
প্রখ্যাত সম্পাদক ও সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের জন্ম ১৮৯৭ সালের ৩ নভেম্বর ময়মনসিংহের ত্রিশালে। তিনি ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাস করার পর কলকাতার রিপন কলেজে বিএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু ওই সময় খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন এবং বিএ পরীক্ষা না দিয়ে কলকাতার গৌড়ীয় সুবর্ণ বিদ্যায়তন থেকে ১৯২১ সালে উপাধি পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯২২ সালে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হিসেবে তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। পরে তিনি সাপ্তাহিক মোসলেম জগৎ, দ্য মুসলমান, দৈনিক সোলতান প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি দৈনিক আজাদে যোগ দেন এবং পরে ১৯৪০-৬২ সাল পর্যন্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে তিনি আইন পরিষদের সদস্যপদ ও মুসলিম লীগ সংসদীয় পার্টি ত্যাগ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে প্রথমবার যে শহীদ মিনার নির্মিত হয়, আবুল কালাম শামসুদ্দীন তার উদ্বোধন করেন। তার রচিত ও অনূদিত একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। ‘পলাশী থেকে পাকিস্তান’ ও ‘অতীত দিনের স্মৃতি’ তার উল্লেখযোগ্য রচনা। তিনি ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্র্তৃক সিতারা-ই-খিদমত এবং ১৯৬৭ সালে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৭৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন। আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯৭৮ সালের ৪ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
ত্রিশ শতকের মহামন্দার মহাচিকিৎসক অর্থনীতিবিদ জন এম কেইনস বলতেন, ‘আমি অচল ঘড়ির কাঁটা নই যে, একই জায়গায় থেমে থাকব; আমি সচল ঘড়ি, অবস্থা যখন পাল্টায়, আমি আমার মত পরিবর্তন করি। আপনি কী করেন জনাব?’
আজ যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন, পৃথিবীতে তথা বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র কি সম্ভব এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই হয়তো জন মেইনারড কেইনসের মন্তব্যের দ্বারস্থ হবেন।
এক
‘সমাজতন্ত্র’ নামক শব্দটি কিংবা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ধারণা, এক কালে আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এবং স্বাধীনতা-উত্তর ক’টা বছর গ্রাম-শহর, ধনী-গরিব, ডান ও বামসবখানে, সব জায়গায়, সবার করোটিতে সমাজতন্ত্র জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়। তবে কেউ হুজুগে, কেউ সুযোগে এবং কেউ অন্তরের অন্তস্তল থেকে বিশ্বাসে ভর করে। তৎকালীন সিনেমা, নাটক, উপন্যাস কিংবা গানে সমাজতন্ত্রের মূল চেতনার সন্ধান পাওয়া যেত; যা ছিল ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না।’
সত্তরের নির্বাচনী প্রচারণায় এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাজতন্ত্রের কথা গণবিবৃতির মাধ্যমে বিধৃত করেছেন। প্রফেসর রেহমান সোবহানের আত্মজীবনীমূলক বই থেকে অনুবাদ করা অনুসন্ধান এই যে, বঙ্গবন্ধু নিয়মিত সমাজতন্ত্রের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি পুনরায় ব্যক্ত করেছেন। যেখানে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, একটা শোষণমুক্ত সমাজ গঠন। ‘আমি আমাদের শ্রমিক শ্রেণিকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তার একটা মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রমিক সমাজের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা। জাতীয়করণের জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যেখানে শিল্পে শ্রমিকদের ভূমিকা রাখার ব্যবস্থা থাকবে। বস্তুত বর্ধিত উৎপাদনের ভাগ তারাও পাবে।’
অতীত স্মরণ করে পাই, সত্তরের দশক বিশেষত স্বাধীনতা-উত্তর থেকে পঁচাত্তর-পূর্ব বাংলাদেশে বামধারার রাজনীতির প্রাধান্য আর ডানধারা ডানাকাটা পাখির মতো মুখ থুবড়ে মাটিতে পতিত। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, পঁচাত্তরের দুর্ভাগ্যজনক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষিতে পেন্ডুলাম ঠিক উল্টো ঘুরে যায়। ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি শাসনতন্ত্র থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়, বাজার অর্থনীতির ধারণা প্রাধান্য পায় এবং সমাজ থেকে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা বিলুপ্তির পথে পা বাড়ায়। খাঁটি কতক বামপন্থি ছাড়া মেকি সব, সমাজতন্ত্র ফেলে ভোঁ-দৌড় দিল। খুশিতে টগবগ ডুগডুগি বাজাল, ডান।
বিগত দিনে বাংলাদেশের চিত্তাকর্ষক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (এবং উন্নয়নের) পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাবগুলো নিয়ে আমরা সবাই উদ্বিগ্নঊর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক বৈষম্য, ভারসাম্যহীন এক সমাজব্যবস্থা, স্বজনতোষণ পুঁজিবাদ, লুটেরা ধনিক শ্রেণি, ব্যাপক এবং বিস্তৃত দুর্নীতি, পরিবেশ ক্ষয় ইত্যাদি। বাজার অর্থনীতির ব্যর্থতা এবং একই সঙ্গে সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং তদারকির অদক্ষতা কিছুটা হলেও বিকল্প উন্নয়ন মডেলের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। এর একটি তো অবশ্যই সমাজতন্ত্র যে শব্দটি তিরোহিত পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে।
সেই বিলুপ্ত সমাজতন্ত্র শব্দটি মাটি খুঁড়ে যেন তুলে আনলেন প্রখ্যাত অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ তার সদ্য প্রকাশিত ‘উন্নয়নশীল দেশের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র : একটি রূপরেখা’ বইতে। ‘সমসাময়িক উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির সমন্বয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি রূপরেখা তৈরি করা যায় কি না, তা নিয়ে কিছু প্রাথমিক চিন্তাভাবনাই এ বইয়ের উদ্দেশ্য।’ কিন্তু এই ‘উদ্দেশ্য’ যে তাকে কট্টর মার্কসবাদীদের সমালোচনার জ্বলন্ত উনুনে নিক্ষেপ করতে পারে এবং স্বজনতোষণ পুঁজিবাদের সমর্থকরা বিস্ফারিত নেত্রে তার দিকে তেড়েফুঁড়ে আসতে পারে, আশা করি সেটা মাথায় রেখেই তিনি হাতে কলম নিয়েছেন।
দুই
গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র? এ আবার হয় নাকি? ভ্রু কুঁচকে সাচ্চা বামপন্থি এই প্রশ্ন করতেই পারেন, যখন তাদের ধারণা ‘গণতন্ত্র’ হচ্ছে বুর্জুয়াদের বিলাস। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এক সাক্ষাৎকারে তার রাজনৈতিক পছন্দ সম্পর্কে যা বলছেন, তা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় এরকম ‘অবশ্যই বাম কিন্তু স্বাধীনতা এবং সমগ্র সাপেক্ষে। যেটা আমি পছন্দ করি না তা হচ্ছে বামেরা, হোক কলকাতা কিংবা ক্যামব্রিজে, জনগণকে স্বাধীনতা এবং পছন্দ করার অধিকার প্রদানকে একধরনের বুর্জুয়া বিলাসিতা বলে গণ্য করে। সুতরাং আমি বামধারায় ঝুঁকে গেলাম কিন্তু স্বাধীনতা ও মুক্তির আগ্রহ সহকারে।’
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা এবং সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন ধরন নিয়ে আমাদের কিঞ্চিৎ ধারণা আছে এবং বইটি থেকে লব্ধ জ্ঞান তা শানিত করে বৈকি। আগেও বলা হয়েছে যে, একসময় এতদাঞ্চলে সমাজতন্ত্র শব্দটি বহুল আলোচিত ছিল : “বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৯৭১ সালে, শ্রীলঙ্কায় ১৯৭৮ সালে এবং নেপালে ২০১৫ সালে শাসনতন্ত্রে সমাজতন্ত্রের কথাটি যোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বেশকিছু দেশ, যেখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান, সেসব দেশের শাসনতন্ত্র বা রাষ্ট্রের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্রের উল্লেখ আছে।” স্মর্তব্য যে, নানান ব্যাখ্যায় এবং অস্পষ্ট সংজ্ঞায় ব্যবহৃত সেই সমাজতন্ত্র। আবার, তথাকথিত ‘গোলাপি জোয়ার’ বা ‘পিংক টাইড’-এর প্রেক্ষাপটে বামপন্থি অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে ব্রাজিলসহ লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ। ‘লাতিন আমেরিকার এই বামপন্থি ধারার রাজনীতি প্রধানত ইতিপূর্বের আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক সমর্থিত কট্টর বাজার অর্থনীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে।’
তিন
গণতান্ত্রিক সমাজের বিবর্তনশীল ধারণা থেকে আমরা লক্ষ করি, কীভাবে ‘অ-সমাজতান্ত্রিক’ জওহরলাল নেহরু সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক সাফল্যে আকৃষ্ট হয়ে এবং কেমব্র্রিজ সতীর্থ প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশের অনুপ্রেরণায়, বেসরকারি বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর সরকারের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ, দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণে ভারী যন্ত্রশিল্প গড়ে তুলতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। ‘সে তুলনায় বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরপর সমাজতন্ত্রকে আদর্শগতভাবে বাহ্যত অনেকটা শক্তভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল; বিশেষত প্রস্তাবিত ভূমি সংস্কার ও শিল্পের সরকারি মালিকানার বিষয়ে।’ তা ছাড়া, আশির দশকের শেষার্ধ থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দর্শনে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিবর্তনের ইতিবৃত্তান্ত‘নব্য-উদারীকরণ পরবর্তী সমাজতন্ত্র’, অমর্ত্য সেন এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে ব্যক্তি স্বাধীনতার সুযোগ, জন রলসের ন্যায়পরায়ণতা, ‘বাজার সমাজতন্ত্র’ ইত্যাদি সমেত উপসংহার আমাদের অজানা নয়। মোট কথা, ‘এযাবৎকালের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষণীয় হলো যে, বাজার অর্থনীতি ও ব্যক্তি উদ্যোগের অন্তর্নিহিত শক্তিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সে সঙ্গে কিছু মানুষের হাতে এত সম্পদ হতে দেওয়া যাবে না, যাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং জনকল্যাণমূলক নীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।’
যে দেশে বাজার বৈষম্যের বাহক আবার বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বহারার ক্ষমতা দখল সম্ভব নয়, সেসব দেশে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র একটা সমাধান হিসেবে কাজ করতে পারে; তবে তার জন্য প্রয়োজন খুব দক্ষ আমলাতন্ত্র এবং প্রতিশ্রুত রাজনীতিবিদ (দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যার বিশাল ঘাটতি রয়েছে)। যেসব দেশে, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া রাষ্ট্রীয় খাত প্রতিযোগিতামূলক মুনাফা অর্জন করতে পেরেছে; সেসব দেশে দক্ষ আমলা আর আইনের শাসনের বলেই সম্ভব হয়েছে।
আর কিছু না হোক, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের পর্যালোচনা সমাজতান্ত্রিক চিন্তার খোরাক জোগাবে তাদের জন্য যারা মনে করেন, সমসাময়িক কালে ‘বাজার সমাজতন্ত্র’ একটা বিকল্প ভাবনা হতে পারে। রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক এবং অধ্যাপনায় রত সবার জন্য এটি পুনরায় বিবেচনার দাবি রাখে। যদিও এ ধরনের বক্তব্য বিতর্কের বাইরে নয়। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভালো যে, ‘নব্য-উদারীকরণপরবর্তী সমাজতন্ত্র’ নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে লাতিন আমেরিকায় এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রে, তার ঢেউ বাংলাদেশে আসতে পারে একদিন এবং তখন বাংলাদেশের এই প্রফেসরের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণাগুলো খুব কাজে লাগবে বলে বিশ্বাস।
অনেকটা সমাধিস্থ সমাজতন্ত্রকে লোকালয়ে নিয়ে আসার সাহস দেখানোর জন্য প্রফেসর মাহমুদকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আশা করি, একদিন আরও বিস্তারিত লেন্সে তিনি বিষয়টি নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হবেনবিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখে। যেখানে ‘অন্যায় সুবিধা ও সর্বব্যাপী দুর্নীতিই বড় সমস্যা’ এবং ব্যাংকব্যবস্থা হরিলুটের কারখানা।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, কলাম লেখক সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মানবসমাজে সভ্যতার গতি যত বেগবান হচ্ছেতত কমে যাচ্ছে আবেগ, আন্তরিকতা, ভালোবাসা, মানবিকতা, কৃতজ্ঞতার মতো মানবহৃদয়ের কোমল সত্তাগুলো। ফলস্বরূপ ক্রমান্বয়ে আমরা হৃদয়হীন পশুতে পরিণত হচ্ছি। সৃষ্টিকর্তার এই সৃষ্টিশালায় বুদ্ধি-বৃত্তিসম্পন্ন একমাত্র জীব হচ্ছে মানুষ। তারাই সৃষ্টির সেরা সম্পদ বলে গর্ব এবং অহংকার করে থাকেন। সংবেদনশীল ও হৃদয়সম্পদে ধনী বলে দাবি করা মানুষগুলো কি আসলেই তাই? আমার কাছে এই বিষয়টা সবচেয়ে বড় অদ্ভুত লাগে। হৃদয়সম্পদে ধনী মানুষগুলোই আজ হৃদয়হীন, অমানবিক হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।
একটি শিশুর জীবনের প্রথম প্রভাতে যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তিনি হচ্ছেন মা। জীবনের পরম আদরগুলো মায়ের কাছ থেকেই সবাই পেয়ে থাকেন। সেইসঙ্গে বাবার খাটুনি করা শেষে ঘামে ভেজা শরীরে জড়িয়ে ধরা, চুমু দেওয়ার মতো ঐশ্বরিক সুখ পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না। পিতা-মাতার মমতা স্নেহ-ভালোবাসায় ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে প্রতিটি শিশু। সন্তানের প্রতি তাদের স্নেহ অকৃত্রিম এবং অতুলনীয়। পিতা-মাতার মিলিত আত্মত্যাগ, পরিশ্রম ও স্নেহে লালিতপালিত শিশু ক্রমে পা বাড়ায় আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং একদিন এই পিতা-মাতার কাঁধে ভর করে সেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছেও যায়।
বড় দুঃখের বিষয়, পরিতাপের বিষয় এই শিশু যখন বড় হয়ে নিজ পায়ে দাঁড়ায় এবং নিজের লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, তখন সে ভুলে যায় তার বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেই আত্মত্যাগ, কষ্ট, পরিশ্রমের লড়াইকে। এই সন্তানের কাছেই তখন তার বৃদ্ধ পিতা-মাতা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় নতুন একটি দরজা। যেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মাসে মাসে, সেই বৃদ্ধাশ্রমে কিছু টাকা পাঠিয়ে কৃতজ্ঞতার পবিত্র দায় পালন করে এই হৃদয়হীন আধুনিক প্রজন্ম। কখনো কখনো খোঁজও নেন না, বাবা-মা কেমন আছেন! স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া, মমতা এসব কিছুর বিনিময় তখন শুধু অবহেলা। এই কৃতজ্ঞতাহীন হৃদয়হত্যার কাহিনী আমাদের জন্য বড় লজ্জার এবং দুর্ভাগ্যের।
যে পিতা-মাতা নিজেদের রক্তকে পানি করে শরীরের ঘাম ঝরিয়ে নিজে না খেয়ে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করলেন, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অবজ্ঞা, অবহেলাই কি তাদের পাওনা? এটাই কি তাদের প্রতি উপযুক্ত প্রতিদান? একটু ভালোবাসা, যতœ, সুখ চাওয়া কি তাদের অন্যায়?
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে বিশ্বজুড়েই বেড়েছে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা। বর্তমানে পরিবর্ধিত সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় যৌথ পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বাড়িতে ছেলের বউ কিংবা ছেলের সঙ্গে বনিবনার অভাবে তারা একই বাড়িতে থাকতে পারছেন না। তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে পরিচালন সমিতির অত্যাচারও চরম। এই অমানবিক অবস্থায় বর্তমানে বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের অবস্থা করুণ। তাদের প্রতিনিয়ত ভোগ করতে হচ্ছে নরকযন্ত্রণা। আর্থিক, শারীরিক ও সামাজিক দিক দিয়ে দুর্বল ও শক্তিহীন এই মানুষগুলোর অসহনীয় দুর্দশা দেখে কেন নিশ্চুপ নিরুত্তর এই বর্তমান প্রজন্ম সেটাও বোধগম্য নয়।
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রত্যাশা খুব বেশি কিছু নয়। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার, একটু আশ্রয়, চিকিৎসা যতœ আর বেশি করে ভালোবাসা। এই সহমর্মিতা, সহৃদয়তা কি দেখানো যায় না? ভুলে গেলে চলবে না, তারা আমাদের একান্ত আপনজন, আমাদের জন্মদাতা-জন্মদাত্রী, আমাদের পিতা-মাতা। তারা আমাদের লালন-পালন করে মানুষের মতো মানুষ না করলে আজ আমরা কোথায় থাকতাম? একবার কি ভেবে দেখেছেন? আধুনিক জীবনভাবনার আত্মঘাতী আগুন কিন্তু একদিন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেবে আমাদের হৃদয়হীন এই অমানবিকতাকে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বোঝা নয়, বরং সম্মান-সম্ভ্রমের অফুরন্ত উৎস। তাদের অভিজ্ঞতার ওপর যদি আমরা আরও বেশি করে আস্থা রাখতে পারি, তাহলে অনেক উপকৃত হব, লাভবান হব। যে মানুষজন জীবনের সোনালি সময়টা সন্তানদের সফল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য বিলিয়ে দেন তাদের আমরা যেন একটু ভালোবাসা, যতœ, শান্তি দিতে পারি, এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। পোশাকে আধুনিকতা আসে না, আসে ভাবনা মন ও মননে। আমাদের মন ও মনন সেই অঙ্গীকারের শুদ্ধতায় উজ্জ্বল হোকএটাই কামনা করি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
হাস্যকৌতুকের অসামান্য শিল্পী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় খাঁটি বাঙাল এবং অনিবার্যরূপে আমাদেরই লোক। পূর্ববঙ্গের তো বটেই। খাস ঢাকারও। ঢাকার স্থানীয় ভাষাকে পশ্চিম বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে ঢাকার ভানু খ্যাতিমান হয়েছিলেন। তার কৌতুকনক্শাসমূহে এবং স্বর্ণযুগের বাংলা চলচ্চিত্রে নিজের সংলাপগুলো পর্যন্ত নির্ভেজাল বাঙাল ভাষায় প্রয়োগ ও প্রচার করে নিজেকে ঢাকার ভানু রূপে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এমনিতে পূর্ববঙ্গীয় বাংলা ভাষা নিয়ে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের নাক সিটকানো, ব্যঙ্গোক্তি, বিদ্রƒপ, হাসি-তামাশার খামতি ছিল না। পূর্ব বাংলার প্রচলিত বাংলা ভাষাকে তারা রীতিমতো তাচ্ছিল্য, উপহাস করতেন। এর ওপর ঢাকার স্থানীয় ভাষা তাদের পক্ষে হজম করা কঠিন থেকে কঠিনতর ছিল। ভানুর ঢাকার বাঙাল ভাষা নিশ্চিত তাদের কান গরম করে দিত। তাচ্ছিল্যের পূর্ব বাংলার ভাষাকে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে উল্টো তাদেরই নাজেহাল করে ছেড়েছেন তিনি। ভানুর অসাধারণ কৌতুকপূর্ণ ঢাকার ভাষা তারা নিরুপায়ে হজম করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভানুর কৌতুকে মানুষ হেসেছে, নির্মল আনন্দ উপভোগ করেছে, পাশাপাশি সচেতনতায় ঋদ্ধ হয়েছে। ভানুর কৌতুক কেবল হাসিসর্বস্ব ছিল না। তির্যক ছিল বহুলাংশে। অসংগতি-অনাচারের শৈল্পিক উপহাস করেছেন কৌতুকের মাধ্যমে। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রের অসংগতি নিয়ে কৌতুকে তির্যক করেছেন, খোঁচা দিয়েছেন। ভানুর কৌতুকের উল্লেখযোগ্য দিকটি অসংগতিকে উপহাস করা। সেটা সার্থকভাবে তিনি করেছেন। দম ফাটানো হাসিতে লুটোপুটি খেলেও ভানুর তির্যকপূর্ণ কৌতুক শ্রোতাদের বুঝতে বেগ পেতে হতো না। সহজ-সাবলীল এবং সর্বজন বোধগম্যে ভানুর কৌতুকের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী।
ঢাকার ভানু কেবল পশ্চিম বাংলায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না। মাতৃভূমি পূর্ববঙ্গেও জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরও ভারতীয় চলচ্চিত্র পূর্বপাকিস্তানে প্রদর্শনে বিধিনিষেধ ছিল না। ভারতীয় হিন্দি-বাংলা ছবির বিশাল বাজার ছিল পূর্ব বাংলায়। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় জেনারেল আইয়ুব খান তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী এবং সংবাদপত্রসহ সকল প্রকাশনার আগমন নিষিদ্ধ করে দেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্ববর্তী বছরগুলোতে পূর্ব বাংলায় কলকাতায় নির্মিত বাংলা এবং মুম্বাইর হিন্দি ছবি অবাধে প্রদর্শিত হতো। সে কারণে পূর্ববঙ্গের দর্শকদের কাছে ভানু অপরিচিত-অজ্ঞাত কেউ ছিলেন না। বরযাত্রী (১৯৫১), পাশের বাড়ি (১৯৫২), সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩), ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪), ভানু পেল লটারী (১৯৫৮), যমালয়ে জীবন্ত মানুষ (১৯৫৮), পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (১৯৫৯)সহ ভানু অভিনীত অনেক ছবি এখানে নিয়মিত প্রদর্শিত হওয়ার কারণে ভানু দুই বাংলায়ই সমান জনপ্রিয় ছিলেন। আমার বাবা-মায়ের কাছে নির্মল হাসি-আনন্দের উপভোগ্য সে সমস্ত ছবির ঘটনা শুনে শুনে বড় হয়েছি। সে কারণে সেসব ছবির প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ কিশোর বয়স থেকেই অনুভব করতাম। নিষিদ্ধের কারণে ভানুর কৌতুক শোনা এবং তার চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ তখন ছিল না। স্বাধীনতার পরই অডিও ক্যাসেটে ভানুর কৌতুকনক্শা শোনার সুযোগ পেয়েছিলাম। এর-ওর থেকে ক্যাসেট সংগ্রহ করে হরহামেশা শুনতাম অসাধারণ সব কৌতুকনক্শা। ভানুর ন্যায় বাংলা ভাষায় অন্য কেউ তার স্থানে আজ অবধি দাঁড়াতে পারেনি এবং তাকে অতিক্রমও করতে পারেনি। ভানু তাই আজও একমাত্র এবং অদ্বিতীয়। চলচ্চিত্র সংসদ কর্তৃক আয়োজিত ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের অডিটরিয়ামে ভানুর অভিনীত ছবি দেখার সুযোগ হয়। এর বহু পরে ভিসিআরের আগমনে ভিডিও ক্যাসেটে ভানুর অভিনীত ছবি দেখেছি। ইন্টারনেট এবং স্যাটেলাইট টিভির বদৌলতে এখন তো আমাদের জন্য কিছুই নিষিদ্ধ-আরাধ্য নেই। কলকাতার বাংলা চ্যানেলে কলকাতার স্বর্ণযুগের বাংলা ছবিও মাঝেমধ্যে সম্প্রচারিত হয়। এ ছাড়া ভিডিও সিডি এখন বেশ সহজলভ্য। ভানুর অভিনীত প্রচুর ছবি এখন সিডিতে পাওয়া যায়।
অভিনয় শৈলী, অভিব্যক্তি, বাচনভঙ্গি, কণ্ঠস্বর সমস্ত মিলিয়েই হাস্যকৌতুকের দিকপাল ভানু। দর্শক-শ্রোতাদের কখনো সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর বৃথা চেষ্টা করেননি। শ্রোতা-দর্শকদের হাসানোর অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সচরাচর কৌতুকশিল্পীদের মাঝে কেবল অসামান্য নন, বিরলও। এই অসামান্য প্রতিভার মানুষটিকে যোগ্য সম্মান আমরা দিতে পারিনি। আমাদের একজন চলচ্চিত্রকার কিংবা সাংস্কৃতিক আয়োজনে তাকে এখানে কেউ ডাকেনি। এই লজ্জা আমাদের বহন করতেই হবে। ক্ষণজন্মা ভানু মাত্র ৬২ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। একাত্তরের বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে পশ্চিম বাংলার অনেক গুণী-শিল্পীর আগমন ঘটেছিল। সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগে তারা ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু ভানুকে সরকারি-বেসরকারি একটি উদ্যোগেও ঢাকায় কেউ আনেনি। অগত্যা ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। বিটিভি তাকে নিয়ে অনুষ্ঠানও সম্প্রচার করেছিল। সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, কৌতুক পরিবেশন করেছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। জানি না বিটিভির আর্কাইভে সেই অনুষ্ঠান সংরক্ষিত আছে কিনা? বিটিভির সাক্ষাৎকারে ভানু আক্ষেপে-শ্লেষে বলেছিলেন, ‘আমাকে আপনারা কেউ ডাকলেন না। আপনাদের ডাকের অপেক্ষায় বহুদিন ছিলাম। কিন্তু আপনারা কেউ আমাকে ডাকেননি।’ আমরা নিশ্চয় ভানুর প্রতি সুবিচার করিনি। ঢাকার ভানুকে ঢাকা যোগ্য সম্মান দিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এই লজ্জা আর মোচন হওয়ার নয়। নিজেকে কেবল পূর্ববঙ্গীয় নয়, খাস ঢাকার বলেই গর্ব করে বলতেন, আমি ঢাকার ভানু। এতে তার হীনম্মন্যতা ছিল না। ছিল প্রচ- অহংকার বোধ। ক’বছর পূর্বে কলকাতা ভ্রমণে নন্দনে ছবি দেখতে গিয়েছিলাম। ছবি দেখে বের হচ্ছি, হঠাৎ কলকাতার স্থানীয় আমার সঙ্গীটি ইশারায় এক ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে নিচুস্বরে বলেন, ওই মহিলা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় মেয়ে। শুনেই আমি ছুটে যাই ভদ্রমহিলার নিকট। দ্বিধা-সংকোচের পরোয়া না করে জিজ্ঞেস করি তিনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে কিনা? অপরিচিত আমার প্রশ্নে তিনি কিছুটা ইতস্তত। তার মুখে হ্যাঁ শোনার পর বলি, আমি ঢাকা থেকে এসেছি। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আমার ছিল না। কিন্তু তার সৃজনশীলতার সঙ্গে আমার পরিচয় বহু পূর্বের। আমার কথায় তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তার পিতার প্রসঙ্গে অনেক প্রশ্ন করি এবং তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন নির্মল আন্তরিকতায়, সামান্যতম বিরক্ত না হয়ে।
ভানুর সদৃশ তার মেয়ে বাসবী, একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ভানু পারিবারিক পরিম-লে আজীবন খাস ঢাকার ভাষায় কথা বলতেন। কলকাতার স্থানীয় বাঙালিদের ঘটি বলতে ছাড়তেন না। ১৯৪৬ সালে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন এবং ওই বছরই বিয়ে করেন। ১৯৪৭-এর রক্তাক্ত দেশভাগে মাতৃভূমিতে ফিরে আসার আশা ত্যাগ করে কলকাতায় স্থায়ী হয়ে যান। সাম্প্রদায়িকতার রক্তাক্ত দেশভাগে বাঙালি আর বাঙালি থাকেনি। হিন্দু-মুসলমানে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে থাকলেও মাতৃভূমিতে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না। জয় বাংলার আমন্ত্রণের প্রতীক্ষায় থাকলেও, জীবদ্দশায় তাকে কেউ ঢাকায় আমন্ত্রণ জানায়নি। এই নিয়ে আক্ষেপ করতেন। শেষে নিজ উদ্যোগে ঢাকায় গিয়েছিলেন। বাসবীর কাছে জেনেছিলাম ভিন্ন এক ভানুর কথাও। বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন আমাকে সেই না-জানা কথা, তার বাবা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সশস্ত্র স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। সক্রিয় সদস্য ছিলেন সশস্ত্র স্বদেশি সংগঠন অনুশীলন দলে। কলকাতার রাইটার্স অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন তিন দেশপ্রেমিক স্বদেশি বীর বিনয়, বাদল এবং দীনেশদের সঙ্গে। অপারেশনে তিনজন পৃথকভাবে রাইটার্সে ঢুকেছিলেন সেদিন। দীনেশকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অপারেশন সংঘটনে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল ভানুর ওপর। সাইকেলের সামনে বসিয়ে দীনেশকে রাইটার্সের গেইটে পৌঁছে দিয়েছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে দীনেশকে নামিয়ে গেইটের বাইরে সাইকেল নিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ভানু রাইটার্স এলাকা ত্যাগ করেছিলেন। রাইটার্স অপারেশনের পরিণতি আমরা জানি। ইউরোপীয় পোশাকে সজ্জিত তিন বিপ্লবী রাইটার্সে আচমকা আক্রমণ করে হত্যা করেন কুখ্যাত কর্নেল সিম্পসনকে। নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষে তিন ইংরেজ পুলিশ কর্মকর্তা টোয়াইনাম, প্রেন্টিস এবং নেলসন গুরুতর আহত হয়। ধরা পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে বাদল বসু পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে ঘটনাস্থলে আত্মহত্যা করেন। বিনয় বসু ও দীনেশ গুপ্ত নিজেদের পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মেডিকেল ছাত্র বিনয় বসু সকলের অলক্ষ্যে বুলেটের ক্ষতস্থানে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। গুলিবিদ্ধ দীনেশ সুস্থ হলে বিচারে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসক। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের রাজনৈতিক-দেশপ্রেমের এই অধ্যায় জানা সম্ভব হতো না, যদি সেদিন আগ-বাড়িয়ে বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ না করতাম। ভানুর টানেই সেদিন তার মেয়েকে পেয়ে ছুটে গিয়ে আলাপ করে ভানু সম্পর্কে জেনেছিলাম অনেক অজানা কথা।
ভানুর প্রকৃত নাম সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম ২৭ আগস্ট ১৯২০ ঢাকার বিক্রমপুরে। পিতা জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। মা সুনীতি বন্দ্যোপাধ্যায়। শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের শুরুটা কেটেছে ঢাকায়। সদরঘাটের সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। জগন্নাথ কলেজের শিক্ষা শেষে ১৯৪১ সালে জীবিকার জন্য চলে যান কলকাতায়। শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, সাধারণ পেশা, সম্মানজনক জীবিকার জন্য কলকাতার বিকল্প তখন ছিল না। পূর্ব বাংলার প্রচুর মানুষ শিক্ষা, পেশার কারণে কলকাতায় দ্বিতীয় আবাস গড়ে তুলেছিলেন। কলকাতার বালীগঞ্জের অশ্বিনী দত্ত রোডে বোনের আশ্রয়ে থেকে চাকরিতে যোগ দেন আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি নামক সরকারি দপ্তরে। দুই বছর বোনের কাছে থাকার পর টালিগঞ্জের চারু এভিনিউতে নিজের পৃথক আবাসে ওঠেন। ১৯৪৬ সালে নীলিমা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন। তাদের তিন সন্তান। গৌতম, বাসবী ও পিনাকী। চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন ‘জাগরণ’ ছবিতে। সেটি মুক্তি পায় ১৯৪৭ সালে। একই বছরে দ্বিতীয় ছবি ‘অভিযোগ’ মুক্তি পাওয়ার পর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ক্রমেই হয়ে পড়েন চলচ্চিত্রের ব্যস্ত শিল্পী। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র মনমুগ্ধ (১৯৪৯), বরযাত্রী (১৯৫১), পাশের বাড়ি (১৯৫২), বসু পরিবার (১৯৫২), সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩), [সাড়ে চুয়াত্তর সুচিত্রা সেন অভিনীত প্রথম ছবি। নির্মল হাস্যরসের অসামান্য ছবি সাড়ে চুয়াত্তরের কাহিনীকার বিজন ভট্টাচার্য, পরিচালক তপন সিংহ।] ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪), ভানু পেল লটারী (১৯৫৮), যমালয়ে জীবন্ত মানুষ (১৯৫৮), পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (১৯৫৯), গল্প হলেও সত্যি (১৯৬৬), ৮০তে আসিও না (১৯৬৭), মিস প্রিয়ংবদা (১৯৬৭), ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট (১৯৭১), সর্বশেষ ছবি শোরগোল তার মৃত্যুর পর ১৯৮৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল। বান্দিশ (১৯৫৫) এবং এক গাঁও কি কাহানী (১৯৫৫) এই দুটি হিন্দি ছবিসহ ভানু অভিনীত সর্বমোট চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২৩১টি। ২২৯টি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন অসামান্য প্রতিভাধর সপ্রতিভ অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
তার উল্লেখযোগ্য কৌতুকনক্শাসমূহ ভানু এল কলকাতায়, লর্ড ভানু, টেলিফোন বিভ্রাট, ভানু সদানন্দ, নব রামায়ণ, ঘাতক সংবাদ, কর্তা বনাম গিন্নি, কর্তা বাবুর দেশ ভ্রমণ, হনুমানের নগর দর্শন, কলকাতা ও ভদ্রতা, চাটুজ্যে-বাড়–জ্যে ইত্যাদি।
৪ মার্চ ১৯৮৩ সালে মাত্র ৬২ বছর বয়সে মানুষ হাসানোর অসামান্য এই মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
বিশেষ ধরনের ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউটের (বিআরআরআই) বিজ্ঞানীরা। চিকিৎসকরা বলছেন, এই ধান উদ্ভাবনের ফলে ডায়াবেটিস রোগীকে ভাত খাওয়া নিয়ে টেনশনে থাকতে হবে না। জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগ প্রায় প্রতি ঘরে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে শর্করাসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ কমিয়ে দিতে হয়, যদিও বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাবার ভাতএকটি শর্করাসমৃদ্ধ খাবার। কিন্তু এই ধানের চাল থেকে তৈরি ভাত খেলেও, ডায়াবেটিস রোগীরা থাকবেন একেবারেই শঙ্কাহীন। বিষয়টি যে কত বড় ধরনের আনন্দের সংবাদ, তা কেবল ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত মানুষজনই জানেন। যেসব সম্মানিত বিজ্ঞানী, এ ধরনের ধান উৎপাদন করে সফল হয়েছেন তাদের বিশেষভাবে সম্মানিত করা দরকার। কারণ, এমন সংবাদে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত দেশের লাখ লাখ মানুষের যে কী ধরনের অনুভূতি তৈরি হয়েছে, তা কেবল সেই রোগীরাই বলতে পারবেন।
গতকাল দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘অনুমোদন পেল ডায়াবেটিস ধান’ শীর্ষক সংবাদের মাধ্যমে জানা যায় ‘বোরো মৌসুমে চাষের উপযোগী কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) সম্পন্ন একটি ও রোপা আউশ মৌসুমের অলবণাক্ততা জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের উপযোগী একটিসহ উচ্চফলনশীল নতুন দুই জাতের ধানের অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় বীজ বোর্ড। গতকাল বৃহস্পতিবার বোর্ডের ১০৯তম সভায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) উদ্ভাবিত ব্রি ধান১০৫ ও ব্রি ধান১০৬ জাতের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ব্রি ধান১০৫ জাতে কম জিআই থাকায় সেটি ইতিমধ্যে গবেষকদের মধ্যে ডায়াবেটিস ধান নামে পরিচিতি পেয়েছে।’
সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে ‘এ জাতের পূর্ণবয়স্ক গাছের গড়-উচ্চতা ১০১ সেমি। গড় ফলন হেক্টরে ৭.৬ টন, তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে অনুকূল পরিবেশে হেক্টরপ্রতি ৮.৫ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম। এর জীবনকাল ১৪৮ দিন। এ জাতের ১০০০টি দানার ওজন ১৯ দশমিক ৪ গ্রাম। ব্রি ধান১০৫-এর অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৭ শতাংশ এবং প্রোটিনের পরিমাণ ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। রান্না করা ভাত ঝরঝরে ও সুস্বাদু। তিনি জানান, ব্রি ধান১০৬ আউশ মৌসুমের অলবণাক্ততা জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের উপযোগী উচ্চফলনশীল ধানের জাত। এ জাতের ডিগপাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা। পাতার রঙ গাঢ় সবুজ। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ব্রি ধান১০৬-এর ফলন হেক্টরপ্রতি ৫.৪৯ টন পর্যন্ত পাওয়া যায়। নতুন জাতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটি ঢলেপড়া প্রতিরোধী। ফলে গাছ হেলে পড়ে না। ধানের দানা মাঝারি মোটা এবং সোনালি বর্ণের। এ জাতের গড় জীবনকাল ১১৭ দিন। ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ২৪.৫ গ্রাম। ধানের দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৭.২ ভাগ এবং প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৮.৫ ভাগ।’
সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে ‘এ জাতের হোমোজাইগাস কৌলিক সারিটি নির্বাচনের পর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা মাঠে তিন বছর এর ফলন পরীক্ষা করা হয় এবং পরে কৌলিক সারিটি আউশ ২০২০-২১ মৌসুমে দেশের অলবণাক্ততা জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে কৃষকের মাঠে আঞ্চলিক উপযোগিতা যাচাই করা হয়। পরে ২০২১-২২ সালে কৌলিক সারিটি উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগের গবেষণায় ঢলেপড়া প্রতিরোধী বলে বিবেচিত হওয়ায় ২০২২-২৩ সালে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের ছয়টি অলবণাক্ততা জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে কৃষকের মাঠে মূল্যায়ন করা হয়। এরপর জাতীয় বীজ বোর্ডের মাঠ মূল্যায়ন দল কর্তৃক ফলন পরীক্ষা সন্তোষজনক হওয়ায় কৌলিক সারিটি আউশ মৌসুমের অলবণাক্ততা জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের উপযোগী উচ্চফলনশীল আউশ ধানের জাত হিসেবে চূড়ান্তভাবে ছাড়করণ করা হয়।’
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা ভাত খেতে পারবেনএই সংবাদ যেমন আনন্দের তেমনি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। কারণ, এমন সংবাদে নিশ্চিতভাবেই মধ্যস্বত্বভোগীরা আরও সক্রিয় হবে। তারা তৈরি করতে পারে, ধানের কৃত্রিম সংকট। ফলে চাল সরবরাহে, বিঘœ ঘটতে পারে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি দরকার। এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে না তেমনটিই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে।
শনিবার ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭১ সালের এ দিন শেষে এক বিভীষিকাময় ভয়াল রাত নেমে এসেছিল। এদিন মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন এবং সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনা সভা হবে। এ ছাড়াও সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনের মিনিপোলগুলোতে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বাদ জোহর দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই নাম অপারেশন সার্চলাইট।
এ অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। অনেক পরে, ২০১২ সালে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অ·ফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।
অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিচারণ করে রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউজে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত করি।’ পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট।
যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হলো আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভ‚মি।’
পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্তে¡ও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। এদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারযোগে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসেন।
ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজীর জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্বে থাকা সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থেও এ সংক্রান্ত একটি বিবরণ পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল নিয়াজীর পাশেই ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অনুগত পাকিস্তানি হিসেবে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার চক্রান্ত তিনি খুব কাছে থেকেই দেখেছেন। ২৫ মার্চ, অপারেশন সার্চলাইট শুরুর মুহ‚র্ত নিয়ে তিনি লিখেন ‘নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এমন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহ‚র্ত (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল।’
পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
কাল ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা দিবস। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হতে পুরোপুরি প্রস্তুত সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। দিনটি উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দিনের প্রথম প্রহর থেকে মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ফুলে ফুলে ভরে উঠবে স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদি। দিনটি উপলক্ষে এর মধ্যে জাতীয় স্মৃতিসৌধকে ধুয়ে-মুছে, ফুল আর রং-তুলির আঁচড়ে প্রস্তুত করেছে গণপূর্ত বিভাগ।
গণপূর্ত বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, দিনটি উপলক্ষে স্মৃতিসৌধের মিনার থেকে শুরু করে পায়ে চলার পথ সবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। রং-তুলির আঁচড় পড়েছে ফুলের টপসহ না স্থাপনায়। এর মধ্যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ধুয়ে-মুছে প্রস্তুত রেখেছে গোটা সৌধ এলাকা।
স্বাধীনতা দিবসে সৌধ এলাকা ছাড়াও পুরো উপজেলায় সেজেছে নতুন সাজে। সড়ক-মহাসড়ক ছাড়াও ভবনগুলো সাজানো হয়েছে লাল-সবুজ বাতিতে।
সাভার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাজহারুল ইসলাম বলেন, দিবসটি পালন করতে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর উপজেলা চত্বরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেওয়া হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন আয়োজন করেছে নানা অনুষ্ঠান।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাদা পোশাকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করছেন। গোটা সৌধ এলাকায় বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। এ ছাড়াও সড়ক-মহাসড়কে বসানো হয়েছে নিরাপত্তাচৌকি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।
নাম আছে কিন্তু নিবন্ধন নেই। বেশির ভাগেরই কার্যালয় নেই। বছরের পর বছর চলে ইচ্ছেমতো কমিটি দিয়ে। এ নিয়ে আছে কোন্দল। দলাদলিতে সংগঠন ভেঙে একই নামে হয় আরেক সংগঠন। রয়েছে শাখা সংগঠন। ব্যবহার করা হয় মুক্তিযুদ্ধের লোগো। সংগঠনের নেতাদের অনেকে ব্যবহার করেন ভিজিটিং কার্ড। নেতাদের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনৈতিক কাজের অভিযোগ।
নানা দাবিতে কালেভদ্রে এসব সংগঠনকে কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক সমাবেশে যোগ দেওয়া ছাড়া দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামে এমন গুরুত্বহীন ও নামসর্বস্ব অগণিত সংগঠন গড়ে উঠেছে দেশজুড়ে।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলসহ (জামুকা) বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এমন অবৈধ সংগঠনের সংখ্যা শতাধিকের বেশি। এর মধ্যে কিছু সংগঠন নেতিবাচক নানা কারণে প্রায়ই আলোচনায় আসে।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নামে জামুকার আড়াইশোর বেশি নিবন্ধিত সংগঠনের বেশির ভাগেরই অস্তিত্ব নেই। এ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। এখন মুক্তিযুদ্ধের নামে নিবন্ধনহীন এসব সংগঠন চেতনা বাস্তবায়ন তো করছেই না, উল্টো মুক্তিযুদ্ধের সম্মান হচ্ছে ভূলুণ্ঠিত। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ এসব সংগঠনকে আশকারা ও প্রশ্রয় দেন ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ও জনপ্রতিনিধি। তবে দীর্ঘ দিন ধরে জামুকার নাম ভাঙিয়ে এসব চললেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, জামুকা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকি নেই।
ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, প্রজন্ম লীগের নামে একাধিক সংগঠন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা লীগ, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, শহীদ খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, মুক্তিযুদ্ধ ফ্রন্ট, শহীদ সন্তান ৭১ ফাউন্ডেশন, মুক্তিযোদ্ধা নাতি-নাতনী সংসদ, ৭১-এর সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ এমন নানা নামে সংগঠনের খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে এক নামের আদলে একাধিক সংগঠনও রয়েছে।
‘প্রজন্ম লীগ’ নামটি ব্যবহার করে কয়েক বছরে দলাদলি ও কোন্দলে বেশ কয়েকটি সংগঠন হয়েছে। এর মধ্যে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম’ লীগ নামেই রয়েছে একাধিক সংগঠন। এ ছাড়া ‘বাংলাদেশ আওয়ামী প্রজন্ম লীগ’, ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্বা প্রজন্ম লীগ’ নামে রয়েছে কয়েকটি সংগঠন। একসময় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়কেন্দ্রিক এসব সংগঠনের পোস্টার ও তৎপরতা ছিল। এখনো আছে, তবে সমালোচনার মুখে কিছুটা সীমিত। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কেন্দ্রিক ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন আলোচনায় আসে ২০১৯ সালের শেষদিকে। যদিও বিরোধের জের ধরে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে পৃথক আরেকটি সংগঠন করেছে একটি পক্ষ। তবে তাদের তৎপরতা এখন আর আগের মতো নেই। ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান’ নামে একটি সংগঠন জামুকা থেকে নিবন্ধন নিয়েছিল কয়েক বছর আগে। জামুকার সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এক নামে দুটি সংগঠন হওয়ায় সংগঠনের নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে। আর নানা নেতিবাচক কর্মকা-ে এসব সংগঠন নিয়ে তারাও বিব্রত।
জামুকার মহাপরিচালক মো. জহুরুল ইসলাম রোহেল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সংগঠন চালাতে অবশ্যই জামুকার অনুমোদন লাগবে। ওদের বিষয়ে যতটুকু জানি এদের রেকর্ড ভালো নয়। কিন্তু আমাদের তো কেউ লিখিত বা মৌখিকভাবে অভিযোগ করেননি। অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়নের জন্য এ ধরনের সংগঠন করা হয় এবং খুব সচেতনভাবেই এদের প্রশ্রয় দেওয়া হয়। কেননা কিছু লোকের উদ্দেশ্যই হলো মানুষ যেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। এ সংগঠনগুলো সে কাজটিই করছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আর রাজনৈতিক দলগুলোর নাম ভাঙিয়ে যদি কেউ কিছু করে তাহলে সেটি রাজনৈতিক দলগুলো দেখবে।’ তিনি বলেন, ‘এরা যদি অনৈতিক কাজে জড়িত হয় তাহলে এটি ফৌজদারি অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। জামুকা এ বিষয়ে শক্ত ভূমিকা নিতে পারে।’
জামুকা থেকে গত ১৬ বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ২৭০টি সংগঠন নিবন্ধন নিয়েছে। কিন্তু দু-একটি ছাড়া বাকিগুলোর তেমন কোনো অস্তিত্ব নেই। নানা অভিযোগে অন্তত ৬টি সংগঠনের নিবন্ধন বাতিল ও স্থগিত করা হয়েছে। এত বেশিসংখ্যক সংগঠনের কাজ ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সচেতন মহলে। এ নিয়ে গত ১১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক দেশ রূপান্তর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর ইতিমধ্যে তদন্ত সাপেক্ষে এসব সংগঠনের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে জামুকা। নানা অভিযোগ ও বিতর্কের মুখে তিন বছর ধরে নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ রেখেছে সংস্থাটি।
সরেজমিনে যা জানা গেল : রাজধানীর গুলিস্তান ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউকেন্দ্রিক কয়েকটি সংগঠনের কার্যালয় রয়েছে। সম্প্রতি ঠিকানা অনুযায়ী বেশ কয়েকটি কার্যালয় ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে দেশ রূপান্তর। ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ নামে একটি সংগঠনের দেওয়া ঠিকানায় (১০ গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) একটি ভবনের দোতলায় দুদিন গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটি কার্যালয় থাকলেও সেটি তালাবদ্ধ। ভবনসংশ্লিষ্ট কয়েকজন বলেন, মাঝেমধ্যে অফিসে কিছু লোকজনকে দেখা গেলেও বেশির ভাগ দিনই এটি বন্ধ থাকে।
একই ভবনে ‘শহীদ সন্তান ৭১ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠনের ঠিকানায় গিয়ে এ ধরনের কোনো কার্যালয়ের অস্তিত্ব মেলেনি। সংগঠনের সাইনবোর্ডে লেখা একটি মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে এর নির্বাহী সভাপতি হিসেবে পরিচয় দেন হাজি মো. এমদাদুল হক নামের এক ব্যক্তি। নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে এই ব্যক্তি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’-এর অফিসটি তারা সংগঠনের নামে ব্যবহার করেন। জামুকার অনুমোদন না থাকলেও আবেদন করা আছে। বিভিন্ন দিবসে তারা নানা কর্মসূচি পালনসহ অসহায় মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের কল্যাণে কাজ করেন। তবে এখন সংগঠনের কার্যক্রম কিছুটা কম বলে জানান তিনি।
প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের জন্য ভাতা চালুসহ বিভিন্ন দাবিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা নাতি-নাতনী সংসদ’ নামে একটি সংগঠন প্রায়ই কর্মসূচি পালন করে। সামাজিক যোগযোগমাধ্যমেও সক্রিয় দেখা যায়। ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ’ নামে একটি সংগঠনের শাখা সংগঠন এটি। সংগঠনটির সভাপতি পরিচয় দেওয়া মো. জাহাঙ্গীর আলম জয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা বঞ্চিত ও নির্যাতিত হচ্ছেন। তাদের হয়ে আমরা মানবিক কারণে কর্মসূচি পালন করি। কোনো মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে তাদের সন্তানরা ভাতা পান। কিন্তু নাতি-নাতনিরা কেন বঞ্চিত হবেন?’ গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের ছয়তলায় ‘শহীদ খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান’ নামে একটি সংগঠনের ঠিকানায় সম্প্রতি একাধিকবার গিয়ে সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও জামুকার চেয়ারম্যান আ ক ম মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ রকম বহু সংগঠন দেশে আছে। এদের বিষয়ে নানা অভিযোগ শুনি। এগুলোর বিষয়ে একটাই সিদ্ধান্ত এরা অবৈধ ও ভাঁওতাবাজি ছাড়া কিছু নয়। এদের কোনো সৎ উদ্দেশ্য নেই। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নামে উল্টোটা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের মান সম্মানকে এরা ভূলুণ্ঠিত করছে। মুক্তিযুদ্ধের নামে কেউ এমন করুক এটা মানা যায় না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাইলেও এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি না। এটি করতে পারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কিংবা কেউ অভিযোগ করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ অভিযোগ করলে এদের আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে।’
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার নির্যাসে ভাববাদী গীতি ও চারণ কবিরা, সাধু সন্ন্যাসীরা যে বাণী ও বয়ান রেখে গিয়েছেন তা অনুভবের আয়নায় প্রতিফলনের সময় ফুরিয়ে যায় না। কেননা ‘দিন থাকতে দ্বীনের সাধনা’র কথা ভুলিয়ে দেওয়ার প্রথম প্রয়াস আদি মানব মানবীর জীবনে স্বর্গ থেকে বিদায়ের কারণ হিসেবেই এসেছিল, এখনো যা আছে অব্যাহত। শিক্ষা নেওয়ার জন্যই ইতিহাস অধ্যয়ন, সময়ের উত্থান পতনের পটভূমি বোঝাবার জন্য অতীত রোমন্থন, কিন্তু সেই ইতিহাস যদি প্রতিষ্ঠা ও নির্মাণের নামে চর্বিত চর্বনে বিকৃত বিকারগ্রস্ত করা হয় তাহলে অতীত অনুসরণের মৌল ভূমিকায় ঘটে বিপত্তি। যে অনুসরণ বারবার ভুলিয়ে দিয়ে যায় সময়ের প্রবহমানতাকে, অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে বর্তমানকে দায় দায়িত্বহীন করার প্রয়াস প্রচেষ্টায় ভবিষ্যতের জন্য শুধু অন্ধকার অপেক্ষা করে। মানব সভ্যতার উত্থান বিকাশ ও পতনের নাড়ি নক্ষত্র ঘাঁটলে এ সত্যটাই বেরিয়ে আসে যে, মানুষই সভ্যতা সমৃদ্ধির স্রষ্টা, আবার এই মানুষই তার ধ্বংসকারী। বলাবাহুল্য মানুষই মানুষের শত্রু, যে শত্রুতা আদি মানব-মানবীর প্রথম সন্তানেরা পোষণ করতে প্ররোচিত হয়েছিলেন অশুভ প্রবণতা প্রবৃত্তির দ্বারা। এ প্ররোচনা এখনো চলছে, চলছে বলেই স্বার্থান্ধ হয়ে অতীতের কাছে আশ্রয় মাঙতে গিয়ে বর্তমানকে উপেক্ষার উপলক্ষ মিলে যায় এবং ভবিষ্যৎ কেন কীভাবে অগ্রসরমান হবে সে বিবেচনার সুযোগ হয় হাতছাড়া। এ কথা মাথায় রাখতে হবে যে আজকের বর্তমানই একদিন অতীত হবে, বর্তমানকে সময়ের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং ভবিষ্যতে এখনকার কর্মসাফল্য দিয়ে তখনকার জাত কুল মান রক্ষা করা কঠিন হবে।
আত্মশুদ্ধি আর খোদার নৈকট্য অর্জনের অসীম রহমত ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান আমাদের মধ্যে সমুপস্থিত। আল কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মাহে রমজানে রোজা পালন বা সিয়াম সাধনাকে ‘পরহেজগারি অর্জনের জন্য’ ফরজ বা অবশ্য পালনীয় বলে বিধান দিয়েছেন। বলা হয়েছে ‘পূর্ববতী সম্প্রদায়ের জন্যও একই বিধান ছিল।’ অর্থাৎ রোজা পালন শুধু কোরআনের বিধান ঘোষিত হওয়ার পর থেকে প্রবর্তিত হয়নি। আত্মশুদ্ধি ও বিধাতার নৈকট্য লাভের জন্য কৃচ্ছ্র সাধনের এই এবাদত হিসেবে শুধু ইসলামেই নয়, স্থান কাল পাত্র ভেদে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মিক নির্বাণ লাভের এ সাধনা বিদ্যমান।
সিয়াম সাধনায় আত্মশুদ্ধির চেতনা জাগ্রত হয়। কর্মফলের দ্বারা আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতের স্থায়িত্বের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে, আল কোরআনের এ ঘোষণা উপলব্ধি থেকেই আত্ম তাগিদ অনুভূত হয়। ৮ সংখ্যক সুরা আনফাল-এর ৫৩ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে ‘যদি কোনো সম্প্রদায় নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করে তবে আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তাদের যে সম্পদ দান করেন তিনি তা পরিবর্তন করবেন’। ১৩ সংখ্যক সুরা আর রা’দ-এর ১১ আয়াতে আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘মানুষের জন্য তার সম্মুখে ও পশ্চাতে একের পর এক প্রহরী থাকে; তারা আল্লার আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে। এবং আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।’
আল্লাহ্র নিয়ামত স্থায়িত্বের যে নিয়ম বা মূল নীতি তা হলো কোনো ব্যক্তি বা জাতিকে যে নেয়ামত দান করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা ফিরিয়ে নেওয়া হয় না, যে পর্যন্ত না নিজের বা নিজেদের অবস্থা ও কার্যকলাপকে পরিবর্তিত করে আল্লার আজাবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সুতরাং নেয়ামত প্রাপ্তির পর তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা, সচেতন দায়িত্ব পালনের দ্বারা এর মর্যাদা রক্ষা করা এবং নিজেদের মধ্যে সংশোধনীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
কোনো কোনো সময় আল্লাহ্ তায়ালা তার নিয়ামত এমন কোনো কোনো লোক বা সম্প্রদায়কে দান করেন, যে তার নিজের বা নিজেদের আমল বা কর্মের দ্বারা তার যোগ্য নয়, কিন্তু প্রদত্ত হওয়ার পর যদি সে নিজের আমল বা কর্মধারা সংশোধন করে কল্যাণের দিকে ফেরানোর পরিবর্তে মন্দ কাজের দিকে আরও বেশি উৎসাহী হয়ে পড়ে, তখন প্রদত্ত নিয়ামত তার বা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
আল্লাহমানুষকে বিবেক বুদ্ধি ও ভালো মন্দ জ্ঞানসহ সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তার প্রিয় বান্দা বিপথগামী হয়ে তার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হোক এটা তিনি চান না, তা সত্ত্বেও কেউ সঠিক ও কল্যাণের পরিবর্তে মন্দ ও অভিশপ্ত পথ নির্বাচন এবং সেখানে অনড় অবস্থান করলে; আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তার আনুগত্য ত্যাগ করে কুকর্ম, কুচরিত্র ও অবাধ্যতার পথ বেছে নিলে তার পরিণতি হয় দুঃখজনক। যে গজব নেমে আসে তা থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় থাকে না। কোনো ব্যক্তি বা জাতির জীবনে কল্যাণকর পরিবর্তন ততক্ষণ পর্যন্ত সূচিত হয় না, যতক্ষণ এই কল্যাণকর পরিবর্তনের জন্য নিজেদের অবস্থা সংশোধন করে নিজেদের তার যোগ্য করে না তোলা হয়।
আল কোরআনের ২৫ সংখ্যক সুরা আল ফোরকানের ৬৩ থেকে ৭৭ নম্বর আয়াতসমূহে আত্মশুদ্ধি লাভের কয়েকটি গুণ ও দোষের লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে। প্রথম ৬টি গুণাবলির মধ্যে আনুগত্যের মূলনীতি এবং পরবর্তী গুণাবলিসমূহ গোনাহ ও অবাধ্যতা থেকে পরিত্রাণ প্রত্যাশার/প্রচেষ্টার নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে।
১) নিজের বিশ^াস, চিন্তাচেতনা, ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা, আচার-আচরণ ও স্থিরতাকে সৃষ্টিকর্তার আদেশ ও অভিপ্রায়ের অনুগামী রেখে তার আদেশ-নিষেধ পালনের জন্য সদা সচেষ্ট থাকা।
২) নম্রতা সহকারে চলাফেরা করা চলন-বলন আচার-আচরণে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। যে পালনকর্তার ভরসা করে না এবং সবসময় দুনিয়ার লাভ-লোকসানের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকে, সে সব সময় বিভ্রান্তিতে থাকে, দুঃখই ভোগ করে।
৩) কথাবার্তায় নিরাপত্তার সঙ্গে সব সময় সচেতন থাকা উচিত। সালামের জবাব দেওয়া, কারও মনে আঘাত লাগতে পারে, বিরূপ ভাব ও সংক্ষোভের উদ্রেক করতে পারে এমন সংলাপ পরিহার করা। সুবচন ও সুশীল আচরণ কখনই বিত-ার জন্ম দেয় না।
৪) ইবাদতে রাত্রি জাগরণ। যে সময় নিদ্রা ও বিশ্রামের সে সময়ে কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও নামাজে দাঁড়ানোর মতো উত্তম কিছুই নেই। এ ইবাদত লোক দেখানোর জন্য নয় এবং এখানে নাম-যশের আশঙ্কা নেই।
৫) দিবারাতে ইবাদতে মশগুল হয়েও নিশ্চিত হয়ে বসে না থাকা। আল্লাহকে ভয় করা, জীবিকা অন্বেষণ ও তার সাহায্য কামনা করা।
৬) ব্যয় করার সময় অপব্যয় না করা, আয়-ব্যয়ের মধ্যে সমতা বজায় রাখা। বৈধ ও অনুমোদিত কাজে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করাও অন্যায় এবং অপব্যয়। রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, ব্যয় করতে গিয়ে মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করা মানুষের বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। যে ব্যক্তি ব্যয়ের সময় মধ্যবর্তিতা ও সমতার ওপর কায়েম থাকে, সে কখনো ফকির ও অভাবগ্রস্ত হয় না।
৭) শিরক সর্ববৃহৎ গোনাহ। দুনিয়ার ভালোমন্দে কাউকে নিয়ন্ত্রক ভাবাও শিরক।
৮) কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা না করা এবং ব্যভিচারের নিকটবর্তী না হওয়া।
৯) তওবা করা। কঠোর অপরাধী যদি তওবা করে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে সৎকর্ম করতে থাকে, তবে আল্লাহ তার মন্দ কর্মসমূহকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন।
১০) মিথ্যা ও বাতিল মজলিশে যোগ না দেওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়া। যদি কেউ মিথ্যা ও বাতিল মজলিশের নিকটবর্তী হয়ে পড়ে তবে গাম্ভীর্য ও ভদ্রতা সহকারে তা এড়িয়ে বা পরিহার করে চলে যাওয়া উচিত।
১১) আল্লার আয়াত ও শরিয়তের বিধানাবলি শুধু পাঠ করা যথেষ্ট নয়, শ্রবণশক্তি ও অন্তদৃষ্টি-সম্পন্ন মানুষের উচিত এগুলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা।
১২) নিজ সন্তান-সন্ততি ও স্ত্রীর জন্য আল্লার কাছে দোয়া করা। তাদের আল্লাহর আনুগত্যে মশগুল দেখা।
কোনো কিছুর বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকা উচিত। মাত্রা অতিক্রম করলে অনেক ভালো জিনিস মন্দ রূপ বা আকার ধারণ করতে পারে। যেমন মাত্রা অতিক্রম করলেই সাহস হঠকারিতায়, আত্মউৎসর্গ আত্মহত্যায়, প্রতিযোগিতা হিংসায়, ধর্মভীরুতা ধর্মান্ধতার পরিণত হতে পারে। অবস্থা বিশেষে সমালোচনা পরচর্চায়, প্রশংসা চাটুবাদে, তেজ ক্রোধে, দেশপ্রেম দেশদ্রোহিতার স্তরে নেমে আসতে পারে। সব দেশ সমাজ সংসারে, রাজনীতি সমাজনীতি অর্থনীতির অবকাঠামোয় এটি প্রায়শই লক্ষ করা যায়।
নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রা যেমন সবার পছন্দ তেমনি সুরের মধ্যে পঞ্চম-স্বরই মিষ্ট এবং শ্রেষ্ঠ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বারবার বলেছেন তোমরা কোনো কিছুতেই সীমালঙ্ঘন কোরো না। আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না। লোকমান হাকিম তার ছেলেকে উপদেশের ছলে বলেছেন, ‘মাটিতে হাঁটবে মধ্যম মেজাজে আর তোমার স্বর হওয়া উচিত মোলায়েম, স্বরের মধ্যে গাধার স্বরই নিকৃষ্ট।’
করোনাকালে এ শিক্ষা সবাই পেয়েছে যে, স্বাস্থ্যবিধি মানা মানে খাওয়া-দাওয়া, চলাচলে, চাওয়া-পাওয়ায়, মেলামেশা, আগ্রহ-আকাক্সক্ষার ক্ষেত্রে একটা পরিমিত বোধ মেনে চলা। নিয়মনিষ্ঠা পালন ও সহনশীলতা প্রকাশ যে কোনো বিশৃঙ্খল পরিবেশে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারে। অধিক ভোজনেই অধিকাংশ রোগবালাইয়ের কারণ। মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। অধিক পরিশ্রমে মন ও শরীর ভেঙে পড়ে। অতি কথনে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। অতিরিক্ত সব কিছু খারাপ। অতিভক্তি চোরের লক্ষণ এর চেয়ে সত্যবাক্য আর নেই।
লেখক: সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান
মডেল ও অভিনেত্রী সাদিয়া জাহান প্রভাকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন জয়নাল আবেদীন মাযহারী নামে কুমিল্লার এক আইনজীবী।
প্রভার ভাইরাল হওয়া সেই স্ক্যান্ডালের বিষয়ে ভুল স্বীকার করে জনসম্মুখে ক্ষমা প্রার্থনা করে ভবিষ্যতে এমন কাজ আর করবেন না মর্মে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ওই আইনজীবী।
এছাড়া জবাব না দিলে ভাইরাল হওয়া স্ক্যান্ডালের কারণে গণউৎপাত, নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টির অভিযোগে প্রভার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) ডাক বিভাগের রেজিস্ট্রি ৫১৪ নম্বর রশিদের মাধ্যমে এডি (প্রাপ্তিস্বীকার) সহ লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশটি অভিনেত্রী সাদিয়া জাহান প্রভা, প্রযত্নে আহসান হাবীব নাসিম, অভিনয়শিল্পী সংঘ কার্যালয় ১০/এ, ব্লক-এ রোড নম্বর ২, নিকেতন, গুলশান-১ ঢাকা, এই ঠিকানায় পাঠানো হয়। ০৫৫/২৩ রেফারেন্স নম্বরীয় লিগ্যাল নোটিশটি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রভার উল্লেখিত ঠিকানায় পৌঁছাবে।
লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন মাযহারী কুমিল্লা জেলা বরুড়া উপজেলা আড্ডা ইউনিয়নের পোম্বাইশ গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং কুমিল্লা জজ কোর্টের আইনজীবী হিসেবে কর্মরত আছেন।
লিগ্যাল নোটিশে আইনজীবী জয়নাল আবেদীন মাযহারী সাদিয়া অভিনেত্রী প্রভাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি লিগ্যাল নোটিশ গ্রহীতা আপনার কিছু কর্মকাণ্ড ধর্ম এবং প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যা তরুণ প্রজন্মকে গণউৎপাত হেতুতে বিপৎগামী করবে বলে আমার বিশ্বাস জন্মানোর কারণে জনস্বার্থে এবং নিজে সংক্ষুব্ধ হয়ে আপনাকে লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করলাম।
দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে অত্র নোটিশ প্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে আপনার উক্ত বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক সঠিক ছিল না, এমনকি উক্ত ঘটনার বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে পাবলিকলি ক্ষমাপ্রার্থনা চাইবেন। লিগ্যাল নোটিশের জবাব প্রদানপূর্বক তা জনসম্মুখে প্রকাশ করবেন।
অন্যথায় আমরা আপনার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনের বিধান অনুযায়ী জনস্বার্থে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হব। যার ধরুন আপনি আইনের আওতায় আসবেন এবং উক্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য কেবল আপনি এককভাবে দায়ী থাকবেন।
এ বিষয়ে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো আইনজীবী জয়নাল আবেদীন মাযহারী বলেন, আমি একজন আইনজীবী হিসেবে সমাজের নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টির আশঙ্কা করছি। তার (প্রভার) এমন বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্কে প্রলুব্ধ হয়ে সমাজের নারী-পুরুষ এমন বেআইনি কাজে লিপ্ত হতে পারে। তাই অভিনেত্রী প্রভাকে আমার এ নোটিশ দেওয়া।
তিনি যদি নোটিশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে জবাব না দেন এবং জনসম্মুখে ক্ষমাপ্রার্থনা না চান, তবে দেশের প্রচলিত আইনের ধারা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের অপরাধীরা আগে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করত। এরপর জানা গেল, সেখান থেকে দেশে অপরাধ ঘটায় তারা। কারও কারও নেপালে অবস্থানের কথাও জানা যায়। ভারতকে নিরাপদ মনে না করায় আরব আমিরাতের দুবাই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। সেখানে তারা আস্তানা গেড়েছে।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা অপরাধ করেই দুবাই চলে যাচ্ছে। সেখানে বসেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে। এখন বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাও দুবাইকে কেন্দ্র করে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। তাদের কেউ কেউ সোনার কারবারও করছেন। ওই দেশে ভারতের দুর্ধর্ষ অপরাধী দাউদ ইব্রাহিমের শিষ্যত্ব নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ওইসব অপরাধীর তথ্য জানার পরও তাদের ফেরত আনতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিসের’ দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ধরতে রেড নোটিস জারি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে পার পেয়ে গেছে। যদিও মামলাটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে নতুন করে আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্ত করার কথা ভাবছে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ সড়কে গুলি চালিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত হন এক কলেজছাত্রী। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মূল হোতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার রাতেই দেশ ছেড়ে চলে যায় দুবাইয়ে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে মুসা চলে যায় ওমানে। জিসান ও জয় এখনো দুবাইতেই বসবাস করছে। যদিও ওমান থেকে মুসাকে ওই বছরের ৯ জুন ইন্টারপোলের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের আলোচনায় আসে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও হিরো আলমের দুবাই সফরকে কেন্দ্র করে। তারা বনানীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের আসামি আরাভ খান নামধারী রবিউল ইসলামের সোনার দোকান উদ্বোধন করতে সেখানে যান। দুবাই যাওয়ার কারণে সাকিব ও হিরো আলমকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হতে পারে। এ ছাড়া ‘প্লেজার ট্যুরের’ জন্য এখন দেশের শিল্পপতিদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে দুবাই। কারণ ঢাকাকে তারা নিরাপদ মনে করছেন না। পাশাপাশি দেশে আটক সোনার চালানের ৮০ শতাংশ জব্দ হচ্ছে দুবাইফেরত বিভিন্ন এয়ারলাইনস থেকে। সব মিলিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দুবাই।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীরা যে দেশেই থাকুক না কেন, তাদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে আটক করার পর দুবাই থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে চেয়েছিল পুলিশ। সম্প্রতি আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভকে দুবাই থেকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ে সুখবর দেওয়া সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে জানান, সম্প্রতি আলোচনায় আসা আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ভারতের পাসপোর্টধারী। দেশে তার নামে ১২টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ওইসব পরোয়ানার কপি ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে পাঠানোর পর দ্রুতই তাকে ফেরানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এর আগে জিসান ও জয়কে দুবাই থেকে ফেরত আনার উদ্যেগ নিয়েও আনতে পারেনি। টের পেয়ে তারা দুবাই ছেড়ে কানাডায় চলে যায়। তারা আবার দুবাই এসেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এই দেশে অপরাধ করে দুবাই গিয়ে আস্তানা গাড়েন। ইতিমধ্যে পুলিশ একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকায় গুলশান ও বনানী এলাকার মডেলের সংখ্যা বেশি। বছরখানেক আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকেন। তাদের সঙ্গে অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সখ্য আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এমনকি বনানীতে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যাকান্ডে তাদেরও সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার পর পিয়াসা, রাজ ও আরাভকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় তদন্ত করা হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগীতশিল্পী, এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও কয়েকজন মডেল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। আবার কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তাড়া খেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছে কেউ কেউ। আত্মগোপনে থেকেই তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দুবাই রয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আলাদাভাবে বৈঠক হয়েছে। ওইসব বৈঠকে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাই চলে যায়। সেখান থেকেও ঢাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তার সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল, কামরুল হাসান হান্নান, ইব্রাহীম, রবিন ও শাহাদৎ হোসেন বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, শাহাদৎ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নুর হোসেনসহ অনেকেই কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নুর হোসেন ছাড়া অন্য সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। সুব্রত, মোল্লা মাসুদ ও শাহাদৎ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে মুম্বাই হয়ে দুবাই চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার অপরাধজগতের এক সন্ত্রাসী এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধীরা এখন আর ভারত যেতে চায় না। কারণ ওই দেশে শান্তিতে থাকা যায় না। ফলে সবাই এখন দুবাইমুখী হচ্ছে। দুবাইয়ে সবাই নিরাপদে থাকতে পারছে।