
সাত মার্চের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা, মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই, আমি এবং স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ আমরা এই সভা সংগঠিত করার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। সকাল থেকেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনস্রোত আসতে থাকে। তখন মানুষের মুখে মুখে স্বাধীনতা। একটি ঘটনা আমার মনে পড়ে। সাতই মার্চ দুপুর ১টা। আমি এবং আমারই আরেক প্রিয় নেতা নামোল্লেখ করলাম না, আমরা দুজন বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের দুজনের কাঁধে হাত রেখে কথা বলছিলেন। আমাদের সেই নেতা যখন বঙ্গবন্ধুকে বললেন, তিনি তাকে ‘লিডার’ বলে সম্বোধন করতেন ‘লিডার, আজ কিন্তু পরিপূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়া মানুষ মানবে না।’ আমাদের কাঁধে রাখা হাত নামিয়ে তার নামোচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে বললেন, ‘আই অ্যাম দি লিডার অব দি পিপল। আই উইল লিড দেম। দে উইল নট লিড মি। গো অ্যান্ড ডু ইউর ডিউটি।’ এই বলে তিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওপরে চলে গেলেন।
আমরা ধানমণ্ডি থেকে রওনা করি পৌনে ৩টায়। রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাই সোয়া ৩টায়। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা আরম্ভ করেন সাড়ে ৩টায়। দশ লক্ষাধিক লোকের গগনবিদারী স্লোগানে মুখরিত রেসকোর্স ময়দান। আমি নিজেও স্লোগান দিয়েছি। সেদিনের সভামঞ্চে সৌভাগ্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা করার। বলেছিলাম, ‘এবার বক্তৃতা করবেন প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ সেদিনের সভামঞ্চে জাতীয় চার নেতাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন, চারদিকে তাকালেন। মাউথপিসের সামনে পোডিয়ামের ওপর চশমাটি রাখলেন। হৃদয়ের গভীরতা থেকে যা তিনি বিশ্বাস করতেন, যার জন্য তিনি সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন, সেই বিশ্বাসী আত্মা দিয়ে, বাংলার মানুষকে তিনি ডাক দিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার’। তারপর একটানা ১৮ মিনিট ধরে বলে গেলেন স্বাধীনতার অমর মহাকাব্য। বক্তৃতায় তিনি মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। বঙ্গবন্ধুর সামনে ছিল দুটি পথ। এক. স্বাধীনতা ঘোষণা করা। দুই. পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব না নিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত না হয়ে সুচিন্তিত বক্তব্য প্রদান করা। তিনি দুটোই করলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন সেদিনের পরিস্থিতি। যেটা তিনি আমাদের বলেছিলেন। সেনাবাহিনী তখন প্রস্তুত। মাথার ওপর বোমারু বিমান এবং হেলিকপ্টার গানশিপ টহল দিচ্ছে। যখনই বঙ্গবন্ধু এই ভাষায় বলবেন যে, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’, তখনই তারা গোলাবর্ষণ শুরু করবে। সেজন্য বঙ্গবন্ধু সবকিছু জেনেই বক্তৃতা করেছেন। এত বিচক্ষণ নেতা ছিলেন যে, সমস্ত ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সামরিক শাসকের উদ্দেশে চারটি শর্ত আরোপ করলেন ‘মার্শাল ল’ প্রত্যাহার করো, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নাও, এ কয়দিনে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার বিচারবিভাগীয় তদন্ত কর এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করো।’ এই চারটি শর্ত আরোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হলেন না। পাকিস্তানিরা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন সদা সতর্ক এবং সচেতন। অপরদিকে পুরো বক্তৃতাটি জুড়ে ছিল আসন্ন জনযুদ্ধের রণকৌশল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ ‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।’ ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব।’ ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে’ তোলার আহ্বান জানিয়ে বললেন, ‘সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো ওয়াপদা কোনোকিছু চলবে না।’ নির্দেশ দিলেন ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।’ সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো কেউ দেবে না।’ গরিবের কথা খেয়াল রেখে বলেছেন, ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে’ সেজন্য শিল্প কল-কারখানার মালিকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়া দিবেন।’ জীবনভর লালিত প্রগাঢ় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে বিরোধী রাজনীতিকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ আর রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাবডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত কওে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ বক্তৃতা শেষ করেছেন মূলত স্বাধীনতা ঘোষণা করেই। বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অর্থাৎ সামগ্রিকতায় জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতা। সেদিনের সেই স্মৃতি মানসপটে ভেসে ওঠে। অভূতপূর্ব দৃশ্য, কল্পনা করা যায় না।
আমি লক্ষ্য করেছি, বঙ্গবন্ধু জীবনে কখনো স্ববিরোধী বক্তব্য দেননি। যা তিনি বিশ্বাস করেছেন, ভেবেছেন, মনে করেছেন যে এটিই বাস্তবসম্মত, সেটিই তিনি বলেছেন। শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছে শুনেছি, ৬ তারিখ রাতে বঙ্গবন্ধু পায়চারী করেছেন এবং ভেবেছেন কী বলবেন! বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘তোমার এত চিন্তার কারণ কী? সারা জীবন তুমি একটি লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, তোমার জীবনের যৌবন তুমি পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছ, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছ। তুমি যা বিশ্বাস করো, সেই বিশ্বাস থেকেই আগামীকাল বক্তৃতা করবে।’ বঙ্গবন্ধু তার হৃদয়ে ধারিত গভীর বিশ্বাস থেকেই সেদিন বক্তৃতা করেছেন।
আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের বক্তৃতা বিশ্লেষণ করি তবে দেখব, অলিখিত একটি বক্তৃতা। ভাষণের সময় ১৮ মিনিট। শব্দ সংখ্যা ১৩০৮টি। আব্রাহাম লিংকনের এবঃঃুংনঁৎম অফফৎবংং-এর শব্দ সংখ্যা ২৭২, সময় ৩ মিনিটের কম এবং লিখিত। অপরদিকে, মার্টিন লুথার কিং-এর ও যধাব ধ ফৎবধস ভাষণটির সময় ১৭ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১৬৬৭। কিন্তু বিশ্বের কোনো নেতার ভাষণ এমন সংগ্রামমুখর ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী নিরস্ত্র মানুষের সামনে হয়নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি প্রদান করে মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে, নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিলেন। কী বিচক্ষণ একজন নেতা! আইএসআই সাতই মার্চ ঢাকা ক্লাবের সামনে ছিল। তারা অপেক্ষা করেছিল-যে ঘোষণাটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’ তারা মনে করেছিল সেই কথাটি তিনি সাতই মার্চ বলবেন। আমি আগেই বলেছি বঙ্গবন্ধু ছিলেন সতর্ক। তিনি সবই বলেছেন, কিন্তু শত্রুর ফাঁদে পা দেননি। উল্টো শত্রুকেই ফাঁদে ফেলেছেন। যার জন্য পরদিন আইএসআই রিপোর্ট করল ‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সঙ্গে বক্তৃতা করে গেল। একদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা করল, আরেকদিকে ৪টি শর্ত আরোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হলো না এবং পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নিল না। আমাদের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমরা যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম সেটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।’ এই একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে একই মোহনায় দাঁড় করিয়েছেন।
লেখক : আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
২০২২ সালের ৪ জুন বিস্ফোরিত হয়েছিল সীতাকুন্ড। বিএম ডিপোর হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরণের নিদারুণ ক্ষত ও দাগ মুছেনি এখনো। ৯টি মাস না যেতেই আবারও বিস্ফোরিত হলো সীতাকুন্ড। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কদমরসুল (কেশবপুর) এলাকায় ‘সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডের’ প্লান্টে ৪ মার্চ ২০২৩ তারিখে ঘটল আবার বিপজ্জনক বিস্ফোরণ। ঘটনায় নিহত ছয় এবং আহত শতাধিক। ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সাত সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সীমা অক্সিজেন প্লান্টের দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য নিতে পারেনি গণমাধ্যম, তারা পালিয়ে গেছেন। বিস্ফোরণের পর ফায়ার সার্ভিসের কুমিরা, সীতাকুন্ড ও আগ্রাবাদের নয়টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে অংশ নেয়। র্যাব, সেনাবাহিনী, পুলিশ, নৌবাহিনী, বিভিন্ন সংস্থা ও সাধারণ মানুষ উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। প্রতিটি বিস্ফোরণই বিপজ্জনক, একটির সঙ্গে আরেকটির কোনোভাবেই তুলনা করা যায় না। কিন্তু এবারের বিস্ফোরণে বহুদূরের জনজীবনও নিরাপদ ছিল না। বিস্ফোরণে প্রায় দুই কিলোমিটারের বেশি এলাকা কেঁপে ওঠে। আশপাশের বহু বাড়ির কাচের জানালা ভেঙে পড়ে। ঘটনাস্থল থেকে বহু দূরে ৩০০ কেজি ওজনের লোহার খন্ড উড়ে এসে মাথায় আঘাতে একজন নিহত হন। সীমা অক্সিজেন কারখানায় কেন বিস্ফোরণ ঘটেছে এ বিষয়ে কেউ কিছু জানাতে পারেননি। ‘গ্যাস সিলিন্ডার নীতিমালা ১৯৯১’ অনুযায়ী অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপনের জন্য বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হয়। সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে কিনা কেউ জানেন না। এমনকি এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাটি নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায়ও ছিল না। কিন্তু সীমা অক্সিজেন কারখানাটি তো আর চলনবিল বা চিম্বুক পাহাড়ে অবস্থিত নয়। সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে এই সীমা অক্সিজেন প্লান্টের অবস্থান। কারখানার উত্তরে নয় মাস আগের অগ্নিদগ্ধ বিএম কনটেইনার। রাসায়নিক কারখানা বোঝাই এই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বাস করেন শত সহস্র শ্রমিক। এরা সবাই বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন জীবিকার কারণে। কৃষক থেকে হয়েছেন ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার শ্রমিক। তো এই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল, যেখানে এর আগে বিস্ফোরণ ঘটেছে সেখানকার প্রতিটি কারখানা বিষয়ে রাষ্ট্র কেন মনোযোগী হলো না? কেন এতদিনেও এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বিশেষ ব্যবস্থাপনার অংশ হলো না। বিএম ডিপোর পর সীমা কারখানার এই বিস্ফোরণ প্রমাণ করেছে ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা বিষয়ে আমরা দায়িত্বশীল নই। এমন কারখানাগুলোর লাইসেন্স থেকে শুরু করে উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা কোথাও আমাদের নজরদারি ও জবাবদিহি নেই। অবশ্যই এ বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে সামগ্রিক বিবেচনায় আনা জরুরি। আমরা আশা করব সীমা কারখানা বিস্ফোরণের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। ঘটনায় নিহত ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর পাশে মানবিক মর্যাদা নিয়ে দাঁড়াবে রাষ্ট্র। রাসায়নিক বোঝাই ঝুঁকিপূর্ণ সীতাকুন্ডের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে রাষ্ট্র পরিবেশবান্ধব সংবেদনশীল নীতিমালা গ্রহণ করবে। আমরা কোনোভাবেই চাই না বিএম ডিপো কিংবা সীমা অক্সিজেন একের পর এক বিস্ফোরণে দগ্ধ চুরমার হবে ঐতিহাসিক সীতাকুন্ড। সীতাকুন্ডের উৎপাদন অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রাণ-প্রকৃতি ও জনজীবনের নিরাপত্তা রাষ্ট্রকেই সুরক্ষিত রাখতে হবে।
নিমতলীর রাসায়নিক বোঝাই গুদামঘর, তাজরীন গার্মেন্টস, সেজান জুস কারখানা, বিএম ডিপো থেকে সীমা অক্সিজেন। একের পর এক প্রশ্নহীন আগুন। নিমেষেই অঙ্গার টাটকা জীবন। চুরমার সংসার, বিশৃঙ্খল পরিবার। তদন্ত হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করে, মামলা হয়, ক্ষতিপূরণ কিছু দেওয়া হয় কিংবা কিছু ধরপাকড় হয় কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক কিছুই হয় না। তাজরীন, রানা প্লাজা, নিমতলী, সেজান কারখানা কি সীতাকুন্ড ডিপো বিস্ফোরণে প্রশ্নহীন প্রাণহানিকে অনেকেই কাঠামোগত হত্যাকান্ড বলেন। তবে কাঠামো বিশ্লেষণে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক সংগঠন, দুর্নীতি, অবহেলা, উদাসীনতা, দায়হীনতাকেই মূলত আলাপে টানতে দেখা যায়। বিশ্বায়িত বাজার, করপোরেট বাহাদুরি কিংবা নয়া-উদারবাদী ভোগবাদ উল্লিখিত কাঠামোয় আড়াল হয়ে থাকে। অথচ এসব বিস্ফোরণ এবং প্রাণহানির অতলে পোক্ত হয়ে আছে আমাদের নয়া-উদারবাদী করপোরেট ভোগবাদ।
সীতাকুন্ডে বিএম ডিপো বা সীমা অক্সিজেন কারখানা বিস্ফোরণের মূলে আছে করপোরেট বিশ্বায়িত বাজারের নিয়ন্ত্রিত ভোগবাদ। সীতাকু- বিএম ডিপো বিস্ফোরণে নিদারুণভাবে নিহত হয়েছিলেন ৪১ জন, এবার সীমা অক্সিজেনের আগুনে পুড়েছেন ছয় জন। এইসব বিস্ফোরণে কারা অঙ্গার হয়? গ্রামগঞ্জের মেহনতি গরিব মানুষ। নয়া-উদারবাদী বাজারকে আর করপোরেট ভোগবাদকে চাঙ্গা রাখতে এই গরিব মানুষের জীবন সবসময় এক একটি নির্দয় সংখ্যায় পরিণত হয়। আমাদের মনে রাখা জরুরি, ঝুঁকিপূর্ণ উৎপাদনে কর্মরত নিহত প্রতিটি জীবন কোনো সংখ্যা নয়, এক একজন স্বতন্ত্র মানুষ। কেন গরিব মানুষের কর্মস্থল প্রশ্নহীনভাবে ঝুঁকিপূর্ণ থাকে? কেন গরিবের কর্মপরিসর অনিরাপদ ও বিপজ্জনক হয়ে থাকবে চিরকাল? অথচ এমন কারখানাগুলোই দেশের গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন খাত এবং উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি। তাহলে এসব কর্মক্ষেত্র কেন মানবিক, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব হবে না? বারবার একের পর এক অগ্নিকা- বা বিস্ফোরণ ঘটবে আর আমরা ক্ষতিপূরণ কিংবা গাফিলতির মোড়কে কাঠামোগত বৈষম্যকে ঢেকে রাখব। ব্যবস্থাপনা ও নীতিপ্রশ্নের মূল আলাপে টানব না। এভাবে কোনোভাবেই সীতাকু-কে দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যতের জন্য সামগ্রিকভাবে নিরাপদ করে তোলা সম্ভব কি?
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রামকে এখন অনেকেই পরিচয় করান ‘বন্দরনগরী’। আর এই বন্দর আজ বিস্ফোরণের বিপদে বোঝাই। বিএম ডিপো বিস্ফোরণের পর জানা যায়, বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুদ এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতিমালা ছাড়াই বন্দরে গড়ে উঠেছে একের পর এক ডিপো ও কারখানা। ১৯৮৪ সালে সি-ফেয়ার্স লিমিটেড নামে বেসরকারি আইসিডি চালুর ভেতর দিয়ে বেসরকারি ডিপোর কাজ শুরু হয় এবং ২০২১ পর্যন্ত গড়ে ওঠে ১৯টি ডিপো। ২০২০ সালেও এখানে অগ্নিকান্ড ঘটে এবং সেই অগ্নিকান্ডের পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগুন লাগা শেডে ১৯৮৭ সালে আমদানি করা পণ্যও ছিল। বিএম ডিপো বিস্ফোরণ থেকে আমরা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করিনি এমনকি এসব বিষয়ে হয়তো আমাদের কলিজায় একটুও দাগ কাটে না। তাহলে আমরা সতর্ক থাকলাম না কেন? কেন আবার আরেকটি সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটতে দিলাম? দাহ্য বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুদ, ব্যবহার, উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনায় আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি ও কাঠামোগুলো কতটা কীভাবে মানছি বা আমাদের আরও কীভাবে নিজেদের নিরাপত্তা জোরদার করা যায় সেইসব বিষয়ে দ্রুত রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ও অঙ্গীকার জরুরি।
সীমা অক্সিজেন বা বিএম ডিপো নয়; চট্টগ্রাম বন্দরে এর আগেও বহু রাসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটেছে। ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালে মিথানলভর্তি ড্রামে বিস্ফোরণ ঘটে, চার জন শ্রমিক গুরুতর আহত হন ও দগ্ধ হন অনেকেই। ২০২০ সালের ১৫ জুলাই রাতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি গাড়ি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কেবল বন্দর নয়, দেশের রাসায়নিক মজুদাগার কি করপোরেট কারখানা সর্বত্রই ঘটছে বিস্ফোরণ ও প্রাণহানি। পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে অগ্নিবিস্ফোরণ ঘটে ২০১০ সালের ৩ জুন। আগুনে নিহত হয় ১২৪ জন মানুষ। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় আগুন লেগে ১১৭ জন গার্মেন্টশ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বিস্ফোরণ ও ভবন ধসে ৩৫ জন নিহত হয়। ঢাকার কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় ‘প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ কারখানায় ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর অগ্নিকা-ে ২১ জন নিহত হন। পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে রাসায়নিক বোঝাই এক ভবন বিস্ফোরিত হয় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৬৭ জন, দগ্ধ আরও চার জন হাসপাতালে মারা যান। ৭ জুলাই ২০২১ রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপে অবস্থিত ‘হাসেম ফুড বেভারেজ কোম্পানির’ ছয়তলা কারখানাটিতে আগুন লাগে। পুড়ে মারা যান ৫২ জন শ্রমিক। প্রতিটি অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণ কেবল মানুষ নয়; প্রাণ-প্রকৃতিসহ সামগ্রিক প্রাকৃতিক ও সামাজিক জীবনকে তছনছ করে দেয়। জীবনের জন্যই উৎপাদন, আর এই উৎপাদন যদি বারবার জীবনকে বিপন্ন করে তোলে তাহলে দেশের সামগ্রিক বিকাশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
লেখক: গবেষক ও লেখক
দেশের পোলট্রি শিল্পের ভেতরের অবস্থা বড় করুণ। ডিম-মুরগি, ফিডসহ গোটা সেক্টরে হাহাকারের জের কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে, তা অনেকের ধারণার বাইরে। যেমনটি ধারণাতীত ছিল গত ক’দিন ধরে ডিম-মুরগি বাজারে চলমান উথাল-পাথাল পরিস্থিতি। এ অবস্থা চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যে ডিমের হালি শত টাকায় ওঠার শঙ্কা ঘুরছে। আসন্ন রমজানেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। পরিস্থিতিও আরও জটিল হওয়ার বার্তা ঘুরছে।
বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্পের শুরুটা মসৃণ ছিল না। পোলট্রির ডিম বা ব্রয়লার মুরগি নিয়ে ছিল নানান মন্দকথা। এর স্বাদ ও গুণাগুণ বোঝাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের। আশির দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫শ’ কোটি টাকা। সম্ভাবনার জেরে এখন তা ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আমদানি-নির্ভর খাতটি মাত্র ৪ যুগের তফাতে অনেকটাই আত্মনির্ভরশীল। মানুষের মধ্যে নিয়মিত ডিম খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। গরিব ও মধ্যবিত্ত আমজনতার তুলনামূলক কম দামে প্রাণিজ আমিষের জোগান মিলছে এ শিল্প থেকে। চিকেন নাগেট, সসেজ, ড্রামস্টিক, বার্গারসহ অনেক আইটেম মুখরোচক নতুন প্রজন্মের কাছে। প্রায় ৬৯ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর্মসংস্থানের এ খাতটিতে এখন বড় রকমের ছেদ।
দাম বৃদ্ধি পাওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে বিশেষ আলোচনার জায়গায় ডিম আর মুরগি। গরু-খাসির কথা ভুলে মাংস বলতে মানুষের ভরসা হয়ে ওঠা ফার্মের মুরগিও নাগালের বাইরে চলে যেতে বসেছে। অবস্থাটা হুট করে হয়নি। কেবল রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও হয়নি। ফুড ও ফিড ইন্ডাস্ট্রির কাঁচামালের দাম বাড়বাড়ন্ত গত কয়েক বছর থেকেই। করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ফিড তৈরির কাঁচামালের দামে নতুন করে টোকা পড়ে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে তা লাগাম ছাড়া হয়ে যায়। এখন কিছুদিন পরপরই ফ্রিস্টাইলে বাড়ছে ভুট্টা-সয়াবিনসহ অন্যান্য উপকরণের দাম। কয়েকটির দাম ১৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সেখানেও বড়দের চোখ রাঙানি। আমদানি ও স্টকে তাদের সক্ষমতার তোড়ে ছোটদের অনেকের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
এর প্রভাব পড়েছে উৎপাদন খরচ ও খুচরা দামে। এমন একটি পরিস্থিতি হবে, বড়-ছোট খামারিসহ উদ্যোক্তারা সরকারের উচ্চ মহলকে অবিরাম আভাস দিলেও তা তেমন আমল পায়নি। বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ফিড উৎপাদনে সম্পৃক্তদের নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে একটি কমিটি থাকলেও কার্যক্রম না থাকার মতো। অথচ মধ্যস্বত্বভোগীরা আগেভাগেই তা মালুম করেছে। ভাও বুঝে নাও টেনেছে তারা। ফিডের কাঁচামাল স্টকের পাশাপাশি নিজেদের সিন্ডিকেটকে শক্তিমান করেছে। ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের আমদানিকারকদের মাঠে মেরে ফেলার মতো অবস্থা করে গোটা সেক্টরের বর্তমান ভবিষ্যৎ কব্জায় নিয়েছে। প্রান্তিক বনাম করপোরেট খামারিদের বিরোধ চাঙ্গার ফাঁকে মাথা ঢুকিয়ে বাজারব্যবস্থাপনার খবরদারি পুরোটাই এ ফড়িয়াদের হাতে। কোনো পর্যায়ের খামারি-বিক্রেতাই ভালো নেই। আরও নাশকতার মতো বিষয় হচ্ছে, এ সেক্টরে দাম ঠিক করার বিষয়-আশয়ও কম। কেবল ফিড নয়; ডিম, ব্রয়লার মুরগি, সোনালি মুরগি, একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা কোনোটিতেই যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থাই নেই।
একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দরপতন শুরু হয়েছে গত বছরের মে মাস থেকে। মাঝে আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে মার্কেট কিছুটা ভারসাম্যের মধ্যে এলেও পরে আবার দর পড়ে যায়। ২০২২ সালে একদিন বয়সী ব্রয়লার বাচ্চার সর্বনিম্ন দাম ছিল ৮ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫১ টাকা। যেখানে গড় উৎপাদন খরচ পড়ত ৩৮.৭৮ টাকা। ফলে প্রতিটি একদিন বয়সী ব্রয়লার বাচ্চা বিক্রিতে উৎপাদনকারীদের লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় ৩.৯১ টাকা। লেয়ার বাদামি বাচ্চার সর্বনিম্ন দাম ছিল ১৩ টাকা, সর্বোচ্চ ৩১ টাকা। গড়ে প্রায় ২২ টাকা। অথচ উৎপাদন খরচ পড়েছে গড়ে ৪৬.৭৫ টাকা। এ হিসাবে প্রতিটি লেয়ার বাচ্চায় লোকসান প্রায় ২৪.৭৫ টাকা। লোকসানের পাল্লা ডিমেও। গত কিছুদিন ধরে প্রতিটি ডিম উৎপাদনে খরচ পড়ছে ১১ টাকার মতো। মার্চের শুরু থেকে খামারিরা বাদামি ডিম বিক্রি করছে ৯.৩৫ টাকায়, সাদা ৮.৮৫ টাকায়। ২০২২ সালে পাইকারি বাজারে বাদামি ডিমের গড় দাম ছিল ৮.৭৯ টাকা এবং সাদা ডিমের ৭.৯২ টাকা। যেখানে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ১০.৩১ টাকা। এ হিসাবে প্রতি ডিমে খামারির লোকসান ১.৫২ টাকা থেকে ২.৩৯ টাকা। ক্ষতির অঙ্ক ব্রয়লার মুরগিতেও। এক কেজির একটি ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে খামারির খরচ পড়ে ১৪৯ টাকা থেকে ১৫২ টাকা। ২০২২ সালে পাইকারি বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে সর্বনিম্ন ১১৮ টাকা, সর্বোচ্চ ১৪৮ টাকা। গড় মূল্য ছিল ১২৯ টাকা।
আর উৎপাদন খরচ ১৪৪.৯৪ টাকা। হিসাব বলছে, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগিতে খামারিদের লোকসান প্রায় ১৫.৯৬ টাকা। এমন নাকানি-চুবানিতে গত মাস কয়েকে অনেক খামারি বসে গেছেন। খুচরা-পাইকারি বিক্রেতাদেরও লাভের মুখ দেখা হয় না। কিন্তু, ফড়িয়া বা মিডলম্যানদের কোনো ঝুঁকি নেই। অনেকটা বিনা পুঁজিতে টাকা গুনছে। করপোরেট হাউজ নামে পরিচিতরাও যে খুব ভালো অবস্থায় আছে এমনও নয়। তবে, একসঙ্গে পোলট্রি খাদ্য, ডিম, বাচ্চা ও মাংস উৎপাদন এবং সরবরাহ করা করপোরেট প্রতিষ্ঠান টিকে আছে মোটামুটি দাপটের সঙ্গে। সংখ্যায় তারা হাতেগোনা। হলেও নিয়ন্ত্রণ অনেক দূর। তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে চুক্তিভিত্তিক খামার বা কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ব্যবস্থা। যোগফলে তাদের প্রোডাকশন বিস্তর। প্রান্তিক খামারিরা দৈনিক গড়ে ৫ হাজার মুরগি সরবরাহ করলে করপোরেটরা করে ১ থেকে ৫ লাখ পিস। পরিমাণে কম হলেও মোটামুটি ভালো অঙ্কের লাভ তুলে নিচ্ছে তারা। তাদের সক্ষমতার জোরে ডিম-মুরগি-ফিডের বাজার হয়ে উঠছে এককেন্দ্রিক। বিপরীতে পোলট্রি সামগ্রীর দাম বেশি হওয়ার মধ্যেও অপ্রত্যক্ষ লাভের ছড়িটা তাদের হাতে। প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না সাধারণ খামারিরা। হালে দম নেওয়ার অবস্থাও নেই। অথচ উৎপাদন সক্ষমতায় কম-বেশি হলেও প্রান্তিকদের ফেলনা ভাবার জো ছিল না। নিজেরা নিজেদের ফেলনা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন তাদের কেউ কেউ।
অনেকটা আত্মসমর্পণের মতো অবস্থা ছোট ও মধ্যম পর্যায়ের খামারিদের অনেকের। চেয়ে চেয়ে দেখা বা এ লাইন ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গতি নেইÑ এমন একটি ধারণা ভর করেছে তাদের মধ্যে। অল্প বা মধ্যম পুঁজির ফিড আমদানিকারকদের কারও কারও এ অবস্থা। কেউ ছেড়ে দে কেঁদে বাঁচি দশায় চলে যাচ্ছেন অন্য ট্রেডে; কেউ নতুন করে আর বিনিয়োগ না করে এক সময় দুহাতে কামানো টাকা সংরক্ষণে ব্যস্ত। এর অনিবার্য জের ডিম-মুরগির লাগামহীন দাম বৃদ্ধি। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে কয়েক হাতে। সেই হাত টেনে ধরতে সংশ্লিষ্ট কয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা করেও সুফল আসেনি। বরং ওই মহলটি এখন ভেংচি কাটছে। ক্ষেপে গিয়ে হিম্মত দেখাচ্ছে। গোটা সেক্টরে আরও পোক্ত করছে তাদের নিয়ন্ত্রণ।
ডিম-বাচ্চা, মাংস-ফিডের সরবরাহ বাড়ায়-কমায় ইচ্ছা মতো। বাজারে সরবরাহ বাড়লে প্রান্তিকরা সঠিক দাম না পেয়ে লোকসান গুনতে বাধ্য। বাচ্চা ওঠাতেও পারেন না ছোটরা। পোলট্রি খাদ্যের সংকট সইবার ক্ষমতাও তাদের নেই। তখন বাজারে টান পড়ে। এ টানের সুযোগে ডিম ও মুরগির উৎপাদন কমিয়ে বাচ্চা উৎপাদন বাড়ায় বড়রা। প্রান্তিক খামারিরা এখন গড়পড়তা মুরগি বেচে ১৬০ টাকা কেজিতে। কিন্তু সরবরাহ শেকলে যুক্তরা এ দাম ২০০ টাকায় ঠেকিয়ে দিচ্ছে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনা থাকায় বাচ্চা, ডিম, ফিড, ওষুধ সব কিছুতে তারা লাভবান। ডিম-বাচ্চা উৎপাদন, পাইকারি বিতরণ কেন্দ্র, ফিড মিল, প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিংয়ে তাদের একচেটিয়া রাজত্ব। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কম দামে শত শত একর জমি কিনে গড়ে তুলেছে পরগনার মতো খামারবাড়ি। তাদের কাছ থেকে বেশি দামে বাচ্চা, খাদ্য এবং ওষুধ কিনতে হচ্ছে সাধারণ খামারিদের। তাদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় বা বশ্যতায় চুক্তিতে আসতেও বাধ্য হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে রয়েছে। পদ্ধতি হিসেবে এটি মন্দ নয়। কিন্তু, গোলমাল বাধছে একচেটিয়া বাজার তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে।
এ জন্য কেবল করপোরেটদের দিকে আঙুল তোলাও একতরফা হয়ে যায়। মধ্যমানের খামারিসহ কিছু লোকও কোনো কোনো এলাকায় সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। টানা লোকসানে কাহিল হওয়া খামারিদের কেউ কেউ দায়দেনা মেটাতে মূল কোম্পানি এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ডিলারের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। খামারি হয়েও তারা ফড়িয়ার পজিশনে নিয়ে গেছেন নিজেদের। বিভিন্ন কোম্পানিকে হাত করতে তারা পোলট্রি পণ্যের ডিলার সাজেন। কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে এলাকাভিত্তিক কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করেন। নাম-পরিচয় ভিন্ন হলেও একই কাজ করছেন তারা। এ ভজকট ডিম-মুরগির বাজারকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যা একদিকে অর্থনৈতিক দুঃসংবাদ, আরেক দিকে পুষ্টি ও আমিষের জোগানের পথেও মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা। পোলট্রি খাতে দীর্ঘ সময় ধরে চলা এ সমস্যাটি আলোচনার আড়ালে থেকেছে অন্যান্য নানাবিধ সমস্যার কারণে। এর জেরে এখন ভুগতে হচ্ছে। সমস্যাটি জোড়াতালিতে সারানোর মতো নয়। সেই চেষ্টা করলে বড় ধরনের বিপর্যয় আসবে। ডিম-মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ তখন কথিত করপোরেটের কাছেও থাকবে না। আবার দেখতে হতে পারে আশির দশকের আগের চিত্র। এর আগেই পদক্ষেপ জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
শুধু ঢাকা শহর না। নানাবিধ কারণে, দেশের বিভিন্ন শহরে হচ্ছে হঠাৎ বিস্ফোরণ। অজস্র মানুষের মৃত্যু অথবা পঙ্গু হয়ে যাওয়া, নতুন কিছু না। কোথাও বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত লাইনে জমে থাকা গ্যাসের বিস্ফোরণ, কোথাও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ আবার কোথাও ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ। মারা যাচ্ছেন নিরীহ মানুষ। আকস্মিক এমন মৃত্যু অথবা পঙ্গুত্ব অস্বাভাবিক হলেও, সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি অনেকটাই যেন ‘স্বাভাবিক’ মনে হচ্ছে!
বাড়তি আতঙ্ক নিয়ে, মহানগর-নগরে বসবাস করছেন মানুষ। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, এমন আজব কান্ড-কারখানা, হরহামেশাই ঘটছে। যে শহরে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই- সেই শহর কোনোভাবেই নিজেকে ‘সভ্য’ দাবি করতে পারে না। আর সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরাও থাকেন নিশ্চিন্ত-নিরাপদ! বলার অপেক্ষা রাখে না- মানুষ নিরাপত্তা চায়, নিশ্চয়তা চায় স্বাভাবিক মৃত্যুর।
গতকাল দেশ রূপান্তরের ১ম পাতায় প্রকাশিত দুটি সংবাদ, সাধারণ মানুষের আতঙ্ক-ভয় যেন বাড়িয়ে তুলেছে। ‘বিকট শব্দে ভয়াবহ ধস’ এবং ‘সীতাকুন্ডে ভয়াবহ বিস্ফোরণ!’ শিরোনামের সংবাদের মাধ্যমে জানা যায় সায়েন্স ল্যাব এলাকায় বিস্ফোরণে মারা গেছেন ৩ জন। হাসপাতালে আছেন ১৬ জন। বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ বলেছেন, এই বিস্ফোরণ হয়েছে, জমে থাকা গ্যাস থেকে।
অন্যদিকে, ‘অবহেলাতেই সীতাকুন্ড বিস্ফোরণ’ শিরোনামের সংবাদে জানা গেছে অক্সিজেন সেপারেশন কলামে যখন অক্সিজেন এসে জমা হচ্ছিল, সেই অক্সিজেন বের হওয়ার জন্য যে পাইপগুলো ছিল একপর্যায়ে তা বের হতে না পেরেই প্রবল শব্দে বিস্ফোরিত হয়েছে কলামটি। আর ১০০ ফুট উচ্চতার এ কলামটি ছিল লোহার শিটের তৈরি। এই শিটগুলো যখন প্রবল বেগে ছোটে, তখন শেডের লোহার পাতগুলো কারখানার রডের ছাউনিগুলোকে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। আর লোহার আঘাতে চারপাশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনায় অবহেলাতেই প্রাণ গেল ছয়জনের। আহত ২২ জনের মধ্যে চোখ হারাল তিনজন।
সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে- বিস্ফোরণের কারণ জানতে চাইলে কারখানার শ্রমিক আহমদ মিয়া কলামটিকে দেখিয়ে বলেন, এই কলামে এসে অক্সিজেন জমা হচ্ছিল। সেই অক্সিজেন কোনো না কোনো কারণে ডেলিভারি পয়েন্টে যাচ্ছিল না। কোথাও ব্লকেজ হয়েছিল। ব্লকেজ হয়ে যাওয়ায় কলামের ভেতরে অক্সিজেনের চাপ বেড়ে যায় এবং বিস্ফোরণ হয়। কিন্তু চাপ বেড়ে গেলে তো পাশের অপারেটর বসা ছিলেন। তিনি কলামের পাশের জায়গায় আঙুল প্রদর্শন করে বলেন, এখানে বসত অপারেটর। শনিবারের এই বিস্ফোরণে ছয়জনের মৃত্যু ও ২২ জন আহত হয়েছে।
প্রকৃত ঘটনা যাই হোক, একটি বিষয় স্পষ্ট যে- দায়িত্ব অবহেলার কারণেই বারবার এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণ যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের। কর্তৃপক্ষ এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সতর্কতার সঙ্গে পালন করলে এমন বিস্ফোরণ হতো না। অথচ বারবার হচ্ছে। এর একটাই কারণ, প্রকৃত দোষী ব্যক্তির শাস্তির ব্যবস্থা না হওয়াতেই এমনটি হচ্ছে। দায়সারা গোছের বক্তব্য দিয়ে, বছরের পর বছর এমন অপমৃত্যু এবং ধ্বংসযজ্ঞ মেনে নেওয়া যায় না। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আরও সতর্কতার সঙ্গে, জন-গণসম্পৃক্ত এই বিষয়গুলো নিয়মিত তদারকি করা প্রয়োজন। কর্মকর্তা ও মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের নিয়মিতভাবে সচেতনতামূলক উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা দরকার। প্রয়োজনে তাদের জন্য বাড়তি প্রণোদনার উদ্যোগ নিলে ভালো হয়। যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে, উপযুক্ত সম্মান এবং প্রণোদনা নিয়মিত হলে- ব্যক্তি তার সর্বোচ্চ মেধা ও আন্তরিকতা দিয়ে দায়িত্বের পরিচয় দেয়। তারপরও যদি কর্তব্য অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখিয়ে শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এটি হচ্ছে না বলেই, বারবার এমন আকস্মিক দুর্ঘটনার মধ্যে প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। আহত হচ্ছেন শত শত।
ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আগেই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এমনটিই প্রত্যাশা।
১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আব্দুল মোতালেব হাওলাদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে অনার্স পড়াকালে সেনাবাহিনীর অফিসার ক্যাডেট নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে লেফটেন্যান্ট ও ১৯৭০ সালে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় মহিউদ্দীন তখন পশ্চিম পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় কর্মরত। দেশের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি জুলাই মাসে কর্মস্থল ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম পার্বত্য এলাকা অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান তখন ৭ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার। সামরিক বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের অফিসার মহিউদ্দীন সেখানে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যুক্ত হন। তিনি কানসাট, আরগরারহাট, শাহপুরসহ কয়েকটি সফল অভিযান চালান। ডিসেম্বরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখলের জন্য তাকে একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দেওয়া হয়। ১৩ ডিসেম্বর এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাসহ তিনি রেহাইচরের মধ্য দিয়ে নৌকাযোগে মহানন্দা নদী পার হন এবং শত্রুর কয়েকটি বাংকার দখল করে নেন। তিনি শত্রুর মেশিনগান ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়ে বাঁ হাতে এসএমজি ও ডান হাতে একটি গ্রেনেড নিয়ে গোপনে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসেন। হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তা পার হয়ে তিনি গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এ সময়ই শত্রুর গুলি তার কপালে বিদ্ধ হয় এবং তিনি শহীদ হন। ভোর রাতে মহিউদ্দীনের মৃতদেহ উদ্ধার করে ছোট সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানসূচক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়েই চলছে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান। নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়েছে, তারপরও যেন ভাগ্যটা ফেরানো যাচ্ছিল না। পরাশক্তির তকমাটা খসে যায় গেল এক যুগে। লিগ শিরোপা তাদের কাছে শুধুই মরীচিকা। সাদা-কালোদের কাছে টুর্নামেন্টের শিরোপাও দূর আকাশের তারায় রূপ নিয়েছিল। সেখান থেকে মোহামেডানকে বলতে গেলে একাই শিরোপার স্বাদ দিয়েছেন ‘ঘরের ছেলে’ সুলেমান দিয়াবাতে। মালির এই স্ট্রাইকার টানা পাঁচ মৌসুম ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন মাঝারি মানের মোহামেডানকে। তার জাদুতে গতকাল ফেডারেশন কাপের মহা-ফাইনালে আবাহনীকে হারিয়েছে সাদা-কালোরা। এই অর্জন এসেছে অনেক অপেক্ষার পর। তাই তো এই শিরোপাকে মোহামেডানের ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখছেন দিয়াবাতেও। বিশ্বাস করেন, এই শিরোপা বদলে দেবে মোহামেডানের চিন্তাধারাকে।
টাইব্রেকারে শিরোপা জয়ের পর ড্রেসিং রুমে সতীর্থদের হুল্লোড়ের মধ্যে ম্যাচসেরা, টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার নিয়ে এক কোনায় বসে দেশে পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন দিয়াবাতে। সেই ফাঁকেই সাংবাদিকদের কাছে জানালেন প্রতিক্রিয়া, ‘পেনাল্টি শুটআউটের আগ পর্যন্ত ম্যাচটা ভীষণ কঠিন ছিল আমাদের জন্য। আল্লাহ আমাদের সহায়তা করেছেন এই ট্রফিটি জিততে। তাই আমি অনেক খুশি। আমার ক্যারিয়ারে কোনো ফাইনালে প্রথমবারের মতো চার গোল করলাম। তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।’ দিয়াবাতে বলেন, ‘৯ বছর পর আমি একা নই, সব খেলোয়াড় মিলে মোহামেডানকে একটা শিরোপা এনে দিয়েছি। বিশ্বাস ছিল ম্যাচে ফিরতে পারলে আমরাই শিরোপা জিতব, সেটাই হয়েছে। আমি এই অর্জন মালিতে থাকা আমার পরিবার, বিশেষ করে আমার মাকে উৎসর্গ করছি।’ শিরোপাটা মোহামেডানের অন্তর্বর্তীকালীন কোচ আলফাজ আহমেদের জন্যও বিশেষ অর্জন। ফুটবল ক্যারিয়ারে অসংখ্য আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ খেলেছেন এবং জিতেছেন। তবে এই জয়টাকে আলাদা করে রাখছেন তিনি, ‘আজকের খেলাটা অনেক বড় অর্জন। ব্যাকফুটে থেকে ফিরে আসা, ম্যাচ দেখে বোঝা যাচ্ছিল না কে জিতবে। দিয়াবাতে আসাধারণ ফুটবল খেলেছে। মুজাফ্ফারভের হাত ভেঙে দিয়েছিল, ওই অবস্থায়ও সে খেলা চালিয়ে গেছে। খেলোয়াড়দের কমিটম্যান্ট ছিল অসাধারণ। খেলোয়াড় হিসেবে আমি শিরোপা জিতেছি, এবার কোচ হিসেবে শীর্ষ পর্যায়ে প্রথম শিরোপা জিতলাম। তাই শিরোপাটাকেই আমি এগিয়ে রাখব।’ প্রথমার্ধে ২ গোলে পিছিয়ে পড়ার পরও হাল ছাড়েননি আলফাজ। শিষ্যদের শিখিয়েছেন মাথা ঠান্ডা রেখে পাল্টা জবাব দেওয়ার মন্ত্র, ‘প্রথমার্ধের খেলা শেষে শিষ্যদের বলেছি, তোমরা মাথা ঠা-া রেখে খেলো। তারা সেটাই করেছে।’
চোটে পড়ে মাঠ ছাড়া গোলকিপার সুজন সতীর্থ বিপুকে টাইব্রেকারে দারুণ পারফরম্যান্সের জন্য প্রশংসায় ভাসিয়েছেন, ‘মাঠ ছাড়ার এক মিনিটের মধ্যে আবাহনী যখন গোল পরিশোধ করল, তখন ভীষণ খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমরা আর পারব না। তবে আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে বিপু। আমি তাই অনেক বেশি খুশি।’
বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুসলিম উম্মাহকে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে তাদের সন্তানদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও বেশি বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) ক্যাম্পাসে ৩৫তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য আরও বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ করতে হবে।’
মুসলমানদের যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়নে যথাযথভাবে এই সম্পদ ব্যবহার করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, আমরা এটা করতে পারব।’ তিনি আরও বলেন, ‘যখনই আমি ওআইসি সদস্য দেশে যাই, তাদের আমি এই অনুরোধই করি।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘ইসলামের স্বর্ণযুগে বিশ^সভ্যতা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, রসায়ন, গণিত, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোলসহ জ্ঞানের আরও অনেক শাখায় মুসলিম স্কলারদের ব্যাপক অবদান রয়েছে, যা আমাদের মুসলিমদের ঐতিহ্যের গৌরবময় ইতিহাস গড়েছে। সেই যুগের মুসলিম স্কলাররা সংস্কৃতি, জ্ঞান অর্জন, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং সমসাময়িক সাহিত্যে বিশে^ আধিপত্য বিস্তার করেছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেই অবস্থান থেকে বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর এই পিছিয়ে থাকার কারণগুলো আমাদের বিশ্লেষণ করা দরকার।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতির অভাব, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাব এবং অন্য অনেক বিষয় মুসলিম উম্মাহর পতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি এই হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের মুসলিম উম্মাহকে মতভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোকে, বিশেষ করে তাদের নিজস্ব শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও বিজ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, আধুনিক যুগে মুসলিমরা মাত্র তিনটি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এটাই এই আধুনিক যুগে গবেষণা, প্রযুক্তি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর অবদানের প্রকৃত উদাহরণ। তিনি অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ‘মুসলিম জাতির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে জোরালো প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যাতে করে তারা এ ক্ষেত্রে আরও অবদান রাখতে পারেন।’
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব দ্বারা উপস্থাপিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মুসলিম সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া উচিত নয়; বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, ইন্টারনেট অব থিংস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও অন্যান্য খাতে।
ওআইসির মহাসচিব ও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) চ্যান্সেলর হিসেন ব্রাহিম তাহার সভাপতিত্বে এতে স্বাগত বক্তব্য দেন আইইউটির ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। এ ছাড়া এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনিও বক্তব্য দেন।
সমাবর্তনে ২০২১ এবং ২০২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের স্নাতক, মাস্টার্স, পিএইচডি এবং ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের অসামান্য ফলাফলের জন্য দুই ধরনের স্বর্ণপদক আইইউটি স্বর্ণপদক এবং ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে আইইউটির ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তার অর্থায়নে আইইউটির নবনির্মিত মহিলা হলেরও উদ্বোধন করেন।।
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন সুলতান মাহমুদ। ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে ধানমন্ডি এলাকায় ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন এ শিক্ষক। এখনো সেই ফ্ল্যাটের ঋণ পুরোপুরি পরিশোধ হয়নি। সুলতানের ব্যবহৃত ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা দুটি। একটি বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংক আর অন্যটি প্রাইম ব্যাংকের।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধা জানতে চাইলেন তিনি জানান, ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ, সন্তানদের বেতন আর ফ্যামিলি খরচ পরিশোধ সব মিলিয়ে প্রায় প্রতি মাসের শেষেই আর্থিক সংকট তৈরি হয়। এ সংকট থেকে বাঁচতেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। তবে মাসের শুরুতে বেতন পেয়েই পরিশোধ করে দিচ্ছেন ক্রেডিট কার্ডের বিল। এতে অতিরিক্ত সুদও গুনতে হচ্ছে না তাকে।
সুলতান মাহমুদ বলেন, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার না করলে হয়তো প্রতি মাসেই আমার বিভিন্নজনের কাছ থেকে ধার করে চলতে হতো। এতে সম্মানহানিরও ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এখন ব্যাংক থেকে স্বল্প সময়ের জন্য ধার নিয়ে তা আবার ফেরত দিচ্ছি। এতে কারও কাছে হাত পাততে হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, একসময় মানুষ ক্রেডিট কার্ডের প্রতি কম আগ্রহী হলেও বর্তমানে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে দেশের ৩৯টি ব্যাংক কার্ড সেবা দিচ্ছে। গত মার্চ শেষে এসব ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ৭৮ হাজারটি। ঠিক চার বছর আগে ২০১৯ সালে মার্চ শেষে এ কার্ডের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৪৯ হাজারটি। অর্থাৎ মাত্র চার বছরের ক্রেডিট কার্ড বেড়েছে ৮ লাখ ২৮ হাজার বা ৬১ দশমিক ৪২ শতাংশ। এই একই সময়ে লেনদেনের পরিমাণও বেড়েছে। গত মার্চে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের মার্চে এ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার বছরের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ১৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
শুধু সুলতানই নন, ব্যবসায়ী আমিরুল, সাংবাদিক আক্তার আর চাকরিজীবী তারিকুলও একই কারণে ব্যবহার করছেন দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ক্রেডিট কার্ড। তাদের মতে, ক্রেডিট কার্ডের কারণে সহজ হয়েছে তাদের জীবনযাত্রা। তবে উল্টো চিত্রও আছে। করোনা মহামারীর সময় চাকরি হারানো আজাদুল ইসলাম ক্রেডিট কার্ডে ধার নিয়ে এখন বিপাকে রয়েছেন। তিনি বলেন, করোনার সময় প্রথম দিকে আমাদের বেতন কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়। সে সময় সংসারের খরচ বহন করতে ক্রেডিট কার্ডের সহায়তা নিয়েছেন। যে ঋণ এখন পর্যন্ত টানতে হচ্ছে তাকে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ হবে বলে আশাবাদী এ গ্রাহক।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্রেডিট কার্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে এর ‘ধার’ নেওয়ার পদ্ধতির জন্য। পাশাপাশি পণ্যের দামে ডিসকাউন্টের পাশাপাশি কিস্তিতে পরিশোধের পদ্ধতিও এ ব্যাপ্তি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। যেটি গ্রাহককে এককালীন বেশি দামের পণ্য কিনতে সহায়তা করে। এবার জেনে নেওয়া যাক ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা-অসুবিধাগুলো।
পণ্য কিনতে কিস্তি সুবিধা : ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কিস্তিতে পণ্য কিনতে একসঙ্গে সব টাকা পরিশোধ করতে হবে না। বিনা সুদে বা নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদে গ্রাহক কয়েক মাসের সমান কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। যদিও গ্রাহক তার ক্রেডিট লিমিটের চেয়ে বেশি দামি পণ্য কিনতে পারবেন না। আর কিস্তির টাকাও পরিশোধ করতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। এতে কারও কাছে টাকা ধার করার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে পরিশোধের ক্ষেত্রে সময়সীমা পার হয়ে গেলে জরিমানা গুনতে হতে পারে।
ঋণের সুবিধা : কিছু ক্রেডিট কার্ড, বিশেষ করে বিদেশে শূন্য শতাংশ সুদে ঋণ দেয়। এসব ক্ষেত্রে মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য পরিশোধ করতে হয়, যা বেশ সুবিধাজনক। আবার কোনো কোনো কার্ডে ঋণে সুদের হার অনেক থাকে। এ ক্ষেত্রেও একটা সুবিধা আছে। বোঝা এড়াতে দ্রুত ঋণ পরিশোধ করা হয়। নিজস্ব ঋণ থাকে না।
পরিবর্তনযোগ্য : এসব ক্ষেত্রে সঠিক কার্ডটি বেছে নিতে পারা জরুরি। একটি ভুল কার্ড দিনের পর দিন ব্যবহার করলে ঋণের বোঝা শুধু বাড়তেই থাকবে। তবে এটা বুঝতে ব্যাংকের পুরো শর্তাবলি মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। যদিও কার্ডের ধরন পরিবর্তন করা যায় খুব সহজে। কারণ প্রতিটি ব্যাংকে বিভিন্ন প্রকারের ক্রেডিট থাকে। আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী কার্ড যেমন নিতে পারবেন তেমনি পরবর্তী সময়ে সেটির ধরন পরিবর্তনও করতে পারবেন। আবার নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেন করলে বাৎসরিক ফি এড়ানো যায়। যেমন অনেক ব্যাংকের কার্ডে অন্তত ১৮ বার কেনাকাটা করলে বাৎসরিক ফি দিতে হয় না। ব্যাংকভেদে এ নিয়মের ভিন্নতা রয়েছে। দেশের বাইরেও ব্যবহার করা যায় : ক্রেডিট কার্ড ইন্টারন্যাশনাল হলে সেটি ব্যবহার করা যাবে বিশ্বের অনেক দেশেই। টাকার পাশাপাশি ডলারও ধার করে ব্যবহার করা যায়। হোটেল বুকিং, বিমানভাড়া, রেস্টুরেন্ট ও কেনাকাটায় মেলে নানা ছাড় ও পয়েন্ট জেতার সুযোগ। বিদেশে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে যা খরচ করবেন, মাস শেষে আপনার সেই পরিমাণ বিল হিসেবে ইস্যু করবে ব্যাংক। তারপর সুদ বা জরিমানা এড়াতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই বিল পরিশোধ করতে হবে।
অফারের ছড়াছড়ি
বিভিন্ন সময়ে ক্রেডিট কার্ডে বিভিন্ন অফার দেওয়া হয়। যেমন ‘ক্যাশ ব্যাক অফার’, ‘স্পেশাল ডিসকাউন্ট’। দেশের বাইরে বেড়াতে গেলে, হোটেলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারে অনেক সময়ই মূল্যছাড় দেওয়া হয়। প্লেনের টিকিট কাটতেও অনেক সময় পাওয়া যায় বিশেষ মূল্যছাড়। আর অনলাইন কেনাকাটার জন্যও এখন ক্রেডিট কার্ড বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, নামিদামি হোটেল ও রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়ায় ছাড় এবং অফার দিয়ে থাকে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আবাসিক হোটেলগুলোও ক্রেডিট কার্ডে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে। একটি কিনলে একটি ফ্রি (বাই ওয়ান গেট ওয়ান) অফারও দেওয়া হয়। এ ছাড়া রয়েছে মূল্যছাড়সহ নানা অফার। অনেকেই পরিবার নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে ঘুরতে যান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও হোটেলের নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হোটেল বুক করা যায়। এ ক্ষেত্রেও আপনি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন। তবে বিদেশে হোটেল বুকিংয়ের টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে ডুয়েল কারেন্সি ক্রেডিট কার্ড প্রয়োজন হবে।
অসুবিধা
ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি অসুবিধাও কম নয়। এজন্য বেশ সতর্ক হতে হবে গ্রাহককে। একটু বেখেয়ালি হলেই পড়তে পারেন ঋণের ফাঁদে।
ঋণের ফাঁদ
ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার সবসময়ই একটি ঋণ নেওয়ার মাধ্যম। মনে রাখতে হবে অর্থ খরচের ৪৫ দিনের মধ্যে সেটি পরিশোধ করতেই হবে। অন্যথায় ঋণের ওপর সুদ শুরু হবে। যা ঋণের পরিমাণ প্রতিদিন বাড়িয়ে দেবে। তাই কিছুটা ঝুঁকি থেকেই যায়।
লুক্কায়িত ব্যয়
সুদের হার পরিশোধই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের একমাত্র ব্যয় নয়। সময়মতো মাসিক বিল পরিশোধ না করলে গ্রাহককে জরিমানা গুনতে হতে পারে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে নগদ অর্থ তুলতে এর জন্য নির্দিষ্ট হারে ফি দিতে হতে পারে। সরাসরি বুথ থেকে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে নগদ অর্থ উত্তোলন করতে গেলে বাড়তি ফি এবং ওইদিন থেকেই (এ ক্ষেত্রে ৪৫ দিন সময় দেওয়া হয় না) সুদ গণনা শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে চেক দিয়ে টাকা সঞ্চয় হিসেবে স্থানান্তর করে তারপর সেটি নগদায়ন করলে ৪৫ দিন সময় পাওয়া যাবে।
ক্রেডিট কার্ড একটি লাইফস্টাইল পণ্য। বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যাংক এখন ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছে। বাংলাদেশে ইস্যুকৃত মোট ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ২২ লাখ কিন্তু একক (ইউনিক) গ্রাহক সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। ক্রেডিট কার্ড পুরোপুরি জামানতবিহীন পার্সোনাল ঋণ হলেও ঋণ পরিশোধের হার খুব সন্তোষজনক। গ্রাহক পর্যায়ে একটি ক্রেডিট কার্ড দিতে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বেশ কিছু অত্যাবশ্যক কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। এটিকে ঋণ হিসেবে না দেখে লাইফস্টাইল পণ্য হিসেবে দেখে এর আবশ্যকীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা কিছুটা শিথিল করা হলে ক্রেডিট কার্ড ব্যাপ্তি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। তখন নিম্ন আয়ের মানুষরাও ক্রেডিট কার্ড নিতে পারবেন, যা ক্যাশলেস সোসাইটি গঠনের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা দ্রুতগতিতে ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনে রূপান্তরিত হচ্ছে। ক্যাশলেস বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ডিজিটাল লেনদেনে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে যেমন পিওএস, এটিএম, সিআরএম, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কিউআর কোড ইত্যাদি। বিগত বছরগুলোতে ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ মাসে ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং ই-কমার্সের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার কোটি টাকা, ২০২২ সালে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। তাই বলা যায়, প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুতগতিতে অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে প্রথাগত আর্থিক লেনদেনের পাশাপাশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা।
তুলনামূলক কম ব্যবহারকারী
আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক কম। দেশে ইস্যুকৃত ডেবিট কার্ডের সংখ্যা ৩ কোটি ১০ লাখ যেখানে ইস্যুকৃত ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যার মধ্যে যে বড় ব্যবধান, এর প্রধান এবং অন্যতম কারণ হলো ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে কাগজপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা। এছাড়া রয়েছে ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে গ্রাহকদের প্রচলিত বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা।
ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়াতে হলে আগে কার্ড ব্যবহারের ইকোসিস্টেম প্রসারিত করতে হবে। কিউ-আরকোড এবং অ্যাপসভিত্তিক লেনদেন বৃদ্ধি পেলে পুরো দেশে ক্রেডিট কার্ড তথা সামগ্রিকভাবে কার্ডের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়বে।
ব্যবহারকারী কারা
ব্যাংকগুলো চাকরিজীবী এবং ব্যবসায়ী উভয় শ্রেণির গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছে, তবে এক্ষেত্রে চাকরিজীবীদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ক্রেডিট কার্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ঋণের সহজলভ্যতা এবং সুবিধাজনক পরিশোধ ব্যবস্থা। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রমোশনাল অফার যেমন ইএমআই, ক্যাশব্যাক ডিসকাউন্টসহ বাই ওয়ান গেট ওয়ান, ইন্স্যুরেন্স, রিওয়ার্ড পয়েন্ট, মিট অ্যান্ড গ্রিট, লাউঞ্জ সুবিধা ইত্যাদি।
ঋণ শোধের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়
ক্রেডিট কার্ড আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য পণ্য হয়ে উঠেছে। এটি নিতে হলে ঋণ পরিশোধের যোগ্যতার প্রমাণের সঙ্গে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রমাণও দাখিল করতে হয়। দেশে এখন রিটার্ন জমা দেওয়ার হার বেড়েছে। সবাই প্রতি বছর তার আয়কর রিটার্ন জমা দেয়। কিন্তু অনেকে অসাবধানতাবশত আয়কর রিটার্ন জমা দেয় না। তাছাড়া অনেকের করযোগ্য আয় না থাকায় তারাও রিটার্ন জমা দেয় না। যা ক্রেডিট ইস্যু করার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও প্রভাব বিস্তার করছে বলে মনে করি।
জীবন সহজ করছে ক্রেডিট কার্ড
ক্রেডিট কার্ড আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। এটির ব্যবহারও অত্যন্ত সহজ। ক্রেডিট কার্ড বিলম্বিত বিল পরিশোধের ভিত্তিতে কাজ করে, যার অর্থ আপনি এখন আপনার প্রয়োজনে কার্ড ব্যবহার করে অর্থ ব্যয় করতে পারেন এবং পরে তা সুবিধামতো সময়ে পরিশোধ করতে পারেন। ব্যবহৃত অর্থ গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ডেবিট হয় না। এভাবে গ্রাহক প্রতিবার তার প্রয়োজনে কার্ড ব্যবহার করতে পারেন, যা আমাদের জীবনযাত্রাকে অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল করে তুলেছে। একজন গ্রাহক যদি নিয়মিত সঠিক সময়ে তার ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করেন তাহলে কখনোই সেই গ্রাহক ঋণগ্রস্ত হবেন না। ব্যাংকগুলোর শক্তিশালী মনিটরিং ও রিকভারি ব্যবস্থা থাকার কারণে এই সেক্টরের খেলাপি ঋণের হার তুলনামূলক অনেক কম।
নিরাপত্তায় প্রয়োজন সচেতনতা
ডিজিটাল পেমেন্টগুলো সাধারণত বিভিন্ন ব্যবহারিক কারণে অফলাইন পেমেন্টের চেয়ে বেশি নিরাপদ। যেমন নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি না থাকা, চুরি, জালিয়াতির আশঙ্কা কম থাকা। ডিজিটাল লেনদেনে গ্রাহকের যে ধরনের সচেতনতা প্রয়োজন
কার্ড নম্বর, কার্ডের পেছনের ৩ সংখ্যার কার্ড ভেরিফিকেশন ভ্যালু (CVV2), ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (OTP), মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং নিরাপত্তা পিন কারও সঙ্গে বিনিময় না করা।
সন্দেহজনক কোনো ওয়েবসাইটে ই-কমার্স লেনদেন থেকে বিরত থাকা ও কার্ডের তথ্য সংরক্ষণ থেকে বিরত থাকা।
সন্দেহজনক কোনো ই-মেইল অথবা এসএমএসে থাকা লিঙ্কে প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকা।
সাইবার সংক্রান্ত ঝুঁকি বিবেচনায় ডিজিটাল ডিভাইসের সব সফটওয়্যার হালনাগাদ রাখা এবং নিরাপত্তা সফটওয়্যার ব্যবহার করা।
যেকোনো সন্দেহজনক লেনদেন অতিসত্বর ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ব্রাঞ্চ অথবা ব্যাংকের কল সেন্টারে অবহিত করা।
কার্ড হারানোর পরপরই ব্যাংকের কল সেন্টারে অবহিত করা।
সাধারণত, অধিকাংশ ব্যাংকই নির্দিষ্ট লেনদেনের পরিমাণের ভিত্তিতে ক্রেডিট কার্ডের বার্ষিক ফি সম্পূর্ণ বা আংশিক মওকুফ করে দিয়ে থাকে, যার ফলে এটি গ্রাহকের ওপর বাড়তি কোনো চাপ সৃষ্টি করে না। ক্রেডিট কার্ড একটি লাইফস্টাইল পণ্য, বিশ্বের অন্যান্য দেশের ক্রেডিট কার্ডের সুদের হারের তুলনায় বাংলাদেশে তা অপেক্ষাকৃত অনেক কম। তবে ব্যাংকগুলো সেটেলমেন্টের দিন থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন পর্যন্ত বিনাসুদে বিল পরিশোধের সুযোগ দিয়ে থাকে। তাই যদি কোনো গ্রাহক বুঝে সচেতনভাবে নিয়মিত বিল পরিশোধ করে তবে এটা কিন্তু গ্রাহকদের জন্য একটি চমৎকার সুযোগ।
গ্রাহকদের বিভিন্ন চাহিদার কথা মাথায় রেখে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন উৎসবে নানা ধরনের অফার দিয়ে থাকে যার ফলে গ্রাহক বেশি বেশি লেনদেন করতে উদ্বুদ্ধ হয় যা ব্যবসায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এ যেন ২০২২ বিশ্বকাপের ফাইনাল! সুলেমান দিয়াবাতে যেন কিলিয়েন এমবাপ্পে। না, ১৮ ডিসেম্বর লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে ফরাসি যুবরাজ এমবাপ্পের মতো ট্র্যাজিক হিরো হতে হয়নি দিয়াবাতেকে। হয়েছেন বিজয়ী দলের গর্বিত সেনাপতি। দুই ঐতিহ্যবাহী দল মোহামেডান ও আবাহনীর মধ্যে ফেডারেশন কাপের ফাইনালটা হয়ে উঠেছিল এক বাঁক বদলের লড়াই। যতবার আবাহনী এগিয়ে গেছে ততবারই দিয়াবাতে জ্বালিয়েছেন মোহামেডানের আশার প্রদীপ। নির্ধারিত ৯০ মিনিট ৩-৩। অতিরিক্ত সময়ে ৪-৪। আবাহনীর চার গোল চার জনের; কিন্তু মোহামেডানের চারটাই দিয়াবাতের। এরপর টাইব্রেকারের ভাগ্য পরীক্ষার শুরুটাও মালির ফরোয়ার্ডের লক্ষ্যভেদে। শেষ পর্যন্ত ভাগ্য পরীক্ষাটা ৪-২ গোলে জিতে ৯ বছর পর কোনো টুর্নামেন্টের শিরোপার স্বাদ পেল মোহামেডান।
ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে ম্যাচের শুরুতে এগিয়ে ছিল আবাহনীই। তাদের সামনে প্রথমার্ধে বড্ড অগোছালো মনে হয়েছে আলফাজ শিষ্যদের। মারিও লেমস তুণের সব সেরা তীরদের জড়ো করে একাদশ সাজিয়েছিলেন। যার নেতৃত্ব দেন হাফ-ফিট রাফায়েল আগুস্তো। আক্রমণভাগে তার দুপাশে ছিলেন দানিয়েল কলিনদ্রেস ও তরুণ ফয়সাল আহমেদ ফাহিম। আর ঠিক ওপরে এমেকা ওগবাহ। আকাশির আক্রমণ ঠেকাতে তখন নাজেহাল সাদা-কালোরা। উপর্যুপরি আক্রমণ থেকে আবাহনীকে ১৬ মিনিটে এগিয়ে নেন ফাহিম। কলিনদ্রেসের কাছ থেকে বল পেয়ে এমেকা ওগবাহ ডিফেন্সচেড়া পাস বাড়ান। চলন্ত বলে ফাহিমের বাঁ পায়ের শট মোহামেডান কিপার সুজন হোসেনের গ্লাভস ছুঁয়ে জালে জড়ায়। মোহামেডান অসহায়ত্বের সুযোগ ৪৩ মিনিটে কাজে লাগান কোস্টারিকার বিশ্বকাপার কলিনদ্রেস। নিজেদের অর্ধ থেকে হৃদয়ের বাড়ানো বল আয়ত্তে নিয়ে মার্কার হাসান মুরাদকে কোনো সুযোগ না দিয়ে ডান পায়ের জোরালো শটে বল দূরের পোস্ট দিয়ে জালে জড়ান এই তারকা।
বিরতি থেকে মাঠে ফিরে অন্যরকম এক মোহামেডান। আলফাজ তিনটি পরিবর্তন করে মাঠে পাঠান জাফর ইকবাল, শাহরিয়ার ইমন ও আলমগীর রানাকে। তাতেই গতি পায় সাদা-কালোর আক্রমণ। ৫৬ মিনিটে ২-১ করেন দিয়াবাতে। কামরুলের ক্রস হেড করে ক্লিয়ার করতে গিয়ে ডিফেন্ডার আলমগীর মোল্লা বল দিয়ে দেন দিয়াবাতের কাছে; দুর্দান্ত সাইডভলিতে বল জালে জড়ায় দিয়াবাতে। চার মিনিট পর সমতাসূচক গোল করেন তিনি। উজবেক মিডফিল্ডার মোজাফফরভের জোরালো ভলি আবাহনী কিপার রুখলেও বাঁদিকে জাফর পেয়ে দ্রুত ক্রস ফেলেন গোলমুখে। মার্কারদের ছাপিয়ে দারুণ হেডে সোহেলকে পরাস্ত করে ম্যাচ জমিয়ে তোলেন দিয়াবাতে। ৬৫ মিনিটে এমেকা ওগবাহর হেড পোস্টে লেগে ফিরলে হতাশ হতে হয় আবাহনীকে। পরের মিনিটে ডান দিক থেকে ফাহিমের শট সুজন কোনোমতে সেভ করলেও আলতো ট্যাপে গোল করে আবাহনীর লিড পুনরুদ্ধার করেন এমেকা (৩-২)। তবে ৮৩ মিনিটে কামরুলের কর্নারে দিয়াবাতে হ্যাটট্রিক করে মোহামেডানকে আবার ম্যাচে ফেরান।
অতিরিক্ত সময়ের শুরুতে দুটি অসাধারণ সেভ করেন মোহামেডান কিপার সুজন। ৯৬ মিনিটে রহমতের কর্নার ঘুরে ফিরে রাফায়েলের কাছে এলে তাতে দারুণ শট নেন। তবে সুজন ঝাঁপিয়ে তা রুখে দেন। পরের মিনিটে কলিনদ্রেসের কর্নারে আসাদুজ্জামান বাবলুর হেড ফিস্ট করে বিপদমুক্ত করে মোহামেডানকে ম্যাচে রাখেন সুজন। ১০৬ মিনিটে মোহামেডানকে পেনাল্টি উপহার দেন সোহেল। শাহরিয়ার ইমনের ঠেলে দেওয়া বল ধরতে ছুটছিলেন দিয়াবাতে। তার এক টাচে বলটা চলে যাচ্ছিল গোললাইনের বাইরে। তবে সোহেলের পা ধরে টান দিলে পড়ে যান দিয়াবাতে। পেনাল্টি থেকে সোজাসুজি শটে প্রথমবারের মতো মোহামেডানকে লিড এনে দেন দিয়াবাতে। এই ম্যাচটা সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। তবে বিধাতা যে ফাইনালের চিত্রনাট্য লিখেছেন অন্যভাবে। ম্যাচের ১১৬ মিনিটে মোহামেডানের তেকাঠীর আস্থা সুজনকে ব্যথা পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয়। মাঠে এসে অপ্রস্তুত আহসান হাবিব বিপুকে পরের মিনিটেই গোল হজম করতে হয়। রয়্যালের কাছ থেকে আড়াআড়ি পাস পেয়ে বক্সের অনেক বাইরে থেকে ডানপায়ের জোরালো শটে গোল করেন এই ডিফেন্ডার। তাতে ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টিতে।
ভাগ্য পরীক্ষায় অবশ্য বিপু মোহামেডানের বিজয়ের নায়ক হয়ে ওঠেন বিপু। শুরুতেই ঠেকিয়ে দেন রাফায়েলের শট। অন্যদিকে দিয়াবাতে, আলমগীর কবির রানা, রজার দুরাতে টানা ৩ গোল করেন। আবাহনীর হয়ে এমেকা ও ইউসেফ গোল করলে স্কোরলাইন দাঁড়ায় ৩-২। এরপর মোহামেডানের শাহরিয়ার ইমনের শট সোহেল ঠেকিয়ে দিলে আবাহনীর ফেরার আশা জাগে। তবে বিপু কলিনদ্রেসের শট রুখে দিলে উত্তাল হয়ে ওঠে মোহামেডান গ্যালারি। আর কামরুল হাসান ঠিকঠাক লক্ষ্যভেদ করে অনেক চাওয়ার শিরোপা নিশ্চিত করেন মোহামেডানের।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নির্মিত হয়েছে বিশেষ কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘ও ভোরের পাখি’। ঈমাম হোসাইনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করেছেন তামান্ন তিথি। অনুষ্ঠানটিতে আবৃত্তি করেছেন আশরাফুল আলম, মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, পলি পারভিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, আসলাম শিশির, সংগীতা চৌধুরী, আহসান উল্লাহ তমাল। প্রচারিত হয় ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টায়।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমারে দেবো না ভুলিতে’। অনুষ্ঠানটিতে গান, কবিতা ও আলোচনার সমন্বয়ে কবিকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ইয়াসমিন মুসতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, শেলু বড়ুয়া, ছন্দা চক্রবর্ত্তী ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন প্রফেসর মুন্সী আবু সাইফ। মনিরুল হাসানের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে ২৫ মে দুপুর ১ টা ০৫ মিনিটে। আরও প্রচারিত হবে সংগীতানুষ্ঠান ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘সন্ধ্যামালতী’। রাত ৯টায় প্রচারিত হবে নাটক ‘বনের পাপিয়া’ (পুনপ্রচার)।