
বেশি দূরে নয়, সিলেট থেকে শতেক কিলোমিটার। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ ও মাধবপুর উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে শিল্প-কারখানা। এ এলাকাতেই আমাদের চিরচেনা গ্রাম, যেখানে ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছি। পড়ালেখা এবং চাকরির সুবাদে শহুরে জীবনকে ধারণ করতে দীর্ঘদিন গ্রামের বাইরে কাটিয়ে দিলাম। প্রাত্যহিক জীবনের ছন্দ মনে করিয়ে দেয় চিরচেনা গ্রামের দৃশ্য। গ্রামের স্নিগ্ধ মনোরম প্রকৃতি অনেকটা ইটের টুকরায় বন্দি হয়ে যেতে দেখেছি। সেখানে আর শত শত গাছগাছালি নেই। পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে না, ঘুম ভাঙে মেশিনের শব্দে! সকালের রোদটুকু হারিয়ে যায় অচেনা শহুরের আবেশে। সন্ধ্যার পর রাস্তায় দেখতে পাওয়া যায় হাজার হাজার কর্মব্যস্ত মানুষকে। এখন আর সারি সারি বৃক্ষ চোখে পড়ে না। গ্রামীণ আবহের নিস্তব্ধতা হারিয়ে নতুন করে গড়ে উঠেছে শিল্পায়ন। গ্রামবাংলার যে ঐতিহ্যকে ধারণ করে বড় হয়েছি সবই বিলীন হয়ে গিয়েছে শিল্পায়নের ছোঁয়ায়। পূর্ণিমা রাতে এক ফালি চাঁদের দেখা মেলা ভার। সবই যেন বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় ঝলসে গেছে। স্নিগ্ধ আবেশে শীতের সকালে কুয়াশা দিন দিন ধোঁয়াশায় পরিণত হচ্ছে। কৃষিজমিতে কলকারখানা স্থাপনে কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে।
গ্রামের স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ এখন আর চোখে পড়ে না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। বাঁশঝাড়গুলো উজাড় হয়ে গেছে। শরৎকালে কাঁশবনগুলো আগেকার মতো মুগ্ধতা ছড়ায় না কিংবা পাতা ঝরা ফাগুনের উষ্ণ আলিঙ্গন অনুভূতি জাগায় না। সন্ধ্যাবেলায় যে পাখিগুলো নীড়ে ফিরে আসত তা চোখে পড়ে না। সবই যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে শিল্পায়নের ছোঁয়ায়। সবকিছু শহুরে খাঁচায় বন্দি জীবন। বেরসিক জীবনকে সবাই চলমান পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। পাড়ার যে লোকগুলো ভোরবেলায় গরু নিয়ে মাঠে যেত তারা এখন রাত অবধি কারখানায় কাজ করে। ক্লান্তি তাদের হার মানাতে পারে না। যে কৃষক কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা এখন কারখানায় কাজ করে সংসার চালান। খুবই অল্প সংখ্যক কৃষক ঐতিহ্যগতভাবে তাদের পেশাকে ধরে রেখেছে। তাই, ধানচাষ হলেও শীতকালীন ফসলের আবাদ কমে আসছে। ফলে অনেক কৃষিজমি পতিত থেকে কৃষি অর্থনীতি ব্যাহত হচ্ছে।
শিল্পায়নের ছোঁয়ায় সেখানকার অবস্থায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। উন্নয়ন হয়েছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ির। পূর্বের তুলনায় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বেড়েছে বহুগুণে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ কলকারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাই প্রতিদিন হাজারো লোকের সমাগম হয়। নিস্তব্ধ গ্রামগুলো এখন ব্যস্ততায় ভরপুর। কিন্তু শীতল স্নিগ্ধ বাতাস দূষিত করে তুলছে শিল্পায়নের ডামাডোলে। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ সেখানকার মনোরম পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে। বহমান নদীতে চর জেগে আছে। নদীর ঘাটে সারি সারি নৌকা বাঁধা থাকে না। নদীর পানি দূষিত হয়ে কালছে রং ধারণ করছে। ছোট ছোট খালগুলো অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে। তাই, নদী কিংবা খালে মাছের দেখা পাওয়া ভার। পাশে রয়েছে রঘুনন্দন পাহাড়। পাহাড় এবং রেললাইনের পাশে রয়েছে ময়লার ভাগাড়। মেশিনের শব্দ এবং মানুষের সরব উপস্থিতিতে প্রাণীদের অভিযোজন ক্ষমতা কমে আসছে। তাই সেখানকার প্রাণীরা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মূলত জীবিকার তাগিদে আমরা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য হারাতে বসেছি। প্রশান্তিময় গ্রামবাংলার কোলাহলমুখর পরিবেশ সেখানে নেই।
তারপরও হাজারটা প্রশ্ন উপেক্ষা করে মেতে ওঠি সম্ভাবনাময় শিল্পায়ন নিয়ে। একদিকে মেশিনের শব্দ, অন্যদিকে হাজারো অচেনা মানুষের কর্মসংস্থান। সকালবেলায় হাজারো লোক উৎপাদন কারখানায় নিয়োজিত থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ করে। তাদের ক্ষুদ্র হাতে গড়া পণ্য দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাচ্ছে। তাদের শ্রম দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সাহায্য করছে। গ্রামের কেউ আর বসে থেকে অলস সময় পার করে না। বেকারত্ব ঘুচে সবাই এখন স্বাবলম্বী। গাঁয়ের মেঠোপথ এখন পিচঢালা পথে পরিণত হয়েছে। রাস্তাঘাটের উন্নয়নে যোগাযোগব্যবস্থা সহজতর হয়েছে। মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার সুযোগ বহুলাংশে বেড়েছে। ফলে শিক্ষার হারও বেড়েছে। সর্বোপরি মানুষের জীবনমানের অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
তবে গ্রামের মানুষগুলো ফুটবল, ক্রিকেট, হা-ডু-ডু খেলায় কোনো আনন্দ খুঁজে পায় না। চিরচেনা রাখালের গরুর পাল চোখে পড়ে না। কেউ বাঁশি বাজিয়ে চৈত্রের দুপুরটাকে মাতিয়ে রাখে না। গ্রীষ্মের দুপুরে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যায় না। হেমন্তকালে নতুন ধানের পিঠা বানানোর আমেজ অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। শীতকালে এখন আর যাত্রাপালা হয় না। বৈশাখ কিংবা পৌষ মাসে মেলার আয়োজন থাকে না। অথচ গ্রামই প্রাণ, গ্রামই আমাদের বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। তা ছাড়া শিল্প ও সংস্কৃতির সূক্ষ্ম মেলবন্ধন গ্রামের পটভূমিতেই ধরা দেয়। অথচ শিল্প ও সংস্কৃতির মৌলিকতা শিল্পায়নের প্রভাবে সেখানে আজ হারাতে বসেছে। ফলে সেখানকার মানুষদের জীবন থেকে গ্রামীণ সংস্কৃতি বিলুপ্ত হচ্ছে।
শিল্পায়নে যেমন সেখানকার জীবনমান উন্নত হয়েছে তেমনি তৈরি হয়েছে নানা মাত্রিক জটিলতা। পারস্পরিক সম্পর্ক এখন টিকে আছে মুঠোফোনের ছোঁয়ায়। তাই সম্প্রীতিকে সুদৃঢ় করার পরিবর্তে হারাতে বসেছি, যা আমাদের চিরায়ত সমাজব্যবস্থাকে ক্ষয়িষ্ণু করে দিচ্ছে। মূলত, আমরা গ্রামের সে দিনগুলো হারাতে বসেছি, যে দিনগুলোয় সমাজের একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়াত। সামাজিক হৃদ্য হারিয়ে সবাই এখন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছি।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। রূপবৈচিত্র্যের এ দেশে হাজার বছরের আবহমান গ্রামবাংলার বিভিন্ন ঐতিহ্য ধরা পড়ে গ্রামীণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এ দেশের কৃষ্টি, কালচার মিশে আছে গ্রামবাংলার মানুষের মনে প্রাণে। তাই গ্রামবাংলার মানুষ তার নিজস্ব ঐতিহ্য ধারণ ও লালন-পালন করে আসছে আবহমানকাল থেকেই। কিন্তু শিল্পায়নের ছোঁয়ায় আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির আমেজ থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। খড় কিংবা টিনের ঘরের পরিবর্তে তৈরি হচ্ছে বহুতল বিশিষ্ট নতুন নতুন ভবন। সেখানে অতি পরিচিত বাঁশঝাড় কিংবা বনলতার শ্যামল স্নিগ্ধ আমেজ আর নেই। অথচ, গ্রামের সে মেঠোপথকে আপন বলে জেনেছি, যে পথে বর্ষাকালে কাদা, শীতকালে ধুলা থাকে। কিন্তু আজ আর তা দেখা যায় না। শিল্পায়নের ছোঁয়ায় রাস্তাগুলো পিচঢালা পথে পরিণত হয়েছে। মানুষের জীবনমানেরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু স্নিগ্ধ কোলাহলযুক্ত নির্মল বায়ুর দেখা মেলে না।
প্রকৃতির সঙ্গে উন্নয়নের পরিমিতবোধ পরিবেশকে অনিন্দ্য সুন্দর করে তোলে। কিন্তু শিল্পায়নের ছোঁয়ায় সে বাঁধন না থাকায় আমরা আজ তা হারাতে বসেছি। অথচ আমাদের সংস্কৃতির রূপায়নে গ্রামের আবহকে অনন্যরূপে বারবার তুলে ধরি। আমরা চাই শিল্পায়নের মাঝে গ্রামীণ অবয়ব আরও অনিন্দ্য সৌন্দর্যের হাতছানি দিয়ে ডাকবে। তবেই তা হবে প্রকৃতির জন্য বিশালত্বের ছোঁয়া।
লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা
ছোটদের বেড়ে ওঠার সময়ে অনেক কিছুই দরকার। বিশেষ করে দরকার পড়ে বীরের। এমন মানুষের, কিশোর যাকে অনুসরণ করে এগোতে পারে। যাকে শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসবে, ভাববে : তার মতো বড় হতে না পারি, অন্তত তার পথ ধরে এগোবার চেষ্টা করব।
বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের জন্য এখন বীর কারা? দেখা যাবে বীর হচ্ছেন নায়ক-নায়িকা, টেলিভিশনের তারকা, খেলাধুলার তারকা। এটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। টেলিভিশনের ও খেলাধুলার মানুষদেরই তো হরহামেশা দেখছে তারা। এদের তারা পছন্দ করে। কিন্তু এখানে মস্ত একটা অসুবিধা আছে। সেটা হলো এই, ওইসব নায়ক স্থায়ী হন না। আকাশের তারার মতো তারা জেগে ওঠেন, আবার সময় শেষ হলে তারাদের মতোই হারিয়ে যান। গতকালের নায়করা আজ স্মৃতিমাত্র। স্থায়ী বীর কারা? যারা আজকে আছেন, গতকালও ছিলেন, ঝরে যাবেন না আগামীকালও। তারা হচ্ছেন ইতিহাসের মানুষ। এই মানুষেরা ইতিহাসকে বদলে দেন এবং বদলে দিয়ে নিজেরাও ইতিহাসের অংশ হয়ে বেঁচে থাকেন। কিশোরদের জন্য এদেরই হওয়া উচিত অনুসরণীয় বীর। এদের দেখে, এদের কথা ভেবে কিশোররা চাইবে মহৎ হয়ে উঠতে।
কিন্তু ইতিহাসে তো অনেক মানুষেরই নাম পাই। তারা সবাই কি বীর হবেন? না, তা হবেন না। এক কথায় যদি বলতে চাই তাহলে বলব, বীর হবেন সেসব মহৎ মানুষ, পৃথিবীকে যারা বোঝেন এবং বুঝে তাকে বদলানোর চেষ্টা করেছেন। কেবল বুঝতে নয়, চেষ্টা করেছেন বদলে দিতেও।
এমন মানুষদের খোঁজ পাওয়া যাবে নানা ক্ষেত্রে। তারা আছেন সাহিত্যের জগতে। রয়েছেন বিজ্ঞান ও দর্শনের ক্ষেত্রে। তাদের পাওয়া যাবে রাজনীতির অঙ্গনে। তারা সবাই যে এক রকমের বা এক মাপের সেটা অবশ্যই নয়। কিন্তু সবাই মহৎ এবং বীর হওয়ার জন্য আদর্শ মানুষ। এদের সবাই যে পৃথিবীকে বদলাবার শপথ নিয়ে কাজে নেমেছিলেন তা নয়, কিন্তু বড় কঠিন ছিল কাজের প্রতি তাদের অঙ্গীকার ও কাজের ব্যাপারে সাধনা, সেই সঙ্গে অর্জন করেছিলেন উঁচুমানের সাফল্য। ফলে বহু মানুষ উপকৃত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। যে পৃথিবীতে তারা এসেছিলেন, তারা চলে যাওয়ার পর সেটি আর আগের মতো থাকেনি, বদলে গেছে।
সাহিত্যের দিকে তাকানো যাক। সেখানে আমরা শেকস্পিয়রকে পাব। শেকস্পিয়রকে আমরা আলাদা করেই রাখব। মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন, তাদের বুঝতে চেয়েছেন এবং কেবল ইংরেজি ভাষার পাঠকদের নয়, বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে তিনি মানুষের কল্পনা ও অনুভবের জগতে পরিবর্তন ঘটিয়ে গেছেন। বাংলা ভাষায় আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তো আমাদের একেবারেই কাছের মানুষ।
রবীন্দ্রনাথ মানুষকে ভালোবাসতেন এবং যদি হিসাব করতে হয়, তবে বলতে হবে বাঙালিদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি হিসেবে নন, অনেক দিক দিয়েই তিনি অসাধারণ। রাজনীতিতেও অংশ নিয়েছেন, নানা বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। পৃথিবীটাকে বুঝেছেন এবং চেষ্টা করেছেন তাকে বদলাবার। এই কাজটা আরও বেশি স্পষ্টভাবে করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম।
বীর হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও আসবেন। বাংলা গদ্যকে তিনি বদলে দিয়ে গেছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন এনে দিয়ে গেছেন। তিনি চাইতেন মানুষের মেরুদণ্ড শক্ত হোক। পরাধীন দেশে মেরুদণ্ড শক্ত রাখাটা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। তার সময়ে মানুষ নত হতো সমাজের কাছে, ধর্মের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে। বিদ্যাসাগরের গদ্য যেমন শক্ত মেরুদণ্ডের, তেমনি তার নিজের অবস্থানও ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। তিনি আপস করার মতো মানুষ ছিলেন না। বেগম রোকেয়ার নামও আসবে। একেবারেই বিরূপ পরিবেশে তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন। জগৎটাকে বুঝেছেন এবং চেষ্টা করেছেন সেটিকে বদলে দেওয়ার। বিজ্ঞানের বেলায় খুবই বৈপ্লবিক কাজ করে গেছেন গ্যালিলিও। এক সময়ে ধারণা করা হতো যে, পৃথিবী হচ্ছে স্থির এবং সূর্য, গ্রহ, উপগ্রহ সবাই পৃথিবীর চারপাশ দিয়ে ঘুরছে। এটা যে সত্য নয়, সেটা প্রথমে ধারণা করেন কোপার্নিকাস। গ্যালিলিও তার পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার সাহায্যে কোপার্নিকাসের ধারণাই যে সঠিক তা প্রমাণ করলেন। সেই সত্যটাকে তিনি প্রকাশ করেন তার বইতে। এতে তার মহাবিপদ ঘটে। ধর্মযাজকরা ক্ষেপে ওঠেন। এতকাল ধরে তারা বলে আসছেন পৃথিবী স্থির, আর এই লোক কিনা প্রমাণ করতে চায় যে সেটা মিথ্যা কথা, আসলে পৃথিবী নিজেই সূর্যের চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে! ধর্মযাজকদের বক্তব্য তাহলে মিথ্যা? আরও একটি বড় অপরাধ ছিল গ্যালিলিওর। সেটি এই যে, তার ওই বৈজ্ঞানিক বক্তব্য পণ্ডিতদের ল্যাটিন ভাষায় না লিখে সাধারণ মানুষ যাতে বুঝতে পারে সেই লক্ষ্যে মাতৃভাষা ইটালিয়ানে লিখেছেন। ধর্মযাজকরা দেখলেন সাধারণ মানুষ যদি একবার টের পেয়ে যায় যে, তারা মিথ্যাচার করেছেন তাহলে তো তাদের মানসম্মান বিষয়-সম্পত্তি কিছুই আর অক্ষুন্ন থাকবে না। তারা বিচার বসালেন গ্যালিলিওর। চাপ দিয়ে গ্যালিলিওকে বাধ্য করবেন তার বৈজ্ঞানিক বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিতে। কিন্তু গ্যালিলিও তো পরাজিত হওয়ার মানুষ নন। তাই বইপত্র নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, তার ওপর চোখ রাখা হয়েছে যেন নতুন কোনো ‘উৎপাত’ সৃষ্টি না করেন। কিন্তু হতাশ না হয়ে গ্যালিলিও তার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবার লিখেছেন এবং একজন ছাত্রের সাহায্যে তা গোপনে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার তত্ত্ব রক্ষা পেয়েছে। কাজটি তাকে করতে হয়েছে অত্যন্ত সংগোপনে।
আলো জে¦লে কাজ করছেন দেখলে সন্দেহ করা হবে, তাই রাতের বেলায় চাঁদের আলোতে তিনি লিখতেন। তার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছিল। তিনি অন্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তবু ক্ষান্ত হননি। তার ওই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কেবল যে বিজ্ঞানের জগতে তা তো নয়, মানুষের চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রেও মস্ত এক বিপ্লব সম্ভব করে তোলে।
ধরা যাক কার্ল মার্কসের কথা। তার দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল বৈজ্ঞানিক। তিনি তথ্য থেকে তত্ত্বে আরোহণ করেছেন। সে কাজটা অবশ্য সব বৈজ্ঞানিকই করে থাকেন; কিন্তু মার্কস যেখানে অন্যদের থেকে আলাদা সে জায়গাটা হলো এই তিনি পরিষ্কারভাবেই বলে দিয়েছেন, তার কাজ কেবল পৃথিবীকে বোঝার নয়, তাকে বদলানোও। বীরত্ব পরিমাপের জন্য পৃথিবীকে বদলানোর যে নিরিখের কথা আমরা বলছি, সেটাও মার্কসেরই দেওয়া। এই নিরিখে বিচার করলে বীর হিসেবে তাকে না দেখে কোনো উপায়ই থাকে না। মার্কসের জন্ম পুঁজিবাদী বিশ্বে, সেই বিশ্বকে তিনি যেমন পরিষ্কারভাবে বুঝেছেন, তার আগে অন্য কেউ সেভাবে বুঝতে পারেননি এবং সেটা বুঝতে গিয়ে তিনি ও তার বন্ধু ফ্রেডরিক এঙ্গেলস দেখতে পেয়েছেন, কেবল পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেই নয়, সব ব্যবস্থাতেই অল্পকিছু মানুষ থাকে যারা শোষক আর বেশির ভাগ মানুষকে হতে হয় তাদের দ্বারা শোষিত। শোষক ও শোষিতের যে দ্বন্দ্ব, তার কারণেই মানুষের ইতিহাস বদলে গেছে। মার্কস-এঙ্গেলস কেবল তত্ত্ব দাঁড় করাননি, তারা ওই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার যে আন্দোলন তাতেও যোগ দিয়েছেন। পুঁজিবাদে পুঁজির যে শোষণ চলে শ্রমিকের ওপর, সেই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে অগ্রনায়ক হিসেবে যারা এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন লেনিন। লেনিনও অর্থনীতি ও দর্শনের ওপর বই লিখেছিলেন এবং নিজের দেশ রাশিয়াতে পুঁজির মালিকদের শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিপ্লব সম্পন্ন করেছেন। যেভাবে তিনি সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এই বিপ্লবের কাজটি করতে পেরেছেন, সেটা একটা দৃষ্টান্তও বৈকি। নিপীড়িত মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা না থাকলে এমন কাজ করা যায় না। লেনিনের নেতৃত্বে যে বিপ্লব ঘটল তা ইতিহাস দর্শন রাজনীতি সবকিছু সম্পর্কেই মানুষের ধারণা বদলে দিল। বদলের এই ধারাতে চীনে বিপ্লব ঘটিয়েছেন মাও সে-তুং। চীন ছিল হতদরিদ্র কৃষকের দেশ; সেই দেশে দেশি-বিদেশি শক্তির শোষণকে উপড়ে ফেলে মানুষের জন্য মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তিনি প্রমাণ করলেন সঠিক পথে সম্মিলিতভাবে এগোলে কেমন করে মুক্তি অর্জন করা যায়। তাদের পথ ধরে এগিয়ে, তবে ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্নভাবে সমাজকে বদলে ফেলেছেন কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রো। তার সঙ্গে ছিলেন আর্জেন্টিনার চে গুয়েভারা। পৃথিবীকে বোঝা এবং তাকে বদলে দেওয়ার ব্যাপারে এদের দুজনের যে কাজ তাও বীরত্বব্যঞ্জক বৈকি। বীর ছিলেন হো চি মিন। মার্কিনিদের যিনি ভিয়েতনাম থেকে তাড়িয়ে এবং ভিয়েতনামের সাম্রাজ্যবাদী বিভাজনের নিরসন ঘটিয়ে আশ্চর্য এক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অনেকে এগিয়ে এসেছেন, যাদের কথা বারবার স্মরণ করতে হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন সুভাষচন্দ্র বসু। যিনি ব্রিটিশের আমলা হওয়ার সর্বোচ্চ পরীক্ষায় ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান পেয়েছিলেন। পরীক্ষা হয়েছিল লন্ডনে। কিন্তু ততদিনে এই তরুণ বুঝে ফেলেছেন যে, ব্রিটিশের সেবা করা আর যারই সাজুক তার সাজে না। তাই চাকরির অত্যন্ত লোভনীয় আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে চলে এসেছিলেন দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে। কিন্তু অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তিনি বুঝে নিয়েছিলেন যে, আবেদন নিবেদন করে আর যাই পাওয়া যাক, স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না। স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের প্রয়োজন হবে। দেশের ভেতর থেকে সেই যুদ্ধের প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ যে সম্ভব নয়, সেটা জানতেন তিনি। তাই দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে গেলেন এবং সেখানে ভারতীয়দের নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ নামে এক বাহিনী গড়ে তুললেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেটা। তার এই বাহিনী ওই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তৈরি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে রাজধানী দিল্লি দখল করে নেবে এবং ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে এটাই ছিল আশা। তার এই হিসাব নির্ভুল প্রমাণিত হয়নি এ কারণে যে, যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ ও তার মিত্রদেরই জয় হয়েছে, জাপানিরা পরাজিত হয়েছে। সুভাষ বসুর অন্তর্ধান ঘটেছে। কিন্তু তবু এই সত্য ইংরেজ লেখকরাই স্বীকার করেছেন যে, সুভাষের সশস্ত্র বাহিনী ব্রিটিশদের যে মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা দিয়েছিল তার দরুনই তারা ভারত থেকে দ্রুত প্রস্থান করার সিদ্ধান্ত নেয়।
সুভাষ বসুর মতোই সশস্ত্র পথে স্বাধীনতা আনতে চেয়েছিলেন চট্টগ্রামের মাস্টারদা সূর্য সেন। ব্রিটিশের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে নিজের যুববাহিনীর সাহায্যে সূর্য সেন চট্টগ্রাম শহরকে স্বাধীন করে ফেলেছিলেন। সেই স্বাধীনতা অবশ্য দুদিনের বেশি ধরে রাখতে পারেননি; শেষ পর্যন্ত তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। প্রাণ দিয়েছেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারও। মেয়েদের রাজনীতিতে যেতে নেই, এই সামাজিক নিষেধাজ্ঞা ছিন্ন করে প্রীতিলতা সূর্য সেনের দলে যোগ দেন এবং সামনাসামনি যুদ্ধ করে শহীদ হন।
পূর্ববঙ্গে আরও পেয়েছি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে। তিনি ছিলেন পিতৃ-মাতৃহীন এক কিশোর, যার শিক্ষাজীবন কেটেছে ধর্মের আশ্রয়ে। কিন্তু তিনি দেখেছিলেন কৃষক কীভাবে অত্যাচারিত হয় জমিদারের হাতে। আসামে চলে গিয়েছিলেন সেখানকার বাঙালি কৃষকদের পাশে দাঁড়াবার জন্য। পরে বুঝেছেন কেবল জমিদার নয়, ব্রিটিশের রাষ্ট্রই কৃষকবিরোধী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ভাসানী যোগ দিয়েছিলেন এই আশা বুকে নিয়ে যে, ওই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটলে
কৃষক মুক্তি পাবে। কিন্তু সেই মুক্তি আসেনি। যে জন্য তিনি রাষ্ট্র ও সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। পাকিস্তানি সেনাশাসকরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল এবং অস্ত্রধারী ভীরুরা যা করে তাই করেছিল, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালিদের ওপর। ফলে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছেন। এরা সবাই ছিলেন বীর। পরবর্তী প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের জন্য আদর্শ হওয়ার মতো মানুষ।
বীরদের মধ্যে বিজ্ঞানীদের কথা এসেছে। তাদের বীরত্বটা ভিন্ন রকমের। তাদের অনেক সময়েই একাকী কাজ করতে হয়েছে। দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়েছে গবেষণাগারে। সেই যে তাদের অভিনিবেশ, একাগ্রতা, অঙ্গীকারে অবিচলিত থাকা, সেসবও বীরেরই কাজ। তারা তাদের সময়কার প্রচলিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বেও আস্থা রাখেননি, সংশয় প্রকাশ করেছেন এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। যেমন নিউটন ও ডারউইন। নিউটন মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিষয়ে আগে যেসব চিন্তা প্রচলিত ছিল তা তাকে সন্তুষ্ট করেনি। তাই তিনি গবেষণা করে নতুন ব্যাখ্যা উপস্থিত করলেন। যার ফলে মানুষের চিন্তাজগতে বিরাট এক পরিবর্তন ঘটে যায়। বীর ছিলেন ডারউইনও। মানুষ যেকোনো এক বিশেষ দিনে সৃষ্টি হয়নি, তাকে আসতে হয়েছে বিবর্তনের অতি দীর্ঘ একটি পথ পার হয়ে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করে তিনি প্রতিষ্ঠিত ধ্যানধারণাকে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত ও পরিবর্তিত করে দিয়েছেন।
মূল কথাটা রয়ে গেল এই যে, বীর তারাই, যারা পৃথিবীটাকে বুঝতে চান ও তাকে বদলাতে চান। আমাদেরও কাজটা হওয়া চাই ওই রকমেরই। আমরা প্রত্যেকেই যে বীর হব এমন নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু বীরদের পথ ধরে চলতে চাইব না কেন? আরেকটা কথা, যারা বীর হন তারা কেউই কিন্তু স্বার্থপর হন না। কেবল নিজের কথা ভাবেন না, সবার কথা ভাবেন। নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়ে অন্যদের কথা ভাবার ব্যাপারটা একেবারেই প্রাথমিক বটে।
লেখকঃ ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে অসংখ্যবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। ১৯৭৮, ১৯৯২ বা ২০১২-এ বড় পরিসরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার মুখে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাস করছে। আর সে তালিকায় প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছে নতুন জন্ম নেওয়া ৩০ হাজার রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘকালের হলেও মূলত ২০১৭ সালের গণহত্যার পর এই সংকট বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা যখন মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সীমান্ত প্রত্যাখ্যাত হচ্ছিল তখন বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সীমান্তকে উন্মুক্ত করে দেয়। ২০১৭ সালের সে আপদকালীন আশ্রয়ের পর রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের আলোচনা হওয়া উচিত রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিয়ে। ‘নিউইয়র্ক ডিক্লারেশন ফর রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেন্টস’-এর মতে, একটি রিফিউজি হোস্ট রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যে সার্বিক সহযোগিতা পাওয়ার কথা তা পায়নি। বর্তমানে ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। রোহিঙ্গারা অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা, পরিবেশ সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, স্থানীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে দ্বন্দ্বসহ নানা সংকটের কারণ হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকটের দুটি সমাধান ১. সম্মানজনক ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন, ২. তৃতীয় কোনো দেশে স্থানান্তর।
দ্বিতীয় সমাধানের বাস্তবতা খুবই কম। কারণ এত সংখ্যায় রোহিঙ্গাকে তৃতীয় দেশে স্থানান্তর করা ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে আগ্রহী তৃতীয় দেশের সঙ্গে সংকটাপন্ন এলাকার কোনো ভৌগোলিক সংযোগ নেই। রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান হতে পারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন। বর্তমানে খুবই স্বল্প সংখ্যক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনা চলছে। তবে এসব আলোচনাকে নানা কারণে প্রশ্নের মুখে রাখা যায়। মনে রাখতে হবে এটা সেই মিয়ানমার যারা কোনো আন্তর্জাতিক রিপোর্ট, উদ্বেগ, অনুরোধকে তোয়াক্কা না করে ইতিহাসে জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর। এমনকি তাদের ন্যূনতম ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাকারী সংস্থাগুলোকে রাখাইনে প্রবেশ করতে দেয়নি। কোনো সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীদের প্রবেশাধিকার ছিল না। রাখাইনে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে স্যাটেলাইট ইমেজের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। সে মিয়ানমারের আলোচনা উদ্যোগকে সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আট লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছিল। এরপর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ৬৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি ফিরতি তালিকা পাঠানো হয়। ওই তালিকা থেকে পরিবারভিত্তিক প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাথমিকভাবে ১১৪০ জনকে বাছাই করা হয়। ফলে লাখ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে হাজারখানেক রোহিঙ্গার নামমাত্র প্রত্যাবাসন সংকটের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়ার একটা কৌশল হতে পারে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে চীনের মধ্যস্থতায় সাম্প্রতিক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। চীনের পক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার লি ঝা উই এবং মিয়ানমারের পক্ষে সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব আই ই চান। বৈঠকটি নিঃসন্দেহে হাই প্রোফাইলের। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট কোনোভাবেই সৌদি-ইরানের মতো কোনো দ্বিপক্ষীয় সংকট নয় যে, তৃতীয় দেশের দূতের মধ্যস্থতায় দুটি দেশের কূটনীতিকরা বসে একটা সমাধান আনলেন। চীন এখানে মধ্যস্থতাকারী মাত্র, চীন শুধু দুই দেশের সঙ্গে থাকা তার সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে মিডলম্যানের কাজটা করছে। মিয়ানমার যদি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার মাঝখানে বেঁকে বসে সে ক্ষেত্রে এই বৈঠক বা ঐকমত্যে গ্যারান্টার কে হবে!
গত এপ্রিল মাসে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় মিয়ানমারকে তাদের যুক্তি পেশ করতে হয়েছে। যুক্তিতর্কে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে তারা কী পদক্ষেপ নিচ্ছে তার একটা বিশদ ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। এই যুক্তি-তর্ক বেশ একটি চলমান প্রক্রিয়া। ফলে নামমাত্র এই প্রত্যাবাসন আইসিজের কাছে সংকট সমাধানে মিয়ানমার আন্তরিকতা প্রমাণের একটি কৌশল হতে পারে। মিয়ানমার ভূকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থল ও সমুদ্রসীমার দেশ। বর্তমান জান্তা সরকারের ন্যূনতম বৈদেশিক গ্রহণযোগ্যতা নেই, এমনকি আসিয়ানও জান্তা সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের নামমাত্র প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে নিজেদের ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে চাইছে। বাংলাদেশকে এসব ফ্যাক্টসকে মাথায় রাখতে হবে। এমনিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বের মনোযোগ রোহিঙ্গা সংকট থেকে সরে গেছে। চলমান বৈশ্বিক ক্রাইসিস ফান্ডও কমে আসছে। সুতরাং প্রত্যাবাসন আলোচনা সংকটে গুরুত্ব কমানোর একটি প্রক্রিয়া কিনা সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
মিয়ানমারের বর্তমান সরকার ও সবসময়ের জন্য অর্থনীতি, সামরিক নীতি ও রাজনীতিতে চীন এতটাই প্রভাবশালী, চীনকে এড়িয়ে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কঠিন। অন্যদিকে, রোহিঙ্গাদের রাজ্য রাখাইনে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। গভীর সমুদ্রবন্দর, গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল মিলিয়ে রাখাইন রাজ্যে চীনের ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। বিনিয়োগকৃত একটি অঞ্চলকে বিরোধপূর্ণ রাখাও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে চীনের স্বার্থেও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান দরকার। কিন্তু রোহিঙ্গাদের পূর্ণ মর্যাদা, অধিকার ও নিরাপত্তার সহিত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তত্ত্বাবধানে প্রত্যাবাসন হওয়া জরুরি। জাতিসংঘ ও আসিয়ানের অংশগ্রহণ ছাড়া বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের অস্বীকৃত একটি সরকারের সঙ্গে শুধু চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলমান ও কত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে তা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ঘোষণা দরকার। চলমান প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার যদি কিছু রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার পর ঠুনকো অজুহাতে তাদের অত্যাচার-নিপীড়নের মুখে আবার বাংলাদেশে ফেরত পাঠালে রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধানই হবে না।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
দেশের বিভিন্ন ক্লিনিকের বিরুদ্ধে, বহুবার নবজাতক বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। কোনো অভিযোগেরই বিচার হয়নি। হলেও গণমাধ্যমে সেই ঘটনা প্রকাশিত বা প্রচারিত হয়নি। অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কেউ গোপনে সম্ভবত সেই সমস্যার সমাধান করেছেন। যে কারণে, এ ধরনের অপরাধে যুক্ত হতে কোনো ধরনের দ্বিধা বা ভয় কাজ করে না। যদি এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হতো, যদি নবজাতক বিক্রি আইন করে নিষিদ্ধ করা হতো এবং যদি নিয়মিতভাবে এসব পর্যবেক্ষণ করা হতো, তাহলে গাজীপুরের শ্রীপুরে নবজাতক বিক্রির যে অভিযোগ উঠেছে, সেই ঘটনার ক্ষেত্র প্রস্তুতের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।
তবে একটা ঘটনা যে আছে, তা প্রসূতি নারীর বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। প্রসূতি প্রিয়া আক্তার জানিয়েছেন, তার স্বামী দিনমজুর। তাদের আরও দুটি সন্তান রয়েছে। গত রবিবার প্রসবব্যথা নিয়ে শ্রীপুর চৌরাস্তার নিউ এশিয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যান। সেখানে জাহাঙ্গীর আলম নামে একজন নিজেকে চিকিৎসক বলে পরিচয় দেন। জাহাঙ্গীর তাকে জানান, দ্রুত সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসব না করলে মা ও সন্তান দুজনেরই সমস্যা হবে। আর এই অপারেশন করতে ১৫-১৬ হাজার টাকা লাগবে।
প্রিয়া বলেন, ‘আমার স্বামী যখন যে কাজ পায় সেই কাজই করে। এতে আমাদের সংসার কোনোমতে চলে। বাসা ভাড়া আর সংসারে খাবার জোগাতেই টাকা শেষ। আমার স্বামী চেষ্টা করেও টাকা জোগাড় করতে পারেনি। পরে জাহাঙ্গীর আমাকে প্রস্তাব দেয়, বাচ্চাকে তার কথামতো হাতে তুলে দিলে নগদ টাকা দেবে। ছেলে হলে ৫০ হাজার, মেয়ে হলে ৩০ হাজার টাকা। হাসপাতালের বিলও লাগবে না। পরে আমরা রাজি হয়েছি।’
পৃথিবীতে একজন মা, কতটুকু অসহায় হলে গর্ভজাত সন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হন? এই ঘটনা সত্য হলে, অভিযুক্ত ক্লিনিক সিলগালা করে দেওয়া হোক। চিকিৎসক-পরিচালক-ম্যানেজার মো. জাহাঙ্গীরকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা হোক। যদি তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে এমন শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের অমানবিক কাজে যুক্ত হতে না পারে। পাশাপাশি এই ঘটনা প্রকাশের মাধ্যমে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। বিষয়টি যেমন অমানবিক, তেমনি পাশবিক।
অবশ্য এই ঘটনার উল্টো দিকও আছে। পৃথিবীর বহু দেশে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, যারা সদ্যপ্রসূত সন্তানের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অনেক দেশে এই সন্তান চড়া মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। কারণ, ল্যাবরেটরিতে বিশেষ গবেষণা এবং নতুন ধরনের ওষুধ আবিষ্কার করতে দীর্ঘদিন ধরে, সদ্যপ্রসূত মানবসন্তানের ওপর গবেষণা হচ্ছে। আবার এটাও সত্যি, অনেক ধনী মানুষ আছেন যারা নিঃসন্তান। সেই তারাই, বিভিন্ন ক্লিনিকের সঙ্গে গোপনে চুক্তিবদ্ধ হন। তবে এ ধরনের ঘটনা যেকোনো শহরের প্রান্তিক অঞ্চলে বেশি দেখা যায়।
অবশ্য নিজেকে চিকিৎসক পরিচয় দেওয়া ক্লিনিকটির ম্যানেজার কাম পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর নবজাতক বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। আর বিষয়টি শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রণয় ভূষণ দাসকে অবগত করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এ ধরনের বক্তব্যের কারণেই, একজন অপরাধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে সাহসী হয়ে ওঠে। কারণ তারা জানে, একজন পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারেন! সেই সঙ্গে তাকে ম্যানেজ (!) করা কঠিন কোনো বিষয় নয়।
একশ্রেণির মানুষের মধ্যে দুর্বিষহ দারিদ্র্য আঘাত হানছে এটা প্রমাণ করতেই এই ঘটনা? নাকি কোনো পাচারকারী দলের সঙ্গে জড়িত রয়েছে মো. জাহাঙ্গীর? ঘটনা যা-ই হোক, বিষয়টি উচ্চপর্যায়ে সুষ্ঠু তদন্ত করা দরকার। এ বিষয়ে কোনোভাবেই, উন্নাসিকতার সুযোগ নেই।
১৯৬৪ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু। তার জন্ম ১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে। তাদের পরিবার মূলত কাশ্মীরি প-িত বংশের উত্তরসূরি। তার বাবা ভারতের বিখ্যাত আইনজ্ঞ ও কংগ্রেসের একসময়কার সভাপতি মতিলাল নেহরু ও মা স্বরূপ রানী। আনন্দ ভবন নামক বিশাল বাড়িতে পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তিনি বেড়ে ওঠেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ডের হ্যারোতে চলে যান। প্রকৃতিবিজ্ঞানের ওপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে তিনি লেখাপড়া করেন। পরে কেমব্রিজেই ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেন। ইংল্যান্ডে পড়ার সময় তিনি ভারতীয় ছাত্র সংসদের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এ সময়েই তিনি সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন। ভারতে ফিরে আসার পর ১৯১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি কমলা কাউলকে বিয়ে করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় একজন আইনজ্ঞ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মহাত্মা গান্ধীর দর্শন ও নেতৃত্ব তাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। চাম্পারান আন্দোলনের সময় তিনি গান্ধীর সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাকে সাহায্য করেন। গান্ধীর প্রভাবে তিনি পরিবার ও ভোগ-বিলাসের জীবন ত্যাগ করেন। তখন থেকে তিনি খাদির তৈরি কাপড় পরতেন। গান্ধীর প্রভাবে তিনি ভগবত গীতাপাঠ ও যোগ ব্যায়াম শুরু করেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনেও গান্ধীর কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন এবং তার সঙ্গেই বেশির ভাগ সময় কাটাতেন। একজন বিশিষ্ট সংগঠক হিসেবে তিনি উত্তর ভারতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, বিশেষ করে যুক্ত প্রদেশ, বিহার ও কেন্দ্রীয় প্রদেশগুলোতে। ১৯৪৭ সালে তিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার শাসনামলে ভারতে ব্যাপক শিল্পায়ন হয়।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) হলের আসন দখল করে রাখার বিরুদ্ধে অনশনরত ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম প্রত্যয়সহ তাকে সমর্থন দেওয়া কয়েকজনের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।তারা বলেন, ওই স্থানে গত বুধবার রাত থেকে অনশনে ছিলেন প্রত্যয়। তাকে মারধরের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায় হামলায় জড়িতরা। এ সময় প্রত্যয়ের দাবির সঙ্গে সংহতি জানানো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা হয়।
জানা গেছে, তিন দাবিতে গত বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনের খেলার মাঠে অনশনে বসেন প্রত্যয়। তিনি ওই হলের আবাসিক ছাত্র। তার অন্য দুটি দাবি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করা ও হলের গণরুমে অবস্থান করা বৈধ ছাত্রদের আসন নিশ্চিত করা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং নবীন শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছিলেন। ওই সময় ক্যাম্পাসে লোডশেডিং চলছিল। হঠাৎ করেই প্রত্যয়সহ তার সঙ্গে থাকা অন্যদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
হামলায় জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী, মার্কেটিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সৃষ্টি, চারুকলা বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের মনিকা, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ৪৮তম ব্যাচের সুরসহ আরও কয়েকজন আহত হন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, হামলায় ৩০ থেকে ৪০ জন অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। অভিযুক্তদের কয়েকজন হলেন ছাত্রলীগ নেতা ও রসায়ন বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী গৌতম কুমার দাস, তুষার, ফেরদৌস, নোবেল, গোলাম রাব্বি, মুরসালিন, মুরাদ, সোহেল, তানভীর, রায়হান, রাহাত, সৌমিক, তারেক মীর, সজীব ও নাফিস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানান, আমরা যারা প্রত্যয়ের সঙ্গে ছিলাম তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর প্রত্যয়কে দেখতে চিকিৎসক এসেছিলেন। তখন তারা অ্যাম্বুলেন্সের ওপর হামলা করে সেটি ফিরিয়ে দেয়। প্রক্টরকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি আসেননি। একাধিক ছাত্রীর দিকেও চড়াও হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলের এক শিক্ষার্থী অসুস্থ এমন একটি ফোনকল পেয়ে তারা অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। তবে কে কল দিয়েছিল সে সম্পর্কে চিকিৎসা কেন্দ্রের কেউ বলতে পারেননি।
তবে যে ফোন নাম্বার থেকে কল দেওয়া হয়েছিল সেটিতে যোগাযোগ করে দেখা যায় নাম্বারটি শাখা ছাত্রলীগের নেতা গৌতম কুমার দাসের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ১৫ হাজার শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। দরকার হলে আমি পদত্যাগ করব।
এদিকে হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে রাতেই বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিল নিয়ে তারা এ রাত পৌনে ১টায় প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করছেন।
তবে অনশনরত শিক্ষার্থী সামিউলের ওপর হামলারে পেছনে ছাত্রলীগের কোনো হাত নেই বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, মীর মশাররফ হোসেন হলের অনশনরত ওই শিক্ষার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। তবে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে। সেখানে ছাত্রলীগের একজনও জড়িত নয়।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।