
সময়ের আবর্তে প্রতিবছর রমজান মাস আসে। এর উদ্দেশ্য হলো রমজানের শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের একজন পরিপূর্ণ মুমিন হিসেবে গড়ে তোলা। তাই মুমিন-মুসলমান হিসেবে সবার উচিত জীবন গঠনে রমজানের শিক্ষার প্রতিফলন ঘটানো, এগুলো নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করা।
আমরা জানি, ইবাদত বাহ্যিক ও আত্মিক দুধরনের হয়ে থাকে। রোজা একটি আত্মিক ইবাদত, যা সম্পূর্ণরূপে রিয়া তথা লোক দেখানো মুক্ত একটি ইবাদত। একজন মুমিন-মুসলিম বাহ্যিক কোনো নেক আমল করলে মানুষ তা দেখতে পায়, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। কারণ কেউ রোজাদার কিনা তা একমাত্র সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে আল্লাহ রাসুল! আমাকে এমন একটি কাজের আদেশ দিন যার দ্বারা আল্লাহ আমাকে উপকৃত করবেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি রোজা রাখ। রোজার সমতুল্য কিছু নেই।’ সুনানে নাসাঈ : ২৫২৯
শুধু রোজা নয়, মুমিনের প্রতিটি ইবাদতই একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি বলুন! আমার নামাজ, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।’ সুরা আনআম : ১৬২
রোজার মতো যেকোনো ইবাদত কবুলের পূর্বশত হলো হালাল খাবার। মানুষের জীবন, কাজ-কর্ম, চরিত্র ও আচরণের ওপর হালাল ও হারাম খাদ্যের প্রভাব পড়ে। তাই হালাল খাবার খেলে ভালো ও নেক কাজের প্রেরণা জাগে। পক্ষান্তরে হারাম খাবার খেলে গোনাহ ও নিষিদ্ধ কাজের প্রেরণা আসে। সে জন্য হালাল খাদ্যগ্রহণের জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র জিনিস থেকে খাবার গ্রহণ করো এবং নেক কাজ করো।’ সুরা আল মুমিনুন : ৫১
বর্ণিত আয়াতে খাবারের সঙ্গে নেক আমলকে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। অধিকন্তু হারাম আয়-উপার্জন দিয়ে রোজাসহ কোনো ইবাদতই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না বলে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মতকে জানিয়ে দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন এক মুসাফিরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন, ‘যে বহু দূরদূরান্ত থেকে সফর করে এসেছেন এবং যার চুল ধুলামলিন ও এলোকেশি, তিনি আকাশ পানে দুই হাত তুলে দোয়া করেন এবং বলেন, হে রব! হে রব! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং হারামের ওপর ভিত্তি করেই তিনি গড়ে উঠেছেন, তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?’ সহিহ মুসলিম : ২২১৮
রমজানের রোজার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আত্মসংযম। একজন মানুষ আত্মসংযমের চর্চা করে তখন নৈতিকতাবিবর্জিত সব কাজ থেকে সংযত থাকারও চর্চা করে। যথাযথভাবে রোজা পালনে একজন মুমিন বান্দার মাঝে চারিত্রিক ত্রুটিমুক্ত হয়ে উন্নত নৈতিকতা ও উত্তম চরিত্র গড়ে ওঠে। হাদিসে এসেছে, হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যখন তুমি রোজা রাখবে তখন যেন তোমার কর্ণ, চক্ষু এবং জিহ্বাও মিথ্যা ও হারাম কাজ থেকে রোজা রাখে। তুমি প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাক। আত্মমর্যাদা ও প্রশান্তভাব যেন তোমার ওপর বজায় থাকে, এমন হলে তোমার রোজা রাখা ও না রাখা সমান হবে না।’ ইবনে আবি শাইবা : ৮৮৮০
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে আমাকে তার দুই ঠোঁট ও দুই ঊরুর মধ্যবর্তী স্থানের নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব।’ সহিহ বোখারি : ৬১০৯
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে রোজাদারদের ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের নির্দেশনা দিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সিয়াম ঢালস্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মতো কাজ করবে না। যদি কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দুইবার বলে, আমি সিয়াম পালন করছি।’ সহিহ বোখারি : ১৭৭০
পবিত্র রমজান মাসে আমাদের সামনে সব ধরনের সুযোগ থাকার পরও আমরা পানাহার বর্জন করে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে থাকি। তাই এই রমজান মাসকে শাহুরুস্ সবর তথা ধৈর্যের মাস বলে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই রোজাসহ আল্লাহর প্রতিটি হুকুম আমাদের ইচ্ছা হোক বা না হোক তা পালনে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে যেতে হবে।
মনে রাখা দরকার, শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরায় চলাচল করে আমাদের কুমন্ত্রণা দেয় এবং নফসের কুপ্রবৃত্তির কারণে আমরা অনেক পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ি। রমজানের সিয়ামের মাধ্যমে আমরা শয়তান ও কুপ্রবৃত্তি দমনের শক্তি অর্জন করে থাকি। তাই কুপ্রবৃত্তি দমনেও সিয়াম পালনের নির্দেশনা এসেছে হাদিসে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা যুবক বয়সে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম, অথচ আমাদের কোনো কিছু (সম্পদ) ছিল না। এমনি অবস্থায় আমাদের রাসুল (সা.) বলেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি ও লজ্জাস্থানের সুরক্ষা দেয়। আর যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে না সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ এটা তার রক্ষাকবচ।’ সহিহ বোখারি : ৪৬৯৬
আরেকটি কথা, রমজানের রোজা কি গোনাহ মাফের উপযুক্ত করে তুলছে কিনা তা নিয়ে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মসমালোচনা করতে হবে। এমন রোজাদারের জন্যই গোনাহ মাফের ঘোষণা রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ইমান (বিশ্বাস) ও ইহতেসাবের (একনিষ্ঠ নিয়ত, প্রত্যাশা) সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে রমজানের রোজা রাখবে আল্লাহতায়ালা তার অতীতের সব গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ জামে তিরমিজি : ৬৮০
আল্লাহতায়ালা সবাইকে পরিপূর্ণ হক আদায় করে রমজানের রোজা পালনের তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
ছোটবেলায় পড়া গল্প যে জীবনের পরতে পরতে কাজে লাগবে তা কি আমরা কেউ ভেবেছিলাম? সেই যে বুদ্ধিমান বিদূষক যিনি রাজদরবারে রাজার সামনে কথা বলতে এসে বিনয়ে বিগলিত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন মহারাজ! সভয়ে বলব না নির্ভয়ে বলব? মহারাজ বললেন, নির্ভয়ে বলো। এত বড় রাজার সামনে কথা বলা, রাজা অভয় দিয়েছেন, সংশয় তো তবুও যায় না। তিনি জানতে চাইলেন, প্রিয় কথা বলব, না প্রয়োজনীয় কথা বলব? এটা একটা গল্প কিন্তু তা যেন জড়িয়ে আছে আমাদের বর্তমান সময়ের সঙ্গে।
ভয়ে ভয়ে কথা বলা বা চুপ করে থাকার সংস্কৃতি প্রবল রূপ নিয়েছে। প্রিয় কথা বলার নামে তোষামোদি প্রায় শিল্পের রূপ নিয়েছে আর নির্ভয়ে প্রয়োজনীয় কথা বলা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাংবাদিক শামসুজ্জামানের তৈরি সংবাদের কারণে তাকে গ্রেপ্তার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের; র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় হয়েছে দেশ। সংবাদ প্রকাশ করা সঠিক হয়েছে কিনা, গ্রেপ্তার করা এবং মামলা দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। বিতর্কটা তুমুল এবং বিষয়টাও তুচ্ছ নয়।
যদি প্রশ্ন করা হয়, একের স্বাধীনতা কি অন্যের নিরাপত্তাকে বিপদাপন্ন করে তোলে কিনা? স্বাধীনতার সীমা এবং নিরাপত্তার মাপকাঠি কী হবে? আইন করে নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে নাকি স্বাধীনতাকে সংকুচিত করা হবে? বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ বলতে কী বোঝাবে? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কাকে নিরাপত্তা দেবে? এসব প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সাম্প্রতিক প্রয়োগ নিয়ে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আশঙ্কা, আতঙ্ক ও আলোচনা তো কম হলো না। আইন প্রণয়নের সময় থেকেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বলেছিলেন এবং এখনো বলছেন এই আইনের অপপ্রয়োগ হবে না এবং আইনটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। গত বছর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার সঙ্গে সঙ্গেই কোনো সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হবে না। (সমকাল, ২১ মে ২০২২)। এতেই স্বস্তি ফেরেনি। কারণ আইনটা এমন যে, এর প্রয়োগটাও ভয় ধরাতে পারে।
২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত ৪২৬টি মামলা বিশ্লেষণ করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) দেখিয়েছে যে, এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৯১৩ জনকে। তাদের মধ্যে ১১ শতাংশের বেশি রাজনীতিবিদ এবং ১০ শতাংশের বেশি সাংবাদিক। এসব মামলায় আটক হয়েছেন ২৭৩ জন, যাদের মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ হচ্ছেন সাংবাদিক। গবেষণা থেকে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে তাতে দেখা যায়, রাজনীতিবিদরা বেশি অভিযুক্ত হলেও আটকের তালিকায় সাংবাদিকরাই আছেন বেশি।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কোনো সংবাদের বিরুদ্ধে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তিনি প্রতিকার পাওয়ার জন্য প্রেস কাউন্সিলে যেমন যেতে পারেন আবার মানহানিকর কোনো বিষয়ে প্রতিকার পাওয়ার জন্য দণ্ডবিধিতেই (৪৯৯ ধারা) বিধান রয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হওয়ার পর থেকে কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ বা সমালোচনামূলক এমনকি ইঙ্গিতপূর্ণ বা রসিকতামূলক ফেসবুক পোস্টদাতার বিরুদ্ধেও মানহানির অভিযোগ এনে মামলা হচ্ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এমন সব ব্যক্তি মামলা করছেন, যারা সরাসরি ওই সংবাদ ও ফেসবুক পোস্টের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নন।
এই আইনের সবচেয়ে বড় ভয় এবং যে দুর্বলতা (অনেকের ধারণা তা রাখা হয়েছে সচেতনভাবেই) সেটা হলো, এই আইনে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’র কোনো সংজ্ঞা নেই। ফলে রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিক অন্য যেকোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করতে পারছেন এবং এ আইনের এমনই দারুণ ক্ষমতা যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এমনকি মামলা হওয়ার আগেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে ফেলছে।
নাগরিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষার কথা বলা হলেও এই আইনের প্রধান লক্ষ্য যে সেটি নয়, তা বেশকিছু ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। ফলে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যম বা গণতন্ত্রের পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক।
ঘটনা যা ঘটে, তা বলা বা লেখা কি বিপদের কারণ হবে? সিজিএসের ‘দ্য আনএন্ডিং নাইটমেয়ার : ইমপ্যাক্টস অব বাংলাদেশ’স ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত ২৬ মাসে এই আইনের অধীনে ৮৯০টি মামলা দায়ের হয়। প্রতি মাসে গড়ে ৮৬ জনের বেশি মানুষসহ ২ হাজার ২৪৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।’
‘দ্য গ্লোবাল ফ্রি এক্সপ্রেশন রিপোর্ট-২০২২’-এর প্রতিবেদন অনুসারে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়’ সবচেয়ে তলানিতে থাকা ৫টি দেশের একটি। স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার এটাই বাস্তব চিত্র!
যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের আবেগ এবং গর্ব সেই যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বা ফিরে এসেছিলেন, বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন-আশার জায়গা ছিল অভিন্ন। সবারই প্রত্যাশা ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তা হবে সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক দেশ।
স্বাধীন দেশে শোষণমুক্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, সেখানে মানবাধিকার নিশ্চিত করা হবে, প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি প্রত্যেকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, নিরাপত্তা থাকবে জীবন ও সম্পদের।
সেই স্বপ্ন-আশার যেটুকু অর্জিত হয়েছে, যেটুকু হয়নি, না হলে কেন হয়নি দেশ স্বাধীনের পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসব প্রশ্ন জনগণের মনে আসাটাই তো স্বাভাবিক। সেই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে আবেগ তৈরি হওয়াটাও তো স্বাভাবিক! সেই আবেগ প্রকাশকে যদি স্বাধীনতার প্রতি কটাক্ষ আর ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাহলে স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ হবে কীভাবে?
ভোট ও ভাতের লড়াই এ দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের। কিন্তু এত উন্নয়নের পরও মানুষের পেটে ভাতের অবস্থা কী? গত ২৯ মার্চ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম তাদের এক গবেষণায় উল্লেখ করে, ‘প্রয়োজনের তুলনায় খাবার কম খাচ্ছেন নিম্ন আয়ের ৭১ শতাংশ পরিবার। গত ছয় মাসে তাদের জীবিকার খরচ ১৩ শতাংশ বেড়েছে। একবেলা না খেয়ে থাকছে ৩৭ শতাংশ নিম্নআয়ের পরিবার। ৭৪ ভাগ নিম্ন আয়ের পরিবার ধার করে চলছেন। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের নিম্ন আয়ের মানুষ ব্যাপকভাবে খরচ কমিয়েছে। পোশাক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।’
আবার বিবিএস রিপোর্টে বলছে, দেশের মূল্যস্ফীতি গত মার্চে ৯ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এই রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে কোনো শ্রমিক সংগঠন যদি বলে, এই সামান্য মজুরি দিয়ে কী করব? এই মজুরিতে সংসার চলে না। তারা যদি মজুরি বৃদ্ধির দাবি করে আন্দোলনে নামে, তাহলে কি গবেষকরা দায়ী হবেন? শিল্পে অসন্তোষের দায়ে অভিযুক্ত হবেন?
শাসক দলের কর্তাব্যক্তিরা সব সময় বলতে পছন্দ করেন যে, তাদের আমলে যে উন্নতি হচ্ছে তা বিগত কোনো আমলেই হয়নি। কথা তো সত্য। কারণ আগে যা হয়েছে, তা তো আর হওয়ার উপায় নেই। এখন যা হবে সব তো নতুনই হবে। ফলে সফলতার শ্লাঘা থাকবেই। কিন্তু এই আলোচনাও তো থাকতে হবে যে, আর কী কী হতে পারত? কেন হলো না সেই প্রশ্ন এবং সমালোচনাও তো থাকবে। ক্ষমতায় থাকলে সমালোচনা হবে, কেউ করবেন ভালোর জন্য আবার কেউ করবেন ত্রুটি দেখিয়ে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য।
কিন্তু সমালোচনাটা হবেই এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে জনগণের স্বার্থে সমালোচনা করতেই হবে। আর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা না থাকলে এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতা থাকলে জবাবদিহির পরিবেশ থাকে না আর তখন শাসকরা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। অগণতান্ত্রিক পরিবেশে সমালোচনা করা সম্ভব হয় না সেটা তো সবার জানা কথা। সে কারণেই নিবর্তনমূলক আইনের বিরোধিতা হয়েছে স্বাধীনতাপূর্ব এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সব সরকারের আমলেই।
কিন্তু জনগণ স্বাধীনতা চাইবে তার স্বপ্নের কথা, তার স্বপ্নভঙ্গের কথা বলার জন্য এবং নিরাপত্তা চাইবে তার স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া আছে। জনগণের বাকস্বাধীনতা আর ভাব প্রকাশের স্বাধীনতাকে কোনোভাবেই খর্ব করা হয়নি। বরং রাষ্ট্রকে বলা হয়েছে, যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ ছাড়া আর কোনোভাবে স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা না হয়। ফলে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ, তাই যদি কোনো নিরাপত্তা আইন দ্বারা জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করা হয় তখন প্রতিবাদ করেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করার অধিকার সংবিধান জনগণকে দিয়েছে।
রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক দ্বিপক্ষীয়। রাষ্ট্র যদি তার কর্তব্য পালন করতে না পারে তাহলে সমালোচনা করার একটি নৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকারও থাকে। এই সমালোচনা করলে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার আতঙ্ক থাকলে রাষ্ট্র এবং সরকার নিপীড়নের আইনি এবং আইনবহির্ভূত পদক্ষেপ নিতে থাকে। এতে শুধু গণতান্ত্রিক অধিকারই হুমকির মধ্যে পড়ে না, সরকারের প্রতি অসন্তোষটাও তীব্র হতে থাকে।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল। স্বাধীন বাংলাদেশে বয়স্কাউট সমিতি গঠিত হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে বিশ্ব স্কাউটস সংস্থার ১০৫তম সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ স্কাউটস সমিতি। ১৯৭৮ সালে বয়স্কাউট সমিতির নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ স্কাউটস’ নামকরণ করা হয়। মেয়েদের সুযোগ দেওয়ার জন্য ১৯৯৪ সালে গার্ল-ইন স্কাউটিং চালু করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ স্কাউটসের সদস্য ২২ লাখ ১০ হাজারের বেশি। গৌরব আর অর্জনে বাংলাদেশ আজ বিশে^র ষষ্ঠ বৃহত্তম স্কাউট দেশ। তবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের যাত্রা শুরু অনেক আগে। ১৯০৭ সালে রবার্ট স্টিভেন্সন স্মিথ লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল অব গিলওয়েল এই যুব আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা করেন। ২৯ আগস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ১৯০৭ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ব্রাউন-সী দ্বীপে ব্যাডেন পাওয়েল পরীক্ষামূলক ক্যাম্প আয়োজন করেছিলেন এবং সেখান থেকেই শুরু হয় বিশ্বব্যাপী স্কাউটিংয়ের পথচলা।
উন্নত সোনার বাংলার স্বপ্নসারথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রথম চিফ স্কাউট। অর্থাৎ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম প্রধান স্কাউট ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতার পর তিনি স্কাউটিংয়ের দীক্ষা নিয়ে চিফ স্কাউটের দায়িত্ব নেন। ১৯৭১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির ১১১নং অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় স্কাউট সংগঠনকে স্বীকৃতি দেন।
আজকের তরুণ, আগামীর বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, বাংলাদেশ আজ যতদূর এগিয়েছে, ভবিষ্যতে আজকের শিশু-কিশোর-তরুণ বাংলাদেশকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর তাই গত ২৫ জানুয়ারি গাজীপুরের মৌচাকে ৩২তম এশিয়া প্যাসিফিক ও একাদশ জাতীয় স্কাউট জাম্বুরির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন স্কাউট প্রশিক্ষণ পায়।’
বাংলাদেশ স্কাউটসের সোনালি পথ চলায় ৫০ বছর অতিক্রান্ত করে ২০২২ সালে আমরা উদযাপন করেছি বাংলাদেশ স্কাউটসের সুবর্ণজয়ন্তী। বর্তমান বাংলাদেশ স্কাউটসের চিফ স্কাউট হিসেবে আছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। যা যুব সংগঠন হিসেবে ২২ লক্ষাধিক স্কাউট সদস্যের গর্বের জায়গা। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ স্কাউটসের জাতীয় কাউন্সিলের ৫০তম বার্ষিক সাধারণ সভায় যোগ দিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মহোদয় বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, স্কাউটিং কার্যক্রমই পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রগতিশীল, সৃজনশীল ও উন্নয়নের পথে সম্পৃক্ত করে দেশকে জাতির পিতার কাক্সিক্ষত সোনার বাংলায় রূপান্তর করতে।’ বাংলাদেশে বর্তমানে স্কাউটের সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমাদের যুবসমাজকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কাউটিংয়ে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও স্কাউটিংয়ে সমানভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। মেয়েরা পিছিয়ে থাকলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। স্কাউট সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের গুণগতমানও নিশ্চিত করতে হবে।’ দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় দুর্গতদের পাশে স্কাউটদের উপস্থিতিতে মুগ্ধ হয়ে মহামান্য বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অগ্নিকাণ্ডসহ দুর্যোগকালে ক্ষতিগ্রস্তদের সেবাদানে স্কাউটরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।’
কিন্তু ছাত্ররা কেন স্কাউটিং করবে? আসুন একটা গল্প বলি। বাংলাদেশ স্কাউটসের সাবেক প্রধান জাতীয় কমিশনার মনযুর-উল-করিম একবার সারা দেশে সব কারাগারে তথ্য সংগ্রহের অভিযান চালালেন। সব আসামিদের জিজ্ঞাস করা হলো তারা কারাগারে আসার আগে জীবনে একটি দিনও স্কাউটিং করেছিল কিনা? সারা দেশের সব কারাগার খুঁজে একটিও আসামি খুঁজে পাওয়া যায়নি যে কিনা কখনো স্কাউটিং করেছে। অর্থাৎ স্কাউটরা সব সময় অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে। একজন মানবিক মানুষের স্বাদ পেতে হলে অন্যের বিপদে এগিয়ে যেতে হবে। তাই দেশের প্রতিটি দুর্যোগে স্কাউট ও রোভার স্কাউট সদস্যরা সেবার মন্ত্রে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়। বন্যায় পানিবন্দিদের উদ্ধার কাজ, অগ্নিকা-ে উদ্ধার অভিযান, মানুষকে শীতবস্ত্র বিতরণসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্কাউটদের সাড়া দিতে দেখা যায়। এই তো গত ৪ এপ্রিল রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৫০ ইউনিট, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করেছে বাংলাদেশ স্কাউটসের বিভিন্ন ইউনিটের রোভার স্কাউটরা।
ছাত্রজীবনে দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে অ্যাওয়ার্ড অর্জন করতে পারে কজন? একজন রোভার স্কাউট তার কার্যক্রম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সুযোগ পায় প্রেসিডেন্টেস রোভার স্কাউট অ্যাওয়ার্ড অর্জনের। যা দেশে রোভার স্কাউট বয়সীদের জন্য সর্বোচ্চ অ্যাওয়ার্ড। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিজে প্রতিবছর এই অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। এমন সোনালি অর্জনের সুযোগ ছাত্রজীবনে নিশ্চয় কেউ হাতছাড়া করতে চাইবে না। শুধু দেশে নয়, প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ স্কাউটসের সদস্যরা বিভিন্ন দেশের ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করে। যা একদিকে যেমন ছাত্রজীবনকে সমৃদ্ধ করে। একই সঙ্গে দক্ষ ও যোগ্য হয়ে উঠতে সহায়তা করে। নিজের প্রতি কর্তব্য পালন, সৃষ্টিকর্তার প্রতি কর্তব্য পালন এবং অপরের প্রতি কর্তব্য পালন এই তিন মূল মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে স্কাউটরা। স্কাউটদের মূলমন্ত্র হচ্ছে কাব স্কাউট যথাসাধ্য চেষ্ট করা, স্কাউট সদা প্রস্তুত এবং রোভার স্কাউট- সেবা। স্কাউটদের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, সৎ, চরিত্রবান, কর্মোদ্যোগী, সেবাপরায়ণ, সর্বোপরি সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্কাউটস কাজ করে থাকে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও মূল্যবোধ অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে দেশ ও জাতি গঠনে স্কাউট আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিহার্য।
লেখক: সদস্য, জনসংযোগ ও মার্কেটিং বিষয়ক টাস্কফোর্স বাংলাদেশ স্কাউটস
দ্বীপ দেশ শ্রীলঙ্কা সবময়ই সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল, বিশ্বজুড়েই খ্যাতি দেশটির সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, অপরূপ সমুদ্রসৈকত আর উষ্ণ আতিথেয়তার। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি ব্যাপকভাবে আলোচিত এর অর্থনৈতিক সংকট এবং এ থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে। গত ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় যখন দেশটির প্রধান বিমানবন্দরে নামলাম, আমাদের জন্য তখন অপেক্ষা করছিল বিস্ময়কর মিশ্র কিছু অভিজ্ঞতা। প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি গত কয়েক দিন এখানকার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে, বিভিন্ন এলাকায় বিচরণ করে।
বন্দরনায়েকে বিমানবন্দরে নেমেই কিন্তু শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকটের কোনো হদিস পাওয়া যায় না। বরং বিমানবন্দরটিকে আগের চেয়েও আরও বেশি ঝকঝকে, সাজানো-গোছানো মনে হলো। পর্যটক বা যাত্রীর সংখ্যা খানিকটা কম মনে হয়েছে অবশ্য। তবে পরিবর্তনের প্রথম পরিচয়টা পাওয়া যায় ইমিগ্রেশন বুথে যাওয়ার পর। সাধারণত শ্রীলঙ্কার ট্যুরিস্ট ভিসার আবেদন অনলাইনে করা যায়, অনলাইনেই ভিসা আবেদনের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে পাসপোর্ট দিলে সেখানে সাদা রঙের একটি ভিসা লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এবার আর সেই ভিসা দেওয়া হলো না, শুধু ‘এরাইভাল সিল’ দিয়েই কাজটা সারা হলো। যাত্রীর চাপ তেমনটা না থাকায় পুলিশের কাছে ভিসা না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি হাসতে হাসতেই বললেন, অযথা খরচের কী দরকার? বুঝতে অসুবিধা হয়নি মিতব্যয়ের প্রচেষ্টার কথা।
বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখলে প্রায় প্রতিবারই ইমিগ্রেশন পুলিশ কেন এসেছি, কদিন থাকব ইত্যাদি কয়েকটা প্রশ্ন করতেন, এবার একদমই কোনো প্রশ্ন করলেন না। সম্ভবত দেশটি চায় পর্যটক বেশিসংখ্যক আসুক, এর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াগুলোও সহজ করে দেওয়া হয়েছে। ভিসার জন্য আমার অনলাইন আবেদন অনুমোদন করা হয়েছে আবেদনের কয়েক মিনিটের মধ্যেই।
সবকিছুতে খরচ কমানোর আরেকটা প্রমাণ পেলাম স্থানীয় সিমকার্ড কিনতে গিয়ে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে দোকানি জানালেন, ক্রয় রসিদ এসএমএসের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে চলে যাবে, কাগজে ছাপা কোনো রসিদ নেই। দেখলাম কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেই এসএমএস চলে এলো।
ধারণা করেছিলাম, কলম্বোর দোকানগুলোতে হয়তো জিনিসপত্রের অভাব চোখে পড়বে। মনে হলো, শ্রীলঙ্কানরা প্রাথমিক সেই অর্থনৈতিক ধাক্কাটা সামলে নিয়েছে। বিমানবন্দরে ডিউটি ফ্রি শপগুলোতে নানা পসরার চাকচিক্য চোখে পড়ার মতো। বিমানবন্দর থেকে প্রায় আধা ঘণ্টা দূরের হোটেলে আসার পথে রাস্তার দুই পাশে দোকানপাটগুলোতে সাজানো পণ্যের পসরা অবাক করার মতো। হোটেলে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যাও দেখছি বেশ স্বাভাবিক। পর্যটন এলাকা নিগোম্বোতে বেশ রাত পর্যন্ত রেস্টুরেন্টগুলোতে পর্যটকদের হৈচৈ দেখলাম। আর জিনিসপত্রের দামও বিদেশি মুদ্রায় হিসাব করলে খুব একটা বেশি বলা যায় না, যদিও দেশটির মুদ্রার মান কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। এখানে রাতের বেশ ভরপুর খাবার খাওয়ার জন্য দিলাম ২ হাজার রুপি, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৬৫০ টাকার মতো।
নিগোম্বোর গ্রিনস রোড এলাকার শপিংমলগুলো দেখেও বোঝার কোনো উপায় নেই অর্থনৈতিক সংকটের কথা। অলঙ্কারের দোকান, ওষুধের দোকান, জামা-কাপড়ের দোকান কোথাও অপ্রতুলতার ছিটাফোঁটা নেই, বরং আছে প্রাচুর্য। স্থানীয় টুকটুকওয়ালা, স্থানীয় দোকানি, ক্রেতাদের মধ্যেও দেখা মেলিনি কোনো অস্বাভাবিকতা, সবকিছুই বরং স্বাভাবিক।
বলা বাহুল্য, ২০২১ সাল পর্যন্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় তুলনামূলকভাবে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ছিল স্পষ্টভাবেই ভালো। মানব উন্নয়ন সূচকে শ্রীলঙ্কা ছিল এই অঞ্চলের সবচেয়ে সেরা, গড় আয়ু ছিল ৭৭ বছর, এটাও এই অঞ্চলে সর্বোচ্চ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে বদলে গেছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, উচ্চমাত্রার ঋণ এবং কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবই মূলত এই সংকটের জন্য দায়ী। দেশটিতে বর্তমান সময়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে, শ্রীলঙ্কার রুপি মূল্যমান এখন সর্বকালের সর্বনিম্নে অবস্থান করছে।
শ্রীলঙ্কার মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ দীর্ঘদিনের, দেশটিতে এসেছিও কয়েকবার। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শ্রীলঙ্কার মানুষ এই সংকট কাটিয়ে উঠবে খুব শিগগির। আমার এই বিশ্বাস সাধারণ মানুষের নম্র, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের ওপর ভিত্তি করে। সংকট সমাধানের আশার আলোও উঁকি দিতে শুরু করেছে।
এখানে অনেকের সঙ্গে কথা বললাম দেশটির অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে, জানতে চাইলাম মূল শিক্ষণীয় বিষয়গুলো। মোটা দাগে সবাই রাজাপাকসে সরকার এবং তার পরিবারের অদূরদর্শিতাকেই দেশটির সংকটের জন্য দায়ী করা হয়। অনিয়ন্ত্রিত পরিবারতন্ত্রই দেশটির সংকটের প্রধান কারণ বলে প্রায় সব বিশেষজ্ঞই মনে করেন। শ্রীলঙ্কার মোট জাতীয় বাজেটের প্রায় ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করত একটি মাত্র পরিবার, রাজাপাকসে পরিবার। এই পরিবারের সদস্যদের ক্ষমতার অপব্যবহার দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
অবশ্য কোভিড-১৯ না এলে হয়তো সংকট প্রকট হতে আরও কিছুটা সময় বেশি লাগত। কোভিডের কারণে দেশটির আয়ের অন্যতম প্রধান খাত পর্যটন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভুল নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি। অন্যদিকে অহেতুক ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প দেশটিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে হয়।
শ্রীলঙ্কার সংকট কিন্তু জাতীয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে। অবকাঠামো এবং অত্যাবশ্যকীয় খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু এ ধরনের বিনিয়োগের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা জরুরি। বাংলাদেশে আমরা দেখছি অনেক টাকা ব্যয়ে নির্মিত অবকাঠামো বছরের পর বছর অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। খরচ হচ্ছে অস্বাভাবিক। এই বিষয়গুলো কিন্তু আশঙ্কা তৈরি করে। উন্নয়ন এবং অপচয়ের পার্থক্য কঠোরভাবে নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপনা করা না গেলে সংকট মোকাবিলা করা একটা সময় চলে যাবে সাধ্যের বাইরে।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী, যুগ্ম পরিচালক, কোস্ট ফাউন্ডেশন
১৮৯৪ সালের ৮ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন প্রখ্যাত বাঙালি ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার জন্ম ১৮৩৮ সালের ২৭ জুন চব্বিশ পরগনা জেলার কাঁঠালপাড়ায়। তার বাবার নাম যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের যে দুজন ছাত্র বিএ পাস করেন, তিনি ছিলেন তাদের একজন। বঙ্কিমচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে ভারত সরকারের চাকরি করেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কর্র্তৃপক্ষ তাকে ১৮৯১ সালে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি দেয়। পেশাগত জীবনে তিনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, তা তার চিন্তা ও কর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পেশাগত জীবনেই তার সৃষ্টিশীল মননের বিকাশ ঘটে। মফস্বলে চাকরিরত থাকাকালে তিনি বাংলার প্রকৃত অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংসর্গ ও তাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া থেকে তিনি তার উপন্যাসের চরিত্র গ্রহণ করেন। বারুইপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকা অবস্থায় তিনি ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ও ‘কপালকুন্ডলা’ রচনা করেন। উপন্যাস দুটি দ্রুত প্রচার লাভ করে। ১৮৮০ থেকে বঙ্কিমমনীষা রাজনীতি ও ধর্মের দিকে অগ্রসর হয়। সে সময় তিনি পুনরুত্থানবাদী সংস্কারক হওয়ার চেষ্টা করেন। ‘আনন্দমঠ’ তার শেষ উল্লেখযোগ্য কীর্তি। বাংলা উপন্যাস ও গদ্য সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। অতীতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার এবং পরবর্তী জীবনে সাহিত্যব্যক্তিত্ব হিসেবে নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও তিনি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের আবির্ভাব পর্যন্ত সবার কাছে, এমনকি শিক্ষিত মুসলিম সমাজের কাছেও সে সময়ের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে পরিগণিত হতেন।
বঙ্গবাজারে যখন আগুন লাগে, সুরিটোলার আফসার আলী তখন ভোরের দ্বিতীয় ঘুমে অচেতন। শেষ রাতে সাহরি খেয়ে নামাজ-কালাম পাঠ করে, ঘণ্টা দুয়েক আবার ঘুমানোর অভ্যাস তার। ‘ও বাপজান উঠো, দেখো আগুন, কত আগুন’! মেয়ে শরীফার ডাকে আচমকা হকচকিয়ে উঠে বসে আফসার আলী। ‘আগুন কোথায় রে মা’! ‘টিভিতে দেখাচ্ছে, বঙ্গবাজারেও, সেখানে না শহীদ মামার দোকান?’, ‘হরে মা! শহীদের দোকান, ভাড়া করা একটা গোডাউনও সেখানে। তা শহীদ এখন কোথায়?’ আফসার আলী তার শ্যালক শহীদ ওরফে শহীদুল খন্দকার, আদিনিবাস বারইখালী, মুন্সীগঞ্জ-কে মোবাইলে ফোন দেয়। ‘সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়’ বলে ফোনে নারীর রেকর্ড করা বেরসিক ভয়েস মেসেজটা আফসার আলীর রাগ আর আক্ষেপকে বাড়িয়ে দেয়। শহীদ গত সপ্তাহে তার কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকা কর্জ নিয়েছে। বলেছে, ‘‘দুলাভাই গেল দু’বছর ঈদে ব্যবসাপাতি ছিল না। এবার যদিও মানুষের হাতে টাকা পয়সা তেমন নেই। জিনিসপত্রের দামও নানান কারণে চড়া, তবু মানুষ কেনাকাটায় যতটা পারে আসবে। মার্কেটের দোতলায় ১৫ বাই ১৫ ফিট একটা ঘর গুদাম হিসেবে ভাড়া নিয়েছি। আর আমার নিজের ‘জেসমিন এ্যাটায়ার’ তো আছে। দেখি কিছু কামাই করতে পারি কিনা।’’ আফসার আলী অফিসের জিপিএফ থেকে লোন নিয়ে শহীদকে টাকাটা দেয়। তার এখনো তিন বছর চাকরি আছে। উপায় একটা হবেই। এখন শুধু শহীদ না, আফসার আলীও চোখে সরষের ফুল দেখছে। সে রোজা রেখেছে। সাড়ে ৯টায় অফিসে পৌঁছাতে হবে। কী যে করবে বুঝে উঠতে পারছে না। টিভি পর্দায় আগুনের লেলিহান শিখার তীব্র রোষ, যেন দোজখের আগুন। চারদিকে ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। এত বড় অগ্নিকা- এর আগে কেউ দেখেনি।
ভবনটির মাঝখান থেকে নাকি আগুনের সূত্রপাত। সংকীর্ণ পথের জন্য পানি ও নির্বাপক নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা সেখানে সহজে ঢুকতে না পারায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফায়ার সার্ভিসের হেড কোয়ার্টার পাশে, পাশে পুলিশ প্রধানের অফিসও। এমন একটা কৌশলগত জায়গায় কেন এমন একটা বিপজ্জনক ভবন এমন ঠাসাঠাসি ব্যবসা পণ্যের সমাহার নিয়ে এতদিন চলেছে, এর ব্যাখ্যা কেন কারও কাছে নেই? অতি কাছে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নগর ভবন। ঝুঁকিপূর্ণ এ ভবনের দেখভাল কাদের দায়িত্বে ছিল? গোটা দেশের আইনশৃঙ্খলা দেখার ছক আঁটা হয় যে দপ্তর থেকে- তার পেটের ভেতর এ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কেন, কীভাবে চলেছে? ফায়ার সার্ভিস পানি ও যন্ত্রপাতি নিয়ে যে ভবনে যেতে পারে না সে ভবন তাদের চোখের সামনে রইল কী করে? রাজউকের যে শাখায় বঙ্গবাজার ভবনের কাগজপত্র নকশা নথিপত্র, সে শাখার কেরানি কৌশলীরা এখন আজ কোথায়? ঝুঁকিপূর্ণ এই ভবন ভাঙার জন্য আদালতের স্থগিতাদেশ কবে প্রত্যাহার হবে কে জানে? কে কাকে তদবির তদারকি করবে?
‘পুড়ে ছারখার’ বিরাট প্রশ্নবোধক দুশ্চিন্তার পোকারা আফসার আলীর মাথায় ঢুকে ঠোকরাচ্ছে। দেশের অর্থনীতি এভাবে কেন বা কারও পোড়াচ্ছে? এই জমি দখলের লোভে? এখানে বিশাল ভবন নির্মাণের নাটক সাজানোর জন্য? মধ্যম আয়ের দেশের পথে হাঁটা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের, মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের কেনাকাটার দোকানে, তাও রোজা রমজানের মাসে ঈদের আগে এভাবে উৎসবের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে দেওয়া যায় না। অফিসে ফোন করে জানায় আফসার আলী, সে আজ অফিসে আসবে না। বঙ্গবাজারে আগুন লাগেনি আগুন লেগেছে তার কপালে, শ্যালক শহীদের সংসারে। তার শ^শুর মারা যাওয়ার সময় শহীদ সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। জামাই আফসার আলীর হাতে বলতে গেলে সংসার রেখে চোখ বুঝেন চুড়াইন মদনখালির মহাব্বত আলী খোন্দকার। আফসার আলী তার বিশ্বস্ত স্নেহভাজন বড় জামাই। আরেক সম্পর্কে ভাগিনাও। শহীদের সংসার তাকে দেখতে হয়। অফিস থেকে জিপিএফ লোন নিয়ে তার ব্যবসায় লগ্নি করাকে আফসার আলী শুধু দায়িত্ব মনে করেনি মনে করেছে শহীদ আর সে এক। দুজনের পরিবারের মধ্যে নেই কোনো ফারাক। সেই ফারাক সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল করোনা। কিন্তু এখন এই আগুন সব শেষ করে দিল।
আফসার আলী ভাবতে বসে। দেশের কর্তাব্যক্তিরা, পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন তারা কি দেশকে দেশের মানুষকে তাদের নিজের মনে করেন কিনা, তাদের পাত্তা দেন কিনা । বার্ন হাসপাতাল, একুশে হল, ফজলুল হক হল, ফুলবাড়িয়া, নগর ভবন, পুলিশ ভবন আর ফায়ার সার্ভিস ভবনের মাঝখানে বঙ্গবাজার।
ইদানীং ছুতানাতা কারণে যেখানে সেখানে আগুন লাগছে, মানুষ মারা যাচ্ছে সেটা জেনেও সতর্কতামূলক এমন কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়েছিল কি না , যার অবর্তমানে ব্যাখ্যাবিহীন কারণে হঠাৎ অকস্মাৎ মানুষ পুড়ে মারা যাবে, পুড়ে যাবে মালসামানা? হারিয়ে যাবে মা-মেয়ের নাকের নোলক, তাদের ছেলে-মেয়ের হাতের বইখাতা? বিগত বায়ান্ন বছরে শুধু আগুনে পুড়ে কত ক্ষতি হয়েছে, তা পত্রিকাগুলোর লাল অক্ষরে ছাপানো হেডলাইনে দুর্ভোগের অঙ্কের পরিমাণ যোগ করলে বোঝা যাবে- ক্ষতি সামান্য না অসামান্য। আজ আফসার আলীর মনে পড়ে যায়, রবীন্দ্রনাথের সামান্য ক্ষতি কবিতাটির কথা।
এতসব দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটির রিপোর্টগুলো একত্র করলে শহীদের ভস্ম হয়ে যাওয়া ১৫ বাই ১৫ ফুটের গোডাউনেও জায়গা হবে না। আফসার আলীর মনে পড়ে না এই সব তদন্ত রিপোর্টের ওপর কখনো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি না। ব্যবস্থা গ্রহণের অপারগতা অনাগ্রহকে ভবিষ্যতে এমন ধরনের ঘটনা ঘটার ইন্ধন বলা যেতে পারে।
আফসার আলীর ধারণা, তার মোটা বুদ্ধির বিবেচনায় রাজনীতির মধ্যে ‘পলিটিক্স’ ঢুকে দিন দিন জনসেবার পেশা থেকে শোষণের ব্যবসায় পরিণত হচ্ছে। ঔপনিবেশিক আমল বলে, এক সময় ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলকে গালমন্দ করে নিজেরা সাধু সাজা যেত। কিন্তু এখন নিজেরা এমন সব মন মানসিকতা চিন্তাভাবনা চেতনা ও মূল্যবোধের বিবরে বড্ড বেশি ঔপনিবেশিক হয়ে পড়ছে আফসার আলীর কেমন জানি তা মনে হয়।
এক সময় দরিদ্রতা মানে, খাদ্যাভাব সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত থাকা ইত্যাদিকে বোঝানো হতো। এখন যেন চিন্তা-চেতনার দরিদ্রতা, জনসেবায় দরিদ্রতা, দেশপ্রেম বোধের দরিদ্রতা আরও বেশি প্রকট। মধ্যম আয়ের দেশে ওঠা মানে কি জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা বা ওপরে ওঠা? খোদ জিডিপির উপস্থিতিকে খুঁজে পাওয়া যায় না জনজীবনের খাতায়। পাওয়া গেলেও গোয়ালের গরুর উপস্থিতির প্রমাণ মেলে না। ফলে দেখা যায়, চলাচল ব্যবস্থা দ্রুত করতে গিয়ে প্রশস্ত পথকে অপ্রশস্ত করা হচ্ছে, যানজট কমানোর লক্ষ্যে কঠিন দামে করা ব্যবস্থায় বরং যানজট বাড়ছে। সময় ও সমাজের সবার প্রয়োজন যে যানবাহন ও চলাচল ব্যবস্থা তাকে এড়িয়ে মাড়িয়ে অধিক ব্যয়ের ব্যবস্থাপনা এসে গণ-সুযোগ সুবিধাকে বড় সংকুচিত করে দিচ্ছে। জনবহুল দেশে বড় আকারের পাবলিক ট্রান্সপোর্টের পরিবর্তে প্রাইভেট ছোট ছোট বাহনের সংখ্যা বাড়িয়ে হযবরল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েই চলেছে। একজন মোটামুটি শিক্ষিত স্বল্পবেতনভুক কর্মচারী আফসার আলী যদি এটা বোঝে তাহলে বড় বড়দের মাথায় তা ঢোকে না কেন!
আফসার আলী ও তার স্ত্রী শেফালী বিকেলে বাড্ডায় শহীদের বাসায় সান্ত¡না দিতে যাওয়ার পথে পড়ে হাতিরঝিল। কী সুন্দর পথঘাট বানানো, গাছপালা লাগানো, টলটলে পানির লেক, তাকালে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আফসার আলী হঠাৎ বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পায় হাতিরঝিলের দক্ষিণ পাড়ে চার লেনের একাংশে অর্ধেক পুরোপুরি কেটে গর্ত করা হচ্ছে। মনে হয় কোনো বড় পাইপ টাইপ বসানো হবে। আফসার আলী একবার হাতিরঝিল প্রকল্পের নথিতে দেখেছিল এখানে পাখির অভয়ারণ্য থাকবে, ঝুলন্ত থিয়েটার, গুলশান পর্যন্ত যাতায়াতের নৌপথ, চারপাশের সার্কুলার রোডসমূহ দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনায় রক্ষণাবেক্ষণ উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছিল এখন এই মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে কী এমন প্রয়োজনে রাস্তা খোঁড়ার কাজ শুরু হলো তাও এই চৈত্র-বৈশাখে দুদিন পর বর্ষা শুরু হবে, তখন পরিবেশ কেমন হবে? আফসার আলী আরও শুনতে পেল, এই হাতিরঝিলের ওপর দিয়ে নাকি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হবে, সেজন্য শত শত পিলার বসানো হবে। একটা টলটলের পানির লেক চারপাশে গাছপালা শোভিত একটা মনোরম পরিবেশের মধ্যে পিলার বসানোর মতো বিতিকিচ্ছিরি কিসিমের কাজ কেন করা হবে লেকের ওপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হলে জলাধারের কী হবে এক্সপ্রেসওয়ের গাড়িঘোড়ার অসম্ভব চলাচলে, এক সময় রেলিং ভেঙে যদি কোনো বাস বা বেবি ট্যাক্সি পড়ে যায় লেকের মধ্যে তাহলে কেমন হবে? দিনচারেক পত্রিকায় হেডিং হবে আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সংবাদ পাঠিকা ‘এখন আমাদের প্রতিনিধি সাব্বির সেখানে আছেন... এখন পরিস্থিতি কেমন?’ ‘ধন্যবাদ লাবনী! ডুবুরিরা পাঁচটি মৃতদেহ উদ্বার করেছে। মাননীয় মন্ত্রী কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত উদ্ধারকাজ দেখতে এসেছিলেন। স্বয়ং সরকারপ্রধান সারা ক্ষণ খবরাখবর নিচ্ছেন বলে মন্ত্রী জানালেন...।’
ফায়ার ব্রিগেডের কর্তাব্যক্তি আজ বলেছেন, পর্যাপ্ত পানি তারা পাননি। বঙ্গবাজার ফুলবাড়িয়া এলাকায় আশপাশে পাঁচ-ছয়টা খাল ছিল, বড় বড় পুকুর ছিল সেগুলো থাকলে পুলিশ প্রধানের অফিস থেকে হাজার লিটারের পানি দিয়ে আগুন নেভানোয় হা-পিত্তেশ করতে হতো না। হাতিরঝিলের লেক এখন এই মহানগরীর অন্যতম জলাধার। এটাও খেয়ে ফেলার এই প্রয়াস কেন? আফসার আলী শুনেছে, তার এক বড় স্যারের কাছে হাতিরঝিলের ওপর দিয়েই হোটেল সোনারগাঁও থেকে রামপুরা বিশাল ফ্লাইওভার বানানোর প্রকল্প দাখিল হয়েছিল পরিকল্পনা কমিশনে। তাহলে ঝিলের পানি কি পচা গন্ধ হতে হতে এক সময় উর্বর সবজি ক্ষেত তারপর ঘরবাড়ি হবে?
পরিকল্পনা কমিশন থেকে, জলাধার সংরক্ষণ করে বর্তমানে যেভাবে আমরা দেখছি সেভাবে প্রকল্প বানাতে বলা হয়। মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে বুয়েটের মেধাবী ও সৃজনশীল প্রকৌশলীরা এমন সুন্দর পরিকল্পনাটি করেছিলেন। পরিবেশ রক্ষা, সৌন্দর্যবর্ধন এবং গণযাতায়াতের সহজতম পথ তৈরি আমরাই করতে পারি। আর আজ রাস্তা কাটা, এক্সপ্রেসওয়ে, লেকের মধ্যে পিলার বসানো এসব ভাবতে গিয়ে আফসার আলীর মাথা তালগোল পাকিয়ে যায়, সে প্রায়ই কিম্ভূতকিমাকার চিন্তাভাবনায় মগ্ন থাকে। এহেন অন্যমনস্কতার জন্য স্ত্রী শেফালীর কাছ থেকে বকাঝকা জোটে। আজ শহীদুলের বড় বিপদ। হাজার হাজার শহীদুলের মহাবিপদ। পুঁজি ও পণ্য পুড়ে ছাই। আফসার আলীকে ধাক্কা দেয় শেফালী। হাতিরঝিলের কী হবে এসব চিন্তা ছাড়ো। আগে শহীদুলের ব্যবসা, তার পরিবারের ভরণ-পোষণ কী হবে এসব ভাবো! আফসার আলী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- দেশে দরিদ্রতার পদোন্নতি হয়েছে আগে। বলত ভাত চাই, এখন বলে মাছ-মাংস চাই। আগে পরনে জুতা ও প্যান্ট ছিল না। এখন জুতা ও প্যান্ট পরে। সবার আগে কাঁচা ঘর ছিল এখন প্রায় পাকা ঘর, এই সব কথা বলে বলে বায়ান্ন বছরে এসব বড় বিবর্তন অফিসের কর্তাব্যক্তিরা আফসার আলীকে এভাবে উন্নয়নকে ইতিবাচক ভাবতে বলেছে। আজ বঙ্গবাজার অগ্নিকান্ডে হাজার হাজার শহীদুলের কপাল যে ভাবে পুড়েছে- সেটা দেখেশুনে আফসার আলীর কাছে ইতিবাচক-নেতিবাচক সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। এটা কেন হয়েছে, এর ভেতর নাশকতা ছিল কি না- এ নিয়ে নথি চালাচালি শুরু হয়েছে। আফসার আলীর হাসি পায়, কীভাবে কর্তাব্যক্তিরা সরকারের (রাষ্ট্রের নয়) পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে নিজেরাই অজান্তে নিজেদের দুষ্কর্মের স্মৃতি উজাড় করে দিচ্ছেন। এসব জেনে কী লাভ হয় আফসার আলী, শহীদুলের মতো মানুষদের? এ জন্য শহীদুল-আফসার আলী গংরা ইদানীং পেপার পড়া আর টিভি দেখা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ইউটিউব তাকে, অসম্ভব গুজবের খবরে ব্যর্থ আশায় চাঙ্গাও রাখে। ভুলিয়ে রাখে, সত্য বা আসল দুরবস্থা থেকে।
লেখক: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা উন্নয়ন অর্থনীতি বিশ্লেষক
নিজের বিদায়ী ম্যাচ বলেই কিনা জ্বলে উঠলেন সার্জিও রামোস। শুরুতেই পেয়ে যান গোলের দেখা। কিলিয়ান এমবাপ্পে আছেন তার আগের মতোই। তিনিও ডাবল লিড এনে দেন। তবে বিদায়ী ম্যাচে নিষ্প্রভ রইলেন লিওনেল মেসি। তাতেই কিনা শুরুতেই এগিয়ে যাওয়া ম্যাচটি হার দিয়ে শেষ করেছে পিএসজি।
লিগ ওয়ানের শেষ ম্যাচে ক্লেরমো ফুতের সঙ্গে ৩-২ গোলে হেরে গেছে প্যারিসিয়ানরা। তাতে রাঙানোর বদলে বিষাদভরা বিদায় হলো মেসি-রামোসদের।
আগেই লিগ শিরোপা নিশ্চিত করা পিএসজি মৌসুমে নিজেদের এই শেষ ম্যাচে দুটি পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নেমেছিল। হুগো একিতেকে ও আশরাফ হাকিমিকে ফেরান কোচ ক্রিস্তফ গালতিয়ের।
শুরুতে গুছিয়ে উঠতে সময় লেগেছে পিএসজির। প্রথম ১০ মিনিটের পর ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২১ মিনিটের মধ্যে এগিয়ে গিয়েছিল ২-০ গোলে। রামোস ১৬ মিনিটে হেড থেকে এবং তার ৫ মিনিট পর কিলিয়ান এমবাপ্পে পেনাল্টি থেকে গোল করেন।
২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে ক্লেরম ফুতের পাল্টা লড়াই শুরু করতে সময় নিয়েছে মাত্র ৩ মিনিট। ২৪ মিনিটে গোল করেন ক্লেরমঁর গাস্তিয়েন। এর প্রায় ১২ মিনিট পরই পেনাল্টি থেকে গোল করার সুযোগ নষ্ট করেন ক্লেরমঁ স্ট্রাইকার কেয়ি। পরে অবশ্য ৬৩ মিনিটে তাঁর গোলেই জিতেছে ক্লেরমঁ। প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে ক্লেরমঁর হয়ে সমতাসূচক গোলটি জেফানের।
বিরতির পর গোলের দারুণ একটি সুযোগ নষ্ট করেন মেসি। ৫৪ মিনিটে বাঁ প্রান্ত দিয়ে এমবাপ্পে ঢুকে পড়েন ক্লেরমঁর বিপদসীমায়। তাঁর ক্রস পেয়ে যান ডান প্রান্ত দিয়ে দৌড় বক্সে ঢোকা মেসি। সামনে গোলকিপার একা, কিন্তু মেসি অবিশ্বাস্যভাবে বলটা পোস্টের ওপর দিয়ে মারেন।
সতীর্থ গোলকিপার সের্হিও রিকোর সুস্থতা কামনা করে বিশেষ জার্সি পরে মাঠে দাঁড়িয়েছিলেন মেসি-এমবাপ্পেরা। ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে দূর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন রিকো। ম্যাচে বিশেষ জার্সি পরে খেলেছে পিএসজি। মেসি-রামোসদের জার্সির পেছনে রিকোর নাম লেখা ছিল।
৩৮ ম্যাচে ৮৫ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষে থেকে মৌসুম শেষ করল পিএসজি। ৮৪ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে লেঁস। তৃতীয় মার্শেইয়ের সংগ্রহ ৭৩ পয়েন্ট। ৬৮ পয়েন্ট নিয়ে চারে ইউরোপা লিগ নিশ্চিত করা রেঁনে।
এক যুগের ব্যবধানে ঘটা সহিংসতার দুটি ঘটনায় করা তিন শতাধিক মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর তদন্ত করে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মামলাগুলো ২০০১ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা এবং ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়ের করা হয়েছিল। পাশাপাশি যেসব মামলা বিচারাধীন আছে সেগুলোও দ্রুত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে পুলিশের সব ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে।
পুুলিশের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনে আসা ‘ভিআইপি অভিযোগগুলো’ আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশ ও দুদক সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নতুন করে তদন্ত করার সময় অহেতুক নিরপরাধ লোকজন যাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। মামলায় যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে আরও গভীরে গিয়ে তদন্ত করতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ২০০১ ও ২০১৩-২০১৫ সালে সহিংসতা মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করতে বলা হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানান, রাজনৈতিক কারণে মামলা জিইয়ে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। সব সরকারের আমলেই এসব করা হচ্ছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে তান্ডব চালিয়েছিল এই নিয়ে দেশে বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাসহ অনেকেই আসামি হয়েছেন। ২০১৩-২০১৫ সালে সহিংতার ঘটনা মামলা হয়েছে এসব মামলা দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন ও যেসব মামলা আদালতে বিচারাধীন আছে সেগুলোর দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দিনের পর দিন ওইসব মামলা আদালতে ঝুলছে। এতে ভুক্তভোগীরা বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই যারা এসব অপকর্ম করেছে তাদের তাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে।
সহিংসতা মামলার পাশাপাশি গত ১০ বছরের ব্যবধানে দুর্নীতি দমন কমিশনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ‘ভিআইপি অভিযোগগুলো’ অনুসন্ধান করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি ও জামায়াত ২০১৩-২০১৫ সালে তান্ডবলীলা চালিয়েছে। ২০০১ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক অত্যাচার করা হয়েছিল। ওইসব মামলার বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তাছাড়া আন্দোলনের নামে ঢাকাসহ সারা দেশে তান্ডব চালিয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট। সারা দেশেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব মামলা কী অবস্থায় আছে তাও পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতা করে যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল, তাদের বিচার করা হবে। এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। তবে নিরপরাধ কাউকে আমরা হয়রানি করছি না। ভবিষতেও করব না।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে একটি মহল দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। তাদের দমন করতে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে হবে না। এতে সাধারণ জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। আন্দোলনের নামে তারা জ্বালাও-পোড়াও করে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। এসব ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি যেসব মামলা আদালতে রয়েছে সেগুলোর বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।
একই কথা বলেছেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, হামলায় পেশিশক্তি যেমন থাকে, রাজনৈতিক শক্তিও থাকে। সাধারণভাবে এমন একটি ধর্মীয় জিগির তোলা হয় তখন অনেক ক্ষেত্রেই সব দল এক হয়ে হামলা চালায়। বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। যারা এসব অপকর্ম করছে তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি যেসব মামলার তদন্ত শেষ হয়নি তা সঠিকভাবে তদন্ত করতে হবে। ঢালাওভাবে রাজনৈতিক নেতাদের দোষারোপ করা যাবে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখনো বেশ কিছু মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। তাছাড়া জ্বালাও-পোড়াওয়ের অনেক মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। সবমিলিয়ে অন্তত তিন শতাধিক মামলা হবে। এসব মামলা সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে পুুলিশের সব ইউনিটকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে বিচার না হওয়ায় আবারও একটি মহল দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, স্পর্শকাতর মামলায় দীর্ঘদিনে বিচারকাজ শেষ না হওয়ার কারণে বাদীপক্ষের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আসামিপক্ষ ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। আর এসব কারণে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঝুলে থাকা মামলাগুলো সক্রিয় করে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। তবে অহেতুক কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে বলা হয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার কারণ উদঘাটন এবং জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে ‘হিউম্যান রাইট ফর পিস’ নামের একটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। ২০০৯ সালের ৬ মে এসব নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয় আদালত। ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মো. সাহাবুদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন দীর্ঘ সময় তদন্ত করে ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে একটি প্রতিবেদন দেয়। তদন্তকালে কমিশন ৫ হাজার ৫৭১টি অভিযোগ পেয়েছিল। বিএনপি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাসহ অন্তত ১৮ হাজার নেতাকর্মী জড়িত ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। সহিংসতার পর বরিশাল বিভাগে ২ হাজার ১৮৯টি, ঢাকায় ১৮৪টি, চট্টগ্রামে ৩৫০টি, রাজশাহীতে ১১৭টি এবং খুলনায় ৪০৫টি হামলার ঘটনা ঘটে। তাছাড়া হামলায় খুলনা বিভাগে ৭৩, ঢাকা বিভাগে ৯২, রাজশাহী বিভাগে ৫৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৭, বরিশাল বিভাগে ৩৮ এবং সিলেট বিভাগে ২ জন হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। তারমধ্যে ভোলা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, যশোর, নাটোর, রাজবাড়ী, পাবনা, ফেনী, রাজশাহী, ঝিনাইদহ, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, দৌলতখান, চরফ্যাশন, লালমোহন, বোরহানউদ্দিন, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা এবং মৌলভীবাজার জেলায় হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড বেশি ঘটে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২২১টি। এর মধ্যে ৫৭টি মামলা তদন্তাধীন। বাকিগুলোতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, ২০১৩-১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন কর্মসূচি চলাকালে পেট্রলবোমা হামলায় দেশজুড়ে মারা গেছে শতাধিক নিরীহ মানুষ। তারমধ্যে আগুনেই পুড়ে মারা গেছে ৪০ জনের মতো। এ সময় রেললাইন পর্যন্ত উপড়ে ফেলাসহ সরকারি সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। ওই সময় মামলা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার। বেশির ভাগ মামলার তদন্ত হয়েছে। ৪৫০টি মামলা বিচারধীন। এসব মামলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা আসামি। তারা কৌশলে বারবার শুনানির তারিখ নেয়, যে কারণে মামলা পিছিয়ে যায়। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে, কয়েকটি তারিখ দেওয়ার পর মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা হবে।
এছাড়া ৩১২টি মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তদন্ত শেষ করে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে নাশকতা মামলার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বেশিরভাগ মামলার আসামি এলাকায় থাকেন না। তাদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করে অভিযোগপত্র দেওয়া তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে খুব কঠিন হয়ে যায়। আর যেসব মামলায় আদালতে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোরও বিচার কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না। তাছাড়া পলাতক আসামিদের বিষয়ে কিছু আইনি জটিলতার কারণেই দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পুনরায় নাশকতা ঘটানো হতে পারে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। এই নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। তার জানামতে, মামলাগুলো নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা একাধিক সভা করেছেন।
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, গত দশ বছরে দুদকে ‘অনেক ভিআইপির’ বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। ওইসব অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। অনুসন্ধানের জন্য আলাদা কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চা শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে চা শিল্প সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, বর্তমান সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে দেশে চায়ের উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আজ রবিবার (৪ জুন) জাতীয় চা দিবস উপলক্ষে গতকাল শনিবার দেওয়া এক বাণীতে এ কথা বলেন রাষ্ট্রপ্রধান।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, এক সময় চা ছিল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে দেশে চায়ের উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চা শিল্পের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ২০১৭ সালে 'উন্নয়নের পথনকশা : বাংলাদেশ চা শিল্প' অনুমোদন দিয়েছে।
মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, চা শিল্পের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন চা শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধিসহ তাদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বাসস্থান, শৌচাগার ও নলকূপ স্থাপন, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধু মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে ল্যাবরেটরি ও লাইব্রেরি স্থাপনের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রম জোরদারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত চা শিল্প পুনর্গঠনে বাগান মালিকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ও অবকাঠামো উন্নয়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেন। তিনি ১৯৭৩ সালে শ্রীমঙ্গলের টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করেন। এটি বর্তমানে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) হিসেবে দেশের চা গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ বছর চা দিবসের প্রতিপাদ্য 'চা দিবসের সংকল্প, শ্রমিকবান্ধব চা শিল্প' অত্যন্ত যথার্থ হয়েছে বলেও মনে করেন রাষ্ট্রপ্রধান।
মো. সাহাবুদ্দিন আশা প্রকাশ করেন, চা শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ চা বোর্ডসহ চা শিল্প সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
রাষ্ট্রপতি 'জাতীয় চা দিবস ২০২৩' উপলক্ষে নেওয়া সব কর্মসূচির সফলতা কামনা করেন।
দুর্ঘটনা ঘটেছিল শুক্রবার রাতে। তারপর থেকে আসছিল হতাহতের ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। তবে প্রকৃত ভয়াবহতার চিত্র ফুটতে শুরু করে গতকাল শনিবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে। সকালে দেখা যায় তিনটি ট্রেনের বেশিরভাগ কামরা পড়ে আছে মাটিতে। কোনো কামরা পুরোপুরি উল্টে গেছে। কোনোটি আবার উঠে গেছে আরেকটির ওপর। আশপাশে, সামনে-পেছনে শুধু মৃতদেহ। কয়েক ঘণ্টা আগেও যারা বেঁচে ছিলেন, যাদের চোখে স্বপ্ন ছিল তারা লাশ হয়ে পড়ে আছেন খোলা আকাশের নিচে। আহত ও স্বজনহারাদের আর্তনাদ-হাহাকার আর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দে গতকাল সারা দিনই বিভীষিকাময় ছিল ভারতের ওড়িশার বালাশ্বরের কাছের বাহানগায়ের বাতাস। ওড়িশা রাজ্যে ঘোষণা করা হয়েছে এক দিনের শোক।
শুক্রবার রাতে বালাশ্বরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর উদ্ধার শেষে দেশটির সরকার ২৮৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যাও হাজার ছুঁইছুঁই করছে। উদ্ধারকাজ শেষ হলেও এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও মানুষ আটকে থাকার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। উদ্ধারকাজের নেতৃত্ব দেওয়া ওড়িশা ফায়ার সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেল সুধাংশু সারাঙ্গি জানান, নিহতের সংখ্যা ২৮৮। অবশ্য উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার পর রেল কর্র্তৃপক্ষ জানিয়েছে নিহতের সংখ্যা ২৬১। ভারতের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াও দাবি করেছে নিহতের সংখ্যা ২৬১। দেশটির আরেক সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিও প্রথমে ২৬১ জনের কথা বললেও গতকাল সন্ধ্যার পরে তারা নিহতের সংখ্যা ২৮৮ বলেই জানায়। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। দেশটির কেন্দ্রীয় রেল মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অমিতাভ শর্মাও তেমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘উদ্ধারকাজ শেষ হয়েছে। এখন আমরা সংযোগ পুনঃ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করব। তবে এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে মানুষ থাকার আশঙ্কা রয়েছে।’
এনডিটিভি জানায়, যাত্রীবাহী ট্রেন করমণ্ডল এক্সপ্রেস কলকাতা থেকে চেন্নাই যাচ্ছিল। বেলা ৩টার দিকে শালিমার স্টেশন থেকে ছাড়ে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ ট্রেনটি পৌঁছায় বালাশ্বরে। কাছেই বাহানগা বাজারের কাছে মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রেনটি। সে সময় তৃতীয় ট্রেন যশবন্তপুর-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসও এই দুর্ঘটনার শিকার হয়।
ওড়িশা রাজ্যের মুখ্যসচিব প্রদীপ জেনা দুর্ঘটনার পরপর জানিয়েছিলেন, দুর্ঘটনাস্থলে অন্তত ২০০টি অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ১০০ জন অতিরিক্ত ডাক্তার সেখানে সেবায় নিয়োজিত করা হয়েছে।
ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার কারণ কী, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। স্থানীয় মানুষ বলছে, মালগাড়ি গিয়ে ধাক্কা দেয় করমণ্ডল এক্সপ্রেসে। সেই ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। উল্টোদিক থেকে আসছিল সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। উল্টে যাওয়া কামরায় ধাক্কা লেগে সেই ট্রেনের অধিকাংশ কামরা উল্টে যায়। গতকাল দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজন ভারতের বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর আমি ১০ থেকে ১৫ জনের নিচে চাপা পড়ি। আমি ওই মানুষের স্তূপে সবার নিচে ছিলাম। আমার হাতে আর ঘাড়ে আঘাত লাগে। আমি যখন ট্রেনের বগি থেকে বের হই, তখন দেখি কেউ হাত হারিয়েছে, কেউ পা হারিয়েছে, কারও আবার মুখ সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে গেছে।’
এদিকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দেবেন রেলওয়ে সেফটি বিভাগের কমিশনার। এ সংস্থাটি বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে।
এখন পর্যন্ত দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও সিগন্যালের সমস্যার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি জানিয়েছেন, এই রুটে ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ প্রতিরোধী ব্যবস্থা ‘কবচ’ ব্যবহার করা হতো না। রেলওয়ের মুখপাত্র অমিতাভ শর্মা জানান, কবচ সিস্টেমটি এই রুটে নেই। বর্তমানে দিল্লি-হাওড়া এবং দিল্লি-বোম্বে রুটে কবচ স্থাপন করা হচ্ছে।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসের চারটি বগি ও ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়ে পাশের রেললাইনে পড়ে, যে লাইন দিয়ে যশবন্তপুর-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস যাচ্ছিল। দ্বিতীয় ট্রেনটির পেছন দিকের দুটি বগি তখন লাইনচ্যুত হয়।
রেলওয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ১২টি বগি বাহানগার বাজার স্টেশন পার করার সময় লাইনচ্যুত হয় এবং পাশের লাইনের ওপর পড়ে। সে সময় ওই লাইন দিয়ে হাওড়া এক্সপ্রেস ট্রেন যাওয়ার সময় সেগুলোর সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
পত্রিকাটির খবর অনুযায়ী, বাহানগা বাজার স্টেশনে চারটি রেললাইন আছে, যার একটিতে দুর্ঘটনার সময় একটি মালবাহী ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। যাত্রীবাহী ট্রেন দুটি ভিন্ন ভিন্ন লাইনে একে অপরকে বিপরীত দিক দিয়ে পার করার কথা ছিল। কিন্তু একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পাশের লাইনে পড়ে গেলে বিপরীত দিক থেকে আসা হাওড়া এক্সপ্রেসের সঙ্গে সেটির সংঘর্ষ হয়।
হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা বলছে, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ১৫টি কোচ লাইনচ্যুত হয়ে পাশের লাইনের ওপরে পড়ে এবং পরে হাওড়া এক্সপ্রেসের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে সেই ট্রেনের দুটি বগি লাইনের বাইরে চলে যায়।
অন্য একটি সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য হিন্দু পত্রিকা খবর প্রকাশ করেছে যে প্রথমে হাওড়া এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়। করমণ্ডল এক্সপ্রেস পশ্চিমবঙ্গ থেকে তামিলনাড়ু যাতায়াতের মাধ্যম। দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগে ট্রেনটি শালিমার স্টেশন অতিক্রম করে। পত্রিকাটি বলছে, মূলত তামিলনাড়ুতে কাজের জন্য ও উন্নত চিকিৎসার জন্য যারা গিয়ে থাকেন, তারা এই ট্রেন ব্যবহার করে থাকেন।
এদিকে বিবিসি বলছে, দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে উপস্থিত সাংবাদিকদের পাঠানো খবর ও ছবি দিয়ে সেখানকার সবশেষ পরিস্থিতির আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। রেললাইনসহ আশপাশের জায়গাগুলোতে ট্রেনে থাকা মানুষের জিনিসপত্র ছড়িয়ে রয়েছে। লাইনের পাশে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা মৃতদেহ সারিতে রাখা ছিল। কিছুক্ষণ পরপর এই মৃতদেহগুলো গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ট্রেনের বগির ভেতরে মানুষের স্যান্ডেল, কাপড় এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। উদ্ধারকাজ চলাকালে কয়েকজনকে পড়ে থাকা কাপড় ও দড়ির সাহায্যে টেনে বের করা হয়।
ওড়িশার মুখ্য সচিব প্রদীপ জেনা জানিয়েছেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত মানুষকে গোপালপুরে একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কিছু মানুষকে বালাশ্বর মেডিকেল কলেজেও নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের বাইরে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, বালাশ^র হাসপাতালের পোস্টমর্টেম বিভাগের বাইরে শত শত মানুষ ভিড় করেছে। শুক্রবার রাতেই ৫০০ ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রদীপ জেনা। মানুষ নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে এসে রক্তদান করে যাচ্ছে।
ভারতের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব শুক্রবার দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে ভুক্তভোগীদের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের আশ্বাস দেন। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, তদন্তের জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কেন দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা শিগগিরই বোঝা যাবে। এই দুর্ঘটনার দায় নিয়ে তিনি পদত্যাগ করবেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের চিন্তা মানুষের জীবন বাঁচানো ও উদ্ধারকাজ শেষ করা।’
রেলমন্ত্রী অশি^নী বৈষ্ণব বলেছেন, প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে ১০ লাখ রুপি করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া গুরুতর আহতদের জন্য দুই লাখ রুপি ও অপেক্ষাকৃত কম আহতদের জন্য ৫০ হাজার রুপি ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে শনিবার সন্ধ্যার দিকে ওড়িশায় ট্রেন দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিনি বলেছেন, এই মর্মান্তিক ঘটনায় যারা পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন তাদের পাশে রয়েছে সরকার। এটা বেদনাদায়ক ঘটনা। আহতদের চিকিৎসার জন্য সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। এটা গুরুতর ঘটনা। তিনি বলেন, এই দুর্ঘটনার প্রতিটি দিক বিবেচনায় নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দোষীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
ট্রেন দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের সঙ্গে ঘুরে দেখেন দুর্ঘটনাস্থল। পরিদর্শনকালে মমতা বলেন, এই দুর্ঘটনার পেছনে কিছু আছে। ভালো করে তদন্ত করতে হবে। তিনি অভিযোগ তোলেন, রেলের কাজে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের অ্যান্টিকলিশন ডিভাইস ছিল না। ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৮১ সালে। সে সময় অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন বিহার রাজ্যে সাইক্লোনের সময় লাইনচ্যুত হয়ে নদীতে পড়ে যায়। ওই দুর্ঘটনায় অন্তত ৮০০ মানুষ মারা গিয়েছিল।
তুমি জয়ী তুমি বীর
তুমি দুর্ভেদ্য প্রাচীর
তুমি অগ্নি তুমি সেই জ¦লন্ত মশাল
যাতে চিরন্তন প্রজ্বলিত থাকে অগ্নিশিখা
বৈরীর আঘাতে যখন তুমি হও ক্ষতবিক্ষত
অস্ত্র চলে ক্ষিপ্ত বেগে বজ্রশক্তির মতো
সৈনিক তুমি দাউ দাউ করে জ¦লতে থাকা
প্রজ¦লিত অগ্নিশিখা
সেনাবাহিনী তুমি বাংলা মায়ের সার্বভৌমত্ব রক্ষায়
দুই সীমানায় ঘাত-বিঘাতে শহীদ হওয়া হাজার প্রাণ
সেনাবাহিনী মানে সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা কান্না
সেনাবাহিনী মানে বাংলার মানুষের পূর্ণ আস্থা ও ভরসা
সেনাবাহিনী মানে দেশের সেবা অক্ষুন্ন রেখে
দেশবাসীকে বাঁচানোর লক্ষ্যে পথচলা
হয়তো তার মনের অবচেতনে জেগে ওঠে
মা-বাবা আর আপনজন
তব্ওু মনের গভীরে জেগে রয় তার শপথ বাণী
কখনো তোমার সম্মান ক্ষুন্ন হতে দেব না মাগো
তুমি যে আমার বঙ্গমাতা
তুমি যে সব দেশের রানী
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।