
(গতকালের পর)
সকাল ১০টায় রেডিও নতুন সামরিক আদেশের ঘোষণা দিল। যখনই কোনো সাংবাদিক সেনা কর্মকর্তাদের কাছে কোনো তথ্য জানতে চান, তাদের রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়। কূটনৈতিক মিশনে পৌঁছার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। এক দল সাংবাদিক যখন সামনের দরজা দিয়ে একজন ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলতে বেরিয়ে এলেন, ক্যাপ্টেন ভয়ংকর ক্ষুব্ধ হলেন। তাদের ভেতরে ঢোকার হুকুম দিয়ে পেছন থেকে বললেন, ‘আপনাদের কীভাবে সামলাতে হবে আমি জানি। আমি আমার নিজের মানুষদের হত্যা করতে পারি। আমি আপনাদেরও হত্যা করতে পারব।’
অল্পক্ষণের মধ্যেই সামরিক সরকার হোটেলে হুকুম পাঠাল, সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটের মধ্যে হোটেল ত্যাগ করার জন্য সব বিদেশি সাংবাদিককে তৈরি থাকতে হবে। সাংবাদিকরা তাদের ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন, বিল শোধ করলেন। প্রেসিডেন্টের ভাষণের ঠিক পর পর ৮টা ২০ মিনিটে সামনে-পেছনে সৈন্যবোঝাই পাঁচটি ট্রাকের প্রহরায় তারা এয়ারপোর্টের দিকে বেরিয়ে পড়লেন।
যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে একজন সাংবাদিক দায়িত্বপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলেন, বিদেশি সাংবাদিকদের কেন চলে যেতে হবে?
‘আমরা চাচ্ছি আপনারা চলে যান, কারণ থাকাটা আপনাদের জন্য ভয়ংকর বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।’
হোটেলের সব কর্মচারী এবং হোটেলে অবস্থানকারী অন্য বিদেশিরা বিশ্বাস করে, সাংবাদিকরা একবার চলে গেলেই শুরু হবে হত্যাযজ্ঞ।
হোটেলের একজন কর্মকর্তা বললেন, ‘এটা আর হোটেল থাকবে না, এটা হয়ে উঠবে রক্তাক্ত হাসপাতাল।’
এয়ারপোর্টে সাংবাদিকদের লাগেজ খুব কড়াভাবে চেক করা হচ্ছে, বাইরে গোলাগুলির শব্দ; কিছু টেলিভিশন ফিল্ম, বিশেষ করে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের ফিল্ম বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানে কামানের বিরুদ্ধে লাঠি ও বল্লম নয়াদিল্লি, ২৮ মার্চ (১৯৭১) : লাঠি-বল্লম ও স্থানীয়ভাবে তৈরি রাইফেল দিয়ে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বোমারু বিমান, বোমা, ট্যাংক ও ভারী কামান সজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন জোরদার করে তুলছে।
গত ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে জিতে পূর্ব পাকিস্তানিরা সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতা দাবি করলে, তা প্রতিহত করতে সেনাবাহিনী নামে। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক আইন প্রশাসনের গণসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক অবাধ্য বেসামরিক জনগণকে সামাল দিতে সেনাবাহিনীর কী ভূমিকা হবে, সে সম্পর্কে বিদেশি সাংবাদিকদের ব্রিফিং দিচ্ছিলেন।
লম্বা পশ্চিম পাকিস্তনি এ অফিসার বলেন, ‘কখন সেনাবাহিনী তলব করা হয়? এটাই হচ্ছে শেষ ভরসা। হত্যা করার জন্যই সেনাবাহিনী গুলি করবে।’
তার মন্তব্য ছিল ভবিষ্যদ্বাণীর মতো। দুই সপ্তাহ পর গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার রাস্তায় যে-ই বেরিয়েছে এমন যে কাউকে, জানালা দিয়ে যে প্রতিবাদী স্লোগান দিয়েছে এমন সবাইকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাঙালিদের স্বশাসনের আন্দোলন গুঁড়িয়ে দিতে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক জনতার ওপর সেনাবাহিনী কামান, মেশিনগান, রিকয়েললেস রাইফেল ও রকেট হামলা চালিয়েছে।
এটা নিশ্চিত মনে হচ্ছে, হাজার হাজার বাঙালিকে খুন করা হবে। কিন্তু তাদের স্বশাসন আন্দোলন এবং তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাদের যে আনুগত্য ও আত্মত্যাগ, তাতে এক হাজার মাইল দূর থেকে এসে কার্যত কোনো বিদেশি সেনাবাহিনী অনির্দিষ্টকাল পূর্ব পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে কি না, এখন সে প্রশ্ন উঠে এসেছে।
সেনাবাহিনী এসেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, বড় বড় সব ব্যবসাও সেখানে কেন্দ্রীভূত; সেখানে মাথাপিছু আয় বেশি আবার দ্রব্যমূল্য পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে কম। সাড়ে পাঁচ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানির সবকিছুই সাড়ে সাত কোটি পূর্ব পাকিস্তানির চেয়ে উত্তম।
বর্তমান সংবাদদাতাসহ বিদেশি সাংবাদিকদের শনিবার পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের শরীর ও লাগেজ তল্লাশি করে ছবির ফিল্ম ও নোটবই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
ঢাকায় রাজনৈতিক আলোচনায় কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে। আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পরই সেনাবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণ। কিন্তু যেসব টুকরো খবর আসছে, তাতে এটা স্পষ্ট, পাকিস্তানি ক্ষমতাশালীরা কখনই শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তনের জন্য লক্ষণীয় পরিমাপের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করবে না।
শেখ মুজিব ও তার আওয়ামী লীগ কার্যত জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে অসহযোগিতার অহিংস আন্দোলন চালিয়ে সামরিক আইন প্রশাসনের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করছেন। শেখ মুজিবের অনুসারীরা কতগুলো সরকারি দপ্তর দখল করে নিয়েছে, কতগুলো বন্ধ করে দিয়েছে, হুকুম অমান্য করছে- এর মধ্যে একটি হচ্ছে প্রতিরক্ষা দপ্তরের বেসামরিক ব্যক্তিদের কাজে যোগদান সংক্রান্ত: হয় কাজে যোগ দিন, নতুবা ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করুন।
কিন্তু বাঙালিদের উচ্ছলতার দিন শিগগিরই ঘনিয়ে এল। প্রথম দিকে আলোচনায় কিছু অগ্রগতির খবর থাকলেও তা শ্লথ হয়ে এল এবং সেনা অভিযানের আশঙ্কা ও আতঙ্ক ছাপিয়ে উঠল।
প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আসছে। বাঙালিদের অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, ইচ্ছে করে সমঝোতা আলোচনা দীর্ঘ করা হচ্ছে, যেন এর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত সরকার পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক প্রস্তুতি ও সেনা মোতায়েন আরও জোরদার করতে পারে।
(উৎস : আন্দালিব রাশদীর বিদেশির চোখে ১৯৭১ ও একাত্তরের দশ বিদেশি সাংবাদিক)
(সমাপ্ত)
লেখক: অনুবাদক ও সাহিত্যিক
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চা ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে সাফল্যের সঙ্গে চলছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শহরকেন্দ্রিক নাট্যচর্চা নিয়মিত হতে শুরু করে। শুরু থেকে বাংলাদেশের থিয়েটারে নারীর অংশগ্রহণ সক্রিয়ভাবেই আছে। বলতে দ্বিধা নেই যে বাংলাদেশের থিয়েটারের সব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নারী ও পুরুষ প্রায় সমানভাবেই পালন করছে।
শুরু থেকেই অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মতোই থিয়েটার অঙ্গনেও ক্ষমতার অধিকারী পুরুষরাই। অর্থাৎ মূল সিদ্ধান্তের হোতা আসলে পুরুষরাই। বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাংগঠনিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যদি দৃষ্টিপাত করা হয় তবে দেখা যাবে তাতে নারীদের তেমন কোনো নেতৃত্বের নজির নেই। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের প্রতিষ্ঠা ১৯৮০ সালের ২৯ নভেম্বর। এই ৫০ বছরে সারা যাকের একবার চেয়ারম্যান ছিলেন।
রোকেয়া রফিক বেবী অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। আর কোনো নারীর অবস্থান প্রায় নেই বললেই চলে! এমনকি বেশিরভাগ থিয়েটারের দলে দলপ্রধান হিসেবে এখনো কেন যেন পুরুষের আধিপত্যই চোখে পড়ে! তবে কি সামন্তীয় পরিবারতন্ত্র ও গোষ্ঠীবাদ ছেয়ে রেখেছে থিয়েটার অঙ্গনকে? জানা কথা যে প্রতিষ্ঠানের বিকাশের অন্তরায় এই পরিবারতন্ত্র ও গোষ্ঠীবাদ। প্রশ্নহীন কর্র্তৃত্বের দীর্ঘস্থায়িত্বের ফলে সদস্যদের বিকাশের সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবের ফলে থিয়েটারে নারীর অংশগ্রহণ যেন অতি ব্রাত্য! আর কর্র্তৃত্ব বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের অংশীদারত্ব যেন গণ্যই করা হয় না! ক্ষমতাধর পুরুষতন্ত্রের কাছে ক্ষমতাহীন পুরুষ নিজেও যেন এক গৌণ চরিত্র! প্রধান চরিত্র ওই প্রাতিষ্ঠানিক পুরুষতন্ত্রের কাছে যখন ক্ষমতাহীন ও দুর্বল পুরুষ যেখানে নিজেই নিরুপায়, সেখানে নারীর স্থান যেন আরও নিচে!
এত কিছুর পরেও সুখের কথা হলো বাংলাদেশের বর্তমান থিয়েটার চর্চায় লক্ষ করলে করলে দেখা যায় যে, নাটকের প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর প্রতিভার ক্ষমতাশীল পদার্পণ রয়েছে। পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে অভিনয়, কোরিওগ্রাফি, নাট্য রচনা, পোশাক পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় নারীরা যথেষ্ট এগিয়ে। বাংলাদেশে যতগুলো একক অভিনয় এখনো নিয়মিত মঞ্চস্থ হয় তার প্রায় সবগুলো নারী অভিনীত। এই একক নাটকগুলোর বিষয় নির্বাচন লক্ষ করলে দেখা যাবে তাতে উঠে এসেছে নারীর জীবনের নানা সংগ্রাম ও না বলা কথা।
ইতিহাস নারীদের উপেক্ষার কথা, সমাজ, পরিবার, প্রতিষ্ঠান থেকে বঞ্চনার কথাই বলছে। উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলোÑ কোকিলারা, বিনোদিনী, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, গহনযাত্রা, পঞ্চনারীর আখ্যান, নভেরা, কহে বীরাঙ্গনা, আমি বীরাঙ্গনা বলছি, পুতুলটিকে দেখে রেখো, শোণিতের হাত, হেলেন কেলার প্রভৃতি।
সত্যিকার অর্থে থিয়েটার দ্বারে প্রবেশ করার আগেই পরিবারের দ্বার থেকে প্রায় বহিষ্কৃত হয়ে যান নারীরা। কেননা জননী জায়া জ্ঞাত এই সমাজের দৃষ্টিতে ঘরোয়া জীবনে কেউ অশ্রদ্ধার, হিংসার, অবজ্ঞার পাত্রী নয়, কিন্তু এই নাটক করতে আসা নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টি যেন বেশি জটিল কুটিল আর ঘৃণার।
সময় বদলেছে, অনেক প্রগতিশীল পরিবার তাদের কন্যাসন্তানটির নাটকের মানুষ হওয়ার স্বপ্নপূরণে পাশে দাঁড়ান। কিন্তু তা অনেক ক্ষেত্রেই বিয়ের আগ পর্যন্তই থাকে। বিয়ের পরে নারীরা শুধু সংসার দেখবে! আর যদি কর্মজীবী নারী হয় তবে শুধু চাকরি আর সংসার দেখবে এর বেশি কিছু নয়!
একটু ভালো করে যদি বাংলাদেশের থিয়েটারের দলগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখব থিয়েটারগুলোতে সামন্তীয় নানান লক্ষণ এখনো ক্ষতের মতন রয়ে গিয়েছে। এখনো পরিবারতন্ত্র ও গোষ্ঠী প্রাধান্যর মতো গুরুতর সমস্যাগুলোই দলগুলোর বিকাশে মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্বামী হয়তো দলপ্রধান ও স্ত্রী দলের অভিনেত্রী। এসব কি এই সমাজব্যবস্থার কারণে হয়েছে কিনা তা নিয়ে একটা সামাজিক গবেষণা হতে পারে। পারিবারিক বন্ধনকেন্দ্রিক থিয়েটারের এই রূপের সুবিধা আছে, অসুবিধাও আছে। সুবিধা হলো মহড়ার শিডিউল সমস্যা নেই, পারিবারিক দিক দিয়ে বাধা আসে না আবার সামাজিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত।
অসুবিধা হলো যে, সব নারীর পিতা-ভ্রাতা-স্বামী বা কাছের কেউই থিয়েটারের সদস্য না তাদের জন্য। ক্ষমতার কেন্দ্র এবং নির্দেশক যেহেতু পৌনঃপুনিকভাবে পুরুষ, ফলে ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কেবল পুরুষতন্ত্রের চর্চাই হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে ক্ষমতাশীল পুরুষের সঙ্গে কোনো প্রকার সম্পর্কহীন নারীরা স্বাধীনভাবে প্রতিভা বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ হারান। উপরন্তু তার জন্য থাকে পারিবারিক লড়াই, অর্থনৈতিক লড়াই, সামাজিক নিরাপত্তার লড়াই ও শিল্পীর নিজের অস্তিত্বের লড়াই। আর এত কিছুর পরে থিয়েটার থেকে তাদের স্বীকৃতি প্রদানেও যেন যথেষ্ট কার্পণ্য দেখা যায়। এ যেন নানা রূপে নারীকে তার কাজ করার ক্ষেত্রে সেই প্রবাদটিই সত্যি হয়ে দাঁড়ায়!
We must think like a man act like a lady look like a young girl and work like a horse.
ঠিক এভাবেই যেন নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে নারীরা থিয়েটার শিল্পতে।
লেখক : নাট্যকর্মী ও শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুধু সে দেশে মানুষের জীবন ও সম্পদহানি করছে না, তা এখন পুরো বিশ্বকেই নানাভাবে প্রভাবিত করছে। বহু দেশে তেলসহ বহু ধরনের দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে। বহু দেশে সামরিক খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে। বহু ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য ও জননিরাপত্তায়। কী কারণে রাশিয়ার এই আগ্রাসন তা নিয়ে বহু রকম ব্যাখ্যা আছে। ন্যাটোর ভূমিকা এবং বিশ্বে জ্বালানি নির্ভরতার ধরন দুটোই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর থেকে তেল, গ্যাস ও কয়লা সব ধরনের জ্বালানির দাম হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে দাম কমতে শুরু করলেও দাম যুদ্ধের আগের মাত্রায় ফেরেনি। তা ছাড়া অনিশ্চয়তাকে কেন্দ্র করে জ্বালানির বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, তাতে যেকোনো সময় এই দাম আবারও বৃদ্ধি পেতে পারে। সাধারণত যেকোনো সংকট সামনে হাজির হলে আমরা পূর্ববর্তী সংকটগুলোর দিকে তাকাই।
বোঝার চেষ্টা করি, এর আগের সংকটগুলো কেন হয়েছে এবং তা মোকাবিলায় কোন দেশ কী করেছে এবং সংকট থেকে কারা ক্ষতিগ্রস্ত আর কারা লাভবান হয়েছে। তারপর প্রশ্ন জাগে আগের সংকটের সঙ্গে এখনকার সংকটের পার্থক্য কী। আগের যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বর্তমান যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা সংকটকে বুঝতে কী দিকনির্দেশনা দেয়। আর তখন যুদ্ধের পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে পেছনের ইতিহাস যেমন দেখা দরকার হয়, তেমনি দরকার হয় চলমান ঘটনার ধারাবাহিক বিশ্লেষণ।
যেমন : ৭০ দশকের সংকটের সঙ্গে বর্তমান সংকটের ভিন্নতা এবং গত কয়েক দশকে বৈশ্বিক পরিবর্তন ও রাশিয়া, ইউক্রেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে জ্বালানি সম্পর্কের নানান দিক উন্মোচন করে ইউক্রেন আগ্রাসনের পেছনে পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়।
কীভাবে বর্তমান সময়ে জ্বালানিকে ভূরাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাশিয়া এই আগ্রাসনে লিপ্ত হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের কী ভূমিকা ছিল। ৭০ দশকে সারা বিশ্বই জ্বালানি তেলের ওপর বেশি নির্ভর ছিল। গ্যাস ও কয়লার ওপর নির্ভরতা তখনো ছিল; কিন্তু তেলের ওপর নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি ছিল। বাংলাদেশের কথাই যদি ধরি, বাংলাদেশে ৭০ দশকের শুরুতে তেল থেকেই অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। তেল সংকটের সময় জ্বালানি তেলের দাম বেশি থাকায় গড়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৭০-৮০ শতাংশ চলে যেত তেল আমদানি করে, তা বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন, শিল্প ও অন্যান্য খাতে ব্যবহার করতে। বেশির ভাগ তেল উৎপাদন হতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে।
১৯৭৩ সালে তেল সংকট শুরুর সময় পৃথিবীর মোট তেলের ৪৯ শতাংশ উৎপাদিত হতো মধ্যপ্রাচ্যে। পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো যখন সামরিক অস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্রকে নিরাপত্তা রক্ষার অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে আসছিল, তখন আরব দেশগুলোর জন্য জ্বালানি তেল ছিল সবচেয়ে বড় অস্ত্র। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশে জ্বালানি তেলের রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্য থেকে সস্তায় তেল পাওয়ার জন্য নিজ দেশে উৎপাদন কমিয়ে ৭০ দশকের শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিল, তখন হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বিপাকে পড়লেও বর্ধিত দামে তেল বিক্রি করে তেল কোম্পানিগুলো সে সময় ব্যাপক মুনাফা করতে সক্ষম হয়।
প্রায় ৫০ বছর পর, ২০২২ সালের মার্চে এসে রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে, তখন রাশিয়া জ্বালানি তেলকে সামরিক অস্ত্রের বিকল্প একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছে এবং এখনকার সঙ্গে সত্তরের দশকের পার্থক্য হলো এখন শুধু তেল নয়; গ্যাস, নিউক্লিয়ার ও কয়লার ওপরও নির্ভরতা বেড়েছে। এখন তেল রপ্তানিতে সৌদি আরবের পরই রাশিয়ার অবস্থান।
২০০৯ সালের পর থেকে রাশিয়ার তেল উৎপাদনের পরিমাণ ১০ বছরে ১০ গুণ বেড়েছে। শুধু তেল নয়, রাশিয়া গ্যাস ও কয়লা রপ্তানিতেও এগিয়ে গেছে। বিশ্বে বর্তমানে যেসব নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে বা নির্মাণাধীন বা পরিকল্পনার ধাপে রয়েছে, তার ৬০ শতাংশ রাশিয়ার প্রযুক্তির। জ্বালানিকে ভূরাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের এই তরিকা রাশিয়া সুচিন্তিতভাবেই করে এসেছে এতদিন ধরে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং কোল্ড ওয়ার-পরবর্তী বিশ্বে রাশিয়া একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে টিকে থাকার জন্য সারা বিশ্বে জ্বালানি বাণিজ্য বিস্তৃত করার মাধ্যমে একটি নির্ভরশীলতার সম্পর্ক রক্ষার কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বিশেষ করে পুতিন ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ার ঐতিহাসিক আধিপত্য পুনর্নির্মাণের জন্য জ্বালানি নির্ভরতার সম্পর্ক পুনর্নির্মাণই পুতিনের কৌশলে পরিণত হয়। তবে এই কৌশল সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা পরিচালিত নয়, বরং পুঁজিবাদী বিশ্বে পুঁজির আধিপত্য রক্ষাই এই কৌশলের উদ্দেশ্য।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গ্যাস আমদানির ৪৫ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক-চতুর্থাংশের বেশি তেল আমদানি হয়েছে রাশিয়া থেকে। এ ছাড়া ইউরোপের কয়লার ৪৭ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে।
সারা পৃথিবীতে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য ব্যবহৃত ইউরেনিয়ামের ৩৫ শতাংশ রাশিয়া সরবরাহ করে থাকে। বুলগেরিয়া, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রযুক্তি রাশিয়ার। কাজেই রাশিয়ার জ্বালানির আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ইউরোপের জন্য মোটেই সহজ নয়। যেকোনো একটি উদ্ভূত সংকট পরিস্থিতিতে নতুন বিকল্প জ্বালানি দিয়ে ব্যবহৃত হয়ে আসা পুরনো জ্বালানি প্রতিস্থাপন কোনো স্বল্পমেয়াদি বিষয় নয়।
৭০-এর সংকটের সময় তা যেমন ছিল না, তেমন ২০২২-এর সংকটেও খুব দ্রুত কোনো সমাধান নেই, যা পুরো জ্বালানি সরবরাহের চেহারা পাল্টে দিতে পারে। যেকোনো প্রযুক্তি নতুন করে ব্যবহার উপযোগী করতে সময় প্রয়োজন হয়। এদিক থেকে ৭০ দশকের বিকল্প আর এখনকার বিকল্পের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো এখন কিছু কিছু বিকল্প যেমন, সৌরশক্তি অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে উৎপাদনে যেতে পারে। এলএনজি অবকাঠামো প্রস্তুত থাকলে এলএনজি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু এ সংকটের বেলায় এলএনজি আশানুরূপ দ্রুতগতিতে গ্যাসকে প্রতিস্থাপন করতে পারছে না।
বিভিন্ন সময়ে রাশিয়ার জ্বালানিকে ভূরাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করে বহুদিন ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিকল্প জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা করে আসছিল। এর মধ্যে রয়েছে স্টোরেজ নির্মাণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো, নতুন জ্বালানি যেমন : হাইড্রোজেন প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ। অন্যদিকে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি ব্যবহার ব্যয়বহুল বলে এই দেশগুলো রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল ও গ্যাস আমদানিও বন্ধ করতে পারেনি; বরং রাশিয়া থেকে বাল্টিক সাগরের মধ্য দিয়ে প্রথম নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইন চালুর পর দ্বিতীয় নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণেও সম্প্রতি বিনিয়োগ করেছে ইউরোপ।
৭০ দশকের জ্বালানি তেলকেন্দ্রিক নির্ভরতা আর এখনকার একাধিক জ্বালানিকেন্দ্রিক নির্ভরতা দুটি ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ৭০ দশকে তেল সংকটের পর যখন বিশ্ব বুঝতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভর করে জ্বালানি নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব নয়, তখন দেশগুলো প্রাপ্যতাভেদে নিউক্লিয়ার, গ্যাস ও কয়লার দিকে ঝুঁকতে থাকে।
কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে বিশ্বব্যবস্থা এমনভাবে পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে যে, জ্বালানির ওপর নির্ভরতার ধরন পরিবর্তন হয়েছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন রকম নির্ভরশীলতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় কয়লার ওপর নির্ভরতা কমানোর চাপ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে নিউক্লিয়ার ক্লিন এনার্জি হিসেবে স্বীকৃত নয় বলে এবং এর দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বেশি বলে ইউরোপের অনেক দেশ ধীরে ধীরে নিউক্লিয়ারের ওপর নির্ভরতা কমানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এদিকে রাশিয়া যখন একে একে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জ্বালানি সম্পর্ক তৈরি করেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র বসে ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই ইউরোপের দেশগুলোকে রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানোর জন্য সমালোচনা করে আসছিল। বিশেষ করে রাশিয়ার ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ ও ইউক্রেন আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর শুধু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাই জারি করেনি, রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন যেন সম্পন্ন করা না যায়, সে জন্য পাইপলাইন নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত একটি সুইস কোম্পানির অপরিহার্য প্রযুক্তি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল। অবশ্য পরে জার্মানির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্কের কারণে শর্তসাপেক্ষে যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে সম্মত হয়। নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইনটি নির্মাণ শেষ হলেও তা সার্টিফিকেশনের অপেক্ষায় ছিল। ইউক্রেন আক্রমণের পর জার্মানি ক্ষুব্ধ হয়ে নিজেই এই পাইপলাইনটি বন্ধের ঘোষণা দেয়। তবে জ্বালানি সংকট শুরুর কারণ নর্ড স্ট্রিম-২ বন্ধ করা নয়। ইউক্রেন আক্রমণের পর নতুন করে রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমানোর তাড়না, শীতকালে চাহিদা বৃদ্ধি, রাশিয়ান গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার কারণে নতুন করে সরবরাহে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়া সব মিলিয়ে জ্বালানির যুদ্ধবিষয়ক অনিশ্চয়তা থেকে দাম বৃদ্ধি হওয়ার কারণে সংকট ঘনীভূত হয়েছে।
কাজেই একদিক থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যেমন রাশিয়াকে কোণঠাসা করছে, তেমনি অন্য দেশগুলোও অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যেমন, বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা রাশিয়ায় রপ্তানির জন্য এলসি খুলতে পারছেন না, যারা পণ্য সরবরাহ করেছিলেন তাদের অনেকের অর্থপ্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের কর্মীদের বেতন এবং সাপ্লাইয়ারদের দেনা পরিশোধের জন্য বিকল্প খুঁজতে হচ্ছে। কিন্তু এই বিকল্প পদ্ধতি কতদিন চালিয়ে নেওয়া যাবে, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসলে যুদ্ধ থামাতে কতটুকু কার্যকর এ নিয়ে নানা জনের নানা বিশ্লেষণ রয়েছে।
কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, রাশিয়া ২০১৪ সাল থেকেই নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার মুখাপেক্ষী হয়ে আসছে এবং অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে যতটা বিপদে ফেলেছে, অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি বিপদে ফেলেছে অন্য দেশগুলোকে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ, যারা কেউ-ই এই যুদ্ধের জন্য দায়ী নয়। এসব দিক বিবেচনা করলে ইউক্রেন আক্রমণকে কেন্দ্র করে ২০২২-এর সংকট বহুল বিস্তৃত, তীব্র এবং বহু পক্ষ-বিপক্ষ যুক্ত।
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের পর এর পেছনের কারণ হিসেবে ইউক্রেনের ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি যেভাবে আলোচিত হয়েছে, ততটা পরিষ্কারভাবে আলোচিত হয়নি জ্বালানির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতার বিষয়টি। ৭০ দশকের সঙ্গে বর্তমান সময়ের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, জ্বালানিনির্ভরতা, সংকটের ধরন, তীব্রতা ইত্যাদির পার্থক্য থাকলেও পরিবর্তিত বিশ্বে জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্নটির পরিবর্তন হয়েছে মনে হলেও আসলে যে পরিবর্তন হয়নি, তা আরও স্পষ্ট হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর। উন্নত বিশ্ব যখন বারবার সংকটে পড়ে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করে, তখন দরিদ্র দেশগুলো খেলার দর্শকে পরিণত হয়। আর এটাই বোধহয় বৈশ্বিক সংকটের বাস্তবতা।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক
মোবাইল টেলিফোনে, এক ধরনের বিপ্লব ঘটেছে। বছর ২৫ আগে, বিষয়টি সাধারণের কল্পনার বাইরে ছিল। বর্তমানে এমন কোনো পেশার লোক নেই, যাদের হাতে মোবাইল ফোন দেখা যায় না। এমনকি, যারা নিত্য ভিক্ষা তনু রক্ষায় ব্যস্ত- সেই ভিক্ষুক শ্রেণির অধিকাংশের হাতেও মোবাইল। কিন্তু ৯০ দশকের শেষের দিকে, এই মোবাইল ফোন ব্যবহার করা মোটেও সহজ ছিল না।
শুরুতে কলচার্জ ছিল মিনিটে ৮ টাকা। কলার আইডির জন্য আবার আলাদা টাকা। এরপর ইনকামিং-আউটগোয়িংয়ের জন্যও, মিনিট অনুযায়ী কাটা হতো টাকা। তখন সব ছিল, পোস্ট পেইড ফোন। এখনকার মতো, প্রিপেইড ফোন চালু ছিল না। এমন অবস্থার মধ্যে, একটু সাশ্রয়ী অফার নিয়ে আসে- টেলিটক।
এখন সময় পাল্টেছে। মোবাইলের মাধ্যমে সহজেই সম্পন্ন করা যাচ্ছে, বিরক্তিকর কাজ। সাশ্রয় হচ্ছে, জনগণের মূল্যবান সময়। অনেক কমেছে, ভোগান্তি। এই ধারাবাহিকতায় চাহিদা বেড়েছে, মোবাইল ইন্টারনেটের। কোম্পানিগুলোও, বাহারি অফার নিয়ে হাজির হচ্ছে গ্রাহকদের সামনে। টুজি, থ্রিজির পর এখন চলছে ফোরজির যুগ। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে, আবার কিছু এলাকায় শুরু হয়েছে- ফাইভজি। তবে দেশব্যাপী ফোরজি চালু করে, মোবাইল কোম্পানিগুলো ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করছে। কিন্তু গ্রাহক পাচ্ছেন থ্রিজি, টুজি! এই প্রতারণার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া দরকার।
গতকাল দেশ রূপান্তরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত- ‘ফোরজির নামে পকেট কাটা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়- দেশে ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি ইন্টারনেট সেবা চালু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। অন্য অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক একই সেবা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সব মোবাইল অপারেটরই দেশের বেশিরভাগ স্থানে ফোরজি সেবা চালু করেছে। আর সে হিসেবেই তারা ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু গ্রাহকরা ফোরজি ইন্টারনেট কিনলেও দেশের অনেক এলাকায় টুজি-থ্রিজি’র সেবা পাচ্ছেন। তারা অপারেটর কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ জানালেও এর সুরাহা হচ্ছে না।
সংবাদে আরও বলা হয়েছে, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো সারা দেশের ব্যবসা একত্রে হিসাব না করে এলাকাভিত্তিক ব্যবসার হিসাবনিকাশ করার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা দেখেন, কোন এলাকায় তাদের গ্রাহক সংখ্যা কত, সেখানে কত সিমে ইন্টারনেট চালু আছে। যদি দেখা যায়, তাদের হিসাব মতে তা সন্তোষজনক আছে তাহলে সেখানে ফোরজি সেবা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বহাল রাখে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টাওয়ার নির্মাণ করে। কিন্তু যদি দেখে সন্তোষজনক গ্রাহক নেই তাহলে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না, এতে সেই এলাকায় ফোরজি পাওয়া যায় না। অথচ শহর এলাকাগুলোতে তারা বেশি ব্যবসা করলেও সেটাকে হিসাবে ধরে না। কিন্তু মফস্বল এলাকা থেকে কল বাবদ প্রয়োজনের বেশি ব্যবসা হলেও তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সমন্বয় করে না।
গত বছরের ২৮ এপ্রিল টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত ‘আনলিমিটেড’ ও ‘মেয়াদবিহীন’ ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। কারণ এজন্য প্যাকেজের দাম বাড়িয়েছে অপারেটররা। আর মেয়াদহীন ইন্টারনেট পেতে প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একই প্যাকেজ চালু করতে হবে। কিন্তু গ্রাহকের সব সময় একই ধরনের ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে গ্রাহকের কেনা ইন্টারনেট। এছাড়া মেয়াদবিহীন হিসেবে মোবাইল অপারেটররা যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে গ্রাহকদের।
কোনোভাবেই মোবাইল অপারেটরদের আনা যাচ্ছে না, জবাবদিহির মধ্যে। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। সরকারকেই পালন করতে হবে অগ্রণী ভূমিকা।
প্রথম মহাকাশচারী মানুষ হিসেবে জগদ্বিখ্যাত সোভিয়েত বৈমানিক ও নভোচারী ইউরি আলেক্সেইভিচ গ্যাগারিন ১৯৬৮ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন। ‘ভস্টক-১’ নভোযানে করে ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করে মানব ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অর্জন করে নেন গ্যাগারিন। ১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ বর্তমান রাশিয়ার মোলেনস্ক ওবলাস্টের কাছে ক্লুসিনো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কৈশোরেই ইউরি মহাকাশ এবং গ্রহ সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং মহাকাশ যাত্রা নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেন, যা এক দিন বাস্তবে পরিণত হয়। লুবার্টসিতে এক বছর একটি ভোকেশনাল কারিগরি স্কুলে পড়ার পর, গ্যাগারিন সারাতোভে একটি কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়ে আরও পড়াশোনার জন্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে, কারিগরি বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে তিনি ওরেনবার্গে পাইলটস স্কুলে যুদ্ধবিমান চালনা প্রশিক্ষণে ভর্তি হন। ইউরি ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত বিমানবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট পদ লাভ করেন। ১৯৬০ সালে ইউরি গ্যাগারিনসহ আরও ১৯ জন্য বৈমানিক সোভিয়েত মহাকাশ কর্মসূচির জন্য নির্বাচিত হন। দীর্ঘ বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘ভস্টক-১’ নভোযানের একমাত্র নভোচারী হিসেবে ইউরি গ্যাগারিন নির্বাচিত হন এবং ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল নভোযানটি উৎক্ষেপণ করা হয়। গ্যাগারিন পরিণত হন পৃথিবীর প্রথম মানুষ যিনি প্রথম মহাকাশ ভ্রমণ করেন এবং একই সঙ্গে প্রথম মানুষ যিনি পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করেন। ১৯৬৮ সালে একটি মিগ-১৫ প্রশিক্ষণ বিমান চালনার সময় মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন ইউরি গ্যাগারিন।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।