
সাহিত্যিক, শিল্প-সমালোচক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ১৯২০ সালের ২৬ মার্চ বর্তমান মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ আলী হামেদ ছিলেন একজন স্কুল ইন্সপেক্টর; মা সৈয়দা কামরুন্নেগার খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। সক্রিয়ভাবে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং কলা অনুষদের ডিন নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি ভারতে চলে যান এবং কলকাতায় অবস্থান করে যুদ্ধের পুরো ৯ মাস স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেন। তিনি ১৯৭২ সালে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। তিনি বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষ্য চূড়ান্তকরণ, জাতীয় সংগীতের ইংরেজি অনুবাদ করা, শিল্পকলা একাডেমির গঠনতন্ত্র প্রণয়ন, বাংলা একাডেমি ও বাংলা ডেভেলপমেন্ট বোর্ড একত্রীকরণের মতো অনেক জাতীয় কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। ১৯৮৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘নজরুল ইসলাম’, ‘ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘রবীন্দ্রনাথ : কাব্যবিচারের ভূমিকা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৭ সালে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’, ১৯৮৩ সালে ‘একুশে পদক’ এবং ১৯৮৭ সালে ‘স্বাধীনতা পদক’ লাভ করেন। ২০০২ সালের ২৫ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এত দিন বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার একটা হিসাব দিয়ে আসছিল। এখন থেকে দেবে তিনটা; একটি সনাতনী হিসাব পদ্ধতিতে করা, দ্বিতীয়টি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিধান মতে করা, আর তৃতীয়টি নিট, যেটি সাধারণ্যে প্রকাশ্য নয়। আইএমএফের কথা হলো, যে গরু গোয়ালে নেই, তার হিসাব কেতাবে অন্তর্ভুক্ত করে স্থিতির স্বাস্থ্যে স্ফীতি আনা চলবে না। ঋণদাতা সংস্থাটির ব্যবস্থাপত্র হলো রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ (ইডিএফ) অন্যান্য তহবিলে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্থানান্তরিত রয়েছে, অর্থাৎ যে পরিমাণ মুদ্রা চাহিবামাত্র লভ্য হবে না, তা স্থিতি থেকে বাদ দিয়ে হিসাব করতে হবে। এই পদ্ধতি অনুসরণে প্রতিষ্ঠানটি ৩০ জুন, ২০২৩ তারিখের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের তল-সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি ২৩.৫৬ বিলিয়ন ডলার, যদিও আমাদের আগের পদ্ধতি অনুসারে ওটার মজুদ ২৯.৯২ বিলিয়ন। প্রথমোক্ত দুটোই গ্রস হিসাব; রিজার্ভ সংশ্লিষ্ট বকেয়া দায় এবং বছরের মধ্যে পরিশোধযোগ্য ঋণের সুদাসল বাদ দেওয়া হলে নিট উপাত্ত পাওয়া যাবে, সেটা হয়তো আরও দুই তিন বিলিয়ন কম হতে পারে। কিন্তু গভর্নর বাহাদুরের কথা হলো যে, বিশ্বের কোনো দেশই নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করে না। কাজেই তিনিও সেটা করবেন না। ২০২১ সালে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে সেই মজুদের অবনমন ঘটে সেটা এখন হয়ে গেছে ২৩.৫৬ বিলিয়ন। অনেকেই আতঙ্কিত বোধ করছেন। অর্থনীতিবিদরা নানা রকম কথাবার্তা বলছেন। আমি খাদ্যশস্যের মতো স্পর্শকাতর পণ্যের মজুদ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছি, সেই আলোকে কিছু কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
খাদ্যনীতিতে ৩০ জুন তারিখে খাদ্যশস্যের অন্যূন ১০ লাখ মেট্রিক টন মজুদ নির্বাহ করার বাধ্যবাধকতা আছে। দেশের প্রধান ফসল বোরো কাটার ভরা মৌসুমে এই মজুদের আবশ্যকতা অনেকের কাছেই খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। তার ওপর ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অনুকূল আবহাওয়া ও সরকারের নীতি সহায়তায় খাদ্যশস্যের বাড়ন্ত ফলন থেকে জুন মাসে এই পরিমাণ মজুদ গড়া ছিল অত্যন্ত সহজ একটা কাজ। এর মধ্যে ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কায় ২৫ হাজার টন চাল রপ্তানিও করা হয়েছিল। তখন খাদ্যশস্য, বিশেষ করে চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে অতিক্রম করে ফেলেছিÑ এমন একটা উন্নাসিকতা আমাদের পেয়ে বসেছিল। এরপর ২০১৭ সালের মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কায় ৫০ হাজার টন চাল রপ্তানির প্রস্তাব আসে। কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তর থেকে মে-জুন মাসে সংগ্রহতব্য বোরো ফসলের সংগ্রহ সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ঐ সময় চাল রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া সমীচীন হবে না মর্মে জানানো হয়। এতে মন্ত্রণালয় তখন খাদ্য অধিদপ্তরের ওপর ভীষণ নাখোশ হয়। এপ্রিল মাসে সিলেটে অকাল বন্যার প্রভাবে ঐ বছর চালের দাম এত বেড়ে যায় যে, ৩০ জুন ত্রাণ খাতের মালামাল বিলি বণ্টনের পর চালের মজুদ দাঁড়ায় মাত্র ১,৩৫,০০০ টন; দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তা ছিল এক অশনি সংকেত। ঐ বছর শ্রীলঙ্কায় চাল রপ্তানি করা হলে তখন বিরোধী পক্ষ নিশ্চয়ই আমাদের কাণ্ডকারখানা চীনের এৎবধঃ খবধঢ় ঋড়ৎধিৎফ কালের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ পেত। চীনে তখন একদিকে খাদ্যশস্য রপ্তানি চলছিল, আবার অন্য দিকে খাদ্যাভাবে মানুষ মৃত্যুবরণ করছিল।
বৈদেশিক মুদ্রা হলো অন্য কোনো দেশ থেকে পণ্য ও সেবা ক্রয় করার জন্য ব্যবহৃত আর্থিক ক্ষমতার একটা একক। আর বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বলতে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রায় গচ্ছিত সম্পদের মজুদকে বোঝায়। দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা-রিজার্ভের অনুকূল প্রভাব নানামুখী। দেশের বাইরের দেনা-পাওনা পরিশোধ ও মুদ্রানীতি প্রভাবিত করতে এর ব্যবহার সর্বজনবিদিত। অর্থনীতির ঘাত-প্রতিরোধ ক্ষমতা ও নমনীয়তা বৃদ্ধি করতে এর ভূমিকা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। দেশীয় মুদ্রামানের অবাঞ্ছিত অবমূল্যায়ন ঘটলে এই মজুদ ব্যবহার করে বাজারের ঘাত-প্রতিরোধ করা হয়। যে কোনো সংকটে দ্রুত পণ্য ও সেবা আমদানিতে উদ্বৃত্ত বৈদেশিক মুদ্রার ভূমিকার কোনো তুলনা নেই; আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি বাগে আনা যায়। উচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের মনে আস্থা ও প্রণোদনা জোগায়। তাছাড়া, দেশের বিভিন্ন সেক্টরের অবকাঠামো উন্নয়নে এটা বিশেষ তহবিল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
কতটা বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দেশ ও অর্থনীতির জন্য নিরাপদ তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তবে এ বিষয়ে অঙ্গুষ্ঠ বিধি (Rule of thumb) হলো ৩ মাসের আমদানি বিলের সমপরিমাণ শক্ত মুদ্রা। তবে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে, সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি আস্থাশীল হয় যে, গৃহীত সময়োপযোগী সংস্কার কর্মকাণ্ডের ফলে অদূর ভবিষ্যতে টেকসই ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে, তবে ৩ মাসের অঙ্গুষ্ঠ বিধি কোনো অলঙ্ঘনীয় বাধা নয়। কঠিন সময়ে খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা মজুদ গড়তে গিয়ে আমরা এর সত্যতা পেয়েছি।
এখন মাসে গড়পড়তা ৫.৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে; বিগত মে মাসে যেটা ছিল ৬.৪৬ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাবে দেশের রিজার্ভ ৩ মাসের বিল পরিশোধের জন্য পর্যাপ্তই বলা চলে। কাজেই আপাতত শঙ্কার কোনো কারণ নেই; তবে সতর্ক হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হলো সাম্প্রতিককালে রিজার্ভ ক্ষয়ের হার; প্রতি মাসে গড়পড়তা এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মুদ্রা ভাণ্ডার থেকে বিযুক্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ডলারের খরচ কমাতে গিয়ে আমাদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। অথচ এদেশের রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কাঁচামাল, মধ্যবর্তী ও মূলধনী পণ্য আমদানি করতে হয়। ফলে সামনের দিকে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তৃতীয়ত, মুদ্রাপাচার রোধ করা এবং আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে বিদেশি মুদ্রা দেশে নিয়ে আসার কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। কাজেই, কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি না করা গেলে খাদের কিনারায় উপনীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বড় ক্ষয় শুরু হয় ২০২১-২২ অর্থবছরে; তখন মোট ৮৯.৩৩ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করতে হয়। বাণিজ্য লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দেয় ৩৩.২৪ বিলিয়ন ডলার এবং চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়ায় ১৮.৬৮ বিলিয়ন ডলার। এটাই বৈদেশিক ভাণ্ডারের ওপর বেশি চাপ তৈরি করে। বিগত অর্থবছরে অবশ্য এই ঘাটতির পরিমাণ কমে আসতে থাকলেও পরিস্থিতি উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট নয়। এর জন্য নানামুখী স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কার্যক্রম নেওয়া দরকার।
প্রথম কাজ হবে জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে রিজার্ভের হিসাবায়নে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা। গভর্নর বাহাদুরের নিট হিসাব প্রকাশ না করার দৃঢ় অঙ্গীকার আস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিপরীত ফল এনে দিতে পারে। যে পদ্ধতিতেই হিসাব করা হোক না কেন, মানুষ এখন আর বড় কোনো অঙ্ক বিশ্বাস করতে চাইবে না; গোপনে সংরক্ষিত ছোট নিট অঙ্কটি খুঁজে বের করতে চাইবে। কাজেই অতিরিক্ত খাটাখাটি না করে শুধু নিট স্থিতিটা প্রকাশ করলে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে।
দ্বিতীয়ত, অনাবশ্যক বিলাস পণ্যের আমদানি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তবে রপ্তানি যাতে ব্যাহত না হয়, তার জন্য কাঁচামাল ও সংশ্লিষ্ট অন্তর্বর্তী পণ্যের আমদানি কোনোক্রমেই ব্যাহত করা যাবে না। এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও নিখুঁত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে যখন দলে দলে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা দেশে প্রবেশ করছিল, তখন ঐ দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল খুবই তিক্ত। কিন্তু নৈকট্যের কারণে সেদেশ থেকে চাল আমদানি করা ছিল অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে সহজ, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তা ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী সিদ্ধান্তে সেখানে গিয়ে আমরা যে চুক্তি সম্পাদন করি, সেই চালই প্রথম দেশে প্রবেশ করে এবং আমরা তাতে প্রভূত স্বস্তি লাভ করি। এখানেও অনুরূপ গতিশীল ও উদ্ভাবনমূলক কাজ করা যেতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার হিসেবে আমদানির ক্ষেত্রে ওভার-ইনভয়েসিং এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং-এর কথা বারবার বলে আসছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও এই জাতীয় অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এখানে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নীতি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে কার্যকর করা হলে অবস্থারও দ্রুত উন্নতি হতে বাধ্য।
বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের সবচেয়ে প্রচলিত মাধ্যম হলো হুন্ডি। অর্থমন্ত্রী নিজেই একবার উল্লেখ করেছেন যে, যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে আসে, তার সমপরিমাণ মুদ্রার লেনদেন হয় অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে। এর মানে শুধু হুন্ডি প্রতিরোধ করে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা যায়। বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলারের বিপরীতে টাকার প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ করে অবৈধ হুন্ডি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব মর্মে অর্থনীতিবিদদের অভিমত। এটা করতে গড়িমসি কেন? একদিকে দুর্বিষহ মুদ্রাস্ফীতি, আরেক দিকে আমানতের সুদের হারে টুপি; পুঁজিবাজারের অবস্থাও টালমাটাল। এই প্রেক্ষাপটে অনেক রাঘব বোয়াল নাকি মূলধনী মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে ডলারের মজুদ গড়ে তুলেছেন। ত্রুটিপূর্ণ মুদ্রানীতিতে এটা বিচিত্র কিছু না।
অভিযোগ আছে যে ঋণখেলাপিরা ইচ্ছা করেই তাদের ঋণের একটা বড় অংশ প্রকল্পের বাইরে সরিয়ে নেন এবং সেটা সুযোগ-সুবিধা মতো বাইরে পাচার করে দেন। ফলে খেলাপি হয়ে প্রতিষ্ঠানে লালবাতি জ্বললে তাদের কোনো সমস্যা নেই। এদের নিয়ন্ত্রণ করা কি রাষ্ট্রের জন্য এতই কঠিন?
ঋণ প্রদানের সময় বেশি বেশি করে শর্ত আরোপ করায় অনেকেই আইএমএফকে গালমন্দ করে থাকেন। আইএমএফ সাধারণত অর্থনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে শর্তগুলো আরোপ করে থাকে, যেগুলোর অধিকাংশ হয়ে থাকে রাজনৈতিকভাবে অজনপ্রিয়। সরকার এইসব অজনপ্রিয় শর্তের বোঝা মাথায় নিয়ে ঋণ গ্রহণ করেছে, তাও আবার নির্বাচনের বছরে, এটা নিঃসন্দেহে একটি সাহসী কাজ। আশা করব সংস্কার বাস্তবায়নেও দলটি সমধিক সাহসিকতা ও আন্তরিকতা দেখাবে। লেখক: খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও কলামিস্ট
গত ৪ মে মণিপুরে নারীদের বস্ত্রহীন করে ঘোরানোর মতো বর্বরতা এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ম্যাকডাফের কথাগুলো বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ‘হে বিভীষিকা, বিভীষিকা, বিভীষিকা! না হৃদয় পারে তোমায় ধারণ করতে, না জিহ্বা পারে নাম নিতে!’ এতক্ষণে মণিপুরের পাহাড় থেকে আরও কঙ্কাল গড়িয়ে পড়েছে। প্রায় হাজারখানেক জনতার নেতৃত্বে থাকা বর্বররা তাদের ঘৃণ্য পাপের মূল্য একদিন নিশ্চয় দেবে আশা করি। কিন্তু পরিহাস, যখন সম্ভব ছিল কর্র্তৃপক্ষ তখন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখন কুম্ভীরাশ্রু ফেলছে এবং অহেতুক স্থূল আলাপ ও নোংরামি ছড়াচ্ছে। তারা কেবল নিষ্ক্রিয়তার জন্য দোষী নয়, নেপথ্যের উসকে দেওয়ার ভয়াবহতার জন্যও দায়ী। সুতরাং অপরাধীও বটে। কিন্তু তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে কে?
এটা বিশ্বাস করা অসম্ভব যে, গত সপ্তাহে ভিডিওটি সামনে আসার আগ পর্যন্ত মণিপুর রাজ্যের কর্র্তৃপক্ষের কেউ এই ভয়াবহতা সম্পর্কে জানত না। চিন্তা করুন, একটি সশস্ত্র গ্রুপ, প্রায় এক হাজার মানুষের একটি দল, রাজধানী ইম্ফল থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে গ্রামের পর গ্রাম, বাড়িঘর কুঁড়ে-ছাউনি সব জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অথচ শহর থেকে দূরত্ব হবে দিল্লির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের চেয়েও কম। যে এলাকায় নারীদের ঘোরানো হয়েছিল এবং তাণ্ডব চালানো হয়েছিল সেটি একটি চেকপোস্ট থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। বলতে গেলে দিল্লির ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’র এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের চেয়ে কম দূরত্বে। সরকারি লোকজন নীরব এবং নিষ্ক্রিয় থাকা ছাড়া কী করেছিল? গোয়েন্দারা কী করছিল? নিরো’র মতো বাঁশি বাজাচ্ছিল?
এখন জানা গেছে, নিগৃহীত নারী-পুরুষ পুলিশের সঙ্গেই ছিল এবং পুলিশের হাত থেকে বর্বররা তাদের নিয়ে যায়। তারা ছিল ২০২০ সালে স্বীকৃত ভারতের সেরা পুলিশ স্টেশন থেকে দুই কিলোমিটার অদূরে। আমরা কি বিশ্বাস করব যে, পুলিশও জানত না কী ঘটছে? যদি তারা জেনে থাকে, তবে কী করেছে তারা? তারা কি ‘ঊর্ধ্বতনদের’ খবর দিয়েছে? যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে ‘ঊর্ধ্বতনরা’ কী করেছে? আর যদি না হয়, তাহলে কেন দেয়নি? নাকি পুলিশ জড়িত? পুলিশ কি সমান দোষী নয়? আমরা কখনই জানব না।
ঘটনার দিন সরকারি নির্দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অপ্রীতিকর কিছু যদি না ঘটে থাকে তাহলে ইন্টারনেট বন্ধ করা হলো কেন? বোঝা গেল, সরকার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরেছিল এবং লৌহপ্রাচীর স্থাপন করতে চেয়েছিল। দিনের বেলা কী ঘটেছে যদি জানা যেত এবং বেআইনিভাবে নেটসংযোগ বন্ধ না থাকত, তাহলে ভিডিওটি নিশ্চয় সেদিন দেখা হয়ে যেত এবং কর্র্তৃপক্ষকে ভূমিকা নিতে বাধ্য করা যেত। নীরবতার পরিণামটি চিন্তা করুন মণিপুরে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ফেনিয়ে ওঠা পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধের আবহ তৈরি করেছে; যার ফলে প্রায় ১৫০ জন নিহত, ৩০০ জনেরও বেশি আহত এবং ৫০ হাজারেরও বেশি গৃহহীন হয়ে পড়েছে। আসলে নিন্দার কোনো ভাষা নেই, বেদনা ও যন্ত্রণা বোঝানোর কোনো শব্দ নেই।
নীরবতার ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। একদিকে ভিডিও বার্তাবাহককে গুলি করার চেষ্টা করা হয়, টুইটারকে আপত্তিকর ভিডিওটি নামিয়ে নিতে বলা হয় এবং আমরা জানি তারা নাকচ করার পর কী হবে। বরখা দত্ত নামে একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিককেও কর্র্তৃপক্ষ বেশ আপত্তিকর আদেশ দেয়। এই ভয়াবহ ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর, ১৮ মে কাংকোকপি জেলার পুলিশকে কেউ একজন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটনাটি জানাতে সাহস করে। পুলিশ অভিযোগের রেকর্ড রাখে ব্যস, আর কিছুই না।
অবশেষে, ১৮ মে নথিভুক্ত অভিযোগসহ এফআইআরটি ২১ জুন এক মাসেরও বেশি সময় পরে থৌবাল জেলার এখতিয়ারি থানায় পৌঁছায়। যাক নথিভুক্ত হয়েছে তো, এইটুকু করুণার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আপনার কি মনে আছে চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগীরদের এফআইআর হিসেবে অভিযোগ রেকর্ড করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের দুয়ারে কড়া নাড়তে হয়েছিল?
আইন বলে না যে, কোনো এফআইআর রেকর্ড হলেই পুলিশ রিপোর্টটি তদন্ত করতে বাধ্য। মানে রিপোর্ট হলেই নির্ভেজাল এবং নিরপেক্ষভাবে তদন্ত শুরু হয়ে যাচ্ছে না। সুতরাং, এফআইআর রেকর্ড হলো বটে, কিন্তু পুলিশ যেহেতু আইনত তদন্তে বাধ্য নয়, তাই থৌবাল জেলা-থানায় কেউ তদন্ত করার প্রয়োজনও মনে করেনি। ফলে পরিস্থিতি আপন গতিতে চলতে থাকে এবং প্রায় এক মাস পরে, ভয়াবহতার একটি ভিডিও প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত এফআইআরটি নিষ্ক্রিয় পড়ে থাকে।
পুলিশ এখন টারজানের মতো অ্যাকশনে নেমেছে এবং মুষ্টিমেয় অসভ্যদের গ্রেপ্তার করেছে। হয়তো পুলিশের প্রতি আস্থা না থাকায় অন্য নারীরা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে মূল অভিযুক্তের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে ‘বুলডোজার বিচার’ চলে, তা থেকে তারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকতে পারে। যদিও সেই নারীদের সঙ্গে বুলডোজার ছিল না। হতে পারে জাতীয় নিরাপত্তার কারণে বা সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে। সবকিছুই সম্ভব।
এরপর কী? সত্যাসত্য জানা অসম্ভব। সত্য কখনই বেরিয়ে আসবে না। দীক্ষা দ্বিবেদী নামের ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একজন প্র্যাকটিসিং আইনজীবী মণিপুরে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য জানতে চেয়েছিলেন। অনুমান করেন তো তারপর কী হয়েছে? তাকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং গ্রেপ্তার থামানোর আদেশ দিতে তাকে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করতে হয়েছে। আর এদিকে গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা কত তাড়াতাড়ি জামিন পাবেন তা কল্পনাও করতে পারবেন না। বিলকিস বানো মামলার ধর্ষক ও খুনিদের কথা মনে আছে?
লেখক : ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি।
দা ওয়্যার ডট ইন থেকে ভাষান্তর মনযূরুল হক
রাজনৈতিক বড় দুই শক্তির তোড়ে গণতন্ত্র, জনগণ, আন্দোলন ধরনের শব্দগুলো এখন একেবারেই আপেক্ষিক। তারা যে যা করেন সেটাই গণতন্ত্র। আবার এক দলের কাছে যেটি গণতন্ত্র, অন্যের কাছে সেটি স্বৈরতন্ত্র। একপক্ষের কাছে যা আন্দোলন, অন্যপক্ষের কাছে সেটি সন্ত্রাস-নৈরাজ্য। নিজস্ব সুবিধা মতো শব্দার্থ ও উদাহরণ বের করে নিতে পারছেন তারা। এক্ষেত্রে ব্যাকরণ-অভিধানও অসহায়। তাদের কাছে ‘জনগণ’ শব্দের অর্থও পাল্টে গেছে। জনগণ বলতে তারা নিজ দলের কর্মী-সমর্থকদের বোঝেন। কথিত এই জনগণকেও তারা এই বুঝে অভ্যস্ত করে নিয়েছেন। দল যা বলে তাই সমর্থন করে এই জনগণেরা।
গণতন্ত্র, গণদাবি, জনগণ ইত্যাদির দোহাই দিয়ে সব এস্তেমালের সুযোগ কেবল রাজনীতিতেই খাটে। সেইসঙ্গে সংবিধানের অজুহাত। ক্ষমতার রাজনীতিতে তা বেশি লাগসই-টেকসই। জনভোগান্তি যেন না হয়, সংবিধানের এ ধারা রক্ষায় কদিন আগেও বিরোধী দলের কর্মসূচির অনুমতি মেলেনি। এক পর্যায়ে ছুটির দিনে কর্মসূচির অনুমতি দিয়ে সংবিধান রক্ষা করা হয়েছে। বিরোধী দলের কর্মসূচিগুলো হয়েছে শুক্র-শনিবার। বন্ধের দিনের গণতন্ত্র এখন খোলার দিনেও চলে এসেছে। তাও আবার পাল্টাপাল্টি। বিরোধী দল সভা-সমাবেশ ডাকলে সেদিন সরকারি দলও ডাকছে। এটিও গণতন্ত্রের সৌন্দর্য-চমৎকারিত্ব। পুলিশের দিক থেকে অনুমতিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। জনদুর্ভোগের প্রশ্নও অবান্তর। লক্ষণীয় হচ্ছে, এ ব্যাপারে দুদলের মধ্যে বেশ মিলমিশ। রবিবার রাতে একটি টেলিভিশন টক শোতে কথা হচ্ছিল এ নিয়ে। জনদুর্ভোগ স্বীকার করে বিএনপি দলীয় আলোচক সাবেক এমপি হারুনুর রশীদ বলছিলেন, সৃষ্টির কিছু বেদনা থাকেই। তার কাছে সৃষ্টি মানে সরকারের পতন ঘটিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করা। আর আওয়ামী লীগ নেতা শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের যুক্তি- তারা এত এত উন্নয়ন করেছেন তা জানান দিতে সমাবেশ করা লাগছে। আর সমাবেশে উপচেপড়া মানুষ রাস্তায় চলে আসায় কিছুটা ভোগান্তি হচ্ছে। তা সহনীয়-বরণীয়।
জনদুর্ভোগ নিয়ে তাদের এমন যুক্তির সঙ্গে টক শোর অংশীজন হিসেবে আমি যোগ করলাম নির্বাচন একই দিনে হবে। দুদলের জন্য আলাদা দিনে নির্বাচন হবে না। সেই বিবেচনায় তারা একই দিনে সমাবেশকে জনগণের জন্য তেমন দুর্ভোগ না ভাবলে, সেই ভাবনার স্বাধীনতা তো তাদের আছেই। দেশের জনগণ তো তারা তারাই। বাদবাকিরা কি আর জনগণের আওতায় পড়েন? আমার কথা তাদের বেশ মনে ধরেছিল বলে তাৎক্ষণিক মনে হয়েছে। এটাই বাস্তবতা। দুর্ভোগ আর স্বস্তির অর্থও তারা ঠিক করে দেওয়ার হিম্মত রাখেন। পারেন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতেও। গণতন্ত্রের মূল কথাই হলো আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি মীমাংসায় আসা। যার যার প্রয়োজন বা চাহিদা দৃষ্টে তা তারা করে চলছেন। দাঙ্গা-হানাহানিকেও ‘আন্দোলন-কর্মসূচি’ নামকরণের অধিকার-ক্ষমতা সবই রাখেন। তারা যা করেন সবই শান্তি আর গণতন্ত্রের চর্চা। ক্ষমতা আয়ত্ত করতে জনতাও তাদেরই কব্জায়।
তাদের দফারফাও মিলে যায়। রকমফেরটা নিজেদের মতো। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা মানেই শান্তি-উন্নয়ন। আর বিএনপিরও ক্ষমতায় আসার নমুনা মানে গণতন্ত্র কায়েমের লক্ষণ। তা কারও পদযাত্রায়, কারও শান্তিযাত্রায়। আওয়ামী লীগ অবিরাম ক্ষমতা নিশ্চিত রাখতে চায়, বিএনপি সেই নিশ্চয়তা আর দিতে চায় না। তাদের এই চাওয়াই গণতন্ত্র। আর ভেতরের বেদনা অন্যরকম। বিএনপির চুন খেয়ে মুখ পুড়ে আছে। এ সরকার দই দিলেও তাদের কাছে চুনই মনে হবে। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগের শঙ্কা বিএনপি কোনোভাবে ক্ষমতায় চলে এলে তাদের কচুকাটা করবে। বিপদে পড়বে আওয়ামী লীগের জনগণ। তাই নিয়তির ওপরে সব ছেড়ে দেওয়ার অবস্থা নেই কারোরই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা ক্ষমতাহীন বিএনপি কোনোটিই আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামও নয়। ঘরদোর ছেড়ে চিল্লায় চলে যাওয়ার দল তাবলিগও নয়। দেশপ্রেম-দেশসেবাসহ তাত্ত্বিক নানা কথা বলা হলেও ক্ষমতাই তাদের কাছে মুখ্য। ক্ষমতা ছাড়া অন্য কিছু গুরুত্বহীন তাদের কাছে। ক্ষমতামুখী দলের ধর্মই হচ্ছে, মসনদে থাকলে একমাত্র চিন্তা টিকে থাকা এবং তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। আর ক্ষমতাহীন থাকলে ক্ষমতাসীনকে হটিয়ে গদিনশীন হওয়া। সেইক্ষেত্রে টানা সোয়া এক যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি কিছুদিন আগে আর রাখঢাক না রেখে এক দফার কথা জানিয়ে দিয়েছে। আর সেই দফাটি হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের হটানো। যার আরেক অর্থ নিজে ক্ষমতাসীন হওয়া। সেই ক্ষমতাটাও কার্যকরভাবে জনতানির্ভর হলে আশা থাকে। আর জনতানির্ভরতার অর্থ নির্বাচন। ২০১৪ বা ১৮ স্টাইলের নির্বাচন না হলে ক্ষমতার গ্যারান্টি পাচ্ছে না আওয়ামী লীগ। আবার ২০১৪-১৮’র মতো নির্বাচন ঠেকাতে না পারলে সেই গ্যারান্টি থাকে না বিএনপির। মূল সমস্যা সেখানেই।
বিএনপি নিজেরা মনে করে এবং জনগণকেও মনে করাতে চায়, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ দশটির বেশি সিট পাবে না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ক’দিন বেশি বেশি করে বলছেন, এ ভয়েই আওয়ামী লীগ নির্বাচন দেবে না। এর জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলে যাচ্ছেন, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে শেখ হাসিনাকে আবারও ভোট দিয়ে ক্ষমতায় রাখতে। বড় ইন্টারেস্টিং দুদলের এমন অঙ্কশাস্ত্র। উভয়েরই দাবি কেবল তারাই দেশপ্রেমিক। আর অন্যরা দেশ ধ্বংসকারী। যার যার দলীয় জনতাও এমনই ভাবে। ভাবাতেও চায়। নিজস্ব যুক্তি-শক্তিতে তারা বড় কড়া। সংখ্যায় তাদের দফারও বেশ মিল। সরকারের পতন বনাম সরকারের থেকে যাওয়ার এক দফার মধ্যে ডেঙ্গু মহামারী বা নিত্যপণ্যের দরদাম নিয়ে কারোরই দফা নেই। এ প্রশ্নে বেশ মিল তাদের। গণমাধ্যমের নিউজ ভ্যালুতেও ডেঙ্গুতে হালি-হালি মৃত্যুর চেয়েও দুদলের বড় নেতাদের বক্তব্যের ওজন বেশি। ক্ষমতার এ দাপটের কাছে জনতা কী চায়, সেটা মোটেই মুখ্য নয়। জনতার ক্ষমতার প্রতি তাই আস্থা না থাকলেও চলে। চলছে। তাদের দুর্ভোগ বিবেচনার বিষয়ই নয়। পুলিশের কাছেও জনদুর্ভোগ এখন আর সাবজেক্ট-অবজেক্ট নয়। রাজধানী কেন, গোটা দেশ স্থবির হয়ে গেলেও জনতার দুর্ভোগ ‘জনদুর্ভোগ’ শব্দটি গত ক’দিন যেন তাদের অভিধান থেকে উঠে গেছে। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণকে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা জানানো হয় নিজেদের সুবিধা মতো। গণতন্ত্রের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘জনতার ক্ষমতা’, ‘নাগরিক শাসন’, ‘জনগণের শক্তি’র কথাও শোনানো হয়। গণতন্ত্রকে এই মডেলে নিয়ে আসার কৃতিত্বে কে বেশি আগোয়ান, তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। তবে, কেউ যে কারও চেয়ে কম নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরের অনেকে গণতন্ত্র ও আন্দোলনের এ মডেলের নাটাই হারিয়ে এখন নিজেরাই ঘুড়ির পাকে পড়ে গেছেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নাটাই চলে গেছে বিদেশে। জনতার ক্ষমতাকে অবিরাম উপেক্ষা করার এ ফল তাদের এখন কেবল খেতেই হচ্ছে না, হজমও করতে হচ্ছে। যার এক চিলতে সম্প্রতি দেখতে হয়েছে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে। টেনেটুনেও ভোটার খরা আড়াল করা যায়নি। ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন ভোটারের মধ্যে ৩৭ হাজার ৩৭ জন ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনের এ আচানক শো প্রদর্শন হলো দেশের কূটনৈতিক পাড়ায়। দেশের নামিদামি এ নির্বাচনী এলাকার প্রায় ৮৯ শতাংশ ভোটার ভোটই দেননি। মোট ভোটের ৮ শতাংশে (২৮ হাজার ৮১৬ ভোটে) জিতেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী। আলোচিত হিরো আলম পাঁচ হাজার ৬০৯ ভোট। আর বোনাস হিসেবে বাংলা মাইর। ঢাকার বিদেশি কূটনীতিক এবং সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলও দেখলেন-জানলেন। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য অংশীদারত্বমূলক নির্বাচনের জন্য বিদেশিরা যখন বাংলাদেশের ওপর অবিরাম চাপ বাড়াচ্ছেন তখন যেনতেন এক প্রার্থীকেও সহ্য করতে না পারা এবং তার ওপর ন্যক্কারজনক হামলার মধ্য দিয়ে জনতার ভ্যালু স্পষ্ট। ক্ষমতাসীন দলের নিজস্ব জনতারাই বা সেদিন গেলেন কোথায়? জনতার এই মন-মননকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ক্ষমতাকে টপ প্রায়োরিটি দিয়ে জনতাকে উচ্ছিষ্টের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার লাগামে দেশি-বিদেশি যেই টানই পড়ুক, চমৎকার ভেবে এতে অমত কার? বলার একটুও অপেক্ষা রাখে না যে, এ সুযোগটাই দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাচ্ছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। তাদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার মানার ছবক দেওয়া এত সহজ নয়, যত সহজে নানান কিছু বোঝানো যায় জনতাকে। এই জনতাকে অন্ধকারে রেখে ক্ষমতা নিষ্কণ্টক রাখায় সক্ষমতা আর বিদেশি পেশাদার কূটনীতিকদের বুঝ দেওয়া এক বিষয় নয়। সামনে বা আড়ালে এর ফয়সালা না হলে সূচি আর কর্মসূচি যতই চলুক, সামনে ভিন্ন কোনো দৃশ্যপট রোখা অসাধ্য হয়ে উঠতে পারে। তা বুঝতে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়া জরুরি নয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা রোগ হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার মধ্যে আটকে আছে। এর মূলে হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্যজ্ঞানের স্বল্পতা। প্রাথমিক কিছু স্বাস্থ্যবিষয়ক জ্ঞান ও ন্যূনতম সচেতনতা জীবনযাপনকে এমনভাবে পরিচালিত করতে পারে যা অনেক ধরনের স্বাস্থ্যগত জটিলতা থেকে মুক্তি এনে দিতে পারে। আর এটা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সচেতন হিসেবে গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই শুরু করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুলজীবনে প্রতি পাঁচজনে একজন শিক্ষার্থী কোনো না কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যজ্ঞানের পরিধি প্রায় শূন্য।
দেশের প্রত্যন্ত এলাকার কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা পেতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কিশোর-কিশোরীদের ওপর চালানো একটি জরিপে এ চিত্র পাওয়া গেছে। গত জুন মাসে স্বাস্থ্যকর্মীদের উপস্থিতিতে এ জরিপ চালায় দেশ রূপান্তর। জরিপে স্বাস্থ্যবিষয়ক অধিকাংশ প্রশ্নের ভুল উত্তর দিয়েছে তারা। এমনকি, কেউ কেউ এইচআইভিকে একটি সফটওয়্যার বলে উল্লেখ করেছে।
কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যবিষয়ক জ্ঞানদান ও সচেতনতায় সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ থাকলেও মাঠপর্যায়ের এই জরিপে সেগুলোর কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যজ্ঞান তৈরির জন্য কমিউনিটি হাসপাতাল থেকে কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্যোগ থাকার কথা। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও আছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এই নির্দেশনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাগজে রয়ে গেছে। দেশ রূপান্তরের ওই জরিপে দেখা যায়, বিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বইয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য দেওয়া থাকলেও কিশোর-কিশোরীরা এগুলো সম্পর্কে বলতে পারে না। কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন দৈহিক পরিবর্তন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহার, কিশোরী মাতৃত্বের কুফলসহ অন্যান্য বিষয়ে কাউন্সেলিং না পাওয়ায় স্বাস্থ্যবিষয়ক জ্ঞান নিয়ে সঠিক ধারণা তাদের মধ্যে নেই। দেখা গেছে, শ্রেণিকক্ষে এসব বিষয়ে ঠিকমতো পাঠদান করা হয় না। এগুলো পড়ানোর জন্য আলাদা এবং উপযুক্ত শিক্ষক নেই। ফলে যে উদ্দেশ্যে পাঠ্যবইয়ে এগুলো সংযোজিত হয়েছে, তা ব্যর্থ হচ্ছে। এ বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের সরাসরি জানাতে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিদ্যালয়গুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত এসব কার্যক্রম পরিচালনা করছেন না। ফলে স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে কিশোরীরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে সারা দেশে একটি কর্মসূচি চালু হয়েছিল। বিদ্যালয়ে কৃমি নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে জোরদার করার লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া এই ক্ষুদে ডাক্তার কর্মসূচিটি খুবই ফলপ্রসূ হবে বলে মত দিয়েছিলেন অনেকে। এটি শিশুদের স্বাস্থ্য সচেতন করে। পাশাপাশি রোগজীবাণু সম্পর্কে ধারণা ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা হাতে-কলমে শিক্ষা দেয় শিক্ষার্থীদের। ক্ষুদে ডাক্তাররা স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত জ্ঞান নিজেরা যেমন পায়, তেমনি তা ছড়িয়ে দেয়। কার্যক্রমটিতে জোর দেওয়া প্রয়োজন।
বিদ্যালয়ের স্কুল ক্লিনিক করা যেতে পারে। স্কুল ক্লিনিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের আচরণ তৈরি করে দেয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে সব শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর বিধান রয়েছে, তবে সেটি তেমন মানা হয় না। স্কুলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। সিনিয়র অভিজ্ঞ স্কুল নার্স ও স্টাফ নিয়োগ দেওয়া তেমন কঠিন ও জটিল কিছু নয়। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অংশগ্রহণে প্রতি মাসে একবার বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষামূলক অধিবেশনের আয়োজন করা দরকার। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি স্বাস্থ্য ডায়েরি থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। আর সুস্থ নাগরিক দেশের সম্পদ। ফলে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে ‘বিদ্যালয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে’ এখনই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
ব্যাংকপাড়াখ্যাত মতিঝিল এখন মৃতপ্রায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যত্র সরে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা ঘোরানো মতিঝিলে আবাসিক ভবন, শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান তৈরি না হলে দেশের প্রধান এই বাণিজ্যিক অঞ্চল প্রাণ হারাবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তাদের মতে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় অবদান রয়েছে মতিঝিলের টাকার। শুধু তা-ই নয়, মতিঝিলে উপার্জিত অর্থে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডাসহ আরও অনেক দেশে। এখানকার উপার্জিত টাকা অনেকে জমা রেখেছেন সুইস ব্যাংকেও। শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি মতিঝিলে। এ যেন মা কাঁকড়ার আত্মত্যাগের গল্প। মা কাঁকড়া বাচ্চাদের আগলে রাখে বুকের ভেতর; যেদিন বাচ্চাগুলো বের হয়ে আসে, সেদিন খোলস ছাড়া মা কাঁকড়ার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। মা কাঁকড়ার মতো দুঃখী ও ত্যাগী বাণিজ্যিক মতিঝিল।
ষাটের দশকে মতিঝিলে গড়ে ওঠে দেশের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল (সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট-সিবিডি)। সেই থেকে এখনো দেশের প্রধান বাণিজ্যিক অঞ্চল মতিঝিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। এর মধ্যে সরকারি ৮টি, বেসরকারি ৪৫টি এবং বিদেশি ব্যাংক রয়েছে ৮টি। এ ছাড়া ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ৮১টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের বেশির প্রধান কার্যালয় চলে গেছে কারওয়ান বাজার, গুলশান-বনানী ও উত্তরায়। নতুন করে যেসব ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাচ্ছে, সেগুলোর প্রধান কার্যালয় মতিঝিলের বাইরে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মতিঝিলের আশপাশে পরিকল্পিত কোনো আবাসিক এলাকা, অভিজাত হোটেল, কাজের ফাঁকে অবসর কাটানোর মতো উন্মুক্ত স্থান, শপিং কমপ্লেক্স না থাকায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের সুবিধার জন্য অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয়গুলোও মতিঝিলের বাইরের এলাকা, অর্থাৎ কারওয়ান বাজার, গুলশান অ্যাভিনিউ, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে গড়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, মধুমিতা সিনেমা হল এবং ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে এবং দিলকুশা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবন এবং বঙ্গভবনের পাশের এলাকাজুড়ে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল। বিশ্বের বাণিজ্যিক অঞ্চলের ভবনগুলো সুউচ্চ হয়ে থাকে। কিন্তু মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের পাশেই বঙ্গভবন। নিরাপত্তার কারণে বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর কোনো বহুতল ভবন করতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, মতিঝিলের প্লটগুলোর ‘নন-রেসট্রিকটেড’ উচ্চতা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর সাড়ে চারতলার বেশি উচ্চতার ভবনের অনুমোদন মেলে না। ফলে মূল্যবান ওই প্লটগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন না মালিকরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ জরাজীর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণও রয়েছে কয়েকটি ভবন। একটির সঙ্গে অন্যটি লাগানো। দুটি ভবনের মাঝখানে উন্মুক্ত জায়গা নেই বেশিরভাগ ভবনের। দিলকুশা এলাকার বঙ্গভবন লাগানো ভবনগুলোর মাঝখানেও কোনো ফাঁকা জায়গা দেখা যায় না।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, মতিঝিল এলাকার ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে। ভাঙাচোরা এবড়োখেবড়ো সড়ক। সড়ক বিভাজকগুলো শ্রীহীন। এগুলোতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হয়নি। প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরে গেলে মতিঝিলের আরও করুণ দশা চোখে পড়ে। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকার সড়কের ফুটপাতে গড়ে উঠেছে চটের ছালা দিয়ে ঘেরা খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান এবং নানা পণ্যের অস্থায়ী দোকান। সামান্য বৃষ্টিতে মতিঝিল এলাকার সড়কগুলো তলিয়ে থাকে পানির নিচে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। ডিএসসিসি এলাকার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে। খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে মূল্যায়ন করলে মতিঝিল ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। যদিও এটা মানতে নারাজ ডিএসসিসির কারিগরি কমিটি।
মতিঝিল এলাকার বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিল এলাকার সংস্কার ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে ডিএসসিসি। পরিত্যক্ত প্রায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মতিঝিলের সড়ক, নর্দমা, ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকের অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা দরকার। পর্যায়ক্রমে এ এলাকার বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কাজ করবে ডিএসসিসি। তবে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের মূল সংস্কার ও আধুনিকায়নের দায়িত্ব রাজউকের। রাজউককে সেসব বিষয় পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কাজে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা লাগলে করপোরেশন সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে তোলে রাজউক। রাজউক সূত্রে জানা যায়, ষাটের দশক থেকেই মতিঝিলের পুরোপুরি বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যিক অঞ্চলে শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান থাকে। আর কাছাকাছি এলাকায় পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা থাকে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে সেটা ছিল না। অভিজাত মানের হোটেল পূর্বাণী গড়ে উঠলেও আশপাশে সময় কাটানোর মতো ব্যবস্থা নেই। সে কারণে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা লোকজন গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় থাকেন। মতিঝিলের সৌন্দর্য নিশ্চিত করতে ও আধুনিকায়নে যেসব বিষয়ে দৃষ্টি রাখা দরকার ছিল রাজউক ও সিটি করপোরেশন সেটা করেনি।
রাজউক সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধরা, উত্তরা। সেই সব এলাকা থেকে মানুষ মতিঝিলে আসেন। শহরের জনসংখ্যা বাড়ায় দিন দিন যানজট বাড়ছে। ওই সব এলাকা থেকে মতিঝিলে আসতে সড়কে এক থেকে দেড় ঘণ্টা চলে যায়। দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার মধ্যে ৩০ শতাংশ সময় সড়কে নষ্ট হচ্ছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে চিন্তা করেছে, তার কর্মস্থল এমন একটা জায়গায় হবে যা তার আবাসনের কাছাকাছি। মতিঝিল থেকে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও ভূমিকা রেখেছে।
কালের বিবর্তনে গুলশান হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক এলাকা। কারওয়ান বাজার, উত্তরায়ও গেছে কিছু। এসব জায়গায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও সেখানে চলে গেছে। এসব এলাকার আশপাশে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় তাদের বসবাস। আবাসিক এলাকা ছাড়া, পৃথিবীর কোথাও শতভাগ জায়গা শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা অথবা একই শ্রেণির কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহার হয় না।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মুখপাত্র মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, নগর পরিকল্পনায় ভূমির ব্যবহার সম্পর্কে বলা হয়, যেকোনো জায়গার ব্যবহার হবে ২৪ ঘণ্টা। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল কর্মচঞ্চল থাকে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এরপর ওই জায়গার ব্যবহার হয় না। রাতে নীরব ও ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়।
তিনি বলেন, যে মতিঝিলে দিনের বেলায় হাঁটা যায় না; গাড়ির কারণে, যানজটে; সেই মতিঝিলে রাত ৮টার পরে আবার একাও হাঁটা যায় না; অনিরাপদ বোধ হয়। এ জন্য যারা দিনে বাণিজ্য করতে আসেন, তারা মতিঝিল এলাকার হোটেলগুলোতে থাকেন না। অন্যদিকে গুলশান-বনানী এলাকায় থাকলে তারা শপিংয়ে যেতে পারেন, কফি শপে যেতে পারেন। এসব কারণে সারা বিশ্বে ভূমির মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, মতিঝিল এলাকা যেহেতু ইতিমধ্যে তার আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছে, এ জন্য মতিঝিলের জমির শ্রেণিকে মিশ্র ব্যবহার হিসেবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি নিয়েছে রাজউক। সংশোধিত ড্যাপে সে বিষয়ে নির্দেশনা রাখা হয়েছে। পৃথিবীর নগর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৫০, ৬০ বা ১০০ বছর অন্তর সেসব ঢেলে সাজানো হয়। সেটা বিবেচনায় নিয়েই মতিঝিল এলাকাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে আবাসিকের বৈশিষ্ট্য দিতে হবে; কনডোমিনিয়াম গড়ে তুলতে হবে। ইতিমধ্যে রাজউক বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে ১৬ একর জায়গা নিয়ে একটি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে লাইব্রেরি, ওয়াকওয়ে থাকবে। বসার ব্যবস্থা থাকবে। মতিঝিল এলাকায় ঝিল ছিল, ওই ঝিলকে প্রাধান্য দিয়ে পার্কটি তৈরি করা হবে। বহুমুখী ব্যবহার ছাড়া মতিঝিলকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিলের আধুনিকায়ন ও ভূমির মিশ্র ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাহলে মতিঝিল সচল থাকবে; তবে ঢাকা শহর বড় হওয়ায় আরও বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে ওঠা ইতিবাচক। এসব পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা দরকার ছিল; কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। এটা দুঃখজনক। এ জন্য শহরে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ঢাকায় এখন অনেকগুলো বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই সব অঞ্চলে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত বড় বড় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় মতিঝিলে রয়েছে। তবে ব্যবসা গুলশান, বনানী, উত্তরা, গাজীপুরে সরে যাওয়ায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ব্যবসা কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির অঙ্ক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখী করতে পারলে নির্বাচন বিতর্ক সামাল দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেওয়া নানা পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এ ছাড়া জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নির্বাচন নিয়ে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগ এ তিন পরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সফর করে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিগত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে দেশ-বিদেশে বেশ বিপাকে ফেলেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সরকারি দল। সেজন্য আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নামতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরেই কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে এ সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে ভোটের পরে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চক্রান্ত বিএনপির রয়েছে, সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করার অন্যতম কারণ হলো এটি।
সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ৫০-৪০ শতাংশ ভোট কাস্টিং করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তা সম্ভব হলেই ভোট বিতর্ক এড়ানো যাবে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পরে সব নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ফোরামে আলোচনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে কম ভোটার উপস্থিতির উদাহরণ। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা ধরে নিয়েই তিন পরিকল্পনায় সফল হতে পারবেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন পর্যন্ত জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য বেঁধে রাখা পারলেই নির্বাচন পর্যন্ত আর সমস্যাগুলো বড় বাধা হয়ে আসবে না সরকারের সামনে। বাকিটা হলো ভোটের দিন লক্ষ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ঘটানো।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তেমন আধুনিক উদ্যোগ নেই। কম ভোট উপস্থিতির এটিও একটি কারণ। প্রত্যেক ভোটারকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে হবে এমনকি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, সেটি ইসিকে ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও কেন্দ্রে ভোটার আনতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। এ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কী কী উপায় নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, স্বল্প সময়ে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো আগামী নির্বাচনে করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের কর্মব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পেলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেয়ে পরিবারকে একটু সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বের মনে করেন ভোটাররা।’ ভোট দেওয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি দল নির্বাচনে না যাওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করে না ভোটাররা। ফলে নির্বাচন বর্জন করা দলের ভোটাররা কেন্দ্রে যান না এবং দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন এ ভেবে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যান না। গত নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়ার বড় কারণ এগুলো। তবে আগামী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা। জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের হিসাবে মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশই তাদের ভোটার। এবার দলীয় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোটার কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ সফল হলে ভোট নিয়ে সব প্রশ্নই দূর করতে পারবে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে কম ভোটার উপস্থিতিও অন্যতম। তারা চান না এবার সেই প্রশ্ন উঠুক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার বড় বড় কাজ করছে ঠিকই, ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ জনগণের একটি অংশ সরকারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, এমনটাই মনে করছেন তারা। তাই ভোটের আগে বাকি সময়ে ছোট বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তা পূরণ করা হলে সাধারণ জনগণের ওই অংশটি আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে। সংসার জীবনের কশাঘাতে পড়ে সরকারের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ওই শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সংসার সামলাতে যে বিষয়গুলো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সেগুলোকে নির্বাচন পর্যন্ত কড়া মনিটরিংয়ে রেখে সামাল দেওয়া সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত অংশের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। আর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস।
জনআকাক্সক্ষা পূরণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বারবার একই চেহারা দেখছেন এলাকার মানুষ। অন্যদিকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধি। তাতে মানুষ বিরক্ত হন। এলাকার ভোটাররা মনে করেন, একজনকে কতবার ভোট দেব? এটি হলো জনআকাক্সক্ষা। এ জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগবে। রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন লোকজনও আগ্রহী হবেন। নতুন প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে ভোটাররা আসবেন।
এদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এ বিষয়টি বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে এটা এখন বিএনপিও বিশ্বাস করে। দলটি ভাবছে, আন্দোলন জমছে না, নির্বাচনও ঠেকানো যাবে না। আর সেটাই তাদের বিপাকের কারণ।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।