
সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড়শোর ওপর। এগুলোর বেশিরভাগেই প্রতি বছর বা এক বছর পরপর সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সমাবর্তনে অংশ নিতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে ‘নিবন্ধন ফি’ নামে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের ব্যবসা চালু রয়েছে। স্নাতক, স্নাতকোত্তর শেষ করে একজন শিক্ষার্থী যখন চাকরির আবেদনে ব্যস্ত ঠিক তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আনুষ্ঠানিক সনদ দেওয়ার নাম করে হাজার হাজার টাকা গ্র্যাজুয়েটদের কাছ থেকে আদায়ের ‘প্রথা’ চালু করে রেখেছে। নিবন্ধন ফি জোগাড় করতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সেরা স্বাদ নেওয়া থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আদায় করা টাকার অর্ধেকও খরচ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশ রূপান্তরে ‘উচ্ছ্বাসের আড়ালে অসন্তোষ’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শনিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সমাবর্তন। সমাবর্তন উপলক্ষে ডিগ্রিপ্রাপ্তদের হাস্যোজ্জ্বল পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে গোটা ক্যাম্পাস। তবে শিক্ষার্থীদের এই উচ্ছ্বাসের মধ্যেই সমাবর্তনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রয়েছে অসন্তোষ। নিবন্ধন করতে জটিলতা থেকে শুরু করে খাবারের মেন্যু ও সমাবর্তনের লোগো নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এবারের সমাবর্তনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর একসঙ্গে ৪ হাজার টাকা ফি ধরা হয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে পৃথকভাবে ২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে নিবন্ধন করা গেছে। আর এমফিল ডিগ্রির শিক্ষার্থীরা ৬ হাজার, পিএইচডি ৭ হাজার এবং সাপ্তাহিক কোর্সের সনদধারীরা ৮ হাজার টাকা দিয়ে নিবন্ধন করেছেন। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সবশেষ সমাবর্তনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য নিবন্ধন ফি ছিল পৃথকভাবে ১ হাজার ৫০০ টাকা। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর একত্রে ছিল ২ হাজার ৫০০, এমফিল ডিগ্রি ২ হাজার ৫০০ এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের নিবন্ধন ফি ছিল ৩ হাজার টাকা। এবারের নিবন্ধন ফি অতিরিক্ত জানিয়ে তা কমানোর দাবিতে মানববন্ধন ও উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাপ্তাহিক কোর্সের শিক্ষার্থীদের সমাবর্তন না দেওয়ার দাবিও ছিল তাদের। তবে সেসব দাবি মানেনি প্রশাসন।
অংশগ্রহণকারীদের খাবার হিসেবে দেওয়া হবে ছোট একটি বান পিৎজা, এক সøাইস কেক, সন্দেশ, চিকেন ফ্রাই, আপেল এবং পানি। ৩১১ টাকা মূল্যের এ খাবারের জন্য প্যাকেটের পেছনেই ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫ টাকা। যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থীরা। ১৮ হাজার জনের এ খাবারে মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে প্রায় ৫৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিনা পারিশ্রমিকে লোগো তৈরির বিনিময়ে চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. মহসিনকে সমাবর্তনের প্যান্ডেলের আওতায় ডিজাইনের জন্য ১১ লাখ টাকার কাজ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ লোগোর মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। এবারের সমাবর্তনে ১৫ হাজার ২২৩ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী ১১ হাজার ৪৪৬, উইকেন্ড প্রোগ্রামের ৩ হাজার ৪৬২, এমফিল ডিগ্রির ৩৪ ও পিএইচডি সম্পন্নকারী ২৮১ জন। সমাবর্তনে ১২ কোটি টাকা বাজেট ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অর্থায়ন করবে ১ কোটি টাকা।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নামমাত্র ফি দিয়ে পড়ালেখা করছে। চার বছরের স্নাতক কোর্সে একজন শিক্ষার্থীর যে টাকা টিউশন ফি দিতে হয়, দেখা যায় এর চেয়ে বেশি তাকে সমাবর্তন ফি দিতে হচ্ছে। রাষ্ট্র যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নামমাত্র ফি নিয়ে বছরে লাখ টাকার বেশি ব্যয় করতে পারে, তাহলে সমাবর্তনের আয়োজনও রাষ্ট্রেরই করা উচিত। তাহলে সমাবর্তনের নামে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। উন্নত দেশগুলোতে সমাবর্তনে অংশ নিতে শিক্ষার্থীদের কোনো ফি দিতে হয় না। এমনকি সনদ নেওয়ার জন্যও তাদের শিক্ষার্থীদের পয়সা খরচ করা লাগে না। বরং এই সব সমাবর্তনে অংশ নিতে গ্র্যাজুয়েটদের বাবা-মাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপিয়ে দেওয়া এই নিবন্ধন ফি জোগাড় করতে না পারায় বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে সনদ হাতে ফ্রেমবন্দি হওয়া থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থীর জীবনে সবচেয়ে আনন্দময় দিন হলো এই সমাবর্তন। সবাইকেই আনুষ্ঠানিক সনদ দেওয়ার রীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য। উচিত হবে, গ্র্যাজুয়েটদের এই সব সনদ দেওয়ার অনুষ্ঠানকে বাণিজ্যিকীকরণ না করা ও লুটপাটের আয়োজন থেকে বিরত থাকা। আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক আয়ের বাড়তি খাত হিসেবে না দেখে সমাবর্তনকে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের শেষ অনুষ্ঠানটি আনন্দময় করার সুযোগ দেবে।
চারদিকে হইহল্লা, ছোটাছুটি। বেশ আনন্দমুখর একটি পরিবেশ। দুই ঘরের মধ্যে ফাঁদ। অব্যর্থ চেষ্টা ওকে ফাঁদে আটকাতেই হবে, না হয় লজ্জার অন্ত থাকবে না। ঘরে নতুন অতিথি। সকাল বেলা কে যেন একটু আগ বাড়িয়ে আজ খোপ ছেড়েছে। তাই তো মা-বোনের ভ্রুকুটিতে চিন্তার ভাঁজ। বেলা গড়িয়ে সূর্য প্রায় মধ্যগগনে। সবাই ব্যস্ত মোরগটাকে ধরতে। আবহমান বাংলার এটি একটি চিরায়ত কর্ম। যা দুই-আড়াই দশক আগেও দেখা যেত। মাছে-ভাতে বাঙালির আতিথেয়তায় থালায় একটু মুরগির মাংস এটি ছিল যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক একটি ব্যাপার। পরিস্থিতি এখন অনেক পাল্টে গেছে। দেশ উন্নয়নের সঙ্গে প্রাণিজ প্রোটিনের এই উৎসও পরিবর্তিত হয়েছে। দেশি মুরগির স্বাদ মানুষ ভুলেই গেছে। এর স্থলে জায়গা করে নিয়েছে ব্রয়লার মাংস যা খুবই সহজলভ্য।
আমাদের দেশে বাণিজ্যিকভাবে পোলট্রি খামার চালু হয় আশির দশক থেকে। ক্রমান্বয়ে এটি একটি কৃষির উপখাতে পরিণত হয়েছে এবং জিডিপিতে অবদান রাখছে ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আমাদের দেশে ছোট, বড়, মাঝারি মিলিয়ে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ হাজার পোলট্রি ফার্ম রয়েছে। করোনার আগে সংখ্যাটি ছিল ১ লাখ ১০ হাজারের ওপর। দেশে প্রতিদিন চার কোটির বেশি ডিম উৎপাদিত হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়েছে। ১০ বছরের মধ্যে এই উৎপাদন তিনগুণের বেশি বেড়েছে। আর বণিজ্যিক ভিত্তিতে দৈনিক মুরগির মাংস উৎপাদিত হয় ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। তা এখন দেশের মানুষের প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
পুষ্টিবিদরা বলছেন , মানবদেহের জন্য দৈনিক ২ হাজার ৪০০ ক্যালরি আবশ্যক। এটা কিন্তু একেবারেই ন্যূনতম হিসাব। দেখা যায়, গ্রামীণ গরিব খেটে খাওয়া লোকজন জীবনধারণে প্রয়োজনীয় ক্যালরির শতকরা ৫৪ ভাগ পূরণ করে ভাতের মতো শর্করাজাতীয় খাবার খেয়ে। আর শাকসবজির অবদান ৩৩ ভাগ। মাছ প্রায় শতকরা ৬ দশমিক ৬ ভাগ। মাংস থেকে আসে মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ। মোট কথা, ক্যালরির চাহিদা পূরণে গ্রামীণ খানাগুলো ভাত বা রুটির ওপরই অধিক নির্ভরশীল এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ মাংস পরিভোগ করে থাকে নামমাত্র। অথচ প্রোটিন ছাড়া মানুষের শরীর স্বাভাবিক নিয়মে কাজ করতে পারে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মানবদেহের শক্তির ১০-১৫ শতাংশ আসা উচিত আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে। সংস্থার মতে, আমাদের গড় আয়ু ৭৪ বছর ৩ মাস। অথচ একজন রিকশাচালকের গড় আয়ু মাত্র ৪৫ বছর। রিকশাচালকের আয়ুর এ করুণ অবস্থা কিন্তু প্রোটিনের অভাবেই। প্রোটিনের অভাব হলে মানুষ অকালেই বার্ধক্যে আক্রান্ত হয়।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এখনো প্রোটিন ঘাটতি অনেক। শুধু চালের উৎপাদন বাড়িয়ে একটি সুস্থ-সবল জাতি গঠন করা সম্ভব নয়। তাই প্রাণিজ প্রোটিনের সহজ উৎস পোলট্রি খাতে মনোযোগ দিতে হবে। ইতিমধ্যে ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদনে একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে এই শিল্প। প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে থাকা ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান ও আগামীর আপামর মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে এ শিল্প অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। অথচ কৃষিভিত্তিক এ খাতটি নানামুখী অবহেলার শিকার। এমনিতেই অতিমারী করোনার রেশ কাটতে না কাটতেই পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চোট সামলাতেই দিশেহারা এই খাত সংশ্লিষ্টরা। এর ওপর আবার সাম্প্রতিক সময়ে ডলার ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা এই খাতের চলমান সংকটকে আরও গভীরতর করছে। সয়াবিন ও ভুট্টা দিয়ে মুরগির খাবারের ৭০-৭৫ শতাংশ উপাদান তৈরি হয়। আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব পণ্যের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য বলছে, পোলট্রিজাত পণ্য, মাছ ও গবাদিপশু উৎপাদনে ব্যবহৃত ১৬ ধরনের কাঁচামালের দাম করোনা মহামারী শুরু অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চ থেকে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত গড়ে ৬৩ শতাংশের মতো বেড়েছে। আট ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ বা এরও বেশি হারে। এই কাঁচামালের দরের ঊর্ধ্বগতি এখনো অব্যাহত আছে। এর পর জ্বালানি তেলের দাম ও দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ের কারণে পোলট্রি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আর খামারিদের বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। বাড়তি এই খরচের অনুপাতে লাভ হচ্ছে কি না, সেই অঙ্ক এখন আর সরল নেই। খামারিরা যখন এই জটিল অঙ্ক মেলাতে ব্যস্ত, তখন মূল্যস্ফীতির চাপে মাংস কেনায় লাগাম টানতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা। ফলে মুরগি সঠিক সময়ে বিক্রি নিয়েও দেখা দেয় একপ্রকার অনিশ্চয়তা। তবে এ শিল্পে সবচেয়ে ধোঁয়াশার জায়গা হলো বাচ্চা মুরগির দামের অস্থিতিশীলতা। কখনো কখনো এর দাম আকাশছোঁয়া। সরকারের পক্ষ থেকে এর একটি নির্দিষ্ট দর বেঁধে দেওয়া হলেও তা মানছে না কেউই। ২৫ থেকে ৩০ টাকার উৎপাদন খরচের একটি বাচ্চা ৪০ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে হরহামেশাই। আবার দেখা যায়, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ৭০ থেকে ৮০ টাকাও বিক্রি হয়। এই অধিক মুনাফা লাভের প্রবণতাও এই শিল্পে সংকটের অন্যতম বড় এক কারণ। তাই তো হতাশায় জর্জরিত প্রান্তিক খামারিরা নিরুপায় হয়ে পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) তথ্যানুসারে, গত বছরের মে মাসে দেশে গড়ে সাপ্তাহিক ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার চাহিদা ছিল ১ কোটি ৮৭ লাখ। আগস্ট মাসে প্রথমার্ধে যা কমে দাঁড়িয়েছে সপ্তাহে ১ কোটি ৩২ লাখে। অর্থাৎ দেশে প্রতি সপ্তাহে তখন ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার চাহিদা কমেছে ৫৫ লাখ। ফলে পোলট্রি খাবারের চাহিদাও কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট, মাঝারি অনেক দেশীয় ফিডমিল। এতে সামগ্রিকভাবে চাপে পড়ছে পোলট্রি শিল্প। তবে এর মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে হাঁসের মাংস। এটির উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে হাঁসের উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৭৩ লাখ। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ। বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকায়। এখানে এক উদ্যোক্তাশ্রেণি তৈরি হচ্ছে। যা কর্মসংস্থান তৈরিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে। দেশের মোট মাংস উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশই আসে পোলট্রি খাত থেকে। কিন্তু তা এখন ক্রমান্বয়ে নানামুখী সংকটে সংকুচিত হচ্ছে। এই সমস্যার উৎসমূলে অনুসন্ধানী নজর দিলে দেখা যায় এখানে যেমন খাবার ও মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কিছু বড় প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট বাণিজ্য কাজ করছে, ঠিক তেমনি খামারিদের খামার ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানসম্মত সঠিক জানা-শোনার অভাবের বিষয়টিও সুস্পষ্ট।
এই খাতে সরকারি তদারকির অভাব যথেষ্ট লক্ষণীয়। না হয় খাবার তৈরির অন্যতম কাঁচামাল সয়ামিলের দেশে যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এ খাতে ব্যবহৃত পণ্যগুলো আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা যায় কি না, সেটি ভেবে দেখতে হবে। চলমান সংকট নিরসনে দ্রুত পোলট্রি বোর্ড গঠন করে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে, খামারিদের সহজ শর্তে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থাসহ বীমার আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় এ বিকাশমান বিশাল শিল্পটি মুখ থুবড়ে পড়বে। বেকার হয়ে যাবে হাজার হাজার তরুণ উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্টরা। ফলে কালক্রমে পুষ্টি বা প্রোটিনজনিত ঘাটতির কারণে আপামর জনসাধারণের স্বাস্থ্যহানি ও মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। যা জাতীয় জীবনে একটি বড় সংকট হিসেবে উদয় হবে।
লেখক : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
তৌহীদ রেজা নূর। শহীদ সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান। প্রজন্ম ’৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এই আলোকিত মানুষ পিএইচডি ডিগ্রি নেন ভারতের জওয়াহেরলাল ইউনিভার্সিটিতে। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা বিষয়ে গবেষণা করতে চলে যান স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কে। হঠাৎই দেশে আসা। চলে যাবেন আবার। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রজন্ম’৭১ নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সহকারী সম্পাদক- তাপস রায়হান ।
দেশ রূপান্তর : ১৯৫২ ও ১৯৭১। বাঙালির এই দুই অর্জনকে কীভাবে দেখেন?
তৌহীদ রেজা নূর : বায়ান্ন হচ্ছে- চেতনার লড়াই। অস্তিত্বের লড়াই। নিজের ভাষাকে, প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই। আর ১৯৭১ হচ্ছে অধিকারের লড়াই। স্বাধিকারের লড়াই। সার্বভৌমত্বের লড়াই। একটি জাতির পূর্ণ বিকাশ, স্বাধীনতায়। আমরা সেটা অনেক রক্ত দিয়ে অর্জন করেছি। এর জন্য অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে। এর সব কিন্তু চেতনা থেকেই জন্ম নেওয়া। যার ভিত্তি তৈরি করেছিল ১৯৫২। এই যুদ্ধ কিন্তু শেষ হয়নি। আজও চলছে। চলবে ততদিন, যতদিন সেই আদর্শের পূর্ণ বাস্তবায়ন না হবে।
দেশ রূপান্তর : আপনি তো ‘জেনোসাইড’ নিয়ে গবেষণা করছেন। সেখানে, ভাষা আন্দোলনকে কীভাবে যুক্ত করা হবে?
তৌহীদ রেজা নূর : আমরা যখন, জোনোসাইড বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছি- তখন এর প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে ভাষা আন্দোলনও বাদ যাবে না। দুটো তো একই সূত্রে গাঁথা। একাত্তর তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপট নির্মাণে, ভাষা আন্দোলনের বিশাল অবদান। কোনোভাবেই তাকে বাদ রাখা যাবে না।
দেশ রূপান্তর : ভাষাশহীদদের সন্তানও তো, সরকারি সুবিধা পাওয়ার দাবি রাখেন?
তৌহীদ রেজা নূর : অবশ্যই।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু বাস্তবতা কি অন্য কথা বলে?
তৌহীদ রেজা নূর : ঠিক, তা না। অর্জন করার আরও অনেক কিছু আছে। সেগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : আপনি তো, প্রজন্ম ’৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। সেই নব্বই দশকের শুরুতে, এই সংগঠন তৈরির কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল?
তৌহীদ রেজা নূর : অবশ্যই ছিল। একটিবার ভাবুন, তখন বাংলাদেশের অবস্থা কেমন ছিল? কেন আমরা বাধ্য হয়েছিলাম, এই সংগঠন দাঁড় করাতে?
দেশ রূপান্তর : এর মানে, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে ঘাতক-দালাল নির্মূল আন্দোলন শুরু হয়েছিল, আপনাদের সংগঠন এরও আগে তৈরি করেছিলেন?
তৌহীদ রেজা নূর : ১৯৯১ সালের অক্টোবরে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। এর ২ মাস পরে, গোলাম আযমকে যখন জামায়াতে ইসলামী, ‘আমির’ বলে ঘোষণা দেয়। তার বিরুদ্ধেই গর্জে ওঠে সবাই। তখনই এগিয়ে আসেন জাহানারা ইমাম। গড়ে তোলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
দেশ রূপান্তর : বর্তমানে কি আমরা, ভাষা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে?
তৌহীদ রেজা নূর: না। ঠিক তা নয়। শুধু সরকারের ওপর, নির্ভর করলে চলবে না। দায়, আমাদেরও আছে। যদিও সময়, অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়। যেভাবে দিয়েছে, গণজাগরণ মঞ্চ।
দেশ রূপান্তর : সমাজে কি গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করার কোনো বাস্তব ভিত্তি তৈরি হয়েছিল?
তৌহীদ রেজা নূর : এছাড়া তো কোনো পথ ছিল না। ওটা তৈরি হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়ার দাবিতে। আইনে একটা ফাঁক ছিল। সেই আন্দোলনের কারণেই, আইনের সংশোধন করা হয়। এরপর ফাঁসি দেওয়া হয় তাকে।
দেশ রূপান্তর : আপনার কী মনে হয়, বর্তমানে একাত্তরের শহীদ সন্তানদের আন্দোলন করা জরুরি?
তৌহীদ রেজা নূর : প্রজন্ম ’৭১ তো এখনো আছে। অবশ্যই আন্দোলন করা জরুরি। এটা থাকবেও।
দেশ রূপান্তর : শহীদ সন্তানদের মধ্যেও তো বিভক্তি? বিভিন্ন নামে তাদের সংগঠন। এই বিভক্তি কেন?
তৌহীদ রেজা নূর : দেখেন, এই বিভক্তিটা অনিবার্য। এখানে চেতনাগত, ভাবনাগত, উপলব্ধিগত একটা বিষয় আছে। এটা থাকতে হবে। আপনি যদি মনে করেন, ‘জয় বাংলা’ আওয়ামী লীগের স্লোগান তাহলে তো হবে না। আপনি যদি এটাকে মুক্তিযুদ্ধের ‘রণধ্বনি’ হিসেবে স্বীকার না করেন, তাহলে বিভক্তি আসবেই। আপনার ওরিয়েন্টশন যদি হয় জাসদ ভাবনা, শিবির ভাবনা তাহলে তো হবে না। এরপর আর একসঙ্গে থাকা যায়? তাহলে তো আপনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে নেই। যখন স্বাধীনতার ২০ বছর পর, আমাদের যখন যাত্রা শুরু হয়- তখন ছিল আদর্শ থেকে বিচ্যুতির সময়।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু এই চেতনা তো পাই, ভাষা আন্দোলন থেকে। মূলত কি তখনই এর শুরু হলো না?
তৌহীদ রেজা নূর : তাতো অবশ্যই। নিশ্চয়ই।
দেশ রূপান্তর : আপনি তো বর্তমানে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে ‘জেনোসাইড’ নিয়ে গবেষণা করছেন। এ ব্যাপারে একটু বিস্তারিত বলবেন?
তৌহীদ রেজা নূর : বিষয়টা হলো, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছিল বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করছি। এই জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে আমি কাজ করছি। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ‘জেনোসাইড’ এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। অনেক ক্ষেত্রেই, এটি থাকে অনুচ্চারিত।
দেশ রূপান্তর : শহীদ সন্তান বা পরিবার কি সরকার থেকে কোনো ধরনের, বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে? যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানরা পাচ্ছেন?
তৌহীদ রেজা নূর : আমার জানা নেই। আসলে ‘ভাতা’র বিষয়টি আমি যেভাবে দেখি, সেটা হচ্ছে আজ অর্ধশতাব্দী পার হওয়ার পর, সেই সময় যে মানুষটি হত্যার শিকার হয়েছিলেন, সেই মানুষটিই কিন্তু পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। প্রত্যেকেই কিন্তু আমরাসহ এক ধরনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এতদূর এসেছি।
দেশ রূপান্তর : এর মানে ভাষা আন্দোলনে যে চেতনা কাজ করেছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধে যে চেতনা কাজ করেছিল- বাস্তবতা সেখান থেকে অনেক দূরে- তাই তো?
তৌহীদ রেজা নূর : না। ঠিক তা না। বাস্তবতা অনেক দূরে, সেটা আমি বলব না। আমাদের অর্জন করার জন্য, আরও অনেক কাজ করার আছে। এই বিষয়টি লালন করার জন্য আরও অনেক কিছু করার আছে। এটা শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব না। একজন নাগরিকের দায়িত্বও কম না। এটা একটি পরিবারের দায়িত্ব। শিক্ষাঙ্গনের দায়িত্ব। দায়িত্ব সবার আছে। শুধু রাষ্ট্রের ওপর সব দায় চাপালে ঠিক হবে না। এখানে গণমাধ্যমের দায়িত্বও রয়েছে। রাষ্ট্র অনেকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই যে, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বিষয়টি। এটা অত্যন্ত জটিল এবং এখানে মূল ভূমিকা কে পালন করেছে? শুধু বাংলাদেশ না। সারা বিশে^ই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার বিষয়টি, বেশ জটিল এবং স্পর্শকাতর বিষয়। এটা কিন্তু বাংলাদেশ করতে পেরেছে। এই যে, বীরাঙ্গনাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় দেওয়া- এটাও তো কম বড় বিষয় নয়? কিছু কিছু দুর্বলতা থাকলেও, অনেক বড় বড় কাজ কিন্তু করেছে। আমাদের বড় দুর্বলতার জায়গা হলো- যে চর্চাটা, যে শেকড় থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের চেতনাবোধে সেভাবে লালন করা দরকার। এই চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। এই দায়িত্ব কিন্তু সবার। যদিও আমাদের মধ্যে, দিবসকেন্দ্রিক ভাবনাটা বেশি। এটা গণমাধ্যমে বেশি দেখা যায়। গণমাধ্যমের অনেক সাংবাদিকের মধ্যেও এই চেতনার ঘাটতি আছে। যেমন ধরেন- যে সাংবাদিক ‘বুদ্ধিজীবী দিবস’ কভার করতে এসেছেন- তিনি যথেষ্ট গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করে আসেননি। দেখা যায়, একজন শহীদের নামও সে ভুল উচ্চারণ করেছে। আমি জানি না, এটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় । তবে বছরব্যাপী মানুষের মধ্যে একটা রুচি, বোধ এবং মনন তৈরির দায়িত্ব নিতে পারে গণমাধ্যম। অনেক আলোচনা হতে পারে। গবেষণা হতে পারে।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু তা থেকে তো পরিত্রাণ পেতে হবে?
তৌহীদ রেজা নূর : আমি তা বলতে পারব না। এ থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়।
দেশ রূপান্তর : আবার ‘ভাষা’র বিষয়ে ফিরে আসি। এটা তো একটা চেতনা।
তৌহীদ রেজা নূর : হ্যাঁ, চেতনার একটি অংশ।
দেশ রূপান্তর : এই চেতনার পূর্ণ বাস্তবায়ন কি হচ্ছে?
তৌহীদ রেজা নূর : না, পারছি না। বাস্তবায়ন করতে হলে তো, আগে বুঝতে হবে? চেতনার জায়গায় বড় রকমের ঘাটতি আছে। আগে মাতৃভাষাকে আত্মস্থ করতে হবে? নিজের মধ্যে নিতে হবে? নিজেকে তো উন্নত করতে হবে, নাকি? আমাদের বইপত্র, কোর্টকাচারি- সব জায়গায় তো বাংলার প্রাধান্য থাকতে হবে?
এক বছর আগে, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের সিদ্ধান্ত সমগ্র বিশ্বকে হতচকিত ও আতঙ্কিত করে তুলেছিল। তখন কেউ ভাবেনি যে, এই যুদ্ধ এতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, এক বছর পরও এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা যাবে না। এক বছরে ইউক্রেন দেশটি বিধ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু আরও বড় কথা, ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে যে, আধুনিক ইতিহাসের একটি মাইলফলক হয়ে চলেছে এই যুদ্ধ। পুরো বিশ্বাসীকেই এই যুদ্ধের নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে তা হলো, পরমাণু যুদ্ধ কি আসন্ন? ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তির আগে, গত ২১ ফেব্রুয়ারি রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের হুমকিতে সেই জল্পনাই এখন চরমে। এতদিন মস্কোর তরফে এ ব্যাপারে পরোক্ষে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আচমকা কিয়েভ সফর এবং হুমকিতে এক লহমায় পাল্টে গিয়েছে গোটা পরিস্থিতি। এই পদক্ষেপের জবাবে এদিন আমেরিকার সঙ্গে স্বাক্ষরিত পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি ভাঙার কথা ঘোষণা করেন পুতিন। তার সাফ হুঁশিয়ারি, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, তাহলে আমরাও পিছিয়ে থাকব না। একসপ্তাহ আগে আমি যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন স্ট্র্যাটেজিক সিস্টেম মোতায়েনের ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেছি।’ যদিও সেটি কী, তা স্পষ্ট করা হয়নি। তবে একথার মাধ্যমে তিনি যে কার্যত পরমাণু যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা স্পষ্ট।
পুতিনের এই ঘোষণা পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনা উসকে দিয়েছে বলে মত সামরিক বিশেষজ্ঞদেরও। ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে গত ২০ ফেব্রুয়ারি আচমকা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ পরিদর্শনে যান জো বাইডেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে পাশে নিয়ে প্রচ্ছন্ন হুমকিও দেন মস্কোকে। সঙ্গে ছিল ইউক্রেনকে চার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র সাহায্য, প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র এবং আধুনিক সাঁজোয়া গাড়ি পাঠানোর আশ্বাস। বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি ক্রেমলিন। তাই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত শেষ চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’ বা ‘স্ট্র্যাটেজিক অফেন্সিভ আর্মস ট্রিটি’ থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে আসার কথা ঘোষণা করেছেন পুতিন।
২০১০ সালের ৮ এপ্রিল বারাক ওবামার আমলে তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের সঙ্গে এই কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষর করে ওয়াশিংটন। দু’দেশে পরমাণু অস্ত্র হ্রাসে এটির ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ২০২১ সালে সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন সেটি আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে দেয়। এদিন দেশবাসীর উদ্দেশে ‘স্টেট অব দ্য নেশন’ ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট তা খারিজ করে দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে আমেরিকাসহ পশ্চিমি দুনিয়াকে দায়ী করেছেন পুতিন। তিনি বলেছেন, ‘স্থানীয় সমস্যাগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে রূপ দিয়েছে পশ্চিমি দেশগুলো। দেশের স্বার্থে এই অভিসন্ধির বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছি। রাশিয়াকে সহজেই হারানো যাবে বলে মনে করেছিল পশ্চিমের দেশগুলো। সেই কারণে ইউক্রেনে সংঘাতের আগুন জ্বালানো হয়। কিন্তু আমাদের হারানো অসম্ভব। তাদের জন্যই আমরা আজ যুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছি।’ ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল (খেরাসন, জাপোরিঝিয়া, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক) রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত করার কথাও ঘোষণা করেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
এই মুহূর্তে ইউক্রেন যুদ্ধ দু’টি গতিপথের সামনে দাঁড়িয়ে। এক, ক্রমাগত ও নিরন্তর আক্রমণ প্রসারে তত বেশি না-হলেও ক্ষয়ক্ষতিপ্রবণ ঘটিয়েই যাবে রাশিয়া। বহু মানুষ মারা যাবেন, বহু নগর-লোকালয় বিনষ্ট হবে, রুশ ফেডারেশনের মধ্যেও দেখা দেবে অস্থিরতা। দুই, একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের অঞ্চলগণ্ডি পেরিয়ে এটি আরও বড় হয়ে উঠতে পারে, যে পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের পরমাণু-অস্ত্র নিয়ে জুয়াখেলার ইচ্ছেও চাগিয়ে উঠতে পারে।
ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে মোড় নিচ্ছে তাতে একটি ছবি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপীয় শক্তি, অর্থাৎ ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোকে অতঃপর একটি বৃহত্তর ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে পূর্ব ইউরোপীয় অঙ্গনে। যদি কখনো প্রেসিডেন্ট পুতিন যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করেন, তখনো। কেননা ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন কিংবা কাশ্মীরের মতোই, সম্ভবত ইউক্রেনেও কোনো যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। মূল রাশিয়ার সঙ্গে পূর্বতন সোভিয়েট বলয়ের সম্পর্ক এমনই বিস্ফোরক থেকে যাবে, বিশেষত ইউক্রেনে এর সহজ মীমাংসা কল্পনাতীত। সে ক্ষেত্রে আর একটি দ্বিতীয় ইসরায়েল পরিস্থিতির জন্ম হলো বলা যায়, যেখানে পশ্চিমি শিবির সব সময়ে দায় বোধ করবে একটি নির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক ভূমিকা পালনের, প্রয়োজনে সামরিক হস্তক্ষেপেরও। অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহ দুই-ই দ্রুতবেগে বাড়ছে। ১৯৪৫ সালের পর এই প্রথম ন্যাটো এত বড় যুদ্ধে নেমেছে। কাকতালীয় নয় যে, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তি এই যুদ্ধের সময়েই ঘটতে পেরেছে।
দুর্ভাগ্যজনক এই পরিস্থিতির অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়তে চলেছে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। ইতিমধ্যেই তা অনুভূত হতে শুরু করেছে। রাশিয়ার শক্তি সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার ফলে গোটা ইউরোপ জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন। যদিও সদ্য-অতিক্রান্ত শীত আশঙ্কার তুলনায় স্থিতিশীল কেটেছে, ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্বনেতারা অতীব উদ্বিগ্ন। বিশ্বজুড়ে গম উৎপাদনের ৩০ শতাংশ ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে আসে, সুতরাং খাদ্যশস্যেও ঘাটতি আসার আশঙ্কা। মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে বিভিন্ন দেশে। নাগরিক ক্ষোভ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। ইউক্রেন থেকে আসা নতুন উদ্বাস্তুস্রোত আবার সামাজিক অস্থিতি তৈরি করছে। সব মিলিয়ে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর যে সময়ের মধ্যে বিশ্বকে ঠেলে দিয়েছে, তা মোটেও স্বস্তির নয়।
সবচেয়ে বড় কথা ৩৬ বছরের পুরনো ক্ষেপণাস্ত্র চুক্তি থেকে আমেরিকা-রাশিয়ার এই সরে আসা এবং নতুন করে হুমকি-ধমকি সেই ঠাণ্ডা যুদ্ধের স্মৃতিকেই ফিরিয়ে আনছে। বিশ্বজুড়ে দুই বৃহৎ শক্তির, অর্থাৎ আমেরিকা ও রাশিয়ার অস্ত্র প্রতিযোগিতায় রাশ টানতে বিশ্বজনমতের চাপে ১৯৮৭ সালে সম্পাদিত এই চুক্তিতে (আইএনএফ) ক্ষুদ্র ও মাঝারি পাল্লার (৫০০ কিলোমিটার থেকে ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার) সব পরমাণু অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর চার বছরের মধ্যে আমেরিকা ও রাশিয়া ২ হাজার ৭০০ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে ফেলেছিল। সারা বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লাগাম টানতে এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও কয়েক বছর ধরে পৃথিবীজুড়েই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।
পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া ক্রমেই সমরসজ্জায় এগিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমের ওপর রাশিয়ার অগ্রগণ্যতা প্রতিষ্ঠা করার একটা প্রচেষ্টা রাশিয়ার মধ্যে প্রবল। বিশেষ করে ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার অস্ত্রের ক্ষেত্রে রাশিয়া পশ্চিমা শক্তির তুলনায় এগিয়ে থাকতে চায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমারা ভেবেছিল, রাশিয়া আর কোনোদিন কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না বা পুনরুজ্জীবন ঘটবে না। কিন্তু সে ধারণা যে ভুল, সেটা এরই মধ্যে পুতিন প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
পুতিন মনে করেন, ন্যাটোর প্রচলিত অস্ত্রশক্তির কাছে তার দেশের পিছিয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতিতে যে কোনো হামলার সম্ভাব্য প্রত্যুত্তর হতে পারে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের উৎপাদন বাড়ানো। এর ফলে কেউ তার দেশের ওপর পরিকল্পিত কোনো হামলা পরিচালনার সাহস পাবে না।
বিষয়টি সম্পর্কে আমেরিকানরাও ওয়াকিবহাল। তাই তো রাশিয়ার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আমেরিকাও অস্ত্র তৈরিতে, বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র উন্নত করে চলেছে। রাশিয়া ও আমেরিকা উভয় দেশই অত্যাধুনিক সব পারমাণবিক অস্ত্র ক্রমাগত শক্তিশালী করে চলেছে এবং এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগও বাড়িয়েছে। নিজ নিজ দেশের নিরাপত্তার নামে রাশিয়া ও আমেরিকা এখন গভীর সামরিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। যদিও এটা নিরাপত্তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো কাজেই আসবে না। বরং এতে উভয় পক্ষের সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাবে। সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, বর্তমানে রাশিয়া ও আমেরিকা দুই দেশেই দুজন একরোখা-অপরিণামদর্শী যুদ্ধবাজ ব্যক্তি ক্ষমতায় রয়েছেন। বিশ্বশান্তির পথে না হেঁটে যারা উল্টোপথে চলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন! এই দুই ব্যক্তির খেয়ালি আচরণ মানবজাতির জন্য যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্যোগ বয়ে আনতে পারে।
সন্দেহ নেই, ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাদানুবাদ ফের ঠাণ্ডা মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে। পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা থেকে এখন দুই রাষ্ট্রকে বিরত করবে কে বা কারা? এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হচ্ছে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে নতুন করে বিশ্বে জোরদার শান্তি আন্দোলন গড়ে তোলা। তা না হলে পরমাণু শক্তিধর দুটি দেশের নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বড় যুদ্ধের বিপদ ডেকে আনবে! আবার আমরা ফিরে যাব সেই স্নায়ুযুদ্ধের যুগে!
ইউক্রেনকে ঘিরে দুই পরাশক্তির যে যুদ্ধ, তা সহসাই মিটবে বলে মনে হচ্ছে না। আমেরিকা আর রাশিয়া, দুটো দেশেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২৪ সালে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, তার আগে হয়তো এই প্রাণক্ষয়ী, অর্থক্ষয়ী সংঘাত শেষ হবে না। মানবজাতির জন্য যা চরম দুঃসংবাদ!
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
ভারতীয় বাঙালি লেখিকা লীলা মজুমদারের জন্ম কলকাতার রায় পরিবারে ১৯০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তার বাবার নাম প্রমদারঞ্জন রায় ও মা সুরমাদেবী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি পরীক্ষায় তিনি সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি বিয়ে করেন দন্ত চিকিৎসক ডা. সুধীরকুমার মজুমদারকে। এ বিয়েতে তার বাবার প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি তার স্বনির্বাচিত পাত্রকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। বিবাহিত জীবনে তারা সুখী দম্পতি ছিলেন। স্বামী আজীবন তার সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী ছিলেন। তার প্রথম গল্প ‘লক্ষ্মীছাড়া’ ১৯২২ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় সন্দেশ পত্রিকা পুনর্জীবিত করলে তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সাম্মানিক সহ-সম্পাদক হিসেবে পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘হলদে পাখির পালক’, ‘টং লিং’, ‘পদি পিসির বর্মী বাক্স’ ও ‘সব ভুতুড়ে’। তিনি অনেক শিক্ষামূলক রচনা ও রম্যরচনা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন। তার আত্মজীবনীতে শিলংয়ের ছেলেবেলা, শান্তিনিকেতন ও অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গে তার কাজকর্ম, রায়চৌধুরী পরিবারের মজার ঘটনাবলি ও বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘ পরিভ্রমণের কথা বর্ণিত হয়েছে। রবীন্দ্র পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, ভুবনেশ্বরী পদক, দেশিকোত্তমসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছেন। ২০০৭ সালের ৫ এপ্রিল তিনি মৃতুবরণ করেন।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।