
নোবেলজয়ী রুশ চিকিৎসক ও শরীরতাত্ত্বিক ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ ১৯৩৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিনগ্রাদে মৃত্যুবরণ করেন। শরীরের বস্তুবাদী গবেষণার জন্য তিনি প্রসিদ্ধ। চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের আধুনিক রূপান্তরে তার ব্যাপক অবদান রয়েছে। ১৮৪৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার রয়াজানে জন্মগ্রহণ করেন পাভলভ। তার বাবা ছিলেন পাদ্রি। প্রথমে ধর্মীয় বিদ্যায় শিক্ষা শুরু করলেও ২০ বছর বয়সের আগেই চার্লস ডারউইনের লেখা পড়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন তরুণ পাভলভ। ১৮৭০ সালে রয়াজান থিওলজিক্যাল সেমিনারির পাঠ শেষ করেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব সেইন্ট পিটার্সবুর্গের পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত অনুষদে প্রকৃতিবিজ্ঞান নিয়ে পড়েন। অধ্যাপনা করেন ইউনিভার্সিটি অব সেইন্ট পিটার্সবুগ, ইম্পেরিয়াল মেডিকেল অ্যাকাডেমি ও মিলিটারি মেডিকেল অ্যাকাডেমিতে। তার সবচেয়ে বড় অবদান ‘সাপেক্ষ প্রতিবর্ত’ ব্যাখ্যাকারী গবেষণা। গুরু মস্তিষ্কের অনেকগুলো প্রতিবর্ত ক্রিয়ার ব্যাখ্যা প্রদান করেন এবং গবেষণার মাধ্যমে কুকুরের দেহে কীভাবে এসব প্রতিবর্ত তৈরি হয় ও কাজ করে তা প্রমাণ করেন তিনি। এভাবে মানুষ এবং পশুর মস্তিষ্কের সঙ্গে বাইরের উত্তেজকের সম্পর্কের বিধান আবিষ্কার ও ব্যাখ্যা করেন তিনি। তার সাপেক্ষ প্রতিবর্ত ক্রিয়ার তত্ত্বের ভিত্তিতে আধুনিক মনোবিজ্ঞানে বস্তুবাদী ও আচরণবাদী গবেষণা এবং ব্যাখ্যা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯২২ সালে তার গবেষণা ফলাফলগুলো ভাষণ আকারে প্রকাশিত হয়। চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পান ১৯০৪ সালে। ১৯১৫ সালে তিনি ‘কপলে মেডাল’ জিতেন। তার উল্লেখযোগ্য দুটি বই হলোÑলেকচার্স অন দ্য ওয়ার্ক অব দ্য ডাইজেস্টিভ গ্ল্যান্ডস (১৮৯৭) এবং কন্ডিশনার্ড রিফ্লেক্সেস : অ্যান ইনভেস্টিগেশন অব দ্য ফিজিওলজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি অব দ্য সেরেব্রাল কর্টেক্স (১৯২২)।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে, ২৫ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় ষষ্ঠ সমাবর্তন। বয়সের বিচারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তার যৌবন পেরিয়ে পূর্ণবয়স্ক, যার বয়স বাংলাদেশের বয়সের সমান। অন্যদিকে, যশোর বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বয়সের দিক থেকে একেবারে নবীন। এ বছর চতুর্থ সমাবর্তনে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডিপর্যায়ে ১ হাজার ৮৩৪ জন গ্র্যাজুয়েটকে সনদ দিয়ে, যার মধ্য থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ৫৭ জন স্বর্ণপদক ও অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত হন। এর মধ্যে ২২ জন গ্র্যাজুয়েট চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক, ২৬ জন ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড এবং ৯ জন ডিন অ্যাওয়ার্ড পান (তথ্যসূত্র :themailbd.com, ফেব্রুয়ারি, ১৮, ২০২৩)। অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ষষ্ঠ সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করেন ১৫ হাজার ২১৯ জন শিক্ষার্থী, যার মধ্য থেকে ১৬ জনকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে স্বর্ণপদক দেওয়া হয় (তথ্যসূত্র : ঢাকা পোস্ট, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)।
দেখা যায় যে, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ বছরে চারবার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের সমান বয়সী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৫২ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে ছয়বার। অন্যদিকে শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালে ৫৩তম সমাবর্তনের আয়োজন করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিতভাবে সমাবর্তন আয়োজনে ব্যর্থ। অথচ প্রতি বছরই ছাত্র ভর্তি করার সময় তাদের শিক্ষাজীবন শেষে সনদ প্রদানের আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ছাত্র ভর্তি করার সময় হলগুলোতে কী সংখ্যক আসন শূন্য আছে, বিভাগগুলোর কী পরিমাণ ধারণক্ষমতা আছে ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ছাত্রকল্যাণ ফান্ড এবং বিভাগ ছাত্র সংসদে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষাদান এবং পরীক্ষা শেষে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ প্রদানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় না। আমি অনুমান করতে পারছি এটি প্রায় বাংলাদেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চিত্র। অথচ, সমাবর্তন তথা শিক্ষাজীবন শেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সনদপ্রাপ্তির আনুষ্ঠানিকতা ছাত্র মাত্রেই অধিকার। যেকোনো ট্রেনিং প্রোগ্রাম শেষেও একটি আনুষ্ঠানিক সনদ প্রদান অনুষ্ঠান এর আয়োজন করা হয়। অথচ কোটি কোটি টাকার বাজেটের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে সময় লাগে কয়েক বছর। অনেকেই এ সময়ের মধ্যে কর্মজীবনেও কয়েক বছর পার করে দেন, ফলে সনদপ্রাপ্তির আনন্দটা সময়মতো উপভোগ করতে না পেরে সে যেন ক্রমেই ম্লান হতে থাকে।
অনেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন যে সমাবর্তন আয়োজন একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। চার পাঁচ বছরের দীর্ঘ বিরতিতে সমাবর্তন আয়োজন একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া বৈকি। আর এ ব্যয়ের একটি বড় অংশ বরাদ্দ করা হয় ১০-১৫ হাজার গ্র্যাজুয়েটের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন প্যান্ডেল তৈরি করতে। পত্রপত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ষষ্ঠ সমাবর্তনের প্যান্ডেল বাবদ খরচ হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্র্যাজুয়েট উভয়ের জন্যই এটা গলায় বিঁধা কাঁটার মতো। প্যান্ডেল ছাড়া সমাবর্তন আয়োজন সম্ভব নয়, আবার এত টাকার জোগান দেওয়াও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থ জোগানের চাপ গিয়ে পড়েছে রেজিস্ট্রেশন ফির ওপর।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব সহজেই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রতি বছর প্রথম বর্ষে ছাত্র ভর্তি করার সময় বিভাগের ছাত্রকল্যাণ তহবিল, বিভাগের জন্য বরাদ্দ করা ফান্ডের মতো সমাবর্তন তথা শিক্ষাজীবন শেষে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ প্রদানের বিষয়টি মাথায় রেখে একটা অর্থ বরাদ্দ দিতে পারে। এটা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটে কিংবা শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন ফির মাধ্যমে, যেমনটি এখন করা হচ্ছে। একইভাবে অনুষ্ঠান আয়োজন হতে পারে অডিটোরিয়াম বা কোনো হলরুমে। এতে করে প্রতি বছর অল্পসংখ্যক গ্র্যাজুয়েটের জন্য আয়োজন করতে হবে বলে সমাবর্তন আয়োজন করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষকে বেগ পেতে হবে না। আবার অন্যদিকে, একটা বিশাল অঙ্কের অর্থ অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।
সমাবর্তন গ্র্যাজুয়েটদের জন্য শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে প্রবেশের এক মাইলফলক। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে গ্র্যাজুয়েটদের সামনে এমন একজন ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যার জীবন থেকে গ্র্যাজুয়েটরা একটি সুন্দর এবং বাস্তবধর্মী দিকনির্দেশনা পাবেন। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে একবার সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন টেকনোলজির জগতের অন্যতম পুরোধা অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস, যিনি তার বক্তব্যে তার জীবনের তিনটি ঘটনা বর্ণনা করে গ্র্যাজুয়েটদের ভবিষ্যতে কী করণীয় সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যা বিশ্বের কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে পারে। এতে সদ্য শিক্ষাজীবন সমাপ্তকারী গ্র্যাজুয়েটরা নিজেরা এ ধরনের সম্মানসূচক ডিগ্রি অর্জনের জন্য অনুপ্রাণিত হবেন, কর্মজীবনে সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন, সমাজ এবং মানবতার কল্যাণে ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা লক্ষ করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয়তার গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি। কিংবা সমাবর্তন বক্তা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নিজেদের প্রচলিত কনভেনশনের বাইরে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে সমাবর্তন বক্তব্য গ্র্যাজুয়েটদের জন্য মূল আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে না।
সমাবর্তনের অন্যতম এক আকর্ষণ স্বর্ণপদক প্রদান। স্বর্ণপদক একদিকে যেমন একজন গ্র্যাজুয়েটের জন্য তার কঠোর পরিশ্রমের স্বীকৃতি, অন্যদিকে তেমনি এটি বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের প্রেরণা। তাই স্বর্ণপদক প্রদানের ক্ষেত্র এবং পরিধি বাড়ানো বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিসির একটা অংশ হওয়া উচিত। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে স্বর্ণপদক প্রদান করা সম্ভব হয় না, কিংবা কয়েক বছরের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে হয়তো একজন বা দুজন গ্র্যাজুয়েটকে ফলাফলের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়। যেমন : এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মোফাসসিল উদ্দিন আহমেদ স্বর্ণপদক ১১ জন গ্র্যাজুয়েটের মধ্য থেকে ১ জনকে প্রদান করার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ স্বর্ণপদকের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ আছে তাতে একজনকেই শুধু এই পদক দেওয়া যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই সংবাদ পড়ার পর খুবই মর্মাহত হয়েছি। মোফাসসিল উদ্দিন আহমেদ স্বর্ণপদকপ্রাপ্তির যে শর্ত তাতে এই ১১ জনের ফলাফলই সেই শর্ত পূরণ করে। কিন্তু অর্থ সংকুলান করতে না পারার কারণে অনেকেই তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্র্যাজুয়েট উভয়ের জন্যই বিব্রতকর বটে।
এখন কথা হচ্ছে, স্বর্ণপদকের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান আসবে কোথা থেকে? আমরা যদি একটু উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকাই তাহলে সহজেই এ সমস্যার সমাধান খুঁজে পাব। একটি বিশ্ববিদ্যালয় একজন গ্র্যাজুয়েটের জন্য দ্বিতীয় আঁতুড়ঘর। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গ্র্যাজুয়েটের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত তার প্রতিটি গ্র্যাজুয়েটের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য লিপিবদ্ধ রাখা। এটা কঠিন কোনো কাজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইদের কাছে স্বর্ণপদকের ফান্ড গঠনের জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে। আমি মাঝেমধ্যেই ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা থেকে ইমেইল পাই গ্র্যাজুয়েট দপাঠানো হয় যেখানে আমার পাঠানো ১০০ কিংবা ৫০ ডলার কী করে একজন মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি স্টুডেন্টের টিউশন ফি প্রদানে সহায়ক হতে পারে তার বর্ণনা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একজন অ্যালামনাইয়ের সম্পর্ক যেন বিশ্ববিদ্যালয় দিবস কিংবা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আগমন, র্যালি, স্মৃতিচারণ ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তার বিশালসংখ্যক অ্যালামনাইকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড গঠনের জন্য কাজে লাগাতে পারে।
আমাদের দেশে সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ, সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় যেন ব্যস্ত থাকে এই আয়োজনকে ঘিরে। এই প্র্যাকটিস থেকেও আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। সমাবর্তন গ্র্যাজুয়েটদের অনুষ্ঠান, এটির আয়োজন যেন বর্তমান শিক্ষার্থীদের শিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমে কোনো প্রভাব না ফেলে সে বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Email: [email protected]
১.
এই প্রজন্ম কতটা ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানী সেটা বেশ ভালোভাবেই প্রতিনিয়ত টের পাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক হিসেবে, যেমন শ্রেণিকক্ষে, তেমনি আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’-এর পাঠচক্রের আলোচনাতেও। আমাদের বাংলার আনাচে-কানাচে, আসা-যাওয়ার পথের ধারে মহান মুক্তিযুদ্ধের নানান স্মৃতিক্ষেত্র রয়েছে, অথচ শিক্ষার্থীদের কাছে সেসব বিষয়ে জানতে চাইলে নিজেকেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। আমাদের ভাসানটেক সরকারি কলেজে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে স্থাপিত হয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাসভিত্তিক ম্যুরাল ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’। কদিন আগে একাদশ শ্রেণির নবাগত শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের পাঠদানকালে আকস্মিক ভিজিলেন্সে উপস্থিত হন আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন। তিনি আমার পাঠদানের বিষয়ে জেনে নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে কলেজের উল্লেখযোগ্য শিক্ষণীয় স্থাপনার বিষয়ে প্রশ্ন করলে হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া কেউই কিছু বলতে পারেনি। অথচ কলেজের প্রবেশ পথেই শহীদ মিনারের সঙ্গে ম্যুরালটি স্থাপিত। অনেকেই দৃষ্টিনন্দন ম্যুরালের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পড়েননি কিংবা পড়লেও মনে রাখতে পারেননি বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিষয়বস্তু। যতদূর জানি, কলেজের মতন দেশের প্রতিটি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে জানি’ বিষয়ে বিশেষ পাঠ ও পরীক্ষা গ্রহণের নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মোবাইলসহ নানান তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি যে পরিমাণ আগ্রহ ও মনোযোগ দেখি, সেই বিবেচনায় আত্মানুসন্ধানে দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মহান শহীদদের বিষয়ে জানার আকুতি আশাব্যঞ্জক নয় বলেই বেদনাহত হই। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এবং অনেক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকই নিজেকে জানার গভীর প্রত্যয়ে স্বপ্নবান শিক্ষার্থীদের মনে স্বদেশপ্রেম, নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সচেষ্ট থাকেন কিন্তু সেই প্রয়াস কতটুকু ফলপ্রসূ হয় তা শ্রেণিকক্ষের পাঠ অভিজ্ঞতায় নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। ২.
এত কথা বললাম একাত্তরের মহান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর নির্মিত ফাখরুল আরেফিন খানের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘অবিনশ্বর’-এর প্রিমিয়ার শো দেখতে দেখতে ভাবনার জালে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সত্য তথ্য নিয়ে তৈরি কাওসার চৌধুরীর ‘বধ্যভূমিতে এক দিন’, জাহিদুল ইসলাম বিপ্লবের ‘ওমর ফারুকের মা’ কিংবা ফাখরুল আরেফিন খানেরই আরেকটি চলচ্চিত্র ‘জেকে ৭১’Ñ দেখার স্মৃতি মনে পড়ায়। দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ডিজিটাল ক্লাসরুমের ব্যবস্থা আছে। সেই সুবিধা গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঠিক চেতনা জাগরণে নিয়মিত প্রদর্শনের নীতিমালা প্রণীত হলে এবং বাস্তবায়নে যথাযথ মনিটরিং হলে সবার মধ্যেই প্রকৃত চেতনার বিকাশ ঘটবে বলেই আমি মনে করি। ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে বিভ্রান্তির নানান সুযোগসমূহকে প্রতিহত করতে বিকল্প ইতিবাচক বাস্তবায়নযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না আমার।
৩.
ভাষার মাসে ভাষা আন্দোলনের রূপকার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের লড়াই ও সংগ্রামের ওপর নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘অবিনশ্বর’-এর প্রিমিয়ার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অনুদানে ফাখরুল আরেফিন খানের পরিচালনায় ও গড়াই ফিল্মসের প্রযোজনায় প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। আমরা জানি, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একজন বাঙালি আইনজীবী, সমাজকর্মী ও ভাষাসৈনিক। যিনি দেশভাগের আগে ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত অংশে এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতিবিদ হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপের জন্য তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হন। তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের সব কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলায়ও রাখার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সর্বপ্রথম বাংলা ভাষাকে আমাদের ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার দাবি পাকিস্তান গণপরিষদে উত্থাপন করেন। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার ছোট ছেলে দিলীপকুমার দত্তকে ধরে নিয়ে যায় এবং ময়নামতী সেনানিবাসে নির্যাতন করে হত্যা করে। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অবদান চিরস্মরণীয়। এটি নির্মাণ প্রসঙ্গে পরিচালক ফাখরুল আরেফীন খান বলেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে কজন মানুষকে নিয়ে আমরা সর্বময় আলোচনার মধ্যে থাকি, সেখানে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অনুপস্থিত। তাকে আমরা কখনো আলোচনার মধ্যে আনি না। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল সূতিকাগার ভাষা আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। আর সে কারণেই শেষ পর্যন্ত তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল ১৯৭১ সালে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিতব্য প্রামাণ্যচিত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলা ভাষার এই মহান সৈনিককে তরুণ প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও চেতনাকে পৌঁছে দেওয়া।
৪.
‘অবিনশ্বর’ প্রামাণ্যচিত্রের যে মূল উদ্দেশ্য বাংলা ভাষার যে মহান সৈনিককে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা, সেটি যথার্থভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে বলে একজন দর্শক হিসেবে মনে হয়েছে। তবে মনে করি, শুধু বাছাই করা কিছু নির্দিষ্ট দর্শকের জন্য নয়, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘অবিনশ্বর’-এর মতন আরও সমগোত্রীয় প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্রের বাছাই করা তালিকা প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরব্যাপী প্রদর্শনীর নির্দেশনা দিতে পারে। তাহলেই সঠিক ইতিহাস চেতনায় সমৃদ্ধ নাগরিক গড়ে তোলার সরকারের প্রত্যাশিত নানান শুভ উদ্যোগ বিস্তৃত পরিসরে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ে উঠবে বলেই গভীরভাবে আশাবাদী।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা
যদি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে, ধরা যাক দৈব কারণে উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, বিহার অথবা আসামের যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াবে? বাহ্যত তা যুদ্ধই। হতে পারে তা ছোট অথবা বড়। তাতে বিবিধ রঙ চড়তে পারে বা চড়ানো হতে পারে। কেউ বলবেন, এটা এক ধরনের গৃহযুদ্ধ। কারণ তা একটি দেশের মধ্যে ঘটছে ভারতে। ধরা যাক আবারও দৈব কারণে রাজ্যগুলোর যেকোনো একটির সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধ বেধে গেল। তখনো সংঘাতটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে সীমিত থাকলেও সেটি আর গৃহযুদ্ধ থাকবে না। সেটি হয়ে যাবে বাংলাদেশ-ভারত যুদ্ধ। গৃহযুদ্ধের সংজ্ঞায় থাকা আর সম্ভব নয়। তবে যত যাই হোক নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমাতেই থাকতে হচ্ছে।
উল্লিখিত অঞ্চলগুলো মহাভারতের বিবরণ অনুযায়ী যথাক্রমে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র এবং সুম্ম। তারা বালী রাজার দত্তক অথবা স্বীকৃত পুত্র। পাঁচ ভাই। বালী রাজা নিঃসন্তান ছিলেন। তার স্ত্রীর গর্ভে এক ঋষি, যার নাম গৌতম দীর্ঘতম, তার ঔরসে তারা জাত। সেকালে এবং তার বহু যুগ পরেও ক্ষেত্রজ সন্তানের প্রথা চালু ছিল। ফলে প্রথা অনুযায়ী তারা বালী রাজার সন্তান। মোটকথা তারা বা তাদের অধ্যুষিত অঞ্চল পরস্পর সম্পর্কিত। বালী ছিলেন মগধের রাজা। মগধ নিয়ে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুম্মর প্রতিষ্ঠাতাদের ব্যাপারে এমন কথাই চালু আছে।
বাংলা (বঙ্গ), উড়িষ্যা (কলিঙ্গ), বিহার (অঙ্গ), ঝাড়খণ্ড (অঙ্গ বা মগধ), আসাম (প্রাগজ্যোতিষ) সবই একই সাংস্কৃতিক এবং মোটাদাগে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীভুক্ত। জরাসন্ধ যখন ভারতবর্ষের সম্রাট ছিলেন তখনো ছিল; মৌর্য্যরা যখন সম্রাট ছিল তখনো ছিল, গুপ্তরা যখন ছিল তখনো মগধ ছিল ভারতের (ভারতবর্ষের) ক্ষমতার কেন্দ্র। সুলতানি আমলেও বাংলা (বৃহৎ বঙ্গ) বা বাঙ্গালাহ (তথা মগধ/বৃহৎ বঙ্গ) প্রায় স্বাধীন অস্তিত্ব ছিল। মুগল আমলে কেন্দ্র সরেছিল দিল্লিতে। আবার ব্রিটিশ আমলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি নামে বাংলা অঞ্চল (বৃহৎ বঙ্গ/সাবেক মগধ) একসঙ্গেই ছিল, ভারতবর্ষ তথা ইন্ডিয়া কাঠামোর মধ্যে। পৌরাণিক বা মিথলজিক্যাল দৃষ্টিতে উল্লিখিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে সশস্ত্র বিবাদকে যুদ্ধ বলা যাবে বটে কিন্তু তা যথার্থ হবে না। একে গৃহযুদ্ধ বললে তা হবে সংকীর্ণ সংজ্ঞা। একে বরং ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বলা যেতে পারে। বলা উচিতও।
ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বলাই শ্রেয়। দুটি কারণে। এক, দুই দেশই সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ছিল। দুই, ঐতিহাসিক বা প্রাগৈতিহাসিক সংযোগও আছে দুই দেশের মধ্যে। তারা জাতিগতভাবে সøাভ। পূর্বাঞ্চলীয় সøাভদের কেন্দ্র ছিল কিয়েভে বা কিয়িভে। এই স্ল্যাভদের বলা হতো কিয়েভান রাস বা কিয়িভের রুশ। কিয়েভ আসলে পূর্বী সøাভদের মক্কা। অতএব এটা যুদ্ধ হলেও ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। এক সময় মগধের মৌর্য্যবংশীয় রাজা অশোক কলিঙ্গ আক্রমণ করে অনুরূপ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। অশোক অবশ্য শোকে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ভøাদিমির পুতিন বা ভলোদিমির জেলেনস্কি কী করবেন সেটা তাদের ব্যাপার। ইতিহাসে প্রায়শ এরকম ঘটনা ঘটে থাকে।
এটা যে কার্যত ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ সে কথা মনে রেখেছে রাশিয়া। যুদ্ধের শুরু থেকেই সে কথা ভেবে যত কম বেসামরিক নাগরিক নিহত হয় তার চেষ্টা করেছে তারা। রাশিয়া চেষ্টা করেছে, এখনো করছে; তবে তেমন কোনো চেষ্টা করেনি ইউক্রেন। মার্কিন ও ন্যাটো-বটিকা গিলেছে তারা। অথবা গেলানো হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে ইউক্রেনও নাৎসিবাদ এবং নাৎসিবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। এখন ইউক্রেনের নব্য নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে রাশিয়াকে। নব্য নাৎসিবাদের উত্থান হলো কী করে? যুক্তরাষ্ট্রের বদান্যতায় ময়দান অভ্যুত্থানের পর। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের ইতিহাসটা তাহলে মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে! যুক্তরাষ্ট্র কোনোকালেই নাৎসিবাদবিরোধী ছিল না। হলোকাস্টের শিকার ইহুদি জনগোষ্ঠীর জায়নবাদীরাও যে নাৎসিবাদের বিরোধী ছিল না তা এখন স্পষ্ট। পোরোশেঙ্কো, জেলেনস্কিরাও যতটা না ইহুদি, ইউক্রেনযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রমাণিত হয়েছে তারা অনেক বেশি জায়নবাদী। যুক্তরাষ্ট্র এবং জায়নবাদীরা কখনো মৌলবাদবিরোধীও ছিল না। থাকলে কন্ট্রা বিদ্রোহী, আল-কায়েদা, আইএস বা দায়েশ, তাহরির আল শাম, আল নুসরা প্রভৃতি জঙ্গি মৌলবাদী গোষ্ঠীর জন্ম তারা দিতে পারত না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্কের খেসারত দিচ্ছে ইউক্রেন। ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ এবং ইউক্রেনে নব্য নাৎসি তৎপরতা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সারকথা।
যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ২০২৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। যুদ্ধ ২০২২-এর মার্চেই শেষ হয়ে যেতে পারত। আলোচনা সেদিকেই যাচ্ছিল। তুরস্কের মধ্যস্থতায় চুক্তি প্রায় সম্পন্নের পর্যায়ে ছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ওরফে বোজো অ্যাংলো-জায়নিস্ট ইমপেরিয়াল মন্ত্রণায় গত মার্চে কিয়েভে গিয়েছিলেন। আর তারপরই বুচাকাণ্ড ঘটল। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সমঝোতা-প্রয়াসও ভেস্তে গেল। ইউক্রেনের পিস ডেলিগেশনের প্রতিনিধি দানিস কিরেভকে ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংস্থাই হাপিস করে দিল। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাপতালি বেনেতও ইউক্রেনের শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে চেয়েছিলেন। বোজোর কারণে পারলেন না। ভেস্তে গিয়েছে বোজোর প্রধানমন্ত্রিত্বও। ন্যাটো-মার্কিন হুকুমে তিনি শান্তিপ্রক্রিয়া নস্যাৎ করেছিলেন। ব্রিটিশ অধিপতিমানস বলে কথা! মার্কিন সাম্রাজ্য মানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যই। এক সময় যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশের রায়ত বই তো আর কিছু ছিল না। ইউক্রেনে যুদ্ধটা এখনো চলছে ন্যাটোর নামে মার্কিন হস্তক্ষেপে। মাস দেড়েকের মধ্যে থেমে যেতে থাকা একটা যুদ্ধ এক বছর ধরে চলছে। এ ব্যাপারে সব কৃতিত্বই যুক্তরাষ্ট্রের। এখন যুদ্ধে ইউক্রেন আসলে কোনো পক্ষ নয়। এখন এক পক্ষে রাশিয়া, আরেক পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। ইউক্রেন শিখণ্ডী মাত্র। জিতবে কে? যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো নাকি রাশিয়া? হারবে কে? রাশিয়া নাকি যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো? ইউক্রেন আলোচনায় নেই ইউক্রেন ‘গয়ং গছ’।
রসাতলে যেতে বসা ইউক্রেনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে যেতে হচ্ছে জেলেনস্কির সঙ্গে বোঝাপাড়া করে নয়, বরং প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে। যেখানে যাবেন সেখানে যাতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা না হয় বাইডেন তার নিশ্চয়তা চেয়েছেন রাশিয়ার কাছে, ইউক্রেনের কাছে নয়। কারণ তিনি জানেন ইউক্রেনের যুদ্ধজয়ের সামর্থ্য নেই, ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা ঠেকানোর মুরোদও নেই। ইউক্রেন এখন ‘মুরাদ টাকলা’।
জেলেনস্কি এখন উপায় নেই গোলাম হোসেন দশায়। বাইডেনের এই সফরের আগে তিনি দুই মাস বাঙ্কারে ছিলেন বলে খবরে প্রকাশ। তিনি ইউক্রেনে প্রকাশ্যে খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। যতটুকু সময় থাকেন হয় ইউক্রেনের পশ্চিম সীমান্তের লিববে নতুবা পোল্যান্ডে থাকেন। এ অঞ্চলটি স্তালিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউক্রেনের সঙ্গে জুড়েছিলেন। আগে ছিল জার্মানির দখলীকৃত অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ায়। যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ^ব্যবস্থার মোড়ল তার তো নিজের সক্ষমতাতেই ইউক্রেনে যাওয়ার কথা ছিল। তাহলে কি তার জোর নেই? হবে হয়তো Biden dared not visit Kiev without asking Russia for security guarantees first-Foreign Ministry Spokeswoman Maria Zakharova noted that “the US leader’s visit was staged with drama, but, in reality, sembled a failed stage of in a provincial theater.” (https://tass.com)
২০ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। বাইডেন রাশিয়ার অনুমোদন সাপেক্ষে কিয়েভে গেলেন। সম্রাটের চালচলন যদিও ছাড়লেন না। নিজে টেবিলে বসে কী যেন লিখলেন। কিন্তু দেখা গেল ভলোদিমির জেলেনস্কি অধোবদনে তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন হুকুম বরদার। বাইডেন সম্ভবত মস্কোর অনুমতি নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করবেন! পুতিন আবার পরমাণু অস্ত্র বিষয়ক তৃতীয় স্টার্ট চুক্তি স্থগিত করলেন। অবশ্য বাতিল করেননি। বাতিলের কালচার (ক্যানসেল কালচার) সাধারণত মার্কিনি এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। পারমাণবিক বলটা এখন মার্কিনি কোর্টে। জুনিয়র বুশ এক দফায় স্টার্ট চুক্তির দফারফা করেছিলেন। ট্রাম্প এক দফায় আইএনএফ চুক্তি বাতিল করেছিলেন। আরেক দফায় ট্রাম্প (ইসরায়েলি উসকানিতে) ইরানের পরমাণু চুক্তি (জেসিপিওএ) থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। বলা যায় মার্কিনি পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে ‘ঘ্যাচাং ফু’! ইমপেরিয়াল ম্যাডনেসে আক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্র।
বাইডেন ইউক্রেনে যেতে পারলেন কিন্তু ওহাইও’র ট্রেইন ডিরেইলমেন্টের (ট্রেইন লাইনচ্যুত হওয়ার) জায়গায় যেতে পারলেন না। প্রায় ৪৪ হাজার প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে ওই ঘটনায় প্রায় ৫ মাইল এলাকাজুড়ে বিষাক্ত রাসায়নিক বিক্রিয়ায়। ভয়ংকর বিপর্যয়। নিজ দেশের দুর্যোগের এলাকায় যাওয়ার সময় তার নেই। কিন্তু ইউক্রেন সফরের সময় আছে। সমালোচকরা বলছে, ২০২৪-এর নির্বাচনে জনসমর্থন বাড়ানোই ইউক্রেন সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল। ইউক্রেন রসাতলে না পাতালে গেল তা বিবেচনার বিষয় ছিল না। এ কথাও বলা হচ্ছে, দেশের অভ্যন্তরে বড় একটি দুর্ঘটনাস্থল এড়িয়ে গিয়ে জনসমর্থনকে তিনি কার্যত ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। বাইডেনের সফরের সময়েই ওয়াশিংটনে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সমাবেশ তেমন বড় ছিল না। হাজার তিনেক লোক ছিল। কিন্তু তাতে জড়ো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, পাবলিক ফিগার এবং সাংবাদিক। সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী তুলসি গ্যাবার্ড, গ্রিন পার্টির সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জিল স্টাইন, সাবেক কংগ্রেসম্যান ডেনিস কুচিনিচ, পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক সিমুর হার্শ, বর্ষীয়ান কংগ্রেসম্যান এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রন পল। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ এবং ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা বন্ধ করার দাবিই এ সমাবেশের মূল দাবি ছিল। ইউক্রেনে নয় বরং দেশের অভ্যন্তরে বেশি নজর দেওয়ার কথা বলেছেন তারা।
যুদ্ধে রাশিয়া ‘যুদ্ধাচরণ’ করছে বটে, তবে পশ্চিমারা বলছে, বেসামরিক লোকদের এবং সামরিক লোকজনকেও নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু সবাই, পাশ্চাত্যের প্রেস্টিটিউট ছাড়া, জানে যে, এ যুদ্ধ শুরুর আগে ২০১৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত দনবাসের ১৪ হাজার লোককে হত্যা করেছে ইউক্রেন। চলমান যুদ্ধে কত লোককে হত্যা করেছে তা এখনো সঠিকভাবে নির্ণীত নয়। রাশিয়া ছাতু করছে বটে, তবে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে; হত্যা করছে বটে, তবে সামরিক ব্যক্তিবর্গকে। যুদ্ধের ফলে রাশিয়ায় এবং ইউরোপে লাখ লাখ লোক উদ্বাস্তু হয়েছে। ১৯৯১ সালে পৃথগ্নতার পর (ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য হিসেবেই জাতিসংঘের সদস্য ছিল। তার নতুন করে স্বাধীন হওয়ার কিছু নেই।) জিডিপি বাড়েনি। ইউক্রেন আইএমএফের তৃতীয় বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা এবং ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ। সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়াকোভিচ বরং কড়া শর্তের কারণে আইএমএফের ঋণ নিতে অস্বীকার করেছিলেন। তার বিরুদ্ধেই ময়দান অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। রাশিয়াকে এসবের জন্য দায়ী করা চলে না। যুদ্ধকেও দায়ী করা যায় না। কারণ এর সবই ২০১৪ সালের আগের ইতিহাস।
ইউক্রেন ভয় পাচ্ছে মার্কিনিরা না আবার রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য চাপ দেয়! ২১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’ স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন ভøাদিমির পুতিন। তিনি ইউক্রেনযুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের দায়ী করেছেন। বলেন, রাশিয়াকে ধ্বংস করতে বিশ্বযুদ্ধ বাধাতে চায় তারা। বৈশ্বিক সমস্যা তাতে বরং আরেক দফা বাড়ল। এখন সিদ্ধান্তটা যুক্তরাষ্ট্রকেই নিতে হবে। তবে ২৪ ফেব্রুয়ারিতেই চীন ইউক্রেনে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে ১২ দফার একটি প্রস্তাব দিয়েছে। ওয়াশিংটনকে হয় কোনো নতুন বোজোর সন্ধান করতে হবে অথবা শান্তি স্থাপনে সায় দিতে হবে। কী হবে!
লেখক: সাংবাদিক
বিষয়টা কিছু মানুষের মজ্জাগত। ভয়াবহ আত্মকেন্দ্রিক এসব মানুষ, অন্যের কথা ভাবেন না। মনে করেন, নিজের উন্নতি মানেই দেশের উন্নতি। তাদের পদযুগল সামনে হাঁটে না। কিন্তু চিন্তার পদে হয়, উল্লম্ফন। যে কারণে, সেই মানুষ হরিণের মতো পাতার ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে বসে থাকেন। ভাবেন, কেউ তাকে দেখে না। অথচ চোখ অন্ধকারে রেখে, উদোম শরীর যে বাইরে রেখেছেন সেই খেয়াল নেই। শুধু তা-ই না। মনে করেন, তার অপকীর্তির কথা কেউ জানবে না। এদিকে, বিষয়টা যে শৃঙ্খলা, আইন ও নীতিবিরুদ্ধ সেটিও ভুলে যান। সাধারণ মানুষ যখন অর্বাচীনের মতো কাজ করে, মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন নীতিবিরুদ্ধ কাজে নিজেকে সচেতনভাবে সম্পৃক্ত করেন, তখন বিস্মিত হতে হয়। না হলে কি আর আইননীতির তোয়াক্কা না করে নিজের উন্নতিতে নিজে সম্পৃক্ত হন?
রবিবার দেশ রূপান্তরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ‘নিজেরাই পদোন্নতি দিচ্ছেন নিজেদের’ শিরোনামের সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, শিক্ষক নিয়োগ-সংক্রান্ত বিধি ভেঙে দুই শিক্ষক নেতাকে সহযোগী অধ্যাপক (গ্রেড-৪) বানাতে নানা আয়োজন করছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) কর্র্তৃপক্ষ। শিক্ষকরা হলেন লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের প্রচার, প্রকাশনা ও দপ্তর সম্পাদক সাব্বীর আহমেদ চৌধুরী এবং একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বেরোবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ। তারা দুজনই আবার নিয়োগ-সংক্রান্ত প্ল্যানিং কমিটির সদস্য। তারা নিজেরাই নিজেদের যোগ্য ঘোষণা করেছেন।
গতকাল রাতে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদ কথা বলতে রাজি হননি। জনসংযোগ উপপরিচালক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিধি ভেঙে প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য ডাকা হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। প্ল্যানিং কমিটির সদস্যরা ভালো বলতে পারবেন।’ সংবাদে আরও জানা যায়, জানা গেছে, লোকপ্রশাসন বিভাগের দুটি সহযোগী অধ্যাপকের শূন্যপদে চারজন প্রার্থী আবেদন করেছেন। তাদের তিনজন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তারা হলেন লোকপ্রশাসন বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. জুবায়ের ইবনে তাহের, মো. আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ এবং সাব্বীর আহমেদ চৌধুরী। বেরোবির শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী তাদের কেউই সহযোগী অধ্যাপকের শূন্যপদে আবেদনের যোগ্য নন। তবে অভ্যন্তরীণ শিক্ষক পদ আপগ্রেডেশন নীতিমালা অনুযায়ী শুধু জুবায়ের ইবনে তাহের সহযোগী অধ্যাপক পদে আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদের সর্বসাকল্যে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আট বছর এক মাস ৯ দিন এবং সাব্বীর আহমেদ চৌধুরীর চাকরিকাল আট বছর এক মাস আট দিন। তাদের কারোরই পিএইচডি বা এমফিল ডিগ্রি না থাকায় বর্তমান অভিজ্ঞতায় তারা সহযোগী অধ্যাপক পদে আবেদনের যোগ্য হননি। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, শূন্যপদে আবেদন করা অপর প্রার্থী ড. মো. রুহুল আমিন। তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তার সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ১২ বছরের বেশি। ২০টি গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে তার। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্থাপন শাখা থেকে জানা গেছে, প্রার্থীদের মধ্যে যে তিনজন বেরোবির তারা প্ল্যানিং কমিটিরও সদস্য। তারা আবেদনকারী চার প্রার্থীকেই সহযোগী অধ্যাপকের শূন্যপদে যোগ্য মনোনীত করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, শর্ত শিথিল করে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগের ব্যাপারটি জানেন ভিসি অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ।
প্রকাশিত সংবাদে আরও বলা হয়েছে যোগ্যতা অর্জনের আগেই বিধি ভেঙে দুজন জুনিয়র শিক্ষককে সহযোগী অধ্যাপক করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক তাদের জ্যেষ্ঠতা হারাবেন। অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি শিথিল করে শিক্ষক নিয়োগের নজির বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। এমন ঘটনা আগেও হয়েছে। সেই অসততা, দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তির সঠিক বিচার হলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। পদোন্নতির বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ নেই। যোগ্য মানুষ যোগ্যতম স্থানে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক বিষয় হয় তখনই, যখন যোগ্যতার তোয়াক্কা না করে জুনিয়র হয়ে যান সিনিয়র। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দরকার।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রোজার মাসে খাবারের জন্য শরীফুল আলমের বাজেট ১২ হাজার টাকা। পাঁচ দিনের বাজার করতে গিয়ে তিনি দেখেন, মাছ কিনলে মুরগি কেনা যায় না, মুরগি কিনলে মাছ বাদ দিতে হয়। গরুর মাংস তো বিলাসী খাবার, তাই সে দোকানে নজরই দেননি তিনি। পাঁচ দিনের মধ্যে তিন দিনই তার পরিবারকে মাছ-মাংসের মতো প্রোটিন খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। আর ইফতারিতে উচ্চ মূল্যের বিদেশি ফল বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি আগেই নিয়েছেন। শুধু শরিফুলই নন, বাজার করতে আসা নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন আয়ের সব ভোক্তারই একই গল্প। তারা বলছেন, এবারের রমজানে কম খেয়েই রোজা রাখতে হবে।
গত এক বছরে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। প্রায় একই হারে বেড়েছে পাকিস্তানি ককসহ অন্যান্য মুরগির দাম। সব ধরনের মাছের দাম গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
একটু সাধারণ হিসাব করা যাক। চারজনের একটি পরিবার যদি মাছ, মাংস বাদ দিয়ে সাহরিতে গড়ে ২০০ টাকা, সন্ধ্যা রাতের খাবারে যদি গড়ে ১৫০ টাকা আর ইফতারিতে ফল যোগ না করে গড়ে যদি ১০০ টাকা খরচ করেন তবে মাসে ব্যয় হবে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর যদি মাছ-মাংস যোগ হয় তাহলে সাহরিতে ন্যূনতম ৩০০, রাতের খাবারে ৩০০ ও ইফতারিতে ফল যোগ করলে গড়ে ২০০ টাকা খরচ করলে মাসে খরচ হবে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। এ হিসাব চারজনের একটি পরিবারের সর্বনিম্ন হিসাব। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গত অক্টোবরের হিসাবে বলা হয়েছে, চারজনের একটি পরিবারে খাবার তালিকায় মাছ-মাংস যোগ করলে মাসে খরচ হবে ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এটি শুধু খাবারের খরচ। যদি কোনো পরিবার মাছ-মাংস যোগ না করেন তাতে মাসিক খরচ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৯ টাকা।
সিপিডির গবেষণা সেলের কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, চলতি মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। পরিবারপ্রতি এ মাসে খরচ আরও বেড়ে গেছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিচ্ছি আমরা। কিছু ক্ষেত্রে ট্যাক্স ভ্যাট পুরোপুরি উঠিয়ে দিলে সেখানে সবাই উপকৃত হবে।
সিপিডির অক্টোবরের হিসাবই যদি ধরা হয়, তাহলে এবারের রোজায় খাবারের তালিকা ছোট করা ছাড়া উপায় নেই ভোক্তাদের। ২২ হাজার টাকার সঙ্গে যদি বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ভাড়াসহ গড়ে ১৫ হাজার টাকা ধরলে চারজনের একটি পরিবারের খরচ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার টাকা।
অবশ্য সিপিডির এ তথ্য যখন প্রকাশ করা হয়, তখন মুরগির মাংসের কেজি ছিল ১৫০ টাকা, এখন তা ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে। গরুর মাংসের দাম ছিল ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায়, এখন তা ৭৫০ টাকায়। চিনির দাম ছিল ৯৮ টাকায় এখন তা ১২২ টাকায়। অর্থাৎ সব পণ্যেরই দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন ভোক্তার। বেসরকারি স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিন থাকেন রাজধানীর বাড্ডায়। থাকেন ৩ কামরা একটি ফ্ল্যাটে। তার মাসিক খরচ ৩১-৩২ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু মাত্র বাসা ভাড়ায় খরচ হয় ১৬ হাজার টাকা। একমাত্র সন্তানের পড়া ও পরিবারের ভরণ-পোষণে খরচ হয় আরও ১৩-১৫ হাজার টাকা। বাদ বাকি খরচ আরও ২ হাজার। তবে এই শিক্ষক মাসে আয় করেন ২৮-৩০ হাজার টাকা। মাসিক আয় হিসেবে তার অতিরিক্ত খরচ হয় ২-৩ হাজার টাকা।
এ শিক্ষক খরচের সমন্বয় করতে সঞ্চয়ও ভেঙেছেন ইতিমধ্যে। তাতেও তার বাড়তি খরচের টাকা প্রতি মাসে ঋণের খাতায় যোগ হয়। উপায়ান্তর না দেখে পরিচয় গোপন করে মাঝেমধ্যে রাইড শেয়ার দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলাম মহাখালীতে। ভাবলাম একই সঙ্গে রোজার বাজার করে বাসাই ফিরি। তবে বাজারে প্রবেশ করে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, ১ কেজি করে মুরগি, মাছ ও ছোলাসহ আরও দুএকটি পণ্য কিনতেই ১ হাজার টাকা শেষ। দামের অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে চাহিদা মতো বাকি সদাইগুলো বাসায় নিয়ে যেতে পারব না। আর নয়তো অর্ধেকের ওপর ভরসা রাখতে হবে।
শুধু স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিনই নন, গেল কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ অবস্থার কারণে মধ্য ও নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্যের বাজার। মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজির দামও মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গরিবের মাছ বলে খ্যাত পাঙ্গাস, তেলাপিয়াও এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়। গত ৩-৪ মাস আগেও পাঙ্গাস ১৪০-১৪৫ টাকা ও তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হয়েছিল ১৩৫-৪০ টাকা করে। এছাড়া অন্যান্য মাছের মধ্যে মান ভেদে রুই মাছ ২৯০-৩৮০ টাকা, সরপুঁটি ২০০-৪০০ টাকা, চাষের মাগুর ৬০০ টাকা, শোল মাছ ৮০০ টাকা, গলদা চিংড়ি ১ হাজার টাকা করে বিক্রি করছেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
দ্রব্যমূল্য যে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, তা শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদারও বলছেন। গত বুধবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের কোনো মিল নেই। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ব্যবসা করছে। ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই দেখা যায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। যদিও গত মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, চলতি মার্চে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। চৈত্রের খরা ও রোজায় মানুষের অতিরিক্ত মজুদের কারণে এ মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কার কথা বলেছেন তিনি।
বিবিএসের চিত্রেই আবার ফেরা যাক। গত বছর চিনির কেজি ছিল ৮২ টাকা, সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২২ টাকায়। যদিও বাজারের চিত্র ব্যতিক্রম। গরুর মাংস গত বছরের মার্চে কেজি ছিল ৬১০ টাকা, কিন্তু বছর ঘুরতেই এ পণ্যের দাম এখন ৭৫০ টাকা। মানুষ বেশি দামে গরুর মাংস কিনতে না পেরে কিছুদিন আগেও ভরসা করত ব্রয়লার মুরগির ওপর, যার দাম এখন ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে।
রমজানের ইফতারিতে বেশি চাহিদা থাকে ফলের ওপর। কিন্তু সেই ফলের দামও লাগামছাড়া। ডলার সংকটের কারণে ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ফলের ওপর শুল্কারোপ বাড়িয়ে দেয় সরকার। ফলে গত কয়েক মাস ধরেই ফলের দাম অনেক বেশি।
সাহরিতে রোজাদারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর অন্যতম উপাদান দুধ। গত বছরের মার্চে দুধের লিটার কিনতে হয়েছিল ৭০ টাকায়, এ বছর তা ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটা প্রভাব রয়েছে। তবে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছি বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তিনি বলেন, রমজানের ভোক্তা পর্যায়ে ভোগান্তি কমাতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। মাঠ পর্যায়ে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যেখানে অনিয়ম পাচ্ছি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিছুটা দায়ী। কিন্তু পুরোপুরি না। সম্পূর্ণ দায় এ যুদ্ধের ওপর চাপানো ঠিক না। ভোক্তাদের দায় বেড়েছে, তাদের ওপর চাপও বেড়েছে।
সিন্ডিকেশন করে মুরগির বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে মাত্র ৫২ দিনে বড় উৎপাদকদের একটি চক্র ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের অন্য একটি সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন গতকাল বৃহস্পতিবার এ অভিযোগ করে। এদিকে মুরগির দাম নিয়ে ‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। অন্য এক মতবিনিময় সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম না কমালে তা তারা বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবেন। রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সরকারি তদারকি না থাকায় হরিলুট চলছে পোলট্রি সেক্টরে। প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম ও প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে উৎপাদন কমায় এখন দুই থেকে আড়াই হাজার টন সরবরাহ হচ্ছে। প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ আগে কম থাকলেও এখন প্রতি কেজিতে ১৬০-১৬৫ টাকা এবং করপোরেট কোম্পানিদের উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকা। কিন্তু পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত।
সংগঠনটি জানিয়েছে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজিতে যদি অতিরিক্ত ৬০ টাকা মুনাফা ধরা হয় তবে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার টনে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫২ দিনে শুধু ব্রয়লার মুরগি থেকে ৬২৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ সিন্ডিকেট। এ ছাড়া এক দিনের মুরগির বাচ্চা প্রতিদিন উৎপাদন হয় ২০ লাখ। একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। যা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ১০-১৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সেই বাচ্চা ৬২ থেকে ৬৮ টাকা মেসেজ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা বিক্রয় হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। প্রতি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা ধরা হলে আলোচ্য সময়ে মুরগির বাচ্চা বিক্রি থেকে ৩১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চা বিক্রি থেকেই ৫২ দিনে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শীর্ষ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পোলট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চা শতভাগ উৎপাদন করে করপোরেট গ্রুপ। তারাই আবার আংশিক ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে এবং চুক্তিভিক্তিক খামার করেন। এতে বাজার এসব প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাচ্ছে।
ব্রয়লার মুরগির দাম কমল ৪০ টাকা : ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণে শীর্ষ উৎপাদনকারী ফার্মগুলো নতুন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোজার মাসে ভোক্তা পর্যায়ে অস্বস্তি কমাতে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি খামারি পর্যায়ে ১৯০-১৯৫ টাকা দরে বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় চারটি মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যা গেল কয়েক সপ্তাহে ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি হয়ে আসছে। হাতবদল হয়ে এসব মুরগি ভোক্তাপর্যায়ে এসে বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৮০ টাকায়।
‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত এই চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত জাতীয় ভোক্তা অধিকারের কনফারেন্স কক্ষে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস ও সিপি বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, গতকাল আমরা ২৭০-২৮০ টাকায় ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতে দেখেছি। এ দাম অযৌক্তিক। এটা ২০০ টাকার বেশি হতে পারে না। ফার্ম পর্যায়ে ২২০-২৩০ টাকা দরে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে। হাতবদল হয়ে ভোক্তাপর্যায়ে এ অবস্থা। ব্রয়লার মুরগি এসএমএসের মাধ্যমে নিলাম হচ্ছে। আমি তাদের আহ্বান করেছি, আপনারা এ রমজান মাসে একটু কম লাভ করেন। তারা একমত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, খামার থেকে আসা ব্রয়লার মুরগি হাতবদলে যেন দাম খুব বেশি না বাড়ে, সে বিষয়ে সংস্থাটি নজর রাখবে। ব্রয়লারের দাম কমাতে প্রয়োজনে বর্ডার উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
এ সময় কাজী ফার্ম কর্তৃপক্ষ জানান, তারা রমজানে ২২০ টাকা থেকে কমিয়ে ব্রয়লার বিক্রি করবেন ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়। এ বিষয়ে একমত পোষণ করছে আফতাব, প্যারাগন ও সিপি কোম্পানি।
রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে : মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বাড়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে আগামী দুই-তিন মাসের জন্য মুরগি ও গরুর মাংস বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবে সংগঠনটি। গতকাল এফবিসিসিআই বোর্ডরুমে ‘রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি, মজুদ, সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায়’ এ কথা জানানো হয়। এ সময় সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশীয় উৎপাদক, ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার কিছু পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ ও কিছু পণ্য আমদানি বন্ধ রেখেছে। এ সুযোগে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ালে হবে না। ভোক্তার ওপর এত চাপ দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় বেশি খেজুর আছে। পর্যাপ্ত রয়েছে ছোলা, পামঅয়েল, সয়াবিনসহ অন্যান্য পণ্য। আমরা চাই না ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের হেনস্তা করুক। পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও মজুদ বিষয়ে সরকারের নিয়মনীতি রয়েছে। এসব বিষয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে বাজার কমিটিগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হলে আমাদের জানান, আমরা সহযোগিতা করব।
জসিম উদ্দিন বলেন, এখন গরু ও পোলট্রির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। দেশীয় এ খাত বাঁচাতে এতদিন মাংস আমদানি বন্ধ ছিল। এখন তারা যদি সঠিক মূল্যে গরুর মাংস ও ব্রয়লার মুরগি দিতে না পারে তাহলে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলব, বাজার ঠিক রাখতে আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য। আমদানি করলে যদি বাজারে দাম কমে যায়, তাহলে আমদানি করতে হবে। মানুষ যদি ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে না পারে, তাহলে ইন্ডাস্ট্রির কথা চিন্তা করে লাভ নেই।
এফবিসিসিআই সভাপতি ব্যবসায়ীদের বলেন, এবার সরকার বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে কঠোরভাবে। কোনো বাজারে বেশি মূল্য রাখা হলেই সেই বাজার কমিটি বাতিল করবে সরকার। একই সঙ্গে দাম বেশি নেওয়া প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও বাতিল করা হবে। আমরা চাই না, রোজায় কোনো ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল হোক, কাউকে আটক করা হোক।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের সমস্যা থাকতে পারে। সমস্যাটি আমাদের জানাবেন। আমরা কথা বলব। আমাদের টিমও বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে। আশা করব আপনারা কেউ বেশি মুনাফা করবেন না।
কয়েক দফা বাড়ার পর রমজানের প্রথম দিন কিছুটা কমেছে মুরগির দাম। শুক্রবার (২৪ মার্চ) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমনটা দেখা গেছে। এ ছাড়াও গতকাল শীর্ষ চার পোল্ট্রি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানকে তলব করে ভোক্তা অধিকার। পরে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় মুরগির দাম।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা কমে ২৪৫-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোনালির দাম ২০ টাকা কমে ৩৬০ টাকায়, আর দেশি মুরগি ৬৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলত চাহিদা কমে যাওয়ায় দাম কমেছে। তারা জানান, আগের তুলনায় তাদের বিক্রি কমে গেছে। এ অবস্থায় দাম আরও কমতে পারে বলে জানান তারা।
আর ক্রেতারা বলছেন, এখনও তাদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে মুরগি ও ডিম।
এদিকে, বাজার তদারকিতে সকাল থেকে অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। রোজার প্রথম দিন শুক্রবার (২৪ মার্চ) সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অভিযানে নামে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সকাল সাড়ে ১০টায় এ বাজারের কিচেন মার্কেটে অভিযান শুরু করেন সংস্থার সদস্যরা। অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। উপস্থিত আছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান আব্দুল জব্বার মণ্ডলসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা।
এর আগে, গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুরগির দাম সমন্বয়ের জন্য ডাকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সেখানে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, 'মুরগির দাম ২০০ টাকার বেশি হতে পারে না।'
ব্রাজিলের সমুদ্রতীরবর্তী শহর রিও ডি জেনেইরোর কাছে একটি অপরাধী চক্রের প্রধানের গ্রেপ্তারে অভিযানের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার রিও ডি জেনেইরোর উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সাও গনসালো শহরের শ্রমিকদের আবাসিক এলাকা সালগেইরোতে এ ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ জানায়। পুলিশের দাবি, নিহতরা সবাই সন্দেহভাজন অপরাধী।
ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য পারার মাদক-নেতা অভিযুক্ত লিওনার্দো কোস্তা আরাউজো সালগেইরোতে লুকিয়ে আছে- এমন খবরের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ। সংঘর্ষে নিহতদের মধ্যে আরাউজোও আছেন। পারার বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার নিহতের ঘটনায় তার হাত আছে বলেও অভিযোগ।
পুলিশ জানিয়েছে, আরাউজোকে গ্রেপ্তারে বৃহস্পতিবার চালানো এই অভিযানে হেলিকপ্টার ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করা হয়।
রিও শহরের পুলিশ প্রায়ই এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করে। শহরটির গভর্নর ক্লডিও কাস্টো সোশালে এক পোস্টে লেখেন, আমরা আমাদের এই শহরকে অন্য কোনো এলাকা থেকে আসা দুর্বৃত্তদের অভয়াশ্রম হতে দেব না।
এ ঘটনায় অপরাধী চক্রের স্থানীয় তিনজন সোর্সও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।