
বাজেট যেমন প্রতি বছরের রুটিন কাজ তেমনি বাজেটের বেশিরভাগ পরিকল্পনাই রুটিনমাফিক, অনেক সময় বছর বছর খাতসমূহের ধারাবাহিক বরাদ্দের বৃদ্ধি। তারপরও এবারের বাজেটে বেশ কিছু ব্যতিক্রম আছে। এই প্রথম কোনো বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের রূপান্তরের বর্ণনা করা হয়েছে। সাধারণভাবে জাতীয় বাজেট এক বছরের আয় ও ব্যয়ের হিসাব ও এ সংশ্লিষ্ট নীতির উল্লেখ থাকে কিন্তু এবারের বাজেটে গত চৌদ্দ বছরে এই সরকারের অগ্রগতিসমূহ বিস্তৃত পরিসরে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে এই বাজেট যতটা না বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাব তার থেকে বেশি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি-কাঠামোর একটি বিশদ মূল্যায়ন। এটা সুখপাঠ্য নিঃসন্দেহে, তবে এতে বাৎসরিক পরিকল্পনার অগ্রাধিকারসমূহ বোঝা বেশ কষ্টকর ঠেকছে।
এই বাজেটের অন্যতম শক্তিশালী দিক হচ্ছে এখানে স্মার্ট বাংলাদেশের একটি রূপরেখা প্রদান করা হয়েছে। এতে চারটি স্তম্ভ যেমন ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সোসাইটি’, ‘স্মার্ট গভর্নমেন্ট’ ও ‘স্মার্ট ইকোনমি’ ইত্যাদির বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। বাজেটে এর সপক্ষে উল্লেখ করা হয়েছে স্মার্ট সিটিজেন গড়ার অংশ হিসেবে ২০২৬ সালের মধ্যে ২০ হাজার তরুণ-তরুণীকে উচ্চতর প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ প্রদানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ও ইনোভেশন সেন্টারের মাধ্যমে ৮০ হাজার তরুণ-তরুণীকে উচ্চতর প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যত্র বলা হয়েছে, হাইটেক পার্কের মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫২ হাজার এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দুই লাখ যুব জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। সংখ্যাটা একেবারে ছোট না, তবে বাংলাদেশের বিশাল যুব জনগোষ্ঠীর তুলনায় এই সংখ্যাটি কত অপ্রতুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না যেখানে দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ২৮ শতাংশ তরুণ বা যুব এবং আগামী দিনগুলোতে এরাই হবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কারিগর তেমনটাই প্রত্যাশা।
অন্যদিকে বাজেটে স্মার্ট গভর্নমেন্ট এর অংশ হিসেবে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, তথ্য বাতায়ন, মাইগভ প্লাটফর্ম, ই-নথি, ই-নামজারি, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ইত্যাদির কথা হয়েছে। একই ভাবে স্মার্ট ইকোনমি’র মাধ্যমে দ্রুত ও নিরাপদ লেনদেন, ক্যাশলেস সোসাইটি, স্টার্ট-আপ কার্যক্রম ও ১০০টি স্টার্ট-আপ এ বিনিয়োগ ইত্যাদি বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। আর স্মার্ট সোসাইটির অংশ হিসেবে ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আলোকে ‘সকলের সাথে সমৃদ্ধির পথে’ এই স্লোগানের প্রতি প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। তবে বাজেটের বরাদ্দ বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রচেষ্টা খুব একটা ইতিবাচক বলা যাবে না। তথ্য প্রযুক্তি খাতে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে যুব মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত বরাদ্দ আসছে বছরে এ বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, এর মধ্যে উন্নয়ন বাজেট হ্রাস পেয়েছে পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি। শিক্ষায় বাজেট এখনো জিডিপির দুই শতাংশের নিচে যেখানে ৩৫টি স্বল্পোন্নত দেশ শিক্ষায় দুই শতাংশ বা তারও বেশি ব্যয় করে থাকে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও একই অবস্থা এখনো বরাদ্দ জিডিপির এক শতাংশের নিচে।
স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের ওপরের বর্ণনা ও বরাদ্দের আলোকে স্মার্ট শব্দটি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে। এখানে যে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে তাতে নতুনত্বের তুলনায় প্রচলিত ধারাবাহিকতায়ই বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার অনেকগুলোতেই দেশের মানুষ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। অন্যদিকে স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে প্রথম প্রথম স্মার্ট শব্দটির সঙ্গে আমাদের পরিচয়ের সূত্রপাত হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী সেই ধারণায় অনেক পরিবর্তন এসেছে এতে যেমন নতুন প্রযুক্তি যোগ হচ্ছে একই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন বিশ্বব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি। যে দৃষ্টিভঙ্গি সক্ষমতার কথা বলে, সমতার কথা বলে, টেকসই পৃথিবীর কথা বলে। আর স্মার্ট বাংলাদেশের সংজ্ঞায় তা কতটুকু ধারণ করা গেছে তাই এখন প্রশ্নসাপেক্ষ। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই স্মার্ট বাংলাদেশে সম্ভাব্য রূপকল্প বিস্তৃত পরিসরে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা ও মতামত গ্রহণের দাবি রাখে।
স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণায় টেকসই বাংলাদেশ নির্মাণের ওপর যেমন গুরুত্ব দেওয়া দরকার একই সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া দরকার ‘স্মার্ট গভর্নেন্স’-এর ওপর যদিও বাজেটে ‘স্মার্ট গভর্নমেন্ট’-এর কথা বলা হয়েছে। গভর্নমেন্ট ও গভর্নেন্স এই দুইয়ের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক সেটা সংশ্লিষ্ট সবাই অনুধাবন করতে পারেন। টেকসই পৃথিবী প্রয়োজনীয় গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোজন, প্রশমন, নদী-খাল-বিল দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ের ওপর কেমন যেন দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। যেখানে মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ শতাংশ উল্লেখ করলেও এবারের বাজেটে তা মাত্র ১০ শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে যেখানে বাংলাদেশ অন্যতম ভুক্তভোগী দেশ সেখানে টেকসই পৃথিবী ও টেকসই বাংলাদেশ নির্মাণের এই ধারণাগুলো এড়িয়ে কীভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ করা যাবে তা বোধগম্য না। অন্যদিকে দায়সারা গভর্নেন্সের ধারণা আমাদের দেশের পশ্চাৎপদতার অন্যতম মূল কারণ। হোক পর্যাপ্ত জনবলের অভাব, হোক দক্ষতার অভাব বা দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা, জেঁকে বসা অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিই যেন শাসনব্যবস্থার নির্মম বাস্তবতা। লালফিতার সংস্কৃতিতে প্রতি পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হওয়া বোধকরি সাধারণ জনগণের জন্য কোনো নতুন অভিজ্ঞতা নয়। যতই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলা হোক না কেন এখানে সাধারণ সেবা গ্রহণকারীরা কোনো অবস্থায়ই শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীয় অবস্থানে থাকেন না, তাদের অবস্থান হয় নিতান্তই প্রান্তে। এখন স্মার্ট বাংলাদেশেও কি এই অবস্থার ধারাবাহিকতাই দেখতে পাব? গভর্নমেন্ট স্মার্ট হলো, কিন্তু গভর্নেন্স সেই পুরনো ধ্যানধারণার ভিত্তিতে চলতে থাকল তাহলে এই স্মার্ট বাংলাদেশের সার্থকতা কী? এবারের বাজেট ডকুমেন্টে বলা হয়েছে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৫৭২টি আইন পাস হয়েছে কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠান আইন যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন এর ন্যায্য বাস্তবায়ন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরে নিঃসন্দেহে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই, বাজেট সেই বিনিয়োগের নীতি রূপরেখা তৈরি করবে সেটাই কাম্য। তবে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ আছে কি না, আর সম্পদ সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় প্রগতিশীল (স্মার্ট) কর কাঠামোর বাস্তবায়ন করতে পারছে কি না সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। আর এর পাশাপাশি রয়েছে কর ফাঁকির নানা ব্যবস্থা। এসব কারণে প্রতি বছরের মতো প্রয়োজনীয় খাতে সম্পদ বরাদ্দের ঘাটতি এবারের বাজেটেও চোখে পড়বে। উন্নয়নের বাজেটের প্রায় সবটাই হয় ঘাটতি বাজেটের ওপর নির্ভর করে ফলে যেকোনো আর্থিক সংকটেই এটাই কাটছাঁট করা হয় সবার আগে যেমনটা আমরা দেখেছি গত বছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে পারাই হচ্ছে স্মার্ট বাজেটের অন্যতম অনুষঙ্গ।
সবশেষে বলা যায়, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য এবারের বাজেটে যুবদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কিছু উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এই উদ্যোগগুলো যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতিসহ, প্রকৃতি-পরিবেশ ও অন্য বিষয়সমূহের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ শুধু কোনো প্রযুক্তি সম্পর্কিত বিষয় হতে পারে না মূলত এটি একটি সংস্কৃতি এবং তা শুধু দেশীয় পরিপ্রেক্ষিতেই বিবেচনা করলে হবে না বরঞ্চ তাল মেলাতে হবে বিশ্বপরিস্থিতি ও মানদণ্ডের সঙ্গে। আর একে শুধু একটি ধারণার ওপর ছেড়ে দিলে হবে না এর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যার জন্য পরিবর্তনটা আনতে হবে সামগ্রিক, একদম ভেতর থেকে, সাধারণ মানুষের ওপর নির্ভর করে, তাদের মর্যাদা ও পরিবর্তনকে সবার আগে গুরুত্ব দিয়ে।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
নির্মল সেন, দীন মোহাম্মদ ও আবদুর রশীদ ছদ্ম পরিচয়ের অন্তরালে তিনজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ-অধ্যাপক যথাক্রমে নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমান একাত্তরের মার্চে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পৌঁছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতে থাকেন। আবদুর রশীদ কখনো অশোক রায়ও হয়েছেন। তাদের কাজের শুরুটা আরও আগে, পঞ্চাশের দশকেই পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বঞ্চনা স্পষ্ট হওয়ার পর থেকেই। বিভিন্ন ব্রিটিশ ও মার্কিন বিশ^বিদ্যালয়ে খ-কালীন দায়িত্ব নিয়ে তারা একসময় ভারতও ছাড়েন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এ পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান সংকট নিয়ে গৃহীত অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হওয়ার পর আনিসুর রহমান ম্যাসাচুসেটস-এর উইলিয়াম কলেজে শারদ মৌসুমের অতিথি অধ্যাপক হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় শীর্ষক একটি পাঠ প্রকল্প পরিচালনার নিমন্ত্রণ পান। ওদিকে একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতা ছেড়ে বাংলাদেশের দিকে রওনা হন, স্বাধীনতার ১৬ ডিসেম্বর তিনি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মুক্ত শহর কুষ্টিয়াতে। উইলিয়ামস কলেজের সঙ্গে চুক্তির বরখেলাপ না করতে এবং প্ল্যানিং কমিশনের কিছু অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে ঢাকা না এসে কলকাতা ফিরে গেলেন এবং সেখান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ততদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এসেছেন। উইলিয়ামস টাউন নিবাসী আনিসুর রহমান সংবাদপত্রে দেখছেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং মোশাররফ হোসেন ও রেহমান সোবহানকে সদস্য করে একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে তিনি ডেপুটি চেয়ারম্যানের টেলিগ্রাম পেলেন: APPOINTED MEMBER PLANNIG COMMISSION, JOIN EMMEDIATELY. NURUL ISLAM দিল্লিতে অশোক মিত্রের বাড়িতে অবস্থানকালে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি বলেন: ‘...বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পর আমরা দেশে ফিরলে দেশের অর্থনৈতিক প্রশ্নে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য আমাদের ডাক পড়বে, কিন্তু আমাদের উচিত হবে সরাসরি সরকারে যোগ না দিয়ে বাইরে থেকে পরামর্শ দেওয়া। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ রাজনৈতিক বিবেচনা অনুযায়ীই নেওয়া হবে, আমাদের কথামতো নেওয়া হবে না, কাজেই এই সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমরা পার্টি হয়ে গেলে আমাদের পজিশন কম্প্রোমাইজড হয়ে যাবে। এই কথায় আমার সব কলিগ সায় দিয়েছিলেন।’ বন্ধনী দিয়ে আনিসুর রহমান এর পরপরই যোগ করেন যদিও আসল ঘটনা অন্যরকম হয়ে যায়।
দেশে ফিরে জানতে পারেন ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ তার নিয়োগের গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে, গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে যোগ দেন, নিভৃতেই থাকতে চেয়েছেন।
‘পথে যা পেয়েছি’ প্রথম পর্ব থেকে উদ্ধৃত: প্রথমে ফোন করলেন পরিকল্পনা কমিশনের ‘মেম্বার ওয়ান’ (অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন)। ‘কী আনিস, তুমি জয়েন করছ না? তোমাকে ভীষণ দরকার অনেক কাজ।’
আমি বললাম ‘আমার সঙ্গে তো দিল্লিতে কথা হয়েছিল আমরা জয়েন করব না। আপনারা জয়েন করে ভুল করেছেন। আমি করতে চাই না। তা ছাড়া, সবাই ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিলে ছাত্রদের পড়াবে কে?’
তখন স্বয়ং ডেপুটি চেয়ারম্যান (অধ্যাপক নুরুল ইসলাম) ফোন করলেন। তাকেও একই কথা বললাম। তিনি বললেন তার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু আমি বেয়াদবের মতোই বললাম, দেখা করতে হয় আপনি আসুন।’ তিনি আমার শিক্ষকতুল্য (আমাকে সরাসরি পড়াননি, তবে আমার মাস্টার্স থিসিসের এক্সটার্নাল এগজামিনার ছিলেন), তা ছাড়া পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে তার এখন ক্যাবিনেটমন্ত্রীর পদমর্যাদা। তিনি কী করে আমার কাছে আসবেন?’
পরে মেম্বার ওয়ানের মধ্যস্থতায় ডেপুটি চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্য (মোশাররফ হোসেন ও রেহমান সোবহান) ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর অফিসে আসেন। সেখানে আনিসুর রহমানকে তাড়াতাড়ি পরিকল্পনা কমিশনে যোগ দিতে বলেন। আনিসুর রহমান ছয় মাসের জন্য মেম্বার থ্রি হিসেবে যোগ দিতে রাজি হলেন। ছ’মাসে যদি বুঝতে পারেন সরকার তার প্রত্যাশা পূরণ করে এগোচ্ছে তাহলে দায়িত্ব পালন করে যাবেন, নতুবা ছেড়ে দেবেন।
১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ কৃচ্ছ্রসাধনের আদেশ জারি করার লক্ষ্যে তিনি ডেপুটি চেয়ারম্যানকে যে নোট দেন তা আমলা-মন্ত্রী সবাইকে তার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন করে তোলার জন্য যথেষ্ট। ১৯৭২ সালেই তার মনে হয়েছে ঢাকায় গাড়ির প্রসেশন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়... ‘আমাদের মতো একটা দরিদ্র দেশে এরকম বিলাসী গাড়ির প্রদর্শন আমাদের দরিদ্র জনগণের জন্য নিদারণ অপমানকর, সমতানীতির বিরুদ্ধে এবং দেশ গড়ার কাজে দরিদ্র জনগণের উৎসাহের ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব। এসব গাড়ির স্পেয়ার পার্টস আমদানি নিষিদ্ধ করতে চেয়েছেন যাতে গাড়িগুলোর দ্রুত মৃত্যু ঘটে, অথবা বিদেশে বেঁচে দিতে বলেছেন। গাড়ির ব্যবহার প্রয়োজনভিত্তিক হওয়া প্রয়োজন, স্ট্যাটাসভিত্তিক নয়।’
তিনি প্রস্তাব করেন, সরকারের মালিকানায় যে সব বড় গাড়ি আছে তা বেশির ভাগ জেনারেল পাবলিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হোক অথবা সম্ভব হলে বিদেশে রপ্তানি করে দেওয়া হোক।
এ আশা তিনি অবশ্যই করতে পারেন, কিন্তু তার নিজের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও সদস্যদ্বয়কে রাজি করাতে পেরেছেন কি না সে সন্দেহ তো রয়েই গেছে। মার্কিন কিংবা ব্রিটিশ বিশ^বিদ্যালয়ে সমাজতন্ত্রের পাঠ নেওয়া তাত্ত্বিক বিদ্বানদের তাতে ‘হ্যাঁ’ করার কথা নয়। আনিসুর রহমান লিখলেন, ‘কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যায় এ দেশ মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুত সমতাবাদী/সমাজতন্ত্রের পথে এত সহজে এগুবে না। পরিকল্পনা কমিশনের ভেতরেই এবং সঠিকভাবে প্রশাসনে হায়ারার্কিকাল চেতনা তীব্র। অফিসে আমাদের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর এবং মেঝেতে শৌখিন কার্পেটের ব্যবস্থা করা হয় সে সময় এটাও আমার অহেতুক বিলাসিতা মনে হয়েছিল। আমি এরকম ঘর নিইনি, কার্পেটবিহীন ফ্যানওয়ালা ঘরেই অফিস করে গেছি।’
তিনি লিখেছেন, শুরু থেকেই প্ল্যানিং কমিশনের সঙ্গে সিভিল সার্ভিসের আমলাদের একটা টেনশনের সম্পর্ক তৈরি হয় ইউনিভার্সিটির মাস্টাররা মন্ত্রী আর প্রতিমন্ত্রীর র্যাঙ্ক নিয়ে র্যাঙ্কের জোরে সচিবদের ডেকে পাঠাবার অধিকার অর্জন করেছেন। সিএসপিদের উল্লেখযোগ্য অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং কেউ কেউ পরিকল্পনা কমিশনের প্রফেসরদেরও আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সামন্ত সংস্কৃতি ও আমলা আচরণের নিবিড় নৈকট্য আনিসুর রহমান তুলে ধরেছেন এবং মর্যাদার হায়ারার্কিতে তার সহকর্মীরাও একই সামন্ত সংস্কৃতির ধারক সে ইঙ্গিতও দিয়েছেন।
‘যুদ্ধবিধ্বস্ত’ দেশজুড়ে মানুষের এত কষ্টের মধ্যে এলিট শ্রেণির ভোগবিলাসের চাকচিক্য দেখে আমি ৮ মার্চ (১৯৭১) প্রধানমন্ত্রীকে ‘প্রথম পদক্ষেপ’ বলে একটি প্রস্তাব লিখে পাঠাই।’ প্রথাগতভাবে ডেপুটি চেয়ারম্যানের হাত হয়ে পাঠাতে গেলে হয়তো আটকে যেত সে আশঙ্কা থেকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে পাঠিয়ে ‘প্রথম পদক্ষেপ’-এর অনুলিপি তাকে দেন। অন্যসব মন্ত্রীকেও দেন। এই কর্মটি ডেপুটি চেয়ারম্যানের ‘অসোয়াস্তি’-র কারণ ঘটিয়ে থাকতে পারে।
বাহাত্তরের এপ্রিলে ঢাকা টেলিভিশনের আগে কেনা কিছু যন্ত্রপাতি স্থাপনের জন্য সোয়া লাখ টাকার বরাদ্দের জন্য আবেদন জানানো হলে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্বাসন অগ্রাধিকারের কথা বললেন এবং গণমুখী টেলিভিশনের সুপারিশমালা দিতে একটি কমিটি করে দিলেন যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপিত হয়েছে বলা মুশকিল, ‘কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় সদস্যরা যখন ডেপুটি চেয়ারম্যানের অফিস কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর ভারীকণ্ঠ শোনা যায়, ‘ডাক্তার সাহেব আপনারা পরিকল্পনা কমিশনে খুব বাড়াবাড়ি করেছেন। টেলিভিশনের ওপর কমিটি করতে আপনাদের কে অধিকার দিয়েছে? আমি এর রিটেন এক্সপ্ল্যানেশন চাই।’ ডেপুটি চেয়ারম্যান ঘাবড়ে গেলেন।
‘আনিস, প্রধানমন্ত্রী আমাদের কমিটি করার ওপর রিটেন এক্সপ্ল্যানেশন চাচ্ছেন, কী বলব?’ আমি বললাম এতে তো কোনো সমস্যা নেইÑ আজ তো শনিবার কাল ছুটি আপনি বলেন যে সোমবার সকালে আমরা তার কাছে গিয়ে রিটেন এক্সপ্ল্যানেশন দিয়ে আসব।’
পরিকল্পনা কমিশনের করা কমিটি বাতিল হলো। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লেখা পত্রটি একই সঙ্গে এক্সপ্ল্যানেশন এবং আনিসুর রহমানের পদত্যাগপত্র। দীর্ঘপত্রের শুরুটা ও শেষটা কেবল উদ্ধৃত করছি:
‘টেলিভিশন ব্যবস্থার র্যাশনালাইজ করবার জন্য কমিটি’ নাম দিয়ে যে কমিটি গঠন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং যে ঘটনা নিয়ে মনে হয় বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে সেটার জন্ম দেওয়ার জন্য আমিই দায়ী।’ সুতরাং তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো পথ দেখছেন না। অতএব ‘অন্য কোনো আদেশ না পেলে আমি ৩০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে ডেপুটি চেয়ারম্যানের কাছে আমার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেব।’
অর্থমন্ত্রী পদত্যাগপত্র পড়ে শোনালেন আর প্রধানমন্ত্রী আনিসুর রহমানকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ডাক্তার সাহেব আমি সব বুঝতে পেরেছি, আপনি সমস্ত ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দেন, আমি সব ঠিক করে দেব। আর পদত্যাগপত্র ছি ছি আমাকে এভাবে লজ্জা দেবেন না।... আমি বুঝতে পেরেছি আপনাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ করার একটা বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। কারা এটা করছে তাও আমি বুঝে গেছি।’
প্রধানমন্ত্রীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে কি আর পদত্যাগ করা যায়?
প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার জন্য লন্ডনে। এ সময় পদত্যাগ করলে প্রধানমন্ত্রী আর তাকে জড়িয়ে ধরে আটকাতে পারবেন না। ২ আগস্ট ১৯৭২ প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসাকালীন অনুপস্থিতির সময় ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। কমিশনের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত হননি তখনো। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দাখিলের পর ২ অক্টোবর ১৯৭৩ তিনি কমিশন থেকে বেরিয়ে এলেন, তার ভাষায় প্রধানমন্ত্রী আমাকে (পরিকল্পনা কমিশন থেকে) ছেড়ে দিলেন।
অনুমেয়, পরিকল্পনা কমিশন হয়েছিল বটে, কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। এটা না টেকারই কথা।
লেখক: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও কলামিস্ট
কয়েক সপ্তাহ যাবৎ অনলাইন অফলাইন সংবাদপত্র ছাড়াও পুরো সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে গেছে একটি সংবাদে, সেটি হচ্ছে উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক কিংবা জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কর্মকর্তা ইত্যাদি পোস্টে। কীসের ওপর ভিত্তি করে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক কিংবা শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কর্মকর্তা? একজন শিক্ষক কী করলে বা কী কী করলে এলাকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হবেন, জেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হবেন, বিভাগের মধ্যে এবং জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হবেন। মানদন্ডগুলো কী কী? সেটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত না হলে বিষয়টি মূল্যহীন হয়ে পড়ে। একজন শিক্ষক উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ হলে শিক্ষার্থী, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি কিংবা সহকর্মীদের কতটা কাজে লাগবে, জাতীয় পর্যায়ে কীভাবে কাজে লাগবে? তার বর্ণনা থাকতে হবে। শিক্ষক বা শিক্ষা কর্মকর্তা তাদের পেশাগত জীবনে কতটা পরিবর্তন এনেছেন, তার চারদিক কতটা পরিবর্তন করতে পেরেছেন সেটি জানা প্রয়োজন।
একজন শিক্ষক যিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হয়েছেন তিনি কি শিক্ষার্থীদের জন্য এমন নতুন কিছু করেছেন যা আগে কেউ করেননি? শিক্ষকতায় ইনোভেশন প্রয়োজন সেখানে তার অবস্থান কী? তিনি কি জীবনে প্রাইভেট পড়াননি কিংবা পড়ালেও গরিব ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে কোনোদিন অর্থ নেননি? এমন কী ঘটেছে যা জাতির সামনে উদাহরণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে? যিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হলেন তাকে কি বিদ্যালয়ের অন্তত ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভালো বলেন? এমন কী হয়েছে যে তার পড়ানোর ধরন ভালো, তার আচরণ শিক্ষকসুলভ, বোঝানোর ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে আলাদা, তিনি কোন বিষয় নতুনভাবে, আনন্দের মাধ্যমে অন্যদের থেকে আলাদাভাবে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করেছেন যা অন্য শিক্ষকদের অনুকরণ করার মতো? অথবা, তিনি প্রায় ৭০ শতাংশ অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, অভিভাবকরা তার কথা শুনেন, তার আহ্বানে তারা সমাবেশে যোগ দেন। প্রতিষ্ঠান প্রধান তার অনেক ক্লাস দেখেছেন, অন্যান্য কাজ দেখেছেন এবং সন্তোষ প্রকাশ করেছেন লিখিতভাবে। একেবারে পিছিয়ে পড়া নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীদের তিনি ওপরে তুলেছেন। তিনি কোনোদিন ছুটি নেননি? তার শিক্ষার্থীরা কি ডিবেট কিংবা অন্য কোনো সহপাঠক্রমিক কাজে অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে পুরোপুরি আলাদা? এগুলোর কয়টি বিষয় ঘটেছে একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের ক্ষেত্রে, শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কর্মকর্তার ক্ষেত্রে? তার কোনো প্রমাণ আছে কি?
অধিকাংশ শিক্ষার্থী, অধিকাংশ অভিভাবক, অধিকাংশ সহকর্মী, প্রতিষ্ঠান প্রধান, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অফিসার, কমিটির বৃহদাংশের সদস্যরা কি কোন বিশেষ বিশেষ গুণাবলির উল্লেখ করেছেন যেজন্য একজন শিক্ষক কিংবা একজন শিক্ষা কর্মকর্তা উপজেলা/জেলা/বিভাগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন? নতুন কোন পদ্ধতিতে তার বিষয় পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে বিশেষ কোন কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন, কিংবা কোন গবেষণা করেছেন যার ফল অনেকের উপকারে এসেছে? এর কোনোটিই যদি না হয় তাহলে কীসের ওপর ভিত্তি করে একজন শিক্ষক শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা ও সম্মান অর্জন করছেন? এ ধরনের তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বে কি কোনো তৃপ্তি পাওয়া যায়? এটি কেন করা হচ্ছে? বিষয়টিকে হাস্যকর করা হচ্ছে না?
ফেসবুক পেইজে কুষ্টিয়ার এক শিক্ষকের একটি পোস্ট দেখলাম তার কাছে একটি মেসেজ এসেছে যে, কভিভকালীন আপনি শিক্ষায় অনেক অবদান রেখেছেন তাই আমাদের প্রতিষ্ঠান আপনাকে একটি সম্মাননা দেবে। উনি বলেছেন, কই আমি তো তেমন কিছুই করিনি। অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার কথা, দু’একটি হয়তো নিয়েছি। তারা বললেন, যা করেছেন তাই আমাদের কাছে মূল্যবান। তারপর উক্ত শিক্ষক বললেন, তো কী করতে হবে আমাকে। বললেন কিছুই না, শুধু হাজার দশেক টাকা দিতে হবে। আমাদের প্রশাসনিক খরচের জন্য। উক্ত শিক্ষক বলেছেন, টাকা দিয়ে সম্মাননা বা প্রাইজ কোনোটিই আমি নেব না। তারপর তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। অন্য কাউকে হয়তো ধরবে, কিছু শিক্ষককে এভাবে পেয়েও যাবে। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু শিক্ষককে দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়ে বলছেন কোথা থেকে তাদের বিরল সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে, অনেকে আবার সার্টিফিকেটসহ পোস্ট দিচ্ছেন। শিক্ষকদের মধ্যে এসব কী হচ্ছে?
এনসিটিবির এক সভায় একবার দেখলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব উপস্থিত শিক্ষকদের বলছেন, আপনারা মামা-চাচা ধরে এখানে এসে সবাই বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন। এক একজন বিশেষজ্ঞের চেয়ার দখল করেছেন। অনেকেই প্রফেসর হয়েছেন। জীবনে কোনো গবেষণাপত্র লিখেছেন? নিজ থেকে কোনো একটি রচনাও লিখেছেন, এমনকি একটি প্যারাগ্রাফও নিজ থেকে লিখেননি অথচ সবাই প্রফেসর হয়েছেন। সরকারি কলেজে এখন প্রফেসরের ছড়াছড়ি। ক্রাইটেরিয়া কী? তেমন কোনো ক্রাইটেরিয়া নেই। এত বছর চাকরিতে আছেন, ধরা করা একটু বেশি কিংবা অন্য কোনো পরিচয় আছে তাই তিনি প্রফেসর। এ ধরনের প্রফেসর হলে কতটুকু তৃপ্তি পাওয়া যায়? মজার ব্যাপার হলো কোনো অধ্যাপক বা এনসিটিবির কোনো বিশেষজ্ঞ একটি কথাও বলেননি। এখানে একটি বিষয় যোগ করার আছে সেটি হচ্ছে, সরকারি কলেজের শিক্ষকদের যখন প্রমোশন দেওয়া হয় তখন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো পাবলিকেশন বা অবদানের মতো কিছু একটা থাকা উচিত তা না হলে এর মূল্য বোঝা মুশকিল।
শিক্ষকতার ব্যাপারটি যাতে হাস্যকর না হয়ে যায় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে সবাইকে। জেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়া, এটি কি চাট্টিখানি কথা? শ্রেষ্ঠ মানে কী? তিনি ওই জেলার মধ্যে সবচেয়ে ভালো, আচরণে সবচেয়ে ভালো, মানবিকতায় সবচেয়ে ওপরে, সামাজিকতায় সবার ওপরে, নতুন কিছু করায় সবার ওপরে, কালচারাল দিক দিয়ে সবার ওপরে। এগুলো কোনো বাছবিচার নেই, বলে দিলাম উনি জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক! বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের চিন্তা করতে হবে।
কোনো শিক্ষকের অবদানের স্বীকৃতি এমনভাবে দিতে হবে যাতে তিনি বা তারা তৃপ্তি পান, তারা যেন বুঝেন এটি তাদের প্রকৃতভাবেই অর্জিত সম্মান। এটি অন্য কোনো পন্থায় আসেনি এবং মানুষের মনে যাতে প্রশ্ন না জাগে। তাহলে সবাই উৎসাহিত বোধ করবেন। আমরা নুরুল ইসলাম স্যারের কথা অনেকেই শুনেছি। অনেকেই সুন্দরগঞ্জে তার পরিবর্তন করা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখে এসেছি যা একটি কলেজ এমনকি বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনীয়। একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেখানে সরকারি নিয়মকানুনের মধ্যে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক কিছু করা যায় না, সেই পাহাড়সম অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন নুরুল ইসলাম স্যার। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস-চ্যান্সেলর কী করেন আমি দেখেছি তার চেয়েও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনেক বেশি কিছু করেছেন। দেশ-বিদেশ থেকে তার বিদ্যালয় দেখতে আসেন শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তারা। এ ধরনের শিক্ষকের কথা আলাদা, তাদের কিন্তু পুরস্কার দেওয়া হয় না, তাদের কথা প্রচারও করা হয় না। এ ধরনের শিক্ষক, এ ধরনের বিদ্যালয়ের প্রচার দরকার, প্রসার দরকার যাতে শিক্ষকরা উৎসাহিত হতে পারেন। এসবের দিকে আমরা খেয়াল না করে কীসের ওপর ভিত্তি করে উপজেলা, জেলা, বিভাগ এমনকি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কর্মকর্তা নির্বাচন করছি আর সেই খবরে সোশ্যাল মিডিয়া ভাসিয়ে দিচ্ছি?
লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিষয়ক গবেষক
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, বাংলাদেশে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। প্রতিদিনই এমন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে মানুষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চালকের বেপরোয়া ড্রাইভিং যেমন দায়ী তেমনি কিছু ক্ষেত্রে পথচারীর অসতর্কতাও যে দুর্ঘটনায় হতাহতের কারণ তা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। তবে আজ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো চালকের আমৃত্যু কারাদন্ড হয়েছে সে রকম তথ্য জানা নেই। তবে দুর্ঘটনার কারণে বিভিন্ন মেয়াদে অসংখ্য চালকের জরিমানা ও ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হয়েছে। কিন্তু আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও কারাবাসের কোনো খবর আমাদের জানা নেই। আমৃত্যু কারাদন্ড তো দূরের কথা। কিন্তু এবার হয়েছে। আদালতে প্রমাণিত হয়েছে কক্সবাজারের চকরিয়ায় পিকআপের চাপায় যে ছয় ভাইয়ের করুণ মৃত্যু হয়েছে তার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন পিকআপ চালক। যে কারণে তাকে আদালত কর্তৃক আমৃত্যু কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-তে বলা হয়েছে, বেপরোয়াভাবে বা অবহেলা করে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনায় কেউ গুরুতর আহত বা কারও মৃত্যু হলে চালককে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। তবে তদন্তে যদি দেখা যায়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চালক বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন, তাহলে দণ্ডবিধি ৩০২ অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে। অর্থাৎ সাজা হবে মৃত্যুদন্ড। তবে এটা তদন্তসাপেক্ষে এবং তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধারা নির্ধারণ করবে।
সোমবার দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় কক্সবাজারের চকরিয়ায় পিকআপ চাপায় ছয় ভাই নিহতের ঘটনায় হওয়া মামলায় পিকআপটির চালক সাইদুল ইসলামকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে তাকে এক লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। রবিবার দুপুরে আসামির উপস্থিতিতে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল এ রায় ঘোষণা করেন।
পিকআপ চাপায় ছয় ভাই নিহতের ঘটনাটি দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে রায় ঘোষণার সময় বিচারক বলেন, পিকআপ চালক প্রথমবার চাপা দেওয়ার পর দ্বিতীয়বার পেছন থেকে আহত ব্যক্তিদের চাপা দিয়ে ঘটনাস্থলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে। এজন্য চালক সাইদুলের মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কথা। কিন্তু চালকের বয়স (২২) বিবেচনায় নিয়ে তাকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো। সংবাদে আরও বলা হয়েছে, নিহত ছয় ভাইয়ের মা মৃণালিনী সুশীল তার ছেলেদের হত্যার নির্দেশদাতা কে বা কারা তা জানতে চান। এর মানে, বিষয়টি পরিষ্কার। তদন্তে অবশ্যই ইচ্ছাকৃত হত্যাকান্ড হিসেবে এটি প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু হত্যাকান্ডের শিকার ছয় ভাইয়ের মা’র কথা আরেক ধরনের রহস্যের উন্মোচন করেছে। তিনি আরও বলেছেন, যে পিকআপটি ওই ঘটনা ঘটিয়েছে, সেই পিকআপের নম্বর প্লেট ও লাইসেন্স নেই। সাইদুলের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। তারপরও কী করে গাড়িটি এমনভাবে রাস্তায় চলেছে তাও জানতে চাই। গাড়িতে চালকের পাশে বসে থাকা পিকআপ মালিকের ছেলে তারেকের সেদিনের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাই। আশা করি, উচ্চ আদালতে গেলে আমি আমার মনের ভেতর থাকা সব প্রশ্নের জবাব পাব।
চালকের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক থাকলেও, দন্ডপ্রাপ্ত চালকের কোনো লাইসেন্স নেই! এ ছাড়া পিকআপের মালিকের ছেলে গাড়িতে থাকা অবস্থায় ছয় ভাইকে গাড়ির চাকায় পিষ্ট করা হয়েছে। এখান থেকে আন্দাজ করা যায়, হয়তো কোনো বড় ধরনের ঝামেলা ছিল। যে কারণে এমন নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে। পিকআপ, বাস, ট্রাকসহ পরিবহন চালকদের মনে এমন ধারণা জন্ম নিয়েছে যে, দুর্ঘটনায় কোনো পাবলিকের মৃত্যু হলে, আমাদের তেমন কোনো সমস্যা নেই। সবকিছু ‘ম্যানেজ’ হয়ে যাবে। এইভাবে খুন করে, সড়ক দুর্ঘটনার নামে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টার প্রতি তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানাচ্ছি। আইনের প্রতি আমরা পুরোপুরি আস্থাশীল। এমন যুগান্তকারী রায়ের জন্য বিচারকের প্রতি শুভকামনা। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সবকিছু বিশ্লেষণ করেই এমন রায় দিয়েছেন। অবশ্যই এই রায় একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
১৯৬৯ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন ভাষাতত্ত্ববিদ, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তার জন্ম ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায়। হাওড়া জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ করে হুগলি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। অসুস্থতার কারণে বিরতির পর কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এমএ পাস করেন। দুই বছর পর বিএল ডিগ্রিও নেন। যশোর জিলা স্কুলের শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে শরৎচন্দ্র লাহিড়ী গবেষণা-সহকারী হিসেবে কাজ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ঘরোয়া পরিবেশে উর্দু, ফারসি ও আরবি এবং স্কুলে সংস্কৃত শিখেছিলেন। ইউরোপ গিয়ে শেখেন প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃত, প্রাকৃতসহ বিভিন্ন ভাষা। তিনি ‘চর্যাপদাবলি’ বিষয়ে গবেষণা করে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই ধ্বনিতত্ত্বের মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হন, ১৯৪৪ সালে অবসর নেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস নিযুক্ত হন। মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে তিনিই প্রমাণ করেন গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। তার কাজের মধ্যে অভিধান তৈরি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উর্দুকে বাদ দিয়ে তিনিই প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিক দাবি তোলেন। তার রচনার মধ্যে আছে, ‘সিন্দবাদ সওদাগরের গল্প’, ‘ভাষা ও সাহিত্য, ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’, ‘দীওয়ান-ই-হাফিজ’, ‘রুবাইয়াত-ই-উমর খইয়্যাম’, ‘পদ্মাবতী’, ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’ প্রভৃতি।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ আগস্ট ৯ বছরের শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। সপ্তাহ না যেতেই ২৫ আগস্ট মারা যায় আরাফাতের ছোট বোন ৬ বছরের রাইদা। রাজধানীর মধ্যপাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের একটি বাসায় দুই সন্তান আরাফাত ও রাইদাকে নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি। সন্তানদের মৃত্যুর পর জীবনটাই বদলে গেছে তাদের। তছনছ হয়ে গেছে সাজানো সংসার। ইব্রাহিম ও রাবেয়া দম্পতির মতো বহু পরিবার এবার সর্বস্বান্ত হয়েছে ডেঙ্গুজ¦রের থাবায়। সন্তান হারানো এমন বাবা-মায়েরা পাগলপ্রায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সী ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৮৬ এবং নারী ৯১ জন। এবার শুধু শহর নয়, গ্রামেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। সেখানেও মারা গেছে অনেক শিশু। এ বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই রোগে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ হাজার ৯১৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ২৩ হাজার ৬১৭ এবং পুরুষ ৪০ হাজার ৩০২ জন। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে শিশুদের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের যারা সুস্থ হয়ে উঠছে, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডেঙ্গুর বর্তমান সংক্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি শিশুদের নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার বিরূপ প্রভাব শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে। মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব থাকতে পারে। এতে তাদের মেধাবিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের যদি কিডনি কিংবা লিভারের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেই ভার সারা জীবন বহন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শিশুদের মৃত্যু নিয়ে ভালোভাবে অ্যানালাইসিস করতে পারছি না। এসব মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে অটোপসি করতে পারলে ভালো হতো। বিভিন্ন দেশে মৃত্যু নিয়ে ডেথ রিভিউ বা অটোপসি করা হয়। এটি করতে পারলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। কোনো শিশুর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, ১ মাস থেকে ১২ বছর বয়সী মুমূর্ষু শিশু রোগীদের পৃথক পিআইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। তবে দেশে পিআইসিইউ সংকট রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পিআইসিইউর জন্য স্বজনদের হাহাকার করতে দেখা গেছে। হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ শিশুকে সেবা দিতে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি, সেখানে শিশু রোগীও উল্লেখযোগ্য। এই দুটি হাসপাতালে একেকটি শয্যায় একাধিক শিশু রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। ৭০ থেকে ৮০ জনের সেবা পাওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে প্রতিদিন সেবা নিচ্ছে প্রায় ৩০০ শিশু। ঢামেক হাসপাতালের ২৫ শিশুকে একসঙ্গে পিআইসিইউতে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো পিআইসিইউ নেই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখানে শিশুদের ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পিআইসিইউ নেই, তবে এনআইসিইউ (নিউনেটাল আইসিইউ বা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আছে।
এদিকে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু শনাক্তে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা ইয়াসমীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিশুদের জ্বর আসার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হবে। এবার অনেকের মধ্যে হঠাৎ করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ফলে তারা দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসছে। দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে যেসব শিশু মারা গেছে, তারা বাড়ি থেকেই জটিলতা নিয়ে এসেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, শুধু প্লাটিলেট কমা আশঙ্কার নয়, রক্তচাপ কমে যাওয়া প্লাটিলেট কমার চেয়ে ভয়ের। তাই আমাদের শিশুদের রক্তচাপ নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে শর্ত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই শর্তের অন্যতম ইস্যু হচ্ছে, বিএনপিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমন ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। কিন্তু সরকারের সেই শর্তে রাজি নন খালেদা জিয়া। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো শর্তের বিনিময়ে তিনি মুক্তি চান না। ফলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সরকারের যে চেষ্টা, সেটা এ দফায় সফল হচ্ছে না বলে মনে করছেন আন্দোলনে থাকা নেতারা। তাদের মতে, সরকার ফাঁদ পাতলেও এতে পা না দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বেগম জিয়ার। বরং আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলতে চান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ লক্ষ্যে প্রায় অর্ধশত দল নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলনে রয়েছেন তারা।
শর্তের বিনিময়ে মুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে গত রবিবার রাতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল তিনি যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তাহলে বিএনপিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি থেকে উত্তর দেওয়ার আগেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়া বিদ্রোহ করে বলেছেন, তার জীবনে গণতন্ত্রের জন্য কোনো শর্ত নেই। ভোটের অধিকারের জন্য, এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো শর্ত নেই। কোনো শর্ত খালেদা জিয়ার নামের সঙ্গে যায় না এবং আমরাও তা মানি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়া ৫৪ দিন ধরে টানা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতই খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এ সময় বেশ কয়েকবার শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের দেওয়ার বক্তব্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সম্পাদক ও সদস্য খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সূত্রগুলো বলছে, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কথা প্রসঙ্গে এ ধরনের প্রসঙ্গেও ইঙ্গিত দিলে খালেদা জিয়ার শর্ত দিয়ে মুক্ত হতে চান না বলে পুনর্ব্যক্ত করেন। যদিও এর আগে শর্ত দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার বিষয়ে দল যাতে সম্মত না হয়, সে কথা নেতাদের আগেই বলে রেখেছিলেন একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ নেত্রী। কোনো অবস্থায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সমঝোতাও নয়Ñ এ ব্যাপারেও খালেদা জিয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেন। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এ আন্দোলনে উনার সমর্থন আছে। আমাদের একজন নেতা (ওই বৈঠকে) বলেছেন, সরকার একটা নির্বাচনের জাল বিছানোর চেষ্টা করছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, কোনো অবস্থায় এ সরকারের অধীনে নির্বাচনী ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।’
এর আগে ৮ মে রাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় সাক্ষাৎ শেষে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন, কেউ কেউ বলছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া তাদের বলেছেন, প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে আমি কোনো অনুমতি দেব না।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান করবে তারা। এজন্য চলমান এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুটি জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে চান তারা। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নিতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস।
গতকাল সোমবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৫ অক্টোবর বিএনপি ঘোষিত রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হবে। এর আগেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘দাবার ঘুঁটি হিসেবে খালেদা জিয়াকে ব্যবহারের চিন্তা তারা কীভাবে করে সেটাই বোধগম্য নয়। সরকারের এ ধরনের চিন্তা বা পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে না।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে বিএনপিপ্রধানের পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের ওপর গত রবিবার আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। যদি যেতে হয়, তাহলে সাজা স্থগিতের আদেশ বাতিল করতে হবে। কিন্তু সেটা করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি।
আবার গতকাল নিজ কার্যালয়ে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি কিংবা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। তবে তার আগে তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতি বা আপিল বিভাগের খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদন করবে না বলে দলীয় আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে বলা হয়েছে, তাকে “দেশে চিকিৎসা নিতে হবে”, তার বদলে “দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন” বলাই যথেষ্ট। এর বাইরে দলের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।’
এদিকে চিকিৎসক সূত্র জানা গেছে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। গতকাল তার আলট্রাসনোগ্রাম ও ইকো করা হয়েছে।
স্যাংশন নিয়ে ভয় না পাওয়ার বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার মেথডিস্ট সেন্ট্রাল হলে নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি পাল্টা স্যাংশন দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ইস্যু সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন, সাজাপ্রাপ্ত কাউকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় কোন দেশ?
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় বলতে পারেন? কোনো দেশে পাঠায়? তারা এটা দাবি করে। আমাদের কেউ কেউ আঁতেল আছে। তারা বলে, একটু কী সহানুভূতি দেখাতে পারেন না! সে এভারকেয়ার, বাংলাদেশের সবথেকে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়সতো আশির ওপর। মৃত্যুর সময় তো হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে লাভ নাই।
স্যাংশনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আপনাদেরও বলব, স্যাংশন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
তিনি জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রণীত আইনের অধীনে ধানমন্ডিতে যে বাড়ি পেয়েছিলেন শেখ রেহানা, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সে বাড়ি উচ্ছেদ করে। সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি করছে আর ‘লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে’ সেই পুলিশ ফাঁড়ি উদ্বোধন করেছে খালেদা জিয়া। ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর তাকে (শেখ হাসিনা) খালেদা জিয়ার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কীভাবে খালেদা জিয়ার জন্য আমার কাছ থেকে আরও সহানুভূতি আশা করে।’
লন্ডনের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্টমিনস্টারে তার সম্মানে আয়োজিত একটি কমিউনিটি সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলা বিএনপির পক্ষে শোভা পায় না কারণ তারা জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ধোকাবাজি খেলেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মধ্যেই দেশের জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ কখনই ভোট কারচুপিকারীদের ক্ষমতায় বসতে দেয় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রধান হিসেবে তার ওপর ন্যস্ত নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে এতিমদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড স্থগিত করার পর খালেদা জিয়াকে তিনি বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আইন অনুযায়ী যা করতে পারেন তাই করেছেন। অনেকেই এখন যুক্তি দিচ্ছেন, ‘আইন নিজের গতিতে চললেও খালেদা জিয়ার প্রতি আমি বেশি সহানুভূতি দেখাতে পারি’।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুক।
ফরিদপুরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুও। গত এক মাসে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৪৫ ডেঙ্গু রোগীর। আর গত এক সপ্তাহেই মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। চলতি বছর সব মিলিয়ে জেলাটিতে এ নিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ৬১ জন। জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে এবার ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১২ হাজার ৬৩২। এর আগে এক বছরে এত আক্রান্ত আর মৃত্যু দেখেনি জেলাটি। রোগীর চাপে বিভিন্ন হাসপাতালে দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট। ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছে হাসপাতালের বারান্দা ও সিঁড়িতে। তাতে ব্যাহত হচ্ছে অন্য রোগীদের চিকিৎসাসেবাও।
ডেঙ্গুতে জেলার এমন পরিস্থিতির জন্য সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে জেলা প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সব কার্যক্রম চলমান। সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিভিন্ন এলাকায় মশা নিধন কার্যক্রম চলছে। বিভিন্ন হাসপাতালে বিনামূল্যে স্যালাইন বিতরণ করা হচ্ছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের হিসাবে এ বছর জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ১২ হাজার ৬৩২ রোগী। বর্তমানে ফরিদপুরে ভর্তি হয়ে ৮২৪ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে সেবা নিচ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্তের সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মৃত্যুও। এদের অধিকাংশই নারী। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, গত এক মাসে এ জেলার হাসপাতালগুলোতে মৃত্যু হয়েছে ৪৫ জনের। এর মধ্যে ফরিদপুরের ৩১ এবং অন্যান্য জেলার ১৪ জন। আর এ বছর জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ৬১ জন। এর মধ্যে ফরিদপুরে ৪১ জন, বাকি ২০ জন রাজবাড়ী, মাগুরা, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের।
হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় শয্যা সংকটের পাশাপাশি তীব্র গরমে অনেকটাই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন সেবা নিতে আসা রোগী ও স্বজনরা। তবে ডেঙ্গু রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে দিন-রাত চেষ্টা করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সব স্কুল-কলেজ, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থানে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার আশা প্রকাশ করেন, শিগগিরই সবার সমন্বয়ে ডেঙ্গু মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
সিভিল সার্জন অফিস বলছে, বিভিন্ন হাসপাতালে দিন দিন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে জেলার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ২ হাজারের অধিক রোগী। ফলে রোগীদের চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এনামুল হক বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের চিকিৎসকসহ সব বিভাগের কর্মীরা দিন-রাত কাজ করছেন। তবে শুধু সেবা দিলেই চলবে না। এর প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শুধু ফরিদপুর নয়, এ অঞ্চলের ৫ থেকে ৬টি জেলার রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
ডেঙ্গু রোগীদের বিষয়ে জেলার সিভিল সার্জন ডা. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘গত এক মাসে এ জেলায় অতিরিক্ত ডেঙ্গু রোগীর চাপ লক্ষ করা গেছে। আমরা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জেলার সব হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে বলেছি। তিনি জানান, ফরিদপুরে এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১২ হাজার ৬৩২ ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছে ১১ হাজার ৭৪৭ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ৬১ জনের। গতকাল সোমবার জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল ৮২৪ জন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।