
জীবনের একটি দীর্ঘ ইনিংস খেলে নার্ভাস নাইন্টিতে বিদায় নিলেন বাংলাদেশজাত অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম, ৯ মে ২০২৩ ওয়াশিংটন ডিসিতে। বয়স ৯৪ বছর। বিশ্বব্যাংকের বড় চাকরি প্রিয়জনদের বাধার মুখে প্রত্যাখ্যান করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সরকারপ্রধান যেখানে চেয়ারম্যান, ডেপুটি চেয়ারম্যানই পরিকল্পনা কমিশনের কার্যত প্রধান পদ। তার নেতৃত্বে অসমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য থেকে সমাজতান্ত্রিক অভিযাত্রা সঠিক ছিল না ভ্রান্ত ছিল এ নিয়ে অর্ধশতক পরও বিতর্ক আছে। বিতর্কটা শতবর্ষ পরের বিশ্লেষকও যেমন এড়িয়ে যাবেন না, তেমনি শূন্য থেকে শুরুর যে চ্যালেঞ্জ নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রথম প্ল্যানিং কমিশন গ্রহণ করেছিল তার গুরুত্বকেও অস্বীকার করতে পারবেন না।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দোহাই কারও কারও বিদেশ গমন কিংবা প্রলম্বিত বিদেশবাসের অজুহাত হিসেবে তুলে ধরা হয়। ১৯৭৫-এ আমাদের অনেকেরই শিক্ষাজীবনের দ্বাদশ বর্ষও অতিক্রান্ত হয়নি। রাষ্ট্রক্ষমতার বৈধ বা অবৈধ যেকোনো ধরনের পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীনদের মর্যাদা লাঘবের ঘটনা হামেশাই ঘটে থাকে। পঁচাত্তরোত্তর বাংলাদেশ তাকে আর প্রত্যক্ষভাবে পায়নি। সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবী ও বাস্তবায়নকারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আবাস গেড়েছেন ধনতন্ত্রের পীঠস্থান যুক্তরাষ্ট্রে। অধ্যাপক ইসলাম একটি স্কিম অর্থনীতির পথ দেখিয়ে তার পরিণত জীবনের শেষে ৪৭ বছর অন্তরে বাংলাদেশ লালন করলেও বাংলাদেশ থেকে দূরেই ছিলেন। উত্থাপিত অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি, ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘অ্যান অডেসি : দ্য জার্নি অব মাই লাইফ’ গ্রন্থে। বহুল সমাদৃত এই বই থেকে কৌতূহলোদ্দীপক কিছু কিছু অংশ ভাষান্তর করা হলো। এটি মূলত পরিকল্পনা কমিশনের কথা।
পরিকল্পনা কমিশন পর্ব
একটি সদ্য স্বাধীন দেশ যার প্রশাসনিক আর্থিক এবং নিরাপত্তাজনিত স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই এটা যে কত বড় চ্যালেঞ্জ একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সেই সময় থেকে এতটা দূরে এসে তা অনুধাবন করা বর্তমান প্রজন্মের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
এই প্রেক্ষাপটে আমাকে অবশ্যই একটি ঘটনা স্মরণ করতে হবে, যা ধারণা দেবে সে সময় কর্মক্ষেত্রে কত ধরনের পরস্পরবিরোধী শক্তি সক্রিয় ছিল। ১৯৭২-এর মাঝামাঝি সময়, বাংলাদেশ তত দিনে বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়ে গেছে, প্রথম আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে এর মধ্যেই যোগ দিয়েছেন নরওয়ের জাস্ট ফাল্যান্ড। তিনি যখন পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা তখন থেকেই তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব, একই সঙ্গে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
এক দিন সকালে তিনি খুব উদ্বিগ্ন ও বিচলিত অবস্থায় আমার বাসায় এলেন। তিনি আমাকে যা বললেন তা বিচলিত হওয়ারই ব্যাপার। তিনি অস্থায়ী নিবাস হিসেবে যে হোটেলে থাকছিলেন, গতরাতে সেখানে একজন দর্শনার্থী আসেন। যে দর্শনার্থী এলেন তিনি নিজের পরিচয় দিলেন কোনো এক মেজর এম এ জলিল, জাসদ নামের একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। এটি মূলত ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে আসা একটি দল। জলিল ফাল্যান্ডের কাছে জানতে চেয়েছেন, যদি তার দল বর্তমান সরকার উৎখাত করে তাদের স্থলাভিষিক্ত হয় সে ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক নতুন সরকারকে সমর্থন এখনকার মতোই অব্যাহত রাখবে কি না? কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, প্রয়োজনীয় উন্নয়নের জন্য তিনি বিশ্বব্যাংকের সহায়তার ওপর আস্থা রাখতে পারেন কি না?
ফাল্যান্ড অবাক হলেন যে সরকারের বয়স মাত্র কমাস সে সরকার উৎখাতের প্রশ্ন আসছে কেন! এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়া সত্যিই চলছে কি না তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন।
আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, নিরঙ্কুশ গণসমর্থন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এ সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে সন্দিহান হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে এটা অবশ্যই সত্য, চরম বাম ভাবধারার অসন্তুষ্ট ক্ষুদ্র কিছু রাজনৈতিক দল রয়েছে যারা সরকারের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে অসন্তুষ্ট কিন্তু তাদের প্রতি গণসমর্থন নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। তারা শক্তি ও ক্ষমতার বিভ্রান্ত মোহে আক্রান্ত। এই হুমকি শাসক দলের রাজনৈতিক শক্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য আদৌ কোনো দুশ্চিন্তার বিষয় নয় ফাল্যান্ডকে তাই মনে করতে হবে। একই সঙ্গে আমিও বিস্মিত না হয়ে পারিনি, কঠোর সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ এমন একটি দল ধনতান্ত্রিক বিশে^র প্রধান দাতাসংস্থা বিশ্বব্যাংকের অর্থ সাহায্যের নিশ্চয়তা এমন আকুল হয়ে কেন চাইতে যাবে?
তারপরও মনে হলো একটি রাজনৈতিক ভাবাদর্শ আঁকড়ে থাকার পর দলটি যথেষ্ট বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই জানে যে অর্থনৈতিক অবস্থার পুনরুদ্ধার এবং উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। দৃশ্যত তারা অধিকতর বিশ্বস্ত এবং বন্ধুভাবাপন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের দিকে সাহায্য পাওয়ার জন্য হাত বাড়ায়নি, আবার তারা যে সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজনীয় আত্মত্যাগ করতে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে নিজেদের সক্ষমতা নিয়ে সে আস্থাও তাদের ছিল না।
১৯৭২ সালের শুরুতে কেমন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন সৃষ্টি হয়েছিল এটা তার একটি উদাহরণ।
***
পরিকল্পনা কমিশন এবং সরকাররে বাদবাকি অংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা বিরাজ করার মৌলিক কারণটিই হচ্ছে সরকার কর্তৃক অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের ভিন্ন একটি অঙ্গ সংস্থা প্রতিষ্ঠা। এটাই স্বাভাবিক শরীরের ক্ষেত্রেই হোক বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, যখন তাতে ভিন্ন একটি অস্তিত্বে প্রবেশ ঘটবে বৈরী হিসেবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে। যেহেতু অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা শিক্ষাঙ্গনের কিছু ব্যক্তির হাতে চলে গেছে আমলাতন্ত্র কমিশনকে তাদের ক্ষমতাহরণকারী হিসেবে বিবেচনা করেছে। আমার দুটি গ্রন্থে আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি : ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং ইন বাংলাদেশ (ইউপিএল ১৯৭৯) এবং বাংলাদেশ : মেকিং অব অ্যা নেশন (ইউপিএল ২০০৩)। রাজনৈতিক নেতৃত্বে সৃষ্ট সরকারের জন্য বাইরের বিশেষজ্ঞরা এত দিন ধরে প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানে যে চ্যালেঞ্জ ও বাধার সম্মুখীন হন তা বাংলাদেশের বেলায় কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত ও অগ্রগামী দেশেও তা ঘটেছে, হেনরি কিসিঞ্জার ‘হোয়াইট হাউজ ইয়ার্স’ গ্রন্থে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। কিসিঞ্জার অল্প সময়ের মধ্যেই আমলাতান্ত্রিক অন্তর্দ¦ন্দ্বের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে পুরোই ওয়াকিবহাল হয়ে উঠলেন যে নিজেই স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমলাদের কুপোকাত করে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর ও সেক্রেটারি অব স্টেট পদ দুটি সাফল্যের সঙ্গে নিজের অধিকারে রাখতে সমর্থ হন। আমার কিংবা প্ল্যানিং কমিশনের অন্য কোনো সদস্যের সেই মেজাজ, সেই সক্ষমতা বা অভিজ্ঞতা ছিল না যার মাধ্যমে আমলাতান্ত্রিক ম্যানিপুলেশন ও দ্বন্দ্ব ঠেকানো যায় কিংবা সেই দক্ষতাও ছিল না যা দিয়ে সরকারের ভেতর আমলাতন্ত্রের জোট ভেঙে আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়।
* * *
শুরুর বছরগুলোতে পরিকল্পনা কমিশনের কাজ নিয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ছিল। ...১৯৭৩ সালে আমার বন্ধু ও সহকর্মী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগ করলেন পরিকল্পনা কমিশন নিজেদের সর্বশক্তিমান মনে করে; তারা অন্য মন্ত্রণালয়ের উদ্বেগ ও বিবেচনা সম্পর্ক নিষ্পৃহ, বিশেষ করে বিদেশি সাহায্যের দর-কষাকষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা তাদের কাছে উপেক্ষিত, এই অভিযোগ শুনে আমি হতবাক। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন আর্থিক সংস্থা বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক এবং আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংকের মতো সবচেয়ে বড় দাতার সঙ্গে দর-কষাকষি দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক কোনো বিষয় না। ...দুটি বিশেষ ঘটনায় কানাডা ও যুগোসøাভিয়ার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রদূতকে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে এইড নিগোসিয়েশনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। কানাডার ক্ষেত্রে দেখা যায় রাষ্ট্রদূত তার আত্মীয়কে ঢাকায় কানাডিয়ান দাতা সংস্থার সাহায্য প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট নিয়োগ করার জন্য লবিং করছেন। কানাডিয়ান হাইকমিশনার আমার কাছে এই অভিযোগ করেছেন এবং ত্রাণ সহায়তা-সংক্রান্ত সব কর্মসূচি থেকে তাকে দূরে রাখার অনুরোধ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করি। শেষ পর্যন্ত এই হাইকমিশনারকে অন্য দেশে বদলি করা হয়। আর যুগোসøাভিয়ার রাষ্ট্রদূতের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি স্বয়ং নৌবাহিনীর জাহাজ ক্রয় এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন, এই রাষ্ট্রদূতকেও দর-কষাকষি থেকে বিরত রাখা হয়। অভিযোগ আনা হয় বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা কমিশন সৃষ্টি করে আমার নেতৃত্বে একটি সমান্তরাল সরকার চালানোর সুযোগ করে দিয়েছেন। সবাই মনে করেছেন সে সময় অসীম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দিয়ে পরিকল্পনা কমিশনকে করা হয়েছে একটি সরকার আর অবশিষ্ট মন্ত্রণালয় নিয়ে একটি সরকার। দুই সরকারের একটির দায়িত্বে স্বয়ং আমি। ...আমি প্রায়ই ভাবি এত কম আয়ুষ্কালের একটি পরিকল্পনা কমিশন নিয়ে তখন এবং পরবর্তীকালেও এত আগ্রহ ও সমালোচনা কেন সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৭৪-এর গোড়ার দিকে মোশাররফ হোসেন কমিশন ত্যাগ করেন, ১৯৭৪-এর শেষ দিকে কমিশন ছেড়ে যান রেহমান সোবহান। (আনিসুর রহমান ১৯৭৩ সালেই কমিশন ছেড়ে যান।) তখন কেউ কেউ বলতেন অধ্যাপকদের পরিকল্পনা কমিশন। এর গড় আয়ুষ্কাল ছিল তিন বছরেরও কম। যারা পরিকল্পনা কমিশন সৃষ্টি করেছিলেন তাদের মধ্যে আমিই ছিলাম সবচেয়ে দীর্ঘ সময়।
***
ভারতে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনুষ্ঠিত অনেক সভা ও সম্মেলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার আগে থেকেই বহু বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন সেক্টরের অর্থনীতিবিদের সঙ্গে আমার বিস্তৃত পেশাগত সংযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনর সময় এবং স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এই সম্পর্ক আরও গভীরতর হয়। আমার বন্ধু ও হার্ভার্ডের ক্লাসমেট পিএন ধর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সচিব ছিলেন। বহুল কথিত কাশ্মীরি মাফিয়াদের অন্যতম পিএন ধর প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার পর আমি যখন দিল্লিতে ছিলাম তার সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। ১৯৭২-এর প্রথম দিকে তার ঢাকা সফরের সময় আমরা অনানুষ্ঠানিক চায়ে মিলিত হয়েছি। আমরা অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ করেছি। বাংলাদেশ সরকার যে অর্থনৈতিক ও রাজনীতির পরিবেশ মোকাবিলা করছে তিনি তার সঙ্গে পরিচিত হতে চাচ্ছেন। গান্ধী সরকারের সমাজতন্ত্রের দিকে প্রবণতা থাকার বিষয়টি আলোচিত। ভারতের সরকারি খাত অনেক বড়, এর সঙ্গে জাতীয়করণকৃত ব্যাংক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয় অর্থনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। অবশ্য পিএন ধর নিজে সরকারি খাতের ব্যাপারে বিশেষ কোনো উৎসাহী ব্যক্তি নন, কোনো ভাষাদর্শেরও নন। তিনি বুঝতে পেরেছেন আওয়ামী লীগ সরকারি খাতনির্ভর অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে আছে। তিনি মনে করেন বাংলাদেশকে দিল্লির অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে।
পিএন ধরের পরামর্শই বাংলাদেশ শুনেছে, বেশ দেরিতে।
গণতন্ত্র সম্পর্কে এত যে কথা বলা হয়, তাতে ধারণা করা মোটেই অসঙ্গত নয় যে, গণতন্ত্র জিনিসটা কী সে বিষয়ে সবাই একমত। সেটা অবশ্য ঠিক নয়। গণতন্ত্র বলতে নানা মত আছে, কেউ ভাবেন গণতন্ত্র হচ্ছে নির্বাচিত সরকার, অন্যপক্ষ বলেন মোটেই না, গণতন্ত্র অনেক বড় ব্যাপার। এ হচ্ছে একটা পরিপূর্ণ সংস্কৃতি। সংজ্ঞা নিয়ে মতবিরোধ যতই থাকুক, গণতন্ত্র যে পরিচিত শাসন ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম এ নিয়ে তেমন একটা দ্বিমত নেই।
সর্বোত্তম কেন তাও আমরা জানি। কারণটা হচ্ছে এই যে, গণতন্ত্র ব্যক্তিকে মর্যাদা দেয়। কেবল মর্যাদা দেয় না, ব্যক্তির অধিকার, তার স্বার্থ, বিকাশ এসবকে বিবেচনার একবারে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে। অন্য শাসনব্যবস্থায় এমনটা ঘটে না। সেখানে একনায়কত্ব, স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি জিনিস নানা নামে কার্যকর থাকে। কয়েকজন শুধু স্বাধীনতা পায়, অন্য সবার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে, ক্ষমতা নাগরিকদের হাতে থাকে না, চলে যায় শাসকদের হাতে। ব্যক্তি ছোট ও কাবু হয়ে যায়।
ওদিকে আবার ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির সম্পর্ক নিয়েও সমস্যা আছে। যেখানে রাষ্ট্র থাকে সেখানেই এই প্রশ্নটা থাকে। সমস্যাটা সমাজেও আছে এবং থাকে। আসলে সমাজ যেখানে, রাষ্ট্রও তো সেখানেই। আর সমাজ আছে সবখানেই; মানুষ অরণ্য, দ্বীপ বা পাহাড়চূড়া, যেখানেই থাক না কেন, সমাজের প্রয়োজনটা তার সঙ্গেই থাকে। সঙ্গ ছাড়ে না। সমাজ ছাড়া মানুষ বাঁচে না; সম্পর্কটা মাছ ও পানির মতো না হলেও কাছাকাছি বটে।
ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির দ্বন্দ্বটাও খুবই স্বাভাবিক। আর এখানেই গণতন্ত্রের বিশেষ উপযোগিতা রয়েছে। গণতন্ত্র সবার স্বার্থ দেখতে চায় এবং ব্যক্তির স্বার্থকে মেলাতে চায় সমষ্টির স্বার্থের সঙ্গে। অর্থাৎ এমন একটা ব্যবস্থা চায় যেখানে ক্ষমতা বিশেষ কোনো কেন্দ্রে কুক্ষিগত থাকবে না, ছড়িয়ে থাকবে সমাজের সর্বত্র; এবং রাষ্ট্র শাসন করবে জনপ্রতিনিধিরা। এখানেই নির্বাচনের ব্যাপারটা আসে। জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয় যে, অনেকে ধারণা করেন যে, যেখানে নির্বাচিত সরকার আছে সেখানেই গণতন্ত্র রয়েছে।
কিন্তু সেটা যে সত্য নয় তা তো আমরা আমাদের দেশে নিজেদের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই জেনেছি। এখানে নির্বাচন হয় এবং সামরিক বাহিনীর সাহায্যে জোর করে ক্ষমতা দখলও চলে। তবে জবরদখল স্থায়ী হয় না। নির্বাচন আছে, এবং মনে করা হয় যে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিণামে যা পাওয়া যায় তা মোটেই গণতন্ত্র নয়, সেটা হচ্ছে নির্বাচিত স্বৈরাচার। আর সাধারণ অভিজ্ঞতা এটাই যে, স্বৈরাচার যদি নির্বাচিত হয়, অর্থাৎ নিজেকে বৈধ করে নেয় তবে তা অবৈধ স্বৈরাচারের চাইতেও ভয়ংকর হতে পারে। কেননা বৈধ স্বৈরাচার নিজেকে বৈধ মনে করে, ভাবে সে জনগণের রায় নিয়ে এসেছে, তাই যা ইচ্ছা তা করতে পারবে, যতটা সম্ভব আইন চালাবে, পাঁচ বছর পরে দেখা যাবে জনগণ তাদের কাজ পছন্দ করেছে কী, করেনি। বলা বাহুল্য, এ রকম শাসনকে গণতন্ত্র বলে না।
গণতন্ত্রের জন্য জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা আবশ্যক। কিন্তু তাও যথেষ্ট নয়, জবাবদিহিতা কার কাছে, স্বচ্ছতাই বা কতটা? আর ভোট? ভোটের তো কেনাবেচা চলে আরও বড় সমস্যা যেটা সেটা হলো নাগরিকদের সামনে আসলেই কোনো পছন্দ থাকে না; তারা দুই দল থেকে একটিকে বেছে নেয়। যাদের উভয়েই হচ্ছে অত্যাচারী। জনগণ কার হাতে অত্যাচারিত হবে, এর নাকি ওর ভোটের মধ্য দিয়ে এর বাইরে কোনো কিছুর মীমাংসা ঘটে না। এমন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলার কোনো মানেই হয় না।
গণতন্ত্রকে চিনতে হয় কয়েকটি উপাদান দিয়ে। উপাদানগুলো আমাদের খুবই পরিচিত; কিন্তু বারবার স্মরণ করা আবশ্যক। এদের মধ্যে প্রথম যেটি সেটি হলো অধিকার ও সুযোগের সাম্য। তারপর আসে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এবং অবশ্যই দরকার হবে সব স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন। এসবই পন্থা, উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তির স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও বিকাশকে নিশ্চিত করা। যথার্থ গণতন্ত্রের সঙ্গে তাই সমাজতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই; বলা যায়, আসল পার্থক্যটা নামেরই, অন্যকিছুর নয়। গণতন্ত্রে পৌঁছাবার পথটা যে মসৃণ নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেন যে মসৃণ নয় তাও বোঝা যায়। মূল কারণ কায়েমি স্বার্থ। যারা ক্ষমতা পেয়ে গেছে তারা সেটা জনগণের কাছে চলে যাক, এটা কখনই চায় না। চাইবার কথাও নয়, ক্ষমতা তাই শাসকশ্রেণির হাতেই থাকে, এক হাত থেকে অন্য হাতে যায়, কিন্তু বৃত্তের বাইরে যায় না। কায়েমি স্বার্থের বিশ্বব্যাপ্ত একটি রূপ রয়েছে, তার নাম পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ পুঁজির স্বার্থ দেখে, শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থকে পদদলিত করা ছাড়া তার স্বৈরাচার কায়েমি হতে পারে না।
পুঁজিবাদের তৎপরতার ভেতরে একটা বক্রাঘাত রয়েছে। ব্যক্তির জন্য স্বাতন্ত্র্যের বোধ তৈরিতে পুঁজিবাদের ভূমিকা আছে। ইহজাগতিকতার চেতনা, মানবাদিতা, মানুষের ভেতর বিশ্বজয়ের আকাক্সক্ষা এসব পুঁজিবাদের অবদান বৈকি; কিন্তু সেই পুঁজিবাদই আবার মানুষকে বন্দি করে ফেলেছে তার নিজের শাসনে। যারা উৎপাদন করে তারা বঞ্চিত হয়। অথচ পুঁজি আসে শ্রমজীবী মানুষের তৈরি উদ্বৃত্ত মূল্য থেকেই।
গণতন্ত্রের কথা পুঁজিবাদ গলা ফাটিয়ে বলে। বলতেই থাকে; থামে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশে ওদেশে গিয়ে সে হানা দেয়। মানুষ মারে। কিন্তু যার প্রতিষ্ঠা ঘটায় তা হলো পুঁজির স্বেচ্ছাচার। পুঁজিবাদীরা ঋণ দেয়। তাদের আছে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ বিভিন্ন সংস্থা। পুঁজিবাদীদের অধীনস্থ এনজিওরাও ঋণ দিয়ে থাকে। বিশ্ব পুঁজিবাদ রাষ্ট্রকে আটকায় ঋণের জালে, ক্ষুদ্র ঋণদাতারা গরিব মানুষকে বেঁধে ফেলে বিভিন্ন ধরনের দড়িতে। মূল পুঁজিটা আসে কোথা থেকে? আসে লুণ্ঠন ও জবরদখল থেকে। যে উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে টাকা আসে তাদেরই ঋণ দেওয়া হয়, নতুনভাবে শোষণের ইচ্ছায়। মাছের তেলে মাছ ভাজা হয়, ভক্ষণের স্বার্থে। এনজিওদের আসল কাজ দারিদ্র্য-বিমোচন নয়, আসল কাজ হচ্ছে একদিকে সেবক ও ক্রেতা সৃষ্টি করা, অন্যদিকে মানুষকে পুঁজিবাদী আদর্শে দীক্ষিত অবস্থায় রাখা।
আর আছে বাণিজ্য। মুনাফা লাভের যত বৈধ উপায় আছে তার মধ্যে বাণিজ্য হচ্ছে নিকৃষ্টতম। এ হচ্ছে ছদ্মবেশী লুণ্ঠন। ছদ্মবেশী বলেই বিশেষভাবে গর্হিত। পুঁজিবাদ বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য চালাচ্ছে; বলছে বাণিজ্য হবে উন্মুক্ত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যা দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে ধনী দেশের পণ্য গরিব দেশে বিক্রি করা। এর জন্য পুঁজিবাদীরা তদের নিজেদের উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়, বৃহৎ পরিমাণ উৎপাদনের সুযোগ নিয়ে উৎপাদন ব্যয় কমায়, গরিব দেশের শ্রম ভাড়ায় খাটায় এবং বিজ্ঞাপনের বিশাল আয়োজন করে। পাশাপাশি গরিব দেশের পণ্য যাতে ধনী দেশে ঢুকতে না পারে তার জন্য নানারকম বিধি বন্দোবস্ত ও অজুহাত খাড়া করে রাখে।
পুঁজিবাদীরা অবাধে জ্বালানি পোড়ায়। পরিবেশ নষ্ট করে। যে সমুদ্র মানুষের বন্ধু হওয়ার কথা তাকে শত্রুতে পরিণত করে। সমুদ্রের পানি উঁচু হয়, সেখান থেকে ঝড় আসে, বন্যার পানি সহজে নামে না, অন্যদিকে ভূমিতে দেখা দেয় পানির অভাব। আর সমাজ পরিণত হয় জঙ্গলে, যেখানে নিপীড়ন, সংঘর্ষ, ধর্ষণ চলতে থাকে। সব মিলিয়ে মানুষের বিপদ ঘটে। তার মুক্তি আসে না। প্রকৃত অর্থে উন্নতিও ঘটে না। তার বিপদ বাড়ে। প্রকট হয় বিচ্ছিন্নতা ও ভোগবাদিতা। এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনাই গণতন্ত্রের লক্ষ্য। কিন্তু পুঁজিবাদ কিছুতেই চাইবে না গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। কেননা গণতন্ত্র এলে ক্ষমতা পুঁজির হাত থেকে চলে যাবে জনগণের হাতে।
কিন্তু তাকে ভান করতে হয় গণতন্ত্র কায়েম করার। লোকে যাতে মনে করে যে তারা ক্ষমতাহীন নয়, কেননা তারাই ঠিক করে দেয় রাষ্ট্রের কর্তা কারা হবে। তাই সে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে বলে এটাই গণতন্ত্র। আসল অভিপ্রায়টা মনুষ্যত্ববিরোধী ব্যাপারটাকে বৈধতা দেওয়া এবং টিকিয়ে রাখা। ওদিকে কী শিল্প, কী গণমাধ্যম সবকিছুতেই প্রচার চলতে থাকে পুঁজিবাদী আত্মস্বার্থসর্বস্বতা ও ভোগবাদিতার। মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়; তাতে পুঁজিবাদের খুব সুবিধা, কারণ তাতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। এই ব্যবস্থায় গণমাধ্যম খুব কার্যকর থাকে, সে মনে করে যে সে স্বাধীন; কিন্তু তার গলায় থাকে দড়ি, বিপথগামী হতে চাইলেই টান পড়ে গলায়; গণমাধ্যম তখন সামলে নেয়, পুঁজিবাদের সেবায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে।
আমরা স্বাধীন হয়েছি ৫০ বছর। এই স্বাধীনতা সব মানুষকে স্বাধীন করেছে কি? না, করেনি। করেছে কতিপয় শাসক শ্রেণিকেই। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীন দেশে অনেক রক্ত ঝরেছে। নব্বইর গণঅভ্যুত্থানে সামরিক স্বৈরাচারের পতনেও অনেক আত্মদানের ঘটনা ঘটেছে। ওই যে নূর হোসেন বুকে পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ স্লোগান লিখে রাজপথে মিছিলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। তার আত্মত্যাগেও গণতন্ত্র আসেনি। স্বৈরাচারের পতনের পর আমাদের শাসকরা ওই অভ্যুত্থানের সঙ্গে, আত্মত্যাগীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতায় কসুর করেনি। কেবল পোশাক বদল হয়েছে। কিন্তু কায়মনের বদল ঘটেনি। তাই নব্বইর গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ে গণতন্ত্র আসেনি। বিপরীতে গণতন্ত্র হরণের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।
গণতন্ত্রের পথ তৈরি করার উপায় একটাই। সে হচ্ছে আন্দোলন। জনগণের আন্দোলন, মুক্তির লক্ষ্যে। সে-আন্দোলনকে একই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হতে হবে এবং তার সামনে থাকা চাই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মানবতার ধর্ম ইসলাম মায়ের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পবিত্র কোরআনের অন্তত পনেরো জায়গায় পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে, দেওয়া হয়েছে মাকে সম্মানের উচ্চাসন। আর একাধিক হাদিসের সারকথা হলো, মায়ের সেবা-শুশ্রƒষা দ্বারা জান্নাতের হকদার হওয়া যায়। মায়ের সন্তুষ্টি দুনিয়ার সাফল্য ও আখিরাতের মুক্তির কারণ।
সৃষ্টিজগতের মধ্যে সর্বাধিক অনুগ্রহকারী ও দয়াবান অন্তরের অধিকারী করে সৃষ্টি করা হয়েছে মাকে। সন্তানের ওপর মায়ের যে হক, তা পুরোপুরি পরিশোধ করার মতো নয়, এটা বিনিময়যোগ্য কোনো বিষয়ও নয়। সন্তানের জন্য মায়ের এক রাতের কষ্টের বিনিময় আদায় করা যাবে না কোনোভাবেই। মায়ের সঙ্গে নম্র আচরণ, যথাসাধ্য সেবা-শুশ্রƒষা এবং কায়মনোবাক্যে তার প্রতিদানের জন্য মহান প্রভুর দরবারে দোয়া করলে মায়ের হক সামান্য আদায় হতে পারে। বলা হয়, মা সন্তানের জন্য জান্নাতের পথ করে দেন। মায়ের সন্তুষ্টিই আবার সন্তানকে জাহান্নামে পৌঁছায়। যে সন্তান মায়ের সান্নিধ্য গ্রহণের পাশাপাশি মাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে, তারাই সাফল্যের সন্ধান পেয়েছে।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমার পালনকর্তা (কতিপয়) সিদ্ধান্ত দিয়েছেন (তা এই) যে, তোমরা শুধু তারই ইবাদত করবে এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। যদি তাদের মধ্যে একজন কিংবা দুজনই তোমার কাছে বৃদ্ধ বয়সে অবশ্যই পৌঁছে যায়, তাহলে (তাদের খিটখিটে ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে) তাদের তুমি উহ্ শব্দ বলবে না এবং তাদের ধমক দেবে না। আর তাদের সঙ্গে তুমি সম্মানজনক কথা বলবে এবং তাদের জন্য দোয়ার মধ্য থেকে নম্রতার বাহু ঝুঁকিয়ে দাও। আর তাদের জন্য দোয়াস্বরূপ এ কথা বলবে, হে আমার পালনকর্তা! তাদের দুজনের ওপর ওইরূপ দয়া করো, যেরূপ তারা আমাকে ছোটবেলায় লালন-পালন করেছিলেন।’ সুরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪
বর্ণিত আয়াত দুটিতে মহান আল্লাহ মানুষকে ৫টি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। ১. আল্লাহর ইবাদতের পরই পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, ২. পিতা-মাতাকে বৃদ্ধ বয়সে পেলে তাদের খিটখিটে মেজাজের কারণে বিরক্ত না হওয়া, ৩. তাদের ধমক না দেওয়া, ৪. তাদের মানসম্মান রেখে কথা বলা এবং শক্তির গরম না দেখানো ও ৫. তাদের প্রতি দয়া করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার নেয়ামতরাজিকে যেমন কেউ গণনা করে শেষ করতে পারে না, তেমনিভাবে পিতা-মাতার অনুগ্রহ কেউ হিসাব করে শেষ করতে পারবে না। কোরআন মাজিদ তাই আমাদের বলে, প্রথমে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে এর পর পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে। তবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অর্থ এই নয় যে, শুধু তাদের ধন্যবাদ বলবে, বছরের এক দিন তাদের সঙ্গে কাটাবে, ভালো কিছু উপহার ও পোশাকাদি দিয়েই দায়িত্ব শেষ বলে মনে করবে। বরং দায়িত্ব হলো, তাদের আরাম-আয়েশ, সুচিকিৎসা ও মানসিক প্রশান্তির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বলতে দ্বিধা নেই, সমাজের অনেকেই খুব ঘটা করে বছরের একটি দিনকে মা দিবস হিসেবে পালন করেন। দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এ মায়েরা শেষ বয়সে অনেকটা অযতে্ন-অবহেলায় কিংবা কোনো বৃদ্ধাশ্রমে জীবন পার করছেন। এমন আচরণ ও লোকদেখানো মনোভাব কাম্য নয়। ইসলামের শিক্ষা হলো, পিতা-মাতার প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে, যা আল্লাহর প্রতি এবং পিতা-মাতার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধকে প্রতিফলিত করে।
ইসলামের শুধু নিজের পিতা-মাতাকে ভালোবাসতে ও সম্মান জানানোর কথাই বলে না। বরং অন্যদের পিতা-মাতার সঙ্গেও অনুরূপ আচরণ করতে শিক্ষা দেয়। আর নবী করিম (সা.) মায়ের মর্যাদা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ ইসলামের এই বুনিয়াদি শিক্ষা মুসলিমসমাজে মায়েদের একটি সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান দান করেছে। পরিবারের সব সদস্যের কাছে মা তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ভালোবাসা ও সম্মানের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। ইসলামের বিধানে পিতা-মাতার জন্য ব্যয় করা সওয়াবের কাজ। ইসলাম বলে, আমরা যা কিছুই আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য খরচ করি না কেন, পরিবার কিংবা সমাজের অন্যান্য লোকের আগে প্রথমে পিতা-মাতার জন্য খরচ করতে হবে। অতএব, যদি কেউ তার পরিবারের সদস্যদের ওপর ব্যয় করে কিংবা সমাজের কোনো মহৎ কাজে ব্যয় করে, কিন্তু পিতা-মাতার অধিকার সম্পর্কে বেখবর থাকে, সে আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন করে।
পিতা-মাতার জন্য অর্থ-সম্পদ রেখে যাওয়াও ইসলামের বিধান। ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা এমন এক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে, যাতে শুধু অধস্তনরাই উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত হয় না; বরং ঊর্ধ্বতন পরম্পরাতেও উত্তরাধিকার বণ্টিত হয়। বিশ্বের অন্যসব সমাজব্যবস্থায় শুধু অধস্তনদের জন্য উত্তরাধিকারের আইন প্রচলিত। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে, যখন তোমাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হবে, যদি সে কোনো সম্পদ রেখে যায়, তবে পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয়দের জন্য ন্যায়ভিত্তিক অসিয়ত করবে। এটি মুত্তাকিদের দায়িত্ব।’ সুরা আল বাকারা : ১৮০
এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, এক ব্যক্তি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, সন্তানের ওপর মা-বাবার হক কী? নবী করিম (সা.) বললেন, ‘তারা উভয়েই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।’ অর্থাৎ তাদের আনুগত্য ও সেবাযতœ জান্নাতে নিয়ে যায় এবং তাদের সঙ্গে বেয়াদবি ও তাদের অসন্তুষ্টি জাহান্নামে পৌঁছে দেয়। হজরত ছাওবান (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দোয়া ছাড়া অন্যকিছু ভাগ্যকে বদলাতে পারে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদাচার ছাড়া অন্যকিছু আয়ুকে প্রলম্বিত করতে পারে না। কোনো ব্যক্তি তার পাপের কারণে তার রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়। ইবনে মাজাহ
হাদিসে জীবন প্রলম্বিত হওয়া সম্পর্কে বিজ্ঞজনরা বলেন, এ থেকে উদ্দেশ্য জীবনে সৎকাজের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, বছরের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়। যে ব্যক্তি পিতা-মাতার অনুগত সে জীবনে ভালো কাজ করার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ লাভ করবে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি পিতা-মাতার অবাধ্য হবে সে বিভিন্ন রোগ, শোক, দুঃখ বেদনা ও পেরেশানিতে আক্রান্ত হবে এবং জীবনে ভালো কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক
মণিপুর ভারতের ছোট একটি প্রদেশ। রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে হাজার মাইল দূরে মিয়ানমারের সামীন্তবর্তী এই প্রদেশটিতে নানা ধর্ম ও জাতির জনগোষ্ঠী বাস করে। উত্তর-পূর্ব ভারতের যে সাতটি রাজ্যকে একসঙ্গে ‘সেভেন সিস্টার’ বলা হয় মণিপুর তার মধ্যে একটি।
ভারতের অন্য বড় বড় রাজ্য ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অঞ্চল উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র বা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি রাজধানী দিল্লিতে আলোচিত হলেও উত্তর-পূর্বের ছোট রাজ্য মণিপুরের রাজনৈতিক আলোচনা রাজধানী দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে কিঞ্চিৎই। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে মণিপুরের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। মাত্র দুটি লোকসভা ও একটি রাজ্যসভার সিট রয়েছে মণিপুরে। খ্রিস্টান ও আদিবাসী অধ্যুষিত এই প্রদেশটিতে গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কোয়ালিশন সরকার গঠন করার পর কিছুটা আলোচনায় ছিল রাজ্যের রাজনীতি।
তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। জাতিগত অবিশ্বাস ও হিংসা, সেখান থেকে সংঘর্ষে অশান্ত মণিপুর। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত রাজ্যে ৫৪ জন নাগরিক নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অন্তত ২৩ হাজার মানুষ পার্শ¦বর্তী রাজ্যগুলোতে মাইগ্রেট করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজ্যের পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, ৩৫৫ ধারা রাজি করে রাজ্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার হাতে তুলে নিয়েছে। সেই সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীকে ‘দেখামাত্র গুলির’ নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
এই সংঘাতের সূত্রপাত মূলত জাতিগত অবিশ্বাস থেকে। মণিপুরের শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত ও প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী মূলত মেইতেই, এর বাইরে কুকি, অঙ্গামি, লুসাই, নাগা ও অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করে মণিপুর রাজ্যে। মেইতেই জনগোষ্ঠী হিন্দুধর্মের অনুসারী হলেও আদিবাসী জনগোষ্ঠী মূলত খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। মেইতেই শহরাঞ্চলে বাস করলেও আদিবাসীরা বাস করে পাহাড়ি অঞ্চলে। মণিপুরে বর্তমানে বিজেপির নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষ এবং ধর্মে হিন্দু। তবে আদিবাসী জনগোষ্ঠী কুকি, অঙ্গামি, লুসাই, নাগা ও অন্যদের আস্থা অর্জনে তিনি রাজধানী ইম্ফলের বাইরে গিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক করে আলোচিত হয়েছিলেন।
মেইতেই জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠী হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে তারা নিজেদের ‘বঞ্চিত’ বলে দাবি করছে। তারা মনে করছে রাজ্যে তাদের চেয়ে আদিবাসীরা বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। এ ছাড়া একটা পরিসংখ্যান এই আলোচনায় ঘি ঢেলে দিয়েছে। ১৯৫১ সালের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে মণিপুরে মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষ ছিল মোট জনসংখ্যার ৫৯ শতাংশ, ২০১১ সালের পরিসংখ্যানে সে অনুপাত এসে দাঁড়িয়েছে ৪৪ শতাংশে। মেইতেই জনগোষ্ঠী মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠী হলেও তারা মূলত শহরাঞ্চলে বসবাস করে। ফলে এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রদেশের মাত্র ১০ শতাংশ ভূমিতে তারা বাস করে, বাকি ৯০ শতাংশ ভূমিতে (পাহাড়ি অঞ্চল) আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সংবিধানের ৩৭১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মণিপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে শুধু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষই জায়গা জমি কিনতে পারে। আইন অনুসারে পাহাড়িরা রাজ্যজুড়ে জমি কিনতে পারলেও মেইতেইরা পাহাড়ে জমি কিনতে পারে না। মেইতেই জনগোষ্ঠীর অভিযোগ, পাহাড়িরা তাদের জমি কিনে নিচ্ছে।
মূল সহিংসতার আগে আরও কিছু ঘটনা মূলত সহিংসতাকে উস্কে দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধ পোস্ত চাষের অভিযোগে এর আগে পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান চালিয়েছিল সরকারের বিশেষ বাহিনী। অবশ্য কুকিরা অভিযোগ করছিল এসব অভিযানের মাধ্যমে রাজ্য সরকার মূলত পাহাড়ে মেইতেইদের ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে মেইতেইদের অভিযোগ, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের তাড়া খেয়ে এসে বহু ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ সাম্প্রতিক সময়ে মণিপুরে আশ্রয় নিয়েছে। যেভাবে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ ঢুকে পড়েছে বলে একটি শোরগোল তোলা হয় অনেকটা সেরকম একটা আলোচনা চলছিল যে, পাহাড়ে মিয়ানমার থেকে ‘অনুপ্রবেশকারীরা’ ঢুকে পড়েছে। এ ছাড়া পাহাড় থেকে কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাড়িঘরও উচ্ছেদ করেছে রাজ্য সরকার। সরকার অবশ্য বলছে এসব বাড়িঘর সরকারের ‘রিজার্ভ ফরেস্টে’র অংশ, ফলে এখানকার বাড়ি উচ্ছেদ করার আইনগত অধিকার সরকারের রয়েছে। কিছুদিন আগে অবৈধ উপায়ে জমি দখলের অভিযোগে পাহাড়ি অঞ্চলের তিনটি গির্জাও ভেঙে দেয় মণিপুরের রাজ্য সরকার। এই ঘটনায় কুকিসহ অন্যান্য খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আদিবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছিল। যেহেতু মেইতেই জনগোষ্ঠী হিন্দুধর্মের ও আদিবাসীরা খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী, ফলে ধর্মের সমীকরণ এখানে জড়িয়ে পড়ছে।
বর্তমান সহিংসতার শুরু মূলত আদালতের একটি রায়কে নিয়ে। গত ৩ মে হাইকোর্ট একটি রায়ে মেইতেই জনগোষ্ঠীকেও ‘তপশিলি উপজাতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য রাজ্য সরকারকে সুপারিশ করে। রাজ্যে যারা ‘তপশিলি উপজাতি’ তারা নানা ধরনের বিশেষ সংরক্ষিত সুবিধা পায়। মেইতেইরা ‘তপশিলি উপজাতির’ তকমা পেয়ে গেলে তারাও পাহাড়ের জমির মালিকানা দাবি করতে ও মালিক হতে পারবে। এই রায়ের পর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। রায়ের প্রতিবাদে ‘অল ট্রাইভস স্টুডেন্ট ইউনিয়ন’ বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিলে সেখান থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সে সহিংসতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যে বিশেষ নিরাপত্তা সংকট তৈরি হয়েছে।
মণিপুরে যেসব আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে তার মধ্যে কুকি চিন হলো প্রধান। তাদের এই রাজনৈতিক সচেতনতা ও প্রতিবাদকে সরল রৈখিকভাবে দেখছে না ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। যেহেতু তাদের সঙ্গে সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের কিছু জনগোষ্ঠীর শারীরিক গঠনে মিল রয়েছে, ফলে তারা ভারতে এসে মিশে যাচ্ছে বলে একটা সতর্কতা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে রয়েছে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে তাদের অনেকে আবার বর্তমানে শিবিরে রয়েছে। রাজ্যের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে মিয়ানমার থেকে যেন কেউ ভারতের প্রবেশ করে পরিস্থিতি আরও জটিল করতে না পারে তা নিয়ে সীমান্তে আসাম রাইফেলস নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কঠোর করেছে। কুকি চিনকে নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আরও মাথাব্যথার কারণ হতে পারে তাদের স্বাধীকারের চিন্তা তৈরি হওয়া নিয়ে। কুকি চিন নামে একটি জাতিগত কোয়ালিশন বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের একটি অংশ নিয়ে নিজেদের জন্য আলাদা রাজ্য ঘোষণা করেছিল। এই পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবানে এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কুকি চিনদের একটি অংশ আবার মিয়ানমারেও বাস করে। বাংলাদেশে যারা রাজ্য দাবি করেছিল তারা সশস্ত্র। ফলে এই অঞ্চলে একটি কুকি চিন জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে পড়ে কিনা সেটা নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্বেগ থাকতে পারে। যেহেতু তাদের কেউ কেউ সশস্ত্র। তাই এই উদ্বেগকে একেবারে হালকা করার সুযোগ নেই।
তবে মণিপুরে এমন সময়ে একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যখন ভারতের কেন্দ্রীয় লোকসভা নির্বাচনের বাকি ১ বছরের কম সময়। এর আগে পাঞ্জাবে শিখ জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলন দমন করতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। লাদাখে চীন- ভারতের সংঘর্ষে ভারতের ভূমিকা যথাযথ ছিল না বলেও বিরোধীরা কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করছে। এ ছাড়া বিজেপির নিয়োগকৃত জম্মু কাশ্মীরের সাবেক গভর্নর সত্য মালিক কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে যে ৪০ সিআরপিএফ জওয়ান নিহত হন তাতে প্রশাসনের গাফিলতি ছিল বলে দাবি করেন। এ ছাড়া সে সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাকে ‘চুপ’ থাকতে বলা হয়েছিল বলে দাবি তার। তার এই দাবির পর কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসসহ বিরোধীরা বিজেপিতে একহাত নিয়েছে। সেখানে যুক্ত হয়েছে পাঞ্জাবের শিখ মুভমেন্ট ও মণিপুরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। সব মিলিয়ে ভারতের বিজেপি সরকারকে বেশ কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে।
মণিপুরে যখন এমন পরিস্থিতি যখন দক্ষিণের রাজ্য কর্ণাটকে চলছে বিধানসভা নির্বাচন। এই রাজ্যটি দক্ষিণ ভারতে বিজেপিশাসিত একমাত্র রাজ্য। অন্যদিকে কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের বাড়ি এই রাজ্যে। রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ এই রাজ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে বলে দাবি করছে কংগ্রেস এবং বিধানসভায় জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। অন্যদিকে দক্ষিণের একমাত্র শাসিত রাজ্য ধরে রাখতে মরিয়া বিজেপি। এই নির্বাচনের ফলাফল যা হোক তা আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনে বড় একটি প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া কাশ্মীর এটাক নিয়ে সত্য মালিকের মন্তব্য, পাঞ্জাব ও মণিপুর পরিস্থিতিও লোকসভা নির্বাচনে ফ্যাক্টর হতে পারে। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে নয়াদিল্লি শাসন করা বিজেপির জন্য আগামী লোকসভা নির্বাচন এবং নির্বাচন-পূর্ববর্তী এক বছর বেশ কঠিন সময় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
১৯৭১ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন প্রখ্যাত মুসলিম সমাজ সংস্কারবাদী প্রবন্ধকার সাহিত্যিক সা’দত আলি আখন্দ। বগুড়ার চিংসাপুর গ্রামে ১৮৯৯ সালের ১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার বাবা সানিউদ্দিন আখন্দ এবং মা করিমুন্নেছা। তিনি বগুড়ার করোনেশন স্কুল থেকে ১৯১৬ সালে প্রবেশিকা, ১৯১৮ সালে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯২০ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে বিএ অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথমে কিছুদিন স্কুলে শিক্ষকতা করে ১৯২২ সালের শেষ দিকে তিনি পুলিশ বিভাগে যোগ দেন। কলকাতার গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত অবস্থায় তিনি আইন কলেজে ভর্তি হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৩৩ সালে আইনশাস্ত্রের ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু তিনি আইন পেশায় না গিয়ে পুলিশ বিভাগে দারোগা পদে ৩৩ বছর দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৫৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন। পুলিশ বিভাগে চাকরি করেও সাহিত্যচর্চায় মনোযোগী ছিলেন তিনি। বাঙালি মুসলমান সমাজের নানা অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূর করা নিয়ে ১৯২৮ সালে ‘তরুণ মুসলিম’ নামে একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে তার যাত্রা শুরু হয়। কলকাতায় অবস্থানকালে সওগাত ও বুলবুল পত্রিকায় লিখে মুক্তচিন্তার লেখক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন তিনি। লেখালেখির সূত্রে সেকালের খ্যাতিমান মুসলিম কবি-লেখক-সম্পাদকদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, জসীম উদ্দীন, আবুল ফজল, সুফিয়া কামাল প্রমুখের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সা’দত আলি আখন্দের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হচ্ছে ‘ইতিহাসের শহীদ’, ‘অতীত ও বর্তমান’, ‘মোহাম্মদ বিন কাসিম’, ‘তেরো নম্বরে পাঁচ বছর’ ও ‘অন্য দিন অন্য জীবন’। সা’দত আলির আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘তেরো নম্বরে পাঁচ বছর’ ষাটের দশকে দুই বাংলার পাঠকসমাজে জনপ্রিয় ছিল। বাংলা একাডেমি ১৯৯০ সাল থেকে ‘সা’দত আলি সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করে আসছে এবং ২০০৯ সালে ‘সা’দত আলি আখন্দ রচনাবলি’ প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি।
সাপ্লাই এবং ডিমান্ডের তারতম্য হলে, পণ্যমূল্যের দাম বাড়ে অথবা কমে। কিন্তু আমাদের বাজারব্যবস্থা অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী চলা তো দূরের কথা, কোনো নীতিরই ধার ধারে না। কোনো পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি না থাকলেও, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করা হয়। সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন কোনো পণ্য নেই, যার মূল্যবৃদ্ধি হয়নি। এমন অস্থির বাজার মূল্যেই, কষ্ট হলেও ক্রেতাসাধারণ নিজেদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা শুরু করেছেন। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে যেন, মজুদদাররা হাতে চাঁদ পেয়েছে। হু হু করে, পণ্যমূল্য বাড়ছেই কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। পণ্য ঘাটতি, চাহিদা হ্রাস-বৃদ্ধি অথবা আমদানিকৃত পণ্যের সরবরাহের সঙ্গে, বিভিন্ন পণ্যের বর্তমান বাজারমূল্যের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। বাজার তদারকির দায়িত্বে যারা আছেন তাদের কর্তব্যই বা কী ক্রেতাসাধারণের তাও অজানা।
নতুন করে চিনির দাম ১৬ টাকা বাড়িয়ে কেজিপ্রতি খোলা চিনি ১২০ এবং প্যাকেটজাত ১২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। সেই আগের দামেই, ১৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরের শেষ পাতায় প্রকাশিত ‘নতুন দামে মিলছে না চিনি’ প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বাড়ায় দেশের বাজারে আবারও কেজিতে ১৬ টাকা বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছে সরকার। এর ফলে প্রতি কেজি পরিশোধিত খোলা চিনি ১২০ এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম ১২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সরকার নির্ধারিত নতুন দামেও বাজারে চিনি মিলছে না। বাজারে নির্ধারিত দামের চেয়ে কেজিপ্রতি আরও ১৫ টাকা বাড়তি দামে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে চিনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, চিনির জন্য শুল্ক কমানো হয়েছে। কমানোর পরও দাম অতটা কমানো যাচ্ছে না। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেড়েছে, পাশাপাশি বেড়েছে ডলারের দামও। এ ছাড়া দেশের মধ্যে পরিবহন খরচও কিছু বেড়ে গেছে। এর কারণেই দামে প্রভাব পড়ছে। তবে এ বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেখছে।
চিনির জন্য যে ট্যারিফ হার কমানো হয়েছে, সেটি ৩১ মে পর্যন্ত বহাল আছে জানিয়ে সচিব বলেন, ট্যারিফ হার আরও কমানোর জন্য এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হবে। কারণ গত বছরের তুলনায় চিনির দাম অনেক বেড়ে গেছে। তবে এনবিআর স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা করে দেখবে রাজস্ব ঘাটতি কতটা। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকে। রাজস্ব আদায় না হলে দেশের উন্নয়ন কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করেই তারা সিদ্ধান্ত নেবে। আর ট্যারিফ নির্ধারণের বিষয়টি এনবিআর দেখে থাকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেশি বেড়ে গেলে এনবিআরকে শুল্ক কমানোর জন্য অনুরোধ করা হয়।
এনবিআর পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন সময় শুল্ক কমিয়ে থাকে- সচিবের এমন কথার ব্যাখ্যা হতে পারে বহুমাত্রিক। এনবিআরের পর্যবেক্ষণ যাই হোক, সরকার নির্ধারিত বাজারমূল্যে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না- এটাই বাস্তব। নতুন দাম কার্যকরে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়ে সচিব বলেন, গত সোমবার অ্যাসোসিয়েশনকে নতুন দাম সুপারিশ করা হয়েছে। এখন অ্যাসোসিয়েশন নতুন দাম বাস্তবায়ন করবে কি না, সে বিষয়ে যোগাযোগ চলছে। এ দাম বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে কাজ করবে ভোক্তা অধিকার।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই যোগাযোগের চূড়ান্ত ফল দেখতে চায় ক্রেতাসাধারণ। সেই ফল হচ্ছে সরাসরি আর তা হলো দ্রব্যমূল্য হ্রাস। জনগণকে জিম্মি করে, অতিমুনাফার লোভ শুভ পরিণতি নিয়ে আসে না। বিষয়টি অনুধাবন করা উচিত। কাবুলিওয়ালা চরিত্রের মজুদদারদের সঙ্গে সরকারের কোনো পক্ষের গোপন আঁতাত রয়েছে কি না সেই বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত দরকার।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) হলের আসন দখল করে রাখার বিরুদ্ধে অনশনরত ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম প্রত্যয়সহ তাকে সমর্থন দেওয়া কয়েকজনের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।তারা বলেন, ওই স্থানে গত বুধবার রাত থেকে অনশনে ছিলেন প্রত্যয়। তাকে মারধরের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায় হামলায় জড়িতরা। এ সময় প্রত্যয়ের দাবির সঙ্গে সংহতি জানানো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা হয়।
জানা গেছে, তিন দাবিতে গত বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনের খেলার মাঠে অনশনে বসেন প্রত্যয়। তিনি ওই হলের আবাসিক ছাত্র। তার অন্য দুটি দাবি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করা ও হলের গণরুমে অবস্থান করা বৈধ ছাত্রদের আসন নিশ্চিত করা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং নবীন শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছিলেন। ওই সময় ক্যাম্পাসে লোডশেডিং চলছিল। হঠাৎ করেই প্রত্যয়সহ তার সঙ্গে থাকা অন্যদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
হামলায় জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী, মার্কেটিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সৃষ্টি, চারুকলা বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের মনিকা, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ৪৮তম ব্যাচের সুরসহ আরও কয়েকজন আহত হন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, হামলায় ৩০ থেকে ৪০ জন অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। অভিযুক্তদের কয়েকজন হলেন ছাত্রলীগ নেতা ও রসায়ন বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী গৌতম কুমার দাস, তুষার, ফেরদৌস, নোবেল, গোলাম রাব্বি, মুরসালিন, মুরাদ, সোহেল, তানভীর, রায়হান, রাহাত, সৌমিক, তারেক মীর, সজীব ও নাফিস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানান, আমরা যারা প্রত্যয়ের সঙ্গে ছিলাম তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর প্রত্যয়কে দেখতে চিকিৎসক এসেছিলেন। তখন তারা অ্যাম্বুলেন্সের ওপর হামলা করে সেটি ফিরিয়ে দেয়। প্রক্টরকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি আসেননি। একাধিক ছাত্রীর দিকেও চড়াও হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলের এক শিক্ষার্থী অসুস্থ এমন একটি ফোনকল পেয়ে তারা অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। তবে কে কল দিয়েছিল সে সম্পর্কে চিকিৎসা কেন্দ্রের কেউ বলতে পারেননি।
তবে যে ফোন নাম্বার থেকে কল দেওয়া হয়েছিল সেটিতে যোগাযোগ করে দেখা যায় নাম্বারটি শাখা ছাত্রলীগের নেতা গৌতম কুমার দাসের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ১৫ হাজার শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। দরকার হলে আমি পদত্যাগ করব।
এদিকে হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে রাতেই বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিল নিয়ে তারা এ রাত পৌনে ১টায় প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করছেন।
তবে অনশনরত শিক্ষার্থী সামিউলের ওপর হামলারে পেছনে ছাত্রলীগের কোনো হাত নেই বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, মীর মশাররফ হোসেন হলের অনশনরত ওই শিক্ষার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। তবে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে। সেখানে ছাত্রলীগের একজনও জড়িত নয়।’
অসুস্হ সাবেক ফুটলার মোহাম্মদ মহসীনের পাশে দাড়িয়েছেন তার সাবেক সতীর্থরা। মোহামেডান ক্লাবের সাবেক ফুটবলার ও সোনালী অতীত ক্লাবের সদস্যরা বিকেলে বসে এই সিদ্ধান্ত নেন। পরে মহসীনের বাসায় যান তার সংগে দেখা করতে।সাবেক ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল গাফফার, জোসী, বাবলু, জনি, সাব্বির, রিয়াজ।
এসময় গাফফার জানান, মহসীনের চিকিৎসার জন্য বিসিবি সভাপতির উদ্যোগে বুধবার সকালে অসুস্হ ফুটবলারকে হাসপাতালে ভর্তি করবে।
হাসপাতাল থেকে সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে ফেরার পর মহসীন কানাডায় ফিরে যেতে চাইলে সাবেক ফুটবলাররা সহায়তা করবে। মহসীন কানাডা থেকে দেশে ফিরেছেন মায়ের পাশে থাকতে। প্রায় নব্বই ছুই ছুই মহসিনের মায়ের পায়ে ব্যথা। মহসীনের পাশাপাশি তার মায়ের চিকিৎসার ব্যাপারেও সাবেক ফুটবলাররা পাশে থাকবেন বলে জানান আবদুল গাফফার।
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
প্রথম সেটে হেরে পিছিয়ে পড়েছিলেন। তবে পরের সেটেই ঘুরে দাঁড়ান। ৩ ঘণ্টা ৩৮ মিনিটের লড়াইয়ের পর কোয়ার্টার ফাইনালটা জিতে নিলেন নোভাক জকোভিচ। কারেন খাচানভকে ৪-৬, ৭-৬, ৬-২, ৬-৪ ব্যবধানে পরাজিত করে ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেমিফাইনালে উঠলেন এই সার্বিয়ান।
কোয়ার্টার ফাইনালের শুরুটা দেখে মনে হচ্ছিল, দিনটা বোধহয় জকোভিচের নয়। তবে মাথা ঠান্ডা রেখেছিলেন তিনি। খাচানভ প্রথম সেট জিতে নেওয়ার পর দ্বিতীয় সেটেও সমানে সমানে লড়াই করেন। যদিও টাইব্রেকারে জোকোর সামনে দাঁড়াতে পারেননি তিনি।
ম্যাচে সমতা ফেরানোর পর এক বার লকার রুমে ফিরে যান জোকোভিচ। তার পর শুধু কোর্টেই ফিরলেন না। নিজের চেনা ছন্দেও ফিরলেন। তৃতীয় এবং চতুর্থ সেটে আর শুরুর মতো লড়াই করতে পারলেন না প্রতিযোগিতার ১১ নম্বর বাছাই।
ফ্রেঞ্চ ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে মঙ্গলবার প্রতিযোগিতার প্রথম সেট হারলেন জোকোভিচ। হেরে যেতে পারেন এমন মনে না হলেও এ দিন ছন্দ পেতে কিছু সময় লেগেছে তার। ৩৬ বছরের জোকোভিচ কি সর্বোচ্চ পর্যায়ের টেনিসের ধকল আগের মতো সামলাতে পারছেন না আর?
এমন প্রশ্ন যখন উঁকি দিতে শুরু করছে, তখনই নিজের চেনা ছন্দে দেখা দিয়েছেন। কোয়ার্টার ফাইনালে খাচানভের বিরুদ্ধে সময় পেয়েছেন। সুযোগ পেয়েছেন। সেমিফাইনাল বা ফাইনালের প্রতিপক্ষরা কি ছন্দে ফেরার সময় বা সুযোগ দেবেন তাঁকে?
টেনিসপ্রেমীদের মনে এই প্রশ্ন রেখেই ফ্রেঞ্চ ওপেনের শেষ চারে পৌঁছে গেলেন দু’বারের চ্যাম্পিয়ন। পাশাপাশি কিছুটা হয়তো উদ্বেগেও রাখলেন। সেমিফাইনালে জায়গা নিশ্চিত করার পর জোকার স্বীকারও করে নিয়েছেন, কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথম দু’টি সেট তার থেকে ভাল খেলেছেন রুশ প্রতিপক্ষ।
এদিকে ওপর কোয়ার্টার ফাইনালে জয় পেয়েছেন কার্লোস আলকারাজ। সিৎসিপাসের বিপক্ষে তিনি ৩-০ (৬-২, ৬-১, ৭-৬) সেটে জিতে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছেন এই স্পেনিশ টেনিস তারকা।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।