
আধিপত্য বিস্তারে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। যান্ত্রিক সভ্যতার নামে, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করার ফলে হু হু করে বাড়ছে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। পরিবেশবাদী, গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বলছেন এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার চলতে থাকলে, প্রকৃতির রূদ্রমূর্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। দেখা দেবে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া। এর ফলে সৃষ্টি হবে তাপপ্রবাহ। হ্রাস পাবে বৈশ্বিক উৎপাদন ও খাদ্য মজুদ। ধ্বংসের মুখে পড়বে প্রাণবৈচিত্র্য। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে গলতে থাকবে মেরু অঞ্চলের বরফ। সমুদ্রগর্ভে বিলীন হবে অনেক দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চল। একইসঙ্গে অনাবৃষ্টি ও তাপপ্রবাহে মানুষের জীবন হয়ে উঠবে দুর্বিষহ। পরিবেশবাদী সুস্পষ্ট নীতিমালা ও জীবনবোধকে বাদ দিয়ে এই পৃথিবীর তাপমাত্রা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। দেখা দেবে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিকম্প।
গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ‘তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা’ প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে সিডর থেকে মোখা পর্যন্ত অন্তত ১১টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত করেছে। আগের তুলনায় ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়েছে, যা আগে দেখা যায়নি। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রার ভারসাম্যহীনতার কারণে বেশি বেশি ও শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। গত বছর বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত করেছিল ‘সিত্রাং’ নামের ঘূর্ণিঝড়। এতে প্রাণহানি কম হলেও ফসল ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে অনেক। ২০২১ সালে ‘ইয়াস’, ২০২০ সালে ‘আম্পান’, ২০১৯ সালে ‘ফণি’, ২০১৭ সালে ‘মোরা’, ২০১৬ সালে ‘রোয়ানু’, ২০১৫ সালে ‘কোমেন’, ২০১৩ সালে ‘মহাসেন’, ২০০৯ সালে ‘আইলা’, ২০০৮ সালে ‘নার্গিস’ ও ২০০৭ সালে সিডর উপকূলে আঘাত করেছিল। দুই বছরের মধ্যে সিডর ও আইলার মতো তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত উপকূল থেকে এখনো মুছে যায়নি। এ দুটি ঘূর্ণিঝড় বহু মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে এদিকে ‘মোখা’ সৃষ্টি হওয়ার আগে গত প্রায় দুই মাস ধরে উত্তপ্ত আবহাওয়া বিরাজ করছিল। বৃষ্টি কিংবা মেঘের অভাবে গত এপ্রিল মাসে দেশে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। ভূপৃষ্ঠে যে তাপপ্রবাহ ছিল একই চিত্র ছিল সমুদ্রের উপরিপৃষ্ঠে। আর এর প্রভাবেই সৃষ্টি ‘মোখা’র মতো শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের।
আবহাওয়াবিদরা জানান, কয়েক দশক আগেও শুধু লঘুচাপ বা নিম্নচাপের মধ্যে সাগরের ঝড়গুলো সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু এখন তা ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিচ্ছে।
বৈশি^ক জলবায়ুর উষ্ণতার দায় আমরা ভোগ করছি বলে উল্লেখ করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বঙ্গোপসাগর ভৌগোলিক অবস্থানগতভাবে ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে।’ ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বাংলাদেশের উপকূল সবসময় প্রস্তুত বলেও জানান।
ঘূর্ণিঝড় নিয়ে গত ২৫ বছর ধরে কাজ করছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ এস এম কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় আগের তুলনায় এখন ঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে।’ দুই দিন আগে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র আঘাতে তছনছ হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চল। মৃত্যু হয়েছে দুই নারীর। বর্তমান বিশ^ কাঠামোতে এভাবে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, বাংলাদেশকে আঘাত করতেই থাকবে।
অপরিণামদর্শী কিছু মানুষের লোভের কাছে দেশের জনগণ যেমন জিম্মি, তেমনি বিশ্বনেতৃত্বের অহংকার ও লালসার কাছে মানবগোষ্ঠী জিম্মি হয়ে পড়েছে। অবাধে প্রকৃতির ওপর যেভাবে অত্যাচার হচ্ছে, প্রকৃতির পাল্টা প্রতিশোধ মোকাবিলার সামর্থ্য মানুষের নেই। তাই, নিজেকে নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই।
মোখার পর যে ঝড় আসছে, তার নাম দিয়েছে বাংলাদেশ। নাম হয়েছে বিপর্যয়। এর আঘাত সামলানোর জন্য এখনই প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। আমরা জানি না, কোন মাত্রার গতিবেগ নিয়ে ঝড়টি আঘাত করবে। তবে প্রথমেই যে উদ্যোগ নেওয়া দরকার তা হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ। এ বিষয়ে অনতিবিলম্বে দেশের অভিজ্ঞ পরিবেশবিদ ও সংশ্লিষ্ট পরামর্শকদের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার।
The pessimist sees, difficulty in every opportunity. The optimist sees the opportunity in every difficulty. - Winston churchill
অনুমান করি ২০২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ পুরোদমে চলছে । সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিশেষত বাজেট তৈরির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থ মন্ত্রণালয় আরামের ঘুম হারাম করে বাজেট ঘষামাজা নিয়ে ব্যাস্ত। মাননীয় অর্থমন্ত্রী প্রাক-বাজেট আলোচনায় লিপ্ত; শুনছেন নানা গোষ্ঠীর প্রত্যাশার কথা, টুকে নিচ্ছেন সমাজবিজ্ঞানী আর অর্থনীতিবিদদের অভিমত। মনে করা হচ্ছে যে, প্রধান তিনটি বিষয় বাজেট সংক্রান্ত ভাবনায় ওপরে থাকবে আইএমএফের শর্ত, অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচন। সুতরাং, কম মূল্যস্ফীতির মুখে বেশি জিডিপি অর্জন হবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, সম্ভবত এবারের বাজেটের আকার সাড়ে সাত কোটি লাখ টাকা। গেল অর্থবছরের প্রায় সাত লাখ কোটি টাকার বিপরীতে; বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় বরাদ্দ ২.৬৫ লাখ কোটি; মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশ এবং রাজস্ব লক্ষ্য চার দশমিক ছিয়াশি লাখ কোটি টাকা এবং প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হার সাত শতাংশের ওপর। আগেও বলেছি, এই সংখ্যাগুলো প্রাথমিক এবং পরিবর্তন হতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে।
দুই
অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, নীতিনির্ধারকদের কপালে ভাঁজ ফেলার মতো সাতটি চিন্তা চোখের সামনে উপস্থিত: (ক) সর্ব্বোচ্চ জিডিপি অর্জন করতে সাপ্লাই চেইন শক্তিশালী করা; (খ) আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা; (গ) সামাজিক সুরক্ষা জাল বিস্তৃত করে দরিদ্র ও হতদরিদ্রের মুখে খাবার তুলে দেওয়া এবং (ঘ) বিশ্ববাজার বিবেচনায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও কৃষির ওপর ভর্তুকি প্রদান। এর সঙ্গে সার ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি, মানব সম্পদের উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির চিন্তা তো থাকছেই। সবশেষে, আইএমএফের শর্তগুলোর বাস্তবায়ন উদ্বেগের অন্যতম উৎস হিসেবে থাকছে।
তিন
কেমন বাজেট চাই?
প্রথম কথা, কৃষিতে যেন ভর্তুকি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রণোদনা অব্যাহত থাকে। বাংলদেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের ভূমিকা বাড়ছে না কমছে এ নিয়ে বিতর্ক আছে, হয়তো থাকবে। এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে কোন কোণ থেকে আমরা বিষয়টা দেখছি। মোট জাতীয় আয়ে এর পড়ন্ত অবদান, ধরা যাক সত্তরের দশকের প্রায় অর্ধেক থেকে বর্তমানে এগারো শতাংশ ছুঁইছুঁই। সুতরাং, যারা বলছেন কৃষির ক্রমহ্রাসমান কৃতিত্বের কথা তারা সঠিক বলছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে এখনো প্রধানত কৃষিপ্রধান দেশ মোট শ্রমশক্তির ৪০ ভাগ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত, দেশের কর্মসংস্থান, খাদ্য নিরাপত্তা এবং দারিদ্র্য নিরসনে কৃষি খাতের অবদান এখনো অবিচল, সেটা প্রমাণ করে যে কৃষি খাতের ভূমিকা কোনোভাবেই খাটো করে দেখবার নয়।
প্রসঙ্গত জানান দেওয়া দরকার যে, সম্পদের শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই কৃষি খাতের উন্নয়নে মনোযোগী হয়েছে। আর যখন বিরোধী দলে থাকতে হয়েছে, তারা কৃষিবান্ধব পদক্ষেপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আরও বলে রাখা দরকার, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার কৃষি উন্নয়নে যে সমস্ত বৈপ্লবিক পদক্ষেপ প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল, বাংলাদেশের অন্য কোনো সরকার তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। তবে স্বীকার করতে হয় তার ধারাবাহিকতায় এবং পরিবর্তিত অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শেখ হাসিনার সরকার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেছে কৃষিবান্ধব নীতিমালা পরিগ্রহণে।
দ্বিতীয়ত, উন্নয়ন পরিকল্পনার নামে প্রকল্প চাই না যার সঙ্গে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনা এবং অর্থের অপচয় জড়িত। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নয় এমন প্রকল্প থাকা ঠিক হবে না। যত সম্ভব অন্তত এই বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পের আকার যেন ছোট থাকে; দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই নাজুক, এমন অবস্থায় না নিলে নয় এমন প্রকল্প যেন গ্রহণ করা হয় যা অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক প্রকল্প যেন পরিহার করা হয়। প্রসঙ্গত, চলমান বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ পরিস্থিতি এবং সার্বিকভাবে বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখে কিছু মেগা প্রকল্প কাটছাঁট করার পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার এখন তুলনীয় দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভালো এমনকি ছয় শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রশংসনীয় এবং পূজনীয়। যেমন গেল অর্থবছরে হিসাবকৃত ছয় দশমিক তিন শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের দাবি যদিও সমালোচিত, তবু কম গর্বের নয়, বিশেষ করে চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনা করে। সামস্তিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে অপেক্ষাকৃত কম প্রবৃদ্ধিও দীর্ঘ মেয়াদে সুফল বয়ে আনতে পারে। এই বাজেটে পরিষ্কারভাবে জানতে চাইব চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারের ঋণের সঙ্গে যুক্ত সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি।
এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ যেন না থাকে। প্রথমত, এ কাজটি নৈতিক নয়। কারণ এক অর্থে অবৈধ অর্থ বৈধ করা মানে অবৈধতাকে পুরস্কৃত করা। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই ঘোষণা গেল একুশ বছরে খুব একটা সস্তিদায়ক পরিমাণ সরকারি কোষাগারে টানতে পেরেছে বলে হিসাব পাচ্ছি না। তা হলে আম এবং ছালা দুটো হারিয়ে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকার মানে কী?
অর্থমন্ত্রীর বাজেট ভাষণে আমরা শুনতে চাই ঋণখেলাপিদের নিয়ে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা, টাকা পাচার এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এ যাবৎ কীভাবে এবং কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কেও জাতি জানতে আগ্রহী। বস্তুত এই দুই গোষ্ঠীকে কঠোর হস্তে দমন করা না গেলে সমাজে বৈষম্য কমবে না, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না।
এই বাজেটে আমরা ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের, বিশেষত নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা চাই, চাই ঋণে তাদের প্রবেশগম্যতা; আশা করি দেশজ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো সুরক্ষা পাবে।
চার
সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য বলি, মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপি দায়িত্বভার নেওয়ার পর থেকে যে বাজেট পেশ করে আসছেন, তা বিশ্বব্যাপী ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে। স্বাভাবিক বছর পেয়েছেন খুব কম, কিন্তু তারপরও কৃতিত্বের সঙ্গেই হালটা তার হাতে রয়েছে। এবার তাকে বেশ কিছু অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে এবং সেগুলো নিম্নরূপ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে বিপুল সম্পদ আহরণ, মোট ভর্তুকি বৃদ্ধি সম্ভবত ৮২০ বিলিয়ন টাকা থেকে এক ট্রিলিয়ন টাকা, মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অর্থের অপচয় বন্ধ, বিনিময় হারের ওঠানামা বন্ধ করা, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যস্ফীতিকে ছয় শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখা।
পরিশেষে, এমন বাজেট চাই যে বাজেটে নেওয়া ইতিবাচক পদক্ষেপের সুফল এদেশের আপামর জনসাধারণের বিশেষত মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট দরিদ্র মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটে। মনে রাখতে হবে যে চ্যালেঞ্জের অপর নাম সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জকে ভয় না করে সুযোগ হিসেবে সামনের দিকে পথ চলাই হবে সমীচীন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়/ দুঃখ তাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত¡না/ দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।
লেখকঃ অর্থনীতিবিদ। সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সংঘাত-সহিংসতা পাকিস্তানে নতুন কোনো ব্যাপার নয়। জন্ম থেকেই জ্বলছে দেশটি। কালেভদ্রে পাকিস্তানে কোনো সরকার তার মেয়াদ শেষ করার সুযোগ পায় না। ইমরান খানও পাননি। তিনি ক্ষমতা হারালেন প্রথম; তারপর হলেন গ্রেপ্তার। অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন ইমরান খান। আগাম নির্বাচনের দাবিতে শাহবাজ শরিফের সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে আসছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের খেলা চলছিল। এতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক মাঠে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই ছিল চীনের অন্যতম প্রধান কৌশলগত মিত্র। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধকালে আমেরিকান বলয়ে ছিল ইসলামাবাদ। নব্বইয়ের দশকে এক মেরুর বিশ্বব্যবস্থার সূচনা হলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গঠনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আর জুনিয়র জর্জ বুশের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে পাকিস্তানের পারভেজ মোশাররফের সরকার আমেরিকাকে সব ধরনের সহযোগিতা করলেও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগী হিসেবে ভারতকে প্রতিষ্ঠিত করে। আফগান সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা পরিষেবাসহ নিরাপত্তা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এক প্রকার ভারতের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অন্তর্ঘাতী কাজে ভারত-মার্কিন সমর্থিত আফগান সরকারের সংশ্লিষ্টতা তৈরি হয়, আর যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে স্থান পায় পাকিস্তান। এসব কারণে পাকিস্তানের মার্কিনবিরোধী মনোভাব ডিপ স্টেটের গভীরে প্রোথিত হয়। আর দেশটির দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতে ইমরান খান গভীর ক্ষমতা বলয়ের সমর্থন পেয়ে তিন বছর আগে পাকিস্তানে সরকার গঠন করেন। কিন্তু পাকিস্তানের বিভক্ত রাজনৈতিক বাস্তবতায় তিনি নিজেকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রক অবস্থানে নিতে পারেননি। তিনি যতই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন ততই তার বিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি বিশেষত মুসলিম লিগ নওয়াজ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি কাছাকাছি চলে আসে। এর সঙ্গে থাকে মওলানা ফজলুর রহমানের দল। পাকিস্তানের সরকার সর্বাত্মকভাবে চীন-রুশ অক্ষে চলে যাওয়ার ধারণা তৈরির পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমা শক্তি ইসলামাবাদে সরকার পরিবর্তনের কলকাঠি নাড়তে শুরু করে। তাদের নেপথ্য সমর্থন বিভক্ত বিরোধী দলকে এক সারিতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। ইমরান খান তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার এই আয়োজন সম্পর্কে জানতে পারেন। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান সেটিকে সঠিকভাবে রক্ষা করতে পারেননি তিনি। এর ফলে এক এক করে পাকিস্তানের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ তার হাতছাড়া হতে থাকে।
পশ্চিমা অর্থনৈতিক বিধিনিষেধের ঝুঁকিতে পড়ে পাকিস্তান। দেশটির সামরিক উন্নতির পক্ষেও ইমরান সরকারকে টেকাতে ভূমিকা রাখার মতো বাস্তব অবস্থা থাকেনি।
সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি থিঙ্কের ইন্দো-প্যাসিফিক সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক লিসা কার্টিস-ট্যাংক বলেছেন, ‘তালেবানের বাহক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানের প্রয়োজন নেই। কাতার এখন অবশ্যই সেই ভূমিকা পালন করছে। পাকিস্তান চায় তালেবানরা চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলো দমন করার জন্য আরও কিছু করুক এবং তারা এই গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানে সহিংসতা ছড়াবে বলে আশঙ্কা করছে। ইমরান খান ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তান এবং বিশ্বে চীনের ইতিবাচক ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছেন। ৬০ বিলিয়ন ডলারের চায়না-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের দুটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের অধীনে চালু করা হয়েছিল, উভয়ই খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চায়।
আর ইমরান খানকে উৎখাতের জন্য পশ্চিমাদের প্রধান যুক্তি হলো তিনি অতি বেশি চীননির্ভর হয়ে পড়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা শেহবাজ শরিফ পূর্বাঞ্চলীয় পাঞ্জাব প্রদেশের নেতা হিসেবে সরাসরি চীনের সঙ্গে চুক্তি করেন এবং বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো নিজ প্রদেশে নেওয়ার জন্য তার খ্যাতি রয়েছে। ফলে সরকার পরিবর্তন হলেও বেইজিংয়ের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্কে তার প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। তিনি অবশ্য বলেছেন, ভিক্ষুকের পররাষ্ট্র সম্পর্কে পছন্দ অপছন্দ থাকা উচিত নয়।
এবারের রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে ইমরান খান বেশি দায়ী করেছেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অগ্রাধিকার হওয়ার সম্ভাবনা কম, যদি না এটি ভারতের সঙ্গে ব্যাপক অস্থিরতা বা ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার দিকে পরিচালিত করে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনে দায়িত্ব পালনকারী জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক ড. কার্টিস বলেছেন, যেহেতু সামরিক বাহিনী সেই নীতিগুলোর ওপর দৃষ্টি রাখে যেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সত্যই চিন্তার কারণ হয়, যেমন আফগানিস্তান, ভারত এবং পারমাণবিক অস্ত্র। ফলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঘটনাবলি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক। তিনি উল্লেখ করেন যে, ইমরান খানের মস্কো সফর মার্কিন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিপর্যয় ছিল এবং ইসলামাবাদে একটি নতুন সরকার অন্তত কিছু মাত্রায় সম্পর্ক সংশোধন করতে সহায়তা করতে পারে। ইমরান খানও বলেছিলেন, সাম্প্রতিক মস্কো সফরের কারণে ওয়াশিংটন তাকে অপসারণ করতে চেয়েছিল। তিনি হুমকির চিঠি পাঠানো মার্কিন কর্মকর্তার নামও প্রকাশ করেছিলেন। তিনি জানান যে, দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি অব স্টেট ডোনাল্ড লু থেকে হুমকিমূলক বার্তা পাওয়া গেছে।
ডোনাল্ড লু হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে, হুমকিপূর্ণ বার্তা বিতর্ক সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অভিযোগের প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করেন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং হোয়াইট হাউজ একসঙ্গে ইমরান খানের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।
অন্যদিকে, গ্রেপ্তার ও জামিন পরিস্থিতির পর ইমরানের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। পাকিস্তানে সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন পেলে সম্ভাব্য নির্বাচনে ইমরান খানের ভালো করার সম্ভাবনা রয়েছে। এক জরিপে বলা হয়েছে, বর্তমানে ৫৪ ভাগ পাকিস্তানি ইমরান খানকে সমর্থন করেন। ভারতের রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ায় পাকিস্তানের গুরুত্ব পশ্চিমা বলয়ে কিছুটা বেড়েছে। সেনাপ্রধানের ইউক্রেন আগ্রাসনের ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য সে সম্পর্ক আরও বাড়াতে পারে। তবে দেশটির গভীর ক্ষমতা বলয় ইমরান খানকে আবার ক্ষমতায় ফেরাতে চায় কি না সেটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। ইসলামাবাদ হাইকোর্ট থেকে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা বেআইনি ঘোষণা করে তাকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট।
পাকিস্তানের বর্তমান সংকটকে নজিরবিহীন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোথি। ইমরান খানের গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে জানতে চাইলে সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, পুরোটাই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক পতন। বর্তমান পরিস্থিতি একেবারে অসহনীয়। দেশের মানুষ এমনটি কখনো চায়নি। এ অবস্থা আর থাকতে পারে না। অবশ্যই পরিস্থিতি বদলাতে হবে। তবে এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে পাকিস্তানকে তাদের দেশ ও জাতিকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক
Subversion বা অন্তর্ঘাতমূলক কাজ হচ্ছে প্রকৃত নাশকতা। আধুনিক রাষ্ট্র দখল পলিসি বা উপনিবেশবাদের জন্ম দিতে চমৎকার কিছু কৌশলে নাশকতা চালানো হয়। নাশকতা শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে নাশকতা ‘শব্দ’র ওপরেই নাশকতা চালিয়ে নাশকতার গুরুত্ব নষ্ট করে দেওয়া হয়। যাতে মানসিকভাবে মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে নাশকতা উপলব্ধি না করে উঠতে পারে। নাশকতার মাধ্যমে রাষ্ট্র দখলের রাজনীতিতে প্রথমে সমাজের অভ্যন্তরে, একেবারে গণমানুষের ভিত্তিমূলে আঘাত করা হয়। ভিত্তিমূলে আঘাত করতে সমাজ থেকে নীতি-নৈতিকতা দূর করার প্রয়োজন হয়। তারপর প্রয়োজন হয় তার শিক্ষার বুনিয়াদটা ধ্বংস করে দেওয়ার।
এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, কেবল এক রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্র দখলের কথাই নয়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রেও এ মত প্রযোজ্য আবার চিন্তন ও মননের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। একদিকে যেমন নাৎসিদের সময়ে ও ক্ষমতায় টিকে থাকতে দেশের অভ্যন্তরে নানা ধরনের সাবভার্সনের অবতারণা করা হয়েছে। এ বিষয়ে নাৎসিবাহিনীর রাইটস্ট্যাগে আগুন লাগানোর ঘটনা উল্লেখ করা যায়। তেমনি উপমহাদেশেও এমন ঘটনা বিরল নয়। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার কথা প্রবচনে থাকলেও বর্তমানে গাছের গোড়ায় বিষক্রিয়া ঘটিয়ে সবুজ বৃক্ষরাজি ধ্বংসের ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ বিষয়টা যে মানুষের অজ্ঞাত তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে সবাই কেমন যেন গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছে।
ধর্ম, রাজনৈতিক এবং সামাজিক শক্তিগুলোকে সাধারণত নির্মূল করা যায় না। তাই এসব শক্তিকে অকেজো রাখতে স্যাবোটাজ ঘটানো দরকার পড়ে যায়। দরকার পড়ে একদল পরস্পরবিদ্বেষী ধর্মহীন ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক চেতনা জন্ম দেওয়া। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক একরোখা মনোভাব সৃষ্টির মাধ্যমে অন্য ধর্ম বা বিশ্বাসের মানুষের প্রতি অবিচার শুরু হয়।
নানান সময়ে নানান দেশে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে মানুষের ওপর কোনো নির্দিষ্ট মতবাদের আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা। একটা সময় পাশ্চাত্যে বাইবেলের আধিপত্য স্থাপন করতে নিষিদ্ধ হয়েছিল ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব। বাংলাদেশে এবং ভারতেও সিলেবাস থেকে ডারউইন বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে ধর্ম ও রাজনীতিবিমুখ করা সহজ হয়ে যায়। ব্যক্তি জীবন, ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন এবং রাজনৈতিক জীবনে নীতি হারিয়ে গেলে সমাজের নীতি-নৈতিকতার গোড়া উৎপাটন হতে সময় লাগে না। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে তখন সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এমনকি তার পণ্যায়ন ঘটানোও বিচিত্র নয়। তখন দেশে বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই শাসকের তথা পুঁজির নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েন আর তা দেখে দেশের আমজনতা বিভ্রান্তির শিকার হন।
সর্বক্ষেত্রেই ন্যায়নীতি আগেই নষ্ট করে ফেলাতে শিক্ষা অর্জনের মূল উদ্দেশ্য হয়ে যায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। অর্থ কামানো শিক্ষা অর্জনের মূল চাহিদা হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠতে থাকে চাপরাসি মানসিকতা নিয়ে। ফলে নিজ দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে তারা রাস্তাতে নামতে বা চ্যালেঞ্জ নিতে ইচ্ছুক হয় না। তখন আল্টিমেটলি উৎপাদনমুখী শিক্ষা সিস্টেম বন্ধ রেখে দাস প্রবৃত্তির শিক্ষা সিস্টেম বহাল রাখতে রাষ্ট্রকে বেগ পেতে হয় না। প্রতিরোধবিহীন হয়ে যাওয়ার ফলে প্রভুত্ববাদের দাস হতে শিক্ষা অর্জন করে দাসানুদাসে পরিণত হওয়া ছাড়া বিকল্প থাকে না। ফলে একটা সময় আধুনিক উপনিবেশের আদলে দখলিকৃত রাষ্ট্রের শিক্ষিত নাগরিকরাই অনুগত দাসের ভূমিকা গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা তার মাহাত্ম্য হারায়। ফলে সাধারণ মানুষ শিক্ষার প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ে। ফলত শিক্ষায় কলোনিয়ালিজম বা ঔপনিবেশিকতার বীজ সুপ্তভাবে তার শিকড় বিস্তার করতে থাকে।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতে উপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো হলো ১. সীমাবদ্ধ শিক্ষা, ২. ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা, ৩. ব্যবসা ও পারিবারিক শিক্ষা, ৪. মানুষের মধ্যে ব্যবধান, ৫. ইংরেজি পাঠক্রম, ৬. প্রাথমিক শিক্ষাকে অবহেলিত করা। এ জন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে উপনিবেশিক শিক্ষাকে নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম দিকে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। কারণ ১. তারা মনে করত ভারতীয়দের শিক্ষার অগ্রগতির জন্য ব্রিটিশদের অর্থব্যয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। ২. ভারতবর্ষের ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করলে তারা সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হতে পারে। ৩. ভারতীয়রা আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলে ভাবিষ্যতে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জেগে উঠতে পারে। ব্রিটিশরা দুটি কারণে এ দেশের শিক্ষা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। প্রথমত, তারা বুঝতে পারে প্রশাসনের উচ্চপদে কোম্পানির কর্মচারীরা থাকলেও প্রশাসনের নিম্নস্তর চালানোর জন্য উপযুক্ত লোকবল তাদের নেই। ভারতীয় কর্মচারীদের ওপর তাদের নির্ভর করতেই হবে।
ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি প্রবর্তন করতে গিয়ে ব্রিটিশরাও অবগত ছিল যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা বাড়বে, যা ব্রিটিশ শাসনের অস্তিত্বের পক্ষে আদৌ কাম্য নয়। কিন্তু তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে তাদের পক্ষে এই ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের ফলে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার হয়। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস, ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লব ও গ্যারিবল্ডির আত্মোৎসর্গের কথা এমনকি ইউরোপের রেনেসাঁস তারা পাশ্চত্য শিক্ষার মাধ্যমেই জানতে পেরেছিল। পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শনের সংস্পর্শে তাদের মানসিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের বিকাশে পাশ্চাত্য শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। এমনকি এ দেশে কমিউনিস্ট উত্থান পর্যন্ত ইউরোপীয় প্রভাব।
বর্তমানে সে সুবিধাও যে নেই, সবাই শিক্ষার আসল উপলক্ষ হিসেবে শুধুই অর্থ উপার্জন বলেই মনে করছেন। ওদিকে শিক্ষাসংক্রান্ত উপকরণকে সাধারণের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শিক্ষা সিস্টেমের ভেতর বিভিন্ন ক্লাস তৈরি করে বিভেদ বাড়ানো হয়। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশা থেকে দূরে রাখতে শিক্ষকদের দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামোতে রাখা হয়, তাদের ওপর নামিয়ে আনা হয় নানা অসম্মান এবং তাদের ঠেলে দেওয়া হয় নানা রকম পারিপার্শ্বিক চাপের মুখে। ফলে শিক্ষকদের অসাধু ও অনৈতিক কাজে প্রলুব্ধ করা সহজ হয়ে যায়। পরীক্ষামূলকভাবে অযৌক্তিক বিভিন্ন শিক্ষা সিস্টেম প্রয়োগ করা হয়। সেসব সিস্টেমে ছাত্রদের মেধা উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটে। নকল বা ভুয়া সার্টিফিকেট সহজলভ্য করে ছাত্রদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতা নির্মূল করে ফেলা হয়। এ ছাড়াও এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের ভূমিকাকে ক্রমাগত গৌণ বলে পরিগণিত হয়ে থাকে, ক্রমেই শিক্ষাব্যবস্থার চিরাচরিত কাঠামো ভেঙে পড়ে।
ফলে পচন ধরে সমাজে, পচন ধরে মানুষের মানসিকতায়ও। এই কাজকে আরও ত্বরান্বিত করে মিডিয়া। মিডিয়া বিভিন্ন স্বার্থে মানুষের সৃজনশীল চিন্তায় বাধা তৈরি করে মানুষকে ভুল কাজে ব্যস্ত রাখতে শুরু করে। ভুল মানুষ, ভুল আইডিওলজি, ভুল পথকে সত্য ও ন্যায়ের একমাত্র সোল এজেন্ট হিসেবে বোঝাতে থাকে। অযোগ্য মানুষকে বারবার সামনে ধরে তাকেই সমাজের চোখে সিলিব্রেটি, রোল মডেল করে তোলে। অক্ষম অপদার্থের রুচিবোধকে জনপ্রিয় করে তোলে। স্বার্থ অনুযায়ী একটা অন্যায় বা ভুলকে এমনভাবে মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যাতে নতুন করে কিছু ভাবার সুযোগ না ঘটে মানুষের। বরং সেই ভাবনার কারণে তাকে কত ধরনের শাস্তি-ভোগান্তি পেতে হবে তার রগরগে ধারা-বর্ণনা প্রচার করে সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করে। মানুষের চিন্তা-চেতনার মধ্যেও এক সর্বব্যাপী ভয়ের সঞ্চার করা হয় পরিকল্পনা মাফিক।
ওদিকে সামাজিক নিরাপত্তার নামে রাষ্ট্রকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। সমাজের ভেতরে অপরাধ প্রবণতা উস্কে দেওয়া হয়, অপরাধের বিচার রহিত করা হয়, কিন্তু পুলিশি ব্যবস্থাতে মানুষের চোখে ধুলো দেওয়া হয়। পুলিশকে মানুষের শত্রুতে পরিণত করতে পুলিশ বিভাগকে অপরাজনৈতিক কৌশলে ঘায়েল করা হয়। দলবাজ ব্যক্তিদের পুলিশ প্রশাসনে নিয়োগের মাধ্যমে এদের দলীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়। আইনকে বন্ধুর বদলে ভীতি ও হুমকি তৈরির মেশিনে পরিণত করা হয়। পুলিশ বাহিনীকে প্রস্তুত করা হয় দুর্নীতির করপোরেট হাউজ হিসেবে। এদের একমাত্র কাজ হয় জনগণের স্বাভাবিক জীবনে হস্তক্ষেপ করে, দুষ্টের পালন করা। মানুষকে শায়েস্তা করতেই আইন প্রণয়ন করা হয়, আর ছাড় পেয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন যত দুষ্কৃতরাই। সাধারণ মানুষ দুর্নীতিবাজদের জাঁতাকলে আটকে পড়ে কলে পড়া ইঁদুরের মতোই ছটফট করতে থাকে।
সরকারের দায়দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন সামাজিক ও এনজিওর হাতে। ফলে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান সুযোগ পেয়ে যায় নিজস্ব আইডিওলজি প্রতিষ্ঠা করতে। তারা বিভিন্ন ছদ্মবেশে শিল্প-কারখানা চালু বন্ধের দাবি করে, রাস্তা দখল করে, সংখ্যালঘুদের উস্কানি দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নাকাল করে। এমনকি কোন পণ্য কতটুকু উৎপাদন করা যাবে বিভিন্নভাবে তার ক্রাইটেরিয়া নির্দিষ্ট করে দেয়। তার ফলে রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটি যন্ত্রীর ইচ্ছাধীন হয়ে তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। এর ফলেই সেসব যন্ত্রীর প্রোরোচনাতেই রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব হারায় ও অসহায় দুর্বল বলে পরিগণিত হয়। আর এখানেই মাথা গলানোর রাস্তা প্রশস্ত হচ্ছে ঔপনিবেশিকতা বা কলোনিয়ালিজমের।
লেখক: ভারতীয় গবেষক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক
১৯১৭ সালের ১৬ মে জন্মগ্রহণ করেন লাতিন আমেরিকার মেহিকোর বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুয়ান রুলফো। তার বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাসটি হচ্ছে ‘পেদ্রো পারামো’। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয় রুলফোর ক্ষীণকায় এ উপন্যাসটি। উরুগুয়ের বিখ্যাত পত্রিকা ‘এল প্যারিস’ লাতিন আমেরিকার লেখক, সমালোচকদের কাছে এক জরিপে জানতে চায় সেখনকার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস কোনটি? জরিপে হুয়ান রুলফোর উপন্যাস ‘পেদ্রো পারামো’র নামই সবার ওপরে উঠে আসে। স্প্যানিশ সাহিত্যের কিংবদন্তি হোর্হে লুই বোর্হেসের অভিমত, ‘পেদ্রো পারামো’ লাতিন আমেরিকা তো বটেই, গোটা বিশ্বেরই উল্লেখযোগ্য গুটিকতক ভালো কাজের একটি। বিশ্বখ্যাত লাতিন কথাশিল্পী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলেন যে, এই বইটি পড়েছিলেন বলেই তার পক্ষে ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড’ উপন্যাসটি লেখা সম্ভব হয়েছিল। হুয়ান রুলফোকে গুরু মেনেছিলেন লাতিন কথাসাহিত্যের কার্লোস ফুয়েন্তেসও। হুয়ান রুলফোর ছোটগল্পের সংকলন ‘দ্য বার্নিং প্লেইন অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়। এই সংকলনেই রয়েছে তার বিখ্যাত গল্প ‘টেল দেম নট টু কিল মি’। লেখালেখির পাশাপাশি ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত মেহিকোর ‘পাপালোয়াপান নদী কমিশন’-এ কাজ করেন তিনি। পরে ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেহিকোর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ইনডেজেনাস পিপল’-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রুলফো। খ্যাতিমান সাহিত্যিক হুয়ান রুলফো ১৯৮৬ সালের ৭ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) হলের আসন দখল করে রাখার বিরুদ্ধে অনশনরত ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম প্রত্যয়সহ তাকে সমর্থন দেওয়া কয়েকজনের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।তারা বলেন, ওই স্থানে গত বুধবার রাত থেকে অনশনে ছিলেন প্রত্যয়। তাকে মারধরের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায় হামলায় জড়িতরা। এ সময় প্রত্যয়ের দাবির সঙ্গে সংহতি জানানো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা হয়।
জানা গেছে, তিন দাবিতে গত বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনের খেলার মাঠে অনশনে বসেন প্রত্যয়। তিনি ওই হলের আবাসিক ছাত্র। তার অন্য দুটি দাবি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করা ও হলের গণরুমে অবস্থান করা বৈধ ছাত্রদের আসন নিশ্চিত করা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং নবীন শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছিলেন। ওই সময় ক্যাম্পাসে লোডশেডিং চলছিল। হঠাৎ করেই প্রত্যয়সহ তার সঙ্গে থাকা অন্যদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
হামলায় জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী, মার্কেটিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সৃষ্টি, চারুকলা বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের মনিকা, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ৪৮তম ব্যাচের সুরসহ আরও কয়েকজন আহত হন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, হামলায় ৩০ থেকে ৪০ জন অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। অভিযুক্তদের কয়েকজন হলেন ছাত্রলীগ নেতা ও রসায়ন বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী গৌতম কুমার দাস, তুষার, ফেরদৌস, নোবেল, গোলাম রাব্বি, মুরসালিন, মুরাদ, সোহেল, তানভীর, রায়হান, রাহাত, সৌমিক, তারেক মীর, সজীব ও নাফিস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানান, আমরা যারা প্রত্যয়ের সঙ্গে ছিলাম তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর প্রত্যয়কে দেখতে চিকিৎসক এসেছিলেন। তখন তারা অ্যাম্বুলেন্সের ওপর হামলা করে সেটি ফিরিয়ে দেয়। প্রক্টরকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি আসেননি। একাধিক ছাত্রীর দিকেও চড়াও হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলের এক শিক্ষার্থী অসুস্থ এমন একটি ফোনকল পেয়ে তারা অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। তবে কে কল দিয়েছিল সে সম্পর্কে চিকিৎসা কেন্দ্রের কেউ বলতে পারেননি।
তবে যে ফোন নাম্বার থেকে কল দেওয়া হয়েছিল সেটিতে যোগাযোগ করে দেখা যায় নাম্বারটি শাখা ছাত্রলীগের নেতা গৌতম কুমার দাসের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ১৫ হাজার শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। দরকার হলে আমি পদত্যাগ করব।
এদিকে হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে রাতেই বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিল নিয়ে তারা এ রাত পৌনে ১টায় প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করছেন।
তবে অনশনরত শিক্ষার্থী সামিউলের ওপর হামলারে পেছনে ছাত্রলীগের কোনো হাত নেই বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, মীর মশাররফ হোসেন হলের অনশনরত ওই শিক্ষার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। তবে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে। সেখানে ছাত্রলীগের একজনও জড়িত নয়।’
অসুস্হ সাবেক ফুটলার মোহাম্মদ মহসীনের পাশে দাড়িয়েছেন তার সাবেক সতীর্থরা। মোহামেডান ক্লাবের সাবেক ফুটবলার ও সোনালী অতীত ক্লাবের সদস্যরা বিকেলে বসে এই সিদ্ধান্ত নেন। পরে মহসীনের বাসায় যান তার সংগে দেখা করতে।সাবেক ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল গাফফার, জোসী, বাবলু, জনি, সাব্বির, রিয়াজ।
এসময় গাফফার জানান, মহসীনের চিকিৎসার জন্য বিসিবি সভাপতির উদ্যোগে বুধবার সকালে অসুস্হ ফুটবলারকে হাসপাতালে ভর্তি করবে।
হাসপাতাল থেকে সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে ফেরার পর মহসীন কানাডায় ফিরে যেতে চাইলে সাবেক ফুটবলাররা সহায়তা করবে। মহসীন কানাডা থেকে দেশে ফিরেছেন মায়ের পাশে থাকতে। প্রায় নব্বই ছুই ছুই মহসিনের মায়ের পায়ে ব্যথা। মহসীনের পাশাপাশি তার মায়ের চিকিৎসার ব্যাপারেও সাবেক ফুটবলাররা পাশে থাকবেন বলে জানান আবদুল গাফফার।
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
প্রথম সেটে হেরে পিছিয়ে পড়েছিলেন। তবে পরের সেটেই ঘুরে দাঁড়ান। ৩ ঘণ্টা ৩৮ মিনিটের লড়াইয়ের পর কোয়ার্টার ফাইনালটা জিতে নিলেন নোভাক জকোভিচ। কারেন খাচানভকে ৪-৬, ৭-৬, ৬-২, ৬-৪ ব্যবধানে পরাজিত করে ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেমিফাইনালে উঠলেন এই সার্বিয়ান।
কোয়ার্টার ফাইনালের শুরুটা দেখে মনে হচ্ছিল, দিনটা বোধহয় জকোভিচের নয়। তবে মাথা ঠান্ডা রেখেছিলেন তিনি। খাচানভ প্রথম সেট জিতে নেওয়ার পর দ্বিতীয় সেটেও সমানে সমানে লড়াই করেন। যদিও টাইব্রেকারে জোকোর সামনে দাঁড়াতে পারেননি তিনি।
ম্যাচে সমতা ফেরানোর পর এক বার লকার রুমে ফিরে যান জোকোভিচ। তার পর শুধু কোর্টেই ফিরলেন না। নিজের চেনা ছন্দেও ফিরলেন। তৃতীয় এবং চতুর্থ সেটে আর শুরুর মতো লড়াই করতে পারলেন না প্রতিযোগিতার ১১ নম্বর বাছাই।
ফ্রেঞ্চ ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে মঙ্গলবার প্রতিযোগিতার প্রথম সেট হারলেন জোকোভিচ। হেরে যেতে পারেন এমন মনে না হলেও এ দিন ছন্দ পেতে কিছু সময় লেগেছে তার। ৩৬ বছরের জোকোভিচ কি সর্বোচ্চ পর্যায়ের টেনিসের ধকল আগের মতো সামলাতে পারছেন না আর?
এমন প্রশ্ন যখন উঁকি দিতে শুরু করছে, তখনই নিজের চেনা ছন্দে দেখা দিয়েছেন। কোয়ার্টার ফাইনালে খাচানভের বিরুদ্ধে সময় পেয়েছেন। সুযোগ পেয়েছেন। সেমিফাইনাল বা ফাইনালের প্রতিপক্ষরা কি ছন্দে ফেরার সময় বা সুযোগ দেবেন তাঁকে?
টেনিসপ্রেমীদের মনে এই প্রশ্ন রেখেই ফ্রেঞ্চ ওপেনের শেষ চারে পৌঁছে গেলেন দু’বারের চ্যাম্পিয়ন। পাশাপাশি কিছুটা হয়তো উদ্বেগেও রাখলেন। সেমিফাইনালে জায়গা নিশ্চিত করার পর জোকার স্বীকারও করে নিয়েছেন, কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথম দু’টি সেট তার থেকে ভাল খেলেছেন রুশ প্রতিপক্ষ।
এদিকে ওপর কোয়ার্টার ফাইনালে জয় পেয়েছেন কার্লোস আলকারাজ। সিৎসিপাসের বিপক্ষে তিনি ৩-০ (৬-২, ৬-১, ৭-৬) সেটে জিতে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছেন এই স্পেনিশ টেনিস তারকা।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।