
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই বড় ধরনের গলদ রয়েছে। ছোটবেলায়, এমনকি এসএসসি পরীক্ষাতেও রচনা শেখানো হয় অরস রহ ষরভব। শিক্ষক বলেন বলো তো, তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? আর ছাত্রছাত্রী বলে স্যার, আমি ডাক্তার হবো। কেউ চায় প্রকৌশলী হতে। আবার কেউ হতে চায় সামরিক বাহিনীর অফিসার। বর্তমানে এর রং পাল্টেছে। ছাত্রছাত্রী স্কুল-কলেজে, শিক্ষকের সামনে যাই বলুক, শিক্ষা শেষে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আর কিছু চায় না। শুধু চায়, অর্থ উপার্জন করতে। এটাই এখন অধিকাংশের জীবন লক্ষ্য হাউ টু আর্ন মানি! এমন অসৎ চাওয়া আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে তখন, একজন মানুষ যখন দেখেন শিক্ষার চেয়ে অর্থের মূল্য অনেক বেশি। ঠিক এমন অবস্থাতেই সক্রিয় হয়ে উঠে প্রতারক চক্র। বেকারত্বের জাঁতাকলে পিষ্ট শিক্ষিত তরুণ-তরুণী দিশেহারা হয়ে সরকারি চাকরির সন্ধান করেন। অন্ধের মতো বিশ্বাস করে প্রতারকের হাতে টাকা দেন। কারণ, তারা জীবনের নিরাপত্তা চান। যে কারণে বেসরকারির চেয়ে দিন দিন সরকারি চাকরির চাহিদা বেড়ে চলেছে। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা।
গতকাল রবিবার দেশ রূপান্তরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ‘চাকরি সহজ হয় না সহজে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে সরকারি হোক বা বেসরকারি, চাকরির বাজারে ঘোর মন্দা না হলেও মন্দা চলছে। চাকরির বাজার যত সংকুচিত হচ্ছে, ততই কদর বাড়ছে বাঁকা পথের খেলোয়াড়দের। নিয়োগের খেলা বুঝে নিয়ে তারা নিজেদের পকেট ভরছে দুই হাতে। অথচ কয়েক বছর আগেও তারা শুধু সাধারণ নয়, অতি সাধারণ ছিল। কেউ ছিল ছোট ব্যবসায়ী, কেউবা রোজগারহীন। নিয়োগ দুর্নীতির বদৌলতে তারাই এখন কোটি টাকার মালিক। এ ছা-পোষা, সাধারণ মানুষগুলো মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে কেউ দুর্নীতি করছেন, কেউ আবার দুর্নীতিবাজের হয়ে মধ্যস্থতাকারীর কাজ করে কোটি টাকা কামাচ্ছেন। দিন দিন স্ফীত হচ্ছে তাদের ব্যাংক স্থিতি আর অন্যান্য সম্পত্তি। আর যারা দুর্নীতিবাজ, তাদের বুদ্ধি কোনো হিসাবেই কুলায় না। তারা দেশের ব্যাংকে রেখে স্বস্তিও পায় না। পাচার করে দেয় বিদেশে, তাদের সেকেন্ড হোমে। ২০০৯ সালে দায়িত্ব নিয়েই সরকারপ্রধান চাকরির বাজারের দুর্দশা ঘোচানোর নির্দেশনা দেন সচিব সভায়। সভায় বলা হয়, সংবিধানে একাধিক পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) গঠনের সুযোগ আছে। আলাদা পিএসসি করে শূন্যপদ পূরণে গতি আনার নির্দেশনা পেলেন সচিবরা। কমিটির পর উপকমিটি হয় আর সময়ক্ষেপণ হয়। অনেক ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে একাধিক পিএসসি করার রাস্তা কৌশলে আটকে দেওয়া হয়।
সংবাদে আরও বলা হয়েছে, সরকারের একের পর এক উদ্যোগ আটকে দিলেও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, চাকরি দিতে ব্যর্থ হয়ে টাকা ফেরত না দিয়ে পরিবারগুলোকে পথে বসিয়ে দেওয়া বা বেকারের আর্তনাদ বন্ধ করতে পারলেন না কর্তারা। চাকরি নিয়ে মানুষের দুর্ভোগ আগের মতোই রয়েছে। যত দিন যাচ্ছে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার টাকার অঙ্কও বাড়ছে। মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমেই নিয়োগ দুর্নীতির টাকা পৌঁছে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের কাছে। জানা যাচ্ছে, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশের সরকারি ব্যয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় অনেক কম। ভারতের এ ব্যয় জিডিপির তুলনায় ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের দেশে সরকারি ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। সরকারি সেবাগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে গেলে মানবসম্পদে আরও ব্যয় বাড়াতে হবে।’
বেসরকারি যেমন তেমন, সরকারি চাকরির পথ ইচ্ছা করেই যে সহজ করা হচ্ছে না, তা পরিষ্কার। কারণ, অবৈধ অর্থে যারা ফুলে-ফেঁপে, সমাজে নিজেকে যে পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেখান থেকে সহজে তিনি সরবেন না। আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া কখনোই দুর্নীতি বন্ধ হবে না শুধু মুখের কথায়। কোনো সমাজে মেধার মূল্যায়ন না হলে, অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। সেখানে কাঠামোগত উন্নয়ন যতই হোক, প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে মানবিক মূল্যবোধের স্তর উন্নত না করতে পারলে সার্বিক উন্নয়ন অধরাই থেকে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই দিন দিন তৈরি হবে প্রতারণার আধুনিক কৌশল।
তিতাস বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক অনন্য সঙ্গী। আমাদের বহু স্মৃতিময় আখ্যান ও জল-রোমন্থন জড়িয়ে আছে তিতাসের সঙ্গে। তিতাসপাড়ের জেলেজীবন নিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ লেখেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। পরবর্তীতে ঋত্বিক ঘটক নির্মাণ করেন যুগান্তকারী চলচ্চিত্র। তিতাস এক আন্তঃরাষ্ট্রিক নদ। উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড় থেকে জন্ম নিয়ে এই নদ ত্রিপুরায় ককবরক ভাষায় সাইদ্রা ও বাংলায় হাওড়া নামে প্রবাহিত। বাংলাদেশের ছয় ভাগের এক ভাগ হলো হাওর। সাতটি প্রশাসনিক জেলার ভেতর ব্রাহ্মণবাড়িয়াও হাওরাঞ্চল। এখানকার বিশাল অঞ্চলের কৃষিজমির বৈশিষ্ট্য হলো বর্ষাকালে বিস্তীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া ও হেমন্তে আবার বিল ছাড়া বিশাল জমিন জেগে ওঠা। এখানকার কৃষিপ্রতিবেশের
কৃষিজমিগুলোর সঙ্গে প্রচুর খালের সংযোগ আছে। আর এসব খাল দিয়েই বর্ষাতে তিতাসে পানি প্রবাহিত হয়ে যায় এবং হেমন্তে খালের পানি কৃষিতে কাজে লাগে।
কিন্তু সবুজ বিপ্লব-পরবর্তী কৃষি উন্নয়ন তিতাস অববাহিকার এই কৃষিপ্রতিবেশ বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দেয়নি। বরং নানাভাবে উন্নয়ন অবকাঠামো ও নগরায়ণ সম্প্রসারণের নামে কৃষিজমির শৃঙ্খলা বিনষ্ট করা হয়েছে। বহু নালা, খাল, জলাভূমি ভরাট করা হয়েছে। পানিপ্রবাহের গতি ও ধারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। কৃষি বাস্তুতন্ত্র হয়েছে চুরমার। উন্নয়নের নামে এসব ঘটলেও সামগ্রিকভাবে এটি দেশের জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তাকে বারবার আঘাত করছে এবং প্রাণ-প্রতিবেশের ব্যাকরণকে বিশৃঙ্খল করে দিচ্ছে। বহুদিন ধরে তিতাস অববাহিকার নানা জায়গায় মাটি ভরাট করে বাঁধ দিয়ে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ও নিষ্কাশনব্যবস্থাকে বিনষ্ট করে কৃষিজমির ক্ষতি করা হচ্ছে। কৃষিজমি সুরক্ষায় আমরা জোরালো কোনো রাষ্ট্রীয় তৎপরতা দেখিনি। আশা করব, তিতাস অববাহিকার বিশেষ কৃষিপ্রতিবেশ সুরক্ষায় রাষ্ট্র তৎপর হবে। প্রভাবশালীদের বাঁধ বাহাদুরি বা এলোপাতাড়ি উন্নয়নের চাবুক থেকে রক্তাক্ত কৃষিজমির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার মোগড়া ইউনিয়নের চরনারায়ণপুর মৌজায় প্রায় ৫০০ বিঘা জমিকে জবরদস্তি করে বিপন্ন করে তোলা হয়েছে। গণমাধ্যমসূত্র জানায়, মোগড়া ইউনিয়নের দরুইন গ্রামের মো. তাহের মিয়া ও মো. রাসেল মিয়া বছর পাঁচেক আগে এই বিলে কিছু জমি কেনেন। এরপর তারা একতরফাভাবে খালের পাশে এক বেড়িবাঁধ তৈরি করেন। যার ফলে হাওর থেকে তিতাস নদে পানিপ্রবাহের ধারাটি বন্ধ হয়ে যায়। প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ বন্ধ হওয়ায় বেলুয়া বিলের জমিগুলো বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধ ও হেমন্তে রুক্ষ পানিহীন হয়ে পড়ে। উভয় মৌসুমেই কৃষির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয় কৃষকদের ভোগান্তি ও দুশ্চিন্তা বাড়ছে। দুই প্রভাবশালীর একতরফা এই বাহাদুরি সরাসরি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তাকেও বিপদে ফেলছে।
বাঁধ সরিয়ে জমিগুলোকে বিপদমুক্ত করার জন্য ভুক্তভোগী কৃষকরা স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনকে বহুবার জানিয়েছে। কিন্তু কোনো ন্যায়বিচার নেই। যে দেশে প্রতিদিন এক শতাংশ হারে জমি কমছে আর পাল্লা দিয়ে মানুষের উৎপাদন বাড়ছে সেই দেশে খাদ্য উৎপাদন বিনষ্ট করার এমন বাহাদুরি কীসের ইঙ্গিত? প্রধানমন্ত্রী নিজে চাষ করে দেখাচ্ছেন, দেশের প্রতি ইঞ্চি জায়গা ফেলে না রাখার ঘোষণা দিচ্ছেন। কিন্তু বেলুয়া বিলে কেন প্রশ্নহীনভাবে ৫০০ বিঘা কৃষিজমি সংকটে আছে? এই
কৃষিজমি মুক্ত করার দায় ও দায়িত্ব কার? খাদ্য উৎপাদনে কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব কার? কৃষি বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সরকার কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কী করছেন? কেন ৫০০ বিঘা কৃষিজমির সুরক্ষায় দাঁড়াতে পারছেন না? বিশেষ করে মহামারী ও যুদ্ধ সংকটে প্রতিদিন নেতিয়ে পড়া এক মুমূর্ষু দুনিয়ায় যখন কৃষিজ খাদ্য উৎপাদন নানাভাবে রক্তাক্ত, সেখানে কয়েকজন প্রভাবশালীর কারণে দেশের জমি বিনষ্ট হবে তা কেন মেনে নেয়া হচ্ছে?
প্রতিকার না পেয়ে ভুক্তভোগী কৃষকরা গণমাধ্যমে বলছেন, বিষ দেন না হলে জমি থেকে পানি নিষ্কাশন করে দেন। করোনাকালে দেশ দুনিয়া লকডাউন হয়ে থাকলে
কৃষকসমাজ ছিল নির্ঘুম। মহামারী ও যুদ্ধের পাশাপাশি কৃষককে প্রতিদিন সামাল দিতে হয় করপোরেট কৃষিবাজারের নিয়ন্ত্রণ, কৃষিজমি হ্রাস, দুর্যোগ ও জলবায়ু সংকট। এর ওপর যদি আবার জলাবদ্ধ বা পানিহীনতায় বিঘার পর বিঘা জমি বিনষ্ট হয়, সেই ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে সামাল দেয় গ্রামীণ কৃষক সমাজ?
বাঁধ দিয়ে কৃষিজমি বিপদাপন্নতার এই প্রসঙ্গটি নতুন নয়। ২০১৯ সালে ‘খালে অবৈধ বাঁধ’ শিরোনামে দৈনিক সমকালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় (১৫/৩/২০১৯)। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের শ্যামনগর খালের মুখে মাটি ভরাট করে বাঁধ দিয়ে প্রায় ৩০০ হেক্টর কৃষিজমি বিনষ্ট করা হয়। জানা যায়, আখাউড়া পৌর শহর লাগোয়া সদর উপজেলার বরিশল ও শ্যামনগর মৌজায় অবস্থিত বুয়ালিয়া বিলের পানি শ্যামনগর খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তিতাস নদে মিশে। কিন্তু শ্যামনগর গ্রামের মো. হুমায়ুন কবির ভুইয়া খাসজমি লিজ নিয়ে খালের মুখে মাটি ভরাট করে বাঁধ দেয়ায় বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা ও শুষ্ক মৌসুমে পানিহীনতা তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে ত্রিশটি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের ভেতর ‘আখাউড়া সোপান’ একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যময় কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চল। এমনকি এখানে হাওর প্রতিবেশগত বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান। প্রভাবশালীদের বাঁধ-বাহাদুরি বা উন্নয়নের নামে এভাবে একের পর এক কৃষিজমি বিপন্ন হলে তিতাস অববাহিকার এই বিশেষ কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ও রূপ অচিরেই বদলে যাবে। যার দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাব পড়বে জনপরিসরে।
রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিবছর এক শতাংশ হারে কমছে কৃষিজমি। কিন্তু কৃষিজমি সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও তৎপরতা কতখানি? চরনারায়ণপুর মৌজার ৫০০ বিঘা কৃষিজমির নিরাপত্তা কেন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না? এ বিষয়ে নীতি, নথি ও কাঠামো আছে। তাহলে সমস্যা কোথায়? মনোজগতে নাকি রাজনৈতিক অঙ্গীকারে? নাকি দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার অভাব? আমরা এখন কিছু আইন ও নীতি ঘেঁটে দেখব। দেশে একটি প্রস্তাবিত ‘কৃষিজমি সুরক্ষা আইন ২০২১’ আছে। আইনটি উল্লেখ করেছে, ‘বাংলাদেশের যে স্থানে কৃষিজমি রহিয়াছে, তাহা এই আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা করিতে হইবে এবং কোনভাবেই তাহার ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন করা যাইবে না।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চরনারায়ণপুর মৌজার কৃষিজমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে, কারণ খালের মুখে মাটি ভরাট করে জমিতে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ও নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। এলাকাটির কৃষিজমির শ্রেণির রূপ এবং এই রূপ উন্নয়নের ফলে কীভাবে বদলে যায় বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা ‘জাতীয় পানি নীতি’ পাঠ করতে পারি।
জাতীয় পানি নীতি (১৯৯৯)-এর ৪.১৩ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘... হাওর, বাঁওড় ও বিল জাতীয় জলাভূমিগুলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে এগুলোর গুরুত্ব অসীম। হাওর এবং বাঁওড়গুলোতে শুষ্ক মৌসুমেও যথেষ্ট গভীরতায় পানি থাকে, তবে ছোট বিলগুলো সাধারণত চূড়ান্ত পর্যায়ে আর্দ্র ভূমিতে পরিণত হয়। এই বিলগুলো প্লাবনভূমির নিম্নতম অংশ।
এই জলাশয়গুলো আমাদের প্রাকৃতিক মৎস্য-সম্পদের সিংহভাগের উৎস এবং নানা ধরনের জলজ সবজি ও পাখির আবাসস্থল। তা ছাড়াও শীত মৌসুমে উত্তর গোলার্ধ থেকে আগত অতিথি পাখিদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। হাওর এবং বিলগুলো খালের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। অতীতে প্রকৌশলগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অনেক বিলকে তাৎক্ষণিক ফসল লাভের জন্য নিষ্কাশিত আবাদী জমিতে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকট আকার ধারণ করে। প্রথমেই মাছ এবং গ্রামীণ জনগণের খাদ্যের উৎস কচু, শাপলা, কলমি জাতীয় জলজ সবহির বিলুপ্তি ঘটে। বর্ষা মৌসুমে প্লাবনভূমির বর্জ্য প্রবাহমান খালের মাধ্যমে বাহিত ও শোধিত হয়ে নিষ্কাশিত হতো। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সেই প্রাকৃতিক শোধনক্রিয়া ব্যাহত হয়ে পরিবেশের মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করেছে।’ চরনারায়ণপুর মৌজায় এটিই ঘটছে। বর্ষায় কৃষিজমি থেকে পানি সরতে পারছে না এবং শুষ্ক মৌসুমে জমিগুলো পানি পাচ্ছে না। কারণ জমি ও নদীর সঙ্গে সংযোগকারী খাল বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আশা করব, রাষ্ট্র ভুক্তভোগী কৃষক ও কৃষিজমির আহাজারি শুনবে। স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন খালের বাঁধ মুক্ত করে চরনারায়ণপুরসহ তিতাস অববাহিকার সব কৃষিজমির সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।
লেখক: গবেষক ও লেখক
বাংলাদেশে ভিখারিরাও দুর্নীতিগ্রস্ত কথাটা বলেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। বিষয়টি অস্বীকারের উপায় নেই। বিশেষ করে, পাবলিক বাস এবং রাস্তায় বিনা পরিশ্রমে অর্থ আয়ের লাভজনক পেশা ভিক্ষাবৃত্তি। শুধু দৃষ্টিহীন, পঙ্গু এখন আর এই পেশায় নেই। অনেক সুস্থ মানুষও ব্যক্তিত্ব এবং কায়িক শ্রমের কথা বেমালুম ভুলে, এমন পথ বেছে নিয়েছে। তারা অভিনয়ের মাধ্যমে আদায় করে মানুষের সহানুভূতি। দিন দিন এসব দক্ষ অভিনেতার সংখ্যা বাড়ছে। এ ব্যাপারে তাদের কোনো অনুভূতিও নেই।
জরুরি কাজে যাচ্ছিলাম মিরপুর-১। গাড়িতে বসে বাদাম খাচ্ছি। কল্যাণপুর বাঙলা কলেজের গেট থেকে একজন তরুণ উঠলেন। পরনে সুন্দর পোশাক। সাদা হাফ শার্ট, কালো প্যান্ট। গলায় টাই বাঁধা। গায়ের রং শ্যামলা। দীর্ঘাঙ্গী, স্বাস্থ্যবান সেই তরুণকে দেখে ভালোই লাগল। চমকে উঠলাম, তার কথা শুনে। তরুণটি গাড়ির মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইছিলেন। ঠিক ভিক্ষা না, অর্থ সাহায্য। তিনি ফর্ম ফিলাম করতে পারছেন না। পড়ছেন হিসাববিজ্ঞানে অনার্স। শুদ্ধ উচ্চারণে তিনি বলছেন আমি আর পারছি না। আমার কেউ নেই। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছি। এতদূর এসেছি, আপনাদের সহযোগিতা নিয়ে। পড়াশোনা করেছি, কমার্স বিষয়ে। এভাবে এসএসসি, ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ভর্তি হয়েছি বাঙলা কলেজে। পড়ছি হিসাববিজ্ঞানে। কিন্তু চূড়ান্ত বর্ষে এসে আটকে গেছি। পারছি না, ফর্ম ফিলাপের টাকা জোগাড় করতে। গাড়ির অনেক যাত্রী ছেলেটিকে দেখে আফসোস করলেন। প্রায় প্রত্যেকেই টাকা বের করলেন। খেয়াল করলাম, সর্বনিম্ন নোট ৫০। একজন দিলেন ৫০০ টাকা! এভাবে একটি গাড়ি থেকেই তরুণটি প্রায় ২০০০/২৫০০ টাকা পেলেন। কেন যেন কৌতূহল হলো। ছেলেটিকে কাছে আসতে ইশারা করলাম। বললাম, আপনার এ পর্যন্ত কত টাকা হয়েছে?
গুনি নাই। মনে অয়, ৪-৫ হাজার হইবো!
ফর্ম ফিলাপ করতে কত টাকা লাগবে? একটু থতমত খেয়ে ছেলেটি বলল- হ, প্রায় ১২-১৫ হাজার টাকা লাগব!
আপনার সাবসিডিয়ারি বিষয় কী ছিল?
সম্ভবত ছেলেটি এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ঢোক গিললেন। মুখ কালো করে বললেন উম, অ্যাঁ...!
বলছিলাম, আপনার সাবসিডিয়ারি বিষয় কী ছিল? পড়েছেন তো অ্যাকাউন্টিং অনার্স, নাকি?
হ! ছেলেটির ভাষা শুনে, সন্দেহ গাঢ় হলো। এবার জোর দিয়ে, একটু উচ্চৈঃস্বরে বললাম আপনি অনার্স ফাইন্যাল ইয়ারে পড়ছেন, সাবসিডিয়ারি বিষয় মনে নেই!
এবার ছেলেটি মুখ ফ্যাকাশে করে, রাগান্বিত চোখে বললেন টাকা দিলে দেবেন, অত কথা বলেন ক্যান?
আশ্চর্য, আপনাকে তো একটি প্রশ্নই বলেছি! এত কথা কোথায় বললাম!
এতক্ষণ খেয়াল করিনি, বাসের অধিকাংশ যাত্রী আমাদের কথোপকথন শুনছিলেন। এবার সবাই গর্জে উঠলেন বললেন, হারামজাদা টাকা ফেরত দে। ফাইজলামি করার জায়গা পাস না? এক যাত্রী প্রায় ছিনিয়ে নিলেন ১০০ টাকা। এভাবে সব যাত্রীই তাদের টাকা ফেরত নিলেন।
এবার ছেলেটি আমার দিকে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকালেন। বললেন পাইতাম না! একা পাইয়া লই?
কী করবেন?
দেহা হইলে, একদম...!
মুচকি হাসলাম। বললাম আমার বাসা বাঙলা কলেজের উল্টো পাশে। ফোন নম্বরটা রাখেন। আমি চলে আসব। আমিই দেখা করব। আর আপনার ফোন নম্বরটা দেন?
ছেলেটি কথা না বাড়িয়ে হন হন করে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আমাকে ঠিকমতো দেখে নিলেন!
দুই.
তখন কাজ করি দৈনিক জনকণ্ঠে। সম্ভবত ২০০০ সাল। যাচ্ছিলাম বিটিভিতে। তালিকাভুক্ত সংবাদ পাঠক হিসেবে নিয়মিত নিউজ পড়তে হতো। প্রায় সময়ই ছিল লেট নাইট। রাত ১১.৩০ মিনিটে পড়তে হতো সংবাদ। কিন্তু সেদিন বুলেটিন ছিল বিকাল ৪টায়। ইস্কাটনের জনকণ্ঠ অফিস থেকে আড়াইটার দিকে, টেলিভিশনের উদ্দেশে যাত্রা। নোটিস করতে হতো, আধা ঘণ্টা আগে। এরপর মেকআপ বা পাফ। কিন্তু ৩-৩.১৫ মিনিটের দিকে পৌঁছে যাই রামপুরা। ফলে টেলিভিশন ভবনে ঢোকার আগে, ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলাম। এক জায়গায় দেখলাম বেশ জটলা। এগিয়ে যেতেই অপরিচিত একজন বললেন আমি টেলিভিশনে চাকরি করি। আপনে তো খবর পড়েন। চইলা যান, টিভির ভেতরে। মেকআপ নেন। সামনে যাওয়ার দরকার নাই। ঐটা টাউট, যাইয়েন না! কৌতূহল হলো। ভাবলাম, যাই। দেখি ঘটনা কী? ঘটনা জানার পর কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। প্রায় ২০-২৫ জন মানুষের জটলা। কেউ হাসছে, আবার কারও মুখ গোমড়া। একজনকে বললাম ভাই, ঘটনা কী? তিনি ঠোঁট ভ্যাটকি দিলেন। বললেন আর বইলেন না, হালায় একটা টাউট! হুদাই কানতাছে!
কাঁদে ক্যান?
আরে, তার বলে বউ মরছে! অহন দাফন করার ট্যাহা নাই। ইশারা করে বললেন ঐ যে মরা বউ হুইত্তা রইছে? আসলে ঐডা মরা না। তাও কাপড় দিয়া ঢাইক্কা রাখছে! ভিত্রে জ্যাতা মানুষ! মাইনষেও ট্যাহা দিতাছে। এদিকে সময় হলো টিভি ভবনে ঢোকার। নিউজ পড়া শেষে মুখে মেকআপ নিয়ে আবার সেই লাশের (!) সামনে! দেখি, লোকটা টাকা গুনছে। ভালো টাকা হয়েছে। এবার তিনি আমার দিকে তাকালেন। চোখে জল এনে বললেন
আপনে দাঁড়াইয়া আছেন ক্যান! কিছু দেবেন?
কী দেব?
ট্যাকা!
কেন?
দেখতাছেন না? একটা মরা পইড়া আছে!
মরাটা কি ছেলে না মেয়ে?
মাইয়া। আমার বউ!
কাপড়টা তোলেন। মুখটা একটু দেখব! আপনার টাকা রেখে দেন। দাফনের সমস্ত খরচ আমি দেব। কাপড় তোলেন? এবার লোকটির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। দ্রুতগতিতে হাত ধরে বললেন ভাই, সত্যি বলতাছি আর করুম না। ভিত্রে বউ আছে, এইডা সত্য। কিন্তু জ্যাতা। কী করুম! কেউ তো কাম দেয় না! এই কারণে দুজনে মিল্লা এই বুদ্ধি বাইর করছি।
আপনার বউ শ্বাস-প্রশ্বাস কীভাবে নিচ্ছেন! কষ্ট হচ্ছে না?
লোকটা দাঁত বের করে, হেসে হেসে বললেন আসলে এইডা আমার বউ না। ডেইলি ভাড়া খাটে। ৫০০ ট্যাহা দেই। বাকিডা আমার। অরা, এইডা পারে। পাক্কা অভিনয় করে। একদম মরা। ক্যামনে যে দম নেয়, প্যাটটাও ফুলে না!
প্রতিদিন কত টাকা হয়?
পাই, ৩-৪ হাজার। কিন্তু সব দিন একই জায়গায় থাহি না। ঘটনাও আলাদা।
এসব কেন করেন?
কইলাম তো? কেউ কাম দেয় না। কী করুম!
রিকশা চালাবেন। সবজি বিক্রি করবেন?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে লোকটি এবার যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন।
মরা (!) কে বললেন ঐ, ওঠ। কেউ নাই। উইঠাই দৌড় দিবি। আর এই নে, তর ৫০০!
কাপড়ের ভেতর থেকে, জলজ্যান্ত একজন মহিলা টাকা হাতে দিলেন দৌড়!
লোকটি আমার দিকে আর তাকালেন না। বিড়বিড় করে, কী যেন বললেন! দেখলাম, একটি খাবার হোটেলে তিনি ঢুকছেন!
লেখক : সাংবাদিক
বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির সমৃদ্ধিশালী ইতিহাস এখন যেন অতীত। এ দেশের মুক্তিসংগ্রামে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা সংগ্রাম, এমনকি নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতির ঐতিহাসিক ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ছাত্রদের পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সব ধাপে গণমানুষের অংশগ্রহণ এ দেশের মানুষের সংগ্রামকে সাফল্যমণ্ডিত করেছে। সাধারণ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমেই ধাপে ধাপে মুক্তি অর্জিত হয়েছে ও হচ্ছে। আর গণমানুষকে রাজনীতি সচেতন ও রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ছাত্রসমাজ ও ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা সেই ঐতিহাসিককাল থেকেই ছিল অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ।
সেই ছাত্ররাজনীতির লক্ষ্য ছিল পশ্চাৎপদতা ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির আদর্শ, সমতা, সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররাজনীতির সেই ধারা যেন অমাবস্যার চাঁদে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক দশকের বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির প্রধানতম যে ধারা, সেই ধারায় ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার ধ্বজাবাহী হওয়া ছাড়া এখানে কোনো নতুনত্ব ও সৃজনশীলতার লেশমাত্র যেন নেই।
এই অবস্থায় ছাত্ররাজনীতির মানে মাসল পাওয়ার তৈরির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা বা ক্ষমতাসীনদের সরিয়ে বিরোধী পক্ষের ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া অথবা জনতুষ্টিবাদিতার অনুসারী হয়ে মৌলবাদিতা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া। এতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদর্শের অস্তিত্ব থাকলেও এর সঙ্গে বঞ্চনা ও অধিকারহীনতাকে মোকাবিলার কোনো সম্পর্ক নেই। আর এভাবে ছাত্ররাজনীতি আজ নানাভাবে কলুষিত, অন্তত আমরা পত্রপত্রিকায় যে ধরনের খবর দেখতে পাই। বেশিদিন আগের কথা না, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির মূল বিষয় ছিল বিবদমান দলগুলোর মধ্যে হল দখল ও পাল্টাদখল। এখন আর দখল আর পাল্টাদখলের কিছু নেই, সবই ক্ষমতাসীনদের দখলে।
অনেক বছর ধরেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে, যেখানে দুর্বৃত্তদের মদদপুষ্ট কিছু শিক্ষার্থী, বলা বাহুল্য তারা যতটা শিক্ষার্থী তার থেকে অনেক বেশি পেশি শক্তির পূজারি। আর এই সূত্র ধরেই এ সময়ে সবচেয়ে বেশি খবরের শিরোনাম হচ্ছে ছাত্রলীগ, যেমনটা এর আগে হতো ছাত্রসমাজ, ছাত্রদল ও শিবির এবং এমনকি কিছু কিছু বামপন্থি ছাত্রসংগঠন। এদের থেকে ক্যাম্পাস, ছেলেদের হল, কিংবা মেয়েদের হল কোথাও সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয়। মূলত এই প্রবণতা হচ্ছে পাওয়ার প্র্যাকটিস সিনড্রমের অংশ, যাতে তথাকথিত ছাত্রনেতারা সাধারণ ছাত্রদের ওপর বিভিন্ন ধরনের অত্যাচারের খড়্গ নিয়ে হাজির হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কিছু কিছু ছাত্রনেতার এই আচরণের কারণ কী? বা সেই সুযোগই তারা কীভাবে পায়? বিশ্ববিদ্যালয় এসেই কি তারা এ ধরনের আচরণে অভ্যস্ত হয়েছে? নাকি ইতিমধ্যে হাত পাকিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে মাত্র? ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ রকম একটি ঘটনা সম্প্রতি বেশ চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। ছাত্রলীগ ও ছাত্রী হল এই দুয়ের মিশেল বলেই হয়তো কিছুটা আলোচনার খোরাক জোগাচ্ছে। এর সূত্র ধরেই এক ছাত্রী হলের পাঁচ ছাত্রীকে সাময়িক বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই সময় হাইকোর্টের পক্ষ থেকে ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিংয়ের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে।
আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরাই শুধু রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। এখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী প্রায় সবাই রাজনৈতিক দল এবং বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার সঙ্গে যুক্ত। অনেক সময় দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থান্বেষীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে ছাত্ররা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার সুযোগ পায়। তবে সরকারি দলের সঙ্গে যারা আছেন শুধু তারাই শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেন না, যারা ক্ষমতায় যেতে চায় তারাও শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে সিদ্ধহস্ত। নিঃসন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাই শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক ও প্রধানতম কাজ, কিন্তু রাজনীতি সচেতন হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ না।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে, যারা ফুলটাইম রাজনীতিবিদ, পার্টটাইম শিক্ষার্থী এবং তাদের নজর ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদের দিকে, যেটা বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য একদম সহায়ক না। যার নমুনা দেখা যায় বর্তমান সময়ের কিছু কিছু ছাত্রনেতার লাইফস্টাইলে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলে তারা যেভাবে বিলাসী জীবনযাপন করে, এমনকি এদের অনেকেই রাজনীতির জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি পর্যন্ত ব্যবহার করে। ফলে বদনাম হয় পুরো ছাত্ররাজনীতির। নানা ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে মনে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব সমস্যার মূলে আছে ছাত্ররাজনীতির। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনীতি সচেতন হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো সচেতনভাবেই রাজনীতিবিমুখ হতে থাকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কারা ছাত্রদের অপরাজনীতির দিকে পরিচালিত করছে? তথাকথিত এই ছাত্রনেতাদের মোহটা কোথায়? কেনই বা তাদের একটা অংশ এ ধরনের আগ্রাসী আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে? কেনই বা তারা সেই কাঁচা বয়সেই অর্থ-বিত্তের মোহে বাঁধা পড়ছে। এ কথা স্বীকার করতে হবে, আজকে থেকে অর্ধশতাব্দী আগের ছাত্ররাজনীতি ও বর্তমান সময়ের ছাত্ররাজনীতি এক হবে না সেটাই স্বাভাবিক।
যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় স্বাধীনতার পূর্বকালীন সময়ে বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির বিকাশ হয়েছিল সেই রাজনৈতিক বাস্তবতা যে নেই, সেটাই সত্যি। একদিকে ছাত্ররাজনীতি থেকে নীতি-আদর্শ হারিয়ে গেছে, অন্যদিকে ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য নেই প্রয়োজনীয় বুদ্ধিভিত্তিক ন্যারেটিভস, যা সময়ের চোখে আধুনিক এবং একই সঙ্গে প্রয়োজনীয়। এই ন্যারিটিভস হতে হবে ইতিবাচক, বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, ভবিষ্যৎমুখী, প্রগতিবাদী যেমনটা ছিল স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়কালে এবং একই সঙ্গে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক ও দক্ষতানির্ভর। কিন্তু আমাদের ছাত্ররাজনীতি এখনো অতীতকেন্দ্রিক, হয়তো এ থেকে বের হতে পারছে না।
রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে মুক্তি অর্জন, কিন্তু বর্তমান বিশ্বে মুক্তি শুধু রাজনৈতিক মুক্তি অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এখানে মুক্তি অর্জনের বিষয়গুলো অন্যান্য আর্থ-সামাজিক ও প্রযুক্তিগত স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়গুলোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। যেখানে যে কোনো ধরনের বঞ্চনাকে মোকাবিলা করার পাশাপাশি ছাত্র ও যুব জনগোষ্ঠীর অধিকার, বিশ্ব নাগরিক হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করা ইত্যাদি বিষয় সরাসরি যুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই ইতিবাচক, ভবিষ্যৎমুখী ও প্রগতিবাদী রাজনীতি না থাকার কারণে এখনকার ছাত্ররাজনীতি সাধারণ জনগণকেও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করতে পারছে না, উল্টো বিভিন্ন পর্যায়ের নেতিবাচক ও পশ্চাদমুখী রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।
তাই এ সময়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, গবেষণা ও ছাত্ররাজনীতি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কতটুকু প্রাসঙ্গিক। কতটুকুই বা সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাব্যবস্থা যেমন যুগোপযোগী নয়, একই সঙ্গে ছাত্ররাজনীতিও এই প্রজন্মের সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটাতে পারছে না, ফলে শিক্ষার্থীরাও এতে আগ্রহী হয়ে উঠছে না। আর এই সামগ্রিক পশ্চাৎপদতার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের যেমন দায় আছে, একই সঙ্গে দায়িত্ব আছে রাষ্ট্রের, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর। তবে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এ রকম নতুন কোনো রাজনীতির সন্ধান এখনো পাওয়া যাচ্ছে না, কবে আসবে সে ভবিষ্যদ্বাণীও করা যাচ্ছে না; তবে নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো সে হিসেবে স্বার্থান্বেষীদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার এখনো যথেষ্ট সুযোগ আছে।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
২০১০ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশের সাংবাদিক ও ভাষাসৈনিক কে জি মুস্তাফা। তার পুরো নাম খোন্দকার গোলাম মোস্তফা। তার জন্ম ১৯২৮ সালে সিরাজগঞ্জের কুড়িপাড়ায়। তার বাবা খোন্দকার ওয়াসিউজ্জামান ও মা তাহিয়াতুন্নেসা। তিনি ১৯৪৪ সালে সিরাজগঞ্জের বানোয়ারীলাল বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন এবং প্রথমে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ও পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়েন। ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনার সূত্রে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচিত হন এবং ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। এমএ পাঠকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যুক্ত হন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ইসলামিয়া কলেজে পড়াকালে তিনি পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে গ্রহণ করেন এবং কলকাতার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজারভার, দৈনিক পূর্বকোণ ও সংবাদ পত্রিকায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। দৈনিক মুক্তকণ্ঠের সম্পাদক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এ ছাড়া সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত লেবানন ও ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘকাল কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।