
বাঙালি রাজনীতিক ও কবি সরোজিনী নাইডু ১৯৪৯ সালের ২ মার্চ ভারতের এলাহাবাদে মৃত্যুবরণ করেন। পৈতৃক নিবাস বিক্রমপুরের ব্রাহ্মণগাঁও। নাইডুর বাবা ড. অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন হায়দরাবাদের নিজামের শিক্ষা উপদেষ্টা। মা বরোদা সুন্দরী দেবী ছিলেন কবি। সরোজিনী ১৮৭৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের হায়দরাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। মাদ্রাজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ১৮৯৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান সরোজিনী। ১৮৯৮ সালে হায়দরাবাদের ড. মতিয়ালা গোবিন্দরাজলু নাইডুর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯১৫ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি ১৯১৬ সালে বিহারে নীলচাষিদের অধিকারের দাবিতে প্রচারাভিযানে অংশ নেন। ১৯১৭ সালে নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে অ্যানি বেসান্তকে সভাপতি করে উইমেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হলে নাইডু এই সংগঠনের সদস্য হন। ১৯২৬ সালে অল ইন্ডিয়া উইমেন কনফারেন্স গঠিত হলে সরোজিনী এর সভাপতি নির্বাচিত হন। সরোজিনী ১৯২৮ সালে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের বার্তা নিয়ে আমেরিকা যান এবং আফ্রিকান, আমেরিকান ও ভারতীয় আমেরিকানদের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদ জানান। ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৩১ সালে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের জন্য তাকে আবার গ্রেপ্তার করে ২১ মাস কারান্তরীণ রাখা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ভারতের উত্তরপ্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। সরোজিনীর আজীবন কর্মসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার সরোজিনী নাইডু স্বর্ণপদক প্রবর্তন করেছে।
পূর্ববঙ্গ থেকে যখন স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা হয় তখন যুক্তি হিসেবে পাকিস্তানে দুই অংশের ভেতরকার আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্বের যুক্তি তো থাকেই, ১৯৪০ সালে গৃহীত যে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সেই প্রস্তাবের কথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। লাহোর প্রস্তাবে পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছে যে, প্রস্তাবিত রাষ্ট্রটি এককেন্দ্রিক হবে না, এর থাকবে দুটি অংশ, একটি ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমে অপরটি উত্তর-পূর্বে; দুটি অংশই হবে ‘স্বাধীন’। জোর দিয়েই বলা হয়েছিল যে, constituent states shall be autonomous and sovereign। অর্থাৎ তারা কেবল যে স্বায়ত্তশাসিত হবে তা-ই নয়, তাদের ‘সার্বভৌমত্ব’ও থাকবে। তখন পাকিস্তান ছিল একটা ধারণা।
কিন্তু ১৯৪৬ সালে যখন দেখা গেল ধারণাটির বাস্তবায়ন ঘটতে যাচ্ছে তখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ইচ্ছানুসারে এবং তার নিকটস্থ ব্যক্তিদের সমর্থন অনুযায়ী ব্যবস্থাপক পরিষদসমূহের সদস্যদের এক সম্মেলনে প্রস্তাবটি সংশোধন করে নিয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জায়গাতে একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের কথা বসিয়ে দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করেন। পাকিস্তানের জন্য জিন্নাহ সাহেব প্রাণপাত করছেন, অথচ তিনি শাসনকর্তা হবেন শুধু একটি অংশের, এটি কেমন কথা। তিনি অখণ্ড পাকিস্তান চাইলেন, নেহরু যেমন চাইছিলেন অখণ্ড ভারত। আদি প্রস্তাবের সংশোধনীটি তিনি উত্থাপন করিয়ে নিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়েই, যিনি তখন কেবল যে বাংলার প্রধানমন্ত্রী তাই নন ভারতবর্ষে একমাত্র পাকিস্তানপন্থি প্রধানমন্ত্রীও বটে। ইতিহাসের কৌতুক এখানেও যে, মূল নায়ক, কুশলী জিন্নাহ আদি প্রস্তাবটি উত্থাপন করিয়েছিলেন যাকে দিয়ে তিনি, এ কে ফজলুল হকও ছিলেন বাংলার তখনকার প্রধানমন্ত্রী, এবং যাকে দিয়ে তিনি সেই প্রস্তাবকে সংশোধনের মাধ্যমে কিম্ভূতরূপে বিকৃত করার প্রস্তাব উত্থাপন করালেন সেই সোহরাওয়ার্দীও ছিলেন বাংলারই প্রধানমন্ত্রী।
শুধু তাই নয়, আরদ্ধ কর্মটি সম্পাদিত হওয়ার পর ‘শেরে বাংলা’ ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দুজনেই পেয়েছিলেন একই রকমের সমাদর। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকালীনই ফজলুল হককে নানাভাবে অপদস্থ করে বাংলার প্রধানমন্ত্রিত্ব ও মুসলিম লীগে তার অবস্থান, দুজায়গা থেকেই ঠেলে-ধাক্কিয়ে বের করে দেওয়া হলো। এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে সোহরাওয়ার্দীকে প্রায় একই ভাবে নতুন রাষ্ট্রের পূর্বাংশের প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে তো অবশ্যই, এমনকি গণ-পরিষদের সদস্য পদ থেকেও বঞ্চিত করা হলো। পাকিস্তানের কোনো-অঞ্চলেরই-বাসিন্দা নন, এই কারণে পাকিস্তানের নতুন শাসকদের মধ্যে যাদের পক্ষে গণপরিষদের সদস্য থাকার উপায় ছিল না, এমন ছয়জনকে পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্যদের কোটা থেকে গণপরিষদে পাঠানো হলো।
এদের মধ্যে নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান ছিলেন প্রধান; যিনি পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন, এবং হওয়ার পরপরই পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন কীভাবে ও কতটা পরিমাণে হরণ করা যায় সে কাজে তৎপর হয়ে উঠলেন। অখণ্ড বাংলাকে যে বিভক্ত করা হয়েছে তার দায়িত্ব অনেকেরই, কিন্তু প্রধান অপরাধী হচ্ছে কংগ্রেসের অভ্যন্তরের হিন্দু মহাসভাপন্থিরা। অবাঙালি পাকিস্তানপন্থিরা বাংলার সবটা না-পাওয়াতে অসন্তুষ্ট হয়েছিল অবশ্যই, কিন্তু কে জানে ভেতরে ভেতরে এইটুকু ভেবে স্বস্তি পেয়েছিল কি না যে কলকাতাকে না-পাওয়াতে মন্দের ভালো হয়েছে, কেননা ভারতবর্ষের ওই দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরটি পাকিস্তানে এলে সেটাকেই হয়তো রাজধানী করবার দাবি উঠত। তবে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথার্থ কোনো কারণ ছিল না, কারণ বাংলার মুসলিম লীগে এমন কোনো নেতা তখন ছিলেন না যিনি শক্তভাবে অমন দাবি তুলতে পারতেন।
সে যাই হোক, স্বাধীন হওয়ার পরপরই টের পাওয়া গেল যে পূর্ব বাংলা পাঞ্জাবশাসিত পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হতে চলেছে। সে জন্যই দাবি উঠেছে স্বায়ত্তশাসনের, এবং ওই দাবিকে যৌক্তিক দিক দিয়ে জোরদার করবার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে আদি লাহোর প্রস্তাবের। বলা হয়ে থাকে যে, মুসলিম লীগের নেতাদের স্বার্থান্বেষী ও স্বেচ্ছাচারী আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমপন্থিরাই উদ্যোগ নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে তৎপরতাটা সোহরাওয়ার্দীপন্থিদের তুলনায় হাশিমপন্থিদের দিক থেকেই ছিল অধিক উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, সোহরাওয়ার্দী নিজে পূর্ববঙ্গকে নয়, পশ্চিম পাকিস্তানকেই তার কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন; দ্বিতীয়ত, তিনি সেখানে গিয়ে জিন্নাহ-আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি দল গঠন করেছিলেন এবং আশা করছিলেন পূর্ববঙ্গে তার একটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হবে।
অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে যে তরুণরা উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন শামসুল হক, যাকে দলের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়; এবং মতাদর্শিকভাবে শামসুল হক ছিলেন আবুল হাশিমের রব্বানিয়াত দর্শনের অনুসারী। নতুন দলের ঘোষণাপত্রটি শামসুল হকই লিখে থাকবেন, কারণ তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাকিস্তান খেলাফত বা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র হবে এবং আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতা ও প্রভুত্বের অধিকারী হবে। এটি রব্বানিয়াত দর্শনেরই কথা। তবে ‘মূলদাবি’ হিসেবে শামসুল হক যে লাহোর প্রস্তাবের কথা বলেছেন সেটা আরও অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। তার মতে, লাহোর প্রস্তাব ‘সর্বকালের সর্বযুগের সর্বদেশের যুগপ্রবর্তক ঘটনাবলির ন্যায় একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে।” মনে হচ্ছে উদ্যোগীদের দৃষ্টিতে লাহোর প্রস্তাব ছিল একটি মহাবৈপ্লবিক ঘটনা। তবে, তাদের মতে, মুসলিম লীগ নেতৃত্বের অপরাগতার দরুন ওই বিপ্লবের লক্ষ্যগুলো অর্জন করা যেহেতু সম্ভব হয়নি তাই মুসলিম লীগকে “স্বার্থান্বেষী মুষ্টিমেয় লোকদের পকেট হইতে বাহির করিয়া সত্যিকারের জনগণের মুসলিম লীগ হিসেবে গড়িয়া তোলা আবশ্যক।” অর্থাৎ কিনা লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন চাই।
নতুন সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী, এর আগে যিনি আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন, এবং মনেপ্রাণে যিনি লাহোর প্রস্তাবের ‘দুই পাকিস্তান’ নীতিতে বিশ্বাস করতেন। যে-মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় সেটির আহ্বান করা হয়েছিল ভাসানীর নামেই; যার প্রতিক্রিয়াতে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) ও অন্য কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে এক বিবৃতিতে জানান যে, “মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাহেবের দ্বারা আগামী ২৩শে ও ২৪শে জুন তারিখে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন নামে যে সভা আহূত হইয়াছে, তাহার সহিত মুসলিম লীগের কোনো সম্পর্ক নাই।
বস্তুত ইহা দলগত স্বার্থ ও ক্ষমতা লাভের জন্য মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির দ্বারা মুসলমান সংহতি নষ্ট করিয়া পাকিস্তানের স্থায়িত্ব ও অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আহূত হইয়াছে।”
নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মতো ‘প্রাদেশিক’ ছিল না; ছিল লাহোর প্রস্তাবে যে ধারণা ব্যক্ত হয়েছিল কল্পনার সেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি সংগঠন। মওলানা ভাসানী অবশ্য সোহরাওয়ার্দীকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। সেটা এই লক্ষ্যে যে সারা পাকিস্তান জুড়ে সংগঠনের বিস্তার ঘটলে মুসলিম লীগের বিরোধী শক্তি হিসেবে এর শক্তি বৃদ্ধি পাবে। সোহরাওয়ার্দী তখন থাকতেন লাহোরে, ভাসানী শেখ মুজিবকে লাহোরে পাঠিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী এবং সম্ভব হলে মিয়া ইফতেখারউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। সেটা ১৯৪৯-এরই ঘটনা।
এর পরে ১৯৫২-তে মুজিব আবার পশ্চিম পাকিস্তানে যান; একই উদ্দেশ্যে; সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে। সোহরাওয়ার্দী তখন তাকে জানান যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষে পশ্চিমে-গঠিত জিন্নাহ-আওয়ামী মুসলিম লীগের এফিলিয়েশন নেওয়া দরকার। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘তিনি বললেন, একটা কনফারেন্স ডাকব, তার আগে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এফিলিয়েশন নেওয়া দরকার।’ জবাবে শেখ মুজিব তখন তাকে যা বলেছিলেন, ‘আপনি জিন্নাহ আওয়ামী লীগ করেছেন, আমরা নাম পরিবর্তন করতে পারব না। কোনো ব্যক্তির নাম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগ করতে চাই না। দ্বিতীয়ত আমাদের ম্যানিফেস্টো আছে, গঠনতন্ত্র আছে, তার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। মওলানা সাহেব আমাকে ১৯৪৯ সালে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তখনো তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তারও কোনো আপত্তি থাকবে না যদি আপনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র মেনে নেন। অনেক আপত্তির পর তিনি মানতে রাজি হলেন এবং নিজ হাতে তার সম্মতির কথা লিখে দিলেন।’
মুজিব লিখেছেন, ‘আমি আর এটাও অনুরোধ করলাম তাকে লিখে দিতে যে, উর্দু ও বাংলা দু’টোকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তিনি সমর্থন করেন। কারণ অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ ও তথাকথিত প্রগতিশীলরা প্রপাগান্ডা করছে তার বিরুদ্ধে। [...]’
লাহোর প্রস্তাবের রাজনৈতিক মর্মবস্তুতে অবশ্য আরেকটি জিনিস ছিল, সেটি হলো দ্বিজাতি তত্ত্ব। ভারতবর্ষের মুসলমানরা একটি অভিন্ন ও স্বতন্ত্র জাতি, এই ধারণার ওপর দাঁড়িয়েই লাহোর প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে জাতীয় সত্তার প্রধান ভিত্তি হচ্ছে ধর্ম। সেটা যে সত্য নয়, প্রধান ভিত্তি যে ভাষা সেটা তো অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বের হয়ে এসেছিল বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়েই। সোহরাওয়ার্দী কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের ওই মর্মবস্তুটিকে কখনোই খারিজ করে দেননি; জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দ্বিজাতি তত্ত্বকে তিনি সত্য বলে জেনেছেন, যে জন্য পাকিস্তানকে ভাঙা নয়, তাকে রক্ষা করার কাজেই তিনি সচেষ্ট ছিলেন।
১৯৬২ সালে আইয়ুব খান যখন তাকে কারারুদ্ধ করে তখন তার বিরুদ্ধে প্রধান যে অভিযোগ আনা হয়েছিল সেটি হলো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই, ‘বিশেষ করে গত তিন বছর ধরে, তিনি ভেতরের ও বাইরের পাকিস্তান-বিরোধীদের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন।’ অভিযোগনামার জবাবে জেলখানা থেকেই সোহরাওয়ার্দী যে জোরালো চিঠিটি লিখেছিলেন তাতে তিনি বলেছেন যে, এই অভিযোগ পড়ে তিনি যারপরনাই মর্মাহত হয়েছেন। কারণ তিনি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, ‘মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান হচ্ছে এক ও অবিভাজ্য’; এবং এই বিশ্বাসের দ্বারা তাড়িত হয়েই তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছেন এবং এখন বার্ধক্যে এসে পৌঁছেছেন। পূর্ব ও পশ্চিমকে এক সঙ্গে থাকতে হবে এই বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত হয়েই তিনি কাজ করে গেছেন।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নারী একজন গর্ভধারিণী মা জননী, নারী কর্মজীবী একজন সফল মানুষ। তিনি শিক্ষক, নেতা, কর্তা, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী। পরিবারের ভালোমন্দ, অগ্রগতি, শান্তি-শৃঙ্খলার একজন মহান দায়িত্বশীল মানুষ। তাকে ছাড়া পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা করা যায় না।
পরিবারের সুখ-শান্তি-উন্নতি-অগ্রগতির একজন অংশীদার সফল মা। দুনিয়াজুড়ে নারী জাতি, তাদের মেধাশক্তি যোগ্যতা দিয়ে সফলভাবে পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। নারীর শ্রম, মেধা, যোগ্যতা দিয়ে পরিবার ও সমাজ নানাভাবে উপকৃত হচ্ছে। নারী মানুষের কর্মস্থল স্বামী থেকে পরিবার, পরিবার থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে দুনিয়াজুড়ে তাদের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না।
নারীর প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করতে দুনিয়ায় ধর্মগ্রন্থসমূহে গুরুত্বের সঙ্গে নির্দেশনা রয়েছে। নারীকে অবহেলা, অবমূল্যায়ন, ছোট করে দেখা, মোটেও ভালোভাবে দেখা হয়নি। কঠোরভাবে ধর্মগ্রন্থে বলা আছে, মা জাতির প্রতি সুন্দর সদাচরণ করার জন্য। কিন্তু সমাজ সে পথ থেকে বহু দূরে সরে যাচ্ছে।
সেই সাহেবি যুগের চরিত্র এখনো সমাজ পালন করছে। নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান ও মূল্যায়ন করতে পুরুষ সমাজ নানাভাবে ফন্দি আঁটে। নানাভাবে নারী সমাজ তাদের সততা, দক্ষতা, যোগ্যতায় এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, কর্মক্ষেত্রে নারীর দক্ষতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নারী জাতি অত্যন্ত ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। তাদের অবদান পুরুষশাসিত সমাজ যেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার, সেভাবে তারা পাচ্ছে না।
সামাজিকভাবে মাতা-পিতার সম্পদ থেকে, যেভাবে তাদের অধিকার পাওয়ার ন্যায্যতা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে নারীরা এখনো পরিবার ও সমাজ থেকে সে অধিকার বঞ্চিত। নানাভাবে নারী জাতিকে ঠকানোর পরিকল্পনা থাকে, পরিবার ও সমাজ কর্তাদের হাতে। নারী তার অর্থ সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার পাচ্ছেন না।
সমাজে অসংখ্য চিত্র লেখকের সৃষ্টিতে রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সমাজে অসংখ্য পরিবারে দেখছি, নারীর যে অংশ সম্পত্তিতে ‘অধিকার’ হিসেবে ক্ষমতা রাখা রয়েছে, সে অধিকার পুরুষ আত্মীয়রা আত্মসাৎ করছে। অথবা নামমাত্র দিয়ে ঠকিয়ে রেখেছে। নারীদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ঠকাঠকির খেলা, আমার জীবনকালেই দেখে আসছি।
আমরা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করি। নারীর সম্পদের অধিকার সমাজ ও পরিবার দিচ্ছে না। অসংখ্য সংবাদ ও ঘটনা আমার জানা। কিন্তু সমাজকর্তা কিছুই করছে না। রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে গিয়েও তেমনভাবে সুফল পাওয়া যায় না। নানাভাবে ছলচাতুরী করে বঞ্চিত করার সফল নিয়মনীতি বাস্তবায়ন করা দৃশ্যমান একটি সামাজিক ব্যাধি। এ ব্যাধি এখন পরিবার ও সমাজের রক্তে রক্তে ঢুকে গেছে। এ চরিত্র নিয়মিতভাবে অনুশীলন হচ্ছে।
শিক্ষা, সংস্কৃতি চরিত্রে আমরা যতই উন্নতি ও দায়িত্বশীলতার কথা বলি না কেন বাস্তব ক্ষেত্রে নারীর সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে চোখ বন্ধ রেখেছি। চোখ খোলার কোনোই লক্ষণ ও সময় বাস্তবে দেখব বলে মনেও করতে পারছি না। কারণ সম্পত্তির মূল্য দিন দিন যে হারে বাড়ছে, তাতে করে নারী জাতি পিতা, স্বামী, ভাইবোন অথবা অন্য কারও কাছ থেকে যে সম্পদের হিসাব নিতে পারবে, সেটি আমার বিশ্বাসের জায়গায় স্থান পাচ্ছে না।
আমাদের পারিবারিক দায়িত্ববোধ থেকে এ বিষয়টি যত দিন বাস্তবায়ন না করব, সে সময় পর্যন্ত নারী তাদের পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত থাকবে। তাদের পাশে সে বিষয়ে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখছি না। অসহায়ভাবে নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে। মায়া-মমতা, লজ্জায় অনেক মা জাতি সম্পত্তির অধিকার না চাইলেও, তাদের মনের মধ্যে জ¦ালা ও যন্ত্রণার আহামরি দেখা যায়। সমাজের জন্য এটি একটি মারাত্মক অভিশাপ, মারাত্মকভাবে জঘন্য অপরাধ। এ অপরাধকে সমাজ অপরাধ হিসেবে এখনো মনে করছে না।
নারীদের পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার অন্য সদস্যরা আত্মসাৎ করে নীরবে ভোগ করে যাচ্ছে। কঠিন ধরনের অবস্থা সমাজের নানা পরিবারে দেখা যায়। এসব লজ্জাজনক কর্মকাণ্ডের কোনো প্রতিকার এ সমাজে হবে বলে মনে হয় না।
অসহায় অধিকার হারা, মা-বোনরা কীভাবে জঘন্য অনিয়ম ও পারিবারিক জুলুম থেকে রক্ষা পাবে, সেটি তাদের চিন্তা ও সাহসের মধ্যে আসছে না। তাই তারা মজলুম, অসহায় ও নির্যাতিত। বহু নামিদামি মানুষ, জমিদার, চৌধুরী, সিকদার পরিবারে এসব বঞ্চিত করার ইতিহাস অসংখ্যবার সমাজ দেখছে। তারাই সমাজ চালায়, তারাই সমাজের কর্তা। সমাজের নেতৃত্ব তাদের হাতেই।
এটি পরিষ্কারভাবে রাষ্ট্রের কাছে জানা আছে। বর্তমানে নারীরা সমাজের নীতিনির্ধারণী অনেক পদের সঙ্গে যুক্ত, ভাবতে হবে তাদের। পুরুষ ইচ্ছে করে হলেও নারীর সব অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে না।
নিজের অধিকার নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ ও কর্মসূচি নিতে হবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবক্ষেত্রে নারীর ন্যায্য অধিকারপ্রাপ্তি রাষ্ট্রীয়ভাবে করার আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। ঠকিয়ে ঠকিয়ে যেনতেনভাবে মা জাতির সম্পত্তির আত্মসাৎ আর দেখতে চাই না।
পুরুষের পাশাপাশি নারীর সম্পত্তির অধিকার পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হোক। তাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনি সহায়তার পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
পারিবারিকভাবে নিগৃহীত মজলুম অসহায় নারীদের সাহায্য ও কল্যাণে নারী সংগঠনদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
লেখক : কলাম লেখক
সম্প্রতি প্রযুক্তিবিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে, বিশেষ করে চ্যাটজিপিটি’র ব্যবহার শুরু হলে এ নিয়ে যেন আলোচনা থামছেই না। যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের অংশ বেশ কিছুদিন ধরেই। গুগল, অ্যাপেল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, টেসলা ও আলিবাবা’র মতো বড় বড় কোম্পানিগুলো বেশ কিছুকাল ধরেই জোরেশোরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করছে। চ্যাটজিপিটি যেমন একটি সার্চইঞ্জিন বট যে কিনা শুধু তথ্য খুঁজতেই দক্ষ না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আলোকে তথ্যের প্যাটার্ন তৈরি করতেও পারে, এটাই এখন অসীম বিস্ময় সৃষ্টি করছে এবং সংবাদ মাধ্যমে একের পর এক খবরের জোগান দিচ্ছে। একইভাবে আমরা অন্য বট প্রোগ্রামের কথা জানি বিশেষ করে করোনার সময় বিভিন্ন সেবা গ্রহণে বট ব্যবস্থার সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত হই। আবার গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট যে কি না আমাদের সঙ্গে ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারে এবং চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় তথ্য মুহূর্তের মধ্যে হাজির করে। আবার আমাদের মধ্যে কে কে গুগল অনুবাদের ব্যবহার করেছি, এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা কেমন?
কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কাজ চালানো যায় কিন্তু একটু জটিল বাক্য অনুবাদ করতে গেলে অনেক সময় হাস্যরসের সৃষ্টি করে। তবে চ্যাটজিপিটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নাকি অনেক বেশি গোছানো, গল্প-কবিতা লিখছে, পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নিবন্ধ রচনা করতে পারছে। তার মানে বোঝাই যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ধীরে ধীরে কতটা উন্নতি করছে।
ভার্চুয়াল জগৎ এখন মানব সংস্কৃতির অংশ যদিও আমাদের ডিজিটাল সংস্কৃতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় সাধারণভাবে সরকারি দু’একটা ফর্ম ডাউনলোড করা, অডিও ও ভিডিও কল করা, ফেসবুকের ব্যবহার, প্রকাশনা, ওয়েবসাইট তৈরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসা ও বাণিজ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য ফেসবুক-সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার ও ই-কমার্সের কিছুটা হলেও প্রচলন শুরু হয়েছে। এই সীমিত চর্চার মধ্যেও আবার নেতিবাচক চর্চার দৃষ্টান্ত যথেষ্ট। যার মধ্যে আছে অনলাইন গুজব ছড়ানো, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি ও ছড়িয়ে দেওয়া, অন্যকে হেনস্তা করা ও ট্রল এবং পর্নগ্রাফি ইত্যাদি।
কিন্তু পৃথিবীর অর্থনৈতিক কাঠামো যেদিকে যাচ্ছে তাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারই জয়জয়কার এবং চলছে বাজার ধরার প্রতিযোগিতা। পৃথিবীতে ডিজিটাল প্রযুক্তি অতিদ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে আর এই পরিবর্তন হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে। বলা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত স্বচালিত গাড়ির বাজার হবে ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং স্বচালিত ড্রোনের বাজার হবে ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও আমাদের দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক আছে।
অনেকেই মনে করেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মনে হয় মানুষের বিকল্প হতে যাচ্ছে কিন্তু আদতে মোটেও তা নয়। বরঞ্চ এটি মেশিন লার্নিং, তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা এবং ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় এটি মানুষের আচরণ অনুকরণ করতে পারে এবং মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য ও বারবার করতে হয় এমন কাজে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে। তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ধীরে ধীরে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারে ও কোনো ধরনের তাৎক্ষণিক নির্দেশনা ছড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও সেবা দিয়ে থাকে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের চিন্তাভাবনার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত ভাবনাকে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা বা যান্ত্রিক উপায়ে প্রকাশ করে থাকে এবং এভাবেই এটি নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি করছে।
আজ থেকে বিশ কিংবা ত্রিশ বছর আগে আমাদের সংস্কৃতির প্রায় পুরোটাই ছিল সামাজিক জগৎ সম্পর্কিত। কিন্তু গত ত্রিশ বছরে আমাদের সংস্কৃতির জগতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মানুষের সংস্কৃতি এখন শুধু সামাজিক পরিমণ্ডলকেন্দ্রিক না, ধীরে ধীরে তা ভার্চুয়াল পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে ঠাঁই করে নিয়েছে।
এই ভার্চুয়াল মাধ্যমকে কেন্দ্র করেই জীবনযাপন, যোগাযোগ, বাজার সদয়, লেনদেন, বিনোদন ইত্যাদি সবই চলছে। এই ভার্চুয়াল জগতেই আস্তে আস্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আনাগোনা গভীর হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মানুষের অভিজ্ঞতা আরও সমৃদ্ধ করছে, শুধু তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে না। মেশিন লার্নিং ও রোবটিক্স প্রযুক্তির সহযোগে মানুষের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাকে পাল্টে দিচ্ছে। আর এসবই মানব ইতিহাসে এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে এবং মানুষে সেখানেই ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সেখানে ভার্চুয়াল জগৎও মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে ওঠে, ভার্চুয়াল অপরাধীদের দাপটে। না ভার্চুয়াল অপরাধের সঙ্গে শুধু মানুষই নয় এখানেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকেও ব্যবহার করা হয়।
কোনো কম্পিউটার ব্যবস্থার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা, আড়িপাতা, ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়া সবই হচ্ছে এই জগৎকে ঘিরে। ইতিমধ্যে আমরা সামাজিক মাধ্যমের অলগারিদম সম্পর্কে জানি কীভাবে ঝড়ের বেগে বিভিন্ন সংঘাত ও সহিংসতা সম্পর্কিত কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়ে। আবার এদের প্রতিরোধ করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত বিভিন্ন ফিল্টারও তৈরি করা হয় যা দ্রুতই সহিংসতামূলক বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট আটকে দিতে পারে। এখানেও চোর-পুলিশের খেলা, আমাদের দৃশ্যমান জগতের বাইরে এই অদৃশ্যমান জগতের বহর যে কত বড় তা অনেক সময় আমাদের চিন্তারও বাইরে।
ডিজিটাল সংস্কৃতি ও ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে মানুষের কর্মসংস্থানের ধরনের ক্ষেত্রে একটি বিরাট পরিবর্তন আসবে। বারেবারে করতে হয় এমন কাজগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়বে। ফলে প্রচলিত এমন অনেক পেশা অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। ভার্চুয়াল মার্কেটে এখন আর কোনো সেলস পার্সন-এর কোনো প্রয়োজন নেই, বরং সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত কোনো একটি বট কাজ করছে যে প্রতিনিয়ত ক্রেতার আলাদা আলাদা পছন্দ ও অপছন্দকে অনুসরণ করে এবং প্রত্যেককে কাস্টমাইজ সার্ভিস দিচ্ছে। একইভাবে দেখা যাচ্ছে কলকারখানায় অনেক শ্রমিকের কাজ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত মাত্র একটি রোবট।
আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে বসবাস করছি, এই যুগে প্রযুক্তি যেভাবে সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করছে তা নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণীই যেন কাজে লাগছে না। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েভ এখন শুধু তরঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই এর সঙ্গে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয় ঘটেছে, আর ভবিষ্যতে আর কী কী অপেক্ষা করছে তা বলা দুরূহ। বিশ্বায়নের কালে বিশ্বে ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা নির্ভর করে বিশ্বপ্রযুক্তির ওপর কার কতটুকু নিয়ন্ত্রণ আছে তার ওপর।
এই অবস্থায় বিশ্বে আমাদের অবস্থান তৈরি নির্ভর করে নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং এ সম্পর্কিত ইকোসিস্টেমে আমরা কতটুকু অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারছি তার ওপর। অধিকন্তু শুধু অভ্যস্ত হলেই হবে না এর পাশাপাশি এই প্রযুক্তির ওপর কতটুকু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও অন্যের নির্ভরশীলতা তৈরি করতে পেরেছি তার ওপর। ডিজিটাল বাংলাদেশের পর দেশকে এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে তৈরি করতে চাই, আর এই স্মার্ট দেশ তৈরিতে স্মার্ট সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
‘রাজনীতি’ করা হয়, মানুষের কল্যাণে। একজন মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়, চলমান রাজনীতি। দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলে রাজনৈতিক সংগঠন। সেই সংগঠনই, সময়ের প্রয়োজনে কথা বলে- গণমানুষের। সেখানে আদর্শগত পার্থক্য থাকলেও- দেশের মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেই, গঠিত হয়- রাজনৈতিক দল। সেই দল যখন, জনকল্যাণ এবং দলীয় আদর্শের সঙ্গে দেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করে নেয়- তখন নিবন্ধন শর্ত কঠিন হলেও তা পূরণ করা, দুরূহ হওয়ার কথা নয়। কোনো রাজনৈতিক দলে জনগণ সম্পৃক্ত থাকলে- নিবন্ধন শর্ত মেনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা, কঠিন কিছু না।
গতকাল দেশ রূপান্তরের ১ম পাতায় প্রকাশিত- ‘নিবন্ধন শর্ত আসলেই কঠিন!’ শিরোনামের সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়- নিবন্ধনের জন্য ৯৮টি দল নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করেছিল। সেগুলো থেকে দ্বিতীয় দফায় ৭৭টি দলকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়। এসব দলের কিছু নথির ঘাটতি ছিল। ঘাটতি পূরণের সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। ওই সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ায় ইসির সংশ্লিষ্ট দপ্তর দলগুলোর আবেদনের কাগজ যাচাই করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করছে। সূত্র জানিয়েছে, এক-তৃতীয়াংশ দলই নিবন্ধনের জন্য শর্ত ঠিকভাবে পূরণ করতে পারেনি। যেসব দল বৈঠকের পর্যালোচনায় উতরে যাবে তারা তৃতীয় দফায় মাঠপর্যায়ে জরিপের জন্য যোগ্য হবে। জরিপ সম্পন্ন হলে কমিশনের পরবর্তী বৈঠকে দলগুলোর চূড়ান্ত তালিকা করা হবে। ইসি সূত্র বলেছে, তৃতীয় দফায়ও কয়েকটি দল নিবন্ধনের অযোগ্য হবে। কারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনের ৪ নম্বর ধারায় নিবন্ধনের জন্য মাঠপর্যায়ে কার্যক্রমের শর্তের কথা বলা রয়েছে। অধিকাংশ দলেরই মাঠের কার্যক্রম থাকে না। তৃতীয় দফায় উত্তীর্ণ দলের চূড়ান্ত তালিকা জুনে প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে- রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনের ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, নিবন্ধন পেতে হলে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। (ক) দফার (অ) উপধারায় বলা হয়েছে, আবেদন দাখিল করার তারিখের আগের দুটি সংসদ নির্বাচনে দলীয় নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে কমপক্ষে একটি আসন পেতে হবে; (আ) উপধারায় বলা হয়েছে, ওইসব সংসদ নির্বাচনের কোনো একটিতে আবেদনকারী দলের অংশগ্রহণ করা আসনে প্রদত্ত মোট ভোটের ৫ শতাংশ ভোট পেতে হবে; (ই) উপধারায় বলা হয়েছে, দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সক্রিয় কেন্দ্রীয় দপ্তর ও অন্যূন একশ উপজেলা বা মেট্রোপলিটান থানার প্রতিটিতে কার্যকর দপ্তরসহ কমপক্ষে দুইশ ভোটার সদস্য থাকতে হবে। (খ) দফার (অ) উপধারায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব পর্যায়ের কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা; (আ) উপধারায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য থাকতে হবে এবং কমিশনে দেওয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিবরণী অন্তর্ভুক্ত করা।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বাছাইয়ে টিকে থাকা অধিকাংশ দলই তৃতীয় শর্ত পূরণ করতে পারে না। কারণ কাগজ-কলমে কার্যালয় থাকলেও বাস্তবে অনেক দলের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কারও কার্যালয় থাকলেও উপজেলা পর্যায়ে ২০০ জনের স্বাক্ষরের যে বিধান রয়েছে, সংগৃহীত স্বাক্ষরে তার মিল থাকে না। সংবাদেই উল্লেখ রয়েছে- আজ বৃহস্পতিবারের বৈঠকে যে প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হবে তাতে টিকে থাকা দলগুলোর এক-তৃতীয়াংশই নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। ২০ থেকে ২৫টি দলের নিবন্ধনের বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে।
একটি বিষয় পরিষ্কার- যে সব দলের কাছে নিবন্ধন শর্ত পূরণ কঠিন মনে হচ্ছে, তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নির্বাচন এবং তার মাধ্যমে ভিন্ন উপায়ে অর্থ উপার্জন। সেখানে জনকল্যাণ বা দেশপ্রেমের কোনো প্রেরণা নেই। ‘নাম কা ওয়াস্তে’ রাজনৈতিক দলের কাছে, নির্বাচনই মুখ্য হবে- এটাই বাস্তবতা। তবে এই বাস্তবতা, কতটুকু জনহিতকর- তা সবাই বোঝে। রাজনৈতিক আদর্শ বাদ দিয়ে, জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে- নির্বাচন এবং ক্ষমতা যখন মুখ্য হয়ে যায়, তখন সাধারণ বিষয়ও জটিল হতে বাধ্য।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছেন গ্যারেথ বেল। তাই এই টুর্নামেন্টের ফাইনাল সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে ওয়েলসের সাবেক অধিনায়কের। আজ রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে মুখোমুখি হবে ম্যানচেস্টার সিটি ও ইন্তার মিলান। বেলের বাজি সিটির পক্ষে।
ইংলিশ ক্লাব সাউদাম্পটন ও টটেনহামে খেলার সময় ম্যানসিটির বিপক্ষে খেলেছেন বেল। আজ রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের ফলাফলের সঙ্গে ম্যাচসেরা কে হবেন সেই মতামতও দিয়েছেন বেল। ইন্সটাগ্রামে বেল বলেন, 'ম্যানসিটি ৫-০ তে হারাবে ইন্তার মিলানকে।’
বেলের মতে, ম্যাচসেরা হবেন সিটি মিডফিল্ডার কেভিন ডি ব্রুইনে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৩ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নেন বেল। তার আগে কাতার বিশ্বকাপে খেলে বিশ্ব ফুটবল মঞ্চে খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে গেছেন।
মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ ও এফএ কাপ শিরোপা জিতেছে পেপ গার্দিওলার দল। আজ চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলে ট্রেবল হবে তাদের। ২০২১ এ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে চেলসির কাছে হেরেছিল ম্যানসিটি।
দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুটা প্রত্যাশামতো পায়নি অস্ট্রেলিয়া। তবে মিডল অর্ডাররা দিয়েছেন আস্থার প্রতিদান। তাতে ভারতকে ৪৪৪ রানের লক্ষ্য দেয় অসিরা। এই রান তাড়া করলেই বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের নতুন শিরোপাজয়ী হবে ভারত। রান টপকালে শুধু জয়ই হবে না, হবে রেকর্ডও। তাই শেষ দিনে বিরাট কোহলি ও অজিঙ্কা রাহানের পানে তাকিয়ে থাকবে ভারত।
টেস্ট চ্যাম্পিয়ন হতে হলে বিশ্বরেকর্ডটাই করতে হবে ভারতকে। করতে হবে টেস্টের সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড। আর না হলে ড্রয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওভালে পঞ্চম দিনের পিচে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে কোহলি-রাহানেদের। এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই ভারতের সামনে।
রেকর্ড গড়ার লক্ষ্যে নেমে লন্ডনের ওভালে আজ চতুর্থ দিন শেষে ভারত তুলেছে ৩ উইকেটে ১৬৪ রান। দুই বছরের জন্য টেস্ট শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পেতে রবিবার পঞ্চম তথা শেষ দিনে ভারতের দরকার ২৮০ রান, অস্ট্রেলিয়ার চাই ৭ উইকেট। শেষ দিনের শুরুটা করবেন অজিঙ্কা রাহানে (২০*), সঙ্গে বিরাট কোহলি (৪৪*)।
টেস্টের শেষ ইনিংসে ব্যাট করা সবসময়ই কঠিন। ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪১৮ রানের লক্ষ্য তাড়া করে উইন্ডিজের ওই জয় এখনো সাদা পোশাকে সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড। সে হিসেবে ওভালে ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথটা অনেক কঠিন।
রেকর্ড গড়ার লক্ষ্যে ভারতের শুরুটা হয়েছিল ওয়ানডে মেজাজে। প্রথম ৭ ওভারে দুই ওপেনার রোহিত শর্মা ও শুবমান গিল করেন ৪১ রান। গ্রিনের বিতর্কিত এক ক্যাচে বোল্যান্ডের বলে গিল আউট হলেও খেলার ধরন পাল্টাননি রোহিতরা।
১৯ ওভারে ৯১ রান তোলা ভারত ২০তম ওভারে হারায় রোহিতকে। এই ইনিংস খেলার পথে ওপেনার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৩ হাজার রানের মাইলফলক ছুঁয়েছেন রোহিত।
রোহিতের আউটের পর যখন সবাই ভাবছিলেন, উইকেটে থাকা চেতেশ্বর পূজারা তাঁর চিরাচরিত ধরন মেনে রয়েসয়ে ব্যাটিং করবেন। তবে পূজারা আউট হন নিজের চরিত্রের বাইরে গিয়ে কামিন্সের বলে আপার কাট খেলতে গিয়ে।
এর আগে ৪ উইকেটে ১২৩ রান তুলে গতকাল তৃতীয় দিনের খেলা শেষ করে অস্ট্রেলিয়া। আজ চতুর্থ দিন সকালটা দুর্দান্ত শুরু করেন ভারতের পেসাররা। কাল ৪১ রানে অপরাজিত থাকা লাবুশেন চতুর্থ দিনে কোনো রান যোগ না করেই আউট হন উমেশ যাদবের দলে। স্লিপে চেতেশ্বর পূজারার হাতে ক্যাচ দেওয়ার আগে ১২৬ বলে ৪ চারে ৪১ রান করেছেন লাবুশেন। অ্যালেক্স ক্যারি (৬৬*) ও বোলার মিচেল স্টার্কের (৪১) ৯৩ রানের জুটিতে দারুণ পুঁজি গড়ে ফেলে অজিরা। সুবাদে ৮ উইকেটে ২৭০ রান করে দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করা সহজ হয় দলটির। হয়তো জয়ের পথটাও তৈরি হলো ওই জুটিতে।
সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেন বলেই লাতিন দেশটিকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যত উৎসাহ–উদ্দীপনা। এর আগেও বাংলাদেশের মানুষ ম্যারাডোনা–প্রীতি থেকে আর্জেন্টিনার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছেন। কিন্তু এবার কাতার বিশ্বকাপে অতীতের সেই ভালোবাসা বা উদ্দীপনাকে চরমভাবে হার মানিয়েছে। আর এর কারণ ওই একটাই, মেসি।
মেসি যে ইউরোপের ফুটবলের পাট চুকিয়ে মেজর লিগ সকারের দল ইন্টার মায়ামিতে যাচ্ছেন, সেই ঘোষণা আসে গত বুধবার। এখনও নাম লেখাননি, কবে থেকে মায়ামির হয়ে মাঠে নামবেন, সেটাও নিশ্চিত নয়। শুধু মেসি ইন্টার মায়ামিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইন্টার মায়ামির অনুসারীর সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে।
গুগলে ফ্লোরিডাভিত্তিক এই ক্লাবটিকে খোঁজা শুরু করে সারা বিশ্বের মেসি–সমর্থকেরা। গুগলে গত ৭ দিনে সবচেয়ে বেশি মায়ামিকে খোঁজা হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই। গুগলে এই খোঁজার দিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে মেসির নিজের দেশ আর্জেন্টিনার চেয়েও। কেউ কেউ বলতে পারেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা আর্জেন্টিনার চেয়ে বেশি ১৪ কোটি। সেই বিবেচনায় এটাই তো হওয়ার কথা।
মূলত গুগল ট্রেন্ডে কোনো ওয়েব সার্চের সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তার মানদণ্ড হচ্ছে ১০০। বাংলাদেশ এখানে পেয়েছে এক শই। শনিবার বিকেল ৫টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত আর্জেন্টিনা পেয়েছে ৮৪।
গুগল ট্রেন্ডের এই তালিকায় বাংলাদেশ আর্জেন্টিনার পরের নামটা নেপালের। তারা পেয়েছে ৮২। চার নম্বরে আছে হাইতি (৮১), আর পাঁচে আইভরি কোস্ট (৭৩)। এই তালিকায় সেরা দশে আছে ইরাক, ইয়েমেন, কঙ্গো, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া। মেসিকে নিজেদের লিগে নিতে চাওয়া সৌদি আরব আছে এই তালিকার ১৪ নম্বরে।
যুক্তরাষ্ট্র আছে ৫১ নম্বরে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ নিজেদের দেশের ক্লাব সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের ভালোই জানাশোনা থাকার কথা। তা ইন্টার মায়ামি ক্লাব হিসেবে যতই নতুন হোক না কেন।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ১২ বছরে ৭ বারই চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটি। পেপ গার্দিওলার অধীনেই ৫ বার। কিন্তু ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছে তারা। দুবছর আগে ফাইনালে উঠলেও পারেনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে। অবশেষে গেঁরো খুলতে পারল তারা। ইন্তার মিলানকে হারিয়ে ইউরোপের সর্বোচ্চ ক্লাব আসরের শিরোপা জিতেছে তারা।
ইস্তানবুলের ফাইনালে ইতালীয় ক্লাবকে ১-০ গোলে হারিয়ে এই আসরের নতুন চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা। একমাত্র গোলটি করেছেন ৬৮ মিনিটে স্প্যানিশ মিডফিল্ডার রদ্রি।
প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতে এবারের মৌসুমে ট্রেবলও পূরণ করে নিল সিটি। এর আগে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও এফএ কাপের শিরোপা জিতেছিল তারা। তাদের আগে একমাত্র ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জিতেছিল তাদের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। আর কোচ হিসেবে দুবার ট্রেবল জয়ের নতুন রেকর্ডও গড়লেন গার্দিওলা। এর আগে বার্সেলোনার কোচ হিসেবে প্রথমবার ট্রেবল জিতেছিলেন তিনি।
২০২১-র ফাইনালে রদ্রিকে না খেলানো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল গার্দিওলার। দুই বছর পর আরেকটি ফাইনালে সিটির জয়ের মূলনায়ক সেই রদ্রি। ডিফেন্সিভ এই মিডফিল্ডার গোল নিয়ে অতো ভাবেন না। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ১১ ম্যাচ খেলে একটা গোল ছিল তারা। সেটি ছিল এবারের আসরের কোয়ার্টার ফাইনালে ঘরের মাঠে বায়ার্ন মিউনিখকে ৩-০ গোলে হারানো ম্যাচের প্রথমটি। সেই গোলের পেছনে অবদান ছিল যার সেই বার্নার্দ সিলভা ইস্তানবুলে গোলশূণ্য প্রথমার্ধের পর ৬৮ মিনিটে ইন্তার গোললাইনের কাছ থেকে বল ফিরিয়ে দেন বক্সের মাথায়। অরক্ষতি রদ্রির কথা কেউ ভাবেইনি। ডান পায়ের চতুর শটে দুই ডিফেন্ডারের পা এড়িয়ে ডান দিকে জালে জড়ায় বল (১-০)।
এর পরপরই সমতা ফেরানোর সম্ভাবনা তৈরি করেছিল ইন্তার। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের, দিমারকোর হেড বাধা পায় পোস্টে। ২০২১'র ফাইনালে মতো এবারো চোটে পড়ে মাঠ ছাড়েন সিটির মধ্যমাঠের প্রাণ ডি ব্রুইনে। ৩৬ মিনিটেই মাঠে নামা ফিল ফোডেন ইন্তারের আক্রমণ ভাগে বার বার হানা দিয়েছেন। তবে সিটির আর গোল পায়নি। বরং গোল খেতে পারতো তারা। কিন্তু গোলরক্ষক এডারসনের দক্ষতায় দুবার নিশ্চিত বেচে যায়। রবিন গোসেনের ক্রস থেকে একেবারে ফাঁকায় থেকে হেড নেওয়ার সুযোগ পান লুকাকু। কিন্তু নেন গোলরক্ষক বরাবর। কোনো মতে পা দিয়ে ঠেকিয়ে সে যাত্রা দলকে রক্ষা করেন এডারসন।
ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে এডারসনের আরও একটি দুর্দান্ত সেভ। কর্নার থেকে গোসেনের নেওয়া হেড ঝাঁপিয়ে ঠেকান তিনি। এরপর রেফারি শেষ বাঁশি বাজালে উল্লাসে মাতে সিটিজেনরা।
সাধারণত প্রাথমিক স্তরে একটি দেশে এক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থাই চালু থাকে। তবে কোনো কোনো দেশে এক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেও পাঠক্রমে (কারিকুলামে) ভিন্নতা থাকে সেটা সর্বোচ্চ দুই বা তিন ধরনের হয়ে থাকে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ঠিক করে দেয় শিক্ষার্থীরা কী ধরনের শিক্ষাগ্রহণ করবে।
বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণি থেকেই হরেক রকমের শিক্ষাব্যবস্থা এবং হরেক পরীক্ষা চালু আছে। এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষা ১২ রকমে দেওয়া যায়। ফলে এক সনদের জন্য ১২ রকমের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। আর শিক্ষা-প্রশাসনের পক্ষে শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
প্রচলিত বা সাধারণ স্কুলগুলোতে যারা পড়ালেখা করে তারা ‘সাধারণ’ এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে থাকে। আর মাদ্রাসায় যারা পড়ে তারা দেয় দাখিল পরীক্ষা। দাখিল ভোকেশনাল নামেও একটি পরীক্ষা দেওয়া যায়। কারিগরিতে যারা পড়ে তারা দেয় এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমেও দেওয়া যায়। প্রাইভেট এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। মাধ্যমিকে যেসব বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভার্সন রয়েছে, সেখানে ইংরেজি ভাষায় এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া যায়।
ইংলিশ মিডিয়ামে (ইংরেজি ভার্সন নয়) যারা পড়ে, তাদের এসএসসি সমমানের পরীক্ষার নাম ‘ও’ লেভেল। সে ব্যবস্থাতেও এডেক্সেল ও কেমব্রিজ কারিকুলামের স্কুলে পৃথক পড়ালেখা। আর সারা দেশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কওমি মাদ্রাসা; এ শিক্ষাকেও সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। কওমি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস করা শিক্ষার্থীদের মাস্টার্সের সমমান দেওয়া হয়েছে। কওমিতে হাফেজি ও মাওলানা (টাইটেল) ধারায় পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক এম তারিক আহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় বিভিন্ন ধারা থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে এ ধারাগুলো যদি একটা ফ্রেমওয়ার্ক ও মনিটরিংয়ে না থাকে, তাহলে বিশৃঙ্খলা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বিভিন্ন ধারাকে একটা ফ্রেমওয়ার্কে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে; অর্থাৎ সবার জন্য নির্দিষ্ট কিছু বিষয় রাখা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠদান ও মূল্যায়ন করা হচ্ছে কি না তা শিক্ষার সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে মনিটরিং করতে হবে।’
তারিক আহসান বলেন, ‘কওমিতে অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে, এটা ঠিক। তবে সরকার তাদের কিছু ডিগ্রিকে সাধারণ শিক্ষার সমমান দিচ্ছে। এই শিক্ষাকেও একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাধারণ এসএসসি ও ইংরেজি ভার্সনের এসএসসি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আছে ৯টি শিক্ষা বোর্ড। মাদ্রাসায় দুই ধরনের দাখিলের জন্য রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। কারিগরি শিক্ষার জন্য আছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের মাধ্যমেও দেওয়া যায় এসএসসি পরীক্ষা। শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীনেই প্রাইভেট এসএসসি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ইদানীং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। বিভাগীয় এবং জেলা শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। এসবের বেশিরভাগের নিবন্ধন নেই। তারা এডেক্সেল ও কেমব্রিজ কারিকুলামে পরীক্ষা দিলেও তাদের কোনো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ নেই। শিক্ষা বোর্ডগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ করে না।
অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা চালু রয়েছে। করোনার পর দেশে সাধারণ স্কুলের সংখ্যা কমলেও কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ কওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। তাদের পরীক্ষার জন্য তারা নিজেরাই একাধিক বোর্ড বানিয়েছে। এগুলোতে সরকারের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসিক বিষয়গুলো সবাই অনুসরণ করে। কারিগরি ও মাদ্রাসায় আলাদা কিছু বিষয় যুক্ত রয়েছে। আমি বলব, বিভিন্ন ধারা বলে কিছু নেই। তবে ব্যতিক্রম ইংলিশ মিডিয়াম। আমাদের দেশের ইংলিশ মিডিয়ামে সাধারণত ব্রিটিশ কারিকুলামে পড়ানো হয়। সেখানেও আমরা বাংলাদেশ স্টাডিজ নামে একটি বিষয় যুক্ত করেছি। ওই কারিকুলামের শিক্ষার্থীরা যেন দেশপ্রেম ভুলে না যায় এবং নিজের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি বিরূপ মনোভাবের না হয়। আরেকটি বড় ব্যতিক্রম কওমি মাদ্রাসা। সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।’
যারা খুব দরিদ্র তারা সাধারণত কওমি শিক্ষায় যায়। সেখানে পড়ালেখার পাশাপাশি থাকা-খাওয়ারও ব্যবস্থা থাকে। যারা নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত তারা সাধারণ স্কুলে লেখাপড়া করে। উচ্চবিত্তরা সাধারণত তাদের সন্তানদের ইংলিংশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ালেখা করান। ইদানীং মধ্যবিত্তরাও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও ইংরেজি ভার্সনের স্কুলে ঝুকছে। যারা পড়ালেখায় পিছিয়ে তারা সাধারণত কারিগরি শিক্ষায় যায়। আর যেসব অভিভাবক ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষার মিশ্রণ চান, তারা সাধারণত তাদের সন্তানদের আলিয়া মাদ্রাসায় পাঠান।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশে একাধিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। আবার শিক্ষাকাঠামোর নিয়ন্ত্রণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকছে না। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী তার পছন্দের বাইরের শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ালেখা করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ফলে মাধ্যমিকে ঝরেপড়া কমছে না। আবার উচ্চশিক্ষায় গিয়েও অনেকে তাল মেলাতে পারছে না। অনেকে তার উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা তেমন কাজে লাগাতে পারছে না।
ব্রিটেনে সাধারণত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সবার একই রকমের শিক্ষা। এরপর শিক্ষার্থীদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একদল যায় কারিগরি শিক্ষায়। অন্যদল যায় সাধারণ শিক্ষায়। যদিও দুই ভাগেই কিছু ট্রেড কোর্স থাকে। কে কোন ধরনের শিক্ষায় যাবে তাতে অভিভাবকদের কিছু বলার নেই। শিক্ষকরাই বিবেচনা করে শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষাব্যবস্থা নির্ধারণ করেন।
কোনো দেশের উন্নয়নের মূল হচ্ছে কারিগরি শিক্ষার প্রসার। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে। কারিগরিতে এখনো মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে না। সরকার ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থীকে কারিগরিতে নিতে পেরেছে বললেও তাতে নানা ফাঁকি রয়েছে। কওমি মাদ্রাসা ও ইংলিশ মিডিয়ামে শিক্ষার্থী বাড়লেও কারিগরিতে সেভাবে শিক্ষার্থী বাড়ছে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশে^র বেশিরভাগ দেশেই শিক্ষাব্যবস্থা চলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। অর্থাৎ উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর পড়ালেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা স্কুলেই সময় কাটায়। আমাদের দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পড়ালেখা করা যায়। তবে টিউশন ফি ও বই ছাড়াও শিক্ষার্থীদের নানা খরচ থাকে, যা পরিবারকে বহন করতে হয়। মাধ্যমিক থেকে পুরোপুরিই পড়তে হয় অভিভাবকদের খরচে। ফলে অভিভাবকদের পছন্দে ও বাণিজ্যিক কারণে নানা ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এর থেকে সরকার কোনোভাবেই বের হতে পারছে না। বের হওয়ার পরিকল্পনাও দেখা যাচ্ছে না।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে দেশি-বিদেশি শিক্ষাকে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছিল; অর্থাৎ সবাইকে কিছু কোর সাবজেক্ট পড়তে হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। সবাই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আচ্ছন্ন। মতভেদও রয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে, মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা যায়, কারণ সেখানে পড়তে পয়সা লাগে না। আমাদের হাজার হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারীকরণ করেছি। কিন্তু রাষ্ট্র শিক্ষার্থীদের পুরো দায়িত্ব নিচ্ছে না। যত দিন রাষ্ট্র দায়িত্ব নেবে না, তত দিন সব ধরনের শিক্ষাকে এক প্ল্যাটফরমে আনা কঠিন।’
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের মেয়ে অর্পিতা শাহরিয়ার কবির মুমুর (৪১) ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মৃত্যুর আগে তিনি চিরকুট লিখে গেছেন। তবে সেখানে কি লেখা আছে তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি।
বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর মহাখালীর আমতলী এলাকার বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। রাতেই পরিবারের দাবির প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়ায় মরদেহ হস্তান্তর করেছে পুলিশ। বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. জাহাঙ্গীর আলম। পুলিশের ধারণা, অর্পিতা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ বাসা থেকে লাশটি উদ্ধার করে। পরে স্বজনের অনুরোধে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়।
জানা গেছে, লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করতেন অর্পিতা। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মা ফাতেমা কবিরের মৃত্যুর কারণে তিনি দেশে আসেন। এরপর দেশেই ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ ছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার তার লণ্ডনে ফেরার কথা ছিল। মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া একটি চিরকুটে (সুইসাইড নোট) তিনি আত্মহত্যার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
মেয়ের মৃত্যুতে শোকে বিবহবল লেখক–কলামিস্ট শাহরিয়ার কবির গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। তবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল বলেন, রাজধানীর মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে অর্পিতাকে তাঁর মায়ের কবরে দাফন করা হয়েছে। রবিবার তাঁর কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের মেয়ে অর্পিতা শাহরিয়ার কবির মুমুর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (৮ জুন) রাতে বনানীর বাসা থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। রাতেই পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করেছে পুলিশ।
তবে কী কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
শুক্রবার সকালে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বনানীর একটি বাসা থেকে অর্পিতা শাহরিয়ার কবির মুমুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়, যা ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। পরে রাতেই পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।
এর আগে, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে স্ত্রী হারান শাহরিয়ার কবির।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’