
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
ডিজিটাল বিপণন কৌশলবিদ, ‘ওয়ান মিলিয়ন ফলোয়ার্স’ গ্রন্থের লেখক ব্রেনডান কেইন সোজা বললেন ‘মন স্পর্শ করে এমন কনটেন্ট তৈরি করুন। বিষয়বস্তু তৈরি করার সময় আরেকটি প্রশ্ন আপনার সবসময় নিজেকে জিজ্ঞাসা করা উচিত, ‘এই বিষয়বস্তু কি দর্শক/পাঠক/গ্রাহককে মায়ায় জড়াতে পারবে? যে কোনো বিষয়বস্তু কেউ মূল্যবান মনে করলে তাকে মায়ায় জড়াতে পারে। বিষয়বস্তু তৈরির সময় ভাবুন- এটা মানুষকে হাসাতে কাঁদাতে রাগাতে বা উৎসাহিত করতে পারবে কি না। মানে মানুষের সাড়া পাওয়ার মতো কী আছে এতে। মন স্পর্শ করে এমন বার্তা/বিষয়বস্তু/পণ্য মানুষ শেয়ার করে।’
দেখা যাচ্ছে ‘বিজ্ঞানের অবদান’ ডিজিটাল মার্কেটিং দুনিয়ায় মন স্পর্শের হিসাব গুরুত্ব সহকারে নিতে হচ্ছে। মানে, বুদ্ধি যা দিল বের করে, তা সফল হওয়ার জন্য মায়ার শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। সেটা কি বুদ্ধি আর মায়ার পারস্পরিক সংযোগ বা শেয়ারিং? নাকি দুই পক্ষের পারস্পরিক নির্ভরতা?
শেয়ার করলে কী হয়? সহজ উত্তর কেয়ার করা হয়। কেয়ার মানে যত্ন। যত্ন অন্তর দিয়ে হলে কেল্লা ফতে, মানে বিজয় নিশ্চিত। অনলাইন জায়ান্ট কোম্পানি ‘শেয়ারেবিলিটি’ একটি ব্রান্ড এজেন্সি। বিলিয়ন-বিলিয়ন মানুষের সঙ্গে সংযোগ এ কোম্পানির। তারা শেয়ার বাড়ানোর বুদ্ধি বাতলে দেয়। শেয়ারেবিলিটি জানে যে বিজ্ঞাপন শুধুমাত্র আবেগপূর্ণ সংযোগ তৈরি করতে পারলে গ্রাহক/পাঠক/দর্শকের সঙ্গে দৃঢ় বন্ধন তৈরি করতে পারে। আর তা মানুষ সানন্দে শেয়ার করে নতুন সম্পর্ক তৈরি করে। ‘শেয়ারেবিলিটি’ সহপ্রতিষ্ঠাতা ও চিফ স্ট্র্যাটেজি অফিসার এরিক ব্রাউনস্টেইন বললেন ‘লোকেরা যখন শেয়ার করেন তখন তারা কেয়ার করেন এবং যখন তারা কেয়ার নেন তারা আপনার পণ্য কেনেন।’ ভালো কেয়ার নিতে হলে আবেগ ও অনুভূতি থাকতে হয়। আন্তরিক থাকতে হয়। অন্তরের ব্যাপার-স্যাপার আবেগ ছাড়া হয় না। তার মানে আবেগের জয়ধ্বনি ঠিক না, আবেগের ভান্ডার থেকে আসা খাঁটি মায়ার জয়ধ্বনি সর্বত্র। মায়া কেবল গরিব দেশগুলোতে না। ‘উন্নত’ দেশগুলোতে মায়ার ইতিহাস জ্বলজ্বলে। ‘উন্নত’ দেশের নাগরিক ব্রেনডান কেইন-ই তো বললেন কনটেন্ট মন ছুঁতে না পারলে, মায়ায় জড়াতে না পারলে সফলতা আসে না। তার গবেষণায় অন্তর গুরুত্বপূর্ণ।
অন্তরের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হলে আন্তরিক হতে হয়। সেটা কৃত্রিমভাবে করলে হয় না। টাকা খরচ করে কোনো ‘ডক্টর’-র অযথা প্রশংসা আদায় করলে কেউ কালজয়ী মেধাবী হয়ে যায় না। আমড়া কাঠের ঢেঁকি বানানো যায় কিন্তু ওই ঢেঁকি দিয়ে চাল কুটা যায় না। কেবল রাজনৈতিক চালবাজি করলে অবশেষে বঞ্চিত হতে হয়। তাই দেখা যায় অনেক রাজনীতিক ‘অনেক কিছু করেও’ গণমানুষের হৃদয়ে স্থান পান না। খুব তাড়াতাড়ি বিস্মৃত হন। রাজনীতিক উৎসুক জনতার মায়া ধরতে না পারলে ব্যর্থ হতে হয়। কেননা উৎসুক জনতা খাঁটি মায়ার কাঙাল। তাদের কাছে ‘সভ্যতার ভণ্ডামি’ নেই।
আবার একটু যাওয়া যাক ব্রেনডান কেইনের কাছে। তিনি বললেন- ‘আপনি যখন নিজের কাছে সৎ আর নিজের প্রতি মনোযোগী থাকেন, তখন অন্যরা সহজে আপনার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারেন।’ কেননা অন্তরের কাজে সততা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৃত্রিমতা সেখানে প্রবেশ নিষেধ। নিজের কাছে সৎ থাকলে নিজেকে জানতে পারার দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। নিজেকে জানা ব্যাপারটা কী? একটা জানা এরকম যে, প্রত্যেকে তার মধ্যে যেসব গুণ আছে, তার কাজ করার ক্ষমতা আছে তা বুঝে নিতে পারা। এই জানা এমন যে মানুষটির ঘনিষ্ঠ কেউ, মা-বাবা নিশ্চিত কিছু বলতে পারবেন না তার নিজের এই জানা সম্পর্কে, যতটুকু আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে তার নিজের কাজের ক্ষমতা বোঝেন, অন্য কেউ অত নিশ্চিত হতে পারে না। আবার নিজে অধিক জানার পরেও সে যা দেখতে পারছে তার মধ্যে আছে, মানে ক্ষমতার ব্যাপারটাই, মানে ষোলআনা নিশ্চিত হয়েও সে তার গুণের ব্যাপারে কখনো এমনও হয়, সে সন্দিহান, সে দ্বিধাতে সে পারবে কিনা নিশ্চিত না। এখানে সে তার ‘চেনা-জানা’ নিজের ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্য ষোলআনা চিনতে পারছে না। তার মানে সে তার কনশাসনেস-কে চিনতে পারছে না? কখনো বাস্তবতা তার সামনে এভাবে আসে যে, কাজটির ফল কী হবে সুনিশ্চিতভাবে বুঝতে না পেরেই তাকে কাজটি করে ফেলতে হয়। সে বলে, ‘অন্য উপায় খুঁজে পাইতেছিলাম না, এইটা ঠিক হবে কিনা নিশ্চিত হওয়ার আগেই করে ফেলতে হয়েছে।’
কেইন জানালেন- ‘বর্তমান সময়ের সেরা ফেসবুক কন্টেন্ট জিনিয়াসদের একজন হলেন প্রিন্স ইএ। তিনি কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেন গ্রাহকসেবা। তিনি স্বীকার করেন যে যদিও তার অহং (প্রায়শই হয়) লাখ লাখ ভিউ পাওয়ার আকাক্সক্ষার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তিনি সর্বদা মূল লক্ষ্যে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। মূল লক্ষ্য হলো ফলোয়ারদের হৃদয়ে পৌঁছে যাওয়া। মানে ভালো সেবা দেওয়া। তিনি কনটেন্ট তৈরি করেন মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে এমন কিছু। প্রিন্স ইএ বিশ্বাস করেন যে যদিও একটি ভিডিওর শিরোনাম, থাম্বনেইল, দৈর্ঘ্য, এবং প্রথম কয়েক সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ। তবে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন কনটেন্ট মানুষের মনে দোলা না দিলে আসল কাজ হবে না।’
মন দোলে আবেগে। হ্যাঁ, মন ও আবেগ দুইই অধরা- আধ্যাত্মিক এই অধরা বস্তু, সীমিত অর্থে। আত্মা থেকে আগত বিষয়ক না। (আধ্যাত্মিকতা অন্য জিনিস, যদিও এর সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক আছে।) প্রভাবশালী মন যা মানুষ চিহ্নিত করে সেই মনে থাকে প্রভাবশালী মায়া। মায়া বের হয় ম্যাটার থেকে। ম্যাটারের ভেতর থাকে স্পিরিট বা চেতনা। চেতনাকে সাজায় বা জেনারেট করে ইলেক্ট্রন নিউট্রন প্রোটন। এ রকম একটা বিশ্লেষণ আছে। থাকতেই পারে। অন্যদিকে এটা তো দেখাই যায়- জগতের সব প্রভাবশালী ঘটনা/সৃজন গভীর মায়াজাত। চিন্তাবিদের চিন্তাটি আবেগঘন হওয়ার পরেই প্রভাব সঞ্চার করে। সৃজন পালন ধ্বংসে প্রবল আবেগ ক্রিয়াশীল। আবেগ ছাড়া বেগ আসে না। জোনাহ বার্গারের ২০১৩ সালের বই কনটেইজিয়াস (সংক্রামক), এতে মনোবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী মানুষের মন কীভাবে প্রভাবিত হয় এর ব্যাখ্যা আছে। বোঝানো হয়েছে মানুষের আচরণ কীভাবে আকৃষ্ট হয়- কেন মানুষ উৎসাহিত হয় অন্যের বার্তা/বই/কনটেন্ট/বিষয়বস্তু শেয়ার করতে। তাতে দেখানো হয়েছে কেন মানুষ সমাজে প্রচলিত ধারণা শেয়ার করে থাকে। তারা ভাবে- এটা শেয়ার করা স্মার্ট মানুষের কাজ- এতে মানুষকে সাহায্য করা হয়। কারও কাছে কোনো নতুন বার্তা পৌঁছে দেওয়ার আনন্দ পেতে চায় মানুষ।
হালিম বয়াতির গান- ‘তুমি এমন করে ছেড়ে যাইবা দয়াল’ কিংবা জেইন টেইলরের ক্লাসিক গান ‘টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার’, অথবা ফকির লালন সাঁই, হাছন রাজার গান, কিংবা আবুল হাসানের কবিতাগুলো মন স্পর্শের পাঠবস্তু। জীবনানন্দ, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, কিটস, ইয়েটস, বায়রন, শেলি, শেক্সপিয়র, এলিয়ট, ওয়াল্ট হুইটম্যান প্রমুখ এই লাইনের- এই ধারার সবাই শীর্ষে এসেছেন ক্লাসিক মায়া চর্চা করে। ক্লাসিক মায়া থেকে জনম নেয় ক্লাসিক শিল্প। মূল্যবান জিনিস ক্লাসিক অমূল্য ধন মায়াতে জড়ায়। তবে, ফেইক-ফালতু অতঃপর দিন শেষে ফেইক-ফালতু চিহ্নিত হয়।
পি বি শেলি লিখেছিলেন একটি অসাধারণ কবিতা ‘টু অ্যা স্কাইলার্ক’, যে-কবিতার ভেতরের একটি সহজ সরল পঙ্ক্তি- Our sweetest songs are those that tell of saddest thought. কী দারুণ সত্য বেরিয়ে এলো সুগভীর মনোযোগ আর আন্তরিক পর্যবেক্ষণ থেকে। দুঃখভারাক্রান্ত হওয়া থেকে প্রস্ফুটিত হয় সুইটেস্ট সং। যে জানে সে বুঝে দুঃখও একটি অনন্য রস।
তারা বলেন স্কাইলার্ক, আমরা বলি ভরত পাখি। পাখিবিশারদ শরিফ খান চমৎকার করে আমাদের জানালেন এই ভরত পাখি সম্পর্কে- ‘বোশেখের বিকেলে এই পাখি যে সুমধুর গান গাইতে গাইতে ওপরে উঠল ও নামল, তার কারণ, ওটার বুকভরা এখন ম-ম ভালোবাসা, প্রেমিকা তো মাঠের ভেতরে ছদ্মবেশ ধারণ করে আছে। ‘কত ভালোবাসি তোমাকে’ দেখানোর জন্যই তো নৃত্যগীতের এতটা কসরত।’ এই পাখির মায়াভরা হরকত- মনোমুগ্ধকর নৃত্যগীত- কবির মনকে প্রভাবিত করল, কবির মন মনন অনিন্দ্য অনুভবে আচ্ছাদিত হয়ে সৃষ্টি হলো কালজয়ী ‘টু অ্যা স্কাইলার্ক’।
মন কেন অন্য মনের মায়াতে সাড়া দেয়? বিজ্ঞান কী দেখায়? হেলথকেয়ার প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে Beth A. Lown জানালেন- ‘Advances in neuroscience have shown us that the human brain has neural networks that are hard-wired with the ability to share the experiences of others, including emotions and sensations.’ (বাংলা অনুবাদ: নিউরোসায়েন্সের অগ্রগতি আমাদের দেখিয়েছে, মানুষের মস্তিষ্কে এমন নিউরাল নেটওয়ার্ক রয়েছে যা অন্যের আবেগ অনুভবের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার ক্ষমতাসম্পন্ন।)
একটা প্রশ্ন এমন তো করা যায়- খাঁটি মায়ার জয়ধ্বনি সর্বত্র কী কারণে? সহজ উত্তর- খাঁটি মায়া মানুষকে খাঁটি মানুষ বানায়। খাঁটি মানুষ জীবনে চলার পথে ভুলত্রুটিসহ চলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি সচেতন থাকেন হৃদয়জাত নিয়ম-নীতির ব্যাপারে। হৃদয় আকৃষ্ট হয় Laws of the heart বা হৃদয়ের নিয়ামবলির নিয়মে। এই সূত্রসমূহ ফ্রাংক-স্টারলিং-এর বায়োলজিক্যাল ম্যাকানিজম বিষয়ক নয়।
ওদিকে শামস তাবরিজি জানিয়ে গেলেন- ‘মায়ার কোনো নাম-আখ্যা নেই, সংজ্ঞা নেই। মায়া শুধু মায়া, বিশুদ্ধ এবং সহজ। মায়া জীবনের পানি। আর আশেক হয়ে ওঠেন অগ্নিআত্মা। মহাবিশ্ব অন্যরকম হয় যখন আগুন ভালোবাসে পানি।’ মন স্পর্শের কাজ হয় মায়াভরা, অনিন্দ্য, কার্যকর- সফল।
সারওয়ার চৌধুরী : কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক
১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমী। আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। এ ছাড়া বিশেষ অনুমতি নিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ক্লাস করতেন। ছিলেন তুখোড় বিতার্কিক। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে সুযোগ পেলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার ব্যাপারে তার মন সায় দেয়নি। তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন গেরিলা যোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মাকে রাজি করিয়ে ২ মে রুমী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে সীমান্ত পাড়ি দেন। তিনি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ নেন। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও রশীদ হায়দার। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেন। রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে হামলা চালানো। একবার একটি পাকিস্তানি সেনা জিপ তাদের বহনকারী গাড়ির পিছু নিলে তিনি গাড়ির পেছনের গ্লাস ভেঙে ‘লুক লুক, এ জিপ ইজ ফলোয়িং আস’ বলে গুলি করেন। তার গুলিতে পাকিস্তানি জিপের ড্রাইভার নিহত হয় এবং গাড়ি ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খায়। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাও তার গুলিতে মারা যায়। এরপর তিনি সহকর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি তার নিজের বাড়িতে কাটান এবং রাতেই বেশ কিছু গেরিলা যোদ্ধার সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। রুমীর সঙ্গে তার বাবা শরীফ ও ভাই জামীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রুমী নিখোঁজ হন। পরে আর কখনো তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দেশে অনেক ধরনের পণ্য আমদানি করতে হয়। অধিকাংশ পণ্যই জীবননির্ভর নয়। কিন্তু মেডিকেল ডিভাইসের মতো জীবনঘনিষ্ঠ পণ্য আমদানি করতে হয় প্রায় ৯২ শতাংশ। মাত্র ৮ শতাংশ ডিভাইস উৎপাদন হচ্ছে দেশে। এর মানে হচ্ছে, দেশের ৯২ শতাংশ মানুষই পুরোপুরি নির্ভর করছে ৮ শতাংশ আমদানিকৃত মেডিকেল ডিভাইসের ওপর। এই নির্ভরতা কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। দেশেই যেহেতু বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস উৎপাদন করা সম্ভব, তাহলে তা হচ্ছে না কেন? বাংলাদেশ তো প্রযুক্তিগতভাবে বহুদূর অগ্রসর হয়েছে। অসংখ্য যোগ্য মানুষ রয়েছেন। নিজের দেশে তৈরি না করে, এই আমদানিনির্ভরতা কেন?
ঔষধ প্রশাসনের ডিজির উদ্ধৃতি দিয়ে গতকাল দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত, ‘দেশে মাত্র ৮% মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদন হয়’ শীর্ষক সংবাদের মাধ্যমে জানা যায় দেশে চাহিদার মাত্র ৬-৮ শতাংশ মেডিকেল সরঞ্জামাদি উৎপাদন হয় বলে জানিয়েছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে মেডিকেল সরঞ্জামের চার হাজার কোটি টাকার মার্কেট। এই মার্কেটের মাত্র ৬ থেকে ৮ শতাংশ দেশে উৎপাদন হয়। বাকি সম্পূর্ণটাই আমদানিনির্ভর।
সংবাদে আরও বলা হয়েছে, ডিভাইস উৎপাদন বাড়াতে সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান ঔষধ প্রশাসনের ডিজি। তিনি বলেন, সরকার যাতে কমমূল্যে উৎপাদকদের ভূমি দেয়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের কাছে আমরা আবেদন জানাব যাতে বেজা, বেপজা এসব এলাকায় স্বল্পমূল্যে তাদের ভূমির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। ঋণের সুদের হারের বিষয়ে এসএমই ও সরকারের যেসব খাত আছে সেখানে নির্দিষ্ট হারের চেয়ে কমিয়ে তাদের ঋণ দেওয়া যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘ডিভাইস আমদানিনির্ভর হওয়ায় আমাদের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। আবার প্রয়োজনের সময় পাই না। আমরা যাতে দেশে সক্ষমতা বাড়াতে পারি সেজন্য উদ্যোক্তা, আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানানো হয়েছে।’
এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন, এনবিআর, অর্থ, বাণিজ্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। ৯২ শতাংশ আমদানির ওপর নির্ভর করে, দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত আসা দরকার।
অবশ্য আমদানি করার পেছনে মুনাফার বিষয়ও রয়েছে। কারণ আমদানি করে, স্থানীয় বাজারে বিক্রিতে লাভ বেশি। উৎপাদন করে সেই পরিমাণ লাভ সম্ভব নয়। সুতরাং আমদানিকারকদের বৃহৎ একটি অংশ, আমদানি করতেই উৎসাহী। তারা মনে করেন, মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ করলে তেমন কোনো লাভ হবে না, এটি পুরোপুরি ভুল ধারণা।
কারণ, এই মেডিকেল ডিভাইসের বাজার বিশে^র অনেক দেশে রয়েছে। কম মজুরি এবং কাঁচামালের মূল্য কম হওয়াতে বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনে রীতিমতো বিপ্লব করেছে। দাম কম হওয়ার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে।
একসময় ওষুধ উৎপাদন নিয়েও, আমদানিকারকদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। বর্তমানে যা কল্পনারও অতীত। দেশের মানুষের জীবন রক্ষার চেয়ে, কোনো বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়লে, এর দামও নিশ্চিতভাবে কমবে। দেশের অধিকাংশ মানুষের গড় আয়ের কথা চিন্তা করে, বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা দরকার।
মানুষের মৌলিক অধিকারের বিষয়, ‘চিকিৎসা’কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। এ বিষয়ে দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাই।
উপনিবেশবাদ হোক, চাই কি সাম্রাজ্যবাদ, এটি একটি ভাইরাস। প্রকোপ কমে, বহু বছর পেরিয়ে পুনর্জাগরণ ঘটে তার। মাঝে শীতঘুম দেয় ঠিক সাপের মতো। প্রাণীদেহ তা গোপনে বহন করে। এভাবে জীবজন্তুর শরীর থেকে সংক্রমিত হয় মানবদেহে। পুনরায় মানবদেহ থেকে জন্তুর ভেতর। কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র উত্তরাধিকার সূত্রে কিংবা ঐতিহ্যগতভাবে পেয়ে থাকে পুরনো প্রভুর সাম্রাজ্যবাদ বা সম্প্রসারণবাদের বীজ। সেই বীজ পুষ্ট হতে থাকে নানা কেন্দ্রকে ভর করে। সবচেয়ে ভয়ংকর কেন্দ্রগুলো হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, বর্ণবাদ আর সম্প্রসারণবাদের আকাক্সক্ষা। সেই আকাক্সক্ষার উচ্চমাত্রায় পা ফেলেছে আজকের চীন আর ভারত। এ ভারত মোহন চাঁদ করম চাঁদ গান্ধীর ভারত নয়। মাও সে তুংয়ের চীনও নয়। এ হচ্ছে নতুন ধরনের নতুন আকাক্সক্ষার দেশ। নতুন শাসকদের দেশ।
চীন-ভারত প্রসঙ্গ উঠলেই রাজনৈতিক ব্যাখ্যাকারদের সামনে এসে দাঁড়ায় ভয়ংকর একটি শব্দ ‘এথনিক ন্যাশনালিজম’ বা নৃ-রক্তধারা গোষ্ঠীভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। মনে পড়ে, হিটলারের তথাকথিত আর্যরক্তবাহী নরকুল শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার জার্মান জাত্যভিমান বা কৌলীন্যবাদের কথা। এর পেছনের ইতিহাসটা হচ্ছে মধ্যযুগ। গোত্রে গোত্রে লড়াই। ধর্মে ধর্মে লড়াই। আধুনিক সভ্যতা এসব বিষবৃক্ষের বন ধ্বংস করলেও বীজের বিনাশ সাধন করতে পারেনি। তাই আজ কবরগুহা থেকে এর উত্থান। ইউরোপীয় রেনেসাঁ, আধুনিক গণতন্ত্রের উদ্ভব এবং সবশেষ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ও মাত্র কয়েক শতকে এর পিছু হটার পরিণাম আজকের এই অবস্থা।
কেন এমনটা ঘটল? সমাজতন্ত্রের ভুল প্রয়োগ, সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পতনের ফলে পুঁজিবাদ দানুবে শক্তি সঞ্চয় করে পুনরুত্থিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক পতাকা হাতে কমিউনিস্ট পার্টির নাম ধারণ করে আজ যে চীনের উত্থান, তা প্রকৃতপক্ষে সম্প্রসারণবাদী-পুঁজিবাদী একটি দেশ। তার ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ নামের যে প্রচার, তা আদতে একটি ভোগাস তত্ত্ব। মাও সে তুং এবং চৌ এন লাইয়ের মৃত্যুর (রহস্যজনক মৃত্যু) পার্টির ভেতর ঘাপটি মেরে পড়ে থাকারা যারা পুঁজিবাদের ছদ্মবেশী সেবক, তারা ক্ষমতা দখল করে। বর্তমান চীন আসলে কমিউনিস্ট ছদ্মবেশী স্বৈরতান্ত্রিক পুঁজিবাদী দেশ। ঠিক যেমন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিন ও স্তালিন-পরবর্তী বাস্তবতা। লেনিন ও স্তালিনের মৃত্যুর ঘটনাও রহস্যে ঘেরা।
ভারত কোনোদিনই সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল না। বরাবরই ছিল পুঁজিবাদী দেশ। বরং বলতে হয় ব্রিটিশ পুঁজিবাদের উত্তরসূরি। জহরলাল নেহরু-পরবর্তী বর্তমান বিজেপি শাসকদের উত্থানের পূর্ববর্তী পর্যন্ত ওই যে বলা হতো গণতন্ত্র (বহুদলীয়), সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা বা জোটনিরপেক্ষতার কথা, তা আসলে রাষ্ট্রটির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার রাজনৈতিক কৌশল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের মতো ভারতবর্ষের ভেতরও আজ সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা, আদর্শ বা রাজনীতি হীনবল হয়ে পড়েছে। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ চর্চায় ভাটা পড়েছে। ফাটল ধরেছে প্রগতিবাদ চিন্তা-চর্চায়। দ্রুত উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে যুক্তি আর বুদ্ধির উল্টো দিক অন্ধবিশ্বাস অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীলতা। সেই ফাটলের ভেতর দিয়ে আগ্নেয়গিরির ধোঁয়া সর্পিল গতিতে যেমনি বেরিয়ে আসে, তেমনি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজ সামনের আলোর পথ ছেড়ে পেছনে হাঁটছে ভৌতিক অন্ধকারে। সব গণতান্ত্রিক রাজনীতি পিছু হটছে, প্রগতিবাদ মুখ থুবড়ে পড়েছে।
ভারতের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য নেই। জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিতে পারে এমন নেতার বড়ই অভাব। রাজনৈতিক মহান আদর্শের চেয়ে অনেক বড় হয়ে উঠেছে ক্ষমতার মোহ। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে দুর্বল করা হয়েছে। জনগণ তাদের প্রতি হতাশ হয়েছে। ক্ষমতাশীলদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনও করতে ব্যর্থ। কে হবে প্রধানমন্ত্রীর মুখ এ নিয়ে দ্বন্দ্ব। সবার লোভ ওই গদির দিকে। এই অনৈক্যের ফায়দা তুলছে বিজেপি। তাই আজ ধর্মনিরপেক্ষতা দুর্বল হয়ে সাম্প্রদায়িকতা শক্তিশালী হয়েছে। গণতন্ত্র হীনবল হয়ে পড়েছে। স্বৈরাচার অপ্রতিরুদ্ধ হয়ে হিংস্র রূপ নিয়েছে। উত্থান ঘটেছে উচ্চবর্গীয় হিন্দুত্ববাদ। নিম্নবর্গ হিন্দু বা দলিত শ্রেণির প্রতি বিদ্বেষ আর ঘৃণা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে ব্রাহ্মণ্যবাদী, ‘মনুসহিংসতা’বাদী উচ্চবর্গের শ্রেণি। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণশক্তির সব কয়টি উচ্চপদ ব্রাহ্মণদের হাতে। অর্থনীতিও নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চবর্গীয়রা। নিম্নবর্গ কেবল ভোটদাতা। অর্থ-ক্ষমতার ধারেকাছেও নেই তারা। ভোটও তাদের ইচ্ছাধীন নয়। তাই তো উত্থান ঘটেছে ‘মনুবাদী’ উগ্র হিন্দুত্ববাদ, হিন্দুত্ববাদী উগ্র জাতীয়তাবাদ। চীন বা অপরাপর রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণ এটাই। স্বপ্নের ভেতর প্রাচীন ভারত। গুপ্তযুগের ভারত। যে ভারতের সীমানা ছিল বিশাল। আফগানিস্তানের বিশাল এক এলাকা পর্যন্ত। সাংস্কৃতিক প্রভাব ছিল ইন্দোনেশিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে। এক অতিকল্প পৌরাণিক ভারত ঝলকে ওঠে বর্তমান নেতাদের অন্তরাত্মায়। সেই কল্পিত মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ আর ‘মহাভারত’। লঙ্কার যুদ্ধ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। অন্ধ উন্মত্ত আকাক্সক্ষা।
বর্তমান চীন আর ভারত দুটো রাষ্ট্রেই উত্থান ঘটেছে উগ্র ন্যাশনালিজমের। তাদের পররাষ্ট্রনীতির বদল ঘটে। চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব ঘটলেও বিপ্লব আদর্শে ঘাপটি মেরে ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদ। শুধু মাও সে তুংয়ের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই নয়, একই সঙ্গে চলছিল চিয়াং কাইশেকের জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ। স্মৃতি সেই আফিম যুদ্ধ। মোটকথা, চীন-ভারত দুটো দেশই সম্প্রসারণবাদ, আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকারী। কমিউনিস্ট চীনের আদর্শগত পতনের কারণ অনেক কিছু। উপাদান বহুতর। অন্যতম হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের দুশমন হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। যে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের ভেজাল মিশেল হয়, সে সমাজতন্ত্রে পচন ধরে। যেমনটা ঘটেছে চীনে।
চীনাদের ভারতবিদ্বেষ নতুন নয়। সেই ঔপনিবেশিক ইংরেজ জমানা থেকে। ভারতবর্ষের কৃষকদের দিয়ে উনিশ শতকে আফিম চাষ করে ব্রিটিশরা চীনের বাজারে বিক্রি করত। ভয়ংকর সেই মাদক চীনে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করে চীনা শাসকরা। বেধে যায় চীনাদের সঙ্গে ইংরেজের যুদ্ধ, যা খ্যাত হয় প্রথম-দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ নামে। সেই যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের মূলে ছিল ইংরেজ বাহিনীর ভারতীয় সৈন্যরা। তখন চীনের বন্দর শহর ক্যান্টন আর সাংহাইয়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে ইংরেজ বাহিনীর ভারতীয় সৈন্যরা। তাই চীনারা ভারতীয় সেনাদের বলত ইংরেজের পোষা কালো চামড়ার চাকর-নফর। চীনাদের ভারতবিদ্বেষ সেখান থেকেই শুরু। পরে চীনের তিব্বত দখলের সময় ভারত দালাইলামাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিলে বিদ্বেষ আরও বাড়ে। একাত্তরের যুদ্ধে বাঙালিদের বিরুদ্ধে চীনারা পাকিস্তানের পক্ষে থাকার পেছনেও কাজ করেছিল ভারতবিদ্বেষ। বর্তমান ভারতের অর্থনৈতিক উত্থানকেও চীনারা ভালো চোখে দেখে না প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে।
ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে এটাই যে, ভারত যেমনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকারী, ঠিক তেমনি চীনও প্রাচীন সিং সাম্রাজ্যের অনুসারী। অথচ একদিন দুটো রাষ্ট্রই ছিল সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামের কেন্দ্রভূমি। ইতিহাস দেখাচ্ছে যে, প্রাচীন চীনের সিং সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিল মাঞ্চুরিয়া, মঙ্গোলিয়া, মুসলিমপ্রধান শিনজিয়াং এবং লামা বৌদ্ধপ্রধান তিব্বত। বর্তমানে মঙ্গোলিয়া ছাড়া সব ভূমিই চীনের দখলে, কিন্তু প্রাচীন সাম্রাজ্যের স্মৃতি ভুলতে পারেনি বর্তমান চীনারা। মাঝেমধ্যেই তারা দেশের মানচিত্র প্রকাশ করে। একবার তো মানচিত্রে দেখিয়ে দিল তিব্বত থেকে নেপাল, ভুটান, সিকিম, আসাম, মেঘালয়, বাংলাদেশের সিলেট-চট্টগ্রাম, ভারতের মিজোরাম মণিপুর-নাগাল্যান্ড হয়ে বার্মা (মিয়ানমার), থাইল্যান্ড তাদের দেশ। অন্যদিকে দেখাল ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, এমনকি জাপানের বহু দ্বীপও তাদের।
অন্যদিকে ’৪৭-পরবর্তী ভারত কী করল? দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদ, জুনাগড়, পণ্ডিচেরি, গোয়া, দমন, দিউ, কাশ্মীর দখল করে বসল সেনা পাঠিয়ে। পারল না লাদাখ, নেফার পুরোটা কবজা করতে। সামনে দাঁড়িয়ে চীন। অন্যদিকে চীন-ভারত বুঝতে পারল বড় ধূর্ত জাতি ইংরেজ। তারা চীন-ভারতের অচিহ্নিত সীমান্ত রেখে দিয়ে সটকে পড়ে। যাওয়ার আগে ম্যাকমোহন লাইন নামে কাল্পনিক সীমানা নির্দেশ করে যায়। এ যেন দুই রাক্ষসের পাহাড় ভাগের মতো। উত্তরের পাহাড় তোর, দক্ষিণেরটা আমার। তো মাঝখানে যে রয়েছে মাইলের পর মাইল জমি, নদী তার বেলা? জনমানবশূন্য পাথুরে ভূমি, শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা। তাই নিয়ে লড়াই দুই দেশের। এ হলো ভূমির লোভ, দেশের আকার বৃদ্ধির ঝগড়া। ভারত ও চীন সাংবিধানিকভাবে দাবি করে ওরা প্রজাতান্ত্রিক ও গণপ্রজাতান্ত্রিক দেশ। খুব উত্তম কথা। কিন্তু তাদের আচরণ, চিন্তায় ও রাজনীতিতে এর প্রতিফলন আছে কি? দেখেশুনে মনে হয় ওরা উভয়েই রাজতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক দেশ। পার্থক্য এক দেশে ভোট হয়, অন্যটিতে হয় না। সংবিধানটা তাদের বাইরের পোশাক, ভেতরে অন্যকিছু। ওই সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘লালসালু’তে বলেছেন, ‘বাইরে কোট-টাই-প্যান্ট পরা সাহেব, ভেতরে মুসলমান, নব্যশিক্ষিত মুসলমান।’ চীন-ভারত হতে পারে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-কমিউনিস্ট কিংবা নাস্তিক বা আস্তিক, কিন্তু ভেতরটা সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ।
বিপ্লবের পর চীনা কমিউনিস্ট পার্টি জনগণকে নির্দেশ দিয়েছিল পার্টি ও বিপ্লবের প্রতি শর্তহীন অনুগত থাকতে। এখন বলছে সরকার আর দেশের প্রতি অনুগত থাকতে। ভারতও স্বাধীনতার পর বলত ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অনুগত থাকতে, এখন বলছে হিন্দুত্ববাদের প্রতি অনুগত থাকতে। বর্তমান চীন কী ব্যবহার করছে শিনজিয়াং প্রদেশের সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলমানদের প্রতি? কী আচরণ করছে তিব্বতি লামা বৌদ্ধদের প্রতি? আর ভারত? শাসকরা হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদে সন্তুষ্ট নয়, তারা চায় উচ্চবর্ণ হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ। দেশের সংখ্যালঘু মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দু বা দলিত হিন্দু শাসকদের কাছে সমার্থক। নিকৃষ্ট! ভারত-চীনের সীমান্ত সংঘাত আসলে চীনের অহংবোধের ‘হান’ নৃতাত্ত্বিক উগ্র জাতীয়তাবাদ বনাম আর্য ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত। উভয়ের আত্মাভিমান ক্রমেই ঊর্ধ্বসীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাঙালিদেরও এই ভয়ংকর উগ্র জাতীয়তাবাদ অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। চিরবঞ্চিত, দরিদ্র বাঙালি একদিন না একদিন এশিয়ার অন্যতম উন্নত-ধনী রাষ্ট্রে রূপ নেবে, অবশ্যই আনন্দের কথা। কিন্তু ভুললে চলবে না এ দেশেও ভাষাগত, ধর্মগত, নৃতত্ত্বগত আদিবাসী আর পাহাড়ি জনজাতিরাও রয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ যেন তাদের প্রতি আগ্রাসী রূপ না নেয়। বাঙালি জাত্যাভিমান চীনা-ভারতীয় জ্যাতাভিমানের চেয়ে ভয়ংকর কম নয়। আটকে পড়া বিহারি উর্দুভাষীদের প্রতি বাঙালির দায় আছে, ভুললে চলবে না।
হরিপদ দত্ত : কথাশিল্পী
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
দেশের বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষায় ৫০০ টাকার বেশি নেওয়া যাবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর সরকারি হাসপাতালে এজন্য খরচ হবে ১০০ টাকা। এ ছাড়া সব হাসপাতালে পরীক্ষাসহ ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা গাইডলাইন অনুযায়ী দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ডেঙ্গু রোগীদের প্লাটিলেট ব্যবহার নিয়েও গাইডলাইনে নির্দেশনা রয়েছে।
গতকাল রবিবার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ নির্দেশ দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির। সংবাদ সম্মেলনে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল ৮টা-রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) আরও ৬৭ জন ডেঙ্গু রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি হয়েছে ৫৮ ও ঢাকার বাইরে ৯ জন। এ নিয়ে এ বছর হাসপাতাল ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ১ হাজার ৭৭১ জন। এখন পর্যন্ত মারা গেছে ১৩ জন। ঢাকার পর বেশি রোগী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে : সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় থাকা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৬ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। কক্সবাজারে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে এ সংখ্যা ৪২৬ জন। সব মিলে এখন পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ৫৩২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ সংখ্যা ঢাকায় শনাক্ত রোগীর চেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেওয়া ডেঙ্গু আক্রান্তদের তথ্যে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নেই। এর ব্যাখ্যায় অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গা কমিউনিটি যেহেতু আমাদের নাগরিক নয়, তাই তাদের তথ্য দেওয়া হয় না। তবে যেহেতু তারা আমাদের সঙ্গেই থাকে, জাতিসংঘও তাদের তথ্যটা চায়, সেহেতু গুরুত্ব দিয়েই আমরা তাদের তথ্য সংগ্রহ করি এবং আলাদাভাবে হিসাব রাখি।’
এ বছরের পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। সেখানকার স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ছড়ানো এ সংখ্যাটাও উপেক্ষা করার মতো নয়। তাদের পরিষ্কার পানির উৎস সীমিত। তারা পানি সংগ্রহ করে অনেক সময় খোলা পাত্রে রেখে দেয়, যা মশার জন্য একটা ভালো প্রজননক্ষেত্র। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কম জায়গায় মানুষ বেশি। ফলে সেখানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যা পরিস্থিতি, তাতে সেখানে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা ‘কঠিন’ বলেও মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সচেতনতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তাদের সংস্কৃতি আলাদা হওয়ায় এ ব্যাপারে কাজও সেভাবে করা যায় না। তারা একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থাকেন, সেখানে স্বাস্থ্যকর্মীদেরও অনেক নিয়ম মেনে কাজ করতে হয়।’
সিটি করপোরেশনকে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ : সংবাদ সম্মেলনে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির। তিনি বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে সিটি করপোরেশনগুলোকে জানিয়েছি, খুব দ্রুত যদি মশার স্থানান্তর নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ হয়। আমরা তাদের ম্যাপিং করে জানিয়ে দিই, কোথায় বেশি ছড়াচ্ছে। তাদের জায়গা থেকে আরেকটু বেশি অ্যাকটিভ হতে হবে। যেহেতু আমরা জানিয়ে দিচ্ছি কোথায় কী হচ্ছে, তাই তাদের উড়ন্ত মশা নিয়ন্ত্রণ, লার্ভা ধ্বংসসহ তারা যেসব ব্যবস্থা নেয়, সেগুলোর মাধ্যমে যেন আমরা ভেক্টরটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।’
অবশ্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কোন এলাকায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী, সে তথ্য জানাতে পারেনি অধিদপ্তর। এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘যেখানে ঘনবসতি বেশি, সেখানে মশার উপদ্রব বেশি। আমরা পুরো ঢাকা শহরকেই বিবেচনায় নিচ্ছি। আমাদের কাজ রোগী ব্যবস্থাপনা। ডেঙ্গু কোথায় বেশি এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের।’
ডেঙ্গু বাড়ছে কয়েক কারণে : সংবাদ সম্মেলনে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ডেঙ্গু বাড়ার পেছনে জলাবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জনঘনত্বের কারণের কথা বলেন। অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ অনেক জনবহুল, তার ওপর এখানে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। ফলে এখানে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সহজ নয়।’
এ ব্যাপারে অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন বলেন, ‘জানুয়ারি মাসের পর থেকে অনেক গরম পড়েছে। বিজ্ঞান বলে, কোনো জিওগ্রাফিতে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে তার দ্বিগুণ পরিমাণ ডেঙ্গু রোগী দেখা দেয়। সব দেখে অনুমান করা হয়েছে, প্রাক মৌসুমেই ডেঙ্গু রোগী বেশি হবে।’
এ ব্যাপারে ডেঙ্গু চিকিৎসায় সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরির সঙ্গে যুক্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. কাজী তারিকুল ইসলাম সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে সবার অংশগ্রহণ জরুরি। ২০০০ সালে এটা বাংলাদেশে আসার পর মাঝে পরিস্থিতি ভালো ছিল। কিন্তু কভিডের আগের বছর একটা বড় সংক্রমণ দেখেছি, গত বছর দেখলাম, এবারও হয়তো এমন কিছু একটা হতে পারে।’
ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ১১ পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা। গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব পরামর্শ দেওয়া হয়।
ময়মনসিংহের নান্দাইলে বাল্যবিয়ের ১০ দিনের মাথায় স্ত্রী ও নিজ পরিবারের সঙ্গে অভিমান করে স্বামীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রবিবার (২৮ মে) রাত ১১টার দিকে উপজেলার নান্দাইল ইউনিয়নের ভাটিপাছানি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিহত কিশোরের নাম ইমরান (১৫) সে একই গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে। নুরুল ইসলামের প্রতিবেশী জিয়াউর রহমানের মেয়ে সাথী আক্তার ও ইমরান স্থানীয় পাঁচানী উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। ১০ দিন আগে প্রেমিকাকে নিয়ে নিজের বাড়ি পালিয়ে যায় ইমরান। পরে ইমরানের বাবা মেয়ের বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দেয়। আট দিন সংসার করার পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলে স্ত্রী অভিমান করে বাবার বাড়ি চলে যায়। ইমরান তার স্ত্রীকে এনে দিতে পরিবারকে চাপ দিলে পরিবার বিষয়টি এড়িয়ে যায়। এই অভিমানে গতরাত ১০টার দিকে বিষ পান করে সে, ঘটনাটি টের পেয়ে তার পরিবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে সেখানে মৃত্যু হয় ইমরানের।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে স্থানীয় ইউপি সদস্য আতিক হাসান বাবুল জানান, শনিবার আমার কাছে মেয়ের বাবা ও ছেলের বাবা এসেছিল। রবিবার দুই পক্ষকে ডাকলেও ছেলের বাবা সাড়া না দেওয়ায় সমস্যাটি সমাধান করতে পারিনি। রাতে ছেলে এ ঘটনা ঘটায়। এ ঘটনায় মেয়ে পক্ষের কোনো অবহেলা দেখছি না।
নান্দাইল মডেল থানার ওসি রাশেদুজ্জামান জানান, ঘটনাটি আমাদের কেউ অবহিত করেনি। আমি খোঁজ নিচ্ছি।
নতুন পে-স্কেল কিংবা মহার্ঘ ভাতা নয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট অনুযায়ী। তাদের বেতন প্রতি বছর যতটা বাড়ার কথা এবার তার চেয়ে বেশি বাড়বে। আর তা চলতি বছরের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ানো হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশের বাইরে বাড়ানো হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত প্রায় এক বছর ধরে দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বেশিরভাগের একমাত্র আয় বেতন-ভাতা। বৈশি^ক মন্দার কারণে সরকারও খানিকটা সংকটে আছে। এ পরিস্থিতিতে পে-স্কেল দেওয়ার মতো বড় ধরনের ব্যয় বাড়ানো সরকারের পক্ষে কঠিন হবে। ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলে সরকারের ওপর চাপ বেশি হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সরকারি কর্মরতদের খানিকটা স্বস্তি দিতে কোন খাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এমন প্রস্তাব চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বাজেটবিষয়ক বিভিন্ন বৈঠকে সরকারি নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে আলোচনা করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই করে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করে। চলতি মাসে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী ওই বৈঠকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে কত বাড়তি ব্যয় হবে তা হিসাব করে পরের বৈঠকে উপস্থাপন করতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বড় ধরনের ব্যয় না বাড়িয়ে একটা উপায় বের করতেও বলেন। শেষ পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে নিজেই জানিয়েছেন।
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ২০১৫ সালের বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ বেতন কমিশন প্রণীত হয়েছিল। এ কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, আর নতুন বেতন কমিশন গঠন করা হবে না। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট বা বেতন বাড়ানো হবে। এ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তা হয়ে আসছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাব অনুযায়ী, দেশে সরকারি কর্মচারী ১৪ লাখ। বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে হিসাব করলে প্রায় ২২ লাখ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নিয়মিত ইনক্রিমেন্টের বাইরে আরও কতটা বাড়ানো যায় তা হিসাব করে নির্ধারণ করা হবে। এ কাজ করতে বাজেট প্রস্তাব পেশ করার পর আলাদা কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে যাচাই-বাছাই শেষে ইনক্রিমেন্টের হার সুপারিশ করবে। এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে বিদ্যমান ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে প্রতি মাসে বেতন বাড়ানো হবে, নাকি গড় মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে ইনক্রিমেন্টের হার বাড়ানো হবে, তা খতিয়ে দেখা হবে। ২০তম গ্রেড থেকে প্রথম গ্রেড পর্যন্ত সবার জন্য একই হারে বেতন বাড়নো হবে কি না, তা আরও খতিয়ে দেখা হবে। চূড়ান্ত হিসাব অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে প্রকাশ করা হবে। যে তারিখেই প্রকাশ করা হোক না কেন, আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকরী ধরা হবে।
এখানে মহার্ঘ ভাতা ১০ শতাংশ দেওয়া হলে এ হিসাবে ৪ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে ৬ হাজার কোটি এবং ২০ শতাংশ দেওয়া হলে ৮ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। অর্থাৎ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যয় বাড়বে। আর এতে সরকার ব্যয় কমিয়েও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টিতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো পথে হেঁটেছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতা বাবদ রাখা হয়েছে ছিল ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। খরচ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা বাজেট হওয়ার কথা আছে। এ বাজেট সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ ৭৭ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক পদ এখনো খালি আছে। এতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো হলেও সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের চাপ বাড়বে না।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নির্মিত হয়েছে বিশেষ কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘ও ভোরের পাখি’। ঈমাম হোসাইনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করেছেন তামান্ন তিথি। অনুষ্ঠানটিতে আবৃত্তি করেছেন আশরাফুল আলম, মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, পলি পারভিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, আসলাম শিশির, সংগীতা চৌধুরী, আহসান উল্লাহ তমাল। প্রচারিত হয় ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টায়।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমারে দেবো না ভুলিতে’। অনুষ্ঠানটিতে গান, কবিতা ও আলোচনার সমন্বয়ে কবিকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ইয়াসমিন মুসতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, শেলু বড়ুয়া, ছন্দা চক্রবর্ত্তী ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন প্রফেসর মুন্সী আবু সাইফ। মনিরুল হাসানের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে ২৫ মে দুপুর ১ টা ০৫ মিনিটে। আরও প্রচারিত হবে সংগীতানুষ্ঠান ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘সন্ধ্যামালতী’। রাত ৯টায় প্রচারিত হবে নাটক ‘বনের পাপিয়া’ (পুনপ্রচার)।