস্তক্ষেপেরও। অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহ দুই-ই দ্রুতবেগে বাড়ছে। ১৯৪৫ সালের পর এই প্রথম ন্যাটো এত বড় যুদ্ধে নেমেছে। কাকতালীয় নয় যে, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তি এই যুদ্ধের সময়েই ঘটতে পেরেছে।
দুর্ভাগ্যজনক এই পরিস্থিতির অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়তে চলেছে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। ইতিমধ্যেই তা অনুভূত হতে শুরু করেছে। রাশিয়ার শক্তি সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার ফলে গোটা ইউরোপ জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন। যদিও সদ্য-অতিক্রান্ত শীত আশঙ্কার তুলনায় স্থিতিশীল কেটেছে, ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্বনেতারা অতীব উদ্বিগ্ন। বিশ্বজুড়ে গম উৎপাদনের ৩০ শতাংশ ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে আসে, সুতরাং খাদ্যশস্যেও ঘাটতি আসার আশঙ্কা। মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে বিভিন্ন দেশে। নাগরিক ক্ষোভ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। ইউক্রেন থেকে আসা নতুন উদ্বাস্তুস্রোত আবার সামাজিক অস্থিতি তৈরি করছে। সব মিলিয়ে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর যে সময়ের মধ্যে বিশ্বকে ঠেলে দিয়েছে, তা মোটেও স্বস্তির নয়।
সবচেয়ে বড় কথা ৩৬ বছরের পুরনো ক্ষেপণাস্ত্র চুক্তি থেকে আমেরিকা-রাশিয়ার এই সরে আসা এবং নতুন করে হুমকি-ধমকি সেই ঠাণ্ডা যুদ্ধের স্মৃতিকেই ফিরিয়ে আনছে। বিশ্বজুড়ে দুই বৃহৎ শক্তির, অর্থাৎ আমেরিকা ও রাশিয়ার অস্ত্র প্রতিযোগিতায় রাশ টানতে বিশ্বজনমতের চাপে ১৯৮৭ সালে সম্পাদিত এই চুক্তিতে (আইএনএফ) ক্ষুদ্র ও মাঝারি পাল্লার (৫০০ কিলোমিটার থেকে ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার) সব পরমাণু অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর চার বছরের মধ্যে আমেরিকা ও রাশিয়া ২ হাজার ৭০০ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে ফেলেছিল। সারা বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লাগাম টানতে এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও কয়েক বছর ধরে পৃথিবীজুড়েই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।
পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া ক্রমেই সমরসজ্জায় এগিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমের ওপর রাশিয়ার অগ্রগণ্যতা প্রতিষ্ঠা করার একটা প্রচেষ্টা রাশিয়ার মধ্যে প্রবল। বিশেষ করে ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার অস্ত্রের ক্ষেত্রে রাশিয়া পশ্চিমা শক্তির তুলনায় এগিয়ে থাকতে চায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমারা ভেবেছিল, রাশিয়া আর কোনোদিন কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না বা পুনরুজ্জীবন ঘটবে না। কিন্তু সে ধারণা যে ভুল, সেটা এরই মধ্যে পুতিন প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
পুতিন মনে করেন, ন্যাটোর প্রচলিত অস্ত্রশক্তির কাছে তার দেশের পিছিয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতিতে যে কোনো হামলার সম্ভাব্য প্রত্যুত্তর হতে পারে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের উৎপাদন বাড়ানো। এর ফলে কেউ তার দেশের ওপর পরিকল্পিত কোনো হামলা পরিচালনার সাহস পাবে না।
বিষয়টি সম্পর্কে আমেরিকানরাও ওয়াকিবহাল। তাই তো রাশিয়ার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আমেরিকাও অস্ত্র তৈরিতে, বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র উন্নত করে চলেছে। রাশিয়া ও আমেরিকা উভয় দেশই অত্যাধুনিক সব পারমাণবিক অস্ত্র ক্রমাগত শক্তিশালী করে চলেছে এবং এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগও বাড়িয়েছে। নিজ নিজ দেশের নিরাপত্তার নামে রাশিয়া ও আমেরিকা এখন গভীর সামরিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। যদিও এটা নিরাপত্তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো কাজেই আসবে না। বরং এতে উভয় পক্ষের সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাবে। সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, বর্তমানে রাশিয়া ও আমেরিকা দুই দেশেই দুজন একরোখা-অপরিণামদর্শী যুদ্ধবাজ ব্যক্তি ক্ষমতায় রয়েছেন। বিশ্বশান্তির পথে না হেঁটে যারা উল্টোপথে চলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন! এই দুই ব্যক্তির খেয়ালি আচরণ মানবজাতির জন্য যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্যোগ বয়ে আনতে পারে।
সন্দেহ নেই, ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাদানুবাদ ফের ঠাণ্ডা মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে। পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা থেকে এখন দুই রাষ্ট্রকে বিরত করবে কে বা কারা? এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হচ্ছে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে নতুন করে বিশ্বে জোরদার শান্তি আন্দোলন গড়ে তোলা। তা না হলে পরমাণু শক্তিধর দুটি দেশের নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বড় যুদ্ধের বিপদ ডেকে আনবে! আবার আমরা ফিরে যাব সেই স্নায়ুযুদ্ধের যুগে!
ইউক্রেনকে ঘিরে দুই পরাশক্তির যে যুদ্ধ, তা সহসাই মিটবে বলে মনে হচ্ছে না। আমেরিকা আর রাশিয়া, দুটো দেশেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২৪ সালে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, তার আগে হয়তো এই প্রাণক্ষয়ী, অর্থক্ষয়ী সংঘাত শেষ হবে না। মানবজাতির জন্য যা চরম দুঃসংবাদ!
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
চারদিকে হইহল্লা, ছোটাছুটি। বেশ আনন্দমুখর একটি পরিবেশ। দুই ঘরের মধ্যে ফাঁদ। অব্যর্থ চেষ্টা ওকে ফাঁদে আটকাতেই হবে, না হয় লজ্জার অন্ত থাকবে না। ঘরে নতুন অতিথি। সকাল বেলা কে যেন একটু আগ বাড়িয়ে আজ খোপ ছেড়েছে। তাই তো মা-বোনের ভ্রুকুটিতে চিন্তার ভাঁজ। বেলা গড়িয়ে সূর্য প্রায় মধ্যগগনে। সবাই ব্যস্ত মোরগটাকে ধরতে। আবহমান বাংলার এটি একটি চিরায়ত কর্ম। যা দুই-আড়াই দশক আগেও দেখা যেত। মাছে-ভাতে বাঙালির আতিথেয়তায় থালায় একটু মুরগির মাংস এটি ছিল যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক একটি ব্যাপার। পরিস্থিতি এখন অনেক পাল্টে গেছে। দেশ উন্নয়নের সঙ্গে প্রাণিজ প্রোটিনের এই উৎসও পরিবর্তিত হয়েছে। দেশি মুরগির স্বাদ মানুষ ভুলেই গেছে। এর স্থলে জায়গা করে নিয়েছে ব্রয়লার মাংস যা খুবই সহজলভ্য।
আমাদের দেশে বাণিজ্যিকভাবে পোলট্রি খামার চালু হয় আশির দশক থেকে। ক্রমান্বয়ে এটি একটি কৃষির উপখাতে পরিণত হয়েছে এবং জিডিপিতে অবদান রাখছে ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আমাদের দেশে ছোট, বড়, মাঝারি মিলিয়ে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ হাজার পোলট্রি ফার্ম রয়েছে। করোনার আগে সংখ্যাটি ছিল ১ লাখ ১০ হাজারের ওপর। দেশে প্রতিদিন চার কোটির বেশি ডিম উৎপাদিত হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়েছে। ১০ বছরের মধ্যে এই উৎপাদন তিনগুণের বেশি বেড়েছে। আর বণিজ্যিক ভিত্তিতে দৈনিক মুরগির মাংস উৎপাদিত হয় ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। তা এখন দেশের মানুষের প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
পুষ্টিবিদরা বলছেন , মানবদেহের জন্য দৈনিক ২ হাজার ৪০০ ক্যালরি আবশ্যক। এটা কিন্তু একেবারেই ন্যূনতম হিসাব। দেখা যায়, গ্রামীণ গরিব খেটে খাওয়া লোকজন জীবনধারণে প্রয়োজনীয় ক্যালরির শতকরা ৫৪ ভাগ পূরণ করে ভাতের মতো শর্করাজাতীয় খাবার খেয়ে। আর শাকসবজির অবদান ৩৩ ভাগ। মাছ প্রায় শতকরা ৬ দশমিক ৬ ভাগ। মাংস থেকে আসে মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ। মোট কথা, ক্যালরির চাহিদা পূরণে গ্রামীণ খানাগুলো ভাত বা রুটির ওপরই অধিক নির্ভরশীল এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ মাংস পরিভোগ করে থাকে নামমাত্র। অথচ প্রোটিন ছাড়া মানুষের শরীর স্বাভাবিক নিয়মে কাজ করতে পারে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মানবদেহের শক্তির ১০-১৫ শতাংশ আসা উচিত আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে। সংস্থার মতে, আমাদের গড় আয়ু ৭৪ বছর ৩ মাস। অথচ একজন রিকশাচালকের গড় আয়ু মাত্র ৪৫ বছর। রিকশাচালকের আয়ুর এ করুণ অবস্থা কিন্তু প্রোটিনের অভাবেই। প্রোটিনের অভাব হলে মানুষ অকালেই বার্ধক্যে আক্রান্ত হয়।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এখনো প্রোটিন ঘাটতি অনেক। শুধু চালের উৎপাদন বাড়িয়ে একটি সুস্থ-সবল জাতি গঠন করা সম্ভব নয়। তাই প্রাণিজ প্রোটিনের সহজ উৎস পোলট্রি খাতে মনোযোগ দিতে হবে। ইতিমধ্যে ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদনে একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে এই শিল্প। প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে থাকা ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান ও আগামীর আপামর মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে এ শিল্প অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। অথচ কৃষিভিত্তিক এ খাতটি নানামুখী অবহেলার শিকার। এমনিতেই অতিমারী করোনার রেশ কাটতে না কাটতেই পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চোট সামলাতেই দিশেহারা এই খাত সংশ্লিষ্টরা। এর ওপর আবার সাম্প্রতিক সময়ে ডলার ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা এই খাতের চলমান সংকটকে আরও গভীরতর করছে। সয়াবিন ও ভুট্টা দিয়ে মুরগির খাবারের ৭০-৭৫ শতাংশ উপাদান তৈরি হয়। আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব পণ্যের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য বলছে, পোলট্রিজাত পণ্য, মাছ ও গবাদিপশু উৎপাদনে ব্যবহৃত ১৬ ধরনের কাঁচামালের দাম করোনা মহামারী শুরু অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চ থেকে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত গড়ে ৬৩ শতাংশের মতো বেড়েছে। আট ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ বা এরও বেশি হারে। এই কাঁচামালের দরের ঊর্ধ্বগতি এখনো অব্যাহত আছে। এর পর জ্বালানি তেলের দাম ও দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ের কারণে পোলট্রি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আর খামারিদের বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। বাড়তি এই খরচের অনুপাতে লাভ হচ্ছে কি না, সেই অঙ্ক এখন আর সরল নেই। খামারিরা যখন এই জটিল অঙ্ক মেলাতে ব্যস্ত, তখন মূল্যস্ফীতির চাপে মাংস কেনায় লাগাম টানতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা। ফলে মুরগি সঠিক সময়ে বিক্রি নিয়েও দেখা দেয় একপ্রকার অনিশ্চয়তা। তবে এ শিল্পে সবচেয়ে ধোঁয়াশার জায়গা হলো বাচ্চা মুরগির দামের অস্থিতিশীলতা। কখনো কখনো এর দাম আকাশছোঁয়া। সরকারের পক্ষ থেকে এর একটি নির্দিষ্ট দর বেঁধে দেওয়া হলেও তা মানছে না কেউই। ২৫ থেকে ৩০ টাকার উৎপাদন খরচের একটি বাচ্চা ৪০ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে হরহামেশাই। আবার দেখা যায়, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ৭০ থেকে ৮০ টাকাও বিক্রি হয়। এই অধিক মুনাফা লাভের প্রবণতাও এই শিল্পে সংকটের অন্যতম বড় এক কারণ। তাই তো হতাশায় জর্জরিত প্রান্তিক খামারিরা নিরুপায় হয়ে পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) তথ্যানুসারে, গত বছরের মে মাসে দেশে গড়ে সাপ্তাহিক ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার চাহিদা ছিল ১ কোটি ৮৭ লাখ। আগস্ট মাসে প্রথমার্ধে যা কমে দাঁড়িয়েছে সপ্তাহে ১ কোটি ৩২ লাখে। অর্থাৎ দেশে প্রতি সপ্তাহে তখন ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার চাহিদা কমেছে ৫৫ লাখ। ফলে পোলট্রি খাবারের চাহিদাও কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট, মাঝারি অনেক দেশীয় ফিডমিল। এতে সামগ্রিকভাবে চাপে পড়ছে পোলট্রি শিল্প। তবে এর মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে হাঁসের মাংস। এটির উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে হাঁসের উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৭৩ লাখ। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ। বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকায়। এখানে এক উদ্যোক্তাশ্রেণি তৈরি হচ্ছে। যা কর্মসংস্থান তৈরিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে। দেশের মোট মাংস উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশই আসে পোলট্রি খাত থেকে। কিন্তু তা এখন ক্রমান্বয়ে নানামুখী সংকটে সংকুচিত হচ্ছে। এই সমস্যার উৎসমূলে অনুসন্ধানী নজর দিলে দেখা যায় এখানে যেমন খাবার ও মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কিছু বড় প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট বাণিজ্য কাজ করছে, ঠিক তেমনি খামারিদের খামার ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানসম্মত সঠিক জানা-শোনার অভাবের বিষয়টিও সুস্পষ্ট।
এই খাতে সরকারি তদারকির অভাব যথেষ্ট লক্ষণীয়। না হয় খাবার তৈরির অন্যতম কাঁচামাল সয়ামিলের দেশে যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এ খাতে ব্যবহৃত পণ্যগুলো আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা যায় কি না, সেটি ভেবে দেখতে হবে। চলমান সংকট নিরসনে দ্রুত পোলট্রি বোর্ড গঠন করে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে, খামারিদের সহজ শর্তে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থাসহ বীমার আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় এ বিকাশমান বিশাল শিল্পটি মুখ থুবড়ে পড়বে। বেকার হয়ে যাবে হাজার হাজার তরুণ উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্টরা। ফলে কালক্রমে পুষ্টি বা প্রোটিনজনিত ঘাটতির কারণে আপামর জনসাধারণের স্বাস্থ্যহানি ও মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। যা জাতীয় জীবনে একটি বড় সংকট হিসেবে উদয় হবে।
লেখক : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
তৌহীদ রেজা নূর। শহীদ সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান। প্রজন্ম ’৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এই আলোকিত মানুষ পিএইচডি ডিগ্রি নেন ভারতের জওয়াহেরলাল ইউনিভার্সিটিতে। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা বিষয়ে গবেষণা করতে চলে যান স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কে। হঠাৎই দেশে আসা। চলে যাবেন আবার। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রজন্ম’৭১ নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সহকারী সম্পাদক- তাপস রায়হান ।
দেশ রূপান্তর : ১৯৫২ ও ১৯৭১। বাঙালির এই দুই অর্জনকে কীভাবে দেখেন?
তৌহীদ রেজা নূর : বায়ান্ন হচ্ছে- চেতনার লড়াই। অস্তিত্বের লড়াই। নিজের ভাষাকে, প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই। আর ১৯৭১ হচ্ছে অধিকারের লড়াই। স্বাধিকারের লড়াই। সার্বভৌমত্বের লড়াই। একটি জাতির পূর্ণ বিকাশ, স্বাধীনতায়। আমরা সেটা অনেক রক্ত দিয়ে অর্জন করেছি। এর জন্য অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে। এর সব কিন্তু চেতনা থেকেই জন্ম নেওয়া। যার ভিত্তি তৈরি করেছিল ১৯৫২। এই যুদ্ধ কিন্তু শেষ হয়নি। আজও চলছে। চলবে ততদিন, যতদিন সেই আদর্শের পূর্ণ বাস্তবায়ন না হবে।
দেশ রূপান্তর : আপনি তো ‘জেনোসাইড’ নিয়ে গবেষণা করছেন। সেখানে, ভাষা আন্দোলনকে কীভাবে যুক্ত করা হবে?
তৌহীদ রেজা নূর : আমরা যখন, জোনোসাইড বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছি- তখন এর প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে ভাষা আন্দোলনও বাদ যাবে না। দুটো তো একই সূত্রে গাঁথা। একাত্তর তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপট নির্মাণে, ভাষা আন্দোলনের বিশাল অবদান। কোনোভাবেই তাকে বাদ রাখা যাবে না।
দেশ রূপান্তর : ভাষাশহীদদের সন্তানও তো, সরকারি সুবিধা পাওয়ার দাবি রাখেন?
তৌহীদ রেজা নূর : অবশ্যই।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু বাস্তবতা কি অন্য কথা বলে?
তৌহীদ রেজা নূর : ঠিক, তা না। অর্জন করার আরও অনেক কিছু আছে। সেগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : আপনি তো, প্রজন্ম ’৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। সেই নব্বই দশকের শুরুতে, এই সংগঠন তৈরির কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল?
তৌহীদ রেজা নূর : অবশ্যই ছিল। একটিবার ভাবুন, তখন বাংলাদেশের অবস্থা কেমন ছিল? কেন আমরা বাধ্য হয়েছিলাম, এই সংগঠন দাঁড় করাতে?
দেশ রূপান্তর : এর মানে, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে ঘাতক-দালাল নির্মূল আন্দোলন শুরু হয়েছিল, আপনাদের সংগঠন এরও আগে তৈরি করেছিলেন?
তৌহীদ রেজা নূর : ১৯৯১ সালের অক্টোবরে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। এর ২ মাস পরে, গোলাম আযমকে যখন জামায়াতে ইসলামী, ‘আমির’ বলে ঘোষণা দেয়। তার বিরুদ্ধেই গর্জে ওঠে সবাই। তখনই এগিয়ে আসেন জাহানারা ইমাম। গড়ে তোলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
দেশ রূপান্তর : বর্তমানে কি আমরা, ভাষা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে?
তৌহীদ রেজা নূর: না। ঠিক তা নয়। শুধু সরকারের ওপর, নির্ভর করলে চলবে না। দায়, আমাদেরও আছে। যদিও সময়, অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়। যেভাবে দিয়েছে, গণজাগরণ মঞ্চ।
দেশ রূপান্তর : সমাজে কি গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করার কোনো বাস্তব ভিত্তি তৈরি হয়েছিল?
তৌহীদ রেজা নূর : এছাড়া তো কোনো পথ ছিল না। ওটা তৈরি হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়ার দাবিতে। আইনে একটা ফাঁক ছিল। সেই আন্দোলনের কারণেই, আইনের সংশোধন করা হয়। এরপর ফাঁসি দেওয়া হয় তাকে।
দেশ রূপান্তর : আপনার কী মনে হয়, বর্তমানে একাত্তরের শহীদ সন্তানদের আন্দোলন করা জরুরি?
তৌহীদ রেজা নূর : প্রজন্ম ’৭১ তো এখনো আছে। অবশ্যই আন্দোলন করা জরুরি। এটা থাকবেও।
দেশ রূপান্তর : শহীদ সন্তানদের মধ্যেও তো বিভক্তি? বিভিন্ন নামে তাদের সংগঠন। এই বিভক্তি কেন?
তৌহীদ রেজা নূর : দেখেন, এই বিভক্তিটা অনিবার্য। এখানে চেতনাগত, ভাবনাগত, উপলব্ধিগত একটা বিষয় আছে। এটা থাকতে হবে। আপনি যদি মনে করেন, ‘জয় বাংলা’ আওয়ামী লীগের স্লোগান তাহলে তো হবে না। আপনি যদি এটাকে মুক্তিযুদ্ধের ‘রণধ্বনি’ হিসেবে স্বীকার না করেন, তাহলে বিভক্তি আসবেই। আপনার ওরিয়েন্টশন যদি হয় জাসদ ভাবনা, শিবির ভাবনা তাহলে তো হবে না। এরপর আর একসঙ্গে থাকা যায়? তাহলে তো আপনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে নেই। যখন স্বাধীনতার ২০ বছর পর, আমাদের যখন যাত্রা শুরু হয়- তখন ছিল আদর্শ থেকে বিচ্যুতির সময়।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু এই চেতনা তো পাই, ভাষা আন্দোলন থেকে। মূলত কি তখনই এর শুরু হলো না?
তৌহীদ রেজা নূর : তাতো অবশ্যই। নিশ্চয়ই।
দেশ রূপান্তর : আপনি তো বর্তমানে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে ‘জেনোসাইড’ নিয়ে গবেষণা করছেন। এ ব্যাপারে একটু বিস্তারিত বলবেন?
তৌহীদ রেজা নূর : বিষয়টা হলো, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছিল বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করছি। এই জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে আমি কাজ করছি। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ‘জেনোসাইড’ এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। অনেক ক্ষেত্রেই, এটি থাকে অনুচ্চারিত।
দেশ রূপান্তর : শহীদ সন্তান বা পরিবার কি সরকার থেকে কোনো ধরনের, বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে? যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানরা পাচ্ছেন?
তৌহীদ রেজা নূর : আমার জানা নেই। আসলে ‘ভাতা’র বিষয়টি আমি যেভাবে দেখি, সেটা হচ্ছে আজ অর্ধশতাব্দী পার হওয়ার পর, সেই সময় যে মানুষটি হত্যার শিকার হয়েছিলেন, সেই মানুষটিই কিন্তু পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। প্রত্যেকেই কিন্তু আমরাসহ এক ধরনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এতদূর এসেছি।
দেশ রূপান্তর : এর মানে ভাষা আন্দোলনে যে চেতনা কাজ করেছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধে যে চেতনা কাজ করেছিল- বাস্তবতা সেখান থেকে অনেক দূরে- তাই তো?
তৌহীদ রেজা নূর : না। ঠিক তা না। বাস্তবতা অনেক দূরে, সেটা আমি বলব না। আমাদের অর্জন করার জন্য, আরও অনেক কাজ করার আছে। এই বিষয়টি লালন করার জন্য আরও অনেক কিছু করার আছে। এটা শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব না। একজন নাগরিকের দায়িত্বও কম না। এটা একটি পরিবারের দায়িত্ব। শিক্ষাঙ্গনের দায়িত্ব। দায়িত্ব সবার আছে। শুধু রাষ্ট্রের ওপর সব দায় চাপালে ঠিক হবে না। এখানে গণমাধ্যমের দায়িত্বও রয়েছে। রাষ্ট্র অনেকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই যে, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বিষয়টি। এটা অত্যন্ত জটিল এবং এখানে মূল ভূমিকা কে পালন করেছে? শুধু বাংলাদেশ না। সারা বিশে^ই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার বিষয়টি, বেশ জটিল এবং স্পর্শকাতর বিষয়। এটা কিন্তু বাংলাদেশ করতে পেরেছে। এই যে, বীরাঙ্গনাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় দেওয়া- এটাও তো কম বড় বিষয় নয়? কিছু কিছু দুর্বলতা থাকলেও, অনেক বড় বড় কাজ কিন্তু করেছে। আমাদের বড় দুর্বলতার জায়গা হলো- যে চর্চাটা, যে শেকড় থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের চেতনাবোধে সেভাবে লালন করা দরকার। এই চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। এই দায়িত্ব কিন্তু সবার। যদিও আমাদের মধ্যে, দিবসকেন্দ্রিক ভাবনাটা বেশি। এটা গণমাধ্যমে বেশি দেখা যায়। গণমাধ্যমের অনেক সাংবাদিকের মধ্যেও এই চেতনার ঘাটতি আছে। যেমন ধরেন- যে সাংবাদিক ‘বুদ্ধিজীবী দিবস’ কভার করতে এসেছেন- তিনি যথেষ্ট গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করে আসেননি। দেখা যায়, একজন শহীদের নামও সে ভুল উচ্চারণ করেছে। আমি জানি না, এটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় । তবে বছরব্যাপী মানুষের মধ্যে একটা রুচি, বোধ এবং মনন তৈরির দায়িত্ব নিতে পারে গণমাধ্যম। অনেক আলোচনা হতে পারে। গবেষণা হতে পারে।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু তা থেকে তো পরিত্রাণ পেতে হবে?
তৌহীদ রেজা নূর : আমি তা বলতে পারব না। এ থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়।
দেশ রূপান্তর : আবার ‘ভাষা’র বিষয়ে ফিরে আসি। এটা তো একটা চেতনা।
তৌহীদ রেজা নূর : হ্যাঁ, চেতনার একটি অংশ।
দেশ রূপান্তর : এই চেতনার পূর্ণ বাস্তবায়ন কি হচ্ছে?
তৌহীদ রেজা নূর : না, পারছি না। বাস্তবায়ন করতে হলে তো, আগে বুঝতে হবে? চেতনার জায়গায় বড় রকমের ঘাটতি আছে। আগে মাতৃভাষাকে আত্মস্থ করতে হবে? নিজের মধ্যে নিতে হবে? নিজেকে তো উন্নত করতে হবে, নাকি? আমাদের বইপত্র, কোর্টকাচারি- সব জায়গায় তো বাংলার প্রাধান্য থাকতে হবে?
সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড়শোর ওপর। এগুলোর বেশিরভাগেই প্রতি বছর বা এক বছর পরপর সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সমাবর্তনে অংশ নিতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে ‘নিবন্ধন ফি’ নামে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের ব্যবসা চালু রয়েছে। স্নাতক, স্নাতকোত্তর শেষ করে একজন শিক্ষার্থী যখন চাকরির আবেদনে ব্যস্ত ঠিক তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আনুষ্ঠানিক সনদ দেওয়ার নাম করে হাজার হাজার টাকা গ্র্যাজুয়েটদের কাছ থেকে আদায়ের ‘প্রথা’ চালু করে রেখেছে। নিবন্ধন ফি জোগাড় করতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সেরা স্বাদ নেওয়া থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আদায় করা টাকার অর্ধেকও খরচ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশ রূপান্তরে ‘উচ্ছ্বাসের আড়ালে অসন্তোষ’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শনিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সমাবর্তন। সমাবর্তন উপলক্ষে ডিগ্রিপ্রাপ্তদের হাস্যোজ্জ্বল পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে গোটা ক্যাম্পাস। তবে শিক্ষার্থীদের এই উচ্ছ্বাসের মধ্যেই সমাবর্তনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রয়েছে অসন্তোষ। নিবন্ধন করতে জটিলতা থেকে শুরু করে খাবারের মেন্যু ও সমাবর্তনের লোগো নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এবারের সমাবর্তনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর একসঙ্গে ৪ হাজার টাকা ফি ধরা হয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে পৃথকভাবে ২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে নিবন্ধন করা গেছে। আর এমফিল ডিগ্রির শিক্ষার্থীরা ৬ হাজার, পিএইচডি ৭ হাজার এবং সাপ্তাহিক কোর্সের সনদধারীরা ৮ হাজার টাকা দিয়ে নিবন্ধন করেছেন। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সবশেষ সমাবর্তনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য নিবন্ধন ফি ছিল পৃথকভাবে ১ হাজার ৫০০ টাকা। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর একত্রে ছিল ২ হাজার ৫০০, এমফিল ডিগ্রি ২ হাজার ৫০০ এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের নিবন্ধন ফি ছিল ৩ হাজার টাকা। এবারের নিবন্ধন ফি অতিরিক্ত জানিয়ে তা কমানোর দাবিতে মানববন্ধন ও উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাপ্তাহিক কোর্সের শিক্ষার্থীদের সমাবর্তন না দেওয়ার দাবিও ছিল তাদের। তবে সেসব দাবি মানেনি প্রশাসন।
অংশগ্রহণকারীদের খাবার হিসেবে দেওয়া হবে ছোট একটি বান পিৎজা, এক সøাইস কেক, সন্দেশ, চিকেন ফ্রাই, আপেল এবং পানি। ৩১১ টাকা মূল্যের এ খাবারের জন্য প্যাকেটের পেছনেই ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫ টাকা। যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থীরা। ১৮ হাজার জনের এ খাবারে মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে প্রায় ৫৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিনা পারিশ্রমিকে লোগো তৈরির বিনিময়ে চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. মহসিনকে সমাবর্তনের প্যান্ডেলের আওতায় ডিজাইনের জন্য ১১ লাখ টাকার কাজ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ লোগোর মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। এবারের সমাবর্তনে ১৫ হাজার ২২৩ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী ১১ হাজার ৪৪৬, উইকেন্ড প্রোগ্রামের ৩ হাজার ৪৬২, এমফিল ডিগ্রির ৩৪ ও পিএইচডি সম্পন্নকারী ২৮১ জন। সমাবর্তনে ১২ কোটি টাকা বাজেট ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অর্থায়ন করবে ১ কোটি টাকা।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নামমাত্র ফি দিয়ে পড়ালেখা করছে। চার বছরের স্নাতক কোর্সে একজন শিক্ষার্থীর যে টাকা টিউশন ফি দিতে হয়, দেখা যায় এর চেয়ে বেশি তাকে সমাবর্তন ফি দিতে হচ্ছে। রাষ্ট্র যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নামমাত্র ফি নিয়ে বছরে লাখ টাকার বেশি ব্যয় করতে পারে, তাহলে সমাবর্তনের আয়োজনও রাষ্ট্রেরই করা উচিত। তাহলে সমাবর্তনের নামে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। উন্নত দেশগুলোতে সমাবর্তনে অংশ নিতে শিক্ষার্থীদের কোনো ফি দিতে হয় না। এমনকি সনদ নেওয়ার জন্যও তাদের শিক্ষার্থীদের পয়সা খরচ করা লাগে না। বরং এই সব সমাবর্তনে অংশ নিতে গ্র্যাজুয়েটদের বাবা-মাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপিয়ে দেওয়া এই নিবন্ধন ফি জোগাড় করতে না পারায় বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে সনদ হাতে ফ্রেমবন্দি হওয়া থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থীর জীবনে সবচেয়ে আনন্দময় দিন হলো এই সমাবর্তন। সবাইকেই আনুষ্ঠানিক সনদ দেওয়ার রীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য। উচিত হবে, গ্র্যাজুয়েটদের এই সব সনদ দেওয়ার অনুষ্ঠানকে বাণিজ্যিকীকরণ না করা ও লুটপাটের আয়োজন থেকে বিরত থাকা। আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক আয়ের বাড়তি খাত হিসেবে না দেখে সমাবর্তনকে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের শেষ অনুষ্ঠানটি আনন্দময় করার সুযোগ দেবে।
ভারতীয় বাঙালি লেখিকা লীলা মজুমদারের জন্ম কলকাতার রায় পরিবারে ১৯০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তার বাবার নাম প্রমদারঞ্জন রায় ও মা সুরমাদেবী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি পরীক্ষায় তিনি সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি বিয়ে করেন দন্ত চিকিৎসক ডা. সুধীরকুমার মজুমদারকে। এ বিয়েতে তার বাবার প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি তার স্বনির্বাচিত পাত্রকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। বিবাহিত জীবনে তারা সুখী দম্পতি ছিলেন। স্বামী আজীবন তার সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী ছিলেন। তার প্রথম গল্প ‘লক্ষ্মীছাড়া’ ১৯২২ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় সন্দেশ পত্রিকা পুনর্জীবিত করলে তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সাম্মানিক সহ-সম্পাদক হিসেবে পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘হলদে পাখির পালক’, ‘টং লিং’, ‘পদি পিসির বর্মী বাক্স’ ও ‘সব ভুতুড়ে’। তিনি অনেক শিক্ষামূলক রচনা ও রম্যরচনা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন। তার আত্মজীবনীতে শিলংয়ের ছেলেবেলা, শান্তিনিকেতন ও অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গে তার কাজকর্ম, রায়চৌধুরী পরিবারের মজার ঘটনাবলি ও বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘ পরিভ্রমণের কথা বর্ণিত হয়েছে। রবীন্দ্র পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, ভুবনেশ্বরী পদক, দেশিকোত্তমসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছেন। ২০০৭ সালের ৫ এপ্রিল তিনি মৃতুবরণ করেন।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় ব্যবসায়ীদের। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেনাপোল, হিলি ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে গত সোমবার থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। ট্রান্সপোর্ট খরচ, ট্যাক্স পরিশোধ ও লেবার খরচসহ আমদানিকরদের হাতে ভারতীয় পেঁয়াজের মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৭ টাকা। যা ভারতের বাজারে ১৪-১৫ রুপি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে এখানেও মধ্যস্বত্বভোগীর কারসাজি রয়েছে। দেশি পেঁয়াজের মতো কয়েক হাত ঘুরে অস্বাভাবিক দামে ২৭ টাকার পেঁয়াজ পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৫৬-৬০ টাকায়। তবে আমদানি করা পেঁয়াজ এখনো খুচরা বাজারে পৌঁছায়নি।
গতকাল মঙ্গলবার কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সোমবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। প্রথম দিনে ২ লাখ ৮০ হাজার ৮০০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। গতকাল দ্বিতীয় দিন শেষে আইপি বা আমদানি অনুমোদনের পরিমাণ ৪ লাখ ৩৩ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে।
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন। চলতি বছর পেঁয়াজের নিট উৎপাদন ধরা হচ্ছে ২৪ লাখ ৫৩ হাজার টন। ফলে বাকি পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৬৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল। গতকাল কৃষি মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এদিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থলবন্দর হয়ে ১ হাজার ২৮৮ টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে।
চলতি বছর পেঁয়াজের দর রোজার ঈদের পর থেকেই বাড়তে শুরু করেছিল। এক মাসের ব্যবধানে তা ৩০ থেকে ৮০ টাকায় উঠে যায়। গত কয়েক দিন ধরে ১০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছিল।
কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে এতদিন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি কৃষি মন্ত্রণালয় না দিলেও পরিস্থিতি দেখে রবিবার সায় দেয়। পরদিনই পাইকারি বাজারে এর প্রভাব দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় পেঁয়াজ আসা শুরু হলে পাইকারিতে দাম কমে যায় এক ধাক্কায় ৩০ টাকা। প্রতি কেজি পেঁয়াজের খুচরা মূল্য এখন ৪৫ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় বলে সরকার মনে করে। আর প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে যে পেঁয়াজ দেশে এসেছে, সেগুলো কেনা প্রতি কেজি ২১ থেকে ২২ টাকার মধ্যে ছিল বলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সব খরচ মিলিয়ে বন্দর পর্যন্ত প্রতি কেজি পেঁয়াজের ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ২৭ টাকায়। আমদানিকারকরা কেজিপ্রতি ২ টাকা লাভে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ২৯ টাকায় বিক্রি করছেন। স্থানীয়রা আরও ৫ টাকা লাভে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ঢাকার পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন ৩৪ টাকায়। ঢাকার পাইকাররা শ্যামবাজারে সেই পেঁয়াজ বিক্রি করেন ৫০-৫৬ টাকায়। শ্যামবাজার ব্যবসায়ীর হাতবদল হয়ে কারওয়ান বাজার পাইকারি মার্কেটে এসে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা করে।
ভোমরা স্থলবন্দরের আমদানিকারক আমির হামজা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভারতীয় বাজার থেকে ১৪-১৫ রুপিতে কিনে সব খরচসহ বন্দর পর্যন্ত প্রতি কেজি পেঁয়াজের মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৭ টাকা। কেজিতে ২ টাকা লাভে ভোমরা স্থলবন্দরের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ২৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
হিলির বন্দর এলাকার আরেক ব্যবসায়ী আহমেদ আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মূলত আমদানিকারকদের থেকে আমরা পেঁয়াজ কিনে থাকি। আমাদের কাছ থেকে ঢাকার ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ সংগ্রহ করেন। কেজিপ্রতি ৩১-৩২ টাকা আমাদের কেনা পড়ে। ঘরভাড়া, লেবার খরচসহ প্রতি কেজি পেঁয়াজে সামান্য লাভ করে ৩৪-৩৫ টাকা বিক্রি করতে হয়। এর নিচে বিক্রি করলে আমাদের ৭০-৮০ পয়সার মতো লোকসান হয়।’
গতকাল রাজধানীর শ্যামবাজার ঘুরে দেখা যায়, ভারত থেকে আসা পেঁয়াজ বাছাই করে দুই ভাগে বিক্রি করছেন শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরা। আকারে কিছুটা ছোট পেঁয়াজের কেজি ৪০-৪৫ ও ভালো মানের পেঁঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৬ টাকায়।
শ্যামবাজারের মেসার্স নিউ সেবা এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার শেখর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আজই (গতকাল) আমদানি করা পেঁয়াজের চালান শ্যামবাজারে এসেছে। হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী ভারতীয় পেঁয়াজ পেলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ী আমদানি করা এসব পেঁয়াজ পাননি। বেশ কিছু পেঁয়াজ ট্রাকে পচে যাওয়ায় দুই ভাগে তা বিক্রি হয়েছে। তুলনামূলক ভালো প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪০-৪৫ ও ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৬ টাকা করে।’
জানতে চাইলে শ্যামবাজার পেঁয়াজ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মোহাম্মদ মাজেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে ভারতের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৩-১৫ রুপিতে। সেই হিসাবে সব খরচ মিলিয়ে আমাদের দেশের পাইকারি বাজারগুলোতে ৩৫-৩৬ টাকায় ভোক্তারা কিনতে পারবেন। তবে এ পেঁয়াজ কেন ৫০ টাকার ওপর বিক্রি হচ্ছে সে বিষয়ে আমার জানা নেই।’
এদিকে ভারত থেকে আসা প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬০ টাকা করে বিক্রি করতে দেখা গেছে কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের। পেঁয়াজ ব্যবসায়ী ময়না মিঞা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভারতীয় পেঁয়াজ দেশের বাজারে আসায় আমাদের অনেক লস হয়েছে। আগের কেনা দেশি পেঁয়াজের কেজিপ্রতি ২০-২৫ টাকা করে লস দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে আমদানি করা যেসব পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে, তা শ্যামবাজার থেকে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। মার্কেটে ক্রেতা না থাকায় সব খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজিতে ২ টাকা লাভ করতেও এখন কষ্ট হচ্ছে।’
এদিকে খুচরা বাজারগুলোতে খবর নিয়ে জানা যায়, এখনো ভারত থেকে আসা আমদানি করা পেঁয়াজ খুচরা বাজারে প্রবেশ করেনি। আমদানি করা পেঁয়াজ খুচরা বাজারে না এলেও দেশি পেঁয়াজের দামে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা দরে। যা গত তিন দিন আগেও বিক্রি হয়েছে ১০০-১০৫ টাকায়।
এদিকে ভারতীয় পেঁয়াজ আসায় স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম কমেছে বলে জানান দিনাজপুর ও সাতক্ষীরা প্রতিনিধি। তাদের তথ্যমতে, সোমবার বিকেলে ভোমরা বন্দর দিয়ে ২৮৭ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও ৫০ ট্রাক পেঁয়াজ দেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে।
অন্যদিকে হাকিমপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের হিলি বন্দর দিয়ে গত দুদিনে ১৬ ট্রাক পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা দরে। আর দেশি পেঁয়াজ ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।