
ইট তৈরিতে আলাদা ধরনের মাটি দরকার। সাধারণত বালু-মাটি ও কাদা-মাটি উচ্চতাপে পুড়িয়ে, তৈরি করা হয় ইট। এর বেশিরভাগ অংশ, সিলিকন ডাই অক্সাইড। এ ছাড়া রয়েছে অ্যালুমিনা, আয়রন অক্সাইড, ম্যাগনেশিয়া, সামান্য চুন ও অন্য কিছু পদার্থ। কিন্তু ইটের জন্য বেশি প্রয়োজন- সিলিকা অর্থাৎ বালু ও অ্যালুমিনা বা কাদামাটি। সিলিকা ও অ্যালুমিনার মিশ্রণকে শক্ত ইটে পরিণত করার পেছনে চুনের একটি বড় ভূমিকা থাকে। প্রচণ্ড তাপে এই চুন, সিলিকা ও অ্যালুমিনার মিশ্রণকে শক্ত গাঁথুনি দেয়। ইটভাটায় প্রচণ্ড তাপে নির্দিষ্ট সময় পোড়ালে তৈরি হয় ইট ।
কৃষিজমি ব্যবহার করা হয়, ইট তৈরির মাটির জন্য। ফলে মাটির উপরিভাগ নষ্ট হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফসল। যে কারণে এখন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে কৃষিজমির মাটি ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু সমস্ত ইটভাটায়, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই, ইট তৈরিতে দরকার পড়ছে কৃষিজমির মাটি।
গতকাল দেশ রূপান্তরের শেষ পাতায় প্রকাশিত ‘চুরি লুটে ফোকলা হচ্ছে ফসলি জমি’ শীর্ষক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, ঢাকার ধামরাইয়ের কুল্লা ইউনিয়নের পাল্লী মৌজার ৪০ শতাংশ ফসলি জমির মালিক আবুল কালাম আজাদ। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ওই জমি ভোগদখল করছেন। কিন্তু কিছু না জানিয়েই গত ২০ জানুয়ারি দুপুরে ইটভাটার জন্য স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র এক্সকাভেটর (খননযন্ত্র) দিয়ে তার ফসলি জমিতে গভীর গর্ত করে মাটি কেটে নিয়ে যায়।
তখন ঢাকায় ছিলেন আজাদ। এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে ধামরাই থানার ওসি, ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অভিযোগ করেন তিনি। কিন্তু মেলেনি কোনো প্রতিকার।
সংবাদে আরও বলা হয়েছে, নিজের ফসলি জমির মাটি লুটের বর্ণনা তুলে ধরে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পাল্লী মৌজার এক দাগের ৮৫ শতাংশ ফসলি জমির মধ্যে ৪০ শতাংশ আমার। জমির অন্য মালিকদের কাছ থেকে ৪৫ শতাংশ কিনেছে ইটভাটার মালিক সোলাইমানের লোকেরা। কিন্তু পুরো জমির মাটিই কেটে নিয়ে গেছে তারা। আমার ফসলি জমি থেকে প্রায় তিন লাখ টাকার মাটি চুরি করেছে। ঘটনার দিনই আমি থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ করি। কিন্তু পুলিশ কোনো সুরাহা করেনি।’
একই মৌজায় ১৬৫ শতাংশ ফসলি জমি রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা মো. সাখাওয়াতের। তার জমির পাশের একটি জমি থেকে গভীর গর্ত করে প্রথমে মাটি কেটে ইটভাটায় নেয় একই চক্র। পরে সেখান থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে সাখাওয়াতের ফসলি জমি। সম্প্রতি তিনি এর প্রতিকার চেয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছেন।
সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ার ফলে শুধু জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হওয়াই নয়, পরিবেশের ভারসাম্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘ইটভাটায় লাগে টপ সয়েল। এটি হারিয়ে যাওয়া মানে ফসলি জমি হারিয়ে যাওয়া। এটি বহু বছরের ফসল। এটি নষ্ট হলে আবার তৈরি হতে বহু বছর সময় লাগে। এটি শুধু আমাদের ফুড সিকিউরিটিতে প্রভাব ফেলবে না, সামাগ্রিক ইকো সিস্টেমেও প্রভাব ফেলবে। কাজেই এটি ঠেকানো দরকার।’
তিনি আরও বলেন, ইটের বিকল্প বিভিন্ন দেশে আবিষ্কৃত হয়েছে। আমাদের দেশেও ইটের বিকল্প ব্লক এবং অন্যান্য ম্যাটেরিয়াল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আইনেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। সরকারি প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমস্যা আইন বাস্তবায়ন হয় না এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার কোনো জবাবদিহি নেই।
হাজার মানুষের জীবন-জীবিকাকে পুঁজি করে যে গোষ্ঠী দুর্বৃত্তায়নে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে আইনের মুখোমুখি করা জরুরি। অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা, প্রশাসনের দায়িত্ব। এ বিষয়ে কালক্ষেপণ, কোনোভাবেই কাম্য নয়।
কাজী হায়াৎ। বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক। বর্তমানে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি। যাত্রা শুরু করেছিলেন, সহকারী পরিচালক হিসেবে- ১৯৭৪ সালে পরিচালক মমতাজ আলীর হাত ধরে। পরবর্তী সময়ে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের সঙ্গে ‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্রেও কাজ করেন, সহকারী পরিচালক হিসেবে। এরপর ১৯৭৯ সালে ‘দি ফাদার’ ছবির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেন পরিচালক হিসেবে। এই ছবির গান- ‘আয় খুকু আয়’ সেই সময় অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। কাজী হায়াৎ এ পর্যন্ত ৫১টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। অভিনয় করেছেন- শতাধিক চলচ্চিত্রে। তার পরিচালিত ‘দাঙ্গা’ ও ‘আম্মাজান’ ছবি দেশ-বিদেশে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেশের বাইরে, উত্তর কোরিয়া চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়- দাঙ্গা। জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও অন্যান্য পুরস্কারসহ এ পর্যন্ত ৭৩টি সম্মাননা পেয়েছেন। ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন ৯টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এই গুণী অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা সিনেমার সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু- ‘সেন্সরশিপ’ নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ
দেশ রূপান্তর : ঢাকাই সিনেমায় ইদানীংকার সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুর নাম সেন্সরশিপ। কিছু সিনেমার ক্ষেত্রে এ নিয়ে জল ঘোলাও কম হয়নি। চলচ্চিত্রের মানুষ হিসেবে সামগ্রিকভাবে বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
কাজী হায়াৎ: সেন্সর বোর্ড নিয়ে কথা বলার আগে আমার মনে হয়, আমাদের সংবিধানে কতটুকু স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে সেটা জানতে হবে। যারা বাক স্বাধীনতার কাজ করবেন, মানে কোনো মাধ্যমে কাজ করবেন, তারা কতটুকু স্বাধীনতা পাচ্ছেন তা বড় বিষয়। আমাদের সংবিধানের ৩৯ ধারায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। ৩৯ এর ১-এ উল্লেখ আছে- ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ ৩৯ এর ২-এ বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ আমার মনে হয়, এগুলো অনুসরণ করেই সেন্সর বোর্ডের নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল। তাতে কতটুকু স্বাধীনতা আমাদের আছে আমার জানা নেই।
দেশ রূপান্তর : তাহলে এই সংকটের সমাধন কী?
কাজী হায়াৎ: আগে এই ৩৯-এর দুটি ধারার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তাহলে সাংবাদিকদেরও স্বাধীনতা আসবে। আমার মনে হয়, যারা এই মাধ্যম (চলচ্চিত্র) নিয়ে কাজ করেন, তাদেরও পূর্ণ স্বাধীনতা আসবে। আর এই পূর্ণ স্বাধীনতা নেই বলেই এত বাগ্বিতণ্ডা, সেন্সর বোর্ডের সমালোচনা, সেন্সর করতে গিয়ে ঝামেলা। সত্যিকথা বলতে কি, একটি স্বাধীন দেশে সেন্সর শব্দটিই খুব অযৌক্তিক। সেন্সর শব্দটি ইংরেজি না। প্রাচীন গ্রিসে যারা ম্যাজিস্ট্রেসি করতেন, তাদের সেন্সর বলা হতো। সেখান থেকে এই সেন্সর শব্দটি ইংরেজি ভাষায় এসেছে। যখন সারা বিশ্বে ব্রিটিশ রাজত্ব হয়ে গেল, তখন এই গণমাধ্যম এবং বাক স্বাধীনতা গ্রহিত করার জন্য অনেক কিছুতে সেন্সর বসিয়ে দিল। মানে ম্যাজিস্ট্রেসি বসিয়ে দেওয়া হলো। সেখান থেকেই এই সেন্সর শব্দটি এসেছে। আমার মনে হয়, একটি স্বাধীন দেশে এটির প্রয়োগ এবং এই শব্দটিই ব্যবহৃত হওয়া উচিত না। একটি সংগঠন বা কিছু ব্যক্তি আইন দ্বারা বাক স্বাধীনতার ওপর ম্যাজিস্ট্রেসি করবে, এমনটা হওয়া উচিত নয়। সেন্সর শব্দটিতে মনে হয় কেমন পরাধীনতা এবং ম্যাজিস্ট্রেসি আছে। আমার মনে হয়, সেন্সর শব্দটি না রেখে অন্য কোনো শব্দ দেওয়া উচিত। যেমন, সেটা ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সনদপত্র বিভাগ’ হতে পারে। তখন তারা নীতিমালা অনুসরণ করে ছাড়পত্র দেবেন।
দেশ রূপান্তর : এ অঙ্গনের অগ্রজ হিসেবে নিশ্চয়ই এ নিয়ে আপনারা কাজ করছেন?
কাজী হায়াৎ: বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। সেন্সর বোর্ডের অনেকেও আমার এই কথার সঙ্গে একমত। এ নিয়ে আমরা মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলব। পরিচালক সমিতির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হলে আমরা দাবি তুলে ধরব। আমাদের এই দাবিতে যৌক্তিকতা আছে, তাই আশা করি এটার অগ্রগতি হবে। নীতিমালা যা আছে সেটাই থাকবে, শুধু সেন্সর বোর্ডের নাম পরিবর্তন হবে।
দেশ রূপান্তর : অনেক পরিচালক তো সেন্সর জটিলতা এড়াতে ওটিটি বা ভিন্ন প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিচ্ছেন?
কাজী হায়াৎ: এখন পর্যন্ত ওটিটি প্ল্যাটফর্ম মুক্ত। তাদের সেন্সর প্রয়োজন নেই। তবে এখানেও হয়তো কিছুদিন পর সেন্সরশিপ আরোপিত হবে।
দেশ রূপান্তর : ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
কাজী হায়াৎ: ওটিটি এই সময়ের জনপ্রিয় একটি প্ল্যাটফর্ম । আমি বলব, চলচ্চিত্র দেখার ক্ষেত্র পরিবর্তন হয়েছে। চলচ্চিত্র দেখার বিষয়টি হাতের মুঠোয় এসেছে। সেই হাতের মুঠোয় দেখার পদ্ধতিটা বাংলাদেশেও এসেছে। যে কোনো ব্যক্তি টাকা দিয়ে ওটিটিতে সিনেমা দেখতে পারে। তবে ওটিটিতে সিনেমা দেখা আর বড় পর্দায় সিনেমা দেখার মধ্যে অনেক তফাৎ। সিনেমা শব্দের সঙ্গে পর্দাই আসলে ভালো মানায়। সিনেমা মানেই অন্ধকার একটি প্রেক্ষাগৃহ। এক সময় এটার আলাদা একটা কালচার ছিল। সেখানে গিয়ে মানুষ বসবে, পর্দায় মনোনিবেশ করবে। পর্দায় ভেসে উঠবে ছবি, পাত্র-পাত্রীগুলো অনেক বড় দেখা যাবে। শব্দ ভালো পাবে। এটা ওটিটিতেও করা সম্ভব। হোম থিয়েটারে অনেকে এমন পরিবেশ তৈরি করে দেখতে পারে। এখন কে কোথায় দেখবে সেটা একটা বিষয়। কেউ হয়তো ওটিটিতে দেখেই ভালো বিনোদন পাবে, আবার কেউ হয়তো সিনেমা হলে গিয়ে দেখে বেশি তৃপ্তি পাবে। তবে হ্যাঁ, ক্ষেত্র পরিবর্তন হয়েছে। আর এটাকে আমি স্বাগত জানাই। আধুনিক বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি, এটাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, সাধুবাদ জানাতে হবে।
দেশ রূপান্তর : নানা বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশের মানুষ হলবিমুখ হয়ে পড়েছে। এখন থেকে বের হওয়ার উপায় কী?
কাজী হায়াৎ: ভালো মানের সিনেমার বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে বলব, দর্শকদের ভালো সিনেমা হল দিতে হবে। ভালো বসার জায়গা দিতে হবে, ভালো পর্দা দিতে হবে, শব্দ ভালো দিতে হবে। আগের হল অবকাঠামোতে যে সিনেমা হলগুলো রয়েছে, সেই সিনেমা হলগুলোর পর্দা ছোট। যার ফলে দর্শকরা একেবারে বিমুখ হয়ে গেছে। এগুলো পরিষ্কার করে আধুনিক মেশিন লাগানোর ব্যবস্থা যদি করা যায়, যদি শব্দ ভালো দেওয়া হয়, আমার মনে হয় দর্শক আবার ফিরে আসবে।
দেশ রূপান্তর : বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে মূলধারার সিনেমার যে অবস্থা, সেটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কাজী হায়াৎ: আমি বলব, খুবই দুর্দিন চলছে। প্রযোজকের এখানে আয়ের পথ হলো সিনেমা হলে দর্শক। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সেই দর্শক খরা তো চলছেই।
দেশ রূপান্তর : এর পেছনের কারণগুলো কী বলে মনে করেন?
কাজী হায়াৎ: অনেক কারণই রয়েছে। মানুষের মনমানসিকতার উন্নতি হয়েছে। সেই তুলনায় ভালো সিনেমাও হচ্ছে না। অনেকগুলো দিক এর পেছনে কাজ করছে। কাজে মনোনিবেশ করেছে অনেক লোক। বেকারের সংখ্যা কমে গেছে অনেকটা। এখন যে বেকার, তারও কিছু না কিছু কাজ আছে। সেই কাজ ফেলে সে সিনেমা দেখার সময়টা বের করতে পারে না। এগুলোর পরও যে সব সিনেমা তৈরি হচ্ছে, সেগুলো এত কম অর্থের সিনেমা এবং একই ধরনের সিনেমা। যার ফলে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
দেশ রূপান্তর : দীর্ঘ সময় চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আপনি। যদি দেশের সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রী বাছাই করতে বলা হয়, কাদের নাম বলবেন?
কাজী হায়াৎ: এগুলো বলা উচিত না। আমি মনে করি, এই প্রশ্নই করা উচিত না। আমি কার নাম বলব, একজন হয়তো খুশি হবেন, আরেকজন বিরাগভাজন হবেন। আর অভিনয়ে অনেক বিতর্কিত বিষয় আছে। কেউ উচ্চ মার্গে অভিনয় করে। কেউ নিচু স্বরে কথা বলে অভিনয় করে। কেউ মুখ ভেংচি দিয়ে অভিনয় করে, কেউ হাত-পা ছুড়ে অভিনয় করে। আমাদের দেশে সিনেমা-নাটক, এমনকি এই উপমহাদেশের সিনেমা-নাটক অধিকাংশই অপেরাইসড স্টাইলে তৈরি হয়। অর্থাৎ ঘুরে যে করেই হোক ক্যামেরার সামনে চলে আসা। একটি দৃশ্য একটু লিঙ্গার হলেই দাঁড়িয়ে পড়া। এই যেমন, আমি-আপনি এতক্ষণ বসে কথা বললাম। অথচ এটা যদি সিনেমায় ধারণ করা হতো, তাহলে একবার আমি উঠতাম, পায়চারী করে আবার ঘুরে আসতাম। এগুলো অপেরা স্টাইল। এই উপমহাদেশেরই ধারা এটা। এগুলোর কে কোনটাকে ভালো অভিনয় বলবে, কোনটাকে কে খারাপ বলবে, সেটা অনেকের ধারণাবশত হতে পারে। অনেকের ধারণার সঙ্গে অনেকের ধারণার মিল নাও থাকতে পারে। আমি নিশ্চয়ই বোঝাতে পেরেছি।
দেশ রূপান্তর : পুরো জীবন চলচ্চিত্রে কাটিয়ে দিলেন। যদি নিজের চলচ্চিত্র জীবন মূল্যায়ন করতে বলা হয়, কী বলবেন?
কাজী হায়াৎ: আমি সুখী। আমার আর কী চাওয়ার আছে? জীবনের চলার পথে শেষ প্রান্তে এসেছি। যে কোনো সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাব। তবে বলব, ভালোই কাটল। এই জীবনটায় চলচ্চিত্রে এসে হয়তো ভালোই করেছি। অনেক সুনাম হয়েছে। অনেক ভালোবাসা, অনেক শ্রদ্ধা পেয়েছি। সিনেমাতেই আগে একটা সময় ছিল, সবাই হায়াৎ নামে ডাকত। তারপরে হায়াৎ ভাই হলাম। তারপরে কাজী হায়াৎ হলাম। তারপরে দাদা হলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তনগুলো হয়েছে। সবমিলিয়ে ভালোই কেটেছে।
দেশ রূপান্তর : এই যে অনেকগুলো পরিচয়ের কথা বললেন। আপনি নিজে কোনটা বেশি উপভোগ করেন?
কাজী হায়াৎ: সবগুলোই ভালো লাগে। পরিবর্তনগুলো হয়েছে ভিন্ন কারণে। পরিবর্তন আরও হয়েছে। আমি যখন কৈশোরে, তখন পাড়া-প্রতিবেশী, চাচা-চাচাত ভাইয়েরা সবাই আমাকে হায়াৎ আলী বলে ডাকত। এরপরে স্কুলে যখন গেলাম, তখন হায়াৎ কাজী বলে ডাকত। এই হায়াৎ কাজী কলেজ পর্যন্ত ছিলাম। এরপরে সিনেমায় আসার পরে, শুরুর দিকে যখন সহকারী ছিলাম, তখন হায়াৎ বলে ডাকত সবাই। এরপর যখন পরিচালক হলাম, অনেকে হায়াৎ ভাই বলে ডাকতে লাগলেন। এরপরে যখন সিনেমা হিট হতে লাগল, তখন কাজী হায়াৎ হয়ে গেলাম। এই সবগুলোই ধাপে ধাপে এসেছে এবং সবগুলোই আনন্দদায়ক ছিল আমার কাছে। কোনটায় বেশি আনন্দ পেয়েছি সেটা মূল বিষয় না। এই পরিবর্তগুলো আমার ক্ষেত্রে হয়েছে। অনেকের ক্ষেত্রেই হয়, তবে আমি এটা গভীরভাবে লক্ষ করেছি।
ইফতারের সময় এক গ্লাস গুড়ের শরবত রোজদারদের দেহমনে নিয়ে আসে এক নিবিড় প্রশান্তি। গুড়ের গ্লুকোজ শরীরে সরাসরি শক্তি জোগায়। ক্লান্তি দূর করে। এ কারণে আবহমান কাল থেকে রোজার সময় গ্রামের মানুষ গুড়ের শরবত পান করে আসছেন। পানীয় প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডার মধ্যেও গুড়ের শরবত এখনো মানুষের
তৃষ্ণা নিবারণে অনন্য উপকরণ হিসেবে সমাদৃত। রোজা এলে চিনি, ডাল, তেল ও দুধ, মাংস, ডিমের মতো গুড়ের দামও বেড়ে যায়। বর্তমানে দেশের বাজারে প্রতি কেজি আখের গুড় বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা, খেজুরের গুড় বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। ভাবতে অবাক লাগে, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি আখের গুড়ের দাম বেড়েছে ৬০ টাকা আর খেজুর গুড়ের দাম বেড়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
গুড় চিনির চেয়ে অধিক পুষ্টিকর। সাদা চিনিতে শুধু শর্করা ও সামান্য আয়রন ছাড়া আর কিছু নেই। অন্যদিকে গুড়ে শর্করা ছাড়াও রয়েছে প্রোটিন, ফ্যাট, বিভিন্ন খনিজ লবণ ও ভিটামিন। খেজুর ও তালের গুড়ে রয়েছে বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম। গুড়ে অধিক পরিমাণে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ থাকার কারণে দেহে দ্রুত শক্তি জোগায়। মিষ্টতার দিক থেকেও গুড় চিনির চেয়ে দেড়গুণ মিষ্টি। শরবত ছাড়াও মিঠাই, মন্ডা, সন্দেশ, নাড়ু, মোয়াসহ বিভিন্ন ধরনের আচার, রকমারি পিঠা এবং পায়েস তৈরিতে গুড়ের কোনো বিকল্প নেই। আয়ুর্বেদীয়, হেকিমি ও কবিরাজি ওষুধ তৈরির কাজেও গুড় ব্যবহার করা হয়। পুরাতন গুড়, রোগপ্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশে সাধারণত আখ, খেজুর, তাল ও গোলপাতার রস থেকে গুড় তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে বেশিরভাগ গুড় উৎপাদিত হয় আখের রস থেকে। দেশে মিলজোন ও মিলজোন বহির্ভূত এলাকায় আখ থেকে গুড় উৎপাদিত হয়। মিলজোন বহির্ভূত এলাকার মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, শরিয়তপুর, সাতক্ষীরা, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, বরিশাল ও হবিগঞ্জে বেশি পরিমাণে গুড় উৎপাদিত হয়। আর মিলজোন এলাকার মধ্যে অবৈধ পাওয়ার ক্রাশার ব্যবহারের মাধ্যমে রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, গাইবান্ধা, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় ব্যবসায়িক ভিত্তিতে প্রচুর পরিমাণে গুড় উৎপাদন করা হয়।
আজ থেকে ৪/৫ বছর আগেও বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৬৫ লাখ মেট্রিক টন আখ উৎপাদিত হতো। উৎপাদিত আখের শতকরা ৫০ ভাগ গুড় ২৫ থেকে ৩০ ভাগ চিনি উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হতো। বাকি ২০ থেকে ২৫ ভাগ আখ চিবিয়ে খাওয়া, রস উৎপাদন ও বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রতি বছর দেশে গড়ে আখ থেকে ৩ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন গুড় এবং তাল, খেজুর ও গোলপাতা থেকে বছরে বড়জোর ৪০ থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হতো। সে হিসেবে দেশে প্রতি বছর উৎপাদিত হতো ৩ লাখ ৬০ থেকে ৩ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন গুড়। বর্তমানে তা কমে ২ থেকে ২.৫ লাখ টনে এসে দাঁড়িয়েছে।
২০২০ সালে ৬টি সরকারি চিনিকল বন্ধ করার হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে মিলজোন এলাকায় আখের আবাদ ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়, যার বিরূপ প্রভাব পড়ে দেশের চিনি ও গুড় উৎপাদনে। আখ একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল এবং গুড় উৎপাদন কাজটি বেশ কষ্টসাধ্য হওয়ায় মিল বহির্ভূত এলাকায়ও ব্যাপকভাবে গুড় উৎপাদনের কাঁচামাল আখের আবাদ হ্রাস পায়। জনপ্রতি বার্ষিক ৬ কেজি হিসেবে দেশে মোট বার্ষিক গুড়ের প্রয়োজন প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন।
গুড় চিনির চেয়ে পুষ্টিকর হলেও বাংলাদেশে উৎপাদিত গুড়ের প্রায় শতভাগ ভেজাল ও অনিরাপদ বললে মোটেও ভুল হবে না। এক শ্রেণির লোভী গুড় উৎপাদনকারী আখের রসের সঙ্গে পশুখাদ্য হিসেবে পরিচিত চিটাগুড়, আটা, ভুট্টা ও ডালের গুড়া মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করে। কেউ কেউ খেজুর গুড়ের রসে চিনির বস্তা ঢেলে ভেজাল গুড় তৈরির উৎসবে মেতে ওঠে। ভয়ের বিষয় হলো- দেশের প্রায় সব গুড় উৎপাদন এলাকায় গুড়ের রং ক্ষণস্থায়ী সোনালি হলুদ করার জন্য হাইড্রোজ নামক এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ ক্ষতিকর মাত্রায় মেশানো হয়। হাইড্রোজের রাসায়নিক নাম সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। এই রাসায়নিক পদার্থটি পৃথিবীর কোনো দেশেই খাদ্য প্রস্তুত কাজে ব্যবহারে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। এটি কাপড় ও কাগজ কলে বিরঞ্জক হিসেবে ব্যবহার করা হয়- যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
গুড় উৎপাদনে আখ থেকে রস আহরণের জন্য দেশে পশুচালিত, ডিজেলচালিত ও বিদ্যুৎচালিত মাড়াই কল ব্যবহার করা হয়। পশুচালিত মাড়াই কলে তুলনামূলকভাবে রস আহরণ হার বেশি। শতকরা ৫০ থেকে ৫৫ ভাগ। বর্তমানে গুড় উৎপাদনে ডিজেলচালিত মাড়াই কল বেশি ব্যবহার হচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ থেকে ৫৫০ কেজি ইক্ষু মাড়াই ক্ষমতা সম্পন্ন এ জাতীয় মাড়াই কলের রস আহরণ ক্ষমতা ৪৫ থেকে ৫৫ ভাগ। অন্যদিকে বিদ্যুৎচালিত মাড়াই কলের ঘণ্টায় ৩৫০ থেকে ৪৫০ কেজি পর্যন্ত আখ মাড়াই করা যায় এবং এর রস আহরণ ক্ষমতা ৪৫ থেকে ৫০ ভাগ। এসব মাড়াই কলে আখ একবারই মাড়াই করা হয় ফলে ইক্ষুতে বিদ্যমান চিনির ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ ছোবড়াতে থেকে যায়, যা বিরাট অঙ্কের জাতীয় অপচয়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসআরআই একটি আধুনিক আখ মাড়াই কল উদ্ভাবন করে। মাড়াই কলটি ঘণ্টায় ৪৫০ থেকে ৫৬০ কেজি আখ মাড়াই করতে পারে এবং এর রস আহরণ ক্ষমতা ৫৫ থেকে ৬০ ভাগ। মাড়াই কলটির আনুমানিক মূল্য ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতির মতো এই যন্ত্রটিতে শতকরা ৫০ ভাত ভর্তুকি এবং মাড়াই কল ক্রয়ে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে গুড় উৎপাদন এলাকায় মাড়াই কলটির বহুল ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত।
আমাদের কথা, গুড়ের ঘাটতি পূরণের জন্য চর ও পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক ভিত্তিতে আখের চাষ করতে হবে। দেশে মিলজোন বহির্ভূত এলাকায় একটি গুড় বোর্ড গঠন করে আখচাষিদের মধ্যে মিল এলাকার মতো ঋণে বিশুদ্ধ বীজ, সার, নগদ অর্থ ও বালাইনাশক বিতরণ করতে হবে। আখচাষিদের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে উন্নত মানের আখ মাড়াই যন্ত্র সরবরাহ করতে হবে। মিল এলাকার মতো মুড়ি ও রোপা আখ চাষে সমপরিমাণ ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। গুড় উৎপাদন এলাকায় আর্দ্র-গরম-বাতাস শোষিত পরিচ্ছন্ন ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন এবং বিতরণ করতে হবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও বাংলাদেশ বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লি. বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন
এক.
সরকারি প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের অনাস্থা, সরকার ও নাগরিক কারও জন্যই ভালো নয়। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, পারস্পরিক আস্থার ওপরে যেমন সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক স্থিতি দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনই সরকারের প্রতি নাগরিকের আস্থার ওপরে নির্ভর করে প্রশাসনের ভারসাম্য। নাগরিকের আস্থা দৃঢ় থাকলে তবেই মানুষ সরকার তথা প্রশাসনের নীতি মন দিয়ে মেনে চলেন তা-ই ফুটে ওঠে জনস্বাস্থ্যের প্রতিক্রিয়ায়। সরকারি নির্দেশিকা পালনে, এমনকি নানা কানুনে। প্রশাসনের প্রতি আস্থায় মানুষের সচেতন রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ে, বাড়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাও। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার ও নাগরিকের মধ্যে আস্থার ভারসাম্য থাকলে উন্নয়নের কাজ হয় দ্রুত ও মসৃণ। মানুষ এগিয়ে আসেন অনেক বেশি, উৎপাদনশীলতায় তার সুফল মেলে। অন্যথায় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দুই.
একদিকে দেশ উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মানুষের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প ছড়িয়ে পড়ছে। বড় বড় মেগা প্রকল্পে সরকার হাজারো কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। এসব মেগা প্রকল্প সচল রাখতে, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সরকার কঠিন শর্তে বড় বড় অঙ্কের ঋণ নিচ্ছে।
অপরদিকে বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ, যারা মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আয় করেন বা স্বল্প আয় করেন, উচ্চ দ্রব্যমূল্যের কারণে নিজেদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। মানুষ ঠিকমতো খাবার খেতে পারছে না, নিজেদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।
দেশ যখন অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ঠিক সেই সময়ে বড় দাগে সামাজিক অবক্ষয়ও বেড়ে চলছে। এটাই কি দেশের সুষম বা টেকসই উন্নয়ন?
তিন.
ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের শুরু থেকে বঙ্গীয় সমাজে ‘স্যার’ ডাকা সম্মানসূচক। হালে একশ্রেণির কাছে ‘স্যার’ ডাকটি আদায় করে ছাড়ার বিষয়। সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ের কিছু ব্যক্তি উন্মুখ হয়ে থাকেন ‘স্যার’ ডাক শুনতে। কিছু করপোরেট হাউসে আবার ব্যতিক্রম। সেখানে নিচু পর্যায়ের কাস্টমারকেও ‘স্যার’ সম্বোধনের সংস্কৃতি চলে। সেখানেও আবার সীমাহীন সাংঘর্ষিক চিত্র। কাস্টমারদের দিক থেকে কাউন্টারের ওপাশের জনকে নাম ধরে ডাকা দূরে থাক, করজোড়ে দাঁড়াতে হয়। কে সেবাদাতা, কে গ্রহীতা বোঝার অবস্থা থাকে না। বছর কয়েক ধরে টিভি-রেডিওতে বিচারকের আসনে বসা শিল্পীকেও গুরুজি-ওস্তাদজির বদলে ‘স্যার’ সম্বোধনের রীতি চালু হয়েছে।
আমাদের এ বঙ্গে ‘স্যার’ চালু করা ব্রিটিশ রাজ্যের দেশেও এখন ‘স্যার’ সম্বোধনের চল উঠে গেছে। ডাকা হচ্ছে, সরাসরি নাম ধরে। নামের আগে ডক্টর-ডাক্তার, প্রফেসর, মিস্টার যুক্ত করা হয় সম্মানের সঙ্গে। কথায় ব্রিটিশদের গাল দিয়ে এক ধরনের তুষ্টিতে ভুগলেও আমাদের তথাকথিত বরেণ্য তথা ক্ষমতাধররা ব্রিটিশদের চালু করা ‘স্যার’-এর ভূত ধরে রাখতে বড্ড আগ্রহী। কিন্তু ব্রিটিশদের ‘স্যার’ পরিহারের শিক্ষা নিতে আগ্রহী নন। তারা কর্র্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও আভিজাত্য কায়েম করতে ‘স্যার’ ছাড়তে নারাজ।
বিষয়টি সামন্তবাদী চর্চার। এ ব্যবস্থা অক্ষুণœœ রেখে কেবল ‘স্যার’ কেন তাদের ‘জাঁহাপনা’ সম্বোধন আদায় করে নিতেও বাধা পড়বে না। তারা উপলব্ধিই করতে পারেন না, সামনাসামনি ‘স্যার’ ডেকে মাথা চুলকালেও পেছনে গেলেই গালমন্দ জোটে তাদের ভাগ্যে। আমাদের অধিকাংশ মানুষের মনোজগতে বাস করে ফিউডালিজম বা সামন্তবাদ। আমরা যার যার ক্ষেত্রে একেকজন সামন্ত প্রভু। আমলা তার অধস্তন কর্মকর্তা ও জনগণের সঙ্গে, ডাক্তার রোগীদের সঙ্গে, শিক্ষক ছ্ত্রাছাত্রীর সঙ্গে এবং রাজনীতিবিদ তার সমর্থকদের সঙ্গে সামন্ত প্রভুর মতো আচরণ করেন। আমলার কাছে জনগণ, ডাক্তারের কাছে রোগী, শিক্ষকের কাছে তার শিক্ষার্থীরা যেন প্রজার মতো।
আমরা প্রকৃত ‘স্যার’ হারিয়ে ফেলছি না তো? শিক্ষকদের এখন ‘স্যার’ না ডাকলেও সমস্যা হয় না। কিন্তু তাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষক হয়ে ‘স্যার’ হওয়ার চেয়ে শাসক হয়ে ‘স্যার’ হওয়ার লিপ্সা ভর করছে মারাত্মক পর্যায়ে। কর্মজীবনে প্রশাসক হয়ে ‘স্যার’ হতে যারপরনাই উদগ্রীব তারা। এই মেধাবীদের মধ্যে শিক্ষক-গবেষক হওয়ার চেয়ে শাসক-প্রশাসক হয়ে ‘স্যার’ হওয়ার দৌড় শুরু হয়েছে।
আমাদের পদস্থ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীরা সাধারণ জনগণের কাছ থেকে ‘স্যার’ ডাক শুনতে চান, সমীহ চান, সালাম চান। নিজেদের দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে, জনগণকে সেবা দেওয়ার আইনসঙ্গত কর্তব্যের কথা বিস্মৃত হয়ে তারা মালিকপক্ষ হয়ে যান। রাষ্ট্রের কর্মচারী ও জনগণের সেবক নয়, তারা নিজেদের প্রভু, জমিদার ও ক্ষমতার মালিক ভাবেন। আমাদের রাষ্ট্রীয় চর্চা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রচলিত সামাজিক প্রথা জমিদারি ও ফিউডালিজমকে পুষ্ট করে তোলে, উৎসাহ দেয় যেন জমিদার-প্রজা ও প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক ফুলে-ফলে ফুলে-ফেঁপে ওঠে!
চার.
সম্প্রতি বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রুবাইয়া ইয়াসমিন বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীর মাকে বিদ্যালয়ে ডেকে এনে তার পা ধরে মাফ চাইতে বাধ্য করেছেন। এ কারণে ওই বিচারককে ইতিমধ্যে বগুড়া থকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যে ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে, সেটি আর উল্লেখ করলাম না। ইতিমধ্যে ঘটনাটি সবার জানা। নিঃসন্দেহে ঘটনাটি দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। বাংলাদেশে তো এখন দাসপ্রথা নেই, জমিদার বা রাজা-রানীও নেই। তাহলে পদস্থ কর্মকর্তা, সম্পদ ও ক্ষমতা যাদের আছে, তারা সাধারণ মানুষকে দাসী-বাঁদি কেন মনে করবেন? সংবিধানে ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’-এর বাংলা করা হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। এ সংবিধানের মুখবন্ধ এবং ৭ অনুচ্ছেদের কারণে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাংলাদেশে সব ক্ষমতার উৎস হচ্ছে জনগণ এবং সে জন্য এখানে সাংবিধানিক ও আইনিভাবে কোনো রাজা-প্রজা, প্রভু ও দাস বলে কিছু নেই। এখানে সব মানুষ লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে পদমর্যাদাগতভাবে সমান এবং আইনের সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী।
সেই জজ গত বুধবার বগুড়ার কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মীর কাছে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছেন। তিন পৃষ্ঠার সেই বিবৃতিতে তার মেয়ের সঙ্গে সহপাঠীরা নতুন শিক্ষার্থী হিসেবে ‘র্যাগিং’ ও ‘বুলিং’ করার কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ এ ঘটনা নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা নেই। বরাবরের মতো গণমাধ্যম, একই সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরা তার দায়কে অস্বীকার করেছে।
যে কোনো অবস্থায় ‘র্যাগিং’ ও ‘বুলিং’ এক ধরনের হেনস্তা। কেউ শারীরিক নিগ্রহের সম্মুখীন হন, কাউকে আবার শুনতে হয় কুকথা। তবে এ ধরনের নিগ্রহ ছাড়াও আরেক ধরনের নির্যাতন রয়েছে, যা চোখ এড়িয়ে যায় বহু মানুষের, তা হলো সামাজিক বৈষম্য। মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা বলছে, সামাজিক বৈষম্য এমন এক ধরনের হেনস্থা, যা শারীরিক নিগ্রহ বা কটু কথার থেকেও বেশি দেখা যায়। বিষয়টি খুবই বেদনাদায়ক। যারা বুলিংয়ের শিকার হন, তারা বুঝতে পারেন এ যন্ত্রণা বা কষ্টগুলো কেমন। সাধারণত এ ধরনের হেনস্তার শিকার হলে মানুষের মধ্যে ইমপালস কাজ করে। তার মনে হয়, তার জীবন শেষ হয়ে আসছে, সেখান থেকেই আইসোলেশন ও সুইসাইডের ভাবনা।
কারা এই জাতীয় অত্যাচারের শিকার হয়? দেখা গিয়েছে, সাধারণত শারীরিক বা মানসিকভাবে দুর্বলরাই হয়রানির শিকার হয়। যারা এই বুলিং করেন, তারা মূলত নিজেদের আপার অ্যাগ্রেশন প্রকাশ করতে এই পথ বেছে নেন। বুলিংয়ের শিকার যারা হন, তাদের প্রথমেই চোট লাগে আত্মবিশ্বাসে। প্রাথমিকভাবে তাদের এই ধারণা হয় যে, এ ঘটনা একমাত্র তাদের সঙ্গেই হয়েছে, এই লড়াইয়ে তিনি একা। তার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সেই ভাবনা থেকেই ধীরে ধীরে গুটিয়ে যাওয়া, অবসাদ, উৎকণ্ঠায় ভোগা ও একসময়ে আত্মহত্যার কথা ভাবা।
শারীরিকভাবে দুর্বল বা রুগ্্ণ, অতিরিক্ত মোটা, বেঁটে; যারা কোনো শারীরিক বা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত, অন্যদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারে না, বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা কম, জাতি-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি কারণে ক্লাসে সংখ্যালঘু, তারাই সাধারণত এ ধরনের অত্যাচারের শিকার হয়। ‘বুলিং’-এর ফলে নিজের ভেতর সংকুচিত হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। তীব্র মানসিক অবসাদ থেকে আত্মহত্যার ঘটনাও অস্বাভাবিক নয়। অন্যদিকে যারা এ ধরনের হয়রানি ঘটানোর মূলে, তারাও স্বাভাবিক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই এদের মধ্যে ব্যক্তিত্বজনিত সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়।
কাউকে আক্রমণ করে নিজেকে শক্তিশালী মনে হলেও, দিন শেষে আয়নার সামনে দাঁড়ালে দেখা যায়, অপূর্ণতা রয়েছে নিজের মধ্যে। তাই পরস্পরকে রক্তাক্ত করার বদলে যদি অনুভূতির পাঠ শেখা যায়, তাহলে সমাজ বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মানও বাড়বে।
লেখক: সহকারী সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন
১৮৪০ সালের এই দিনে ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক এমিল জোলা। বাবা ফ্রাংকোয়িজ জোলা ইতালি বংশোদ্ভূত হলেও মা ছিলেন ফরাসি। বাবার মৃত্যুর পর তার পরিবার ১৮৫৮ সালে ফ্রান্সে চলে আসে। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি লিখতে শুরু করেন এবং তার লেখালেখি শুরু রোমান্টিক ধারার কবিতা দিয়ে। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ১৮৭৭ সাল থেকে, যখন ফরাসি ভাষায় লেখা তার বই ‘লা’সআমোর’ প্রকাশিত হয়। মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে তিনি বিপণনকেন্দ্র এবং শিপিং ফার্মে কেরানির কাজ করেন। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘দি আর্থ’ ও ‘দ্য জার্মিনাল’। প্রকৃতিবাদী চিন্তাধারার জোরালো প্রবক্তা ছিলেন তিনি। তার ‘নানা’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত মহল প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। কিন্তু বইটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। উপন্যাস ছাড়া বেশ কিছু ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও নাটক লিখেছেন তিনি। ফ্রান্সের উদারনৈতিক রাজনীতির জন্য সব সময় কাজ করেছেন তিনি। নেপোলিয়নের প্রতি ব্যক্তিগত বিরাগ তিনি লুকাতেন না। এ জন্য তাকে নির্বাসিত জীবনযাপনও করতে হয়েছে। ১৯০১ ও ১৯০২ সালে দুবার তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯০২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ব্যাংকপাড়াখ্যাত মতিঝিল এখন মৃতপ্রায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যত্র সরে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা ঘোরানো মতিঝিলে আবাসিক ভবন, শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান তৈরি না হলে দেশের প্রধান এই বাণিজ্যিক অঞ্চল প্রাণ হারাবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তাদের মতে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় অবদান রয়েছে মতিঝিলের টাকার। শুধু তা-ই নয়, মতিঝিলে উপার্জিত অর্থে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডাসহ আরও অনেক দেশে। এখানকার উপার্জিত টাকা অনেকে জমা রেখেছেন সুইস ব্যাংকেও। শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি মতিঝিলে। এ যেন মা কাঁকড়ার আত্মত্যাগের গল্প। মা কাঁকড়া বাচ্চাদের আগলে রাখে বুকের ভেতর; যেদিন বাচ্চাগুলো বের হয়ে আসে, সেদিন খোলস ছাড়া মা কাঁকড়ার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। মা কাঁকড়ার মতো দুঃখী ও ত্যাগী বাণিজ্যিক মতিঝিল।
ষাটের দশকে মতিঝিলে গড়ে ওঠে দেশের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল (সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট-সিবিডি)। সেই থেকে এখনো দেশের প্রধান বাণিজ্যিক অঞ্চল মতিঝিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। এর মধ্যে সরকারি ৮টি, বেসরকারি ৪৫টি এবং বিদেশি ব্যাংক রয়েছে ৮টি। এ ছাড়া ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ৮১টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের বেশির প্রধান কার্যালয় চলে গেছে কারওয়ান বাজার, গুলশান-বনানী ও উত্তরায়। নতুন করে যেসব ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাচ্ছে, সেগুলোর প্রধান কার্যালয় মতিঝিলের বাইরে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মতিঝিলের আশপাশে পরিকল্পিত কোনো আবাসিক এলাকা, অভিজাত হোটেল, কাজের ফাঁকে অবসর কাটানোর মতো উন্মুক্ত স্থান, শপিং কমপ্লেক্স না থাকায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের সুবিধার জন্য অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয়গুলোও মতিঝিলের বাইরের এলাকা, অর্থাৎ কারওয়ান বাজার, গুলশান অ্যাভিনিউ, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে গড়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, মধুমিতা সিনেমা হল এবং ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে এবং দিলকুশা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবন এবং বঙ্গভবনের পাশের এলাকাজুড়ে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল। বিশ্বের বাণিজ্যিক অঞ্চলের ভবনগুলো সুউচ্চ হয়ে থাকে। কিন্তু মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের পাশেই বঙ্গভবন। নিরাপত্তার কারণে বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর কোনো বহুতল ভবন করতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, মতিঝিলের প্লটগুলোর ‘নন-রেসট্রিকটেড’ উচ্চতা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর সাড়ে চারতলার বেশি উচ্চতার ভবনের অনুমোদন মেলে না। ফলে মূল্যবান ওই প্লটগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন না মালিকরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ জরাজীর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণও রয়েছে কয়েকটি ভবন। একটির সঙ্গে অন্যটি লাগানো। দুটি ভবনের মাঝখানে উন্মুক্ত জায়গা নেই বেশিরভাগ ভবনের। দিলকুশা এলাকার বঙ্গভবন লাগানো ভবনগুলোর মাঝখানেও কোনো ফাঁকা জায়গা দেখা যায় না।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, মতিঝিল এলাকার ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে। ভাঙাচোরা এবড়োখেবড়ো সড়ক। সড়ক বিভাজকগুলো শ্রীহীন। এগুলোতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হয়নি। প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরে গেলে মতিঝিলের আরও করুণ দশা চোখে পড়ে। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকার সড়কের ফুটপাতে গড়ে উঠেছে চটের ছালা দিয়ে ঘেরা খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান এবং নানা পণ্যের অস্থায়ী দোকান। সামান্য বৃষ্টিতে মতিঝিল এলাকার সড়কগুলো তলিয়ে থাকে পানির নিচে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। ডিএসসিসি এলাকার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে। খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে মূল্যায়ন করলে মতিঝিল ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। যদিও এটা মানতে নারাজ ডিএসসিসির কারিগরি কমিটি।
মতিঝিল এলাকার বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিল এলাকার সংস্কার ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে ডিএসসিসি। পরিত্যক্ত প্রায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মতিঝিলের সড়ক, নর্দমা, ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকের অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা দরকার। পর্যায়ক্রমে এ এলাকার বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কাজ করবে ডিএসসিসি। তবে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের মূল সংস্কার ও আধুনিকায়নের দায়িত্ব রাজউকের। রাজউককে সেসব বিষয় পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কাজে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা লাগলে করপোরেশন সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে তোলে রাজউক। রাজউক সূত্রে জানা যায়, ষাটের দশক থেকেই মতিঝিলের পুরোপুরি বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যিক অঞ্চলে শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান থাকে। আর কাছাকাছি এলাকায় পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা থাকে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে সেটা ছিল না। অভিজাত মানের হোটেল পূর্বাণী গড়ে উঠলেও আশপাশে সময় কাটানোর মতো ব্যবস্থা নেই। সে কারণে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা লোকজন গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় থাকেন। মতিঝিলের সৌন্দর্য নিশ্চিত করতে ও আধুনিকায়নে যেসব বিষয়ে দৃষ্টি রাখা দরকার ছিল রাজউক ও সিটি করপোরেশন সেটা করেনি।
রাজউক সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধরা, উত্তরা। সেই সব এলাকা থেকে মানুষ মতিঝিলে আসেন। শহরের জনসংখ্যা বাড়ায় দিন দিন যানজট বাড়ছে। ওই সব এলাকা থেকে মতিঝিলে আসতে সড়কে এক থেকে দেড় ঘণ্টা চলে যায়। দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার মধ্যে ৩০ শতাংশ সময় সড়কে নষ্ট হচ্ছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে চিন্তা করেছে, তার কর্মস্থল এমন একটা জায়গায় হবে যা তার আবাসনের কাছাকাছি। মতিঝিল থেকে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও ভূমিকা রেখেছে।
কালের বিবর্তনে গুলশান হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক এলাকা। কারওয়ান বাজার, উত্তরায়ও গেছে কিছু। এসব জায়গায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও সেখানে চলে গেছে। এসব এলাকার আশপাশে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় তাদের বসবাস। আবাসিক এলাকা ছাড়া, পৃথিবীর কোথাও শতভাগ জায়গা শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা অথবা একই শ্রেণির কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহার হয় না।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মুখপাত্র মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, নগর পরিকল্পনায় ভূমির ব্যবহার সম্পর্কে বলা হয়, যেকোনো জায়গার ব্যবহার হবে ২৪ ঘণ্টা। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল কর্মচঞ্চল থাকে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এরপর ওই জায়গার ব্যবহার হয় না। রাতে নীরব ও ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়।
তিনি বলেন, যে মতিঝিলে দিনের বেলায় হাঁটা যায় না; গাড়ির কারণে, যানজটে; সেই মতিঝিলে রাত ৮টার পরে আবার একাও হাঁটা যায় না; অনিরাপদ বোধ হয়। এ জন্য যারা দিনে বাণিজ্য করতে আসেন, তারা মতিঝিল এলাকার হোটেলগুলোতে থাকেন না। অন্যদিকে গুলশান-বনানী এলাকায় থাকলে তারা শপিংয়ে যেতে পারেন, কফি শপে যেতে পারেন। এসব কারণে সারা বিশ্বে ভূমির মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, মতিঝিল এলাকা যেহেতু ইতিমধ্যে তার আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছে, এ জন্য মতিঝিলের জমির শ্রেণিকে মিশ্র ব্যবহার হিসেবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি নিয়েছে রাজউক। সংশোধিত ড্যাপে সে বিষয়ে নির্দেশনা রাখা হয়েছে। পৃথিবীর নগর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৫০, ৬০ বা ১০০ বছর অন্তর সেসব ঢেলে সাজানো হয়। সেটা বিবেচনায় নিয়েই মতিঝিল এলাকাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে আবাসিকের বৈশিষ্ট্য দিতে হবে; কনডোমিনিয়াম গড়ে তুলতে হবে। ইতিমধ্যে রাজউক বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে ১৬ একর জায়গা নিয়ে একটি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে লাইব্রেরি, ওয়াকওয়ে থাকবে। বসার ব্যবস্থা থাকবে। মতিঝিল এলাকায় ঝিল ছিল, ওই ঝিলকে প্রাধান্য দিয়ে পার্কটি তৈরি করা হবে। বহুমুখী ব্যবহার ছাড়া মতিঝিলকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিলের আধুনিকায়ন ও ভূমির মিশ্র ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাহলে মতিঝিল সচল থাকবে; তবে ঢাকা শহর বড় হওয়ায় আরও বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে ওঠা ইতিবাচক। এসব পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা দরকার ছিল; কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। এটা দুঃখজনক। এ জন্য শহরে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ঢাকায় এখন অনেকগুলো বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই সব অঞ্চলে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত বড় বড় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় মতিঝিলে রয়েছে। তবে ব্যবসা গুলশান, বনানী, উত্তরা, গাজীপুরে সরে যাওয়ায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ব্যবসা কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির অঙ্ক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখী করতে পারলে নির্বাচন বিতর্ক সামাল দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেওয়া নানা পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এ ছাড়া জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নির্বাচন নিয়ে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগ এ তিন পরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সফর করে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিগত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে দেশ-বিদেশে বেশ বিপাকে ফেলেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সরকারি দল। সেজন্য আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নামতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরেই কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে এ সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে ভোটের পরে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চক্রান্ত বিএনপির রয়েছে, সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করার অন্যতম কারণ হলো এটি।
সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ৫০-৪০ শতাংশ ভোট কাস্টিং করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তা সম্ভব হলেই ভোট বিতর্ক এড়ানো যাবে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পরে সব নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ফোরামে আলোচনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে কম ভোটার উপস্থিতির উদাহরণ। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা ধরে নিয়েই তিন পরিকল্পনায় সফল হতে পারবেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন পর্যন্ত জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য বেঁধে রাখা পারলেই নির্বাচন পর্যন্ত আর সমস্যাগুলো বড় বাধা হয়ে আসবে না সরকারের সামনে। বাকিটা হলো ভোটের দিন লক্ষ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ঘটানো।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তেমন আধুনিক উদ্যোগ নেই। কম ভোট উপস্থিতির এটিও একটি কারণ। প্রত্যেক ভোটারকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে হবে এমনকি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, সেটি ইসিকে ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও কেন্দ্রে ভোটার আনতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। এ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কী কী উপায় নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, স্বল্প সময়ে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো আগামী নির্বাচনে করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের কর্মব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পেলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেয়ে পরিবারকে একটু সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বের মনে করেন ভোটাররা।’ ভোট দেওয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি দল নির্বাচনে না যাওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করে না ভোটাররা। ফলে নির্বাচন বর্জন করা দলের ভোটাররা কেন্দ্রে যান না এবং দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন এ ভেবে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যান না। গত নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়ার বড় কারণ এগুলো। তবে আগামী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা। জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের হিসাবে মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশই তাদের ভোটার। এবার দলীয় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোটার কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ সফল হলে ভোট নিয়ে সব প্রশ্নই দূর করতে পারবে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে কম ভোটার উপস্থিতিও অন্যতম। তারা চান না এবার সেই প্রশ্ন উঠুক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার বড় বড় কাজ করছে ঠিকই, ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ জনগণের একটি অংশ সরকারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, এমনটাই মনে করছেন তারা। তাই ভোটের আগে বাকি সময়ে ছোট বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তা পূরণ করা হলে সাধারণ জনগণের ওই অংশটি আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে। সংসার জীবনের কশাঘাতে পড়ে সরকারের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ওই শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সংসার সামলাতে যে বিষয়গুলো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সেগুলোকে নির্বাচন পর্যন্ত কড়া মনিটরিংয়ে রেখে সামাল দেওয়া সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত অংশের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। আর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস।
জনআকাক্সক্ষা পূরণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বারবার একই চেহারা দেখছেন এলাকার মানুষ। অন্যদিকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধি। তাতে মানুষ বিরক্ত হন। এলাকার ভোটাররা মনে করেন, একজনকে কতবার ভোট দেব? এটি হলো জনআকাক্সক্ষা। এ জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগবে। রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন লোকজনও আগ্রহী হবেন। নতুন প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে ভোটাররা আসবেন।
এদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এ বিষয়টি বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে এটা এখন বিএনপিও বিশ্বাস করে। দলটি ভাবছে, আন্দোলন জমছে না, নির্বাচনও ঠেকানো যাবে না। আর সেটাই তাদের বিপাকের কারণ।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।