
মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান যশোরে ১৯২৫ সালের ২৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৯ সালে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪১ সালে আইএসসি পাস করেন। ১৯৪৩ সালে কাজী নূর-উজ্জামান রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভিতে যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি বার্মা এবং সুমাত্রায় মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৪৬ সালে তিনি প-িত জওহরলাল নেহরুর আহ্বানে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি থেকে আর্মিতে চাকরি স্থানান্তর করে রয়্যাল ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর কাজী নূর-উজ্জামান পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কাজী নূর-উজ্জামান ১৯৫৬ সালে মেজর পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং ১৯৫৮ সালে স্টাফ কলেজ সম্পন্ন করেন। ১৯৬২ সালে তিনি প্রেষণে ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনে (ইপিআইডিসি) যোগ দেন। এখানে পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিলে ১৯৬৯ সালে তিনি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন এবং ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে কাজী নূর-উজ্জামান ২৮ মার্চ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক কাজী সফিউল্লাহর ব্যাটালিয়নে (ময়মনসিংহ) যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ৭ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হক ভারতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে কাজী নূর-উজ্জামান ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। কাজী নূর-উজ্জামান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সমন্বয়ক ও আহ্বায়ক হিসেবে গঠন করেন ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক কমিটি। তিনি স্বদেশ চিন্তা সংঘ, লেখক শিবির ও গণসংস্কৃতি ফ্রন্টের সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পরপরই কাজী নূর-উজ্জামান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন। আশির দশকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি ছিলেন। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে রাজপথের আন্দোলনে তিনি সরাসরি অংশ নেন। ২০০৭ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম গঠনে তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ২০১১ সালের ৬ মে ঢাকায় তার মৃত্যু হয়।
২১ মার্চ ২০২৩, সন্ধ্যা ৬টা। ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে নিভে গেল ভাস্কর শামীম সিকদারের জীবন প্রদীপ। লন্ডন থেকে ২০২২-এর শেষ দিকে ঢাকায় এসেছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবাসী এই শিল্পী। তারপর দীর্ঘ রোগভোগ ও একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে ২১ মার্চ সন্ধ্যায় তার জীবনাবসান ঘটে। সারা রাত হিমঘরে রেখে পরদিন অর্থাৎ ২২ মার্চ সকালে তার স্পন্দনহীন দেহ নিয়ে আসা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের সামনের চত্বরে। এই বিভাগে তিনি কাটিয়েছেন তার জীবনের সুদীর্ঘ সময়। গত শতকের ৭০ দশকে তরুণ শিক্ষার্থী হিসেবে এবং ৮০ দশক থেকে দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন এই বিভাগে। পরের প্রায় এক দশক সময়কাল লন্ডন ও ঢাকায় যাওয়া-আসায় কেটে গেছে। তার ৭০ বছরের জীবনের তারুণ্য থেকে শেষাবধি তিনি সবসময় থেকেছেন আলোচিত, কখনো কখনো বিতর্কিত। কিš‘ এ সব কিছু ছাপিয়ে দলমত নির্বিশেষে নানা বয়সের, নানা মত ও পথের মানুষ মিলিত হলেন তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। তার অগ্রজ-অনুজ-সমবয়সী শিল্পী, শিক্ষক, সহকর্মী, শিক্ষার্থী, সংস্কৃতজন, রাজনৈতিক দলসমূহ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হলো। বিদেশ থেকে সন্তানদের আসার অপেক্ষায় তার মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে আবার রাখা হয়েছে হিমঘরে। আজ ২৪ মার্চ জুমার পর ২য় জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হবে ঢাকার মোহাম্মদপুরের কবরস্থানে। সেখানে শায়িত আছেন তার মা, বাবা ও ভাই সিরাজ সিকদার।
১৯৫৩ সালে ফরিদপুরে জন্মগ্রহণকারী দেশের অন্যতম পথিকৃৎ এই ভাস্করের আকস্মিক বিদায়ের পর তার যাপিত জীবনকে উপলব্ধি করতে স্বভাবতই ইতিহাসের পাতা উল্টাতে হবে। বিশ শতকের ষাটের দশকে বাংলাদেশে আধুনিক ভাস্কর্য চর্চার পটভূমি রচনা করেছিলেন একজন নারী ভাস্কর, যার নাম নভেরা আহমেদ। তারই ধারাবাহিকতায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে স্বাধীনতা-পূর্ব ঢাকার চারুকলায় ভাস্কর্য বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে ১৯৬৩ সাল থেকে ভাস্কর্য বিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার সুযোগ সৃষ্টি হলেও শুরুতে নিয়মিত শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছিল না। ঊনসত্তরের উত্তাল গণ-আন্দোলনের কালে যারা চারুকলায় ভর্তি হয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে ভাস্কর্যকে বিষয় করে বিএফএ প্রোগ্রামে ভর্তি হতে আগ্রহী হলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের মিছিলের মুখ সেই শিক্ষার্থী শামীম আরা সিকদারও একজন নারী। স্বাধীন বাংলাদেশে অন্য অনেক নতুন আগ্রহের মতো নবীনদের মধ্যে ভাস্কর হওয়ার স্বপ্ন নির্মাণে তাই তাকে একজন অগ্রদূত বলা যেতে পারে। ভাস্কর্যের শিক্ষার্থী হিসেবেই শুধু নয়, বরং প্রচলিত লৈঙ্গিক জড়তাকে উপেক্ষা করার সাহস নতুন প্রজন্মে সঞ্চারিত করতেও তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণা। সাধারণের ধারণায় ভাস্কর্য শিল্প ‘পুরুষালি’ চর্চার প্রতীক। সম্ভবত শামীম সিকদার সত্তর দশক থেকেই এ ধারণাকে ভাঙতে প্রচলিত ‘পুরুষালি’ পোশাক ও আচরণকে সচেতনভাবে নিজস্ব করে নিয়েছিলেন।
শিক্ষাজীবন থেকেই সাহসী, বেপরোয়া এই ভাস্কর সারা জীবনে শত শত ভাস্কর্য গড়েছেন। ভাস্কর্য বিভাগের প্রথম বিএফএ ব্যাচের তিনি ছিলেন একমাত্র শিক্ষার্থী। ১৯৭৪ সালে ভাস্কর্যে স্নাতক হন। শোনা যায় তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতেও কিছুদিন ভাস্কর্য অনুশীলন করেছেন। থাইল্যান্ড ও ইতালি ভ্রমণ শেষে ১৯৭৬ সালে লন্ডনের জন ক্যাস স্কুল অব আর্ট থেকে এক বছরের সার্টিফিকেট কোর্স করেন। ১৯৮০ সালে তৎকালীন চারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ভাস্কর্যের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউটে পরিণত হওয়া থেকে অনুষদে রূপান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এখানে শিক্ষকতা করেন। তবে ২০০১ সালে তিনি লন্ডনে যান এবং তখন থেকে সেখানেই বেশিরভাগ সময় বসবাস করতে থাকেন। ২০০৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে ভাস্কর্য বিভাগ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।
দীর্ঘ শিল্পী জীবনে তিনি অসংখ্য বাস্তবধর্মী ভাস্কর্য রচনা করেন। তার বেশিরভাগ ভাস্কর্য প্রতিকৃতি নির্ভর। মাটিকে ম-ন করে কংক্রিট মাধ্যমে ঢালাই করে নির্মিত। কিছু ভাস্কর্য ব্রোঞ্জ, কাঠ ও অন্যান্য মাধ্যমেও রচনা করেন। তিনি বরাবরই বহিরাঙ্গন ভাস্কর্যের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা তার ভাস্কর্য চর্চার আগ্রহের একটি বিশেষ দিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পশ্চিম পাশের সড়ক দ্বীপে নির্মিত ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ নামের মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্যটি মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে নির্মিত স্মারক ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তিনি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ প্রতিকৃতি নির্মাণ করে আলোচিত হয়েছেন। কামানের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় আলোকচিত্র অবলম্বনে নির্মাণ করেন জাতীয় কবির পূর্ণাঙ্গ প্রতিকৃতি ভাস্কর্য। বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বের বহু বরেণ্য খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি ভাস্কর্য তিনি নির্মাণ করেছেন। আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে আত্মদানকারী নূর হোসেন এবং ডাক্তার মিলনও তার ভাস্কর্যের বিষয় হয়েছে। সাদা সিমেন্ট-কংক্রিটে ঢালাই করা এ ধরনের শতাধিক ভাস্কর্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের সড়ক দ্বীপটিতে প্রত্যক্ষ করা যায়। ঢাকার ইস্কাটনে তার সৃষ্ট ভাস্কর্যের বড় একটি সংগ্রহ আছে বলে জানা যায়। এছাড়াও দেশে বিদেশে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে তার নির্মিত বহু ভাস্কর্য রয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে তিনি বেশ কিছু নিরীক্ষাধর্মী ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। সাদা সিমেন্ট-কংক্রিটে সিলিন্ডার আকৃতির সরলাকৃতির জ্যামিতিক বিমূর্ত অবয়ব নির্ভর এইসব নির্মাণের মধ্যে ‘লা-গুয়ের্নিকা ৭১’ নামের ভাস্কর্যটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে নির্মিত এই ভাস্কর্যটি সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনের সবুজ লনে স্থাপিত আছে। বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের ভবন বর্ধনের কাজ চলমান। ফলে ভাস্কর্যটি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। শোনা যায় শামীম সিকদার গত বছরের শেষ দিকে লন্ডন থেকে ঢাকায় আসেন যেসব কারণে তার মধ্যে অন্যতম ছিল ঐ ভাস্কর্যটির রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা।
সর্বদা আলোচিত ভাস্কর শামীম সিকদারের শিল্পকর্মের ভালোমন্দ নিয়ে পরে শিল্প-সমালোচক ও গবেষকরা হয়তো বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়ন করবেন। তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় সময়ের সাহসী ও বেপরোয়া এই ভাস্করের বর্ণিল কর্মমুখর জীবন ও ব্যক্তিত্ব এদেশের শিল্পের ক্ষেত্রে অনেকদিন আলোচনার অংশ হয়ে থাকবে। নারীর স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত থাকবেন।
১৯৮২ সালে শামীম সিকদারের ভাস্কর্য প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত ক্যাটালগে মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস লিখেন, ‘তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ শামীম বেশ কিছু পুরস্কার ও পদক লাভ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৩ সালে পাওয়া প্রধানমন্ত্রীর পদক এবং চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের সিলভার জুবিলি পদক। তবে এতে আত্মতৃপ্তির কোনো স্থান নেই। তিনি তার শিল্পী জীবনের সুন্দর সূচনা করেছেন। এখন সামনে পড়ে আছে এক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।’ একই লেখায় তিনি আরও মন্তব্য করেন, ‘শামীম সিকদার নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সব চেয়ে ফলবান এবং সম্ভবত সমরূপ সৃজনশীল ভাস্কর। তার ভাস্কর্যকর্মের পরিচিতিকরণ আনন্দের ব্যাপার। সত্যি কথা বলতে কি, মিডিয়ামের প্রচণ্ড সীমাবদ্ধতা এবং ভাস্কর্য সংক্রান্ত ব্যয়ভার সত্ত্বেও মূলত তিনিই বিগত কয়েক বছর ধরে এদেশের ভাস্কর্যের বর্ধিষ্ণু ধারার হাল ধরে রেখেছেন।’ মিজারুল কায়েসের এই মন্তব্য দুটিকে সামনে রেখে ভবিষ্যতে ভাস্কর শামীম সিকদার মূল্যায়িত হবেন এমন প্রত্যাশা রইল। লেখক: সহকারী অধ্যাপক ভাস্কর্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। কোরআন নাজিলের মাস। আমলে অগ্রগামী হওয়ার মাস। গোনাহ ছেড়ে দেওয়ার মাস। ক্ষমা লাভের মাস। প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরার মাস। দেহমন শুদ্ধ ও পবিত্র করার মাস। এ মাসের চাঁদ উঠতেই ঘোষণা হতে থাকে, ‘ওহে কল্যাণ অন্বেষী! তুমি সুসংবাদ গ্রহণ করো, নেকির পথে তুমি আরও বেগবান হও। ওহে অকল্যাণের পথিক, তুমি নিবৃত্ত হও, নিয়ন্ত্রিত হও।’ -জামে তিরমিজি : ৬৮২
পবিত্র এ মাস আখেরাতের পাথেয় গোছানোর মাস। এ মাসে আল্লাহতায়ালা ইমানদারদের জন্য রোজা ফরজ করেছেন, যা ইসলামের মৌলিক একটি স্তম্ভ। ইমান ও ইহতিসাবের (সওয়াবপ্রাপ্তির আশায়) সঙ্গে সিয়াম সাধনা বান্দার গোনাহ মাফ করে দেয়। ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইমান এবং ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সওয়াবের প্রত্যাশা রেখে রমজান মাসে রোজা রাখবে, তার আগের গোনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে।’ -সহিহ বোখারি : ৩৮
রমজানের প্রতিটি ইবাদত, প্রতিটি মুহূর্ত বিশেষ মর্যাদা ধারণ করে। এ মাসের নামাজ- রোজা, সাহরি-ইফতার, তাসবিহ-তাহলিল, কোরআন তেলাওয়াত-মোনাজাত সবকিছুর রয়েছে বিশেষ ফজিলত। এর প্রতিটি আমল বান্দাকে তাকওয়ার সোপানে উন্নীত করে এবং আল্লাহর নৈকট্য ত্বরান্বিত করে। অতএব রোজার সঙ্গে সঙ্গে তারাবির প্রতি যতœবান হওয়া, তাহাজ্জুদের অভ্যাস করা এবং সাহরির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। খেয়াল রাখা, রোজা যেন আমার জন্য ঢাল হয়। আমার কোনো ত্রুটির কারণে যেন এ ঢাল বিদীর্ণ না হয়।
আল্লাহর হুকুম পালনের স্বাদ উপভোগের সময় ইফতারের মোবারক মুহূর্ত। একটু আগে বা পরে খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকা শুধু আল্লাহর ভালোবাসার জন্য। এটা এক অপার্থিব মুহূর্ত। এমন বরকতময় মুহূর্তে জিকির ও কোরআন তেলাওয়াতে জবানকে সতেজ রাখা কাম্য। এভাবে রমজানজুড়ে ক্ষণে ক্ষণে ও নানা মুহূর্ত ও সময়ে রয়েছে বরকত ও রহমতের সময়। সেগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো।
রমজান মাসে ইতিকাফের প্রতি মনোযাগী হওয়া। এটা ছিল নবীজির দায়েমি (সর্বদার) আমল। শেষ দশকে তা সম্ভব না হলে অন্তত বেজোড় রাতগুলোয় কিংবা যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব। হাজার রজনী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল কদরের অন্বেষায় বিভোর থাকা গোটা রমজান। বিশেষ করে শেষ দশক, যে দশকে নবী কারিম (সা.) কোমর বেঁধে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। মনে রাখা নবীজির সেই কথা, ‘এই মহিমান্বিত মাস উপস্থিত। তাতে একটি রাত রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত থাকল সে যেন সব কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। আর কেবল অভাগাই এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে।’ -ইবনে মাজাহ : ১৬৪৪
রমজান ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার মাস। এ মাসে মুমিনরা সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন। খোঁজ-খবর নেবেন আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং অভাবী ভাইবোনের। নেক ও কল্যাণের পথে আরও ধাবিত হওয়া। যাদের ওপর ওয়াজিব সদাকাতুল ফিতর, তারা তা পৌঁছে দেবেন গরিবের দুয়ারে সসম্মানে।
জাকাত রমজানের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো আমল নয়। তার পরও অনেকে এ মাসে জাকাত আদায় করেন। এটা একটি স্বতন্ত্র ফরজ ইবাদত। জাকাত প্রদান কোনো লোকদেখানো বা বাহাদুরির বিষয় নয়। সুতরাং এটা নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো, প্রচারণা কাম্য নয়। আর জাকাত শাড়ি-লুঙ্গিতে পরিণত করে বিতরণ করাও ইসলামের মূল শিক্ষার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। এ বিষয়ে পরিপূর্ণ সতর্কতা কাম্য।
ইসলামি স্কলারদের মতে, রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান। এ সময়গুলো যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করা। দিনগুলো দোয়া-দরুদ, জিকির-আজকার, কোরআন তেলাওয়াত, তওবা-ইস্তেগফার, নফল নামাজ ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা। গল্পগুজব পরিহার করা। ডিভাইসের অনর্থক ব্যবহার বন্ধ রাখা।
বরকতময় এ মাসে গোনাহের ধারা অব্যাহত রাখা খুবই খারাপ কথা। যেখানে ঘোষণা হতে থাকে নেকির কাজে অগ্রসর হতে, অনিষ্ট থেকে নিবৃত্ত হতে, সেখানে গোনাহের ধারা অব্যাহত রাখা রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ। বিশেষ করে অনাচার-পাপাচার ও অশ্লীলতা এবং এমন গোনাহ, যা আল্লাহর ক্রোধকে আরও বাড়িয়ে দেয়, এমন সব বিষয় পুরোপুরি বর্জন করা উচিত; এবং এখন থেকে সারা জীবনের জন্য বর্জন করা উচিত। কারণ ফিরে আসার এটাই মোক্ষম সময়।
রমজান উপলক্ষে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পণ্য মজুদকরণ, খাদ্যে ভেজাল ইত্যাদি অসাধুতা অত্যন্ত গর্হিত মানসিকতার পরিচায়ক। সহমর্মিতার মাসে এ ধরনের অন্যায় বড় ধরনের জুলুম। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।
ঈদকে সামনে রেখে যে শপিং-সংস্কৃতি সমাজে চালু হয়েছে তা খুবই উদ্বেগের কথা। ঈদের কেনাকাটায় নারীদের অংশগ্রহণ, ঈদ উপহারের সংস্থানে হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করা, সময়ের অপচয়, কেনাকাটায় বাহুল্য ইত্যাদি নিয়ে ইসলামের আলাদা আলাদা বিধান রয়েছে। রমজানে সেগুলো পরিপালনে মনোযোগী হওয়া চাই।
আফসোসের কথা হলো, যেখানে রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধানের কথা বলা হয়েছে এবং নবী কারিম (সা.) যখন কোমর বেঁধে ইবাদতে মশগুল হতেন, পরিবারের লোকদের সজাগ করতেন তখন তার উম্মত কেনাকাটায় ব্যস্ত! এ অবস্থার পরিবর্তন কাম্য।
রমজানজুড়ে এই হাদিস স্মরণে রাখা, হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি একবার মিম্বরে আরোহণ করলেন। প্রথম ধাপে উঠে বললেন, আমিন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে উঠেও বললেন, আমিন। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন (কী বিষয় আল্লাহর রাসুল!) আপনাকে (এভাবে) আমিন বলতে শুনলাম। তখন নবীজি বললেন, আমি যখন মিম্বরে আরোহণ করলাম তখন হজরত জিবরাইল আগমন করলেন এবং বললেন, ওই ব্যক্তি হতভাগা, যে রমজান মাস পেল, আর রমজান গত হয়ে গেল কিন্তু তার গোনাহ মাফ হলো না। আমি বললাম, আমিন। তারপর বললেন, ওই ব্যক্তি হতভাগা, যে তার মা-বাবাকে অথবা কোনো একজনকে পেল অথচ তারা (মা-বাবা) তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাল না (তাদের সেবার সুযোগ কাজে লাগিয়ে সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না) আমি বললাম, আমিন। তৃতীয় বার বললেন, ওই ব্যক্তি হতভাগা, যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হলো- আর সে আপনার ওপর দরুদ পাঠ করল না। বললাম, আমিন। -আল আদাবুল মুফরাদ
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
(প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির পর)
প্রতিরোধ ও গবেষণা
দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রম হিসেবে কিছু সভা-সেমিনার ও গণশুনানি আয়োজন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সততা স্টোর গঠন ও পরিচালনা, ছাত্রাবাসে সততা সংঘ গঠন ও পরিচালনা, জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠন, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন ইত্যাদি সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম চালানো হয়ে থাকে। এনফোর্সমেন্ট টিমের মাধ্যমে কিছু কিছু প্রতিরোধমূলক কাজও করা হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা ও তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত ও সুপারিশ তৈরির মাধ্যমে গবেষণা জাতীয় সামান্য কিছু কাজও করা হয়ে থাকে।
এগুলো যা হয় তার প্রায় সবই হয় নামকাওয়াস্তের মতো, লোক দেখানোর মতো। এগুলোর সমস্ত কাজ করানো হয় অনুসন্ধান-তদন্তে ব্যস্ত একই কর্মকর্তাদের দিয়ে। প্রতিরোধ ও গবেষণার উইং আলাদা থাকলেও আলাদাভাবে কর্মকর্তা রাখা হয় না, বিশেষত জেলা পর্যায়ে তো নয়ই। ফলে, প্রতিরোধ ও গবেষণার কাজও যেমনটি হওয়া দরকার তেমন ফলপ্রসূ হয় না, আবার অনুসন্ধান-তদন্তও যেমনটি হওয়া দরকার তেমন সফল ও সার্থক হয় না। তাই, অনুসন্ধান-তদন্তের কাজমুক্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রতিরোধ ও গবেষণা সংক্রান্ত কাজ পরিচালনার ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।
দুর্নীতিলব্ধ অর্থ-সম্পদ উদ্ধার
মামলায় সাজা হলে জরিমানা আদায় ও বাজেয়াপ্তি কার্যকর করার দায়িত্ব আর দুদকের হাতে থাকে না বিদ্যমান আইনে, চলে যায় জেলা প্রশাসকের কাছে; জরিমানা আদায় তাকে করতে হবে দেওয়ানি আদালতে ডিক্রি জারি মামলা করে (ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮৬ ধারা)। গুরুত্বপূর্ণ এই বিশেষ কর্ম সম্পাদনের জন্য জেলা প্রশাসকদের অফিসে বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা নির্ধারিত নেই। জরিমানা আদায় ও বাজেয়াপ্তি কার্যকরে জেলা প্রশাসকদের তাই কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন। তাদের নিজেদের অফিসে অন্তত একজন কর্মকর্তাকে এ-বিষয়ে বিশেষভাবে দায়িত্বে রাখা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আদালত ও জেলা প্রশাসকের অফিসে দুদকের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ও খোঁজখবর রাখা দরকার। দুদকের নবগঠিত ‘অপরাধলব্ধ সম্পদ ব্যবস্থাপনা সেল’-কে এ-বিষয়ে সক্রিয় করা দরকার।
স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট গঠন
দুদক আইনে (৩৩ ধারা) স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট গঠনের বিধান আছে। কিন্তু, সে ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে আপন পেশায় নিয়োজিত আইনজীবীদের একরকম ভাড়া করা অস্থায়ী ব্যবস্থাই চলে আসছে ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে। এসব আইনজীবীর বেশিরভাগেরই দক্ষতা ও আন্তরিকতা, এমনকি সততা ও আনুগত্য নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। যার ক্ষতিকর প্রভাব দুদকের মামলায় স্পষ্ট। তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায় না সব সময়। তাই, অতি সত্বর ৩৩ (২) ধারার বিধান অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বিধিমালা প্রণয়ন করে দক্ষ ও শক্তিশালী স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট প্রতিষ্ঠা জরুরি।
বিচার কার্যক্রম
২০১৮ সালে স্পেশাল জজ আদালতসমূহে আগের পেন্ডিং মামলার সঙ্গে তার প্রায় ৮% নতুন এসে যোগ হয়; নিষ্পত্তি মোটের ওপর মাত্র প্রায় ৭%, যার প্রায় ৬০% সাজা। পিপিদের কাজের মনিটরিং-তদারকি জোরদার করায় এবং সাক্ষী-আলামত হাজির করায় বিশেষ জোর দেওয়ায় সাজার হার বাড়া শুরু হয় ২০১৬ সাল থেকে। কিন্তু, মোট নিষ্পত্তির হার বাড়ানো মোটেই সম্ভব হয়নি। প্রতি বছর দুদকের বিচারাধীন মোট মামলা প্রায় সাড়ে তিন হাজারের কাছাকাছি থাকে (২০১৮ সাল পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী)। ২০০৭ সালে ঢাকায় সৃষ্ট ১০টিসহ সারা দেশে পুরোপুরি পৃথকভাবে স্পেশাল জজ আদালত আছে ২৯টি। সে-হিসাবে আদালতপ্রতি গড়ে ১২০টি করে মামলা পড়ে। ২০১৮ সালে মোট নিষ্পত্তি হয় মাত্র ২৪৯টি মামলা। অর্থাৎ, সারা বছরে এই ২৯টি আদালতের একেকটিতে গড়ে নিষ্পত্তির সংখ্যা দাঁড়ায় ৯টিরও কম এবং মাসে পড়ে একটিরও কম।
শুরুতে স্পেশাল জজ আদালতগুলোতে দুর্নীতির মামলা ছাড়া অন্য কোনো মামলা বিচারের এখতিয়ার ছিল না। কিন্তু, ২০০৩ সালে ‘অতিরিক্ত দায়িত্ব আইন’ করে অন্যান্য আদালতে জট লেগে থাকা বিচারাধীন মামলা স্পেশাল জজ আদালতে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে, তখন থেকে স্পেশাল জজ আদালতগুলোতে দুর্নীতির মামলার চেয়ে অন্যান্য আদালত থেকে আসা মামলারই জট লেগেছে বেশি, তার বেশিরভাগ আবার দুর্নীতির মামলার চেয়ে অনেক কম জটিল। স্বাভাবিক কারণেই দুর্নীতির মামলার ভাগে আদালতের সময় ও মনোযোগ পড়ে অনেক কম। সারা দেশে আদালতগুলো যে-রকম মামলাভারাক্রান্ত তাতে এসব স্পেশাল জজ আদালতকে আর কেবলমাত্র দুদকের তিন/সাড়ে তিন হাজার দুর্নীতির মামলা বিচারের জন্য আগের মতো পৃথক রাখার দাবি করারও কোনো উপায় নেই। এছাড়া, ৬৪ জেলায় সিনিয়র স্পেশাল জজের কাছ থেকে কগনিজ্যান্স হয়ে বিচারের জন্য স্পেশাল জজ আদালতে মামলা আসতে কালক্ষেপণ হয় প্রচুর, অনেক ক্ষেত্রে স্পেশাল জজ আদালতে না এসে মামলা পড়ে থাকে অতিরিক্ত দায়রা জজ বা যুগ্ম দায়রা জজের কাছেও (সরকারি নোটিফিকেশন অনুযায়ী পদাধিকারবলে তারাও স্পেশাল জজ)।
স্পেশাল জজ আদালতের বিচারাধীন অনেক মামলার কার্যক্রম রিট-রিভিশনে হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত হয়ে যায়। হাইকোর্টে অন্যান্য মামলার চাপে এসব রিট-রিভিশন নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যায়, স্পেশাল জজ আদালতে মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকে বছরের পর বছর। অনেক সময় কোনো কোনো মামলায় একাধিকবারও হাইকোর্টে আসে আর স্থগিতাদেশ হয় একাধিকবার। স্পেশাল জজ আদালতে মামলার বিচার শেষ হলে হাইকোর্টে শুরু হয় আপিল। হাইকোর্টে অন্যান্য মামলার চাপে এসব আপিল নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যায়, সাজাপ্রাপ্ত-আপিলকারী অনেক আসামি মারাও যায় আপিল নিষ্পত্তির আগে। হাইকোর্টের পরে আবার আপিল বিভাগ তো আছেই। সাজা কার্যকর হয় না প্রায়ই।
পৃথক আদালত/ট্রাইব্যুনাল গঠন
দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করতে যথাসময়ে বিচার নিষ্পত্তির কোনো বিকল্প নেই। সর্বোচ্চ ৬০ দিনের মধ্যে (৪৫ দিনে না পারলে আরও ১৫ দিনে অবশ্যই) স্পেশাল জজ আদালতে মামলার বিচার শেষ করার সময়সীমা আইনে নির্ধারিতও আছে। কিন্তু, বাস্তবে শেষ হয় না বছরের পর বছর গেলেও। এ অবস্থায় আমি মনে করি, শুধুমাত্র দুর্নীতির মামলা বিচারের এখতিয়ার দিয়ে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে ঢাকায় ৩/৪টি এবং বাকি পুরাতন ১৮টি জেলায় একটি করে দুর্নীতি দমন আদালত/ট্রাইব্যুনাল নতুনভাবে সৃষ্টি করা দরকার।
সিনিয়র স্পেশাল জজে কগনিজ্যান্স হয়ে বিচারের জন্য স্পেশাল জজ আদালতে মামলা আসার কালক্ষেপণ প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে সৃজিতব্য এসব আদালত/ট্রাইব্যুনালের প্রত্যেকের স্থানীয় এখতিয়ারের এলাকা নির্দিষ্ট করে দিয়ে একইসঙ্গে কগনিজ্যান্স ও বিচারের ক্ষমতা দিতে হবে। এসব আদালত/ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্সিং ব্যবস্থায় দ্রুত সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ডিজিটাল মাধ্যমে প্রাপ্ত/সংগৃহীত শব্দ, ছবি, লেখা ইত্যাদি এসব আদালত/ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে গ্রহণের বিধান রাখতে হবে। মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমা নির্ধারিত করে দিতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে পালন করার মতো করে। মামলা নিষ্পত্তির আগে অন্তর্বর্তীকালে উচ্চ আদালতে আপিল-রিভিশন নিষিদ্ধের বিধান রাখতে হবে অর্থঋণ আদালত আইনের মতো করে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় জরিমানা আদায় ও বাজেয়াপ্তি কার্যকর করার দায়িত্ব চলে যায় জেলা প্রশাসকের কাছে, তাকে আবার জরিমানা আদায় করতে হয় দেওয়ানি আদালতে ডিক্রি জারি মামলা করার মাধ্যমে (ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮৬ ধারা)। এত ঘুরপথের কারণে জরিমানা আদায় ও বাজেয়াপ্তি কার্যকর হয় না মোটেও। অপরাধলব্ধ সম্পদ দণ্ডিত অপরাধীরাই বংশপরম্পরায় ভোগ করে চলে। তাই, সাজার পরে জরিমানা আদায় ও বাজেয়াপ্তি কার্যকরের বাকি কার্যক্রমটুকুও সৃজিতব্য এসব আদালত/ট্রাইব্যুনালেই সম্পন্নের বিধান করতে হবে।
পৃথক আপিল আদালত/ট্রাইব্যুনাল গঠন
সরকারি কর্মচারী ও শ্রমিকদের চাকরির মামলার আপিলের জন্য হাইকোর্টের বাইরে পৃথকভাবে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনাল, শ্রমআপিল ট্রাইব্যুনাল আছে। তেমনি দুর্নীতির মামলার সব কার্যক্রমের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি দ্রুততর করার জন্য হাইকোর্টের বিচারপতির যোগ্যতাসম্পন্ন বিচারকদের সমন্বয়ে পুরোপুরি পৃথক ২/৩টি দুর্নীতি দমন আপিল আদালত/ট্রাইব্যুনাল গঠন করা দরকার। আপিল বিভাগের রায়ে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালকে যেমন রিট এক্তিয়ারের বিষয়েও হাইকোর্ট বিভাগের অনুরূপ ক্ষমতা নিশ্চিত করা হয়েছে তেমন ক্ষমতা সৃজিতব্য এসব আপিল আদালত/ট্রাইব্যুনালকে দিতে হবে।
দুর্নীতিবাজদের জনপ্রতিনিধি ইত্যাদি থাকার ও নির্বাচিত/মনোনীত হওয়ার অযোগ্যকরণ সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত রাখার বিধান আছে। সেটা দুর্নীতির অপরাধেও তাদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু, জনপ্রতিনিধি, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সংগঠনের কার্যকরী কমিটি/বোর্ডের চেয়ারম্যান-পরিচালক-সদস্যদের সাময়িক অপসারণ/অব্যাহতির কোনো বিধান নেই। দুর্নীতির অপরাধে অভিযুক্ত হলে তাদেরও সাময়িক অপসারণ/অব্যাহতির এবং দণ্ডিত হলে সেই সাময়িক অপসারণ/অব্যাহতি চূড়ান্ত করা এবং দণ্ডাদেশ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তাদের নির্বাচিত/মনোনীত হওয়ার অযোগ্য করার বিধান করা প্রয়োজন। আপিলে দণ্ড স্থগিতের অজুহাতে নির্বাচিত/মনোনীত হওয়ার সুযোগ চিরতরে বন্ধ করা দরকার। গুটিকয় ব্যক্তির অধিকার/স্বার্থের চেয়ে সমগ্র জনগণের স্বার্থ অনেক বেশি বড়। ক্ষুদ্রতর স্বার্থে বদলে বৃহত্তর স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
কোনো অপরাধী অনুসন্ধানকালে বা তদন্তকালে বা বিচারকালে এমনকি আপিলেও দোষ স্বীকার করলে কোনো কারাদণ্ড না দিয়ে (দোষ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য), শুধুমাত্র জরিমানা ও তার অপরাধলব্ধ অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার এবং তাকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য জনপ্রতিনিধি/রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সংগঠনের কার্যকরী কমিটি/বোর্ডের চেয়ারম্যান-পরিচালক-সদস্য ইত্যাদি পদে থাকার ও নির্বাচিত/মনোনীত হওয়ার অযোগ্য করার বিধান করা দরকার। তাহলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে এবং একই সঙ্গে আপিল-রিভিশনের ঝামেলা দূর হবে। তার ফলে ছোট ছোট দুর্নীতির তো বটেই বড় বড় দুর্নীতির মামলারও দ্রুত চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা যাবে।
(সমাপ্ত)
লেখক: প্রবন্ধকার ও আইন গ্রন্থকার
অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক
শুরু হলো, সিয়াম সাধনার মাস। বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ মানুষ, রমজান মাসে নিজেকে শুদ্ধ চিন্তায় উন্নীত করেন। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন, ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। বিশেষ করে, মানব মনের অবিচ্ছেদ্য রিপু ‘লোভ’ থেকে নিজবৃত্তিকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন- আত্মচিন্তায় মগ্ন হয়ে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে। সেই সংযম, আত্মশুদ্ধির মাসই- রমজান। কিন্তু তা হওয়ার নয়! বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলেও, কৃত্রিম সংকটের কারণে দেশের বর্তমান দ্রব্যমূল্যে নাভিশ্বাস মধ্যবিত্তের। এরমধ্যে চলমান রমজানে যদি আরেক দফা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হতে পারে- সেটি সহজেই চিন্তা করা যায়।
বর্তমানে দ্রব্যমূল্য মধ্যবিত্তের কাছে, এমনিতেই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম। এরপর আবার যদি রমজানের অজুহাতে ‘বাজার সিন্ডিকেট’ তৈরি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বৃদ্ধি করা হয়- তাহলে সাধারণ মানুষকে ফেলে দেওয়া হবে চরম হতাশা ও উদ্বেগের মধ্যে। এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে সরকারের কঠোরতর পদক্ষেপ। বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে, দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট ভাঙা সাধারণ জনগণের পক্ষে সম্ভব না। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আন্তরিকতা নিয়ে উদ্যোগী হয়ে কাজ করতে হবে। সাধারণ মানুষের মনে, এমন আস্থা আনতে হবে, মানুষ যাতে ভাবতে বাধ্য হয়- সরকারের আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। যদি তাই-ই হয়, তাহলে কোনোভাবেই ‘বাজার সিন্ডিকেট’ থাকার কথা না। আর সিন্ডিকেট না থাকলে, দ্রব্যমূল্যও বৃদ্ধি পাবে না।
এরই মধ্যে রোজায় ব্যবহৃত অধিকাংশ পণ্যমূল্য একদফা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রায় ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে বিভিন্ন পণ্যমূল্য। রমজানকে ঘিরে, অবশ্যই তৎপর রয়েছে- বাজার সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর অবস্থান নেওয়া দরকার। ইতিমধ্যে রোজায় ব্যবহৃত ছোলা, শসা, ডিম, ডালের দাম বেড়ে গেছে। এমনকি, মাছ এবং ব্রয়লার মুরগির দামও কল্পনাতীতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রয়লার মুরগির দাম বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে বলা হচ্ছে, পোলট্রি ফিডের কথা- যা একেবারেই সত্য নয়। যেখানে পোলট্রি খাদ্যের দাম বেড়েছে মাত্র ১০ ভাগ, সেখানে মুরগির দাম বেড়েছে ৭০ ভাগ! এই স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার পরিষদ যদিও সোচ্চার, তবু নিয়ন্ত্রণহীন বাজার।
এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ যদিও ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছেন, রমজানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি না করার জন্য- তবু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। প্রতি বছর এই অনুরোধের পরও পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি, শাস্তি তো দূরের কথা। অন্তত নিকট অতীতে তেমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। অসহায় সাধারণ মানুষ যখন দেখেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন, মজুদদার কিংবা বাজার নিয়ন্ত্রণকারীর কেউ কঠোর শাস্তির আওতায় এসেছেন- তখন দ্রব্যমূল্য এমনিতেই, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতাই আসল।
কোনো দেশে, কোনো সভ্য সমাজে এই ধরনের দুর্র্বৃত্তায়নের সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে সরকারকেই, জনগণের সেবায় এগিয়ে আসতে হয়। কঠোর নজরদারি এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, অনাচার ও দুর্ভোগ থেকে মানুষকে স্বস্তির পথ দেখায়। এক্ষেত্রে আমাদের দেশেও এমনটিই হবে- সেই প্রত্যাশা থাকল। সংযমের এই মাসে, লোভাতুর কাবুলিওয়ালাদের নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মূল চ্যালেঞ্জ।
ঢাকাসহ সারা দেশে তীব্র দাবদাহ চলছে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ থাকছে না বাসা-বাড়ি, অফিস আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।
বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে একটি মহল পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টায় আছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য এসেছে। আর ওই তথ্য পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর নড়েচড়ে বসেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ শীর্ষ কর্তারা বৈঠক করেছেন। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সোমবার পুলিশের সব রেঞ্জ অফিস ও ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
বিশেষ বার্তা পেয়ে ইউনিট প্রধান, রেঞ্জ ডিআইজি ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপাররা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছে পুলিশ।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি। এরই মধ্যে যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলো নিরাপত্তার আওতায় আনা হচ্ছে। এই জন্য আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সোমবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সব ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে বিদ্যুৎ স্টেশনে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি নজরদারি বাড়াতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একটি মহল লোডশেডিংয়ের অজুহাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। যেসব এলাকায় বেশি বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তারও একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, পুলিশ সদর দপ্তরের চিঠি পাওয়ার পর আমরা বিশেষ বৈঠক করছি। এলাকায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তা সত্য। এ জন্য আমরা বেশ সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ অফিস ও স্টেশনগুলোর বিষয়ে থানার ওসিদের দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, লোডশেডিংয়ের অজুহাত তুলে বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে একটি বিশেষ মহল। প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে থানার ওসিদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন জেলার পুলিশ সুপাররা। এমনকি বাড়তি ফোর্সও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তা ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
বিদ্যুৎ অফিসের পাশাপাশি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তুলতে ৫০ থানার ওসিদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
খন্দকার গোলাম ফারুক দেশ রূপান্তরকে জানান, বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে যাতে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সে জন্য আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো বাড়তি নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে সবাইকে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎসহ যেকোনো সমস্যা নিয়ে কোন মহল যাতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে। আশা করি বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটবে না। তারপরও পুলিশ সতর্ক আছে।
সূত্র জানায়, লোডশেডিংকে পুঁজি করে কেউ যাতে অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখতে বলা হয়েছে। নির্দেশনার পর সারা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, বিদ্যুৎ অফিস, সাবস্টেশনসহ কেপিআই স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের চেয়ে বৃদ্ধি করা হয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম ও পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা সমিতি বা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকেও পুলিশকে চিঠি দিয়ে বাড়তি নিরাপত্তাও চাওয়া হয়েছে।
অবশেষে বন্ধ হয়ে গেল দেশের সর্ববৃহৎ পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। গতকাল সোমবার দুপুরে কেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কয়লা সংকটে গত ২৫ মে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট বন্ধ হয়। ২০২০ সালে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পর এবারই প্রথম কয়লা সংকটে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন বন্ধ হলো।
চীন ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগের এই বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানটিকে কয়লা ক্রয়ে ঋণ দিয়ে আসছে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি (সিএমসি)। এপ্রিল পর্যন্ত কয়লার ৩৯০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সিএমসি। পরে ১০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হলে কয়লা আমদানির এলসি খোলার শর্ত দেয় চীনা প্রতিষ্ঠান। গতকাল পর্যন্ত ৯৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এ মাসের শেষদিকে কয়লা দেশে আসার কথা রয়েছে।
কয়লার অভাবে দেশের সবচেয়ে বড় এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এক মাসে লোকসান হবে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের কারণে জনদুর্ভোগ ও কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে পুরো ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।
এদিকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের বাইরে শুধু কয়লাবাবদ পিডিবির কাছে কেন্দ্রটির বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে থাকা এ বকেয়ার টাকা পরিশোধের জন্য দফায় দফায় চিঠি দিয়েও তা পরিশোধ করা হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলার কারণেই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নিজেদের দায় অস্বীকার করে বলছে, বৈশি^ক মন্দার পরিস্থিতিতে ডলার সংকটের কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের পাশাপাশি কেন্দ্রভাড়া বাবদ প্রতি মাসে পিডিবিকে ২৪৭ কোটি টাকা দিতে হবে। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও নির্ধারিত কেন্দ্রভাড়া পরিশোধ করতে হবে পিডিবিকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্নভাবে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট করে প্রায় তিন কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছিল কেন্দ্রটি। প্রতি মাসে এর পরিমাণ ছিল ৯০ কোটি ইউনিট। গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য ছিল ৫ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৬ টাকার মতো।
প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফার প্রকৃত জানা না গেলেও নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানান, সব ধরনের ব্যয় বাদ দিয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে তাদের নিট মুনাফা হতো ৫ থেকে ৬ শতাংশ। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড়মূল্য সাড়ে ৫ টাকা এবং মুনাফা সাড়ে ৫ শতাংশ বিবেচনায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির এক মাসে মুনাফার পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। কেন্দ্রটি বন্ধ থাকায় এ মুনাফা থেকে বঞ্চিত হবে বিসিপিসিএল। এদিকে কয়লা কেনার জন্য সাড়ে ৬ শতাংশ সুদে ঋণ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। গত ছয় মাসের বেশি সময় কয়লার বিল বকেয়া থাকায় সুদের পরিমাণও বেড়ে যাবে। বাড়তি এ সুদের অর্থ বিসিপিসিএলকেই পরিশোধ করতে হবে।
বর্তমানে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ের প্রতি ইউনিটের গড়মূল্য প্রায় ১১ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও পিডিবি এ বিদ্যুৎ লোকসান দিয়ে বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করছে ৮ টাকা ১০ পয়সায়। পায়রা থেকে এক মাস বিদ্যুৎ কিনতে না পারলে পিডিবির লোকসান আরও বাড়বে।
সূত্রমতে, কয়লা দেশে পৌঁছানো এবং কেন্দ্র চালু করতে সব মিলে অন্তত এক মাসের মতো সময় লাগবে। কোনো কারণে যদি কয়লা আসতে আরও দেরি হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিশে^র সেরা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এক সুইচে চালু করার পর নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও বৈশি^ক কারণে ডলার সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। এটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। তবে এ সময়ে আমরা বসে না থেকে কেন্দ্রের মেইনটেনেন্সের কাজটি করে ফেলব, যাতে দীর্ঘদিন আর মেইনটেনেন্স করা না লাগে।’
কেন্দ্রটি বন্ধের ফলে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হবে তা জানতে চাইলে প্ল্যান্ট ম্যানেজার শাহ আবদুল মওলা দেশ রূপান্তরকে বলেন ‘আমরা এমনিতেই বকেয়া বিল পাচ্ছি না। এটাই বড় ক্ষতি। অন্যান্য ক্ষতির পাশাপাশি কেন্দ্রটি বন্ধের কারণে সাশ্রয়ী দামে দেশের মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এ কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ দিতে না পেরে কমফোর্ড ফিল করছি না।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কেন্দ্র ভাড়ার পাশাপাশি লোডশেডিংয়ে মানুষের ভোগান্তি এবং কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলেও এ ক্ষতির পরিমাণ অপূরণীয়। আর লোডশেডিং না দিয়ে সরকার যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়, তাহলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই এই মুহূর্তে। সে ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে ৪ টাকার ওপর লোকসান হবে।’ তিনি বলেন, ‘ডলার ছাড় ঠিকই হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার আগেই ডলার ছাড় করা উচিত ছিল। এতে বিরাট ক্ষতি হলো। এ ক্ষেত্রে দুটো বিষয় হতে পারে। একটি হলো যারা ডলার ছাড় করছেন তারা বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না অথবা দেশের পরিস্থিতি আসলেই ভয়াবহ। তবে দেশের উন্নয়নে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতকে অবশ্যই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জাকির হোসেন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডলার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের। আর বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়া হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে। এ ক্ষেত্রে খাতের গুরুত্ব বুঝে ডলার ছাড় করা হয়। তবে দেশের প্রয়োজনে ডলার ছাড় করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ধরনের গাফিলতি নেই।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল বিশ্বের প্রায় সব দেশই। অধিকাংশ দেশই তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। প্রতিবেশী ভারত ও শ্রীলঙ্কার নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির কথা প্রায় সবারই জানা, তারাও ইতিমধ্যে তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসেছে। তবে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। কোনোভাবেই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। ফলাফল ভোক্তা মূল্যসূচকে (সিপিআই) বা মূল্যস্ফীতিতে ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড। মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সিপিআই ইনডেক্সে এ হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে।
গত ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করে সরকার। এ বাজেটের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আগামী অর্থবছরে সরকার কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাজেট প্রস্তাবে কোনো পদক্ষেপ না থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি পরাবাস্তব বাজেট। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা আসলে সম্ভব নয়। গত ১১ মাসে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। সে হিসাবে মূল্যস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো, আগের বছরের মে মাসে যে পণ্য গড়ে ১০০ টাকা কিনতে হয়েছে, এ বছরের মে মাসে তা কিনতে হচ্ছে গড়ে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সায়। আরও পরিষ্কারভাবে বললে, ধরুন আগের বছরের একই সময়ে ৫০০ টাকার একটি নোটে কোনো ব্যক্তি পাঁচটি পণ্য কিনতে পেরেছিলেন। এ বছরের একই সময়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় এখন একই টাকায় তিনটি পণ্য কিনতে পারছেন। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।
খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১ বছরে বেড়েছে ১১.৩২ শতাংশ : ২০২২ সালের মে মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, অথচ এ বছরের মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। এ বছরের এপ্রিল মাসেও খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ০৪ শতাংশ।
খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে এক বছরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৬৪ শতাংশ : বিবিএসের তথ্য বলছে, সদ্য শেষ হওয়া মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ হয়েছে। ২০২২ সালের মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৬৩ দশমিক ৮২ শতাংশ বা ৬৪ শতাংশ।
গ্রামের চেয়ে শহরের মূল্যস্ফীতি বেশি : এক বছর আগেও শহরের মূল্যস্ফীতি গ্রামের চেয়ে কম ছিল। কারণ গ্রামের চেয়ে শহরে পণ্য মজুদের আধুনিক ব্যবস্থা আছে। তবে সরকারি উদ্যোগে শহরের মতো গ্রামেও কিছু স্থানে খাদ্যগুদামের ব্যবস্থা তৈরি হওয়ায় এখন শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি কমেছে। মে মাসে শহর এলাকায় গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ, একই সময়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
বিশ্বে কমেছে মূল্যস্ফীতি, বাংলাদেশে বাড়ছে : গত শনিবার মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের (এমসিসিআই) বাজেট-পরবর্তী আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ মূল্যস্ফীতি ইস্যুতে বলেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশ সফলভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। শুধু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, থাইল্যান্ডে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, গত এপ্রিলে তা নেমে এসেছে ২ দশমিক ৭ শতাংশে। অর্থাৎ আগের তুলনায় দেশটিতে মূল্যস্ফীতি কমেছে ৬৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। সেখান থেকে ৪৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে আনতে সক্ষম হয়েছে তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের গত অক্টোবর মাসের মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখান থেকে ৩৪ শতাংশ কমিয়ে ৭ শতাংশে আনতে সক্ষম হয়েছে ইইউ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার বাড়িয়ে দেয়। তবে বাংলাদেশ এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় শুরুর দিকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো গত বছর আগস্টে এক ঘোষণাতেই জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই মাসেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ দেরিতে হলেও নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। বর্তমানে এ সুদহার ৬ দশমিক ২ শতাংশ। তবে নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে আভাস দিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দাবি করেছে, বিশে^র দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির যে হার, তা সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য হুমকি। মূল্যস্ফীতির এই হার ১২ বছর বা এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনো মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপর ছিল। পরে অবশ্য তা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ঠিক এরকম এক সময়ে গত বছর ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। এর পরপরই বাড়ানো হয় সব ধরনের পরিবহন ভাড়া। এ দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম। ফলে পরের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে।
যদিও সেপ্টেম্বর থেকে তা কমতে থাকে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে আসে। জানুয়ারিতে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে আসে। তবে রোজাকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চ মাসে হয় ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছিল।
মজুরি সূচক বেড়েছে : বিবিএসের তথ্য বলছে, গত কয়েক মাস ধরেই মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। অক্টোবরে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। যা মে মাসে এসে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩২ শতাংশে।
দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে হাইড্রোলিক পাওয়ার স্টেশনে তীব্র পানির সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনাবৃষ্টি এবং তীব্র তাপদাহে কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এই সংকট দেখা দিয়েছে। ৫টি ইউনিটের মধ্যে কোনরকমে মাত্র ১টি ইউনিট সচল রেখে সর্বনিম্ন ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার (৬ জুন) সকালে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আবদুজ্জাহের জানান, হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি জানান, পানির অভাবে কেন্দ্রের সব ক’টি ইউনিট সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে ঠেকেছে। তিনি আরও জানান, কেন্দ্রের ৫টি ইউনিটের মধ্যে বর্তমানে ১ নম্বর ইউনিটটি চালু রাখা হয়েছে। এই ইউনিট হতে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। অথচ এই কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট সচল থাকলে প্রায় ২৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে পাঠানো হয়। সেখানে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট।
এটিএম আব্দুজ্জাহের বলেন, বছরের এই সময়ে কখনই পানি এতো নিচে থাকে না। এ বছর এখনো বৃষ্টিপাত শুরু না হওয়ায় খুবই বিপাকে পড়তে হয়েছে আমাদের। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মাত্র একটি ইউনিট চালু আছে। আমরাও বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছি।
কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বরত প্রকৌশলী জানান, গত মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদের পানির পরিমাণ ৭৩ দশমিক ৬২ ফুট (মিন সি লেভেল) ছিল। রুলকার্ভ অনুযায়ী এসময় হ্রদে পানি থাকার কথা ৭৮ দশমিক ২০ ফুট এমএসএল (মিন সি লেভেল)। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর বৃষ্টিপাত না হলে এই সংকট হতে উত্তরণ সম্ভব নয় বলে জানান প্রকৌশলীরা।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, অনাবৃষ্টি, বন উজার হওয়া, কাপ্তাই হ্রদে নাব্যতা সংকটের কারণে পানি তলানিতে চলে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে এমন বিপর্যয় ঘটেছে। সঙ্গতকারণে গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে পানি কমে যাওয়ার ফলে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে তা নয়, কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। হ্রদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি উপজেলার সাথে নৌপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষের দুর্ভোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কাপ্তাই হ্রদের পাশে বসবাসকারী নুরুল ইসলাম জানান, ভারী বৃষ্টিপাত না হলে হ্রদে পানি বাড়ার সম্ভাবনা নেই। তাই দ্রুত সময়ে কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং করা প্রয়োজন। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কাপ্তাই হ্রদের গভীরতা যেমন বাড়বে তেমনি এই সমস্যা থেকে কিছুটা সমাধান পাওয়া যাবে।
বিলাইছড়ি বাজারের ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন জানান, বিলাইছড়িতে নৌপথ বন্ধ মানেই জীবন ও জীবিকার দুর্বিষহ অবস্থা। আমরা বিলাইছড়িবাসীই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি হ্রদের পানি কমে যাওয়ায়। বৃষ্টি হতে যত দেরি হবে আমাদের কষ্ট তত বেশি দীর্ঘায়িত হবে।
তিনি বলেন, হ্রদের পানি অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় বাজারের পণ্য পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। বড় বোটতো আসতেই পারছে না, ছোট ছোট বোটে পণ্য পরিবহনে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে, পর্যাপ্ত পণ্যও আনা যাচ্ছে না। আবার অনেক দূর থেকে পণ্য বাজারে তুলতে শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি দিতে হচ্ছে। একই সঙ্গে সাপ্তাহিক বাজারও এখন ঠিকমতো জমছে না। কারণ দূর থেকে মানুষজন আসতে পারছে না। এখন বৃষ্টি হওয়া ছাড়া পানি বাড়ার তো আর কোনো সম্ভাবনা নেই।
সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে প্রেম এরপর বিয়ে। দেড় বছরের দাম্পত্য জীবনে আট মাস ধরে চিত্রনায়িকা পরীমণি ও শরিফুল রাজের বনিবনা হচ্ছে না বলেই শোনা যাচ্ছে। চলছে টানাপোড়েন এবং সেই সংসার এখন ভাঙনের পথে। রাজের ফেসবুক থেকে অভিনেত্রী তানজিন তিশা, নাজিফা তুষি ও সুনেরাহ বিনতে কামালের কিছু ছবি ও ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর রাজের সঙ্গে পরীমণির মতপার্থক্য প্রকাশ্যে আসে। সব ছাপিয়ে যা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
রবিবার একটি গণমাধ্যমের ‘লাইভ’ অনুষ্ঠানে এসে শরিফুল রাজ জানান, আপাতত তারা সেপারেশনে আছেন এবং তাদের আর একসাথে হওয়ার কোন সুযোগ নেই। পরীকে তিনি শ্রদ্ধা করেন জানিয়ে সবশেষে পরীমণির উদ্দেশ্যে রাজ বলেন, ‘বেবি, আই লাভ ইউ। যা-ই হোক না কেন, আনন্দে থেকো। আমরা আমাদের সন্তানকে ভালো রাখব।’
রাজের এমন মন্তব্যের উত্তর দিতে সোমবার রাতে গণমাধ্যমটির লাইভে এসে রাজের উদ্দেশ্যে পরীমণি বলেন, ‘গরু মেরে জুতা দান করার কোনো দরকার নেই। কেউ রেসপেক্ট করলে সেটা তার কার্যকলাপ দেখেই বোঝা যায়, মুখ ফুটে বলতে হয় না। আমাকে পাবলিকলি অপমান করে এরপর রেসপেক্ট দেখানোর কোনো দরকার নেই। আর আমার বাচ্চাকে নিয়ে এসব ইমোশনালি কোনো কথা শুনতে চাই না। এসব ইমোশনালি কথা মানুষকে গিলিয়ে লাভ নেই। মানুষ বুঝে।’
ফাঁস হওয়া ভিডিওগুলো পরী বলেন, ‘এত বছর ধরে তারা বন্ধু অথচ আমি জানতাম না। এসব সামনে আসার পর জানতে পারলাম। আর রাজ যতটা তার বন্ধুদের ইমেজ নিয়ে কনসার্ন তার পরিবার নিয়ে এতটাও কনসার্ন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এমনিতে অনেক শান্তশিষ্ট। অনেকটা সাপের মতো, লেজে পাড়া না দিলে চুপচাপ থাকি কিন্তু আমার লেজে পাড়া দিলেই আমি ফুঁস করে উঠি আর তখন কামড় দিবই।’
সবশেষে পরী বলেন, ‘আমি চাই এসবের শেষ হোক। আমি আজকে এখানে এসে এসব বলতাম না। তুমিই (রাজ) আমাকে বাধ্য করেছ। এরকম অসুস্থ মানুষের সঙ্গে আমি আর থাকতে চাই না। আমি চাই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাজ আমাকে ডিভোর্স দিক।’
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।