
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
নিকোল ফক্স ফেনলন, ২১ বছর বয়সী এক আইরিশ তরুণী। তিনি বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের কাছে কোকো নামে পরিচিত ছিল। বছরের পর বছর ভয়ংকর শারীরিক এবং অনলাইন নির্যাতন সহ্য করার পর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সে আত্মহত্যা করে। জ্যাকি ফক্স, নিকোল ফক্সের মা জানান যে, ২০১৬ সালে কোকো একবার তার নিজের জীবন নেওয়ার চেষ্টা করার পরেও তার ওপর সরাসরি ও অনলাইন নিগ্রহ অব্যাহত ছিল। অপব্যবহারকারীরা জাল ফেসবুক পেজ তৈরি করেছিল; স্ন্যাপচ্যাট, হোয়াটসঅ্যাপ এবং মেসেঞ্জারের মাধ্যমে সব সময় তাকে কটু কথা (বুলিং) শুনিয়ে যেত এবং প্রতিনিয়ত ফাঁসিতে ঝুলে তাকে মরে যেতে বলত। এমনকি তারা তাকে ফাঁসের ভিডিও পাঠিয়েছিল যেখানে কীভাবে নিজেকে ঝুলিয়ে মেরে ফেলতে হয় তা দেখানো হয়েছিল। উত্ত্যক্তকারীরা নির্যাতন ও নিগ্রহের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফরম বেছে নিয়েছিল কারণ তারা জানত যে, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এ ধরনের অপরাধ করে নিস্তার পাওয়া সহজ। কারণ তখন পর্যন্ত আয়ারল্যাণ্ডে এভাবে অনলাইন হয়রানি প্রতিরোধে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন ছিল না।
শেষমেশ ২০২০ সালে আইরিশ আইনসভা অনলাইন হয়রানি, ক্ষতিকারক যোগাযোগ এবং এ-সংক্রান্ত অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়াবলি বিচারে জন্য নতুন একটি আইন প্রণয়ন করলে জ্যাকির অবিরাম পরিশ্রম ও প্রচারণা সফলতা পায়, যা পরবর্তীতে অনলাইনে আবির্ভূত নব্য অপরাধগুলো যথা : সম্মতি ছাড়া অনলাইনে অন্তরঙ্গ ছবি ছড়িয়ে দেয়া বা ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া, প্রতিশোধ পর্নোগ্রাফি, অনলাইন বা ডিজিটাল হয়রানি/উত্ত্যক্তকরণ; অনলাইন প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে অশ্লীল বার্তা পাঠানো প্রভৃতি দমনে কোকোর আইন নামে পরিচিত লাভ করে। যদিও এই নতুন আইনটি নিকোল কোকোকে সুরক্ষা দিতে পারেনি, তথাপি এটি অন্যদের জীবন এবং পরিবারকে তার মতো অসহনীয় ভোগান্তি থেকে রক্ষা করে অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করার পথ সুগম করেছে।
ডিজিটাল অপরাধ ও হয়রানি, যেমন: সম্মতি ছাড়াই অনলাইনে অন্তরঙ্গ ছবি প্রকাশ করা বা প্রকাশের হুমকি দেয়া আজকাল বিশ্বব্যাপী একটি উদ্বেগের বিষয়। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উদ্ভব এবং ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা লাভের পর সমস্যাটি তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বর্তমান বাংলাদেশে বেশ কিছু আইন যেমন : ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮; দিয়ে সীমিত পরিসরে এসব অপরাধের বিচার বা ডিজিটাল হয়রানি মোকাবিলা করা সম্ভব। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফরমে সংঘটিত ডিজিটাল যৌন হয়রানি বিচারে ওপরের কোনো আইনই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় বা শুধু এসব আইন দিয়ে পরিস্থিতি যথাযথভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এর ৮(১) ধারার অধীনে কোনো নারী, পুরুষ বা শিশুকে কোনো প্রলোভনে পর্নোগ্রাফিতে অংশগ্রহণ করিয়ে তার জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে স্থির বা ভিডিওচিত্র ধারণ করলে ‘অপরাধ’ বলে বিবেচিত হবে; যার দরুন সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। অধিকন্তু, ৮(২) ধারানুযায়ী কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে অন্য কোনো ব্যক্তির সামাজিক বা ব্যক্তিগত মর্যাদা হানি করলে বা ভয় দেখিয়ে অর্থ বা অন্য কোনো সুবিধা আদায় করলে অথবা সেই ব্যক্তির জ্ঞাতসারে বা অজান্তে রেকর্ড করা পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে মানসিকভাবে নির্যাতন করলে শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে। ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি বিতরণও উল্লিখিত আইনের ৮(৩) ধারানুসারে নিষিদ্ধ। তবে আইনটি শুধু পর্নোগ্রাফি বিষয়ক অপরাধগুলো সন্নিবেশিত করেছে। যদিও এই আইনেও প্রতিশোধ পর্নো বা অনলাইন যৌন হয়রানির মতো অন্যান্য অপরাধ উপেক্ষিত থেকেছে। আবার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯(১) ধারা শুধু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মানহানিকর বিষয়বস্তু ছড়িয়ে দেওয়ার শাস্তির বিধান রেখেছে; যেখানে অন্তরঙ্গ ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার বা ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি বিষয়ে কোনো বিধান নেই।
অন্তরঙ্গ চিত্রধারণ, বিতরণ বা প্রকাশ কোকোর আইনানুসারে একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এমনকি যে ব্যক্তি সম্মতি ছাড়া ছবিটি রেকর্ড, বিতরণ বা প্রকাশ করে, তার ক্ষতি করার কোনো উদ্দেশ্য না থাকলেও তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। অপরাধ প্রমাণে এটিই যথেষ্ট হবে যে, অন্তরঙ্গ চিত্রগ্রহণ, বিতরণ বা প্রকাশ অন্য ব্যক্তির শান্তি এবং গোপনীয়তার অধিকারকে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করেছে বা তাতে ওই ব্যক্তির ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে বা ওই কাজ তার যন্ত্রণার কারণ হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে কোকোর আইনের জন্য আমাদের আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? আমরা কি হাজার হাজার অনলাইন যৌন নির্যাতনের শিকার এবং/অথবা অন্তরঙ্গ ছবি/ভিডিও প্রকাশের শিকার ব্যক্তিদের আর্তনাদ এখনো শুনতে পাচ্ছি না? নাকি আমরা আমাদের আইনপ্রণেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কোকোর মতো অন্য কারও জীবন উৎসর্গ করার জন্য অপেক্ষা করব? ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন ইতোমধ্যে অনেক পথ পাড়ি দিলেও এসব উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল অপরাধ দমনে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ এখনো দৃষ্টিগোচর হয়নি। অনলাইন প্ল্যাটফরমে নিয়মিতভাবে ঘটে যাওয়া এই অপরাধগুলোর দেশে এ মুহূর্তে কোনো স্বীকৃতিই নেই। যেন চোখের সামনে প্রতিনিয়ত অপরাধ ঘটলেও চোখ মুদে প্রতিকারের ব্যবস্থা না করলে আপনা আপনি অপরাধ হ্রাস পাবে।
এই মুহূর্তে প্রথমে আমাদের কোকোর আইনের ন্যায় একটি আলাদা আইন তৈরি করে উপর্যুক্ত অপরাধগুলো স্বীকৃতি দিতে হবে। নতুবা নিরাপদ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার এটিই সবচেয়ে বড় অন্তরায় হতে পারে। এখনই আমাদের দেশে এ রকম একটি নতুন আইন প্রণয়ন করার উপযুক্ত সময়, যাতে সব অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সব নতুন ধরনের ডিজিটাল যৌন হয়রানির শাস্তির যথাযথ বিচার করা যায়। অধিকন্তু আইনটিতে ভুক্তভোগীর গোপনীয়তা বজায় রেখে কেউ অপরাধের শিকার হলে সহজে এবং হয়রানিমুক্তভাবে যেন অভিযোগ দায়ের করতে পারে সে ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আইনে বিচার কার্যক্রম রুদ্ধদ্বারে পরিচালনার বিধান সংযুক্ত করে ভুক্তভোগীদের অতিরিক্ত হয়রানির শিকারের হাত থেকে নিস্তার দিতে হবে। অন্যথায়, অপরাধীরা এসব অপরাধ বিচারে একটি সুনির্দিষ্ট আইনের অভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশেকে ডিজিটাল যৌন হয়রানির স্বর্গে পরিণত করে ছাড়বে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে আছে। তার একটি হচ্ছে, ছাত্রলীগ নেত্রী কর্র্তৃক একজন নারী শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনা। যেটা আদালতের রায়ে একটা সুরহায় পৌঁছেছে। অন্যটি হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালামের কণ্ঠ সদৃশ ফাঁস হওয়া ফোন কল। যেখানে তাকে দুজন চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে কিছু আদান-প্রদানের কথা বলতে শোনা গেছে। যখন এই লেখাটি লেখছি (১৫ মার্চ) তখন উপাচার্যের ফাঁস হওয়া ফোন কলসহ বেশ কিছু অনিয়মের ঘটনা তদন্ত করতে ইউজিসির একটি প্রতিনিধি দল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘুরে এসেছে এবং তারা এসব ঘটনায় প্রাপ্ত তথ্যের প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পেশ করবে বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।
এই লেখার বিষয় হচ্ছে, গত এক মাসে ইবি উপাচার্যের দুটি ফোন কল এবং সেই ফোন কল কে বা কারা ফাঁস করেছে সেটা খুঁজে বের করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি। ইবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালামের ফোন কলের প্রথম অডিও ফাঁস হয় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। প্রথম অডিওর ৭ পর্ব ধারাবাহিকভাবে ফাঁস হয়। দ্বিতীয় অডিও ফাঁসের ঘটনা ঘটে গত ৭ মার্চ দিবাগত রাত ১২টার দিকে। ফাঁস হওয়া দুটি ফোন কলের অডিওতে দুটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে ইবি উপাচার্যকে নিয়োগ প্রার্থী ও তার আত্মীয়ের সঙ্গে ‘দাম-দাম’ করতে শোনা গেছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারিতে ফাঁস হওয়া ফোন কল নিয়ে ইবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম দৈনিক প্রথম আলোকে (২০ ফেব্রুয়ারি) জানিয়েছেন, ‘কয়েক বছর আগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগ খোলা হয়। সেখানে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেন অলিউর রহমান। তখন একটা বোর্ড করা হয়েছিল। কিন্তু কোরাম পূরণ না হওয়ায় সেটি বাতিল হয়ে যায়। অলিউরের সঙ্গে উপাচার্যের মুঠোফোনে কথা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন উপাচার্য।’ তিনি নিয়োগপ্রার্থী অলিউর রহমানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন বলে স্বীকার করলেও ফাঁস হওয়া ফোন কল তার নয় বলে দাবি করেছেন। অথচ ফাঁস হওয়া ফোন কলে তাকে অলিউরের নাম ধরে ডেকে কথা বলতে শোনা গেছে। ফোন কল তার নয় বলে যে দাবি তিনি করেছেন তার কারণ হচ্ছে, উপাচার্য মহোদয় নিয়োগপ্রার্থী ‘অলি’কে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগেই জানিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন এবং তাকে নিয়োগ দিতে একটি সাজানো নিয়োগ বোর্ড করবেন বলেও নিশ্চয়তা দিয়েছেন। ফলে এই ঘটনা স্বীকার করার প্রশ্নই আসে না। তবে অডিও ফাঁসের পর ১৯ ফেব্রুয়ারি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগসহ তিনটি বিভাগের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রথম অডিওর একটি অংশ ফাঁস হয় গত ২২ ফেব্রুয়ারি। এর জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন অফিস এবং প্রকৌশল অফিসের নিয়োগ পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে গত ৭ মার্চ ফাঁস হওয়া ফোন কলে শোনা যায়, ইবি উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে একজনকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে নিয়োগপ্রার্থীর আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। এই ফোন কলের বিষয়ে ইবি উপাচার্য সংবাদমাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমি এ বিষয়ে আপাতত কিছু বলতে চাচ্ছি না। এই অডিও আমার হতেও পারে, নাও হতে পারে। আমি থানায় জিডি করেছি। পুলিশ বাকি ব্যবস্থা নেবে।’ (প্রতিদিনের বাংলাদেশ : ৪ মার্চ ২০২৩)
ফাঁস হওয়ার ফোন কলে যে নিয়োগ বাণিজ্যের কথা প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, আওয়ামীপন্থি শিক্ষক সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও প্রগতিশীল শিক্ষকদের সংগঠন শাপলা পরিষদ উপাচার্যের কাছে ওই অডিওগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যা দাবি করেছেন। সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে, (১৫ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদে উপাচার্যের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষর অভিযান করছে এবং আন্দোলনে যাবে বলেও জানিয়েছে।
এই ঘটনায় কীভাবে ফোন কল ফাঁস হচ্ছে তা খোঁজ করতে গত ২০ফেব্রুয়ারি প্রক্টরের নেতৃত্বে ইবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আননূর যায়েদ বিপ্লব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি সেল ও সহকারী প্রক্টররা মিলে ইবি উপাচার্যের কার্যালয়ে তল্লাশিও চালান। (‘অডিও ফাঁস : ‘ডিভাইসের খোঁজে’ ‘ইবির ভিসির কার্যালয়-বাসভবনে তল্লাশি’, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: ২০ ফেব্রুয়ারি) এই ঘটনাটি লক্ষণীয়।
ফাঁস হওয়া অডিওগুলো যে ইবি উপাচার্যের না, এটা কিন্তু প্রমাণিত হয়নি। একই সঙ্গে এই অডিওগুলো যে ইবি উপাচার্যেরইÑ সেটা এখনো অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়নি। ফলে এই ঘটনায় একটি তদন্ত হওয়া জরুরি এবং ইবি উপাচার্যের কণ্ঠ সদৃশ যে অডিওগুলো ফাঁস হয়েছে সেই ঘটনাগুলো সত্য কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু সেটা হয়নি। ঘটেছে তার উল্টো; কে বা কারা এই অডিও ফাঁস করছে সেই নেপথ্যের কারিগরদের খুঁজে বের করতে ইবি প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অনেকেই বলবেন, কারও ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁস করা অন্যায়। এটা আইনসম্মত না। যারা এমন কথা বলেন তাদের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিখ্যাত সংবাদমাধ্যম উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ দারুণ একটা উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শাসকগোষ্ঠী যেটা জনগণের কাছে প্রকাশ করে সেটা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে প্রচারণার কাজ। আর শাসকগোষ্ঠী যেটা জনগণের কাছ থেকে লুকাতে চায় সেটা প্রকাশ করা হচ্ছে সাংবাদিকতা। তথা তাদের অপকর্ম প্রকাশ করা সাংবাদিকতারই অংশ। আর সাংবাদিকতা কোনোভাবেই অন্যায় না।
ইবিতে যা হচ্ছে, সেটা গোটা জাতির সঙ্গে অন্যায়। কারণ টাকার বিনিময়ে চুক্তি করে একজনকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত মেধাবী তার যোগ্য মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অযোগ্য ব্যক্তি শিক্ষক হচ্ছে। একজন অযোগ্য ব্যক্তি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয় তখন সে অন্তত ৩০টি ব্যাচকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা এই ৩০টি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নানাভাবে রাষ্ট্র তথা দেশকে সার্ভিস দেয়, জাতিকে সার্ভিস দেয়। যখন শিক্ষার্থীরা অযোগ্য শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রকে সার্ভিস দিতে যায় তখন সেই সার্ভিস ভালো না হওয়ারই কথা। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ মানে গোটা জাতি ও দেশের সঙ্গে অন্যায় করা।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
এ এক ভয়াবহ বিপন্ন সময়। দেশের মানুষকে জাপটে ধরছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। অধিকাংশের চোখেমুখে, চারদিক অন্ধকার। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেও, মুখে হাসি নেই তাদের। রক্তচোষা শোষকের লকলকে জিহ্বায় লালা ঝরে অনবরত। শোষকের সীমাহীন লোভে বিপর্যস্ত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত। জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত সাধারণ মানুষ। বাজার অব্যবস্থাপনা চরম পর্যায়ে।
বিশ^ অর্থনীতির উলট-পালটেও অধিকাংশ মুসলিম দেশ আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য, সাধারণের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করবে। এমনকি, কিছু দেশে এই পবিত্র মাসে পণ্যমূল্য কমিয়ে দেওয়া হয়। মানুষ যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে রোজার মাসে নিজেকে বাজারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এ সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় বিশেষ উদ্যোগ। একই সঙ্গে সরকারের সেই নির্দেশনা ঠিকমতো পালন করা হচ্ছে কি না তার জন্য রয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। নির্দেশনা অমান্যকারীর জন্য থাকে কঠোর শাস্তি। যে কারণে দেখা যায়, রমজান মাসে পণ্যমূল্যের দাম আরও হ্রাস করা হয়। দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়। কোনো কোনো দেশে আবার ক্রেতাদের জন্য বাড়তি উপহারও বরাদ্দ থাকে। এসবই হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে।
এর মানে হচ্ছে, আমাদের নৈতিকতার স্খলন কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেলে পবিত্র রমজানেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না! একই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কেন যে কঠোর পথ নিচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। আইন থাকলেও, সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। ফলে দিন দিন ব্যবসায়ীদের একটা চক্র, মানুষকে জিম্মি করে টাকার পাহাড় গড়ছে। বিষয়টা এমনÑ মানুষ মরছে মরুক, তাতে আমার কী! পণ্যমূল্য বাড়বেই।
গতকাল দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত, ‘রোজার পণ্যে চোখ রাঙানি’ শীর্ষক সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে শুরু করে ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, মসুর ডালসহ অন্যান্য পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় এসব পণ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি করেছে। আমদানিকারকরাও চাহিদার বড় একটা অংশ আমদানি করেছেন। তবে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে সব পণ্যের দামই এরই মধ্যে বেড়েছে। কোনো কোনো পণ্যের দাম গত রমজানের দ্বিগুণ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এতে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছে চরম বিপাকে।
সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির তথ্যমতে, গত বছর এ সময়ে ৬৫-৬৮ টাকায় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি কিনতে পেরেছেন ভোক্তারা। এবার তার দাম ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। আর গত রমজানের আগে যে ছোলা ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে তা এবার ১০৫ টাকা দামেও বিক্রি হচ্ছে।
সংবাদে আরও বলা হয়েছে, এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৫০-২৬০, লেয়ার ৩০০-৩২০, দেশি ৫০০-৫৬০, গরু ৭৫০, খাসি ১ হাজার ১০০ ও ছাগলের মাংস ৯০০ টাকা করে বিক্রি করতে দেখা গেছে। মাংস ছাড়াও ফার্মের ডিমও চড়া দামে বিক্রি হতে দেখা যায়। সপ্তাহের ব্যবধানে এক ডজন ফার্মের ডিমে ৫ টাকা বেড়ে পাইকারিতে ১৩০ ও খুচরায় ১৩৫-১৪০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ থাকলে, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকানো কঠিন কিছু না। সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দিলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই।
একবার শোষক শ্রেণির মনে আতঙ্ক এবং ভয় তৈরি হলে, কোনোভাবেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে না। কেবল রমজান মাসে না, প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবের ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর দৃষ্টি রাখা দরকার। বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ কোন পক্ষের অবহেলায় তৈরি হচ্ছে এটি তদন্ত করা প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, মানুষের মৌলিক চাহিদার ওপর উপর্যুপরি আঘাত, একসময় বুমেরাং হতে বাধ্য। এখনই সময়, বাজার ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসা। এভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে, মানুষকে তিলে তিলে হত্যা করা, কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য দেশের চিত্র নয়।
আবুল মনসুর আহমেদ ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, সাংবাদিক এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্রুপাত্মক রচয়িতা। ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (১৯৬৯)’ তার বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক রচনা। তিনি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার ধানিখোলা গ্রামে ১৮৯৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাংবাদিক হিসেবে নানান সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। আবুল মনসুর আহমেদ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর কংগ্রেসের আন্দোলনগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর তিনি মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৪০ সাল থেকে পাকিস্তানের আন্দোলনগুলোর সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কর্মসূচি ২১-দফার অন্যতম প্রণেতা ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৫৪ সালে তিনি ফজলুল হক মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। আওয়ামী মুসলিম লীগের (পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠাতা নেতা ছিলেন। ১৯৫৩-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। আবুল মনসুর আহমেদ একজন শক্তিমান লেখক ছিলেন। সাহিত্য চর্চায় অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হিসেবে পরিচিত ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করা হয় তাকে। এ ছাড়াও তিনি ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ (১৯৬০) ও নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছেন। আবুল মনসুর আহমেদ ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রথম সেট ২৫ মিনিট, দ্বিতীয়টি ২৮ মিনিটে জিতলেন কার্লোস আলকারাজ। মনে হচ্ছিল কোয়ালিফায়ার ফ্যাভিও কোবোলিকে বুঝি উড়িয়েই দিচ্ছেন শীর্ষ বাছাই।
না, তৃতীয় সেটতে প্রতিরোধ গড়লেন ইতালিয়ান। সময় গড়ালো ঘন্টায়। শেষপর্যন্ত জয় এসেছে ৬৬ মিনিটে। ৬-০, ৬-২, ৭-৫ গেমে প্রথম রাউন্ডের ম্যাচ জিতে রাফায়েল নাদালের উত্তরসুরি ক্লে কোর্টের সর্বোচ্চ আসর শুরু করলেন।
নাদালের চোটজনিত অনুপস্থিতিতে শীর্ষবাছাই আলকারাজ। ২০২১ এ তৃতীয় রাউন্ড, গতবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন। এবার আরো এগোলে সেমিফাইনালে নোভাক জকোভিচের সংগে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা।
সে দেখা যাবে। আপাতত দ্বিতীয় রাউন্ডে আলকারাজকে টপকাতে হবে জাপানের টি. দানিয়লেকে।
নতুন পে-স্কেল কিংবা মহার্ঘ ভাতা নয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট অনুযায়ী। তাদের বেতন প্রতি বছর যতটা বাড়ার কথা এবার তার চেয়ে বেশি বাড়বে। আর তা চলতি বছরের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ানো হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশের বাইরে বাড়ানো হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত প্রায় এক বছর ধরে দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বেশিরভাগের একমাত্র আয় বেতন-ভাতা। বৈশি^ক মন্দার কারণে সরকারও খানিকটা সংকটে আছে। এ পরিস্থিতিতে পে-স্কেল দেওয়ার মতো বড় ধরনের ব্যয় বাড়ানো সরকারের পক্ষে কঠিন হবে। ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলে সরকারের ওপর চাপ বেশি হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সরকারি কর্মরতদের খানিকটা স্বস্তি দিতে কোন খাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এমন প্রস্তাব চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বাজেটবিষয়ক বিভিন্ন বৈঠকে সরকারি নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে আলোচনা করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই করে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করে। চলতি মাসে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী ওই বৈঠকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে কত বাড়তি ব্যয় হবে তা হিসাব করে পরের বৈঠকে উপস্থাপন করতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বড় ধরনের ব্যয় না বাড়িয়ে একটা উপায় বের করতেও বলেন। শেষ পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে নিজেই জানিয়েছেন।
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ২০১৫ সালের বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ বেতন কমিশন প্রণীত হয়েছিল। এ কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, আর নতুন বেতন কমিশন গঠন করা হবে না। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট বা বেতন বাড়ানো হবে। এ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তা হয়ে আসছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাব অনুযায়ী, দেশে সরকারি কর্মচারী ১৪ লাখ। বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে হিসাব করলে প্রায় ২২ লাখ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নিয়মিত ইনক্রিমেন্টের বাইরে আরও কতটা বাড়ানো যায় তা হিসাব করে নির্ধারণ করা হবে। এ কাজ করতে বাজেট প্রস্তাব পেশ করার পর আলাদা কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে যাচাই-বাছাই শেষে ইনক্রিমেন্টের হার সুপারিশ করবে। এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে বিদ্যমান ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে প্রতি মাসে বেতন বাড়ানো হবে, নাকি গড় মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে ইনক্রিমেন্টের হার বাড়ানো হবে, তা খতিয়ে দেখা হবে। ২০তম গ্রেড থেকে প্রথম গ্রেড পর্যন্ত সবার জন্য একই হারে বেতন বাড়নো হবে কি না, তা আরও খতিয়ে দেখা হবে। চূড়ান্ত হিসাব অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে প্রকাশ করা হবে। যে তারিখেই প্রকাশ করা হোক না কেন, আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকরী ধরা হবে।
এখানে মহার্ঘ ভাতা ১০ শতাংশ দেওয়া হলে এ হিসাবে ৪ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে ৬ হাজার কোটি এবং ২০ শতাংশ দেওয়া হলে ৮ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। অর্থাৎ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যয় বাড়বে। আর এতে সরকার ব্যয় কমিয়েও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টিতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো পথে হেঁটেছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতা বাবদ রাখা হয়েছে ছিল ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। খরচ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা বাজেট হওয়ার কথা আছে। এ বাজেট সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ ৭৭ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক পদ এখনো খালি আছে। এতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো হলেও সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের চাপ বাড়বে না।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নির্মিত হয়েছে বিশেষ কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘ও ভোরের পাখি’। ঈমাম হোসাইনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করেছেন তামান্ন তিথি। অনুষ্ঠানটিতে আবৃত্তি করেছেন আশরাফুল আলম, মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, পলি পারভিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, আসলাম শিশির, সংগীতা চৌধুরী, আহসান উল্লাহ তমাল। প্রচারিত হয় ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টায়।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমারে দেবো না ভুলিতে’। অনুষ্ঠানটিতে গান, কবিতা ও আলোচনার সমন্বয়ে কবিকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ইয়াসমিন মুসতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, শেলু বড়ুয়া, ছন্দা চক্রবর্ত্তী ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন প্রফেসর মুন্সী আবু সাইফ। মনিরুল হাসানের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে ২৫ মে দুপুর ১ টা ০৫ মিনিটে। আরও প্রচারিত হবে সংগীতানুষ্ঠান ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘সন্ধ্যামালতী’। রাত ৯টায় প্রচারিত হবে নাটক ‘বনের পাপিয়া’ (পুনপ্রচার)।