
১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আব্দুল মোতালেব হাওলাদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে অনার্স পড়াকালে সেনাবাহিনীর অফিসার ক্যাডেট নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে লেফটেন্যান্ট ও ১৯৭০ সালে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় মহিউদ্দীন তখন পশ্চিম পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় কর্মরত। দেশের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি জুলাই মাসে কর্মস্থল ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম পার্বত্য এলাকা অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান তখন ৭ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার। সামরিক বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের অফিসার মহিউদ্দীন সেখানে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যুক্ত হন। তিনি কানসাট, আরগরারহাট, শাহপুরসহ কয়েকটি সফল অভিযান চালান। ডিসেম্বরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখলের জন্য তাকে একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দেওয়া হয়। ১৩ ডিসেম্বর এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাসহ তিনি রেহাইচরের মধ্য দিয়ে নৌকাযোগে মহানন্দা নদী পার হন এবং শত্রুর কয়েকটি বাংকার দখল করে নেন। তিনি শত্রুর মেশিনগান ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়ে বাঁ হাতে এসএমজি ও ডান হাতে একটি গ্রেনেড নিয়ে গোপনে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসেন। হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তা পার হয়ে তিনি গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এ সময়ই শত্রুর গুলি তার কপালে বিদ্ধ হয় এবং তিনি শহীদ হন। ভোর রাতে মহিউদ্দীনের মৃতদেহ উদ্ধার করে ছোট সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানসূচক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
২০২২ সালের ৪ জুন বিস্ফোরিত হয়েছিল সীতাকুন্ড। বিএম ডিপোর হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরণের নিদারুণ ক্ষত ও দাগ মুছেনি এখনো। ৯টি মাস না যেতেই আবারও বিস্ফোরিত হলো সীতাকুন্ড। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কদমরসুল (কেশবপুর) এলাকায় ‘সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডের’ প্লান্টে ৪ মার্চ ২০২৩ তারিখে ঘটল আবার বিপজ্জনক বিস্ফোরণ। ঘটনায় নিহত ছয় এবং আহত শতাধিক। ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সাত সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সীমা অক্সিজেন প্লান্টের দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য নিতে পারেনি গণমাধ্যম, তারা পালিয়ে গেছেন। বিস্ফোরণের পর ফায়ার সার্ভিসের কুমিরা, সীতাকুন্ড ও আগ্রাবাদের নয়টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে অংশ নেয়। র্যাব, সেনাবাহিনী, পুলিশ, নৌবাহিনী, বিভিন্ন সংস্থা ও সাধারণ মানুষ উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। প্রতিটি বিস্ফোরণই বিপজ্জনক, একটির সঙ্গে আরেকটির কোনোভাবেই তুলনা করা যায় না। কিন্তু এবারের বিস্ফোরণে বহুদূরের জনজীবনও নিরাপদ ছিল না। বিস্ফোরণে প্রায় দুই কিলোমিটারের বেশি এলাকা কেঁপে ওঠে। আশপাশের বহু বাড়ির কাচের জানালা ভেঙে পড়ে। ঘটনাস্থল থেকে বহু দূরে ৩০০ কেজি ওজনের লোহার খন্ড উড়ে এসে মাথায় আঘাতে একজন নিহত হন। সীমা অক্সিজেন কারখানায় কেন বিস্ফোরণ ঘটেছে এ বিষয়ে কেউ কিছু জানাতে পারেননি। ‘গ্যাস সিলিন্ডার নীতিমালা ১৯৯১’ অনুযায়ী অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপনের জন্য বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হয়। সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে কিনা কেউ জানেন না। এমনকি এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাটি নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায়ও ছিল না। কিন্তু সীমা অক্সিজেন কারখানাটি তো আর চলনবিল বা চিম্বুক পাহাড়ে অবস্থিত নয়। সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে এই সীমা অক্সিজেন প্লান্টের অবস্থান। কারখানার উত্তরে নয় মাস আগের অগ্নিদগ্ধ বিএম কনটেইনার। রাসায়নিক কারখানা বোঝাই এই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বাস করেন শত সহস্র শ্রমিক। এরা সবাই বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন জীবিকার কারণে। কৃষক থেকে হয়েছেন ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার শ্রমিক। তো এই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল, যেখানে এর আগে বিস্ফোরণ ঘটেছে সেখানকার প্রতিটি কারখানা বিষয়ে রাষ্ট্র কেন মনোযোগী হলো না? কেন এতদিনেও এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বিশেষ ব্যবস্থাপনার অংশ হলো না। বিএম ডিপোর পর সীমা কারখানার এই বিস্ফোরণ প্রমাণ করেছে ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা বিষয়ে আমরা দায়িত্বশীল নই। এমন কারখানাগুলোর লাইসেন্স থেকে শুরু করে উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা কোথাও আমাদের নজরদারি ও জবাবদিহি নেই। অবশ্যই এ বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে সামগ্রিক বিবেচনায় আনা জরুরি। আমরা আশা করব সীমা কারখানা বিস্ফোরণের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। ঘটনায় নিহত ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর পাশে মানবিক মর্যাদা নিয়ে দাঁড়াবে রাষ্ট্র। রাসায়নিক বোঝাই ঝুঁকিপূর্ণ সীতাকুন্ডের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে রাষ্ট্র পরিবেশবান্ধব সংবেদনশীল নীতিমালা গ্রহণ করবে। আমরা কোনোভাবেই চাই না বিএম ডিপো কিংবা সীমা অক্সিজেন একের পর এক বিস্ফোরণে দগ্ধ চুরমার হবে ঐতিহাসিক সীতাকুন্ড। সীতাকুন্ডের উৎপাদন অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রাণ-প্রকৃতি ও জনজীবনের নিরাপত্তা রাষ্ট্রকেই সুরক্ষিত রাখতে হবে।
নিমতলীর রাসায়নিক বোঝাই গুদামঘর, তাজরীন গার্মেন্টস, সেজান জুস কারখানা, বিএম ডিপো থেকে সীমা অক্সিজেন। একের পর এক প্রশ্নহীন আগুন। নিমেষেই অঙ্গার টাটকা জীবন। চুরমার সংসার, বিশৃঙ্খল পরিবার। তদন্ত হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করে, মামলা হয়, ক্ষতিপূরণ কিছু দেওয়া হয় কিংবা কিছু ধরপাকড় হয় কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক কিছুই হয় না। তাজরীন, রানা প্লাজা, নিমতলী, সেজান কারখানা কি সীতাকুন্ড ডিপো বিস্ফোরণে প্রশ্নহীন প্রাণহানিকে অনেকেই কাঠামোগত হত্যাকান্ড বলেন। তবে কাঠামো বিশ্লেষণে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক সংগঠন, দুর্নীতি, অবহেলা, উদাসীনতা, দায়হীনতাকেই মূলত আলাপে টানতে দেখা যায়। বিশ্বায়িত বাজার, করপোরেট বাহাদুরি কিংবা নয়া-উদারবাদী ভোগবাদ উল্লিখিত কাঠামোয় আড়াল হয়ে থাকে। অথচ এসব বিস্ফোরণ এবং প্রাণহানির অতলে পোক্ত হয়ে আছে আমাদের নয়া-উদারবাদী করপোরেট ভোগবাদ।
সীতাকুন্ডে বিএম ডিপো বা সীমা অক্সিজেন কারখানা বিস্ফোরণের মূলে আছে করপোরেট বিশ্বায়িত বাজারের নিয়ন্ত্রিত ভোগবাদ। সীতাকু- বিএম ডিপো বিস্ফোরণে নিদারুণভাবে নিহত হয়েছিলেন ৪১ জন, এবার সীমা অক্সিজেনের আগুনে পুড়েছেন ছয় জন। এইসব বিস্ফোরণে কারা অঙ্গার হয়? গ্রামগঞ্জের মেহনতি গরিব মানুষ। নয়া-উদারবাদী বাজারকে আর করপোরেট ভোগবাদকে চাঙ্গা রাখতে এই গরিব মানুষের জীবন সবসময় এক একটি নির্দয় সংখ্যায় পরিণত হয়। আমাদের মনে রাখা জরুরি, ঝুঁকিপূর্ণ উৎপাদনে কর্মরত নিহত প্রতিটি জীবন কোনো সংখ্যা নয়, এক একজন স্বতন্ত্র মানুষ। কেন গরিব মানুষের কর্মস্থল প্রশ্নহীনভাবে ঝুঁকিপূর্ণ থাকে? কেন গরিবের কর্মপরিসর অনিরাপদ ও বিপজ্জনক হয়ে থাকবে চিরকাল? অথচ এমন কারখানাগুলোই দেশের গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন খাত এবং উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি। তাহলে এসব কর্মক্ষেত্র কেন মানবিক, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব হবে না? বারবার একের পর এক অগ্নিকা- বা বিস্ফোরণ ঘটবে আর আমরা ক্ষতিপূরণ কিংবা গাফিলতির মোড়কে কাঠামোগত বৈষম্যকে ঢেকে রাখব। ব্যবস্থাপনা ও নীতিপ্রশ্নের মূল আলাপে টানব না। এভাবে কোনোভাবেই সীতাকু-কে দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যতের জন্য সামগ্রিকভাবে নিরাপদ করে তোলা সম্ভব কি?
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রামকে এখন অনেকেই পরিচয় করান ‘বন্দরনগরী’। আর এই বন্দর আজ বিস্ফোরণের বিপদে বোঝাই। বিএম ডিপো বিস্ফোরণের পর জানা যায়, বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুদ এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতিমালা ছাড়াই বন্দরে গড়ে উঠেছে একের পর এক ডিপো ও কারখানা। ১৯৮৪ সালে সি-ফেয়ার্স লিমিটেড নামে বেসরকারি আইসিডি চালুর ভেতর দিয়ে বেসরকারি ডিপোর কাজ শুরু হয় এবং ২০২১ পর্যন্ত গড়ে ওঠে ১৯টি ডিপো। ২০২০ সালেও এখানে অগ্নিকান্ড ঘটে এবং সেই অগ্নিকান্ডের পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগুন লাগা শেডে ১৯৮৭ সালে আমদানি করা পণ্যও ছিল। বিএম ডিপো বিস্ফোরণ থেকে আমরা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করিনি এমনকি এসব বিষয়ে হয়তো আমাদের কলিজায় একটুও দাগ কাটে না। তাহলে আমরা সতর্ক থাকলাম না কেন? কেন আবার আরেকটি সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটতে দিলাম? দাহ্য বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুদ, ব্যবহার, উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনায় আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি ও কাঠামোগুলো কতটা কীভাবে মানছি বা আমাদের আরও কীভাবে নিজেদের নিরাপত্তা জোরদার করা যায় সেইসব বিষয়ে দ্রুত রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ও অঙ্গীকার জরুরি।
সীমা অক্সিজেন বা বিএম ডিপো নয়; চট্টগ্রাম বন্দরে এর আগেও বহু রাসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটেছে। ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালে মিথানলভর্তি ড্রামে বিস্ফোরণ ঘটে, চার জন শ্রমিক গুরুতর আহত হন ও দগ্ধ হন অনেকেই। ২০২০ সালের ১৫ জুলাই রাতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি গাড়ি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কেবল বন্দর নয়, দেশের রাসায়নিক মজুদাগার কি করপোরেট কারখানা সর্বত্রই ঘটছে বিস্ফোরণ ও প্রাণহানি। পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে অগ্নিবিস্ফোরণ ঘটে ২০১০ সালের ৩ জুন। আগুনে নিহত হয় ১২৪ জন মানুষ। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় আগুন লেগে ১১৭ জন গার্মেন্টশ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বিস্ফোরণ ও ভবন ধসে ৩৫ জন নিহত হয়। ঢাকার কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় ‘প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ কারখানায় ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর অগ্নিকা-ে ২১ জন নিহত হন। পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে রাসায়নিক বোঝাই এক ভবন বিস্ফোরিত হয় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৬৭ জন, দগ্ধ আরও চার জন হাসপাতালে মারা যান। ৭ জুলাই ২০২১ রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপে অবস্থিত ‘হাসেম ফুড বেভারেজ কোম্পানির’ ছয়তলা কারখানাটিতে আগুন লাগে। পুড়ে মারা যান ৫২ জন শ্রমিক। প্রতিটি অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণ কেবল মানুষ নয়; প্রাণ-প্রকৃতিসহ সামগ্রিক প্রাকৃতিক ও সামাজিক জীবনকে তছনছ করে দেয়। জীবনের জন্যই উৎপাদন, আর এই উৎপাদন যদি বারবার জীবনকে বিপন্ন করে তোলে তাহলে দেশের সামগ্রিক বিকাশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
লেখক: গবেষক ও লেখক
সাত মার্চের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা, মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই, আমি এবং স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ আমরা এই সভা সংগঠিত করার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। সকাল থেকেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনস্রোত আসতে থাকে। তখন মানুষের মুখে মুখে স্বাধীনতা। একটি ঘটনা আমার মনে পড়ে। সাতই মার্চ দুপুর ১টা। আমি এবং আমারই আরেক প্রিয় নেতা নামোল্লেখ করলাম না, আমরা দুজন বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের দুজনের কাঁধে হাত রেখে কথা বলছিলেন। আমাদের সেই নেতা যখন বঙ্গবন্ধুকে বললেন, তিনি তাকে ‘লিডার’ বলে সম্বোধন করতেন ‘লিডার, আজ কিন্তু পরিপূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়া মানুষ মানবে না।’ আমাদের কাঁধে রাখা হাত নামিয়ে তার নামোচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে বললেন, ‘আই অ্যাম দি লিডার অব দি পিপল। আই উইল লিড দেম। দে উইল নট লিড মি। গো অ্যান্ড ডু ইউর ডিউটি।’ এই বলে তিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওপরে চলে গেলেন।
আমরা ধানমণ্ডি থেকে রওনা করি পৌনে ৩টায়। রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাই সোয়া ৩টায়। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা আরম্ভ করেন সাড়ে ৩টায়। দশ লক্ষাধিক লোকের গগনবিদারী স্লোগানে মুখরিত রেসকোর্স ময়দান। আমি নিজেও স্লোগান দিয়েছি। সেদিনের সভামঞ্চে সৌভাগ্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা করার। বলেছিলাম, ‘এবার বক্তৃতা করবেন প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ সেদিনের সভামঞ্চে জাতীয় চার নেতাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন, চারদিকে তাকালেন। মাউথপিসের সামনে পোডিয়ামের ওপর চশমাটি রাখলেন। হৃদয়ের গভীরতা থেকে যা তিনি বিশ্বাস করতেন, যার জন্য তিনি সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন, সেই বিশ্বাসী আত্মা দিয়ে, বাংলার মানুষকে তিনি ডাক দিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার’। তারপর একটানা ১৮ মিনিট ধরে বলে গেলেন স্বাধীনতার অমর মহাকাব্য। বক্তৃতায় তিনি মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। বঙ্গবন্ধুর সামনে ছিল দুটি পথ। এক. স্বাধীনতা ঘোষণা করা। দুই. পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব না নিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত না হয়ে সুচিন্তিত বক্তব্য প্রদান করা। তিনি দুটোই করলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন সেদিনের পরিস্থিতি। যেটা তিনি আমাদের বলেছিলেন। সেনাবাহিনী তখন প্রস্তুত। মাথার ওপর বোমারু বিমান এবং হেলিকপ্টার গানশিপ টহল দিচ্ছে। যখনই বঙ্গবন্ধু এই ভাষায় বলবেন যে, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’, তখনই তারা গোলাবর্ষণ শুরু করবে। সেজন্য বঙ্গবন্ধু সবকিছু জেনেই বক্তৃতা করেছেন। এত বিচক্ষণ নেতা ছিলেন যে, সমস্ত ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সামরিক শাসকের উদ্দেশে চারটি শর্ত আরোপ করলেন ‘মার্শাল ল’ প্রত্যাহার করো, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নাও, এ কয়দিনে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার বিচারবিভাগীয় তদন্ত কর এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করো।’ এই চারটি শর্ত আরোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হলেন না। পাকিস্তানিরা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন সদা সতর্ক এবং সচেতন। অপরদিকে পুরো বক্তৃতাটি জুড়ে ছিল আসন্ন জনযুদ্ধের রণকৌশল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ ‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।’ ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব।’ ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে’ তোলার আহ্বান জানিয়ে বললেন, ‘সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো ওয়াপদা কোনোকিছু চলবে না।’ নির্দেশ দিলেন ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।’ সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো কেউ দেবে না।’ গরিবের কথা খেয়াল রেখে বলেছেন, ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে’ সেজন্য শিল্প কল-কারখানার মালিকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়া দিবেন।’ জীবনভর লালিত প্রগাঢ় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে বিরোধী রাজনীতিকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ আর রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাবডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত কওে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ বক্তৃতা শেষ করেছেন মূলত স্বাধীনতা ঘোষণা করেই। বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অর্থাৎ সামগ্রিকতায় জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতা। সেদিনের সেই স্মৃতি মানসপটে ভেসে ওঠে। অভূতপূর্ব দৃশ্য, কল্পনা করা যায় না।
আমি লক্ষ্য করেছি, বঙ্গবন্ধু জীবনে কখনো স্ববিরোধী বক্তব্য দেননি। যা তিনি বিশ্বাস করেছেন, ভেবেছেন, মনে করেছেন যে এটিই বাস্তবসম্মত, সেটিই তিনি বলেছেন। শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছে শুনেছি, ৬ তারিখ রাতে বঙ্গবন্ধু পায়চারী করেছেন এবং ভেবেছেন কী বলবেন! বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘তোমার এত চিন্তার কারণ কী? সারা জীবন তুমি একটি লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, তোমার জীবনের যৌবন তুমি পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছ, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছ। তুমি যা বিশ্বাস করো, সেই বিশ্বাস থেকেই আগামীকাল বক্তৃতা করবে।’ বঙ্গবন্ধু তার হৃদয়ে ধারিত গভীর বিশ্বাস থেকেই সেদিন বক্তৃতা করেছেন।
আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের বক্তৃতা বিশ্লেষণ করি তবে দেখব, অলিখিত একটি বক্তৃতা। ভাষণের সময় ১৮ মিনিট। শব্দ সংখ্যা ১৩০৮টি। আব্রাহাম লিংকনের এবঃঃুংনঁৎম অফফৎবংং-এর শব্দ সংখ্যা ২৭২, সময় ৩ মিনিটের কম এবং লিখিত। অপরদিকে, মার্টিন লুথার কিং-এর ও যধাব ধ ফৎবধস ভাষণটির সময় ১৭ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১৬৬৭। কিন্তু বিশ্বের কোনো নেতার ভাষণ এমন সংগ্রামমুখর ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী নিরস্ত্র মানুষের সামনে হয়নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি প্রদান করে মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে, নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিলেন। কী বিচক্ষণ একজন নেতা! আইএসআই সাতই মার্চ ঢাকা ক্লাবের সামনে ছিল। তারা অপেক্ষা করেছিল-যে ঘোষণাটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’ তারা মনে করেছিল সেই কথাটি তিনি সাতই মার্চ বলবেন। আমি আগেই বলেছি বঙ্গবন্ধু ছিলেন সতর্ক। তিনি সবই বলেছেন, কিন্তু শত্রুর ফাঁদে পা দেননি। উল্টো শত্রুকেই ফাঁদে ফেলেছেন। যার জন্য পরদিন আইএসআই রিপোর্ট করল ‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সঙ্গে বক্তৃতা করে গেল। একদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা করল, আরেকদিকে ৪টি শর্ত আরোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হলো না এবং পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নিল না। আমাদের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমরা যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম সেটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।’ এই একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে একই মোহনায় দাঁড় করিয়েছেন।
লেখক : আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
দেশের পোলট্রি শিল্পের ভেতরের অবস্থা বড় করুণ। ডিম-মুরগি, ফিডসহ গোটা সেক্টরে হাহাকারের জের কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে, তা অনেকের ধারণার বাইরে। যেমনটি ধারণাতীত ছিল গত ক’দিন ধরে ডিম-মুরগি বাজারে চলমান উথাল-পাথাল পরিস্থিতি। এ অবস্থা চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যে ডিমের হালি শত টাকায় ওঠার শঙ্কা ঘুরছে। আসন্ন রমজানেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। পরিস্থিতিও আরও জটিল হওয়ার বার্তা ঘুরছে।
বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্পের শুরুটা মসৃণ ছিল না। পোলট্রির ডিম বা ব্রয়লার মুরগি নিয়ে ছিল নানান মন্দকথা। এর স্বাদ ও গুণাগুণ বোঝাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের। আশির দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫শ’ কোটি টাকা। সম্ভাবনার জেরে এখন তা ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আমদানি-নির্ভর খাতটি মাত্র ৪ যুগের তফাতে অনেকটাই আত্মনির্ভরশীল। মানুষের মধ্যে নিয়মিত ডিম খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। গরিব ও মধ্যবিত্ত আমজনতার তুলনামূলক কম দামে প্রাণিজ আমিষের জোগান মিলছে এ শিল্প থেকে। চিকেন নাগেট, সসেজ, ড্রামস্টিক, বার্গারসহ অনেক আইটেম মুখরোচক নতুন প্রজন্মের কাছে। প্রায় ৬৯ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর্মসংস্থানের এ খাতটিতে এখন বড় রকমের ছেদ।
দাম বৃদ্ধি পাওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে বিশেষ আলোচনার জায়গায় ডিম আর মুরগি। গরু-খাসির কথা ভুলে মাংস বলতে মানুষের ভরসা হয়ে ওঠা ফার্মের মুরগিও নাগালের বাইরে চলে যেতে বসেছে। অবস্থাটা হুট করে হয়নি। কেবল রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও হয়নি। ফুড ও ফিড ইন্ডাস্ট্রির কাঁচামালের দাম বাড়বাড়ন্ত গত কয়েক বছর থেকেই। করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ফিড তৈরির কাঁচামালের দামে নতুন করে টোকা পড়ে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে তা লাগাম ছাড়া হয়ে যায়। এখন কিছুদিন পরপরই ফ্রিস্টাইলে বাড়ছে ভুট্টা-সয়াবিনসহ অন্যান্য উপকরণের দাম। কয়েকটির দাম ১৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সেখানেও বড়দের চোখ রাঙানি। আমদানি ও স্টকে তাদের সক্ষমতার তোড়ে ছোটদের অনেকের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
এর প্রভাব পড়েছে উৎপাদন খরচ ও খুচরা দামে। এমন একটি পরিস্থিতি হবে, বড়-ছোট খামারিসহ উদ্যোক্তারা সরকারের উচ্চ মহলকে অবিরাম আভাস দিলেও তা তেমন আমল পায়নি। বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ফিড উৎপাদনে সম্পৃক্তদের নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে একটি কমিটি থাকলেও কার্যক্রম না থাকার মতো। অথচ মধ্যস্বত্বভোগীরা আগেভাগেই তা মালুম করেছে। ভাও বুঝে নাও টেনেছে তারা। ফিডের কাঁচামাল স্টকের পাশাপাশি নিজেদের সিন্ডিকেটকে শক্তিমান করেছে। ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের আমদানিকারকদের মাঠে মেরে ফেলার মতো অবস্থা করে গোটা সেক্টরের বর্তমান ভবিষ্যৎ কব্জায় নিয়েছে। প্রান্তিক বনাম করপোরেট খামারিদের বিরোধ চাঙ্গার ফাঁকে মাথা ঢুকিয়ে বাজারব্যবস্থাপনার খবরদারি পুরোটাই এ ফড়িয়াদের হাতে। কোনো পর্যায়ের খামারি-বিক্রেতাই ভালো নেই। আরও নাশকতার মতো বিষয় হচ্ছে, এ সেক্টরে দাম ঠিক করার বিষয়-আশয়ও কম। কেবল ফিড নয়; ডিম, ব্রয়লার মুরগি, সোনালি মুরগি, একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা কোনোটিতেই যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থাই নেই।
একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দরপতন শুরু হয়েছে গত বছরের মে মাস থেকে। মাঝে আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে মার্কেট কিছুটা ভারসাম্যের মধ্যে এলেও পরে আবার দর পড়ে যায়। ২০২২ সালে একদিন বয়সী ব্রয়লার বাচ্চার সর্বনিম্ন দাম ছিল ৮ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫১ টাকা। যেখানে গড় উৎপাদন খরচ পড়ত ৩৮.৭৮ টাকা। ফলে প্রতিটি একদিন বয়সী ব্রয়লার বাচ্চা বিক্রিতে উৎপাদনকারীদের লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় ৩.৯১ টাকা। লেয়ার বাদামি বাচ্চার সর্বনিম্ন দাম ছিল ১৩ টাকা, সর্বোচ্চ ৩১ টাকা। গড়ে প্রায় ২২ টাকা। অথচ উৎপাদন খরচ পড়েছে গড়ে ৪৬.৭৫ টাকা। এ হিসাবে প্রতিটি লেয়ার বাচ্চায় লোকসান প্রায় ২৪.৭৫ টাকা। লোকসানের পাল্লা ডিমেও। গত কিছুদিন ধরে প্রতিটি ডিম উৎপাদনে খরচ পড়ছে ১১ টাকার মতো। মার্চের শুরু থেকে খামারিরা বাদামি ডিম বিক্রি করছে ৯.৩৫ টাকায়, সাদা ৮.৮৫ টাকায়। ২০২২ সালে পাইকারি বাজারে বাদামি ডিমের গড় দাম ছিল ৮.৭৯ টাকা এবং সাদা ডিমের ৭.৯২ টাকা। যেখানে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ১০.৩১ টাকা। এ হিসাবে প্রতি ডিমে খামারির লোকসান ১.৫২ টাকা থেকে ২.৩৯ টাকা। ক্ষতির অঙ্ক ব্রয়লার মুরগিতেও। এক কেজির একটি ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে খামারির খরচ পড়ে ১৪৯ টাকা থেকে ১৫২ টাকা। ২০২২ সালে পাইকারি বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে সর্বনিম্ন ১১৮ টাকা, সর্বোচ্চ ১৪৮ টাকা। গড় মূল্য ছিল ১২৯ টাকা।
আর উৎপাদন খরচ ১৪৪.৯৪ টাকা। হিসাব বলছে, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগিতে খামারিদের লোকসান প্রায় ১৫.৯৬ টাকা। এমন নাকানি-চুবানিতে গত মাস কয়েকে অনেক খামারি বসে গেছেন। খুচরা-পাইকারি বিক্রেতাদেরও লাভের মুখ দেখা হয় না। কিন্তু, ফড়িয়া বা মিডলম্যানদের কোনো ঝুঁকি নেই। অনেকটা বিনা পুঁজিতে টাকা গুনছে। করপোরেট হাউজ নামে পরিচিতরাও যে খুব ভালো অবস্থায় আছে এমনও নয়। তবে, একসঙ্গে পোলট্রি খাদ্য, ডিম, বাচ্চা ও মাংস উৎপাদন এবং সরবরাহ করা করপোরেট প্রতিষ্ঠান টিকে আছে মোটামুটি দাপটের সঙ্গে। সংখ্যায় তারা হাতেগোনা। হলেও নিয়ন্ত্রণ অনেক দূর। তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে চুক্তিভিত্তিক খামার বা কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ব্যবস্থা। যোগফলে তাদের প্রোডাকশন বিস্তর। প্রান্তিক খামারিরা দৈনিক গড়ে ৫ হাজার মুরগি সরবরাহ করলে করপোরেটরা করে ১ থেকে ৫ লাখ পিস। পরিমাণে কম হলেও মোটামুটি ভালো অঙ্কের লাভ তুলে নিচ্ছে তারা। তাদের সক্ষমতার জোরে ডিম-মুরগি-ফিডের বাজার হয়ে উঠছে এককেন্দ্রিক। বিপরীতে পোলট্রি সামগ্রীর দাম বেশি হওয়ার মধ্যেও অপ্রত্যক্ষ লাভের ছড়িটা তাদের হাতে। প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না সাধারণ খামারিরা। হালে দম নেওয়ার অবস্থাও নেই। অথচ উৎপাদন সক্ষমতায় কম-বেশি হলেও প্রান্তিকদের ফেলনা ভাবার জো ছিল না। নিজেরা নিজেদের ফেলনা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন তাদের কেউ কেউ।
অনেকটা আত্মসমর্পণের মতো অবস্থা ছোট ও মধ্যম পর্যায়ের খামারিদের অনেকের। চেয়ে চেয়ে দেখা বা এ লাইন ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গতি নেইÑ এমন একটি ধারণা ভর করেছে তাদের মধ্যে। অল্প বা মধ্যম পুঁজির ফিড আমদানিকারকদের কারও কারও এ অবস্থা। কেউ ছেড়ে দে কেঁদে বাঁচি দশায় চলে যাচ্ছেন অন্য ট্রেডে; কেউ নতুন করে আর বিনিয়োগ না করে এক সময় দুহাতে কামানো টাকা সংরক্ষণে ব্যস্ত। এর অনিবার্য জের ডিম-মুরগির লাগামহীন দাম বৃদ্ধি। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে কয়েক হাতে। সেই হাত টেনে ধরতে সংশ্লিষ্ট কয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা করেও সুফল আসেনি। বরং ওই মহলটি এখন ভেংচি কাটছে। ক্ষেপে গিয়ে হিম্মত দেখাচ্ছে। গোটা সেক্টরে আরও পোক্ত করছে তাদের নিয়ন্ত্রণ।
ডিম-বাচ্চা, মাংস-ফিডের সরবরাহ বাড়ায়-কমায় ইচ্ছা মতো। বাজারে সরবরাহ বাড়লে প্রান্তিকরা সঠিক দাম না পেয়ে লোকসান গুনতে বাধ্য। বাচ্চা ওঠাতেও পারেন না ছোটরা। পোলট্রি খাদ্যের সংকট সইবার ক্ষমতাও তাদের নেই। তখন বাজারে টান পড়ে। এ টানের সুযোগে ডিম ও মুরগির উৎপাদন কমিয়ে বাচ্চা উৎপাদন বাড়ায় বড়রা। প্রান্তিক খামারিরা এখন গড়পড়তা মুরগি বেচে ১৬০ টাকা কেজিতে। কিন্তু সরবরাহ শেকলে যুক্তরা এ দাম ২০০ টাকায় ঠেকিয়ে দিচ্ছে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনা থাকায় বাচ্চা, ডিম, ফিড, ওষুধ সব কিছুতে তারা লাভবান। ডিম-বাচ্চা উৎপাদন, পাইকারি বিতরণ কেন্দ্র, ফিড মিল, প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিংয়ে তাদের একচেটিয়া রাজত্ব। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কম দামে শত শত একর জমি কিনে গড়ে তুলেছে পরগনার মতো খামারবাড়ি। তাদের কাছ থেকে বেশি দামে বাচ্চা, খাদ্য এবং ওষুধ কিনতে হচ্ছে সাধারণ খামারিদের। তাদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় বা বশ্যতায় চুক্তিতে আসতেও বাধ্য হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে রয়েছে। পদ্ধতি হিসেবে এটি মন্দ নয়। কিন্তু, গোলমাল বাধছে একচেটিয়া বাজার তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে।
এ জন্য কেবল করপোরেটদের দিকে আঙুল তোলাও একতরফা হয়ে যায়। মধ্যমানের খামারিসহ কিছু লোকও কোনো কোনো এলাকায় সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। টানা লোকসানে কাহিল হওয়া খামারিদের কেউ কেউ দায়দেনা মেটাতে মূল কোম্পানি এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ডিলারের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। খামারি হয়েও তারা ফড়িয়ার পজিশনে নিয়ে গেছেন নিজেদের। বিভিন্ন কোম্পানিকে হাত করতে তারা পোলট্রি পণ্যের ডিলার সাজেন। কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে এলাকাভিত্তিক কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করেন। নাম-পরিচয় ভিন্ন হলেও একই কাজ করছেন তারা। এ ভজকট ডিম-মুরগির বাজারকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যা একদিকে অর্থনৈতিক দুঃসংবাদ, আরেক দিকে পুষ্টি ও আমিষের জোগানের পথেও মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা। পোলট্রি খাতে দীর্ঘ সময় ধরে চলা এ সমস্যাটি আলোচনার আড়ালে থেকেছে অন্যান্য নানাবিধ সমস্যার কারণে। এর জেরে এখন ভুগতে হচ্ছে। সমস্যাটি জোড়াতালিতে সারানোর মতো নয়। সেই চেষ্টা করলে বড় ধরনের বিপর্যয় আসবে। ডিম-মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ তখন কথিত করপোরেটের কাছেও থাকবে না। আবার দেখতে হতে পারে আশির দশকের আগের চিত্র। এর আগেই পদক্ষেপ জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
শুধু ঢাকা শহর না। নানাবিধ কারণে, দেশের বিভিন্ন শহরে হচ্ছে হঠাৎ বিস্ফোরণ। অজস্র মানুষের মৃত্যু অথবা পঙ্গু হয়ে যাওয়া, নতুন কিছু না। কোথাও বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত লাইনে জমে থাকা গ্যাসের বিস্ফোরণ, কোথাও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ আবার কোথাও ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ। মারা যাচ্ছেন নিরীহ মানুষ। আকস্মিক এমন মৃত্যু অথবা পঙ্গুত্ব অস্বাভাবিক হলেও, সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি অনেকটাই যেন ‘স্বাভাবিক’ মনে হচ্ছে!
বাড়তি আতঙ্ক নিয়ে, মহানগর-নগরে বসবাস করছেন মানুষ। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, এমন আজব কান্ড-কারখানা, হরহামেশাই ঘটছে। যে শহরে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই- সেই শহর কোনোভাবেই নিজেকে ‘সভ্য’ দাবি করতে পারে না। আর সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরাও থাকেন নিশ্চিন্ত-নিরাপদ! বলার অপেক্ষা রাখে না- মানুষ নিরাপত্তা চায়, নিশ্চয়তা চায় স্বাভাবিক মৃত্যুর।
গতকাল দেশ রূপান্তরের ১ম পাতায় প্রকাশিত দুটি সংবাদ, সাধারণ মানুষের আতঙ্ক-ভয় যেন বাড়িয়ে তুলেছে। ‘বিকট শব্দে ভয়াবহ ধস’ এবং ‘সীতাকুন্ডে ভয়াবহ বিস্ফোরণ!’ শিরোনামের সংবাদের মাধ্যমে জানা যায় সায়েন্স ল্যাব এলাকায় বিস্ফোরণে মারা গেছেন ৩ জন। হাসপাতালে আছেন ১৬ জন। বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ বলেছেন, এই বিস্ফোরণ হয়েছে, জমে থাকা গ্যাস থেকে।
অন্যদিকে, ‘অবহেলাতেই সীতাকুন্ড বিস্ফোরণ’ শিরোনামের সংবাদে জানা গেছে অক্সিজেন সেপারেশন কলামে যখন অক্সিজেন এসে জমা হচ্ছিল, সেই অক্সিজেন বের হওয়ার জন্য যে পাইপগুলো ছিল একপর্যায়ে তা বের হতে না পেরেই প্রবল শব্দে বিস্ফোরিত হয়েছে কলামটি। আর ১০০ ফুট উচ্চতার এ কলামটি ছিল লোহার শিটের তৈরি। এই শিটগুলো যখন প্রবল বেগে ছোটে, তখন শেডের লোহার পাতগুলো কারখানার রডের ছাউনিগুলোকে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। আর লোহার আঘাতে চারপাশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনায় অবহেলাতেই প্রাণ গেল ছয়জনের। আহত ২২ জনের মধ্যে চোখ হারাল তিনজন।
সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে- বিস্ফোরণের কারণ জানতে চাইলে কারখানার শ্রমিক আহমদ মিয়া কলামটিকে দেখিয়ে বলেন, এই কলামে এসে অক্সিজেন জমা হচ্ছিল। সেই অক্সিজেন কোনো না কোনো কারণে ডেলিভারি পয়েন্টে যাচ্ছিল না। কোথাও ব্লকেজ হয়েছিল। ব্লকেজ হয়ে যাওয়ায় কলামের ভেতরে অক্সিজেনের চাপ বেড়ে যায় এবং বিস্ফোরণ হয়। কিন্তু চাপ বেড়ে গেলে তো পাশের অপারেটর বসা ছিলেন। তিনি কলামের পাশের জায়গায় আঙুল প্রদর্শন করে বলেন, এখানে বসত অপারেটর। শনিবারের এই বিস্ফোরণে ছয়জনের মৃত্যু ও ২২ জন আহত হয়েছে।
প্রকৃত ঘটনা যাই হোক, একটি বিষয় স্পষ্ট যে- দায়িত্ব অবহেলার কারণেই বারবার এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণ যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের। কর্তৃপক্ষ এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সতর্কতার সঙ্গে পালন করলে এমন বিস্ফোরণ হতো না। অথচ বারবার হচ্ছে। এর একটাই কারণ, প্রকৃত দোষী ব্যক্তির শাস্তির ব্যবস্থা না হওয়াতেই এমনটি হচ্ছে। দায়সারা গোছের বক্তব্য দিয়ে, বছরের পর বছর এমন অপমৃত্যু এবং ধ্বংসযজ্ঞ মেনে নেওয়া যায় না। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আরও সতর্কতার সঙ্গে, জন-গণসম্পৃক্ত এই বিষয়গুলো নিয়মিত তদারকি করা প্রয়োজন। কর্মকর্তা ও মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের নিয়মিতভাবে সচেতনতামূলক উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা দরকার। প্রয়োজনে তাদের জন্য বাড়তি প্রণোদনার উদ্যোগ নিলে ভালো হয়। যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে, উপযুক্ত সম্মান এবং প্রণোদনা নিয়মিত হলে- ব্যক্তি তার সর্বোচ্চ মেধা ও আন্তরিকতা দিয়ে দায়িত্বের পরিচয় দেয়। তারপরও যদি কর্তব্য অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখিয়ে শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এটি হচ্ছে না বলেই, বারবার এমন আকস্মিক দুর্ঘটনার মধ্যে প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। আহত হচ্ছেন শত শত।
ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আগেই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এমনটিই প্রত্যাশা।
বেলজিয়ামের নতুন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে সম্মানতি বোধ করছেন ম্যানচেস্টার সিটি তারকা কেভিন ডি ব্রুইনা।
গত বছর বিশ্বকাপের পর রিয়াল মাদ্রিদ তারকা এডেন হ্যাজার্ড জাতীয় দলকে বিদায় জানান। বেলজিয়াম কোচ ডোমেনিকো টেডেসকো প্লেমেকার ডি ব্রুইনাকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন। বিশ্বকাপের পর বেলজিয়ামের কোচের পদে রবার্তো মার্টিনেজের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন টেডেসকো।
গত জানুয়ারিতে ৩২ বছরে পা রেখেছেন ব্রুইনা। আরটিএল-টিভিআই টেলিভিশনে বেলজিয়ামের নেতৃত্ব পাওয়া নিয়ে ডি ব্রুইনা বলেছেন, ‘এভাবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা সত্যিই সম্মানের। আমার বয়স প্রায় ৩২ হয়ে গেছে। আমি কখনই আন্তর্জাতিক অবসরের চিন্তা করিনি। আমি বিশ্বাস করি এখনো দলকে কিছু দেবার সক্ষমতা আমার আছে। এই সুযোগে তরুণদেরও সহযোগিতা করতে চাই।’
সুইডেনের বিরুদ্ধে শুক্রবার ইউরো বাছাইপর্বে অধিনায়ক হিসেবে ডি ব্রুইনার অভিষেক হতে যাচ্ছে। মাদ্রিদ গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া ও চেলসি রোমেলু লুকাকু ডি ব্রুইনার সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করবেন।
রাজধানীর মালিবাগ রেলগেটে ট্রেনের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষের ঘটনায় ২ ঘণ্টা পর চালু হয়েছে রেল যোগাযোগ।
ইঞ্জিন পরীক্ষার পর পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাত ১১টার দিকে ছেড়ে যায়। এতে সড়কের ২ পাশের যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে।
বুধবার রাত ৯টার পর মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি সোহাগ পরিবহনের একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এ ঘটনায় তিন জন আহত হন। দুর্ঘটনার সময় বাসটিতে কোনো যাত্রী ছিল না। ট্রেনের গতিও কম ছিল।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।